গৌড়ানন্দ কবি ভনে

পঞ্চম যোজনা এখন ছুটিতে আছেন

পঞ্চম যোজনা এখন ছুটিতে আছেন

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেল, আমাদের লোকপ্রিয় পঞ্চম যোজনা বিগত ১ এপ্রিল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটি নিয়েছেন। প্রকাশ, গুরুতর শ্রমজনিত ক্লান্তিতে তিনি বর্তমানে বড়ই কাতর। অনুরোধ, তাঁকে কেউ এখন বিরক্ত করবেন না। অন্যান্য দিনের মত ওইদিনও তিনি যথারীতি অফিসে আসেন এবং অত্যন্ত ত্বরিৎগতিতে যোজনামন্ত্রী শ্রী ডি পি ধরের নিকট ছুটির দরখাস্তখানা পাঠিয়ে দিয়ে সরকারিভাবে পঞ্চম যোজনা চালু করেন। কথা ছিল, পঁচিশ বার তোপধ্বনি করে সাড়ম্বরে পঞ্চম যোজনা চালু করা হবে। কিন্তু বর্তমানের বাজারের কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রী যোজনামন্ত্রীকে কৃচ্ছ্রতা সাধনের পরামর্শ দেন। তাই তোপের বারুদে বেশি খরচ পড়বে, এই কথা চিন্তা করে যোজনামন্ত্রী শেষ মুহূর্তে তোপধ্বনির অনুষ্ঠান বাতিল করে দেন।

বিকল্পে পঁচিশটি চীনা পটকা ফাটাবার প্রস্তাব কেন্দ্রীয় কেবিনেটের বিশেষ অধিবেশনে গৃহীত হয়। যোজনা মন্ত্রক পঞ্চম যোজনার উদ্বোধনী মুহূর্তে ফাটাবার উপযোগী পঁচিশটি চীনা পটকা সংগ্রহের জন্য টেনডার আহ্বান করেন। অতঃপর একদিন ভারত-বন্ধু সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত কমরেড মালেৎসেভ এক বিশেষ সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকারের জন্য আমাদের বিদেশমন্ত্রী সর্দার স্মরণ সিং-এর দফতরে আসেন। সেখানে উভয়ে বেসরকারিভাবে বিশ্বশান্তি, ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী, সাংস্কৃতিক দল বিনিময় ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে খোসগল্প করেন। তারপর একদিন আমাদের বিদেশমন্ত্রীর বিশেষ আমন্ত্রণে আমাদের যোজনামন্ত্রী তাঁর বাড়িতে চা খেতে আসেন এবং আবহাওয়া, বিশ্ব শান্তি, ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী বজায় রাখার গুরুত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে আলাপচারী করেন।

তারপর একদিন সকালে আমাদের বিদেশমন্ত্রী এবং আমাদের যোজনামন্ত্রী একযোগে বিশেষ কুশলবার্তা বিনিময়ের জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে উপস্থিত হন এবং ঘরোয়াভাবে গরিবি হটাও, আবহাওয়া, বিশ্ব শান্তি, দিয়াগো গারসিয়া, ভারত-সোভিয়েত মৈত্রীর হেফাজত ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেন। এবং তারপর যোজনামন্ত্রী তাঁর দফতরে গিয়ে তাঁর সচিবকে ডেকে পাঠান এবং কীভাবে পঞ্চম যোজনার উদ্বোধনী উৎসব শুরু হবে, সেই সম্পর্কে নতুনভাবে আলোকপাত করেন। যোজনা-সচিব অতঃপর তাঁর ঘরে গিয়ে তাঁর সহকারীকে, তাঁর সহকারী নিজ কামরায় ফিরে গিয়ে তাঁর সহকারীকে এবং একে অনুরূপভাবে ক্রমান্বয়ে অন্যকে ডাকতে থাকেন এবং এইভাবে যে ডিলিং ক্লার্ক পঞ্চম যোজনার উদ্বোধন মুহূর্তে ফাটাবার জন্য পঁচিশটি চীনা পটকা সংগ্রহ কল্পে সংশ্লিষ্ট টেন্ডারের বয়ান রচনা করেছিলেন তাঁকে খুঁজে বের করা হয় এবং তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে চীনা পটকার জন্য টেন্ডার আহ্বান করাটা ভ্রমাত্মক হয়েছে। ওই টেন্ডার বাতিল বলে যেন গণ্য করা হয়।

চীনা পটকা বাতিল করার সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ করার মত দেশীয় কোনও বস্তুর খোঁজ পড়ে যায়। অবশেষে নানা বিকল্পের মধ্য থেকে সরকারি বিশেষজ্ঞগণ এক অহিংস পটকাকে উপযুক্ত বলে বিবেচনা করেন। এই পটকার কোনও নাম না থাকায় এর নাম হাত পটকা রাখা হয়। এই হাত পটকার নির্মাণ প্রণালী এমনই যে এতে বিদেশী মুদ্রার প্রয়োজন হয় না। সেই কারণে এই হাত পটকাকে সরকারি অনুষ্ঠানে কাজে লাগাতে উচ্চ মহলে একটু ইতস্তত ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর খাস সচিবালয়ের চাপে ওই হাত পটকা ফাটাবার কর্মসূচী অবশেষে গ্রহণ করা হয়।

১ এপ্রিল বেলা ঠিক দশটায় পঁচিশজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী সারিবদ্ধভাবে যোজনাভবনের কনফারেন্স কক্ষে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে কাগজের ঠোঙা যোজনামন্ত্রী তাঁদের উদ্দেশ্যে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে বেলেন, ‘আপনাদের কর্মদক্ষতার উপরেই পঞ্চম যোজনার সাফল্য নির্ভর করছে। বন্ধুগণ, এবার ফুঁ দিয়ে নিজ নিজ হাত পটকা ফুলিয়ে নিন। পটকার মুখ ডান হাতে চেপে ধরুন। তারপর এক দো তিন চার ইত্যাদি গোনার সঙ্গে সঙ্গে বাঁ দিক থেকে একজন একজন করে নিজের ডান হাতের পটকা জোরসে বাঁ হাতের তালুতে ফটাস করে ফাটিয়ে দেবেন। নাউ বি রেডি।’

‘প্রসতুত! সিধা দেখ। পটকা ফোলাও। ঝুঁটি ধর। আভি জোরসে মার! এক দো তিন চার’— ইত্যাদি ইত্যাদি।

এইভাবে তোপধ্বনির বিকল্প পঁচিশবার হাত পটকার ধ্বনি সহযোগে পঞ্চম যোজনার শুভ মহরৎ সুসম্পন্ন হয়। মহরতের অব্যবহিত পরেই জানা যায় পঞ্চম যোজনা আপাতত ছুটি নিয়েছেন। এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণের মধ্যে এক অনিশ্চয়তার ভাব দেখা দেয়। তাঁদের মধ্যে এই আশঙ্কা দেখা দেয় যে যোজনা মধ্যবর্তীকালে দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি এবং বাজার থেকে ভোগ্যপণ্য উধাও হয়ে যাবার যে অবাধ সুবিধা তাঁরা পাচ্ছিলেন পঞ্চম যোজনা ছুটি নেবার ফলে সেই সুবিধা থেকে তাঁরা বোধহয় বঞ্চিত হবেন।

যোজনামন্ত্রী জনগণের মধ্যে আস্থার ভাব ফিরিয়ে আনার জন্য বলেন, যে পঞ্চম যোজনা ছুটি নেবার ফলে আমাদের কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে মাত্র। কিন্তু তাতে কোনও ক্ষতি নেই।

‘ক্ষতি নেই মানে আপনারা কি বোঝাতে চাইছেন?’

যোজনা মহলের সূত্র জানান, ‘যোজনা থাকলে যা ক্ষতি হত, যোজনা না থাকলে তার বেশি ক্ষতি হবে না।’

‘স্যার, জিনিসপত্রের দাম আবার ঝপ্ করে কমে যাবে না তো?’

‘সে বিষয়ে আমরা যোজনা ভবনের পক্ষ থেকে আপনাদের এই গ্যারানটি দিতে পারি যে দেশের অর্থনীতিকে আমরা এখন এমন একটা ফুটিং-এ দাঁড় করিয়েছি যে যোজনা অর নো যোজনা, ফল সমানই দাঁড়াবে। জিনিসপত্রের দাম কমবে না, নিশ্চিন্ত থাকুন।’

‘স্যর, যোজনার কল্যাণে এখন, এই কেরাসিন পাচ্ছি তো হ্যারিকেন পাই নে, কয়লা পাচ্ছি তো চাল পাইনে, গাড়ি পাওয়া যায় তো তা চাকা পাওয়া যায় না। সব সময় যেন স্যর একটা বেশ রগরগে হিন্দি ফিলমের সাসপেনসের মধ্যে আছি। স্যর, প্ল্যান হলিডের ফলে এই সাসপেনটা আবার নষ্ট হয়ে যাবে না তো?’

‘অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন, সেই আগের মতো দোকানে গিয়ে যে জিনিসটা চাইছেন সহজে তাই পেয়ে যাচ্ছেন, এই তো?’

‘ঠিক ধরেছেন স্যর। ঠিক ওই কথাই বলতে চাইছিলাম।’

‘অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তার সাসপেনস্ নষ্ট করে দিয়ে আবার জীবন যাপনের একঘেয়ে ক্লান্তি ফিরিয়ে আনব। আমাদের যোজনা সম্বন্ধে এমন একটা খারাপ ধারণা আপনারা পোষণ করেন। ছিঃ। আমাদের যোজনার মূল কথাই হল অনিশ্চয়তা। হামেশা অনিশ্চয়তা। তবে না মশাই, বেঁচে সুখ!’

৩ এপ্রিল ১৯৭৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *