পটলা সমগ্র ১
পটলা সমগ্র ২

পটলার ভোটরঙ্গ

পটলার ভোটরঙ্গ

পটলা সেদিন ক্লাবের মাঠে এসে কিছু না বলতেই হাঁক পাড়ে,—অ্যাই পাঁড়েজি, ডবল করে ঝালমুড়ি লাগাও।

আমাদের ক্লাবের মাঠের ধারেই পাঁড়েজির ভুজিয়ার দোকান। মুড়ি-বাদাম-ছোলাসেদ্ধ আরও নানারকম মশলা সহযোগে পাঁড়েজি যা ঝালমুড়ি বানায়, তা এক কথায় ফার্স্টক্লাস ! পটলাকে অন্যদিন চাপ-টাপ দিতে হয়, আজ যেন ও কল্পতরু হয়ে গেছে। ঝালমুড়ির পরই আসে নন্টের মনোরমা কাফে থেকে গরম চা।

হোঁৎকা শুধোয়,–কেসটা কি ক’তো? অ্যাক্কেবারে ম্যাঘ না চাইতেই জল !

আমরাও অবাক ।

পটলা এবার পাশে বসে বলে—একটা প্ৰ-প্ৰ—!

আমিই পাদপূরণ করি, – প্রবলেম ?

পটলা বলে, – ঠি-ঠিকই বলেছিস। এখন তো-তোদের হেল্প চাই ।

উত্তেজিত হলে পটলার তোতলামি বেড়ে যায়। আর তোতলামির মাত্রা বাড়া কমা দেখে আমরাও তার প্রবলেমের গুরুত্বটা অনুভব করতে পারি।

পটলা এরপর তার প্রবলেমটা জানায় ।

তার নসুমামা থাকে কোনো মফঃস্বলের দূর গ্রামে—ওর পূর্বপুরুষরা সেখানকার জমিদার ছিল। এখন জমিদারি গিয়েছে, ওরাও প্রায় জমাদারে পরিণত হয়েছে। তবে নামটা আছে। এহেন নসুমামা এবার ভোটে দাঁড়িয়েছে। সামনেই ভোট।

পটলা বলে,—যে-যেভাবেই হোক, মা-মামাকে ভোটে জেতাতেই হবে।

হোঁৎকা বিরসবদনে বলে,—কি হাবিজাবি কস্? ভোটে দাঁড়ায় যারা তাগোর বিলিভ করস না। হক্কলেই ‘ডেঞ্জার পার্সন’। ওই ভোটের ব্যাপারে আমি নাই।

গোবর্ধন বলে,—এখন কুমড়োর সিজন। চারদিক থেকে এখন মাল কিনতে হচ্ছে, দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে। আজ তারকেশ্বর কাল দশঘরা, পরশু আরামবাগ। এখন টাইম কই ? ফটিক কালোয়াতি গানের সাধনা করে। সে বলে,—সামনে সঙ্গীতবিশারদ পরীক্ষা — ! অর্থাৎ পটলার এতবড় বিপদে তারা ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় না।

পটলা কাতরস্বরে বলে,—তা-তাহলে নসুমামা গো-গো গোহারান হেরে যাবে। তো-তোরা থাকতে!

তারপরই পটলা বলে,—নসুমামা ভোটের জন্য তো-তোদের হাতে এন্তার টাকা দেবে। খ-খরচা পাতি ক-করবি তোরাই। ক-ক্লাবের ফান্ডেও কিছু আসবে। খাওয়া-দাওয়াও ভালোই হবে।

আমদানির কথায় আর খাওয়া-দাওয়ার কথায় এবার হোঁৎকা নড়ে বসে। শুধোয়, খরচার কথাটা যেন কি কইছিলি ?

পটলা ব্যাপারটা বিশদভাবেই জানায়। তাতে মনে হয়, নসুমামা যেন রাজসূয় যজ্ঞই করছে। আর সেই যজ্ঞের হোতা হবার জন্য আমাদের সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।

সেদিন পটলাদের বাড়িতে আমাদের ক্লাবের জরুরি মিটিং। সামনেই সরস্বতী পুজো। হোঁৎকার ইচ্ছে এবার তাকলাগানো পুজো করতে হবে। তারপর হবে ফাংশান। নামিদামি গাইয়েদের আনতেই হবে। কুলেপাড়ার সেভেন বুলেটস্ ক্লাবের পাশেই পটলাদের বিশাল পুকুর। ওখানেই জলের উপর প্ল্যাটফর্ম করে চারদিকটা চন্দননগরের আলোয় সাজাতে হবে। ডাইনোসোর, কুমির এসবও বানানো হবে আলোর খেলা দিয়ে।

কিন্তু টাকা! টাকা তো নেই। গোবর্ধন আমাদের ক্যাশিয়ার, সেই বলে,—ফান্ড তো নিল । তাই ভাবনায় পড়েছি, এমনসময় ঈশ্বরপ্রেরিত মহাপুরুষের মত এসে হাজির হয়, নসুমামা স্বয়ং।

নসুমামার চেহারাটা বেশ লম্বাটে, মুখখানা ফুলসাইজ নোড়ার মত লম্বা। উঁচু কপালে জোড়া যেন একটা আস্ত ধনুকের মত মধ্যস্থল থেকে দুদিকে বাঁকানো। পরনে দামি সার্জের পাঞ্জাবি, ফুললতাপাতা কলকা বসানো শাল, কোঁচানো ধুতি ।

নসুমামা বলে,—ওর জন্য ভাবিস না পটলা, তোর ক্লাবের পুজো বেশ ধুমধাম করেই হবে । তবে —

কথাটা শুনে খুশিই হয়েছি, কিন্তু তারপর ওই ‘তবে’ কথাটায় একটু ধন্দ লাগে। হোঁৎকা এদিকে চাইল। নসুমামা বলে,–ভোটে জিতিয়ে দে। তোরা শহরের চালু ছেলে, পাড়াগাঁয়ে শহরের মত ভোটের ক্যাম্পেন করলে জিতবোই।

গোবর্ধন বলে,–আর শহরের বৈজ্ঞানিক রিগিং—ওটা?

নসুমামা বলে,—সেটা করতে পারলে তো কথাই নেই, জিতবোই। আর তোদের জন্য বরাদ্দ থাকবে দশহাজার টাকা !

দ-শ-হা-জা-র! —গোবর্ধন ক্যাশে এতটা মাল পাবে তা ভাবতেই পারে না। তাই ঈষৎ ঘাবড়ে গেছে। আমরাও এই লোভ ছাড়তে পারি না।

পটলার মা অর্থাৎ আমাদের কল্পতরু মাসিমাও লুচি আলুরদম ‘সার্ভ’ করতে এসে নসুমামার কথায় বলেন,—নসু বলছে তোরা যা

হাজার হোক ভাই—তা খুড়তুতোই হোক, তাকে এই বাজারে নেতা বানাবার মতলবে সকলেই সমর্থন করবে। পটলার মা-ও করেন। হোঁৎকা জানে কোনদিকে কখন ঘাড় কাত করতে হয়।

বলে,—ঠিক আছে। যামু—ট্রাই করুম তোমারে জিতানোর ।

নসুমামা যেন হাতে চাঁদ পায়!—তাহলে এই শনিবারই চলে আয়। পটলা পথ চেনে। খরচা বাবদ এটা রাখ।

কলকাতা থেকে বাসে সোজা হরিণখোলায় নেমে সেখান থেকে মাইল পাঁচেক গেলে নদীর ধারে পড়বে হাড়মাসপুর। আমরা সকালের দিকে আরামবাগগামী বাসে উঠেছি এসপ্ল্যানেড থেকে।

নামেই আরামবাগের বাস। ভেবেছিলাম আরামেই যাওয়া যাবে। কিন্তু বাসটা ডানকুনি পার হয়ে কিছুদূর গিয়েই বিকট শব্দ করে থেমে গেল। অবশ্য আর একটু হলে পাশের একটা পচা ডোবার মধ্যে গিয়ে থামত। সামনের চাকাটা ফেটে গিয়ে গাড়ি একেবারে ডোবার কাদায় মুখ নিচু করে গেড়ে বসেছে।

একজন যাত্রী মাটির হাঁড়িতে করে নলেন গুড় নিয়ে যাচ্ছিল। গাড়ির প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে উপরের বাঙ্ক থেকে গোবর্ধনের গায়ে মাথায় গড়িয়ে পড়েছে খোসবুদার নলেন গুড়।

ওদিকে ড্রাইভার তখন অ্যাক্সিডেন্টের ভয়ে লাফ মেরেছে। দশ কেজি কাতলা মাছের মত ঝপাং করে গিয়ে পড়েছে পচা ডোবার জলে।

কোনোমতে নামলাম মালপত্র নিয়ে। সরকারি গাড়ি। পয়সা ফেরতের প্রশ্নই নেই। এখন যাই কিসে? দু’একটা লোকাল বাস যাচ্ছে তারকেশ্বর অবধি, কিন্তু তাতে ভিতরে, মায় ছাদে অবধি যাত্রীঠাসা।

এদিকে বেলা বাড়ছে। শেষ পর্যন্ত একটা সিমেন্টের লরিকে বেশ কিছু টাকা কবুল করে উঠে বসলাম সিমেন্টের বস্তার উপর। গাড়ি চলছে নেচে কুঁদে, ঝাঁকানিতে সিমেন্ট উড়ছে। আমরা যেন কংক্রিট হয়ে যাব! মাঝে মাঝে বিকট শব্দে হাঁচিও শুরু হয়।

কোনোমতে চাঁপাডাঙা পৌঁছলাম।

ততক্ষণে সিমেন্টওয়ালা একটা দোকানের সামনে গাড়িটা থামায়। বলে,—এখানে কিছু মাল নামবে।

হোঁৎকা বেছে বেছে একটা বড় মিষ্টির দোকানে ঢুকে ডজন খানেক গরম সিঙাড়া, আর বড় সাইজের রাজভোগ অর্ডার দিয়েছে। কলের জলে মুখচোখ গলার ভিতর থেকে সিমেন্টের পলেস্তারা ধুয়ে মুছে খেতে বসেছি। হোঁৎকা বলে,—নাহ্। সিঙাড়াখানা বানাইছে খাসা, আরও খান দুই দিতি ক!

এর মধ্যে ভেঁপু বেজে ওঠে, সিমেন্টওয়ালার ট্রাক এবার আরামবাগের দিকে রওনা হবে। আমরাও উঠে পড়লাম ।

হরিণখোলা জায়গাটা মুণ্ডেশ্বরী নদীর ওপর। এখন নদীর উপর পাকা ব্রিজ হয়েছে, আগে নৌকোয় পার হতে হত খরস্রোতা দামোদরের এই শাখা নদী। বেশ নাব্য। এখন অবশ্য বালির স্তূপ।

নদীর ওপারে গিয়ে নামলাম যখন বেলা একটা বেজে গেছে। এখান থেকে নদীর ধারের কাঁচা সড়ক ধরে পাঁচ মাইল পথ যেতে হবে। দেখি নসুমামার বাড়ি থেকে গরুর গাড়ি এসেছে। বাহারের ছই লাগানো গাড়ি। নিচে পুরু করে খড় পাতা—তার উপর সতরঞ্চি।

নসুমামার গাড়োয়ান গদাধরের চেহারাটা দেখার মতই। যেন নিরেট একখানা গদাই । আগাপাশতলা সমান, গোলগাল চেহারা। গাড়ির ছই-এ বেশ কয়েকটা ‘হাঁড়ি’ মার্কা পোস্টার। দরদি দেশসেবক নৃসিংহ রায়কে ‘হাঁড়ি’ মার্কায় ভোট দিন।

অর্থাৎ নসুমামার প্রতীক ওই হাঁড়ি। এখান থেকেই তার ভোটের এলাকার শুরু। গাছের ডালেও পোস্টার, অবশ্য আশপাশে জোড়া বলদ, লাঙল, সাইকেল, কাস্তে—নানা ছাপের ছবি নিয়ে বহু দরদি দেশসেবকদের নাম হাওয়ায় উড়ছে। ভোটের গাড়িও চোঙা ফুঁকে চলেছে। হাওয়া যে গরম তা বোঝা যায় ৷

গদাই বলে,–বাবু, যেতে টাইম’ লাগবে। দুপুরের খাওয়াটা পেটচুক্তি করে ওই হোটেলে খেয়ে লেন।

আদর্শ হিন্দু হোটেলের চেহারাটা মোটেই দর্শনধারী নয়। তবু কথাটা যুক্তিপূর্ণ মনে হয়। হোঁৎকা বলে,–তাই চল।

খাই লই।

পটলা বলে,—খ-খাবি ?

গোবর্ধন বলে,—না হলে এ বেলায় আর কিছুই জুটবে না।

হোটেলওয়ালা পড়তি বেলায় একসঙ্গে ছ’জন খদ্দেরকে দেখে খুশিই হয়।

কোনোরকমে আহার পর্ব সেরে এবার যাত্রা হল শুরু। এর মধ্যে দু-চারটে ভোটের দল ঘুরে গেছে। তারা শুনেছে নসুমামার জন্য কলকাতা থেকে তাঁর দল নাকি স্পেশাল ভলেনটিয়ার পাঠিয়েছে। কোনো এক প্রতিপক্ষ দলের লোকজন দেখছিল আমাদের। কে একজন বলে,—নসুবাবু কি—ফট্ !

অর্থাৎ আমরা যে উত্তপ্ত পরিবেশেই এসে পড়েছি, বুঝতে পারছি।

হোঁৎকা বলে, –কি কয়, ওরা ?

পটলা বলে, – মামার এগেনেস্ট পা-পার্টি।

গরুর গাড়ি চলছে হটর পটর করে, মেঠো সড়ক ধরে। দুদিকে দিগন্ত প্রসারী আলু গমের ক্ষেত। সবুজ পরিবেশ।

হঠাৎ গেল গেল রব। গাড়িটা টাল খাচ্ছে। ছই-এর বাতা ধরে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করি । দেখি একটা চাকা বের হয়ে গড়িয়ে চলেছে, আর আমরা সশব্দে বালিতে কাত হয়ে ছ‍ই চাপা পড়েছি। গরুর গলার দড়িটা ছিঁড়ে গেছে। দুটো গরুর একটা নদীর বালিতে, অন্যটা আলুর ক্ষেত দিয়ে দৌড়চ্ছে। গদা ডিগবাজি খেয়ে দৌড়চ্ছে গরুটাকে ধরতে।

নেহাত বালিতে পড়েছি, তাই তত বেশি লাগেনি কারুর। অল্পসল্প ছড়ে গেছে।

গদা গরুদুটোকে ধরে এনে এবার অ্যাক্সিডেন্টের কারণটা পরীক্ষা করে বলে,—কুন্ শালা গাড়ির চাকার আলানগুঁজি খুলে দিয়েছে? এ ওই ধনাবাবুর লোকদেরই কাজ !

অর্থাৎ এর মধ্যে প্রতিপক্ষ ধনকেষ্টবাবুর লোকরা নসুবাবুর ভোটকর্মীদের উপর আক্রমণ হেনেছে।

নসুমামার বাড়িটা সাবেকি ধরনের। এককালে এঁদের অবস্থা বেশ ভালোই ছিল তো বোঝা যায়। বড় বড় থাম, এককালে পঙ্খের কাজ করা ছিল, এখন পায়রার বাসায় ভর্তি। কার্নিশ ভেঙে গেছে।

ধ্বংসস্তূপের পাশে নসুমামার নতুন বাড়িটা বেশ ছিমছাম। ওদিকে খামার বড় বড় খড়ের পালুই। নসুমামার বাড়ির একদিকে দড়ি বেঁধে পোস্টারগুলো টাঙানো হয়েছে। নসুমামা এগিয়ে আসে। পথে কোনো অসুবিধা হয় নি তো?

-না-না।

নসুমামা একজনকে বলে,–সুশীল, এদের ওদিকের ঘরে নিয়ে চল। আর খাওয়া-দাওয়া ? হোঁৎকা বলে,—ওসব পথেই সারছি।

—তাহলে চলো। হাতমুখ ধুয়ে বিশ্রাম করবে। চা-টা খেয়ে, কথা হবে।

বাড়ির পিছনে বেশ খানিকটা এলাকা জুড়ে আম কাঁঠালের বাগান, একটা ঘাট বাঁধানো পুকুরও আছে। গোয়ালে তিনচারটে জারসি নধর গরু রয়েছে। এদিকের ঘরটাও ছোটখাটো হলঘরের মত। আগে থেকেই মামা পাঁচখানা তক্তপোশে পরিপাটি বিছানাও করে রেখেছে। লাগোয়া বাথরুম, ওদিকে বড় ইঁদারা। ব্যবস্থাদি ভালোই।

বৈকালেই বের হলাম গ্রাম দেখতে। সঙ্গে নসুমামার ভাইপো সুশীল। আমাদেরই বয়সি। গ্রামটা বড়সড়। মাটির ঘর খড়ের চাল, মাঝে মাঝে দু’চারটে দালানও রয়েছে।

ওদিকে বাজার পাড়ায় সন্ধের আলো জ্বলে ওঠে। দূর গ্রাম হলেও দোকানপশার ভালোই। আশপাশের এলাকার মধ্যে বড় গ্রাম, তাই ইলেকট্রিকও আছে।

ওপাশে একটা বড় বাড়ি—চারদিকে পোস্টার। ধনকৃষ্ণ পালকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন। বাড়িটার বাইরে একটা অফিস মত – সেখানে অনেকেই রয়েছে। ঘনঘন চা-ও যাচ্ছে।

–তোমরাই কলকাতা থেকে এসেছ, না ?

মিটমিটে বাতির সামনে গেলে পিপের মত চেহারার লোকটি, মাথায় চুল নেই – চকচকে টাক। গায়ে একটা দামি শাল। আমাদের দিকেই এগিয়ে আসে পিছনে দুচারজন চামচা । সুশীলই চাপা স্বরে বলে, —ইনিই ধনকেষ্টবাবু।

আমি জানাই,—আজ্ঞে !

ভদ্রলোক আমাদের দিকে জরিপ করা চাহনি নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, – নসু তাহলে ভোটে লড়বে ?

হোঁৎকা বলে,–ক্যান! আপত্তি আছে আপনাগোর ?

হোঁৎকার বেশ পাকাপোক্ত চেহারার দিকে চেয়ে ধনকেষ্ট বলে,—না-না। ভোটে নামা তো গণতান্ত্রিক অধিকার। আপত্তি থাকবে কেন? তবে এই গাঁয়ের নাম শুনেছ তো? হাড়মাসপুর ! একজন শীর্ণকায় লগার মত লম্বা চামচা বলে,—হাড় মাস এখানে আলাদা করা হয়, তোমরা নতুন এসেছ কিনা !

ধনকেষ্ট বলে,—এসো হে ভুবন। ভদ্রলোকের ছেলেদের ওসব কথা শোনাতে নেই । চলে যায় ওরা ।

ফটিক বলে,—শাসাচ্ছে? ঠিক আছে!

নসুবাবুর ভোটের লোকজন অবশ্য কিছু আছে। পাড়ার কিছু বেকার ছেলে পোস্টার লাগা আশেপাশের গ্রামে। চোঙা ফুঁকে এপাড়া ওপাড়ায় প্রচার করে। তবে ধনকেষ্টর লোকবল বেশি। লোকটা পরপর দুবার ভোটে জিতে অঞ্চল প্রধানের আসন অলঙ্কৃত করে এর মধ্যেই তার আখের গুছিয়ে নিয়েছে। নিজের ধানকল আছে, গঞ্জে সিমেন্ট লোহার হোলসেল এজেন্ট। এছাড়াও নানা ব্যবসা আছে। ছেলের নামে বাঁধ-রাস্তা তৈরির ঠিকাদারির কাজও বের করেছে।

লাখ লাখ টাকা মঞ্জুর হয় নদীর বাঁধের জন্য। যাতে বন্যার জল বাঁধ ভেঙে এই এলাকায় না ঢোকে, ফসল নষ্ট না হয়। কিন্তু বাঁধের মাটি ফেলা হয় অদ্ভুত কৌশলে। পরের বর্ষাতেই নদীর জলে জরাজীর্ণ তাপ্পিমারা বাঁধ ভেঙে যায়। বন্যার জল এসে সবুজ ধানখেত ডুবিয়ে ফসল নষ্ট করে, রাস্তাও ভেঙে দেয়। তখন আসে বন্যাত্রাণের টাকা, গম, কম্বল। সে সব বিলির মালিক ধনকেষ্টবাবু। সেখান থেকেই সিকি ভাগ তার পেটোয়া লোকদের বিলি করে বাকি সব মাল অন্ধকার পথে বিক্রি করে দিয়ে টাকা ঘরে তোলে সে।

এ যেন সোনার খনি। হাত মুঠো করে তুললেই পয়সা। তাই ধনকৃষ্ণবাবু এহেন রাজ্যপাট হাতছাড়া করতে চায় না। আর এতদিন বেশ ছিল সে। হঠাৎ নসুবাবুকে ওই পদের দিকে হাত বাড়াতে দেখে এবার প্রমাদ গনে সে। তাই মরিয়া হয়ে উঠেছে। নসুবাবুকে যেভাবে হোক ভোট থেকে সরাতে হবে। কারণ সে বুঝেছে এলাকার বেশ কিছু মানুষ তার এই উন্নতিতে মনে মনে ক্ষেপে উঠেছে।

ধনকেষ্টবাবুর ব্যবসা বাণিজ্যে বেশ কিছু আজেবাজে লোককেও পুষতে হয়। এখন তাদেরও দরকার। ভালো কথায় কাজ না হলে বাঁকা পথই ধরতে হবে। আর সেই লোকগুলো বাঁকা পথের হদিশ ভালো ভাবেই জানে ৷

বল্টু, পরেশ, মদনারা ছিল বখাটে বেকার। হাটে গঞ্জে মস্তানি করত। বল্টুটা তো পাকা ডাকাত। দু-একবার ডাকাতির কেসেও ফেঁসেছিল। ইদানীং সে বোম-টোমও বাঁধতে শিখেছে। ছেলেটার কয়েকজন ল্যাংবোটও আছে।

সেবার বন্যাত্রাণের সময় বেশ কিছু গ্রামের লোক ঠিকমত সাহায্য না পেয়ে ধনকেষ্টকে ঘেরাও করেছিল পঞ্চায়েত অফিসে।

তাদের অভিযোগ অনেক। অবশ্য তার জন্য তারা সদরেও দরখাস্ত করেছিল। তখন ছিলেন এক দুদে ছোকরা ম্যাজিস্ট্রেট।

রিলিফের অনেক মাল এসেছিল। গম, চাল, কম্বল, ত্রিপল – লাখ লাখ টাকার মাল। সে সব মাল গুদামে সরিয়ে দিয়ে, সামান্য কিছু মাল বাইরে রেখে, তার নিজের দলের লোকদের মধ্যে ভাগ করে বাকি সব মাল পাচার করার ব্যবস্থা করেছিল নদীপথে।

কিন্তু ওই সব বেআদব গ্রামবাসীরা গুদাম ঘেরাও করে। তারা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে দেখাবে হাতে নাতে। ধনকেষ্ট বিপদে পড়ে যায় ৷

কয়েকশো লোক ঘিরে আছে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আসছেন। এমন সময় বল্টুর দল রাতের অন্ধকারে বোমা মেরে গোলমাল বাঁধিয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। গ্রামের সাদাসিধে মানুষ ভয় পেয়ে দে দৌড়। ওদিকে আকাশে গুলির শব্দ ওঠে। কে যেন রটিয়ে দেয় ডাকাত পড়েছে। ধনকেষ্টবাবুও ছাদে উঠে আর্তনাদ করে,—বাঁচাও, বাঁচাও !

জনতা তখন গুলি, বোমার শব্দে ভীত। কে কোনদিকে মিলিয়ে গেছে।

পরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এসে খবর পান গতকাল ক্রুদ্ধ জনতাই সব রিলিফের মাল লুটপাট করে নিয়ে গেছে। ধনকেষ্ট ও তার কয়েকজন লোক আহত। গুদাম ছড়িয়ে পড়ে আছে কিছু মাল। বাকি রাতারাতি সব উধাও।

এহেন ধনাবাবু এবার যেন বিপদের গন্ধ পেয়েছে। তাই সন্ধের পর ওই ছেলেদের দেখে একটু ঘাবড়ে যায়। কলকাতা থেকে নাকি সবে একদল এসেছে, আরও দলবল আসবে। আর স্থানীয় লোকদেরও বিশ্বাস নেই ।

তাই বল্টু, নন্টে, মন্টারা এসেছে ধনকেষ্টবাবুর ডাকে। তারাও জানে ওই ধনকেষ্টবাবুই তাদের ভরসা। কারণ হাটে গঞ্জে ওরা চুরি করে, হাটের ব্যাপারীদের কাছ থেকে ধমক দিয়ে নজরানার টাকা তোলে। ধনাকেষ্টবাবুর রাজত্বে তারা সুখে আছে।

ধনকেষ্টবাবুর রাজ্যপাট চলে গেলে জনতা মায় পুলিশও তাদের এবার ছাড়বে না। তাই বল্টুরা এসেছে নিজেদের পিঠ বাঁচাতে।

সব শুনে বল্টু বলে,—এত ঘাবড়াচ্ছ কেন কেষ্টদা? আমরা থাকতে তোমাকে ভোটে কে হারায়? এক ব্যাটাকেও ভোটের দিকে এগোতে দেব না। দেখবে সব ভোটই পড়বে তোমার নামে।

ধনকেষ্টবাবু বলে,—এবারের ব্যাপার আলাদা। নসুবাবুকে এলাকার মানুষ ভালোবাসে। হাজার হোক জমিদার বংশ। নামী ঘর।

বাজারে ধনকেষ্টবাবুর বাবার মুদিখানার দোকান ছিল। আর ধনকেষ্ট তখন থেকেই দোকানে বসে দাঁড়িপাল্লাতে খেল দেখাতো। পাঁচশো গ্রাম মাল দেখাতো চারশোকে। হাতের সাফাই ছিল। তাই অনেকে বলত চোর কেষ্টা।

এখনও আড়ালে অনেকে ওই নামেই ডাকে। তাই নসুবাবু দাঁড়াতে বিপদেই পড়েছে ধনকেষ্ট।

বল্টুর চ্যালা গালকাটা গোবিন্দ বলে,—বলো তো উড়িয়েই দিই নসু-ফসুকে।

গোবিন্দ ওসব কাজ ভালোই পারে। এর আগেও একটা জমি দখলের জন্য সেই জমির চাষী রমেশকে খুন করে নদীর জলে ডুবিয়ে দিয়েছিল। সে কথা এখনও কেউ জানে না। এবারও তাই করতে চায় সে।

কিন্তু ধনকেষ্টবাবু জানে এতে বিপরীত ফলই হবে। আর রমেশের মত গরিব চাষীকে খুন করা যত সহজ, নসবাবুকে ওটা করা তত সহজ হবে না। ধরা পড়লে ফাঁসিই হয়ে যাবে । ধনকেষ্টবাবু বলে,—ওসবের কথা ভাবিস না। ক্যানভাস্ কর ভোটের জন্য। আর কিছু জনসেবামূলক কাজ নিয়ে লোকের কাছে।

বল্টু বলে,–লোকে যে আমাদের ভয় পায়, যা তা বলে। এড়িয়ে যেতে চায়। তাই ওসব তেল দিয়ে ভোট নয়, স্রেফ ধমকি দিয়েই কৌশলে তোমাকে জিতিয়ে দেব, দ্যাখো না ! ধনকেষ্টর ভাবনা তবু যায় না।

এদিকে আমরাও বসে নেই। দুচারটে ক্লাবের ছেলেরাও এসে নসুমামার পিছনে দাঁড়িয়েছে। সুশীল তাদের দিয়ে হাটতলায়, আশেপাশের গ্রামে মিটিং করছে। নসুমামা বলেন,—এবার তোরাই ভোটের প্ল্যান-টান কর।

এসব ব্যাপারে হোঁৎকা-গোবরার মাথা খোলে। পটলা বুদ্ধি যোগায়। আমি বেশ ভাষা দিয়ে কোথাও রবীন্দ্রনাথ, কোথাও লেনিনের কোটেশন দিয়ে, নরম গরম ভাষায় ইস্তাহার ছাড়ি। আর ফটিক গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে পথসভা মাইকে দারুণ ফাটাফাটি মার্কা গান গেয়ে লোক জুটিয়ে আমাদের প্রার্থীর জয়গান করে ।

ওসব ছাড়াও হোঁৎকা আর একটা বুদ্ধি বের করেছে। এটা তার একেবারে অরিজিন্যাল আইডিয়া । বাগনানের ওদিকে তার পিসেমশাই-এর বাড়ি। তাদের আবার বাজি পটকার বিরাট কারখানা। নানা রকম বাজি, রংমশাল, হাউই, তুবড়ি এসব তৈরি হয়। হাউই বানায় অপূর্ব। হোঁৎকা এবার পিসেমশাই-এর কোম্পানি থেকে বেশ কিছু মাল আমদানি করেছে।

সেদিন হাড়মাসপুরের হাট বসেছে। নসুমামাদের জায়গাতেই বহুকাল আগে থেকেই এই হাট-এর পত্তন হয়েছিল। এখন এই গ্রাম ও আশপাশের গ্রামের আয়তন বেড়েছে। ফলে হাটে মালপত্র যেমন আসে, তেমনি কেনার লোকজনও আসে প্রচুর।

হাট একেবারে জমজমাট।

এর মধ্যে বটতলায় তক্তপোশ দিয়ে স্টেজ বানিয়ে সেখানে মাইক আর গাছের ডালে চোঙা ফিট করে, বিরাট একটা বাঁশের সাইকেল বানিয়ে প্রতীক বানিয়েছে ধনকেষ্টবাবুর দল। বল্টুর চ্যালারা তদারক করছে। আর মঞ্চে ধনকেষ্টবাবুর গলায় কে যে গাঁদা ফুলের মালা দিয়েছে জানি না—সেই মালা পরে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছে! মঞ্চে আরও দুজন শীর্ণ টাকমাথার লোক। একজন সিঁটকে গলাবন্ধ কোট পরে বসে আছে, মুখের মধ্যে ঝুরো গোঁফগুলোই নজরে পড়ে।

চারদিকের পাঁচিলে পোস্টার সাঁটা ‘ধনকৃষ্ণ পালকে সাইকেল মার্কা ছাপে ভোট দিন।’ ধনকেষ্টবাবুও দুহাত নেড়ে নেচে নেচে ভাষণ দিচ্ছে,—ভাইসব ওই নসুবাবু কি করেছে তোমাদের জন্যে ?

কিছু না!-বল্টুর জনতা চিৎকার করে।

এবার জোর পেয়ে গলা আর একপর্দা ওপরে তোলে ধনকেষ্ট,—তবে ওকে কেন ভোট দেবে? ভাইসব, আমি তোমাদের জন্যে খরায়, বন্যায় কত সাহায্য দিয়েছি। পথঘাট করেছি। তোমাদের জন্যে ডাক্তারখানা করিয়েছি।

কে যেন বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে চিৎকার করে,—ডাক্তার নাই, ওষুধও নাই, সব কোথায় যায়?

ধনকেষ্ট এহেন মন্তব্যে মাইকের সামনেই গর্জন করে,–কে র‍্যা?

হেসে ফেলে জনতা? ধনকেষ্টবাবু চুপ। বল্টুরা অভয় দেয়,—বলো কত্তা! চালাও | সাহস পেয়ে আবার শুরু করে ধনকেষ্টবাবু,—ভাইসব, আমার পেছনে বাঁশ দিতে চায় অনেকে, আমি সর্বত্যাগী অকুতোভয় দেশসেবক।

বেশ চলছে মিটিং। হঠাৎ শূন্যে কয়েকটা শব্দ ওঠে। যেন আকাশে বোমা ফাটছে। হাটতলার মানুষ হৈ চৈ করে ওঠে। মিটিং থেকে কলরব ওঠে, সকলে চাইছে উপরের দিকে। দেখা যায় আকাশে বড় বড় হাউই-এর মত কি উঠছে আর আসমানে শব্দ ফাটছে। সেই সঙ্গে শয়ে শয়ে, লাল নীল কাগজ হাওয়ায় ভেসে ভেসে নীচে নামছে।

কে বলে,–নোট বৃষ্টি হচ্ছে !

কেউ কেউ আসমানী নোট ধরে ভাগ্য ফেরাবার জন্য, কেউ নিছক কৌতূহল বশেই ভেসে আসা কাগজের পিছনে ছোটে।

শান্ত হোন, চুপ করে বসুন। ভাইসব!-চিৎকার করছে ধনকেষ্ট।

বল্টুরা ছত্রভঙ্গ মিটিং আবার শুরু করার জন্য চিৎকার করে। ধনকেষ্টবাবুও মঞ্চ থেকে নেমে একগলা মালা পরা অবস্থায় জনতাকে বসাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু ওই কাগজগুলো তখন হাতের কাছাকাছি এসে গেছে।

সারা হাটে তখন অসংখ্য কাগজ উড়ে আসছে। সকলেই কাগজ ধরার জন্য ব্যস্ত। তার মধ্যে দু’চারজন ধরে ফেলেছে কয়েকটা কাগজ ।

একসময় নন্দলাল গ্রামে ফিরে এল। হাটতলায় একটা ছোট ঘর নিয়ে ডাক্তারি শুরু করল। গরিবদের ভিড়ই বেশি হয়। নন্দলালের টাকার খাঁইও বিশেষ নেই। কিছু ধানজমি আছে । পৈতৃক পুকুরে মাছের চাষে আয় হয়। তাই অল্প পয়সায়, কখনোও অ্যালোপ্যাথি, কখনও হোমিওপ্যাথি করে।

ক্রমশ তার নাম ছড়িয়ে পড়ে সারা এলাকায়। সেবার আদর্শ নিয়েই ডাক্তারি করে, তাই এলাকার সাধারণ মানুষও তাকে মানে, ভালোবাসে।

সেবার অনেকে একসঙ্গে মিলে নন্দলালকেই ভোটে দাঁড় করায়। নন্দলাল রাজি হয়নি। বলে—ডাক্তারি করছি এই ভালো ওসব রাজনীতি ফাজনীতি, ভোটের মধ্যে আমি নেই ।

কিন্তু ওদের চাপেই শেষপর্যন্ত রাজি হতে হয় নন্দলালের মত সৎ মানুষকে। আর তখনই নন্দলাল দেখে ধনকৃষ্ণবাবুর আসল স্বরূপটাকে।

ধনকৃষ্ণ একদিন রাতে ডিসপেনসারিতে আসে। তখন রোগী নেই। হাটতলাও নিঝুম। নন্দলাল দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরবে। ধনকেষ্ট বলে,—ডাক্তার, এসব ভোটে-ফোটে দাঁড়ানো তোমার কম্ম নয়। তুমি নাম তুলে নাও। অবশ্য তার জন্য তোমাকে দশহাজার টাকা

দেব।

তখন ওই টাকার অনেক দাম। অযাচিত ভাবে এত টাকা দিতে আসছে তাকে ধনকেষ্ট! তার কাছে এক পয়সা মা বাপের চেয়েও দামি। হাড় কেপ্পন লোক। সেই লোক তাকে এত টাকা দিতে এসেছে দেখে নন্দলাল অবাক হয় ৷

ধনকেষ্ট বলে,–তোমার ভোটে খরচা তো হয়েছে।

নন্দলাল এমনিতে সৎ, কিন্তু একজায়গায় সে কঠিন। জেদী। সে-ও বুঝেছে, লোকে ধনকেষ্টকে যেসব অপবাদ দেয়,—সেটা সত্যিই।

নন্দলাল বলে,—যাদের কথায় দাঁড়িয়েছি, তাদের সঙ্গে কথা না বলে নাম তোলা ঠিক হবে না। ওদের সঙ্গে কথা বলে জানাব ?

ধনকেষ্টও ঘোড়েল লোক। সে বুঝেছে ব্যাপারটা। তাই বলে,—তাহলে নাম তুলে নেবে না? লড়বে ভোটে আমার সঙ্গে?

কথাটার মধ্যে হুমকির সুর শুনে নন্দলাল বলে,—তাদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে তবেই জানাব ।

ধনকেষ্ট বের হয়ে যায় ।

যথাসময়ে নন্দলাল দেখেছে ধনকেষ্টর প্রকৃত স্বরূপ।

রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘের মত হিংস্র হয়ে উঠেছে সে। আর বল্টুর দলও তৈরি। নন্দলাল দেখে ওরা লোকের ঘরে ঘরে গিয়ে শাসায়—ভোট দিতে কেউ যাবে না।

তবু ভোটের দিন বেশ কিছু লোক জোর করে ভোট দিতে যায়। বল্টুর দল বোমা মেরে তাদের কয়েক জনকে আহত করে। ফলে আর কেউ বেরোয় না। পুলিশ ধনকেষ্টর কাছারিতে বসে তখন চা সিঙাড়া রাজভোগ খাচ্ছে। বল্টুরাই সব ভোট দিয়ে দেয়। ফলে ধনকেষ্টই আবার ‘জনগণ’ কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে মসনদে বসে ।

এবারও সেইভাবেই বসতে চেয়েছিল ধনকেষ্ট, কিন্তু নসুবাবুই এবার ঝামেলা পাকিয়ে তুলেছে।

পটলা আমি গোবর্ধন হোঁৎকা বের হয়েছি পথসভা করতে। হাটের ওদিকে যাচ্ছি, হঠাৎ নন্দলালবাবুর ডাকে চাইলাম।

সেদিন হাটবার নয়, তাই হাটতলাও শুনসান। ওদিকে দু’একটা বাঁধা দোকান, লোকজন বিশেষ নেই। দু’একটা গরু হাটতলার চালা দখল নিয়ে নিশ্চিন্তে জাবর কাটছে।

ডাক্তারখানার সাইনবোর্ডটা পুরোনো, নামটা রোদে জ্বলে গেছে। কয়েকটা বেঞ্চ পাতা। নন্দলালবাবুকে দেখে সুশীল বলে,—এখানকার ডাক্তার, নন্দবাবু।

নামটা আগেই শুনেছি। নন্দলালবাবু বলে,–তোমরা এসেই সাড়া ফেলেছ হে। ত ধনকেষ্ট কিন্তু খুব সেয়ানা লোক। সাবধানে থাকবে। তোমরা এসেছ তাতে ও খুশি হয়নি।

হোঁৎকা বলে,—তা হইবই। তয় দৈববাণী তো কাল হইছে।

নন্দলাল বলে,—ওর চ্যালারা অবশ্য ঠিকই বের করবে কাদের কাজ। ওই বল্টু, গালকাটা গোবিন্দদের থেকে সাবধানে থাকবে।

আমি বলি,—ওদের উপরও নজর আছে। তবে ধনকেষ্টর মুখোশ খুলতেই হবে। কিন্তু গাঁয়ের লোকদের ও কাছে ভিড়তে দিচ্ছে না।

নন্দলাল বলে,—সন্ধের পর কাল যাব। কথা হবে।

দেখি হাটতলার ওদিকের চালার নীচে দু’একজন ঘোরাঘুরি করছে। সুশীল বলে,—ওদের দেখেছিস? ধনকেষ্টর চামচা।

অর্থাৎ আমাদের উপরও নজর রেখেছে ওরা। হোঁৎকা বলে,—ওগোর ধনকেষ্টরে এবার পথেই বসাইমু !

দুপুরে খেয়ে দেয়ে গোটা দশেক সাইকেল নিয়ে আমরা বের হবো ওদিকের কোনো গ্রামে। নসুমামা আমাদের থাকা খাওয়ার কোনো অসুবিধাই রাখেনি।

এর মধ্যে নসুমামা পল্লী উন্নয়নের কাজও শুরু করেছে। হোঁৎকা-গোবর্ধন ছেলেদের নিয়ে পচা ডোবার পানা তুলে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের কাজে শামিল হয়েছে। পাড়াগাঁয়ের মানুষর আমাদের নিঃশর্ত সেবার জন্য নসুমামাকে ধন্যবাদ দেয় ।

নসুমামা ভাষণ দেয়,—মুখের কথাকে নয়, হাতে কাজ করে পল্লি উন্নয়ন করতে হবে ওদিকে ভাঙা রাস্তায় মাটি পড়ছে। যেসব কাজে টাকা মেরেছে ধনকেষ্ট, সেসব কাজ আমরাই করব। দেশের মানুষদের স্বাবলম্বী করতে হবে।

সেদিন হাটতলায় ধনকেষ্টবাবুর মিটিং হবে। সারা এলাকার মানুষকে জানানো হয়েছে সেখানে শ্রোতাদের নাকি লুচি আর বোঁদে দেওয়া হবে।

নসুমামা ভাবনায় পড়ে। লুচি-বোঁদের লোভ সাংঘাতিক। জনসমুদ্র হবে ওখানে। নসুমাম ভাবছে বসে বসে। আমরা তখন পচা ডোবায় পানা তুলছি।

সন্ধের পর ঘরে ফিরে দেখি, আমাদের ঘরটা কারা তছনছ করে গেছে। অবশ্য জিনিসপ কিছুই নেয়নি। হোঁৎকার সেই ব্রহ্মাস্ত্র, অর্থাৎ ইস্তাহার ঠাসা বাকি কিছু হাউই নসুমামার ঘরে রাখা ছিল উপরের তাকে। সেগুলো নেই।

নসুমামা এসে পড়ে—কি ব্যাপার ?

হোঁৎকা বলে,–দ্যাহেন কাণ্ড, হালায় কারা ঘরে ঢুকছিল স্পাইগিরি করছে, ইস্তাহারও নাই ।

সর্বনাশ!—নসুমামাও অবাক হয় !

আমি বলি,—এসব কেউ করে গেছে, কারা এসেছিল এখানে ? সুশীলই খবর দেয়,—পঞ্চাকে দেখেছিলাম এদিকে।

পঞ্চা এ বাড়িতে কাজ করে। নসুমামা বলে, – পঞ্চা? কই সে?

পঞ্চার দেখাও মেলে না। পটলা বলে,—ব্যাটা কে-কেটে পড়েছে বোধহয় মাল নিয়ে এমন সময় গোবর্ধন নন্দলাল ডাক্তারকে নিয়ে ফিরেছে। নন্দলাল ঘরের অবস্থা আর ওই সব মাল চুরির কথা শুনে বলে,—পঞ্চা! ওকে তো দেখলাম একটু আগে ধনকেষ্টর বাড়িতে সে কি!—চমকে ওঠে পটলা। বলে, ওই স্-স্পাই। মামা জেনে শুনে ওবে রে-রেখেছেন?

নসুমামা ভাবতেই পারেনি যে তার ঘরের লোকদের মধ্যেই ধনকেষ্ট টাকা দিয়ে চর ঢুকিয়ে

রেখেছে।

নন্দলাল বলে,—তখন বলিনি, ধনকেষ্টর অসাধ্য কাজ কিছু নেই! ও সব পারে। সরষের মধ্যেই ব্যাটা ভূত ঢুকিয়ে দিয়েছে।

রাত নামছে। নন্দলালবাবু বলে,—নসুবাবু, আমি পারিনি। আপনাকে পারতে হবে। ওই শয়তান ধনকেষ্ট এই এলাকার মানুষকে পদে পদে ঠকিয়ে তাদের সর্বস্বান্ত করেছে।

অন্ধকারে একজন এসে পড়ে। লোকটার মাথায় একটা গামছা জড়ানো। পরনের ধুতির ওপর একটা ধুসো চাদর। হাতে একটা লাঠি আর হ্যারিকেন।

-ডাক্তারবাবু?

নন্দডাক্তার বলে, – নটবর ?

নটবর বলে,–ছেলেটার খুব অসুখ!

নন্দ বলে,—যাব। বসো নটবর।

লোকটা কুণ্ঠিত ভাবে বসে বলে,—তা ভোটে এসেছেন আজ্ঞে এনারা ? নসুমামা বলে,—হ্যাঁ !

!

নটবর বলে, – পারবেন ওই শয়তানটারে হারাতে? এই অঞ্চলের গরিব চাষীদের বাঁচাতে পারবেন?

ওর কথার সুরে করুণ আবেদন ফুটে ওঠে। বলে,—ওই ধনকেষ্টর শয়তানি হাড়ে হাড়ে। গ্রামের কত চাষীর জমি যে জালিয়াতি করে নিজের করে নিয়েছে—তা বলার নয় !

নন্দবাবু বলেন,—শুনলে তো? আরও অনেক কীর্তির কথাই বলব। তবে খুব সাবধানে, পরে কথা হবে, চল নটবর ।

নন্দবাবু চলে গেল নটবরকে নিয়ে।

পটলা বলে,–ব্যাটা ড-ডাকাত!

হোঁৎকা বলে,—মনে হয় আমাগোর পিছনে মোক্ষম লাগবো। তবে পঞ্চা ব্যাটারে তরা কিছুই কবি না। ওর উপর নজর রাখবি। ওর দৌড়খানও দেখনের লাগবে।

নসুমামা বলে,—ব্যাটাকে চাবকে তাড়াবোই ।

হোঁৎকা বলে,—না। ওরে রাইখা দ্যান। কিছুই কইবেন না ।

গোবর্ধন বলে,—ও যেন জানতে না পারে ওর ব্যাপারটা আমরা জেনেছি। হোঁৎকা বলে,—হ। কাঁটা দিই কাঁটা তুলতি হইব। থাউক পঞ্চা য্যামন আছে।

ধনকেষ্ট লোকটা কূটকৌশলী। সে জানে কাজ উদ্ধারের জন্য যখন যেমন দরকার তখন সেই পথই নিতে হয়। লোকে বলে ধনকেষ্টর দুটো হাত—একটা লোকের গলায়, অন্যটা থাকে পায়ে। দরকার হলে পায়েও ধরতে পারে, আবার প্রয়োজন হলে অন্য হাত দিয়ে নির্মম ভাবে কারো গলা টিপে ধরে, তাকে দমবন্ধ করে শেষ করতেও দ্বিধা করে না।

ধনকেষ্ট নসুবাবুর বাড়ির কাজের লোক ওই পঞ্চাকে আগে থেকেই টাকাকড়ি দিয়ে হাত করেছিল।

পঞ্চাও জানে কেষ্টবাবুর কথা না মানলে তার বিপদ হবে। মানলে টাকাকড়ি তো পাবেই, তার ভাইটারও চৌকিদারির কাজ মিলবে কেষ্টবাবুকে ধরে। তাই পঞ্চা সহজেই টোপ গেলে ।

সে কলকাতার বাবুদের দেখভাল করে, তাদের আলোচনা, তাদের কাজের ফদও শোনে। সেই দেখেছে আমাদের ছাদ থেকে হাউই ছুঁড়তে। তার ভিতর থেকে ওই দৈববাণীর কাগজপত্র—চোরা কেষ্টার কাহিনি, এসব বের হতে দেখেছে সেই-ই ।

পঞ্চা নসবাবুর বাড়িতে এতদিন নিশ্চিন্তে ছিল। নসুবাবুর টুকটাক ফাইফরমাস খাটত, বাজারের পয়সা চুরি করেও টু-পাইস রোজগার হত। নসুবাবুর সংসারে প্রাণী বলতে নসুবাবু, তার স্ত্রী আর, ওই ভাইপো সুশীল। সুতরাং তাদের খেয়েও যা থাকত, সেটা কম নয়। আমরা আসায় তার বাড়া ভাতে ছাই পড়েছে। এখন বাজার করছে সুশীল।

তারপর আমরা এসে ওই ধনকেষ্টবাবুকেই ডোবাতে চাই। সুতরাং পঞ্চা আমাদের সহ্য করবে কেন? সেটা অবশ্য সে মুখে প্রকাশ করেনি।

এবার উঠে পড়ে লেগেছে আমাদের পিছনেই। সব প্রমাণ তুলে দেয় কেষ্টবাবুর হাতে। আর বলে,—নসুবাবুকে তাতিয়েছে ওই কলকাতার বাবুরাই, ওরাই সেদিন বড় বাড়ির ভাঙা ছাদে উঠে এ সব হাউই ছেড়েছিল। আরও কি সব যন্ত্র এনেছে কে জানে !

ধনকেষ্টর ম্যানেজার হরেনবাবু বলে,—এখানকার বহু ক্লাবকে মোটা টাকা চাঁদা দিয়েছি। ফুটবল, হ্যাজাক, সতরঞ্চি কিনে দিয়েছি।

ধনকেষ্ট গর্জন করে,—আর সেসব হজম করে ব্যাটারা এখন নসুর ওই কলকাতা পার্টির সঙ্গে ভিড়ে আমার সব্বোনাশ করছে!

বল্টু বলে,—হাউই ফাটাবে ব্যাটারা! বলো তো বোম ফাটিয়ে দিই ওদের ওপর।

ধনকেষ্ট জানে তাতে গোলমালই হবে। কলকাতার ছেলেরা বোমাকে ভালো করেই চেনে। আর হাউই যখন এনেছে, বোমা আনেনি তা হতে পারে না! বল্টুর দেশি বোমার থেকে কলকাতার বোমার জোর অনেক বেশি।

ধনকেষ্ট বলে,—ওসব এখন থাক। পঞ্চা, তুই বাবুদের উপর নজর রাখবি। ওদের কথাবার্তা কি হয় মন দিয়ে শুনবি, সব জানাবি আমাকে?

ধনকেষ্ট পঞ্চাকে শতখানেক টাকা দেয়। পঞ্চা খুশি হয়ে বলে,—সব খবরই পাবেন। তবে ছেলেগুলো মহা ধূর্ত। নিজেদের মধ্যে আবার ইংরেজিতে হট্ মট্ করে কথা বলে। সেসব তো বুঝি না ।

ধনকেষ্ট বলে,—তবু কান খাড়া রাখবি।

পঞ্চা বলে,—আজ্ঞে, আর একটা কথা ছিল। নন্দ ডাক্তার কাল থেকে খুব যাতায়াত করছে নসুবাবুর কাছে। আর দেখলাম ওই আলগাঁয়ের নটবর ঘোষও কাল আপনার জমি দখল করার কথাবার্তা বলছিল।

–সে কি! নন্দ গতবারে গোহারান হেরে এবার তার শোধ নেবার জন্যে নসুবাবুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে?

ম্যানেজার হরেন মিত্তির বলে,–সে কি! নন্দ ডাক্তারের হাতে ওই অঞ্চলের চাষী-জেলে অন্যসব ভোট বাঁধা। লোকটা ফোকটিয়া ডাক্তারি করে বেশ জমিয়েছে।…তখন বললাম আপনাকে—সরকারি ডাক্তারখানা সরকারের পয়সায় চালু করে দিন। নাম হবে আপনার, ভোটও বাড়বে। আর নন্দ ডাক্তারের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবে। তা করলেন না। ধনকেষ্ট অবশ্য তার চেয়ে বেশি লাভই করেছে। সরকারি ডাক্তারখানা খাতে বেশ কয়েক লাখ টাকা এদিক ওদিক করে নিজের পকেটেই পুরেছে।

সে কথাটা প্রকাশ করাও যাবে না। তাই ধমকে ওঠে ধনকেষ্ট, – থামো তো হরেন। বড্ড বাজে কথা বলো। সরকার টাকা দিলে তো! এখন কিছু একটা করতেই হবে।

পটলার বৈষয়িক বুদ্ধিটা আমাদের চেয়েও বেশি। বড়লোকের ঘরের ছেলে। নিজেদের বিরাট ব্যবসা। আত্মীয়-স্বজনদের অবস্থাও ভালো। অনেকেই পদস্থ চাকুরে। কেউ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, কেউ পুলিশের বড় কর্তা, কেউ আয়কর বিভাগের বড় অফিসার। পটলার মাথাটাও সাফ। মাঝে মাঝে বেশ জব্বর প্যাঁচও কষতে পারে।

এবার মোক্ষম প্যাঁচ কষেছে ধনকেষ্ট। গ্রামের পঞ্চাননতলার গাজনের সব খরচা, এবার নাকি ধনকেষ্টই দেবে। দুদিন ধরে সেখানে ঢালাও প্রসাদ বিতরণ করা হবে। যাতে এই এলাকার সকলেই ভরপেট প্রসাদ পায়। সেই সঙ্গে বস্ত্র বিতরণ, কম্বল বিতরণ।

সারা অঞ্চলে ধন্য ধন্য রব পড়ে গেছে। এই অঞ্চলের বয়স্ক লোকজন, মেয়েরা ধনকেষ্টর এহেন ভক্তির পরিচয় পেয়ে ধন্য ধন্য করছে।

নসুমামা বলে,—এত দান খয়রাত করলে ভোট তো সবাই ওকেই দেবে। তোরা এসে এত মেহনত করলি, সব জলে গেল। এবার নন্দ ডাক্তারের মত আমিও গোহারান হারব ?

নন্দবাবু বলে,—বলেছিলাম না, ওই কেষ্টার অসাধ্য কাজ কিছু নেই। আমাকে জোর করে হারালো, এবার তোমাকেও হারাবে।

হোঁৎকা বলে, – ব্যাটা শয়তানের ধাড়ি!

আমাদের শিবিরে সেই উন্মাদনা যেন উবে গেছে। বহু ক্লাবের ছেলেরাও হতাশ।

পটলা কি ভেবে বলে,—চাল, কাপড়, কম্বল ও পয়সা দিয়ে কিনে বি-বিতরণ করবে? নন্দবাবু বলে,—ছাই। ওসব রিলিফের মাল। কাউকে না দিয়ে নিজের গুদামে রেখেছিল। 1 গ্রামের মদনবাবু প্রবীণ লোক। বলেন,—অন্যায় অনাচারে দেশটা ভরে গেল হে। চোরদেরই এখন রাজত্ব।

পটলা বলে,–নে-নেভার। এর বিহিত হবেই।

কি ভাবছে পটলা? চা জলখাবার ক্ষীরের সন্দেশের স্বাদও পানসে লাগে ।

পটলা কি ভেবে বলে, কাল একবার সদরে যেতে হবে ।

কেন?–নসুমামা প্রশ্ন করে।

পটলা বলে,—কিছু ওষুধপত্রের দরকার। আর বাড়িতেও ওখান থেকে একটা ফোন করে দিতে হবে।

হোঁৎকা বলে,—তাই দিবি। সমীও সঙ্গে যাক। একা যাবি না।

নসুমামা বলে,—তাই ভালো।

সদর শহর কয়েক ঘণ্টার পথ। ভোর রাতেই বের হয়েছি দুজনে। গ্রাম ছাড়িয়ে বেশ কিছুদূর আসার পর একটা কাঁদর পড়ে। বর্ষাকালে এখানে তালগাছের ডোঙায় পারাপার করতে হয়। এখন অবশ্য জল নেই। তবে কাঁদরটা বেশ খাল মত। পথ এখানে মাঠের সমতল ছাড়িয়ে নীচে নেমেছে। সামান্য জল, পার হয়ে পথটা ওদিকে আবার উঠেছে মাঠের সমতলে। কাঁদরের ধারে কিছু জাম-অর্জুন গাছের জটলা।

তখনও দিনের আলো ফোটেনি, হঠাৎ নদীর মুখেই গাছের আড়াল থেকে দুজন লোককে উঁকি মারতে দেখে পটলা থামল। ও আগে ছিল, পিছনে আসছি আমি, আর বাসস্ট্যান্ড অবধি এগিয়ে দিতে আসছিল সুশীল। তার হাতে একটা খেঁটে লাঠি।

পটলাকে থমকে দাঁড়াতে দেখেই কোনো বিপদের আশঙ্কায় আমি থেমে গেছি। টর্চের আলোয় দেখা যায় দুটো লোককে গাছের আড়ালে। জোরালো টর্চের আলো চোখে পড়তে, তারা চমকে উঠেছে। সুশীল অবশ্য আগেই টের পেয়েছিল ওদের অস্তিত্ব । সে অন্ধকারে পিছন দিক থেকে গিয়ে সেই খেটে লাঠি দিয়ে একজনের মাথায় মারতে ‘বাপরে’ বলে সে ছিটকে পড়ে। এই অবকাশে আমি একটা শক্ত মাটির টুকরো তুলে সপাটে দ্বিতীয় জনের মুখে মারতে সে আর্তনাদ করে দৌড়লো অন্ধকারে। লাঠি খাওয়া লোকটাও আহত রক্তাক্ত অবস্থাতেই দৌড়চ্ছে।

পটলা বলে, –ক-কারা ওরা? চিনতে পারলি ?

সুশীল বলে,—ওই ধনকেষ্টর চ্যালা কালু—অন্যটাকে ঠিক দেখতে পাইনি।

এবার চমকে উঠি,—বলিস কি রে? ব্যাটারা তাহলে আমাদের যাওয়ার খবর পেয়ে গেছে ! কাল সন্ধ্যায় কথা হল, ওরা জানলো কি করে ?

এবার পটলাই বলে,—জানবে না? স্-স্পাই ওই পঞ্চা ব্যাটা তো কাল ছিল ঘরে।

সুশীল বলে,–ওরই কাজ। ও গিয়ে বলতে ধনকেষ্ট তোদের মারার জন্য এখানে ওদের পাঠিয়েছে।

পটলা বলে,–ডেঞ্জারাস লোক ওই ধনকেষ্ট। মার্ডার করতেও পারে দেখছি।

সুশীল বলে,—এসব করেই তো এত কিছু করেছে। খুন জখম করা ওর পক্ষে কিছুই নয়। পটলা বলে,—এবার ওর ব্যবস্থাই করছি। চল, বাস ধরতে হবে।

শহরে এসে পটলা বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা নিয়ে চলেছে। সঙ্গে আমি। ওর মতলব কিছুই বুঝি না। শুধোই,—শহরে কোথায় যাবি?

পটলা কি যেন ভাবছে। বলে,—চু-চুপ করে বসে থাক।

বেশ কিছুটা এসে পড়েছি। দোকান পসার, লোকজনের আসা যাওয়ার এখানে বেশ কম বাড়িগুলো আধুনিক ধরনের, প্রত্যেকটা বাড়ির লাগোয়া সাজানো বাগান। পাড়ার অধিবাসীরা যে অভিজাত তা দেখলেই বোঝা যায় ।

পটলা একটা গেটওয়ালা বাড়ির সামনে নামল। দেখি পেতলের নেমপ্লেট লাগানো—জি সি. রায়, অ্যাডিশনাল ডি. এম ।

গেট ঠেলে ভিতরে ঢুকতে দারোয়ান ওকে দেখে সেলাম করে। পিছনে আমি। একটু ঘাবড়ে গেছি। পটলা বলে,-আয়। আমার পি-পিসতুতো দাদার বাড়ি।

ওর পিসতুতো দাদা কোথাকার পদস্থ অফিসার তা শুনেছিলাম। কিন্তু এ যে সেই, তা বুঝি নি।

সাজানো ড্রয়িংরুম। জানলা দরজায় শান্তিনিকেতনী পর্দা, দামি সোফাসেট, ঝকঝকে পিতলের পটে কয়েকটা পামগাছ সাজানো ।

– —

একজন বয়স্কা অভিজাত চেহারার মহিলাকে প্রণাম করে পটলা। তিনি অবাক হন, পটল তুই !

পটলার পিসিমা হন। আমিও প্রণাম করতে তিনি বলেন,–বসো

পটল শুধোয়,–গোরাদা আছেন পিসিমা? পিসিমা বলেন, আছে, বাড়ির খবর বল! কেমন আছে দাদারা, মা?

পটলা বলে,—ভালোই। গোরাদার সঙ্গে জরুরি দরকার আছে। অফিস বেরুবার আগেই ধরতে হবে।

পিসিমা বলেন,–বোস, চা-টা খা, তারপর কথা হবে।

আদর আপ্যায়নের ত্রুটি হয় না। পিসিমা আমাকে বলেন,–তোমাকে দেখেছি ওদের বাড়িতে। এসেছ, খুব খুশি হয়েছি। খাও।

কেক, প্যাস্ট্রি আর কলা এসেছে। খিদেও পেয়েছিল, সেই ভোর রাতে বের হয়েছি। পথেও একটা ঘটনা ঘটে গেছে। যুৎ করে চা-টা খেতে খেতে পটলার গোরাদা এসে পড়েন। বলেন তিনি,—কি খবর রে পটলা ?

পটলা আমাদের বর্তমান কাজের ফিরিস্তি দিয়ে বলে,—এখন নসুমামার গ্রামেই রয়েছি। আর যা সব ঘটনা দেখছি, তাতে মনে হয় তোমরা সদরে বসে আছ সরকারি প্রশাসনের মাথায়। আর গ্রামে গ্রামে অপশাসন, শোষণ, আর সরকারি পয়সার লুটপাট চলছে।

গৌরাঙ্গবাবু বয়সে তরুণ। সৎ কর্মঠ অফিসার। তিনি বলেন,—ওসব কথা অবশ্য কানে আসে, কিন্তু কেউ সাক্ষ্য প্রমাণ তো কিছুই দিতে পারে না। তেমন সত্যিকার কেস প্রমাণ সমেত ধরতে পারলে তাদের শাস্তি দেবই।

পটলা বলে,—যদি সাক্ষী প্রমাণ সব দি-দিতে পারি ?

গৌরাঙ্গবাবু বলেন, –তাহলে কথা দিচ্ছি তার শাস্তি দেবই ।

পিসিমা জানেন পটলকে। একটা না একটা ঝামেলা বাধাবেই। এই নিয়ে অনেক কাণ্ডই ঘটেছে। পটলা বোধহয় এবারও তেমনি কোনো প্রবলেমে জড়িয়েছে। পিসিমা বলেন, আবার কি করবি পটলা ? ওইসব ঝামেলায় যাসনে। যারা ওসব কাজ করে তারা সাংঘাতিক লোক। তাদের অসাধ্য কিছু নেই।

গোরাদা বলে,—তাই বলে একদল লোক যা খুশি তাই করে যাবে? পাবলিকের সর্বনাশ করবে? ঠকাবে? পটল, সাক্ষ্য প্রমাণ যদি কিছু থাকে বলো, আমি দেখব।

পটলা এবার ব্যাগ থেকে একটা মোটা খাম বের করে। ক’দিন সে ঘুরে ঘুরে গ্রাম-গ্রামান্তরের বহুলোকের বেশ কিছু কেসের বিবরণ নোট করেছে। তাদের রসিদ-দরখাস্ত মায় রিলিফের কাগজের বেশ কিছু ফর্দও বের করে। সেখানে সই টিপছাপ সব রয়েছে।

নসুমামাই এসব তার কাছে দিয়েছে। নন্দ ডাক্তারও কিছু কাগজপত্র দিয়েছে।

কাগজগুলো দেখছেন গোরাদা। গণদরখাস্তটা পড়েন। বেশ কিছু গ্রামের লোক তাতে সই করেছে। রিলিফ নিয়ে যে কত অনাচার, বেআইনি কাজ হয়েছে, তার ফর্দও রয়েছে। রাস্তার কাজের হিসাব, বাঁধের হিসাবও রয়েছে। সর্বোপরি কয়েক লাখ টাকা খরচ করে সেই কাঁদরের উপর যে সাঁকোর কাজ হচ্ছে, তাও জানানো হয়েছে।

আমি বলি,—সাঁকো কোথায় রে? কাঁদর তো হেঁটে পার হলাম জল ভেঙে।

গৌরাঙ্গবাবু বলেন,–সে কি !

পটলা বলে,–গেলে প্রমাণ পাবেন। সেখানকার লোক ওই কেষ্টবাবুর ভয়ে কেউ মুখ খোলেনি। কারণ পুলিশ আইন সবই তাঁর হাতে। কেষ্টবাবু ক’বছরেই ধানকল করেছে প্রায় পঞ্চাশ লাখ টাকা খরচা করে, নিজের লঞ্চও আছে।

গৌরাঙ্গদা বলেন,—ওঁর সম্বন্ধে অনেক কথাই শুনেছি।

তারপরই ফোন করেন তাঁর এক ইনকাম ট্যাক্স অফিসার বন্ধুকে। তাঁর সঙ্গে ফোনে কেষ্টবাবুর বিষয়ে কি সব কথাবার্তা হয়।

গৌরাঙ্গদা বলেন,—আমাকে বেরুতে হবে। পটল তুই আজ থেকে যা। সন্ধ্যায় এ নিয়ে কথা হবে। আমি এই কাগজগুলো অফিসে নিয়ে যাচ্ছি, ও বেলায় এসে কথা বলব। পিসিমাও বলেন,– হ্যাঁ, কতদিন পর এল, ওকে আজ ছাড়ছি না ।

গাড়ি বের করে গৌরাঙ্গবাবু অফিসে চলে গেলেন।

ধনকেষ্ট তার দুজন বিশ্বস্ত চ্যালা ওই বল্টু আর গোপালকে পাঠিয়েছিল আমাদের উচিত শিক্ষা দিতে, যাতে আহত হয়ে আমরা রণে ভঙ্গ দিই।

ধনকেষ্ট আশা করেছিল কাজ ঠিক মতই হবে। কিন্তু তা হয়নি। উল্টে সকালে উঠেই তার অফিস ঘরে ওই দুই মূর্তিকে রক্তাক্ত অবস্থায় ফিরে আসতে দেখে চমকে ওঠে।

—তোরা !

গোপালের মাথার পিছনে জব্বর ঘা লেগেছে। এখনও ঘাড় সোজা করতে পারছে না। সুশীলের লাঠিটা বেশ জোরেই বসেছে। আর বল্টুর নাকে শক্ত মাটির ঢ্যালাটা বেশ নিপুণ ভাবেই মেরেছে। জামা কাপড়ে রক্ত। নাক মুখ ফুলে গেছে।

ধনকেষ্ট বলে,—অ্যাঁ, বল্টে, খুব যে মস্তানি করিস! তোর মুখের নক্সাই বদলে গেছে। আর গোপলা, গেলি ঘাড় সোজা করে, এলি অষ্টাবক্র মুনির মত বেঁকে চুরে! ওদের কিছুই করতে পারলি না, উল্টে প্যাঁদানি খেয়ে ফিরে এলি ?

নাক চেপে ধরে বল্টু বলে নাকি সুরে,—ব্যাঁটা সঁপাটে ঢিলটা মারলোঁ—

—আর গোপলা ?

গোপলা কাত মেরে ত্রিভঙ্গ মুরারী সেজে দাঁড়িয়ে আছে। সে বলে,–আচমকা পিছন থেকে ঝাড়লো যে।

ধনকেষ্ট গর্জে ওঠে,না ফুল ছুঁড়বে সামনে থেকে। অপদার্থ কোথাকার।

বল্টু বলে,–এর জবাব দেবই, ওই তোতলাটাকে চিনে রেখেছি। ওঁকে ছাঁড়বো না। —থাক! দু’দিন আর বেরুস না। আজকের মিটিং সেরে আসি।

ততক্ষণে বাইরের হলঘরে ইলেকশন পার্টির ছেলেরা এসে গেছে। চা আর গরম সিঙাড়াও এসেছে তার জন্য। ধনকেষ্ট বলে,—খরচা তো করছি। ভোটে না জিততে পারলে চা সিঙাড়া দুপুরের মাছ ভাত সব উশুল করব।

ছেলেরাও শুনেছে ঘটনার কথা। অবশ্য পুরোটা শোনেনি। দলের লিডারদের ওপর নাকি কাল রাতে নসুবাবুর ছেলেরা হামলা করেছে। ওরাও এবার ঘোষণা করে,–কেষ্টদা, ইঁটের বদলা পাটকেল। আমরাও ছাড়ব না। হুকুম দ্যান, রক্তগঙ্গা বইয়ে দিই।

ধনকেষ্ট জানে কখন কি করতে হবে, আর কাকে দিয়ে কোনো কাজ হবে। সকলকে তার গোপন কাজের খবরও জানতে দেয় না। তাই ওদের বলে,–শোন, অহিংস নীতিই আমার জীবনের নীতি, আদর্শ। নিঃস্বার্থভাবে সেবাই করব। ওরে, গৌরাঙ্গদেব কি বলেছিলেন ? মেরেছ কলসির কানা, তা বলে কি প্রেম দেব না? তেমনি যে যা করে করুক। নিজের সেবাধর্ম থেকে সরে যাবি না। সামনে পঞ্চাননের উৎসব, কত বড় যজ্ঞ! তার কথা ভাব। আর লোকদের শুধু জানাবি—এই অন্যায়ের কথা। তারা যেন নির্ভয়ে আমাকে ভোট দেয়। নে, জিলাপি খা, অমৃতি খা।

ছেলেরা ভক্তিভরে অমৃতবাণী শোনে আর অমৃতিতে কামড় দেয়। রসাল অমৃতি। রোজই ভোট হোক—অন্যসময় তাদের খবর কেউ নেয় না। ভোটের সময়ই তাদের কদর বাড়ে। ধনকেষ্ট বলে,—আর বিকালে গোপীনাথপুরে মিটিং। ওহে মাস্টার, এবার বক্তৃতাটা ভালো করে লিখে দিও। দেশ উদ্ধার, বেকার সমস্যা, রাস্তাঘাটের ব্যাপার—এসব লিখবে। আর, বাবা পঞ্চাননের মাহাত্ম্য, তার উৎসব পালন অবশ্য কর্তব্য সকলের—এসবও লিখো। আর হ্যাঁ—নিরক্ষরতা নিয়ে এখন হৈ চৈ হচ্ছে। দেশের মানুষকে সাক্ষর করার ব্রত নিয়েছি—এসব কথাও বেশ গুছিয়ে লিখো।

এমন সময় ম্যানেজার হরেনবাবু এসে কানে কানে কি বলে। রাতের অন্ধকারে লঞ্চ আসে। কলকাতা থেকে এদিক ওদিকে ঠেক খেয়ে ওই লঞ্চে বেশ কিছু চোরাই মাল—ইলেকট্রিক তার, পাম্পসেট, দামি বিদেশী কাপড়, ঘড়ি ইত্যাদি আসে। ওগুলো পরে সদরের মহাজনদের গুদামে পাচার করা হয়। খুবই গোপন ব্যবসা। ম্যানেজারের কাছে সেসব মালের ফর্দ আসে। আজও রাতে বেশ কিছু মাল এসেছে। ম্যানেজার সেই ফর্দ এনেছে।

ধনকেষ্ট খুশি হয়। পকেটে ফর্দটা পুরে ঘাড় নাড়তে নাড়তে ম্যানেজার চলে যায়। তারপর আবার ভোট নিয়ে পড়ে।

হোঁৎকা গোবর্ধনের দলও বসে নেই।

নসুমামা বলে,—আজ ভোরে পটল আর সমীরের উপর হামলা করতে গিয়েছিল মাঠের মধ্যে কাঁদরের ধারে।

সুশীল বলছিল,—কিছুই করতে পারেনি, উল্টে তারাই মার খেয়ে পালিয়েছে।

হোঁৎকা বলে,—তারা কারা? নিশ্চয়ই ওই ধনকেষ্টর লোক?

সুশীল বলে,—তাই মনে হল।

গোবর্ধন বলে ওঠে,-ওদের সাবাড় করতে পারলি না?

হোঁৎকা বলে,—মামাবাবু, আজ ওগোর ওপর হামলা করছে, এবার আরও বড় হামলাই

করতি পারে।

গোবর্ধন বলে,–আসুক না! মজা টের পাইয়ে দেব।

এমন সময় পঞ্চা চা নিয়ে আসে।

হোঁৎকা বলে,—মামাবাবু, হালায় আজ বৈকালে গোপীনাথপুরে ধনকেষ্টর মিটিং। –হ্যাঁ।

হোঁৎকা দেখে পঞ্চা উৎকর্ণ হয়ে শুনছে ওদের কথা।

হোঁৎকা গলা নামিয়ে বলে,–আজ ওই মাঠে মাটির তলে গোটা চারেক মাইন—মানে বিরাট বোমা রাইখ্যা এসেছি। তাতে চাপ পড়লেই স্টেজ মাইক সমেত ওই ধনকেষ্ট উইড়া গিয়া খতম হইব।

নসুমামা অবাক হয়। বলে,–সেকি রে? ওসব ‘মাইন’–ও তো সাংঘাতিক জিনিস! উড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে?

হোঁৎকা বলে,—আজ ভোরে পটলা সমীরে মারতি গুণ্ডা পাঠাইল–তার জবাব দিমু না? পঞ্চা চায়ের কাপগুলো নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। যেন কিছুই শোনে না ।

একটু পরেই ফটিক বলে,–হোঁৎকা তুই সাইকেল লই যা। দ্যাখ, পঞ্চা ব্যাটা কনে যায়।

জানলা থেকে দেখা যায় পঞ্চা পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে ওই বিশাল ভাঙা বাড়ির ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দিয়ে চলেছে।

ধনকেষ্ট তখন মিটিং-এর ব্যাপার নিয়েই ব্যস্ত। মিটিং-এর পর এন্তার লুচি বোঁদে প্যাকেটে করে বিলানো হবে। সেখানে আগেই লোক চলে গেছে। ভিয়েন বসেছে। খবর আসছে লোকজন জমায়েত হতে শুরু করেছে। ওদিকে মঞ্চও তৈরি করা হয়ে গেছে।

ধনকেষ্ট স্নানটান সেরে এখন ঘণ্টাখানেক ধরে পূজা পাঠ করে। মা কালী, শিবঠাকুর, মা লক্ষ্মী—নানা দেবদেবীর ভক্ত হয়েছে সে। রাধাকৃষ্ণের ছবিও আছে ঠাকুর ঘরে।

পুজো করে খেয়ে দেয়ে বেলা থাকতে বের হবে, এমন সময় পঞ্চাকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখল ধনকেষ্ট।

পঞ্চা নিশ্চয়ই ও বাড়ি থেকে জরুরি কিছু খবর এনেছে। তাই জিপে ওঠার মুখে ওকে ডাকল, –কি ব্যাপার রে?

পঞ্চা হাঁফাচ্ছে। বলে,—খবর সাংঘাতিক!

– কেন ?

গোপীনাথপুরের মাঠময় মাটির নীচে, এসটেজের নীচে ‘মাইন’, খুব বড় বড় বোমা গো—ওই কলকাতার ছেলেগুলো ওসব রেখে এসেছে। চাপ পড়লেই ‘বদাম’! একেবারে ফেটে স্বর্গে পাঠিয়ে দেবে সবাইকে। ওখানে মিটিং করবেন না বাবু ।

– অ্যাঁ ! বলিস কি!

ধনকেষ্ট ‘মাইন’ বোমা এসবের খবর রাখে। জানে কেমন শক্তিশালী জিনিস ওসব। আর কলকাতার বাঁদরদের বিশ্বাস করতে পারে না সে। ওদের পক্ষে ওইসব বোমা পুঁতে রাখা মোটেই অসম্ভব নয়। যদি উড়ে যায় রাজত্ব করা ঘুচে যাবে। তাই চিন্তায় পড়ে সে।

কিন্তু লোককে এসব কথা বলা যাবে না। তাহলে জনসাধারণ ভাববে যে ধনকেষ্টর চেয়ে ওই নসুবাবুই বেশি শক্তিমান। তাকে ভোটও দেবে না। সব ভোট যাবে নসুবাবুর দিকেই। তাই ধনকেষ্ট ওই ‘মাইন’ বোমা এসবের খবর চেপে রেখে আজ গোপীনাথপুরের মিটিং ক্যানসেল করে সেই মিটিং করবে পাশের গ্রাম – খাদিলপুরে।

ধনকেষ্ট তখুনি তার সৈন্যবাহিনীকে বলে,—ওখানে আজ মিটিং হবে না বলে দে গা, মিটিং হবে পাশের গাঁ খাদিলপুরে।

দলবল অবাক হয়।—আজ ওখানে লোকজন আসবে যে!

ধনকেষ্ট বলে,—যা বলছি তাই করগে। ওখানকার লোকদের বল, আমি খাদিলপুরে যাচ্ছি। তোরাও চলে আয়। আগের মিটিং ক্যানসেল।

দলের ছেলেরা সেই আদেশ পালন করতে দৌড়লো।

হোঁৎকা খবর পেয়ে যায়। কারণ এবার খবর হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। হোঁৎকা এর জন্য তৈরি ছিল। নসুমামাকে এবার বলে সে,—মামা, আমাগোর মিটিং হইব ওই গোপীনাথপুরেই। —তাই হবে। তৈরি হয়ে চলুন। গোবরা, তুই ছেলের দলকে চারদিকে তাই ঘোষণা করতে পাঠা। ধনকেষ্ট ভেগেছে—তার জায়গায় হবে নসু রায়ের নির্বাচনী সভা ।

আগে থেকেই হোঁৎকা তৈরি হয়ে ছিল। ওদিকে গোপীনাথপুরের জনতা তখন মাঠ ভরিয়ে ফেলেছে। ধনকেষ্টর সাইকেলও চলে গেছে সেখান থেকে। সেখানে জড়ো হয়েছে নৃসিংহ রায়ের হাঁড়ি চিহ্ন। বিশাল মাঠে এবার মাইক গম গম করে ওঠে–এখানের জনগণকে আজ অভিনন্দন জানাবেন আপনাদের প্রিয় নেতা নসু রায়। নসু রায়-জিন্দাবাদ।

মাঠে তখন ফটিকের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, অর্থাৎ নসুবাবুর প্রিয় দেশাত্মবোধক গান শুরু হয়েছে।

ওদিকে খাদিলপুরের মাঠে তখন শ’কয়েক কৌতূহলী জনতা মাত্র উপস্থিত হয়েছে। আর বাকি যারা আছে তারা ধনকেষ্টরই ছেলের দল। বল্টু এসেছে নাকে ব্যান্ডেজ করে, গোপলা আসতে পারেনি। কারণ এখনও সোজা হতে পারেনি ঠিকমত। কেরে কেরে চলছে।

ধনকেষ্টর মনমেজাজ ভালো নেই। গোপীনাথপুরের মিটিং ভয়ে বাতিল করেছে সে। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে মাস্টারের লেখা ভাষণটা বের করে পড়ছে।

—চামরমণি চাল দুশো বস্তা। রঙিন সোনি টিভি চোদ্দটি পাঠাতে হবে কাদুরাম ঢনঢনিয়াকে। দু গাঁট বিলাতী জিন, পাঁচ বস্তা লবঙ্গ, দু পেটি বল বিয়ারিং যাবে মোহনলাল দুধোরিয়ার গদিতে।

জনতা এই ভাষণের ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারে না। তারা অবাক হয়ে ওইসব ফর্দ শুনছে। ধনকেষ্টও পড়ে চলেছে।

হরেনবাবু ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। আজ সকালে সে ওইসব দু’নম্বরি চোরাই মাল লঞ্চে পাচার করেছে। তারই লিস্টটা দিয়েছিল ধনকেষ্টটা। ধনকেষ্ট সেটা পকেটে রাখে, মূল্যবান ভাষণটাও ওই পকেটেই ছিল। এখন ভুল করে ভাষণের বদলে ওই দু’নম্বরি মালের ফদই বের করে প্রকাশ্যে তার অন্ধকারের ব্যবসার খবর দিচ্ছে।

হরেনবাবু এবার মঞ্চে উঠে কানে কানে বলে,—এসব তো দু’নম্বরি কারবারের ফর্দ। মাইকে সেই কথাটাও ছড়িয়ে পড়ে। খাদিলপুরেও নসুবাবুর কিছু সমর্থক আছে। তারাও এবার চিৎকার করে,—দুনম্বরি ধান্দা করে মোটা টাকা কামাও! এসমাগলার !

এবার হুঁস হয় ধনকেষ্টর। সে দারুণ একটা বেফাঁস কাজ করে ফেলেছে। তখুনি রেগে উঠে হরেনকেই বলে, শালা !

জনতা গর্জে ওঠে,—গাল দেবেন না!

হৈ চৈ ওঠে। ধনকেষ্টর দলও ঝাঁপিয়ে পড়ে ।

জনতাও গর্জে ওঠে,—গলা দেবে, চোরাচালানি করবে, আবার শাসাবে? ভোট দেবো?- কাঁচকলা দেবো।

তারপরই শুরু হয়ে যায়, লণ্ডভণ্ড কাণ্ড। দু’চারজনকে বাধা দিতে জনতাও এবার মারমুখী হয়ে ওঠে। কে যেন ওই কাঠের সাইকেল প্রতীকটাকেই আছড়ে ভেঙে ফেলে।

মিটিং এখানেও হল না। জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ধনকেষ্ট গর্জায়,—এসব ওই নসুবাবুদেরই কাণ্ড। ওদের লোকরাই আমাদের মিটিং পণ্ড করেছে।

এইসময় বেশ কিছু ছেলে খবর আনে ধনকেষ্টর কাছে,–গোপীনাথপুরের মাঠে দারুণ লোক গে জুটেছে। এখানে আর লোক আসবে কেন? ওই মাঠে নসবাবুর দলের সাংঘাতিক অনুষ্ঠান, মানে নাচগান চলেছে। লোকজন সেখানেই বসে গেছে। তারপর নসুবাবুর বক্তৃতা ও হল।

চমকে ওঠে ধনকেষ্ট,অ্যা। ওই মাঠে নসুটা বক্তিতেও করেছে?

—হ্যাঁ গো। খুব কড়া কড়া কথা বলেছে। নন্দ ডাক্তারও ছিল।

কথাটা ধনকেষ্ট যেন বিশ্বাস করতে পারে না। হঠাৎ মনে হয়, পঞ্চাই বোধহয় নসুবাবুর টাকা খেয়ে তাকে এইসব গালগল্প শুনিয়ে ভয় দেখিয়ে ওই মাঠ থেকে তাড়িয়েছে। আর ওই মাঠে এসে নসবাবু মিটিং-এর নামে তার আদ্যশ্রাদ্ধ করেছে।

ধনকেষ্টকে সকলে মিলে যেন পথে বসাতে চায় ।

বাড়ি ফিরেই পঞ্চাকে ডাকিয়ে আনে ধনকেষ্ট। পঞ্চা খুশি মনেই বাড়িতে আসে। ধনকেষ্ট এবার সপাটে তার গালে চড় মেরে গর্জে ওঠে,– নেমকহারাম, আমারই টাকা খেয়ে আমার সঙ্গে গদ্দারি করবি? বিশ্বাসঘাতক, বেইমান কোথাকার!

পঞ্চা অবাক,—আজ্ঞে আমি কি করলাম ?

—কি করিসনি? তোর জন্য আজ গোপীনাথপুরে আমার মিটিং হল না। বেইজ্জত হলাম । মাঠে ‘বোমা’ ‘মাইন’ পুঁতে রেখেছে বলিসনি ?

পঞ্চা বলে,—যা শুনেছিলাম, আপনাকে বাঁচাবার জন্য ছুটে এসে তাই বলেছি। বিশ্বাস করুন।

বল্টু বলে,—ওই ছোঁড়াগুলোই আমাদের ঠকাবার জন্য এইসব গুল দিয়েছে কেষ্টদা। ছোঁড়াগুলো বোধহয় মালুম পেয়েছে পঞ্চা আমাদের সব খবর এনে দেয়।

ধনকেষ্টর এবার সম্বিৎ ফেরে। সে বলে,—অ্যাঁ। এতবড় শয়তানি করবে ওরা? উড়ে এসে জুড়ে বসেছে দেখছি !

গোপাল এবেলায় বাঁকানো পিঠ একটু সোজা করতে পারছে। তবু বের হতে পারেনি এখনও। মনে মনে তার রাগটা রয়েছে। বল্টুর নাক এখনও টন টন করছে। দলের সকলেই রেগে আছে ওই নসুবাবুর আমদানী করা ছেলেগুলোর উপর।

বল্টু বলে,—অনেক সহ্য করেছি, এবার জবাব দেব।

গোপাল বলে,—ওই তোলা ছেলেটাই পালের গোদা। ওটাকেই এমন মজা দেখাবো যে হাড়মাসপুরমুখো আর হতে সাহস পাবে না।

নসুমামা ক্রমশ, এবার পায়ের তলে যেন মাটি পাচ্ছে। সর্বত্রই তার মিটিংগুলোয় লোকজন ভিড় করছে। এই অঞ্চলের মানুষ ধনকেষ্টকে সহ্য করতে পারছে না, তার অন্যায় অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারেনি। এবার তারা সাহসী হচ্ছে।

সন্ধ্যার পর নসবাবুর নির্বাচনী অফিসে অনেকেই আসছে। নন্দলাল বলে,–এই ভাবে মিটিং আর টেম্পো চালিয়ে যাও ।

কে একজন বলে,—কিন্তু কেষ্টবাবু যে দানছত্র খুলছে। দরিদ্র নারায়ণকে ভোজন করাবে তিনদিন, কাপড় কম্বল বিলোবে, অনেকের কৃষিঋণও মাপ করে দেবে—তাদের ভোটও কম নয়।

এটা ভাবনার কথা ।

নন্দলাল বলে,—দেখাই যাক।

নসুমামা তবু দমে না। বলে,–শেষ অবধি লড়ব, দেখা যাক কি হয় ।

সেদিন সন্ধ্যায় পটলার পিসিমার বাড়িতে আমাদের জমাটি মিটিং বসেছে। গৌরাঙ্গবাবু তার চেনা জানা দু’তিনজন অফিসারকে এনেছেন, আয়কর দপ্তরের সেই অফিসারও এসেছে। তারা পটলার দেওয়া কাগজগুলোকে এর মধ্যে জেরক্স করিয়েছে।

একজন বলেন,—এ তো ক্রিমিন্যাল অপরাধ। এসব হচ্ছে তা শুনেছি, এবার প্রমাণ পেলাম ।

অন্যজন বলেন,–অফিস ফাইলগুলো দেখে নিতে হবে। নিশ্চয়ই ওরা মিথ্যা রিপোর্ট দিয়েছে।

আয়কর অফিসার বলেন,—লাখ লাখ টাকা আয় করেছে, অথচ এক পয়সাও ট্যাক্স দেয় নি সরকারকে।

গৌরাঙ্গবাবু বলেন,—এ তো খানিকটা আয় দেখছ। এহেন ব্যক্তি লঞ্চে করে কি ব্যবসা করে, সেটাও দেখার দরকার। খবর আছে অন্ধকার পথে শহরে প্রচুর বিদেশী মাল আসছে। পুলিশও চেষ্টা করছে ধরতে।

একজন বলেন,—ওসব কাজ এদের মত লোকই যে করছে না, তাই বা কে জানে!

ওঁদের আলোচনা শুনছি। মনে হয় ধনকেষ্ট খুব সাদামাটা লোক নয়। আমরা যেন কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপের ল্যাজের সন্ধান পেয়ে গেছি।

গৌরাঙ্গবাবু বলেন,—এসব আমাদের কাছে থাক, দেখা যাক কি করা যায়। তোমরা কাল ফিরে যাবে, আর এসব খবর কাউকে বলবে না। জানাজানি হলে সব ভেস্তে যাবে, উল্টে তোমাদের বিপদ হতে পারে।

আমরা পরদিন সকালেই সদর থেকে বাসে উঠেছি, নসুমামার গ্রামে ফিরতে হবে। সকালের বাস ছাড়তে তখনও দেরি আছে। শীতের দিন। শহরের ঘুম ভাঙেনি তখনও। হালকা কুয়াশা জমে আছে। বাস স্ট্যান্ডে চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে চা খাচ্ছি, দেখি দু তিনজন লোক এসে ওই দোকানেই ঢোকে।

লোকদুটোর মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথায় হনুমানটুপি আর চাদরে সর্বাঙ্গ ঢাকা। লোকদুটো ওদিকের বেঞ্চে বসে হাঁক পাড়ে,—দু’কাপ চা দাও হে। চারখানা লেড়ো বিস্কুটও দেবে।

গ্রামের লোক, এমন অনেক যাত্রীই আসে, লোকদুটো চা খাচ্ছে আর আমাদের দিকেই চেয়ে চেয়ে দেখে!

ওদিকে বাস ছাড়ার সময় হতে দুজনে গিয়ে বাসে ওঠে। এর মধ্যে বাসযাত্রী বোঝাই হয়ে গেছে। তার মধ্যে তরকারির ঝুড়ি, মাছের বড় বড় গামলা। বাস ছেড়ে দেয়।

শহর ছাড়িয়ে চলেছে বাসটা। কিছু লোকজন পথে নামতে, দেখি ওই লোকদুটোকে। পটলা বলে,—সেই লোকদুটো না ?

আমি বলি,–এই বাসে কোথাও যাবে হয়তো।

আমাদের স্টপেজ এসে গেছে। মাঠের মধ্যে স্টপেজ, গ্রাম অনেক দূরে। অবশ্য বাসরাস্তার ধারে দুচারটে চা পান বিড়ির দোকান, তেলেভাজা, মুড়ির দোকানও আছে। একটা কাঠগোলা ও রয়েছে ওদিকে।

আমরা নেমেছি, দেখি লোকদুটোও নামল। আমরা দুজনেই একটু সাবধান হই । লোকদুটোর মতলব যেন ভালো নয়। ওদের এড়াবার জন্যই চায়ের দোকানে বসলাম ।

লোকদুটো নেমে ওপাশের কাঠগোলার দিকে চলে গেল। পটলা বলে, —চ-চল। আমরা মেঠো সড়ক ধরি। এখানে পথটার দুদিকে বেশ ঝোপ-ঝাড় রয়েছে।

দুজনে গল্প করতে করতে আসছি, হঠাৎ দেখা যায় ঝোপের আড়ালে সেই দুজনকে। হাতে দুখানা লাঠি। কাঠগোলা থেকেই বোধহয় ওগুলো সংগ্রহ করে তৈরি হয়ে এসেছে। পটলা বলে,—দেখছিস?

আমিও দেখেছি ওদের। বলি,-দৌড়।

দুজনে তখন মেঠো রাস্তা ধরে একেবারে হাওয়ার বেগে দৌড় শুরু করেছি। লোকদুটো ভাবতে পারে নি যে এইভাবে আমরা নিমেষের মধ্যে দৌড় শুরু করব।

আমাদের দৌড়তে দেখে তারাও এবার মরিয়া হয়ে আমাদের পিছনে দৌড়তে শুরু করে।

কিন্তু দৌড়ে আমরাই এগিয়ে আছি। আর ওদের মধ্যে একজন বেশ মোটা। চাদর জড়িয়ে আলপথ দিয়ে দৌড়তে গিয়ে মোটকা লোকটা চাদরে লটাপটি খেয়ে পড়ে পাশের নয়ানজুলির জলকাদায়।

ফলে অন্যজনও থেমে গেছে। আমরা তখনও দৌড়চ্ছি। গ্রামের কাছে একটা পুকুরের ধারে গাছের নিচে বসে হাঁপাতে থাকি।

একজনকে শুধোই,কোন্ গাঁ ভাই ?

লোকটা কি একটা গ্রামের নাম করে। তাকেই বলি,—হাড়মাসপুরে যাব কোনো দিকে? লোকটা বলে,–সে তো ওই দিকে। ওই ডাইনের গাঁ পার হয়ে একটা মাঠ পেরুতে হবে। অর্থাৎ ওদের তাড়া খেয়ে আমরা সোজা যেদিকে পেরেছি দৌড়েছি। বেশ বেলাতেই পৌঁছলাম নসুমামার আস্তানায়।

ওরাও অবাক, এত দেরি?

ওদের কথাটা বলতে নসুমামা বলে,–জানতাম ধনকেষ্ট তোদের পিছনে লোক লাগাবেই। হোঁৎকা বলে,—আজ খেয়ে দেয়ে রেস্ট নে। আমরা অন্য গাঁয়ে মিটিং-এ যাচ্ছি।

পটলা বলে,—আমরাও যা-যাব।

ধনকেষ্টর হাতটা অনেক লম্বা। এই গ্রামেই নয়, জেলা-শহরেও তার একটা আস্তানা আছে। সেখানেও তার বিশ্বস্ত কিছু কাজের লোক আছে। অন্ধকার জগতের লোক তারা। ওদের মধ্যে ভবতারণ আর গদাই বেশ কাজের লোক। তারা এই গ্রামেও আসে। কয়েকদিন আগেও এসেছিল তারা এখানকার হেড কোয়ার্টারে। তারা জেনে গেছে যে তাদের মালিকের ভাতে হাত দেবার জন্য কলকাতা থেকে আমরা এসেছি।

আমরা উঠে পড়ে লেগেছি ধনকেষ্টর গদি কেড়ে নেবার জন্য। দলের মধ্যে আমাদের দুজনকেও দেখেছে তারা। শুনেছে আমাদের কথা ।

তাই ভবতারণ সেদিন শহরে আমাদের দু’একটা সরকারি অফিসে, আর জেলার বড়কর্তার সঙ্গে ঘুরছি দেখে, ভেবে নিয়েছিল আমাদের মতলব সুবিধের নয়। তাদের মালিকের গোপন খবরই বোধহয় দিতে এসেছি সদরের কর্তাদের কাছে।

আমাদের আটকে রেখে সব খবর বের করার জন্যই ওরা মতলব করেছিল। শহরের মধ্যে সেটা করা সম্ভব নয়, তাই লোকদুটো আমাদের পিছু নিয়েছিল।

কিন্তু আমরা তাদের চোখের সামনে থেকে এইভাবে পালাব, ওইভাবে শিকার হাত ছাড়া হয়ে যাবে, তা তারা ভাবতেও পারেনি।

ধনকেষ্টর মন মেজাজ ভালো নেই, চুপ করে বসে আছে সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে। এমন সময় ভবতারণ আর সেই মোটকা গদাই এসে হাজির হয়। একেবারে ঝোড়ো কাকের মত। ধনকেষ্ট ওদের দেখে শুধোয়,–কি ব্যাপার? কোনো গোলমাল হয় নি তো রে?

ভবতারণ বলে,–গোলমাল হয়নি এখনও, তবে হতে পারে।

কেন?—ধনকেষ্ট ভাবনায় পড়ে। বলে, আবার কি হল? ভবতারণ বলে,—নসুবাবুর ওই তোতলা ভাগ্নে আর ওদের দলের একটা ছেলেকে দেখলাম সদর শহরে কাছারিতে, রিলিফ অফিসে—অন্য সব জায়গাতে ঘুরছে একটা জিপে। অফিসারদের সঙ্গেও কি সব কথা বলছিল। গদাই বলে,—শুনলাম শহরের কর্তাদের কাছে কিসব দরখাস্ত, গোপন কাগজপত্রও দিয়েছে।

ধনকেষ্ট জানে তার সব কাজেই বহু গলদ, জালজোচ্চুরি করা আছে। সেসব কাগজপত্র কোনোমতে বাইরে গেলে, সদরের কর্তাদের নজরে গেলে, তার সমূহ বিপদ হবে। তাই চমকে ওঠে,–সে কি? ব্যাটারা এখানে আমাকে পদে পদে হেনস্থা করে এবার সদরে নালিশ করতে গেছে?

ভবতারণ বলে,—তাই মনে হল।

—ওদের ধরে গলা টিপে কথা বার করতে পারলি না?

ভবতারণ বলে,—তার জন্যই তো শহর থেকে ওদের পিছু নিয়ে এসেছিলাম, মাঝমাঠে

ওদের ধরেও ফেলতাম।

গদাই বলে,–ছেলেগুলো খুব স্যায়না। দেখে শুনে যা দৌড় মারল! ওদের ধরতে গিয়েই তো, এই দেখুন কি হাল হয়েছে। খালে পড়ে কাদায় জলে—!

ধনকেষ্ট গজরায়,–এই মুরোদ তোদের? দুটো ছেলে তোদের সামনে দিয়ে পালাল, আর তোরা দাঁড়িয়ে শুধু দেখলি? অকম্মার দল। একটার পর একটা কাণ্ড বাঁধিয়ে চলেছে ওরা, আর তোরা বসে বসে দেখছিস? ওই বাঁদরের দল এখানে আমাকে ঠকাচ্ছে, আর ওই তোতলাটা এবার সদরে গেছে! কি সর্বনাশ করবে কে জানে ?

উত্তেজিত ধনকেষ্ট পায়চারী করছে। উপস্থিত সকলে প্রমাদ গণে।

ধনকেষ্ট বলে,—ওই ছোঁড়াদুটোকে আমার চাই।

ভবতারণ, বল্টুও এবার তাদের এলেম দেখাতে তৈরি। তারা বলে,—তাই হবে। ধনকেষ্ট বলে,—তবে যা করবি খুব সাবধানে। কেউ যেন টের না পায় কিছু। দরকার হলে ওদের এমন জায়গায় তুলবি, কেউ যেন জানতে না পারে। তারপর দেখছি ওদের।

এমন সময় পঞ্চাও এসে পড়ে। পঞ্চা ধনকেষ্টবাবুর বিশ্বাস অর্জন করার চেষ্টা করছে। কাল ওই ছেলেগুলো তাকে ইচ্ছা করেই ভুল খবর দিয়েছিল। এখন সে আরও নজর রেখেছে।

আজ বিকেলে নসুবাবু অন্য গ্রামে মিটিং করতে গেছে। ক্রমশ তার দলেই লোক বেশি জুটছে। সাধারণ মানুষ এত ভাবে না। তারা দেখে হৈ চৈ লোকজন কোনদিকে বেশি ভিড়ছে।

তাছাড়া নসুবাবুর দলে নন্দ ডাক্তার এসে ভিড়েছে। ওই লোকটিকে এই অঞ্চলের মানুষজন সকলেই শ্রদ্ধা করে। তাই নন্দবাবুর জন্যও বহু লোক এবার প্রকাশ্যে ধনকেষ্টর বিরুদ্ধে গেছে।

পঞ্চা দেখে তাদের। আর সেইসব খবর দেবার জন্যই সময়মত যায় ধনকেষ্টবাবুর ওখানে। আজ দেখেছে নসীপুর, ভুবনপুর আরও দু’একটা গ্রামের মাতব্বররা এখানে এসেছে। পঞ্চা গেছে সেই খবর দিতে।

ধনকেষ্ট শুনে বলে, ওরাও এসেছে তাহলে?

পঞ্চা বলে,—হ্যাঁ। ওদের নিয়েই ধনপুরে বিরাট মিছিল হবে। সেই গানবাবুও দলবল নিয়ে গেছে। হোঁৎকা গোবরবাবুও গেছে। সেখানেও হাউই বাজি ছুঁড়বে গাঁয়ে গাঁয়ে ।

ধনকেষ্ট চটে ওঠে. –আমার নামে আবার সেই ইস্তাহার ছড়াবে? এখন আর কে আছে বাড়িতে?

পঞ্চা বলে,ওই তোতলাবাবু আর একজন ফর্সামত ছেলে আছে। ওরা ক’দিন ছিল না, আজ দুপুরে ঘেমে নেয়ে ফিরেছে। তাই ওরা আর যায়নি।

ধনকেষ্ট যাচাই করে,—ঠিক তো? না বাকিগুলোও আছে? ওদের বিশ্বাস নাই।

পঞ্চা বলে,—দেখলাম ওরা সবাই চলে গেল মিটিং-এ ওইসব নে। ওরা দুজন ঘুমুচ্ছে, তাই ছুটে এলাম।

ধনকেষ্ট বলে ভবতারণকে, – দ্যাখ, যদি কাজ হাসিল করতে পারিস।

আজ বেশ ক্লান্ত হয়ে ফিরেছি আমরা দুজন। তাই পটলা আর আমি ওদের মিটিং-এ যাইনি। স্নান করে খেয়ে দেয়ে লেপচাপা দিয়ে শুতেই ঘুমে দু’চোখ বুজে আসে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। শীতের সন্ধ্যা পাড়াগাঁয়ে অতর্কিতেই নেমে আসে। বেশ অন্ধকার। ঘুমটা ভেঙে যায় কাদের পায়ের শব্দে। মনে হয় হোঁৎকারা মিটিং থেকে ফিরেছে। পটলা তখনও ঘুমুচ্ছে। আমি শুধোই,—কিরে ফিরে এলি?

তারপরই কয়েকজন লোক আমাদের দুজনের উপর লাফিয়ে পড়ে। মুক্ত হবার চেষ্টা করি, কিন্তু লোকগুলো আমাদের ঠেসে ধরে নাকে রুমাল চাপা দেয়, ঝাঁঝালো মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ ওঠে। তারপরই আর আমাদের কিছু মনে নেই।

নসুমামা দলবল নিয়ে ভুবনপুর, নসীপুর আর কখানা গ্রামে বিরাট মিছিল মিটিং করে ফিরেছে। দেখে আমাদের ঘরে আলো জ্বলেনি। সারা বাড়ি শুনশান ।

হোঁৎকা বলে,—ওই দুটোতে এখনও ঘুমুচ্ছে !

এমন সময় অন্ধকার দাওয়া থেকে নেমে পঞ্চা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।

নসুমামা শুধোন,–কি হয়েছে?

পঞ্চা বলে,—সন্ধ্যার আগে বাবুরা উঠে বেড়াতে গেল, তারপর থেকে এখনও ফেরেনি। তারপরই আরও কাতরস্বরে বলে,—কত খুঁজলাম চারদিকে। হাটতলায়, মদনার চায়ের দোকানে—কোথাও পেলাম না। কি যে হল !

নসুমামা চমকে ওঠে, সে কি?

হোঁৎকা মন দিয়ে সব শুনছে। গোবর্ধন এমনিতে গোঁয়ার গোছের। সে পঞ্চাকে আগেই চিনেছে। ও যে ধনকেষ্টর গুপ্তচর, এতদিন জেনে শুনেও সে চুপ করেছিল।

এবার গোবর্ধন পঞ্চাকে সপাটে লাথি মেরে ছিটকে ফেলে দিয়ে বলে,—ওরা বেড়াতে গিয়ে হারিয়ে গেল তোদের এই অজ পাড়াগাঁয়ে—না? ইয়ার্কি মারার জায়গা পাসনি? তোর গুণের কথা সব জানি ব্যাটা বেইমান–ধনকেষ্টর কুকুর। বল-বল কি হয়েছে?

পঞ্চাও সত্যিকার ব্যাপারটা জানে না। ধনকেষ্ট কাঁচা কাজ করে না। পঞ্চা যখন ওইসব খবর দিতে গেছে, ধনকেষ্ট তাক বুঝে ওর পোষা গুণ্ডাদের এই বাড়িতে পাঠিয়েছে কাজ হাসিল করতে। আর পঞ্চাকে আটকে রাখার উদ্দেশ্যে বলে,—বাড়িতে কড়াইশুঁটির কচুরি হচ্ছে, গরম গরম খেয়ে যা ।

পঞ্চা মালিককে খুশি করার জন্য বসে থাকে।

এদিকে ধনকেষ্টর লোকজন ছেলেদুটোর মুখ হাত-পা বেঁধে অন্ধকারে পিছনের আমবাগান, বাঁশবনের মধ্যে দিয়ে উধাও হয়।

পঞ্চা কচুরি খেয়ে বেশ খুশি মনে বাসায় ফিরে দেখে সারা বাড়ি অন্ধকার। কেউ কোথাও নেই। আলো জ্বেলে দেখে দোতলায় ঘরে জামা কাপড় বিছানা ছড়ানো। ছেলে দুটো নেই।

প্রথমে ভেবেছিল বাবুরা ধারে কাছে কোথাও বেড়াতে গেছে। এদিকে এখন হাড়কাঁপানো ঠান্ডা পড়েছে। শীতের ধমকেই ওরা ফিরে আসবে। কিন্তু রাত ন’টা অবধিও ফেরেনি। তারপর বাকি বাবুরা এসেছে।

পঞ্চা বুঝেছে ধনকেষ্টবাবুর ওখানে তার যাতায়াতের খবর এরা জেনে গেছে।

এবার হোঁৎকা বলে, – ঠিক কইরা ক’ কি কেসখ্যান, নালি তর কেষ্টধনের বাপও তরে বাঁচাইতে পারবো না ।

হোঁৎকা সাঁড়াশির মত শক্ত হাত দিয়ে ওর গলাটা টিপে ধরেছে। ছটফট করছে পঞ্চা ৷ নসুমামাই বলে,–ছেড়ে দাও হোঁৎকা, মরে যাবে যে।

হোঁৎকা গর্জে ওঠে,–ওরে মার্ডারই করুম। হোঁৎকারে চেনে না। ক’ কি হইছিল। কি কইছস ওই কেষ্টারে ? ক!

পঞ্চাও বুঝেছে এবার শক্ত পাল্লাতেই পড়েছে সে। এ মেরেই ফেলবে তাকে। প্রাণের ভয় বড় ভয়। পঞ্চা বলে,–বলছি। ছাড়ুন।

হোঁৎকা ওর গলা ছেড়ে দিয়ে বলে,–ক’ কি হইছিল ?

পঞ্চা এবার বলে কথাগুলো। সব শুনে নসুমামা বলে,—ধনকেষ্টর ওখানে ওই লোকগুলো ছিল, যারা বাবুদের মাঠে তাড়া করেছিল? বল !

পঞ্চা তাই বলে,—হ্যাঁ। সেই লোকদুটোও ছিল।

তাদের চেনস?—হোঁৎকা শুধোয়।

পঞ্চা ঢোক গিলে বলে,—আজ্ঞে না। ওরা এখানে থাকে না ।

—তবে?

—শহরে-অন্য কোথায় থাকে। মাঝে মাঝে আসে।

দেখলে চিনতে পারবি?—গোবর্ধন জেরা করে।

পঞ্চা উভয় সঙ্কটে পড়েছে। বেশ বুঝেছে চিনলে সমূহ বিপদ। অথচ না বলার উপায়ও নেই। হোঁৎকা ধমকে ওঠে,—কি হইল? জবাব দে! পঞ্চা ওর রুদ্র মূর্তি দেখে বলে,-তা হয়তো পারবো ।

হোঁৎকা বলে,—গরিব মানুষ, খেটে খাই।

গোবর্ধন বলে,—এখন খাটতেও হবে না। আরাম করেই বসে বসে খাবি। তবে ওখানে যাওয়া বন্ধ। বের হলেই ঠ্যাং দুটো খোঁড়া করে দেব জন্মের মত।

নসুমামার পৈত্রিক প্রজা লেঠেল দু’-চার ঘর এখনও আছে। তারা এখনও নসুবাবুকে শ্রদ্ধাভক্তি করে। তাদের সর্দার নরু বলে,—ভাববেন না ছোটবাবু, আমরা এখন পালা করে এই বাড়িতেই থাকব। কে জানে ওই ডাকাত ধনকেষ্ট আবার কি করে। এমন জানলে আগে থেকেই পাহারা দিতাম। কোথায় যে নে গেল ওই দুটো ছেলেকে― !

নসুমামাও এবার ভাবনায় পড়েন।

চারদিকে খবর হয়ে যায়, কলকাতার ছেলেদের মধ্যে দুজনকে পাওয়া যাচ্ছে না। কারা তাদের উপর পথে হামলা করার চেষ্টা করেছিল, ওরা বেঁচে গেছে। তারপর থেকেই তাদের পাওয়া যাচ্ছে না ৷

নন্দবাবুও এসে পড়ে। বলে,—চারদিকে খুঁজেছ ?

রাতভোর খোঁজাখুঁজি চলেছে। বাগান, বাদাবন, বাঁশবন, এখানে ওখানে বহুলোক খুঁজছে। গাং-এ ডোবার খবরও নেই।

হোঁৎকা বলে,—ওরা সাঁতার ভালোই জানে। সমী তো ইন্টার স্কুল সুইমিং-এ চ্যাম্পিয়ন। ডুইবা যাইব না।

নন্দলালবাবু বলেন,—এ ওই ধনকেষ্টর কারসাজি।

নসুমামা বিপদে পড়েন। বাড়িতেও মা ও স্ত্রী চাননি নসুমামা ভোটে দাঁড়ান। কিন্তু তাদের নিষেধ না শুনেই জেদের বশে, আর এই অত্যাচার, অন্যায়কে বন্ধ করার জন্যই তিনি ভোটে দাঁড়িয়েছেন। জিতবেনও। হাওয়া তাঁর দিকেই। কিন্তু এই সময় পটলা আর সমীকে গুম করায় তিনিও ভেঙে পড়েছেন।

নসুমামা বলেন,–কি জবাব দেব পটলার বাবা মা ঠামাকে, যদি কিছু হয়ে যায় ওর! নন্দলালবাবু বলেন, –এত ভেঙে পড়ছেন কেন? ওদের হদিস ঠিকই পাওয়া যাবে। আমরাও বসে নেই ।

হোঁৎকা বলে,—থানাতেও একটা খবর দিয়া রাখুন।

নন্দলাল বলেন,—হ্যাঁ, এটা করা দরকার।

রাত কত জানি না। মনে হয়, ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরেছে আমার। দেখি পাশের একটা খালি বস্তার গাদায় পটলা শুয়ে আছে। আমাকে উঠে বসতে দেখে এবার চাইল পটলা। মুখের বাঁধন আর নেই। তবে হাত-পা দুটো বাঁধা। আর দুপাশে দুটো লোক বসে আছে। একটা হ্যারিকেন টিমটিম করে জ্বলছে। লোকদুটো বিড়ি ফুঁকছিল। আমাকে উঠে বসতে দেখে চাইল।

ম্লান হ্যারিকেনের আলোয় দেখতে পাই ওদের। সেই বাসস্ট্যান্ডে দেখা লোকদুটোই। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, সেই লম্বা মত লোকটার সঙ্গে গোল মত মোটা লোকটাও রয়েছে।

গোল মত লোকটার মাথায় চকচকে টাক। গায়ে সেই চাদর। বলে,—চুপ করে থাকবি। তখন মাঠে খুব কসরৎ করে পালিয়েছিলি, এবার !

এবার ওরাই আমাদের বিপদে ফেলেছে তা বুঝেছি। লম্বা লোকটাকে শুধোই,—আমাদের ধরে এনেছ কেন?

লোকটা বলে,—খুব বেড়েছিলি তোরা। কেষ্টবাবুর সঙ্গে পাল্লা দিবি কলকাতা থেকে এসে তারই মুলুকে? দুটোকে ধরেছি, বাকি তিনটেকেও ধরে এনে এখানেই শেষ করে দেব। ওদের রাগের কারণটা এবার বুঝেছি।

রাত ভোর হয়। পাখিদের কলরব ওঠে। এবার বুঝতে পারি ওরা আমাদের এনে আটকে রেখেছে একটা গাদাবোটে। এর উপরে চারপাশে টিনের ছাউনি। এই গাদাবোটে করে পাটের গাঁট, ধানচালের বস্তা লঞ্চের সঙ্গে বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়৷

জায়গাটার ঠিক হদিস পাই না। খোলা বিরাট দরজা দিয়ে দূরে দেখা যায় গাঙের বিস্তার । দূরে দূরে ছবির ফ্রেমের মধ্যে দিয়ে দু-একটা মালবোঝাই নৌকো পাল তুলে চলে যাচ্ছে।

আমাদের মাঝ গাঙে গাদাবোটের একটা কুঠুরিতে আটকে রেখেছে। বেলা বাড়তে ওরা চা আর পাঁউরুটি দিয়ে যায়।

পটলা বলে,–কে-কেন আটকে রেখেছ ?

লোকটা শোনায়,—কৈফিয়ৎ চাইলে মুখ বন্ধ করে দেব। চুপচাপ থাক ।

গাদাবোটের একদিকে পায়খানা। স্নানের জায়গা বলতে কাঠ দিয়ে ঘেরা একটু জায়গা। নীচের তক্তাগুলো কিছু ফাঁকা, নদী থেকে ছোট বালতিতে দড়ি বেঁধে জল তুলে ওই জলই

গায়ে ঢেলে স্নান করতে হয়।

এই ফাঁক দিয়ে জায়গাটাকে দেখার চেষ্টা করি। নদীতে জোয়ার, তাই নদীর জল বেশ ঘোলা। জল বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছে।

লোকটা তাড়া দেয়,—স্নান করতে কতক্ষণ লাগে রে? চলে আয় ।

লোকগুলো আমাদের বেশিক্ষণ বাইরেও থাকতে দিতে চায় না। ওদের তাড়ায় ভিতরে আসি।

একপাশে রান্নার ব্যবস্থা আছে। ওরা ডাল ভাত আর একটা কি তরকারি দিয়েছে। খেতে রুচি নেই। এই ভাবে মাঝ গাঙে এনে আটকে রাখবে-রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলছে। শুধোই, কি করবে আমাদের ?

লোকটা বলে,—বাকি কটাকে তুলে আনি, তারপর কি করব দেখবি। গলা টিপে এক একটাকে খুন করে ওই বস্তার পাথর সমেত পুরে ডুবিয়ে দেব সব ক’টাকে।

পটলা চুপ করে থাকে। আমারও মনে হয় এই বন্দী অবস্থায় ওদের কথার প্রতিবাদ করে লাভ হবে না। বরং ওদের কথা শুনে ওদের বিশ্বাস অর্জন করাই ভালো। তাতে হয়তো মুক্তির উপায় হবে।

আমি খেয়ে নিই। বলি, দারুণ রান্না হয়েছে। চমৎকার!

মোটকা লোকটা খুব খুশি হয়। আমাকে বলে,—তুমি বেশ ভালো। ওই ছোঁড়াটার দ্যামাক দেখেছো। খেলই না! ঠিক আছে, কদ্দিন না খেয়ে থাকতে পারিস দেখি।

দিন যায়। সন্ধ্যা নামে। নদীর বুকে ঘন কুয়াশা জমে। দূরে আলো জ্বেলে একটা লঞ্চ বের হয়ে গেল। আবার সব চুপচাপ । লম্বা লোকটা এদিক ওদিক ঘুরছে। আর মোটকা লোকটা উনুন ধরিয়ে রুটি আর তরকারি বানাচ্ছে। আমাদের মনে পড়ে হোঁৎকা, গোবরাদের কথা। নসুমামার কথা। ওরা কি করছে কে জানে!

নসুমামা বসে নেই। চারিদিকে খোঁজ-খবর চলেছে। থানাতেও রিপোর্ট করেছে নসুমামা। দারোগাবাবু ধনকেষ্টরই পেটোয়া লোক।

নন্দ ডাক্তার দারোগাবাবুকে বলেন,—এসবের মূলে কে, তা আপনারা জানেন না ? দারোগাবাবু বলেন,—যত দোষ তো পুলিশেরই! খবর নেন—কলকাতার বখাটে ছেলে, সিধে হয়তো সেখানেই ফিরে গেছে! তারপর আসবেন।

নসুবাবু বলেন,–খোঁজখবর আমরা নিচ্ছি। তবে তারা বখাটে ছেলে নয়। বড় ফ্যামিলির ছেলে, ভালোই পড়াশোনা করে।

দারোগাবাবু বলেন,—আজকালকার ছেলে তো! কখন যে কী করে তার ঠিক-ঠিকানা নেই।

তারপর বলেন,–যান। দেখছি।

অবশ্য ওই পর্যন্তই। খবরটা ধনকেষ্টর ওখানেও পৌঁছেছে। ধনকেষ্ট বেশ বুঝতে পারছে ক’দিনেই নসুবাবু মুষড়ে পড়েছে। ভোটের সেই প্রচার, মিটিং-মিছিলও নেই।

এদিকে পটলা, সমীরের হারাবার খবর যায় সদরে। সদর থেকে পটলার পিসিমাই খবর দেন কলকাতায় পটলাদের বাড়িতে।

পটলার মা বাবা কাকারাও চিন্তায় পড়ে। ঠাকুমা তো রীতিমত কান্নাকাটিই শুরু করে দেন, -ওরে আবার কি ফ্যাসাদ বাঁধালো ছেলেটা দ্যাখ দিকি! তোরা যা, যেভাবে হোক পটলাকে ধরে আন।

বাধ্য হয়ে পটলার কাকা ছুটে আসে সদরে। গৌরাঙ্গদা এবং অফিসারদের এবার দৃঢ় ধারণা হয়, এসব ধনকেষ্টবাবুরই কীর্তি।

গৌরাঙ্গবাবু বলেন এস. পি-কে,—এসবের আদ্যোপান্ত তদন্ত করতে হবে।

পুলিশও তাই চায়। কারণ ওই হাড়মাসপুরে প্রায়ই খুন জখমের ঘটনা ঘটে, আর লোকাল থানা এ নিয়ে কোনো কথাই বলে না। এসব চলতে দেওয়া যাবে না।

ক’দিন ধরে ওই গাদাবোটেই বন্দী হয়ে আছি। এই ক’দিনে আমরা তেমন কোনো গোলমাল করিনি। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করেছি, ওদের কথা শুনেছি দেখে, ওরা কিছুটা সহজ হয়েছে।

এখন আমরা ওদের রান্নার কাজে সাহায্য করি, কথাবার্তা বলি। মোটকা লোকটা কিছুটা ভালো। হেসে কথা কয়। কিন্তু লম্বা লোকটা তবু আমাদের বিশ্বাস করতে পারে না। নজরে নজরে রাখে।

ক’দিন ধরে দেখছি তীর থেকে এদের ইশারা পেলে একটা ছোট ডিঙি আসে। তাতেই আমাদের জন্য চাল ডাল আনাজপত্র আসে, মায় খাবার জল অবধি। মাঝে মাঝে সেই ডিঙিওয়ালা এদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে রাতেই চলে যায় ডিঙি নিয়ে।

সেদিন বেশ ঠান্ডা পড়েছে, বৃষ্টি পড়ছে টিপি টিপি। আজ ওরা রাতে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছের ব্যবস্থা করেছে। নদীতে হাওয়ার দাপট খুবই বেশি। তাই ওরা ঘেরা জায়গায় বসে রান্না করছে। আর নিজেদের মধ্যেই খোস গল্প করছে। বোধহয় গরম ইলিশ মাছ ভাজার সঙ্গে চা-টা খাচ্ছে।

এদিকের খুপরিতে আমি আর পটলা বসে আছি। কি খেয়াল বশে আমি একটু বের হয়ে গাদাবোটের পিছনে আসি। মনে হয় ওপাশের তীরভূমিতে দু’একটা আলো জ্বলছে। লোকবসতি বাজার আছে ওদিকে। মেঘলা আকাশ ।

হঠাৎ নজরে পড়ে গাদাবোটের সঙ্গে ওই ছোট নৌকোটা বাঁধা রয়েছে। মাথায় বুদ্ধিটা খেলে যায়। ইশারায় পটলাকে ডাকি ।

পটলা আসতে ইশারায় ওই ডিঙিটা দেখিয়ে বলি,—চল পালাতে হবে। যেভাবেই হোক ধারে উঠে পড়তে পারব।

লোকগুলোর হাসিঠাট্টার পর্ব চলেছে। ওরা জানে আমরা ঠিকই আছি। এই ফাঁকে ডিঙিতে উঠে দড়ি খুলে দিতে জোয়ারের টানে নৌকো ছিটকে বের হয়ে যায়।

ডিঙি বাইতে থাকি ওপারের আলো লক্ষ্য করে। কিছুক্ষণের মধ্যে আর গাদাবোটটাকে দেখা যায় না। ঘন কুয়াশার মধ্যে সেটা হারিয়ে যায়। আমরাও বেশ জানি ওই গাদাবোটের পক্ষে একইঞ্চিও নড়া সম্ভব নয়। আর কোনো ডিঙিও নেই। ওরা আমাদের পিছনে তাড়া করতে পারবে না ।

বেশ জোরেই দাঁড় বাইছি। তীরভূমিও কাছে এগিয়ে আসছে। আলোগুলো উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে। পটলা বলে, এই রা-রাতে কোথায় যাবি?

শীতে সোয়েটার মাফলার ঠান্ডা হয়ে গেছে। হাতগুলো কনকন করছে। তবু প্রাণের দায়েই দাঁড় বাইতে বাইতে বলি,-ডাঙায় তো নামি, তারপর দেখা যাবে কি করা যায়।

নৌকোটা এসে তীরে ঠেকে, জোয়ারের সময় বলে জল অনেক উপরেই রয়েছে। তাই শুকনো ডাঙাতে লাফ দিয়ে নেমে নৌকোটাকে স্রোতের দিকে ঠেলে দিই।

কোথাও না দাঁড়িয়ে সামনের পিচরাস্তা দিয়ে চলতে থাকি নির্জন অন্ধকারে।

বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেখা যায় উঁচু বাঁধ। পটলা বলে,—বাঁধের মত লাগছে। আবার কোনো নদী নাকি রে?

জায়গাটার সম্বন্ধে কোনো ধারণাই নেই। হঠাৎ একাট ট্রাককে সশব্দে হেডলাইট জ্বেলে আসতে দেখে মনে হয়, বাঁধ নয়। কোনো রাস্তাই ।

সেই দিকেই এগিয়ে চলি। তখন রাত কত জানি না। সঙ্গে ঘড়িও নেই। তবু পথের দিকেই এগোতে থাকি।

ওদিকে হাড়মাসপুরে তখন হইচই শুরু হয়েছে। পটলার কাকা এসেছেন। পুলিশও এবার সদর থেকে চাপ পেয়ে নড়ে বসেছে। তারা ধনকেষ্টর ধানকলের গুদাম, এদিক ওদিক, মায় নসুমামাদের জঙ্গলঢাকা বিশাল পোড়ো বাড়িতেও হানা দিয়েছে।

ধনকেষ্ট বলে,—ওসব নসবাবুর প্যাঁচ স্যার। নিজেরাই ওদের কোথাও লুকিয়ে রেখে ভোটের সময় আমার বিরুদ্ধে বদনাম রটিয়ে ভোট কুড়োতে চায়। এসব পলিটিক্স স্যার। পুলিশও হতাশ। ছেলেদুটো কর্পূরের মত উবে গেল !

হোঁৎকা, গোবর্ধন ফটিকরাও মিইয়ে গেছে। তাদেরও আর উৎসাহ নেই। পটলাকে হারিয়েছে তারা।

এবার নসুমামা ঘোষণা করে,–ভোটের জন্যই এই সর্বনাশ হয়ে গেল। ভোটে আর আমি নাই ।

হোঁৎকা বলে,—এটা কি কন মামা? ভোটে জিততেই হইব।

—পটলা নাই, সমীও নাই। আর দরকার কি ভোটে? ভাবছি বসে যাব। ধনকেষ্ট যা পারে করুক।

খবরটা ধনকেষ্টর শিবিরে পৌঁছে যেতে সে খুবই খুশি।

ঘটা করে এবার পঞ্চাননের উৎসব করছে তারা। চারদিকে খবর দেওয়া হয়েছে, তিনদিন প্রসাদ দেওয়া হবে ভরপেট, আর বস্ত্র কম্বল বিতরণ করা হবে।

বিরাট সমারোহ চলেছে। নসুবাবুর দলের সাড়া নেই।

হঠাৎ এমনি সময়, ওই ভবতারণ আর তার মোটকা চ্যালাকে আসতে দেখল ধনকেষ্ট।

লোকদুটো বলে,—সব্বোনাশ হয়েছে কত্তা !

ধনকেষ্ট ঘাবড়ে যায় ।

ভবতারম বলে,–ছেলেদুটোকে নবীনগরের গাঙে আপনার গাদাবোটে আটকে রেখেছিলাম হুজুর, কিন্তু দুদিন হল ওরা পালিয়েছে।

চমকে ওঠে ধনকেষ্ট,—মানে? ওই বিশাল গাং পার হয়ে পালালো? তাদের কি ডানা গজালো যে উড়ে যাবে? কি করে পালালো ?

লোকদুটো কিছু বলার আগেই ধনকেষ্ট এসে ওদের আচমকা চড় থাপ্পড় মারতে থাকে। ধনকেষ্ট গর্জে ওঠে,—গাঙে ডুবিয়ে শেষ করতে পারলি না? এখন কি হবে ?

ধনকেষ্ট প্রমাদ গনে। সবকিছুই এখন তার কাছে বিশ্রি লাগে। বাইরে উৎসবের সমারোহ চলেছে। ঢাক বাজছে পঞ্চাননের মন্দিরে। বেষ কয়েকটা ঢাক। ওদিকে বিরাট বিরাট উনুনে খিচুড়ি চেপেছে।

হঠাৎ বাতাসে ভেসে আসে কয়েকটা জিপের শব্দ। সদর থেকে বিরাট পুলিশ বাহিনী নিয়ে রিলিফ অফিসার এ. ডি. এম, রাস্তাঘাটের ইঞ্জিনিয়াররা এসে পড়েন।

ধনকেষ্ট অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য বের হয়। কিন্তু ভয়ঙ্কর রকম চমকে ওঠে। জিপ থেকে পুলিশ সাহেবের সঙ্গে নামছে সেই কলকাতার দুই পলাতক বিচ্ছু। যাদের ধনকেষ্ট গুম করে আটকে রেখেছিল নদীর বুকে গাদাবোটে।

ভবতারণ আর মোটকা লোকটাকে দেখিয়ে পটলা বলে,—এদের অ্যারেস্ট করুন । এই দুজনই গাদাবোটে আমাদের পাহারা দিত আটকে রেখে।

ধনকেষ্ট অবাক। এবার রিলিফ অফিসার বলেন,—অফিসে চলুন। রিলিফের কাগজপত্র বের করুন।

ইঞ্জিনিয়ার বলেন, – আপনার এলাকার রাস্তার কোনো কাজই হয়নি। নিজেই দেখলাম। অথচ বাইশ লাখ টাকা তুলেছেন ফলস্ বিল দিয়ে। এবার ম্যানেজার হরেন মিত্তির বেগতিক দেখে কেটে পড়তে চায়। কিন্তু পুলিশই আটকায় তাকে।

এর মধ্যে নসুমামা, পটলার কাকা ও হোঁৎকাদের নিয়ে এসে হাজির হয়। ততক্ষণে ধনকেষ্টকে জিপে তোলা হচ্ছে। সঙ্গে হরেন মিত্তির, বল্টু, গোপলাকে।

মোটকা লোকটাকেও চুলের মুঠি ধরে ভ্যানে তোলা হল।

একদিনেই যদুবংশ ধ্বংস হয়েছিল। এখানে ধনকেষ্টর সব পাপের সাজার ব্যবস্থা একদিনে হয়ে গেল।

এবার নসুমামাই বলেন,–এই ঢাক থামালি কেন? বাবার পুজো ভোগ উৎসব সবই হবে । খরচার জন্য ভাবিস না !

আবার আনন্দ কলরব ওঠে। বিকট শব্দে ঢাক ঢোল বাজছে। হাজার কণ্ঠে জয়ধ্বনি ওঠে, -জয় বাবা পঞ্চানন !

ডুবলো কে?—ধনকেষ্ট !

জিতছে কে—নসু রায় আবার কে!

সেবার নসুমামাকে ভোটে জিতিয়ে ফিরেছিলাম আমরা, হাড়-মাস আলাদা করা হাড়মাসপুর থেকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *