2 of 2

পঞ্চম রিপু – শৈলেন রায়

পঞ্চম রিপু – শৈলেন রায়

টাকার রং কেমন? সাদা না কালো?

না, টাকার কোন রং নেই। না সাদা না কালো।

টাকা রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি। টাকার না আছে পাপ না পুণ্য।

গঙ্গাজলের মত। গরু ছাগল মানুষের গলা-পচা শব ভেসে যায় জলে। নোংরা আবর্জনা সব নিয়ে সাগরসঙ্গমে চলে নদী। চির-পবিত্র চিরনতুন। এই জলে পাপী তাপী পুণ্যাত্মা অবগাহন করে। ঘড়ায় জল ভরে বাড়ি নিয়ে যায়। পান করে। দেবতার পুজোয় লাগায়।

হাতিবাগানে এককালে হাতি কেনাবেচা হতো। রাজারাজড়া জমিদার তালুকদার ব্যবসায়ী সেই হাতি কিনতে। দোল দুর্গোৎসবে হাওদাচড়িয়ে সেই হাতি নিয়ে শোভাযাত্রা করতো।

কলকাতার বাবু কালচার আর নেই।

অনেক সিন্দুক শূন্য হয়ে গেছে। মদ মেয়েমানুষ ভাইয়ে ভাইয়ে মামলা মারামারি কাটাকাটি। মহাকালের কশাঘাতে প্রাসাদের মত বাড়িগুলো ভগ্ন জীর্ণ। ধুকছে।

পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন নতুন বাড়ি তৈরী হচ্ছে। দশ তলা বারো তলা। খোপে খোপে মানুষ। রাস্তাঘাট আলো আর থিকথিকে মানুষ। কলহ বিপদ হৈ হট্টগোল।

সেই কলকাতা আর নেই।

বুক ভেঙে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তেজেন্দ্রনারায়ণের। এতসব তার জানার কথা। কিন্তু জানে। কিছু বই পড়ে, বেশীর ভাগ বৃদ্ধ নায়েবের মুখ থেকে গল্প শুনে।

সে জমিদারী এখন আর নেই। কিন্তু গল্প আছে।

বৃদ্ধ নায়েব বসে থাকেন আর ঝিমোন। বাড়ির কর্তৃঠাকুরণ, তেজেনের ঠাকুমার হুকুমে আফিমের বরাদ্দ বেড়েছে বৃদ্ধ মানুষটির। কর্তাদের আমলে বহু কাজ করেছেন এখন বিশ্রামের সময়। কিন্তু বিশ্রাম বললেই বিশ্রাম হয় না। যতক্ষণ জেগে থাকেন। লাঠি নিয়ে খুট খুট করে এঘর ওঘর ঘুরে বেড়ান।

আগে তে-তলা অবদি উঠতে পারতেন হলধর। এখন পায়ে আর সে জোর নেই। এক তলায় ঘুরে বেড়ান আর চাকর ঝিদের ওপর খবরদারি করেন।

সন্ধ্যের আগে নিজের ঘরে ঢুকে যান। বসে থাকেন একটি কিশোরের প্রতীক্ষায়, তেজেন্দ্রনারায়ণ গুটিগুটি ঘরে ঢোকে। তার নির্দিষ্ট চেয়ারে এসে বসে। বলে, গল্প বলল দাদু।

গল্প বলেন হলধর। চৌধুরী বংশের গল্প। কী পরাক্রান্ত ছিলেন তেজেন্দ্র নারায়ণের পূর্বপুরুষেরা।

বিশাল বৈঠকখানায় টাঙানো অয়েলপেন্টিং। কেউ বসেছে সাদা ঘোড়ায় কেউ বা কালো ঘোড়ায়। কেউ বা দাঁড়িয়ে আছেন। মাথায় উষ্ণীষ কোমরে খাপে মোড়া বাঁকা তলোয়ার। ঠোঁট-জোড়া বিরাট গোঁফ।

উদ্ধত দাম্ভিক সব পুরুষ। তেজেন্দ্রনারায়ণের পূর্বপুরুষ।

তুই তোর বাপ দাদার মত হলি না কেন দাদু। এ প্রশ্ন নয়, বৃদ্ধ নায়েবের ক্ষেদ।

বালক তেজেন্দ্র উত্তর দিতে পারে না।

উত্তর তার জানা নেই।

সে বলে, তুমি গল্প বলো দাদু।

তেজেন্দ্র শান্ত ধীর স্থির। সংযত। সে গল্প শুনতে বড় ভালবাসে।

গল্প বলেন হলধর। গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনে তেজেন্দ্র।

এত বড় বাড়ি, বলতে গেলে অট্টালিকা। কিন্তু মানুষের সংখ্যা কম। কর্তা মা, গিন্নী ঠাকরুণ এবং বংশের কুলপ্রদীপ তেজেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। বাকী সবাই কাজের লোক। আর একটি মানুষ হলধর বিশ্বাস। এককালে তাকে বাইরের লোক হিসেবেই ভাবা হতো। এখন তিনি ঘরের মানুষ। বিশ্বস্ত বিচক্ষণ।

বিরাট এক ইতিহাস বহন করে বেড়াচ্ছেন নিজের ন্যুজ পিঠে।

লোকে বলে টাকার কুমীর। সঠিকভাবে কেউ জানে না চৌধুরীদের কত টাকা। জলধর জানেন। যতদিন ক্ষমতা ছিল তিনি একটা অলিকা তৈরী করেছেন। সেই তালিকা কর্তামাকে দিয়েছে। কর্তামা দিয়েছেন পুত্রবধূকে। বিধবা পুত্রবধূ সেটি দিয়েছেন তেজেন্দ্রকে। সে তালিকার ওপর চোখ বুলিয়ে সিন্দুকে তুলে রেখেছে। তা। নিয়ে মাথা ঘামায় নি।

আছে, থাক। ফেলে দেবার মত বস্তু তো নয়। মাথায় নিয়ে নাচানাচি করার মতও কিছু নয়। আদরের ধন আদরেই আছে।

ব্যাঙ্কে, সিন্দুকে, জমিজমায়, ভাড়া-দেওয়া বাড়িতে।

সংসার চলছে নদীর মত। ধীর সংযত শান্ত।

এই শান্ত পরিবেশে তেজেন্দ্র বড় হতে লাগলো। স্কুল থেকে কলেজ। কলেজ থেকে ইউনিভারসিটি। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ ভিন্ন ভিন্ন মানুষ। সহপাঠী পাঠিনী। অনেকে ভাব জমাতে এগিয়ে এল। তেজেন্দ্র নির্লিপ্ত। সে সবার সঙ্গে হেসে কথা বলে। পারতপক্ষে কারও মনে আঘাত দেয় না। ছেলেরা বলে দাম্ভিক। মেয়েরা মনে মনে গালপাড়ে, মাকাল ফল একটা। দেখতেই যা। পাখিও এ ফলে ঠোঁট ছোঁয়ায় না।

তেজেন্দ্রর কানে আসে, মেয়েরা তার নাম দিয়েছে, মিষ্টার মাকাল।

সে মনে মনে হাসে। মনের হাসি মুখে প্রকাশ পায় না। যতদিন পর্যন্ত হল বেঁচে ছিলেন মনের কথা হলধরদাদুকে বলতে তেজেন্দ্র। শুধুমাত্র হলধরকেই।

হলধর একদিন কষ্ট করে ওপরে উঠলেন। কর্তামা গত হয়েছেন। গৃহকর্তী এখন তেজেন্দ্রর মা বিভাবতী। তিনি ওপরে থাকেন। নীচে বড় একটা নামেন না। হাঁটুতে ব্যথা। চলাফেরা যা করেন ওপরেই করেন। কর্তা যতদিন বেঁচে ছিলেন তার ছায়ায় বাড়িময় বিচরণ করতেন। চাকর ঝিদের দিয়ে কাজ করাতেন। বাড়িঘর পরিষ্কার করাতেন। রান্নার ঠাকুরকে দরকার মত নির্দেশ দিনে। নিজেও মাঝে মধ্যে হাতা খুন্তি ধরতেন। কর্তা ভোজনবিলাসী ছিলেন। স্ত্রীর হাতের রান্না খেতে তিনি খুব ভালবাসতেন। বিভাবতী ভালবাসতেন তার সুরসিক স্বামীটিকে।

স্বামীর মৃত্যুর পর বিভাবতীর জগৎ আলোশূন্য হয়ে গেল। বাঁচার স্পৃহা তিনি হারিয়ে ফেললেন। কিন্তু মৃত্যু কারও আজ্ঞাবহ ভৃত্য নয় যে ডাকলেই হুজুর বলে ছুঁটে আসবে। তাছাড়াও একটা ব্যাপার আছে তেজেন্দ্রকে একা ফেলে রেখে স্বর্গে গেলেও তার সুখ নেই। একথা তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন।

সংসার আবার আগের মত চলতে লাগলো। ধীর সংযত শান্ত।

হলধর বললেন, আর দেরী করা ঠিক হবে না বউরানি। শরীরের গতিক ভাল ঠেকছে না আমার। যদি কিছু হয়ে যায় তেজেন্দ্রকে নিয়ে তুমি বিপদে পড়বে। এখনই ওর বিয়ে দেওয়া দরকার। আমি থাকতে থাকতে।

হলধরের কথায় সম্মতি জানানোই বিভাবতীর রীতি। তিনি বললেন, ওর বিয়ের ব্যবস্থা করুন।

ব্যবস্থা করুন বললেই কনে জোগাড় করা যায় না। বিচক্ষণ জলর মন করলেন, তেজেন্দ্রর মধ্যে যে তেজ রয়েছে সেই তেজ বহির্মুখী নয়। সে তেজকে দেখা যায় না। তাকে অনুভব করতে হয়। সুতরাং এমন মেয়ে চাই, যে হবে রূপসী বিদূষী তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন। তার মনে থাকবে ভালবাসা। সেই ভালবাসা দিয়ে সে ভরিয়ে তুলবে তেজেন্দ্রর শান্ত নিস্পৃহ মনকে। ভালবাসার তেজে জ্বলে উঠবে তেজেন্দ্র! হলধর খুবই বুদ্ধিমান। জমিদারী কাজে অত্যন্ত বিচক্ষণ। এ সংসারের হিতকামনায় তিনি জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারেন। বিশেষ করে তেজেন্দ্রর স্বার্থে।

তিনি ঘটক লাগালেন। ঘটক একজন দুজন না ছ’জন। তারা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়লো। সেরা পাত্রী চাই। রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী। যদি প্রয়োজন পড়ে গরীব ঘরের মেয়েকে টাকা দিয়ে তুলে আনবেন। শাঁখা সিন্দুরটুকু হলেই চলবে বাদবাকী খরচাপাতি হাতিবাগানের চৌধুরীদের।

হলধরের হিসেবে একটু ভুল ছিল। তিনি কড়ি দিয়ে তেজেন্দ্রর সুখ শান্তি কিনতে চেয়েছিলেন। অর্থ দিয়ে অনেক কিছুই কেনা যায় এ কথা যেমন সত্য কিন্তু তার বাইরে আর একটা বস্তু রয়েছে। সে বস্তুটিকে দেখা যায় না বোঝা যায় না। এমনকি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুত্বও করা যায় না। মাথার ওপর যিনি রয়েছে, সেই বিধাতা পুরুষটি ভয়ানক রকমের খামখেয়ালি। নাকি তিনি খামখেয়ালীপনা করেন না। আমরা তাঁকে বুঝতে পারি না। চাইও না হয়তো।

সে কথা এখন থাক।

.

২.

সুন্দরবন তখন পার্কটি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

গড়ের মাঠ জুড়ে ছিল নলখাগড়ার জঙ্গল। সেই জঙ্গলে বুনো শুয়োর হরিণ বিষধর সাপ ময়াল গোখুরো কেউটে। আর ছিল বাঘ। হলুদের ওপর কালো ডোরা কাটা। হেস্টিং সাহেব এই বনে হাতিতে চড়ে বাঘ শিকার করতে এসেছিল। এসব। ইতিহাসের কথা। কিন্তু ইতিহাস নিয়ে বিশদ আলোচনা করা এ গল্পের বিষয়বস্তু নয়।

এ হচ্ছে এক নারী পুরুষের কাহিনী।

চৌধুরীদের ঘটক ঘুরতে ঘুরতে সিংহ বাড়িতে এসে উপস্থিত একদিন। রতিকান্ত তখন ব্রেকফাষ্ট শেষ করে খবরের কাগজ পড়ছিলেন।

ছাতা হাতে ঘটক এসে দাঁড়ালো। মাথায় বড় টিকি শ্বেতচন্দন দিয়ে কপাল লেখা। মাথা নুইয়ে হাতজোড় করে বিনয় বিগলিত কণ্ঠে বললে, একটা নিবেদন ছিল কত্তা।

তখন পর্যন্ত ঘটকদের খাত্রি ছিল। ছেলেমেয়েদের বিয়ের জন্য কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়ার রীতি তেমনভাবে চালু হয়নি।

কর্তামশাই রতিকান্ত সিংহ রাশভারী মানুষ। মুখে খুশি প্রকাশ না করলেও তার চোখে খুশির আলো ঝিলিক দিয়ে উঠলো। তার একমাত্র কন্যা নারায়ণীর বিয়ের জন্য তিনি কিঞ্চিৎ উতলা হয়ে উঠছিলেন। মার শরীর ভাল যাচ্ছে না। নাতনীর বিয়ে দেখে যেতে চান। রতিকান্ত মাতৃভক্ত সন্তান। মা-মরা মেয়েটিকে আদরে আল্লদে বড় করে তুলেছেন। কিন্তু বড় করলেই তো হবে না। চাই উপযুক্ত পাত্র।

নারায়ণী যেভাবে বেড়ে উঠেছে সেখানে শাসনের বালাই নেই। শুধুই আদর দিয়ে যাওয়া। দুদিন পর তো শ্বশুর বাড়ি যেতে হবেই। সুতরাং যতটা আদরে। আহলাদে কন্যাকে রাখা যায়।

কর্তা প্রশ্ন করলেন, পাত্র কি করে?

কিছু করার দরকার পড়ে না হুজুর। ফেলে ছড়িয়ে খেলেও সাত পুরুষের বাইরে বেরোতে হবে না চাকরির ধান্দায়।

বসে বসে খেলে কুবেরের ভাণ্ডারও শূন্য হয়ে যায়।

খুব সত্যকথা হুজুর। যে চৌবাচ্চায় জল ঢোকে না সে চৌবাচ্চার জলে চান করা বাসন মাজা করতে গেলে শূন্য তো হবেই। এ চৌবাচ্চার জল ঢোকার নল বেরোনোর নলের চেয়ে বল মোটা। ঘটক হি হি করে হাসতে লাগলো।

রতিকান্ত পার্কটি পাড়ার মানুষ। সাহেব কম্পানিতে বড় চাকরি করেন। মোটা টাকা মাইনে পান। কিন্তু জমানো টাকা বলতে তেমন কিছু নেই। সাহেব সুবোদের সঙ্গে ওঠা বসা, ক্লাব পার্টি এ সবের পেছনে গুচ্ছের টাকা খরচ হয়ে যায়। মেয়ের জন্যেও খরচ বড় কম নয়। মা মরা মেয়েটিকে, তিনি সব দিক দিয়ে আধুনিকা করে গড়ে তুলছেন। শুধু রূপ থাকলেও হয় না চাই শিক্ষা দীক্ষা। লরেটো হাউসে ভর্তি করে দিয়েছে। সাহেবরা দেশ ছেড়ে চলে গেছে কিন্তু সাহেবিয়ানা যায় নি। দেশীবাবুরা এখন সাহেবদের থেকেও বেশী সাহেব। তাদের ইংরেজি বলন চলন যে কোন আসল ইংরেজকেও লজ্জা দিতে পারে। পার্টিতে দেশী সাহেবরা যেভাবে সুটেট বুটেট হয়ে বিলেতি বাজনার তালে তালে মদ খেয়ে নাচে বিলেতি সাহেব তা দেখলে চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে থাকবে।

নারায়ণীকে এটুকু বয়সে, সবে আঠেরোয় পা দিয়েছে সে, বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না রতিকান্তর। কিন্তু মা জমিদার বংশের ঐতিহ্য নিয়ে এ বাড়ির বৌ হয়ে এসেছিলেন, তখন থেকেই সংসার পরিচালনার ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। রতিকান্তর বাবা ছিলেন নেহাতই গো-বেচারি গোছের মানুষ। সরকারি চাকুরি করতেন। মোটা টাকা মাইনে পেতেন। জীবনপাত করে আপিসের কাজ চালিয়েছেন। আপিস নিয়ে সদা ব্যস্ত এই মানুষটির সংসারের দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে নি। সংসার জুড়ে রয়েছেন গিন্নী। দশভুজার শক্তি নিয়ে তিনি সংসার পরিচালনা করেছে তারপর সুযোগ্যা পুত্রবধূর হাতে সংসারের ভার তুলে দিয়ে তিনি অবসর নিয়েছে। অবসর নিলেও নিশ্চিন্ত হতে পারেন নি; ক্রমাগত রোগে ভুগতে ভুগতে রতিকান্তর বৌ মারা গেলেন।

মেয়েদের সব বয়সই পুতুল খেলার বয়স।

ঠাম্মা নতুন করে আবার নারায়ণীকে নিয়ে পড়লেন। নাতনী বিলেতি স্কুলে পড়ছে পিয়ানো বাজাচ্ছে, বিটোভেন মোসার্ট। সঙ্গে সঙ্গে মাষ্টার রেখে নাতনীকে গান শেখাচ্ছেন। অতুল প্রসাদ রজনীকান্ত রবীন্দ্র সঙ্গীত। নজরুলের গান। যতদিন শরীরে শক্তি ছিল নারায়ণীকে হাতে ধরে রান্নাও শিখিয়েছেন। তারপর একদিন রতিকান্তকে বললেন, ঘোড়াকে মাঠে নামার উপযুক্ত করে দিলাম। এবার বাজিমাৎ করার দায়িত্ব তোর।

রতিকান্ত মার কথার খোঁচা বুঝতে পারে না। তিনি যে নিয়মিত রেসের মাঠে যান মা সে কথা জানেন। জানলেও ঘোরতর আপত্তি তোলেন না। পুরুষ মানুষের সর্বক্ষণ ঘরমুখী হয়ে থাকা তার পছন্দ নয়। তাঁর স্বামী ছিলেন সুবোধ বালক সম্প্রদায়ভুক্ত। এই অতিভালত্ব তাকে একদিকে যেমন সুখ দিয়েছিল অন্যদিকে মনে মনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিদ্রোহিনী। মুখে কোনদিন সেই বিদ্রোহ প্রকাশ না করলেও তিনি চেয়েছিলেন বাবা-দাদাদের মত তার স্বামীও যথার্থ পুরুষ হয়ে উঠুক। কিন্তু নদীর গতিপথ হয়তো বদলানো চলে কিন্তু মানুষের মনের গভীরে যে আর একটা মন আছে সেই মনকে শত চেষ্টা করলেও বশে আনা যায় না। অধিকাংশ সময় সেই মন থাকে ঘুমিয়ে, খোঁচা দিয়ে তাকে জাগাবার চেষ্টা করো, সে হয়তো ক্ষণকালের জন্য জেগে উঠবে কিন্তু তার জীবন স্রোতে পরিবর্তন আসবে না। যদি বা আসে সেই পরিবর্তন হবে ক্ষণস্থায়ী।

অতি যত্নে যেমন গাছের শ্রীবৃদ্ধি হয় না, নারায়ণীও হয়ে উঠলো অতিমাত্রায় আত্মসচেতন, উদ্ধত এবং অসহিষ্ণু। একদিন সে রতিকান্তকে বললো, আমার নামটা পাল্টে দাও। নারায়ণী থেকে আমি তিস্তা হতে চাই।

মা কষ্ট পাবে মা-মণি।

ঠাম্মাকে বোঝাবার ভার আমার। তুমি অন্য সব ব্যবস্থা করে দাও।

ব্যবস্থা হয়ে গেল। নারায়ণী তিস্তা হলো। রতিকান্ত প্রশ্ন করলেন, বুঝলুম পাত্র সৎবংশজাত, বিদ্বান, ধন সম্পত্তি আছে। বয়স যা বললেন তাতে আমার মেয়ের সঙ্গে মানাবে। পাত্র দেখতে কেমন?

পুষ্ট টিকির ওপর দিয়ে হাত বুলোতে বুলোতে ঘটক বললেন, কার্তিকের মত।

কার্তিককে আপনি দেখেছেন?

হ্যাঁ, বহুবার।

রতিকান্ত ধমক লাগালেন, মিছে কথা বলবেন না।

পুরহিতের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো, একবার দুবার দেখলে ভুলে যাওয়া যেত কিন্তু ফিবার ফুল বেলপাতা দিয়ে যাকে পুজো করতে হয়–।

ফুল না হয় বুঝলুম কিন্তু বেলপাতা তো শিবপুজোয় লাগে।

শিবঠাকুরের পুজোয় বেলপাতা লাগে বলে কি অন্য ঠাকুরের কাছে বেলপাতা অস্পৃশ্য মশাই।

এই মশাই সম্বোধন রতিকান্তর পছন্দ না হলেও তিনি উচ্চবাচ্য করলেন না। ঘটক যে পাত্রের সন্ধান এনেছে মনে হয় সবদিক দিয়ে সে নারায়ণী বা তিস্তার উপযুক্ত হবে।

রতিকান্ত চুপ করে গেলেও ঘটকের চুপ থাকা চলে না। এই কথা বেচেই তাকে খেতে হয়। সে যেমন দেবতার পূজারী বাদেবীকেও সে কম ভক্তি করে না। দু হাত কপালে ঠেকিয়ে সে বলে চললো, কার্তিক ঠাকুরে: পুজোর মজা কি জানেন স্যার, রামবাগানের মেয়েমানুষের নজর খুব উঁচু। তারা যেমন তেমন নৈবদ্য সাজিয়ে ঠাকুরকে খেতে দেয় না।

এখানে টিপ্পনী কাটার লোভ সামলাতে পারলেন না রতিকান্ত। বললেন, দেবতার নাম করে সবই তো যায় নিজের পেটে।

আশ্চর্য দক্ষতা পুরুষটির। সে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর করলো, নিজের পেটে আর কতটুকু জায়গা। গিন্নী, তাও তিনটি, ছেলে পুলে নাতি নাতনী, সে এক এলাহারি কাণ্ড। দুবেলা ঘরে ক’টা পাত পড়ে বলুন তো।

এতক্ষণ পর্যন্ত রতিকান্ত গম্ভীর মুখে কথা চালিয়ে যাচ্ছিলেন এখন কৌতুকের ছোট্ট পাখিটা তার মনের মধ্যে ফরফর করে উড়তে শুরু করলো। তিনি হাসি মুখে উত্তর দিলেন, আপনার বাড়িতে ক’টা পাত পড়ে আমার জানার কথা নয় কারণ আমি জ্যোতিষ না।

গণকার না হয়েও আমি কিন্তু বলতে পারি আপনার বাড়িতে পাত পড়ে পাঁচটি।

রতিকার চোখ কপালে ওঠার যোগাড়। আপনি জানলেন কি করে?

কি করে জানলাম সেটা বড় কথা না। আসল কথা হচ্ছে কথাটা সত্যি কিনা। আরও বলছি। একটা নিরামিষ। দুটো মাছ মাংস সহকারে। আর দুটি মোটা ভাত ডাল একটা আলু কুমোড়ার ঘ্যাট, দুটো চাকর পুষছে তাদের রাদ্দ। গাড়ি চালকটির আহার যত্রতত্র অর্থাৎ কিনা তার ভোজনের নির্দিষ্ট স্থান নেই। গাড়ি চালাতে চালাতে যখন যেখানে সময় সুযোগ আসে। কিন্তু যে বাড়ির সঙ্গে সম্বন্ধ করতে যাচ্ছেন সে বাড়িতে দাসদাসীর হিসেব নেই। তাদের নায়েবের বরাদ্দ আফিমের মাত্রা শুনলে ভিরমি খাবেন। সাহেরা যে জাল টানিয়ে ব্যাট নিয়ে বল পেটাপেটি করে সেই বলের সাইজ।

সে কী! লোকটা এখনও বেঁচে আছে।

বেঁচে আছে কি, বহাল তবিয়তে লাটি ঠকঠকিয়ে বাড়িময় ঘুরছে। আর বাড়ির কথা কী বলবো। লাখনৌয়ের খুলখুলিয়ার নাম শুনেছেন তো। তার চেয়েও বড়, আর টাকার কথা যদি শোনেন।

আপনি কি ওদের সিন্দুকে উঁকি মারতে গিয়েছিলেন?

উঁকি মারতে হয় না স্যার। গন্ধেই বোঝা যায়। এই যেমন আপনাদের। ঠাট বাঁট আছে কিন্তু ধন সম্পত্তির ব্যাপারে। কিছু মনে করবেন না স্যার। মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল। আসলে কি জানেন হুজুর, এই ঘটকালি পেশায় এত বকতে হয় যে জিভের ব্রেকটা ফেল মেরে যায়। কি বলতে কি বলে ফেলি।

তার মানে আপনি যা যা বললেন তা আপনার জিভের ব্রেক ফেল করার ব্যাপার। বিশ্বাস না করার যুক্তি আছে।

ঘটক অম্লান বদনে স্বীকার করলো, তা আছে। কে কবে শুনেছে ঘটক হেরম্ব মৈত্রের মত সদাসত্য কথা বলে।

আপনি হেরম্ব মৈত্রের নাম শুনেছেন? রতিকান্ত বাঁকা চোখের প্রশ্ন।

শুনবো কি মশাই, তিনি সম্পর্কে আমার বড় দাদু ছিলেন। কপালের কি গেরো দেখুন সে বংশের সন্তান হয়ে কী ডাহা মিথ্যে কথা বলতে হচ্ছে আমাকে।

আপনার পদবী তো বলেছেন ভট্টাচার্য আর উনি মৈত্র। এক বংশ হলো কি করে।

ঐ লতায় পাতায় আর কি। রক্তের সম্পর্কই শুধু সম্পর্ক। লতা পাতারও একটা দাম আছে। এবার উঠবো। এই যে এতক্ষণ ধরে বকবকম করে গেলাম দুটো মিষ্টিও এল না। আর চৌধুরী বাড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে চাকর ছুটে আসবে আদর করে ঘরে বসাবে। পুঁটিম দ্বারিক ভীম নাগের বন্যা বইয়ে দেবে থালায়। অবিশ্যি তা নিয়ে দুঃখু করিনে। খেতে দেন নি, দেন নি। কিন্তু ঘটক বিদায় দিতে হবে মোটা টাকায়। আপনাদের মিষ্টি আমার মুখে রুচবেও না। প্রজাপতি ঠাকরুণের কৃপায় যদি কাৎলা মাছটা গেঁথে ফেলতে পারি আমাকে আর পায় কে।

রতিকান্তের চোখে মুখে আবার কৌতুক ফুটে উঠলো। সরস ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, আবার বিয়ে করবেন।

ভট্টাচার্য অম্লান বদনে উত্তর দিল, পাঁচ সাত বছর আগে হলে করতুম। তবে দিনকাল খুব তাড়াতাড়ি পাল্টাচ্ছে। গোঁড়া ব্রাহ্মণের ছেলেরা পৈতা ফেলে দিয়ে মদ মাংস খেতে শুরু করেছে। সেটা অবিশ্যি আমার সমস্যা নয়। তিন তিনটে বিয়ে করলুম একটাও ছেলে পয়দা করা গেল না। সাত আটটাই মেয়ে। তাও যা চেহারা, হা হতো যদি আপনার মেয়ের মত রূপ, দিতুম কোন রইস আদমির রাখেল করে।

সে কী, বাপ হয়ে মেয়েকে কেপট রাখনে!

রাখুন তো আপনার তত্ত্ব কথা। বলে, আপনি বাঁচলে বাপের নাম। দিন, কী দেবেন দিন।

রতিকার চোখের সামনে তখন হাতিবাগান নাচছে। চৌধুরী বাড়ির নাম তিনি আগেই শুনেছে। এক লাফে মেয়ে কোটি পত্নি হয়ে যাবে। ভাবা যায়! একশো টাকার একটা নোট ঘটকের সামনে বাড়িয়ে ধরলেন রতিকান্ত।

তিস্তা এসে ঘরে ঢুকলো। এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা বলছিলে বাপি?

তোর জন্যে সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিল। রতিকান্ত মেয়ের কাছে কথা লুকোন না। পাল্টি ঘর। হাতিবাগানের চৌধুরীরা টাকার কুমীর। ছেলেটিও সুন্দর। লেখাপড়া জানে। এম. এ. পাশ।

তিস্তা চুপ করে রইলো।

তোর মত আছে তো মা?

একটু ভেবে নিয়ে উত্তর দিল তিস্তা, হ্যাঁ আছে। নিয়ম করে কলেজে যেতে আমার ভাল লাগছে না। ঠাম্মাও বলছিল, মেয়েদের নাকি সময়কালে বিয়ে করতে হয়। নইলে পরে পস্তাতে হয়।

এ বাড়ির লোক ও বাড়িতে গেল ও বাড়ির লোক এ বাড়িতে এল। বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।

মহাধুমধাম করে চার হাতের মিলন ঘটলো। লোকে ধন্য ধন্য করতে লাগলো। এমন মহামিলন সচরাচর দেখা যায় না। এক কথায় রাজ-জোক।

.

৩.

সুখের দিন উড়ে চলে। দুঃখের দিন লেংচে লেংচে হাঁটে।

দুই বছর কেটে গেল! কোথা দিয়ে এতগুলো দিন কেটে গেল তার হিসাব তেজেন্দ্র রাখে না। তিস্তা তো রাখেই না। সে খায় দায় ঘুরে বেড়ায়। যখন তখন তেজেন্দ্রকে আদর করে। ভালবাসার কথা শোনায়।

তেজেন্দ্রর ভাল লাগে। খুবই ভাল লাগে। কিন্তু বরাবর সে উচ্ছ্বাসহীন জীবনের বাহক। মনের কথা মুখে ফোটে না।

একদিন তিস্তা বললো, এ ভাবে শুয়ে বসে দিন তো আর কাটে না।

বাড়িতে দুটো গাড়ি রয়েছে। বাপের বাড়ি যাও রোজ।

তা তো যাচ্ছিই। তবে একা একা যেতে ভাল লাগে না।

আমিও তো যাই মাঝে মাঝে।

এখন থেকে রোজ যাবে। বাপি বলছিল, জামাই বাড়িতে একা বসে কি করে। সব সময় একা থাকা নাকি ভাল না।

আমি ছেলেবেলা থেকেই একা থাকতে ভালবাসি।

তোমার কোন বন্ধু নেই? বন্ধু ছাড়া মানুষ আমি দেখিনি আগে।

তেজেন্দ্রর ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে, কে বলেছে আমার বন্ধু নেই। দাদুর সঙ্গে গল্প করেই তো আমার দিন কেটেছে এতদিন।

কী সুখ যে পাও একটা বুড়োর সঙ্গে গল্প করে। আমি তো দাদুর আর্ধেক কথাই বুঝতে পারি না।

ক্ষুণ্ণভাবে বললো তেজেন্দ্র, বুড়ো হলে সবারই এরকম হয়।

তিস্তা আর কথা বাড়ালো না। চুপ করে গেল।

যে উচ্ছ্বাস আহলাদ নিয়ে দু বছর আগে এ বাড়িতে পা রেখেছিল তিস্তা সে আলোয় যেন ছায়া নামতে শুরু করেছে। একদিন রাতে তেজেন্দ্রকে আদর করতে করতে তিস্তা বললো, ক্লাবে ভর্তি হবো।

মনে মনে চমকে উঠলেও তেজেন্দ্র উত্তর দিল, বেশ তো।

এত সহজে যে এই ঘরমুখী মানুষটি ক্লাবের হৈ হট্টগোলের মধ্যে যেতে রাজী হবে তিস্তা বিশ্বাস করতে পারলো না। সংশয় দূর করার জন্যে আবার বললো, তোমার গায়েও বাইরের বাতাস লাগবে একটু। সারাক্ষণ তো বই মুখে বসে থাকো না হয় দাদুর সঙ্গে গল্প করতে যাও। একবার ভেবে দেখেছো আমার সময় কাটে কী করে।

তুমি ক্লাবে ভর্তি হয়ে যাও। গল্পের বই পড়তে যদি ভাল লাগে লাইব্রেরি থেকে আনিয়ে নিতে পারো।

তু তুমি ক্লাবে যাবে না! তোমাদের অনেক টাকা পয়সা কিন্তু তার মানে এই না যে শুয়ে বসে দিন কাটাবে। কাজের জন্যে তুমি ব্যবসা করতে পারো। তোমার সঙ্গে আমিও না হয় মাঝে মাঝে যাব।

কোথায় যাবে!

কেন, অফিসে।

তুমি যাবে আপিসে!

তিস্তা হাসতে হাসতে বললো, কেন অফিসে কি জুজু থাকে যে তোমার সুন্দরী বৌকে টুক করে গিলে খাবে। এভাবে বৌকে আগলে রেখো না-গো পড়ুয়া মশাই। লোকে বৌ-পাগলা বলবে যে।

তেজেন্দ্র তিস্তার কথার উত্তর দিল না। অহেতুক বাক্য ব্যয় করে সে মনোমালিন্যের সৃষ্টি করতে চায় না।

আরও দুটো বছর কেটে গেল।

হলধর বিশ্বাস মারা গেলেন। মহাধুমধাম করে শ্রাদ্ধ করলো তেজেন্দ্র। বহু লোক নিমন্ত্রিত হলো। সবাই ধন্য ধন্য করলো। এস্টেটের নায়েব বই তো নয় তার শ্রাদ্ধ স্বস্ত্যয়ন এমন জাঁকজমক করে হবে এ ঘটনা শুনেছে কেউ। লোকে বাপ মার শ্রাদ্ধই নমোনমো করে সারে আর এ তো পরমানব।

সময়ের পলিমাটিতে শোক দুখ সবই চাপা পড়ে যায় একদিন। তেজেন্দ্র এখন অনেকটা সামলে নিয়েছে। তার জীবনযাত্রা আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। যতদিন। হলধরদাদু বেঁচেছিলেন সে কাছারি ঘরে বড় একটা যেত না। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে হলধর প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন তেজেন্দ্রকে দিয়ে যে সে নিয়ম করে অন্তত ঘন্টা দুই তিনেক কাছারি ঘরে গিয়ে বসবে, কর্মচারিদের কাজ দেখবে।

তেজেন্দ্র তার কথা রেখেছে।

আর একটা কথাও সে রেখেছে। এতদিন পর্যন্ত সে নিয়ম করে বিভাবতীর ঘরে গিয়ে বসতো না। এখন যায়। শুধু নিজেই যায় না। প্রথম প্রথম তিস্তাকে নিয়ে যেত। এখন তিস্তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তিস্তা নিজে থেকেই যায়। তার বাল্যকাল কেটেছে ঠাকমার সঙ্গে। সেই অভ্যেসটা ভেতরেই ছিল। মাঝে কয়েকটা বছর পরিবেশ বদল হওয়ায় অভ্যাসে ছেদ পড়েছিল। কিন্তু কিছুই হারিয়ে যায় না। পুরনো অভ্যেস আবার ফিরে এসেছে। বিকেল হতেই গা ধুয়ে সাজগোজ করে সে ওপরে উঠে যায়। বিভাবতীর সঙ্গে গল্প করতে তার ভালই লাগে। ঠাম্মার

অদর্শনের অভাব অনেকটা পূরণ হয়।

সব মানুষের নিজস্ব গল্প থাকে।

বিভাবতী গল্প বলেন। মনোযোগ দিয়ে শোনে তিস্তা। ঠাম্মাও গল্প বলতেন। সে গল্প শুনতে তিস্তার ভাল লাগতো। বিভাবতীর গল্প অন্য গল্প। অন্য মানুষ অন্য পরিবেশ। বু গল্প তো গল্পই।

ধীরে ধীরে শাশুড়ি বৌএর মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠতে লাগলো। এখন তিস্তা আর নিয়ম করে ওপরে ওঠে না। যখন মন চায় বিভাবতীর ঘরে চলে যায়। সম্পর্ক যখন গড়ে ওঠে নিজের থেকেই গড়ে ওঠে। বিভাবতীর মনও উন্মুখ হয়ে থাকে এই মেয়েটির আশায়। তার মেয়ে ছিল না। মেয়ে জুটলো। পড়ন্ত বেলায় ঠাকুর তার মনোবাঞ্ছা পূরণ করলেন।

কিন্তু মানুষের চাওয়ার বুঝি শেষ নেই।

এবার চাই দুটো কচি হাতের গলা জড়িয়ে ধরে আধ-আধরবে একটি ডাক, দিদা।

বিভাবতী কথাটা পাড়লেন, চার বছর হয়ে গেল এবার কোলে ছেলে আসুক। তিস্তা সলজ্জভাবে বললো, ছেলেই শুধু। মেয়ে না?

বিভাবতী তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, মেয়ে তো ভাল। খুবই ভাল। তবে কথাটা কি জানো বৌমা, বংশরক্ষার ব্যাপারটাও তো আছে। সম্পত্তি টাকা ধনদৌলত সব অন্যের হাতে চলে যাবে, ভাবতে কষ্ট হয়। তাই ছেলে-ছেলে করা।

আরও একটা বছর কেটে গেল।

তিস্তার ছেলে বা মেয়ে হলো না।

বিভাবতীর মন ভেঙে পড়ছে। শরীর ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। বড় বড় ডাক্তার আসছে। ঘরে ওষুধের পাহাড় জমছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। ডাক্তার বললেন, হাওয়া বদল করে দেখা যেতে পারে। অনেক সময় পরিবেশ বদলালে ফল পাওয়া যায়।

তেজেন্দ্র সঙ্গে করে নিয়ে বিভাবতীকে শিমুলতলার বাড়িতে রেখে এল। সঙ্গে রইলো তিস্তা।

দুদিনেই অস্থির হয়ে উঠলেন বিভাবতী। এভাবে রোগ সারাতে গিয়ে সংসারে বিপত্তি এসে পড়বে। খোকাকে একা রেখে আমি স্বস্তি পাচ্ছি নে। কলকাতায় যাওয়ার ব্যবস্থা করো বৌমা।

আবার কলকাতা।

ভাঙা মন জোড়া লাগছে না বিভাবতীর। উত্তরাধিকারী চাই।

তিস্তাকে ডাক্তার দেখানো হলো। ছোট একটা আপারেশনও করানো হলো কিন্তু ফল হচ্ছে না।

তিস্তা বললো, তোমাকেও ডাক্তার দেখাতে হবে।

তেজেন্দ্র উত্তর দিল, না। ছেলেরা বাঁজা হয় না।

হয়।

তর্ক করো না তিস্তা। যা জানো না তা নিয়ে তর্ক করো না।

তিস্তা এখন আর নববধূটি নেই। এ বাড়িতে এসে অনেক সুখ স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়েছে সে। তার মনে অসন্তোষের আগুন জ্বলে উঠলো। স্বার্থপরের গুষ্ঠী। যেমন মা তেমন ছেলে। শুধু বিষয়সম্পত্তি আগলাবার ফিকির। মা বলে, মেয়ে না— চাই ছেলে! ছেলে বলে পুরুষ বাঁজা হয় না! বেশ হয় না তো হয় না, একজন গাইনি দেখালে কি অঙ্গ ক্ষয়ে যাবে তোমার।

অসন্তোষ থেকে আসে ক্ষোভ।

দাবানলের মত ক্ষোভ তিস্তাকে গ্রাস করতে উদ্যত হলো।

শাশুড়ি তো একদিন বলেই বসলেন, কর্তার আমল হলে ছেলের আবার বিয়ে দিতেন।

আপনার আমলে কি করবেন?

মনোস্থির করতে পারছি না।

যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে খুব ধীরে সেই সম্পর্ক যায় মুহূর্তের ভুলে।

তিস্তা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তেজেন্দ্র মনোযোগ দিয়ে মনোস্তত্ত্বের একটা বই পড়ছিল। বই কেড়ে নিয়ে তিস্তা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। অতর্কিত এই আক্রমণের জন্য তেজেন্দ্র প্রস্তুত ছিল না। সে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। কি হয়েছে তিস্তা এমন করছো কেন?

তুমি আবার বিয়ে করো। উত্তেজনায় তিস্তার বুক ওঠা নামা করছে অতি দ্রুত।

কী বলছো পাগলের মত।

আমি পাগল, না তোমরা পাগল। তুমি তোমার মা। একজন বলে পুরুষ বাঁজা হয় না। আর একজন বলছে ছেলের আবার বিয়ে দেবে।

তেজেন্দ্ৰ ভয় পেয়ে বললো, বেশ আমি গাইনি দেখাবো।

তাতেও যদি বাচ্চা না হয় আবার বিয়ে করবে? নাকি পোয্যপুত্র নেবে। নাকি–। একটু থেমে আবার বললো তিস্তা, নাকি প্রয়োগ প্রথা।

ছিঃ! তেজেন্দ্র ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। তিস্তা দরজা আগলে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলো, দাঁড়াও পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করো না।

তেজেন্দ্রর মুখ রক্তিম বর্ণধারণ করেছে। ফর্সা মানুষের বিপদ এখানেই, তাদের উত্তেজনা মুখে ছড়িয়ে পড়ে। তেজেন্দ্র মুখমণ্ডল জ্বলন্ত আগুনের মত গনগন করছে, সে চেয়ারে এসে বসলো। প্রাণপণ শক্তিকে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করছে সে।

তিস্তা তার সামনে এসে দাঁড়ালো।

একটা বড় দম নিয়ে বলতে লাগলো, তোমাদের কীর্তিকলাপ জানতে বাকী নেই আমার। তোমরা না পারো এমন কাজ নেই।

তেজেন্দ্র নিরুত্তর। তিস্তার এমন রূপ সে আগে দেখেনি। সে দেখতে চায় তিস্তা কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে।

তোমরা, এই জমিদাররা না পারো এমন কাজ নেই। মানুষের ভাগ্য ভাল তোমাদের, গুটিকয়েক নিষ্ঠুর মানুষের দিন শেষ হতে চলেছে। এ বাড়ি যখন ভাঙা হবে, কত কঙ্কাল কত ব্যভিচার এর নিচে চাপা পড়ে আছে। কিন্তু কিছুই চাপা থাকবে না। তোমাদের গুম-ঘরের কথা আমি জানি। ঠাম্মার মুখে শুনেছি তোমাদের সেই ভয়ানক অত্যাচারের কাহিনী। সেই বংশের ছেলে তুমি। খুনী ডাকাতের রক্ত তোমার শিরায় শিরায়। বলে কিনা, ছিঃ। কী ছি, এ্যাঁ? তোমরা বাগান বাড়িতে রক্ষিতা পোষ না? পাপ পাপ। সেই পাপে জ্বলছো তুমি। তাই ভয়ে ডাক্তার দেখাতে চাও না। ভয় পাও। হা হা ভয়। তোমাদের এতগুলো ঝি পোর কথা আমি বুঝি না ভেবেছো। আমাদের বাড়িতে ঝি রাখা হয় না। শুধুই চাকর। ভাবো, আমি বুঝিনা কিছু। বিলাসিনীর মত সুন্দর ঝি রাখা হয় কেন। আমি বুঝি না ভেবেছো। ওকে দিয়ে একটা ছেলে করিয়ে নাও। বংশ বংশ করে তোমরা মা ব্যাটায় মরছে। সেই বংশরক্ষা হবে। ভগবানের কৃপা যে আমার ছেলে হয়নি। একটা নিষ্পাপ শিশুকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছি ভেবে আমার সুখ হচ্ছে। খুব সুখ। বুঝলে খুব-খুব সুখ।

তিস্তা উন্মাদের মত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তার শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছে।

তেজেন্দ্র বজ্ৰাহরে মত চেয়ারের সঙ্গে আটকে আছে। নড়াচড়ার ক্ষমতাটুকুও সে হারিয়ে ফেলেছে।

সে কি বুঝতে পেরেছিল, এত বড় একটা ফণা লুকিয়ে রয়েছে অতিসুন্দর প্রিয় এই মানবীটির মাথায়! নাগিনী সব বিষ উদগীরণ করে দিয়ে চলে গেল।

.

৪.

অনেক-অনেকদিন আগের কথা।

তখন দেশে এত মানুষ ছিল না। তোক অনুপাতে বন জঙ্গল বেশী ছিল। অরণ্যেও ছিল বাঘ ভালুক হাতি হরিণ শূয়োর সাপ কীট পতঙ্গ আরও যা যা থাকার কথা সব ছিল।

এমন দুই অরণ্য, মাঝে এক নদী। খরস্রোতা তেমন না। ছোট ছোট ঢেউ। জোয়ারের সময় দুই কুল প্লাবিত হয়, ভাটায় জল অনেক দূরে সরে যায়। ডাঙায় ঘুরিয়া বেড়ায় কাদাখোঁচা ছোট বড় কাঁকড়া বক এবং আরও নানা ধরনের পাখি। সবাই খুব নিশ্চিন্ত আরামে দিন যাপন করে যেহেতু এই নদীতে মানুষের সমাগম বড় একটা হয় না।

দুই তীরে দুইটি গ্রাম। গুটিকয়েক গৃহস্থের বাস। কিছু সংখ্যক মানুষ নদীতে স্নান করিতে আসে। অনেকেই আসে না। কারণ অরণ্য ভেদ করিয়া নদীতে স্নান করিবার সাহস বা বাসনা তাহাদের থাকে না প্রধান কারণ নদীতে কুমীরের উপদ্রব। বনে বাঘের। অনেক মুনিঋষির বাস ছিল অরণ্যে। তাঁহারা কেউ সাধন ভজন করিতেন কেহ বা আশ্রম বানাইয়া শিষ্যদের লইয়া পঠন পাঠন চালাইনে। শিষ্যরা গুরুর নিকট পাঠাভ্যাস করিত। নদী হইতে জল আনিয়া রান্না বান্না করিত। তাহারা বাঘ ভালুক হাতি কুমীরকে ভয় করিত না।

তখন বন্য প্রাণীরাও এত হিংস্র হইয়া উঠে নাই। মানুষকে তাহারা সমাদর করিত। পরম হিতৈষী বন্ধু বলিয়া ভাবিত। মানুষও তাহাদের সেইভাবে মিত্র বলিয়া ভাবিতে শিখিয়াছিল।

নদীতে ছিল বিরাট এক কুমীর। এতদিন পর্যন্ত সে খুব শান্ত ছিল। কোনদিন স্নানরত মানুষের পা ধরিয়া টানাটানি করে নাই। গভীর জলে নিয়া তাহাকে ভক্ষণ করিবার প্রয়াস তাহার ছিল না।

একদিন অতর্কিতে উত্তরের পারে দেখা দিল এক বাঘিনী। বাঘিনীর মত রূপ অন্য কোন বাঘ বাঘিনীর ছিল না। তাহার যৌবনদীপ্ত চেহারা হইতে রূপ চুইয়া চুইয়া পড়িতেছে। ঋষিবালকেরা মুগ্ধ নয়নে বাঘিনীর সেই ভুবনভোলানো রূপ দেখিতে থাকিত। বাঘিনী কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ করিত না।

একদিন, তখন ছিল শীত ঋতু, কুমীর পাড়ে শুইয়া রোদ পোহাইতেছিল। সহসা বাঘিনী আসিয়া উপস্থিত। কুমীরকে দেখিয়া তাহার ঘাড়ের লোম ফুলিয়া উঠিল। দশদিক কাঁপাইয়া সে হুঙ্কার ছাড়িল। কুমীর চট করিয়া জলে ঝাপাইয়া পড়িল। তারপর মুখ ব্যাজার করিয়া বিরাট লেজ জলের উপর ক্রমাগত আছড়াইতে লাগিল।

তখন নদীর জলে ভাটা লাগিয়াছে। বাঘিনী ডাঙার উপর ছুটাছুটি করিতে করিতে তর্জন গর্জন শুরু করিয়া দিল। কুমীরও প্রকাণ্ড হা করিয়া তাহার করাতের মত দাঁত প্রদর্শন পূর্বক লেজ আছড়াইতে লাগিল। কেহই স্ব স্ব স্থান পরিত্যাগ করিল না।

জলের কুমীর জলে রহিল ডাঙার বাঘ ডাঙায়।

দিন কাটে। সূর্য ওঠে। অস্ত যায়। বছর আসে বছর যায়।

কালক্রমে দুই জনেরই বয়স হইল। যৌবন চলিয়া গেল। উভয়ের তেজ বিক্রম কমিয়া আসিতে লাগিল। কিন্তু কেহই নিজ নিজ স্থান পরিবর্তন করিল না।

আরও দিন কাটিয়া গেল।

দুই শরীরে বার্ধক্য নামিয়া আসিল।

এখন জলের কুমীর ডাঙায় উঠিয়া আসে। বাঘ আসিয়া জলের ধার ঘেঁসিয়া বসে।

দুই জনে পাশাপাশি বসিয়া আছে। তাদের মুখ পশ্চিম দিকে ফেরানো। সূর্য অস্ত যাইতেছে। তাহার তেজ ক্রমশ স্তিমিত হইয়া আসিতেছে।

সেইদিকে তাকাইয়া বসিয়া আছে দুইজন।

বিষণ্ণ সূর্যের রশ্মি তাহাদের উপর ঝরিয়া পড়িতেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *