5 of 8

পঞ্জিকা

পঞ্জিকা

সেই বিজ্ঞাপনটা বোধহয় আজও আছে, সেই যেখানে খুব বড় বড় আধ ইঞ্চি সাইজের হরফে লেখা ছিল—

‘মরা মানুষ বাঁচাইবার উপায়’

এবং তার নীচে ছিল সবল পেশি, উন্নতবক্ষ এক তেজোদৃপ্ত পুরুষ মানুষের ছবি, এবং তারও নীচে খুব ছোট ছোট, বোধহয় বর্জয়েস কিংবা স্মল পাইকা অক্ষরে লেখা, ‘এখনও আবিষ্কার হয় নাই।’

তার মানে, ‘মরা মানুষ বাঁচাইবার উপায় এখনও আবিষ্কার হয় নাই।’

ইলেকট্রিক সলিউশনের মতো অত্যাশ্চর্য নামের, এই অমোঘ ওষুধটির বিজ্ঞাপন এই সেদিনো দেখেছি কিন্তু হাতের সামনের পঞ্জিকাটায় খুঁজে পাচ্ছি না।

যেমন খুঁজে পাচ্ছি না, সেই কবেকার জাঞ্জিবারের রাক্ষুসে লাল মুলোর সচিত্র বিজ্ঞপ্তি, যে মুলোর প্রতিটির ওজন ‘ন্যূনপক্ষে’ আড়াই সের।

অথবা ‘ফুল আপনার ভাগ্য বলিয়া দিবে’ কিংবা ছবির মতো ঘড়ির’ বিজ্ঞাপন যে ঘড়ির মূল্য মাত্র সাড়ে তিন টাকা—নতুন পঞ্জিকায় সেটাও দেখতে পাচ্ছি না।

ফুল আর ঘড়ির দুটো বিজ্ঞাপনই অবশ্য জোচ্চুরি। গোটা দশেক পরিচিত নামের ফুলের ছবির নীচে জ্যোতিষের ভাষায় ভূত ভবিষ্যৎ লেখা আছে। আপনি পোস্ট কার্ডে ফুলের নাম জানালে ভি পি ডাকে ভাগ্যফল চলে আসবে।

কিন্তু আমি একবার ধুতুরা এবং আর একবার সজনে ফুলের নাম পাঠিয়ে ভাগ্যফল পাইনি, কারণ গোলাপ বকুল জবা— এই সব সাধারণ ফুলের নামেই ভাগ্যফল তৈরি করা আছে; অন্যরকম নামের ফুলের কোনও ভাগ্যবিচার নেই।

ঘড়ির ব্যাপারটা আরও গোলমেলে। ছবির মতো ঘড়ির জন্য টাকা পাঠালে ঘড়ি নয় তার বদলে ঘড়ির ছবি আসবে ওই সাড়ে তিন টাকার বিনিময়ে একেবারে ‘ছবির মতো ঘড়ি।’

পঞ্জিকার বিজ্ঞাপন নিয়ে অনেক কথাই এ পর্যন্ত লেখা হয়েছে। বরং পঞ্জিকার বিয়ে কিছু বলি।

ইরেজি নববর্ষের যেমন ক্যালেন্ডার যার শৌখিন নাম দেয়ালপঞ্জি, বাংলা নববর্ষে তেমনই পঞ্জিকা, যদিও বাংলা দেয়ালপঞ্জিও ইংরেজি কেতায় তৈরি হয় এবং সেগুলো খুবই কাজে লাগে কারণ তাতে বার, তারিখ, ছুটির দিন ছাড়াও পূর্ণিমা অমাবস্যা, একাদশী, গ্রহণ, পুজো, পার্বণের হদিশ পাওয়া যায় এক নজরে।।

অভিধানমতে পঞ্জিকা হল সেই পুস্তক যার মধ্যে তারিখ, তিথি, পর্বদিন, শুভদিন ইত্যাদি থাকে। আমরা পূর্ববঙ্গে শুদ্ধ ভাষায় পঞ্জিকা বলতাম, এখানে চলিত ভাষায় পাঁজি বলে। কাব্য বা সাহিত্য করে পঞ্জিও অবশ্য বলা হয়, যেমন একটু আগে লিখেছি দেয়ালপঞ্জি।

আমাদের অল্প বয়সে পঞ্জিকা ছিল মোটামুটি তিন রকমের। ফুল পঞ্জিকা, হাফ পঞ্জিকা এবং পকেট পঞ্জিকা। এখনও তিন রকমই আছে তবে নামগুলো একটু বদলে গেছে। ফুল পঞ্জিকা হয়েছে ডাইরেক্টরি, হাফ পঞ্জিকা হয়েছে ফুল পঞ্জিকা আর পকেট পঞ্জিকা প্রমোশন পেয়ে হয়েছে হাফ পঞ্জিকা।

ব্যাপারটা অনেকটা মিলের ধুতি শাড়ির মতো। একালের মধ্যবিত্ত বাড়িতে মিলের ধুতি-শাড়ি খুব একটা কেনা হয় না তাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, সবচেয়ে মোটা শাড়ি হল ফাইন, আর সুপার ফাইন হল সাদামাটা। সত্যিই যেগুলো ফাইন বা সুপার ফাইন, মিহি সুতোয় বোনা, সেগুলোর সব বাহারি নাম মহারাজা ধুতি, রাজকুমারী শাড়ি, প্রিমিয়ার ‘অ্যারিস্টোক্র্যাট’ ইত্যাদি।

অবশ্য এ-বিষয়ে লুঙ্গির নামকরণের কোনও তুলনা নেই। দক্ষিণ ভারত থেকে যে চমৎকার লুঙ্গিগুলো কলকাতায় আসে, যেগুলো চিৎপুরে নাখোদা মসজিদের আশপাশের দোকানে পাওয়া যায় সেগুলোর বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামেই পরিচয়। বেশ ভাল লুঙ্গি হল অফিসার্স লুঙ্গি, কর্নেল লুঙ্গি। তবে সবচেয়ে ভাল, অভিজাত লুঙ্গি হল সাব ইন্সপেক্টর দারোগা লুঙ্গি। সেদিন শুনলাম বড় দারোগা লুঙ্গিও বেরিয়েছে সে আরও উচ্চমানের। সাধারণ চলনসই লুঙ্গির নাম হল রিপোর্টার লুঙ্গি।

ব্যাপারটা কথায় কথায় একটু অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। আমার লেখার সীমাও শেষ। তবু পঞ্জিকা সম্পর্কে আরও দুয়েকটা কথা লেখার আছে।

আমাদের ছোটবেলার ছোট শহরে সবসুদ্ধ বড় পঞ্জিকা ছিল গোটা সাতেক। কালীবাড়িতে একটা, আদালতে একটা, বাজারে মহাজনি গদিতে একটা, আর কোনও কোনও সম্পন্ন গৃহস্থবাড়িতে। যতদূর মনে পড়ে, মেজর মফিজ ডাক্তারের চেম্বারেও একটা ফুল পঞ্জিকা রাখা হত।

হাফ পঞ্জিকা, পকেট পঞ্জিকা হাটে-বাজারে কাছারির বটতলাতেও বৎসরান্তে পাওয়া যেত। কিন্তু ফুল পঞ্জিকা পাওয়া যেত শুধুমাত্র একটা বাইরের দোকানে, ভারত লাইব্রেরিতে। ঠিক যে কয়টা ফুল পঞ্জিকা বিক্রি হবে গোনা-গুনতি সেই কয়টা ভারত লাইব্রেরি কলকাতা থেকে আনাত। কারণ একটা কপি বেশি হলেও নতুন বছরের পর সেটার বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

যে বছর আমাদের পঞ্জিকা হারিয়ে যায়, সেবার দ্বিতীয় একটা পঞ্জিকা কিনতে গিয়ে বোঝা যায় যে দ্বিতীয় পঞ্জিকা সংগ্রহ করতে গেলে কলকাতা বা ঢাকা থেকে আনাতে হবে। ভারত লাইব্রেরির স্টকে আর কিছু নেই।

পঞ্জিক হারানোর ঘটনাটা বলে শেষ করি।

আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া পুরনো বাড়িতে সব কিছু হারাত। গয়নাগাঁটি, বাসন-কোসন ঘড়ি, কলম, গোরু, ছাগল সব কিছু। আমরা অল্পবয়সিরা সদাসর্বদা হারিয়ে যেতাম, পুকুরঘাটে বাসন মাজতে গিয়ে ঝিয়ের গেলাস হারিয়ে আসা, জ্যাঠামশাই আদালতে ছাতা হারিয়ে আসতেন, ছোট পিসিমা ব্রাহ্মমন্দিরে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে গিয়ে নতুন চটি হারিয়ে আসতেন।

সুতরাং পঞ্জিকা হারিয়ে যাওয়া কোনও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু ঘটনাটা জটিল ও রহস্যময়। সেই জন্যেই বলা।

চৈত্র সংক্রান্তির দুয়েকদিন আগেই আদালত থেকে ফেরার পথে মুহুরিবাবু পঞ্জিকা কিনে আনতেন। তারপরে সন্ধ্যাবেলায় কাছারি ঘরে লণ্ঠনের আলোতে বসে খুব ভাল করে সেটায় বাঁশকাগজ দিয়ে মলাট লাগাতেন।

এরপর নীলপুজোর দিনে সেটা যেত গাঁয়ের বাড়িতে শিবমন্দিরে, সেখান থেকে ফিরে সিঁদুর হলুদের ফোঁটা দিয়ে পরের পরের দিন পয়লা বৈশাখে সেটাকে বরণ করা হবে। তারপর থেকে সে পাঁজি থাকত পুজোর ঘরে। প্রয়োজন মতো সারা বছর ব্যবহৃত হত।

দুয়েকদিন পরেই অক্ষয় তৃতীয়ার লগ্নক্ষণ দেখতে গিয়ে দেখা গেল সেই বাঁশকাগজের মলাট দেয়া বইটা মোটেই নতুন পঞ্জিকা নয়, সেটা হল কাকার একটা বই কে পি বসুর অ্যালজেব্রা। কী করে সেই পঞ্জিকার সঙ্গে এই বইয়ের বদল হয়েছিল, সেই পঞ্জিকাই বা কোথায় গেল এসব রহস্যের সমাধান কোনওদিনই হয়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *