পঞ্চম পরিচ্ছেদ : ষড়যন্ত্রের পরিণাম

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – ষড়যন্ত্রের পরিণাম

দেও দেও চাই চাই এই মাত্র বোল।
মাইরের চোটেতে উঠে ক্রন্দনের রোল॥
মানীর সম্মান নাই নাই মানী জমিদার।
ছোট বড়ো নাই বলে সবে করে হাহাকার।।
—রংপুরের জাগের গান

অন্ন ত্রাণে প্রাণে মরি, নানাবিধ কৃষি করি
আমার কৃষি সকল নিল জলে,
কেবল মাত্র লাঙ্গল চষি॥
—রামপ্রসাদ সেন

প্রথম দিকে ইংরাজরা ঠিক বুঝতে পারল না যে রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের হাতের মুঠোয় চলে আসতে শুরু করেছে। কত দিন তারা এ দেশে আছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয়, তাই পাততাড়ি গুটাবার আগে এই বেলা যা লুটেপুটে নেওয়া যায়, সেই ঝোঁক প্রবল হয়ে উঠল। পলাশীর যুদ্ধের পরবর্তী মাসে সাম্রাজ্যের স্বপ্ন নয়, টাকা আদায়ের চিন্তা তাদের মন জুড়ে বসল। তাই তারা যখন শুনল প্রতিশ্রুত টাকার সবটা নতুন নবাব এই মুহূর্তেই দিতে পারছেন না, তখন তারা ভারি মুষড়ে পড়ল। তারা বলল, তবে জগৎশেঠ মুচলেকা দিন যে নবাব সমস্ত টাকা মিটিয়ে দেবেন। তখ্ত যে তাদের কব্জায়, তাই খাজনাও তাদের মুঠোয়, বছর বছর রাজত্ব করে যে কায়েমীভাবে টাকা আনা যায়, তখনো তাদের সে বোধোদয় হয়নি। তাদের ধারণা নবাবের হাতে রাষ্ট্রশক্তি ও ভূমিরাজস্ব। তাঁকে প্রতিশ্রুতিতে বেঁধে রাখতে হলে জগৎশেঠের মধ্যস্থতা চাই। নবাবী রাষ্ট্রের কাঠামো ও সমাজ ব্যবস্থা তখনো আপাতদৃষ্টিতে অটুট আছে। নতুন নবাবের মধ্যে কিছুমাত্র পদার্থ থাকলে সেই কাঠামো টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হত না। কিন্তু ইংরাজদের অপরিসীম বিত্তবাসনা তাতে বাধা দিল। তাদের টাকার দাবি মেটাতে না পারায় মীরজাফর মসনদচ্যুত হলেন। সে দাবি রোধ করতে গিয়ে মীরকাশিম লড়াই করে দেশত্যাগী হলেন। টাকা আদায়ের জন্য দেওয়ানী হাতে নিয়ে ক্লাইভ দ্বৈত শাসনের প্রবর্তন করলেন, তার পাঁচ বছর পেরোতে না পেরোতে প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ ঘটে যাওয়ায় ইংরেজ শাসনের প্রবর্তন করতে হল। এইভাবে ইংরেজদের অর্থলোভের সূত্র ধরে বাঙালি সমাজের পুরাতন রাষ্ট্রীয় ও বৈষয়িক কাঠামো ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।

পলাশী থেকে মুর্শিদাবাদে ফিরেই রায় দুর্ল্লভ বলতে শুরু করলেন, দৌলতখানায় তো মোটে এক কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকা আছে, আর জগৎশেঠই বা কোথা থেকে কোটি কোটি টাকা অগ্রিম দেবেন? ক্লাইভ সত্যিই দৌলতখানায় তজবীজ করে দেখলেন, সেখানে দেড় কোটি টাকার বেশি নেই। তখন জগৎশেঠের কুঠিতে প্রধান প্রধান সভাসদদের বৈঠক বসল। কেউ আমীরচন্দকে ডাকেনি, তিনি স্বনিমন্ত্রিত হয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। স্থির হল, আপাতত নবাব অর্ধেক টাকা দেবেন, বাকি অর্ধেক তিন বছর ধরে কিস্তিতে কিস্তিতে মিটিয়ে দেবেন। জগৎশেঠ এর জামিন হলেন। মীরজাফরের সঙ্গে ইংরাজদের চুক্তি যখন সভায় পাঠ করা হল, তখন তাঁর শতকরা পাঁচ ভাগের কোনো উল্লেখ নেই দেখে আমীরচন্দ চেঁচিয়ে উঠলেন—‘এ তো সে কড়ার নয়, আমি যে লাল কড়ার দেখেছিলাম।’ ক্লাইভ ভারি মজা পেয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ উমিচাঁদ, কিন্তু এটা হল সাদা কড়ার। রায় দুর্ল্লভকে ওভাবে হটিয়ে দেওয়া গেল না। তিনি নতুন দেওয়ান, তিন বছর ধরে ইংরাজদের টাকা মিটাবার জন্য তারা তাঁর উপর নির্ভরশীল। অতএব স্থির হল তাঁকে তাঁর প্রতিশ্রুত শতকরা পাঁচ ভাগ দেওয়া হবে, কিন্তু সমস্ত টাকার উপর পাঁচ শতাংশ নয়, নৌবহর ও সৈন্যবাহিনীর টাকা বাদ দিয়ে যা থাকে তার শতকরা পাঁচ ভাগ তিনি পাবেন।

অর্থলোভ ও দস্যুবৃত্তির সঙ্গে সুবাহ্ বাংলার প্রজারা অপরিচিত ছিল না। বছর দশ পনের আগে বর্গিরা এ দেশে হানা দিয়েছিল। তাদের মুখে একটাই কথা—‘রূপি দেহ, রূপি দেহ।’ রূপি না পেলে বর্গিরা নাকে জল ধরে দিত, কিন্তু অর্থ আদায়ের ব্যাপারে ইংরেজরা অনেক বেশি বিচক্ষণ ও পারদর্শী। বর্গিরা লুটেপুটে যা পেত নিয়ে যেত। ইংরাজরা যা পায় তাই নিয়ে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। তাদের বিষয় বাসনা আকাশের মতো অবারিত। এত অপরিসীম যে প্রয়োজন বোধে এক কড়ি ছেড়ে দিলে তারা নিজেদের সংযম দেখে নিজেরাই অভিভূত হয়ে যেত। পনের বছর বাদে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ক্লাইভ সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন—

‘A great price was dependent on my pleasure, an opulent city lay at my mercy; its richest bankers bid against each other for my smiles ; I walked through vaults which were thrown open to me alone, piled on either hand with gold and jewels! Mr. chairman, at this moment I stand astonished at my own moderation!’

বর্গিদের সঙ্গে ক্লাইভ ও তাঁর দলবলের পার্থক্য এইখানে বড়ো হয়ে দেখা দিল। বর্গিরা একবার মুর্শিদাবাদে হানা দিয়ে যা পেয়েছিল ঘোড়ায় চাপিয়ে নাগপুর নিয়ে গিয়েছিল। ইংরাজরা তার বদলে একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা করে বছর বছর নৌকো নৌকো বোঝাই ধনরত্ন সাজিয়ে নিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে ভাটি বয়ে নিয়ে যেতে শুরু করল। প্রতিশ্রুত তিন কোটি টাকা দিয়ে এই প্রণালীবদ্ধ দস্যুবৃত্তি শুরু হল। নবাব তখন যা দিতে পারলেন তা দিলেন বাকি টাকার পাইপয়সা ইংরাজরা নিশ্ছিদ্র প্রণালীতে কিস্তিতে কিস্তিতে উশুল করবার বন্দোবস্ত করল। এই প্রথায় সবচেয়ে লাভবান হলেন ক্লাইভ নিজে। পলাশীর যুদ্ধের পর এক মাস যেতে না যেতে তিনি উৎফুল্ল চিত্তে নিজের বাবার কাছে লিখলেন—‘ইংরাজদের কাছ থেকে জাফর আলি খান বাহাদুর যে মস্ত উপকার পেয়েছেন তার বদলে তিনি সরকারী ও বেসরকারী খাতে তিন কোটি টাকা দিতে রাজি হয়েছেন—তার অর্ধেক এর মধ্যেই হাতে এসে গেছে। তাঁর বদান্যতায় আমি স্বদেশে এমন ঠাঁটে থাকতে পারব যা আমার সব আশা আকাঙক্ষার অতীত।…যা নবাবী উপহার পাওয়া গেছে তা সবকিছুর অর্ধেক মাত্র। বাকি টাকাও হাতে এসে যাবে বলে পুরো ভরসা রাখি। বোনেদের জন্য আমি বিশ বিশ হাজার টাকা ধরে দিচ্ছি, যথা সময়ে ভাইদের ব্যবস্থা করে দেবো। ছুঁড়ি দুটোর প্রতি আমার পরামর্শ তারা যত তাড়াতাড়ি পারে বিয়ে করে ফেলুক কারণ তাদের আর হাতে সময় নেই। আপনারও আর আইনের ব্যবসা করার দরকার নেই।’

সিলেক্ট কমিটির বড়ো বড়ো সাহেবরা আর সেনাপতিরা সবাই রাতারাতি ‘নবাব’ বনে গেলেন—শুধু ফাঁকিতে পড়ে গেলেন অ্যাডমিরাল ওয়াটসন। পলাশীর যুদ্ধের কয়েক দিন বাদেই তিনি অসুখে ভুগে হঠাৎ মারা গেলেন। ক্লাইভের সঙ্গে তাঁর আধাআধি বখরার কথা ছিল। কার্যকালে সেই অঙ্গীকার পালনে ক্লাইভের কিছুমাত্র আগ্রহ দেখা গেল না। অ্যাডমিরালের উত্তরাধিকারীরা তাঁর নামে মামলা ঠুকে দিলেন। অনিচ্ছাভরে ক্লাইভ এক কিস্তি টাকা পাঠিয়ে দিলেন। যথা লাভ বলে মামলাবাজরা মামলা তুলে দিলেন।

এই বিপুল পরিমাণ অর্থ যোগানের বোঝা বাংলার পুরাতন সমাজ ব্যবস্থা বেশি দিন বইতে পারল না। সমাজের উপরতলায় যে তিনটি শ্রেণী অধিষ্ঠিত ছিল সেই মনসবদার, জমিদার ও সওদাগর সশব্দে ভূপতিত হল এবং গোটা সমাজের বৈষয়িক কাঠামো তের বছর যেতে না যেতে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সেই কাহিনী এই নিবন্ধের বিষয় নয়। কিন্তু ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন তাঁদের পরিণাম থেকে কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যাবে।

নিজেরা রাজ্য চালাবার অভিপ্রায়ে ইংরাজরা মীরজাফরকে মসনদে বসায়নি। কলকাতার সাহেব আর মুর্শিদাবাদের ওমরাও উভয় পক্ষ ধরে নিয়েছিল নবাব সরকার আগের মতোই চলবে। কিন্তু তা হল না। মীরজাফর নামে মাত্র নবাব রইলেন। তিন কোটি টাকা মেটাতে গিয়ে তাঁর তহবিল শূন্য হয়ে গেল। সওয়াররা মাইনে না পেয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠল। ফলে নবাবী সৈন্যবাহিনী ভেঙে পড়ল। সুযোগ পেয়ে জায়গায় জায়গায় জমিদার ও ফৌজদাররা নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। তাদের দমন করতে গিয়ে ইংরাজ ফৌজ ব্যবহার করা ছাড়া নবাবের গতি রইল না। গোরা ও তেলেঙ্গাদের সমস্ত খরচ তাঁকে বহন করতে হবে এই শর্তে ক্লাইভ নবাবকে মদত দিতে এগিয়ে এলেন। বিদ্রোহীরা শায়েস্তা হল কিন্তু যুদ্ধের খরচ মেটাবার টাকা কৈ? মীরজাফর বর্ধমান, নদীয়া ইত্যাদি জেলার গোটা খাজনা ইংরাজদের নামে লিখে দিতে বাধ্য হলেন। খাজনা আদায়ের শাসনযন্ত্রে সেই যে ইংরাজদের প্রবেশ শুরু হল, গোটা দেওয়ানী ও নিজামত তাদের হাতে চলে না যাওয়া পর্যন্ত তার শেষ হল না।

নবাবী শাসনযন্ত্র ক্রমশ অচল হয়ে যেতে লাগল। দরবারের সব ওমরাও উপলব্ধি করলেন তাঁদের দিন শেষ হতে চলেছে। যেসব মনসবদার মীরজাফরের মদত যুগিয়েছিলেন তাঁরা যখন দেখলেন তিনি ইংরাজদের ঠুঁটো জগন্নাথ মাত্র এবং তাঁর হাত থেকে তাঁদের কিছুই প্রাপ্তি নেই তখন সকলে বিলীয়মান পুরনো জমানার জন্য অনুশোচনায় হায় হায় করতে লাগলেন। মীরজাফরের আগেকার কালের এক বন্ধু আশা করেছিলেন নবাব যথোচিত পুরস্কার দেবেন। তিনি কিছুই পেলেন না। আশাহত আমীর নতুন নবাবের নবাবিয়ানা ভিতর থেকে কতটা ফাঁপা তা প্রকাশ্য দরবারে বাজিয়ে দেখালেন। ক্লাইভের লোকজনদের সঙ্গে এই আমীরের লোকজনদের আগের দিন হাতাহাতি হয়েছিল। পরের দিন সকালে নবাব পুরনো বন্ধুকে রোষকষায়িত নেত্রে বললেন—‘জনাব, কর্নেল সাহেবের লোকেদের সঙ্গে কাল আপনার লোকেরা ঝগড়া বাধিয়েছিল। জনাবের কি জানা আছে, এই কর্নেল ক্লাইভ কে—জান্নাতের হুকুমে জাহানে তাঁর কি জায়গা?’ মির্জা শামসুদ্দিন সোজা দাঁড়িয়ে সবার সামনে উত্তর দিলেন—‘হুজুর নবাব বাহাদুর,—কর্নেলের সঙ্গে ঝগড়া করব আমি? এই আমি? যে রোজ সকালে উঠে তাঁর গাধাটাকে পর্যন্ত তিন বার সিজ্দা না করে কোনো কাজ করে না? তবে কোন সাহসে আমি গাধাটার সওয়ারের সঙ্গে লাগতে যাবো?’

মীরজাফর ‘মহাবৎ জঙ্গ’ নামে খ্যাত হতে চেয়েছিলেন কিন্তু ‘ক্লাইভের গাধা’ নামে তাঁর প্রসিদ্ধি হল। রাজকার্যে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি ভাঙ খেয়ে চুর হয়ে রইলেন। লোকে তাঁর ছেলে মীরনকে বলত ছোট নবাব। যত দিন এই নিষ্ঠুর নবাবজাদা বেঁচেছিলেন তত দিন প্রকৃতপক্ষে তিনিই রাজকার্য চালাতেন। তাঁর হুকুমে গহসেটি বেগম ও আমিনা বেগম—দুই নবাবনন্দিনীকে জলে ডুবিয়ে মারা হল। গহসেটি বেগম তাঁর সমস্ত লুকানো ধনরত্ন দিয়ে মীরজাফরকে ষড়যন্ত্রে সাহায্য করেছিলেন। আজ সেই কর্মের ফল ফলল। ডুবে মরবার আগে দুই বোন মীরনের মাথায় বজ্রাঘাতের অভিসম্পাত করে গেলেন। মীরনের সব দুষ্কর্মের সাথী ছিলেন খাদেম হোসেন খান—যিনি প্রকাশ্য রাজপথে সদ্য সন্তানহীনা নবাবনন্দিনী আমিনা বেগমকে মারধোর করতে পিছপা হননি। নয়া জমানায় খাদেম হোসেন খান পৃর্ণিয়ার ফৌজদার হয়ে বসলেন। শীঘ্রই মীরন ও খাদেম হোসেন খানের মধ্যে লাঠালাঠি লেগে গেল। বিদ্রোহী খাদেম হোসেন খানের পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে খোলা মাঠে তাঁবুর মধ্যে বজ্রাহত হয়ে মীরন মরে গেলেন। খাদেম হোসেন খান তরাইয়ের নিশ্ছিদ্র অরণ্যের মধ্যে পালিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরাল হলেন। ইংরাজদের টাকা মেটাতে না পেরে মীরজাফর মসনদচ্যুত হলেন, আবার ইংরাজদের কৃপায় মসনদে বসলেন, শেষে কুষ্ঠ রোগে মরলেন।১০ শেষের দিকে মরিয়া হয়ে তিনি ইংরাজদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন—‘আপনারা কি ভাবেন টাকার বৃষ্টি হয়?’ এ নিতান্ত নিষ্ফল আক্রোশ।

ষড়যন্ত্রের অপর প্রধান নায়ক ছিলেন রায় দুর্ল্লভ। তাঁর কি হল? নতুন নবাব ও তাঁর নতুন দেওয়ানের মধ্যে দু দিন যেতে না যেতেই মারাত্মক রেষারেষি শুরু হয়ে গেল। মীরজাফরের সন্দেহ হল, রায় দুর্ল্লভ সিরাজের ছোট ভাই মীর্জা মেহদীকে মসনদে বসিয়ে নিজে রাজত্ব করবার মতলব ভাঁজছেন। মীরন সেই নিরাপরাধ তরুণকে হত্যা করে রায় দুর্ল্লভের উপর চোরা গোপ্তা হানবার ফিকির খুঁজতে লাগলেন। ক্লাইভের কৃপায় রায় দুর্ল্লভের প্রাণ রক্ষা হল, কিন্তু মীরন ঢাকার রাজবল্লভকে ডেকে এনে রায় দুর্ল্লভকে তাঁর হাতে রাজকার্য তুলে দেবার হুকুম দিলেন। রায় দুর্ল্লভের দু দিনের দেওয়ানী ঘুচে গেল। তিনি কলকাতায় পালিয়ে ধন প্রাণ বাঁচালেন। তাঁর সঞ্চিত ধন তাঁর উত্তরপুরুষদের ভোগে লাগল না। তাঁর ছেলে রাজবল্লভ ইংরাজ আমলে রায় রায়ান পদে অধিষ্ঠিত হলেন বটে, কিন্তু তাঁর একমাত্র সন্তান মুকুন্দবল্লভ তাঁর জীবদ্দশাতে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ায় রায় দুর্ল্লভের বংশলোপ হল। লোকের ধারণা হল—এই রূপে ঐ মহারাজ দুর্ল্লভরা নিঃসন্তান হইলেন ও আপন মুনিব নবাব সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে নিমখারামি বৃক্ষের ফল পাইলেন, অতএব স্বতঃ নিমখারাম অথচ এক ক্ষুদ্রের ঔরষেতে মহারাজ দুর্ল্লভরামের জন্ম, অতএব বিপরীত খচরস্থরূপ ঐ মহারাজ রাজবল্লভের ভাগিনেয়েরা প্রতি পুরুষের ক্রমাগত যে কিছু ধন তাহা অধিকার করিয়া ঐ মহারাজ রাজবল্লভের পুত্রবধূ ঐ মহারাজ মুকুন্দবল্লভের স্ত্রীকে এক বস্ত্রে কএক দাসীসমেত কৌশলক্রমে বাটী হইতে বাহির করিয়া দিয়া নীলবর্ণ শৃগালের ন্যায় আপনাকে মহারাজ মানিয়া ঐ মহারাজ রাজবল্লভের ঐহিক সম্ভ্রম ও পারমার্থিক সকল ধর্ম্ম লোপ করিলেন। ঐ মহারাজা রাজবল্লভের পুত্রবধূ এক ব্রাহ্মণের বাটীতে দুঃখেতে কালক্ষেপণ করিতে লাগিলেন।’১১

সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র অন্যান্য আমীরদের কি হল? কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। মোহনলালকে রায় দুর্ল্লভ বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন। খ্বাজা আবদুল হাদি খানকে মীরজাফর বিশ্বাসঘাতকতা করে মেরে ফেলেন। ঢাকার ভূতপূর্ব নায়েব রাজবল্লভ সেন পরে পাটনার নায়েব হয়ে শেষে মীরকাশিমের হুকুমে গঙ্গাবক্ষে সলিল সমাধি প্রাপ্ত হন। হুগলীর অস্থায়ী ফৌজদার নন্দকুমার পরে মীরজাফরের বুড়ো বয়সের দেওয়ান হয়ে শেষে ওয়ারেন হেস্টিংসের ষড়যন্ত্রে ফাঁসি যান। পাটনার নায়েব রামনারায়ণ নবাব মীরকাশিমের হুকুমে অতি নিষ্ঠুরভাবে নিহত হন। মোটের উপর পলাশীর যুদ্ধের বিশ বছরের মধ্যে প্রায় সমস্ত মহাবৎজঙ্গী ওমরাও সমূলে নষ্ট ও নিশ্চিহ্ন হন।

শেঠ সওদাগরদের পরিণামও ততোধিক করুণ। বঞ্চিত আমীরচন্দ মুর্শিদাবাদে বসে কলকাঠি নাড়ান এটা ইংরাজদের পছন্দ হল না। ক্লাইভ তাঁকে ধর্মে মন দিতে পরামর্শ দিলেন। তীর্থ করতে তাঁকে প্রায় জোর করে মালদায় পাঠিয়ে দেওয়া হল। মরার আগে আমীরচন্দ একবার অমৃতসরে তীর্থ করতে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। সে আর হল না। তার যড়যন্ত্রের সহায় খোজা পেত্রসকে ইংরাজরা একজন ‘পাকা ষড়যন্ত্রী’ বলে চিহ্নিত করে কলকাতা থেকে তাঁকে বের করে দিল। পেত্রস করুণভাবে ষড়যন্ত্রের পুরস্কার বা অন্তত খরচ পূরণের জন্যে আবেদন নিবেদন করতে লাগলেন। কোনো ফল হল না। যে টাকাটা তিনি ষড়যন্ত্রে ঢেলেছিলেন, তার পুরোটাই মারা গেল।

খোজা ওয়াজিদের মতো বড়ো ব্যবসায়ী নয়া জমানাতে টিকে থাকুক এটা আদপেই ক্লাইভের ইচ্ছা নয়। দু বছর যেতে না যেতে ফরাসী ও ওলন্দাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে ইংরাজরা তাঁকে জেলে পুরল। সেখানে তিনি বিষ খেয়ে মরলেন।১২ জগৎশেঠ মহাতাব রায় ও মহারাজা স্বরূপচন্দের পরিণাম হল আরো ভয়াবহ। ইংরাজদের মিত্র বলে নবাব মীরকাশিম আরো অনেকের সঙ্গে এই দুই প্রধান শেঠকে গঙ্গার জলে ডুবিয়ে মারলেন। জগৎশেঠ পরিবার-এর ব্যবসা যে ঘা খেল, তা থেকে আর উঠল না। দেওয়ানী হাতে পেয়ে ক্লাইভ রুক্ষভাবে তাঁদের উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে রাজকোষের চাবি ছিনিয়ে নিলেন। রাজকোষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগের ভিত্তিতে জগৎশেঠের ব্যবসা গড়ে উঠেছিল। সেই সংযোগ ঘুচে যাবার পর তাঁদের ব্যবসাও আর রইল না। ইংরাজরা অসংখ্য প্রকারে এই পরিবারের কাছে ঋণী ছিল। সেই ঋণ তারা এইভাবে শোধ করল।

নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তলে তলে ইংরাজদের সাহায্য করেছিলেন। ইংরাজদের সে সব স্মরণ রইল না। তাদের তিন কোটি টাকার দাবি মেটাতে মীরজাফর লিখে দিলেন নদীয়া জমিদারীর খাজনা মুর্শিদাবাদে না এসে ইংরাজদের তন্খা হয়ে কলকাতায় যাবে। টাকা আদায় করবার জন্য ইংরাজরা কৃষ্ণচন্দ্রকে অশেষ উৎপীড়ন করল। এমন কি সনাতন হিন্দু সমাজের প্রধান ধারক ও বাহক এই রাজার জাতিনাশ করবার ভয় দেখাল। বুড়ো বয়সে তাঁর জমিদারী অপরিমেয় ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ল। রাজা মারা যাবার পর তাঁর বংশধরেরা সে জমিদারী রক্ষা করতে পারলেন না। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূর্যাস্ত আইনে প্রায় সব নিলাম হয়ে গেল। অন্যান্য বড়ো বড়ো জমিদার ও রাজাদেরও সেই অবস্থা হল।

এবার রানী ভবানীর নাম স্মরণ করে এই ইতিহাসের উপসংহার হোক। পলাশীর যুদ্ধের পরে সনাতন বাঙালি সমাজের মধ্যে যে ভাঙন ধরে তা রানী ভবানীর উত্তর জীবনের উপরে গভীর ছাপ অঙ্কিত করে দিয়ে যায়। দেশের ভাগ্যাকাশে যে, ঘন কালো মেঘ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছিল, রানীর সাংসারিক জীবনে তার ছায়া ঘনিয়ে এল।

দুই দিক থেকে বিপদ এল। পলাশীর বিপ্লবের ফলে কোম্পানির সাহেবদের বেসরকারী বাণিজ্যে (private trade) একেবারে নিরঙ্কুশ হয়ে ওঠায় উত্তর বঙ্গের গঞ্জে গঞ্জে তাঁদের গোমস্তারা রাতারাতি কুঠি বানিয়ে চারপাশে অভাবনীয় দৌরাত্ম্য শুরু করল। রায়ত, ব্যাপারী ও জমিদারের আমলারা ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়তে লাগল। মিস্টার সেভালিয়ার, মিস্টার টেক্সিরা এবং কয়েকজন ইংরাজ সাহেবের গোমস্তা রানী ভবানীর জমিদারী জুড়ে যেমন খুশি নৌকা আটক করে, দেশী সওদাগরদের বেচাকেনা থামিয়ে, চড়া দামে নিজেদের পণ্য প্রজাদেরকে কিনতে বাধ্য করে, এমন অবস্থার সৃষ্টি করল যে দিকে দিকে রায়তরা পালাতে লাগল, ফলে খাজনা আদায় ব্যাহত হল।১৩

ঠিক ঐ সময়ে মীরকাশিম ইংরাজদের সহায়তায় শ্বশুর মীরজাফরকে হটিয়ে নিজে মসনদে বসলেন। ইংরাজদের টাকার দাবি মেটাতে তিনি জমিদারদের খাজনা বাড়াতে বাধ্য হলেন। ১৭৬১ খ্রীস্টাব্দে রাজশাহীতে হস্ত-ও-বুদ (পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান ও খাজনা বৃদ্ধি) পরিচালনা করতে একজন আমিন পাঠানো হল। তিনি ‘আবিষ্কার’ করলেন ঐ জমিদারীতে এক কালে দশ লাখ টাকা কিফায়েৎ (লাভ) বাড়ানো যেতে পারে। এতেও ক্ষান্ত না হয়ে পরের বছর নবাব সরকার থেকে প্রভুরাম নামে আর একজন আমিন পাঠানো হল, তিনি আরো পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান করে বের করলেন যে জায়গায় জায়গায় মিলে আরো এক লক্ষ টাকা কিফায়েৎ বাড়ানো সম্ভব।১৪ পলাশীর যুদ্ধের সময় রাজশাহী জমিদারীর খাজনা ছিল বিশ লক্ষ টাকা। ১৭৬১-র হস্ত-ও-বুদ বা অনুসন্ধান অনুযায়ী নবাব মীরকাশিম ৩১ লক্ষ টাকা খাজনা আদায়ের১৫ সংকল্প করলেন। রানীর অবস্থা সহজেই অনুমেয়। তাঁকে দিয়ে প্রজাদের কাছ থেকে এত খাজনা আদায় করা চলে না। অতএব টাকা আদায় করতে নবাবের রায় রায়ান রানী ভবানীর জমিদারী চার ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক ভাগে একজন আমিলদার লাগালেন। পুরনো জমিদারী কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করা হল।১৬

নবাব সরকার থেকে রাজশাহীর খাজনার একাংশ ইংরাজদের টাকা মেটাবার জন্য আলাদা করা হয়েছিল। তখন এক দিক থেকে ইংরাজদের তেলেঙ্গা সেপাইরা রাজশাহী থেকে প্রেরিত বাইশ হাজার মুদ্রার ‘পগোয়া’ (প্রথম ফসল) টাকা ছিনিয়ে কাশিমবাজারের কুঠিতে নিয়ে তুলল, অন্য দিক থেকে রায় রায়ানের আমিলদাররা ইংরাজদের খাতে রানী ভবানী যে এক লক্ষ টাকা যোগাড় করেছিলেন তা ছিনিয়ে নিয়ে গেল। রানী কোন দিক সামলে কোন্ দিক রাখেন? তিনি রায় রায়ানের কাছে লিখলেন, কাশিমবাজারের বড়ো সাহেব, মিস্টার ব্যাটসনকে বলে ঐ বাইশ হাজার টাকা উদ্ধার করা হোক, আবার মিস্টার ব্যাটসনের কাছে লিখলেন, রায় রায়ানের লোকেরা লক্ষ টাকা সুদ্ধ তাঁর কর্মচারীদের ধরে নিয়ে যাওয়ায় ইংরাজদের টাকা মেটাতে দেরি হবে। রানী নবাব মীরকাশিমের কাছেও আবেদন করলেন খাজনা বাকির দায়ে যেসব জমিদারী কর্মচারী বন্দী হয়েছে, তাদের ছেড়ে দিতে। ব্যাটসনকেও রায় রায়ানের কাছে বুঝিয়ে ঐ হতভাগাদের ছাড়িয়ে আনবার অনুরোধ করলেন যাতে তারা কোম্পানির টাকা শীগগির আদায়ে লাগাতে পারে।১৭

এর মধ্যে ইংরাজদের সঙ্গে নবাবের যুদ্ধ বেধে যাওয়ায় রানীর সৌভাগ্যক্রমে হস্ত-ও-বুদের টাকা আর আদায় হল না। রানী ভবানী ও তাঁর দেওয়ান দয়ারাম রায় প্রথমে মীরকাশিমের পক্ষ অবলম্বন করলেন। ইংরাজদের অবাধ বাণিজ্যের অত্যাচারে তারা তিষ্ঠোতে পারছিলেন না। তা ছাড়া নবাব যতই অত্যাচার করুন রাজদ্রোহ ভবানীর চরিত্রে ছিল না। নবাব সরকারের ফৌজদার এবং দেশের জমিদারদের কাছে মীরকাশিমের পরোয়ানা গেল দিকে দিকে ইংরাজদের আমদানী রপ্তানী আটক করতে হবে। সেই হুকুম অনুযায়ী দেওয়ান দয়ারাম রায় রামপুর বোয়ালিয়ার কুঠি থেকে কাশিমবাজার কুঠিতে পাঠানো একশো মন রেশম আটক করলেন।১৮

কিন্তু নবাব মীরকাশিম যুদ্ধে হেরে বাংলা থেকে বিতাড়িত হলেন। মীরজাফর আবার নবাব হলেন। মন্ত্রী হলেন নন্দকুমার। নন্দকুমারকে ঘুষ দিয়ে আগের নবাবের হস্ত-ও-বুদ ও কিফায়েতের ব্যাপারটা ধামা চাপা দেওয়া হল।১৯

কিন্তু রানীর নিস্তার ছিল না। বাংলা ১১৭২ সনে (ইং ১৭৬৫) গভর্নর ক্লাইভ বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে সুবাহ্ বাংলা বিহার ওড়িশার দেওয়ানী হস্তগত করলেন। নন্দকুমারের রাজত্ব ঘুচে গেল। দেওয়ানী কার্য পরিচালনার জন্যে ক্লাইভ মহম্মদ রেজা খানকে নায়েব দেওয়ান পদে এনে মুর্শিদাবাদে বসালেন। রেজা খান পাকা লোক। তিনি বুঝলেন মীরকাশিমের হস্ত-ও-বুদ অনুযায়ী খাজনা আদায় করা অসম্ভব ব্যাপার, সেটা ধামাচাপা দেওয়াই ভালো। কিন্তু তাই বলে রানী ও অন্যান্য জমিদারদের ছেড়ে দিলে তাঁর নায়েবী টিকবে না। অতএব রাজশাহী জমিদারীতে তিনি এক ধাক্কায় খাজনা বাড়িয়ে ২০ লক্ষের জায়গায় ২৪১/২ লক্ষ করলেন।২০ অন্যান্য জমিদারীতেও তথৈবচ। ইংরাজদের অপরিচিত অর্থক্ষুধা মিটাতে জমিদার ও প্রজাদের উপর নিত্য নতুন উৎপীড়ন শুরু হল। এই ভাবে দ্বৈত শাসনের মধ্যে দিয়ে ইংরাজ আমল শুরু হল:

অপূৰ্ব্ব শুনহ সবে স্বর্গের যতেক দেবে

বিলাতে হইলা সাহেব রূপী।

ছাড়িলা আহ্নিক পূজা পরিধান কুর্তি মুজা

হাতে বেত শিরে দিলা টুপী॥

বাঙ্গালার অভিলাষে আইলা সদাগরবেশে

কৈলকাতা পুরাণ কুঠি আদি।

গতামল সুভেদারী শুভ সন বাহাত্তরী

আংরেজ আমল তদবধি।২১

‘শুভ সন বাহাত্তরী’ রানী ভবানী ও তাঁর লক্ষ লক্ষ প্রজাদের ভাগ্যাকাশে বড়ো ভয়ংকর সংকেত সঞ্চার করে গেল। চার বছর যেতে না যেতে খরা মহামারী ও মন্বন্তরের করাল আকৃতি প্রকাশ পেল। চারিদিকে রব উঠল : ‘অন্ন দে গো অন্ন দে গো অন্ন দে,’ ‘আমার জঠরের জ্বালা আর সহে না,’ ‘লুণ মেলে না আমার শাকে।’২২ অন্যান্য জমিদারীর মতো নাটোর রাজ্যেও ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পশ্চাতে অনাবৃষ্টি ছাড়া আরো দুটি কারণ কার্যকরী হয়েছিল, যার প্রভাবে অনাবৃষ্টির প্রারম্ভে প্রজাদের হাতে কোনো সঞ্চয় ছিল না। একটি কারণ মহম্মদ রেজা খানের আমিলদারী বন্দোবস্ত, অপর কারণ স্বাভাবিক বাণিজ্যের গতি রোধ করে গোমস্তাদের মাধ্যমে সাহেবদের ক্রমর্বদ্ধমান একচেটিয়া কারবারের দৌরাত্ম্য। ইংরাজরা যখন দেওয়ানী হাতে পেল তখন তাদের প্রথম লক্ষ্য হল দেশ থেকে যত পারা যায় খাজনা আদায় করে নেওয়া। সুবাহ্ বাংলার গোটা খাজনা কোম্পানির ইনভেস্টমেন্ট ও ফৌজী খরচা বাবদ বাঁধা পড়েছিল বলে খাজনা তখন না বাড়ালেই নয়।২৩ মীরকাশিমের পদাঙ্ক অনুসরণ করে রেজা খান আমিলদারী বন্দোবস্ত চালু করলেন। জমিদারেরা অত টাকা নিরুত্তরে সরবরাহ করতে অনিচ্ছুক দেখে তিনি জায়গায় জায়গায় আমিল পাঠাতে লাগলেন। এইসব আমিলরা মুর্শিদাবাদ দরবারে একটা থোক টাকা দিয়ে এক এক জমিদারীর খাজনা আদায়ের তাহুদ নিত, যে সবচেয়ে বেশি টাকা দিত তাকেই তাহুদ নিতে দেওয়া হত। তাহুদ মানে নিতান্ত সাময়িকভাবে, এক বছর বা তারও কম কোনো একটা কিস্তির জন্য খাজনার আদায়ের অঙ্গীকার করা। এই ব্যবস্থা জমিদার ও প্রজাদের সর্বনাশের সূচনা করল। আমিলদের কোনো স্থিতি ছিল না, তাই জমিদারীর রক্ষণাবেক্ষণেও তাদের কোনো স্বার্থ ছিল না। তারা মৌজায় মৌজায় তরফে তরফে ইজারাদার লাগিয়ে ফসলী সনের মধ্যে যা পারে তাই আদায় করে নেবার পূর্বনির্ধারিত সঙ্কল্প রেখে তাহুদ নিত। তাহুদ এমনি এমনি মেলে না, সে জন্য তাদের অনেক টাকা ঘুষ দিতে হত। দরবারের রেসিডেন্ট মিস্টার সাইক্স সেইসব লোককে মনোনীত করতেন যারা তাঁকে টাকা দিয়ে খুশি করত। আমিলদের নিষ্ঠুর পেষণে কি জমিদার কি রায়ত সবাই ত্রাহি ত্রাহি করতে লাগল।২৪ আমিলদের তদারক করবার ছলে মুর্শিদাবাদের রেসিডেন্ট মিস্টার সাইক্স ও তাঁর বেনিয়ান কান্তবাবু তেরো লক্ষ টাকার ‘সেলামী’ পকেটস্থ করলেন। নির্লজ্জভাবে সাইক্স এ কথাও জানালেন যে তাঁর তদারকিতে যা আদায় হচ্ছে মীরজাফরের আমলে তার অর্ধেকও হত না। এই বিষম অমঙ্গলজনক ব্যবস্থার কুফলগুলি দেওয়ানী লাভের পর দু বছর যেতে না যেতে এমনভাবে প্রকট হয়ে উঠল যে কোম্পানির বড়ো কর্তারা নিজেদের ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে তার ইঙ্গিত না দিয়ে পারলেন না। বারওয়েল সাহেব ১৭৬৭-র পয়লা জানুয়ারী লিখলেন :

‘The enhancing the revenue of the country which appears the great aim of Lord Clive will be found, I believe, in a year more the cause of its being diminished, for the country has been absolutely plundered by those who have been appointed to make the collections.’২৫ বস্তুতপক্ষে নবাব আলিবর্দি খানের আমলে মুর্শিদাবাদের খাজাঞ্চীখানায় দেশ থেকে যত টাকা আসত, রেজা খানের আমিলদারী বন্দোবস্তে তার চেয়ে ঢের বেশি টাকা আসতে লাগল।২৬

এই সময় রানী ভবানী তাঁর বারাণসী প্রত্যাগত বিধবা মেয়ে তারা এবং সদ্য সাবালক দত্তকপুত্র রাজা রামকৃষ্ণকে নিয়ে বড়নগরে ছিলেন। তাঁর দেওয়ান দয়ারাম রায়ও মুর্শিদাবাদ দরবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে রাজধানীতেই থাকতেন।২৭ কিন্তু যদিও দরবার থেকে দেওয়ান দয়ারামকে খেলাৎ দেওয়া হয়েছিল এবং পরে ঘটা করে তাঁকে ‘রাজা দয়ারাম রায় দেওয়ান-ই-রাজশাহী’ খেতাব দেওয়া হয়, তবু আমিলদারী বন্দোবস্তে জমিদারীর আসল কর্তৃত্ব অন্যত্র ন্যস্ত ছিল। মুর্শিদাবাদে নিম্নস্তরের সুযোগসন্ধানী স্বার্থানুসন্ধিৎসু এক একজন আমিল নাটোরের তাহুদ নিতেন। সেই রকম লোকের অধীনে ৩০ জন ইজারাদারের হাতে গোটা জমিদারীর খাজনা আদায়ের ভার তুলে দেওয়া হয়েছিল।২৮ অথাৎ জমিদারীর মফস্বল কর্মচারী, তহসিলদার ও নায়েবদের উপর সর্বময় কর্তৃত্ব করত আমিল ও ইজারাদার। কিন্তু খোদার উপরেও খোদকারী করার লোক ছিল। ইংরাজরা শুনল, আমিলরা জমিদারদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে কিছু সরকারে পাঠাচ্ছে ‘আর বাকিটা নিজেদের পকেটে পুরছে।’ তখন তাদের মনে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জাগল : ‘টাকাটা একজন কালা আদমির পকেটে যাবে না আমার নিজের পকেটে?’২৯ আমিল ও ইজারাদাররা যাতে ইংরাজদের ঠকাতে না পারে সেই জন্য কোম্পানি থেকে মুর্শিদাবাদের ইংরাজ রেসিডেন্টের অধীনে জেলায় জেলায় ইংরাজ সুপারভাইজর (supravisor) নিযুক্ত হলেন।৩০ ১১৭৬ সনে Boughton Rous নামে এক তরুণ সুপারভাইজর নাটোরে পৌঁছে সেখানকার সর্বময় কর্তা হয়ে বসলেন এবং খুঁটিনাটি সব ব্যাপারে তাঁর হস্তক্ষেপের ফলে রানী ভবানীর কর্তৃত্ব ও মহম্মদ রেজা খানের প্রভুত্ব সর্বপ্রকার সংকুচিত হয়ে পড়ল।৩১

রানীর প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে মন্বন্তরের পরের বছর থেকে কোম্পানির নির্দেশ অনুযায়ী মিস্টার রাউজ নিজেই জমিদারীর বন্দোবস্ত করলেন। তাঁর নানা কাজের বিরুদ্ধে রানী বার বার অভিযোগ করলেন, কিন্তু সে নিতান্ত বৃথা।৩২ ১৭৭৩-এ কোম্পানির নির্দেশে সুপারভাইজরদের ফিরিয়ে নেওয়ায় রাউজ নাটোর থেকে বিদায় হলেন বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে যে দুজন আমিল তাঁর আসার আগে নাটোর জমিদারী ছারখার করেছিলেন সেই কুখ্যাত প্রাণ বসু ও দুলাল রায় আবার সদর্পে ফিরে এলেন।

প্রাণ বসু অতি নীচ প্রকৃতির আমিল ছিলেন, দুলাল রায় তদধিক নীচাশয়। ইংরাজদের দেওয়ানী প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে মুর্শিদাবাদের বড়ো কর্তা হয়ে আসেন নতুন রেসিডেন্ট ফ্রান্সিস সাইক্স্ এবং নাটোরের আমিল নিযুক্ত হন তাঁর লোক প্রাণ বসু। এই লোকটি প্রভুর প্রসাদে রেজা খানের আপত্তি সত্ত্বেও রাজশাহীর তাহুদ হস্তগত করেন এরং তাঁর অত্যাচার ও শোষণে সেখানে এমন অবস্থা হয় যে সর্বনাশা সন ছিয়াত্তরের আগে থেকেই নাটোর রাজ্য উজাড় হয়ে যেতে শুরু করে। মন্বন্তরের বছর নাটোরে পৌঁছে রাউজ প্রথমেই লক্ষ্য করেন যে বিগত কয়েক বছর ধরে প্রাণ বসুর অত্যাচারে ভাতুড়িয়া পরগনায় বহু জমি পতিত হয়ে আগাছায় ভরে গেছে।৩৩ সেই প্রচণ্ড অত্যাচারের যুগেও প্রাণ বসুর মতো অত্যাচারীকে মুর্শিদাবাদ দরবারে অসহ্য ঠেকায় তাঁকে সরিয়ে নিয়ে আবার রানী ভবানীর উপর রাজ্যভার প্রত্যর্পণ করা হয়।৩৪ কিন্তু বেশি দিনের জন্য নয়। ছিয়াত্তর সনে মহম্মদ রেজা খান তাঁর নিজের লোক দুলাল রায়কে নাটোরের আমিল নিযুক্ত করেন। এই লোকটি রানী ভবানী ও মিস্টার রাউজের কাছে সমান রকম অসহ্য ছিল। মিস্টার রাউজের বর্ণনা অনুযায়ী সে ছিল ‘একটা নাচ, নিরক্ষর লোক,’—মহম্মদ রেজা খানের ‘বশংবদদের মধ্যে সবচেয়ে নীচাশয়।’৩৫ তার পিয়নরা ভাতুড়িয়া পরগনায় বহুদিন ধরে নিযুক্ত রানী ভবানীর পুরনো নায়েবকে ধরে নিয়ে গিয়ে মুর্শিদাবাদে কয়েদ করল। একজন নিম্নস্তরের আমলাকে দিয়ে সেই ছারখার পরগনার খাজনা আদায় শুরু হল।৩৬

অন্যান্য পরগনায় ঘন ঘন নায়েব বদল হল। সেইসব ক্ষণস্থায়ী আমলারা প্রত্যেকে জুলুম করে রায়তদের কাছ থেকে যা পারে লুটে নিল।৩৭ এতদিন যেসব পুরাতন জমিদারী কর্মচারী রানী ভবানীর রাজ্যের বিভিন্ন কাছারীতে নিযুক্ত ছিল, তাদের জোর করে সরিয়ে দেওয়ায় এমন কেউ রইল না যে রায়ত ও ইজারাদারদের মাঝে দাঁড়িয়ে প্রজাদের বাঁচায়। তখন রাজ্য জুড়ে প্রজাদের মধ্যে ভারি ক্রন্দনের রোল উঠল। উত্তরোত্তর খাজনা বৃদ্ধির জন্য প্রত্যেক প্রজা নতুন খাজনা আদায়কারীদের উপর অভিশাপ বর্ষণ করতে লাগল।৩৮

দুলাল রায়ের ইজারাদার ও তালুকদাররা ছিয়াত্তর সনে তিন বছরের ইজারা নিয়েছিল। পুরনো জমিদারী বন্দোবস্তে জমিদারের মফস্বল কর্মচারীরা খাজনা আদায় করে নাটোরের সদর কাছারীতে পাঠাত, সেখান থেকে মুর্শিদাবাদের দেওয়ানী খাজাঞ্চীখানায় রাজস্ব প্রেরণ করা হত। এই বন্দোবস্তে নাটোর জমিদারীর সদর কাছারীতে খাজনা সংগৃহীত না হয়ে আমিলের তত্ত্বাবধানে ইজারাদাররা সরাসরি মুর্শিদাবাদে খাজনা পাঠাতে লাগল।৩৯ অর্থাৎ খাজনা আদায় সংক্রান্ত সমস্ত কাজের সঙ্গে জমিদারের আর কোনো যোগ রইল না, এমন কি মফস্বল পরগনাগুলিতে কি আদায় হচ্ছে কি হিসাব চলছে সে খবর পর্যন্ত জমিদারের কাছে আসা বন্ধ হয়ে গেল।৪০

এই অবস্থায় নাটোরে পৌঁছে রাউজ দুলাল রায়ের কর্তৃত্ব ঘুচিয়ে দিলেন। তিনি নিজেও কিছু ধোয়া তুলসীপাতা নন। তাঁর মনেও কিছু প্রাপ্তির আশা জ্বলজ্বল করছে।৪১ নায়েব নাজিমের আমিল ও ইজারাদাররা যাতে পাই পয়সা সরাতে না পারে সে জন্যে সব হিসাবপত্র তলব করে প্রত্যেক কাগজে ও পর্চায় তাঁর সই লাগবে এই হুকুম দেওয়ায় তাঁর সঙ্গে মহম্মদ রেজা খানের লাঠালাঠি লেগে গেল। মাঝখান থেকে নিরুপায় রানী নিস্পন্দ হয়ে তাঁর প্রজাদের দুর্গতি দেখতে লাগলেন। এরই মধ্যে আরো একটি কারণে নাটোর রাজ্য উচ্ছন্নে যেতে বসেছিল। কয়েক বছর ধরে ইংরাজরা রাতারাতি নবাব বনবার ধান্দায় জোর করে পরগনায় পরগনায় একচেটিয়া কারবার ফাঁদছিল। সে এক সর্বগ্রাসী আয়োজন। শুধু নাটোর রাজ্য নয়, সারা সুবাহ্ জুড়ে দেশের স্বনির্ভর বাণিজ্যে ভাঙন ধরেছিল। চট্টগ্রাম, হুগলী, বালেশ্বরের বন্দর, বীরভূম, দিনাজপুর, কৃষ্ণনগর রাজ্য, রংপুর, সিলেট, পূর্ণিয়ার ফৌজদারী, ঢাকা ও পাটনার সুবৃহৎ নগরকেন্দ্র, দেশের কোটি কোটি প্রজার সংসার বিপর্যয়ের মুখে এগিয়ে যাচ্ছিল। ঐ একই কারণে মীরকাশিমের সঙ্গে ইংরাজদের লড়াই বাধে এবং লড়াইয়ে হেরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব দেশ থেকে বিতাড়িত হন। অন্যান্য জমিদারীর মতো নাটোর জমিদারীতেও যে উৎপাত শুরু হয়, তারও মূলে অবাধ শুল্কহীন বাণিজ্যের সর্বসংহারী বিস্তার।

অবাধ বাণিজ্য অথাৎ ইংরাজদের ভাষায় free trade কথাটা শুনতে ভালো। অতএব তার রহস্য আর একটু খুলে বলা দরকার। ইংরাজরা মীরকাশিমের সঙ্গে যে লড়াই বাধায়, তা যথাযথ ভাবে অবাধ বাণিজ্যের জন্যে লড়াই বললে সত্যের অপলাপ হবে। ইংরাজরা চাইছিল তাদের বাণিজ্য হবে অবাধ, কিন্তু দেশী সওদাগরদের বাণিজ্য থাকবে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। কান মলে নবাব মীরকাশিমকে দিয়ে এই দুমুখো নীতি প্রয়োগ করতে গিয়ে তারা দেখল, মীরজাফরের জামাই শ্বশুরের চেয়ে অনেক শক্ত লোক। নানান দিক থেকে রাজপুরুষ, ভূস্বামী ও প্রজাদের ত্রাহি ত্রাহি আবেদন শুনে নতুন নবাব তিষ্ঠোতে না পেরে ইংরাজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। রাজশাহীর বিস্তৃত জমিদারীর পূর্বপ্রান্তে ছিল বড়বাজু পরগনা, সেখানকার জমিদার সৈয়দ রজব আলি একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমান। তিনি নবাবের কাছে আর্জি পাঠালেন—

‘অনেক দিন আগে থেকে [অর্থাৎ পলাশীর যুদ্ধের আগে] বিলকুচিতে কোম্পানির কুঠি ছিল, সেখান থেকে কাপড়ের কারবার চলত। আমিও কুঠির গোমস্তাদের দাবি দাওয়া সাধ্যমতো পূরণ করতে কার্পণ্য করতাম না, কোনো বেইনসাফ জুলুমও ছিল না। ঐ কুঠিতে কোম্পানির আমদানী তামা, দস্তা ও তুলা নিয়ে যারা সওদা করত তারা স্বেচ্ছায় সে মাল নিয়ে বাজার দরে কেনাবেচা করত। এখন [অর্থাৎ পলাশীর যুদ্ধের ফলস্বরূপ ইংরাজদের বাণিজ্য ‘অবাধ’ হয়ে যাবার পর] কলকাতা, ঢাকা, চিলমারী, রাঙামাটি থেকে দলে দলে ইংরাজ, নানা সওদাগর আর মঁসিয় সেভালিয়ারের লোকেরা এই পরগনায় তামা, দস্তা, নুন, সুপারি, তামাক, চাল, মুগা ধুতি, সিরিঙ্গা নৌকা, গালা, লাক্ষা, আলকাতরা, শুঁটকি মাছ, ওগয়রহ আমদানী করছে এবং এই সমস্ত লোক কোম্পানির নাম করে যে সব রায়ত কখনো উপরোক্ত মাল নিয়ে কারবার করেনি তাদের দিয়ে জোর করে চড়া দামে কিনিয়ে সওদা করতে বাধ্য করছে। এ ছাড়া, তারা মারমুখো হয়ে মোটা টাকার নজর আর পিয়নদের খরচ আদায় করছে, আর কম দামে যা কিছু তেল কেনা দরকার তা জোরতলব ক্রয় করছে। এই সব জুলুমে পরগনার ব্যাপারী, পিয়ন, রায়তরা পালিয়ে গেছে, আর হাট, ঘাট, গোলা আর গঞ্জগুলি উজাড় হয়ে গেছে।’৪২

পাশের জমিদারী নাটোরে ঐ একই অত্যাচার চলছিল। মীরকাশিম রুখে দাঁড়ানো মাত্র দেওয়ান দয়ারাম রায় ইংরেজ কুঠির রেশম আটক করেছিলেন। একমাত্র রেশমের কারবার একচেটিয়া হলে তত ক্ষতি ছিল না, কিন্তু শুধু রেশম তো নয়। তেল, নুন, আদা, চিনি, সুপারি, তামাক, ঘি, মাছ, শুঁটকি মাছ, খড়, চট, বাঁশ, কাঠ, আফিম ইত্যাদিও ইংরাজদের কবলে চলে যাচ্ছিল। এ সব অনেক কিছুই দেশের অত্যাবশ্যক পণ্য যার উপর গরিবের জীবন নির্ভর করে। এমন কম দামি মাল নিয়ে ইংরাজরা আগে কখনো সওদা করত না। কিন্তু এখন তারা মওকা পেয়ে এই মালগুলি জোর করে একচেটিয়া করে নিতে লাগল। সবচেয়ে বিপদের কথা, তারা ধান চালের কারবারেও হস্তক্ষেপ করতে লাগল। মীরকাশিম দেখলেন, সারা সুবাহ্ জুড়ে চারশো-পাঁচশো নতুন কুঠি গজিয়ে উঠেছে। আর সেখানকার বাঙালি গোমস্তারা কোম্পানির দস্তক দেখিয়ে অবাধ বাণিজ্য চালাচ্ছে। অবাধ বাণিজ্য মানে, রায়ত ও ব্যাপারীদের পণ্যদ্রব্যগুলি সিকি ভাগ দাম দিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া। এবং জোর করে যে জিনিসের দাম এক টাকা তা রায়তদের পাঁচ টাকায় কিনতে বাধ্য করা।৪৩ নবাব মীরকাশিম আর সহ্য করতে না পেরে ঘোষণা করে দিলেন, এখন থেকে এই সুবাহ্য় আর কাউকে কোনো মাশুল দিতে হবে না। দেশী বিদেশী সব সওদাগর অবাধে বাণিজ্য করতে পারবে। কাউকে দস্তক দেখাতে হবে না।

কিন্তু দেশী বণিকরা স্বাধীন হয়ে গেলে ইংরাজদের একচেটিয়া ব্যবসা টিকবে কি কবে? তখন রে-রে করে পাটনা কুঠির একচেটিয়া ব্যবসাদার ও বড়ো সাহেব মিস্টার এলিস নবাবের ফৌজের উপর গিয়ে পড়লেন, লড়াই শুরু হয়ে গেল। ইংরাজরা মীরজাফরকে আবার মুর্শিদাবাদের মসনদে এনে বসাল। তার পরেও বোয়ালিয়া কুঠির আটক রেশম ছাড়িয়ে আনতে তাদের বিলক্ষণ বেগ পেতে হল। কিন্তু বিতাড়িত নবাব অযোধ্যা পালিয়ে যাবার পর ইংরাজদের যদৃচ্ছ কারবারে আর কোনো বাধা রইল না। ১৭৬৬ খ্রীস্টাব্দে তারা জমিদারদের বন্দুকধারী নগদী সৈন্যদের বরখাস্ত করে দিয়ে গ্রামাঞ্চলে সর্বেসর্বা হয়ে একচ্ছত্র বাণিজ্য বিস্তারে লেগে গেল। বোয়ালিয়া কুঠির সাহেব, গোমস্তা, দালাল ও পাইকাররা যে কাণ্ড শুরু করল তা আর বলবার নয়।৪৪ এবারে নবাব মীরজাফর পর্যন্ত অতিষ্ঠ হয়ে ইংরাজদের অনুনয় করে বলতে শুরু করলেন, ‘দেশের যে সব গরিব লোকেরা নুন, সুপারি, তামাক, ওগয়রহ নিয়ে হরদম কারবার করত ফিরিঙ্গিদের সওদার মুকাবিলায় তাদের মুখে রুটি জুটছে না’ আর ‘ইংরাজদের লোকেরা বাংলার গঞ্জে গোলায় সব জায়গাতে ধান আর অন্য অন্য খাদ্যশস্য বেচাকেনা শুরু করায় ফৌজদার ও অন্যান্য আমলারা ফৌজের দানাপানি সরবরাহ করতে পারছেন না।’৪৫

জায়গায় জায়গায় কুঠি বানিয়ে গোমস্তা লাগিয়ে কারবারের নামে যে জুলুম শুরু হল তার চোটে দেশের স্বাধীন সওদাগররা কচুকাটা হয়ে গেল। জগৎশেঠ, খোজা ওয়াজিদ ইত্যাদি বড়ো বড়ো শেঠ সওদাগরদের কারবার মড়মড় করে মাটিতে আছড়ে পড়ায় সেই বৃহৎ কাণ্ডগুলি অবলম্বন করে যে সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসার লতাপাতা বিস্তৃত হয়েছিল সেগুলিও লুটিয়ে পড়ল। দেশের স্বনির্ভর বাণিজ্যে আগাপাশতলা বিপর্যয়ের জের ধরে রূপি হুণ্ডির বাজারে অরাজকতা ঘটল। ফলে অসম্ভব মুদ্রাকষ্ট দেখা দিল। কি করে এই অবস্থার সৃষ্টি হল তা একটু বুঝিয়ে বলা দরকার। শাহ আলমের হাত থেকে ক্লাইভের দেওয়ানী প্রাপ্তির সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ইংরাজদের হাতে দেওয়ানী গিয়ে পড়ায় দেশ থেকে প্রতি বছর এত পরিমাণ ধন নিষ্কাশন হতে লাগল যে সুবাহ্ জান্নাত-উল-বিলাদ বাংলায় আর কোনো স্বাচ্ছন্দ্য রইল না। দেওয়ানী হাতে পড়া মানে সুবাহ্‌র খাজনা হাতে পড়া। খাজনার টাকায় এখন থেকে কোম্পানির ইনভেস্টমেন্টের সরবরাহ হতে লাগল। আগেকার কালে কোম্পানি দেশে রূপা আনত। সেই রূপা জগৎশেঠকে দিয়ে মুদ্রায় পরিণত করে তাই দিয়ে কোম্পানির রেশম, কাপড় ইত্যাদি রপ্তানী দ্রব্য (অর্থাৎ ইনভেস্টমেন্ট) কেনা হত। এখন আর তার দরকার রইল না। দেশের খাজনা দিয়ে দেশের জিনিস কিনে বাইরে পাঠানোর অভিনব প্রকরণ গড়ে উঠল।

পলাশীর যুদ্ধের পরে কোম্পানির হাতে যে টাকা আসে হিসেব করে দেখা গেল তা দিয়ে তিন বছরের ইনভেস্টমেন্ট অনায়াসে চলতে পারে। তখন থেকে ইংরাজ কোম্পানি এ দেশে রূপা আনা বন্ধ করে দিল। দেওয়ানী হাতে আসায় এই ব্যবস্থা পাকাপাকি হবার সম্ভাবনা সূচিত হল। তখন চীনের সঙ্গে ইংরাজ কোম্পানির বাণিজ্য শুরু হয়েছে। চীন থেকে ইংল্যান্ডে চা যেত। রূপা দিয়ে তার দাম দিতে হত। সে রূপা ইংরাজদের খরচের খাতায় উঠত। দেওয়ানী প্রাপ্তির পর খরচের বালাই ঘুচে গেল। বাংলার রাজস্ব হাতের মুঠোয় পেয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইংল্যান্ড, বাংলা ও চীনের মধ্যে এমন এক ত্রিভুজ গড়ে তুলল যাতে ইংরাজরা নিজের দেশ থেকে কিছু না পাঠিয়ে চীন থেকে চা আমদানী করতে পারে। প্রথম প্রথম বিজয়ী ইংরাজরা বাংলা থেকে চীনে রূপা পাঠিয়ে সেখানকার চা রেশম ইত্যাদি পণ্য যোগাড় করত। ইংরাজ গভর্নর ভেরেলস্ট্ সাহেবের হিসাব অনুযায়ী দেওয়ানী লাভের পরবর্তী পাঁচ বছর বাংলা থেকে ইংল্যান্ড ও চীনে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার রূপা শুধু কোম্পানির বাণিজ্যের খাতে নিষ্কাশিত হয়ে গিয়েছিল।৪৬ কিন্তু ক্রমাগত একটা দেশ থেকে রূপা বার করে নিলে এমন একটা সময় আসতে বাধ্য যখন সে দেশ থেকে নিয়ে যাবার জন্য আর কোনো চক্চকে বস্তু বাকি থাকে না। ক্রমে ক্রমে একটি তীর্যক ধন নিষ্কাশনের পদ্ধতি গড়ে ওঠায় সে সমস্যা পূরণ হল। এ দেশ থেকে কোম্পানির টাকায় (অর্থাৎ খাজনার টাকায়) চীন দেশে সুতি কাপড় এবং আফিম যেতে লাগল। ক্যান্টনে ক্রমর্বদ্ধমান পরিমাণে আফিম রপ্তানী করে তাই দিয়ে বিলেত, ইওরোপ ও সারা বিশ্বের জন্য বিপুল পরিমাণে চা কেনা হত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অদ্ভুত বৈষয়িক রসায়নে বাংলা বিহারের চাষীর রক্ত চীনেদের নিঃশ্বাসে আফিমের বিষ হয়ে ঢুকে শেষে ইংরাজদের চায়ের কাপে ধূমায়িত হতে লাগল। দেশ থেকে বিলেত সরাসরি টাকা নিয়ে গেলে ক্রমে ক্রমে দেশে আর কোনো টাকা থাকত না। তখন খাজনা আদায় বন্ধ হয়ে যেত। নতুন ব্যবস্থায় সে সম্ভাবনা রহিত হল।

ইংরাজ কোম্পানি তো আখের গুছিয়ে নিল। এখন অন্যান্য বিদেশী কোম্পানিগুলি কি করে? তারাও আগে ইংরাজদের মতো এ দেশে রূপা এনে জিনিস কিনে ইউরোপে রপ্তানী করত। সবচেয়ে বেশি রূপা আনত ওলন্দাজরা। পলাশীর যুদ্ধের পর কিছু দিন পর্যন্ত তারা গড়পড়তা প্রতি বছর ছত্রিশ থেকে চল্লিশ লক্ষ টাকার রূপা আনত। ইংরেজরাও কিছু দিন পর্যন্ত বারো থেকে চৌদ্দ লক্ষ টাকার রূপা এনেছিল। দিনেমার, আলিমান (অস্ট্রিয়ান) ও প্রাসিয়ানরা যা রূপা আমদানী করত তাও নেহাৎ মন্দ নয়। দেওয়ানী লাভের দু বছর পরে দেখা গেল রূপা আমদানী কমতে কমতে প্রায় শেষ হয়ে আসছে। শুধু ইংরাজ কোম্পানির খাতে নয় ওলন্দাজ ও অন্যান্য কোম্পানির খাতেও আর তেমন রূপা আসে না। এর গূঢ় কারণ ছিল। রাতারাতি ‘নবাব’ বনে গিয়ে ইংরাজ কোম্পানির ছোট বড়ো সাহেবরা দেখলেন, লুণ্ঠিত ধনরত্ন কোম্পানির ডিরেক্টরদের নজর এড়িয়ে বিলেত পাঠাবার কোনো সাদাসিধে উপায় নেই। তখন ঐ অসাধু উপায়ে অর্জিত বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি বিলেতে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিতে ওলন্দাজ দিনেমার ইত্যাদি কোম্পানিগুলি এগিয়ে এল। তারা আর দেশে রূপা না এনে, ইংরাজ কোম্পানির সাহেবদের কাছ থেকে টাকা ধার করে ইওরোপে রপ্তানীর জিনিসগুলি খরিদ করতে লাগল। টাকা ধার করার সময় অধমর্ণ ওলন্দাজ ও দিনেমার কুঠিয়ালরা উত্তমর্ণ ইংরাজ সাহেবদের হাতে এক ধরনের হুণ্ডি (bill of exchange) দিত যা অনায়াসে বিলেতে ভাঙিয়ে নেওয়া চলে। এইভাবে সঙ্গোপনে ইংরাজদের লুণ্ঠিত ধনরাশি ওলন্দাজ, দিনেমার কোম্পানির রপ্তানী বস্তুর আকারে নিষ্কাষিত হয়ে যাওয়ায় ওলন্দাজ দিনেমার সূত্রে রূপা আমদানি বন্ধ হয়ে গেল।

পলাশীর যুদ্ধের আগে লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগরের বন্দর থেকে প্রতি বছর আরমানী, পারস্য, তুরস্ক, আরব, গুজরাটি, হিন্দুস্তানী সওদাগররা জলপথে ১৮ থেকে ২০ লক্ষ টাকার মতন রূপা আমদানী করত। ইংরাজদের দেওয়ানী লাভের পর তা কমতে কমতে পাঁচ লক্ষ টাকায় গিয়ে দাঁড়াল। এর কারণ, হুগলী বন্দর থেকে শুরু হয়ে মোখা পর্যন্ত এক কালে যে স্বনির্ভর বাণিজ্য বিস্তৃত ছিল, তা জলে ডুবতে বসেছিল। আগে গুজরাটি বণিকরা সুরত বন্দর থেকে বাংলার তাঁতীদের জন্য প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ তুলা আনত। পরিবর্তে রেশম নিয়ে যেত। এখন কলকাতা কাউন্সিলের বড়ো সাহেবেরা জলপথে তুলা আমদানী একচেটিয়া করে নেওয়ায় দেশী বণিকদের উপার্জন বন্ধ হয়ে গেল। তুলার দাম চড়চড় করে ১৬ টাকা থেকে ২৮ টাকায় দাঁড়াল। তবুও মরিয়া দেশী বণিকরা স্থলপথে গঙ্গা যমুনা দিয়ে কাপাস আনবার ফাঁক খুঁজতে লাগল। তখন ইংরাজদের হুকুমে রেজা খান অনিচ্ছুকভাবে তার উপর শতকরা তিরিশ ভাগ মাশুল বসিয়ে সেই কারবার থামিয়ে দিলেন।৪৮

মহাবৎ জঙ্গের আমলে সুরত বন্দর, গুজরাট, হায়দরাবাদ, আগ্রা, লাহোর, মুলতান, ফার্‌রুকাবাদ থেকে হিন্দু মুসলমান সওদাগররা বাংলায় জড় হয়ে সত্তর লক্ষ টাকার মতো রূপা ও হুণ্ডি এনে কাপড় ও রেশম কিনে নিয়ে যেত। তাই দিয়ে রায়তের হাতে পয়সা আসত, দেশী সওদাগররা লাভবান হত, মুর্শিদাবাদের খাজাঞ্চীখানায় অনায়াসে খাজনা পৌঁছাত। মহম্মদ রেজা খান শঙ্কিত হয়ে দেখলেন তাঁর আমলে বড়ো বড়ো ধনপতি সওদাগররা অপসৃত হওয়ায় সত্তর লক্ষ টাকার জায়গায় সাত লক্ষ টাকার মালও কেউ কিনতে আসে না। ফলে বাজার থেকে হঠাৎ হঠাৎ এমনভাবে সব রূপা আর মুদ্রা উধাও হয়ে যায় যে খাজনা আদায় করতে গিয়ে রায়তের ঘর থেকে লুঠ করে আনা ছাড়া সরকারের গতি থাকে না। রূপার অভাবে সিক্কা রূপির বদলে বাজারে নানা নিকৃষ্ট সনওয়ত, আর্কট রূপি ছড়িয়ে পড়ে আর খাজনার উপর বাটা দিতে দিতে জমিদার রায়তের নাভিশ্বাস উঠতে থাকে। তখন মহম্মদ রেজা খানের বিলক্ষণ বোধ হল, ‘সওদা বিভাগের’ সঙ্গে ‘খাজনা বিভাগের’ সম্পর্ক কত নিবিড়। কিন্তু অধৈর্য ইংরাজদের সেটা বুঝিয়ে উঠতে পারলেন না।

শুধু তো বড়ো বড়ো সওদাগর নয় বড়ো বড়ো শেঠ সররাফরাও যে বিদায় নিতে শুরু করেছিলেন। দেশে রূপা আসবে কোথা থেকে? আগের কালে খাজনা আদায়ের সময় শেঠ সররাফদের কল্যাণে জমিদার আমিল ও রায়তদের এইভাবে মুদ্রাকষ্ট ও বাটা সমস্যা ভোগ করতে হত না। আমিল ও জমিদাররা শেঠদের সঙ্গে চুক্তি করে নানা মুদ্রায় খাজনা এনে দিতেন, আর শেঠরা নির্দিষ্ট হারে বাটা নিয়ে খাজাঞ্চীখানায় সিল্কা রূপি জমা করে দিতেন। খাজাঞ্চীখানার সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র ছিল শেঠদের ব্যবসায়িক প্রতিপত্তি ও সুনামের ভিত্তি, যার জোরে তাঁরা সর্বজনগ্রাহ্য হুণ্ডি লিখে দেশের লেনদেন ব্যবস্থা সচল রাখতেন। এইভাবে তাঁদের ব্যবসা গড়ে উঠেছিল এবং ঐ সুবিস্তৃত ব্যবসায়ের ভিত্তিতে তাঁরা আগ্রা, দিল্লী ও বানারস থেকে বিপুল পরিমাণ রৌপ্যমুদ্রা আমদানী করতেন। জগৎশেঠের হাত থেকে ক্লাইভ মুর্শিদাবাদের খাজাঞ্চীখানায় চাবি ছিনিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খাজনা আদায়ের ব্যাপারে শেঠ সর্‌রাফ্‌রা তাঁদের লাভজনক ভূমিকা থেকে বঞ্চিত হলেন। তাঁদের প্রতিপত্তি নষ্ট হওয়ায় লেনদেন ব্যবস্থা অচল হয়ে উঠল, দিন দিন দেশের সঞ্চিত রৌপ্যমুদ্রার পরিমাণ হ্রাস পেতে লাগল, খাজনা আদায় এক দুর্বিষহ অত্যাচারে পরিণত হল। ৪৯

মহম্মদ রেজা খান তাঁর প্রভুদের বুঝাবার চেষ্টা করতে লাগলেন, অবাধ বাণিজ্যের নামে গুমশ্তাহ্, দালাল, পাইকারদের মাধ্যমে সবকিছু জোর করে একচেটিয়া করে নেওয়া বন্ধ না করলে দেশে বাণিজ্যের প্রসার হবে না, রূপা আসবে না, খাজনা আদায় হবে না। সেই সঙ্গে একটা উত্তম তত্ত্বকথাও শুনিয়ে দিলেন : ‘খরিদ্দার ও বিক্রেতার পারস্পরিক মনতুষ্টির মধ্যেই ব্যবসা বাণিজ্যের সত্যিকারের প্রাণ নিহিত থাকে।’৫০ কিন্তু প্রবাদেই আছে, ‘চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী।’ এই সময় ইংরাজদের সবচেয়ে দামি রপ্তানীর মাল ছিল রেশমী সুতা। মুর্শিদাবাদ এবং নাটোর জমিদারীর বোয়ালিয়া কুঠিতে নকাদ নামক কারিগরদের বুড়া আঙুল দিয়ে এই সূক্ষ্ম সুতা বের করে আনা হত। মুর্শিদাবাদে রেসিডেন্ট হয়ে এসেই সাইক্স্ সাহেব সমস্ত দেশী ও আরমানী বণিকদের এমন কি অন্যান্য সাহেবদেরও হটিয়ে দিয়ে মুর্শিদাবাদ ও বোয়ালিয়ার রেশমের ব্যাপার নিজের কুক্ষিগত করে ফেললেন। সাইক্স্ সাহেব, তাঁর বেনিয়ান কান্তবাবু আর অন্যান্য সাঙ্গপাঙ্গরা এক বোয়ালিয়ার কুঠি থেকেই বছরে ষাট লক্ষ টাকার নজরানা আদায় করতেন।৫১ সাইক্সের কর্তা ভেরেলস্‌ট্‌ সাহেব মুর্শিদাবাদ ও বোয়ালিয়ার তদন্ত করে দেখলেন, কুঠির সাহেবরা কোম্পানির ও নিজের নিজের রেশমী কারবারের জন্য শুধু এক একটা গ্রাম দখল করেই নিরস্ত থাকেন না, তাঁরা এও স্থির করে দেন কোন্ কোন্ জায়গার বাইরে দেশী সওদাগররা রেশমী সুতা কিনতে পারবে না। আর নিজেদের নিজেদের এলাকায় তাঁদের গোমস্তা দালাল ও পাইকাররা তুঁত চাষী ও রেশমি সুতার করিগরদের উপর এমন জুলুম করে যা এ দেশে কেউ কখনো দেখেনি। ‘সরকারী আমলাদের উপর ভীষণ হুমকি দিয়ে হুকুম জারী করা হয়েছে যেন কোম্পানির নামে নিযুক্ত লোক ছাড়া কাউকে রেশম কিনতে না দেওয়া হয়। এই গোমস্তাগুলি সবার সম্পত্তি যথেচ্ছভাবে আটক করে চরম অত্যাচার শুরু করেছে, আর যদি বা কারো কিছু কোনোমতে তাদের হাত এড়িয়ে গেছে, সেইসব খেটে খাওয়া দুঃখী রায়তদের কপালে জুটেছে জরিমানা, কয়েদ আর দৈহিক সাজা। সেখানকার সন্ত্রস্ত জমিদার নিরুপায়ভাবে তাঁর জমি দিন দিন ছারখার হতে দেখেছেন আর পীড়িত প্রজাদের রক্ষা না করতে পেরে নীরবে তাদের দুর্ভাগ্য নিয়ে বিলাপ করছেন।’৫২

সে সময় সাহেব ও গোমস্তাদের অত্যাচার এমন চরমে উঠেছিল যে এও শোনা যাচ্ছিল যে তাদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য নকাদরা তাদের বুড়ো আঙুল পর্যন্ত কেটে ফেলছে। ৫৩ শুধু যদি রেশমি ফাঁস হত, তাহলে বোধহয় তুঁত চাষী ও নকাদ ছাড়া রানী ভবানীর অন্যান্য প্রজারা গলে বেরিয়ে যেত। কিন্তু সাহেবদের সওদা আর শুধু রেশম রপ্তানীতে আবদ্ধ দিল না। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রকগুলিও একে একে তাদের কুক্ষিগত হতে লাগল। অন্যান্য জমিদারীর মতো রাজশাহীতে ব্যবসার নামে সাত ভূতের নৃত্য শুরু হয়ে গিয়েছিল। দেওয়ানীর এক বছর যেতে না যেতে মহম্মদ রেজা খান নাটোরের জমিদার পরিবারের আবেদন নিবেদনে টিকতে না পেরে মরিয়া হয়ে ইংরাজ কাউন্সিলে আর্জি পাঠালেন:

‘রাজশাহী, রোকুনপুর ও সুবাহ্ বাংলার অন্যান্য জেলার জমিদারদের কাছ থেকে ফরিয়াদ আসছে যে ইংরাজ সাহেবদের বহুতর কুঠি পরগনা পরগনায় গজিয়ে উঠেছে আর সারা বাংলা সুবাহ্ জুড়ে তাঁদের গুমশ্তাহ্‌রা জায়গায় জায়গায় গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। এরা কাপড়, চুন, সর্ষের তেল, তামাক, হলদি, তেল, চাল, শণ, চট, গম ইত্যাদি হরকুছ দানাপানি আর মুল্কে পয়দা সব মাল নিয়ে কেনাবেচা শুরু করেছে। এই জিনিসগুলি রায়তদের কাছ থেকে খরিদ করার জন্য তারা জোর করে টাকা দেয়, আর এইভাবে কম দামে জুলুম করে কিনে তারা দোকানদার ও বাসিন্দাদের ঐ মাল বাজার দরের চেয়ে চড়া দামে খরিদ করতে বাধ্য করে। এরা সরকারের মাশুল তো দেয়ই না, তার উপর নানা জুলুমবাজি করে হাঙ্গামা বাধায়, যেমন, তালুকদার, রায়ত ইত্যাদি আসামীদের কাছ থেকে মালগুজারী আদায় করতে গেলেই ঐ গুমশ্তাহ্রা বকেয়া দেনা বা বাকি হিসাবের ফিকির তুলে তাদের যেতে দেয় না, তাদের খাজনা উশুল করতে দেয় না আর ঝুটা গোয়েন্দা আর বজ্জাত লোকেদের শিখানো ফরিয়াদে রায়তদের উপরে পেয়াদা বসিয়ে তাদের নানা ঝামেলায় জড়িয়ে ফেলে। জোর করে লোকেদের নিজের চাকরীতে ঢুকিয়ে এবং সুরকারী আমলা, স্থানীয় বাসিন্দা, ব্যাপারী ইত্যাদি লোকেদের উপর নানান হুকুম জারী করে তারা সবাইকে কাঙ্গাল করে দেয় আর গ্রাম গঞ্জ উজাড় করে ফেলে।

‘এই রকম জুলুমবাজি করে তারা দেশের লোকেদের কাঙ্গাল করে দেশ থেকে ভাগিয়ে দিয়েছে আর সরকারের খাজনার হানি ঘটিয়েছে। দেশে এখন আর দামি বলতে কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই।’৫৪

রেজা খানের ফরিয়াদ যে একটুও মিথ্যা নয় তা রাউজসাহেব নাটোরে পৌঁছেই বুঝলেন। তখন দুর্ভিক্ষের সব কটি লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে। তিনি ভূষণা থেকে তাঁর উপরওয়ালা রিচার্ড বীচারকে (সাইক্স্ সাহেবের পরবর্তী দরবার রেসিডেন্ট) লিখলেন : ‘এখানকার সব বাসিন্দাদের মধ্যে খাজনা আদায়কারীদের বিরুদ্ধে ভীষণ সোরগোল হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি—সবার এই ভয় যে খাজনা আরো বাড়ানো হবে। এই প্রদেশ থেকে আগেকার কালে যে সমৃদ্ধ বাণিজ্য চলত তা কৃষিকার্যের সঙ্কোচনের ফলে স্বভাবতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিন্তু এতে গোমস্তাদের কারচুপি আর পাইকার দালালদের মাঝখান থেকে দাঁও-এর ভূমিকা কিছুমাত্র কম নয়।’৫৫ তিনি জানালেন পাইকার দালাল গোমস্তাদের অত্যাচার নিবারণ করে কৃষক ও কারীগরদের হাতে তাদের পণ্যের উচিত মূল্য পৌছে দিতে না পারলে এখানকার গ্রামীণ শাসনব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত করা যাবে না।

কেউ যেন এ কথা মনে না করেন যে গ্রামীণ শাসনব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত করাই রাউজ সাহেবের এক এবং অদ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল। তাঁর হাতে ভয়ে ভয়ে রাজা রামকৃষ্ণের এক আমলা যে ফরিয়াদ ধরিয়ে দিয়েছিলেন তাতে দেখা যায় রানী ভবানীর সাবালক দত্তক পুত্র বলছেন : ‘খরা ও দুর্ভিক্ষের প্রকোপে এবং মফস্বলের কর্মচারীরা হস্ত-ও-বুদ (অথাৎ রাউজের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান) ও হাসিলের কাগজপত্র যোগান দিতে (রাউজের কাছে) আটকে পড়ায় রাজস্ব গ্রহণ বিঘ্নিত হচ্ছে…অতএব এই অধীন প্রার্থনা করেন যে…ইংরাজ সাহেব ও আমীনদের নাটোর থেকে ফিরিয়ে নেওয়া হোক যাতে আমার অধীনে এই জেলাগুলির কার্য পরিচালনা হয় এবং আমি কৃষিকার্যে রায়তদের এমন সহায়তা করতে পারি যে গত বছরের বকেয়া ও এ বছরের খাজনা আমার পক্ষে তাহুদ অনুযায়ী মিটানো সম্ভব হয়। আর এতে যদি মত না হয়, তবে বাংলা ১১৭৪ সনের খাজনা সংক্রান্ত কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখা হোক। লাভক্ষতি যা কিছু সরকারের উপর বর্তাবে—আমার শুধু এই প্রার্থনা যে প্রাণধারণের জন্য আমার কিছু উপায় করে দেওয়া হোক।’৫৬

রাজ। রামকৃষ্ণের আর্জি মঞ্জুর হল না। দুর্ভিক্ষের সময় রানী ভবানী ও তাঁর দত্তক পুত্র বড়নগরে রইলেন। নাটোরে সর্বেসর্বা হয়ে বসলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ সুপারভাইজর মিস্টার বোটন রাউজ। এই সুপারভাইজরদের কীর্তিকাহিনী দু বছর যেতে না যেতে জেলায় জেলায় রাষ্ট্র হয়ে গেল। ১৭৭২ খ্রীস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর হয়ে বাংলায় ফিরেই শুনলেন : ‘the trade in every district is engrossed by the supravisor, but more especially rice and the other necessaries of life।’৫৭ সুপারভাইজররা এমন কাণ্ড করলেন যে কলকাতার বড়ো সাহেবরা পর্যন্ত তাঁদের অনুমতি না নিয়ে কোনো জেলায় একটা কিছু কিনবার জন্যেও গোমস্তা পাঠাতে পারতেন না। সুপারভাইজররা অনুমতি দিতেন না এমন নয়, কিন্তু নিতান্ত অপ্রসন্নভাবে, যেন তাঁদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে এইভাবে। ৫৮

রাউজ সাহেব যখন নাটোরে পৌঁছালেন৫৯ তখন ১১৭৫ সনের পৌষ মাস চলছে। সাধারণত সে মাস রাশি রাশি ভারা ভারা আমন ধান কাটার মাস—চাষীদের সুখের সময়। কথায় আছে কারো সর্বনাশ কারো পৌষ মাস। কিন্তু এই প্রবাদ-কীর্তিত পৌষ মাসেও প্রজাদের কোনো সুখ নাই। একটু চোখ কান খোলা রাখলে তিনি তখনি তাদের সর্বনাশের চিহ্নগুলি চারদিকে ছড়িয়ে আছে দেখতে পেতেন। ফাল্গুন মাসে নাটোর থেকে আরো উত্তরে ভাতুড়িয়া পরগনা দিয়ে যেতে যেতে তিনি দেখলেন চারদিকে আগাছা আর জঙ্গল। জমির পর জমি অনাবাদে ‘পতিত’ বা ‘পলাতকা’ হয়ে আছে—তার কিছু প্রাণ বসুর আমলে উজাড় হয়েছে, আর কিছু জমির প্রজারা আরো সম্প্রতি ‘পলাতকা’ হয়েছে।৬০ মুর্শিদাবাদ দরবারে বীচার সাহেবের কাছে তিনি জানালেন রাজশাহীর সর্বত্র প্রজাদের অবস্থা আকালের প্রকোপে এমন শোচনীয় হয়ে পড়েছে যে কিছু না পেলে তারা চাষের যোগাড়যন্ত্র করে উঠতে পারবে না। বিশেষ করে ভাতুড়িয়া পরগনার রায়তদের অবস্থা সঙ্গিন।৬১ ফাল্গুন পেরিয়ে চৈত্র মাস পড়ল—এক ফোঁটা বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। কৃষকদের ঘরে গম যব ইত্যাদি চৈতালী ফসল যা উঠল তা গত বছরের বকেয়া খাজনা মিটাতেই বেরিয়ে গেল। তারপর বছর ঘুরে এল এক ভয়ঙ্কর বৈশাখ মাস। এগারশ ছিয়াত্তর সনের গ্রীষ্মকাল। রৌদ্রের সে কী উত্তাপ। ভাতুড়িয়া পরগনার দিক দিগন্ত যেন জ্বলতে লাগল। সারা পরগনা জুড়ে প্রাতঃস্মরণীয় স্বর্গীয়া রানী সর্বাণী গত শতকের শেষ দিকে বড়ো বড়ো দীঘি কাটিয়েছিলেন। পূণ্যশীলা রানী ভবানীও স্বামীর মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধ সংক্রান্ত ব্রত কর্মে সমস্ত রাজ্যের গ্রামে গ্রামে অগুনতি দীঘি ও পুষ্করিণী সৃজন করেন। লোকে সভয়ে দেখল সেইসব বড়ো বড়ো দীঘি আর পুষ্করিণীতে এক ফোঁটা জল নেই—তলায় মাটি দেখা যাচ্ছে। চরম গ্রীষ্মেও কেউ কখনো শোনেনি যে সেসব দীঘির জল কোনো কালে শুকিয়েছে। সে অঞ্চলের সবচেয়ে বুড়ো লোকেদেরও স্মরণে এল না যে বরেন্দ্রভূমিতে কখনো এমন খরা দেখা দিয়েছে। তখন লোকে পালাতে শুরু করল। যারা পালাল না তারা একে একে মরতে লাগল। প্রথমে ভাতুড়িয়ার গ্রামগুলি থেকে মৃত্যুর খবর আসতে লাগল। তারপর অন্যান্য অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ ও মড়ক লাগল। এতদিন মিথ্যে ভীতি দেখিয়ে কাজ নেই বলে রাউজ উপরওয়ালাকে কিছু লেখেননি। এবার তিনি আর থাকতে পারলেন না। দরবারে বীচার সাহেবকে লিখলেন—প্রায় গোটা ফসলটাই শুকিয়ে গেছে আর রক্ষা নেই। ৬২

বাংলা সাহিত্যে এই দুর্ভিক্ষের সবচেয়ে জীবন্ত বর্ণনা আছে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে। উইলিয়াম উইলসন হান্টারের ‘গ্রাম বাংলার ইতিকথা’ মিলিয়ে পড়লে দেখা যায় বঙ্কিমচন্দ্রের বর্ণনা হান্টারের দলিল নির্ভর সজীব বিবরণের স্বাধীন মর্মানুসরণ। অর্থাৎ উপন্যাস হলেও বঙ্কিমের বর্ণনার প্রত্যেক কথার দলিল-প্রমাণ আছে। ‘পদচিহ্ন’ গ্রাম কল্পিত হতে পারে, কিন্তু সে জায়গায় অনায়াসে নাটোর বা ভাতুড়িয়া বসানো চলে অথবা রংপুর, পূর্ণিয়া, মুর্শিদাবাদের যে কোন সত্যিকারের গ্রাম। হান্টার প্রদত্ত দলিল প্রমাণ সুদ্ধ কয়েকটি অতিরিক্ত তথ্য সমভিব্যাহারে বঙ্কিমচন্দ্রের বর্ণনা উদ্ধৃত করা যাক।

‘১১৭৬ সালে গ্রীষ্মকালে একদিন পদচিহ্ন [বা ভাতুড়িয়া] গ্রামে রৌদ্রের উত্তাপ বড়ো প্রবল। গ্রামখানি গৃহময়, কিন্তু লোক দেখি না। …রাজপথে লোক দেখি না, সরোবরে স্নাতক দেখি না। তলদেশ পর্যন্ত শুষ্ক, গৃহদ্বারে মনুষ্য দেখি না, বৃক্ষে পক্ষী দেখি না, গোচরণে গরু দেখি না, কেবল শ্মশানে শৃগাল, কুক্কুর। …

‘১১৭৪ সালে ফসল [পৌষ মাসের আমন ধান] ভালো হয় নাই, সুতরাং ১১৭৫ সালে চাল কিছু মহার্ঘ হইল৬৩—লোকের ক্লেশ হইল, [একটি সমসাময়িক চিঠিতে দেখি : দেশে সুকা হইয়া খরচপত্র ব্যামহ হইয়াছে তাহা দেখিতে পাইতেছি আমি এ দেশে চাকরি করিতে আসা কেবল নাচারিতে দিনপাত হয় না নানান রূপ দায়গ্রস্থ। ৬৪] কিন্তু রাজা রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়া লইল। ৬৫ ১১৭৫ সালে বর্ষাকালে বেশ বৃষ্টি হইল।৬৬ লোকে ভাবিল, দেবতা বুঝি কৃপা করিলেন [আউশ ধান ভালো হওয়ায় কোম্পানি মাদ্রাজে দু জাহাজ চাল পাঠানোর নির্দেশ দিলেন। কিন্তু বছরের প্রধান ফসল আমনের ক্ষতি লঘুতর আউসের দ্বারা পূরণ না হওয়ায় এক জাহাজের বেশি বোঝাই হল না। ৬৭] আনন্দে আবার রাখাল মাঠে গান গায়িল, কৃষক পত্নী আবার রূপার পৈঁচার জন্যে স্বামীর কাছে দৌরাত্ম্য আরম্ভ করিল। [ঐ কালে তীর্থভ্রমণে নির্গত ‘তীর্থমঙ্গল’ রচয়িতা বিজয়রাম সেন গঙ্গাবক্ষ হতে মুর্শিদাবাদ সমীপস্থ তারাগাণ্য গ্রাম স্বচক্ষে দেখে বর্ণনা দেন, ‘রানী ভবানীর দেশ সেইখানি গ্রাম। কাহারো শকতি নারে তাতে ধুমধাম॥৬৮] অকস্মাৎ আশ্বিন মাসে দেবতা বিমুখ হইলেন। আশ্বিন কার্তিকে বিন্দুমাত্র বৃষ্টি পড়িল না, মাঠে ধান্য সকল শুকাইয়া একেবারে খড় হইয়া গেল, যাহার দুই এক কাহন ফলিয়াছিল রাজপুরুষেরা তাহা সিপাহীদের জন্য কিনিয়া রাখিলেন। [সম্বৎসরের খোরাক আমন ধান অনাবৃষ্টিতে শুকিয়ে যাওয়ায় পৌষ মাসে চাষীদের ঘরে আর কিছুই উঠল না। সেকালে বাংলাদেশে তিনটি ফসল উঠত—ভাদ্র মাসের আউস বা ভাদোই ধান, পৌষ মাসের বৃহত্তর আমন ধান ও চৈত্র মাসের গম যব ভালো। আমন ধান জ্বলে যাবার পর বিষ্ণুপুর থেকে সেখানকার আমিল সংবাদ প্রেরণ করলেন—‘মাঠের ধান দেখে মনে হচ্ছে যেন শুকনো খড়ের ক্ষেত।’৬৯] লোকে আর খাইতে পাইল না। প্রথমে এক সন্ধ্যা উপবাস করিল, তারপর এক সন্ধ্যা আধপেটা করিয়া খাইতে লাগিল, তাহার পর দুই সন্ধ্যা উপবাস করিল। যে কিছু চৈত্র ফসল হইল, কাহারও মুখে কুলাইল না।৭০ [নাটোর থেকে রাউজ কর্তৃক প্রেরিত পূর্বোল্লিখিত সংবাদে দেখা যায় রায়তরা খাজনা দেবার জন্য চৈতালী ফসল বেচে দিতে বাধ্য হয়। ঢাকা সন্নিহিত পূর্বভাগে ফসল ভালো হলেও নাটোর-জমিদারীর অন্যত্র সুচিরস্থায়ী খরাতে ফসল জ্বলে গিয়েছিল]। কিন্তু মহম্মদ রেখা খাঁ রাজস্ব আদায়ের কর্তা, মনে করিল, আমি এই সময়ে সরফরাজ হইব। একেবারে শতকরা দশ টাকা রাজস্ব বাড়াইয়া দিল। ৭১ বাঙ্গালায় বড়ো কান্নার কোলাহল পড়িয়া গেল।

‘লোকে প্রথমে ভিক্ষা করিতে আরম্ভ করিল, তারপরে কে ভিক্ষা দেয়!—উপবাস করিতে আরম্ভ করিল। তারপরে রোগাক্রান্ত হইতে লাগিল। গোরু বেচিল, লাঙ্গল জোয়াল বেচিল, বীজধান খাইয়া ফেলিল, ঘরবাড়ি বেচিল। জোতজমা বেচিল। তারপর মেয়ে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর ছেলে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর স্ত্রী বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর মেয়ে, ছেলে, স্ত্রী কে কিনে? খরিদ্দার নাই, সকলেই বেচিতে চায়। খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল ; ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল। ইতর ও বন্যেরা কুক্কুর, ইন্দুর, বিড়াল খাইতে লাগিল। অনেকে পলাইল, যাহারা পালাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া, রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল।৭২

‘রোগ সময় পাইল—জ্বর ওলাউঠা, ক্ষয়, বসন্ত। বিশেষত বসন্তের প্রাদুর্ভাব হইল। গৃহে গৃহে বসন্তে মরিতে লাগিল। কে কাহাকে জল দেয় কে কাহাকে স্পর্শ করে। কেহ কাহার চিকিৎসা করে না; কেহ কাহাকে দেখে না; মরিলে কেহ ফেলে না। অতি রমণীয় বপু অট্টালিকার মধ্যে আপনা আপনি পচে। যে গৃহে একবার বসন্ত প্রবেশ করে, যে গৃহবাসীরা রোগী ফেলিবার ভয়ে পালায়।’৭৩ [শহরে রোগ দ্রুত ব্যাপ্ত হয়। অতএব রাজধানী মুর্শিদাবাদে মড়ক ভয়াবহ হল। গঙ্গাপথে রোগ অনায়াসে ব্যাপ্ত হয়ে ১১৭৭ সনের বর্ষাকালে বারাণসী শহরে দেখা দিল। কবি বিজয়রাম সেনের তীর্থযাত্রীদলের নেতা খিদিরপুর নিবাসী কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষাল পার্শ্বস্থ কবিরাজকে সমস্ত যাত্রীদলের হয়ে অনুনয় বিনয় করতে লাগলেন: ‘সবাকার হৈতে লাগিল মসূরিকা রোগ। দেখি কর্ত্তা দেশে জাইতে করিলা উদ্যোগ॥ সুস্থ হয়্যা বিশারদে কহিলা ডাকিয়া। তোমারে করিব তুষ্ট খিদিরপুর গিয়া॥ মোর খরচ যত টাকা তত তোমার বড়ী। যাত্রীস্থানে কবিরাজ না লইবা কড়ি॥’৭৪]

বঙ্কিমচন্দ্রের বর্ণনা যে কোথাও সমসাময়িক তথ্য থেকে একটুও সরে যায়নি তা যে দলিলগুলি হান্টার মারফৎ পরোক্ষভাবে তাঁর বিবরণের মালমশলা জুগিয়েছিল তা পাঠ করলেই বোঝা যায়। বিশেষ করে পূর্ণিয়ার আমিলের বিবরণ। সৈয়দ মহম্মদ আলি খান বাংলার নায়েব নাজিম মহম্মদ রেজা খানের ভ্রাতা। ১১৭৭ সনের সেই ভয়ঙ্কর সেই ভয়ঙ্কর বৈশাখ মাসে তিনি পূর্ণিয়া থেকে বীচার সাহেবকে লিখলেন :

‘গরিব লোকের খোয়ার আর ভাষায় বর্ণনা করবার নয়—এমন একদিন যায় না যে দিন তিরিশ চল্লিশটা লোক মরে না। এই মরশুমের খরায় এমন খোয়ার পয়দা হয়েছে যে শয়ে শয়ে লোক ভুখায় মরেছে আর মরছে। রিয়াসতের বরকৎ বিধায় বীজধান বাঁচাবার জন্য আমি তজবীজের কামাই করছি না। কিন্তু বারিষের অভাবে নানা গাঁয়ের রি’আইয়া৭৫ বীজধান বেচে দিতে বাধ্য হয়েছে, তারপর বাঁচবার তাগিদে গরু বাছুর থালা বাটি বেচেছে, এমন কি নিজেদের ছেলেমেয়ে বিক্রি করতে চাইছে কিন্তু খরিদ্দার নেই।’

‘রি’আইয়া আসামিয়ানের এমন দশা যে গত কয়েক সনের আকাল আর এবারকার ফসল হানির চোটে তারা খাজনা দেওয়ার টাকাটা আলাদা রেখে মুখ থুবড়ে দানাপানি ছাড়া মারা যাচ্ছে। আর কোথাও কখনো এমন হালত হয়নি।’৭৬

যে অস্বাভাবিক খরায় গত বছরের (৭৬ সনে) আমন ধান ও চৈতালী ফসল পর পর জ্বলে গিয়েছিল, নতুন বছর (৭৭ সন) কোনো বৃষ্টি না পড়ায় তা আরো ভয়ঙ্কর হল। বৈশাখ গড়িয়ে জ্যৈষ্ঠ মাসে তাপমাত্রা চড়চড় করে বাড়তে লাগল। সারা বাংলা বিহার জুড়ে সে বছর যে অস্বাভাবিক এবং অননুভূতপূর্ব গরম পড়েছিল৭৭ তাতে অকস্মাৎ অগ্নিকাণ্ড হতে লাগল আর জলাশয়গুলি সর্বত্র শুকিয়ে যেতে লাগল। রাজধানী মুর্শিদাবাদেই বহু বাড়ি পুড়ে গেল।৭৮ আর থাকতে না পেরে মহম্মদ রেজা খান নতুন গভর্নর কার্টিয়ার সাহেবকে লিখলেন : এত দিন তিনি যেমনভাবে পারেন খাজনা আদায় করেছেন আর নিজামতের অন্যান্য কাজ চালিয়ে এসেছেন। ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো গাফিলতি করেননি। কিন্তু বিধির লিখন কে খণ্ডাবে। এই খরায় ও আকালে লোকের যে দুর্দশা হয়েছে তিনি কেমন করে তার বয়ান দেবেন ভেবে পাচ্ছেন না। এত দিন খাদ্যশস্য দুর্লভ ছিল, এখন আর পাওয়াই যাচ্ছে না। তালাও আর নালাগুলি শুকিয়ে গেছে। পানি মিলছে না। এসব দুর্ঘটনার উপরে সারা দেশ জুড়ে ভয়ানক অগ্নিকাণ্ড হচ্ছে। বহু লোক পুড়ে মরছে। বহু পরিবারের খোরাক নষ্ট হয়েছে। রায়গঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ, আর পূর্ণিয়া, দিনাজপুর-এর গঞ্জগুলিতে যেসব ছোট ছোট ধানের গোলা টিকে ছিল তাও পুড়ে খাক হয়ে গেছে। এতদিন হাজার হাজার লোকের মরার খবর আসছিল, এবার লাখ লাখ লোক মরছে। আশা ছিল বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে দু-এক পশলা বৃষ্টি হবে, যাতে গরিব রায়তরা অন্তত জমিতে চাষ দিতে পারে কিন্তু এখন পর্যন্ত এক ফোঁটা জল পড়েনি। এই মরশুমে যে মোটা দানাপানি ওঠে তা নষ্ট হয়ে গেছে। ভাদোই ধানের বীজ বৈশাখ মাসে পোঁতা হয়, বারিষের অভাবে তার কিছুই হয়নি। অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষ যদি দেশের এক জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকত, তবে হয়ত কোনো উপায় করা যেত। কিন্তু সারা দেশ জুড়ে যখন আকাল পড়েছে তখন খোদা হাফিজই একমাত্র বাঁচাতে পারেন। ৭৯

গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষা নামল। চালের দাম আরো চড়তে লাগল। খণ্ডঘোষ গ্রামের এক অখ্যাত লিপিকার নন্দদুলাল রায় জ্যৈষ্ঠ মাসে চণ্ডীমঙ্গল পুঁথি লেখা শেষ করে ভাদ্র মাসে তার পুষ্পিকায় একটু সমসাময়িক খবর লিপিবদ্ধ করে রাখলেন। সেই খবর অনুযায়ী ১১৭৫ সনে চালের দাম বেড়ে টাকায় বারো সের হয়েছিল। ১১৭৭ সালের শ্রাবণ মাসে তা দাঁড়াল টাকার চার সের। সেই সময় থেকেই লোকের মুখে মুখে ‘মন্বন্তর’ কথাটি ব্যবহৃত হতে লাগল। নন্দদুলাল রায়ের পুষ্পিকায় দেখি : ইতি লিখিতং শ্রীনন্দদুলাল রায় দেববর্ম্মণ : সন ১১৭৭ সালের ২৭ জ্যৈষ্ঠ বৃহস্পতিবারে অষ্টাঙ্গ পুস্তক সমাপ্ত হইল। নিজ বাটীতে নিজ ঘরে দক্ষিণ দুয়ারির ঘরে পিড়াতে বস্যা লিখা হইল॥ ০ ॥ শ্রীশ্রী মঙ্গলচণ্ডীকায়ৈ নমঃ—শ্রীশ্রীজয়দুর্গায়ৈ নমঃ—শ্রীশ্রী গুরূবে নমঃ সাং খণ্ডঘোষ॥ সন ১১৭৫ সাল মহামন্বন্তর হইল অনাবৃষ্টী হইল সস্বি [শস্য] হইল না কেবল দক্ষিণ তরফ হইয়াছিল আর কোথাও কোথাও জলাভূমে হইল টাকায় ১২ বার সের চালু। ৯১০ সাড়ে ছয় পোণ চালু সের হইল তৈল আড়াই সের লবণ ১ এ [ক] সের কলাই ১১ এগার সের তরিতরকারি নাস্তী [নাস্তি] সাক [শাক] নাস্তী কিছুমাত্রেক নাস্তী এই কথা সৰ্ত্ত [সত্তর] বৎসরের মনিস্বী [মনুষ্য] বলেন আমরা কখন এমন ষুনি [শুনি] নাই ইহাতে কত কত মনিস্বী মরিল বড় বড় লোকের হাড়ী চাপে নাই বাং সন ১১৭৭ সালের মাহ [মাস] ভাদ্রতক মহাপ্রলয় হইল এই সন রহিল আর কীবা হয় [অর্থাৎ এ রূপে বৎসর গেল আবার কি হয় কে জানে]—১৮২ এক সও বিয়াসি পাতে ৪৩০ চারি সও তিরিস নেচাড়ো সমাপ্ত হইল—শ্রাবণ মাসে টাকায় ৪ চারি সের চালু হইল অনেক মন্বিষী নষ্ট হই মহামন্বন্তর—’৮০

১১৭৭ সনের বর্ষায় ভালো বৃষ্টি হল। লোকের মনে আশা জাগল ভাদ্র মাসে আউস ধান ভালো হবে। কিন্তু যাদের জোতজমা গোলাবাড়ি নেই তারা ততদিন বাঁচবে কি করে? আষাঢ় ঘনিয়ে আসার অব্যবহিত আগেই রিচার্ড বীচার মুর্শিদাবাদ থেকে এক ভয়ঙ্কর সংবাদ পাঠালেন: ‘এ একেবারে নিশ্চিত যে অনেক জায়গায় জীবিতেরা মৃতদের ভক্ষণ করেছে।’৮১ বীচারের আশ্রিত একজন তরুণ ইংরাজ চার্লস গ্রান্ট পরে এ কথাও বলেছিলেন: ‘এমন অনেকে ছিল যারা নিষিদ্ধ ও ঘৃণ্য পশুমাংস ভক্ষণ করত। শুধু তাই নয়, শিশু মৃত বাপ মাকে খেত, মা মরা শিশুকে খেত।’৮২ আষাঢ় মাসের অবিরল বর্ষণে মৃতদেহগুলি পচে ওঠায় মহামারী শুরু হল। রাজধানীতে তখনকার অবস্থা জানা যায় বীচারের প্রেরিত সংবাদে: ‘মৃতদেহে অবরুদ্ধ রাস্তাঘাট পরিষ্কারের জন্যে একশ লোককে নিয়মিত নিযুক্ত করা হয়েছিল। মৃতদেহগুলিকে নদীতে ভেলায় ভাসিয়ে দিয়ে পরে তারা নিজেরাও মরেছে। এই সময় শিয়াল কুকুর ও শকুনিরাই ছিল রাস্তা পরিষ্কারক। পূতিগন্ধময় বাতাস ও আর্তস্বর এড়িয়ে চলাফেরা ছিল অসম্ভব।’৮৩

শুধু রাজধানীতে নয়, কলকাতাতেও দলে দলে বুভুক্ষু নিরাশ্রয় লোক এসে পড়ায় ঐ এক দশা হল। পঞ্চাশ বছর পরে যে-সব বৃদ্ধ তাঁদের যৌবনের ঘটনাবলী সেই দুর্ভিক্ষের বছর দ্বারা নিরূপণ করতেন, তাঁদের স্মৃতিপটে কলকাতার দৃশ্য কোনো অংশে কম ভয়ানক ছিল না: ‘সন ১৭৭০ সালে বাংলা দেশে এইরূপ অতি ঘোর দুর্ভিক্ষ হইয়াছিল, তৎকালে নবাগত অন্য ২ ভাগ্যবান লোকেরা দরিদ্র লোকেদের মধ্যে অনেক তণ্ডুল দান করিয়াছিলেন, কিন্তু শেষে তাহাদের ভাণ্ডার শূন্য হওয়াতে দান নিবৃত্ত হইল, ইহাতে অনেক দুঃখিত লোক জীবনোপায় প্রত্যাশাতে তৎকালীন ইংলণ্ডীয়েরদের প্রধান বসতি স্থান কলিকাতায় আইল, কিন্তু তখন কোম্পানির ভাণ্ডারে দ্রব্যাভাব প্রযুক্ত তাহাদের কোনো উপায় হইল না। ইহাতে সে দুর্ভিক্ষারম্ভের সপ্তাহ পরে সহস্র ২ লোক রাজপথে ও মাঠে স্থানে ২ পড়িয়া মরিল এবং কুক্কুর ও শকুনি দ্বারা ঐ সকল মৃত শরীর ছিন্নভিন্ন হওয়াতে বায়ু অনিষ্টকারী হইল, তাহাতে সকলের ভয় জন্মিল, যে এই দুর্ভিক্ষের পশ্চাৎ মহামারী আসিতেছে, কোম্পানির প্রেরিত এক শত লোক নিযুক্ত হইল, তাহারা ডুলি ও ঝোড়া দ্বারা ঐ সকল মৃত শরীর নদীতে ফেলিত, তৎ প্রযুক্ত নদীর জল এমত শবেতে পূরিত হইল যে তাহার মৎস্য অখাদ্য হইল এবং অনেক মৎস্যভোজী তৎক্ষণাৎ মরিল।’৮৪

গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, গ্রামাঞ্চল থেকে মুর্শিদাবাদে এবং অবশেষে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় যে সব গৃহহারা পথবাসী একাকী বা দলবদ্ধভাবে ইতস্তত বিচরণ করছিল, বর্ষা ঋতুতে তাদের দুর্দশা চরম সীমা পেরিয়ে গেল। ভাদ্র মাসের শেষ সপ্তাহে কলকাতা থেকে ইংরাজ কাউনসিল লন্ডনের জাহাজে রিপোর্ট পাঠালেন: ‘It is scarcely possible that any description could be an exaggeration.’৮৫ তখন বৃষ্টিতে পুষ্ট আউস ধান কাটা হচ্ছে। এই সময় যেসব রোগগ্রস্ত বুভুক্ষু পথবাসী কাতারে কাতারে মরল, আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত কোনোমতে টিকে থাকলে তারা হয়তো রক্ষা পেত। সে সব বর্ষণতাড়িত পলাতকেরা যে গাঁয়ের মোড়ল নয় বা জোতজমা লাঙ্গল গরু সম্পন্ন চাষী নয়, পরন্তু কাজের ও খাবারের সন্ধানে নিষ্ক্রান্ত মুনিষ মজুর কৃষাণ শ্রেণীর হতভাগা, আষাঢ় মাসের এক লেখায় তার ইঙ্গিত আছে। অর্ধ শিক্ষিত গ্রাম্য লিপিকরের দুর্বোধ্য পুষ্পিকা:

ষুক [শুখা, শুকননা] বছর দেবতা বরিসিল [বরিষিল] না[।] য়তএব পুতি [পুঁথি] লিখিলাম [।] কোনো কম্ম নাই। আর গ্রামের লোক গৈতনপুর জাইতে লাগিল [।] য়তএব চেলে [টাকায় চাল] ভাই চব্বিস সের হইল [।] তাই মেলে নাই [।] আর গ্রামের য়দ্যেখান [অর্ধেক] লোকের অন্য [অন্ন] জোটে নাই [।] আর গ্রামের [গেরস্ত] লোক [বহিরাগত কর্মান্বেষীদের সম্বন্ধে] বলে [এরা] বেলঙেক৮৬ লোক [।] এ লোক রাখা হবে না [।] জদি রাখা জায় তবে আপনাদের জদি চাকর ছাড়িএ রাখা জায়। তবে ঐ লোক মাহ [মাস্] কাত্তিক মাসে জদি [দেবতা প্রসাদে] জল হৈলে ঐ লোক বলিবে কি আমাদের দেশে জল হয়্যাছে। বাড়ি যাই চল রে [।] কম্ম বসাইতে হবে [।] য়তএব রাখে না [।] আর জে গ্রামের ধম্মকম্ম নাই। [।] আর গ্রামে মনুষ্য নাই [।] আর গ্রামে মণ্ডল খোসামুদে হয় [।] আর বোঙাঞি গ্রামে য়নেক কুড়খেক [খুদকুড়া ভক্ষণকারী, অর্থাৎ নিরবশেষকর] মণ্ডল আছে [।] ইতি ১৬ আসার [আষাঢ়]। দেখ ভাই খপরদার আয়ছে [।] তৈসিলদার [তহসিলদার] তারাচাঁদ আর তালুক [দার] নারায়ণ পোদাররে [।] আর কি কহিব [।] পউস [পৌষ] মাসে লাগ্য জোরে [পৌষ মাসে জোরে কাজে লাগা ছাড়া গতি নেই]

পউস মাসে নাগলি চাটুজ্য ফজ্জদার গোমস্তা [ফৌজদারের গোমস্তা নাগলি চাটুজ্য] আর গোমস্তা রূপন নেউকি [নিয়োগী] জোরে নাই রে নাই [ফৌজদারী গোমস্তারা পৌষ মাসে সজোরে খাজনা তহসিল করতে এসে কিছু বাকি রাখবে না?] মাণিক মওলের নাগীল [নাগাইল, নাগাল] সুয়া [সুয়ো, স্বামী সোহাগিনী] এত খানেই।’

দুর্বোধ্য লেখা। এখনকার ভাষায় রূপান্তর করলে এর মর্ম বোধহয় এই দাঁড়ায়: সুখা বছরে কোনো বৃষ্টি না হওয়ায় গরিব লিপিকর পুঁথি লিখে দিনাতিপাত করল। দেবতা বিমুখ বলে বৃষ্টি পড়েনি। গাঁয়ে কোনো কাজ নেই যে লোকে খেটে খাবে। তাই গাঁয়ের গরিব লোকরা গৈতনপুর যেতে লাগল। কারণ চালের দাম চড়চড় করে টাকায় চব্বিশ সের দাঁড়িয়েছে। তাই মেলে না। গ্রামের অর্ধেক লোকের কোনো অন্ন নাই। এ দিকে দুর্ভিক্ষে যেসব জায়গায় অবস্থা আরো সঙ্গিন হয়েছে সেখানকার লোক কাজের ধান্দায় এখানে এসে হাজির হল। গ্রামের যারা অপেক্ষাকৃত সঙ্গতিপন্ন গেরস্ত তারা ভিন্ গাঁয়ের লোকেদের কাজে বহাল করতে রাজি হল না। তারা বলে—এরা কোদালিয়া মজুর। এদের রাখতে গেলে ঘরের মাহিন্দরকে৮৭ ছাড়তে হয়। তারপর যদি হঠাৎ কার্তিক মাসে বৃষ্টি পড়ে তবে ঐ লোক বলবে, ‘আমাদের দেশে জল হয়েছে। বাড়ি যাই চলরে। ক্ষেতে কাজ বসাতে হবে।’ তাই বাইরের মুনিষরা এখানে এসে কাজ পায় না। গাঁয়ে আর কোনো ধর্মকর্ম নেই। লোকজন এদিক ওদিক চলে যাওয়ায় গাঁ উজাড়। গাঁয়ের যে মোড়ল, সে খোসামুদে লোক,—খাজনা আদায় করে কর্তৃপক্ষকে খুশি রাখতে চায়। গাঁয়ে গাঁয়ে এরকম অনেক মণ্ডল আছে যাদের দৌরাত্ম্যে লোকের খুদকুঁড়ো জোটে না। আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি গাঁয়ের এই দশা—গরিব লোকের যেটা সবচেয়ে কষ্টের সময়। এরই মধ্যে খবরদারি করতে এসে হাজির হয়েছে জমিদারের তহসিলদার তারাচাঁদ আর অধীনস্থ তালুকদার নারায়ণ পোদার। আর কি বলার আছে—পৌষ মাসে আমন ধানের জন্য জোরে লাগা ছাড়া গতি নেই। আবার ঠিক তখনি ফৌজদারের গোমস্তা নাগলি চাটুজ্যে আর এ অঞ্চলের গোমস্তা রূপণ নিয়োগী এসে জোর করে খাজনা আদায় করে কিছু বাকি রাখবে না। কারণ এইখানেই তাদের নাগালধরা সুয়ো সোহাগিনী মাণিক মণ্ডল গাঁয়ের মোড়ল হয়ে বসে আছে।

অনাগত পৌষ মাস সম্বন্ধে লিপিকরের যে আশঙ্কা ছিল তা সৌভাগ্যক্রমে ফলল না। ভাদ্র মাসে বৃষ্টি থামাবার পর আউস ধান ভালোই উঠল। দুর্ভিক্ষের বেগ মন্দীভূত হয়ে এল। পৌষ মাসে আমন ধান এত ভালো হল যে অবশেষে কলকাতার কাউন্সিল লন্ডনে কোর্ট অফ ডিরেক্টর্সকে জানালেন দুর্ভিক্ষ মিটে গেছে।৮৮ ১৭৭১ খ্রীস্টাব্দে ঠিক উল্টো দশা হল। বন্যায় নাটোর জমিদারীর নানা জায়গা ভেসে যাওয়াতে ফসলের ক্ষতি হল। তা সত্ত্বেও ধান এত অপর্যাপ্ত উঠল যে সারা জমিদারী জুড়ে চালের দাম কমতে লাগল। শেষে এমন অবস্থা দাঁড়াল যে রায়তরা আর ফসল বেচে খাজনা আদায়ের টাকা যোগাড় করতে পারে না। তখন বহু রায়ত, ইজারাদার আর তালুকদার পলাতক হল। বোটন রাউজের প্রচণ্ড শাসনেও যোল হাজার টাকা খাজনা বকেয়া পড়ল।৮৯

কিন্তু তারই মধ্যে অন্য উপসর্গ দেখা দিয়েছে। ১১৭৭ সনে ধান যা রোপণ করা হয়েছিল তা বহু লোকের মৃত্যু সত্ত্বেও উত্তমরূপে ফলন হওয়ায় রাজস্বের খুব ক্ষতি হয়নি। মৃত বা পলাতকদের খাজনা জীবিত আসামীদের উপর চাপিয়ে প্রায় সবটাই উশুল করা হয়েছিল। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে দুর্ভিক্ষের সুদূরপ্রসারী অনিষ্ট লক্ষণগুলি প্রকাশ পেল। রাজ্যে প্রজাসংখ্যা কমে যেতে লাগল। শিশুদের মৃত্যু সবচেয়ে ব্যাপক হওয়ায় আগামী কালের পুরুষেরা আর আগের পুরুষের স্থান পূরণ করতে পারে না। জায়গায় জায়গায় জঙ্গল গজাল। যত ডাকাত সেখানে গিয়ে জুটল। আর বাইরে থেকে এল লড়াকু সন্ন্যাসী আর ফকিরের দল। নাটোরের আশপাশ জনশূন্য। বোটন রাউজ দেখলেন পাশেই লালোর গ্রামে যেখানে আগে ১২৩৭ ঘরের বসতি ছিল সেখানে দুর্ভিক্ষ ও বন্যার পর বসতির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১২ ঘর।৯০ পলাতক প্রজারা জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে সেখান থেকে ডাকাতি আরম্ভ করেছে আর ফলে গ্রামকে গ্রাম হঠাৎ রাত্রিবেলা আগুনে ভস্মীভূত হচ্ছে (‘frequent firing of villages by the people, whose distress drives them to such acts of despair and villainy’)। তদন্ত করে দেখা গেল পাঁচ গাঁয়ের মধ্যে যাদের সবচেয়ে সুনাম ছিল এমন অনেক রায়তও ‘মুখে ভাত যোগাড়ের ধান্দায় এই চরম উপায় অবলম্বন করেছে।’৯১

১৭৬৭ থেকে ১৭৭০ পর্যন্ত বজ্রমুষ্টিতে নাটোর রাজ্য থেকে গড়পড়তা বার্ষিক ২৭ লক্ষ টাকা আদায় করা হয়েছিল। ১৭৭০ থেকে ১৭৭২-এ জমিদারী জনশূন্য হয়ে যাওয়ায় বছরে ২১২/৩ লক্ষ টাকার বেশি আদায় করা গেল না।৯২ তখন নতুন গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসে ভাবলেন, সুপারভাইজররা যদি জেলায় জেলায় অব্যাহতভাবে ধানচাল নিয়ে কারবার চালাতে থাকেন তাহলে আবার কখন কি ঘটে। সুপারভাইজরদের জরুরী তলব করে ফিরিয়ে আনা হল। ১৭৭২ খ্রীস্টাব্দের শেষ দিকে বোটন রাউজ যখন বিদায় নিলেন, তখন নাটোর রাজ্য শ্মশানে পরিণত হয়েছে। সেই ভয়ঙ্কর কালের স্মৃতি তখনকার দিনের এক পদ্যে নিম্নরূপ ছন্দোবদ্ধ হয়ে আছে:

নদনদী খালবিল সব শুকাইল।

অন্নাভাবে লোকসব যমালয়ে গেল॥

দেশের সমস্ত চাল কিনিয়া বাজারে।

দেশ ছারখার হল রেজা খাঁর তরে॥

এক চেটে ব্যবসা দাম খরতর।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর হল ভয়ঙ্কর॥

পতিপত্নী পুত্ৰ ছাড়ে পেটের লাগিয়ে।

মরে লোক, অনাহারে অখাদ্য খাইয়ে॥৯৩

দেশের রাজা রেজা খাঁ, লোকে তো তাঁকে দোষ দেবেই। কিন্তু রাজার রাজা ইংরাজ, তাকে ধরে কে? দুর্ভিক্ষের প্রারম্ভে মুর্শিদাবাদ ও পাটনার দুই নায়েব নাজিম মহম্মদ রেজা খান ও মহারাজ সিতাব রায় মিলিতভাবে প্রস্তাব তুলেছিলেন, ‘এ বছরের খাদ্যশস্যের তিন ভাগের এক ভাগ ও চিনি আফিম ইত্যাদি অন্যান্য উৎপন্নের সিকি ভাগ রায়তের মূলধন ও জীবনধারণের উপায় হিসাবে মকুব করা হোক, বাকিটুকু আমিলরা সরকারের তরফ থেকে সংগ্রহ করে বাজারে বেচতে পারেন।’৯৪ কিন্তু এ বছরের খাজনা মকুব করা দূরে থাক, ইংরাজরা আগামী বছরের খাজনা বাড়িয়ে দিল। রেজা খাঁর আশপাশে নন্দকুমার সুযোগের সন্ধানে ঘুর ঘুর করছিলেন আর জাল করে রেজা খাঁকে ফাঁদে ফেলে মন্ত্রী হবার তালে ছিলেন। রেজা খাঁ বুঝলেন গদি রাখবার একমাত্র উপায় কড়ায় গণ্ডায় খাজনা আদায় করে ইংরাজদের তুষ্ট রাখা। এই প্রচেষ্টায় তিনি সফল হলেন (‘your servant with a view to company’s prosperity …notwithstanding the draughts which have prevailed has by exerting his utmost abilities collected the revenue of 1776 as close as so dreadfull a season would admit’)। দরবারের রেসিডেন্ট বীচার এ ব্যাপারে প্রথমত নিজের পিঠ চাপড়ে নিয়ে তারপর তাঁর দেশীয় সহযোগীকে সার্টিফিকেট দিলেন: ‘…no endeavours were wanting on my part, nor as far as I am able to judge on the part of the nabob M. R, Khan, to realize as large a revenue as under such circumstances…could be effected’।৯৫

দুর্ভিক্ষের গোড়ায় রেজা খান প্রজাদের জন্যে আর এক রকম প্রতিকার সাধনের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। মীরকাশিম, মীরজাফরের আমল থেকেই ইংরাজরা গোমস্তা লাগিয়ে ধানচালের কারবারে ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু ধানচালের চেয়ে অনেক বেশি মুনাফা হত নুন, সুপারি ও তামাকের কারবারে, যার জন্য বড় সাহেবরা একটা একচেটিয়া সোসাইটি গড়ে নিয়েছিলেন। ১৭৬৮ খ্রীস্টাব্দে কোম্পানি ডিরেক্টরদের কড়া নির্দেশে ঐ সোসাইটি তুলে দিতে হয়। তখন থেকে বড়ো সাহেবেরা আর একটা লাভজনক পণ্যের সন্ধানে ছিলেন। ১৭৬৯-এ ধানের দাম চড়ে যাওয়ায় জোর করে বারিসিক্ত অঞ্চলে কম দামে চাল কিনে খরাপীড়িত অঞ্চলে চড়া দামে বিক্রী করার সুবর্ণ সুযোগ এল।৯৬ সে সুযোগ নবাবী রাজপুরুষ ও কোম্পানির বড়ো সাহেব কেউ ছাড়লেন না। উত্তরবঙ্গের কুখ্যাত ইজারাদার দেবী সিংহ দুর্ভিক্ষের গোড়াতে টাকায় দু মণ চাল কিনে মজুত করে পরে তা টাকায় তিন চার সের দরে বিক্রী করতে লাগলেন। আর রংপুরের ইংরাজ সেনাপতি ডেভিড ম্যাকেঞ্জী নিজ অঞ্চলে দেশী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাল কিনে তাঁর গোমস্তা মারফৎ মুর্শিদাবাদে বেচে দিয়ে শতকরা পঁচিশ টাকা মুনাফা পেলেন।৯৭ রাজ্যের ভার রেজা খানের উপর। তিনি এই প্রাণঘাতী পদ্ধতির বিরুদ্ধে আপত্তি না জানিয়ে পারলেন না। ১৭৭০-এর ১৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতার কাউন্সিলে বীচারের মারফৎ রেজা খানের চিঠিতে অভিযোগ এল যে ‘ইংরাজদের গুমশ্তাহ্রা চাল একচেটিয়া করছে।’ বীচারের নিজের ধানচালের কারবার ছিল কিন্তু মুর্শিদাবাদের অবস্থা দেখে তিনিও না বলে পারলেন না: ‘আগামী আগস্ট মাসের ফসল ওঠা না পর্যন্ত ইউরোপীয় সাহেব বা তাঁদের গোমস্তাদের চাল কেনা বন্ধ করা উচিত।’৯৮

ইংরাজ কাউন্সিল এ প্রস্তাবে রাজি হলেন না। ঢাকার সুপারভাইজর মিস্টার কেলসল তীব্র আপত্তি জানিয়ে যুক্তি দিলেন, দেশের সর্বত্র যেখানে দুর্ভিক্ষ সেখানে এক জায়গায় চালের কারবার আটকে কি হবে? এখানে উল্লেখ করা দরকার যে ঢাকা অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ না থাকায় সেখান থেকে কম দামে চাল কিনে দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে চড়া দামে বেচার বিপুল ব্যবসা চলছিল।৯৯ রেজা খান বা রিচার্ড বীচার ঐরকম কারবার চালাচ্ছেন এমন কোনো বিশেষ ইংরাজ মহাশয়ের নাম করলেন না। এটা খুবই অর্থবহ যে কারা এই কারবার চালাচ্ছে তা নিয়ে কোনো অনুসন্ধান হল না। লন্ডনে বসে কোর্ট অফ ডিরেক্টর্স বুঝলেন: ‘they could be no other than persons of some rank in our service’। ১০০ তখনকার কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে খোদ মুর্শিদাবাদে ইংরাজরা জোর করে টাকায় তিন থেকে সাড়ে তিন মণ চাল কিনে তা আবার সেখানকার ব্যাপারীদের কাছে টাকায় ১৫ সের দরে বিক্রি করেছিল। ১০১ ওয়ারেন হেস্টিংসে গভর্নর হয়ে এসে লন্ডন থেকে নির্দেশ পেয়েছিলেন, চাল যারা সস্তা অঞ্চল থেকে কিনে খরা অঞ্চলে চড়া দামে বিক্রী করছে, তদন্ত করে তাদের সাজা দিতে হবে। আশ্চর্যের কথা, হেস্টিংস তদন্ত করলেন সেই বরখাস্ত নায়েব নাজিমের বিরুদ্ধে যিনি কালোবাজারী ইংরাজদের বিরুদ্ধে মৃদুস্বরে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তদন্তে প্রমাণ হল, রেজা খান নিজে কালোবাজারী করেননি, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও প্রতিপন্ন করা হল যে কোনো ইংরাজ রাজপুরুষ অমন কুকার্য করেননি। ওয়ারেন হেস্টিংস বুদ্ধিমান লোক। তিনি ব্যাপারটা পুরো আঁচ করে নিয়েছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত গোপন চিঠিতে দেখা যায়—‘এই সরকারের যেসব পদস্থ রাজপুরুষরা নুন, সুপারি, তামাক ও চালের ব্যবসায়ে লিপ্ত তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত করাটাও আমার অন্যান্য করণীয় কাজের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া উচিত ছিল…কিন্তু জোর করে সেটা প্রয়োগ করতে গেলে আমার নিজের কিছু জোর থাকবে না—কারণ তাহলে আমায় প্রত্যেকের বিরুদ্ধে হাত তুলতে হবে আর প্রত্যেকে আমার বিরুদ্ধে হাত তুলবে।’১০২ বাংলা প্রবাদ জানলে হেস্টিংস আর একটু সংক্ষেপে বলতে পারতেন ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়।’ ঠগেদের আদমসুমারী হলে হেস্টিংস নিজেও তা থেকে বাদ পড়তেন না। সে রহস্য শনৈঃ শনৈঃ প্রকাশ হবে।

কিন্তু দেশী বিদেশী সকলেই সমান নন। বাংলাদেশের সেই মহা বিপর্যয় কালে এ দেশে এমন একজন মহানুভব ইংরাজ ছিলেন না যিনি দয়াপরবশ হয়ে বুভুক্ষু ও পীড়িতদের দলকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবেন। কিন্তু নবাবী রাজপুরুষদের মধ্যে অনেকে অকাতরে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের রক্ষা কার্যে স্বীয় সম্পত্তি থেকে দান করেছিলেন এ কথা সরকারী নথিপত্রে লিপিবদ্ধ আছে। মহম্মদ রেজা খানের যত বদনাম থাকুক, তিনি যে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের অনেক সাহায্য করেছিলেন সে সব নথিতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু আর্তের পরিত্রাতা রূপে বাঙালি জাতি যে দুজনকে মনে রেখেছে তাঁদের নাম সরকারী নথিপত্রে নেই এবং তাঁরা কেউ রাজপুরুষ নন। একজন দানবীর তীর্থ পর্যটক পরদুঃখকাতর আজীবন ব্রহ্মচারী হাজি মহম্মদ মহসিন, অপর জন সাক্ষাৎ অন্নদারূপিণী পুন্যশ্লোকা বিধবা রানী ভবানী। করম আলি লিখিত রেজা খানের জীবনী ‘মুজাফ্ফর নামায়’ দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সাহায্যকারীদের মধ্যে হাজি মহম্মদ মহসিনের নাম আছে।১০৩ কিন্তু কোনো সমসাময়িক কাগজে রানী ভবানীর নাম নেই, তাঁর অন্নদারূপিণী মূর্তি শুধু বাঙালির হৃদয়ে জেগে আছে। ‘তীর্থমঙ্গলে’ এইটুকু শুধু পাই যে সেই মহা দুর্দিনেও কাশীতে তাঁর দানাদি পুণ্যকর্ম অব্যাহত ছিল:

জত বড়ো লোক আসি কাশীর ভিতরে।
ভবানীর সম কীর্তি কেহ নাহি করে॥
রানী ভবানীর যশঃ না যায় কথন।
কত স্থানে কত ছত্র কত বিতরণ॥
প্রস্তরের বাটী কতো রচন করিয়া।
বৎসরের খরচ দিয়া দিলা বিলাইয়া॥
সদাব্রত স্থানে স্থানে কত দেবালয়।
যেবা যাহা চাহে তাহা ততক্ষণে পায়॥
স্থাপনা করিলা কালী তথা তথা মহারাণী।
নিত্য পূজার ঘটা কত কি কহিব বাণী॥
কেহ পায় চালু ডালি কেহ ভাত খায়।
রানী ভবানী পুণ্যশ্লোকা সবর্ব লোকে গায়॥১০৪

দুর্ভিক্ষ কালে রানী বড়নগরে ছিলেন আগে বলা হয়েছে, কিন্তু কবি বড়নগরে উপস্থিত হয়ে সেখানকার কোনো বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে যাননি। কাশীর দানাদি বর্ণিত বস্তুর কাল ১১৭৭ সনের বর্ষাঋতু। এটি লক্ষণীয় যে রানীর জীবৎকালেই তিনি সর্বলোক মধ্যে ‘পুণ্যশ্লোকা’ নামে পরিচিত ছিলেন, এবং তাঁর ‘যেবা যাহা চাহে তাহা ততক্ষণে পায়’ এইরূপ খ্যাতি জীবদ্দশায় জন্মেছিল। বিশেষভাবে মন্বন্তর বৎসরে তাঁর সেই খ্যাতি বারাণসী পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল। কাশীতে বসে যখন ‘কেহ পায় চালু ডালি কেহ ভাত খায়’ তখন বড়নগরে কি ঘটছে জানতে হলে পরবর্তী কালের স্মৃতিকথা মন্থন করা ছাড়া উপায় নেই। হিন্দু কলেজের যুগে বসে নীলমণি বসাক তাঁর যে প্রথম জীবনী লিপিবদ্ধ করে গেছেন, তাতে দেখি রানী ভবানী সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার জন্য আটজন বৈদ্যকে বেতন দিয়ে রেখেছিলেন, তাঁদের দায়িত্ব ছিল বড়নগরের আশেপাশের গ্রামে বিনামূল্যে চিকিৎসা করা। ১০৫ তখন বসন্ত রোগ দেখা দিয়েছে। দুর্গাদাস, লাহিড়ী-কৃত উপন্যাসে দৃষ্ট হয়, সেই মহামারীর সময় ঐ রাজবৈদ্যরা গ্রামে গিয়ে পীড়ার চিকিৎসা করতেন। রানী তাঁর কর্মচারীদের প্রত্যেক গ্রামে বা দু তিনখানা গ্রামে এক একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকে চিকিৎসা ও অন্ন দানের বন্দোবস্ত করতে হুকুম দেন। তাঁর নির্দেশ ছিল—কেউ অন্নাভাবে বা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে একথা যেন তাঁকে না শুনতে হয়। ‘কিন্তু দেবতা বিরূপ! মানুষের চেষ্টায় কি হইতে পারে? মহারানীর প্রাণপাত সাহায্য, মরুভূমে বারিবিন্দুর ন্যায়, কোথায় শুকাইয়া গেল।’১০৬

নাটোর রাজ্য তখন ঘোর অরাজক। রানী পুত্রসহ বড়নগরে। নাটোরে রাউজ সাহেব ‘সন্ন্যাসীদের’ ভয়ে পরিখাবৃত রাজবাটীর অন্তরালে থরহরি কল্প। ১০৭ ঐ দুর্ভিক্ষের বছর থেকেই তাদের গতিবিধি বিশেষ করে ইংরাজ সরকারের গোচরে এল। সন্ত্রস্ত বাঙালি প্রজাদের মুখে নাম শুনে রাউজ যাদের ‘সন্ন্যাসী’ নামে অভিহিত করেন তারা আসলে উত্তর ভারত থেকে আগত দুটি আলাদা আলাদা দল। এক দল মাদারীপন্থী ফকির। তারা কানপুর জেলার মাকওয়ানপুর গ্রামে অবস্থিত শাহ মাদারের দরগা থেকে প্রতি বছর শীতকালে বগুড়া জেলার মহাস্থানগড় দরগায় আসত। এদের গায়ে ছাই, গলায় শিকল, হাতে কালো ঝাণ্ডা। মাথায় কালো পাগড়ী, সামনে অশ্বপৃষ্ঠে আসীন দলনেতা মজনু শাহ। আর একদল হিন্দুস্থানের দশনামী নাগাদের গিরি সম্প্রদায়ভুক্ত গোঁসাই। তারা শঙ্করাচার্যের অনুশাসন অনুযায়ী সর্বদা সশস্ত্র এবং কালের প্রভাবে যুদ্ধ ব্যবসায়, মহাজনী কারবার ও রেশমাদির বাণিজ্যকর্মে লিপ্ত। এরাও ফকিরদের মতো পূর্ণিয়ার পথে বাংলায় প্রবেশ করে রংপুর, দিনাজপুর, নাটোর হয়ে মহাস্থানগড়ে স্নান করতে আসত। বাদশাহী হুকুম অনুযায়ী ফকিররা অনেক আগে থেকেই তীর্থপথে প্রজাদের ঘর থেকে ও জমিদারদের কাছারী থেকে সাহায্য আদায় করত, আর বেশ কিছুদিন ধরে গোঁসাইরাও বরেন্দ্রভূমির রায়ত ও জমিদার উভয়কে ঋণের জালে আবদ্ধ করে ফেলে সুদ টানতে শুরু করেছিল। ইদানীং টাকা আদায়ের ব্যাপারে ফকির ও গোঁসাইরা দলবদ্ধ হয়ে জবরদস্তী শুরু করায় খাজনা হাসিলে বিঘ্ন উৎপাদন হচ্ছে দেখে ইংরাজ কাউন্সিল থেকে সুপারইভারদের কাছে এদের গতিপথ রোধ করার হুকুম গিয়েছিল। সেই থেকে সন্ন্যাসীদের সঙ্গে ইংরাজদের বিরোধ বাঁধল।

১৭৭১ খ্রীস্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি কোম্পানির সেপাইদের দ্বারা সহসা আক্রান্ত হয়ে শাহ মজনু রণে ভঙ্গ দিয়ে অশ্বপৃষ্ঠে পলায়ন করলেন। প্রজারা বাঁশ ও লাঠি নিয়ে পলায়মান ফকিরদের পিছনে পিছনে তাড়া করে কয়েকজনকে মেরে ফেলল।১০৮ পরের বছর (১৭৭২) ইংরাজদের উপর প্রতিশোধ নিতে শাহ মজনু প্রায় হাজার অনুচর নিয়ে সদলবলে নাটোরে উদয় হলেন। ফকিরদের হাতে বন্দুক সঙ্গে দুটো ভারবাহী উট আর প্রধান প্রধান সহচরদের জন্য কয়েকটা টাট্টু ঘোড়া। শাহ মজনুর ঘোড়াটা তেজীয়ান। রানী ভবানীর নামে ফকির সাহেব নিম্নরূপ পত্র দিলেন :

‘অনেক দিন আগে থেকে আমরা বাংলায় ভিক্ষা বৃত্তি অবলম্বন করে আসছি। আজ নয় বহু দিন হল আমরা কারো উপর কোনো জুলুম না করে শুধু দরগায় দরগায় আল্লাহ্‌র নামে দোয়া দিই। অথচ গত বছর বিনা কারণে ১৫০ জন ফকিরকে মেরে ফেলা হল। তারা নানা দেশে ভিক্ষা করে বেড়াত। তাদের সঙ্গে খাবারদাবার কাপড়চোপড় যা ছিল তাও খোয়া গেল। অবলম্বনহীন গরিবদের খুন করে যে পুণ্য অর্জন হয় আর যে প্রসিদ্ধি লাভ হয় তা আর খুলে বলবার দরকার করে না। আগে ফকিররা আলাদা আলাদা ছোট ছোট দলে ভিক্ষা করত। কিন্তু এখন আমরা সবাই একত্র হয়ে একসঙ্গে ভিক্ষা করি। তাতে নারাজ হয়ে তারা [ইংরাজরা] আমাদের দরগা ও অন্যান্য জায়গায় যাবার পথে বাধা দিচ্ছে—এ বড়ো অন্যায়। আপনি দেশের মালিকানা। আমরা ফকির, সদাই আপনার মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করি। আপনার উপর আমাদের অনেক আশা ভরসা।’১০৯

শাহ মজনু সম্ভবত শুনেছিলেন রানীর সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক সুমধুর নয়। দেওয়ানী লাভের পর বৎসর থেকেই কোম্পানি রানীর উপর খড়্গহস্ত হয়েছিল। নাটোর ইত্যাদি পরগনায় একচেটিয়াভাবে সুপারি কিনবার জন্য যেসব গোমস্তা পাঠানো হয়েছিল, তাদের অগ্রাহ্য করে রানী ভবানী সব ব্যাপারীদের নিরপেক্ষভাবে সুপারি কিনতে দেন। এতে গভর্নর ভেরেলস্ট ক্রুদ্ধ হয়ে রেজা খানকে রানীর বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। ১১০ কিন্তু রানীর চরিত্র সম্যকভাবে অবগত থাকলে ফকির সাহেব কখনোই আশা করতেন না যে এই কঠোর ব্রতচারিণী হিন্দু বিধবা রাজদ্রোহে যোগ দেবেন। বস্তুত পক্ষে সশস্ত্র ফকির বাহিনীর সঙ্গে নাটোর রাজ্যের স্বার্থের সংঘাত প্রথম থেকেই প্রকট হয়ে উঠল। ফকিররা এসেই রাউজ সাহেবকে অবজ্ঞা করে কাছারীর পর কাছারী লুঠ করতে লেগে গেল। নূরনগর গ্রাম দেওয়ান দয়ারাম রায়ের সম্পত্তি। সেখানকার কাছারী থেকে ৫০০ টাকা লুঠ হল। জয়সিন্ কাছারীর কর্মচারীরা ফকিরদের আসতে দেখে পালাল। সেখান থেকে ১৬৯০ টাকা লুঠ হল। সরকারী কাছারী লুঠ করলেও প্রজাদের উপর যাতে অত্যাচার না হয় সে জন্য মজনু শাহ চেষ্টা করলেন। মন্বন্তরের শেষে উৎসন্ন প্রজারা ফকির দলে যোগ দেবে এই রকম আশা ছিল। রাউজ সাহেব শুনলেন, মজনু শাহ নাকি হুকুম দিয়েছেন কারো কাছ থেকে জোর করে কিছু না নিয়ে খয়রাতি হিসেবে লোকে যা নিজে থেকে দেয় শুধু তাই গ্রহণ করা হবে। পূর্ণিয়া থেকেও একই রকম খবর এল। সেখানেও নাকি ফকিররা যাদের কিছু নেই তাদের উপর জুলুম না করে যেসব সম্পন্ন রায়তরা খয়রাতি করতে অনিচ্ছুক তাদের অতিরিক্ত ধনের বোঝা লাঘব করে এসেছে। পূর্ণিয়া, নাটোর হয়ে ফকির দল দিনাজপুরে চড়াও হল। সেখানকার রাজা সভয়ে খবর দিলেন ‘রায়তরা সব ভয়ে থরহরি কম্প আর কর্মচারীরা কেউ গাঁয়ে থাকতে রাজি নয়।’ দ্রুত বেগে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় হাজির হয়ে মহাস্থানগড়ে জিয়ারত সেরে সে বছরের মতো মজনু শাহ বিদায় হলেন।১১১

পরের বছর মজনুশাহ এলেন না, হাজির হল গোঁসাইরা।১১২ তাদের উপর গুলি বৃষ্টি করতে করতে তাড়া করে রংপুরের জঙ্গলে ঢুকতেই ক্যাপ্টেন টমাসের বন্দুকের টোটা ফুরিয়ে গেল। সন্ন্যাসীরা ঘাসের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। তারা বেরিয়ে এসে ক্যাপ্টেন টমাসের দলকে ঘিরে ফেলল। ক্যাপ্টেন টমাসের মাথায় গুলি লাগল। তাতেও তাঁর প্রাণ গেল না। গোঁসাইরা তলোয়ারের কোপে তাঁকে শেষ করে ফেলল। সেপাইরা পালাতে লাগল। গাঁয়ের লোকরা লাঠি হাতে ঘাস জঙ্গলের মধ্যে লুকানো সেপাইদের টেনে বের করতে লাগল। যেসব সেপাই গাঁয়ে ঢুকবার চেষ্টা করছিল রায়তরা সিঙা ফুঁকে সন্ন্যাসীদের ডেকে এনে তাদের ধরিয়ে দিল। সেপাইদের বন্দুকগুলি উধাও হল। সরকারের হুকুমে এবার ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড্স্ লড়তে এলেন। তিনিও গোঁসাইদের হাতে নিহত হওয়ায় সারা সুবাহ্ জুড়ে ভয়ানক তোলাপাড়া হতে লাগল। পরের বছর ফকির দল নিয়ে এলেন স্বয়ং মজনু শাহ। এবার তাঁর সঙ্গে গোঁসাইরা। প্রত্যেক বছর তাঁর আবির্ভাব হতে লাগল। তাঁর গতিবিধি বিদ্যুতের মতো ক্ষিপ্র। কোম্পানির সৈন্যদল অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে ধরতে পারল না। ফকিররা এমন সাহসী হয়ে উঠল যে ১৭৭৫ খ্রীস্টাব্দে মজনু শাহ আর মাকওয়ানপুর ফিরে না গিয়ে মহাস্থানগড়েই কেল্লা বানিয়ে বর্ষা কাটালেন। তখন আর তাঁর দলে শুধু ‘গেঁয়ো বাংলা আমজনতা’ (‘Bengal rabble’) নয়, অনেকগুলি ‘সশস্ত্র রাজপুত’ও যোগ দিয়েছে।১১৩ মজনু শাহ মাকওয়ানপুরে ১৭৮৭ খ্রীস্টাব্দে মারা গেলেন। উৎপীড়িত বরেন্দ্রভূমির জমিদাররা তাতেও রক্ষা পেলেন না। পরের বছর তাঁর দলবল নিয়ে হাজির হলেন তাঁর ভাইপো মুসা শাহ। রানী ভবানীর বরকন্দাজরা বন্দুক নিয়ে কাছারী লুঠেরা ফকিরদের বাধা দিল। কিন্তু অশ্বারোহী ফকিরদের সঙ্গে আড়াইশ বন্দুকবাজ ও জনাকয়েক হাউইবাজ ছিল। তাদের সঙ্গে কোম্পানির সেপাইরা পেরে ওঠে না, জমিদারের বরকন্দাজ পারবে কেন? পরন্তু গ্রামবাসীদের অনেকে ফকির দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। রানী ভবানীর বাহিনী পরাস্ত হল, নাটোর রাজ্য পুনরায় লুঠ হল। ১১৪ কিন্তু মজনুর মৃত্যুর পর গোঁসাই ও ফকিরদের আনাগোনা থিতিয়ে আসছিল। আস্তে আস্তে তাদের তীর্থযাত্রা বা প্রকারান্তরে যুদ্ধযাত্রা বন্ধ হয়ে এল। তাদের সঙ্গে উৎসন্ন ফেরারী প্রজারা কেউ কেউ যোগ দিয়েছিল বটে কিন্তু সাধারণ গেরস্তরা তাদের নামে ভয়ে কাঁপত। তৎকালীন গ্রাম্য সমাজের স্মৃতিপটে সন্ন্যাসীদের যে ভয়াবহ মূর্তি অঙ্কিত হয়ে গেছে তার সঙ্গে ‘আনন্দমঠের’ সন্ন্যাসীদের মিল খুবই কম। গ্রাম্য রচনা ‘মজনুর কবিতায়’১১৫ হিন্দুস্তানী ফকির দল সম্বন্ধে বাঙালি গ্রামবাসীদের ত্রাসের ভাবটাই অন্য সবকিছু ছাপিয়ে উঠেছে:

সহজে বাঙালিলোক অবশ্য ভাণ্ডয়া।
আসামী ধরিতে ফকির যায় পাড়া পাড়া॥

তখন:

ফকির আইল বলি গ্রামে পৈল হুড়।
পাছুয়া বেপারী পালায় গাছে ছাড়্যা গুর॥
নারীলোক না বান্দে চুল না পরে কাপড়।
সর্বস্ব ঘরে থুয়া পাথারে দেয় নড়॥
হালুয়া ছাড়িয়া পালায় লাঙ্গল জোয়াল।
পোয়াতি পলায় ছাড়ি কোলের ছাওাল॥
বড় মনুষ্যের নারী পালায় সঙ্গে লয়া দাসী।
জটার মধ্যে ধন লয়া পালায় সন্ন্যাসী॥

অনন্তর নারী নির্যাতনের যে বর্ণনা আছে তার সঙ্গে ভবানন্দের কামুকতার কিঞ্চিৎ ক্ষীণ সাদৃশ্য থাকতে পারে, কিন্তু জীবানন্দের আদর্শ থেকে সে বস্তু সম্পূর্ণ আলাদা:

ভাল মানুষের কূলবধূ জঙ্গলে পালায়।
লুটুরা ফকির যত পাছে পাছে ধায়॥
যদি আসি লাগপাস জঙ্গলের ভিতর।
বাজে আসি ধরে যেন লোটন কৈতর॥
বসন কাড়িয়া লয় চাহে আলিঙ্গন।
যুবতি কাকুতি করি কি বলে বচন॥
দন্তে কুটা করি বাপু ধরি হাত পাও।
অতিথ ফকির তোমরা দুনিয়ার বাপ মাও॥

কিন্তু বৃথা কাকুতি মিনতি। পরিশেষে ধর্ষিতা মেয়েরা ফকিরকে শাপ দেয়:

লাজে নাহি কথা রাখে গুপ্তভাবে।
ধর্ম্মসাক্ষী করি তারা মজনুকে শাপে॥
তারা বলে ঈশ্বর এহি করুক।
মজনু গোলামের বেটা শীঘ্র মরুক॥১১৬

এ তো গেল ফকিরদের বর্ণনা। গোঁসাইদের সম্বন্ধেও গাঁয়ের লোকের ত্রাস কিছুমাত্র কম নয়। একই সময়ে রচিত মহাস্থানগড়ের পৌষ-নারায়ণী স্নানের বর্ণনায় গোঁসাইদের সম্বন্ধে দেখি:

মঙ্গলবারের দিন আইল ছয় শত সন্ন্যাসী।
তারা কাশীবাসী, মহাঋষি, ঊর্ধ্ববাহুর ঘটা॥…
সন্ন্যাসী আইল বল্যা লোকের পড়ে গেল শঙ্কা।
…হাজারে হাজারে, বেটারা লুঠ করিতে আইসে।
বেটাদের অস্ত্র আছে, রাখে কাছে, বন্দুক সাঙ্গি তীর।
তামার চিমীটা, খাপে ঢাল, ঢাকা শির॥১১৭

কোম্পানির সেপাইদের সঙ্গে ফকির ও গোঁসাইদের খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলাকালীন ১৭৮২ খ্রীস্টাব্দে রংপুরে প্রজা বিদ্রোহ ঘটল। দেবী সিংহের ইজারা শুরু হয়েছিল তার এক বছর আগে। নবাবী আমল দূরে থাক, কোম্পানির আমলেও কেউ কখনো সে রকম অত্যাচারের কথা শোনেনি। বকেয়া খাজনার দায়ে প্রজাদের নিপীড়ন করবার জন্য দেবী সিংহের লোকেরা যেসব নতুন নতুন উপায় উদ্ভাবন করেছিল, পার্লামেন্টে এডমন্ড বার্ক সেগুলি বর্ণনা করার সময় অনেক ইংরাজ মহিলা মূৰ্ছিতা হয়ে পড়েছিলেন। শুনলে সে যুগের মহিলাদের সম্বন্ধে এ যুগে কিছু বিস্ময় ও অবিশ্বাসের উদ্রেক হয় বটে; কিন্তু রংপুরে তদন্তকারী প্যাটারসন সাহেবের নিরপেক্ষ সমসাময়িক রিপোর্ট (বার্কের বাগ্মিতার ভিত্তি ছিল ঐ রিপোর্ট) পাঠ করলে সত্যিই শিউরে উঠতে হয়।

দেবী সিংহের আমলারা গতানুগতিকভাবে রায়তদের কাছারীতে বেঁধে আনত না। তার পরিবর্তে রায়তদের স্ত্রী ও অনূঢ়া কন্যাদের শিকল পরিয়ে বেত মারতে মারতে কাছারীতে এনে বিবস্ত্র করত এবং রাত্রে সেখানে আটক রেখে তাদের সতীত্ব বা কুমারীত্ব নাশ করত। প্রজাদের চরম অপমানের উপায় অনুসন্ধানে বিস্ময়কর উদ্ভাবনী শক্তি দেখিয়ে কোনো কোনো রায়তকে হুকুম দেওয়া হত তারা যেন তাদের স্ত্রীদের কাঁধে চড়িয়ে কাছারীতে এনে রেখে যায়। সেসব স্ত্রীলোকের যোনীতে জ্বলন্ত মশাল ঢুকিয়ে দেওয়া হত এবং ফাটা বাঁশের মাঝখানে স্তনাগ্রভাগ টিপে স্তন ছিঁড়ে ফেলা হত। তাতেও কাজ না হলে গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হত এবং মাঠের ধান কেটে হাতিদের খাওয়ানো হত। কাজীরহাট গ্রামে সেপাইরা এসে কয়েকজন রায়তকে ফাঁসি দিয়ে তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে গিয়েছিল। কয়েকজন প্রজার মাথা কেটে ফেলা হয়েছিল। কারো কারো নখ উপড়ে ফেলা হত, কারো দু আঙুলের হাড় মধ্যবর্তী কাঠে টিপে ভেঙে ফেলা হত। মুসলমান প্রজার দাড়ি গোড়া থেকে উপড়ে ফেলা একটা বিশেষ মজাদার খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উল্টো গাধায় বা বলদে চাপিয়ে বাদ্য সহকারে হিন্দু প্রজার জাতি নাশ ছিল আর একটা খেলা। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল যে শিশুদের চাবুক মেরে বাপ মার কাছ থেকে খাজনা আদায়ের উপায়টি বিশেষ কার্যকরী। শুধু সাধারণ প্রজা নয়, পাটোয়ারী ও বসনিয়া রায়তদের পর্যন্ত সাজোয়ালের লোক এসে ধরে নিয়ে গিয়ে পায়ে বেঁধে উপর থেকে নীচে ঝুলিয়ে রাখত এবং ক্রমাগত মাথায় জুতো আর পায়ে কাঁটাওয়ালা ডাণ্ডা দিয়ে যে পর্যন্ত নাক দিয়ে রক্ত না বেরোয় সে পর্যন্ত মারতে থাকত।

শুধু মণ্ডল, পাটোয়ারী, বুসনিয়া বা জোতদার কেন, জমিদারদেরও রক্ষা ছিল না। তাঁদের কয়েকজনকে শিকল পরিয়ে বাঁশ ও বেতের প্রহারে অজ্ঞান করে ফেলা হয়েছিল। রংপুরের অনেক জমিদার ছিলেন স্ত্রী জমিদার। খাজনার দায়ে তাঁদের পর্যন্ত নিজেদের কাছারীতে আটকে রাখা হত। অন্তত আটজন জমিদারের জমিদারী বকেয়া খাজনার অজুহাতে ষড়যন্ত্র করে কম দামে বেচে দেওয়া হয়েছিল। এঁদের মধ্যে টেপার জমিদার, মন্থনার জয়দুর্গা চৌধুরানী, এবং বামনডাঙার জগদীশ্বরী চৌধুরানী স্ত্রীলোক ছিলেন। টেপার স্ত্রী জমিদার ও জয়দুর্গা চৌধুরানীকে আটক করা হয় এবং তাদের উপর পাইক বসানো হয়। ইটাকুমারীর জমিদার শিবচন্দ্র রায় এবং মন্থনার জয়দুর্গা চৌধুরানী রায়তদের রক্ষা করতে গিয়ে লাঞ্ছিত হন এবং শিবচন্দ্র রায়কে এক রাত কয়েদ করে রাখা হয়।

তখন প্রজা বিদ্রোহ ধূমায়িত হতে শুরু করেছে। উৎসন্ন জমিদাররা এদিক ওদিক পালাতে শুরু করেছেন। বলিহারের জমিদাররা নিরাশ্রয়ভাবে এখান থেকে সেখান ঘুরতে ঘুরতে শেষে বড়নগরের রানী ভবানীর বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। কাজিরহাটের জমিদাররাও দেশ ছেড়ে পালালেন। কাকিনার স্ত্রী জমিদার অলকানন্দা চৌধুরানী মুর্শিদাবাদে আশ্রয় নিলেন। বামনডাঙার জগদীশ্বরী চৌধুরানী দেশছাড়া হলেন। মন্থনার তেজস্বিনী জমিদার জয়দুর্গা চৌধুরানী পর্যন্ত জমিদারী হারিয়ে নাটোরে রানী ভবানীর রাজ্যে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন।১১৮ হেন কালে রংপুরে ‘ডিং’ বের হল। এই প্রজা বিদ্রোহে জমিদারের—বিশেষ করে শিবকুমার রায় ও জয়দুর্গা চৌধুরানীর—ইন্ধন ছিল। গ্রাম্য গানে তার ইঙ্গিত আছে। রতিরাম দাস কৃত রংপুরের ‘জাগের গানে’ ‘জয়দুর্গা চৌধুরানী’ বা ‘জয়দুর্গা দেবী’র নিম্নরূপ বর্ণনা আছে:

মন্থনার কর্ত্তী জয়দুর্গা চৌধুরানী।
বড় বুদ্ধি বড় তেজ সকলে বাখানি॥

তাঁরই নির্দেশে শিবকুমার রায় প্রজাদের হয়ে দেবী সিংহের কাছে দরবার করতে যান। ফরিয়াদ শুনে দেবী সিংহ রুষ্ট হয়ে তাঁকে কয়েদ করলেন:

রজপূত১১৯ কালাভূত দেবী সিং হয়।
চেহারায় মৈষাসুর হইল পরাজয়॥
শুনি চক্ষু কটমট লাল হৈল রাগে।
কৌন হ্যায় কৌন হ্যায় বলি দেবী হাঁকে॥

পরে মুক্ত হয়ে শিবকুমার ফিরে এলে উৎপীড়িত জমিদার ও রায়তরা তাঁর কাছারীতে সমবেত হল।

রাইয়ৎ প্রজারা সবে থাকে খাড়া হৈয়া।
হাত জুড়ি চক্ষুজলে বক্ষ ভাসাইয়া॥
পেটে নাই অন্ন তাদের পৈরণে নাই বাস।
চামে ঢাকা হাড় কয়খান করি উপবাস॥

শিবচন্দ্র সমবেত জমিদারদের বললেন:

প্রজার অবস্থা দেখি যাক্ করিতে হয়।
কর জমিদারগণ তোমরা মহাশয়॥

কিন্তু দেবীসিংহ দুর্দান্ত লোক। জমিদাররা কেউ কথা না বলে হেঁটমুণ্ডে বসে রইলেন। তখন জয়দুর্গা চৌধুরানী জমিদারদের কাপুরুষতায় রুষ্ট হয়ে প্রজাশক্তি আহ্বান করে বললেন:

জ্বলিয়া উঠিল তবে জয়দুর্গা মাই।
তোমরা পুরুষ নও শকতি কি নাই॥
মাইয়া হইয়া জনমিয়া ধরিয়া উহারে।
খণ্ড খণ্ড কাটিবারে পারোঙ তলোয়ারে॥
করিতে হইবে না আর কাহাকেও কিছু।
প্রজাগুলি করিবে সব হইব না নীচু॥১২১

প্রকৃতপক্ষে এর পর যে প্রজা বিদ্রোহ হল তাতে জমিদারদের কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না। বুসনিয়া ইত্যাদি প্রধান প্রধান রায়তরাই ‘ডিং’ জারি করেছিল। কোম্পানির সৈন্যবাহিনী প্রজা-বাহিনীকে পরাস্ত করে কঠোর হাতে সে বিদ্রোহ দমন করে। কিন্তু তাতে দেশে শান্তি ফিরল না। বিদ্রোহ প্রশমিত হবার সঙ্গে সঙ্গে অতিমাত্রায় ডাকাতির বৃদ্ধি হল। মুর্শিদাবাদের প্রবল প্রতাপান্বিত রাজপুরুষ দেবীসিংহের ভ্রূকুটি অগ্রাহ্য করে রানী ভবানী রংপুরের পলাতক জমিদারবৃন্দকে বড়নগর-এ ও নাটোরে আশ্রয় দিয়ে দুই হাতে রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু বরেন্দ্রভূমির প্রজা অভ্যুত্থান ও ডাকাতির প্লাবন থেকে তাঁর রাজ্যও রক্ষা পেল না।

এদিকে রংপুরে ফকির সন্ন্যাসীর প্রকোপের সঙ্গে সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের প্রাবল্য যুক্ত হল। বিশেষ করে ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানী এই দুই ডাকাতের নাম শোনা যেতে লাগল। মজনু শাহের সঙ্গে ভবানী পাঠকের যোগাযোগ ছিল, আবার ভবানী পাঠকের সঙ্গে দেবী চৌধুরানী যুক্ত ছিলেন। দেবী চৌধুরানী বেতনভুক বরকন্দাজসহ নদীবক্ষে বজরায় থাকতেন। তাঁর নাম থেকে অনুমান হয় তিনি রংপুরের স্ত্রী জমিদার ছিলেন। ভবানী পাঠকের সঙ্গে তাঁর লুণ্ঠিত মালের বখরা থাকলেও তিনি স্বাধীনভাবে ডাকাতি করতেন। ভবানী পাঠক বাহারবন্দ পরগনায় লেফটেনান্ট ব্রেনানের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হবার পরও দেবী চৌধুরানীর নামে লোকে আরো অনেক দিন সন্ত্রস্ত হয়েছিল। ১২০ অনুমান করা যায় তিনি মন্থনার জয়দুর্গা চৌধুরানীর মতো কোনো ছোট জমিদারীর মালিকানী ছিলেন। ১৭৮২-তে যে জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানী প্রথমে নজরবন্দী, পরে জমিদারি থেকে উৎস ‘হন এবং সর্বশেষে পার্শ্ববর্তী নাটোর রাজ্যে আশ্রয় নেন, তিনি নিজেই ১৭৮৭তে অজ্ঞাতভাবে দেবী চৌধুরানীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও আশ্চর্যের কিছু নেই।

এই সময় সারা কোম্পানির মুলুক জুড়ে যে ভয়ানক চুরি-ডাকাতি আরম্ভ হল সে রকম আগে আর কখনো দেখা যায়নি। ‘মুজাফ্ফর নামার’ লেখক করম আলি নবাবী আমলের ফৌজদার ছিলেন। ১৭৪৮ থেকে ১৭৫৬ পর্যন্ত আলিবর্দি খানের অধীনে সরকার ঘোড়াঘাটের ফৌজদারী করে তিনি দেশের শান্তি স্বাচ্ছন্দ্য সম্বন্ধে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। মহাবত জঙ্গের নিজামতের সঙ্গে ১৭৭২-এর পরেকার অবস্থা তুলনা করে তিনি মন্তব্য করেছেন: ‘সে আমলে তাঁর খয়রাৎ দেশের প্রত্যেক বেওয়া ও এতিমের অবলম্বন ছিল। তখন চোর ডাকাতের নাম পর্যন্ত শোনা যেত না। কারো দৌলত রাস্তায় পড়ে থাকলে তার মালিক না আসা পর্যন্ত কেউ সে দিকে একবার তাকাত না। আজকাল এ সবই উল্টো হয়ে গেছে। মাত্র এই কয় বছরে এ দেশে নিরাপত্তা যেন উপকথার হুমা পাখির মতো দুর্লভ হয়ে পড়েছে। দিন দিন লোকের রোজগার কমে যাচ্ছে। দলে দলে জুলুমবাজ ঘোর গণ্ডগোলের মাঝে মাথাচাড়া দিচ্ছে। রাস্তাগুলি মানুষ ও বন্য জন্তুর ভয়ে এমন খতরনাক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে বাড়ির বাইরে বের হওয়া দূরে থাক, বাড়ির মধ্যেই টেকা যায় না।’১২২

মন্বন্তরের পর উচ্ছন্ন ফেরারী প্রজারা এবং নবাব ও জমিদারদের বরখাস্ত নগদিয়ান সেপাইরা ডাকাত দলে যোগ দিয়েছিল। নাটোর রাজ্য জুড়ে পণ্ডিতা ও কার্তিকা নামে দুই ভয়ংকর ডাকাত বহু দিন ধরে প্রজাদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করেছিল। এসব ডাকাতের নিষ্ঠুরতার অন্ত ছিল না। এক বছর এক নিরীহ গরিব গ্রামবাসীকে খুন করে পরের বছর তার বিধবাকে গ্রাম থেকে অন্য জেলায় টেনে নিয়ে গিয়ে পুনঃ পুনঃ ধর্ষণ করা, এবং তার মৃত্যুর পর তার অনাথ ছেলেকে ভয় দেখিয়ে তাকে বোবা করে ফেলা, এদের কাছে কিছুই নয়। ১২৩ অন্যান্য জায়গার মতো রানী ভবানীর জমিদারীতেও গোলযোগ, হিংসাত্মক কার্যকলাপ ও চুরি-ডাকাতি যে এত বেড়ে গিয়েছিল, তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় কোম্পানির অত্যাচার-এর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র আছে। সেই সূত্রেই রায়ত ও জমিদারদের সম্পর্ক নাটোরের মতো আদর্শ রাজ্যেও বিকৃত হয়ে প্রজাদের অসন্তোষ বহ্নিতে ইন্ধন যুগিয়েছিল।

মহম্মদ রেজা খানের আমলেও রানী ভবানীর উপর যে প্রকার জুলুম হয়নি, নতুন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক ১৭৭২ খ্রীস্টাব্দে সরাসরি কোম্পানির দেওয়ানী প্রবর্তিত হওয়ায় এবার সে রকম জুলুম আরম্ভ হল। অন্যান্য সুপারভাইজরদের সঙ্গে রাউজ সাহেব ফিরে যাবার পর রাজ্যভার আবার রানীর হাতে বর্তেছিল। কিন্তু আগের আমলের সেই অপ্রতিহত জমিদারী কর্তৃত্ব আর ফিরবার নয়। হেস্টিংসে তখন ইংরাজ শাসনতন্ত্র গড়তে শুরু করেছেন। অচিরাৎ জেলায় জেলায় সুপারভাইজরদের পরিবর্তে এলেন এক দল কালেক্টর। নবাবী ও জমিদারি আদালতের বদলে ইংরাজ আদালত গঠিত হল। অদ্ভুত তার বিচার প্রণালী—দেশীয় সমাজের সঙ্গে যার কোনো সঙ্গতি নেই। ১৭৭২ নাগাদ নাটোরেও লোকের মনে যুগপৎ ভয় ও কৌতুক উৎপাদন করে এই রকম একটি জজ আদালত গঠিত হল। এ সব ঘটনাবলী জন মানসে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল তার আঁচ পাওয়া যায় সে কালের ‘নাটোরের কবিতায়’:

আদালত ফৌজদারি কেহ কর্ত্তা কেলেট্টরি
আফিলের কর্ত্তা কেহ হৈলা।
বুঝিলাম হক বটে জজ সাহেব ধর্ম বটে
চিত্রগুপ্ত সঙ্গেতে দেওয়ান॥

রানী ভবানীর সদর কাছারী যে আর দেশের সরকার নয় সেটা প্রজাদের বুঝতে দেরি হল না। তাদের উপর নানা অত্যাচার শুরু হয়েছিল, তারাও এবার অবাধ্য হয়ে উঠল। দেশ জুড়ে অরাজক, অনেক প্রজা জঙ্গলে গিয়ে ডাকাত বনেছে, জনশূন্য দেশে একের রায়ত অন্যের মাল জমিতে টেনে এনে বসাবার জন্য জমিদাররা পরস্পর হানাহানি করছেন— এমন অবস্থায় রায়তরা জমিদারকে মানবে কেন? এরই মধ্যে শুরু হল হেস্টিংসের নতুন ইংরাজ শাসনতন্ত্র। সারা দেশে কতখানি রাজস্ব আদায় হতে পারে জানবার জন্য হেস্টিংস নীলাম করে পাঁচ বছরের ইজারা বিক্রি করতে মনস্থ করলেন— জমিদার বা বাইরের লোক যে সব চেয়ে বেশি হাঁকবে সেই মহলের ইজারা পাবে। রাজ্য রক্ষার তরে রানী ভবানীকেও নিজের মহলের ইজারার জন্য নীলামে দর হাঁকতে হল। রেজা খানের আমিলদারী ব্যবস্থাও এমন সর্বনাশা কানুনে চলত না। কথায় আছে গোদের উপর বিষফোঁড়া। শুধু নীলামে উঁচু দর হাঁকলেই হবে না, খালসার নতুন দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ ও কান্তবাবুর মাধ্যমে হেস্টিংস ও অন্যান্য বড়ো সাহেবদের হাতে কিছু দিয়ে তবে ইজারা টিকিয়ে রাখতে হবে। যে হতভাগা জমিদার বা ইজারাদার এই কৌশল আয়ত্ত করতে পারে না, তার ইজারা ঘুচে যায়। এ রহস্য এমনিতে ফাঁস হত না। কিন্তু বিলেত থেকে হেস্টিংসের প্রতিদ্বন্দ্বী এলেন জেনারেল ক্লেভারিং ও ফিলিপ ফ্রান্সিস। কাজেই কান্তবাবু ও দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের শ্রীবৃদ্ধিতে কাতর মহারাজা নবকৃষ্ণ রীতিমতো ছক সাজিয়ে সেই বিপুল উৎকোচ আদায়ের প্রণালীটা ফিলিপ ফ্রান্সিসের সামনে তুলে ধরলেন:১২৫

An account of the money received by Governor Hastings and other gentlemen from the Zamindars, Talookdars and Farmers of the soubah of Bengal from his accession to the Government till the arrival of the General [Clavering] and other gentlemen; exclusive of Nuzzers (presents), Pearls, Jewels, cloths and complimentary presents…

Dacca[Rs]
Ready money5,00,000
Mr. Barwell4,00,000
Rungpore, etc. 
Ready money1,00,000
Promissory1,00,000
Moorshidabad-Exclusive of Mr. Middleton3,00,000
Dinagepore2,00,000
Boglepore1,50,000
Beerbhum, Bishnupur, etc.1,00,000
Midnapore 
Mr. Vansittart and other Gentlemen3,50,000
Raja Kissenchand1,50,000
Burdwan-Exclusive of Mr. Chas Stewart 
Through Diwan Brojkishore2,00,000
Phoolbundy1,50,000
Mundalghat salt contract1,50,000
Hooghly, Hijli, etc. 
Ready money1,00,000
Settlement for salt6,00,000
Jessore etc. 
On account of salt of Raymangal, etc.2,00,000
Farmers of 24 Parganas50,000
From Raja Huzuri Mal and Madan Dutt for relinquishing the farm of Poornea1,00,000
Profit of Batta, premium on bills, etc from Raja Huzurimal and Doyalchand1,50,000
From servants wages1,00,000
 42,00,000

Governor Hastings received from Nawab Shuja-ud-Daula and Others without participation as follows—

From Nawab Mubarak-ud-Daula through

Munny Begum2,00,000
From the Sets50,000
Raja Rajballav1,00,000
From the Zamindari of Rani Bhowani1,25,000
From Nawab Shuja-ud-Daula in cash5,00,000
Promissory5,00,000
From the Raja of Benares in cash2,00,000
Promissory1,00,000
 17,75,000

Mr. George Vansittart without participation—

From Shuja-ud-Daula2,00,000
From the Raja of Benares1,00,000
 62,75,000

এ তো গেল শুধু বড়ো সাহেবদের প্রাপ্তির কথা। যাঁদের মাধ্যমে টাকাটা আদায় হয় তাঁদের উপরেও ছিটেফোঁটা টাকার বৃষ্টি হতে হতে অঙ্কটা আরো বড়ো হয়ে দাঁড়ায়। রানী ভবানী হেস্টিংসকে এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে পার পেলেন না। শুধু হেস্টিংস তত নন, আরো অনেক দাবীদার ছিলেন। রানীর পুত্র রাজা রামকৃষ্ণ আপনভোলা কালীভক্ত মানুষ। সাধক পুরুষ বলেই তাঁর খ্যাতি। জমিদারী দেখাশুনা করতে গিয়ে ভবনদীর নিগূঢ় প্রবাহগুলি সম্বন্ধে তাঁর চাক্ষুষ পরিচয় ঘটল। সাধকসুলভ অনভিজ্ঞতা বশতঃ তিনি মনে করলেন, অন্যায় উৎপীড়নের প্রমাণ দিতে পারলে তার ন্যায়বিচার হবে। তিনি জেনারেল ক্লেভারিং-এর কাছে সুবিচার প্রার্থী হলেন। তাঁর আর্জিতে জানা গেল ১১৭৯ এবং ১১৮০ সনে তাঁর নিজের জমিদারীর ইজারা হস্তগত করবার জন্য তাঁকে মোট ৪,৪০,০০১ টাকা সেলামী দিতে হয়েছে। তার মধ্যে মুরলী পোদ্দার, সদানন্দ পোদ্দার ও হটু বিশ্বাসের হাত দিয়ে কান্তবাবু ১,২৫,০০১ টাকা নিয়েছেন। তাছাড়া যুগল উকিল, রূপ পোদ্দার ও মুরলী পোদ্দারের হাত দিয়ে এবং জগৎ শেঠের কুঠির মাধ্যমে শান্তিরাম সিংগি ২ লক্ষ টাকা গ্রহণ করেছেন—তার মধ্যে এক লক্ষ টাকা রাজবাটি থেকে শেঠভবনে গয়নাগাটি এমন কি থালাবাসন বেচে সংগ্রহ করতে হয়েছে। তৃতীয় যে ব্যক্তি প্রণামী পেয়েছেন তাঁর নাম ভবানী মিত্র—তিনি নয়ান পোদ্দার, মুরলী পোদ্দার, রামকৃষ্ণ পোদ্দার, অখিল পোদ্দার, সদানন্দ, আনন্দরাম উকিল ও পরীক্ষিত মোরারের হাতে হাতে এবং আনন্দরাম উকিলের মধ্যস্থতায় মোতিচন্দ শেঠের ‘পাট’ ও দর্পনারায়ণ উকিলের মাধ্যমে পরগনা নুরুল্লাহ্পুরের উপর ঢাকায় প্রদেয় ‘পাট’ মারফৎ মোট ৩,৭৫,৪৫২ টাকা লাভ করেছেন।১২৬

এত দিয়েও দু বছরের বেশি ইজারা মিলল না। ১১৭৯ ও ১১৮০ সনে রাজশাহীর ইজারাদার থাকার পর ১১৮১ সনে রানী ভবানী দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেখলেন কুখ্যাত দুলাল রায় ও প্রাণ বসু ইজারাদার হয়ে ফিরে এসেছেন। নিলামের সাধ্যের বাইরে দর হেঁকে তিনি জমিদারী হাতে রাখতে চেয়েছিলেন। কার্যকালে দেখা গেল অত খাজনা আদায় হবার নয়। মাঝখান থেকে নুরুল্লাহ্পুরের লাখ টাকা বকেয়ায় ক্রুদ্ধ হয়ে ঢাকার কালেক্টর মত প্রকাশ করলেন, রানীর ছেলে ও আমলারা যে বকেয়ার জবাবদিহি করেন না তার আসল কারণ ‘বর্তমান সরকারের প্রতি তাঁদের অনিষ্ট কামনা ও শত্রুভাব।’১২৭ ইংরাজ কোম্পানি স্থির করে ফেলল নাটোর থেকে রানীকে উৎখাত না করলে নয়। দুলাল রায়কে ডেকে আনা হল, সঙ্গে প্রাণ বসু। প্রজাদের মুখ চেয়ে রানী অনুনয় করে আর্জি পাঠালেন:

‘১১৭৯ সনে সরকারের ইংরাজ রাজপুরুষগণ মদীয় জমিদারীর সমস্ত পুরাতন কর একীভূত করে অসংখ্য পলাতক প্রজা বাবদ কিছু মাত্র খাজনা মকুব না করেই জেলাদারী মাথোট ও অন্যান্য সাময়িক আবওয়াব সমূহ আসলে পরিণত করলেন। এমতাবস্থায় আমি তাঁদের হাত থেকে এদেশের ভার গ্রহণ পূর্বক জমা হাসিলের তাহুদ প্রদান করলাম। আমি প্রাচীন জমিদার কাজেই প্রজাদের দুঃখ দেখতে না পেরে ইজারাদার হয়ে দেশের ভার গ্রহণ করতে স্বীকৃত হলাম। কিন্তু আমি অচিরাৎ উপলব্ধি করলাম অত খাজনা দেবার মতো উপায় দেশে নেই।

১১৭৯ সনে আমি কর্জ করে খাজনা প্রদান করলাম। ১১৮০ সনে পলাতকার বকেয়া, পূর্বোল্লিখিত জেলাদারী মাথোট এবং অতিরিক্ত পরিমাণ রসদের [খাজনা বৃদ্ধির] ভার আমার উপর একত্রে এসে পড়ায় আমি জমার পরিমাণ খাজনা সংগ্রহ করতে অক্ষম হলাম। জলাভাব বশতঃ রাঢ়ের মালভূমিতে কিছুই ফলল না এবং ভাতুড়িয়ার নীচু জমির পুলবন্দীর দায়িত্ব সাহেবেরা নিজেদের হাতে নিয়ে বাঁধ নির্মাণ করায় ১৭৭৩ খ্রীস্টাব্দের অগাস্ট মাসে বাঁধভঙ্গ বশতঃ রায়তদের জমি জলপ্লাবিত হয়ে ফসল নষ্ট হল। আমি জমিদার, অতএব সর্বনাশের হাত থেকে রায়তদের বাঁচাবার জন্য তাদের কিস্তী মেটানোর সময় দিয়ে আমি সাহেবসুভদের অনুরোধ করলাম, আমাকেও জমা হাসিলের নিমিত্ত তদনুরূপ সময় প্রদান করা হোক। তাঁরা তাতে কর্ণপাত না করে স্বেচ্ছানুসারে দুলাল রায়কে দেশের খাজনা গ্রহণের সাজোয়াল নিযুক্ত করলেন। সেই সাজোয়াল আমার দুর্নাম ও নিজের মুনাফা উৎপাদনের অভিসন্ধিতে রায়তদের কাছ থেকে লুঠ করে যা পারল অর্থ সংগ্রহ করল। মদীয় বাটী অধ্যুষিত হল। আমার মাসহারা ও কর্জ্জকৃত টাকা এবং জমিদারী ও ইজারাদারী খাতে সংগৃহীত টাকার পরিমাণ বিষয়সম্পত্তি ইত্যাদি সমস্ত লুণ্ঠিত বস্তু একত্র করে ২২,৫৮,৬৭৪ টাকা সংগৃহীত হল। ১১৮১ সনে আমার হাত থেকে সব কর্তৃত্ব কেড়ে নিয়ে দুলাল রায়কে ২২,২৭,৮৪৭ টাকা জমায় দেশ ইজারা দেওয়া হল। তখন দুলাল রায় এবং তৎসহ পরাণ বসু নামক এক ইতর লোক দেশের উপর আরো নতুন খাজনা, জেলাদারের মাথোট এবং আসামী ইস্তফা (পলাতক প্রজাদের খাজনা বর্তমান প্রজাদের কাছ থেকে আদায়) ইত্যাদি চাপাল। এই দুটি লোকের হুকুমে রায়তদের সমস্ত বিষয় আসয় এমনকি তাদের বীজ ধান, ফসল, হাল ও বলদ পর্যন্ত ছিনিয়ে নেওয়া হল এবং দেশ উজাড় হয়ে গেল। আমি প্রাচীন জমিদার। আশা করি আমার কোনো দোষ ঘটেনি। আমার রাজ্য লুণ্ঠিত হয়েছে এবং প্রজাদের অভাব-অভিযোগের সীমা নেই।

অতএব আমার আবেদন এই যে দুলাল রায় এই বছরে যে পরিমাণ জমায় খাজনার তাহুদ দিয়েছে আমি তত পরিমাণ জমায় ২২,২৭,৮১৭ টাকার খাজনা দিতে প্রস্তুত আছি এবং সরকারের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় আমি তার যত্ন নেবো। অনুগ্রহপূর্বক হুকুম হয় যে দুলাল রায় যা বলপূর্বক গ্রহণ করেছে তা প্রত্যর্পণ করুক।

দুলাল রায় অতি নীচ লোক। ১১৮২ সনের করারে সে যে পরিমাণ রসদ [খাজনা বৃদ্ধি] স্বীকার পেয়েছে তা গণনা বহির্ভূত। ১১৮১-র জমা হাসিল করতে গিয়ে যে ব্যক্তি দেশ উজাড় করে ফেলেছে এবং আগামী বছরের অর্ধেক খাজনাও উশুলের উপায় রাখেনি, সে এ বছরের মতো আগামী বছরও লুঠ না করে কি প্রকারে খাজনার উপর রসদ যোগাবে? রায়তরা যদি দেশে ফিরে না আসে তবে তা কি উপায়ে সম্ভব? কিন্তু সে কোথা থেকেই বা রায়ত যোগাড় করবে?’১২৮

রায়তরা রানী ভবানীর পক্ষ নিল। দুলাল রায়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পাঁচশো প্রধান প্রধান প্রজা পদব্রজে কলকাতায় উপস্থিত হয়ে রানীর হাতে রাজ্যভার প্রত্যর্পণ করার জন্য অনুনয় বিনয় করতে লাগল।১২৯ কিন্তু বৃথা আবেদন। রানী ভবানীর মতো পুরাতন প্রতিষ্ঠিত জমিদার ইংরাজ শাসন কায়েমের পথে বাধা সৃজন করতে পারেন ভেবে রেভেনিউ বোর্ড আদেশ দিলেন:

‘The Ranny has been guilty of such glaring breach of her engagement with the Goverment that we do not approve of her continuing in the nominal trust either as Farmer or Zamindar. We direct that she be wholly dispossessed both of her Farm and Zamindary and all property in land; in lieu thereof she is to be allowed a monthly pension of Rs 4,000 during life, which shall be regularly paid to her month by month in ready money. She must be obliged to fix her residence at Baranagore adjacent to the city of Muradabad and be prevented from holding any intercourse with the mofussil which you will take proper means to see enforced,’১৩০ কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইজারাদাররা বর্ধিত খাজনা দিতে অক্ষম হওয়ায় ইজারাদারি ব্যবস্থা টিকল না আবার জমিদারী ব্যবস্থাতেই ইংরাজরা ফিরে যেতে বাধ্য হল। অন্যান্য ইজারাদারের মতো ঘোর অত্যাচারী দুলাল রায়ও খাজনা মেটাতে পারলেন না। ১৭৭৮ খ্রীস্টাব্দে বাৎসরিক ২৩ লক্ষ টাকার খাজনা আদায়ের কড়ারে রাজশাহীর জমিদারকে জমিদারী প্রত্যার্পণ করা হল।১৩১ কিন্তু বাহারবন্দ পরগনা—যা নামে রানী ভবানীর জমিদারীর অন্তর্গত হলেও মুর্শিদাবাদের রাজপুরুষদের জায়গীর রূপে নির্দিষ্ট ছিল—নাটোর থেকে খারিজ হয়ে হেস্টিংসের প্রসাদে কান্তবাবুর ছেলে লোকনাথ নন্দীর সম্পত্তি হয়ে গেল। ১৭৫৯ খ্রীস্টাব্দ থেকেই রানী ভবানী ঋণজালে আবদ্ধ হয়ে কান্তবাবুর কাছে তালুক বিক্রয় করতে শুরু করেছিলেন। ১৭৫৯-র বিক্রির কবালায় ক্রেতার নাম নিতান্ত সাধারণ ভাবে ‘কান্তবাবু’; ১৭৬০ খ্রীস্টাব্দের কবালায় নামের উন্নতি হয়ে ‘কৃষ্ণকান্ত নন্দী’; ১৭৬৬-তে তিনি একেবারে ‘শ্রীকৃষ্ণকান্ত বাবুজি।’১৩২ তিলি কুলোদ্ভব দেওয়ান দয়ারাম রায় কান্তবাবুর স্বজাতি। তিনিও এই অরাজকতার সময় রানীকে বন্ধকী মহলের উপর ধার দিয়ে নাটোর রাজ্যের পাশে দীঘাপতিয়া রাজ সৃষ্টি করলেন।১৩৩

যত দিনে রানী ভবানীর হাতে কর্তৃত্ব ফিরে এল তত দিনে অত্যাচারে জর্জরিত নাটোর রাজ্যের চরিত্র পাল্টে গেছে এবং ইজারাদারদের প্রচণ্ড শাসন ও প্রচণ্ডতর শোষণের ফলে জমিদারের সদর কাছারীর সঙ্গে মফস্বলের হাজার হাজার গ্রাম ও লক্ষ লক্ষ প্রজার সম্পর্কটি চিরতরে তিক্ত ও বিকৃত হয়ে গেছে। ইংরাজরা রানীর উপর যে পরিমাণ করভার চাপিয়েছে তাতে জমিদারী রক্ষা করতে হলে এমন উপায় নেই যে রায়তদের তুষ্ট করে রাজাপ্রজার পুরাতন পরস্পর নির্ভর সম্পর্কটি ফিরিয়ে আনা যায়। ১৭৭৬ খ্রীস্টাব্দে নাটোরে আমিনী কমিশন বসে, তার রিপোর্টে যে সব তথ্য পেশ করা হয় তা থেকে গোটা জমিদারীর সঙ্কট উপলব্ধি করা যায়।১৩৪

 টাকা
জমিদারীর ‘মালজমি’ পরিমাণ ৮৯৮ মহল বা ১৬১৯৬ গ্রাম, তার উপর ‘আসল’১৪,১৮,৪৩০
১১৮৩ সন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত অতিরিক্ত ‘আবোয়াব’১৪,২৬,২৮৪
কর্তনী, বা উপরি আদায়১,১৯,৬১৬
‘বাজে জমি’ অর্থাৎ দেবোত্তর, ব্রহ্মোত্তর ইত্যাদি নিষ্কর জমি ৪,২৯,১৪৯ বিঘা৪,২৯,১৪৯
১১৮৩ খ্রীস্টাব্দে জমিদারী মোট আদায়৩৩,৯৩,৪৭৯
‘চাকরান জমি’ অর্থাৎ মফস্বলে খাজনা আদায় নিমিত্ত পাটোয়ারী পাইক ইত্যাদির ভরণ-পোষণের সরঞ্জামী জমি বিঘা প্রতি এক টাকায় ২,৩৪,৬৯০ বিঘা২,৩৪,৬৯০
১১৮৩-র হস্ত-ও-বুদ অনুযায়ী জমিদারীর মোট আদায়৩৬,২৮,১৬৯

পলাশীর যুদ্ধের অব্যবহিত পরে নাটোর জমিদারীর উপর যে ‘আসল’ নির্দিষ্ট ছিল (২০ লক্ষ টাকা) তার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় ১১৮৩ সনে (১৭৭৬) ‘আসলের’ পরিমাণ ৬ লক্ষ টাকা কমে গেছে। মন্বন্তরের পর অসংখ্য প্রজা মৃত বা ফেরারী হওয়ায় জমি ‘পতিত’ বা ‘পলাতকা’ হয়ে এই অবস্থা। তদুপরি অনেক জমি দেবোত্তর, ব্রহ্মোত্তর হওয়ায় বা মফস্বলের আমলারা গোপনে ‘আসল’ থেকে জমি সরিয়ে নেওয়ায় আসলের পরিমাণ আরো কমে গিয়েছিল। কিন্তু যে জমি থেকে খাজনা আদায় হয় তার মূল্য ৬ লক্ষ টাকা হ্রাস পেলে কি হবে, তদধিক পরিমাণ আবোয়াব ও কর্তনী চাপিয়ে এক কালে সে জমির উপর ১৫১/২লক্ষ১৩৫ টাকা কর বৃদ্ধি হয়েছিল। যে জমির সত্যিকারের খাজনা দেওয়ার শক্তি এক তৃতীয়াংশ কমে গেছে১৩৬ তার উপর খাজনা আরো প্রায় দু লক্ষ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ লক্ষ টাকা।১৩৭ অসংখ্য ব্রাহ্মণ এবং অগণিত দেবালয়ের জন্য মাল জমি থেকে ৪ লক্ষ বিঘার উপর জমি সরিয়ে নেওয়ায় মাল জমির উপর করভার গুরুতর হয়ে উঠেছে, অথচ সেই দেবোত্তর ব্রহ্মোত্তর জমি থেকে সনাতন ধর্ম পালিকা নিষ্ঠাবতী রানীর নিজের কোনো আয় নেই। রানীর সম্যক চরিত্র না জেনেই জেমস্ গ্র্যান্ট অভিযোগ তুললেন ঐ জমি সরকারকে ঠকিয়ে তাঁরই ভোগে লাগে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিজের ভোগে লাগা দুরে থাক রানী তাঁর দেবসেবার খরচ পর্যন্ত বহন করতে গিয়ে ঋণজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন।

মন্বন্তরের পর থেকেই সুবিস্তৃত নাটোর রাজ্যের বহু স্তরে বিন্যস্ত শাসনযন্ত্রের কলকব্জাগুলি অকেজো হয়ে যেতে শুরু করায় এক দিকে যেমন প্রজাদের উপর অত্যাচার বাড়ছিল, অন্য দিকে তেমনি শাঁসালো রায়তরা অবাধ্য হয়ে উঠছিল। দুষ্ট প্রজার দমন এবং শিষ্ট প্রজার পালন বরাবর রানী ভবানীর রাজধর্মের অঙ্গীভূত ছিল, কিন্তু পরিবর্তিত অবস্থায় ঐ প্রাচীন রাজনীতির দ্বারা খাজনা আদায় অসম্ভব হয়ে পড়ল। নাটোর জমিদারীর আভ্যন্তরীণ অবস্থার দিকে তাকালে ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হবে।

একদা ‘ধরামরেন্দ্রবারেন্দ্রগৌড়ভূমীন্দ্র-ভামিনী শ্রী ভবানী’ যখন রাজ্যের একচ্ছত্র অধীশ্বরী ছিলেন, তখন রাজ্য পরিচালন ব্যবস্থার নীচের ধাপগুলিতে প্রজাদের বৃহৎ ভূমিকা ছিল। শাসনযন্ত্রের তলদেশে ছিল গ্রামের পাটোয়ারী, সে সাধারণত সেই গ্রামেরই রায়ত। তার উপরের তলায় ছিল গ্রামের আমিন ও মফস্বলের কর্মচারী, তদুপরি সেই পরগনার মফস্বল কাছারীর নায়েব, এবং এদের সবার উপর নাটোরের সদর কাছারীর জমিদারী আমলা। সদর ও মফস্বল কাছারীর আমলা ও কর্মচারীদের রানী নিজে নিয়োগ করতেন, কিন্তু গ্রামের পাটোয়ারী ও আমিন নিয়োগের বেলায় প্রজাদের মতামত গ্রাহ্য করা হত। পরগনার আমিনরাও আসলে নিজেরা রায়ত এবং সাধারণত ঐ পরগনাতেই তাদের জোতজমা থাকত। যেমন উত্তর স্বরূপপুর পরগনায় ৩৮ জন আমিন ও ৫৩ জন মফস্বল কর্মচারী ছিল। সে সব আমিনদের মধ্যে কেউ কেউ পার্শ্ববর্তী ভাতুড়িয়া পরগনার লোক। পাটোয়ারী ও আমিনদের ভাতা, খোরাকী ও খরচপাতি রায়তরাই দিত, অতএব সদর ও মফস্বল কাছারীর কর্মচারীদের মতো তারা ঠিক জমিদারের নিজের বেতনভুক লোক ছিল না এ কথা নিশ্চয় করে বলা যায়। পরগনার নায়েব সনদ দিয়ে আমিনদের নিযুক্ত করতেন ঠিকই, কিন্তু পাটোয়ারীদের নিয়োগ করত রায়তরা নিজেরা। রায়তরাই পাটোয়ারীদের বরখাস্ত করত, তবে যে সব পাটোয়ারী ও আমিনকে নায়েব নিজে নিয়োগ করেছেন তাদের বরখাস্ত করতে হলে তাঁর মত নিতে হত। তবু, দশ জন রায়ত একত্র হয়ে কোনো পাটোয়ারী বা আমিনকে বরখাস্ত করার দাবি জানালে সে দাবি পারতপক্ষে—অন্তত সদর কাছারীতে সে লোকটার মুরুব্বি না থাকলে— অগ্রাহ্য করা হত না।১৩৮ সে হিসেবে নাটোর রাজ্যের শাসন ব্যবস্থার তলদেশে অনেকখানি প্রজাতন্ত্র ছিল।

কিন্তু ক্রমে পাটোয়ারী ও আমিন ও মফস্বল কর্মচারীরা গ্রামের কতিপয় বড়ো বড়ো রায়তের অঙ্গুলীনির্দেশে জমিদারীকর্ম নিবাহ করতে শুরু করায় সেই প্রজাতন্ত্রের মধ্যে অনেকখানি রাজবিরোধী মণ্ডলতন্ত্রের অনুপ্রবেশ হল। দুর্ভিক্ষের পর বহু জমি পতিত ও বহু গ্রাম উজাড় হয়ে যাওয়ায় বড়ো বড়ো মণ্ডলরা সে সব জমি নাম মাত্র মালজমায় নিজেদের নামে লিখিয়ে নিল এবং অধমর্ণ রায়তদের দিয়ে ভাগে চাষ করিয়ে গাঁয়ের হর্তাকর্তা হয়ে উঠল। আগে নিরিখ অনুযায়ী প্রত্যেক রায়তের জোত থেকে আলাদা আলাদাভাবে আসল জমা অনুসারে খাজনা আদায় হত। তার পরিবর্তে রেজা খাঁর আমল থেকে গোটা গাঁয়ের উপর আবোয়াব চাপিয়ে বর্ধিত হারে খাজনা আদায় শুরু হয়। মণ্ডলদের স্বার্থে পাটোয়ারীরা সেই সব আবোয়াব বিশেষ করে গরিব রায়তদের উপর চাপিয়ে দেওয়ায়, অত্যাচারের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল।১৩৯ অত বড়ো জমিদারীতে মফস্বলে যা ঘটছে তার কতটুকু খবরই বা সদরে পৌঁছাবে? যে নায়েব তাঁর মফস্বল কাছারী থেকে বের হন না তাঁর পক্ষে তাঁর অধীনস্থ গ্রামগুলিতে কি হচ্ছে তা জানা সম্ভব নয়, আর যে জমিদার তাঁর দেওয়ান বা নায়েবদের উপর নির্ভর করেন তাঁর কাছে মফস্বলের পরগনাগুলির আসল খবর পৌছায় না। ১৪০ রাজশাহীর রায়তদের মধ্যে খোস খাস পাট্টা ভোগী এক দল মোকরারি রায়তের উদ্ভব হল যারা নিজেরা চাষ করে না কিন্তু যারা বিস্তৃত জোতজমা নিয়ে ভাগে বা মজুরী দিয়ে চাষ করায়।১৪১ নতুন কলেক্টর পিটার স্পীক নাটোর থেকে ১৭৮৮ খ্রীস্টাব্দে জানালেন যে প্রধান প্রধান মণ্ডলরা এ দেশের আসল কর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং যে কোনো জমিদারের প্রথম লক্ষ্য হবে ধীরে ধীরে তাদের কর্তৃত্ব খর্ব করে আনা। ১৪২ মফস্বলের পাটোয়ারী, আমিন ও কর্মচারীরা এদেরই কথামতো চলত। এদেরই নেতৃত্বে রাজা-প্রজার বিরোধ ঘনিয়ে উঠল।

১৭৮১ খ্রীস্টাব্দ থেকে ভাতুড়িয়া ও ভূষণা পরগনায় পর পর সাত বছর ধরে অনেকগুলি সংঘর্ষ ঘটে গেল। রায়তরা গ্রামের মণ্ডলদের অধীনে সংঘবদ্ধ হয়ে খাজনা আদায়ে বাধা সৃষ্টি করতে লাগল। রায়তরা মণ্ডলদের নির্দেশে নিজেদের খরচে কতকগুলি বরকন্দাজ পুষল। উদ্দেশ্য জমার পরিমাণ জোর করে কমিয়ে নেওয়া। তাদের পিছনে এক দল স্বার্থানুসন্ধানী জমিদারী আমলার উস্কানি ছিল। ভাতুড়িয়াতে এক জন ইংরাজ সেনানায়ক জনতার উপর গুলি চালাতে বাধ্য হলেন। বনগাঁয় রায়তরা মণ্ডলদের প্ররোচনায় ইজারাদারকে হটিয়ে দিল এবং তাঁকে আবার কাছারীতে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে ম্যাজিস্টে্রট যে সব পাইকদের পাঠিয়েছিলেন তাদের পর্যন্ত পিটিয়ে দিল।১৪৩

সহজে খাজনা আদায় হয় না দেখে প্রজাদের সায়েস্তা করতে গিয়ে নায়েবরা বলপ্রয়োগে অভ্যস্ত হয়ে পড়লেন। এই প্রসঙ্গে হ্যারিংটন সাহেবের কাছে স্বরূপপুর পরগনার নায়েব নিজের কাছারী পরিচালন ও খাজনা আদায় প্রণালীর নিম্নরূপ বর্ণনা দেন: ‘প্রথমে চিঠা নিয়ে পাইক যায়, তাতেও দেরী হলে আর একটা পাইক যায়, তার পর পেয়াদা। দরকার হলে আরো পেয়াদা ভেজা হয়, কিন্তু এমনিতে এক জনই যথেষ্ট। সমস্ত খাজনা আদায় হয়ে গেলে পাইক-পেয়াদা সবাইকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়, কখনো বা পেয়াদা গেলে পাইকদের ফেরত আনা হয়। যদি আমার মনে হয় যে রায়তরা হারামি করছে তবে মহসিল পাঠিয়ে সর্দার রায়তদের সদরে ডেকে আনি, সেখানে আর্জি শুনে আমি তাদের যা দেবার কথা তা দিতে বাধ্য করি এবং প্রয়োজন মতো মহাজনদের কাছ থেকে কর্জ নেওয়াই। বাধ্য করবার উপায়গুলি হল তাদের কয়েদ করা বা বেত মারা। প্রথমে আমি আমিন আর পাটোয়ারীকে সাজা দেই, কারণ তারা হল জমিদারের চাকর। আমিন ও পাটোয়ারীর শাস্তিতেও রায়তরা ভয় না পেলে এবং খাজনা তখনো বাকি থাকলে এর পর আমি রায়তদের সাজা দিই। কিন্তু আমিন আর পাটোয়ারী যদি বলে যে রায়তদের হারামির জন্য খাজনা বাকি পড়েছে, তবে তাদের ডেকে এনে খোঁজ খবর নেবার পর শাস্তি দিই। কিন্তু এমনিতে তাদের বিরুদ্ধে হারামির ফরিয়াদ না উঠলে প্রথমে আমিন ও পাটোয়ারীকে সাজা দেওয়া হয়।’

আমরা দেবী সিংহের ইজারার অত্যাচার কেমন ছিল দেখেছি। তার সঙ্গে রানী ভবানীর জমিদারীর অত্যাচারের কোন তুলনাই চলতে পারে না। তবু এ কথা মানতে হবে যে নাটোরে রায়ত জমিদারের আগেকার আদর্শ সম্পর্কটি আর বজায় ছিল না। প্রাণ বসু-র প্রথম ইজারাদারী থেকেই তা ঘুচে গিয়েছিল। ১৭৮১-র পর রায়ত জমিদারের ক্রমাগত বিরোধে এবং একদল ফন্দিবাজ আমলার ষড়যন্ত্রে বছর বছর বিরাট পরিমাণ খাজনা বাকি পড়ায় ইংরাজ সরকারের হুকুমে নাম মাত্র দামে উত্তর স্বরূপপুর নামক বিরাট পরগনা বকেয়া খাজনার দায়ে কলকাতার বেনিয়ান দর্পনারায়ণ ঠাকুরকে বেচে দেওয়া হল। হিন্দুস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম একজন প্রতিষ্ঠিত জমিদারের এত বড়ো জমিদারী নিলামে বেচা হল। ১৪৪ জমিদারী বাঁচাবার জন্য রানী ভবানী মহাজনদের কাছে ধার করলেন, বাড়ির জিনিসপত্র বেচতে লাগলেন, কিন্তু প্রজারা ঝামেলা পাকিয়ে কিস্তি খেলাপ করায় স্বরূপপুর পরগনা বাঁচানো গেল না। তার পর ইংরাজ সরকার আরো বকেয়ার দায়ে সরকার মাহমুদাবাদের অন্তঃপাতী রাজাপুর পরগনাও নিলামে বেচে খাজনা উশুল করলেন।১৪৫

স্বরূপপুর ও রাজাপুর নিলামে উঠবার আগে রানী কাতরভাবে আবেদন জানিয়েছিলেন— ‘সরকারের আশ্রয় ব্যতীত কেই বা জমিদার?’ কিন্তু ইংরাজ রাজপুরুষরা এ সব পুরাতন আদর্শের ধার ধারতেন না। রানী তাঁর আর্জিতে আরো লিখেছিলেন ‘নিজের এবং পরিবারের ভরণপোষণহীনা এবং ধর্মকর্ম পূজাদির খরচ বহনে অসমর্থা আমার আর অপোযশ, ধর্মহানি, লোকলজ্জা ও সর্বসমক্ষে অপদস্থ হওয়া ছাড়া কি বা আছে?’১৪৬ কিন্তু যে বিদেশী রাজপুরুষদের কাছে তিনি এই কথা বলেছিলেন খাজনা ঘাটতির আশঙ্কা বশতঃ তাঁরাই রাণীর দেবোত্তর, ব্রহ্মোত্তর, দানধ্যান, পূজাদির বিরুদ্ধে বিশেষ ভাবে কঠোর মনোভাব পোষণ করতেন। রানী কিন্তু রাজপুরুষদের রোষ অগ্রাহ্য করে শত বিপদের মধ্যেও তাঁর দেবসেবা ও দানাদি ক্রিয়াকার্যে ত্রুটি ঘটতে দেননি। এ কার্যে তাঁর সহায় ছিলেন তাঁর বিধবা মেয়ে তারা। বড়নগরে রানী অনেকগুলি সুন্দর সুন্দর পোড়ামাটির ‘বাংলা’ মন্দির তৈরি করেছিলেন, সে সঙ্গে তাঁর কন্যা তারাও একটি দেবালয় নির্মাণ করে তাতে মনোহর গোপাল মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের শিলালিপিতে লিখিত আছে:

খশূণ্যমিত্রশকে শ্রীভবানীতনুসম্ভবা।
নিৰ্ম্মমে শ্রীমতী তারা শ্রীমদেগাপালমন্দিরম্।

খশূন্য মিত্র—১৭০০ শক,১৪৭ অর্থাৎ ১৭৭৮ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত তারা জীবিত ছিলেন বোঝা যায়। মা ও মেয়ের পুণ্যব্রত নিয়ে একটি করুণ কাহিনী বারেন্দ্র সমাজে প্রচলিত আছে। তারার মৃত্যু সম্বন্ধে প্রবাদ এই যে, বরেন্দ্রভূমির সুপ্রসিদ্ধ ‘ভবানী জাঙ্গাল’ নির্মিত হবার আগে ভবানীপুর পীঠস্থান যেতে যাত্রীরা বড়ো কষ্ট পেত। তীর্থযাত্রীদের কষ্টলাঘব নিমিত্ত ভবানীপুর পর্যন্ত পথ নির্মাণ করতে গিয়ে রানী ভবানী ভদ্রাবতী নদীর উপর সেতু নির্মাণ করতে উদ্যত হন। তৎকালে দেবীর স্বপ্নদেশ হল— আমার বক্ষে যে সেতু নির্মাণ করবে তার বক্ষস্থল ব্রণ দ্বারা ছিদ্রময় হয়ে সে অচিরাৎ ইহলোক ত্যাগ করবে। কিন্তু পথিকের বড়ো দুভোর্গ হওয়ায় তারা ঠাকুরানী ব্যথিত হয়ে নিজ ব্যয়ে সেতু বন্ধন করবার সঙ্কল্প করেন। ভবানী প্রথমে আপত্তি করেও শেষে বাধা দেননি। তাঁর মেয়ের মত, এতে যদি নিজের বৈধব্য দগ্ধ জীবনের অবসান হয়, সেও সৌভাগ্য। তিনটি বিরাট খিলানের উপর যথাকালে সেতু নির্মাণ কার্য সম্পন্ন হল। সেতু প্রতিষ্ঠার দিন নিশীথে তারার বক্ষস্থলের মাঝে সূক্ষ্মাগ্র ক্ষুদ্র ব্রণ দেখা দিল এবং তা শীঘ্রই শতচ্ছিদ্রে পরিণত হয়ে তাঁকে রোগশোক দগ্ধ ধরাতল থেকে অপসৃত করে নিয়ে গেল। ১৪৮ নীলমণি বসাককৃত ভবানী চরিত্রে দেখা যায়, কন্যা বিধবা হবার পরে দান ধ্যান পূজাদি কর্মে সদা সুখে থেকেও ভবানী দুহিতার পতিহীনত্ব যন্ত্রণায় সতত দুঃখিনী থাকতেন। অপর পক্ষে এও স্থির নিশ্চয় যে জীবনে প্রকারান্তরে দুই বার বৈধব্য যন্ত্রণা ভোগ করেও তাঁর মধ্যে এক অচল আচারনিষ্ঠ পরহিতব্রতী সত্তা ছিল যা তাঁর ধর্ম এবং যা তাঁকে এবং সমাজকে ধরে রেখেছিল।

তাঁর দানাদি কর্মের বিশেষত্ব ছিল এই যে তিনি নিষ্কর জমি ও বৃত্তি প্রদান করে দানের মঙ্গলময় প্রভাব অক্ষয় রাখবার প্রয়াস পেতেন। এককালীন দানে সমাজের মঙ্গল স্থায়ী হয় না। তিনি এমন ব্যবস্থার পক্ষপাতী ছিলেন যাতে দানোদ্ভূত সমাজহিত সুচিরস্থায়ী হয় এবং বংশানুক্রমিক ভাবে চতুর্বর্ণের ও ধর্ম ও বিদ্যার প্রতিপালন হয়। জামাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে তিনি যেমন দান শুরু করেন বড়ো বড়ো রাজারাও তা পারেননি। ব্রাহ্মণ, গঙ্গাতীরবাসী, ক্ষেত্রধামবাসী, আখড়াধারী মহান্ত ও অতিথিদের জন্য নগদ বৃত্তিরূপে তিনি বাৎসরিক এক লক্ষ আশি হাজার টাকা ব্যয় করতেন। ঐ সকল বৃত্তির মধ্যে কুড়ি-পঁচিশ হাজার টাকা অধ্যাপক ও পণ্ডিতদের জন্য ধরা ছিল। তাঁরা টোল ও চতুষ্পাঠী স্থাপন করে ছাত্রদের বিদ্যাদান ও ভরণপোষণ করতেন। কোম্পানির মতিগতি দেখে তাঁর শঙ্কা হল যে উচিত ব্যবস্থা না হলে সে সব বৃত্তি অচিরে ঘুচে যাবে। বাংলা ১১৯৫ (১৭৮৮ খ্রীস্টাব্দ) সনে তিনি কোম্পানির ভাণ্ডারে বার্ষিক এক লক্ষ আশি হাজার টাকা আয়ের সম্পত্তি প্রদান করে ঐ সব বৃত্তি যাতে চিরস্থায়ী হয় সেই বন্দোবস্ত করলেন।

ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নীলমণি বসাক দেখেছিলেন ঐ টাকায় তখনো বংশানুক্রমিক ভাবে বৃত্তিভোগী ব্রাহ্মণ প্রতিপালন হচ্ছে। কিন্তু তিনি এও দেখেছিলেন যে, রানী ভবানী পূর্বকালে বীরভূম, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, মুর্শিদাবাদ, যশোহর ও ঢাকানিবাসী চতুর্বর্ণ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র আশ্রিতদের প্রতিপালনের জন্য যে ন্যূনাধিক পাঁচ লক্ষ বিঘা ব্ৰহ্মত্র, দেব, ও মহত্ৰাণ (আমিনী কমিশনের হিসাব অনুযায়ী ৪,২৯,১৪৯ বিঘা) ভূমি বিতরণ করে গিয়েছিলেন, ইদানীং কোম্পানি লোভ সম্বরণ করতে না পেরে তার উপর কর বসিয়েছেন১৪৯ এবং নগদ বৃত্তির মধ্যেও অনেক বৃত্তি হরণ করেছেন। ১৫০ মহারানী ভবানী যে সব দেবোত্তর ভূমি দান করে গিয়েছিলেন সে সবের দানপত্রে এই সাবধানসূচক শ্লোক লিখে রাখতেন:

দেবস্ব হারিণো যে চ যে চ তদ্বিঘ্নকারকঃ।

নরকান্নিষ্কৃতি স্তেষাং নাস্তি কল্পশতৈরপি॥১৫১

কিন্তু দেবস্ব হরণকারী বা তদ্বিঘ্নকারক জন শতকল্পেও নরকের হাত থেকে নিস্তার পাবে না, এই প্রাচীন সংস্কারে কোম্পানি বাহাদুর বিচলিত হবার পাত্র নন। রানী ভবানী যে জগতের লোক ছিলেন, সেই জগৎ তত দিনে অন্তর্হিত হয়েছে। গঙ্গাতীরে ও কাশীধামে বিধবাদের জন্য তিনি যে সকল আশ্রম নির্মাণ করেছিলেন, এবং যাতে বহু অনাথা বিধবা গ্রাসাচ্ছাদন লাভ করে ধর্ম-কর্মে ব্রতী থাকতেন, তাও কালের গর্ভে কোথায় লুপ্ত হয়েছে। ১৫২

বস্তুতপক্ষে রানীর জীবতকালেই সেই জগৎ অন্তর্হিত হয়। উত্তর স্বরূপপুর, রাজাপুর এবং আরো চৌদ্দটি পরগনা খাজনার দায়ে নিলাম হয়ে যাবার পর ভবানী মনস্থির করলেন, আর নয়, ছেলের হাতে জমিদারীর ভার দিয়ে তিনি এবার পুরোপুরি গঙ্গাতীরবাসিনী হবেন। মহাজনদের কাছে বার বার ধার করেও তখন পাঁচ লক্ষ টাকা খাজনা বাকি পড়েছে এবং ইংরাজ কালেক্টর নলদী পরগনা (ভূষণার অন্তর্গত রাজা সীতারামের প্রাচীন সম্পত্তি), সাহপুর ইত্যাদি নিলাম করবার উদ্যোগ করেছেন। বড়ো বড়ো পরগনা নিলামের যোগাড় দেখে রানীর ছেলে রাজা রামকৃষ্ণ প্রতিবাদ করে বললেন, ‘আগেকার নাজিমরা কখনো খাজনা বাকির দায়ে নিলামে জমিদারের সম্পত্তি বেচতেন না।’ কিন্তু ইংরাজ কালেক্টর পিটার স্পীক ও সব পুরাতন নজিরে কর্ণপাত করবার লোক নন। রামকৃষ্ণ দেখলেন অবস্থা সঙ্গিন। মহাজনরা আর ধার দিতে চায় না, রায়তরা আর খাজনা দিতে চায় না। ১৫৩ তলে তলে জমিদারী আমলারা ঘোঁট পাকাচ্ছিল। তখন দেওয়ান দয়ারাম রায় অনেক দিন হল বিদায় নিয়েছেন। এক দল আমলা রানীর অধীনে ক্ষমতায় আসীন, তারা খাজনা তছরূপ করে পরগনার পর পরগনা নিলামে ওঠায়। আর এক দল আমলা এদের সরিয়ে গদিতে বসতে চায়, তারা রাজা রামকৃষ্ণকে খাড়া করে কলকাঠি নাড়ে।১৫৪

রানীর মনে হল, ‘এ দেশের রায়তরা আগেকার কালে বরাবর জমিদারের সহায়তায় পুষ্ট হত, এবং ফলত তারা বিলক্ষণ জ্ঞাত ছিল যে তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য জমিদারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের উপর নির্ভর করে। পরন্তু জমিদারের অবস্থার পতন ঘটায় তারা আর জমিদারের উপর আস্থা রাখে না!’ যদি রাজা রামকৃষ্ণ রাজ্যভার গ্রহণ করেন তবে হয়তো প্রজাদের আস্থা ফিরে আসবে। ১৫৫ আর সরকারের সনদ বলে তিনি গদিতে এসে বসলে মহাজনরাও ভরসা পেয়ে তাঁকে বাকি খাজনা মেটানোর জন্য কর্জ দেবে। ১৫৬ অতএব ১৭৮৮ খ্রীস্টাব্দে রাজা রামকৃষ্ণ ‘মহারাজাধিরাজ পৃথ্বীপতি বাহাদুর’ খেতাব সহ কোম্পানীর সনদ বলে জমিদারিতে অধিষ্ঠিত হলেন। ১৫৭ তখন তাঁর বয়স চল্লিশ বছর।

রানী ভেবেছিলেন, এবার তাঁর সংসার যাতনা ঘুচবে। কিন্তু সে হবার নয়। রামকৃষ্ণ তাঁর অবাধ্য হলেন। জমিদারী কাজে তাঁর মন নেই। কন্যাশোকাতুরা মাতা শেষ বয়সে পুত্ৰসুখেও বঞ্চিত হলেন। রক্তের স্বাভাবিক সম্পর্ক যেখানে নেই, সেখানে মাতাপুত্রের মনোমালিন্য অন্য আকার নেয়। রাজা রামকৃষ্ণ পরম ধার্মিক ও সাধনায় অন্তর্গত প্রাণ ছিলেন, কিন্তু সেই গুণ তাঁর পালিকা মাতার পক্ষে বড়ো সুখের হয়নি। ১৭৯১ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজরা মহারাজ রামকৃষ্ণের সঙ্গে আড়াই লক্ষ টাকার রসদ বা বৃদ্ধিতে, মোট ২২১/২ লক্ষ টাকা জমায়, দশশালা বন্দোবস্ত করল। কিন্তু এক লক্ষ টাকা পরিমাণ বাটা তার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায়, রসদ ও বাটার খাতে প্রকৃতপক্ষে ৩১/২ লক্ষ টাকা খাজনা বেড়ে গেল। ১৭৯৩ খ্রীস্টাব্দে ঐ বন্দোবস্তুই চিরস্থায়ী বন্দোবতে পরিণত হল, এবং অত টাকা এক সঙ্গে দেওয়া সম্ভব নয় বলে বার বার প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও রাজাকে সে বন্দোবস্ত গ্রহণ করতে এক প্রকার বাধ্য করা হল। ইংরাজরা ভেবেছিল, বর্দ্ধিত হারে খাজনা আদায় করে রাজা ঐ টাকা দিতে পারবেন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেল দশ লক্ষ টাকা জমার মতো জমি ইতিমধ্যেই তালুকদারদের কাছে নির্দিষ্ট খাজনায় বিক্রীত হয়ে যাওয়ার ফলে শুধু অবশিষ্ট অংশের উপর খাজনা বাড়িয়ে ঐ টাকা আদায় করতে হবে। তা করতে গেলে টাকায় চার আনা খাজনা বাড়াতে হয়, সে সম্ভব নয়। অতএব খাজনা বাকি পড়তে লাগল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূর্যাস্ত আইন অনুযায়ী রাজার মহলগুলিও একে একে বিক্রি হতে লাগল।১৫৮

রাজার বিষয়ে আসক্তি ছিল না। তাঁর কুটিল ডাকাবুকো দেওয়ান কালীশঙ্কর রায় সব কিছু চালাতেন। এই কালীশঙ্কর নড়াইল জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা—কূটবুদ্ধি সম্পন্ন অসমসাহসী পুরুষ। মহারাজের বিশেষ প্রিয়পাত্র। তাঁরই ষড়যন্ত্রে রাজশাহীর অর্ধবঙ্গব্যাপী জমিদারী ভেঙে পড়ল। রাজশাহী বংশের ইতিহাসকার কিশোরীচাঁদ মিত্র এঁর সম্বন্ধে লিখেছেন—

‘He was regarded a friend, philosopher and guide. But he was unfortunately neither a faithful friend, a good philosopher, nor an infallible guide. He was on the contrary a principle of evil introduced into the Nator Raj for its destruction’। ১৫৯ বেনামে তিনিই প্রভুর সম্পত্তি হস্তগত করতে লাগলেন। অপরাপর জমি কিনলেন জানবাজারের কৈবর্ত বংশের প্রতিষ্ঠাতা প্রীতিরাম মাড়, (রানী রাসমণির শ্বশুর), রাণাঘাটের পালচৌধুরী বংশ, শ্রীরামপুরের গোঁসাইবাবুরা এবং আরো অনেকে। ১৬০

কথিত আছে রাজা রামকৃষ্ণ বিষয়ে এতই বিরক্ত ছিলেন যে, তাঁর জমিদারী যেমন লাটে নিলামে চড়ত তিনি অমনি কালীবাড়িতে মহাসমারোহে পুজো দিয়ে বলতেন, ভালোই হল, এক একটি করে বিষয় বন্ধন ছিন্ন হচ্ছে। ১৬১ বড়নগরে ও ভবানীপুরে তাঁর পঞ্চমুণ্ডীর আসন ছিল এবং তিনি শবসাধনায় সিদ্ধ হয়েছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দী বিশেষ করে কালী সাধনার যুগ। এই সাধনায় রাজা রামকৃষ্ণ ও তাঁর সমসাময়িক সাধক কবি রামপ্রসাদ দেশজোড়া প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। কোন কিছুই রাজা রামকৃষ্ণের সাধনায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারত না। ভবানীপুরে তখন ডাকাতদের ভীষণ দৌরাত্ম্য। কথিত আছে, রাজা রামকৃষ্ণ যখন জপে বসেছিলেন, তখন ডাকাতদল ভবানীপুর লুঠ করতে এসে সম্মুখে কালীর রণরঙ্গিনী মূর্তি দেখে সভয়ে পলায়ন করে। ১৬২ রাজা রামকৃষ্ণের শাক্ত পদাবলী আজও গীত হয়।

‘জয় কালী’ ‘জয় কালী’ বলে যদি আমার প্রাণ যায়,
শিবত্ব হইব প্রাপ্ত, কাজ কি বারাণসী তায়।
অনন্তরূপিণী কালী, কালীর অন্ত কেবা পায়?
কিঞ্চিৎ মাহাত্ম জেনে শিব পড়েছেন রাঙ্গা পায়॥ ১৬৩
কিন্তু যাঁর
আঁখি ঢুলু ঢুলু রজনী দিনে,
কালী নামামৃত পীযূষ পানে॥

তাঁর জমিদারী চলে না, আর সর্বশক্তিমান সাহেবদের কাছেও সে প্রকার সাধনার কোনো সমাদর নেই। তাই সাহেবরা যেমন তাঁর মাকে ব্রাহ্মণ পালনের দায়ে ‘Prist-ridder at home,’ বা ‘slave within the walls of her harem to a set of the most cruel, unprincipled beings,১৬৪ ইত্যাদি বাছা বাছা গাল দিয়েছিল, তেমনি তাঁর বিরুদ্ধেও লর্ড কর্ণওয়ালিসের বলতে বাধল না:

‘I do not see that the Goverment is bound to make allowances for the incapacity or mismanagement of the Zemindar, both of which I believe do exist in a very great degree. From all that I can learn of the character and conduct of the Zemindar, I believe him to be very dissipated and inattentive to the duties of his situation and that the embarrassments under which he labours are principally imputable to his own misconduct.’১৬৫ অতএব মৃত্যুর আগে রাজা রামকৃষ্ণ এক বছর সাজোয়ালের আওতায় নজরবন্দী থেকে সম্পত্তি বাঁচাবার বৃথা চেষ্টায় নাবালক পুত্রের নামে জমিদারী লিখিয়ে দিলেন যাতে কোর্ট অফ ওয়ার্ড্স-এর রক্ষণাবেক্ষণে জমিদারী টিকে থাকে। দরিদ্র বালক থেকে তিনি রাজা হয়েছিলেন কিন্তু রাজা হয়ে সংসারের সঙ্গে সাধকের যে পরিচয় হল তা সুখের নয়:

এখনো কি ব্রহ্মময়ি, হয়নি মা তোর মনের মত?
অকৃতি সন্তানের প্রতি বঞ্চনা কর মা কত॥
দম দিয়ে ভবে আনিলি, বিষয় বিষ খাওয়াইলি
সংসার-বিষে যত জ্বলি, দুর্গা দুর্গা বলি তত,
বিষয় হর মা বিষহরি মৃত্যুঞ্জয়ের মৃত্যু হত।
জ্ঞানরত্ন দিয়েছিলি, মসিল দে তসিল১৬৬ করিলি,
হিসাব করে দেখ মা তারা, দুঃখের ফাজিল বাকি কত॥ ১৬৭

সে এমন এক সংসার যেখানে রায়তের উপর ইজারাদার মহসিল বসিয়ে রেখেছে, আর রাজার উপর সরকার বসিয়েছেন সাজোয়াল। সাধক রামপ্রসাদ জীবনের সায়াহ্নে নানা কষ্টের মধ্যেও যে শান্তি পেয়েছিলেন, রাজা রামকৃষ্ণ তা পেয়েছিলেন বলে মনে হয় না। রানী ভবানীর জীবৎকালেই অশেষ যাতনার মধ্যে তাঁর জীবনদীপ নির্বাপিত হয়। তাঁর শেষ সিদ্ধিলাভ ও তদনন্তর পরলোকগমন লোকের স্মৃতিতে কল্পনার সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে এক অত্যাশ্চর্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কথিত আছে, ভবানীপুরের পীঠস্থানে রাজা রামকৃষ্ণ যখন শেষ সাধনায় আসীন, তখন দেবী ভবানী স্বয়ং আবির্ভূত হয়ে তাঁকে আদেশ করলেন—‘তুমি আমার আরাধন কি করিতেছ। তোমার মাতা ভবানী—আমার অংশরূপিনী। যদি আমার অনুকম্পা পাইতে চাও, জননীর চরণে শরণাপন্ন হও।’১৬৮ মহারাজের সঙ্গে রানীমাতার দেখাসাক্ষাৎ বাক্যালাপ এক প্রকার বন্ধ ছিল। দেবীর প্রত্যাদেশ শুনেও পঞ্চমুণ্ডীর আসন ত্যাগ না করায় গভীর নিশীথে রাজা প্রচণ্ড বেগে ভবানীপুর থেকে দক্ষিণাভিমুখে বড়নগরের দিকে উৎক্ষিপ্ত হন। পর দিন প্রভাতে পাকুড়িয়ার সেতুর কাছে তাঁর গুরুবংশের ঠাকুররা তাঁকে কুড়িয়ে পেয়ে বড়নগরে ধরাধরি করে নিয়ে আসেন। মার আদেশ না শুনে রাজকার্য অগ্রাহ্য করে সাধনায় মগ্ন থাকার অপরাধে তাঁর প্রতি দেবীর এই শাস্তি।১৬৯ ত্রিরাত্রি গঙ্গাবাস করে গঙ্গাজলে মায়ের পায়ে মাথা রেখে শেষ গান গাইতে গাইতে রামকৃষ্ণের জীবনলীলা সাঙ্গ হল।

মন যদি মোর ভুলে
তবে বালির শয্যায় কালীর নাম দিও কর্ণমূলে।
এ দেহ আপনার নয় রিপু-সঙ্গে চলে;
আনরে ভোলা জপের মালা ভাসি গঙ্গাজলে।
ভয় পেয়ে রামকৃষ্ণ ভোলা প্রতি বলে—
আমার ইষ্ট প্রতি দৃষ্টি খাটো, কি আছে কপালে॥ ১৭০

আট বছর আগে রাজার রাজ্যগ্রহণকালে সরকারের কাছে তাঁর মার আবেদনপত্রে দেখা যায়, নিজের শ্রাদ্ধের জন্য রানী ভবানী তাঁকে দত্তক নিয়েছিলেন। ১৭১ কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুত্রের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া মাকেই দেখতে হল।

উপন্যাসকার দুর্গাদাস লাহিড়ী লিখেছেন, এর পর চোখের জল মুছে রানী ভবানী পুনরায় বিষয়কর্মের ভার নেন।১৭২ প্রকৃতপক্ষে রামকৃষ্ণের নাবালক পুত্রের ও জমিদারী পরিচালনার ভার তখন সরকার নিযুক্ত কোর্ট অফ ওয়ার্ডস-এর উপর ন্যস্ত ছিল। সরকারি পরিচালনাতেই কয়েক বছরের মধ্যে সাড়ে নয় লক্ষ টাকা খাজনা বাকি পড়ায় নিঃসন্দেহে প্রমাণ হয়ে গেল কি পরিমাণ বর্দ্ধিত খাজনার দায়ে ইংরাজরা রাজাকে নজরবন্দী করে রেখেছিল। ১৭৯৮ শীস্টাব্দে কুমার বিশ্বনাথ আঠার বছরে পদার্পণ করা মাত্র ইংরাজরা জোর করে তাঁর হাতে জমিদারী ধরিয়ে দিল। কোর্ট অফ ওয়ার্ড্স্-এর অধীনে জমি নিলামে ওঠা সম্ভব ছিল না। যেই নাটোর রাজ্যের অবশিষ্ট অংশ কোর্ট অফ ওয়ার্ড্স্-এর আওতা থেকে বেরিয়ে এল, অমনি এক বছরের মধ্যে সমস্ত লাটে উঠল। তশ রাজার পদমর্যাদা ও দারিদ্র্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে কোম্পানি বাহাদুর অনুকম্পাবশে মাসিক আটশো টাকা মাসোহারা ধার্য করে দিলেন। নিলামে ওঠার সময় রানী ভবানী মুর্শিদাবাদের অন্তর্গত হুদা বড়নগর সমেত তিনটি মহল নিজের নামে কিনে রাখলেন। রাজা বিশ্বনাথও বেনামীতে কয়েকটি মহল ক্রয় করলেন। এই ভাবে জমিদারীর কয়েকটি খণ্ড অংশ সম্বলিত মোট ৮৮ হাজার টাকা জমা এবং দেবোত্তর সম্পত্তিগুলি রক্ষা পেল।১৭৩ রানী ভবানী ও তাঁর পরিজনবর্গ একেবারে পথে বসলেন না। কিন্তু পরিবারের দুরবস্থা বশত রানীর মৃত্যুর পর কাশীতে তাঁর যে সব অতুল কীর্তি ছিল সেগুলির এমন দশা হল যে অদৃষ্টের পরিহাসে তাঁরই এক কালের লাঠিয়াল এবং জমিদারীর সর্বনাশ-সাধক দেওয়ান কালীশঙ্কর রায় বৃদ্ধবয়সে কাশীবাসী হয়ে সেগুলির উত্তমরূপে সংস্কার করিয়ে দিলেন। ১৭৪

শেষ বয়সে গঙ্গাতীরবাসিনী রানী ভবানী কঠোর ব্রহ্মচর্য ও জপতপের মধ্যে দিয়ে সারা দিন অতিবাহিত করতেন। সংসারের ঝড়ঝাপটা শোক-তাপ তাঁকে স্পর্শ করত কিনা তা তিনি জানতেন আর তাঁর অন্তর্যামী জানতেন। তাঁর পূজার নিয়ম অত্যন্ত কঠিন ছিল। নীলমণি বসাকের বর্ণনা অনুযায়ী প্রত্যহ রাত চার দণ্ড থাকতে তিনি গাত্রোত্থান করে জপে বসতেন। রাত্রি দেড় দণ্ডের সময় শুতে যেতেন। ‘তিনি মধ্যমকায়া ও অতি সুন্দরী ছিলেন, এবং যদিও অত্যন্ত প্রাচীনা হইয়াছিলেন তথাপি পশ্চাৎ হইতে দেখিলে তাঁহাকে বিংশতিবর্ষা যুবতীর ন্যায় বোধ হইত। তাঁহার দন্তমাত্র ছিল না, কিন্তু কেশ কালো ছিল, কেবল সম্মুখের কয়েক গাছা কেশ পাকিয়াছিল মাত্র। এত বয়ঃক্রমেও তাঁহার এমন সামর্থ্য ছিল যে নিত্য পূজাদি করিয়া স্বহস্তে পাক করিয়া ভোজন করিতেন, এক দিনের নিমিত্ত ও ঐ নিয়মের অন্যথা হয় নাই।’১৭৫

সন ১২০৩ বঙ্গাব্দের মাঘী পূর্ণিমায় রানী ভবানী ৭৯ বছর বয়সে সজ্ঞানে গঙ্গালাভ করেন। শেষ বয়সে তাঁর ভাগ্যের বিড়ম্বনার অন্ত ছিল না। সেই গোটা যুগটাই বাংলার ইতিহাসে ঘোর তমসাবৃত যুগ ছিল। কথায় বলত, ‘কোথায় রানী ভবানী, কোথায় ফুলী জেলেনী।’১৭৬ কিন্তু সর্ব স্তরের ভাগ্য বিপর্যয়ে কি রানী ভবানী কি ফুলী জেলেনী কেউ পরিত্রাণ পায়নি। যে দুর্ভিক্ষে ফুলী জেলেনীরা না খেয়ে মরেছিল সেই দুর্ভিক্ষে রানী ভবানী, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ইত্যাদির রাজ্যপাটও উচ্ছন্নে গিয়েছিল। সেই দেশ-জোড়া দুর্ভিক্ষ ও রাষ্ট্রবিপ্লবের দিনে বাঙালির প্রাণের যে কথাটা সাধক রামপ্রসাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে গঙ্গাতীরস্থ শ্মশানের বালুশয্যায় তার সান্ধ্যকালীন অনুরণন রেখে গিয়েছিল তা এই:

মা, খেলবি বলে, ফাঁকি দিয়ে নাবালে ভূতলে।
এবার যে খেলা খেলালে মাগো, আশা না পূরিল॥
রামপ্রসাদ বলে, ভবের খেলায়, যা হবার তা হলো।
এখন সন্ধ্যাবেলায়, কোলের ছেলে, ঘরে নিয়ে চলো॥ ১৭৭

.

টীকা

১। ‘But as the bad consequences of payment of any part of the money appeared to us too evident to be allowed of, we have wrote the Colonel our sentiments there on and desired the Gentlemen of the Select Committee who are at Muxadabad to use their best endavours to obtain immediate payment, but if that is not to be done, to get some good security from the Nabob to abide by his contract…’ Select Committee at Fort William to Select Committee Londan, 14 July 1757, Bengal in 1756-57, Vol II, PP. 445-453.

২। Watts and Walsh to Clive, 26 June 1757, Ibid, p. 430, Clive to Secret Committee London, 26 July 1757, Ibid, p. 460.

৩। Evidence of Clive before Select Committe 1772. Ibid, III, p. 325

৪। Ibid, p. 318

৫। এই মতে জত সব গ্রাম পোড়াইয়া।
চতুর্দিকে বরগি বেড়াএ লুটীয়া॥
কাহুকে বাঁধে বরগি দিয়া পিঠ মোড়া।
চিত কইরা মারে লাথি পাএ জুতা চড়া॥
রূপি দেহ রূপি দেহ বোলে বারে বারে।
রূপি না পাইয়া তবে নাকে জল ভরে॥
মহারাষ্ট্র পুরাণ।

৬। Percival Spear, Master of Bengal, Clive and His India (London 1975), p. 189

৭। Clive to his father, 19 August 1757, Bengal in 1756-57, III, p. 360

৮। Clivie’s evidence to Select Committee 1772, Ibid, pp. 312-313.

৯। Seir II, p. 262.

১০। ‘এইরূপে নবাব জাফরালী খাঁ পুনর্ব্বার ২ বৎসর সুবেদারী করিয়া সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে নিমখারামির ফল গলৎ কুষ্ঠরোগে মরিলেন।’ মৃত্যুঞ্জয় শর্ম্মা রাজাবলী, ১৬৮ পৃঃ। এর উপর অশীন দাশগুপ্তর মন্তব্যটিও প্রণিধানযোগ্য: ‘মীরজাফরের শেষ অসুখ সিরাজের সঙ্গে নিমকহারামীর ফল এমন কথা ডাক্তারী শাস্ত্রে বলে না। মীরনের মাথায় বাজ পড়াটাও প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা।’

১১। রাজাবলী, ১৭০-১৭১ পৃঃ

১২। Sushil Chaudhun, ‘Khwaja Wazid in Bengal Trade and Politics, Indian Hisconcal Review, vol XVI, nos. 1-2, 1989, 1990.

১৩। Long, Selections, no. 624.

১৪। Grant, Analysis, p. 394.

১৫। Grant, Analysis, p. 393.

১৬। Grant, Analysis, p. 394: Long, Selections, no. 556.

১৭। Long, Selections, no. 556; S. C. Nandy, Life and Times of Canto Babu, Vol 1. p. 575.

১৮। Long, Selections, no. 776.

১৯। Grant, Analysis, p. 395

২০। Ibid, p. 389

২১। পাবনা জেলার নাকালিয়া গ্রামের অখ্যাত গ্রাম্য কবি রামপ্রসাদ মৈত্রেয় রচিত। অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় (সম্পাঃ), ঐতিহাসিক চিত্র, ১ম বর্ষ, ১ম খণ্ড, জানুয়ারি ১৮৯৯, ৯৭ পৃঃ।

২২। সে যুগের কবি রামপ্রসাদের গানের কলি। পলাশীর আগে না পরে লিথিত সে তারিখ নেই, পরেকার হওয়াই অধিকতর সম্ভবপর।

২৩। ‘…all the revenue is anticipated for the payment of the amy and for the provision of the Company’s investment.’ Barwell to his father, 4 October 1769. quoted in Khan, Transition in Bengal, p. 211.

২৪। The Letter Copy Books of the Resident at the Durbar at Murshidabad, ed W.K. Firminger (Calcutta 1919) Vol I, pp. XI-XIV, Becher’s letter, 24 May 1769.

২৫। Abdul Majed Khan, The Transition in Bengal, PP 163, 168.

২৬। Letter Copy Books of the Resident at the Durbar, Becher’s letter 24 May 1769.

২৭। Letter Copy Book of the Supervisor of Rajshahi at Nator, Letters Issued 30 December 1769 to 15 September 1772, (Calcutta 1925).p 22

২৮। Letter from Boughton Rous’, no date, Ibid. p 20.

২৯। প্রশ্নটি তোলেন মুর্শিদাবাদের রেসিডেন্ট সাইন্স। Khan, Transition in Bengal, pp. 160, 162.

৩০। মফস্বলে সুপারভাইজার লাগাতে পারলে রাজস্ব আদায়ের ছলে অনেক উপরি পাওনা হবে এবং অভ্যন্তরে আরো নিষ্ঠুর বাণিজ্য বিস্তার করা যাবে এই ভরসা ইংরেজদের মনে ছিল। Ibid, p. 165, 198

৩১। Loughton Rous to Warren Hastings, 25 August 1772. Ibid, p. 50: Rous to Richard Becher, 22 June, 1770. Letter Copy Book Natore, pp. 24-25

৩২। Rous to Hastings, 25 August 1772 Ibid, p. 50 আমিলরা সরে যাবার পর সুপারভাইজরদের কোপ গিয়ে পড়েছিল দেশের জমিদারদের উপর। ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ খ্রীস্টাব্দে সুপারভাইজারদের সম্বন্ধে মন্তব্য করেন। ‘sovereigns of the country…heavy rulers of the people.’ Khan, Transition in Bengal, p. 275

৩৩। Rous to Bocher 16 February 1770, Letter Copy Book Natore, p 6

৩৪। Khan, Transition in Bengal, p. 185

৩৫। Rous to Becher, 22 June 1770. Letter Copy Book at Natore. p. 23

৩৬। Ibid, p. 24

৩৭। Rous to Bocher, 10 May 1770, Ibid, p. 17.

৩৮। Rous to Bccher, 26 March 1770. Ibid, p. 11.

৩৯। Rous to Bocher, 10 May 1770, Ibid, p. 13.

৪০। Letter from Rous, no date, Ibid, p. 20.

৪১। পরে রাউজ স্বীকার করেছিলেন: ‘আমি এমন সব ব্যক্তিগত সুবিধা পেয়েছিলাম যা আমি মনে মনে নিন্দা করতাম।’ Marshall, East Indian Forhenes, p. 197.

৪২। Henry Vansittart, A Narrative of the Transactions in Bengal 1760-1764 (1766, Calcutta reprint 1976). pp. 193-194.

৪৩। Vansittart, Narative, pp. 148-149, 191-192, 431

৪৪। Verelst’s letter, received 16 December 1769, Quoted in Khan, Transition in Bengal, p 190

৪৫। Long, Selections, no. 715

৪৬। এই হিসাব Private Trade বাদ দিয়ে। Khan, Tansition in Bengal, p. 182 n.

৪৭। উপরোক্ত রূপা আমদানির হিসাবের জন্য দেখুন Khan, Transition in Bengal, pp. 174-175.

৪৮। Ibid, pp. 166-167.

৪৯। Reza Khan’s ‘proposition,’ 28 March 1769, quoted in Khan, Transition in Bengal, pp. 172-177.

৫০। Reza Khan’s ‘proposition’

৫১। Khan, Transition in Bengal, p. 183

৫২। Vereist’s letter of 5 June 1769. Ibid, p. 182

৫৩। William Bolls, Comsiderations on Indian Affairs (London 1772). pp. 194-195. সম্ভবত এই ঘটনাই পরবর্তীকালে পল্লবিত আকারে প্রকাশ হয় এবং রটে যায় যে ম্যানচেস্টারের কাপড় বেচবার জন্য ইংরেজরা তাঁতীদের বুড়ো আঙুল কেটে দিত। মনে রাখতে হবে যে তাঁতীদের হটিয়ে ম্যানচেস্টারের কাপড়ের প্রসার অনেক পরবর্তীকালের ঘটনা—১৮২০ নাগাদ তা শুরু হয়। তাঁতীদের আঙুল কাটার গল্প নিছক কল্পনা। কিন্তু ওই কল্পনার ভিত্তি সম্ভবত নকাদের স্বেচ্ছায় বুড়া আঙুল কর্তন এবং যদিও এর কোন দলিল প্রমাণ কোম্পানির কাগজপত্রে নেই, তবু এ ঘটনা সত্য হওয়া অসম্ভব নয়।

৫৪। Reza Khan’s letter received 19 February 1766, quoted in Transition in Bengal, pp. 142-143.

৫৫। Rous to Bocher, 26 March 1770, Letter Copy Book Natore, pp. 11-12

৫৬। ‘…all I ask is some means of sustenance’ (sic). Rous to Becher, 22 June 1770. Ibid, pp. 21-22 ১১৭৪ সনে খাজনা অনেক কমানো হয়েছিল। রাজা চাইছিলেন প্রজারা সেই হারে খাজনা দিক।

৫৭। Warren Hastings to C. Colebrooke 26 March 1772, quoted in Marshall, East Indian Fortunes, p. 140.

৫৮। Ibid

৫৯। ৩০ মে ডিসেম্বর ১৭৬৯-এ তিনি নাটোর থেকে পৌঁছ সংবাদ লিখছেন। Letter Copy Book Natore, p. 1.

৬০। Rous to Becher, 16 February 1769, Ibid, p. 6

৬১। Rous to Becher I March 1770, Ibid. p. 10

৬২। ‘In a year of such universal distress and wretchedness as the whole Provinces of Bengal and Bahar have experienced from the excessive Drought of the season, such as has not been known in the memory of the oldest Inhabitants; it is not to be supposed that the Districts placed under my Inspection, can have altogether escaped the general calamity…the far greatest Part of this Harvest is totally parched and destroyed without even the possibility of Recovery. I have hitherto avoided to alarm your apprehensions: but I should be deficient in my duty, if I were any longer to delay to represent to your view the real situation of affairs, and the lamentable prospect which presents itself for the future Prosperity of the country. Extensive Lakes, which never before failed to water the lands in the Bhettoriah district during the hot season, are now totally dried up by which the Harvest is destroyed; & I fear the Lives of the people will be endangered…Already I have advice, that there has been frequent Desertion and Fatality in some of the northern Pergunnahs…’ Rous to Becher, 10 May 1770, Ibid, pp. 15-16.

৬৩। Hunter—‘In the early part of 1769 high prices (note: Letter from the President and Council to the Court of Directors, dated Fort William, 30 September 1769) had ruled owing to the partial failure of the crops in 1768, but the Scarcity had not been so severe as matenally to affect the Government rental.’ Annals of Rural Bengal, p. 20.

৬৪। উদ্ধৃতি: অনিমা মুখোপাধ্যায়, আঠার শতকের বাংলা পুঁথিতে ইতিহাস প্রসঙ্গ, (কলকাতা ১৯৮৭), ৪৪ পৃঃ। প্রাক্-মন্বন্তর খরা সংক্রান্ত চিঠি।

৬৫। ‘The Revenues were never so closely collected before’—Resident at the Durbar, 7 February 1769. quoted by Hunter, p 21. note.

৬৬। Hunter—‘…the rains of 1769, although deficient in the northern districts, seemed for a time to promise relief (n Mr. Rumbold, chief of Bahar, at the consulation of 16th August 1769). In the Delta they had been so abundant as to cause temporary loss from inundation; and during the succeeding year of general famine, the whole of south-East Bengal uttered no complaint (n. Mr. Becher, Resident at the Durbar, 30th March 1770). The September harvest, indeed, was sufficient to enable the Bengal Council to promise grain to Madras on a large scale (note: Letter from the President and Council to the Court of Directors, dated 25th Septembar. 1769), not withstanding the high prices.’ Annals, p. 21

৬৭। N. K. Sinha, Economic History of Bengal, Vol II. p. 48, also citing above letter to court, 25 Septenber 1769.

৬৮। বিজয় রাম সেন, তীর্থমঙ্গল (সম্পাঃ নগেন্দ্রনাথ বসু, কলকাতা ১৩২২), ৩৮ পৃঃ। যাত্রা শেষে ১১৭৭ সনের ভাদ্রমাসে এই পুস্তক মহা সমারোহে সভায় পঠিত হয়। গ্রন্থের আভ্যন্তরীণ প্রমাণ অনুযায়ী গ্রন্থাকার ১৬৯১ শকের (১৭৬৯) প্রথমেই তীর্থযাত্রায় নির্গত হন। গ্রন্থে দুর্ভিক্ষের উল্লেখ নেই, আছে গতানুগতিক ধুমধাম।

৬৯। Hunter— But in that month (Septamber) the periodical rains prenaturely ceased, and the crop which depended on them for existence [the winter nice of Aman] withered. “The fields of rice,” wrote the native superintendent of Bishenpore at a later period, “are become like fields of dried straw”… The Government had deemed it necessary to lay in a supply for the troops…’ Annals, pp. 21-22.

৭০। Hunter—‘In April a scanty spring harvest was gathered (n the spring crops proved deficient—Lelter from the President and Council to the court of Directors, dated 9th May 1770)’ Annals, Pp. 23-24..

৭১। Hunter— ‘the Council, acting upon the advice of its Mussulman Minister of Finance, added ten per cent to the land tax for the ensuing year (n letter from the President and Council to the Court of Directors, dated 11 September 1770). Annals, p. 23.

৭২। Hunter—‘All through the stifling summer of 1770 the people went on dying. The husbandamen sold their cattle; they sold their implements of agriculture; they devoured their seed grain; they sold their sons and daughters, till at length no buyer of children could be found (n. petition of Mahomed Ala Khan, Foujder of Punreah, consultations, 28 April 1770; they ate the leaves of trees (n. Petition of Ujaggar Mull, Amil of Jessore—consultation of 28 April 1770) and the grass of the field, and in June 1770 the Resident at the Durbar affirmed that the living were feeding on the dead (n. letter of the 2nd June. Consultation of 9th June 1770). Day and night a torrent of famished and discase stricker wretches poured into the great cities.’ Annals, pp. 26-27.

৭৩। Hunter— ‘At an early period of the year pestilence had broken out. In March we find small pox at Moorshedabad, where it glided through the Viceregal mutes, and cut off the prince Syful [nawab Saifuddaulah, son of Mir Jafar and the then Nazim of Bengal] in his place (n. letter from the President and Council to the Court of Directors, dated 18th March 1770). The streets were blocked up with promiscuous heaps of the dying and the dead. Intement could not do its work quick enough; even the dogs and jackals, the public scavengers of the East became unable to accomplish their revolting work, and the multitude of mangled and festering corpses at length threatened the existence of the citizens.’ Annals, p. 27.

৭৪। তীর্থমঙ্গল, ১৫৫ পৃঃ।

৭৫। রায়ত (ফার্সী শব্দ)—রি’ আইয়া (বহুবচন)।

৭৬। Quoted in Khan, Transition in Bengal, pp. 226-227.

৭৭। ‘তীর্থমঙ্গলে’ প্রাকৃতিক বর্ণনা নেই, কিন্তু এক জায়গায় দেখি কবি পাটনা থেকে গয়া যাবার পথ সম্পর্কে বলছেন:

রৌদ্রে পীড়িত হয়্যা জত যাত্রীগণ।

ইন্দারার সন্নিধানে আইল ততক্ষণ॥

তখনী বাঁচিল যাত্রী খায়্যা সেই জল।

সেদিন মোকাম হৈল অশ্বত্থের তল॥ ৭০পৃঃ

৭৮। Khan, Transition in Bengal, p. 224.

৭৯। Quoted in Khan, Transition in Bengal, pp. 219-220

৮০। পঞ্চানন মণ্ডল (সম্পাঃ), পুঁথি পরিচয়, ৪র্থ খণ্ড (শান্তিনিকেতন ১৯৮০), ৭০-৭১ পৃঃ।

৮১। Khan, Transition in Bengal, p. 220.

৮২। Ainslic T. Embree, Charles Grant and British Rule in India (Sondon 1962), p 36

৮৩। নিখিল সুর, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ও সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ (কলকাতা ১৯৮১), ২৪-২৫ পৃঃ

৮৪। দিগদর্শন ১৮২০ ‘বঙ্গভূমি মহাদুর্ভিক্ষ; উদ্ধৃতি: অণিমা মুখোপাধ্যায়, পুঁথিতে ইতিহাস; ৭৭ পৃঃ।

৮৫। From President and Council to Court of Directors, 11 September 1770, Quoted in Hunter, Annals, p. 30.

৮৬। অপরিচিত প্রাচীন শব্দ। বেলদার শব্দের প্রতিশব্দ হতে পারে। বেলদার অর্থ কোদালিয়া, কুড়ালিয়া, মজুর।

৮৭। গাঁয়ে গেরস্ত বাড়ির সম্বৎসরের চাকর। যাকে দিয়ে চাষ করানো হয়।

৮৮। Hunter, Annals, pp 30-31.

৮৯। Rous to Warren Hastings, 10 August 1772, Letter Copy Book Nator, p. 48

৯০। N. K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. II, p. 51.

৯১। Letter from Rous, 13 April 1771, Quoted by Hunter, Annals, p. 70.

৯২। Singh, Economic History, vol II, p. 51.

৯৩। সুপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, ইতিহাসাশ্রিত বাংলা কবিতা (১৭৫১-১৮৫৫) (কলকাতা ১৩৬১), ৮৬ পৃঃ

৯৪। Khan, Transition in Bengal, p. 218

৯৫। Ibid, p. 227.

৯৬। N.K. Sinha, Econownic History of Bengal, Vol II, p. 59.

৯৭। নিখিল শূর, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ২০ পৃঃ।

৯৮। Khan, Transition in Bengal, p. 222.

৯৯। Sinha, Economic History, vol II, p. 59

১০০। Khan, Transition in Bengal, p. 222.

১০১। নিখিল শূর, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, ২০ পৃঃ

১০২। Khan, Transition in Bengal, p. 305

১০৩। Ibid, p. 221

১০৪। তীর্থমঙ্গল, ১৫২ পৃঃ।

১০৫। নীলমণি বসাক, নবনারী, ৩১৩ পৃঃ।

১০৬। দুর্গাদাস লাহিড়ী, রানী ভবানী, ৪৩৪ পৃঃ।

১০৭। Rous to Becher, 6 January 1770, Letter Copy Book Nator, p. 2-3.

১০৮। A. N. Chandra, The Sannyasi Rebellion (Calcutta 1977), p. 51 n.

১০৯। Ibid, p. 51 n.

১১০। S. C. Nandy, Cantoo Baboo, Vol I, p. 576.

১১১। A. N. Chandra, Sannyasi Rebellion, pp. 19, 51, 53.

১১২। এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে বাংলাদেশে বৈষ্ণবরা গোঁসাই বলে অভিহিত হলেও উত্তর ভারতে শৈব নাগা সন্ন্যাসীদের গোঁসাই বলা হত।

১১৩। Ibid, pp.70, 67, 76.

১১৪। Ibid, pp. 120, 126; রণজিৎ কুমার সমাদ্দার, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে স্থানীয় বিদ্রোহের প্রভাব, (কলকাতা ১৯৮২) ৪১ পৃঃ।

১১৫। পঞ্চানন দাস কর্তৃক ১৯২০ সালের ১৪ কার্ত্তিক রচিত।

১১৬। উদ্ধৃতি রণজিৎকুমার সমাদ্দার, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে স্থানীয় বিদ্রোহের প্রভাব, ৬৩-৬৪ পৃঃ।

১১৭। ১২২০ সালে লিখিত (১৮১৩)। উদ্ধৃতি: সুপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, ইতিহাসাশ্রিত বাংলা কবিতা, ৮৪ পৃঃ।

১১৮। জমিদার ও প্রজাদের উপর অত্যাচারের প্যাটারসন দত্ত বিবরণ পাওয়া যাবে নিম্নোক্ত গ্রহে: Narahari Kabiraj, A Peasant Uprising in Bengal 1783 (New Delhi 1972). pp. 47-62

১১৯। দেবী সিংহ প্রকৃতপক্ষে রাজপুত ছিলেন না। তিনি আগরওয়াল জাতির লোক।

১২০। A. N. Chandra, The Sannyasi Rebellion, pp. 140-143.

১২১। উদ্ধৃতি: Narahari Kabiraj, A Peasant Uprising, pp. 97-102.

১২২। Jadunath Sarkar, Bengal Nawabs, pp. 60-61.

১২৩। E Strachey Judge of Rajshahis’ notes, 13 June 1808, Fifty Report, pp. 787-800

১২৪। সুপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, ইতিহাসাশ্রিত বাংলা কবিতা, ৭৪ পৃঃ

১২৫। Raja Nabkishen to Henry Strachey, 23 March 1776, Philip Francis Papers, Francis Mss. Eur. F. 7 (India office Records).

১২৬। ‘An Account of Exactions by the undementioned Persons from Ramkissen the Rajah of Rajshaye Pergunnah &c., dated 9 May 1775, Quoted in N. K. Sinha. Economic History of Bengal, Vol II. pp. 96-97

১২৭। S. C. Nandy, Cantoo Baboo, vol 1. p. 67.

১২৮। Petition of Rani Bhowani, 1775. quoted in N. K. Sinha, Economic Iristory of Bengal. Vol II, pp. 73-75.

১২৯। Ibid, p. 75.

১৩০। S. C. Nandy, Cantoo Baboo, vol I. p. 67

১৩১। N. K. Sinha, Economic History of Bengal, Vol II. p. 104

১৩২। S.C. Nandy, Cntoo Baboo, Vol I, p. 65

১৩৩। Ibid, p. 66.

১৩৪। James Grant, Analysis, p. 397.

১৩৫। আবোয়াব ১৪ ২১১/২লক্ষ, কর্তনী ১ লক্ষ

১৩৬। ১৭৫৭-র আসল ২০ লক্ষ টাকার উপর ৬ লক্ষ টাকার ঘাটতি, অথাৎ এক তৃতীয়াংশ ঘাটতি

১৩৭। ১৭৫৭-র করের পরিমাণ (আসল) মোট ২০ লক্ষ; ১৭৭৬ কণের পরিমাণ (আসল, আবোয়াব ও কর্তনী) মোট ২২ লক্ষ (সদর জমা। আমিনী কমিশন প্রদর্শিত মফস্বল জমা আরো বেশী)

১৩৮। Ratnalekha Ray, Bengal Agrarian Society, pp. 49-50.

১৩৯। Ibid, p. 56

১৪০। Speke’s rport on Rajshahi, 23 May 1788, Ibid, p. 48.

১৪১। Ibid, p. 265

১৪২। Speke’s report on Rajshahi, 23 May 1788; Ibid, p. 73.

১৪৩। Ibid, p. 69n.

১৪৪। James Grant, ‘Analysis’, p. 401.

১৪৫। Petition of Rani Bhawani, received 2 January 1788. Calender of Persian Correspondence, Vol VIII, no. 13.

১৪৬। N. K. Sinha, Economic History of Bengal, vol II. p. 124.

১৪৭। নিখিল নাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, ২৯৮-৮ পৃঃ।

১৪৮। দুগাদাস লাহিড়ী, রানী ভবানী, ৪৫৭-৮ পৃ:

১৪৯। ১৮৩৮ খ্রীস্টাব্দে এই resumption proceedings বা নিষ্কর জমির উপর কর বসানো হয় এবং তার প্রতিবাদে বাঙালি জমিদাররা প্রথম ‘ভূমধ্যকারী সভা’ গঠন করেন।

১৫০। নীলমনি বসাক, নবনারী, ৩০৬-৩০৮ পৃঃ।

১৫১। দুর্গাদাস লাহিড়ী, রানী ভবানী, ৪৬২-৩।

১৫২। ঐ, ৪৫৩ পৃঃ।

১৫৩। Petition of Raja Ramkrishna, received 9 July 1788. Calendar of Persian Correspondence, Vol VIII, no. 535

১৫৪। James Grant, ‘Analysis,’ p. 400-401

১৫৫। Petition of Rani Bhawani, received 30 April 1788. Ibid, no. 372.

১৫৬। Ibid, nos, 32, 535

১৫৭। Ibid, no. 1300

১৫৮। Sjrajul Islam, The Permanent Settlement in Bengal, a Study of lis Operation 1790-1819 (Dacca 1979), pp 85-87

১৫৯। Kishonchund Mitter, ‘The Rajas of Rajshahi,’ Calcutta Review, Vol. LVI, 1975, p. 15.

১৬০। সতীশ চন্দ্র মিশ্র, যশোহর খুলনার ইতিহাস, ২য় খঃ, ৬২০-৬২১ পৃঃ

১৬১। দুর্গাদাস লাহিড়ী; রাজা রামকৃষ্ণ [উপন্যাস] (২য় সং হাওড়া ১৩১৮), ৩৮৩ পৃঃ।

১৬২। ঐ, ৩৭৩-৮ পৃঃ

১৬৩। অমরেন্দ্রনাথ রায় (সম্পাঃ ), শাক্ত পদাবলী (কলকাতা ১৯৭১), ৩২৮।

১৬৪। James Grant, Analysis, p. 398.

১৬৫। Sirajul Islam, Permanent Settlement in Bengal, p. 88

১৬৬। অর্থাৎ রাজা যেমন প্রজার উপর মহসিল বসিয়ে জোর করে খাজনা তহসিল করেন, কালী জ্ঞানরত্ন দিয়ে তেমন তা হরণ করে নিলেন—সংসার বিষে জ্ঞান হারাল।

১৬৭। অমরেন্দ্রনাথ রায়, শাক্তপদাবলী ১৬২ পৃঃ

১৬৮। দুর্গাদাস লাহিড়ী, রানী ভবানী, ৪৫৫ পৃঃ

১৬৯। তদেব

১৭০। অমরেন্দ্রনাথ রায়, শাক্ত পদাবলী, ২৩৯নং

১৭১। Calender of Persian Correspondence, Vol VIII, No. 372

১৭২। দুর্গাদাস লাহিড়ী, রাজা রামকৃষ্ণ, ৪৫৩ পৃঃ।

১৭৩। Sirajul Islam. Permanent Settlement in Bengal, pp. 89-93.

১৭৪। Ibid, p. 176.

১৭৫। নীলমণি বসাক, নবনারী, ৩১৮-৩১৯ পৃঃ।

১৭৬। সুশীল কুমার দে, বাংলা প্রবাদ, ২০৫১ নং।

১৭৭। অমরেন্দ্রনাথ রায়, শাক্ত পদাবলী ১৫৭নং।

_____

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *