‘পঞ্চাশ বছর ধরে করেছি সাধনা।’
‘‘কটা ভাষা?’ ‘হা কপাল! বাংলাই হল না।’
প্রথমেই নিবেদন জানাই, আকাশবাণীর বিরুদ্ধে আমার ব্যক্তিগত কোনও ফরিয়াদ নেই। কেন নেই, যখন চৌদ্দআনা পরিমাণ লোকের আছে, এসব তর্কের ভিতর আমি ঢুকতে নারাজ। বিশেষত যখন খুব ভালো করেই জানি, এই বিশ্ব-সংসারটা রিফর্ম করার গুরুভার আল্লা-তালা আমার স্কন্ধে চাপাননি। আমি শুধু আজ আকাশবাণী বাবদে একটি কাহিনী নিবেদন করব। শোনা গল্প। সত্য না-ও হতে পারে। তবে ক্যারেকটিরিস্টিক– অর্থাৎ গল্পটি শুনেই চট করে চোখের সামনে ভেসে ওঠে আকাশবাণীর একটি বিশেষ স্থূলাঙ্গের ছবি।
‘সুনন্দ’ রাগে বিতৃষ্ণায় বিকৃতকণ্ঠে তাঁর জুর্নালে ইন্টারভ্যু নামক প্রতিষ্ঠানটির ব্যঙ্গ করেছেন। হায় রে কপাল! তিনি কখনও ইন্টারভ্যুর রাজার রাজা ‘অডিশনিং’ নামক খাটাশটির দাঁত-ভ্যাংচানি দেখেছেন– ঈভন ফ্রম এ ভেরি লঙ সেফ ডিসটেন্স? তা হলে বুঝতেন ঠ্যালা কারে কয়। আমি স্বয়ং একাধিক ‘অডিশনিং’ বোর্ডের কর্মকর্তা ছিলুম বেশ কিছুকাল ধরে। আমার জানার কথা। কিন্তু আমি এ সুবাদে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের একটি কাহিনী কীর্তন করব।
একদা ‘গ্রামে গ্রামে এই বার্তা রটি গেল’ যবে যে, বড় কি ছোট তাবৎ সঙ্গীতকাররা পরীক্ষা (এরই ‘ভদ্র’ নাম অডিশনিং) দিয়ে তবে গান গাইবার প্রোগ্রাম পাবেন, তখন পরীক্ষকদেরই একজন আপত্তি তুলে বললেন, ‘বাজারে যাঁদের গ্রামোফোন-রেকর্ড রয়েছে, এবং/কিংবা স্টুডিয়ো-রেকর্ড রয়েছে তাদের আবার অডিশনিং-এর কী প্রয়োজন?’ যাঁদের নেই তাদের কথা আলাদা, কিন্তু তখনকার দিনের আকাশবাণী রাজাধিরাজ স্বাধিকারমত্ত। মোকা যখন পেয়েছেন তখন ছাড়বেন কেন?
তখন, ধরুন, এই লখনৌ শহরে ছোট-বড় তাবৎ গাওয়াইয়া বাজানেওলারা একজোটে স্থির করলেন, তাঁরা পরীক্ষা দেবেন না। তাঁদের আপত্তি, যারা পরীক্ষা নেবে তারাই-বা সঙ্গীত-জগতের কী এমন বাঘ-সিঙ্গি?
আবার বলছি, এটা গল্প।
অবস্থা যখন চরমে তখন দুনিয়ার হালচাল বাবদে সম্পূর্ণ বেখেয়াল, লখনৌয়ের সবচেয়ে বড় ওস্তাদ একদিন ভোরবেলা শিষ্য-সমাবৃত হয়ে রেওয়াজ করতে করতে হঠাৎ শুধোলেন, ‘হ্যাঁ মিয়া, “আডিশনিং আডিশনিং” চারো তরফ লোগ শোরগোল মচা রহে হৈঁ, সো ক্যা বলা?’ (পাঠক, আমার উর্দুজ্ঞান সঞ্চিত হয়েছে কলকাতার পানওয়ালাদের দোকান থেকে– অপরাধ নিয়ো না, বরায়ে মেহেরবানি!) মোদ্দা কথা, তিনি জানতে চাইলেন, চতুর্দিকে যে এই আডিশনিং আডিশনিং রব উঠেছে, সেটা আবার কী বালাই (আপদ, গেরো)।
শিষ্যেরা প্রাঞ্জল ভাষায় সে ‘বালাইয়ের জন্ম’, বয়োবৃদ্ধি ও বর্তমান পরিস্থিতি গুরুকে বুঝিয়ে দিলেন, এবং তাদের কেউই যে এই অপমানকর প্রতিষ্ঠানের সম্মুখীন হবেন না সেটাও জানিয়ে দিলেন।
গুরু তাজ্জব মেনে বললেন, ‘সে কী? ইমতিহান-পরীক্ষা দিতে তোমাদের কী আপত্তি? ভেবে দেখো আমি যখন বিরাট জলসায় গান ধরি তখন কি শেষ কাতারের পানওয়ালাটা পর্যন্ত আমার পরীক্ষা আরম্ভ করে দিয়ে ভাবে না, আমি রসসৃষ্টি করতে পারব কি না, তার দিল ভিজিয়ে নরম করতে পারব কি না? সোজা কথায় বলতে গেলে, মহফিলের সবাই প্রতিবারেই আমার পরীক্ষা নেয়। হ্যাঁ, আত্তা, তারা না বলে পরীক্ষা নেয়, এরা বলে কয়ে নিচ্ছে। তাতে কীই-বা এমন ফারাক?
শিষ্যেরা অচল অটল।
ওস্তাদ হেসে বললেন, ‘মৈঁ তো জাউংগা জরুর!’
শিষ্যেরা বজ্রাহত। আর্তরব ছেড়ে পাঞ্জাবি, যুক্তপ্রদেশি, বাঙালি, হিন্দু, মুসলমান তাবৎ শাগরেদ আরজ করলে, ‘আমরা যাচ্ছি নে ওই সব পাঁ– দের সামনে পরীক্ষা দিতে, আর আপনি যাবেন হুজুর?’
হুজুর বললেন, ‘য়েকিনান– নিশ্চয়ই।’
শিষ্যেরা তখন ‘ফারাম’ ‘form’-এর ভয় দেখালে। তাতে মেলা অভদ্র প্রশ্ন আছে। ওস্তাদ বললেন, ‘সে তো আদমশুমারির সময়ও আমার বুডঢী বিবিকে শুধিয়েছিল, তিনি অন্য কোনও পন্থায় কিছু আমদানি করেন কি না? ওসব বাদ দাও। ফারাম ভর দো।’
***
অডিশনিং-এর দিন টাঙা চড়ে গুরু চললেন, স্টুডিয়োর দিকে। সঙ্গে মাত্র একটি চেলা। বাকি চেলারা চালাকি করে আকাশবাণীকে জানায়নি যে তাদের ওস্তাদ অডিশনিঙে আসছেন– ওদের শেষ ভরসা এপয়েন্টমেন্ট নেই বলে শেষমেশ যদি সবকুছ বরবাদ-ভণ্ডুল হয়ে যায়। অবশ্য এ-কথাও ঠিক, ওস্তাদ ওদের পরীক্ষা দেবার জন্য হুকুম দেননি। নইলে ওরা নিশ্চয়ই অমান্য করত না।
লখনৌয়ের– কথার কথা বলছি– আকাশবাণী সেদিন কারবালার ময়দানের মতো খা-খা করছে। এমন সময় নামলেন গুরু টাঙা থেকে।
আকাশবাণীর ‘চ্যাংড়া’দের যত দোষ দিন, দিন– প্রাণভরে দিন, কিন্তু একথা কখনও বলবেন না, এরা ওস্তাদদের সম্মান করে না। আমার চোখের সামনে কতবার দেখেছি, প্রোগ্রাম এসিসটেন্ট কুলীনস্য কুলীন ব্রাহ্মণসন্তান কী রকম মুসলমান শুরুর পায়ের কাছে কুমড়ো গড়াগড়ি দিচ্ছে, মুসলমান পীরের ছেলে হিন্দু গুরুর পায়ে ধরে বসে আছে। এঁদের অসম্মান করে অবশ্য সেটা ওদের রুচির অভাব– ওপরওয়ালারা যারা সঙ্গীত বাবতে দীর্ঘকর্ণ।(১) ছোকরা কর্মচারীরা তো তন্মুহূর্তেই ওস্তাদকে তাদের চোখের পাতার উপর তুলে নিয়ে ঢুকিয়ে দিল অডিশনিং রুমে যেখানে ‘পরীক্ষক’রা বেকার উকিলদের মতো অনুপস্থিত মাছি মারছিলেন আর নিষ্ফল আক্রোশে আর্টিফিশেল দাঁতে দাঁতে কিড়মিড় খাচ্ছিলেন।
ওস্তাদকে দেখে তাঁরা স্তম্ভিত! এ কী কাণ্ড! যে-সব আনাড়ি ছোকরা গাওয়াইয়ারা দিনকে দিন বেতারকেন্দ্রের ছারপোকা-ভর্তি বেঞ্চিতে বসে দশ রুপেয়ায় প্রোগ্রামের জন্য ধন্না দেয় তারা পর্যন্ত আসেনি অডিশনিঙে– আর এই ওস্তাদের ওস্তাদ লখনৌয়ের কুবৃমিনার, তানসেনের দশমাবতার তিনি এসে গেছেন– এ যে অবিশ্বাস্য, বিলকুল গয়ের মুমকিন তিলিস্মাৎ।
একথা অনস্বীকার্য তাঁরা ওস্তাদকে প্রচুরাধিক ইজ্জৎ দেখিয়ে ইসতিকবাল (অভ্যর্থনা) জানালেন, সর্বোত্তম তাকিয়াটি তাঁর পিছনে চলন দিলেন। ওস্তাদের মুখ যথারীতি পানে ভর্তি ছিল। একটি ছোকরা ছুটে গিয়ে ওগলদন (পিকদান) নিয়ে সামনে ধরল।
কেউ কিছু বলার পূর্বেই ওস্তাদ বললেন, ‘সব যব জমগয়ে তব কুছ হো জায়–’ অর্থাৎ সঙ্গীতামোদীরা যখন একজোট হয়ে গিয়েছি তখন হোক কিঞ্চিৎ গাওনা-বাজনা! সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। নইলে কে তাঁকে সাহস করে পরীক্ষা দিতে বলত? ওস্তাদ সবিনয় শুধোলেন, কী গাইব?’ তার স্বরে চিৎকার উঠল, ‘সে কী, সে কী? গজব কি বাৎ! আপনার যা খুশি!’ (সাধারণ পরীক্ষার্থী জানে, এদের মামুলি পেশা বিৎকুটে, অচেনা রাগ বৎখৎ তালে গাইবার আদেশ দেওয়া )
ইতোমধ্যে বেতারকেন্দ্রের যে পয়লা-নম্বরি সারেঙ্গিওয়ালা ও ওস্তাদ তবলচি অডিশনিং বয়কট করে কেন্টিনে চা খাচ্ছিল তারা টাটু-ঘোড়ার মতো ছুটে এসেছে সঙ্গত দিতে–কর্তারা এদের অভাবে যে দুটি আকাট যোগাড় করেছিলেন, তারা বহু পূর্বেই গা-ঢাকা দিয়েছে।
ওস্তাদ ধরলেন তোড়ি। আলাপের সময় প্রত্যেকটি ধ্বনি যেন বকুলগাছ থেকে এক একটি ফুল হয়ে এদিক ওদিক ছিটকে পড়তে লাগল। যখন তালে এলেন তখন যেন ফুল নিয়ে সাতলহরা মালা গাঁথতে লাগলেন, প্রিয়ার কুন্তলদামে পরাবেন বলে।
আর সমস্তক্ষণ মুখে কী খুশির ছটা! জানুটা যেন ফুর্তিতে ভরপুর! ক্ষণে সারেঙ্গিলার দিকে মুখ বাড়িয়ে তার বাজনার তারিফ করে বলেন, ক্যা বাৎ, ক্যা বাৎ! ক্ষণে তবলচির দিকে দুই হস্ত প্রসারিত করে হুঙ্কার দেন, শাবাশ, শাবাশ, আফরিন, আফরিন! যেন ওরাই সব জমিয়ে চলছে! ওঁর কোনও কৃতিত্ব নেই।
গান থামল। আনন্দে বিস্ময়ে সবাই এমনই স্তম্ভিত যে পুরো এক মিনিট পরে হর্ষধ্বনি ও সাধুবাদ রব উঠল।
ইতিমধ্যে ‘পরীক্ষক’দের একজন ওস্তাদের সঙ্গী ছোকরা শাকরেদের কাছ থেকে অন্য সকলের অজান্তে সেই ‘ফারাম’খানা চেয়ে নিয়েছে। ওইটেতে পাস না ফেল, কোন হারে দক্ষিণা বেঁধে দিতে হবে সেসব লিখে দিতে হয়।
হঠাৎ তার চোখে পড়ল, সেখানে প্রশ্ন, আপনি কোন রাগ-রাগিণী জানেন? তার উত্তরে লেখা মাত্র একটি শব্দ : ‘তোড়ি’।
বিস্ময়! বিস্ময়!! এ কখনও হয়!!! পরশু দিনের কাঁচা গাওয়াইয়াও তো লিখত ডজন দুই ওস্তাদ জানেন কত শত, এ তো রসজ্ঞদেরও কল্পনার বাইরে।
অতিশয় বতরিবৎ এবং প্রচুর মাফ চেয়ে সেই ‘পরীক্ষক’টি বৃদ্ধ ওস্তাদকে শুধোলেন– অল্প অবিশ্বাসের স্মিতহাসি হেসে, ‘ওস্তাদ, এ কখনও হয় যে, আপনি একমাত্র তোড়ি ছাড়া আর কিছুই জানেন না?’
সকলের মুখেই প্রসন্ন মৃদু হাস্য। সারেঙ্গি-তবলা মাথা নিচু করে জাজিমের দিকে তাকিয়ে।
যে-কোনও বিদ্যাতেই তোমার যদি অভিমান থাকে তবে, পণ্ডিত পাঠক, এই বেলা তুমি কান পেতে শোনো আমার জীবনে তার উত্তরটি নিবিড় ঘন আঁধারে ধ্রুবতারার মতো জ্বলে তিনি কী উত্তর দিলেন।
ঠণ্ডী সাঁস লে কর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ওস্তাদ বললেন, ‘পচাস সালসে তোড়ি গা রহাহুঁ– অভি ঠিক তরহসে নহি নিকলতি।’
অর্থাৎ পঞ্চাশ বছর ধরে তোড়ি গাইছি। এখনও ঠিকমতো বেরোয় না। অন্য রাগ-রাগিণীর কথা কেন বৃথা শুধোও।
১৬।১০।৬৫
———-
১. প্যারিসে একবার একটি উদ্ধৃষ্ট সঙ্গীতানুষ্ঠান কর্তাদের নেকনজর পায়নি শুনে ভলতেয়ার সেই সঙ্গীতস্রষ্টাকে একটি চৌপদী লিখে সান্ত্বনা জানান, হায়, বড়লোকদের যে কানও বড় হয়’ (অর্থাৎ গাধা)। আমি ব্যক্তিগতভাবে একটি উদাহরণ জানি। গুণী, ওস্তাদ রবিশঙ্কর তখন দিল্লি-আকাশবাণীর সঙ্গীতাধিনায়ক। গাঁধীর জন্মদিনে সেক্রেটারি তাকে ডেকে হুকুম দেন, ওই উপলক্ষে তিনি গাঁধীর তাবৎ জীবনী– দক্ষিণ-আফ্রিকা, বরদলৈ, উপবাস, সলট-মার্চ-প্রতিফলিত করে যেন নতুন কিছু ‘কম্পোজ’ করেন। বিহ্বল, প্রায়ান্ধ উদ্ভ্রান্তদৃষ্টি রবিশঙ্কর চলেছেন করিডর দিয়ে আমার সঙ্গে আচমকা কলিশন। সম্বিতে এসে আমাকে দেখে করুণ হাসি হেসে তাবৎ বাৎ বয়ান করে শুধোলেন, এ কখনো হয়?’ আমি বললুম, ‘আপনি যখন বাজান তখন আমার মতো সঙ্গীতে আনাড়িরও মনে হয়, আপনার পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। তবে কি না- হেঁ হেঁ হেঁ, সেক্রেটারি বোধ হয় বিলিতি সিমফনি, পাস্তোরাল-টাস্তোরাল বই পড়ে (শুনে নয়) আমেজ করছেন, এ দেশেই-বা হবে না কেন?’ রবি শুধোলেন, করি কী?’ আমি সবিনয়ে বললুম, একটা বাবদ আমার মতো আকাটও একটা সাজেশন দিতে পারে।’ ‘কী কী?’ ‘ওই সল্ট-মার্চের জায়গায় এসে আপনি যন্ত্রের তারগুলোতে করকচ-নুন মাখিয়ে নেবেন।’