পটলবাবুর বিপদ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

পটলবাবুর বিপদ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

পটলবাবু খুন হয়েছেন, অথচ তাঁর লাশ পাওয়া যাচ্ছে না, এইটেই সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। খুন হওয়া ব্যাপারটা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ নেই। কারণ তাঁকে খুন করার হুমকি দিয়েছিল ভিমরুল। আর ভিমরুল যদি কাউকে খুন করার হুমকি দেয় তবে সেই লোক নিজেকে নিহত বলে ধরেই নিতে পারে। কারণ, ভিমরুল হল এক সাংঘাতিক আততায়ী। পুলিশ-টুলিশ তার টিকিরও নাগাল পায় না। অথচ সে বহাল তবিয়তেই তার পছন্দমতো লোককে খুন করে বেড়ায়। তাও আবার আগে থেকে তাকে সতর্ক করে দিয়ে।

পটলবাবু অবশ্য তোক সুবিধের নন। সোনা-রুপোর ব্যাবসায় তাঁর লাখো লাখো টাকা আয়। সুদের কারবারও আছে। তা ছাড়া তাঁর আবার একটি পোষা গুণ্ডাবাহিনীও আছে। পটলবাবুর হয়ে এই গুণ্ডাগুলোই আদায়-উশুল করে। রথতলা এবং আশপাশের অঞ্চল পটলবাবুর ভয়ে তটস্থ। মাসকয়েক আগে শ্ৰীমন্ত নামে একটা গরিব লোক বউয়ের গয়না বাঁধা রেখে পটলবাবুর কাছ থেকে পাঁচশো টাকা ধার নিয়েছিল। শোধ দিতে না পারায় কয়েক মাসেই পটলবাবুর নিজস্ব সুদের হারে ধার বেড়ে সুদে-আসলে দাঁড়াল পাঁচ হাজার। শ্ৰীমন্তর তো মাথায় হাত। যাই হোক, হঠাৎ শ্ৰীমন্ত একটা লটারিতে পাঁচ লাখ টাকা প্রাইজ পেয়ে গেল। আনন্দে সে তখন আত্মহারা। ঠিক সেই সময়ে পটলবাবুর গুণ্ডারা গিয়ে হাজির। তারা বলল, সুদে-আসলে পটলবাবুর পাওনা ওই পাঁচ লাখই দাঁড়িয়েছে। শ্ৰীমন্তকে মারধর করে তারা লটারির টিকিটটা কেড়ে নিয়ে এল। পটলবাবু দিব্যি হাসতে হাসতে প্রাইজের টাকাটা বাগিয়ে নিলেন। এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই ভিমরুলের চিঠি এল। সেই মার্কামারা নীল রঙের খামের ওপর একটা ভিমরুলের ছবি। ভেতরে নীল চিরকুটে পরিষ্কার হাতের লেখায় কয়েকটি কথা, “তোমার পাপের সীমা ছাড়িয়েছে। মরার জন্য প্রস্তুত হও। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে শ্রীমন্তর পাঁচ লাখ টাকা ও তৎসহ ক্ষমাভিক্ষার মূল্যস্বরূপ আরও দশ হাজার টাকা তাকে প্রত্যর্পণ করতে পারলে ভাল, নইলে আর সাতদিনের মধ্যেই তোমাকে খুন করা হবে।

— তোমার যম ভিমরুল।”

ভিমরুলের চিঠি ইয়ার্কির ব্যাপার নয়। সুতরাং উদ্বিগ্ন পটলবাবু পুলিশের কাছে গেলেন।

দারোগাবাবু চিঠিটা তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে হাই তুলে বললেন, “আমাদের কিছু করার নেই মশাই। উড়ো চিঠির পেছনে ছোটা আমাদের কর্ম নয়।”

উত্তেজিত পটলবাবু বললেন, “উড়ো কী মশাই, এ যে ভিমরুলের চিঠি!”

“সে তো জানি মশাই, কিন্তু ঘটনাটা না ঘটলে তো আর কিছু করতে পারি না। আগে ঘটুক তারপর দেখা যাবে।”

আসলে পুলিশও পটলবাবুকে ভাল চোখে দেখে না।

পটলবাবু তখন এসে ধরলেন গোয়েন্দা বরদাচরণকে। “বাবা বরদা, আমি যে মারা পড়তে চলেছি।”

বরদা একটু হেসে বলল, “শুভস্য শীঘ্রম।”

“তার মানে। তুমি কি আমার মৃত্যু চাইছ?”

“ভোট নিলে দেখবেন জনমত তাই চাইছে। তবে আমি গোয়েন্দা। আর্তকে রক্ষা করাই আমার কাজ। দেখি চিঠিটা।”

বরদা চিঠিটা ভাল করে দেখল। নিজের ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গিয়ে আঙুলের ছাপ খুঁজল। পেল না। পোষা কুকুর টমিকে চিঠি শুঁকিয়ে খানিক এদিক-ওদিক খুঁজে এল। তারপর চিঠিটা ফেরত দিয়ে বলল, “সাতদিন একটু সাবধানে থাকবেন।”

“সাবধানে থাকব। তুমি তো বলেই খালাস। সাবধানে থাকলেই কি ভিমরুল রেহাই দেবে? সে যে ভিমরুলের মতোই সাত হাত জলের তলায় গিয়ে হুল দেয়।”

“কেন, আপনার তো একটা গুণ্ডাবাহিনী আছে বলে শুনেছি। তারাই আপনাকে পাহারা দেবে।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পটলবাবু বললেন, “তা তারা দেবে। কিন্তু তারা বেশি বুদ্ধি ধরে না। গায়ের জোর দিয়ে কি আর সব কাজ হয়? শুনেছি ভিমরুল তুখোড় চালাক, কোথা দিয়ে যে তার মৃত্যুবাণ আসবে কে জানে। বাপু বরদাচরণ, তোমাকে মোটা টাকা দেব, আমাকে পাহারা দেওয়ার ভারটা তুমিই নাও।”

বরদাচরণ পটলবাবুকে পছন্দ করে না। তা বলে পটলবাবু খুন হন সেটাও সে চায় না। বলল, “পটলবাবু, আমার হাতে এখন অনেক কাজ। চারদিকে অপরাধের সংখ্যা যেমন বাড়ছে গোয়েন্দাদের ব্যস্ততাও তেমনই বাড়ছে। তিনটে দিন কোনওরকমে যদি কাটিয়ে দিতে পারেন তা হলে চতুর্থ দিন থেকে আমি আপনার নিরাপত্তার ভার নেব। আগামী তিনদিন আমি বড়ই ব্যস্ত। তবে আমি বলি কী, ওই বেচারার টাকাগুলো দিয়ে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়।”

পটলবাবু খ্যাঁক করে উঠলেন, “হক্কের টাকা দিয়ে দিলেই হবে? ধর্ম বলে একটা ব্যাপার আছে না?”

“ওঃ তাই তো। ধর্ম বলেও তো একটা কথা আছে।”

পটলবাবু বরদাচরণের ফি বাবদ পাঁচ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। কিন্ত বুকের ধুকধুকুনিটা যাচ্ছে না। রাতে ঘুম আসে না, খিদে পায় না, কাজে মন দিতে পারেন না। তাঁর তিনজন বিশ্বস্ত দেহরক্ষীর মধ্যে ন্যাপা হল প্রাক্তন ব্যাঁটরাশ্রী। বিশাল চেহারা, যার গায়ে পেশি কিলবিল করছে। দ্বিতীয় দেহরক্ষী হল কুংফু ক্যারাটের ওস্তাদ গুলে। তিন নম্বর দেহরক্ষী স্বর্ণপদকজয়ী মুষ্টিযোদ্ধা হারু। তারা পটলবাবুর কাছ থেকে মোটা বেতন পায়। ষণ্ডা-গুণ্ডার কাজে তারা খুবই দড়। তবে বুদ্ধির ব্যাপারে তাদের খামতি আছে। কিন্তু ভিমরুল অতি বুদ্ধিমান। সে মোটা দাগের কাজ করে না। পটলবাবু খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে রইলেন। স্থির করলেন, তিনদিন আর ঘরের বাইরে যাবেন না।

দ্বিতীয় দিন সকালে মহীতোষ নামে এক মহাজন এল। মোটা সুদে লাখ টাকা ধার নিয়েছিল। সুদে আসলে দু’লাখ টাকা শোধ দিতে এসেছে। সঙ্গে দু’জন পাইক।

টাকা-পয়সার লেনদেন হয় নীচের বৈঠকখানার পাশের ঘরে। এ-ঘরে সিন্দুকটিক আছে। পটলবাবু তাঁর দেহরক্ষীদের কক্ষনও এ-ঘরে ঢুকতে দেন না। লেনদেনের সময় তিনি সবসময়েই একা থাকেন, মক্কেলরাও একাই সে-ঘরে ঢুকতে পায়।

পটলবাবু ঘরে ঢুকে মহীতোষকে ডেকে পাঠালেন। কিন্তু মহীতোষ যখন ঘরে ঢুকল তখন পটলবাবুর একগাল মাছি। লোকটা মোটেই মহীতোষ নয়।।

পটলবাবু শুধু আঁ-আঁ করে দু’বার চিৎকার করার অবকাশ পেয়েছিলেন। তারপর যে কী হল, তা কেউ জানে না। ঘণ্টাখানেক পরেও ঘর থেকে কেউ বেরোচ্ছে না দেখে বাড়ির লোকজন জড়ো হল। বিস্তর ডাকাডাকি আর চেঁচামেচির পর দরজা ভেঙে দেখা গেল, মহীতোষ নামে আগন্তুক এবং পটলবাবু, কারও চিহ্ন নেই। গন্ডগোলের সুযোগে মহীতোষের পাইক দু’জনও পালিয়েছে।

ঘরের মোটা গরাদের একটা জানলা ভাঙা। কিন্তু জানলা দিয়ে পটলবাবুকে নিয়ে যদি আততায়ী বেরিয়েও গিয়ে থাকে তা হলেই বা সে কী করে বাড়ির উঁচু পাঁচিল ডিঙোল কিংবা কী করেই বা দরোয়ানের চোখ এড়িয়ে ফটক দিয়ে বেরোল?

পুলিশ এসে সর্বত্র তন্নতন্ন করে খুঁজে বলল, “এটা গুম কেস। খুনের কেস বলা যাবে না।”

যাই হোক, সবাই ধরে নিল শুধু গুম নয়, গুম করে পটলবাবুকে খুনও করা হয়েছে। কারণ ভিমরুলের যেই কথা সেই কাজ। লাশটা অবশ্যই দু’-চারদিনের মধ্যে পাওয়া যাবে।

কিন্তু একদিন-দু’দিন করে সাতদিন কাটতে চলল। পটলবাবুর লাশের কোনও হদিশ হল না।

পটলবাবুর চার ছেলে গিয়ে বরদাচরণকে ধরে পড়ল, “বাবা আপনার ওপর খুব ভরসা করেছিলেন, কিন্তু আপনি তো বাবাকে রক্ষা করতে পারলেন না। এখন কী হবে?”

বরদাচরণ নানারকম কেস নিয়ে সর্বদাই ভাবিত। গম্ভীর মুখে শুধু বলল, “হুঁ।”

“বাবার লাশটাও যে পাওয়া যাচ্ছে না।”

“হুঁ।”

“ভিমরুলকে ধরার ব্যাপারেও তো কিছু হচ্ছে না।”

“হুঁ।”

বিরক্ত হয়ে পটলবাবুর ছেলেরা ফিরে এল।

গভীর রাত। বরদাচরণ তার দোতলার ঘরে একটা কেস-হিস্ট্রি লিখছে। গভীর চিন্তামগ্ন।

হঠাৎ খোলা জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে একটা ঢিল এসে পড়ল। ঢিলে বাঁধা একটা কাগজ।

বরদাচরণ ঢিলটা কুড়িয়ে নিয়ে কাগজটা খুলে দেখল, তাতে লেখা: “কাহারপাড়ায় মজা পুকুরের ধারে পটলের লাশ পড়ে আছে।

—ভিমরুল।”

বরদাচরণ কাগজটা মুড়ে পকেটে রাখল। তাড়া নেই। লাশ তো আর উঠে পালাবে না। সকালে গিয়ে দেখলেই হবে।

সকালে দেরিতে ঘুম থেকে উঠে একটু গড়িমসি করে যখন বরদা মজাপুকুরের কাছে পৌঁছল তখন সেখানে লাশটাশ দেখা গেল না। মজাপুকুর খুব নির্জন জায়গা। চারদিকে ঘন কড় বন। দিনেদুপুরেও এখানে কেউ বড় একটা আসে না। একসময়ে ডাকাতের আড্ডা ছিল। ডাকাতে-কালীবাড়ির ধ্বংসাবশেষ আজও বিদ্যমান। চারদিকটা ঘুরে দেখে বরদা পুকুরের ধারে এসে দেখল একটা রোগামতো ছোটখাটো চেহারার লোক পুকুরের একধারে বসে ছিপ দিয়ে নিবিষ্টমনে মাছ ধরার চেষ্টা করছে। একটু আগেও লোকটা এখানে ছিল না।

বরদাচরণ লোকটার দিকে অবহেলার চোখে একটু চেয়ে আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলে খুব আলগা গলায় বলল, “ক’টা মাছ পেলেন?”

লোকটা বরদাচরণের দিকে ফিরেও তাকাল না। কিন্তু একটু চাপা গলায় বলল, “একটা মাছ ধরব বলেই বসে আছি। বড় মাছ। খুব লেজে খেলাচ্ছে।”

বরদাচরণ একটু হেসে বলল, “বড় মাছ ধরতে হলে উপযুক্ত টোপ চাই তো। তা টোপটা কী?”

“সেইটেই বড় মাছটার কাছে জানতে চাইছি।”

বরদাচরণ একটু ভেবে বলল, “বড় মাছটা টোপ গিলবে না। তবে আপস করতে রাজি আছে।”

লোকটা ছিপ গুটিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। নিতান্তই হেঁটো ধুতি আর কামিজ গায়ে একটা গেঁয়ো লোক। বয়স ত্রিশের আশপাশে। মুখখানা একদম ভাবলেশহীন। বরদাচরণের দিকে না তাকিয়ে মাথাটা নিচু রেখে বলল, “আপসটা কীরকম?”

“পটলবাবুকে মহীতোষ সেজে আমিই সরিয়েছি বটে, তা বলে আমি তার সমর্থক নই। লোকটা আমার মক্কেল, তাকে রক্ষা করা আমার কর্তব্য।”

রোগাভোগা লোকটা নিচু গলাতেই বলল, “ভিমরুলের চাকে খোঁচা দিয়েছেন। আপনার সাহস আছে বটে।”

“আমি ভিমরুলের শত্রু নই।”

“পটলকে না মারলে এলাকায় শান্তি থাকবে না। ওকে আমার হাতে ছেড়ে দিন।”

মাথা নেড়ে বরদা বলল, “তা হয় না। তাকে মারলে আমার শর্ত ভঙ্গ হবে।”

“তা হলে তো ভিমরুলের সঙ্গে শত্রুতাই আপনি চান। আমার যে কথা সেই কাজ।”

“না, ভিমরুলের মুখরক্ষার ব্যবস্থাও ভেবে রেখেছি।”

“কী ব্যবস্থা?”

“পটলকে বলেছি, প্রাণ বাঁচাতে গেলে তাকে দেশত্যাগ করতে হবে এবং অন্য জায়গায় অন্য নামে বেঁচে থাকতে হবে। পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা চলবে না। সে যে বেঁচে আছে এ-কথা কেউ জানবে না।”

“সে যদি আর কখনও এ-তল্লাটে আসে—”

“না, সে-ভয় আর নেই। আপনার ভয়ে সে আধমরা।”

“আর শ্রীমন্তর টাকাটা?”

“পটল আমার সঙ্গে পালানোর সময় নগদ পাঁচ লাখ দশ হাজার আলাদা করে শ্রীমন্তর জন্য নিয়ে নিয়েছিল। টাকাটা কাল রাতেই শ্ৰীমন্ত পেয়ে গেছে।”

ভিমরুল এবার একটু হাসল। বলল, “চোরের ওপর বাটপাড়ি করেছেন, তবু আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছি। আপনি একজন দক্ষ গোয়েন্দা।”

“ধন্যবাদ।”

ছোটখাটো লোকটা ছিপটা হাতে নিয়ে কসাড় বনের মধ্যে ঢুকে কোথায় চলে গেল কে জানে।

বরদাচরণ বাড়িতে ফিরে এসে তার দোতলার ঘরের পাশে পুরনো লেপ-তোশকের মস্ত কাঠের বাক্স খুলে পটলবাবুকে বের করল। পটলবাবু তখন চিঁচিঁ করছেন।

“তা পটলবাবু, এবার কী করবেন?”

“প্রাণরক্ষা করো বরদা, তারপর কী করব ভাবা যাবে।”

“প্রাণের ভয় আর নেই। ভিমরুল শর্তাধীনে আপনাকে রেহাই দেবে। কিন্তু আপনি যাবেন কোথায়?”

“হিমালয়ে।”

“সাধু হবেন নাকি?”

“না, না, ব্যাবসা আমার রক্তে। হিমালয়ে মেলা সাধু। আমি ঠিক করেছি সাধুদের চাল, ডাল, আটা, লোটা-কম্বল, কৌপীন ইত্যাদি সাপ্লাই দেওয়ার ব্যাবসা করব।”

“সাধুদের সাপ্লাই দেবেন? টাকা দেবে কে?”

‘ভক্তরা দেবে বাবা। ওসব আমার ছক করা আছে।”

পটলের ব্যাবসাবুদ্ধি দেখে বরদা অবাক হয়ে গেল।

৬ নভেম্বর ১৯৯৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *