পঞ্চম আপত্তি।
কেহ কেহ আপত্তি করিতেছেন, বহুবিবাহপ্রথা নিবারিত হইলে, কায়স্থজাতির আদ্যরসের ব্যাঘাত ঘটিবেক। এই আপত্তি অতি দুর্বল ও অকিঞ্চিৎকর। আদ্যরস না হইলে, কায়স্থদিগের জাতিপাত ও ধর্ম্মলোপ হয় না, এবং বিবাহবিষয়েও কোনও অসুবিধা ঘটে না।
কায়স্থজাতি দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। প্রথম কুলীন, দ্বিতীয় মৌলিক। ঘোষ, বসু, মিত্র এই তিন ঘর কুলীন কায়স্থ। মৌলিক দ্বিবিধ, সিদ্ধ ও সাধ্য। দে, দত্ত, কর, সিংহ, সেন, দাস, গুহ, পালিত এই আট ঘর সিদ্ধ মৌলিক। আর সোম, রুদ্র, পাল, নাগ, ভঞ্জ, বিষ্ণু, ভদ্র, রাহা, কুণ্ড, সুর, চন্দ্র, নন্দী, শীল, নাথ, রক্ষিত, আইচ, প্রভৃতি যে বায়ত্তর ঘর কায়স্থ আছেন, তাঁহারা সাধ্য মৌলিক। সাধ্য মৌলিকেরা মাদাবিষয়ে সিদ্ধ মৌলিক অপেক্ষা নিকৃষ্ট। সিদ্ধ মৌলিকেরা সম্মৌলিক, সাধ্য মৌলিকের বায়ত্তরিয়া, বলিয়া সচরাচর উল্লিখিত হইয়া থাকেন।
কায়স্থজাতির বিবাহের স্থূল ব্যবস্থা এই, —কুলীনের জ্যেষ্ঠ পুত্রকে কুলীনকন্যা বিবাহ করিতে হয়; মৌলিককন্যা বিবাহ করিলে, তাহার কুলভ্রংশ ঘটে। কিন্তু প্রথম কুলীনকন্যা বিবাহ করিয়া, মৌলিককন্যা বিবাহ করিলে, কুলের কোনও ব্যাঘাত ঘটে না। কুলীনের অপর পুত্রের মৌলিককন্যা বিবাহ করিতে পারেন, এবং সচরাচর তাহাই করিয়া থাকেন। মৌলিকমাত্রের কুলীনপাত্রে কন্যাদান ও কুলীন- কন্যা বিবাহ করা আবশ্যক। মৌলিকে মৌলিকে আদানপ্রদান হইলে, জাতিপাত ও ধর্ম্মলোপ হয় না; কিন্তু, তাদৃশ আদানপ্রদান কারীদিগকে কায়স্থসমাজে কিছু হেয় হইতে হয়। ৬০।৭০ বৎসর পূর্ব্বে, মৌলিকে মৌলিকে বিবাহ নিতান্ত বিরল ছিল না, এবং নিতান্ত দোষাবহ বলিয়াও পরিগৃহীত হইত না।
মৌলিকেরা কুলীনের দ্বিতীয় পুত্র প্রভৃতিকে কন্যাদান করিয়া থাকেন। কিন্তু, কতিপয় মৌলিকপরিবারের সঙ্কল্প এই, কুলীনের জ্যেষ্ঠ পুত্রকে কন্যাদান করিডে হইবেক। কুলীনের জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রথমে মৌলিককন্যা বিবাহ করিতে পারেন না। কুলীনকন্যা বিবাহ দ্বারা যাঁহার কুলরক্ষা হইয়াছে, মৌলিক কায়স্থ, অনেক যত্ন ও অর্থব্যয় করিয়া তাঁহাকে কন্যা দান করেন। কুলীনের জ্যেষ্ঠ পুত্র এইরূপে মৌলিকগৃহে যে দ্বিতীয় সংসার করেন, তাহার নাম আদ্যরস; আর, যে সকল মৌলিকের গৃহে এইরূপ বিবাহ হয়, তাহাদিগকে আদ্যরসের ঘর বলে।
মৌলিকেরা, আদ্যরস করিয়া, অনেক যত্নে জামাতাকে গৃহে রাখেন। তাহার কারণ এই বোধ হয়, কুলীনের জ্যেষ্ঠ সন্তান পিতৃমর্য্যাদা প্রাপ্ত হন। আদ্যরসপ্রিয় মৌলিকদিগের উদ্দেশ্য এই, তাঁহাদের দৌহিত্র সেই মর্য্যাদার ভাজন হইবেন। কিন্তু, যে ব্যক্তির দুই সংসার, তাহার কোন্ স্ত্রী প্রথম পুত্রবতী হইবেক, তাহার স্থিরতা নাই। পূর্ব্ব- পরিণীতা কুলীনকন্যার অগ্রে পুত্র জম্মিলে, আদ্যরসের উদ্দেশ্য বিফল হইয়া যায়। জামাতাকে পুর্ব্বপরিণীতা কুলীনকন্যার নিকটে যাইতে দেওয়া, সেই উদ্দেশ্যসাধনের প্রধান উপায়। এজন্য, জামাতাকে সন্তুষ্ট করিয়া গৃহে রাখা নিতান্ত আবশ্যক হইয়া উঠে। তাদৃশ স্থলে, পূর্ব্বপরিণীতা কুলীনকন্যা স্বামীর মুখ দেখিতে পান না। বস্তুতঃ, তাদৃশী কুলীনকন্যাকে, নামমাত্রে বিবাহিতা হইয়া, বিধবা কন্যার ন্যায়, পিত্রালয়ে কালযাপন করিতে হয়। কুলীন জামাতাকে বশে রাখা বিলক্ষণ ব্যয়সাধ্য; এজন্য, যে সকল আদ্যরসকারী মৌলিকের অবস্থা ক্ষুণ্ণ হইয়াছে, তাঁহারা তদ্বিষয়ে কৃতকার্য্য হইতে পারেন না; সুতরাং আদ্যরসের মুখ্যফললাভ তাঁহাদের ভাগ্যে ঘটিয়া উঠে না। ঈদৃশ স্থলে, কুলীনের জ্যেষ্ঠ পুত্র কুলীনকন্যা ও মৌলিককন্যা উভয়কে লইয়া সংসারযাত্রা নির্বাহ করেন।
পূর্ব্বে উল্লিখিত হইয়াছে, আদ্যৱস না করিলে, মোলিকের জাতি- পাত ও ধর্ম্মলোপ হয় না, এবং বিবাহবিষয়েও কিছুমাত্র অসুবিধা ঘটে না। কুলীনের মধ্যম প্রভৃতি পুত্রকে কন্যাদান করিলেই মৌলিকের সকল দিক রক্ষা হয়। এজন্য, প্রায় সকল মৌলিকেই তাদৃশ পাত্রে কন্যাদান করিয়া থাকেন। আমি কুলীনের জ্যেষ্ঠ পুত্রকে কন্যাদান করিয়াছি, নিরবচ্ছিন্ন এই অভিমানসুখলাভের বশবর্ত্তী হইয়া, কেবল কতিপয় মৌলিকপরিবার আদ্যরস করেন। কিন্তু, তুচ্ছ অভিমানসুখের জন্য, পূর্ব্বপরিণীতা নিরপরাধা কুলীনকন্যার সর্ব্বনাশ করিতেছেন, ক্ষণকালের জন্যেও সে বিবেচনা করেন না। যে দেশে আপন কন্যার হিতাহিত বিবেচনার পদ্ধতি নাই, সে দেশে পরের কন্যার হিতাহিত বিবেচনা সুদূরপরাহত।
সে সকল আদ্যরসপ্রিয় পরিবার নিঃস্ব হইয়াছেন, এবং অর্থ ব্যয় করিয়া, প্রকৃতপ্রস্তাবে, আদ্যরস করিতে সমর্থ নহেন; আদ্যরস অশেষপ্রকারে, তাঁহাদের পক্ষে, বিলক্ষণ বিপদের স্বরূপ হইয়া উঠিয়াছে। তাঁহাদের আন্তরিক, ইচ্ছা এই, আদ্যরসপ্রথা এই দণ্ডে রহিত হইয়া যায়। রাজশাসন দ্বারা এই কুৎসিত প্রথার উচ্ছেদ হইলে, তাঁহারা পরিত্রাণ বোধ করেন; কিন্তু, স্বয়ং সাহস করিয়া পথপ্রদর্শনে প্রবৃত্ত হইতে পারেন না। যদি তাঁহারা, আদ্যরসে বিসর্জ্জন দিয়া, কুলীনের দ্বিতীয় প্রভৃতি পুত্রে কন্যাদান করিতে আরম্ভ করেন, তাঁহাদের জাতিপাত বা ধর্ম্মলোপ হইবে না। তবে, আদ্যরস করিল না, অথবা করিতে পারিল না, এই বলিয়া, প্রতিবেশীরা তাঁহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া, নিন্দা ও উপহাস করিবেন। কেবল এই নিন্দা ও এই উপহাসের ভয়ে, তাহারা আদ্যরস হইতে বিরত হইতে পারিতেছেন না। স্পষ্ট কথা বলিতে হইলে, আমাদের দেশের লোক বড় নির্ব্বোধ, বড় কাপুরুষ।
রাজশাসন দ্বারা বহুবিবাহপ্রধা নিবারিত হইলে, আদ্যরসের ব্যাঘাত ঘটিবেক, সন্দেহ নাই। কিন্তু, তদ্দ্বারা কতিপয় মৌলিক পরিবারের তুচ্ছ অভিমানসুখের ব্যাঘাত ভিন্ন, কায়স্থজাতির কোনও অংশে কোনও অসুবিধা বা অপকার ঘটিবে, তাহার কোনও সম্ভাবনা লক্ষিত বা অনুমেয় হইতেছে না। আদ্যরস, কায়স্থজাতির পক্ষে, অপরিহার্য্য ব্যবহার নহে। এই ব্যবহার অনেক অংশে অনিষ্টকর ও অধর্ম্মকর, তাহার সন্দেহ নাই। যখন, এই ব্যবহার রহিত হইলে, কায়স্থজাতির অহিত, অধর্ম্ম, বা অন্যবিধ অসুবিধা ও অপকার ঘটিতেছে না, তখন উহা বহুবিবাহনিবারণের আপত্তিস্বরূপে উত্থাপিত বা পরিগৃহীত হওয়া কোনও মতে উচিত বা ন্যায়ানুগত নহে। আর, যদি রাজনিয়ম দ্বারা, বা অন্যবিধ কারণে, অকারণে একাধিক বিবাহ করিবার প্রথা রহিত হইয়া যায়, তাহা হইলেও আদ্যরসের এককালে উচ্ছেদ হইতেছে না। কুলীনের যে সকল জ্যেষ্ঠ সন্তানের স্ত্রীৰিয়োগ ঘটিবেক, তাঁহারা আদ্যরসের ঘরে দারপরিগ্রহ করিতে পারিবেন। যাহা হউক, এই আদ্যরসের ব্যাঘাত ঘটিবেক, অতএব বহুবিবাহপ্রথা নিবারিত হওয়া উচিত নহে, ঈদৃশ আপত্তি উথাপন করা কেবল আপনাকে উপহাসাস্পদ করা মাত্র।