পঞ্চম অধ্যায় – পার্বত্য চট্টগ্রামের বিবরণ
কাপ্তান লেউইন পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী মানবদিগকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছেন। যথা— “খউংতা (নদীবংশজ) ও তউংতা (পার্বত্য বংশজ)। আমরা খউংতাগণকে মগ বংশজ ও তউংতাদিগকে কিরাতবংশজ বলিতে পারি। তউংতাগণ এই পার্বত্য প্রদেশের প্রাচীন অধিবাসী। তউংতাদিগের মধ্যে রিয়াংগণ বিশেষ পরাক্রমশালী ছিল। এজন্যই পূর্বকালে ইহাকে রিয়াং রাজ্য বলা হইত। তৎপরে আরাকানবাসী খউংতাগণ এই প্রদেশে প্রবেশ করত তউঃতাদিগকে নির্যাতন ও উত্তরবাহিনী করিয়াছিল। অধুনা খউংতা এবং তউংতা বংশীয়গণ ভিন্ন ভিন্ন সরদারের অধীনে বাস করিতেছে। তউংতা বংশের একটি শাখা “চাকমা” নামে পরিচিত। চাকমা সরদারগণ প্রথমত ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে কার্পাসকর দান করিত। ১৬৯৯ শকাব্দে চাকমারাজ শ্রীদৌলত খাঁ কোম্পানির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। ১৩০০ শকাব্দে তাঁহার উত্তরাধিকারী রাজা জানবক্স খাঁ ॥৩৩৩। বার্ষিক পাঁচশত মণ কার্পাসের পরিবর্ত্তে মুদ্রা কর দান করেন। এইরূপ সামান্য কর প্রাপ্ত হইয়া গবর্ণমেন্ট দীর্ঘকাল পার্বত্য প্রদেশে পূর্ণ রাজশক্তি পরিচালন করিতে বিরত ছিলেন। তৎপরে কুকিদিগের অত্যাচারে বাধ্য হইয়া ১৭৮২ শকাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টি করেন। তদবধি ক্রমে ক্রম চাকমা সরদারদিগের রাজশক্তি হরণ পূর্বক তাহাদিগকে সাধারণ জমিদার শ্রেণীতে সন্নিবিষ্ট করিয়াছেন। যদিচ গবর্ণমেন্ট পর্বতবাসী মানবদিগকে শাসনযন্ত্রের মধ্যে নিক্ষেপ করিয়া নিষ্পেষিত করিতেছেন; তথাপি তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে বশীভূত করিতে পারেন নাই। পর্বতবাসীদিগকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা যাইতে পারে।
১। যাহারা গবর্ণমেন্টকে নিয়মিতরূপে কর প্রদান করিয়া থাকে তাহারাই প্ৰথম শ্রেণীর অন্তর্গত। যথা, (ক) ত্রিপুরা বা মুরং, (খ) কুইম, (গ) মুরু, (ঘ) খেয়াং জাতি।
২। যাহারা গবর্ণমেন্টের অধীনতা স্বীকার করে, কিন্তু কোন প্রকার কর দান করে না তাহারাই দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্গত। যথা, (ক) বঞ্জুগী,[১] (খ) পঙ্গুজাতি[২]।
৩। স্বাধীন জাতি সমূহ, কর প্রদান দূরে থাকুক, ইহারা গবর্ণমেন্টের মৌখিক বশ্যতাও স্বীকার করে না। যথা কুকি (লুছাই) এবং সিন্ধু। কুকি বা লুছাইদিগের বিবরণ বিশেষ ॥৩৩৪॥ ভাবে পরবর্ত্তী অধ্যায়ে লিখিত হইবে। সিন্ধুজাতি প্রধানত নীল পর্বতের পূর্বদিকে বাস করে। বোধ হয় প্রাচীনকালে ইহারা আরাকানের মগরাজার দণ্ডাধীন ছিল। ইহারা একটি পরাক্রশালী জাতি। আরাকাণ রাজ্য ব্রহ্মরাজের কুক্ষিগত হইলে যে রাষ্ট্রবিপ্লব উপস্থিত হয়, সম্ভবত তদ্বারা ইহারা ইহাদের পিতৃভূমি পরিত্যাগপূর্বক উত্তর বাহিনী হইয়াছিল। কুকি অধ্যায়ে ইহাদিগের বিবরণ সংক্ষিপ্তভাবে লিখিত হইবে।
প্রথম শ্রেণীর জাতি সমূহকে প্রধানত চারিটি শাখায় বিভক্ত করা হইয়াছে। একটি শাখার অনেকগুলি প্রশাখা আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী এক ত্রিপুরাজাতিই পাঁচটি প্রশাখায় বিভক্ত। যথা—পুরান, নোয়াতিয়া, ওস্মি, রিয়াং, এবং মুরুং। প্রথমোক্ত চারিটি প্রশাখার বিবরণ প্রথম ভাগে সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। এস্থলে কেবল মুরুংদিগের কথা লিখিত হইল। আরাকানবাসীগণ সমগ্র ত্রিপুরাজাতিকে মুরুং আখ্যায় আখ্যাত করিয়া থাকে। কর্ণেল ফেয়ার মুরুংদিগের সম্বন্ধে লিখিয়াছেন যে “আরাকানের জনৈক প্রাচীন নরপতি রাজ্য জয় করিয়া কতকগুলি ত্রিপুরাকে বন্দিস্বরূপ স্বরাজ্যে লইয়া যান। আধুনিক মুরুংগণ সেই সকল বন্দি ত্রিপুরার সন্তান সন্ততি। ইহারা প্রথমত আরাকান জেলার অন্ত গত লেমোই নদী তীরে বাস করিত, কিন্তু ইহারা সেই ॥৩৩৫॥ স্থান পরিত্যাগ করিয়া ক্রমে উত্তর দিকে অগ্রসর হইতেছে।” মাতৃভূমির আকর্ষণ এমনই বটে। মুরুগণ অধুনা প্রধানত মাতামুড়ি নদীর তীরে বাস করিয়াছে।[৩]
কুইমি ও মুরুজাতি আরাকানের মগ বংশজাত। খেয়াং, ব্রহ্মদেশের পশ্চিম প্রান্তে পরাক্রমশালী খেয়াং জাতি বাস করে। ইহারা সম্পূর্ণ স্বাধীন। স্বাধীন খেয়াংবংশসম্ভূত কতকগুলি লোক চট্টগ্রামের পার্বত্য প্রদেশে বাস করিয়াছে। ইহাদের সংখ্যা নিতান্ত অল্প।
বঞ্জুরী ও পংখুজাতি এক মূল হইতে উৎপন্ন। ইহারা প্রাচীনকালে কুকি প্রদেশে বাস করিতেছিল। বোধহয় কুকিদিগের উৎপীড়নে ইহারা দক্ষিণবাহিনী হইয়াছে। তাহারা বলে “তলন্দরোক–পা” নামক জনৈক পরাক্রান্ত সরদার তাহাদের আদি পিতা। ইনি ঈশ্বরের কন্যা বিবাহ করেন। তাহাদের দুই পুত্র হইতে উল্লিখিত জাতিদ্বয়ের উৎপত্তি ॥৩৩৬
তাহাদের মতে দুইটি দেবতা আছেন, একজনের নাম “পতৈন”। ইনিই জগৎ সৃষ্টি করিয়াছিলেন। ইনি পশ্চিমদিকে বাস করেন। রজনীতে দিবাকর তাঁহার আশ্রমে যাইয়া বিশ্রাম করিয়া থাকেন। দ্বিতীয় দেবতার নাম “খোজিং”। ব্যাঘ্রজাতি খোজিংদেবের পালিত কুকুর। এজন্যই ব্যাঘ্রজাতি তাহাদের প্রভু সন্তান (বঞ্জুগী ও পংখ) বর্গের কোন অনিষ্ট কামনা করে না। এই দুই জাতির বিশ্বাস অনুসারে মনুষ্যগণ মৃত্যুর পর একটি বৃহৎ পর্বতে গমন করেন। সেই বৃহৎ পর্বতই মানবজাতির সূতিকা গৃহ
বিবাহের পূর্বে বঞ্জুগী ও পংখুজাতি স্ত্রী পুরুষগণ নিতান্ত স্বেচ্ছাবিহার করিয়া থাকে। বিবাহের পর কোন রমণী পরপুরুষ উপগত হইলে, তাহার কর্ণ ছেদন করিয়া দেওয়া হয়, কিন্তু পরপত্নীগামী পুরুষের কোনরূপ দণ্ড হয় না। আচার ব্যবহার দ্বারা এই দুইটি জাতি কুকিদিগের নিকট সম্পর্কিত বলিয়া বোধ হয়। বঞ্জুগী পংখূজাতির লোক সংখ্যা বোধ হয় ৩/৪ সহস্রের অধিক হইবে না। তউংতা অর্থাৎ কিরাতবংশের ইতিহাস বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করাই আমাদের প্রধান অভিপ্ৰায়। ॥৩৩৭॥ সুতরাং খউংতাদিগের সম্বন্ধে বিশেষভাবে কিছুই লিখিত হইল না। আমাদের বিবেচনায় বঞ্জুগী ও পংখূজাতির তউংতা বংশসম্ভূত। পরবর্ত্তী অধ্যায়ে তউংতা বংশের প্রধান শাখা কুকিদিগের বিবরণ লিখিত হইবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত প্রদেশে সিন্ধু নামক একটি পরাক্রমশালী জাতি বাস করে। তাহাদের সহিত এই গ্রন্থের বিশেষ কোনোরূপ সংশ্রব নাই।
আমাদের গবর্ণমেন্ট ক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমারেখা প্রসারিত করিতেছেন, তদনুসারে এই জেলার আধুনিক পরিমাণ ৬ সহস্র বর্গমাইল হইতে অধিক লিখিত হইতেছে। ॥৩৩৮॥
.
টীকা
১-২. বঞ্জোগী ও পঙ্খো উপজাতি একই মূলোদ্ভুত। ভাষা, সামাজিক রীতি, অভ্যাস ইত্যাদিতে উভয়ের মধ্যে গভীর সাদৃশ্য দেখা যায়। তাহাদের ভাষা ও চেহারার সহিত কুকিদের সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। যদিও এই দুই উপজাতি গোষ্ঠী নিজেদের ব্রহ্মদেশের ‘শান’ জাতি গোষ্ঠী শাখা বলিয়াই মনে করে (W. W. Hunter, A Statistical Account of Bengal Vol. VI P. 57 )। বঙ্গোগী এবং পঙ্খো গোষ্ঠী যথাক্রমে তিন (দোই, তলাং, সুংফ্লা) দুই (পাত্মো ও বনজাং) উপশাখায় বিভক্ত। ইহারা তউংতা বংশজ।
৩. কর্ণেল কেয়ার মুরুংদিগের ইতিহাস তাহাদিগের নিকট যেরূপ শ্ৰুত হইয়াছিলেন তাহাই লিপিবদ্ধ করিয়া বলিয়াছেন, “আমি পরিশিষ্টে মুরুং ভাষায় কয়েকটি শব্দ লিখিয়া দিলাম। যাহারা ত্রিপুরা ভাষা অবগত আছেন, তাঁহারা ইহার পরীক্ষা করিয়া বুঝিতে পারিবেন যে, মুরুংদিগের কথিত, তাহাদের উৎপত্তি বৃত্তান্ত সত্য কিনা” (those acquainted with the lan – guage of the Tipperah tribes will be able to beside whether the tale the Mroongs tell of their beseent is correct or not.) ।