পটললাল, চলচ্চিত্র ও লেখক
০১. প্রস্তাবনা
বৎসরান্তে লেখক অন্তত একবার শ্রীযুক্ত পটললালের খোঁজখবর করেন। এমনিতে পটললালের সঙ্গে লেখকের যে খুব একটা সাক্ষাৎ পরিচয় আছে, তা নয়।
তবে পটললাল করিৎকর্মা লোক। অনেক রকম ব্যাপারের মধ্য দিয়ে তার যাতায়াত। নতুন কোনও বিচিত্র ঘটনা থাকলে, এর-ওর কাছ থেকে শুনে পটললালকে নিয়ে একটি গল্প পুজোর সময় লেখককে লিখতে হয়। এটা এখন বাঁধা ব্যাপার হয়ে গেছে।
কোনও কোনও বছর গল্প সংগ্রহ করতে বেশ কষ্ট করতে হয়। এ বছর কিন্তু খুব একটা চেষ্টা বা পরিশ্রম করতে হল না পটললাল কাহিনি সংগ্রহ করতে। গল্পটা লেখকের কাছে পায়ে হেঁটে চলে এসেছে। আসলে হয়েছে কী পটললালের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে লেখকের।
এতে ভাল হয়েছে কি খারাপ হয়েছে, এরপর পটললালের গল্পগুলো আর জমবে কি না বলা কঠিন। সত্য ঘটনা অবলম্বনে, আর যাই হোক, গল্প হয় না। ঘটনার সঙ্গে কল্পনার মিশেল না দিলে গল্প দাঁড়ায় না।
দেখি কী হয়?
০২. পূর্বকথা
বহুকাল আগে, সে প্রায় পঞ্চাশ বছর, উনিশশো একান্ন সাল সেটা, লেখক পূর্ববঙ্গ অধুনা বাংলাদেশের এক ছোট শহরের হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে কলকাতায় আসেন।
এই স্কুলে লেখকের সহপাঠী ছিলেন ব্রজদুলাল সাহা। পাটের আড়তদার এবং বিখ্যাত গুড় ব্যবসায়ী নবদুলাল সাহার জ্যেষ্ঠ পুত্র ব্রজ।
ব্রজ আর লেখক একই সঙ্গে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন, দুঃখের বিষয় লেখক কষ্টেসৃষ্টে, কোনওমতে পাশ করলেও ব্রজ পাশ করতে পারেনি। এরপরেও আরও দু-তিনবার পরীক্ষায় বসে। তবে শেষ পর্যন্ত ব্রজদুলাল পাশ করতে পেরেছিল কি না সেটা লেখকের মনে পড়ছে না।
ব্রজ পূর্ব পাকিস্তানেই ব্যবসাপাতি নিয়ে থেকে যায়। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়ও ব্রজ মাটি আঁকড়িয়ে পড়ে থাকে, সহস্র বিপদের ঝুঁকি নিয়ে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে নিতান্ত প্রাণরক্ষার তাগিদে ব্রজগোপালকে ধর্মান্তরিত হতে হয়। তখন তার নতুন নাম হয় বেজু মিঞা।
ব্রজগোপাল সাহা ওরফে বেজু মিঞা স্বাধীনতার স্বাদ অবশ্য বেশিদিন উপভোগ করতে পারেননি। যুদ্ধকালীন প্রচণ্ড উত্তেজনা এবং দুর্ভাবনা তাঁর প্রাণশক্তি ফুরিয়ে দিয়েছিল, দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকমাস পরেই তিনি মারা যান।
মৃত্যুর সময়ে ব্রজগোপালের বয়েস হয়েছিল বড়জোর চল্লিশ। মৃত্যুকালে ব্রজগোপাল স্ত্রী ও দুটি ছেলে রেখে যান। একটি মেয়েও ছিল, একাত্তর সালের আগেই সতেরো বছর বয়েসি মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়েকে আর পিত্রালয়ে থাকতে দেওয়া হয়নি, কারণ তার বাপ ধর্মান্তরিত হয়েছিল।
বাবার মৃত্যুর সময়ে ব্রজগোপালের জ্যেষ্ঠ পুত্র মণিগোপালের বয়স কুড়ি বছর। সামাজিক প্রথা মেনে ওই বয়েসেই তারও বিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
তা, মণিগোপালও বাংলাদেশে থেকে গিয়েছিল। তবে বাবার মৃত্যুর পরে সে খুব বেশিদিন পারিবারিক ব্যবসা করেনি। পাটের ব্যবসায় এমনিতেই মন্দ যাচ্ছিল, গুড়ের আড়ত মোটামুটি চলছিল। সে দুটোকেই তুলে দেয়, ঢাকায় বসবাস করতে শুরু করে এবং সেখানেই নতুন ব্যবসা আরম্ভ করে।
খুবই গোলমেলে ব্যবসা।
বাইরে একটা লোকদেখানো পাইকারি ব্যবসার গদি থাকলেও মণিগোপালের মূল ব্যবসা হুন্ডি হাওলা এবং চোরাচালানের। ক্রমশ মণিগোপাল প্রচুর অর্থ উপার্জন করে এবং সিনেমার লাইনে চলে যায়।
সিনেমার লাইন মানে মণিগোপাল চলচ্চিত্র ব্যবসায় টাকা ঢালতে থাকে এবং সে একাধারে প্রযোজক এবং পরিচালক হিসেবে কাজ করতে থাকে। অচিরে ঢাকার সিনেমা মহলে সে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
চলচ্চিত্রের কাজ করার সময় তাকে অনবরত কলকাতায় যাতায়াত করতে হয়। অবশ্য তাতে তার কোনও অসুবিধে হয়নি। যেকোনও সফল দু নম্বরি ব্যবসায়ীর মতো তার দুটি পাসপোর্ট, একটি মণি সাহা নামে অন্যটি মণি শেখ নামে।
কলকাতায় এলে শ্রীমান মণিগোপাল পিতৃবন্ধু হিসেবে আমার সঙ্গে দেখা করত। খালি হাতে আসত না, কখনও ঢাকার কালাচাঁদের সন্দেশ, কখনও পোড়াবাড়ির চমচম, কখনও একজোড়া ইলিশ মাছ, সে আমার জন্যে নিয়ে আসত।
মণিগোপাল কলকাতায় এখন-আর-তেমন-যুবতী-নন এরকম এক চিত্রতারকার পাল্লায় পড়েছিল। পরস্পর শুনেছি, ঢাকা শহরেও অনুরূপ দোষের জন্য তার খ্যাতি আছে।
সে যাই হোক, বন্ধুপুত্রের এসব ব্যক্তিগত ব্যাপারে মাথা গলানোর লোক আমি নই। তা ছাড়া ইতিমধ্যে মণিগোপাল সাহা একজন বিখ্যাত মানুষ হয়ে গেছে।
মণিগোপাল পরিচালিত দুটি চলচ্চিত্র বাংলাদেশি সিনেমায় টিকিট বিক্রির সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।
প্রথম ছবিটির নাম, শয়তান খানখান। বাংলাদেশ যুদ্ধের পটভূমিকায় খান সেনাদের বিরুদ্ধে এক সামান্য গ্রাম্যবধূর মৃত্যুঞ্জয় সংগ্রামের অবাস্তব কাহিনি সাধারণ মানুষকে খুব আলোড়িত করেছে।
কলকাতার কাগজপত্রেও এ নিয়ে ঢের আলোচনা হয়েছে।
মণিগোপালের দ্বিতীয় ছবি, গাবলুর ছেলে গুণ্ডা নামেই এর পরিচয়। এই বইও প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
০৩. পটললাল ও মণিগোপাল
অবশ্য শ্রীমান মণিগোপাল আমার কাছে তার সিনেমা-টিনেমার ব্যাপার নিয়ে কখনও কোনও কথা বলেনি, তবে আমি যে অল্পবিস্তর খোঁজখবর রাখি সেটা সে বুঝত।
তা হঠাৎ একদিন সকালে মণিগোপাল ফোন করল ঢাকা থেকে, সন্ধ্যাবেলা বাসায় আছেন?
আমি বললাম, তা আছি। তুমি কোথা থেকে ফোন করছ।
মণি বলল, ঢাকা থেকে। তবে দুপুরের ফ্লাইটেই কলকাতা পৌঁছাচ্ছি। আপনার সঙ্গে একটু দরকার আছে।
কী দরকার, কিছুই শুনলাম না, তবু বললাম, ঠিক আছে এসো। তবে বেশি দেরি করো না।
দেরি অবশ্য করেনি। সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ মণি এল, সঙ্গে আরও দুইজন। এর মধ্যে একজন খুবই পরিচিত মুখ, প্রায় গতযৌবনা বাংলা চলচ্চিত্রের অস্তাচলগামী তারকা শ্রীমতী মানসী দত্ত। ইনিই কিছুদিন হল মণির কাঁধে চেপেছেন। মণিকে দেখে মনে হচ্ছে মণি সানন্দেই এ ভার বহন করছে।
কোনও কোনও রমণীকে দেখলে, লাস্য শব্দটির অর্থ বোধগম্য হয়। বয়েস হলেও, এই মহিলাকে দেখে আবার বহুদিন পরে লাস্য শব্দটির অর্থ অনুধাবন করলাম।
সঙ্গের তৃতীয় ব্যক্তিটি একটি নড়বড়ে চেহারার মাঝবয়েসি লোক। আমার কেমন চেনা চেনা মনে হল।
অবশ্যই তিনি নিজেই আগবাড়িয়ে নমস্কার করে পরিচয় দিলেন, স্যার, চিনতে পারছেন? আমি আপনার পটললাল।
পটললালকে দেখে আমি শুধু একটু অবাক হলাম বটে তবে অনুমান করতে পারলাম যে নিশ্চয় সিনেমার কোনও ব্যাপার, তাই মণিগোপাল পটললালকে সংগ্রহ করেছে।
পটললালকে যারা জানেন তাদের কাছে পটলবাবু বিষয়ে কিছু বলতে যাওয়া অবান্তর হবে। পটললাল একজন গুণী ব্যক্তি, যাত্রা-থিয়েটার-সিনেমা লাইনে এমন অভিজ্ঞ লোক খুব বেশি পাওয়া যায় না।
সুতরাং মণিগোপাল যে পটললালকে তার কাজের জন্য নিয়েছে সেটা ভাল বুঝেই করেছে। আর, এই চিত্রতারকা মানসী দত্ত, তিনিও হয়তো মণির কাজে লাগছেন। পটললাল এবং চিত্রতারকার সঙ্গে পরিচয়পর্ব শেষ হওয়ার পরে মণিলাল বলল, আমি তো সিনেমা করি সে তো আপনি জানেন। ঢাকায় আমার ব্যবসা ভালই চলছে। এখন ভাবছি ভারত-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে একটা বই করব।
আমি বললাম, কিন্তু এ ব্যাপারে আমার কী করার থাকতে পারে?
মণি কিছু বলার আগেই পটললাল বলল, আপনি স্যার শাহেনশা আদমি; আপনি সব কিছু করতে পারেন।
মণি বলল, পটলবাবুকে আমার সহকারী হিসেবে আমি নিয়েছি। এরপর একটু চুপ করে থেকে বলল, বাবার মৃত্যুর পর এখানে তো আমার কোনও অভিভাবক নেই, কলকাতায় এলে আপনিই আমার অভিভাবক। তাই অনেক ভরসা করেই আপনার কাছে এসেছি।
কীসের ভরসা, কী ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারলাম না। ইতিমধ্যে শ্রীমতী দত্ত, যিনি আমার সোফার একপাশে বসেছিলেন, তিনি ঘেঁষতে ঘেঁষতে একেবারে আমার ঘাড়ে এসে পড়েছেন। তাঁর সালোয়ার কামিজের দোপাট্টা কণ্ঠচ্যুত এবং বক্ষভ্রষ্ট হয়ে তাঁর কোলের ওপরে এসে পড়েছে। মনে হল তিনি যথেষ্ট মদ্যপান করে এসেছেন। এই রকম বিব্রত অবস্থায় আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মণিগোপালের দিকে তাকালে সে পটললালকে ইশারা করল। পটললাল মহিলাকে রীতিমতো টেনে সোফার অন্যপ্রান্তে যতটা সম্ভব সরিয়ে তারপর একবার গলাখাঁকারি দিয়ে ক্রিকেটার আজ্জর মতো। শার্টের কলারটা একটু ওপর দিকে তুলে দিয়ে তিনি বললেন, মনুভাইয়ের জগু সরাইওয়ালার সঙ্গে মণিবাবুর নতুন বই হচ্ছে। অর্ধেক কাজ হবে বাংলাদেশে, বাকি অর্ধেক কলকাতায়।
আমি বললাম, সরাইওয়ালা নামটা আমার তেমন ভাল লাগছে না। পটললাল এ কথায় কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, তাকে থামিয়ে দিয়ে মণিগোপাল বলল, এ নিয়ে আপনি ভাবতে যাবেন না, তা ছাড়া সরাইওয়ালা ঢাকায় ইমপোর্ট-এক্সপোর্টের ব্যবসা করে, ওর টুঁটি আমার কাছে বাঁধা।
আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু তোমাদের এই ছবির ব্যাপারে আমাকে কী করতে হবে? এসব ব্যাপারে আমার তো কোনও অভিজ্ঞতা নেই।
উত্তর পেলাম পটললালের কাছ থেকে, সিনেমার লাইনে কোনও অভিজ্ঞতা লাগে না। তা ছাড়া আপনি হলেন প্রধান উপদেষ্টা, আপনার অভিজ্ঞতার কী দরকার? নামটাই যথেষ্ট।
আমাকে আর কথা বলতে না দিয়ে পটলবাবু বললেন, আমাদের বইয়ের নাম শুনলেই বুঝতে পারবেন কীরকম নামের বই।
নামের কথায় আমি বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, নাম? নামে কী সুবিধে? কী নাম?
এবার এই মদালসা চিত্রতারকা জড়ানো গলায় বললেন, চারশো, চারশো বিশ।
আমি অবাক হয়ে বললাম, এ নিয়ে তো পুরনো আমলের রাজকাপুরের বই আছে, চারশো বিশ। মণি সঙ্গিনীর কথায় একটু বিরক্ত হয়েছিল, সে বুঝিয়ে বলল, রাজকাপুরের আর কে ফিল্মসের বইটার নাম চারশো বিশ নয়, নাম ছিল শ্রীচারশো বিশ, শ্রী ফোর টোয়েন্টি।
আমি আশ্বস্ত হলাম, তবু মনে আরেকটা খটকা ছিল সেটা বললাম, চারশো বিশ হল ফৌজদারি আইনের একটা ধারা, পটলবাবু তো জানেন চিটিং কেসের ধারা, বাংলাদেশে এ ধারা চালু আছে তো?
পটলবাবু বললেন, অবশ্য। অবশ্য। একই আইন, একই ধারা। দু জায়গাতেই চিটিং কেস।
মণি আবার বলল, আমাদের বইয়ের নাম কিন্তু শুধু চারশো বিশ নয়, আরেকটু বড়।
বড় নামটা বোধহয় মিসেস দত্ত বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ঠোঁট দিয়ে অস্ফুট মা-মা এই রকম শব্দ করে সোফায় গড়িয়ে পড়লেন।
পটললাল তাকে তুলে নিয়ে সোফার পিঠে হেলিয়ে দিলেন এবং ব্যাপারটার গুরুত্ব লাঘব করার জন্য, যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে কথা চালিয়ে যেতে লাগলেন। তার থেকেই জানা গেল, বইয়ের নাম মা কেন চারশো বিশ?
প্রশ্নবোধক এবং অর্থবোধক এরকম একটি নামকরণ দেখে আমি যথেষ্ট চমৎকৃত হলাম এবং আরও অবাক হলাম এই জেনে যে মণিগোপালের এই আগামী বইয়ের নামকরণ শ্রীমতী দত্তই করেছেন।
পটললাল বললেন, দত্তবউদির অনেক গুণ। যেমন পার্ট করতেন, তেমন নাচতেন। পুরনো বাংলা পৌরাণিক সিনেমায় উর্বশী পার্ট ছিল ওঁর বাঁধা। এক ঘের সাদা সিফনের শাড়ি পরে সেই নাচ দেখলে মুনি-ঋষিদের ধ্যান ভঙ্গ হয়ে যেত, দর্শকেরা পয়সা ছুড়ত।
আমি মন দিয়ে শুনছিলাম। বেহুশ শ্ৰীমতী দত্ত সোফার ওপর কাত হয়ে পড়ে আছেন। পটললালের কথা শুনে একটু দেহচাঞ্চল্য দেখা দিল তার নাচের ভঙ্গিতে দুলতে লাগলেন। আমার ভয় হল, পৈতৃক আমলের পুরনো সোফা মহিলার ভারী শরীরের দোলনে ভেঙে না যায়।
ইতিমধ্যে পটললালের কাছে জানা গেল, শ্রীমতী দত্ত আজকাল গল্প, কবিতা, সিনেমার গান এই সব লিখছেন। মা কেন চারশো বিশ বইয়ের জন্যেও একটা গান লিখেছেন:
কত লম্পট দেয় চম্পট
মাতালেরা ছাড়ে মাল
এম এল এ সাহেব করেন গায়েব
কুমির ভরতি খাল।…
এই হল প্রথম চার লাইন। গানটি বেশ বড়। অনুরূপ আরও কয়েকটি গান শ্রীমতী দত্ত ওই বইয়ের জন্য লিখবেন। একটিতে হাত দিয়েছেন, শ্যামাসংগীতের ঢংয়ে লেখা,
(ওরে) তুই কেন মা, মা করিস
তোর মা যে চারশো বিশ…
শ্ৰীমতী দত্তের বহুগুণাবলির পরিচয় পেয়ে ক্রমশ তাজ্জব বনছিলাম। কিন্তু পটলবাবুর বক্তব্য শেষ হয়ে এল।
এইবার মণিগোপাল আসল কথায় এল।
আসল কথা খুবই জটিল। এই গল্পের জন্য খুব একটা প্রাসঙ্গিক নয়, তবু পাঠকের কৌতূহল নিবারণের জন্যে সংক্ষেপে বলি।
০৪. সারকথা
বাংলাদেশে মণিগোপালের দ্বৈত চরিত্র, মণি সাহা এবং মণি শেখ। কয়েকদিন আগে মণি সাহার নামে চোরাচালানের অপরাধে ঢাকার আদালত জামিন-অযোগ্য ওয়ারেন্ট বেরিয়েছে।
এ অবস্থায় মণিগোপাল আপাতত মণি শেখ নামে নিজেকে রক্ষা করছে। সে এবার ঢাকা থেকে মণি শেখ নামের পাসপোর্ট নিয়ে এসেছে।
বিশেষ বৈষয়িক প্রয়োজনে মণিকে অবিলম্বে ঢাকায় ফিরতেই হবে, তা ছাড়া চোরাচালানি মামলাটির আপিল আছে, তদ্বির-তদারক আছে। কবে আবার কলকাতায় আসতে পারবে তা ঠিক নেই। কিন্তু এদিকে তার সহযোগী সরাইওয়ালা আর দেরি করতে রাজি নয়।
সরাইওয়ালার বিদ্যাবুদ্ধির ওপর মণিগোপালের খুব আস্থা নেই। অথচ সরাইওয়ালা সামনের শনিবার বিকেলেই মা কেন চারশো বিশ ছবিটার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চান।
যেহেতু মণির পক্ষে সামনের শনিবার পর্যন্ত থাকা সম্ভব নয় তাই সে আমার কাছে এসেছে, আমি যদি তার হয়ে শনিবারের প্রাথমিক আলোচনাটা উতরিয়ে দিই। যা করার শ্রীমতী দত্ত আর পটললালই করবেন, কিন্তু সরাইওয়ালা খুব ঘোড়েল লোক। আমাকে সেদিন অধিকতর ঘোড়েল লোকের ভূমিকায় প্রায় মূকাভিনয় করতে হবে। যথাসাধ্য চুপচাপ থাকলেই হবে। সেদিন রাতে মণি ফোন করবে ঢাকা থেকে তখন তাকে সব জানালেই হবে।
শুধু বিষয় বৈচিত্র্যের জন্যে নয়, লাস্যময়ী শ্রীমতী দত্তের একবেলার সাহচর্যের লোভে আমি মণির প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। ঠিক হল, সামনের শনিবার বিকেল চারটের সময় পটললাল এসে আমাকে কেয়াতলায় শ্রীমতী দত্তের ফ্ল্যাটে নিয়ে যাবেন। সেখানেই সরাইওয়ালা এবং সিনেমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও কেউ কেউ আসবেন এবং তখনই বইয়ের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।
পরের শনিবার পটললালের সঙ্গে যথাসময়ে কেয়াতলায় পৌঁছে দেখি জমজমাট ব্যাপার। শ্ৰীমতী দত্তের ছোট ফ্ল্যাটের বাইরের ঘরে প্রায় আট-দশ জন লোক, তাদের মধ্যে সিনেমা লাইনের দাগি এবং গোলমেলে দুয়েকটিকে আমিও চিনি।
শ্ৰীমতী দত্ত আজ খুব সেজেছেন, চুলে ফুলের মালা, ভুরু লম্বা করে টানা, দেহে সুবাস। কিঞ্চিৎ নেশাও করেছেন মনে হল। তবে সেদিনের মতো বিহুলা নন। মি. সরাইওয়ালার সঙ্গে পরিচয় হল, তিনি তার নিজের ভাষায় হামি ফিফটি-ফিফটি বাঙালি আছে।
পানভোজনের যথেষ্ট আয়োজন হয়েছে। কড়া পানীয় আমার সহ্য হয় না। শ্রীমতী দত্ত নিজের হাতে আমাকে এক পেয়ালা চা করে দিলেন, সঙ্গে মাংসের বড়াও খেলাম।
ইতিমধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। দেখা গেল, বইয়ের নায়ক-নায়িকা পাত্র-পাত্রী আগেই ঠিক হয়েছে, বইয়ের নাম তো স্থির হয়েই আছে। এবার স্থির হল বইটি হবে সোয়া দুঘণ্টার রিলের ফিল্মের দৈর্ঘ্য চারহাজার মিটারের মধ্যে না হলে খরচ বেশি হবে, আজকাল দর্শকরাও বিরক্ত বোধ করেন সিনেমা দীর্ঘ হলে।
লালরঙের একটা খেরোর খাতা নিয়ে পটললাল বসেছেন, তার ললাটে শ্ৰীমতী দত্ত সিঁদুর-চন্দনের মাঙ্গলিক ফোঁটা দিয়ে দিয়েছেন। পটললাল একে একে লিখে যাচ্ছেন, যখন যেমন আলোচনা হচ্ছে সব কিছু।
ছবির শুরুতে মি. সরাইওয়ালার গুরুজি শ্রীমৎ ভোগানন্দের ফটো দেখানো হবে। ফটোর গলায় মালা। ধূপ জ্বলছে, প্রদীপ জ্বলছে, ফটোর গলায় মালা পরাচ্ছেন এক মহিলা। সরাইওয়ালার অনুরোধে শ্রীমতী দত্ত মালা পরাতে রাজি হলেন। সমস্ত ব্যাপারের জন্য ধরা হল দেড় মিনিট।
এরপর টাইটেল, টাইটেল সং ইত্যাদি। টাইটেলে ৪২০-র ফ্রেমে শূন্যের মধ্যে মায়ের মুখ থাকবে। সঙ্গে আবহসংগীত, কালীপুজোর ঢাকের বাদ্যি, তেড়ে-কেটে-তাক, তেড়ে-কেটে-তাক। পাবলিক এসব চায়। সব মিলিয়ে পাঁচ মিনিট ধরা হল। প্রথমেই একটা পাঁঠাবলির দৃশ্য। বিদেশ থেকে এই সব ছবি প্রাইজ আনে।
আস্তে আস্তে বই এগোতে লাগল। সরাইওয়ালা এবং শ্রীমতী দত্ত নিজ নিজ বুদ্ধি ও পছন্দমতো বলে যেতে লাগলেন। অন্যেরাও জোগান দিল।
চারটি নৃত্য সহযোগে গান। বইয়ের আরম্ভে এবং প্রায় শেষে দুটি ক্যাবারে নাচ। বম্বে থেকে আর্টিস্ট আসবে, নৃত্য পরিচালনায় মানসী দত্ত। এই ছয়টিতে যাবে গড়ে সাত-আট মিনিট করে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আর দুটি সাধারণ গান, একটি নায়ক কিংবা নায়িকার, বাবার কিংবা মার মৃত্যুর পরে শ্মশানঘাটে, অন্যটি একটি চিঠি হাতে নিয়ে জানলায় দাঁড়িয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে নায়িকার করুণ কণ্ঠে গান। এর জন্য আরও পনেরো মিনিট।
এই নিয়ে এক ঘণ্টা হল, আরও সোয়া ঘণ্টা নায়ক ও নায়িকার সেন্সরসিদ্ধ ঘনিষ্ঠ প্রেম তিন দফায় পনেরো মিনিট। চার স্থানে চারটে ব্যঙ্গ হিউমার আট মিনিট, এই সময় মানসী দত্ত আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, মনে হল হয়তো হিউমারগুলো আমাকেই সরবরাহ করতে হবে। এ ছাড়া নায়িকার বিচার কোর্ট সিন আট মিনিট, থানা সিন পাঁচ মিনিট। গুণ্ডাদের সঙ্গে নায়কের একক লড়াই সবসুদ্ধ তিনবার, পনেরো মিনিট। নায়কের পিসিমার আবেগ-উচ্ছাস দু মিনিট, পূজার ঘরে ক্রন্দন দেড় মিনিট। নায়িকার জ্যাঠামশাইয়ের নায়কের ওপর হম্বিতম্বি চার মিনিট। আইন ও সেন্সর মেনে যতটা সম্ভব এম.এল.এ সাহেব এবং রাজনৈতিক নেতাদের অপমান সাত মিনিট, প্রবঞ্চনার দায়ে কারাবাসিনী নায়িকার পাথর ভাঙার হৃদয় বিদারক দৃশ্য পাঁচ মিনিট।
এইভাবে সোয়া দুঘণ্টা হয়ে গেল। কিন্তু আমার কেমন খটকা লাগল। গল্প? সবই তো হল কিন্তু গল্প কোথায়? আমার প্রশ্নটা বলতে মি. সরাইওয়ালা বললেন, এরপর আবার গল্প? মানসী দত্ত বললেন, গল্প লাগবে না। শুধু পটললাল বললেন, শুটিংয়ের সময় সেটা ডিরেক্টর বানিয়ে নেবেন। রাতে মণি ঢাকা থেকে ফোন করতে তাকে সব কথা বলায় সে বলল, গল্প নিয়ে ভাববেন না। কাহিনি ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে আপনার নাম দিয়ে দেব, তা হলেই যথেষ্ট।