পঞ্চাশের কোঠায় রাসূল (সাঃ)
সফল পরিবর্তনের জন্য দরকার সফল নেতৃত্ব। সফল নেতৃত্ব মানে লোকেরা আগে যা চায়নি, তা চাওয়ার স্পৃহা জাগিয়ে তোলা এবং পাওয়ার ব্যবস্থা করা। নেতৃত্ব মানে লোকেরা যখন মনে করেছে কিছু পারবে না, তখন তাদের দিয়ে তা করানো। একজন নেতা ঝুঁকি নেন, সুযোগ খোঁজেন। তিনি এমন কিছু দেন যাতে মানুষ বিশ্বাস করে, অর্জনের জন্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করেন। রাসূল (সাঃ) যখন মদিনায় আসেন, তখন শহর জিনিসটার নতুন সংজ্ঞা দেন। নতুন সম্পর্ক গড়েন, বিশ্বাসের জন্য মানুষকে নতুন দর্শন দেন। নেতা হওয়া যদিও সহজাত গুণ, তবে এটা শেখাও যায়। প্রয়োগ করা যায়। এমনকি অপেক্ষাকৃত হালকা পর্যায়ের দায়িত্বের বেলাতেও।
নেতৃত্ব গুণ
৫৩ বছর বয়সে রাসূল (সাঃ) মক্কায় পাড়ি জমান। শহরের প্রধান হিসেবে সেখানে তিনি জীবনের বাকি ১০ বছর কাটান। চল্লিশ যদি হয় পরিবর্তনের সময়, তাহলে পঞ্চাশ হলো নেতৃত্বগুণ প্রয়োগের সময়। কেউ কেউ মনে করেন শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই বুঝি নেতা শব্দটা খাটে। কিন্তু যেকোনো পর্যায়ে দায়িত্ব নিলেই কিন্তু কেউ নেতা হয়ে উঠতে পারে। হতে পারে সেই দায়িত্ব আপনার পরিবারের, আপনার শিক্ষার্থীর, আপনার কর্মচারীদের অথবা সেটা হতে পারে যে কারও উন্নতির জন্য তার দায়িত্ব নেওয়া।
নেতৃত্বের কিছু কিছু গুণ মানুষ জন্ম থেকেই পায়। তবে অন্য যেকোনো দক্ষতার মতো প্রশিক্ষণ ও চর্চার মাধ্যমে এটাও যে-কেউ অর্জন করে নিতে পারে। এজন্য কোনো নির্দিষ্ট বয়সে পৌছার দরকার পড়ে না। নেতৃত্বের ভার হাতে নেওয়ার জন্য আপনি কতটা তৈরি এবং আপনার মধ্যে দায়িত্ববোধ কতটা, এটা তার ওপর নির্ভর করে।
এই অধ্যায়ে আমরা দেখব যুদ্ধ ও শান্তির সময়ে রাসূল (সাঃ) নেতা হিসেবে কেমন। ছিলেন। কীভাবে তিনি কোনো লোকের ব্যক্তিত্ব ও সংস্কৃতি অনুযায়ী তার সাথে আচরণ করেছেন। এই অধ্যায়ের উদ্দেশ্য শুধু মদিনার ঘটনাগুলোর বর্ণনা না। চিরায়ত জীবনীগ্রন্থগুলোতে এগুলোর বিস্তারিত খুঁজে পাওয়া যাবে। এখানে আমি দেখাব কীভাবে রাসূল (সাঃ) এর মদিনা জীবন থেকে আপনি নেতা হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত হতে পারেন। সেই নেতৃত্ব হতে পারে পরিবারের, কর্মক্ষেত্র বা যেকোনো দায়িত্বে; এমনকি নিজের ওপরও।
মদিনা
প্রথমে আমরা মদিনা নগর এবং মদিনার অধিবাসী সম্পর্কে কিছু জানব। কীভাবে উভয়ের উন্নয়ন ধারাকে রাসূল (সাঃ) নেতৃত্ব দিয়েছেন। বর্তমান সাউদি আরাবিয়ার উত্তর দিকে মদিনার অবস্থান। দুপাশে দুই পাহাড়, উত্তরে উহুদ, দক্ষিণে আইর। মদিনা আরবের মরুদ্যান। এর মাটি উর্বর। ভূতলে প্রচুর পানি। নিচু নিচু উপত্যকা দিয়ে বৃষ্টির ধারা বয়ে চলে মৌসুমী নদীর মতো।
মদিনার নাম আগে ছিল ইয়াসরিব। মক্কা থেকে এটা প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে। ইসলাম আসার আগে মক্কার যেমন একটা ধর্মীয় মর্যাদা ছিল, মদিনার তেমন কিছু ছিল না। গোত্র-লড়াই ছিল স্বাভাবিক। বাণিজ্যিক কোনো কেন্দ্রও ছিল না। কারণ কোনো কাফেলা রুটের মাঝখানে এটা ছিল না।
এর তেমন কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতাও ছিল না। কেন্দ্রীয় কোনো হাজতখানা বা পুলিশ বাহিনী ছিল না। যদিও এর আয়তন মক্কার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। মদিনার প্রত্যেক প্রতিবেশী গোষ্ঠীর নিজস্ব আশ্রয়স্থল বা দুর্গের মতো ছিল। এটা তাদের পাশের প্রতিবেশি থেকে তাদের রক্ষা করত। এরকম দুর্গের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৮টি। প্রশ্ন হলো, রাসূল (সাঃ) কীভাবে এমন এক অস্থিতিশীল অনিরাপদ শহর সামলালেন?
এক শব্দে বলতে গেলে, তিনি পরিবর্তনের একটা ধারা শুরু করেছিলেন। কোথাও কোনো পরিবর্তন আনার আগে যেকোনো বিচক্ষণ নেতাই সতর্কতার সাথে পরিস্থিতি নির্ণয় করেন। রাসূল (সাঃ) ও তা-ই করেছিলেন।
আমরা দেখব, ধর্ম বা ব্যক্তিগত বিশ্বাস যা-ই হোক, কীভাবে তিনি মানুষের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়েছিলেন। আস্থা ও নিরাপত্তা অর্জনে সবার মধ্যে দায়িত্ব বন্টন করে দিয়েছিলেন। আমরা তাঁর নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জগুলোও দেখব। যারা তাঁর নেতৃত্বে বাগড়া দিয়েছিল, তাদের সাথে তিনি কীভাবে আচরণ করেছিলেন তাও দেখব। মক্কাবাসিদের সাথে বড় তিনটি লড়াইয়ে (বদর, উহুদ, খন্দক) রাসূল (সাঃ) এর অ্যাকশন থেকে বিভিন্ন উপকার নেব। দেখব কীভাবে রাসূল (সাঃ) তাঁর প্রভাব বাড়িয়েছেন এবং অবশেষে মক্কা জয় করেছেন মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে।
যোগ্য নেতৃত্ব
৬২২ সালের জুনে ইয়াসরিবে পৌছে মানুষের মাঝে রাসূল (সাঃ) নতুন বাস্তবতা তৈরি করেন। দ্রুত তিনি উন্নয়নমূলক কাজ হাতে নেন। স্থানীয় অধিবাসীদের ধর্ম বিশ্বাস যা-ই হোক, তিনি সবার যাতে কল্যাণ হবে সে অনুযায়ী বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। যেমন ইয়াসরিবকে তিনি পবিত্র শহর হিসেবে ঘোষণা করেন। এখানে মক্কার মতো হানাহানি নিষিদ্ধ করেন। সামগ্রিক নিরাপত্তার জন্য গোটা শহরের অধিবাসীদের দায়িত্ব দেন।
হাদীস অনুযায়ী রাসূল (সাঃ) বলেন,
“ইবরাহীম নবি আলাইহিস সালাম যেভাবে মক্কাকে হারাম করেছেন, আমিও সেভাবে মদিনাকে হারাম করেছি।
মদিনার জনগণ রাসূল (সাঃ) এর নেতৃত্ব নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট ছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, এদের বেশিরভাগই ছিলেন অমুসলিম। আর তারা তাঁকে নবি বলে মানতেনও না। এই যে এত বিশাল সংখ্যক জনগণ তাঁকে নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন, এটা কিন্তু খাটো করে দেখার উপায় নেই। কারণ, এ রকমটা কখনো মদিনায় আগে দেখা যায়নি। যে জায়গা গোষ্ঠীলড়াইয়ে বিভক্ত ছিল, সেখানে বাইরে থেকে আগত কারও নেতৃত্ব মানা তো দূরের কথা, স্থানীয় কোনো একক নেতার অধীনে যে এক হবে, এমনটা ভাবাই যেত না।
প্রত্যেক গোত্র নিজেদের পাড়ায় থাকত। প্রত্যেক পাড়া মাঝখানে খামার, খালি জায়গা বা দুর্গ দিয়ে আলাদা থাকত। প্রত্যেক পাড়ার দায়িত্বে থাকতেন একজন শেখ। বিভক্ত আর অস্ত্রসস্ত্রের মজুদ থাকার কারণে প্রত্যেক পাড়া হুমকির মুখে থাকত। পরিস্থিতি এত নাজুক হয়ে পড়েছিল যে, তারা নিজেরাও আমূল সংশোধন গ্রহণের জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল।
বাস্তব নেতৃত্বের ভিত্তি
মক্কায় আসার আগেই রাসূল (সাঃ) এর সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। যে কারণে মদিনার লোকেরা সাগ্রহে তাঁর নেতৃত্ব বরণ করে নিয়েছিল। তারা তাঁর যোগ্যতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই তা করেছিল। ভয় কিংবা জোরজবরদস্তিতে না। রাসূল (সাঃ) এর নেতৃত্বের এই দিকটা আপনাকে অনুপ্রাণিত করুক। আপনার যোগ্যতার ওপর অন্যদের আস্থা আর শ্রদ্ধাই যেন হয় আপনার নেতৃত্বের ভিত্তি। কঠিন সময়ে তাদের সহযোগিতা পেতে এটাই কাজে দেবে।
মদিনার কেন্দ্রে তিনি ২০০ স্কয়ার ফিটের মসজিদ বানান। সাথে তাঁর থাকার জায়গাও। খাদিজার মৃত্যুর পর তিনি আবার বিয়ে করেছিলেন। মদিনায় তাঁর সাথে যেসব মুসলিম হিজরত করেছিলেন তাদের সাথে নিয়ে তিনি মসজিদ বানান। নিজ হাতেও কাজ করেছেন। তার সাথে যারা মসজিদ বানানোতে হাত লাগিয়েছিলেন, তাদের বেশিরভাগই ছিলেন ব্যবসায়ী। যারা কিনা অন্যান্য দাস বা কর্মচারীদের কাজের ভার দিতেন। রাসূল (সাঃ) নিজ হাতে মসজিদের নির্মাণ কাজে অংশ নিচ্ছেন এটা দেখে হাতপা গুটিয়ে বসে থাকা মদিনায় হিজরতকারী মুসলিমগণের পক্ষে সম্ভব ছিল না। যেখানে রাসূল (সাঃ) কাজ করছেন সেখানে আমরা বসে থাকি কীভাবে- এমনটাই ছিল তাদের মনের অবস্থা।
জামায়াতবদ্ধ হয়ে সালাত পড়ার জন্য মুসলিমগণ এ মসজিদে জড়ো হতেন। মদিনায় আসার প্রায় ছয় মাস পর আযান চালু হয়। প্রথমদিকে জেরুজালেমের দিকে ফিরে মুসলিমগণ সালাত আদায় করতেন। মদিনার ইহুদি গোষ্ঠী চুক্তি ভাঙার পর এবং তাঁকে নবি হিসেবে না-মেনে আগেকার ধর্মগ্রন্থের ওপর পড়ে থাকায় মহান আল্লাহর নির্দেশে কিবলা বা সালাতের অভিমুখ মক্কার দিকে ফেরানো হয়। মদিনার দ্বিতীয় বছরে মুসলিমগণ রমযান মাসে সিয়াম পালন করতে শুরু করেন।
নেতৃত্ব মানে শুধু ক্ষমতা না; বরং অন্যের অনুসরণের জন্য নজির তৈরি করে দেওয়া। দ্যা লিডারশিপ অফ মুহাম্মাদ বইতে জন আদাইর বলেছেন,
শ্রম, বিপদ ও কঠিনতায় লোকদের সাথে ভাগাভাগি করার মাধ্যমে মুহাম্মাদ ভালো নেতৃত্বের এক সার্বজনীন মূলনীতি দেখিয়েছেন। মানুষ মনে মনে আসলে তাদের নেতাদের কাছ থেকে এটাই চায়। যখন তা হয় না, তখন বিরূপ মন্তব্য আসে।
মদিনাবাসী
সে সময়ে মদিনার মোট জনসংখ্যা কত ছিল তা জানা যায় না। তারা গুচ্ছ গুচ্ছ গোষ্ঠীদলের মতো বাস করত। প্রত্যেক ক্ল্যান বা গোত্র নিজেদের অধীন অঞ্চলে থাকত। আরবের অন্যান্য গোষ্ঠীর বাইরে মদিনাবাসীদের দুটো ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ছিল
- ইহুদি: প্রায় বিশের অধিক ইহুদি গোত্র ছিল। এদের কারও কারও আদি উৎস ছিল লেভান্ত। এদের অনেকেই ছিল দক্ষ কামার, ট্যানার অথবা কৃষক।
- মুসলিম হিজরতকারী: এরা মক্কা অথবা ইথিয়োপিয়া থেকে এসেছিল। নিজেদের থাকার জায়গা হওয়ার আগে কেউ মসজিদে থাকতেন। কেউ মদিনার মুসলিম কনভার্টদের বাড়িতে। প্রথম দফায় প্রায় ৬০ জন মুসলিম এসেছিলেন। পরে মক্কা ও তার আশেপাশের জায়গা থেকে হিজরতকারীর সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়।
সম্পর্ক বদল
রাসূল (সাঃ) একজনের সাথে আরেকজনের সম্পর্ক বদলে দিয়েছেন। শত্রু মনোভাব আর সন্দেহের বদলে নাগরিকত্ব ও আস্থার ওপর সম্পর্ক গড়ার পথ তৈরি করে দিয়েছেন। তিনি এটা করেছিলেন মদিনা সংবিধানের মাধ্যমে। এটা তৎকালীন ভাষায় লেখা। অনেক নেটিভ আররে কাছেও এর কিছু কিছু অংশ বুঝা কঠিন। এর ৫২টি ধারার শব্দ কিছুটা অপ্রচলিত হলেও সামাজিক চুক্তি লিখে রাখার ঘটনাসেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ছিল বৈপ্লবিক। আজও অর্থবহ।
রাসূল (সাঃ) সেখানে মদিনার সবাইকে এক জাতি বলেছেন। মদিনাকে পবিত্র শহর ঘোষণা করেছেন। মক্কার মতো সব ধরনের হানাহানি এখানে নিষিদ্ধ করেছেন। স্থানীয় জনগণকে নিরাপত্তার জন্য দায়ভার বেটে দিয়েছেন। সবার জন্য যার যার ধর্ম বিশ্বাস চর্চার স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছেন।
Leadership &The New Science’ বইতে মার্গারেট হুইটলি বলেছেন,
‘চিরাচরিত নেতারা নজর দেন ভূমিকা আর দায়িত্বের ওপর। নতুন নেতারা মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যেটা হয়ে উঠে সাফল্যের আসল শক্তি’।
মদিনা সংবিধান শুধু এর ধারার শব্দগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল না; বরং সমাজের সবার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্যও। শুধু বিধিবিধান কোনো সফল রাষ্ট্র, কোম্পানি বা পরিবার গড়ে দেয় না। প্রত্যেক অধিবাসী যখন বুঝে, সে নিজের গোষ্ঠীর চেয়ে বড় কোনো অস্তিত্বের অংশ তখন সে সানন্দে সব করে। রাসূল (সাঃ) এটা বুঝেছিলেন। পূরণ করেছিলেন। যে কারণে মদিনার সংখ্যাগরিষ্ঠ অমুসলিমরাও তাঁর নিয়ম মেনে নিয়েছিল।
পরিবর্তনের পথে
রাসূল (সাঃ) মদিনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনেন। কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। নিরাপত্তা জোরদার করেন। হিজরতকারী মুসলিমগণের জন্য ম্যালেরিয়া রোগের উর্বর এক জলাভূমি পরিষ্কার করে বাড়িঘর বানিয়ে দেন। এরা হয় মসজিদে ঘুমাতেন, নয় অন্যান্য পরিবারের সাথে অস্থায়ীভাবে থাকতেন।
বদর যুদ্ধের পর কাফেরদের সাথে লড়াইয়ে ঘোড়ার প্রয়োজনীয়তা টের পাওয়া যায়। রাসূল (সাঃ) ঘোড় দৌড়ের জন্য আলাদা জমির ব্যবস্থা করেন। লোকদেরকে ঘোড়া কিনতে উৎসাহিত করেন। তিনি শিক্ষাদীক্ষাকে উৎসাহিত করেন। নিরক্ষরতা দূর করার জন্য যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেন। তারা মদিনার শিশুদের লিখতে পড়তে শেখাতেন।
কীভাবে পরিবর্তনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন?
- প্রথমে পরিবর্তনের চাহিদা তৈরি করুন। আপনার লোকজনদের সাধারণত ৭৫ ভাগকে পরিবর্তনের গুরুত্বের ব্যাপারে আশ্বস্ত হতে হবে।
মদিনার জনগোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে লাগাতার মারামারির কারণে শান্তিতে জীবনযাপনের প্রয়োজনীয়তা চেপে ধরেছিল। তাই তারা রাসূল (সাঃ) এর সংস্কার নিয়ে খুশি ছিল, কারণ তারা নিরাপদের জীবনযাপনের জন্য তৃষ্ণার্ত পথিকের মতো হা করে ছিল।
- পরিবর্তন নিয়ে আপনার রূপরেখা পরিষ্কারভাবে বলুন। কোনো অসঙ্গতি যেন না-থাকে। তাহলে লোকজন বুঝবে আপনি আসলে কী চান। তারা নিজের চোখে সব দেখতে পারবে।
নিরাপদ ও ভবিষ্যৎ মদিনার ব্যাপারে রাসূল (সাঃ) তাঁর কথা স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘মদিনাকে আমি হারাম করলাম যেভাবে নবি ইবরাহীম আলাইহিস সালাম মক্কাকে হারাম করেছিলেন। একথা শোনামাত্র সবাই নিজেদের শহরকে মক্কার মতো নিরাপদ কল্পনা করতে পেরেছিলেন।
- পরিবর্তনের ব্যাপরে যারা আশ্বস্ত তাদের নিয়ে কাজ করুন। এদের মধ্যে থাকতে পারেন উচ্চপদ অফিসিয়াল ও অন্যান্য প্রভাবশালী লোক।
বদর যুদ্ধে কুরাইশদের চ্যালেঞ্জ করতে যারা তার পরিকল্পনাকে মজবুত করবে রাসূল (সাঃ) তাদের সমর্থন খুঁজেছেন। সা’দ ইব্ন্ মু’আযের মতো গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠী প্রধানদের কাছে পেয়েছিলেন।
নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ
একজন নেতাকে সবসময় বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হতে হয়। যেমন কঠিন সময়, ঝামেলা পাকানো লোকজন অথবা যারা পরিবর্তনের ঘোরবিরোধী এমন লোকজন।
মদিনায় রাসূল (সাঃ) দুধরনের লোকদের থেকে বেশি সমস্যার মুখোমুখী হয়েছেন। এদের একদল আমার ভাষায় বাগড়া-বাধানো ধরনের লোক। যারা তাদের স্বার্থে ঝুঁকি খুঁজে পেয়েছিল। দ্বিতীয় দল শক্তভাবে ভিন্নমতাবলম্বী, যারা কায়নুকার ইহুদি গোত্রের সাথে মিলিত হয়েছিল। এখন আমরা দেখব, দুটো দলের সাথে রাসূল (সাঃ) কীভাবে তাঁর নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ সামলেছিলেন।
আমি চাই,এখান থেকে আপনিও আপনার বিরোধীদের সাথে মোকাবিলায় শক্তি পান। চলুন বিরোধীদের মোকাবিলার পরিকল্পনার রসদ খুঁজি।
বাগাড়া-বাধানো দল
কেউ কেউ রাসূল (সাঃ) যেসব পরিবর্তন আনতে চাচ্ছিলেন তাতে বাধা দিয়েছিল। তিনি তাদের স্বার্থের জন্য হুমকি ছিলেন। আবার যে অবস্থায় তারা অভ্যস্ত ছিল তার প্রতিও রাসূল (সাঃ) এর পরিবর্তন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। তারা রাসূল (সাঃ) এর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ঝামেলা পাকানো, অস্থিরতা তৈরি এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নড়বড়ে করে দেওয়ার হীন উদ্দেশ্যে আদ দিরার নামে ভিন্ন একটি মসজিদ বানায়। তাদের কোনো নির্দিষ্ট গোত্র বা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল না। এটা ছিল পরিবর্তনের ঘোরবিরোধী লোকদের জোট। আল্লাহ তায়ালা এদেরকে মুনাফিক বলেছেন।
তারা সংখ্যায় মোট কত ছিলেন আমরা জানি না। কিংবা তারা কোনো জনগোষ্ঠীর অংশ ছিলেন কিনা তাও জানা যায় না। তাদের সবচেয়ে বিখ্যাত নেতা ছিলেন আবদুল্লাহ ইব্ন্ উবাই। বদর যুদ্ধে মুসলিমগণের জয়ের পর তিনি অনিচ্ছাবশে ইসলাম গ্রহণ করেন। এদের মোকাবিলার জন্য রাসূল (সাঃ) তাদের ব্যক্তিত্ব এবং সমস্যার ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন কৌশল খাটিয়েছিলেন। কখনো তাদের সাথে সংলাপে বসতেন। কখনো কাউকে উপেক্ষা করতেন। আবার কখনো কখনো কাউকে কাউকে মদিনা থেকে বের করে দিতেন।
ভিন্নমতাবলম্বী লোকজন
অন্যরা মদিনা সংবিধানের বিরোধিতা করেছিল। মদিনার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেমন কায়নুকা গোত্র। এরা তুলনামূলক ধনী গোষ্ঠী। মদিনার বাজারে এদের আধিপত্ব ছিল। বদর প্রান্তর থেকে বিজয়ী হয়ে ফেরার পর রাসূল (সাঃ) কায়নুকা গোষ্ঠীকে মদিনা বিধান লঙ্ঘনের ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দেন। এতে করে তাদের এক নেতৃত্বস্থানীয় লোক স্পর্ধার সাথে বলেছিল,
তোমরা এমন একদল (মক্কার কুরাইশরা) লোকের সাথে লড়েছ, যারা জানে না কীভাবে লড়াই করতে হয়। আমাদের সাথে এসো, তাহলে বুঝবে লড়াই কী জিনিস।
সুদ নিষিদ্ধ করায় ওদের মেজাজ এমনিতেই চড়ে গিয়েছিল। আজকালকার দিনের বন্ধকি ব্যবস্থার মতো মরিয়া ধার-গ্রহিতাদের চড়া সুদে ঋণ দিয়ে এসব স্বর্ণব্যবসায়ীরা লাভ করত। মুসলিমগণ সুদমুক্ত বাজার তৈরি করায় তাদের এই লাভের গুরে পিপড়া বাসা বাধে।
পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয় যখন কায়নুকা গোষ্ঠীর কিছু লোক একজন মুসলিম নারীর শ্লীলতাহানি করে এবং এর কিছুদিন বাদে এক মুসলিম পুরুষকে মারতে মারতে মেরে ফেলে। তারা তার রক্তপণ দিতেও অস্বীকার করে। স্থানীয় নিরাপত্তার জন্য বিষফোঁড়া হিসেবে না-রেখে রাসূল (সাঃ) তাঁর বাহিনী জড়ো করে এই গোষ্ঠীকে মদিনা ছাড়া করেন।
দ্বন্দ্ব নিরসন
নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনার মাঝে পার্থক্য আছে। নেতৃত্ব মানে নির্দিষ্ট ভিশন। ব্যবস্থাপনা মানে সেই ভিশন অর্জনের তত্ত্বাবধান। রাসূল (সাঃ) এর মধ্যে এই দুটো গুণই ছিল। তিনি প্রথমে একটি ভিশন দিয়েছেন, পরে সেটি বাস্তবায়নে কাজ করেছেন। অন্যান্যদেরকেও এগুলো শিখিয়েছেন। যেমনকাউকে সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব দিয়েছেন, কাউকে নিজের অবর্তমানে মদিনার দায়িত্ব দিয়েছেন।
বদর, উহুদ, খন্দকের যুদ্ধে রাসূল (সাঃ) এর নেতৃত্বের ধরন এবং তিনি কীভাবে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব নিরসন করেছেন এখন আমরা তা দেখব। আমাদের লক্ষ্য এসব যুদ্ধের গভীরে যাওয়া না; বরং কঠিন অবস্থায় রাসূল (সাঃ) এর চিন্তা ও চর্চা কী ছিল সেটা দেখা উদ্দেশ্য। তাহলে বদর দিয়ে শুরু করি।
বদরের যুদ্ধ
যুদ্ধ সবসময়ই ভীষণ ক্ষতিকর। তবে কখনো কখনো এটা দরকার মূল্যবোধ বজায় রাখার জন্য, যেমন ইবাদাতের স্বাধীনতা’।
সাউদি আরাবিয়ার লোহিত সাগরের উপকূল রেখা ধরে হিজায অঞ্চলে রাসূল (সাঃ) তাঁর প্রভাব বাড়ান। অন্যান্য বেশকিছু গোষ্ঠীর সাথে মৈত্রী চুক্তি সাক্ষর করেন। বিশেষ করে যারা ছিল মদিনার প্রান্ত ও উপকূল অঞ্চলে। এর লক্ষ্য পরিষ্কার: মক্কার কাফেলা যেসব জায়গা দিয়ে অতিক্রম করে সেসব জায়গার গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব বন্ধ করা। নিশ্চিত করা এসব গোষ্ঠীগুলো যাতে যুদ্ধে না-জড়ায়। রাসূল (সাঃ) কুরাইশদের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথে বাধা তৈরি করতে পেরেছিলেন। ফলে তারা ব্যয়বহুল পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিল।
এমন এক ঘটনায় রাসূল (সাঃ) বিশাল এক কুরাইশ কাফেলার গতি রোধ করতে সক্ষম হন। এখানে ২ হাজার উট ছিল। সিরিয়া থেকে আমদানীকৃত প্রায় ৫০ হাজার দিনারের মূল্যমানের মালামাল ছিল। যখন তারা জানতে পারল যে, রাসূল (সাঃ) এর লোকেরা এগিয়ে আসছে, তখন তারা তাদের পথ বদলাতে বাধ্য হয়।
মক্কায় এ নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায়। মদিনার লোকদের উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য মক্কার একাংশ সশস্ত্র বাহিনী পাঠানোর যুক্তি তুলে ধরলে তা সফল হয়। এক হাজার সৈন্য ও সাতশ উটের বিশাল বহর নিয়ে তারা যাত্রা শুরু করে। রাসূল (সাঃ) ভাবেননি যে, বিষয়টা এদিকে গড়াবে। অপ্রস্তুত অবস্থায় তিনি তিনশ যোদ্ধা ও সত্তর উটের বাহিনী জড়ো করতে সক্ষম হন।
যোদ্ধা ও সরঞ্জাম সেই সময়ের যুদ্ধে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মুসলিমদের ছিল মাত্র দুটো ঘোড়া। উটের চেয়ে তড়িৎ আক্রমণে ঘোড়া বেশি কার্যকর। কুরাইশদের ছিল একশ ঘোড়া। সোজা কথায়, মক্কাবাসিদের চেয়ে মুসলিমগণের অস্ত্রশস্ত্র মারাত্মক কম ছিল। রাসূল (সাঃ) কীভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করলেন?
বদর যুদ্ধে রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সৈন্যদের অভিনব ফরমেশনে সাজালেন। ইংরেজি শেপের মতো সমান্তরাল দুই লাইনে সৈন্যরা দাঁড়াল। উভয়ের পিঠ উভয়ের দিকে। মাঝখানে আড়াআড়িভাবে সৈন্যদের এক লাইন। এর ফলে হলো কি, শত্রুবাহিনী কোনোদিক থেকেই মুসলিম বাহিনীকে চেপে ধরতে পারল না। তিনি তাঁর বাহিনীর কিছু অংশকে বৃষ্টির পানি জমে যেখানে খাবার পানি জমে ছিল, সেটার নিয়ন্ত্রণে রাখলেন। এরপর উপর থেকে সবকিছু দেখার জন্য এবং আদেশ দেওয়ার জন্য তিনি উঁচু জায়গা থেকে যুদ্ধ তত্ত্বাবধান করলেন। সবাইকে চমকে দিয়ে এই যুদ্ধ মুসলিমগণ জয় করে নেন। ৭০ জন কাফের নিহত হয়। আরও ৭০ জন বন্দী হয়।
উহুদ পাহাড়
বদর যুদ্ধের একবছর পর কুরাইশদের সাথে মুসলিমদের আবার যুদ্ধ বাধে। এবার তারা অনেক বড়সড় বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হয়। তাদের সাথে ছিল ৩ হাজার যোদ্ধা, ৩ হাজার উট, ২ শ ঘোড়া। যুদ্ধের ময়দানে চিয়ার আপ করার জন্য ছিল নারী। কুরাইশ বাহিনী মদিনার দক্ষিণ দিক থেকে এগোয়।
কিন্তু আগ্নেয় পাহাড়ের মতো জায়গার কারণে উটের গতি কমে যায়। যে কারণে তারা পরে উত্তর দিক থেকে এগোয় উহুদ পাহাড়ের দিকে। এটি মদিনার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। সাগরপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা প্রায় ১ হাজার মিটার। রাসূল (সাঃ) এর বাসা থেকে এর দূরত্ব চার কিলোমিটার।
এই যুদ্ধে মুসলিমরা এমনভাবে অবস্থান নিয়েছিল যে, উহুদ পাহাড় ছিল তাদের পেছনে। যেখান থেকে তাদেরকে মাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, যদি না কুরাইশ বাহিনী ৭০০ মিটার উঁচু পাহাড় পথ পার না করে। তাও আবার সেটা রাসূল ৫০ জন সৈন্য দিয়ে পাহারা দিয়ে রেখেছেন। কড়া নির্দেশ দিয়েছেন জয়-পরাজয় যা-ই হোক, কেউ যেন জায়গা ছেড়ে একচুলও না-নড়ে। মুসলিম বাহিনীর সাতশ সৈন্যকে রাসূল (সাঃ) আদেশ দিয়েছিলেন ব্যক্তিগতভাবে না লড়ে একাট্টা হয়ে যুদ্ধ করতে। কারণ চারগুণ বেশি কুরাইশ বাহিনীর সাথে ব্যক্তিগতভাবে লড়লে ময়দান থেকে মুহূর্তেই তারা হাওয়া হয়ে যাবে।
দুই বাহিনী মুখোমুখী হলো। প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলিমরা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। উঁচু টিলার ওখানে যে ৫০ জন দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা ভেবেছিলেন যুদ্ধে মুসলিমরা জিতে গেছে। তারা পলায়নপর কুরাইশদের থেকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ নেওয়ার জন্য তাদের জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলেন। পাহাড় অরক্ষিত থাকার পুরো সুযোগ সেদিন কুরাইশ বাহিনী নিয়েছিল। তারা আবার জড়ো হয়ে মুসলিমদের পরে পরাজিত করে।
নেতৃত্ব শিক্ষা (এক)
- ক্ষমা করুন: কাউকে শেখাতে বা গড়ে তুলতে সময় লাগে। কখন ক্ষমা করলে ভালো হবে সেটা জানলে ভালো ফল পাবেন। যারা পাহাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল রাসূল (সাঃ) তাদের কঠোর তিরস্কার করেছিলেন। কিন্তু মাত্রা ছাড়িয়ে যাননি। অনুরূপভাবে ভুল করলে আপনার কর্মচারী বা সন্তানের সাথে মাত্রাতিরিক্ত কঠিন হবেন না। সেক্রেতান বলেছেন ‘অহম বলে ন্যায্য হও’। ‘আত্মা বলে দরদি হও’।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
‘তুমি তাদের সাথে কোমল ছিলে। তুমি যদি তাদের সাথে রূঢ় হতে এবং কঠিন হৃদয় হতে, তাহলে তারা তোমাকে ছেড়ে চলে যেত। তাদের ক্ষমা কর। তাদের জন্য ক্ষমা চাও। সলাপরামর্শ কর। আলে ইমরান : ১৫৯
- সবকিছু জানুনঃ নিজে যদি দক্ষ না-হন, নিজের ভূমিকা নিজেই না জানেন, তাহলে নেতা হিসেবে কীভাবে অন্যদের শ্রদ্ধা অর্জন করবেন? রাসূল (সাঃ) ৭০ জন যোদ্ধাকে কুরাইশ বাহিনীকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে বলে দিয়েছিলেন, যদি কুরাইশরা ঘোড়ায় চড়ে আসে, তাহলে তারা মদিনায় হামলা করবে (ঘোড়া ব্যবহৃত হতো দ্রুত গতি আর কম দূরত্বের নড়াচড়ার জন্য) আর যদি তারা উটে চড়ে আসে তাহলে তারা মক্কায় ফিরে যাবে (উট দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য ভালো)।
- নজর: পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক দাপুটে নেতারা মাথা ঠাণ্ডা রাখতে জানেন। কঠিন পরিস্থিতি যেন আপনাকে ঘায়েল করে নাফেলে। নইলে দেখা যাবে বাজে সময়ে বাজে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। উহুদ যুদ্ধে রাসূল (সাঃ) চোট পেয়েছিলেন। মুসলিমদের ৭০ জন শহিদ হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মাথা ঠাণ্ডা রেখেছিলেন। সেই মুহূর্তের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যা যা করা দরকার করেছিলেন। সমস্যা জর্জরিত বাহিনীকে বৈরী অঞ্চলে ২০ কিলোমিটার মার্চের জন্য আবার একত্র করেছিলেন।
পরিখার যুদ্ধ
মক্কার কাফের ও মদিনার মুসলিমদের মধ্যে তৃতীয় ও চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকারক যুদ্ধ হচ্ছে পরিখার যুদ্ধ। উহুদ যুদ্ধের দুবছর পর মক্কার কাফেররা আবার যুদ্ধের জন্য এগোয়। এবার তাদের লক্ষ্য ছিল গোটা মদিনা দখল। তাদের সঙ্গে ছিল ১০ হাজার সৈন্যের বিশাল বহর। ভাড়াটে সৈন্যও ছিল।
ঘটনা জানতে পেরে রাসূল (সাঃ) দ্রুত তিন হাজারের মতো সৈন্য জড়ো করেন। মদিনার শিশু আর অযোদ্ধাদের দুর্গের মধ্যে নিরাপদে থাকার জন্য পাঠান। প্রকৃতিগতভাবে মদিনার অবস্থান এমন ছিল যে, বেশিরভাগ দিক থেকেই একে রক্ষা করা যেত। ঘন গাছগাছালির সারি এবং আগ্নেয় শিলাখণ্ড অশ্বারোহী সেনাদলদের রুখে দিত। তবে উত্তর দিকটা খোলা ছিল। রাসূল সে দিকটা পরিখা খনন করে সুরক্ষিত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। বায়জেন্তাইন আর পারস্যদের আপাত অনিঃশ্বেষ যুদ্ধে পরিখা খনন করা হতো তখন। শত্রুদের অতর্কিত হামলা থেকে শহর রক্ষার জন্য রক্ষণাত্মক কৌশল হিসেবে এটা ব্যবহৃত হতো।
ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও এই কৌশল ব্যবহৃত হয়েছিল। আরবরা অবশ্য আগে কখনো এটা দেখেনি। পারস্য দেশ থেকে আসা সাহাবী সালমান ফারসি এই বুদ্ধি দেন। রাসূল (সাঃ) তাতে সায় দেন। মুসলিমরা ২২ ফুট বাই ৯ ফুট পরিখা খনন করেন। এর দৈর্ঘ্য ছিল তিন কিলোমিটার।
নেতৃত্ব শিক্ষা (দুই)
- সিদ্ধান্তে অটল থাকুন: সময়টা ছিল মার্চ। মদিনায় তখন শীতের মৌসুম। তার ওপর হাতে খুব বেশি সময়ও ছিল না। এমন বৈরী সময়ে এত বড় পরিখা খনন ভীষণ খাটাখাটুনির ব্যাপার ছিল। কিন্তু রাসূল (সাঃ) তাঁর সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন।
আপনিও নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকুন। করবেন কী করবেন না এমন ভাবতে ভাবতে সুযোগ হারাবেন না। সুযোগ অনেক থাকতে পারে কিন্তু সময় কম। সবকিছু জড়ো করুন, সময় নির্ধারণ করুন, আপনার সিদ্ধান্তের সাথে আপনার ইনসটিঙ্কট বা স্বাভাবিক মনোভাব যায় কী না দেখুন। এরপর আল্লাহর ওপর ভরসা করে এগিয় যান।
- উদ্দীপ্ত করুন: কঠিন সময়ে যেসব নেতা হাসেন এবং মজা করেন, তারা সেনাদের মধ্য থেকে দুঃচিন্তা দূর করেন। আত্মবিশ্বাসের দ্যুতি ছড়ান।
মদিনার বেশিরভাগ লোকজনের কাছে স্বাভাবিকভাবেই পরিখা খননের কাজ আকর্ষণীয় ছিল না। আরবরা মুখোমুখী যুদ্ধে গর্ব করে। পরিখা খোঁড়ার মতো অরোমাঞ্চকর কাজে তাদের অনাগ্রহ স্বাভাবিক। কিন্তু রাসূল (সাঃ) তাদেরকে প্রচণ্ডভাবে উদ্দীপ্ত করেছিলেন। নইলে মাত্র ছয় দিনে তিন কিলোমিটার পরিখা খনন সম্ভব ছিল না।
- নিজে হাত লাগানঃ তিনি দশ জন করে একেকটা গ্রুপ বানান। প্রত্যেক গ্রুপকে দায়িত্ব দেন ৩০ মিটার করে খোঁড়ার জন্য। নিজেও তাদের সাথে হাত লাগান।
বুখারীর এক হাদীসে এক প্রত্যক্ষদর্শীর বলেছেন, আমি দেখেছি তিনি গর্ত থেকে মাটি বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর পেট পর্যন্ত ময়লাকাদায় ভরে গিয়েছিল। আপনার সন্তানরা যা করছে তার সাথে যোগ দিন। কর্মচারীদের কাজের বুঝা কমান।
- সৃষ্টিশীলতাকে উৎসাহিত করুন: কথা বলার, মত প্রকাশের স্বাধীনতার মতো পরিবেশ যদি রাসূল (সাঃ) না-দিতেন তাহলে সালমান ফার্সি পরিখা খননের মতো অভিনব বুদ্ধি আরবদের সামনে তুলে ধরতে পারতেন না। হাসি তামাশা করে কেউ তার বুদ্ধিকে উড়িয়ে দেয়নি; বরং সবাই বেশ উৎসাহের সাথে নিয়েছিল। এর সুবিধাঅসুবিধা নিয়ে সিরিয়াসলি আলোচনা করে তবেই গ্রহণ করেছে।
অবরোধ
ভয়ানক এই পরিখা দেখে কাফের বাহিনী পুরোপুরি অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। বুঝতে পারছিল না যে কী করবে। পরিখার খোড়া মাটি দিয়ে তারা উঁচু টিলা বানিয়ে সেটার উপর বসে ছিল যাতে তাদেরকে অতিক্রম করতে না-পারে।
দুই দল একে অপরকে দেখতে পাচ্ছিলো। কাফের বাহিনী মুসলিমদের বিদ্রুপ করছিল। লড়াইয়ের জন্য উস্কে দিচ্ছিল। তোমরা এক গর্তের পেছনে হাত গুটিয়ে বসে আছ? তোমাদের বাপদাদারা কি এভাবে গর্ত খুঁড়ে তার পেছনে লুকিয়ে থাকত? লড়াই করতে ভয় পেত? তোমরা কোনো আরব যোদ্ধার জাত না’!
কখনো কখনো মুসলিমরা তাদের বিদ্রুপের জবাব দিয়েছে। কাফের বাহিনী মদিনায় প্রবেশের জন্য ভিন্ন পথ খুঁজল। পশ্চিম দিকে ইহুদি গোত্রের সাথে কথা বলল। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। একদিকে রসদ কম অন্যদিকে ঠাণ্ডা বালুঝড়ে ওদের মনোবল কমে গেল। একমাস অবরোধের পর কোনো ধরনের যুদ্ধ ছাড়াই তারা চলে গেল।
শান্তি
মুসলিম-অমুসলিমদের লেখা কিছু জীবনীতে রাসূল (সাঃ) এর জীবনের জিহাদগুলোতে বেশি নজর দেওয়া হয়। কিন্তু রাসূল (সাঃ) এর গোটা জীবনে খুব কম অংশ জুড়েই ছিল জিহাদ। তিনি সন্তানসন্ততি আর নাতিদের নিয়ে স্বাভাবিক পারিবারিক জীবন কাটিয়েছেন। তার সরলসিধা জীবন ও আড়ম্বরহীনতার কারণে সবাই তাকে ভালোবাসতেন। জিহাদ ছিল তাঁর সর্বশেষ পন্থা। যখন আর কোনো উপায় ছিল না, তখন শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যুদ্ধে নামতেন। পরিখার যুদ্ধের এক বছর পর কুরাইশদের সাথে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
রাসূল যখন সাহাবীগণকে নিয়ে উমরার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন, তা শুনে কুরাইশরা হকচকিয়ে গিয়েছিল কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কাবায় আসা থেকে তারা তাকে বাধাও দিতে পারছিল না। আবার তাকে আসতেও দিতে চাচ্ছিল না। তাই কাবায় আসার আগেই তারা তাঁর পথ আটকে দেয়। রাসূল (সাঃ) তখন পথ বদলে মক্কা থেকে ১১ কিলোমিটার পশ্চিমে হুদায়বিয়াতে যান। কী হয় দেখার জন্য অপেক্ষা করেন।
কুরাইশরা ভেবেছে তিনি উমরার উসিলায় মক্কা দখল করতে এসেছেন। তিনি অবশ্য সেটা অস্বীকার করেছেন। তাঁরা দেখালেন যে, আত্মরক্ষার জন্য ছুড়ি জাতীয় কিছু অস্ত্র ছাড়া তাদের সাথে কোনো ভারী অস্ত্রসস্ত্র নেই। আবার এগুলো তারা হারামে প্রবেশের সময় সাথে নেবেনও না। কুরাইশ দূত মক্কায় ফিরে কুরাইশ নেতাদের বুঝান যে, রাসূল (সাঃ) আর তাঁর সাহাবীগণ উমরার জন্য মক্কায় আসতে পারেন।
কুরাইশদের আশ্বস্ত করার জন্য তিনি বিভিন্ন পদ্ধতি নেন। নেগোশিয়েশন ও পার্সুয়েশন কৌশল নিয়ে আজকাল যেসব লেখালেখি হয় সেগুলোতে এগুলো পাওয়া যায়। যেমন যাকে আশ্বস্ত করতে চাচ্ছেন তার প্রকৃতি ও স্বভাব বুঝা।
আহাবিশ যে গোত্র প্রধান দূত হয়ে এসেছিলেন, তিনি আল্লাহর জন্য পশু কুরবানী পছন্দ করতেন। তো যখন রাসূল (সাঃ) তাকে আসতে দেখলেন, তিনি তার সামনে ভেড়া ও অন্যান্য যেসব জিনিস তারা কুরবানীর জন্য এনেছিলেন সেগুলো হাইলাইট করে রাখলেন। এগুলো দেখে তার খুব ভালো লাগল। মক্কায় ফিরে যেয়ে শান্তিপূর্ণভাবে মুসলিমদের উমরা পূরণে তিনি কুরাইশদের বলতে লাগলেন।
কীভাবে অন্যদের রাজি করাবেন?
- নিজের মানুষদের জানুনঃ যাদের নিয়ে আপনার কাজ, তাদের ব্যাপারে জানুন। যেমন তাদের সামাজিক ব্যাকগ্রাউন্ড, শিক্ষাদীক্ষা, আগ্রহ ইত্যাদি। নির্ণয় করার চেষ্টা করুন আপনার আইডিয়া ছড়িয়ে দিতে কোন জিনিসটা প্রভাব ফেলতে পারে। হতে পারে তা কোনো যুক্তিচিন্তাভিত্তিক পয়েন্ট, আবেগময় কথা বা তার আগের বিশ্বাসের প্রতি আবেদন ইত্যাদি। মক্কা থেকে যে-দূত এসেছিলেন রাসূল তার ব্যক্তিত্বে ব্যাপারে যা জানতেন তা কাজে লাগিয়েছেন। আহাবিশরা যে কাবায় হজ্জ করতে আসাদের কী পরিমাণ সম্মানের চোখে দেখতেন এটা তিনি জানতেন। এজন্য তাঁরা যে কেফল হজ্জের জন্য এসেছেন তার প্রমাণ দেখাতে পেরেছিলেন।
- নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ান: আপনার কথাবার্তার মাত্র ৭ ভাগ মানুষের মনে চাপ ফেলে। আপনার আচারণের প্রভাব ৫৩ ভাগ। রাসূল (সাঃ) এর ওপর আগে একসময় হামলা করেছিল এমন ৪০ জন মাক্কী বন্দীসেনাকে হুদায়বিয়াতে ক্ষমা করে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এটা কুরাইশদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল, কারণ আরবদের ঐতিহ্য অনুযায়ী কেল মুক্তিপণের বিনিময়েই বন্দীদের ছেড়ে দেওয়া হতো। কথার চেয়ে কাজের ক্ষমতা বেশি।
- কীভাবে নিজের আইডিয়া মার্কেট করতে হবে জানুনঃ বিভিন্ন দূতিয়ালীদের সাথে রাসূল (সাঃ) এর আচরণ বিভিন্ন ছিল। কিন্তু মূলকথা একই ছিল: আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি, [কাব্য] প্রদক্ষিণ করতে এসেছি। এই কথা কুরাইশদের কানে বারবার অনুরণিত হয়ে থাকবে। তারা জানত এই মুহূর্তে যুদ্ধ মক্কার স্থিতিশীলতা নষ্ট করবে, অন্যদিকে ১৪০০ হজ্জযাত্রী এলে আর্থিকভাবে তাদের লাভ হবে।
অচলাবস্থা নিরসন
শেষপর্যন্ত কুরাইশরা রাজি হলো যে, তারা হজ্জ করতে পারবে তবে এবছর না। আগামী বছর। দশকব্যাপী শত্রু এভাবেই শেষ হলো।
মুসলিমদের কাছে এই চুক্তি অবশ্য অন্যায্য মনে হয়েছিল। কারণ, তারা উমরার সব প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল। দেরি হোক এমনটা তারা চাননি। তাছাড়া চুক্তিতে আরেকটা কথা ছিল যে, যারা মক্কা ছেড়ে এসেছে তাদেরকে মুসলিমরা ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু কেউ যদি মদিনা ছেড়ে আসে, তাহলে তাকে ফিরিয়ে দিতে কুরাইশরা বাধ্য থাকবে না।
যাহোক, শেষমেষ তারা চুক্তির শর্ত মেনে নেয়। কারণ রাসূল (সাঃ) একে তাদের বৃহৎ স্বার্থের জন্য দেখেছেন। বিষয়টাকে তিনি শুধু অন্য আদল থেকে দেখেননি; বরং প্রথমে যারা চুক্তিটাকে অন্যায্য ভেবেছিল তাদেরকেও তিনি তা বুঝাতে পেরেছিলেন। রাসূল (সাঃ) কীভাবে হুদায়বিয়ার শান্তিচুক্তির ফায়দা অন্যান্য মুসলিমদের বুঝালেন? আপনি কীভাবে অন্যদের সহজে বুঝাতে পারবেন?
প্রতিপক্ষকে কীভাবে বুঝাবেন?
- শুনুনঃ ব্যলডোনি তার ইন্সপায়ার, হোয়াট গ্রেট লিডারস ডু বইতে দেখিয়েছেন যে, লোকজনদেরকে তাদের ভিন্নমত বলতে দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।
‘এটা কেবল ভিন্নমত দেওয়ার বিষয় না; বরং সত্যিকার অর্থে ভিন্নমত স্বীকার করা। ব্যালডোনি, ১০৮-১০৯ কোনো ধরনের বাধা, তিরস্কার বা রায় দেওয়া ছাড়া রাসূল (সাঃ) তাঁর সাহাবীগণকে তাদের হতাশা প্রকাশের সুযোগ দিয়েছিলেন।
- লাগতে যাবেন না: জোরাজোরি না করে যুক্তি, প্রমাণ ব্যবহার করে রাজি করানোর মাধ্যমে বুঝান। রাসূল (সাঃ) তাঁর সাহাবীগণকে বললেন, কুরবানী করতে। মাথা চেছে ফেলতে। তারা যখন করলেন না, তখন তিনি নিজেই শুরু করলেন। বাকিরা পরে তাঁকে অনুসরণ করতে বাধ্য হলো। তিনি তাদের মন বদলে দিয়েছিলেন প্ররোচনার মাধ্যমে। নিজের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি জোরাজোরি না করে।
মক্কায় প্রবেশ
হিজায অঞ্চলে মুসলিমদের প্রভাব বাড়িয়ে তিনি যুদ্ধবিরতি চুক্তির সুব্যবহার করে তাঁর নিন্দুকদের ভুল প্রমাণ করেছিলেন। মদিনার আরও প্রতিবেশীদের সাথে তিনি চুক্তি করেন। এগুলো কুরাইশদের কাফেলার নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যুদ্ধবিরতি চুক্তি অন্যান্য গোষ্ঠীগুলো কার সাথে মিত্রতা করবে, এটা বাছাই করার স্বাধীনতা দিয়েছিল। বেশিরভাগ গোষ্ঠী যারা কুরাইশদের বাণিজ্য রুটে ছিল তারা মদিনাকে বেছে নিয়েছিল। পরের বছর রাসূল (সাঃ) মক্কায় প্রবেশ করেন চুক্তির শর্ত অনুযায়ী। প্রায় ১ হাজার ৪ শ সাহাবী নিয়ে হজ্জ পালন করেন। শান্তিপূর্ণভাবে পালন করার তিন দিন পর মক্কা ছাড়েন।
নিজের প্রভাব বাড়ান
আপনার জীবনে দুটো অংশ আছে। যাদের ওপর আপনার প্রভাব আছে। আর যাদের নিয়ে আপনি উদ্বিগ্ন। যাদের ওপর আপনার প্রভাব আছে সেগুলো হচ্ছে- যা আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। অন্যদিকে উদ্বিগ্নের বলয় হচ্ছে- যেসব জিনিস আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু এর নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতে নেই।
চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আপনার প্রভাব বলয় বাড়ানো, যাতে এটা উদ্বিগ্ন বলয়ে পৌছায়। রাসূল (সাঃ) তাঁর প্রভাব বলয় বাড়িয়েছিলেন হিজাযের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাথে মিত্রতা স্থাপন করে। যেটা পরে তাঁর উদ্বিগ্ন বলয়ে (মক্কা) প্রভাব ফেলেছিল কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলার মাধ্যমে।
মক্কায় হজ্জ পালনের পর এক সহিংসতার কারণে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে যায়। কুরাইশ সমর্থিত এক গোষ্ঠী মুসলিমদের সাথে মিত্রতা স্থাপনকারী এক গোষ্ঠীর ওপর হামলা করে। এর পেছনে সামরিকভাবে মদদ দিয়েছিল কুরাইশরা। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী তা ছিল নিষিদ্ধ। কুরাইশরা এ ঘটনার জন্য দুঃখজ্ঞাপন করে, কিন্তু রাসূল (সাঃ) কোনোভাবেই নিশ্চিত হতে পারছিলেন না যে এমন ঘটনা আর ঘটবে না। তাই তিনি তাদের সেই দুঃখপ্রকাশ প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ১০ হাজার সৈন্য জড়ো করেন সামরিক অভিযানের জন্য।
মক্কার বাইরে মুসলিমদের এই বিশাল বাহিনী দেখে কুরাইশরা বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে। রাসূল পুরো শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। যদিও সেই সময়ের আরব উপদ্বীপের রীতি অনুযায়ী সব পুরুষদের হত্যা এবং নারীদের দাসী বানানোর পুরো অধিকার তাঁর ছিল।
নবি (সাঃ) জীবনের শেষ
মক্কা বিজয়ের পর রাসূল (সাঃ) মদিনায় ফিরে আসেন। হিজাজের বড় বড় গোষ্ঠীগুলো থেকে তাঁর কাছে প্রতিনিধিদল আসে। তিনি তাদের অভ্যর্থনা জানান। ইসলামে আসার অনুরোধ জানিয়ে পারস্য, সিরিয়া ও মিশরের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে চিঠি লিখিয়ে পাঠান।
আরবের ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ নিয়ে পরে তিনি হজ্জ পালন করেন। সেখানে তিনি ঐতিহাসিক বিদায় হজ্জের ভাষণ দেন। ন্যায়বিচার আর নারীদের প্রতি সম্মানের বিষয় তুলে ধরেন (অন্যায় কোরো না… যা ঠিক তা নিয়ে নারীদের সঙ্গে আলোচনা করো… আমি যা বলছি তা শোন, বিবেক খাটাও’)। হজ্জ শেষে তিনি আবার মদিনায় ফিরে যান।
‘লা ভিয়ে দে মাহোমের’ বইতে কন্সটান্টিন গেওরগিউ রাসূল (সাঃ) এর ভাষণ কতটা আলোড়ন সৃষ্টিকারী ছিল, সে ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছেন-
‘আমরা নবির কণ্ঠ শুনিনি। অল্প সময়ে ছিলাম না। তার সাথেও থাকিনি। কিন্তু তারপরও আমরা যখন তাঁর ভাষণ পড়ি, তখন আমরা তার শব্দের ঝনঝনানিতে আলোড়িত হই। আমাদেরই যখন এই অবস্থা, তাহলে সেদিন সেখানে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের অবস্থা কেমন ছিল? সেই সুম্ভ্রম-জাগানিয়া মুহূর্ত তাদের পক্ষে বুঝি কখনো ভোলা সম্ভব ছিল না। কারণ তারা রাসূল (সাঃ) এর কথায় অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। শুধু কান দিয়ে নয়, হৃদয় ও মন দিয়ে তাঁর কথা গেঁথে নিয়েছিলেন।
রাসূল (সাঃ) এর নেতৃত্বগুণ থেকে ফায়দা
রাসূল (সাঃ) এর নেতৃত্ব | আপনার নেতৃত্ব |
খুব দ্রুত রাসূল (সাঃ) মদিনার বাস্তবতা বুঝে সে অনুযায়ী সংস্কার শুরু করেছিলেন। | কী বদলানো যাবে আর যাবে না- সেটা জানার জন্য বদলানোর আগে নিজের বাস্তবতা বুঝুন। |
পরিখা খননের সময় কোনো কোনো হিজরতকারী মুসলিম যখন কাজটাকে ছোট করে দেখছিলেন, তখন রাসূল (সাঃ) নিজেই হাত লাগান। | শুধু উপর থেকে আদেশ দেবেন না। নিজেই নজির স্থাপন করুন। তাদেরকে যা অর্জন করতে বলছেন তার সাথে নিজেও যোগ দিন। |
দায়িত্ব, অধিকারের ওপর ভিত্তি করে রাসূল (সাঃ) মদিনার লোকদের মধ্যে সম্পর্ক জুড়ে দেন। সবাইকে শহরের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য দায়ী করেন। | যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শুধু তাদের ভূমিকা ও দায়িত্বের ওপর নজর না দিয়ে তাদের মধ্যে মানবিক সম্পর্ক গড়ে দিন। |
তিনি ভুল ধরতেন, তবে যিনি ভুল করেছেন। তাকে দোষারোপ করতে করতে সেটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতেন না। | ভুল ক্ষমা করে দিন। অন্যকে তিরস্কার ও অপদস্থ করার জন্য নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টায় বাড়াবাড়ি করবেন না। |
রাসূল সতর্ক পর্যবেক্ষণ ও নির্ভুল তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতেন। | নিজের কাজের ব্যাপারে সর্বশেষ তথ্য সম্পর্কে জেনে রাখুন। যাতে আপনার সর্বাধুনিক নেতৃত্ব দিয়ে সবার শ্রদ্ধা জয় করতে পারেন। |
অন্যকে রাজি করানোর ক্ষমতা তার ছিল (যেমন হুদায়বিয়াতে বনিবনায়)। | যার সাথে বনিবনা করতে যাচ্ছেন তার স্বভাবপ্রকৃতি জানুন। তার কথা শুনুন। তার উদ্বেগ নিয়ে তার সাথে কথা বলুন। |
রাসূল (সাঃ) এর মৃত্যু
জীবনের শেষ দিনগুলোতে রাসূল (সাঃ) ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েন। তিনি তখন বসে বসে সালাত পড়তে শুরু করেন। অন্যের সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারতেন না। রাসূলের চাচা হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর তীব্র জ্বর ও ক্রমাগত মাথাব্যথা নিয়ে বলেছেন, “আবদুল মুত্তালিবের বংশধররা যখন মারা যায়, তখন তাদের চেহারা কেমন হয় আমি জানি।
মসজিদে শেষ ভাষণে তিনি ইঙ্গিত দেন যে, তার দিন ফুরিয়ে আসছে।কাউকে কষ্ট দিয়ে থাকলে সেজন্য তিনি ক্ষমা চান।
“আমি যদি কারও পিছনে আঘাত করি, তাহলে সেটা আমার নিজের পেছনেই করেছি। কারও সম্পত্তি নিয়ে থাকলে সেটা নিজের সম্পদই অন্যায়ভাবে গ্রাস করেছি। কারও সম্মান নষ্ট করলে আমার করেছি”।
অসাধারণ অনুপ্রেরণামূলক জীবন কাটিয়ে ৬৩ বছর বয়সে রাসূল (সাঃ) তার পরম বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন।
.
১. মদিনায় রাসূলের জীবনের বেশিরভাগ তথ্য নেওয়া হয়েছে সালিহ আল-আলী রচিত ‘আরবি বই দ্য স্টেট অফ দ্য প্রফেট ইন মদিনা: আ স্টাডি ইন ইটস মেকিং অ্যান্ড অর্গানাইজেশন থেকে।
২. আদাইর, ৭৭।
৩. হুয়িটলি, পৃষ্ঠা ৪৯-৬০।
৪. আর্মস্ট্রং, পৃষ্ঠা ১২৮।
৫. গর্গিউ, পৃষ্ঠা ২১৯।
৬. সেকার্টান, পৃষ্ঠা ১৪৩।
৭. দেখুন: জেমস স্কোউলার, দ্য থ্রি লেভেলস অফ লিডারশিপ, পৃষ্ঠা ৭৮-১০৫।
৮. আদাইর, পৃষ্ঠা ৮১।
৯. উদ্বিগ্ন বলয় আর প্রভাব বলয় নিয়ে দেখুন, স্টিফেন কভে’র দ্য সেভেন হ্যাবিটস অফ ফাইলি ইফেক্টিভ পিউপুল, পৃষ্ঠা ৮১-৯১।
১০. গর্গিউ, ৩৭৬।