পঞ্চম দৃশ্য – নিমতলার শ্মশান ৫.১
জীবনটাই প্রহসন— বিয়োগান্ত হলেও। যুবক পুত্রকে শ্মশানে পাঠিয়ে বৎসর ঘুরতে না ঘুরতেই নারী আবার গর্ভবতী হয়, এই কন্যাদায়ের দেশে সাত মেয়ের গরিব কেরানি বাপ স্ত্রী সহবাস ছাড়তে পারে না, জীবকে বলি দিয়ে মানুষ জড়কে সচেতন বলে আরাধনা করে, আজীবন কাঙালের মতো কাটিয়ে, অন্যে ওড়াবে বলে কৃপণ প্রাণপণে টাকা জমিয়ে যায়— কত বার নাম করব— জীবন-গ্রন্থের প্রতি ছত্রে ছত্রে অমনি অগুনতি প্রহসনের দৃশ্য! অভিনয় শেষ করে তাই অভিনেতাদের দেহ যখন নিমতলার চিতার আগুনে এসে অসহায়ভাবে পুড়তে থাকে, তখন চারিদিকে যেন নাটকের অভিনয় হয়, তা নিতান্তই বিয়োগান্ত নয়।
নিমতলার শ্মশানে মাঝে মাঝে গভীর রাতে আমি বেড়িয়ে এসেছি— কত দিন কত রকমের বিচিত্র দৃশ্যই যে আমার চোখে পড়েছে— তা আর বলবার নয়। কাশী মিত্রের ঘাটেও৫.২ একবার আমি গিয়েছিলুম, কিন্তু প্রতিজ্ঞা করেছি, জীবনে আর কখনো যাব না। মেডিক্যাল কলেজের গাড়ি৫.৩ তখন ডাক্তারের অস্ত্রাঘাতে খণ্ডবিখণ্ড অনেকগুলো স্ফীত, বিকৃত ও দুর্গন্ধ শব বহে এনেছিল, পোড়ানো হচ্ছিল সেইগুলোকেই। ওঃ, তেমন ভয়াবহ দৃশ্য আর কোথাও দেখিনি। ছুটে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছিলুম, সে রাতে আর ঘুমোতে পারিনি। ভাবলে, আজও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। শুনচি, এখন নাকি সেখানে মড়া পোড়ানোর ভালো ব্যবস্থা করা হয়েছে।
শ্মশানে যারা বাস করে, তাদের প্রাণ নিশ্চয় কড়া পড়ে কঠিন হয়ে যায়। যে চিতায় সবেমাত্র একটা নরদেহ ভস্মসাৎ হয়েছে, দেখবেন, তারই ওপরে হয়তো কেউ একটা ভাতের হাঁড়ি বসিয়ে দিয়েছে! যে চিতা একজনের দেহকে গ্রাস করলে, সেই চিতাই আর একজনের দেহ পোষণের উপায় করে দিচ্ছে! মানুষ নির্বিকারচিত্তে এই অন্ন গ্রহণ করবে। এ আমার ধারণায় আসে না— মানুষ হয়ে মানুষের মরণে এতখানি অসাড়তা! …একদিনের কথা আমার মনে পড়ে। মিনার্ভায় থিয়েটার দেখতে গেছি। নাটকের প্রথম অঙ্ক শেষ হয়েছে। একবার বাইরে বেরিয়ে খোলা হাওয়ায় মাথাটা একটু ঠান্ডা করে নিতে এসেছি। হঠাৎ দেখি, রাস্তা দিয়ে একটা মড়া নিয়ে যাচ্ছে। খাটের তলা দিয়ে একটা কালো, ন্যাংটো দেহের খানিকটা ঝুলে বেরিয়ে পড়েছে— দড়ির বাঁধন বোধ হয় কোনো গতিকে ছিঁড়ে গিয়েছিল। গ্যাস ও থিয়েটারের আলো সেই দেহকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। শববাহীদের প্রতিপদক্ষেপে সেটা দুলে দুলে উঠছে। …থিয়েটারে এসে ঢুকলুম। কিন্তু রঙ্গমঞ্চের উপরে চেয়ে আবার দেখতে পেলুম সেই কৃষ্ণবর্ণ নগ্ন, দোদুল্যমান, অর্ধনির্গত শবদেহকেই। সেদিন আর থিয়েটার দেখতে পারলুম না। …মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা শবব্যবচ্ছেদ করলে, হাজার ধুলেও হাত থেকে সেদিন পচা মড়ার গন্ধ যায় না। সেই হাতেই তারা অনায়াসে ভাত খায়। আমি হলে অনাহারে মারা পড়তুম। আমহার্স্ট স্ট্রিটের৫.৪ অধুনাগত পুলিশ হাসপাতালে মিনিট খানেক শবব্যবচ্ছেদ দেখে, মাথা ঘুরে আমি পড়ে গিয়েছিলুম। তারপর কয়েক দিন আমার একরকম উপোস করেই কেটেছিল। কেন জানি না, খেতে বসলেই মনে পড়ত সেই দৃশ্যটা— মড়া হাত-পা ছড়িয়ে উপুড় ও আড়ষ্ট হয়ে আছে, আর একজন লোক ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার চেরা পিঠের ভিতর থেকে কী খানিকটা কেটে বার করছে!…
নিমতলার শ্মশানে রাত্রে গিয়ে দেখেছি, হাসি আর অশ্রু সেখানে বাস করে পাশাপাশি। অন্য জাতির সমাধিক্ষেত্রে যে গাম্ভীর্যের ভাব থাকে, হিন্দুর শ্মশানে তা নেই। আমাদের শবযাত্রাতেও তার অভাব। খ্রিস্টান বা মুসলমানের শবযাত্রায় মৃতের প্রতি একটা সম্ভ্রমের ভাব আছে, কিন্তু আমাদের তা আছে বলে মনে হয় না। প্রায়ই দেখি, মড়ার খাট পথে নামিয়ে শবযাত্রীরা মদের দোকানে ঢুকছে মদ খেতে বা মদের বোতল কিনতে। অনেকে হাসিমুখে গল্প করতে করতে শব বহে নিয়ে যায়। আর আমাদের এই ‘বল হরি, হরিবোল’ বলে যে চিৎকার, সে তো ভয়ানক। অনেক সময়ে মনে হয়, সে যেন বিকট উপহাসের রব। হিন্দুরা প্রত্যেকেই বোধ হয় জন্ম-দার্শনিক! জীবন যখন অনিত্য, তখন মৃত্যু নিয়ে আর মাথা ঘামানো কেন? …আমি কিন্তু মরবার আগে বলে যাব, আমার দেহ নিয়ে নিমতলায় যাবার সময়ে কেউ যেন হরিবোল না দেয়।
নিমতলার শ্মশানে গেলে দেখা যাবে, চারিদিকে মৃত্যুর দৃশ্য আর শোকের আড্ডার ভিতরে দিব্য এক নিশ্চিন্ত আড্ডা জমে আছে, এবং আড্ডাটা জমে ওঠে দিনের চেয়ে রাত্রেই বেশি। পুত্রহারা মা, স্বামীহারা স্ত্রী আর বাপ-মা-হারা সন্তান অশ্রান্ত স্বরে কেঁদে কেঁদে আকাশ ফাটিয়ে দিচ্ছে, কাঙাল ও ধনী, মনিব ও চাকর, পণ্ডিত ও মূর্খ, শিশু ও বুড়োর শব এখানে-ওখানে ছড়িয়ে পড়ে আছে, দাউ দাউ করে চিতা জ্বলছে, আর কত আদরের কত যত্নের মানুষের দেহগুলো, কত সৌন্দর্যের প্রতিমা, কত প্রতিভার আধার, কত অসহায়ের একমাত্র অবলম্বন দেখতে দেখতে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। পুরুত মন্ত্র পড়ছে, বালবিধবা উন্মাদিনীর মতো স্বামীর মুখে আগুন জ্বেলে দিচ্ছে, কেউ চিতায় শান্তিজল ঢালছে, সদ্য-পিতৃহীন পুত্র অশ্রুভেজা চোখে, গঙ্গাপুত্রদের সঙ্গে তাদের প্রাপ্য নিয়ে দু-চার পয়সার জন্য দর কষাকষি করছে, শ্মশানেশ্বরের৫.৫ মন্দিরে স্তব আরাধনার ধ্বনি উঠছে, স্থানে স্থানে এক এক দল লোক বসে মদ বা গাঁজা খাচ্ছে, উচ্চস্বরে গল্প-হাসি-মশকরা নিয়ে মত্ত হয়ে রয়েছে, একপ্রান্তে এক সন্ন্যাসী আস্তানা গেড়ে বসেছে, সামনে একদল ভক্ত জোড়হাতে বসে সমস্ত বিচারবুদ্ধি হারিয়ে তার ধাপ্পাবাজি শুনছে আর একদিকে এক পাহারাওয়ালা নাচারের মতো বসে ঢুলছে আর পানওয়ালির টিপ পরা হাসি-হাসি মুখের কথা ভাবছে, গঙ্গার সামনে একদল ফোক্কর ছোকরা নানান রকম ইয়ার্কি মারছে, কেউ-বা ঘাটের ওপরে বসে চক্ষু মুদে ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েছে এবং কেউ-বা মোটা গলায় চেঁচিয়ে গান ধরেছে—
শ্মশান ভালো বাসিস বলে শ্মশান করেছি হৃদি!৫.৬
এইসব বিচিত্র দৃশ্য দেখলেই বোঝা যায় হিন্দুর শ্মশানে দুঃখ-শোকের ভাবটাই প্রধান ভাব নয়— এমনকী এখানকার ভাবে হট্টগোলের মাত্রাটাই যেন বেশি বলে মনে হয়। তোমার বুকের নিধি খসে পড়েছে, চোখের আলো নিভে গেছে তো এ সংসারের কী? সে যেমন চলছে তেমনি চলবে— তোমার দিকে ফিরেও না-তাকিয়ে! তোমার কান্না শুনে সে নিজের হাসি বন্ধ করবে না। দুনিয়ার এই কঠোর সত্যটা নিমতলায় এলেই ধরা পড়ে যায়।
একবার নিমতলায় কোথা থেকে এক সন্ন্যাসী এসে বাসা বেঁধেছিল। কলকাতার পথে পথে তার নাম শুনলুম— স্টেটসম্যানে৫.৭ তার ছবি দেখলুম। হুজুগে লোকগুলো দিন কয়েক অমনি আন্দোলন শুরু করলে যে, এক রাত্রে তাকে দেখতে গেলুম। শ্মশানের ওপাশে গঙ্গামুখো হয়ে চুপ করে বসে আছে— তার চেহারায় প্রধান বিশেষত্ব যা চোখে পড়ল তা হচ্ছে, সে পুরুষ কি নারী চেনা অসম্ভব। কী গুণে সে এত নাম কিনেছে, তা কিছুই বুঝলুম না। তীর্থের কাকের মতো লোকগুলো তার পানে একাগ্র দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, তারাও যে কিছুমাত্র বুঝেছে এমনও মনে হল না। এমন সময়ে আর এক সন্ন্যাসিনীর আবির্ভাব! বয়স তার প্রায় পঁচিশ। প্রতি পদক্ষেপে কোমর যেন ভেঙে পড়ছে, চুলগুলো পিঠে এলানো, পরনে লাল টকটকে কাপড়। এর হাবভাব চেহারায় সন্ন্যাসের কোনো লক্ষণই নেই, আছে খালি কুৎসিত ভাবের লীলা। তার সঙ্গে আরও দু-চার জন লোক এল— বোধ হয় ভক্ত, অবশ্য তার যোগবলের কী যৌবনের উপাসক— সে খবর আমার জানা নেই। নবীন সন্ন্যাসিনী এসেই পূর্বোক্ত সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে মহা ঝগড়া বাধিয়ে দিলে। সে যে কী কদর্য ও অশ্রাব্য ভাষা তা আর কী বলব, শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়। প্রথমটা ঝগড়ার কারণ বুঝতে পারলুম না। শেষে জানলুম, এই নবীন তপস্বিনী এতদিন এই শ্মশানে একচ্ছত্র প্রভুত্ব বিস্তার করে ছিল, কিন্তু নতুন সন্ন্যাসিনীটির আবির্ভাবে তার পসার মাটি হবার জো হয়েছে, তাই নাকি এই বিবাদ! —দিন কয়েক পরে এক রাত্রে নিমতলার শ্মশানে গেলুম। নবাগত বিখ্যাত সন্ন্যাসিনী তখন অদৃশ্য, কিন্তু নবীন তপস্বিনী সেখানে পূর্ণ মহিমায় বিরাজ করছে। কতগুলো লোকের সঙ্গে সে ফস্টিনস্টি করছিল। ঠিক বলতে পারি না, তবে মনে হল তার চোখেও যেন সুরার রং ফুটে উঠেছে।
রাত্রে বারবনিতারাও প্রায় এখানে বেড়াতে আসে। কী দেখতে যে আসে, তারাই জানে। নিছক দেহের উপাসিকা তারা, এখানে এসে নরদেহের এই শোচনীয় পরিণাম দেখতে তাদের ভালো লাগে? আশ্চর্য! এ বিশেষত্ব ভারতে হিন্দুদের মধ্যেই সম্ভব, অন্য জাতির বারবনিতারা কখনোই এমন ব্যাপারে রাজি হবে না। তারা যে কেবল সুখের কপোতী— জরা বা মৃত্যু যে তাদের চোখের বালি! …গণিকারা মত্ত অবস্থায় টলতে টলতে ভিতরে এসে ঢোকে— সঙ্গে সঙ্গে আসে কতকগুলো মার্কামারা লম্পট চেহারা! এখানে ঢুকেও তাদের জঘন্য ও অশ্রাব্য কামের প্রলাপ বন্ধ হয় না, এদিকে-ওদিকে ঘুরে শবদাহ দেখে, শ্মশানেশ্বরের মন্দিরে প্রণাম করে ও প্রণামী দিয়ে তারা আবার চলে যায়— কলুষিত আনন্দ বিলাসের হাসি-তামাশা গোলমালে এই শোকপুরীকে মুখরিত করে!
মাঝে মাঝে গণিকার দলও গণিকার শবদেহ নিয়ে আসে। তারা আসে প্রায় অর্ধনগ্ন অবস্থায় একখানামাত্র কাপড় পরে। তারাও মদ খেয়ে তর হয়ে থাকে। তাদের তীক্ষ্ন মেয়েলি গলার উচ্চ হরিবোলে রাত্রের স্তব্ধতা বিদীর্ণ হয়ে যায় এবং শ্মশানঘাটের কাছাকাছি যাদের বাড়ি, তারা বিলক্ষণই জানে যে, সে চিৎকার শুনলে মনও যেন কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। বহু লাঞ্ছনা, মনোকষ্ট, অপমান, হীনতা ও কুৎসিত ব্যাধির ভারে জীর্ণ দেহের পিঞ্জর থেকে এক অভাগীর আত্মা মুক্তিলাভ করেছে, এই মৃত্যুশীতল দেহে আর হাবভাব ও লালসার কোনো লক্ষণ নেই! কিন্তু তার সঙ্গিনীরা এসব কথা নিয়ে একটুও মাথা ঘামায় না, শ্মশান ও মানুষের শেষ দশা দেখে তারা কিছুমাত্র দমে যায় না, মদ খেয়ে তারা মাতামাতি ও পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া করে, মৃত সঙ্গিনীর প্রতি অশ্লীল ভাষায় কৌতুক বাণ নিক্ষেপ করে, কিংবা শ্মশানের জন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে ভঙ্গিভরে রসিকতা করে। এক বিষম অস্বাভাবিক ব্যাপার।
শ্মশানঘাটে অনেক রাত্রে ছোটোখাটো সভা বসে এবং সেখানে ফুটবল, ক্রিকেট খেলা থেকে সমাজনীতি ও রাজনীতির কথা পর্যন্ত কিছুই বাদ যায় না। ওদিকে মড়ার পর মড়া পুড়ছে, আর এদিকে নিশ্চিন্তভাবে গল্প ও তর্ক চলছে— এ কি বিসদৃশ নয়? কলকাতার প্রায় প্রত্যেক পাড়ায় এক এক দল লোক থাকে, তারা পেশাদার না হলেও পল্লির অনেক শব বহনের ভার তাদের ঘাড়েই পড়ে। মৃতের জন্য এদের মনে বিশেষ কোনো শোকের ভাব থাকে না, মড়া নামিয়ে অনেকে এসে উক্ত সভায় যোগদান করে। এদের কেউ কেউ বহুকাল ধরে বহু মড়ার ভারবহন করে করে এ কাজে রীতিমতো পাকা হয়ে গেছে। এরা আবার শবদাহের অনেক রকমের বিচিত্র কাহিনি জানে। সেসব কাহিনির কোনো-কোনোটি অত্যন্ত চমকপ্রদ ও আশ্চর্য। এই ধরনের একটি কাহিনি এখানে দেওয়া গেল। নিমতলার শ্মশানে এক প্রবীণ শববাহীর মুখে এটি শোনা। এর সত্য-মিথ্যার জন্যে আমি দায়ী নই, কিন্তু কাহিনিটির কথক একে সত্য ঘটনা রূপেই বলেছিলেন। তাঁর গল্প এই—
কলকাতার এক পুরাতন পল্লিতে আমাদের বাস (পল্লির নামও তিনি বলেছিলেন, আমার মনে নেই)। —পাড়ার কেউ মরলে ও তার মড়া বইবার লোকের অভাব হলে তখনই আমাদের ডাক পড়ে। মড়া পুড়িয়ে পুড়িয়ে আমরা পাড়ায় বিখ্যাত হয়ে উঠেছি। এ কাজে আমাদের স্বার্থ আছে এইমাত্র, মৃতের আত্মীয়েরা সামাজিক নিয়ম অনুসারে আমাদের একদিন আহারের নিমন্ত্রণ করে।
বছর কয়েক আগে, একদিন রাত্রে আমরা বসে বসে গল্প করছি, হঠাৎ এক বৃদ্ধ এসে আমাদের ঘরে ঢুকল। তার মুখে শুনলুম, তার বাড়িতে একটি স্ত্রীলোক মারা গেছে, কিন্তু লোকাভাবে সৎকার হচ্ছে না। বুড়োকে আমরা চিনতুম না। কলকাতার পাড়ায় নিত্যই কত নতুন ভাড়াটে আসছে, সকলকে চেনা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা কোনো আপত্তিই না করে, তখনই কোমর বেঁধে গামছা নিয়ে বুড়োর সঙ্গে চললুম।
পাড়ার প্রান্তে আলোকহীন এক গলির ভিতরে একটা বাড়িতে বুড়ো আমাদের নিয়ে গেল। বুড়োর মতো বাড়িটাও অনেক বৎসরের ভারে জীর্ণ। তার ভেতর ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ নেই। ঠিক যেন হানা বাড়ি, ঢুকলেই বুকটা ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ করে!
একতলাতেই একটা ঘরের সামনে গিয়ে বুড়ো দরজা খুলে দিল। ঘরের ভেতর একটা নিভুনিভু মাটির প্রদীপ মিটমিট করে জ্বলছে— যেন ঘরের ভিতরে কতখানি অন্ধকার আছে তাই-ই ভালো করে দেখাবার জন্য! সেই আবছায়াতে দেখলুম, একখানা দড়ির খাটের ওপরে একটা মৃতদেহ শোয়ানো রয়েচে, উপরে তার চাদরে ঢাকা। সমস্ত ঘরটা যেন মৃত্যুর কেমন একটা অস্বাভাবিক গন্ধে পরিপূর্ণ।
আমরা খাটসুদ্ধ মৃতদেহটাকে ঘর থেকে বার করে আনলুম, বুড়ো কিন্তু তবু ভিতরে দাঁড়িয়ে রইল।
আমি বললুম, ‘কই মশাই, আসুন।’
বুড়ো বললে, ‘আমি গেলে বাড়ি আগলাবে কে?’
আমি বললুম, ‘সে কি মশাই, আপনাদের মড়া, আপনি না এলে আমরা কি নিয়ে যেতে পারি?’
অত্যন্ত অনিচ্ছার সঙ্গে বুড়ো বলল, ‘আচ্ছা, তবে চলুন, আমিও যাচ্ছি।’
মড়া নিয়ে আমরা শ্মশানের দিকে এগুলুম, বুড়ো আসতে লাগল আমাদের পিছনে পিছনে। বিডন স্ট্রিটে যখন এসে পড়েছি, তখন হঠাৎ আমার গলার উপরে টপ করে ঠান্ডা কীসের একটা ফোঁটা পড়ল। বৃষ্টি এল নাকি? আকাশের দিকে চেয়ে দেখলুম, সেখানে মেঘের নাম গন্ধও নেই। অবাক হয়ে ভাবছি— আবার এক ফোঁটা! নিশ্চয়ই খাট থেকে কী পড়ছে! …কিন্তু কী পড়ছে?
প্রাণটা কেমন অশান্ত হয়ে উঠল। সঙ্গীদেরও ডেকে ব্যাপারটা বললুম। তারপর একটা গ্যাসপোস্টের কাছে গিয়ে যা দেখলুম, তাতে পা-দুটো যেন পক্ষাঘাতে আড়ষ্ট হয়ে গেল! রক্ত, রক্ত— মড়ার চাদর চুঁইয়ে এ যে রক্তের ফোঁটা ঝরছে! কীসের রক্ত এ?
তাড়াতাড়ি পেছন দিকে চাইলুম— কিন্তু বুড়োকে আর দেখতে পেলুম না। কোন ফাঁকে সে সরে পড়েছে।
এখন উপায়? যাকে বহে নিয়ে যাচ্ছি, তাকে কি কেউ খুন করেছে? পথের মাঝে চাদর খুলে দেখতেও ভরসা হল না— যদি আর কারোর চোখে পড়ে যায়? সকলেই কাঁধে খাট নিয়ে স্তম্ভিতের মতো সেখানে দাঁড়িয়ে রইলুম— না পারি এগুতে, না পারি পেছুতে। মড়া নিয়ে উলটো পথে আবার পাড়ার দিকে ফিরে গেলেও লোকে সন্দেহ করবে, এগুলেও শ্মশানে গিয়ে ধরা পড়ব।
একজন বললে, ‘এসো, আমরা এখানেই খাট ফেলে যে যে-দিকে পারি টেনে লম্বা দি!’
আমি বললুম, ‘তাহলে এখনই ধরা পড়ব। ওই দেখ, একটা পাহারাওয়ালা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখচে!’
বুকটা ঢিপ ঢিপ করতে লাগল, তবু প্রাণপণে আমরা এগিয়ে গেলুম। পাহারাওয়ালার চোখের সামনে দিয়ে যাবার সময়ে আমাদের মনের ভেতরটা যে কীরকম করছিল, তা আর খুলে বলবার নয়! যা হোক, পাহারাওয়ালা কিছু বললে না। উপস্থিত বিপদ থেকে তো রক্ষা পেলুম, কিন্তু শ্মশানে গিয়ে কী হবে? সেখানে তো এই রক্তাক্ত লাশ সকলের সম্মুখে ফাঁকি দিয়ে পোড়ানো যাবে না। বাঁচবার আর কোনো উপায় নেই।
ঠিক যেন ভূতগ্রস্তের মতো আচ্ছন্ন অবস্থায় নিমতলার শ্মশানে এসে পড়লুম। রাত তখন অনেক। প্রতি পদে মনে হতে লাগল আমরা এক-পা এক-পা করে সাক্ষাৎ ফাঁসিকাঠের দিকে এগিয়ে চলেছি।
মরিয়া হয়ে শ্মশানের ভেতরে ঢুকলুম। কোনো দিকে না চেয়ে, শ্মশানের যে অংশ গঙ্গার ঘাটের দিকে, একেবারে সেইখানে গিয়ে পড়লুম। খাট নামিয়ে, মড়া ঢাকা চাদরের একপাশ কোনোরকমে একটু তুলে দেখলুম, যা ভেবেছি তাই! এই স্ত্রীলোকটাকে কেউ খুন করেছে।
আমাদের কপাল— শ্মশানের এ অংশটা সেদিন নির্জন ছিল। আমরা আর এক সেকেন্ড দাঁড়ালুম না, লাশসুদ্ধ খাট সেইখানেই ফেলে রেখে, সকলে চুপি চুপি গঙ্গায় গিয়ে ঝপাঝপ ঝাঁপিয়ে পড়লুম, তারপর একেবারে এক সাঁতারে অনেক তফাতে এসে উঠলুম।…
পাড়ায় এসেই সেই বাড়ির দিকে ছুটলুম। বাড়ি খালি। বুড়োকেও আর চোখে দেখিনি।
***
টীকা
৫.১ নিমতলার শ্মশান— আজ থেকে ৩০০ বছর আগে গঙ্গা বইত আরও প্রায় দুশো মিটার ভিতর দিয়ে, অর্থাৎ আজ যেখানে আনন্দময়ী কালী মন্দির সেইখান দিয়ে। চার্নকের কলকাতায় পদার্পণের ইতিহাস বলছে তিনি নেমেছিলেন সুতানুটি ঘাটে, যার পরে নাম হয় হাটখোলা ঘাট। মার্ক উডের তৈরি ১৭৮৫ সালের কলকাতার ম্যাপে দেখা যায় যে সুতানুটি আর হাটখোলা কিন্তু আদতে একই ঘাটের নাম, এবং এর প্রায় তিনশো মিটার দক্ষিণে একটি ঘাটের নাম নিমতলা ঘাট। স্থানীয় কিংবদন্তি অনুযায়ী, বর্তমান আনন্দময়ী কালী মন্দির বয়সে নবীন হলেও বিগ্রহের বয়স প্রায় ৩৫০ বছর। গঙ্গার ধারের শ্মশানে নাকি পূজিত হতেন দেবী, তাই শ্মশানকালী। কিন্তু এই শ্মশানই কি নিমতলা শ্মশান? বিগত ৩০০ বছরে নিদেনপক্ষে তিনবার স্থান পরিবর্তন হয়েছে নিমতলা শ্মশানের। এখন আমরা যা দেখতে পাই তা হল চতুর্থ সংস্করণ। চার্নকের সময় গঙ্গা আজকের থেকে প্রায় ২০০ মিটার ভিতর দিয়ে বইলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে আসে নদী। ১৮২৩ নাগাদ লটারি কমিটি তৈরি করে স্ট্র্যান্ড রোড, ফলে প্রথমবারের জন্য স্থান পরিবর্তন করে শ্মশান, আজ যেখানে চক্ররেলের লাইন, আন্দাজ তার পাশেই পূর্বদিকে তৈরি হয়, ১৮২৮য়ের মার্চ নাগাদ। ১৮৭৫-এ পোর্ট কমিশনের আপত্তিতে, রেল চলাচলকে বাধামুক্ত করার জন্য, আরও পশ্চিমে সরে শ্মশান। প্রায় ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ে, ম্যাকিনটশ বার্ন কোম্পানি নির্মাণ করে তৃতীয় নিমতলা শ্মশান, যার ভগ্নাবশেষ আজও দেখতে পাওয়া যায় গঙ্গার ধারে। আটের দশকে যোগ হয় বৈদ্যুতিক চুল্লি এবং শেষ অবধি ২০১৫ সালে সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় সামান্য দক্ষিণে তৈরি নতুন বৈদ্যুতিক চুল্লিযুক্ত নিমতলা মহাশ্মশান।
তাহলে নিমতলা ঘাট বা নিমতলা শ্মশানের নামকরণের উৎস যে নিমগাছ, সেটা কোথায়? ‘Chuttanuttee Diary and Consultations’ অনুযায়ী ১৬৯০ সালের ২৪শে আগস্ট চার্নকের জাহাজের ক্যাপ্টেন ব্রুক সুতানুটির কাছে একটি প্রকাণ্ড নিমগাছের কাছে নোঙর করেন। এই নিমগাছটি ছিল বর্তমান আনন্দময়ী কালীবাড়ির সামান্য উত্তরে, যেটি ১৮৮০ নাগাদ আগুনে সম্পূর্ণ পুড়ে যায়।
কিন্তু শুধুই কি নিমগাছ থেকেই জায়গার নাম নিমতলা, নাকি আছে অন্য ব্যাখ্যাও?
জোড়াবাগান চৌমাথা থেকে নিমতলা ঘাট স্ট্রিট ধরে গঙ্গার দিকে যেতে আনন্দময়ী কালী মন্দিরের ঠিক আগেই বাঁদিকে পড়বে একটি মসজিদ, রাস্তা থেকে প্রায় দোতলা উচ্চতায়, নয় গম্বুজবিশিষ্ট। নাম নিয়ামৎউল্লাহ্ মসজিদ। ১৭৮৪ সালে, স্থানীয় জমিদার মহম্মদ রমজান আলি এই মসজিদ নির্মাণ করিয়েছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষ নিয়ামৎতুল্লাহ্র নামে। দোকানের ছাদগুলো সমান নয়, বরং অর্ধবৃত্তাকার, ঠিক যেন মসজিদের তলায় কোনও গোপন কক্ষের প্রবেশপথ! আগে নাকি মসজিদের তলা দিয়ে গঙ্গায় যাওয়ার সুড়ঙ্গ ছিল। রমজান আলির পূর্বপুরুষ নিয়ামৎতুল্লাহ্ নির্মাণ করিয়েছিলেন একটি ঘাট, পরবর্তীকালে ঠিক তার ধারেই তৈরি হয় মসজিদ। এই সুড়ঙ্গটি ছিল আসলে ঘাটে যাওয়ার পথ, যা বর্তমানে বন্ধ। মসজিদ অত উঁচুতে তৈরি করার কারণও হল সেই গঙ্গাই, যাতে জোয়ারের জলে প্লাবিত না হয় ধর্মস্থান। তবে নিয়ামৎতুল্লাহ্ ঘাট নিয়ে প্রচলিত আছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক বিস্ময়কর কিংবদন্তি। এই ঘাট নাকি ব্যবহার করতেন হিন্দু ও মুসলিম, দুই সম্প্রদায়েরই মানুষ। একদিন কিছু ব্রাহ্মণ ঘাটে পুজো করার সময় কয়েকজন মুসলিম বাচ্ছা ছেলের স্নানের জল ছিটকে এসে লাগে তাঁদের গায়ে। নিজেরা ‘অপবিত্র’ হয়ে গেছেন এই কুসংস্কার থেকে ব্রাহ্মণরা বলাবলি করতে থাকেন যে তাঁরা আর এই ঘাট ব্যবহার করবেন না। এই কথা রমজান আলির কানে গেলে তিনি রীতিমতো সেপাই বসিয়ে এই ঘাট শুধুমাত্র হিন্দুদের জন্যই নির্দিষ্ট করে দেন। নিজের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে এই নির্দেশ সত্যিই অভূতপূর্ব!
এখন কয়েক শতক পরে নিমগাছ থেকে নাম নিমতলা নাকি নিয়ামৎতুল্লাহ্ ঘাট বা মসজিদ থেকে অপভ্রংশ হয়ে নাম নিমতলা, সেই প্রশ্নের উত্তরও হারিয়ে গেছে কালের গর্ভেই। সঙ্গে ১৯০২ সালে তোলা নিমতলা শ্মশানের ছবি।
৫.২ কাশী মিত্রের ঘাট— ‘কলিকাতা সেকালের ও একালের’ বইতে হরিসাধন মুখোপাধ্যায় লিখছেন, “কাশীপ্রসাদ, মিত্র, ইতিহাসপ্রসিদ্ধ রাজ রাজবল্লভের ভাগিনেয়। ইঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র, রায় রামপ্রসাদ মিত্র বাহাদুর, গবর্ণমেণ্টের তোষাখানায় দেওয়ান হইয়াছিলেন। ইঁহার অন্যতম পুত্র, বাবু গোপাল লাল মিত্ৰ হাইকোটের উকীল ছিলেন। কাশী মিত্র মহাশয়ের নামে আজও একটা ঘাট কলিকাতা সহরে বর্তমান। এখানে শবদাহ হইয়া থাকে। এই ঘাট ‘কাশী মিত্রের ঘাট’ বলিয়া সাধারণে পরিচিত।”
৫.৩ মেডিক্যাল কলেজের গাড়ি— শব বহনকারী গাড়ি। ১৮২২ সালের ৯ মে, মেডিক্যাল বোর্ডের আলোচনায় উঠে এল, নেটিভদের চিকিৎসাশাস্ত্রে পাঠ দেওয়ার কথা। সেই প্রস্তাব লিখিত আকারেই ভারতের তৎকালীন মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল উইলিয়াম কেসমেন্টকে পাঠালেন সদস্যরা। অনুমতি মিলল। সে বছরের ২১ জুন শুরু হয়ে গেল THE SCHOOL FOR NATIVE DOCTORS (পরবর্তী সময়ে ১৮২৪-এর অক্টোবরে নাম পরিবর্তন হয়ে THE NATIVE MEDICAL INSTITUTION)। মেডিক্যাল কলেজের ইতিহাস রচয়িতা পূর্ণচন্দ্র দে লিখছেন, ‘মনে হয়, মহাত্মা রামকমল সেনের বাটীতেই (পুরাতন এলবার্ট কলেজের গৃহেই) এই স্কুল বসিয়াছিল।’ অর্থাৎ লর্ড ময়রার বদান্যতায় আজকের কফি হাউসের বাড়ি থেকেই কলকাতার তো বটেই, দেশের প্রথম ডাক্তারি শিক্ষার প্রতিষ্ঠানের পথ চলা শুরু।
১৮২৩-এ মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ‘আমাদের চিকিৎসা-বিদ্যালয়ে যত ছাত্র লইবার আদেশ করিয়াছিলেন, তাহা অপেক্ষা অনেক অধিক ছাত্র ভর্ত্তি হইতে আসিয়াছিল। আমরা কেবল ২০ জন বুদ্ধিমান ছাত্রকে ভর্ত্তি করিয়াছি। অবশিষ্ট ছাত্রগণকে বলিয়া রাখিয়াছি যে, খালি হইলেই তোমাদিগকে ভর্ত্তি করা যাইবে।’ নেটিভ ডাক্তারি স্কুলের প্রথম সুপারিন্টেন্ডেন্ট ডাক্তার জেমস জেমিসন। তিনি দেশীয় ভাষায় শিক্ষাদান করতেন। শুধু তাই নয়, চিকিৎসার বেশ কয়েকটি বই তিনি ছাত্রদের জন্য অনুবাদ করেছিলেন দেশীয় ভাষায়। তবে প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার ৭ মাসের মধ্যে মৃত্যু হয় তাঁর। জেমিসনের জায়গায় আসেন জন ব্রেটন, রীতিমতো দেশীয় ভাষাজ্ঞানের পরীক্ষা দিয়ে। বেতন ১ হাজার ৬০০ টাকা। তিনিও দেশীয় ভাষায় বেশ কয়েকটি পুস্তিকা রচনা করেন। সরকারি রিপোর্টে সে কথা লেখা হচ্ছে— ‘Surgeon Breton immediately undertook the compilation of a vocabulary of the names of the different parts of the human body, and of medical and technical terms in Roman, Persian, and Nagree characters: and also submit copies of demonstrations of the brain, thoracic and abdominal viscera, and of the Structure of the eye, in the Persian and Nagree character…’
THE SCHOOL FOR NATIVE DOCTORS কেমন ডাক্তার তৈরি করতে পারল? দেশের চিকিৎসাব্যবস্থারই বা হাল কী? আরও কীভাবে উন্নতি করা যায়? এ প্রশ্নগুলিকে সামনে রেখে দেশীয় ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি তৈরি করেন লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক। ২০ অক্টোবর, ১৮৩৪ কমিটি সুপারিশ করে—অবিলম্বে একটি মেডিক্যাল কলেজের প্রয়োজন। কমিটির সুপারিশ মেনেই মাত্র তিন মাসের মধ্যে ২৮ জানুয়ারি, ১৮৩৫-এ শুরু হয় মেডিক্যাল কলেজ, বেঙ্গল। দেশ তো বটেই, এশিয়ার মধ্যেও এটিই প্রথম ডাক্তারি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। ইংরেজি তো বটেই, দেশীয় ভাষাতেও শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল এই প্রতিষ্ঠানে।
মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠার দিন নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। শিবনাথ শাস্ত্রী লিখছেন— জুন, ১৮৩৫, প্যারীচাঁদ মিত্র লিখছেন— ০১.০২.১৮৩৫। আবার প্রতিষ্ঠানের শতবার্ষিকী ক্রোড়পত্র অনুযায়ী প্রতিষ্ঠার দিন ২০.০২.১৮৩৫। ‘সমাচার দর্পণ’-এ লেখা হচ্ছে ৯ জ্যৈষ্ঠ (অর্থাৎ মে মাসের শেষ)। আবার ‘সমাচার দর্পণ’ পরের বছর মার্চ মাসে লিখছে, ‘গত বৃহস্পতিবার নতুন চিকিৎসা শিক্ষালয়ের কার্য আরম্ভ হয়।’একই দিনের উল্লেখ করছে ২৬ মার্চ ১৮৩৬ সালে প্রকাশিত ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকাও। ‘আদি কলকাতায় পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে চিকিৎসা-বিজ্ঞান চর্চা’ প্রবন্ধে পীযূষকান্তি রায় এর একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন— ‘আগে পরে প্রতিষ্ঠা বছরের এ গরমিল হওয়ার কারণ হল ইংরেজি ও দেশীয় ভাষার মাধ্যমে দুটি বিভাগের আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠা।’ যাঁদের সহায়তা ছাড়া মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা হত না, তাঁরা হলেন— প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, মতিলাল শীল, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, শ্যামচরণ লাহা, ইহুদি ব্যবসায়ী এজরা পরিবার এবং অবশ্যই ডেভিড হেয়ার। ডাক্তার এম.জে রামলি ছিলেন মেডিক্যাল কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ। তবে সামান্য জ্বরেই মৃত্যু হয় এই বিখ্যাত চিকিৎসকের। কলেজের দায়িত্ব নেন ডেভিড হেয়ার। তিনি ছিলেন কলেজের সচিব এবং কোশাধ্যক্ষ। দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রথম তিন বছর মেডিক্যাল কলেজের জন্য ২ হাজার টাকা অর্থসাহায্য করেন। ১৮৪৪-এ তিনি ঘোষণা করেন, মেডিক্যালের কয়েকজন কৃতী ছাত্রকে তিনি ইংল্যান্ডে পাঠাবেন। দ্বারকানাথের প্রস্তাবে চার বাঙালি ছাত্রের বিদেশ যাত্রা সম্ভব হল— ভোলানাথ বসু, সূর্যকুমার চক্রবর্তী, দ্বারকানাথ বসু এবং গোবিন্দলাল শীল। তবে দ্বারকানাথ বসু ও গোবিন্দলাল শীলের ব্যয়ভার বহন করেছিল তৎকালীন সরকার। সঙ্গে তখনকার মেডিক্যাল কলেজের ছবি।
৫.৪ আমহার্স্ট স্ট্রিট— পুরোনো কলকাতা শহরে শুরুতে তিনটে হাসপাতাল ছিল, জেনারেল হাসপাতাল, পুলিশ হাসপাতাল এবং নেটিভ হাসপাতাল। ১৭০৭-এ প্রতিষ্ঠিত জেনারেল হাসপাতাল আজকের এসএসকেএম, ১৭৮৯-এ স্থাপিত পুলিশ হাসপাতালে পুলিশ কর্মী এবং তাঁদের পরিবারের চিকিৎসা। যে দেশে গেঁড়ে বসতে চলেছেন, সে দেশের মানুষদের কি চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করলে চলে ! এতটাও অবিবেচক ছিলেন না ব্রিটিশরা। তাই ১৭৯৪ সালে নেটিভ হাসপাতালের যাত্রা শুরু। এই পুলিশ হাসপাতাল ছিল আমহার্স্ট স্ট্রিটে, যা বিংশ শতকের প্রথমার্ধেই বন্ধ হয়ে যায়।
৫.৫ শ্মশানেশ্বরের মন্দির— নিমতলা ঘাটের পাশের শিবমন্দির। প্রাচীনত্বে প্রায় ঘাটের সমান।
৫.৬ শ্মশান ভালো বাসিস…— পুরো গানটি এই রকম:
শ্মশান ভালো বাসিস বলে, শ্মশান করেছি হৃদি।
শ্মশানবাসিনী শ্যামা, নাচবি সেথা নিরবধি।
আর-কোনো সাধ নাই মা চিতে, সদাই আগুন জ্বলছে চিতে।
(ওগো) চিতাভস্ম চারিভিতে, রেখেছি মা আসিস যদি,
মৃত্যুঞ্জয় মহাকালে রাখিয়ে চরণতলে।
নাচ দেখি মা তালে তালে দেখি আমি চরণ মুদি।
রচয়িতা অজ্ঞাত। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের প্রিয় গান। সারদা মায়ের মাতাল ভক্ত বিনোদবিহারী সোম বা পদ্মবিনোদকেও এই গান শোনাতে দেখা যায়।
৫.৭ স্টেটসম্যানে— দ্য ইংলিশম্যান এবং দ্য ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়া উভয়ই কলকাতা থেকে প্রকাশিত হত। দ্য ইংলিশম্যান ১৮১১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। দ্য স্টেটসম্যান, কলকাতা শুরু হয় দ্য স্টেটসম্যান এবং নিউ ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া নাম থেকে। খুব শীঘ্রই এর প্রকৃত নাম সংক্ষিপ্ত করা হয় এবং এই সংবাদপত্র দ্য স্টেটসম্যান হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ভারতের প্রাচীনতম ইংরেজি সংবাদপত্র দ্য স্টেটসম্যান, কলকাতায় ১৮৭৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। স্বাধীনতার পর এই সংবাদপত্রের কর্তৃত্ব ভারতীয়দের স্থানান্তরিত করা হয়। এই পত্রিকার বিক্রি কমতে থাকে যখন আনন্দবাজার গোষ্ঠী এম জে আকবরের সম্পাদনায় দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকা বের করতে শুরু করে। এরপর টাইমস অফ ইন্ডিয়া কলকাতা সংস্করণ শুরু করলে স্টেটসম্যানের হাল আরও খারাপ হয়। এরপর তারা স্টেটসম্যানের বাড়ির কিছু অংশ প্রথমে বিক্রি করে দেয়। তারপর হাতবদল হয় স্টেটসম্যানের। কিন্তু অবশেষে ২০১৯ সালে তার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।
এই পত্রিকার মাস্টহেডটি খুব বিখ্যাত ছিল। সত্যজিৎ তাঁর চারুলতা ছবিতে কাল্পনিক পত্রিকা The Sentinel-এর মাস্টহেড স্টেটসম্যানের মতো করেন। (সঙ্গে ছবি)।