পঞ্চম পরিচ্ছেদ – জুলুম ও প্রতিরোধ
১. সংবাদপত্র ও সরকারবিরোধী প্রচারপত্রের ওপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ ও হামলা
১৯৪৭ সালের অগাস্ট মাসে দেশ বিভাগের সময় ঢাকায় কোন উল্লেখযোগ্য দৈনিক সংবাদপত্র ছিলো না। কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ, মর্নিং নিউজ ও ইত্তেহাদ এই তিনটি পত্রিকার মধ্যে তৃতীয়টি ছিলো শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পত্রিকা। শহীদ সোহরাওয়ার্দী দেশ বিভাগের পর কিছুদিন কলকাতাতেই থাকেন। কাজেই তাঁর পত্রিকা ঢাকাতে স্থানান্তরিত হয়নি। কলকাতায় কিছুদিন পর্যন্ত তার প্রকাশনা চলার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। দৈনিক আজাদ ও মর্নিং নিউজ ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। এ দুটি পত্রিকাই ছিলো সরকার সমর্থক।
সরকার বিরোধী কোন দৈনিক পত্রিকা ১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ইংরেজী দৈনিক পাকিস্তান অবজার্ভার প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে না থাকায় ১৯৪৮ সালের গোড়াতেই ঢাকা থেকে প্রকাশিত তমদ্দুন মজলিশের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিকই (সম্পাদক শাহেদ আলী) ১৯৪৮ সালে ছিলো পূর্ব বাঙলার সব থেকে বহুল প্রচারিত এবং উল্লেখযোগ্য পত্রিকা। এই পত্রিকাটিতে সরকারের অনেক সমালোচনা থাকলেও পত্রিকাটি ছিলো ইসলামী সমাজতন্ত্রের প্রচারক ও কমিউনিস্ট বিরোধী। সেই হিসেবে তাতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের কোন সংবাদ স্থান লাভ করতো না।
১৯৪৮ সাল থেকে সিলেটে মাহমুদ আলীর পরিচালনায় সাপ্তাহিক নওবেলাল প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকাটি মুসলিম লীগ সমর্থক হিসেবে প্রকাশিত হলেও মুসলিম লীগের মধ্যে যে ভাঙন গোড়া থেকেই শুরু হয় তার প্রতিফলন পত্রিকাটিতে ভালভাবেই পাওয়া যায়। পত্রিকাটি কমিউনিস্ট বিরোধী হওয়ার ফলে তাতেও কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিশেষ কোন সংবাদ প্রকৃতপক্ষে প্রকাশিত হতো না। কমিউনিস্টদের ওপর নির্যাতনের কোন প্রতিবাদও তাতে হতো না। কিন্তু কমিউনিস্টদের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গী সত্ত্বেও পত্রিকাটিতে তৎকালীন পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন গণআন্দোলনের যে সব প্রতিবেদন পাওয়া যায় তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান। এদিক দিয়ে বিচার করলে সিলেট থেকে প্রকাশিত এই পত্রিকাটিকে তৎকালীন পূর্ব বাঙলার একটি জাতীয় সাপ্তাহিক হিসেবেও আখ্যায়িত করা যেতে পারে।
পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি অন্যান্য যে পত্রিকাগুলি প্রকাশিত হতো সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান (সম্পাদক, আব্দুস সালাম), ঢাকার অর্ধ সাপ্তাহিক পাকিস্তান (সম্পাদক, মোহাম্মদ মোদাব্বের), ঢাকার যুগের দাবী (সম্পাদক, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস), ঢাকার জিন্দেগী (সম্পাদক, বজলুল হক), চট্টগ্রামের পাঞ্চজন্য (সম্পাদক, অম্বিকাচরণ দাস) ও আজান, সিলেটের যুগভেরী এবং সোনার বাংলা (ঢাকা), সংগ্রাম (নারায়ণগঞ্জ), নকীব (বরিশাল), তালিম (ফেনী), কাফেলা (ঢাকা), New Age (সিলেট), নয়া জামানা (রাজশাহী), খিলাফত (বরিশাল), আনসার (বগুড়া), পাসবান (উর্দু পত্রিকা, ঢাকা), নওবাহার (ঢাকা), ইমরোজ (ঢাকা), Pakistan Today (ঢাকা), ইস্টার্ণ হেরাল্ড (সিলেট) ও দৈনিক এলান (চট্টগ্রাম)।[১]
১৯৪৮ সালের ৯ই জুন পূর্ব বাঙলা সরকার বিশেষ ক্ষমতা অর্ডিন্যান্স নামে একটি নোতুন অর্ডিন্যান্স জারী করেন। ১৯৪৮ সালের ১৬ই মার্চ থেকে এটি বলবৎ হবে বলে সরকারীভাবে ঘোষণা করা হয়। এই অর্ডিন্যান্সটির সাথে একটি ধারা সংযোজিত করে সম্পূর্ণভাবে অথবা বিজ্ঞপ্তিতে বর্ণিত সময়ের জন্যে পূর্ব বাঙলায় সংবাদপত্র, সাময়িক পত্রিকা, পুস্তিকা ও অন্য যে কোন প্রকার মুদ্রিত কাগজপত্রাদির আমদানী নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করা হয়। অর্ডিন্যান্সটির আদেশ কেউ অমান্য করলে তার পাঁচ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড অথবা উভয়বিধ দণ্ডের ব্যবস্থাও অর্ডিন্যান্সটিতে রাখা হয়।[২]
ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ এবং সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের জন্যেই যে উপরোক্ত অর্ডিন্যান্সটি পূর্ব বাঙলা সরকার কর্তৃক জারী করা হয় এবং তার মাধ্যমে সরকারের স্বৈরাচারী রূপই যে সুস্পষ্টভাবে উদঘাটিত হয় সে বিষয়ে ‘স্বৈরাচারের নূতন রূপ’ নামক একটি সম্পাদকীয়তে সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নওবেলাল পত্রিকায় নিম্নলিখিত মন্তব্য করা হয়:
পূর্ব বঙ্গ সরকার প্রতিষ্ঠার পর হইতেই নাজিম মন্ত্রীমণ্ডলী যে নীতি গ্রহণ করিয়াছেন তাহাতে জনসাধারণের মনে ক্রমশঃ এই ধারণাই বদ্ধমূল হইতেছে যে পাকিস্তানে ব্যক্তিস্বাধীনতার কোন সুযোগ থাকিবে না।… পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বঙ্গের প্রাদেশিক সরকার যেভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিয়াছেন তাহাতে স্বভাবতঃই পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বরূপ সম্বন্ধেও সাধারণের মনে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।… সংবাদপত্রের মারফতে অথবা পুস্তিকা আকারে সরকারকে সমালোচনা করা প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট নহেন এমন লোকের দ্বারা সম্ভব হইতে পারে–কিন্তু তার পথও বন্ধ করিবার জন্য নাজিম সরকারের চেষ্টার ত্রুটি নাই। ঢাকার একখানা পত্রিকা এই সরকারের নানাবিধ লাঞ্ছনা সহ্য করিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত কোন জায়গায়ই স্বাধীনভাবে সংবাদপত্র পরিচালনা করার সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে না। পূর্ব বঙ্গ সরকারকে সমালোচনা করার সকল সম্ভাবনা উপরোক্ত সরকার সেইদিন (অর্থাৎ ১ই জুন, ১৯৪৮ ব.উ.) একেবারে নষ্ট করিয়া দিয়াছেন। ….সোজা কথায় সরকার তাহাদের মতের বিরুদ্ধে কোন মুদ্রিত কাগজই পূর্ব বঙ্গে প্রকাশ করিতে দিবেন না। আরও সোজা কথায় বলিতে হইবে সরকার কোন প্রকার সমালোচনাই বরদাশত করিবেন না।…বর্তমানে পূর্ব বঙ্গ সরকার যে রূপ পরিগ্রহ করিতেছে, তাহাতে তাহাকে ফ্যাসিস্ট বলা কোন অবস্থাতেই অন্যায় নহে।[৩]
১৯৪৯ সালের মে মাসে ঢাকার এনফোর্সমেন্ট বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল সিলেটের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে একটি সার্কুলার পাঠিয়ে তাতে কাগজের দুষ্প্রাপ্যতার উল্লেখ করে কাগজের সংকট লাঘবের জন্যে নওবেলাল-এর প্রকাশনা বন্ধ করার নির্দেশ প্রদান করেন।[৪] কিন্তু তা সত্ত্বেও নওবেলাল অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। এর পর ১৮ই অগাস্ট সিলেটের এনফোর্সমেন্ট বিভাগ ডিআইজির আদেশ অনুযায়ী ১৯৪৫ সালের পেপার কনট্রোল অর্ডারের ৯ক ধারা অমান্য করার অপরাধে পত্রিকাটি বন্ধ করার নির্দেশ দেন এবং পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় চার মাস পরে নিষেধাজ্ঞা সরকার কর্তৃক প্রত্যাহার করা হয় এবং নওবেলাল পুনঃপ্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালের ৯ই ডিসেম্বর।[৫]
১৯৪৯ সালের মে মাসে পূর্ব বাঙলা সরকার একটি আদেশ জারী করে ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘ইত্তেহাদ’ ও ‘দি নেশন’ এই চারটি ভারতীয় পত্রিকার পূর্ব বাঙলা প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।৬ এই নিষেধাজ্ঞা কয়েক মাস বলবৎ থাকার পর এর প্রতিবাদে পাকিস্তান ছাত্র লীগের উদ্যোগে ১২ই অগাস্ট ফজলুল হকের সভাপতিত্বে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ একই মাসে পূর্ব বাঙলা সরকার চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্ব পাকিস্তানের নিকট হতে তিন হাজার টাকা জামানত তলব করেন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পাদকীয় ও সংবাদসমূহের ওপর প্রিসেন্সরশীপের নির্দেশ দেন। ঢাকার ইংরেজী সাপ্তাহিক ইস্টার্ণ স্টার-এর ওপর প্রাদেশিক সরকার ১৯৪৬ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন বলে সংবাদ ও সম্পাদকীয় প্রকাশের পূর্বে সরকারের অনুমোদন লাভের আদেশ জারী করে।[৯]
চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্ব পাকিস্তানের নিকট জামানত তলব করে ও তার ওপর প্রিসেন্সরশীপের ব্যবস্থা করে সরকার যে দমন নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন তার প্রতিবাদে পত্রিকাটির সম্পাদক আব্দুস সালাম ১লা জুন থেকে আমৃত্যু অনশন ধর্মঘট শুরু করেন।[১০] দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান ও ইস্টার্ণ স্টার-এর ওপর সরকারী নির্দেশ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে এই সময় সাপ্তাহিক নওবেলাল বলে:
সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সকল স্বাধীনতাকামী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানই প্রতিবাদ জানাইয়া অবিলম্বে এই আদেশ প্রত্যাহার করিবার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানাইয়াছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত সরকার তাঁহাদের আদেশ বলবৎ রাখিয়াছেন। পূর্ব পাকিস্তানে সংবাদপত্রের সংখ্যা পাকিস্তানের অন্য প্রদেশের তুলনায় খুবই অল্প। এই প্রদেশে শক্তিশালী সংবাদপত্র যাহাতে ত্বরিৎ গড়িয়া উঠে সরকারের উচিত ছিলো সে ব্যবস্থা করা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সরকার তার বিপরীত পন্থাই অবলম্বন করিতেছেন। দেশের জাগ্রত জনমত তাহা কোনমতেই অনুমোদন করিতে পারে না এবং করেও নাই। জনমতের প্রতিধ্বনি করিয়া আমরা সরকারকে আরও একবার অনুরোধ করিবো আপনাদের আদেশ প্রত্যাহার করুন।[১১]
১৯৪৯ সালের ১০ই জুন ফরিদপুর জেলার পাংশা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক খাতক পত্রিকায় ‘আমাদের ফরিয়াদ’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয় এবং তাতে সরকারের কিছু সমালোচনা থাকে। এই সম্পাদকীয়টি প্রকাশের জন্যে ৭ই অগাস্ট তারিখে খাতকের সাতাত্তর বৎসর বয়স্ক সম্পাদক খোন্দকার নাজিরউদ্দীন আহমদকে পাংশা স্টেশনে ১৯৪৯ সালের পূর্ব বঙ্গ স্পেশাল অর্ডিন্যান্সের ৭ ধারা মতে গ্রেফতার করা হয়। ৮ই অগাস্ট গোয়ালন্দ এসডিওর কোর্টে হাজীর করার পর তাঁকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। খাতক সম্পাদকের এই গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে ফরিদপুরের গ্রামাঞ্চলে কিছুটা বিক্ষোভের সঞ্চার হয়।[১২] এই বিক্ষোভের অন্যতম কারণ পত্রিকাটি মুসলিম লীগ, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও তবলীগ জমায়াতের সংবাদ পরিবেশক হিসেবে প্রায় দশ বৎসর ধরে ফরিদপুর জেলার পাংশা থেকে প্রকাশিত হচ্ছিলো। এবং গ্রামাঞ্চলে ধার্মিক মুসলমানদের মধ্যে পত্রিকাটির বেশ কিছু প্রভাব ছিলো। খাতক সম্পাদকের গ্রেফতারের জন্যে জেলা কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে নওবেলালের একটি উপসম্পাদকীয়তে বলা হয়:
সাতাত্তর বৎসর বয়স্ক সাংবাদিক পাংশা (ফরিদপুর) খাতক পত্রিকার সম্পাদক জনাব নাজিরউদ্দিন আহমদের গ্রেফতারে পূর্ব পাকিস্তানের সাংবাদিক মহলে যে বিক্ষোভের সঞ্চার হইবে, তাহাতে আমাদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। আমাদের মনে হয় এই অপকার্যের জন্য তথাকার স্থানীয় কর্তৃপক্ষই দায়ী। পূর্ব বঙ্গ সরকার এত কাণ্ডজ্ঞানহীন হইয়া পড়িবেন আমরা এ বিশ্বাস করি না। ফরিদপুর জেলা কর্তৃপক্ষের এই হিতাহিত জ্ঞানশূন্য কার্যের আমরা তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাইতেছি।[১৩]
পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলা কমিটি ‘বর্মার জনতার স্বাধীনতার লড়াই ব্রহ্মদেশে হস্তক্ষেপ চলিবে না সাম্রাজ্যবাদের দালালী রোধ করো’ শীর্ষক একটি ইস্তাহার প্রকাশ করেন। এই ইস্তাহারটি ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব বাঙলা সরকার বাজেয়াপ্ত করেন।[১৪] পার্শ্ববর্তী দেশ বর্মায় কমিউনিস্ট আন্দোলন সম্পর্কে তৎকালে পূর্ব বাঙলা ও পাকিস্তান সরকারের আতঙ্কের যে শেষ ছিলো না তার অন্যান্য অনেক প্রমাণ পূর্ব বাঙলা সরকারের কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচারণার মধ্যে পাওয়া যায়। এজন্যে কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন বর্মার মুক্তি সংগ্রাম সম্পর্কে পূর্ব বাঙলার জনগণ যাতে অবহিত হতে না পারেন এবং সেই সংগ্রামের প্রতি তাঁদের কোন সহানুভূতি ও সমর্থন না থাকে তার জন্যে সরকারের উদ্বেগ ও প্রচারণার অভাব ছিলো না।[১৫]
১৯৪৯ সালের নভেম্বর মাসে পুলিশ ঢাকার ইংরেজী দৈনিক পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকার কার্যালয় ও আল-হেলাল প্রেসে দুই ঘণ্টা ব্যাপী খানাতল্লাসী চালায় এবং কিছু কাগজপত্র নিয়ে যায়।[১৬] সিলেটের মৌলভীবাজার থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক অভিযান-এর সম্পাদককে পুলিশ নভেম্বর মাসে গ্রেফতার করে।[১৭]
১৮ই নভেম্বর সিলেটের গোবিন্দ পার্কে মুসলিম লীগ ব্যক্তিস্বাধীনতা পুনর্বহালের দাবীতে একটি জনসভা আহ্বান করে। সেই সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক আজান পত্রিকার সম্পাদক এমএ বারী সিলেটের ডেপুটি কমিশনার হামিদ হাসান নোমানীর কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন যে, দেশে যখন দারুণ খাদ্যাভাব বিরাজ করছে তখন তিনি প্রস্তাবিত উর্দু স্কুলের জন্যে চাঁদা আদায়ে ব্যস্ত হয়েছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন যে, তাঁর এই সমালোচনার জন্যে পরের দিন তাঁকে গ্রেফতার করলেও তিনি আশ্চর্য হবেন না।[১৮] আজান সম্পাদকের এই আশঙ্কাই আংশিকভাবে সত্য প্রমাণিত হয়। পরদিনই অর্থাৎ ১৯শে নভেম্বর তাঁর বাড়ী, পত্রিকার অফিস এবং ছাপাখানা আনন্দ প্রেসে পুলিশ খানাতল্লাশী চালায়। প্রেস থেকে কমপোজড ম্যাটার হস্তগত করে তাঁরা। আনন্দ প্রেস তালাবন্ধ করে চলে যায়।[১৯]
সিলেট জেলা সাংবাদিক সমিতি একটি জরুরী সভা আহ্বান করে একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের এই আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন।[২০] সাংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে উত্তর সিলেট জেলা মুসলিম লীগ ও সিলেট জেলা সাংবাদিক সমিতি যৌথভাবে ২২শে নভেম্বর, ১৯৪৯ তারিখে একটি জনসভা আহ্বান করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য মাহমুদ আলী। সিলেটের ডেপুটি কমিশনার নোমানী কর্তৃক সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ ও তার নানান স্বেচ্ছাচারমূলক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগ ও সরকারী প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্তের দাবী জানিয়ে একটি প্রস্তাব এই সভায় গৃহীত হয়।[২১] সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর নানাবিধ নিয়ন্ত্রণ ও হামলা জারী থাকলেও পূর্ব বাঙলায় এ পর্যন্ত সাংবাদিকদের কোন নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ছিলো না। এই ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্দেশ্যে ২১শে জানুয়ারী, ১৯৫০ তারিখে ঢাকাতে পূর্ব বাঙলার কিছু সংখ্যক সাংবাদিক এক সভায় মিলিত হন। এই সভায় আবুল কালাম শামসুদ্দীন (সম্পাদক, আজাদ), বজলুল হক (সম্পাদক, জিন্দেগী), মাহমুদ আলী (সম্পাদক, নওবেলাল), আব্দুল ওয়াহাব (প্রতিনিধি, স্টেটসম্যান), মহম্মদ হোসেন, জহুর হোসেন চৌধুরী (পাকিস্তান অবজার্ভার), এমএ আজম (এপিপি) এবং আজাদ, নওবেলাল ও পাকিস্তান অবজার্ভারের আরও কয়েকজন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। পূর্ব বাঙলায় একটি সাংবাদিক সমিতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণের জন্যে এই সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।[২২]
১৫ই মে, ১৯৫০ তারিখে অনুষ্ঠিত পূর্ব বাঙলার সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রিকা সম্পাদকের এক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান সংবাদপত্র সম্পাদক সম্মেলন নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় ঢাকার এবং প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত পত্রিকা সম্পাদকরা ৬৯টি সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রিকার সম্পাদককে এই সম্পাদক সম্মেলন-এর সদস্য তালিকাভুক্ত করেন। ১৫ই মের সম্পাদক সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটিতে নিম্নলিখিত ব্যক্তিদেরকে নিয়ে কার্যকরী সমিতি গঠিত হয় : সভাপতি, ‘আজাদ’ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। সহ-সভাপতি, ‘পাকিস্তান অবজার্ভারের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আব্দুস সালাম, ‘জিন্দেগী’ সম্পাদক বজলুল হক ‘পাঞ্চজন্য’ সম্পাদক অম্বিকাচরণ দাস ও ‘আজান’ (চট্টগ্রাম) পত্রিকার সম্পাদক। সেক্রেটারী, ‘মর্নিং নিউজ’ সম্পাদক সৈয়দ মোহসিন আলী। জয়েন্ট সেক্রেটারী, অর্ধ সাপ্তাহিক ‘পাকিস্তান’ সম্পাদক মোহাম্মদ মোদাব্বের। সহকারী সম্পাদক, ‘যুগের দাবী সম্পাদক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস ও সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ পত্রিকার সম্পাদক। কোষাধ্যক্ষ ঢাকাস্থ এপিপির প্রতিনিধি এমএ আজম। এছাড়া আরও পনেরো জন পত্রিকার সম্পাদক কার্যকরী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। সম্মেলনে সৈয়দ মহসিন আলীকে আহ্বায়ক এবং আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মোহাম্মদ মোদাব্বের, আব্দুস সালাম ও বজলুল হককে সদস্য করে একটি গঠনতন্ত্র সাবকমিটি গঠিত হয়।[২৩] ১৯৫০ সালের জুলাই মাসে ‘পূর্ব পাকিস্তান সংবাদপত্র সম্মেলন’-এর সভাপতি আবুল কালাম শামসুদ্দীন ও ‘পাকিস্তান সংবাদপত্র সম্মেলন’-এর সভাপতি পীর আলী মহম্মদ রাশেদীর মধ্যে এক আলোচনার ফলে স্থির হয় যে, পূর্ব বাঙলার সংগঠনটি পাকিস্তানের সংগঠনের একটি ইউনিট হিসেবে কাজ করবে এবং পূর্ব বাঙলার যাবতীয় ব্যাপারে তার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে।[২৪]
শুধু পূর্ব বাঙলা সরকারই যে এই সময় সংবাদপত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর নানাভাবে হামলা চালাচ্ছিলো তাই নয় পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশেও ঐ একইভাবে সরকারী নির্যাতন জারী ছিলো। পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের অসংখ্য পত্রিকা এই সময় বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিলো, পত্রিকার নিকট থেকে হাজার হাজার টাকা জামানত তলব করা হচ্ছিলো, পত্রিকার ছাপাখানাসমূহ তালাবন্ধ ও পত্রিকা সম্পাদকদেরকে বেআইনীভাবে গ্রেফতার করা হচ্ছিলো। এই সবের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের সাংবাদিকরা প্রতিবাদ করছিলেন এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্যে সরকারের কাছে দাবী জানাচ্ছিলেন।
এই পরিস্থিতিতে ১৯৫০ সালের ৭ই এপ্রিল করাচীতে ‘পাকিস্তান সংবাদপত্র সম্পাদক -এর একটি সাধারণ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। তখন পর্যন্ত ‘পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক সম্মেলন’ প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার ফলে পূর্ব বাঙলার কোন প্রতিনিধি তাতে উপস্থিত ছিলেন না। তাঁদের এই অনুপস্থিতি সম্পর্কে অধিবেশনে আলোচনা হয় এবং তাঁরা ভবিষ্যতে যাতে উপস্থিত হতে পারেন তার জন্যে গঠনতন্ত্রে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধনের সিদ্ধান্তও তাঁরা গ্রহণ করেন।[২৫]
পাকিস্তান সংবাদপত্র সম্পাদকদের এই সম্মেলনে পাকিস্তান সরকারের ‘জননিরাপত্তা আইন’ সম্পর্কে তুমুল বিতর্ক হয়। সংবাদপত্রের ওপর এই আইনের প্রয়োগ যাতে না হয় এবং সম্পাদকদেরকে যাতে এই আইনের আওতাভুক্ত করা না হয় তার জন্যে কয়েকজন সম্পাদক সম্মেলনে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। এই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যাওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানে বিভিন্ন প্রদেশের সাতজন সম্পাদক অধিবেশন গৃহ পরিত্যাগ করেন।[২৬] সম্মেলনের পর লাহোরের এগারোটি সংবাদপত্র ও সাময়িকীর প্রতিনিধিবৃন্দ এ সম্পর্কে এক যুক্ত বিবৃতি প্রদান করে তাতে বলেন যে, পাকিস্তান সংবাদপত্র সম্পাদক সম্মেলন জাতীয় সংবাদপত্রের অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখার ক্ষেত্রে নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা আরও বলেন যে, বহু সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিষ্ঠান তখনই সমর্থন যোগ্য হয় যখন তা সকল মতাবলম্বী সংবাদপত্রের প্রতিনিধিত্ব করে এবং মতামতের স্বাধীনতা স্বীকার করে। ‘পাকিস্তান সংবাদপত্র সম্মেলন’-এর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভিযোগ জ্ঞাপন করে তাঁরা বলেন যে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার এবং অধিকার রক্ষাই এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত হলেও প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্ব দায়িত্ব প্রতিপালনে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন।[২৭]
করাচীতে অনুষ্ঠিত উপরোক্ত সম্মেলনের ‘জন নিরাপত্তা আইন’ সম্পর্কিত বিতর্কের ওপর পূর্ব বাঙলার সংবাদপত্রগুলিতে সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশ করা হয়। জন নিরাপত্তা আইনের কোন অপপ্রয়োগ করা হবে না, এই মর্মে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন যে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন তার ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে পাকিস্তান অবজার্ভার বলে :
এই ধরনের প্রতিশ্রুতির কোন অর্থই হয় না। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কাইয়ুম মন্ত্রীসভা, মন্ত্রীসভার রদবদল সম্পর্কে এক সংবাদ প্রকাশ করার জন্য সরহদ পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছেন। পূর্ব পাকিস্তানেও এইরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছেন। সমগ্র পাকিস্তান জুড়িয়া এবং বিশেষ করিয়া উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও পূর্ব পাকিস্তানে বিশিষ্ট মুসলিম লীগ পর্যন্ত এই আইনের আওতায় ফেলিয়া বিনা বিচারে আটক রাখা হইয়াছে এবং হইতেছে।[২৮]
১৮ই এপ্রিল, ১৯৫০, তারিখে মর্নিং নিউজ পূর্ব বাঙলার পরিস্থিতি সম্পর্কে এক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে বলেন,
এখানে কর্তৃপক্ষ জনকল্যাণমূলক সমালোচনা সহ্য করিতেও প্রস্তুত নহেন। প্রাদেশিক প্রেস কনসালটেটিভ কমিটির ২১ জন সদস্যের মধ্যে চারিজনই সরকারী কর্মচারী। এই কমিটিকে জিজ্ঞাসা না করিয়াই সম্পাদকদের গ্রেফতার করা হইতেছে, জামানত তলব করা হইতেছে।
২৭শে এপ্রিল তারিখে ‘সাংবাদপত্রের স্বাধীনতা’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয়তে নওবেলাল বলে:
সম্প্রতি করাচীতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান সংবাদপত্র সম্পাদক সম্মেলনের অধিবেশন হইতে লাহোরের কয়েকজন বিশিষ্ট সাংবাদিক সম্মেলনের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া বাহির হইয়া আসিয়াছেন। পাকিস্তান সরকারের জননিরাপত্তা আইনের কবল হইতে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদিগকে অব্যাহতি দিবার জন্য যে প্রস্তাব করা হইয়াছিলো তাহা সম্মেলনে অগ্রাহ্য হইয়া যাওয়াই তাহারা এই পন্থা অবলম্বন করিতে বাধ্য হইয়াছেন। এই আইন অনুযায়ী সরকার কোন কারণ না দর্শাইয়াই যে কোন সময় যে কোন সংবাদপত্র বন্ধ করিয়া দিতে বা যে কোন সংবাদপত্র সম্পাদককে কারা প্রাচীরের অন্তরালে নিক্ষেপ করিতে পারেন। দেশে জরুরী অবস্থাধীনে এই ধরনের আইনের প্রয়োজনীয়তা থাকিতে পারে কিন্তু সাধারণ অবস্থায় এইরূপ বিশেষ ক্ষমতার ব্যবস্থাকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের নামান্তর ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। পাকিস্তান সরকারের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী খাওয়াজা শাহাবুদ্দীন এই আইনের অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন সত্য কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাহার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নাই।
পাকিস্তান অবজার্ভার ও মর্নিং নিউজ-এর উপরোক্ত মন্তব্যের উল্লেখ করে সম্পাদকীয়টিতে বলা হয়:
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য উপরোক্ত দুইটি বিশিষ্ট দৈনিক যে সব মন্তব্য করিয়াছেন তাহার সহিত আমরাও আমাদের ক্ষীণ কণ্ঠ সংযোগ করিতেছি। স্বাধীন রাষ্ট্রে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এক মৌলিক অধিকার। সেই অধিকারে হস্তক্ষেপ করার অর্থ সমগ্রভাবে দেশের স্বাধীনতার উপরই হস্তক্ষেপের নামান্তর। এই স্বাধীনতা যাহাতে কোন প্রকার খর্ব না হয় সে দিকে নজর রাখা স্বাধীনতাপ্রিয় সকল নাগরিকের অন্যতম কর্তব্য। এই অধিকার রক্ষায় আমাদের তৎপরতা যতই হ্রাস পাইবে ততই অধিকার হরণকারীর দল অধিকতর শক্তি সঞ্চয় করিবে এবং অচিরেই গণআজাদীর কিছুমাত্র অবশিষ্ট থাকিয়া যাইবে না।
পাকিস্তান স্বরাষ্ট্র ও প্রচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘কেন্দ্রীয় সংবাদপত্র পরামর্শ কমিটির’ পূর্ব বাঙলা প্রতিনিধি মনোনয়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদে ১০ই মে ১৯৫০ তারিখে পাকিস্তান অবজার্ভার-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আব্দুস সালামের সভাপতিত্বে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘পূর্ব পাকিস্তান’ সাংবাদিক সমিতির কার্যকরী কমিটির একটি সভায় নিম্নলিখিত প্রস্তাব গৃহীত হয়:
কেন্দ্রীয় সংবাদপত্র পরামর্শ কমিটির প্রতিনিধি মনোনয়নের ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদপত্রসমূহের সঙ্গে আলোচনা না করিয়াই পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র ও প্রচার সচিব যে খামখেয়ালী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন এই সভা তাহার তীব্র নিন্দা করিতেছে। এই সভা মনে করে যে কেন্দ্রীয় সংবাদপত্র পরামর্শ কমিটিতে পূর্ব পাকিস্তান হইতে উপযুক্ত সংখ্যক প্রতিনিধি গ্রহণ করা হয় নাই। স্বরাষ্ট্র ও প্রচার বিভাগের এহেন মনোভাব পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদপত্রের প্রতি অপমানজনক বলিয়া সমিতি মনে করে।[২৯]
এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, পূর্ব বাঙলা প্রাদেশিক সংবাদপত্র পরামর্শ কমিটির এগারোজন সদস্যের মধ্যে চারজনই যে সরকারী কর্মচারী এ বিষয়ে মর্নিং নিউজের ১৮ই এপ্রিলের উপরোক্ত সম্পাদকীয়তে অভিযোগ করা হয়।
করাচীতে একটি উর্দু সংবাদপত্রের মালিককে সংবাদপত্র ভবন খালি করে দেওয়ার জন্যে কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও তিনি সেই নির্দেশ পালন করতে অস্বীকার করায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু পরে তিনি মুক্তি লাভ করেন। তাঁর মুক্তি লাভের অব্যবহিত পরেই দি সিভিল অ্যাণ্ড মিলিটারী গেজেট, আনজাম, জঙ্গ, ইমরোজ ও মিল্লাত নামক করাচীর পাঁচটি বিশিষ্ট পত্রিকা একই দিনে যুগপৎ একই সম্পাদকীয় প্রবন্ধে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন যে, ‘গোপনে অসাধু উপায় অবলম্বন, প্রত্যক্ষ চাপ এবং প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থার আশ্রয় গ্রহণ করিয়া পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ সংবাদপত্রগুলিকে ভীতি প্রদর্শন করিতে চেষ্টা করিতেছে।’ সাধারণ নাগরিকদের আশা-আকাক্ষা প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবী করে উক্ত সম্পাদকীয়তে বলা হয় যে, পাকিস্তানে এমন একদল লোক আছে যারা অবাধে নির্ভীক মতামত প্রকাশের ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ করতে চেষ্টা করছে এবং সাংবাদিকতাকে তাঁরা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির ক্রীড়নক রূপে ব্যবহারের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এই ধরনের ব্যক্তিদেরকে তাঁরা ফ্যাসিস্ট মনোভাবাপন্ন বলে অভিহিত করেন এবং বলেন যে, দমন নীতি দ্বারা পাকিস্তানের সাংবাদিকদেরকে দাবিয়ে রাখা যাবে না। কর্তৃপক্ষকে এই সাথে সতর্ক করে দিয়ে তাঁরা বলেন যে, মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হলে পাকিস্তানের সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে তা প্রতিরোধ করবেন।[৩০]
১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসের শেষ দিকে ফেণী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সংগ্রাম পত্রিকার সম্পাদক ফায়েজ আহমদকে ‘জননিরাপত্তা আইনে’ গ্রেফতার করা হয়। এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে ২রা নভেম্বর নওবেলাল ‘দুর্ভাগা সাংবাদিক’ নামে এক দীর্ঘ ও কঠোর সমালোচনামূলক সম্পাদকীয় প্রকাশ করেন। এই সম্পাদকীয়তে বলা হয়:
সরকারের হাতে ‘আইন’ – সাংবাদিকের হাতে ‘জনমত’ এই দুইটির পরস্পরবিরোধী শক্তি পরীক্ষা চলিয়াছে – সত্যিকারের জনমতকে ব্যক্ত করিবার অধিকার সাংবাদিকের নাই। প্রাক পাকিস্তান যুগের শতকরা ১৩ জনের নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা এই সকল স্বেচ্ছাচারী আইন প্রস্তুত হইয়াছে। তাই জনগণের মুক্তির দাবী, জনগণের মনোমানসের অভিব্যক্তিকে কায়েমী স্বার্থশীলেরা জনস্বার্থবিরোধী বলিয়া অভিহিত করিতে দ্বিধাবোধ করিতেছেন না। এমনি পরিহাস চলিয়াছে। দুর্ভাগা সাংবাদিকেরা অতীতের আজাদী আন্দোলনে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের যাঁতাকলে নানা অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করিয়া দুর্গম কণ্টকিত যাত্রাপথ অতিক্রম করিয়া যখন স্বাধীনতার নূতন প্রভাতকে স্বাগত সম্ভাষণ জানাইবার জন্য অপেক্ষা করিতেছিল, – সেই আজাদীর প্রথম পর্যায়েই দেশী একচ্ছত্রপতিদের অমানবীয় মনোবৃত্তি সাংবাদিকদের স্বাধীন মত প্রকাশ করিবার ক্ষমতাকে হরণ করিয়া লইয়া যাইতেছে। আমাদের দেশের সাংবাদিকদের চারিদিকে গড়িয়া উঠিয়াছে দুর্লঙ্ঘ বেড়াজাল। সাধু সাংবাদিকতা রক্ষা করিবার উপায় চারিদিক হইতে বন্ধ হইয়া রহিয়াছে।
বহু কষ্টে দারিদ্রতার সহিত সংগ্রাম করিয়া জনগণের বেদনার কথা জানাইতে গেলেই এদিকে সরকারের কোপদৃষ্টি, অপরদিকে স্বার্থবাদী চক্রান্তকারীদের ষড়যন্ত্র সাংবাদিকের জীবনকে অবর্ণনীয় লাঞ্ছনার দিকে ঠেলিয়া দিতেছে। এই পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে আমরা সাংবাদিকগণ দাঁড়াইয়া আছি। ডানে আমাদের শত্রু-বামে আমাদের শত্রু-তারই মধ্যে সংগ্রাম সম্পাদক একটি মাত্র বলি। আমরা জানি এমনি আঘাতের পর আঘাত আমাদের আসিবে। তাহাকে মাথা পাতিয়া বরণ করিয়া লইতে হইবে। তবে এই কথা আমরা কায়েমী স্বার্থশীল ব্যক্তিসমূহকে স্পষ্টভাষায় জানাইয়া দিতে চাই – তাহাদের দিন গণনার সময় সমাগত। লাঞ্ছিত মানবের আর্তনাদ একদিন আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করিয়া নব-সমাজে পত্তন করিবে।[৩১]
১৯৫১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান সংবাদপত্র সম্পাদক সম্মেলনের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে সরকারী নির্যাতন ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর নিম্নলিখিত প্রস্তাবটি গৃহীত হয়:
সংবাদ পরীক্ষার নির্দেশ দান করিয়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংবাদপত্রের উপর নির্যাতন করিয়া জামানত ইত্যাদির দ্বারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার যে প্রবণতা সরকারী মহলে দেখা যাইতেছে সম্মেলন তাহা গভীর আশঙ্কার সহিত পর্যালোচনা এবং এইভাবে জনমত দাবাইয়া রাখার চেষ্টার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সরকারকে সাবধান করিয়া দিতেছে।
২. ছাত্র নির্যাতন ও প্রতিরোধ
১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্টের পর থেকেই প্রগতিশীল এবং এমনকি সরকারের সাথে সব বিষয়ে একমত নয় সেই ধরনের ছাত্রদের ওপরও পূর্ব বাঙলা সরকারের নির্যাতন শুরু হয়। এই নির্যাতনের ক্ষেত্রে সরকার ও সরকারী দল মুসলিম লীগ শুধু যে পুলিশের ওপরই নির্ভর করে তাই নয়, তাঁরা ছাত্রদের মধ্যে এক শ্রেণীর প্রতিক্রিয়াশীল ও গুণ্ডাস্থানীয় ছাত্রদেরকেও বেপরোয়াভাবে ব্যবহার করে। ১৯৪৮ সালের মধ্যেই এই সরকারী নির্যাতন ও দমননীতির চেহারা ছাত্রদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে; কারণ দেশভাগের এক বৎসরের মধ্যেই পূর্ব বাঙলা সরকার ঢাকা এবং প্রদেশের অন্যান্য অঞ্চলে শত শত ছাত্রকে জেলে নিক্ষেপ করে জরিমানা করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নিজ নিজ এলাকা থেকে বহিষ্কার করে তাঁদের শোষণ ও কুশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন ও বিক্ষোভকে দমন করতে বদ্ধপরিকর হয়। এই পটভূমিকায় ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ’ ১৯৪৯ সালের ৮ই জানুয়ারী সমস্ত পূর্ব বাঙলা ব্যাপী ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ পালনের জন্যে ছাত্র সমাজের প্রতি আহ্বান জানায়। ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস কেন?’ নামক একটি ইস্তাহারে খুলনা, বরিশাল, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, রংপুর, পাবনা, রাজশাহী ও দিনাজপুর অঞ্চলে গ্রেফতার, পরোয়ানা ও বহিষ্কার আদেশ জারী ইত্যাদির মাধ্যমে কত জন ছাত্রের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে তার একটা তালিকা প্রদান করা হয়। তারপর ইস্তাহারটিতে বলা হয়:
এরা প্রত্যেকেই লীগের সুপরিচিত ছাত্রকর্মী ও পাকিস্তান সংগ্রামের পুরোভাগে ছিলো। এদের উপর দমন নীতি চালাবার কারণে এরা শিক্ষা সংস্কার চায়, দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির অবসান চায়। পাকিস্তান হতে হিন্দুস্থানে বে-আইনী খাদ্যশস্য পাঠাতে বাধা দেয়। লক্ষ্য করিয়াছেন কি উপরোক্ত জেলাগুলো সীমান্তে অবস্থিত এবং এগুলো থেকে খাদ্যশস্য বেআইনীভাবে হিন্দুস্তানে চলে যাচ্ছে।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের জুলুম প্রতিরোধ দিবস সাব কমিটি ৮ই জানুয়ারী শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল, মিছিল ও সভাসমিতির মাধ্যমে জুলুম প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়ে ‘ছাত্র সমাজের উপর দমননীতির স্টীমরোলার’ শীর্ষক একটি ইস্তাহার প্রকাশ করেন। এই ইস্তাহারটিতে শিক্ষা, ছাত্র আন্দোলন ও দেশের সাধারণ পরিস্থিতির একটা বিবরণ দিতে গিয়ে বলা হয়:
দেশের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা আজ ভাঙ্গনের মুখে; ছাত্র আছে ছাত্রাবাস নেই, স্কুল কলেজ আছে শিক্ষক নেই, যে কয়জন শিক্ষক আছেন তাঁদের পেটে ভাত পরনে কাপড় নেই। শিক্ষা দপ্তর আছে শিক্ষা প্রসারের চেষ্টা নেই, দপ্তর কিন্তু দপ্তরখানায় বাংলা ভাষা কমিটির ও ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রদের ফাইল নেই, উধাও হয়ে যায়। শিক্ষা সঙ্কোচের উৎসাহে সরকারী মহল উন্মত্ত। ছাত্রেরা যখনই বলেন শিক্ষা সংকোচ চলবে না, শিক্ষকদের উপযুক্ত মাইনা দিতে হবে, শিক্ষা পদ্ধতির আমূল সংস্কার চাই, ছাত্রাবাসের ব্যবস্থা করতে হবে, তখনি ফতোয়া দেওয়া হয় ‘সব ঠিক হায়, ছাত্রলোগ গোলমাল করতা হায়।’ পূর্ব পাকিস্তানের অগণিত জনসাধারণ যখন অন্নাভাবে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় তখন সরকারী কর্মচারী ও দালালদের মধ্যস্থতায় পাকিস্তানের ধান চাল বেআইনীভাবে হিন্দুস্থানে হু হু করে চলে যায়। কেউ কি কসম করে বলতে পারেন যে বরিশাল, উত্তর বঙ্গ ও অন্যান্য উদ্বৃত্ত জেলার চাল রেশন এলাকায় এক সন্ধ্যাও খেয়েছেন? তবে চাল ধান যায় কোথায়? ছাত্রেরা যখনই এ ব্যাপারে মুখ খোলেন তখনই তাঁরা পান ‘রাষ্ট্রের দুশমন’ খেতাব। আজ নিজেদের ঊর্ধ্বতন কর্মচারীরা মনে করেন, ফ্রান্সের চতুর্দ্দশ লুই। কাজেই যারা পাক ভূমিকে অত্যাচার, অনাচার, অবিচার, ঘুষখোর ও চোরাকারবারী মুক্ত করে সত্যিকারের পাকিস্তানে পরিণত করতে চান তাঁদের উপর চলে ঘুষখোর ও পাকিস্তানের ধ্বংসকারীদের অবিরাম অত্যাচার। এরই জন্য চলছে আজ রাজশাহী, কুষ্টিয়া, খুলনা, বরিশাল ও ফরিদপুরের ছাত্রদের উপর অসহনীয় নির্যাতন। ছাত্রাবাসের দাবী করার জন্য কুষ্টিয়ার প্রায় দেড় ডজন ছাত্রের উপর এই সেই দিনও জুলুম চালানো হলো। রাজশাহী কলেজের চারজন ছাত্রকে কলেজ ও জেলা হতে বহিষ্কার করা হয়েছে, ২৫ জন ছাত্রকে হোস্টেল ও শহর ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। আরও ৬০ জনকে বের করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। যে দুর্বত্তেরা মিছিল আক্রমণ করলো তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়নি, হয়েছে ছাত্রদের শাস্তি দেবার ব্যবস্থা। যে পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করলো তাদের শাস্তির কি ব্যবস্থা করা হয়েছে? সরকারী কলেজ হোস্টেলকে সশস্ত্র পুলিশ দিয়ে দু’দুবার ঘিরে ফেলা, হোস্টেলের কামরায় খানাতল্লাশী চালান, বিনা ওয়ারেন্টে হোস্টেল হতে ছাত্র গ্রেপ্তার করা, ২৭ ঘণ্টা অনশনকারীদের পুলিশ দিয়ে বের করে নিয়ে যাওয়ার মত সাহস সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ আমলেও কোন জেলা কর্তৃপক্ষ করেনি। অথচ আজ এ সাহস কেন। শিক্ষামন্ত্রী ঠিকই বলেছেন ‘জেলা কর্তৃপক্ষ এমন একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীর আত্মীয় যার বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করবার আগে ভেবে দেখতে হবে।’ সরকারী কর্মচারীরা কি তবে মন্ত্রী সাহেবানদের সিংহাসন টলটলায়মান করতে পারেন? ছাত্রদের আমরা জিজ্ঞাসা করি আপনারা কাউকে দেখে ভয় করেন? নিশ্চয়ই না। তবে আমাদের প্রতিনিধিরা ভয় করেন কেন? বেসরকারী তদন্তের দাবীতে রাজী হতে মন্ত্রী সাহেবানরা সাহস করেন না কেন? অন্যান্য উপরোক্ত জেলাগুলোতে ঠিক একইভাবে তাদের জুলুম চলছে। কাজেই জুলুম প্রতিরোধ দিবস উদযাপন করা ছাড়া অন্য কেন উপায় নেই।[৩২]
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের ‘জুলুমবিরোধী দিবস’ পালনের এই আহ্বান ছাত্র ফেডারেশনও সমর্থন করে। ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি ও সম্পাদক একটি বিবৃতির মাধ্যমে ৮ই জানুয়ারী প্রদেশব্যাপী জুলুমবিরোধী দিবস পালনের আহ্বান জানান। বিবৃতিটি পূর্ব বাঙলা থেকে প্রকাশিত কোন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত না হলেও কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাক-এ ৩রা জানুয়ারী তারিখে প্রকাশিত হয়।
অপরদিকে সরকারী দলের সমর্থক নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ খুব সক্রিয়ভাবে এই দিবস পালনের বিরোধিতা করে। রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘রাজশাহী কলেজে দলাদলি ‘ শীর্ষক তাঁদের একটি বেনামী ইস্তাহারে তাঁরা ৮ই জানুয়ারী জুলুমবিরোধী দিবস বানচালের জন্যে ছাত্র সাধারণের প্রতি আহ্বান জানায়। ছাত্র ফেডারেশন ও কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বিষোদগারণ করতে গিয়ে তাতে বলা হয়:
তাহাদের উদ্দেশ্য আমরা জানি। অত্যন্ত লজ্জার সহিত স্বীকার করিতে হয় কতিপয় মুসলিম ছাত্র অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করিয়া দায়িত্বহীনের মত উক্ত (অর্থাৎ ছাত্র ফেডারেশনের ব.উ.) কম্যুনিস্ট পন্থীদের সহযোগিতায় দমন নীতিবিরোধী দিবস’ আহ্বান করিয়াছে। আমরা বুঝিতে পারিলাম না ইহা কার বিরুদ্ধে ‘দমন বিরোধী দিবস’ এবং কিসের জন্য দমন নীতি বিরোধী দিবস। রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের জন্য জেলখানায় যাহারা আশ্রয় লাভ করিয়াছে তাহাদেরকেও এই সুযোগে জেলখানা হইতে উদ্ধার করিয়া এক ঢিলে দুই পাখী মারিবার জন্য ছাত্র ফেডারেশন ওঁৎ পাতিয়া রহিয়াছে।
জুলুমবিরোধী দিবসকে রাজশাহীতে কিছুতেই সফল হতে তারা দেবে না এই মর্মে তারা ইস্তাহারটিতে একটি ‘চ্যালেঞ্জ’ প্রদান করে। কিন্তু শুধু রাজশাহীতেই নয়, পূর্ব বাঙলার সর্বত্র তারা এই একইভাবে দিবসটি উদযাপনের বিরোধিতা করে এবং ৮ই জানুয়ারীর ছাত্র সভায় সংগঠিত হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে তারা অনেক ক্ষেত্রেই সমর্থ হয়।
৮ই জানুয়ারী ঢাকা এবং পূর্ব বাঙলার অন্যান্য শহর ও বিভিন্ন অঞ্চলে ‘জুলুম বিরোধীদিবস’ পালিত হয়।
ঢাকায় কেবলমাত্র কলেজ ব্যতীত অন্যান্য সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জুলুমবিরোধী দিবস-এর ধর্মঘট সফল হয়। দুপুর ২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে নঈমুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে জুলুমবিরোধী দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত সভাটি অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে অন্যান্যদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ও দবিরুল ইসলাম বক্তৃতা করেন। সভায় একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে ছাত্রদের দাবীসমূহ মেনে নেওয়ার জন্যে সরকারকে এক মাস সময় দেওয়া হয়।[৩৩] তাজউদ্দীন আহমদের এই বর্ণনা থেকে দেখা যায় যে, বিপুলভাবে সাফল্য মণ্ডিত না হলেও ‘জুলুমবিরোধী দিবস’ ঢাকায় আংশিকভাবে সফল হয়। পূর্ব বাঙলার অন্যান্য অঞ্চলে কিন্তু পরিস্থিতি অন্য রকম দাঁড়ায়। নওবেলালের ঢাকাস্থ নিজস্ব প্রতিনিধি এই সাধারণ পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন:
৮ই জানুয়ারী ‘জুলুমপ্রতিরোধ দিবসে’র ব্যর্থতার পর সাধারণ ছাত্র সমাজের মধ্যে যে নিরাশা ও আন্দোলনের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যে তীব্র অসন্তোষ দেখা গিয়াছে, গত সপ্তাহে ইহাই আরো পরিষ্কার করিয়া লক্ষ্য করা গিয়াছে।
রাজশাহী, খুলনা ও অন্যান্য জেলায় যে সব ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হইয়াছিলো, তাহাদের এখনো মুক্তি দেওয়া হয় নাই। যে সব ছাত্রকে রাজশাহী শহর হইতে বহিষ্কৃত করা হইয়াছিল, তাহারা আজও শহরে প্রবেশ করিবার অধিকার পান নাই। শিক্ষা সংকোচের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ ও ছাত্র ফেডারেশন যে দাবী তুলিয়াছিলো, সে দাবীর প্রতি সরকার কর্ণপাতও করেন নাই। একদিকে সরকারের অনমনীয় মনোভাব, অন্য দিকে ছাত্র সমাজের (বিশেষ করে মুসলিম ছাত্র লীগের নেতাদের আপস – ইহাই হইতেছে ছাত্র সমাজের অসন্তোষের প্রধান কারণ। একদিকে সংগ্রামশীল ছাত্র সাধারণ অন্যদিকে দুর্বল নেতৃত্ব, ইহাই আজ তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করিয়াছে।
যে সব ছাত্র নেতা ৮ই জানুয়ারীর পূর্বে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ দিবসের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করিবার জন্য ঢাকার বাহিরে ছিলেন, তাহারা সকলেই ইতিমধ্যে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করিয়াছে এবং তাহাদের ঢাকা প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কাঠার সমালোচনা জোরালো হইয়া উঠিয়াছে। এই প্রসঙ্গে বগুড়ার জনৈক ছাত্র আমাকে বলেন “সংগ্রামী ছাত্র সমাজকে নেতৃত্ব দিতে গিয়া ঢাকা ব্যর্থ হইয়াছে। আগামী আন্দোলনগুলোকে সার্থক করিয়া তুলিতে হইলে রাজশাহী, খুলনা, সিলেটের ছাত্র সাধারণকে নেতৃত্ব গ্রহণ করিতে হইবে। যে সব জায়গায় ছাত্র দমন চলিতেছে, সেই সব জায়গায়ই আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হইয়া উঠুক।’[৩৪]
ওপরের এই রিপোর্টটিতে ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’কে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ বলে বর্ণনা করলেও বাস্তবতঃ তা ততখানি ব্যর্থ হয়নি। ঢাকাসহ পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন অঞ্চলে এ সম্পর্কে কিছু প্রচার হয়েছিলো এবং সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সাফল্য বলতে উপরোক্ত রিপোর্টটিতে লেখক পূর্ব বাঙলার জেলাগুলি থেকে ৮ই জানুয়ারীর পর ছাত্রবন্দীদের মুক্তি, তাঁদের বিরুদ্ধে সব রকম বিধিনিষেধ প্রত্যাহার ইত্যাদি বোঝাতে চেয়েছেন। কোন ‘দিবস’ পালনের সাফল্য অথবা ব্যর্থতাকে যেমন শুধু এই মাপকাঠিতেই বিচার করা চলে না, তেমনি ছাত্রদের একটি প্রতিবাদ দিবস উদযাপনের ধাক্কায় সরকার যে অবনত মস্তকে ছাত্রদের দাবীসমূহ স্বীকার করে নেবে তেমন পরিস্থিতিও তৎকালীন পূর্ব বাঙলায় ছিলো না। তবে একথা অনস্বীকার্য যে মুসলিম ছাত্র লীগ নেতৃত্বের একটি শক্তিশালী অংশ সরকার ও তাঁদের ছাত্র সংগঠন নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের সাথে আপসপন্থী হওয়ার ফলে প্রতিরোধ দিবস যতখানি সফল হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো ততখানি হয়নি। এই দুই ছাত্র লীগের আপস, সুবিধাবাদিতা এবং ছাত্র ফেডারেশন বিরোধিতা একটি নগ্নরূপ পরিগ্রহ করেছিলো ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিরোধী আন্দোলনের সময়।[৩৫]
সরকার যে ছাত্রদের আন্দোলন, সে যে দাবীর জন্যেই হোক, সর্বপ্রকারে দমন করতে বদ্ধপরিকর ছিলো তার একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ১২ই মার্চ, ১৯৪৯-এর ছাত্র গ্রেফতার। ঐ দিন ছাত্র ফেডারেশনের উদ্যোগে ও পরিচালনায় পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদের সামনে কিছুসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী দলবদ্ধ হয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আরবী হয়ফ চাই না’ ইত্যাদি ধ্বনি সহকারে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এই বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে তাঁদের মধ্যে থেকে সৈয়দ আফজাল হোসেন, মৃণালকান্তি বাড়রী, বাহাউদ্দীন চৌধুরী, ইকবাল আনসারী, আব্দুস সালাম এবং একেএম মনিরুজ্জামান চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়।[৩৬] ১৪ই মার্চ তারিখ সিলেট জেলা ছাত্র ফেডারেশনের অফিসের ওপর পুলিশ হামলা করে।[৩৭]
পূর্ব বাঙলার সর্বত্র, বিশেষতঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নির্যাতন এবং ছাত্রদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ কি পর্যায়ে উপনীত হয়েছিলো তার এক উল্লেখযোগ্য বর্ণনা পাওয়া যায় ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত এবং জনৈক শামসুল হক লিখিত ‘স্কুল কলেজের চার দেয়ালের মধ্যে মত প্রকাশের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা আদায় করুন’ শীর্ষক নিম্নলিখিত প্রবন্ধে:
পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র ও পাকিস্তানের অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়ের তোরণে প্রবেশ করার পরে ডাইনে চোখ ফেরালেই কালো কালির উপর সাদা বড় বড় হরফে লেখা কর্তৃপক্ষের যে বিরাট নোটিশটি নজরে পড়ে তাতে ভাষার মারপ্যাঁচ যতই থাক না কেন, বক্তব্য অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ‘ছাত্র সাধারণকে জানানো যাইতেছে যে কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কোনো সভা হইতে পারিবে না।’ সরকারের তাঁবেদার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানেন, আমরাও জানি কোনো রাজনৈতিক সভা আহ্বান করার অনুমতি কর্তৃপক্ষের কাছে চাইলেও পাওয়া যায় না, যেতে পারে না।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চার দেয়ালের মধ্যে মত প্রকাশের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার প্রতি এর চেয়ে নির্লজ্জ বিদ্রূপ আর কিছু কল্পনা করা অসম্ভব। বস্তুতঃ এই মনোভাবকে গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহের প্রতি সরকারের নীতি থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা অসম্ভব, কারণ এই একই নীতি প্রদেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও অনুসরণ করা হচ্ছে, ঠিক একইভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চার দেয়ালের আড়ালে পুলিশী আইন-কানুন চালু করা হয়েছে। সভা সমিতি করতে গিয়ে গত দু বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বহিষ্কার এবং ‘ডিসিপ্লিনারী এ্যাকশনের’ হুমকির মারফত যে সব বাধা হরদম আমরা পেয়ে আসছি, ঠিক একই ধরনের বাধা পেয়েছি সিলেটের এমসি কলেজ হোষ্টেলের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে, শিক্ষা সম্মেলনের উপর সভা করতে গিয়ে। অর্থ সাহায্য ও অন্যান্য ব্যাপার নিয়ে সরকারের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অভিমানের শেষ নেই কিন্তু ছাত্রসংহতি ও আন্দোলনের উপর এই ধরনের সরকারী কালাকানুন আজ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন, এমন কি মাঝে মাঝে তাঁদের জুলুম সকল প্রকার সীমা ছাড়িয়ে চরম নির্লজ্জভাবে প্রকাশ পায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল ও নোটিশ বোর্ড থেকে নিজের হাতে পোস্টার, সভার বিজ্ঞপ্তি বা দেয়াল পত্রিকা ছিঁড়ে ফেলে দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ আদৌ লজ্জাবোধ করেন না, এমনকি বিভিন্ন কমিটি ও ঘরোয়া বৈঠকে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করে সাধারণ পুলিশ অফিসারের মতো বক্তৃতার নোট নেয়াকে দৈনন্দিন কাজের অংশ বলে ধরে নিয়েছেন। এই ধরনের পুলিশী কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন বলেই ১৮ই অগাস্ট নিখিল পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির বৈঠকে উপস্থিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষ অধ্যাপক অত্যন্ত সহজভাবেই বলেছিলেন—’আমি তাঁদের বলে দিয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তাঁদের ভাবতে হবে না। আমিই সব করবো।’ এই নির্লজ্জ উক্তির উপর মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সভাসমিতি নিষিদ্ধ করে আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর সরাসরি আঘাত হেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারী কর্তৃপক্ষ ক্ষান্ত হচ্ছে না। আজ তাঁরা স্বাধীন ও প্রগতিশীল চিন্তাধারা প্রসারের পথে বাধা সৃষ্টি করবার জন্য সব সময়েই নূতন নূতন পন্থা আবিষ্কার করে চলেছেন। সরকারী ও বেসরকারী কলেজ ও হোস্টেল ইউনিয়ন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ইউনিয়নের গঠনতন্ত্র ও কার্যপদ্ধতির দিকে নজর দিলেই কর্তৃপক্ষের এই বিচিত্র উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। এই সব বিভিন্ন হল ইউনিয়ন, যা অতি সহজেই স্বাধীন ও বলিষ্ঠ চিন্তাধারার প্রচারেক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারতো, আজ তাঁদের উপর কর্তৃপক্ষের ‘রেজিমেন্টেশন’ ও সুপরিকল্পিত গণতন্ত্র-বিরোধী নীতির আস্ফালন চরমে উঠেছে। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছাত্রাবাস ও কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিয়নগুলোতে অর্থহীন পার্লামেন্টারীয়ানইজম-এর কচকচানির আড়ালে বিরাট ধাপ্পাবাজী চলেছে, ছিনিমিনি খেলা চলেছে ছাত্র সাধারণের মত প্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে।
আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর হামলা চালিয়ে কর্তৃপক্ষ ছাত্র সংহতি ও আমাদের আন্দোলনকে বানচাল করে দেবার জন্য যে আঘাত হানছেন, তার বিরুদ্ধে আমাদের সকল শক্তি নিয়ে আওয়াজ তুলতে হবে, শিক্ষা সম্মেলনের ভেতর দিয়ে আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কালা কানুনের অবসান ঘটিয়ে মত প্রকাশের পূর্ণতম স্বাধীনতা আদায় করবার জন্য কর্মপন্থা গ্রহণ করবো।
বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রাবাস ইউনিয়নগুলোকে পার্লামেন্টারীয়ানইজম-এর আওতা থেকে মুক্তি দিয়ে সত্যিকারের স্বাধীন ও বলিষ্ঠ চিন্তাধারা বিকাশের পথ খুলে দেবো এবং সঙ্গে সঙ্গে নিষিদ্ধ সভা সমিতি করার অভিযোগে যাদের উপর ‘ডিসিপ্লিনারী এ্যাকশনের এই ধরনের হুমকি সরিয়ে নেয়ার হুমকি ঝুলছে তাঁদের পেছনে এসে দাঁড়াবো আপোসহীন দাবী জানাবো।[৩৮]
৩. জননিরাপত্তা আইনের মেয়াদ বৃদ্ধি
১৯৫১ সালের নভেম্বর মাসে পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদে ‘জননিরাপত্তা আইনের’ মেয়াদ বৃদ্ধির জন্যে একটি অর্ডিন্যান্স পেশ করা হয়।
ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর আক্রমণকে জারী রাখার উদ্দেশ্যে এই সরকারী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের উদ্দেশ্যে ৪ঠা নভেম্বর পাকিস্তান অবজার্ভার অফিসে ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা লীগের’ একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।[৩৯] পাকিস্তান অবজার্ভারের সম্পাদক আব্দুস সালামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, আব্দুস সালাম, আতাউর রহমান খান, কফিলউদ্দীন আহমদ চোধুরী, কমরুদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ, মীর্জা গোলাম হাফেজ, টি হোসেন, আব্দুল বারী, আব্দুল আওয়াল, আব্দুল ওদুদ, শামসুল হক চৌধুরী এবং মীর্জা গোলাম কাদেরকে নিয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধিদল ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা লীগের পক্ষ থেকে পূর্ব বাঙলার প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে অর্ডিন্যান্সটি সম্পর্কে আলোচনা করবেন। এই সভায় আরও একটি সিদ্ধান্ত হয় যে, তাঁদের আরও কয়েকজন প্রতিনিধি মুসলিম লীগ পরিষদ সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করে অর্ডিন্যান্সটি যাতে তাঁরা পাস না করেন তার জন্যে আবেদন জানাবেন।
ইতিপূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা অর্ডিন্যান্সটির প্রতিবাদে একটি সভা করেন এবং তাঁরা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গঠনের উদ্দেশ্যে ছাত্র সমাজের কাছে আহ্বান জানান। তাঁরা বলেন যে, সরকার নিজেদের দুর্নীতি এবং অকর্মণ্যতাকে ঢেকে রেখে গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের কন্ঠরোধ ও নিজেদের গদী রক্ষার জন্যেই অর্ডিন্যান্সটির আশ্রয় গ্রহণ করেছেন।[৪০]
২রা নভেম্বর, ১৯৫১ তারিখে কফিলউদ্দীন চৌধুরীর সভাপতিত্বে ঢাকা আরমানীটোলা ময়দানে অর্ডিন্যান্সটির বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাটিতে আব্দুল জব্বার খদ্দর, আতাউর রহমান খান, কমরুদ্দীন আহমদ এবং আরও কয়েকজন বক্তৃতা করেন।
৪১ বক্তারা অর্ডিন্যান্সটিকে ‘মন্ত্রী নিরাপত্তা আইন’, ‘অফিসার নিরাপত্তা আইন’, ‘শাসকদল নিরাপত্তা আইন’ হিসেবে অভিহিত করে তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন।
৪২ কিন্তু এসব সত্ত্বেও ৫ই নভেম্বর পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদে অর্ডিন্যান্সটি গৃহীত হয় এবং তার মেয়াদ ১৯৫৩ সালের ১লা অক্টোবর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।[৪৩]
অর্ডিন্যন্সটির ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে ‘জন নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয়তে নওবেলাল বলে:
পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীন সাহেব দেশবাসীকে আশ্বাস দিয়াছেন যে, ‘নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স’ কালোবাজারী ও মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে জনসাধারণের স্বার্থে ব্যবহৃত হইবে। ইহা ছাড়াও পাক সীমান্তে ভারতীয় সৈন্য সমাবেশের ফলে যে যুদ্ধাশঙ্কা দেখা দিয়াছে ইহাতে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিপন্ন হইবার আশঙ্গা দেখা দিয়াছে।
জনাব প্রধানমন্ত্রীর ‘সাধু সঙ্কল্প’ সম্বন্ধে আমাদের বলিবার কিছু নাই—কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা হইতে বলিবার আমাদের অনেক কিছুই আছে। জনাব মন্ত্রী সাহেব জনসাধারণকে জানাইবেন কি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ চার বৎসরের মধ্যে কয়জন মুনাফাখোর ও কালোবাজারী এই অর্ডিন্যান্সের আওতায় আসিয়াছে?… প্রধানমন্ত্রী সাহেব আরও জানাইবেন কি কয়জন নিঃস্বার্থ কর্মী, সমাজ সেবক, রাজনৈতিক কর্মী অর্ডিন্যন্সী হামলার কবলে পড়িয়াছে এবং এখনও জেলে পচিতেছে ও দেশ হইতে বহিষ্কৃত হইয়াছে। ইহাদের কয়জন পাকিস্তানের স্বার্থের বিরুদ্ধে ভারতীয় স্বার্থে কাজ করিয়াছে?
গণতন্ত্রের যুগে আমাদের বাস, সরকারের সমালোচনার স্বাধীনতা বাকস্বাধীনতা আমাদের জন্মগত অধিকার। অর্ডিন্যান্স পাস করিয়া এই স্বাধীনতার উপর হামলাকে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক জনসাধারণ কোন দিনই সহ্য করিবে না।[৪৪]
১৯৪৫ সাল থেকে বিনা রশিদে মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হক কর্তৃক লেডিজ পার্কের জন্যে একটি ফাণ্ডে রিকশাচালকদের নিকট নিয়মিত ও বাধ্যতামূলক চাঁদা আদায় বন্ধ করা এবং রিকশাস্ট্যাণ্ড প্রবর্তনের দাবীতে বরিশালের দেড় হাজার রিকশাচালক তাঁদের ইউনিয়নের মাধ্যমে মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষের কাছে একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন। এই দাবীসমূহ বিবেচনা সাপেক্ষে লাইসেন্স প্রদানের মেয়াদ ১৫ই থেকে ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর অনুরোধও তাঁরা জানান। কিন্তু চেয়ারম্যান মিউনিসিপ্যালিটির কোন সভা আহ্বান না করেই পূর্ব নির্ধারিত মেয়াদ বহাল রাখেন। এর ফলে ১৬ই তারিখে বরিশাল শহরে রিক্সা চলাচল লাইসেন্স অভাবে প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ঐ দিনই রিকশাচালকগণ শান্তভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে তাঁদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিকার এবং মিউনিসিপ্যাল চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবী করেন। পরদিন কমিশনারদের এক জরুরী সভায় লাইসেন্সের মেয়াদ ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়।[৪৫]
রিকশা ইউনিয়নের আংশিক দাবী এইভাবে আদায় হওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ডি.কে. পাওয়ার জননিরাপত্তা আইনের বিশেষ ক্ষমতা বলে বরিশালের সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী আশরাফ, মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার জাহেদ হোসেন, বিএম স্কুলের সহকারী শিক্ষক ও রিকশা ইউনিয়নের সেক্রেটারী তফাজ্জল হোসেন, রিকশা ইউনিয়নের সভাপতি এলেমদ্দিন, রিকশা মহাজন সমিতির সেক্রেটারী সুশীলকুমার বসু এবং অপর দুইজন রিক্সা মহাজন ও রিকশা চালককে বরিশাল মিউনিসিপ্যাল এলাকা থেকে বহিষ্কারের জন্যে আদেশ প্রদান করেন।[৪৬]
পূর্ব পাকিস্তান ব্যক্তি স্বাধীনতা লীগ, পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইকবাল হলের ছাত্র ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্পাদক প্রভৃতি তীব্র ভাষায় এই বহিষ্কার আদেশের নিন্দা করেন এবং অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের দাবী জানান। এছাড়া আলী আহমদ খান, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন, চৌধুরী মোহাম্মদ আরীফ ও চৌধুরী শামসুদ্দীন ব্যবস্থা পরিষদের এই পাঁচজন সদস্য-এর বিরুদ্ধে এক বিবৃতি প্রদান করে জননিরাপত্তার নামে যে প্রহসন চলছে তার প্রতি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং সরকারের স্বৈরাচারী নীতির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গঠনের জন্যে দাবী জানান।[৪৭] বরিশাল জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের এই বহিষ্কারাদেশ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ‘জন নিরাপত্তা শীর্ষক একটি সম্পাদকীয়তে নওবেলাল বলে:
এই অপরিণামদর্শী আদেশের ফলে নিরপেক্ষ এবং স্বাধীনতাপ্রিয় ব্যক্তি মাত্রেই আহত হইয়াছেন।
পরিষদ কর্তৃক জননিরাপত্তা আইন গৃহীত হওয়ার পক্ষকাল যাইতে না যাইতেই ইহার এক নিদারুণ অপব্যবহারে দেশব্যাপী ক্ষোভের সঞ্চার করিয়াছে এবং জনসাধারণ সন্দেহ করিতে শুরু করিয়াছে যে বর্তমান সরকার এই ধরনের বিশেষ ক্ষমতার অধিকার পাওয়ার উপযুক্ত কিনা… তাহারা আরও ভাবিতে আরম্ভ করিয়াছে যে জননিরাপত্তার নামে যে আইন প্ৰচলিত হইলো তাহা যেন জন-অনিরাপত্তার কারণ হইয়া দাঁড়াইতেছে। বরিশালের আদেশ এবং ইতিপূর্বে অর্ডিন্যান্স রূপে এই একই আইনের আমলদারীতে আরও বহু ঘটনা দমনের এই আশঙ্কা অতি স্বাভাবিকভাবেই জাগরিত করিয়াছে। … দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের জন্য স্থানীয় বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে প্রভাবান্বিত করিয়া জননিরাপত্তা আইন যদি প্রতিপক্ষকে পর্যুদস্ত করার কাজে ব্যবহৃত হয় তাহা হইলে কার্যক্ষেত্রে এই আইন জননিরাপত্তার বদলে ‘জন- অনিরাপত্তা’ সৃষ্টি করিতে বাধ্য।[৪৮]
পুলিশী নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং অন্যান্য দাবী আদায়ের উদ্দেশ্যে ২রা ডিসেম্বর ঢাকার ২ হাজার রিকশাচালক ধর্মঘট পালন করেন এবং ঐ দিনই বিকেলে ভিক্টোরিয়া পার্কে রিকশাচালকদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।[৪৯]
১৯শে ডিসেম্বর, ১৯৫১ তারিখে পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের কার্যকরী সংসদ বিনা শর্তে সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবী করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন।[৫০] ২০শে ডিসেম্বর মেডিকেল স্কুলের এক ছাত্র সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমান ও মহীউদ্দীন আহমদের মুক্তি দাবী করা হয়। এই সভায় পাঁচজন মেডিকেল ছাত্রের বিরুদ্ধে বহিষ্কার আদেশ বাতিল করার দাবী জানানো হয়। ছাত্র, শ্রমিক এবং সাধারণভাবে জনগণের ওপর সরকারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে এই সভা তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে।[৫১]
৪. নির্যাতনের ব্যাপকতা
সরকারের নির্যাতন যে কেবলমাত্র কমিউনিস্ট এবং ছাত্রদের ওপরই জারী ছিলো তাই নয়। প্রগতিশীল জনগণের সমগ্র অংশ, এমনকি মুসলিম লীগের মধ্যেকার সরকার বিরোধী অংশও এই নির্যাতনের দ্বারা ব্যাপকভাবে নিপীড়িত হচ্ছিলো। প্রথম থেকেই পূর্ব বাঙলা সরকারের বিভিন্ন নীতি নির্ধারণ ও কার্যাবলীর ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ নেতৃত্বের থেকে আমলাতন্ত্রের প্রভাব তুলনায় অনেক বেশী ছিলো। শুধু তাই নয়, আমলাতন্ত্রের এই প্রভাব সমগ্র প্রশাসন ও সরকারী নীতির ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি লাভই করছিলো। এজন্যে মুসলিম লীগের অন্তর্ভুক্ত হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী এবং জেলা, মহকুমা অথবা তারও নিম্নস্তরের নেতাদের কোন সমালোচনাই তৎকালীন পূর্ব বাঙলা সরকারের নীতি অথবা কার্যাবলীর মধ্যে কোন পরিবর্তন সাধন করতে সক্ষম হচ্ছিলো না। এর ফলে মুসলিম লীগের মধ্যেই সরকারবিরোধিতা ক্রমশঃ একটা ব্যাপক আকার পরিগ্রহ করেছিলো এবং সেই অনুযায়ী এই ধরনের বিরোধী মতাবলম্বীরা ক্রমশঃ মুসলিম লীগের থেকে সাংগঠনিক দিক দিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন।
মুসলিম লীগ কর্মীদের ক্ষেত্রে যা ঘটছিলো সাধারণভাবে মুসলিম লীগ সমর্থক পত্রপত্রিকাগুলির ক্ষেত্রেও ঘটছিলো ঠিক তাই। সামান্য বিরোধিতা কোন জায়গায় দেখা দিলেই তাকে কমিউনিস্ট আখ্যায় ভূষিত করে সেই বিরোধিতাকে নির্যাতনের মাধ্যমে স্তব্ধ এবং বিলুপ্ত করতে সরকারের কোন ক্লান্তি ছিলো না।
এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ খুব বিরাট ব্যাপক আকারে না হলেও তা বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে দানা বাঁধছিলো। অসংগঠিত বিক্ষোভ এবং প্রতিরোধের সংকল্প ধীরে ধীরে সংগঠিত ও দৃঢ় প্রতিরোধের রূপ পরিগ্রহ করছিলো। এবং শুধু কমিউনিস্টরাই নয়, জনগণের ব্যাপকতম অংশ নিজ নিজ ক্ষেত্রে সেই প্রতিরোধে উত্তরোত্তরভাবে অংশগ্রহণ করছিলেন।
তথ্যসূত্র
১ নওবেলাল, ২৫/৫/১৯৫০ ও ২৩/২/১৯৫০।
২ নওবেলাল, ২৪/৬/১৯৪৮।
৩ পূর্বোক্ত।
৪ পূর্বোক্ত, ২৫/৫/১৯৪৯।
৫ পূর্বোক্ত, ৯/১২/১৯৪৯।
৬ পূর্বোক্ত, ৫/৫/৪৯।
৭ জনসভাটি আহ্বান করে ছাত্র র্যালী প্রকাশিত একটি ইস্তাহারে এই সভার সংবাদ পাওয়া যায়।
৮ পূর্বোক্ত, ১২/৫/৪৯।
৯ পূর্বোক্ত, ১৯/৫/৪৯।
১০ পূর্বোক্ত, ২/৬/৪৯।
১১ পূর্বোক্ত।
১২ খাতক, ১২/৮/৪৯ এবং নওবেলাল, ১৮/৮/৪৯।
১৩ নওবেলাল, ১৮/৮/৪৯।
১৪ পূর্বোক্ত, ১৫/৯/৪৯।
১৫ বর্মার কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য এই সময় পূর্ব বাঙলা সরকার বর্মা সরকারকে ৫০,০০০ স্টার্লিং বা প্রায় এক কোটি টাকা সাহায্য প্রদান করে। [দ্রষ্টব্য : ছাত্র ফেডারেশনের ইস্তাহার ‘Save Bengals from the Clutches of Riot Monger’ চতুর্থ পরিচ্ছেদ। কমিউনিস্টবিরোধী প্রচারণীর ক্ষেত্রে বর্মার সংগ্রামের প্রসঙ্গের জন্যে দ্রষ্টব্য : “পূর্ব বাঙলা সরকারের কমিউনিস্ট বিরোধী ইস্তাহার কমিউনিজমের স্বরূপ” তৃতীয় পরিচ্ছেদ।]
১৬ পূর্বোক্ত, ১০/১১/৪৯।
১৭ পূর্বোক্ত, ১৭/১১/৪৯।
১৮ পূর্বোক্ত, ২৪/১১/৪৯।
১৯ পূর্বোক্ত।
২০ পূর্বোক্ত।
২১ পূর্বোক্ত।
২২ পূর্বোক্ত, ২৬/১/১৯৫০।
২৩ পূর্বোক্ত, ২৫/৫/১৯৫০।
২৪ পূর্বোক্ত, ১৩/৭/১৯৫০।
২৫ পূর্বোক্ত, ১৩/৪/৫০
২৬ পূর্বোক্ত।
২৭ পূর্বোক্ত, ২০/৪/৫০।
২৮ পূর্বোক্ত, ২৭/৪/৫০
২৯ পূর্বোক্ত, ২৫/৫/৫০
৩০ পূর্বোক্ত, ২৭/৭/৫০
৩১ পূর্বোক্ত, ১৫/২/১৯৫১, [ছাত্র নির্যাতনের পূর্ণতর বিবরণের জন্যে দ্রষ্টব্য : প্রথম খণ্ডের ছাত্র আন্দোলন শীর্ষক পরিচ্ছেদ। -ব.উ]।
৩২ এই ইস্তাহারটিতে আমলাতন্ত্রের বিশেষতঃ অবাঙালী আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ খুব স্পষ্ট এবং তীব্র। মুসলিম লীগ নেতৃত্বের থেকে আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই ক্ষেত্রের সমালোচনা তাই মূলতঃ কেন্দ্রীভূত। মুসলিম লীগের মন্ত্রীদের সাথে অবাঙালী উচ্চপর্যায়ের আমলাদের সম্পর্ক সম্পর্কিত বক্তব্যও এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয়
৩৩ তাজউদ্দিনের ডায়েরী, ৮/১/৪৯।
৩৪ নওবেলাল, ২০/১/১৯৪৯।
৩৫ চতুর্থ পরিচ্ছেদ ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-১৯৫০’ দ্রষ্টব্য।
৩৬ নওবেলাল পূর্বোক্ত, ১৭/৩/৪৯।
৩৭ পূর্বোক্ত, ৩১/৩/৪৯।
৩৮ পূর্বোক্ত, ১৪/৯/১৯৫০।
৩৯ Pakistan Observer, 6/11/195.1
৪০ নওবেলাল, ৮/১১/১৯৫১।
৪১ নওবেলাল, ৮/১১/১৯৫১ এবং তাজউদ্দীনের ডায়েরী ২/১১/৫১।
৪২ EBL Assembly Proceedings. Vol. VI. No. 2, P. 169 and 5th November, 1951 এবং নওবেলাল, ৮/১১/৫১।
৪৩ EBL Assembly Proceedings. vol. VI. No. 2, P. 216.
৪৪ নওবেলাল, ৮/১১/৫১।
৪৫ নওবেলাল, ২৯/১১/৫১ পৃ ১,৫। ৪৬ পূর্বোক্ত।
৪৭ পূর্বোক্ত, পৃ ৫।
৪৮ পূর্বোক্ত, ২৯/১১/৫১।
৪৯ পূর্বোক্ত, ১৩/১২/৫১।
৫০ পূর্বোক্ত, ২৭/১২/৫১। ৫১ পূর্বোক্ত।