পঞ্চম খণ্ড – প্রতিহিংসা—রক্তে রক্তে
Alh. I look far down the pit-
My sight was bounded by a jutting fagment:
And it was stained with blood. Then first I shrieked.
My eye-balls burnt, my brain grew hot as fire.
And all the hanging drops of the wet roof
Turned into blood-I saw them turn to blood!
And I was leaping wildly down the chasm.
When on the farther brink I saw his sword.
And it said, Vengeance! curses on my tongue?
Coleridge-”Remorse” Act IV, Scene III.
প্রথম পরিচ্ছেদ – ভীষণ আয়োজন
তাহার পর দুই মাস কাটিয়া গিয়াছে। এই দুই মাসের মধ্যে এমন কোন ভীষণ রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটে নাই, যাহাতে কোন পাঠকের সুপ্ত বিস্ময় বিচলিত হইয়া উঠিতে পারে। ইতোমধ্যে সিরাজউদ্দীনের সহিত কুলসমের বিবাহ হইয়া গিয়াছে, এবং তাঁহারা সুখে আছেন শুনিয়া সহৃদয় পাঠক পাঠিকা নিশ্চিন্ত হইবেন, আশা করি। এবং আরও আশঙ্কা করি, শুনিয়া দুঃখিত হইবেন যে, ফুলসাহেবের অন্বেষণে এই দীর্ঘ দুইটি মাস শ্রেষ্ঠ ডিটেকটিভ অরিন্দমের একান্ত নিষ্ফলে কাটিয়া গিয়াছে। যাহা হউক, তথাপি তিনি নিরুদ্যম বা ভগ্নোৎসাহ হইয়া পড়েন নাই; যত সময় যাইতেছে, ফুলসাহেবের জন্য অরিন্দম তেমনি অধীর হইয়া উঠিতেছেন। এই দুই মাস তাঁহার না আছে আহারের ঠিক, না আছে নিদ্রার ঠিক, না আছে মনের ঠিক এবং না আছে স্বাস্থ্যের দিকে দৃপাত্ত অথচ এত পরিশ্রমে কাজ কিছুই হইতেছে না।
এদিকে অরিন্দম ফুলসাহেবকে ধরিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছেন। ঠিক এই সময়ে লোকালয়ের বহির্ভাগে এক গহন বনের মধ্যে তাঁহার মরণ আকাঙ্ক্ষা করিয়া একটা ভীষণ ষড়যন্ত্র হইতেছে।
যে বাড়ী হইতে অরিন্দম সিরাজউদ্দীনকে উদ্ধার করেন, তাহা অতিক্রম করিয়া পূর্ব্বোক্ত মুখে আরও অনেক দূরে যাইলে প্রকাণ্ড আমবাগান দেখিতে পাওয়া যায়। সে-জায়গাটার নাম কাঁপা। কাঁপার চারিদিকে বড় বড় গাছ, ঘন জঙ্গল এবং নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতা যেন সজীব, যেন চারিদিক্ ছম্ ছম্ করিতেছে।
রাত্রে চাঁদ উঠিয়াছে, কৃষ্ণাসপ্তমীর ম্রিয়মাণ চন্দ্র। তাহার আলো বনের ভিতরে তেমন আসিতে পারে না, এক-আধ জায়গায় একটু-আধটু; দেখিয়া একান্তই অনাবশ্যক বলিয়া বোধ হয়; কিন্তু সেই বনের পার্শ্বে যেখানে কালুরায়ের জীর্ণ মন্দির, সেখানের অনেকটা স্থান উন্মুক্ত থাকায় নির্বিঘ্নে সেখানে চাঁদের আলো একেবারে প্লাবিত হইয়াছে; কিন্তু সে ভীষণ স্থানে চাঁদের আল্যে যেন কেমন বড় ভয়ানক-ভয়ানক বলিয়া মনে হয়।
এই বনমধ্যস্থ নির্জ্জন মন্দিরটি একজন ডাকাইতের স্থাপিত। অনেকদিন পূর্ব্বে এই মন্দিরের মধ্যে অসংখ্য নরবলি এবং কত লোকের মাথাটা দেহ হইতে পৃথক্ করিবার মন্ত্রণা হইয়া গিয়াছে। আজও এই কৃষ্ণাসপ্তমীর মধ্যরাত্রে অনেকগুলি লোক একসঙ্গে জটলা করিয়া, কবাট বন্ধ করিয়া সেইরূপ একটা ভীষণ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। এবং সেই যড়যন্ত্রের মধ্যে পড়িয়া আপাততঃ রাশি রাশি তামাক ও গাঁজা মুহুর্মুহুঃ ভস্মীভূত হইতেছিল। চারিদিক্ বন্ধ থাকায় অনর্গল ধূম ভিতরে জমাট বাঁধিতেছিল। একপাশে একটি প্রদীপ জ্বলিতেছিল। এবং সেই ধূমরাশি ভেদ করিয়া আলোক বিস্তার করা দুরূহ ব্যাপার মনে করিয়া সেটা যেন ক্রমশঃ নিস্তেজ হইয়া পড়িতেছিল। এমন সময়ে বাহির হইতে রুদ্ধদ্বারে করাঘাতের শব্দে মন্দিরের মধ্যভাগ প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল।
ভিতর হইতে একজন বলিল, “কে ও?”
বাহির হইতে উত্তর হইল, “আমি!”
বিকৃত মুখ আরও বিকৃত করিয়া দলের ভিতর হইতে একটি তীক্ষ্ণ মেজাজের লোক অতিশয় বিরক্তির সহিত উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিল, “আরে বাপু, আমিও ত, আমি; নম্বর কত?”
“নম্বর ১।”
“আমাদের নিয়ে মোটের উপর?”
“১৩।”
মন্দিরের দ্বার উন্মুক্ত হইল, একটা লোক ভিতরে প্রবেশ করিল। লোকটা আমাদের অপরিচিত নহে—ফুলসাহেব
ফুলসাহেব নিজের নির্দিষ্ট স্থানে গিয়া বসিল। কেহ কোন কথা কহিল না। কিয়ৎপরে ধূমাচ্ছন্ন নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া ফুলসাহেব বলিল, “আমাদের সকলেই কি আসিয়াছে?”
একজন গণনা করিয়া উত্তর করিল, “হাঁ।”
ফুল। আমাদের উদ্দেশ্যটা কি, তা বোধ হয়, কাহারও জানিতে বাকী নাই?
সকলে। ঠিক প্রতিশোধ লওয়া।
ফুল। আমাদের লক্ষ্য কে?
সকলে। (সমস্বরে) অরিন্দম।
আবার সকলে নীরব।
বৃহৎ মন্দিরটা যেন গগম্ করিতে লাগিল।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ভীষণ ষড়যন্ত্র
ফুলসাহেব বলিল, “তোমাদের সকলেই সেই অরিন্দমের হাতে কোন-না কোন রকমে লাঞ্ছিত হয়েছ। তোমরা যদি তাহার প্রতিশোধের কোন চেষ্টা না কর, ইহার অপেক্ষা কাপুরষতা আর কি হইতে পারে? দুই নম্বর কে? আমার সামনে এসে দাঁড়াও।”
দলের ভিতর হইতে তালগাছের সংক্ষিপ্ত সংস্করণের ন্যায় একটি লোক উঠিয়া ফুলসাহেবের সম্মুখে দাঁড়াইল।। লোকাট অসম্ভব লম্বা, তেমন দীর্ঘ দেহ বড়-একটা দেখিতে পাওয়া যায় না। মুখখানা দেখিয়া আরব্য উপন্যাসের দৈত্যের কথা স্বতই মনে পড়ে।
ফুলসাহেব তাহাকে কর্তৃত্বের স্বরে প্রশ্ন করিল, “অরিন্দম তোমার কি করিয়াছে?
২নং। আমার বাঁ হাত ভেঙে দিয়েছে।
ফুল। কিরূপে হাতটা ভাঙলে?
২নং। অরিন্দমের সঙ্গে আমার একদিন হাতাহাতি হয়; শেষে বেটা আমার হাতটা ধ’রে কব্জীর কাছটায় এমন মুচড়ে দিলে যে, হাতটা কেটে বাদ দিতে হ’ল।
ফুল। বটে! তবে তার উপরে তোমার খুবই রাগ থাকতে পারে?
২নং। সে কথা আর একবার করে বলতে? বেটাকে একবার সুবিধায় পেলে মাথাটা চিবিয়ে খাই, তবে রাগ কতকটা যায়।
ফুল। আচ্ছা তুমি বসো। এর মধ্যে তিন নম্বর কে?
“আমি”, বলিয়া একটি লোক দুই নম্বরের স্থান অধিকার করিয়া দাঁড়াইল। দুঃখের বিষয় দুই নম্বরের সমুদয় স্থানটি অধিকার করা তাহার ভাগ্যে ঘটিয়া উঠিল না। অন্যান্য দিকে যাহাই হউক, ঊর্ধ্বের অনেকটা স্থান খালি রহিয়া গেল। লোকটা লম্বায় দুই নম্বরের যেন সিকিখানা, কিন্তু প্রস্থে খুব স্ফীত। ওজনে বরং চতুর্গুণ হইবার সম্ভাবনাই অধিক। মুখানি এমন বখত্, যেন একটা অতি বিরক্তিকর, অতি-বিকৃতভঙ্গি মুখের উপর জমাট বাঁধিয়া চির-অবস্থিতির একটা পাকা বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া লইয়াছে।
ফুলসাহেব তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “অরিন্দম তোমার কি ক্ষতি করেছে?”
সে লোকটা নিজের ভগ্ন নাসিকা অঙ্গুলি-নির্দেশে দেখাইল। সত্যই বেচারার নাসিকাটি একেবারে ভিতরে বসিয়া গিয়াছে।
ফু। ব্যাপার কি?
৩নং। এই নাকের শোধ তুল—তবে ছাড়ব।
ফু। তুমি নাকের বদলে তার নাকটা চাও, কেন?
৩নং। আমার নাকের বদলে আমি তার প্রাণটা চাই।
ফু। আচ্ছা, তুমি যাও—চার নম্বরের কে আছে হে?
দলের ভিতর হইতে একটি বিশ্রী চেহারার লোক খোঁড়াইতে খোঁড়ইতে আসিয়া ফুলসাহেবের সম্মুখে দাঁড়াইল।
ফু। তোমার কি হইয়াছে?
৪নং। আমার পা ভেঙে দিয়েছে। এ পায়ের শোধ আমি না নিয়ে ছাড়ব না।
ফু। পাঁচের নম্বর কে?
৫নং। আমি।
ফু। তোমার ঘটনা কি, বল?
সে লোকটা নিজের দক্ষিণ হস্ত ফুলসাহেবের সম্মুখে তুলিয়া ধরিল। একমাত্র বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ছাড়া সে হাতে আর কোন অঙ্গুলি বিদ্যমান ছিল না।
ফুলসাহেব বলিল, “কি ক’রে অরিন্দম একবারে তোমার চার-চারটে আঙুল ভেঙে দিলে?”
৫নং। পিস্তলের গুলিতে। যেমন আমি তাকে ঘুসি তুলে ছুটে মারতে যাব সে দূরে থেকে এমন একটা গুলি দাগ্লে যে, আমার ঘুসির আধখানা চোখের নিমেষে কোথায় উড়িয়ে দিলে, খোঁজ হ’ল না।
ফু। নম্বর ছয়, উঠে এস।
৬ নম্বরের প্রাণীটি সম্মুখীন হইলে ফুলসাহেব তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কি দুঃখে আমাদের দলে মিশেছ? অরিন্দম তোমার কি অনিষ্ট করেছে?”
৬নং। অরিন্দম আমার একপাটি দাঁত একেবারে উড়িয়ে দিয়েছে।
ফু। আর কিছু?
৬নং। আর আমার দাদাকে ফাঁসী-কাঠে ঝুলিয়ে দিয়েছে।
লোকটার যেমন বিকট চেহারা, তাহার যিনি দাদা, তিনি যে ফাঁসী-কাঠে ঝুলিবেন, তাহাতে আর আশ্চৰ্য্য কি।
ফু। তবে দেখছি তুমি অরিন্দমের রক্তদর্শন না ক’রে কিছুতে সুস্থ হবে না।
৬নং। সে কথা আর মুখে প্রকাশ করে বলতে!
ফু। সাত নম্বর কে আছে, এস।
৭নং। আমি সাতের নম্বর।
ফু। অরিন্দম তোমার কিছু ভেঙেছে?
৭নং। কিছুই না।
ফু। তবে তোমার কি হয়েছে?
৭নং। কিছুই না।
ফু। তবে যে তুমি আমাদের দলে মিশেছ—কারণ কি?
৭নং। কারণ, আমি অরিন্দমকে অন্তরের সহিত ঘৃণা করি!
ফু। কেন ঘৃণা কর?
৭নং। সে আমাকে একবার বোকা বানিয়ে নিজের একটা বড় কাজ হাসিল করে নিয়েছিল। ফু। কিরকম, শুনি?
৭নং। লোখে নামে আমার একটা স্যাঙাৎ একবার একটা লোককে খুন করেছিল। আমরা যে যেখানে খুটা-আটা কম, তা’ কেউ কারও কাছে কোন কথা লুকুতুম না। যা’ করা যেত, তা’ দু’জনে পরামর্শ ক’রেই হত। লোখে একবার একটা খুন করবার পর, একদিন সন্ধ্যার সময়ে বেটা অরিন্দম ঠিক লোখের মত সেজে এসে আমার কাছ থেকে এ-কথা সে-কথার পর সেই খুনটার সব কথা বার ক’রে নিয়ে লোখেকে একেবারে বারো বৎসরের দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে দিলে। আমার জন্যই তাকে দ্বীপান্তরে যেতে হ’ল ব’লে, যাবার সময়ে শাসিয়ে গেছে যে, ফিরে এসে সে আমাকে খুন ক’রে ফাঁসী যাবে। তা সে যেরকম ভয়ানক লোক, বেঁচে যদি ফিরে আসে, নিশ্চয় সে যা বলে গেছে, ঠিক তা’ করবেই করবে। এর মধ্যে যদি আমি অরিন্দমের একটা কিনারা করতে পারি, তার রাগটা আমার উপর থেকে কমে যেতে পারে।
ফু। আচ্ছা, তুমি যাও—আট নম্বরের লোক উঠে এস।
সাতের স্থানে আট আসিয়া দাঁড়াইল।
ফু। তোমার ব্যাপার কি হে?
৮নং। বিষম ব্যাপার!
ফু। বটে! কি?
৮নং। আমি রাত্রে ঘুমুতে পারি না—ঘুমুতে গেলেই একটা-না-একটা স্বপ্ন লেগেই আছে; সকল স্বপ্নেই অরিন্দমের যোগাযোগ। কখন স্বপ্ন দেখি, অরিন্দম আমাকে পাহাড়ের উপর থেকে নীচে ফেলে দিচ্ছে; কখন অরিন্দম আমাকে পচাপুকুরের পাঁকে চুরিয়ে ধরছে। কখন বা আমাকে হাত পায়ে বেঁধে জ্বলন্ত চিতার উপরে তুলে ধরছে। তা’ ছাড়া, কানমলাটা চড়চাপটা, লাথিটা-আস্টা যেন লেগেই আছে; সেগুলো যেন ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। অরিন্দম না মরলে বোধহয়, এই স্বপ্ন-রোগ থেকে আমার কিছুতেই মুক্তি নাই।
ফু। আচ্ছা, তুমি যাও। নয় নম্বরের কে?
৯নং। আমি।
ফু। তোমার ঘটনা কি?
৯নং। তিন বৎসর ছয় মাস।
ফু। বটে!
৯নং। কঠিন পরিশ্রমের সহিত।
ফু। দশের নম্বর কে?
১০নং। আমি।
ফু। তোমার ব্যাপার কি?
১০নং। নয়ের চেয়ে আরও দেড় বৎসর বেশী; ভোগটা বেশি দিন হয় নাই। একমাস পরেই জেলখানা থেকে পালিয়ে এসেছি।
ফু। তবে তুমি খুব কাজের লোক হে! এগারো নম্বরের কে?
এগারো নম্বরের একটি বালক উঠিয়া আসিল। তাহার বয়স এখনও সতেরোর মধ্যেই আছে। তাহার মুখাকৃতি ও দৃষ্টি বড় ভয়ানক, কেউটে সাপের ছানা দেখিয়া ভয়ে বুক্টা যেমন চমকে উঠে, তেমনি হঠাৎ যদি এর মুখখানি চোখের সামনে পড়ে, ঠিক তেমনি ভাবের একটা ভীতি স্পষ্ট অনুভূত হয়। তাহার হাতে একখানা খুব ধারাল, খুব বড় ছুরি ছিল। তাহাকে কিছু জিজ্ঞাসা করিতে হইল না, সে নিজের ছুরিখানা নাড়িয়া নাড়িয়া আরম্ভ করিয়া দিল, “আমি অরিন্দমকে সহজে ছাড়ব না। আমার বাবা একটি লোককে ছুরি মেরে খুন করেছিল ব’লে, অরিন্দম আমার বাবাকে ফাঁসী দিয়ে মেরেছে: আজ তিন বৎসর হ’ল, বাবা মরেছে। যেদিন বাবা মরে, সেইদিন থেকে আমি এই ছুরিব সঙ্গে এমন বন্ধুত্ব করেছি যে, একদণ্ডও ছুরিখানা ছেড়ে থাকি না। অরিন্দমের বুকে না বসিয়ে এ ছুরি ত্যাগ করব না।”
এমন পুত্রের যিনি জনয়িতা, তাঁহার অন্তিমে যে ফাঁসী-কাষ্ঠ অপরিহার্য্য, ইহা সৰ্ব্ববাদীসম্মত। তাহার পর বারো নম্বরের লোক উঠিয়া আসিল। সে বয়সে বৃদ্ধ। বৃদ্ধ হইলেও এখনও যে তিন-চারিজন সবল যুবককে আছাড় দিয়া ফেলিবার ক্ষমতা তাহার বেশ আছে, তাহার চেহারাখানার বিপুল দৈর্ঘ্য ও বিস্তার সেটা সহজেই হৃদয়ঙ্গম করাইয়া দেয়। এবং তাহার আকৃতির সঙ্গে প্রকৃতির যে খুব সৌসাদৃশ্য আছে তাহার কালিমা লেপিত কোটরবিবিক্ষু চক্ষুর তীব্র দৃষ্টি, প্রকটগণ্ডাস্থি মুখের ভীষণ ভঙ্গীতে সে সম্বন্ধে আর তিলমাত্র সন্দেহ থাকে না। সে বলিল, “অরিন্দমের উপর আমার রাগের কোন কারণ আছে কি না, তা আমি বলতে চাই না। তোমাদের সকলের চেয়ে তাকে যে আমি অনেক বেশী ঘৃণা করি, সেইটুকু জেনে তোমরা নিশ্চিন্ত হ’তে পার—হও, বিশ্বাস করতে পার, ভাল—থেকে যাই;না হয় বল, আমি আমার নিজের পথ দেখি। অরিন্দমের যমের বাড়ী যাবার পথটা সহজ ক’রে দিবার ক্ষমতা আমার একারই যথেষ্ট আছে।”
তাহার পর তেরো নম্বরের লোকটা উঠিয়া দাঁড়াইল। ফুলসাহেব তাহাকে দেখিয়া হাসিয়া বলিল, “তোমাকে কিছু বলিতে হইবে না, তোমার সম্বন্ধে আমি অনেক কথা জানি।“
লোকটা সেই গোরাচাঁদ। নামটা শুনিলে কাহারও লোকটাকে মনে করিতে বিলম্ব হইবে না।
গোরাচাঁদ বসিলে ফুলসাহেব নিজে গাত্রোত্থান করিয়া বলিল—বেশ হাসিমুখে মিষ্টকথায় শ্রোতাদের কর্ণে অমৃত বর্ষণ করিয়া বলিল, “আমি অরিন্দমকে কেন ঘৃণা করি, তোমরা কেহই জান না। একমাত্র কারণ হচ্ছে, সে ঠিক আমারই মত বলবান, আমারই মত চতুর, আমারই মত বুদ্ধিমান্ এবং আমারই মত সকল কাজে তৎপর। আমি বেঁচে থাকতে আমার মত আর একটা লোক যে পৃথিবীতে থাকে, সে ইচ্ছা আমার একেবারে নাই। সেটা আমার একান্ত অসহ্য বোধ হ’য়ে আছে। হয়, সে পৃথিবী ত্যাগ করুক—আমি নিরাপদ্ হই, নয় আমি যাই—সে সুখী হ’ক্। এ দু’টার একটা আমি না ক’রে কিছুতেই নিশ্চিন্ত হ’তে পারব না। দেখি, কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায়! যাক্, এখন তোমাদের মধ্যে এমন কেহ এখানে আছে, যে জীবনের মধ্যে কখনও একটা না একটা খুন করে নাই? কে আছ বল।”
কেহ কোন উত্তর করিল না—সকলেই খুনী দস্যু।
ফুলসাহেব বলিল, “ভালই হয়েছে, এসব কাজে এই রকমই লোক দরকার। অরিন্দম-হত্যার জন্য এখন সকলকে শপথ করতে হবে।”
তখন সেই সকল খুনী লোক একমাত্র অরিন্দমের জীবন লক্ষ্য করিয়া শপথ করিল, এবং সঙ্গে সঙ্গে ফুলসাহেবের নিকট হইতে এক-একখানি তীক্ষ্ণধার কিরীচ উপহার পাইল।
সেদিন এই পৰ্য্যন্ত।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – মোহিনীর শেষ-উদ্যম
দেবেন্দ্রবিজয় আশ্বাসিত ও অনুরুদ্ধ হইয়া এখনও অরিন্দমের বাসায় অপেক্ষা করিতেছেন। যত দিন যাইতেছে, রেবতীর জন্য দেবেন্দ্রবিজয় ততই ব্যগ্র হইয়া উঠিতেছেন। রেবতীর সন্ধানের জন্য অরিন্দমকে কোন কথা বলিলে, অরিন্দম মুখে খুবই আশ্বাস দেন; কিন্তু কাজে তাহার কিছুই হয় না দেখিয়া, দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট। এমনকি অরিন্দমের সংসর্গ তাঁহার এক-একবার বড় তিক্ত বোধ হইত। সেই সময়ে মনুষ্যোচিত বিরক্তি এবং রেবতী উদ্ধারের জন্য অন্য ডিটেটিভ নির্বাচনের কল্পনাটা তাহার মনের ভিতরে নিরতিশয় প্রবল ও তীব্র হইয়া উঠিত;মুখে কিছুই প্রকাশ করিতেন না। মুখে প্রকাশ না করিলেও মুখের ভাবটা সে-কথাটা যখন-তখন অরিন্দমের নিকট প্রকাশ করিয়া দিত। দুই-একটা কাজেও অরিন্দম তাহা বেশ বুঝিতে পারিতেন; ফুলসাহেবের অনুসন্ধান সম্বন্ধে গোপন কাজ করিতে হইলে দেবেন্দ্রবিজয় পাঁচ-সাতবার ‘হাঁ’ ‘না’ করিয়া কখন কোন কাজে ‘হাঁ’ দিতেন, কখন কোন কাজে ‘না’ দিতেন। এক-এক সময়ে অরিন্দমের মিথ্যা (?) আশ্বাসবাক্যে তাঁহার বিরক্তি ও ধৈর্য্য একেবারে সীমা অতিক্রম করিয়া এতদূরে উঠিত যে, তাহা একটা নীরব ক্রোধে রূপান্তরিত হইয়া যাইত। এবং সেই সঙ্গে দেবেন্দ্রবিজয় গৃহ-প্রত্যাগমনের জন্য বদ্ধ পরিকর হইয়া উঠিতেন। অসহ্য বিরক্তি, দারুণ উৎকণ্ঠা, দুঃসহ উদ্বেগ এবং লুপ্তপ্রায় ধৈর্য্যের মধ্য দিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের দীর্ঘ দীর্ঘ দিনগুলি দীর্ঘতম হইয়া অতিবাহিত হইতেছে।
****
একদিন দেবেন্দ্রবিজয় কোন কাজে বাহির হইয়াছেন, অরিন্দম মধ্যাহ্ন ভোজনের পর সংক্ষিপ্ত মধ্যাহ্ন-বিশ্রামের আয়োজনমাত্র করিয়াছেন, এমন সময় ভৃত্য আসিয়া সংবাদ দিল, একটি স্ত্রীলোক তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছে।
অরিন্দম সেই স্ত্রীলোককে সেইখানে লইয়া আসিবার জন্য ভৃত্যকে আদেশ করিলেন।
****
অনতিবিলম্বে মুখের উপর অনেকখানি ঘোমটা টানিয়া একটি স্ত্রীমূর্ত্তি অরিন্দমের সম্মুখীন হইয়া, গৃহমধ্যে প্রবেশ না করিয়া দ্বার- সম্মুখে বসিয়া পড়িল। তাহার বেশ-ভূষা মলিন এবং বড় অপরিষ্কার দুই-একগুচ্ছ চুল—অতি রুক্ষ, কানের পাশ দিয়া, সম্মুখে আসিয়া পড়িয়াছিল—সে গৌরবর্ণা হইলেও, ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নির ন্যায় সে বর্ণে কিছুমাত্র ঔজ্জ্বল্য ছিল না। সে দেহ দাবাগ্নিদগ্ধকিশলয় সদৃশ কেমন যেন বিশুষ্ক ও শ্রীহীন, ঠিক বর্ণনা করা যায় না।
অরিন্দম তাঁহাকে দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। তিনি ঘরের ভিতরে শয্যায় শয়ন করিয়াছিলেন উঠিয়া বসিয়া, একটি তাকিয়া টানিয়া তদুপরে দেহভার বিন্যস্ত করিয়া বলিলেন, “কে তুমি?”
ঘোমটার ভিতর হইতে মৃদুস্বরে উত্তর হইল, “আমি ফুলসাহেবের স্ত্রী।”
ফুলসাহেবের স্ত্রী! শুনিয়া বিস্মিত অরিন্দম আরও বিস্মিত হইলেন। কতকটা যেন স্বপ্নের মত বোধ হইল। একবার মনে হইল, ছদ্মবেশে জুমেলিয়া নহে ত? কিন্তু তার কণ্ঠস্বর ত এমন নহে, জুমেলিয়ার কণ্ঠস্বরে এমন একটা তীব্রতা মিশ্রিত আছে যে, একবার শুনিলে চেষ্টা করিয়াও কেহ তাহা সহজে ভুলিতে পারে না। এ কে? সন্দিগ্ধ অরিন্দম কি উত্তর করিবেন, ঠিক করিতে না পারিয়া, ললাট কুঞ্চিত করিয়া অবাঙ্মুখে তাহার দিকে নীরবে চাহিয়া রহিলেন।
অরিন্দমকে নীরব দেখিয়া সেই কৃতাবগুণ্ঠনা রমণী বলিল, “তুমি ফুলসাহবেকে কি জান না?”
অরিন্দম। জানি।
রমণী। আমি তাহার স্ত্রী—আমার নাম মোহিনী।
অরিন্দম। ইহা এখন জানিলাম।
মোহিনী। ফুলসাহেব জেলখানা থেকে পালায়, সে কথা তোমার মনে আছে?
অ। আছে।
মো। সে তোমাকে খুন করবার জন্য যে প্রতিজ্ঞা করেছে, তা’ এখনও তোমার মনে আছে কি?
অ। বেশ মনে আছে।
মো। তবে যে তুমি বড় ভালমানুষটির মত নিশ্চিন্ত হ’য়ে ব’সে আছ?
অ। চিন্তিত হইয়াই বা করিব কি? এই দুইমাস ধরিয়া কিছুতেই তাহার সন্ধান হইল না।
মো। তা’না হলেও তোমার মত একজন বড় গোয়েন্দার চুপ ক’রে ব’সে থাকা কি ভাল দেখায়? দুই মাসে যা’ হয় নাই—দুই দিনে তা’ হতে পারে।
অ। তা’ যেন হ’ল তুমি ফুলসাহেবের স্ত্রী—তা’তে তোমার লাভ কি?
মো। লাভ? অনেক। সে অনেক কথা—সে কথা থাক্। আসল কথাটা আগে শুনে যাও। ফুলসাহেব এখন তোমাকে খুন করবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এইবার সে যা’ হ’ক্, একটা হেস্তনেস্ত না ক’রে ছাড়বে না; তাই আমি তোমাকে সাবধান করে দিতে এসেছি। খুব সাবধান – ফুলসাহেব বড় ভয়ানক লোক! সে শুধু মানুষ না—সে অনেকরকম; সে মানুষও বটে, সে পিশাচও বটে, সে দানবও বটে, সে ডাকাতও বটে, সে খুনেও বটে, সে সাপও বটে—সে বাঘও বটে, একটু অসাবধান হ’লেই হয় সে সাপ হ’য়ে দংশন করবে—না হয় বাঘ হ’য়ে গিলে খাবে—না হয় পিশাচ হ’য়ে ঘাড় মট্কাবে! না হয়—
অ। (বাধা দিয়া) আসল কথা কি বলবে বলছিলে না?
মো। হাঁ, মনে আছে। ফুলসাহেব তোমাকে খুন করবার জন্য একদল দস্যু সংগ্রহ করেছে। তা’রা সকলেই তোমাকে খুন করবার জন্য ফুলসাহেবের কাছে শপথ করেছে। একটু অসাবধান হ’লে কখন সে এসে তোমার বুকে ছুরি বসিয়ে দেবে, তুমি তা’ কিছুই জানতে পারবে না। খুব সাবধান – সারা দিনরাত সাবধান—বড় ভয়ানক লোক, তা’রা—সকলেই খুনী, খুন-জখম করতে তাদের একটুও সঙ্কোচ হয় না।
অ। তারা কে জান?
মো। না, তা’রা দু-চারজন নয়, সর্ব্বসুদ্ধ তেরো জন। সকলেই যেন যমের দূত!
অ। তাদের আড্ডা কোথায়, বলতে পার?
মো। আড্ডার কোন ঠিক-ঠিকানাই নাই। যেখানে যখন তারা যেদিন একসঙ্গে জুটে, সেদিন সেইখানে তাদের আড্ডা। তারা সকলেই দিনরাত যে যার চেষ্টায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
অ। সে চেষ্টার লক্ষ্য আমার মৃত্যু, কেমন?
মো। তাতে আর সন্দেহ আছে।
অ। তাদের ভিতরকার আর কোন কথা তুমি জান?
মো। তাদের একটি পরামর্শের কথা আমি নিজের কানে শুনেছি:বড় ভয়ানক লোক তারা—বড় ভয়ানক কথা!
অ। কথাটা কি?
মো। আজ রাত্রে তোমাকে তারা এখানে খুন করতে আসবে।
অ। (বাধা দিয়া) এখানে! আমার বাড়ীতে?
মো। কেন বিশ্বাস হয় না?
অ। সকলেই আসবে?
মো। সকলেই—সকলেই শপথ করেছে।
অ। কখন আসবে?
মো। আজ রাত্রে।
অ। তা’ জানি। কত রাত্রে?
মো। রাত দু’টার পর
অ। বটে!
মো। শুধু নিজেকে রক্ষা করলে হবে না,—দেখ্ তাদের ধরতে, তবে জাব— গোয়েন্দার মত গোয়ান্দা বটে! এখন থেকে পুলিসের লোকজন এনে বাড়ীর ভিতরে লুকিয়ে রেখে দাও—আমার পরামর্শ শোন।
অ। তা’ হ’লে ফুলসাহেবও ধরা পড়বে—ফুলসাহেব যে তোমার স্বামী।
মো। ফুলাসাহেব যে আমার স্বামী, সে কথা আর আমাকে এত ক’রে বুঝিয়ে দিতে হবে না। আমি ফুলসাহেবের স্ত্রী—আমি কি জানি না, ফুলসাহেব আমার স্বামী? নামজাদা বুদ্ধিমান গোয়েন্দা হ’য়ে তুমি সহসা এমন নির্বোধের মত কথা কও কেন?
অ। তবে যে তুমি ফুলসাহেবের অমঙ্গল চেষ্টা করছ? কারণ কি?
মো। কারণ, সে আমার পরম শত্রু। মানুষ মানুষের এতদূর শত্রু হ’তে পারে, এ কথা আগে জান্তাম না। ফুলসাহেবের তুমি যেমন শত্রু, তার চেয়ে ফুলসাহেব আমার বেশী শত্রু। যখন সে জেলে গিয়েছিল, তখন একবার আমি সুখী হয়েছিলাম;এখন আমার যন্ত্রণায় বুকটা জ্বলে পুড়ে খাক্ হ’য়ে যাচ্ছে!
অ। ফুলসাহেবকে গ্রেপ্তার করলে তুমি সুখী হবে? মো। খুন করলে সুখী হ’ব।
অ। স্বামীর উপরে এত রাগের কারণ কি?
মো। সে কথায় তোমার কোন দরকার নাই, তবে এখন আমি যাই। যা বল্লেম, সব যেন বেশ মনে থাকে।
মোহিনী চকিতে উঠিয়া, অতি দ্রুতপদে তথা হইতে চলিয়া গেল।
অরিন্দম পথের দিক্কার একটা জানালায় মুখ বাড়াইয়া দেখিলেন, মোহিনী তখন ঘোমটা খুলিয়া ফেলিয়াছে—এমনকি অৰ্দ্ধোলঙ্গভাবে সে ছুটিয়া চলিয়াছে। দুই-একজন পথিক পথের ধারে দাঁড়াইয়া, অবাক্ হইয়া মোহিনীর দিকে চাহিয়া আছে।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – অরিন্দমের আয়োজন
এই অপ্রত্যাশিতপূৰ্ব্ব ঘটনাটা অরিন্দমের নিরতিশয় অদ্ভুতরসাত্মক বলিয়া বোধ হইল। কথায়- বার্তায় পূর্ব্বেই তাঁহার ধারণা হইয়াছিল যে, মোহিনীর পাগলের ছিট্ আছে। এখন তাহাকে পথের উপর দিয়া সেরূপভাবে ছুটিতে দেখিয়া, সে ধারণাটা কিছুমাত্র অমূলক নহে বলিয়া বুঝিতে পারিলেন। তাহা হইলেও অরিন্দম তাহার কথাগুলি উন্মাদের খেয়াল মনে না করিয়া, সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিলেন। যদিও তাঁহার ন্যায় সাহসী, সুচতুর ও সদ্বিবেচক ব্যক্তির পুরুষকার অপেক্ষা দৈবের উপর নির্ভর করা একান্ত নিন্দার কথা; তাহা হইলেও তিনি অনেক স্থলে দৈবের উপরেই সমধিক নির্ভর করিতেন। তিনি জানিতেন, এবং এমন অনেক হইতেও দেখিয়াছেন যে, প্রথমে দৈবাৎ এমন এক- একটি ছোট ঘটনা ঘটে যে, এক সময়ে তাহার পরিণাম অদৃষ্টপূর্ব্ব গুরুতর হইয়া উঠে।
তিনি সেই অপরিচিতা উন্মাদিনীর কথায় একান্ত আস্থা স্থাপনপূর্বক দস্যুদল দলনের অচিন্তিতপূর্ব এক বৃহৎ আয়োজনের জন্য প্রস্তুত হইলেন। আয়োজনটা নূতন রকমের, তাহাতে প্রচুর আমোদ আছে, এবং ভয়, পরিশ্রম খুব কম আছে।
তিনি যোগেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করিতে থানায় উপস্থিত হইলেন। যোগেন্দ্রনাথ তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অরিন্দম যোগেন্দ্রনাথকে ফুলসাহেবের এই নতূন কল্পনার কথা বলিলেন বটে, কিন্তু নিজে তাহাকে ধরিবার জন্য যে উপায় স্থির করিয়াছেন, সে সম্বন্ধে কোন কথা তাঁহার নিকট প্রকাশ করিলেন না।
যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “ব্যাপার ত বড় সহজ নহে, তোমার বাড়ীতে ডাকাতি। এইবার তোমার বিদ্যাবুদ্ধি বাহির হইয়া পড়িবে।”
অরিন্দম বলিলেন, “তেরোজন ডাকাতকে ভয় করিতে অরিন্দমের এখনও শিক্ষা হয় নাই। কথাটা যদি ঠিক হয়, তা’ হলে কাল দেখবে, অরিন্দম তেরোজনকেই অয়ষ্কঙ্কণভূষিত ক’রে এখানে চালান্ দিয়েছে।”
যোগেন্দ্র। অরিন্দমবাবু, এ কি তুমি যে-সে তেরোজন মনে করেছ? ফুলসাহেব ত তার মধ্যে আছেই; তা’ ছাড়া ফুলসাহেবের পছন্দ করা বারোজন। মনে থাকে যেন, তাদের এক-একজন দ্বিতীয় ফুলসাহেব।
অরিন্দম। নিঃসন্দেহ।
যো। তবে?
অ। তবে আবার কি?
যো। এখন কি উপায় স্থির করেছ?
অ। আত্মরক্ষার না তাদের বন্দী করবার?
যো। দুই বিষয়েই।
অ। এখনও অনেক সময় আছে, একটা না একটা উপায় স্থির করতে পারব
যো। সময় আর কোথায়? আজ রাত্রেই ত তা’রা আসবে। এখন কতগুলি লোক আমাকে দিতে হবে, বল দেখি?
অ। একজনও না।
যো। (সবিস্ময়ে) সে কি!
অ। লোক নিয়ে আমি কি করব?
যো। একাই বা কি করবে?
অ। যতদূর সাধ্য।
যো। কি পাগলের মত কথা বল, মানে হয় না। ভেবে ভেবে, আর ঘুরে ঘুরে তোমার মাথাটা একেবারে বিগড়ে গেছে দেখছি, অরিন্দমবাবু!
অ। (সহাস্যে) তা’ হবে!
যো। তোমার সকল কথায় পরিহাস। কাজের কথায় পরিহাস করা বুদ্ধিমানের লক্ষণ নয়। তুমি একা সেই তেরোজনের কিছুই করতে পারবে না।
অ। দেবেন্দ্রবিজয় আছে।
যো। সেদিনকার ঘটনায় তার বলবুদ্ধির অনেক পরিচয় পাওয়া গিয়াছে; সেদিনকার মত আজ আবার সে তোমার সাহায্য করতে গিয়ে, তোমার বিপদ্ আর একদিকে না বাড়িয়ে দিলে হয়।
অ। নূতন লোক। তা’ যা’ই হোক্, দেবেন্দ্ৰবিজয়ের মুখ-চোখের ভাব আর কথাবার্তা শুনে তার মাথাটা যে পরিষ্কার আছে, তা’ বেশ বুঝতে পারা যায়। আমার সঙ্গে এই দুইমাসে ঘুরে ঘুরে গোয়েন্দাগিরি শিখতে তার একটু ইচ্ছা হয়েছে। মাথা পরিষ্কার না থাকলে এ জঘন্য কাজে সহজে কাহারই ইচ্ছা হয় না। যে একটু বুদ্ধিমান্, যে একটু চতুর, যে একটু বলবান্, এসব কাজে সে একটু আনন্দ বোধ ক’রেই থাকে।
যো। না হয়, তোমার দেবেন্দ্রবিজয় চতুর, বুদ্ধিমান্, বলবান্ সবই। তা’ হলেও দুইজনে কি সেই তেরোজনের সমকক্ষ হ’তে পারবে? বিশেষতঃ সেই তেরোজনের মধ্যে আবার স্বয়ং ফুলসাহেবের সম্পূর্ণ অস্তিত্ব রয়েছে।
অ। একদিন আমি একা একুশজনের যে দুর্দ্দশা করেছিলাম, তা’ বুঝি তোমার মনে নাই!
যো। তা’ জানি, তোমার বুদ্ধি বল অলৌকিক, কিন্তু ফুলসাহেব বড় সহজ লোক নয়, তাই বলিতেছি।
অ। একটা বিষয়ে আমি তোমার সাহায্য চাই। কতকগুলি ইলেকট্রীক ব্যাটারী আবশ্যক। সন্ধ্যার পূর্ব্বে সংগ্রহ করতে পারবে?
যো। ইলেকট্রীক ব্যাটারী নিয়ে কি হবে?
অ। (সহাস্যে) একটু বিজ্ঞানের চর্চ্চা করা যাবে।
যো। তোমার অন্ত পাওয়া ভার—তুমি লোকটা একান্ত দুৰ্জ্জেয়।
অ। তোমার কাছেও?
যো। তা, বৈকি! ইলেকট্রীক ব্যাটারী ছাড়া আর কিছু চাই?
অ। আর চৌদ্দ জোড়া হাতকড়ি ও বেড়ি। যেন সকলগুলি বেশ মজবুত হয়।
যো। একটা বেশি কেন?
অ। যদি সেই তেরোজনের সঙ্গে আমার বাড়ীতে জুমেলিয়ারও শুভ পদার্পণ হয়। তা’ না হ’লেও ফুলসাহেবের জন্য জোড়া-দুই হাতকড়া আবশ্যক করে।
যো। অরিন্দমবাবু, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমার কথাগুলো আমার বড় ভাল ঠেকছে না। বেশি না হয়—আমি থানা থেকে বারোজন লোক দিচ্ছি, আজ রাত্রের জন্য তোমার বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে রেখে দাও, এসময়ে অনেক কাজে লাগবে।
অ। একজনও না। আমাকে কি তোমার বিশ্বাস হয় না?
যো। তোমার যা’ খুসী, তা’ কর, আমি আর কোন কথা বলব না।
অ। আমি উঠলেম—আর সময় নষ্ট করব না। ইলেকট্রীক ব্যাটারী আর হাতকড়ি ও বেড়িগুলো যত শীঘ্র পার, পাঠিয়ে দিয়ো।
যো। আধ ঘণ্টার মধ্যেই পাবে।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
****
যোগেন্দ্রনাথের নিকট হইতে বিদায় লইয়া, অরিন্দম বাসায় আসিয়া দেখিলেন, তখনও দেবেন্দ্রবিজয় ফিরিয়া আসেন নাই। তিনি বৈঠকখানা ঘরে বসিয়া পরম নিশ্চিন্ত মনে চুরুট টানিতে ও প্রচুর ধূম উদগীরণ করিতে মনোনিবেশ করিলেন।
যথাসময়ে মুটের মাথায় বোঝাই হইয়া যোগেন্দ্রনাথের প্রেরিত অনেকগুলি ইলেকট্রীক ব্যাটারী ও অনেকগুলি হাতকড়ি ও বেড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল। অরিন্দম প্রত্যেক জিনিষটি উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিয়া ঘরে তুলিলেন। হাতকড়ি ও বেড়িগুলি দ্বিতলের উপরে এমন একটা স্থানে রাখিলেন যে, দরকারের সময়ে সহজে পাওয়া যাইতে পারে।
তাহার পর ইলেকট্রীক ব্যাটারীগুলি দ্বিতলে উঠিবার সোপানের নীচে বসাইলেন; এবং সেই ব্যাটারীগুলির সঙ্গে তার যোগ করিয়া সোপানের চারিদিকে এবং রেলিং-এর গায়ে সংলগ্ন করিয়া দিলেন। নিজের শয়ন- কক্ষের কবাটের কড়া দুইটির সহিতও একটি তার লাগাইয়া ইলেকট্রীক ব্যাটারীর সহিত সংলগ্ন করিয়া দিলেন।
সমুদয় ঠিঠাক্ করিতে অরিন্দমের রাত্রি নয়টা বাজিয়া গেল। রাত্রি নয়টার পর দেবেন্দ্রবিজয় ফিরিয়া আসিলেন।
অরিন্দম দেবেন্দ্রবিজয়কে বলিলেন, “ফুলসাহেবের আজ এখানে শুভাগমন হইবে।”
দেবেন্দ্রবিজয় সদ্যঃ-আকাশ-বিদ্যুতের ন্যায় বলিলেন, “ফুলসাহেব! এখানে কোথায় আসবে?”
“এখানে—আমাদের বাড়ীতে।”
“এখন সে কোথায়?”
“যেখানেই থাক্, আজ আমার বাড়ীতে আসবে।”
“আপনার বাড়ীতে?”
“হাঁ, আমার বাড়ীতে।”
“ধরা দিতে নাকি?
“অনেকটা সেই রকমেরই বটে।”
“আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না।”
(সহাস্যে) “এস বুঝিয়ে দিই।”
অরিন্দম দেবেন্দ্রবিজয়ের হাত ধরিয়া টানিয়া, দ্বিতলে উঠিবার সোপানের সম্মুখে লইয়া আসিলেন এবং ইলেকট্রিক ব্যাটারীর সাহায্যে সিঁড়ির উপরকার তারগুলিতে সামান্যমাত্র বৈদ্যুতিক প্রবাহের সঞ্চার করিয়া দিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে বলিলেন, “একবার তুমি সিঁড়ির উপরে উঠে দাঁড়াও দেখি।”
দেবেন্দ্রবিজয়ের অপেক্ষা অরিন্দম বয়সে অনেক বড় বলিয়া এবং এই দুই মাসের ঘনিষ্ঠতায় তাঁহার সহিত কথোপকথনকালে “আপনি”
“আপনার” ইত্যাদি সম্ভ্রমসূচক শব্দের পরিবর্ত্তে স্নেহসূচক “তুমি”
“তোমার” শব্দ ব্যবহার করিতেন। অরিন্দমের কথা শুনিয়া দেবেন্দ্রবিজয় তাড়াতাড়ি পাশের রেলিং ধরিয়া সদর্পেই সিঁড়িতে উঠিলেন; তখনই যন্ত্রণায় তীব্রতর চীৎকারে সমস্ত বাড়ীটা আৰ্ত্তনাদ- প্রতিধ্বনিত করিয়া সিঁড়ি হইতে পাঁচ হাত দূরে লাফাইয়া পড়িলেন।
অরিন্দম তখন দেবেন্দ্রবিজয়কে সমস্ত বুঝাইয়া বলিলেন। শুনিয়া দেবেন্দ্রবিজয় বিস্মিত হইলেন। অরিন্দম বলিলেন, “তুমি একটা ব্যাটারীর তেজ দেখিলে; যথাসময়ে দশটা ব্যাটারী এক সঙ্গে কাজ করবে। তখন একবার পা দিলে আর এক পা নড়তে হবে না। ফুলসাহেব যখন ধরা পড়বে, তখন যতক্ষণ না রেবতীর সম্বন্ধে সব কথা সে বলে, ততক্ষণ তাকে এরূপ যন্ত্রণাময় অবস্থায় সিঁড়ির উপরে ধরিয়া রাখিব। দারুণ যন্ত্রণায় তখনই তাকে তার সমুদয় গুপ্তকথা আমাদের কাছে প্রকাশ করতেই হবে।”
শুনিয়া দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে খুব খুসী হইলেন। মুখের ভাব বুঝিয়া অরিন্দমও যে তাহা না বুঝিলেন, তাহা নহে। বলিলেন, “যেরূপ দেখছি, তাতে রেবতীর উদ্ধারটা খুব সংক্ষিপ্ত হ’য়ে এসেছে ব’লেই বোধ হয়।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনার কল্পনার ভিতরে আমি এখনও প্রবেশ করতে পারি নাই আপনি যা বলছেন, তা না বুঝবার মতন একরকম বুঝে যাচ্ছি। ফুলসাহেব এখানে কি করতে আসবে?”
অ। আমাকে খুন করতে।
দে। এত সাহস তার?
অ। ফুলসাহেবের পক্ষে এটা বড় বেশী সাহসের কথা নয়।
দে। কত রাত্রে?
অ। রাত দু’টার পর
দে। কিরকম ভাবে আসবে?
অ। চোরের মত চুপি চুপি আসবে না—ডাকাতেরা যেমন দল-বল নিয়ে ডাকাতি করতে আসে, ফুলসাহেব তেমনি সদলবলে আসবে?
দে। সে আবার দল-বল পেলে কোথায়?
অ। এই দুই মাস কি সে নিশ্চেষ্ট হ’য়ে চুপ করে বসেছিল? ভিতরে ভিতরে এই সব করেছে।
দে। তবে ত বড় ভয়ানক কথা! আপনি এ-সংবাদ কোথায় পেলেন?
অরিন্দম তখন মোহিনীর মুখে যাহা শুনিয়াছিলেন, সমস্তই বলিলেন। মোহিনী নাম্নী একটা উন্মাদিনীর কথায় অরিন্দমের এতটা বিশ্বাসস্থাপন করা অনেকেই মনে করিবেন, কাজটা ঠিক হয় নাই কিন্তু অনেক দিনের ডিটেক্টিভ অরিন্দমের এমন একটা অসাধারণ নৈপুণ্য এবং অনন্যসুলভ অনুমান শক্তি ছিল যে, একটা কথা পড়িলে ভবিষ্যতে সেটা কিরূপ দাঁড়াইবে, তাহা তিনি ঠিক অনুভব করিতে পারিতেন। নিজের সম্বন্ধে মোহিনী কোন কথা না খুলিয়া বলিলেও তাহার কথাবার্ত্তার ভাবে তিনি আরও বুঝিয়াছিলেন, মোহিনী ফুলসাহেবের নিকটে কোন বিষয়ে প্রতারিত হইয়াছে—এরূপ স্থলে অবশ্য সে বিষয়টা আদিরসাত্মক এবং কিছু মৰ্ম্মভেদী।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – গুপ্তদ্বার
রাত্রি এগারোটার পূর্ব্বে অরিন্দম ও দেবেন্দ্রবিজয় আহারাদি শেষ করিলেন। এবং সম্মুখ দ্বার অর্গলাবদ্ধ করিয়া, দ্বিতলের একটা ঘরে বসিয়া উভয়ে দাবা খেলা আরম্ভ করিয়া দিলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় খেলিতে খেলিতে বারংবার অন্যমনস্ক হইয়া পড়িতেছিলেন। এক-একবার মনটা খেলা হইতে সরিয়া গিয়া ফুলসাহেবের পদধ্বনি শুনিবার জন্য ব্যাকুল হইতেছিল, এবং ফুলসাহেবের দলবলের লোকগুলির ভীষণ চেহারা কল্পনা করিতে চেষ্টা করিতেছিল; কিন্তু অরিন্দম অত্যন্ত মনোযোগের সহিত খেলিতেছিলেন, সুতরাং বাজী জিতিতেছিলেন। মাথার উপরে যে এতবড় একটা বিপদ্, জীবন ও মৃত্যুর এবং ছুরি ও রক্তের একটা সংগ্রামাভিনয় যে আসন্ন, তথাপি সেজন্য তাঁহার মুখে উদ্বেগ, আশঙ্কা অথবা চিন্তার চিহ্ন পর্যন্ত নাই।
রাত্রি দুইটার সময়ে খেলা বন্ধ হইল। অরিন্দম বলিলেন, “এইবার তাদের আবার সময় হ’য়েছে। একঘণ্টার মধ্যেই তাদের শুভাগমন হবে; আমরা দুইজনে মিলিয়া এখন হ’তে তাদের অভ্যর্থনা করবার বন্দোবস্ত করি, এস।”
দেবেন্দ্র। আমি কোথায় থাকব, বলুন দেখি?
অরি। নীচে, সিঁড়ির পাশের ঘরটায় এখন তোমাকে থাকতে হবে। যাবার সময়ে রাবারের জুতা আর দস্তানা প’রে যাবে। সেগুলি এত মোটা রাবারের তৈয়ারী যে, ইলেকট্রীক তারে কিছুই করতে পারবে না।
এই বলিয়া অরিন্দম দুই জোড়া রাবারের জুতা ও দস্তানা লইয়া আসিলেন। উভয়ে সেইগুলি লইয়া হাতে পায়ে পরিলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “নীচের ঘরে গিয়ে আমায় কি করতে হবে?”
অরিন্দম বলিলেন, “সেই ঘরের দক্ষিণ কোণে দেখবে, একটি দড়ি ঝুলছে; যখন দেখবে যে, তেরোজন লোক সিঁড়ির উপরে উঠেছে, তখন সেই দড়িটি টেনে ধরবে। তার পর যা’ করতে হয়, আমি করব।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হয়ত তেরোজনের একজন বাহিরে পাহারা দিতে পারে।”
অ। তাদের পাহারা দিবার আরও লোক আছে, সে কাজ জুমেলিয়া বেশ পারবে। জুমেলিয়ার উপরে ফুলসাহেব যথেষ্ট নির্ভর ক’রে থাকে।
দে। তা’ হ’লেও তেরোজন কি একসঙ্গে উপরে উঠবে?
অ। তেরোজনই উঠবে। ফুলসাহেব যে প্রকৃতির লোক, তাতে যে সে চোরের মত চুপি চুপি, ভয়ে ভয়ে কোন কাজ করবে বোধ হয় না; এমন বীরত্বের অভিনয়টা সে কখনই একেবারে মাটি ক’রে ফেলবে না। একেবারে সকলকে সঙ্গে নিয়ে, আমার শয়নগৃহে গিয়া বিছানার চারিদিক্ থেকে তেরোখানা ছুরি একসঙ্গে আমার বুকে বসিয়ে যাতে এ বীরত্বের অভিনয়টা সর্ব্বাঙ্গসুন্দর হয়, বরং সে সেই চেষ্টা করবে, আমার ত এইরূপ অনুমান;তার পর তার মনে আর কি আছে, সেই জানে। তা’ সে যাহাই মনে ক’রে আসুক, একবার এলে আর ফিরে যেতে হবে না। এই গোয়েন্দাগিরি কাজ বড় শক্ত, দেবেন্দ্রবাবু; যেখানে একটু সন্দেহের ছায়া আছে, সেই সন্দেহকে সত্যের আসনে বসিয়ে, সেখানে আমাদের এক প্রকাণ্ড আয়োজন ঠিক করে রাখতে হয়। তোমার যেরূপ উৎসাহ দেখছি, কিছুদিন আমার সঙ্গে থাকলে তুমি একজন বড় ডিটেক্টিভ হ’তে পারবে। তোমার কিছু কিছু ডাক্তারী জানা আছে, এ-কাজে ডাক্তারী শিক্ষাটাও সময়ে সময়ে উপকারে আসে।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কিন্তু ডাক্তারীর মত এ-কাজটা তেমন মান্য নহে। বিশেষতঃ ডাক্তারীগিরি অনেক লোকের অনেক উপকারে আসে—এমনকি, কত লোককে আসন্ন মৃত্যুর হাত হ’তে উদ্ধার করাও হয়।”
অরিন্দম বলিলেন, “তোমার এ-কথার উত্তরে আমাকে অনেক কথা বলতে হয়; গোয়েন্দাগিরিতে ডাক্তারী অপেক্ষা সহস্রগুণে লোকের উপকার করা হয়। এই গোয়েন্দাগিরি কত ধন-প্রাণে মরণাপন্ন ব্যক্তির ধন ও প্রাণ ফিরিয়ে এনে তার অবসন্ন দেহে নূতন জীবনসঞ্চার করে। গোয়েন্দাগিরি অপহৃত স্নেহের নিধি সন্তানে শোকাতুর পিতামাতার শূন্যক্রোড় পরিপূর্ণ করে। এই গোয়েন্দাগিরি দস্যুর হাত থেকে, খুনীর হাত থেকে কত নিরবলম্বন শিশুর পিতা ও কত অভাগিনী স্ত্রী-স্বামীকে উদ্ধার ক’রে থাকে, তাতে কি পরোপকারের কিছুই নাই? কেবল পণ্ডশ্রম? বোধ করি, কোন ডাক্তারকে পরোপকারের জন্য গোয়েন্দাদিগের মত শ্রম স্বীকার করতে হ’লে, ডাক্তারী বিদ্যাটি মস্তিষ্ক হ’তে শীঘ্র বহিষ্কৃত ক’রে ফেলার জন্য স্মৃতিনাশক কোন আশুফলপ্রদ নূতন ঔষধের আবিষ্কার করতে তিনি সচেষ্ট হ’য়ে উঠতেন। কতক বা কৌতূহল, কতক বা দয়া, কতক বা রোষপরবশ হ’য়ে ডিটেক্টভেরা শরণাপন্নের যেসকল ভয়ানক ভয়ানক বিপদ্ নিজের মাথায় নিয়ে নিজের অসহায় প্রাণটাকে খুনীদের ছুরির নীচে স্বচ্ছন্দে যেমন ছেড়ে দেয়, আর কেহ তেমন পারে, বল দেখি? তথাপি এদেশের লোকেরা ডিটেটিভদের সম্মান করে না। তা’ তাদের দোষ নয়, আমাদেরই অদৃষ্টের দোষ; নতুবা ইংলন্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকার ডিটেক্টিভেরা যেরূপ সম্মানিত হ’য়ে থাকে, এবং আবালবৃদ্ধবনিতার এমন একটা শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে যে, সেখানকার বিচারপতিদিগের অদৃষ্টেও তেমনটি ঘটে না। যদিও আমার মুখে এসকল কথাগুলো ভাল শোনায় না—সম্পূর্ণ আত্মশ্লাগা প্রকাশ পায়; কিন্তু যখন অবসরে এক-একবার নিজেদের কথাগুলি ভাবি, তখন মনে যেমন দুঃখ হয়, তেমনি নিজেদের জীবনের প্রতি একটা ঘৃণাও জন্মে। আমরা অপরের জন্য দেহপাত ও প্রাণপাত করিতে প্রস্তুত, কিন্তু অপরে সেটা স্বীকার করিতে সম্পূর্ণ অসম্মত এবং একটু সম্মান দেখাতে একেবারে অপ্রস্তুত। আমরা যদি তাহাদের দুই চক্ষে অঙ্গুলি দিয়া দেখাইয়া দিই, আমরা পরের জন্য জন্মিয়াছি এবং পরের জন্য বাঁচিয়া আছি; এবং যখন মরিতে হইবে, পরের জন্যই মরিব;তথাপি তাহারা কিছুতেই বুঝিবে না! বোধ করি, বাংলাদেশের ডিটেকটিভশ্রেণীর উপরে বিধাতার একটা অমোঘ অভিসম্পাত আছে। যাক্, সে সকল কথা এখন থাক্, তুমি নীচে যাও। ফুলসাহেবের আসার সময় হ’য়ে এসেছে।”
সপ্তম পরিচ্ছেদ – নূতন প্ৰক্ৰিয়া
দেবেন্দ্রবিজয় নীচে নামিয়া গেলেন। এবং সোপানের পার্শ্ববর্ত্তী একটি অন্ধকারময় ঘরে নীরবে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন! অল্পক্ষণ পরেই বাহিরে একটা কি শব্দ হইল। দেবেন্দ্রবিজয় সেই ঘরের কবাটের ফাক দিয়া দেখিলেন, বৈঠকখানা ঘরের রাস্তার দিক্কার একটা জানালা দিয়া এক-একজন বিকটাকার দস্যু প্রবেশ করিতেছে;এবং একজন দুইহস্তে গবাক্ষের লোহার গরাদ দুইটি ফাঁক করিয়া ধরিয়া রহিয়াছে। অন্ধকারে কাহারও মুখ স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন না; কিন্তু তাহারা যে ফুলসাহেবের দল-বল, তাহাতে আর দেবেন্দ্রবিজয়ের তিলমাত্র সন্দেহ রহিল না।
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, নিঃশব্দে অনেকগুলি লোক উঠানে গিয়া দাঁড়াইল। এমন সময়ে তাহাদের ভিতর হইতে একজন লোক একবার একটা দিয়াশলাই জ্বালিয়া সকলে আসিয়াছে কি না, গণনা করিয়া দেখিল। সে গণনাকারী স্বয়ং ফুলসাহেব। সেই অবসরে দেবেন্দ্রবিজয়ও একবার তাহাদিগের গণনা করিয়া লইলেন। মোটের উপরে তাহারা তেরোজন। সকলের হাতে এক-একখানা তীক্ষ্ণধার কিরীচ।
তাহার পর তাহারা অন্ধকারে ধীরে ধীরে সোপানারোহণ আরম্ভ করিল। নিঃশব্দে—কাহারও মুখে কোন কথা নাই। দেবেন্দ্রবিজয় দেখিয়া ভীত হইলেন; যদি ইলেকট্রীক্ ব্যাটারী এ সময়ে কোন কাজ না করে, তাহা হইলে এখনই যে ভয়ানক ঘটনা ঘটিবে, তাহা ভাবিতেও ভয় হয়। এ সময়ে তাহারা সকলেই মরিয়া—প্রাণের ভয় ভুলিয়া গিয়াছে। তাহাদিগের সকলেই যখন সিঁড়ির উপরে উঠিয়াছে, তখন দেবেন্দ্রবিজয় সেই ইলেকট্রীক্ ব্যাটারীর দড়ি সজোরে টানিয়া ধরিলেন।
তখনই চক্ষুর নিমেষে কী ভয়ানক!
তখনই দস্যুদলের আর্তনাদে, চীৎকারে তর্জ্জনে-গৰ্জ্জনে, গালাগালিতে সমস্ত বাড়ীখানা যেন ভাঙিয়া পড়িবার মত হইল। তখনকার ব্যাপার বর্ণনায় পাঠকের ঠিক হৃদয়ঙ্গম করাইয়া দেওয়া আমার সাধ্যাতীত। পাঠক, পারেন যদি অশ্বশালায় অগ্নিসংযোগের কল্পনা করিতে একবার চেষ্টা করুন, অনেকটা সেই রকমের। অবশ্যই সেই দহ্যমান অশ্বশালায় অনেকগুলি অশ্ব আছে।
এমন সময়ে অরিন্দম একটা লণ্ঠন হাতে বাহিরে আসিলেন। এবং সেই সোপানের উপরে দাঁড়াইয়া হাসিমুখে সেই অপূৰ্ব্ব দৃশ্য দেখিতে লাগিলেন। আর নীচে দেবেন্দ্রবিজয় ভিত্তিগাত্রে পৃষ্ঠস্থাপন করিয়া হাসিয়া হতজ্ঞান হইতেছেন।
কী সুন্দর দৃশ্য—সিঁড়ির উপর হইতে নীচে পর্য্যন্ত তেরোজন সারি-সারি দাঁড়াইয়া! তর্জ্জন গৰ্জ্জনের ত কথাই নাই—তাহার পরে তাহাদের কী চমৎকার মুখভঙ্গি! যন্ত্রণায় কেহ নৃত্য করিতেছে, কেহ সেই উদ্যোগে আছে, এবং কেহ রেলিং হইতে হাত ছাড়াইয়া লইবার জন্য মুখ বিকৃত করিয়া লাফাইতে আরম্ভ করিয়াছে। কিছুতেই কৃতকার্য্য হইতে পারিতেছে না। যাহার যেখানে সেই ইলেকট্রীক ব্যাটারীর সংস্পর্শ হইয়াছে, দেহ হইতে সেই অঙ্গটি যেন ছিঁড়িয়া উঠিয়া যাইতেছে।
ডাক্তার ফুলসাহেব সিঁড়ির উপরের শেষ সীমায় অরিন্দমের সম্মুখে দাঁড়াইয়া; যদিও তাহার মুখে চীৎকার, গোঙানি কি কোন যন্ত্রণাসূচক ধ্বনি ছিল না, তপাপি তাহার মুখের ভাব এবং দেহের সুদৃঢ় মাংসপেশীগুলি যেরূপ স্ফীত হইয়া উঠিতেছিল, তাহা দেখিয়া তাহার ভীষণ যন্ত্রণা বেশ অনুভব করা যায়।
অরিন্দম মৃদুহাস্যে বলিলেন, “ডাক্তারবাবু, ভাল আছেন ত? অনেক দিনের পর একেবারে সবান্ধবে শুভাগমন করেছেন, এ আমার পরম সৌভাগ্যের কথা; বোধহয়, আপনাদের অভ্যর্থনার আয়োজনটা ঠিকই করা হয়েছে—কোন ত্রুটি হয় নাই—কি বলেন?”
ফুলসাহেব কোন উত্তর করিল না;অপর দিকে মুখ ফিরাইয়া রহিল। অরিন্দম বলিলেন, “আগে আপনার বুন্ধুদের মুক্তি দিই, তারপর সকলের শেষে আপনার মুক্তিলাভ হবে।” এই বলিয়া অরিন্দম রাশীকৃত হাতকড়ি লইয়া নীচে নামিয়া গেলেন। তাঁহার হাতে রাবারের দস্তানা ও পায়ে রাবারের জুতা থাকায় ব্যাটারীতে তাঁহার কিছুই হইল না।
অরিন্দম দেবেন্দ্রবিজয়কে কতকগুলি হাতকড়ি দিলেন; এবং দুইজনে মিলিয়া দস্যুদের হাতে হাতকড়া লাগাইতে আরম্ভ করিলেন। ক্রমে বারোজন এইরূপে বন্দী হইল—বাকি ফুলসাহেব
অষ্টম পরিচ্ছেদ – খুনীর আত্মকাহিনী
ফুলসাহেবের যন্ত্রণাটা এই দীর্ঘকালে অত্যন্ত অসহ্য হইয়া উঠিয়াছিল; তথাপি সে নীরব, এবং তাহার মুখ চোখ লাল হইয়া গিয়াছিল।
অরিন্দম বলিলেন, “ডাক্তার সাহেব, তোমার মুক্তির বিলম্ব আছে। আমি যে কথাগুলি জিজ্ঞাসা করিব, যদি তুমি সত্য কথা না বল, তা’ হলে তোমাকে এইরূপ অবস্থায় সারারাত এখানে কাটাইতে হইবে। সিন্দুকের ভিতরে যে বালিকাটির লাস পাঠাইয়াছিলে, সে কে?”
ফুলসাহেব হাসিতে চেষ্টা করিল; কিন্তু যন্ত্রণায় তাহা একটা ক্ষণস্থায়ী বিকৃত মুখভঙ্গিতে পরিণত হইল মাত্ৰ।
ফুলসাহেব বলিল, “তুমি যে রেবতীকে আমার হাত থেকে বাহির ক’রে নিয়েছ, সেই রেবতীর ছোট বোন্—রোহিণী।”
“কে তাহাকে খুন কুরিয়াছে?”
“আমি—স্বহস্তে।”
“কেন খুন করিলে?”
“খুন করা আমার একটা নেশা।”
“নেশাটা এখন ছুটেছে কি?”
“যতক্ষণ না ফাঁসীর দড়িতে আমি ঝুল্ছি ততক্ষণ নয়।”
“রেবতীর কাকা কেমন লোক?”
“আমার চেয়ে ভয়ানক লোক।”
“কেন?”
“যে বিষয়ের লোভে নিজের ভ্রাতুষ্পুত্রীকে হত্যা করিতে চায়, সে কি আমার চেয়ে ভয়ানক লোক নয়? আমি ত অপর লোক—আমার তাতে কষ্ট কি?”
“তুমি রেবতীর কাকার নিকটে এই কাজের জন্য কত টাকা পারিশ্রমিক ঠিক করিয়াছিলে?”
“বিশ হাজার।”
“কত আদায় হইয়াছে?”
“কিছুই না।”
“কেন?”
“রেবতীকে খুন করিতে পারি নাই বলিয়া।”
“পার নাই কেন?”
“তুমি আমার মুখের অন্ন কাড়িয়া লইয়াছ।”
“এতদিন খুন কর নাই কেন?”
“রেবতীর রূপ দেখিয়া ভুলিয়াছিলাম—আরও একটা উদ্দ্যেশ্য ছিল;মনে করিয়াছিলাম, রেবতীকে হস্তগত ও মনের মত করিয়া গড়িয়া তুলিতে পারিলে রেবতীর কাকা ফাঁকে পড়িবে—সমস্ত বিষয়টা আমারই ভোগ-দখলে আসিবে।”
“রেবতী ও তাহার কাকার কাছে তুমি কেশববাবু নামেই পরিচিত?”
“হাঁ, আমি একটা লোক, কিন্তু কাজের খাতিরে আমার অনেকগুলি নাম আছে।”
“মোহিনী তোমার কে হয়?”
“তুমি এত খবর কোথায় পাইলে?”
“মোহিনী তোমার স্ত্রী?’
“মোহিনী আমার যম।”
“কেন এ কথা বলিতেছ?”
“নতুবা আমার এ দুৰ্দ্দশা হইবে কেন?”
“মোহিনী কিসে তোমার এ দুর্দ্দশার কারণ হইল?”
ফুলসাহেব উত্তেজিত কণ্ঠে বলিতে লাগিল, “অরিন্দম, আমার কাছে লুকাইতে চেষ্টা করিও না। তোমার মুখে মোহিনীর নাম শুনিয়া এখন আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি, রাক্ষসী মোহিনীই স্বহস্তে আমার এ মৃত্যুর আয়োজন করিয়াছে; নতুবা এখন ইহার ঠিক্ বিপরীত ঘটনা ঘটিত—তুমি যেমন আমাকে এই দুরবস্থায় রাখিয়া নিশ্চিন্তমনে উপরে দাঁড়াইয়া কর্তৃত্ব করিতেছ; তেমনি তোমাকে ভয়ানক মৃত্যুমুখে তুলিয়া ধরিয়া এখন আমিও তোমার উপরে কর্তৃত্ব করিতে পারিতাম। সর্ব্বনাশী মোহিনী আমার সে সাধে বাদ সাধিয়াছে। নিশ্চয় সে এখানে আসিয়া আমাদের গুপ্তমন্ত্রণার কথা তোমার নিকট প্রকাশ করিয়া দিয়াছে; অরিন্দম, আর না—তুমি আমাকে আপাততঃ এ অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও—প্রাণ যায়—বড় কষ্ট—”
অরি। আর একটু অপেক্ষা কর। তুমি রেবতীর কাকার সম্বন্ধে যে সকল কথা বলিলে, সকলই সত্য?
ফুল। এক বর্ণও মিথ্যা নহে। মরিতে বসিয়া মিথ্যা বলিয়া লাভ কি?
অরি। আর একটি কথা সত্য বলিবে?
ফু। কেন বলিব না?
অ। তুমি সিন্দুকে রেবতীর ভগিনীর লাস পাঠাইবার সময়ে একখানা পত্রে লিখিয়াছিলে যে, সৰ্ব্বশুদ্ধ তুমি তখন আঠারোজনকে খুন করিয়াছ, তাহার একটা তালিকা দাও দেখি?
ফু। ইহা ত আমার গৌরবের কথা। কেন মিথ্যা বলিব? যখন দেখিতেছি, আমার মৃত্যু নিশ্চিত, তখন আর এ গৌরবের কথাটা অপ্রকাশিত না রাখাই ভাল। আঠারোটা খুনের জন্য আমাকে ত আঠারোবার ফাঁসী যাইতে হইবে না। আমার বাড়ী এলাহাবাদ—আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ। নাম বিনোদলাল চট্টোপাধ্যায়। বোধহয়, খুনী বিনোদ চাটুয্যের কথা তুমি শুনিয়াছ। যে বিনোদ চাটুয্যেকে ধরিবার জন্য কত পুলিস-কৰ্ম্মচারী, কত সুদক্ষ গোয়েন্দা এ পৃথিবী হইতে অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছে—আমি সেই লোক! যে মোহিনীর কথা তুমি বলিতেছ, ঐ মোহিনীর বাপ, কাকা, মামা, ভাই একরাত্রে আমার হাতে খুন হয়। সে আজ দশ বৎসরের কথা। বিধবা মোহিনীকে আমি কুলের বাহির করিয়া আনি —অবশ্যই অর্থলোভে; কারণ আমার মনের ভিতরে প্রেম, ভালবাসা, স্নেহ, মমতা এসকল বড় একটা স্থায়ী হ’তে পারে না। মোহিনীদের বাড়ী আমাদের পাড়ার ভিতরেই ছিল। মোহিনীকে বাহির করিয়া আনিলে মোহিনীর বাপ রাগে আমাদের ঘর জ্বালাইয়া দেয়। আমি সেই প্রতিশোধে মোহিনীর বাপ, কাকা, মামা, আর ভাইকে এক রাত্রে খুন করি। সেই রাত্রেই আমি মোহিনীকে নিয়ে সেখান হ’তে স’রে যাই। তাহার পর নয়জন পুলিসের লোককে খুন করি—অবশ্যই যাহারা আমার সন্ধানে দুঃসাহসিক হইয়া উঠিয়াছিল। তাহার পর আর এক মুসলমানের মেয়েকে অর্থলোভে বিবাহ করিয়া তাহার বাপকে খুন করি—তাহাকে খুন করি। কুলসমের মাকে, ভাইকে খুন করি; রেবতীর ভগিনীকে খুন করি, এই ত গেল আঠারো জন; এ ছাড়া পরে তমীজউদ্দীনকে খুন করিয়াছি, জেলখানার প্রহরীকে খুন করিয়াছি, আরও যদি কিছুদিন বাঁচিয়া থাকিতে পারিতাম,—আরও অনেক খুন করিতে পারিতাম। বিশেষতঃ তোমাকে আর যোগেন্দ্রনাথকে খুন করিবার বড় ইচ্ছা ছিল। তোমরা বাঁচিয়া থাকিতে আমার মরণে সুখ হইবে না। উঃ বড় যন্ত্রণা! অরিন্দম, প্রাণ যায়—আমার শরীর অবসন্ন হ’য়ে এসেছে—কি ভয়ানক!
অরিন্দম দেবেন্দ্রবিজয়কে ইঙ্গিত করিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় ফুলসাহেবের হাতে ডবল হাতকড়ি ও পায়ে ডবল বেড়ি লাগাইয়া দিলেন।
—–
দেবেন্দ্রবিজয়ের প্রতি নারী-পিশাচী জুমেলিয়ার তীব্র প্রতিহিংসার ভীষণ কাহিনী গ্রন্থকারের “মনোরমা” ও “মায়াবিনী” নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে।—প্রকাশক।
নবম পরিচ্ছেদ – ভীষণ প্রতিহিংসা
অরিন্দম যোগেন্দ্রনাথকে এ শুভসংবাদ দিবার জন্য দেবেন্দ্রবিজয়কে থানায় পাঠাইলেন। এক ঘণ্টার মধ্যে যোগেন্দ্রনাথ পাঁচ-সাতজন পাহারাওয়ালাকে সঙ্গে লইয়া উপস্থিত হইলেন; দেখিয়া শুনিয়া তিনি অসংখ্য ধন্যবাদের সহিত অরিন্দমের সুখ্যাতি করিতে লাগিলেন।
যোগেন্দ্রনাথ সকলকে থানায় লইয়া চলিলেন। অরিন্দম ও দেবেন্দ্রবিজয় সঙ্গে চলিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় ও যে পাঁচ-সাতজন পাহারাওয়ালা যোগেন্দ্রনাথের সঙ্গে আসিয়াছিল, তাহারা ফুলসাহেব ছাড়া অপর দস্যুদিগকে লইয়া আগে চলিয়া গেল। তাহাদিগের পশ্চাতে ফুলসাহেবকে লইয়া অরিন্দম ও যোগেন্দ্রনাথ থানার দিকে অগ্রসর হইয়া চলিলেন।
তখন রাত্রি প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। দূরবর্ত্তী আমগাছের ঘন পল্লবের ভিতর হইতে দুটো- একটা কোকিল ডাকিতে আরম্ভ করিয়াছে, এবং বাঁশঝাড়ের ভিতর দিয়া শেষরাত্রির স্নিগ্ধ বাতাস সর্ সর্ শব্দে বহিয়া যাইতেছে; এবং অন্ধকারস্তূপবৎ গাছের ভিতরে অসংখ্য খদ্যোৎ জ্বলিতেছে, পথে জন-প্ৰাণী নাই। এমন সময়ে কে ওই পিশাচী নিকটবর্ত্তী বৃক্ষান্তরাল হইতে ছুটিয়া বাহির হইয়া চক্ষুর নিমেষে একখানা দীর্ঘ ছুরিকা ফুলসাহেবের বক্ষে আমূল বিদ্ধ করিয়া দিল। তাড়াতাড়ি যোগেন্দ্ৰনাথ যেমন সেই নরহন্ত্রীকে ধরিতে যাইবে, সে তেমনি ক্ষিপ্রহস্তে সেই ছুরিখানা নিজের বুকে বসাইয়া দিল। এবং একটা খিল খিল খিল কলহাস্যে সুপ্ত নিশীথিনী অন্ধকার-নিস্তব্ধ-বুক দীর্ণ-বিদীর্ন করিয়া যেন তেমনি একখানা শাণিত ক্ষিপ্র ছুরির ন্যায় তীব্রবেগে খেলিয়া গেল। আমগাছে কোকিল থামিয়া গেল; এবং বাতাস যেন রুদ্ধ হইয়া গেল, এবং আকাশের সমস্ত নক্ষত্র নিদ্রাহীন নির্নিমেষ নতনেত্রে রাক্ষসী নিশার এই একটা ক্ষুদ্র অভিনয়ের প্রতি নীরবে চাহিয়া রহিল। প্রলয়ঙ্করী নিশার শোণিতাক্ত মূর্ত্তির সমক্ষে, এবং তাহার শব্দহীন গাম্ভীর্যের মধ্যে পড়িয়া এবং তাহার এই দুর্নিরীক্ষ্য বিভীষিকার মধ্যে পড়িয়া শাসনভীত অপরাধী ক্ষুদ্র বালিকার ন্যায় সমগ্র প্রকৃতি থর্ থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল এবং চারিদিক ছম্ ছম্ করিতে লাগিল।
ফুলসাহেবের সর্ব্বাঙ্গ প্লাবিত করিয়া রক্তস্রোত ছুটিতে লাগিল—তখনই সেখানে সে লুটাইয়া পড়িল। যাহার ছুরির আঘাতে জীবনের সহিত ফুলসাহেবের বন্দিত্ব মোচন করিয়া দিতেছে, অরিন্দম তাহার ভাব-ভঙ্গিতে চিনিতে পারিলেন—সে সেই মোহিনী।
মোহিনী নিজের বুকে যে আঘাত করিয়াছিল, বাধাপ্রাপ্ত হইয়াও তাহা সাংঘাতিক হইয়াছিল। যোগেন্দ্রনাথ ও অরিন্দম তাহাকে ধরিয়া ফেলিলেন, এবং তাহার হাত হইতে সেই রক্তাক্ত ছুরিখানা কাড়িয়া লইলেন। ফুলসাহেবের রক্তস্রাব কিছুতেই বন্ধ হইল না। সে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। আবদ্ধ হস্তে তালি দিতে দিতে, হাসিতে হাসিতে মোহিনী ফুলসাহেবকে বলিল, “কেমন, বিনোদ! আমি কি মিথ্যাকথা বলি? দেখ দেখি, কেমন সুখ! এই না হ’লে মজা!”
মোহিনী খুব হাসিতে লাগিল।
ফুলসাহেব বলিল, “মোহিনী, তুমি আমার যথেষ্ট উপকার করিলে, অরিন্দমের ফাঁসী-কাঠের অপেক্ষা তোমার ছুরি অনেক ভাল।” তাহার পর অরিন্দমকে ডাকিয়া বলিল, “অরিন্দম, আমি ত এখনই মরিব—তা’ বলিয়া মনে করিও না, তুমি নিরাপদ হইতে পারিলে। জুমেলিয়া এখনও বাঁচিয়া আছে সুবিধা পাইলে সে একদিন তোমাকে হত্যা করিবে। সে কোথায় লুকাইয়া আছে, আমি জানি না। জুমেলিয়াকে সাবধান—এখন হইতে তাহার সন্ধান কর—বিশেষতঃ তোমাদের উপরে তার বড় রাগ আছে—সে প্রতিজ্ঞা করিয়াছে, তোমাদের রক্ত দর্শন করিয়া ছাড়িবে। *আমি ত মরিতে বসিয়াছি এখন বুঝিতে পারিয়াছি—এত চেষ্টা করিয়া দেখিয়াছি—অধর্ম্মের জয় কিছুতেই হইবার নয়।”
অজস্র রক্তস্রাবে ফুলসাহেবের সর্ব্বাঙ্গ শীঘ্রই অবসন্ন হইয়া আসিল। চক্ষুর দীপ্তি ম্লান হইয়া গেল এবং গলায় ঘড়ঘড়ি উঠিল। ফুলসাহেব মৃত্যুর পূর্ব্বে অনেকক্ষণ অরিন্দমের মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল; সে দৃষ্টিতে এরূপ বুঝাইল, যেন অরিন্দমকে তাহার আরও কি বলিবার ছিল; বলা হইল না—ফুলসাহেব তখন বাক্ শক্তি রহিত এবং কণ্ঠাগত প্রাণ। দুই-একবার কথা কহিবার জন্য মুখ খুলিল—কোন কথা বাহির হইল না; একটি অব্যক্ত শব্দ হইল মাত্র; তাহার অনতিবিলম্বে দুর্দান্ত ফুলসাহেব এ সংসার হইতে চির-বিদায় গ্রহণ করিল কিন্তু তাহার সেই সকল ভীষণ কীৰ্ত্তি-কাহিনী অনেকেরই মনে চিরজাগরূক থাকিবে।
যথেষ্ট রক্তপাতে মোহিনীর মত্যুকালও যথেষ্ট সংক্ষিপ্ত হইয়া আসিতে লাগিল। রক্ত কিছুতেই বন্ধ হইল না। ফুলসাহেবের মৃত্যুর অনতিবিলম্বে মোহিনীরও মৃত্যু হইল।
****
তাহার পর অরিন্দম ফুলসাহেবের জামার পকেট হইতে দুইটি বিষ-কাঁটা ও কয়েকখানি পত্ৰ বাহির করিলেন। পত্রগুলি একান্ত প্রয়োজনীয়। অরিন্দম পত্রগুলি পড়িয়া যোগেন্দ্রনাথের হাতে দিলেন। যোগেন্দ্রনাথও পাঠ করিয়া মত প্রকাশ করিলেন, “পত্রগুলি প্রয়োজনীয় বটে। এতদিনের পর এ গভীর রহস্যপূর্ণ প্রহেলিকা সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার হইল।”
ফুলসাহেব ও মোহিনীর মৃতদেহ থানায় চালান দেওয়া হইল।
দশম পরিচ্ছেদ
****
ফুলসাহেব ধরা পড়িল—মরিল। দস্যুরা ধরা পড়িল, এবং তাহাদের সকলেই যথোপযুক্ত দণ্ড পাইল। যখন সকলই হইল, অথচ রেবতীর সন্ধানের কোন বন্দোবস্ত হইল না, তখন অরিন্দমের আশ্বাস-বাক্যগুলিকে দেবেন্দ্রবিজয়ের একান্ত নিরর্থক বোধ হইতে লাগিল। দেবেন্দ্রবিজয় একদিন স্পষ্টই অরিন্দমকে বলিলেন, “সকলই ত হইল, তবে এখন আমি বাড়ীতে ফিরিয়া যাই। আর আমাকে আবশ্যক কি?”
রাগের ভাবটা মুখে-চোখে খুব শীঘ্রই ফুটিয়া উঠে। অরিন্দম মুখ দেখিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের মনের কথা বুঝিতে পারিলেন। বলিলেন, “সে কি! আর দিনকতক তোমাকে থাকিতে হইবে—রেবতীর উদ্ধার এখনও হয় নাই।”
দে। সেজন্য কষ্টস্বীকার করা আপনার অনাবশ্যক।
অ। তুমি রাগ করিয়াছ, দেখিতেছি। রাগের কথা নয়, দেবেনবাবু! কেবল রেবতী উদ্ধার করিলে হইবে না—যাহাতে তাহাকে তাহার বিষয়েশ্বর্যের সহিত উদ্ধার করিতে পারি, সে চেষ্টা করিতে হইবে। রেবতীর কাকা কিরকম প্রকৃতির লোক, ফুলসাহেবের মুখে শুনিলে ত। তিনিও বড় সহজ নহেন—তিনিও একটি ডিক্সএডিসনের ছোট খাট ফুলসাহেব।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এখন কি করিবেন, স্থির করিয়াছেন?”
অরি। একবার রেবতীর কাকার সঙ্গে দেখা করিতে হইবে। তুমিও আমার সঙ্গে যাইবে। রেবতীর সন্ধান করিতে তিনি তোমাকে ডিটেক্টিভের জন্য বলিয়াছিলেন;তুমি আমাকেই সেই ভাল ডিটেক্টিভ বলিয়া তাঁহার সহিত পরিচয় করাইয়া দিবে, তাহা হইলেই যথেষ্ট। তাহার পর অগৌণে আমি নিজের পরিচয় তাঁহাকে ভাল করিয়াই দিব।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “ওঃ! রেবতীর কাকা কি ভয়ানক লোক! বিষয়ের লোভে নিজের ভ্রাতুষ্পুত্রীকে অনায়াসে খুনীদের হাতে তুলে দিলেন! পাছে তাঁর উপরে লোকের সন্দেহ হয়, এজন্য আবার ডিটেক্টিভ নিযুক্ত করছেন!”
অ। এ সংসারে কতরকম লোক আছে, দেবেন্দ্রবিজয়! মানুষ চেনা বড় শক্ত কাজ। যে যতটা পরিমাণে মানুষ চিনিতে পারে, সে ঠিক ততটা পরিমাণে নিরাপদ। তোমার বয়স অল্প, এখনও এ পৃথিবীর সকল সংবাদ তোমার কাছে পৌঁছায় নাই।
দে। রেবতীর কাকার কথায়-বার্ত্তায়, ভাবভঙ্গিতে আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে যতটা আসে, বুঝিতে পরি, ফুলসাহেবের মুখে যেমন শুনিলাম, তিনি তেমন ভয়ানক লোক নহেন। তিনি লোকের সহিত যেরূপভাবে কথা ক’ন, যেরূপ ব্যবহার করেন, তাতে পরমশত্রু যে, সে-ও তাঁকে ভক্তি-শ্রদ্ধা না ক’রে থাকতে পারে না।
অ। তাই ত বলছি, তোমার বয়স এখন অনেক কম। আমাকে সঙ্গে নিয়ে একবার তার কাছে চল, লোকটাকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ক’রে খাদ বাদ দিয়ে তোমার চোখের সামনে যখন ধরব, তখন তুমিও জানতে পারবে, লোকটি কী দরের লোক! তখন আমাকে বেশী বাক্যব্যয় করতে হবে না।
একাদশ পরিচ্ছেদ – সাধুতার ভাণ
সেইদিনেই দেবেন্দ্রবিজয়কে সঙ্গে লইয়া অরিন্দম রেবতীর কাকার সহিত সাক্ষাৎ করিতে বেণীমাধবপুর যাত্রা করিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় গোপালচন্দ্রের বাড়ী চিনিতেন। উভয়ে তাঁহার বহির্ব্বাটীতে গিয়া বসিলেন, এবং একজন ভৃত্যকে দিয়া গোপালচন্দ্রের নিকটে সংবাদ পাঠাইয়া দিলেন। গোপালচন্দ্ৰ অন্তঃপুরে ছিলেন;সংবাদ পাইয়া বাহিরে আসিলেন। এবং উভয়কেই মিষ্ট সম্ভাষণে পরিতুষ্ট করিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে তাঁহার কুশলাদি সম্বন্ধে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন।
গোপালচন্দ্রের বয়স হইয়াছে—বয়স আটচল্লিশের কম নহে—বর্ণ গৌর—দেহ স্থূল। উদরটি অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অপেক্ষা দশগুণ স্থূল; যেন সেসকলের সহিত সেটি ঠিক খাপ খায় না। মাথার চুল খুব ছোট করিয়া ছাঁটা, শ্মশ্রুগুম্ফ একেবারে নাই। নাই থাকুক্, মাথায় টাক আছে, তাহার পাশেই দীর্ঘ অকফলা আছে, গলায় হরিনামের মালা আছে, প্রকাণ্ড ভুঁড়ি আছে, এবং তাহার সেই বিপুল দেহের চারিভিতে ছোটবড় অনেক রকমের হরিনামের ছাপ আছে।
গোপালচন্দ্র অরিন্দমকে বলিলেন, “মহাশয়, আপনি দেবেন্দ্রবাবুর মুখে আমার দুরদৃষ্টের সকল কথা বোধ হয়, শুনিয়াছেন। আহা! রেবতী মা আমার—কাকা বলতে অজ্ঞান হ’ত! আর রোহিনি- সে ত আমার ঘাড়ে-পিঠে মানুষ হয়েছে—একদণ্ড আমার কাছ ছাড়া হ’ত না। হায়, হায়, মানুষের এমন সৰ্ব্বনাশ হয়! না জানি, পূৰ্ব্বজন্মে কি মহাপাতকই করেছিলেম, হরি হে—রাধাগোবিন্দ! রাধাগোবিন্দ!”
অরিন্দম বলিলেন, “বড়ই দুঃখের বিষয়, আপনার ন্যায় মহাত্মা, লোকের এমন বিপদ্ হয়! দেখি, মহাশয়ের আশীর্ব্বাদে যদি আমি মহাশয়ের কোন উপকারে আসিতে পারি। এখন মহাশয় যদি অনুগ্রহ করিয়া আমাকে এ কাজে নিযুক্ত করেন।”
গোপালচন্দ্র বলিলেন, “এ আবার নিযুক্ত কি? আপনাকে সেইজন্য ত আহ্বান করা হয়েছে।”
অরিন্দম বলিলেন, “তাহা হইলে আমি আপনার কার্য্যোদ্ধার করিলে কিরূপ পারিশ্রমিক পাইব, তাহার একটা বন্দোবস্ত করিয়া একখানি স্বীকার পত্র লিখিয়া দিন।”
গো। ইহার জন্য আবার স্বীকার-পত্র কি আপনি যাহা চাহিবেন, আমি আনন্দের সহিত তৎক্ষণাৎ তাহা দিব। যাতে আপনি সুখী হ’ন্, তা’ আমি করিব, সে আমার কর্তব্য;যদি স্বর্বস্ব খোয়াইয়া তাদের দুটিকে পাই, তাতেও আমার বুক দশ হাত হইবে।
অরিন্দম বলিলেন, অবশ্যই মনে মনে, “আর তাদের দুটিকে না পেলে উদরটি যে আরও স্ফীত হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।” প্রকাশ্যে বলিলেন, “একটা লেখাপড়া না থাকিলে কি করিয়া চলিবে? সেজন্য আপনি এত ‘কিন্তু’, হইতেছেন কেন, বুঝিতে পারিলাম না। “
গো। না—না, ‘কিন্তু’ হইব কেন, আমি এখনই লিখিয়া দিতেছি। কি লিখিতে হইবে, আর কত টাকা হইলে আপনি সন্তুষ্ট হইবেন, বলুন?
অরি। একশত হইলে ঠিক হয় না?
গো। একশত! আমি আপনাকে পাঁচশত টাকা দিব।
অরিন্দম মনে মনে হাসিলেন। বলিলেন, “মহাশয়ের হৃদয় যথেষ্ট উদার। যাই হ’ক্, আমি আপনার জন্য আরও উৎসাহের সহিত কাজ করিব।”
গো। কি লিখিতে হইবে?
অরি। বেশী কিছু লিখিতে হইবে না; লিখিয়া দিন, আপনার কার্য্যোদ্ধার হইলে আমাকে পাঁচশত টাকা দিবেন। আর আপনার নামটি সহি করিয়া দিন।
গোপালচন্দ্র সেই মর্ম্মে একখানি অঙ্গীকারপত্র লিখিয়া নিজের নাম স্বাক্ষর করিলেন, এবং সেখানি অরিন্দমের হাতে দিলেন।
অরিন্দম “ইহাই যথেষ্ট”, বলিয়া সেখানি অবিলম্বে পকেটস্থ করিলেন। বলিলেন, “তবে এখন হইতেই কাজ আরম্ভ করা যাক্। মহাশয়, প্রথমে আপনার বাড়ীখানা আমি একবার অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে চাই।”
গোপালচন্দ্র হো হো হো করিয়া উচ্চশব্দে হাসিয়া উঠিলেন। হাসির বেগ মন্দীভূত হইলে বলিলেন, “তবেই হয়েছে, আপনার মত বুদ্ধিমান্ লোকের দ্বারা আমার যে উপকার হ’বে, তা’ আমি দিব্যচক্ষেই দেখতে পাচ্ছি! এ বাড়িতে অনুসন্ধান করে কি হবে? এখানে অনুসন্ধান ক’রে তাদের কোন সন্ধানই পাবেন না। তারা কি এতদিন বাড়ীর ভিতরে লুকিয়ে ব’সে আছে!”
অরিন্দম বলিলেন, “তাদের সন্ধান না পাই, তাদের যাতে সন্ধান করতে পারি, এমন কোন সূত্র পাওয়া যেতে পারে; সেজন্য বলিতেছি, তাহাতে আপনার আপত্তি কি।”
গোপালচন্দ্র বলিলেন, “আপত্তি কি—আর কিছুই না, তবে বাজে কাজে অনর্থক একটা হাঙ্গামা করা।”
অরিন্দম বলিলেন, “হাঙ্গামার কিছুই নয়। আমি আপনার বাড়ীর সকল ঘর অনুসন্ধান করিতে চাই না, বাড়ীর মেয়েদের না সরালেও চলে। আমি একবার কেবল বাড়ীর চারিদিক্টা দেখতে চাই। এতে আর হাঙ্গামা কি?”
গোপালচন্দ্র বলিলেন, “না, এতে আর হাঙ্গামা কি, তবে এ দেখায় যে কি ফল হবে, বুঝলেম না।”
অরিন্দম বলিলেন, “না, সেটা এখন আপনার বোঝবার কোন দরকার নাই।”
“তবে আমি একবার বাড়ীর ভিতর হ’য়ে আসি”, বলিয়া গোপালচন্দ্র নিজে স্থূল দেহভার বহন করিয়া মন্থরগতিতে অন্তঃপুর মধ্যে প্রবেশ করিলেন। এবং অনতিবিলম্বে ফিরিয়া আসিয়া অরিন্দমকে বলিলেন, “আসুন, মহাশয়।”
সকলে উঠিয়া ভিতর বাড়ীতে প্রবেশ করিলেন।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – গোপাল ধরা পড়িল
অন্তঃপুরের পশ্চাদ্ভাগে একটি অনতিবৃহৎ পুষ্করিণী, এবং তাহার চারিদিকে নানাবিধ ফলের গাছ। বাহিরের লোকের দৃষ্টি তন্মধ্যে প্রবিষ্ট হইতে না পারে, এমনভাবে সেই স্থানটা চতুৰ্দ্দিকে উচ্চ প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। এই পুষ্করিণীটি অন্তঃপুরস্থ স্ত্রীলোকদিগের জন্যই ব্যবহৃত হইত।
গোপালচন্দ্র ও দেবেন্দ্ৰবিজয়কে সঙ্গে লইয়া অরিন্দম এই ছোট বাগানটি বেশ করিয়া পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। যথাস্থানে উপস্থিত হইয়া অরিন্দম স্থির হইয়া দাঁড়াইলেন। সেখানে অনেকগুলি মানকচুগাছ সুপ্রশস্ত পত্রে অনেকটা স্থান অধিকার করিয়াছিল? তন্মধ্যে দুই-তিনটি গাছ অন্যান্য গাছগুলিকে ছাড়াইয়া অত্যন্ত সতেজ হইয়া উঠিয়াছিল। অরিন্দম গোপালচন্দ্রকে বলিলেন, “অন্যান্য গাছগুলি অপেক্ষা এই দুই তিনটি গাছ অধিক তেজাল দেখিতেছি।”
গোপালচন্দ্র বলিলেন, “হাঁ, ঐ গাছগুলি আলাদা জাতের। রাম সনাতন নামে আমারই একজন প্রজা তার মামার বাড়ী থেকে আমাকে এনে দিয়েছে। চলুন, ঐ দিক্টা আপনাকে দেখাইয়া আনি।” অরিন্দম বলিলেন, “না, আমাকে আর কোথাও যাইতে হইবে না। এইখানে আমার কাজ মিটিবে। একটা কথা হইতেছে, মহাশয়, আপনার এই মানকচু গাছগুলি আমাকে বাধ্য হইয়া নষ্ট করিতে হইতেছে; আপনার কোন আপত্তি আছে কি?”
গোপালচন্দ্ৰ হাসিয়া বলিলেন, “বিলক্ষণ, আপনি ত বড় মজার লোক!”
বলিতে না-বলিতে অরিন্দম দু-তিনটি গাছ টানিয়া তুলিয়া ফেলিলেন। তেমন বেশী বলপ্রয়োগও করিতে হইল না। গোপালচন্দ্র “করেন কি” “করেন কি” বলিয়া সাতিশয় অধীর হইয়া উঠিলেন।
অরিন্দম গোপালচন্দ্রের মুখের দিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ এবং একবার “চুপ করুন”, বলিয়া তাঁহার ধৈর্য্যবিধান করিলেন। তাহার পর কটিদেশ হইতে একখানি দীর্ঘফলক ছুরিকা বাহির করিয়া সেইখানটা খনন করিতে লাগিলেন।
দেখিয়া শুনিয়া গোপালচন্দ্রের মুখ শুকাইয়া এতটুকু হইয়া গেল। এবং তাহার হাত পা কাঁপিতে লাগিল। এক পা এক পা করিয়া—তিনি পশ্চাতে সরিতে লাগিলেন। সেদিকে অরিন্দমের দৃষ্টি ছিল তিনি বলিলেন, “মহাশয়, পলাইবেন না—স্থির হ’য়ে দাঁড়ান; নতুবা এই দেখিতেছেন? (পিস্তল প্রদর্শন) এক পা সরিলে, গুলি করিয়া পা ভাঙিয়া দিব।”
গোপালচন্দ্র বলিলেন, “না, পালাব কেন, ভয় এত কিসের? পুলিসের লোক হলেও আপনি আমাদেরই উপকারী বন্ধু।”
অরিন্দম হাসিয়া বলিলেন, “তা ত বটেই! (দেবেন্দ্রবিজয়ের প্রতি) এই পিস্তলটা তুমি ঠিক করিয়া ধরিয়া থাক, সাবধান, উনি এক পা সরিলে তৎক্ষণাৎ গুলি করিবে।”
দেবেন্দ্রবিজয় এ অদ্ভুত রহস্যের মম্মোদঘাটন করিতে না পারিয়া, বিস্মিত হইয়া অরিন্দমের নিকট হইতে পিস্তল গ্রহণ করিলেন। অরিন্দম দ্রুতহস্তে ছুরিকার দ্বারা মৃত্তিকা খনন করিয়া তুলিতে লাগিলেন। দুই-তিনটি মানকচুর গাছ টানিয়া তুলিয়া ফেলিতে সেই স্থানটা পূর্ব্বেই অনেকটা গভীর হইয়াছিল; এক্ষণে অল্প পরিশ্রমে অরিন্দম স্বকার্য্য উদ্ধার করিলেন। অনতিবিলম্বে সেখান হইতে তিনি একটি মনুষ্যের বাহুর সম্পূর্ণ কঙ্কাল বাহির করিলেন। অঙ্গুলি অবধি স্কন্ধদেশের সন্ধিস্থল পৰ্য্যন্ত লইয়া সেই কঙ্কাল।
সেই কঙ্কাল দেখিয়া অরিন্দম আনন্দিত হইলেন; দেবেন্দ্রবিজয় শিহরিয়া উঠিলেন, এবং গোপালচন্দ্র—তাঁহার চোখে সমুদয় পৃথিবী ঘুরিতে লাগিল।
গোপালচন্দ্র সহসা প্রকৃতিস্থ হইয়া, কৃত্রিম বিস্ময়ের সহিত বলিলেন, “একি ব্যাপার! এ হাড় এখানে কে আনিল? রাধামাধব!”
অরিন্দম বলিলেন, “আর কে আনিবে? আপনি আনিয়াছেন—এ কাজ আপনারই। মনে পড়ে না, ফুলসাহেব প্রদত্ত রোহিণীর মৃত্যুর প্রমাণ?”
গোপালচন্দ্র আকাশ-বিচ্যুতের ন্যায় বলিলেন, “সে কি কথা! আপনি মিথ্যাকথা বলিতেছেন।”
অরিন্দম বলিলেন, “হাঁ, আমাদের দু’জনের মধ্যে একজন যে খুব মিথ্যাবাদী, তা’ আপনি যেমন বুঝিতে পারিতেছেন, আমিও তেমনি বুঝিতে পারিতেছি। এখন বাধ্য হইয়া আপনার হাতে আমাকে হাতকড়ি লাগাইতে হইল।”
হাতকড়ির নাম শুনিয়া, গোপালচন্দ্র তাঁহার সুবৃহৎ ভুঁড়ি নাচাইয়া লাফাইয়া উঠিলেন। অরিন্দম দেবেন্দ্রবিজয়কে ইঙ্গিত করিলেন, দেবেন্দ্রবিজয় গোপালচন্দ্রের হস্তদ্বয় দৃঢ়ভাবে ধরিয়া ফেলিলেন। এবং অরিন্দম হাতকড়ি লাগাইয়া দিলেন।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – প্ৰমাণ পত্ৰ
গোপালচন্দ্র অরিন্দমকে বলিলেন, “আপনি আমারই লোক হইয়া আমারই হাতে হাতকড়ি দিলেন।”
অরিন্দম বলিলেন, “আমি আপনার নই—তাহার নই—আমি পুলিস কর্ম্মচারী। যিনি দোষী, তাঁহার সহিত বাধ্য হইয়া আমাকে এইরূপ অভদ্র ব্যবহার করিতে হয়।”
গোপালচন্দ্র চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া বলিলেন, “কি প্রমাণে আপনি আমাকে দোষী স্থির করিলেন?” অরিন্দম। “প্রমাণ আমার নিকটেই আছে” বলিয়া একখানি পত্র বাহির করিলেন। সেই পত্রখানি গোপালচন্দ্রের সম্মুখে ধরিয়া বলিলেন, “মহাশয়, এ পত্রখানি কা’র—চিনিতে পারেন কি?”
এই পত্রখানি অরিন্দম ফুলসাহেবের নিকটে পাইয়াছিলেন। সহসা সম্মুখে সর্প দেখিলে পথিক যেরূপ ভীতিব্যঞ্জক ভঙ্গী করিয়া পশ্চাতে হটিয়া যায়, পত্রখানি দেখিয়া গোপালচন্দ্রের অবস্থা অনেকটা সেই রকমেরই হইল। গোপালচন্দ্র গৰ্জ্জন করিয়া উঠিলেন; দৃঢ়স্বরে বলিলেন, “কখনই না-এ পত্র আমার নয়!”
অরিন্দম বলিলেন, “চুপ্ করুন, বেশী গোলমাল করিবেন না। এ পত্রখানি কি আপনার হাতের লেখা নয়? আর নীচে যে সহিটি রহিয়াছে দেখুন দেখি, এই সহিটি ঠিক আপনার কি না?”
গোপালচন্দ্র বলিলেন, “না, এ লেখা আমার হাতের নয়—এ সহিও আমার নয়।”
গোপালচন্দ্র ইতিপূর্ব্বে অরিন্দমকে যে চুক্তিনামা লিখিয়া দিয়াছিলেন, তিনি তখন সেই চুক্তিনামাখানি বাহির করিয়া বলিলেন, “এ লেখা ত আপনার? না, ইহাও আপনার লেখা নয়? দেখুন দেখি, আপনার হাতের লেখার সঙ্গে সহির সঙ্গে বেশ ক’রে সব মিলাইয়া দেখুন দেখি?”
তথাপি গোপালচন্দ্র সেইরূপভাবে বলিলেন, “জাল—জাল—এ পত্র জাল—আপনারা বড় ভয়ানক লোক!”
অরিন্দম মৃদুহাস্যে বলিলেন, “আপনার অপেক্ষা নয়।” তাহার পর গম্ভীর মুখে বলিলেন, “বিষয়ের লোভে পড়িয়া যে নিজের ভ্রাতুষ্পুত্রীকে হত্যা করিতে পারে, সে মনুষ্য-মূৰ্ত্তিতে দানব।”
যে-পত্র অবলম্বন করিয়া অরিন্দম গোপালচন্দ্রকে বন্দী করিলেন, সেই পত্র আমরা এখানে উদ্ধৃত করিলাম। পত্রখানি এইরূপ—
“কেশববাবু,
আজ দুইদিন গত হইল, তোমার কোন সংবাদ পাই নাই। সেজন্য অতিশয় উদ্বিগ্ন আছি, খুব সাবধান! যত শীঘ্র পার, রেবতী ও রোহিণীকে খুন করিবে। আমাকে খুনের কোন নিদর্শন পাঠাইলেই, আমি তখনই তোমার প্রাপ্য মিটাইয়া দিব। ইতি।
গোপালচন্দ্র বসু।”
আর দুইখানি—
“কেশববাবু,
গোরাচাঁদের মুখে যেরূপ শুনিলাম, তাহাতে বেশ বুঝা যায় তুমি আমাকে অবিশ্বাস করিতেছ। এখন আমি তোমাকে একটি পয়সা দিতে পারিব না—দিতে পারিব না কেন—দিব না—আগে কাজ শেষ হওয়া চাই। আমাকে তুমি সন্তুষ্ট করিতে পারিলে, তোমাকে যে টাকা পারিশ্রমিক স্বরূপ দিতে স্বীকৃত আছি, তাহা তৎক্ষণাৎ দিব;তা’ ছাড়া তোমাকে আরও কিছু পুরস্কার দিব। তুমি শীঘ্রই রেবতী ও রোহিণীকে খুন করিয়া যত শীঘ্র পার, গোরাচাঁদ মারফৎ প্রমাণ পাঠাইবে। তোমার এই অযথাবিলম্বে আমাকে সাতিশয় উৎকণ্ঠিত হইতে হইয়াছে। তুমি একজন পাকা কাজের লোক হয়ে কাজের কিছুই করিতে পারিতেছ না—বড়ই দুঃখের বিষয়। আশা করি, তুমি আগামী সপ্তাহের মধ্যে তোমার প্রাপ্য আমার নিকট হইতে আদায় লইবে। ইতি।
শ্রীগোপালচন্দ্ৰ বসু।”
“কেশববাবু,
তুমি অদ্যাবধি রেবতীর কিছুই করিলে না। পত্রপাঠ মাত্র রেবতীকে খুন করিবে এবং তাহার একটা প্রমাণ শীঘ্র পাঠাইবে। রোহিণীর লাস থানায় পাঠাইয়া যেমন বাহাদুরী দেখাইতে গিয়াছিলে, রেবতীর লাস লইয়া যেন সে-রকমের কোন একটা বাহাদুরী দেখাইতে যাইয়ো না। তাহাতে কোন প্রয়োজন নাই, বরং বিপদের সম্ভাবনা। রেবতীর লাস একেবারে গোপন করিয়া ফেলিবে। তুমি রোহিণীকে খুন করিয়া চুক্তির অর্দ্ধেক টাকা পাঠাইতে বলিয়াছ। রোহিণীকে খুন করায় আমার যদি কাজের অর্দ্ধেক সুবিধা হইত, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ তোমার অর্দ্ধেক টাকা পাঠাইতে পারিতাম। রোহিণীকে খুন করিয়া তুমি আমার কিছু সুবিধা করিতে পার নাই সুতরাং আমি তোমাকে এখন কিছুই দিব না। রোহিণীর অবর্তমানে রেবতীই সমস্ত বিষয়ের মালিক হইবে, ইহাতে রেবতীরই বরং সুবিধা হইয়াছে। আমার তাহাতে লাভ কি? রোহিণীর মৃত্যু সপ্রমাণ করিতে তুমি যে তাহার একখানা হাত পাঠাইয়াছিলে সেটা আমি আমাদের ভিতর-বাটীর বাগানে পুঁতিয়া ফেলিয়াছি। রোহিণীর ন্যায় রেবতীর একখানা হাত পাঠাইলে চলিবে না। রোহিণীর হাতে একস্থানে একটা দগ্ধ চিহ্ন ছিল বলিয়া সহজে চিনিতে পারিয়াছিলাম, রেবতীর ছিন্ন মস্তক পাঠাইবে। ইতি।
শ্রীগাপাল চন্দ্র বসু।
একান্ত যত্ন, আদর ও আগ্রহের সহিত শ্রীযুক্ত গোপালচন্দ্ৰকে আপাততঃ স্থানীয় থানায় চালান দেওয়া হইল।
অধর্ম্মের পরিণাম এইরূপই শোচনীয় হয়।
চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – তুমি কি সেই?
বেণীমাধবপুরের গোলযোগ মিটাইয়া অরিন্দম দেবেন্দ্রবিজয়কে লইয়া রঘুনাথপুরে আসিলেন। রঘুনাথপুর অরিন্দমের স্বদেশ। বেণীমাধবপুর হইতে হুগলী জেলায় ফিরিতে হইলে রঘুনাথপুরের নিকট দিয়াই আসিতে হয়। রঘুনাথপুরের মধ্যে অরিন্দম সর্ব্বাপেক্ষা সমৃদ্ধি সম্পন্ন। সেখানে তাঁহার যথেষ্ট ভূসম্পত্তিও আছে। তা’ ছাড়া তাঁহার বসত বাড়ীখানিও প্রকাণ্ড। তেমন প্রকাণ্ড দ্বিতল অট্টালিকা সে গ্রামের মধ্যে আর একখানিও নাই। বাটীর পশ্চাদ্ভাগে লতাকুঞ্জবিশোভিত সুরম্য উদ্যান। উদ্যানে মৎস্যসঙ্কুল, স্বচ্ছবারিপূর্ণ সুবৃহৎ সরোবর। মোট কথা, এক সমৃদ্ধিসম্পন্নের যাহা কিছু আবশ্যক, অরিন্দমের তাহা সকলই ছিল।
দেবেন্দ্রবিজয় সেইখানে দুইদিন কাটাইলেন। খাওয়া-দাওয়ার ধূমটা রীতিমতই চলিল। চোর ডাকাত ধরার ন্যায় অরিন্দমের মাছ-ধরার সখ অত্যন্ত প্রবল ছিল। তিনি প্রত্যহ প্রাতে ছিপ্ লইয়া বসিয়া মৎস্যকুল ধ্বংস করিতেন।
একদিন পূর্বাহ্ণে নয়—অপরাহ্ণে অরিন্দম দেবেন্দ্রবিজয়কে বলিলেন, “তুমি যেকালে দুইদিনেই বাড়ী যাইবার জন্য এত উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিয়াছ, তখন কাল প্রতুষেই রওনা করা যাইবে। তাহা হইলে আজ রাত্রের ভোজনের বন্দোবস্তটা পরিপাটি রকমের হওয়াই আবশ্যক। যেমন করিয়া হ’ক্, আজ খুব কম করিয়া চার-পাঁচটি বড় মাছ ধরা চাই। ছিপ্ লইয়া তুমি বাগানে যাও, চার ফেলিয়া ঠিকঠাক্ হইয়া ব’স—আমি এখনই যাইতেছি।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আজ আর থাক্ না।”
অরিন্দম বলিলেন, “সে কি হয়, কাল যখন প্রাতে একান্তই রওনা হইতে হইবে, তখন আর না ধরিলে চলিবে কেন? তুমি যাও, আমি এখনই যাইতেছি।”
দেবেন্দ্রবিজয় মৎস্য ধরিবার উপকরণাদি লইয়া প্রস্থান করিলেন। ইহাতে অরিন্দমের একটা উদ্দেশ্য আছে।
****
উদ্যানের ছায়াস্নিগ্ধ স্বচ্ছ সরোবর পত্রান্তরালচ্যুত সূর্য্যরশ্মিপাতে তক্ তক্ করিতেছে। বায়ুহিল্লোল- বিচলিত বীচিমালা হইতে অনুক্ষণ রবিকিরণ সহস্র-খণ্ডে প্রতিফলিত হইতেছে। এবং সদ্যঃপ্রস্ফুটিত পুষ্পের সৌরভে সমুদয় উদ্যান ভরিয়া গিয়াছে।
দেবেন্দ্রবিজয় ধীরপদবিক্ষেপে ঘাটের নিকটে গিয়া দেখিলেন, স্বচ্ছ কম্পিত জলে পা দুইখানি ডুবাইয়া নিম্নের মগ্নপ্রায় সোপানের উপরে বসিয়া এক অন্দ্যিসুন্দরী নবীনা অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া ছিল, অদূরস্থিত এক আমগাছের ছায়াচ্ছন্ন নিভৃত শাখায় বসিয়া যে একটা সুকণ্ঠ পাপিয়া তাহার বিরহাকুল অশ্রান্ত বেদনা-গীতিতে উদ্যান প্লাবিত করিতেছিল, তাহার নিরলস দৃষ্টি, সেই ঝঙ্কৃত পাপিয়ার প্রতি সংস্থাপিত ছিল, সুতরাং সে দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিতে পায় নাই।
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, সেই মূৰ্ত্তিমতী সৌন্দর্য্য রাণীর মেঘের মত নিবিড়, শৈবালের ন্যায় তরঙ্গায়িত, এবং ভ্রমরের ন্যায় কৃষ্ণ, বিমুক্ত কেশদাম গুচ্ছে গুচ্ছে পৃষ্টদেশ ব্যাপিয়া লুণ্ঠিত এবং জলসিক্ত হইতেছে। সেইরূপভাবে সেখানে দাঁড়াইয়া থাকা একান্ত গর্হিত মনে করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় যেমন পশ্চাতে ফিরিবেন, একখণ্ড শুষ্কপত্রের উপরে তাঁহার পাদক্ষেপ হওয়ায় একটা শব্দ হইল। নবীনা তাড়াতাড়ি সেইদিকে চাহিয়া দেখিল। দেখিল—দেখিয়া মুখ দিয়া তাহার কথা সরিল না। তাহার ভাব দেখিয়া এমন বোধ হইল, সে উঠিবে—ডুবিবে—কি পলাইবে, কিছুই ঠিক করিতে পারিতেছে না।
দেবেন্দ্রবিজয়ও সেই নিরুপমার মুখের দিকে চাহিয়া মুগ্ধ, বিস্মিত, বিহ্বল এবং স্তম্ভিত। বিস্ময়াকুল দেবেন্দ্রবিজয় ব্যাকুলকণ্ঠে তাহাকে বলিলেন, “তুমি—তুমি এখানে!”
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – পরিশিষ্ট
ঠিক সেই সময়ে সেখানে অরিন্দম আসিয়া উপস্থিত। বোধ হয়, তিনি এতক্ষণ অন্তরালে দাঁড়াইয়া ছিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া সেই নবীনা দ্রুতপদে সোপানারোহণ করিয়া সলজ্জবাবে চলিয়া গেল, এবং দেবেন্দ্রবিজয় একান্ত অপ্রতিভের ন্যায় এদিক্-ওদিক্ চাহিতে লাগিল। অরিন্দমের মুখের দিকে চাহিতে আর তাঁহার সাহস হয় না।
অরিন্দম তাহা লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “চল, এখন আর মাছ ধরা হইবে না—এখনই পাড়ার মেয়েরা এ-ঘাটে আসিবে—সন্ধ্যার পর যাহা হয় হইবে।”
দেবেন্দ্রবিজয়ের মনে দারুণ উৎকণ্ঠা। তিনি অরিন্দমকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “যে এখন চলিয়া গেল, উহাকে আপনি জানেন্ কি?”
অরিন্দম বলিলেন, “কেন বল দেখি?”
দেবেন্দ্রবিজয় চুপ করিয়া রহিলেন।
অরিন্দম বলিলেন, “ঘাটে পাড়ার কত মেয়ে আসে, আমি তাহাদের কেমন করিয়া চিনিব? তবে আমাদের বাড়ীর স্ত্রীলোকেরা কাহাকে-কাহাকেও চিনিতে পারে।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমি যাহাকে এখানে দেখিলাম, সে ঠিক রেবতীর মত দেখিতে—সে রেবতী।”
অরিন্দম উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন, বলিলেন, “বটে! তাহাকে তাহার নাম জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “নাম জিজ্ঞাসা করিবার আবশ্যকতা নাই। আমি ঠিক চিনিয়াছি—সে রেবতী। সেই মুখ, সেই চোখ, সেই ভাব, সেই সব—আমার কখনও ভুল হয় নাই।”
অরিন্দম সহাস্যে বলিলেন, নিজের ভুল নিজে কেহই দেখিতে পায় না। বিশেষতঃ এ সব বিষয়ে ভুল হওয়া বড়ই দোষের কথা। যাই হ’ক্, তোমাকে কোথায় মাছ ধরিতে এখানে পাঠাইলাম, আর তুমি কিনা একেবারে একটা আস্ত মেয়েমানুষ গাঁথিয়া ফেলিয়াছ—বাহাদুরী আছে বটে।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনি সকলই জানেন—আপনি আমার নিকটে গোপন করিতেছেন। আমি এখন যাহাকে দেখিলাম, বলুন, সে রেবতী কি না?”
অরিন্দম বলিলেন, “রেবতী! আমি তোমার নিকটে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছিলাম, যেমন করিয়া পারি, রেবতীর সন্ধান করিয়া দিব;কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞার পূর্ব্বেই আমি রেবতীকে উদ্ধার করিয়াছিলাম, একজন পুলিসের লোককে রেবতীর মাতামহ সাজাইয়া রেবতীকে অর্থপিশাচ যদুনাথের হাত হইতে বাহির করিয়া আনি। তাহার পর রেবতীকে আমি এখানে পাঠাইয়া দিই। সেই অবধি রেবতী এখানে আমাদের বাড়ীতেই আছে। প্রত্যহ রেবতী এই সময়ে বাগানে একা আসিয়া থাকে। তাহার সহিত দেখা হইবে বলিয়াই আমি তোমাকে মাছ ধরিবার ছলে বাগানে পাঠাইয়া দিই। তুমি এখন রেবতীকে স্বচক্ষে দেখিয়াছ—আর ত সন্দেহের কোন কারণ নাই?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “যেদিন ফুলসাহেব ধরা পড়ে, সেইদিন আপনি রেবতীকে খুন না করিবার কারণ তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় ফুলসাহেব আপনাকে বলিয়াছিল, “আপনি তাহার মুখের অন্ন কাড়িয়া লইয়াছেন।’ তখনই একবার আমার মনে সন্দেহ হইয়াছিল যে, রেবতীকে আপনি কোন নিরাপদ স্থানে লুকাইয়া রাখিয়াছেন।”
অরিন্দম বলিলেন, “যাই হ’ক্ রেবতীর নিকটে এখন তাহার ভগিনীর খুনের কথা প্রকাশ করিবার আবশ্যকতা নাই। যতদিন গোপন থাকে, ভাল। রেবতীর মনের অবস্থা এখন ভাল নহে, বড় ভয়ানক এবং দুশ্চিন্তায় শরীরও একান্ত দুর্ব্বল; এসময়ে কোন একটা শোকের আঘাত লাগিলে হয় ত তাহার ফল পরে শোচনীয় হইতে পারে। বিশেষতঃ রেবতী—রোহিণী-অন্ত-প্রাণ। তাহার কাকার সম্বন্ধেও এখন তাহাকে কোন কথা না বলাই ভাল। আর একটা কথা হইতেছে, দেবেন্দ্রবাবু! রেবতীর বিবাহে আমিই কন্যাকর্তা হইবার আশা রাখি।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “সেটা আপনার অনুগ্রহ।”
উপসংহার
একটা শুভদিন স্থির করিয়া অরিন্দম কোমর বাঁধিয়া রেবতীর বিবাহে উদ্যোগী হইলেন। তিনি ভবানীপুর হইতে দেবেন্দ্রবিজয়ের পিতাকে আনাইলেন।
দেবেন্দ্রবিজয়ের মাতুল মহাশয় বেণীমাধবপুরেই ছিলেন। বেণীমাধবপুরেই দেবেন্দ্রবিজয়ের সহিত রেবতীর শুভলগ্নে শুভবিবাহ সম্পন্ন হইল।
দেবেন্দ্রবিজয়ের বিবাহ এবং নিজে অরিন্দম সে বিবাহে উদ্যোগী। নিমন্ত্রিত সিরাজউদ্দীন দেবেন্দ্রবিজয়কে, কুলসম রেবতীকে এক-একটি মূল্যবান্ হীরকাঙ্গুরী যৌতুক দিয়াছিলেন। গোপালচন্দ্র এবং ধৃত গোরাচাঁদ ও দুস্যরা আইনানুসারে যথোপযুক্ত দণ্ড পাইল। আপাততঃ জুমেলিয়ার কোন সন্ধান হইল না।