রাজমালা - প্ৰথম ভাগ - উপক্রমণিকা
রাজমালা - দ্বিতীয় ভাগ
রাজমালা - তৃতীয় ভাগ
রাজমালা চতুৰ্থ ভাগ

পঞ্চম অধ্যায় – জেলা ত্রিপুরা (পূর্বের অনুবৃত্তি)

পঞ্চম অধ্যায় – জেলা ত্রিপুরা (পূর্বের অনুবৃত্তি)

ত্রিপুরা জেলা অধুনা তিনটি উপবিভাগে বিভক্ত, যথা-সদর (কুমিল্লা), ব্রাহ্মণবাড়ীয়া এবং চাঁদপুর। সম্ভবত ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া সদর হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছিল। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের চাঁদপুর উপবিভাগ গঠিত হইয়াছে।

সদর মহকুমা ৬টি থানার বিভক্ত যথা- কতোয়ালী, চাঁদিনা, মুরাদনগর, দাউদকান্দি, লাকসাম ও চৌদ্দগ্রাম। সদর মহকুমার লোক সংখ্যা ৮২১২৮৫ জন নির্ণীত হইয়াছে।

ব্রাহ্মণবাড়ীয়া মহকুমা তিনটি থানা ও দুইটি ফাঁড়িতে (আউটপোষ্ট) বিভক্ত, যথা- ব্রাহ্মণবাড়ীয়া ও ফাঁড়ি নাছিরনগর; কসবা এবং নবিনগর ও ফাঁড়ি বাঞ্ছারামপুর। এই মহকুমার লোক সংখ্যা ৫৯০০৯৭ জন নির্নীত হইয়াছে।৫০৯॥

চাঁদপুর মহকুমা তিনটি থানায় বিভক্ত, যথা-চাঁদপুর মতলব, এবং হাজিগঞ্জ। এই মহকুমার লোক সংখ্যা ৩৭১৫৫৩ নির্ণীত হইয়াছে।

ত্রিপুরা জেলা নিম্নলিখিত পরগনা ও মহলে বিভক্ত, কতকগুলি পরগণার ক্ষুদ্র বা বৃহৎ অংশ নওয়াখালী, ঢাকা, ও ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্ভূক্ত রহিয়াছে। কতকগুলি পরগণা সম্পূর্ণরূপে এই জেলা হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া অন্য জেলাভুক্ত হইয়াছে। কোন পরগনা বা তাহার ভগ্নাংশের রাজস্ব অন্য জেলার ধনাগারে অর্পিত। কিন্তু দেওয়ানী ও ফৌজদারি বিচার সম্বন্ধে তাহা এই জেলার অধীন, যথা- কাদবা, রুক্ষ্মণপুর প্রভৃতি। শ্রীহট্টের দক্ষিণাংশ সম্পূর্ণরূপে ত্রিপুরা হইতে গৃহীত। মুসলমানগণ দ্বারা ইহার সূত্রপাত হয়। অল্পকাল গত হইল ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণ মন্তলা পরগণাটি শ্রীহট্ট জেলার অন্তর্ভূক্ত করিয়া লইয়াছেন[১]।॥৫১০

গবর্ণমেন্টের খাসমহল ব্যতীত জেলা ত্রিপুরার ভূমিকে শ্রেষ্ঠ, মধ্য, অধীন এই তিন স্বত্বে বিভক্ত করা যাইতে পারে। তাহার এক একটি স্বত্ব অনেকগুলি শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হইয়াছে।

শ্ৰেষ্ঠ স্বত্বঃ-

ক-শাখা-খেরাজ বা সকর ভূমি।

১। জামিদারি। জমিদারের অধিকৃত ভূমি জমিদারি আখ্যায় আখ্যাত হয়। জমি- ভূমি, এবং দার-অধিকারী, এই দুইটি শব্দ হইতে জমিদার শব্দের উৎপত্তি। স্থানভেদে এবং অবস্থা ভেদে ইহার নানারূপ অর্থ প্রযোজ্য হইয়াছে। কোন কোন লেখক অনুমান করেন যে জিম্বাদার শব্দ হইতে জমিদার শব্দের উৎপত্তি। আমাদের বিবেচনায় মুসলমানগণ প্রাচীন সামন্ত নরপতিগণকেই জমিদার আখ্যায় আখ্যাত করিয়াছিলেন। বাঙ্গালার বিখ্যাত ভৌমিকগণ আধুনিক ভারতবর্ষীয় সামন্ত নরপতিগণ হইতে দুর্বল কিম্বা ক্ষমতাহীন ছিলেন না। মোগল শাসনকর্তাগণ সেই পরাক্রমশালী ভৌমিকদিগকে জমিদার বলিয়া নিৰ্দ্দেশ করিয়াছেন। প্রকৃত পক্ষে প্রাচীন “বিষয়পতি” শব্দটি সম্পূর্ণ রূপে জমিদার শব্দের অনুরূপ। লর্ড কর্নওয়ালিস কৃত দশশালা বা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দ্বারা স্ব স্ব অধিকৃত একটি পরগণা বা বৃহৎ মহালের রাজস্ব যাহারা রাজকীয় ধনাগারে।৫১৪॥ অর্পণ করিতে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হইয়াছেন তাহারাই স্থায়ীরূপে জমিদার পদবাচ্য হইয়াছিলেন।[২] ক্রমে সেই সমগ্র জমিদারি কিম্বা তাহার অংশ ক্রেতাগণ ও সেই পদবি লাভ করিতেছেন। মোগল শাসনকালে জমিদারদিগের পদ নিতান্ত অস্থায়ী ছিল, শাসনকৰ্ত্তাগণ সামান্য কারণে একের জমিদারি অন্যের সহিত বন্দোবস্ত করিয়া দিতেন।

পরগণা বা মহালের নাম, ভূমির পরিমাণ, মহালের সংখ্যা, রাজস্ব

পরগণা বা মহালের নাম, ভূমির পরিমাণ, মহালের সংখ্যা, রাজস্ব

২। তালুক :-তালুকদার অধিকৃত মহাল। এই তালুকদার শব্দ আরবি ভাষা হইতে উৎপন্ন। উত্তর পশ্চিম প্রদেশে তালুকদার শ্রেষ্ঠ ও জমিদার তাঁহাদের অধীন মধ্যস্বত্বের অধিকারী। কিন্তু বাঙ্গালা দেশে জমিদারের অধীন মধ্যস্বত্বের অধিকারীগণ তালুকদার আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্বে অল্প সংখ্যাক স্বাধীন তালুক ছিল, অধিকাংশ তালুকদার জমিদারদিগকে তাঁহাদের দেয় রাজস্ব পরিশোধ করিতেন। লর্ডকর্ণওয়ালিস তালুকদারদিগকে স্বাধীন॥৫১৫॥ ভূম্যধিকারীর শ্রেণীতে উন্নীত করিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করেন[১]। লর্ড কর্ণওয়ালিসের ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে[২] ফেব্রুয়ারীর মন্তব্য লিপি (মিনিট) প্রচারিত হইলে, ত্রিপুরার জমিদারগণ নানা প্রকার অসদুপায় অবলম্বন করিয়াছিলেন। কোন কোন জমিদার তালুকদারদিগের প্রতি অতিরিক্ত খাজনা বার করিয়া তাঁহাদের জমিদারির রাজস্ব হ্রাস করিবার চেষ্টা করেন।[৩] আর ত্রিপুরার মহারাজ তাঁহার অধীন তালুকদারদিগকে স্বীয় কুক্ষি মধ্যে লুক্কায়িত রাখিবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা ও যত্ন করিয়াছিলেন। মজিদারদিগের অন্যায় আচরণে ত্রিপুরা জেলার অতি অল্প সংখ্যক তালুক খারিজ হইয়াছিল; ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে খারিজা বা স্বাধীন তালুকের সংখ্যা ১৩৫৬ নির্ণীত হয়। বোধ হয় ইহার চতুর্থাংশও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় সৃষ্ট হয় নাই।৫১৬॥

আর এক শ্রেণীর স্বাধীন তালুক আছে, একশত বিঘার উর্দ্ধ নিষ্কর বাজেয়াপ্ত করিয়া গবর্ণমেন্ট এই সকল তালুক সৃষ্টি করিয়াছেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিজ্ঞাপণীতে এই শ্রেণীর তালুকের সংখ্যা ১৯১টী প্রদত্ত হইয়াছে। পশ্চাৎ নূতন পয়স্তীভূমি স্থায়ীজমায় বন্দোবস্ত করিয়া গবর্ণমেন্ট ১০৩টি মহাল সৃষ্টি করিয়াছেন।

খ-শাখা-লাখেরাজ বা নিষ্কর।

লা-না, খেরাজ-কর;=না কর, অর্থাৎ যাহার কর নাই,তাহা লাখেরাজ বা নিষ্কর। ইহার অধিকার ও স্বত্ব জমিদারি হইতে ও শ্রেষ্ঠ। ইহা বিশেষরূপে প্রদর্শিত হইয়াছে যে, ব্রিটিসাধিকারের পূর্বে এই প্রদেশের আধিপত্য লইয়া ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় নরপতিগণ মধ্যে অবিশ্রান্ত কলহ চলিত। সতরাং কোন জাতীয় নরপতি দ্বারা কোন সময়ে জেলা ত্রিপুরার অন্তর্গত নিষ্কর সমূহ প্রদত্ত হইয়াছিল তাহা এক্ষণ নির্ণয় করা সুকঠিন হইয়াছে। তাহার কয়েকটি বিশেষ দৃষ্টান্ত এস্থলে প্রদর্শিত হইল।

১১৪১ শতাব্দের (বা নরবঙ্কমল্ল নরপতির ১৭ অব্দের) যে তাম্রশাসনের কথা পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে। উক্ত শাসন পত্র দ্বারা ইজখন্ড (বোধ হয় মহীচাল॥৫১৭ পরগণার অন্তর্গত মাইজখাড়) গ্রামের ২০ দ্রোণ ভূমি (জনৈক ব্রাহ্মণকে) দান করা হয়। যদি সেই ব্রাহ্মনের উত্তরপুরুষগণের অধিকারে সেই ভুমি কিম্বা তাহার কিয়দংশ থাকে, তবে তাঁহারা আপনাদের স্বত্বনির্ণয় করিতে সম্পূর্ণ অক্ষম হইবেন।

প্রাচীন রাজমালা গ্রন্থে লিখিত আছে যে, প্রাচীন ত্রিপুরেশ্বরগণ প্রায় সকলেই তাম্রশাসন দ্বারা ভূমি দান করিয়াছেন। অথচ অতি অল্প সংখ্যক তাম্রশাসন অধুনা অনুসন্ধানে প্রাপ্ত হওয়া যাইতেছে।

মুসলমান শাসনকর্তাগণ ও নানা প্রকার নিষ্কর প্রদান করিয়াছেন। তাহার সনন্দ কোন কোন স্থানে অদ্যাপি বিদ্যমান আছে। দস্যু সমসেরগাজির নিষ্কর দানের কথা পূর্বে বর্ণিত হইয়াছে। ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানী প্রাপ্তির পর ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণও নিষ্কর প্রদান করিয়াছিলেন। রেসিডেন্ট লিক সাহেবের প্রদত্ত নিষ্করের একখণ্ড সনন্দ আমরা দর্শন করিয়াছি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্বে স্থানীয় জমিদারগণ অনেক প্রকার নিষ্কর দান করিয়াছেন।৫১৮

লাখেরাজ বা নিষ্কর নিম্নলিখিত আখ্যাত হইয়া থাকে।

১। দেবোত্তর : দেবমন্দির ও ভজনালয় সংস্থাপন এবং দেবতার সেবাপূজা, বলি, চরু (ভোগ), সত্র (অতিথিসেবা) প্রভৃতির ব্যয় নির্বাহ জন্য যে ভূমি প্রদত্ত হইয়াছে তাহাই দেবোত্তর।

২। ব্রহ্মোত্তর : যাহা ব্রাহ্মণদিগকে প্রদত্ত হইয়াছে।

৩। মহাত্মরাণ বা মহত্তরাণ : কায়স্থ ও বৈদ্য প্রভৃতিকে যাহা প্রদত্ত হইয়াছে, তাহাই মহত্মরাণ। কোন স্থলে চিকিৎসকদিগকে প্রদত্ত ভূমি “বৈদ্যোত্তর” আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছে। মহত্মরাণ শব্দটি ক্রমে বিলুপ্ত হইয়াছে। মুসলমানদিগের দ্বারা মহত্মরাণ “ইনাম” শব্দে পরিণত হইয়াছে।

৪। বৈষ্ণবোত্তর : বৈষ্ণবদিগকে যে ভূমি প্রদত্ত হইয়াছে। ইহার পরিমাণ নিতান্ত অল্প।

৫। চেরাগী : মুসলমান মহাপুরুষদিগের সমাধি মন্দিরের ও ভজনালয়ের (মসজিদের) পরিচর্য্য ও প্রদীপ (চেরাগ) প্রদান জন্য যে ভূমি প্রদত্ত হইয়াছে তাহাই চেরাগী আখ্যায় আখ্যাত হইয়াছে।

৬। পিরাণ : মুসলমান পিরদিগকে যাহা প্রদত্ত হইয়াছে তাহাই”পিরণ” নামে খ্যাত।

৭। ফকিরাণ : মুসলমান ফকিরদিগকে প্রদত্ত ভূমি।

৮। খামার : সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ও তালুকদার প্রভৃতিকে নিজ জোতের জন্য যে ভূমি প্ৰদত্ত হইয়াছে তাহাই খামার পদবাচ্য।

৯। খানেবাড়ী : ঐ প্রকার ব্যক্তিদিগকে বসতবাস করিবার জন্য যে ভূমি প্রদত্ত হইয়াছে।

১০। খোসবাস : হিন্দুর খানেবাড়ী ও মুসলমানের খোসবাস এক শ্রেণীর নিষ্কর।[৬]

১১। মদতমাস : ইছলাম ধর্ম পরায়ণ বিজ্ঞ ব্যক্তিদিগকে যে ভূমি প্রদত্ত হইয়াছিল, তাহাই মদতমাস।

১২। ইনাম : ইহার অর্থ পুরস্কার। ইহা যে কোন ব্যক্তিকে প্রদত্ত হইয়াছে।

১৩। খএরাত : ব্যক্তি বিশেষ কিম্বা সাধারণের উপকারার্থে যে ভূমি প্রদত্ত হইয়াছে।

১৪। আএমা : মুসলমানদিগের ধম্মার্থে দত্ত ভূমি।[৭]

১৫। নান্কার : পদের কিম্বা কার্যের বৃত্তি স্বরূপ যে ভূমি প্রদত্ত হইয়াছে, তাহাই নাকার। জমিদারি নাকার[৮] তালুকদারি নাকার, চৌধুরাই নান্কার প্রভৃতি অনেক॥৫২০॥ প্রকার নাকার দৃষ্ট হয়। নুরনগর পরগণার অন্তর্গত মাইজখাড় ও কৃষ্ণপুরের ঘোষ বংশের বংশাবলীতে লিখিত আছে, মহারাজ (আদি) রত্নমাণিক্য তাহাদিগের আদি পুরুষকে জমিদারী নানকার প্রদান করেন। চৌধুরাই নান্কার অনেকগুলি প্রাচীন সনন্দ আমরা দর্শন করিয়াছি। এই সকল নান্কারের নাম ক্রমে বিলুপ্ত হইতেছে। নিম্ন শ্রেণীর ভৃত্যবর্গকে কোন কার্য্যের জন্য যে ভূমি প্রদত্ত হয়, তাহাই অধুনা নানকার বলিয়া পরিচিত। কোন কোন স্থানে “চাকরান” বা “মোজরাই” ভূমি ও নান্কার বলিয়া আখ্যাত হয়। প্রকৃতপক্ষে এই সকল ভূমি নান্কার শ্রেণীতে স্থান পাইতে পারে না। কারণ চাকরান মোজরাই ভূমির অস্তিত্ব কার্য্যের সহিত বিলুপ্ত হয়; কিন্তু প্রাচীন ও প্রকৃত নান্কার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্ব হইতে অধিকারীগণ পুরুষানুক্রমে নিষ্কর স্বরূপ ভোগ করিয়া আসিতেছেন।

জমিদারদিগের সহিত গবর্ণমেন্টের বন্দোবস্তের কালে সর্বপ্রকার নিষ্কর ভূমির কর ধৃত হয় নাই। কেবলমাত্র জমিদারগণের “নান্কার, খামার” ও চাকরান ভূমির জমা সকর ভূমির রাজস্বের সহিত গণনা করা হয়। লাখেরাজ বাজেয়াপ্তের বিধি দ্বারা এরূপ অবধারিত হয় যে, ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানী প্রাপ্তির পূর্ব হইতে যে সমস্ত ভূমি নিষ্কর স্বরূপ ভোগ করা হইতেছে তাহাকে সিদ্ধনিষ্কর বলিয়া।৫২১॥ জ্ঞান করিতে হইবে। তৎপরবর্তী কালের প্রদত্ত নিষ্কর যাহা কোম্পাণী কর্তৃক প্রদত্ত কিম্বা মঞ্জুরী গৃহীত হয় নাই তাহাই অসিদ্ধ বলিয়া জ্ঞান করিতে হইবে। এরূপ অসিদ্ধ নিষ্কর বাজেয়াপ্ত সম্বন্ধে একপ্রকার নির্ণীত হয় যে ১০০ বিঘার উর্দ্ধ পরিমাণ নিষ্কর কেবল গবর্ণমেন্ট বাজেয়াপ্ত করিতে পারেন। এবং তাঁহার ন্যূন পরিমাণ অসিদ্ধ নিষ্কর জমিদারগণ বাজেয়াপ্ত করিয়া স্ব স্ব জমিদারি ভুক্ত করিতে পারিবেন তাহার জন্য তাঁহাদিগকে অতিরিক্ত কর দিতে হইবে না।

১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৮ আইনের ৩৬ ধারার মর্মানুসারে ৭৮ টি ১০০ বিঘার উর্দ্ধ পরিমাণ মহাল ত্রিপুরা জেলার মধ্যে সিদ্ধ-নিষ্কর বলিয়া গবর্ণমেন্ট স্বীকার করেন।[৯] এবং তাহা”খালাসী লাখেরাজ” বলিয়া সর্বত্র সুপরিচিত। ১০০ বিঘার উর্দ্ধ পরিমাণ অন্যান্য অসিদ্ধ নিষ্কর যৎকালে গবর্ণমেন্ট বাজেয়াপ্ত করিতে প্রবৃত্ত হন। সেই সময় চাকলে রোশনাবাদের জমিদার (ত্রিপুরার মহারাজ বাহাদুর) অতি আশ্চর্য্য কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি প্রথমত গবর্ণমেন্টের গ্রাস হইতে মুক্ত করিয়া আত্মকুক্ষি মধ্যে তাহা নিক্ষেপ করিবার জন্য যত্ন করিয়াছিলেন। তাহাতে অকৃতকাৰ্য্য হইলে অন্য পন্থা অবলম্বন করিলেন। মহারাজ বলিলেন, “চাকলে রোসনাবাদ মধ্যে যত নিষ্কর আছে, তাহা॥৫২২।। আইন অনুসারে অসিদ্ধ হইলে ও আমার পূর্ব পুরুষের প্রদত্ত। গবর্ণমেন্টকে বার্ষিক ৮ সহস্র টাকা অতিরিক্ত কর প্রদান করিব। “গবর্ণমেন্ট মহারাজার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, অধিকন্তু বলিলেন, “মহারাজ ঐ সকল লাখেরাজ ভূমি হইতে কোনরূপ কর গ্রহণ করিতে পারিবেন না।” তদনুসারে ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে গবর্ণমেন্টের সহিত মহারাজের এক এগ্রিমেন্ট লিখিত হয়[১০]। উক্ত এগ্রিমেন্ট অনুসারে চট্টগ্রামের কমিসনর সাহেব ১৮৪৪।৫২৩।। খ্রিস্টাব্দে ২রা আগষ্ট গবর্ণমেন্ট সমীপে লিখেন যে, চাকলে রোসনাবদের অন্তর্গত যে সমস্ত লাখোরাজ ভূমি বাজেয়াপ্ত হইয়া গবর্ণমেন্টের সহিত বন্দোবস্ত হইয়া গিয়াছে। তাহার রাজস্ব উক্ত ৮০০০ টাকা হইতে কৰ্ত্তন করিয়া অবশিষ্ট টাকার জন্য মহারাজের সহিত বন্দোবস্ত যাইতে পারে। কিন্তু যে সমস্ত অসিদ্ধ নিষ্কর গবর্ণমেন্ট বাজেয়াপ্ত করিতে পারিতেন, সেই সমস্ত ভূমি হইতে মহারাজ কোনরূপ কর কিম্বা রাজস্ব গ্রহণ করিতে পারিবেন না। উল্লিখিত এগ্রিমেন্টের পূর্ব পর্য্যন্ত তাহা যেরূপ নিষ্কর ছিল চিরকাল সেইরূপ থাকিবে। সেই সকল লাখেরাজদারগণ নিকট রাজা কোনরূপ কিছু দাবি করিলে তাহা “জুলুম জবরদস্তী” (এষ্টরসন)॥৫২৪॥ স্বরূপ গণ্য হইবে[১১]। এই সকল হেতুবাদে কমিসনর সাহেব উক্ত বন্দোবস্তে গবর্ণমেন্টের মঞ্জুরী প্রার্থনা করেন। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই সেপ্টেম্বর বাঙ্গালার ডেপুটি গবর্ণর বাহাদুর তাহার মঞ্জুর করেন।[১২] তদনুসারে মহারাজা ঈশানচন্দ্র মাণিক্য ৮০০০ টাকার মধ্যে বাজেয়াপ্তী মহালের অবধারিত জমা বাদে অবশিষ্ট ৪৬২৬ টাকা সাত আনা ৯ পাই চাকলে রোস- নাবদের জমার সহিত ভূক্ত করত এক নূতন কবুলিয়ত লিখিয়া দেন।[১৩] এই বন্দোবস্তে র দ্বারা চাকলে রোসনাবাদের অন্তর্গত ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দের পূর্ববর্তী ১০০ বিঘার উর্দ্ধ পরিমাণ অসিদ্ধ নিষ্কর গুলি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্ববর্তী সিদ্ধ নিষ্কর স্বরূপ গণ্য হইয়াছে। গবর্ণমেন্ট কিম্বা জমিদার কাহারও ইহাতে হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার নাই।

মধ্যস্বত্ব :-

কঃ খেরাজ বা সকর।

শ্রেষ্ঠ স্বত্বের অধিকারীগণকে রাজস্ব পরিশোধ করিয়া॥৫২৫॥ তাঁহাদের অধীনে যে সমস্ত ভূমি ভোগ করা হয়, তাহাই মধ্যস্বত্ব। মধ্যস্বত্বের ভূমি ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত হইলেও ইহাকে সাধারণত তালুক বলা যাইতে পারে। ত্রিপুরা জেলায় এরূপ তালুক অনেক আছে, যাহা জমিদারী সৃষ্টির পূর্বে গঠিত হইয়াছে। নুরনগরের তালুক সমূহ তাহার প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত স্থল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর ও অনেক তালুক সৃষ্টি হইয়াছে। মধ্যস্বত্বের তালুকগুলি প্রধানত দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। প্রথম শ্রেণী তালুক ও অন্যান্য আখ্যাবিশিষ্ট ভূমির জমা অপরিবর্ত্তণীয়। দ্বিতীয় শ্রেণীর তালুক প্রভৃতির জমা পরিবর্তনশীল।

প্ৰথম শ্ৰেণী :-

(১) মকররী তালুক, (২) কায়েমী তালুক, (৩)পত্তনি তালুক, (৪) সিকিমী তালুক, (৫) হাওলা (৬) কায়েমী হওলা (৭) মিরাস (৮) মসক্কসী (৯) মকররী-খানেবাড়ী, (১০) কারকোণ।[১৪]

দ্বিতীয় শ্ৰেণী :-

(১) তালুক বা মেয়াদী তালুক। কোন কোন জমিদার এই তালুককে “তকসিসি” বা “তসখিসি” আখ্যায়।৫২৬॥ পরিচিত করিবার জন্য নিতান্ত লালায়িত। তদ্ব্যতীত হওলা মিরাস ও মসক্কসী তালুকের মধ্যে কোন কোনটির জমা পরিবর্তনশীল।

মধ্যস্বত্বের অধীনে কতকগুলি ভূমি আছে যাহা অধীন বা প্রজাস্বত্ব হইতে শ্রেষ্ঠ; যথা দরতালুক, আগত তালুক, পেটাও তালুক, সামিলা তালুক, ওসত তালুক, নিম হাওলা প্রভৃতি এই গুলি মধ্যস্বত্ব শ্রেণীতে নিবিষ্ট হইয়াছে।

খ :-লাখেরাজ বা নিষ্কর।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর জমিদারগণ দ্বারা যে সমস্ত নিষ্কর প্রদত্ত হইয়াছে, তাহাই মধ্যস্বত্বের অন্তর্গত হইতে পারে। কিন্তু কোন ব্যক্তি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্ববর্তী নিষ্করকেও মধ্যস্বত্ব বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। আমাদের বিবেচনায় তাহা ভ্রমাত্মক; কারণ জমিদারের সহিত গবর্ণমেন্টের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কালে সর্বপ্রকার নিষ্কর বাদ রাখা হইয়াছিল।

অধীন স্বত্ব : –

আমরা রায়তী স্বত্বের ভূমিকে অধীনস্বত্ব বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছি। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের পূর্বের ত্রিপুরা জেলার অধিকাংশ স্থলে রায়তীস্বত্ব অপরিজ্ঞাত ছিল, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন দেশবাসী কোন কোন জমিদারের অধিকৃত জমিদারীতে বহুকাল পূর্ব॥৫২৭॥ হইতে রায়তীস্বত্ব স্থির হইয়া গিয়াছে। গঙ্গামণ্ডল ও লৌহগড় পরগণা ইহার প্রধান দৃষ্টান্তস্থল। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ আইন প্রচারের পর হইতে সমগ্র ত্রিপুরায় রায়তীস্বত্ব প্রবল হইয়াছে।

ত্রিপুরাবাসী শ্রেষ্ঠ ও মধ্যস্বত্বের অধিকারী হিন্দু ও মুসলমান ভদ্রলোকদিগের প্রায় সকলেরই খামার বা নিজজোত ভূমি আছে। পূর্বে তাঁহার ভৃত্য দ্বারা হলকর্ষণ করাইতেন, কিন্তু এক্ষণ অনেকেই “বর্গা”দ্বারা খামার ভূমি ভোগ করিতেছেন। বর্গা দুই প্রকার বর্গা দ্বারা উৎপন্ন ফসলের অদ্ধাংশ স্বত্বাধিকারী কৃষককে প্রদান করেন। অতিরিক্ত পরিমাণ জলপ্লাবন কিম্বা অন্য কারণে শস্য বিনষ্ট হইলে স্বত্বাধিকারী কিছুই প্রাপ্ত হন না।

ভূমির পরিমাণ:-

৩ ক্রান্ত (১) কড়া

৪ কড়া (১) গণ্ডা

২০ গণ্ডা (১) কাণী

১৬ কাণীতে (১) দ্ৰোণ‍[১]

অতি প্রাচীন কাল হইতে, শ্রীহট্ট ব্যতীত, সমগ্র বাঙ্গালা॥৫২৮॥ দেশে এই নিয়মে ভূমির পরিমাপ হইত। গৌড়েশ্বর মহারাজ লক্ষণসেন দেবের তাম্রশাসনে তাহার প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যাইতেছে। মুসলমান শাসনকালে বিঘা, কাঠা দ্বারা ভূমির পরিমাপ প্রথা পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত হয়। কিন্তু পূর্ববঙ্গে অদ্যাপি সেই প্রাচীন প্রথা বিলুপ্ত হয় নাই।

প্রাচীন সংস্কৃত শাস্ত্রে দ্রোণ মাপের উল্লেখ দৃষ্ট হয়। ৪ আড়ক বা আড়ীতে এক দ্রোন ধান্য। সেই ১ দ্রোণ বা ৮ মণ শস্য বীজ (ধান্য) যে ক্ষেত্রে বপন করা যাইত, তাহাই দ্রোণ আখ্যা প্রাপ্ত হয়। বাঙ্গালার কোন কোন অংশে রশি বা দড়ি দ্বারা ভূমির পরিমাপ হইয়া থাকে, কিন্তু পূর্ববাঙ্গালায় “নল” নামক গুল্ম দ্বারা ভূমির পরিমাপ করা হইত। অধুনা সেই নলের অভাবে মূলি কিম্বা অন্য প্রকার বাঁশ দ্বারা সেই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইতেছে, কিন্তু তাহার নাম পরিবর্তন হয় নাই। এজন্য অধুনা ভুমি পরিমাপক বংশদন্ডকে নল বলা হইয়া থাকে।

প্রাচীন কালে ভূমির পরিমাণ সর্বত্রই একরূপ ছিল। প্রধাণত জমিদারিগনের লোভে অধুনা সেই পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন আকার প্রাপ্ত হইয়াছে। এসম্বন্ধে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন প্রমাণ, ত্রিপুরেশ্বর মহারাজ ইন্দ্র মাণিক্যের ১১৫৩ ত্রিপুরাব্দের (১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দের) ৭ই আশ্বিনের সনন্দে প্রাপ্ত হওয়া যায়। তাহাতে ভূমির পরিমাণ এইরূপ প্রদত্ত হইয়াছে।।৫২৯।

৩২ অঙ্গুষ্ঠে ১ ডাঙ্গ (হস্ত)।

১৭ ডাঙ্গে ১ নল।

১০×১২ নলে ১ কানী।

১৬ কানিতে (বা ১৯২০ বৰ্গ নলে) ১ দ্রোণ।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্বে যৎকালে রেসিডেন্ট বুলার সাহেব চাকলে রোসনাবাজ জরিপ করেন। তৎকালে তিনি উল্লিখিত প্রণালী অবলম্বন করেন; তিনি যে ডাঙ্গ দ্বারা নলের পরিমাণ স্থির করিয়াছিলেন, তাহা ত্রিপুরার কালেক্টরিতে রক্ষিত হইয়াছে, ইহা আধুনিক১৯ ইঞ্চি হইতে কিঞ্চিৎ অধিক। প্রবাদ অনুসারে ইহাই ইন্দ্র মাণিক্যের লিখিত ৩২ অঙ্গুষ্ঠের ডাঙ্গ বা হস্ত; মতান্তরে রোসনাবদের তদানীন্তন দেওয়ান কালীচরণ সিংহের মস্তকের পরিধি পরিমাণ দ্বারা এই ডাঙ্গ প্রস্তুত করা হয়।

১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দের রেভিনিউ বোর্ড জেলা ত্রিপুরার অন্তর্গত পরগণা সমূহের ভূমির পরিমাণ অবগত হইতে ইচ্ছা করেন[১৫] তদনুসারে তদানীন্তন কালেক্টর যে নক্সা প্রস্তুত করিয়া স্বীয় রিপোর্ট[১৬] সহ চট্টগ্রামের কমিসনর সাহেবের নিকট প্রেরণ করেন তাহার সারাংশ এস্থলে উদ্ধৃত হইল।

ত্রিপুরার অন্তর্গত পরগণা সমূহের ভূমির পরিমাণ

ইহা নিতান্ত দুঃখের বিষয় যে, ত্রিপুরার অন্তর্গত বলদাখাল, সরাইল প্রভৃতি জমিদারগণ প্রায় সকলেই দ্রোণের আয়তন খর্ব করিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা ও যত্ন করিতেছেন।।৫৩১।।

ত্রিপুরার জমিদার মণ্ডলী :- জেলা ত্রিপুরার আধুনিক প্রধান জমিদারগণ প্রায় সকলেই ভিন্ন দেশবাসী। ইহা দ্বারা ত্রিপুরাবাসীগণের নানা প্রকার অনিষ্ট সংসাধিত হইতেছে। দেশবাসিগণ জমিদার মণ্ডলী হইতে যে সকল বিষয়ে সাহায্য পাওয়ার প্রত্যাশা করিতে পারেন; সেই সকল বিষয়ে তাঁহারা অনেক সময়ে উপযুক্তরূপ সাহায্য প্রাপ্ত হন না।

জেলা ত্রিপুরার সর্বপ্রধান জমিদার ত্রিপুরেশ্বর মহারাজ বাহাদুর। তাঁহাকে বিদেশী সংজ্ঞায় অভিহিত করা যাইতে পারে না; কিন্তু বর্তমান মহারাজ ত্রিপুরাবাসী সম্বন্ধে বিদেশী অপেক্ষাও অধিকতর উদাসীন। ত্রিপুরার রাজসরকার জরাজীর্ণ অশ্বত্থবৃক্ষের ন্যায় হইয়া দাঁড়াইয়াছে।

ত্রিপুরা মহারাজের পরেই ঢাকা নিবাসী, -বলদাখালের প্রধান জমিদার নবাব আবদুগণি খাঁ বাহাদুর[১৭] ও সরাইলের জমিদার বাবু আশুতোষ নাথ রায় মহাশয়ের নাম উল্লেখ করা যাইতে পারে। ইঁহাদের উভয়ের জমিদারির লভ্য সমতুল্য হইবে। নবাব সাহেবের দানশীলতার পরিচয় গবর্ণমেন্ট গেজেটে প্রায়ই বিঘোষিত হইয়া থাকে। কিন্তু গরীব ত্রিপুরাবাসী তাহার বড় একটা খোঁজখবর পাইতেছে না।॥৫৩২॥

সরাইলের জমিদারবাবু আশুতোষ নাথ রায়, বাবু জগবন্ধু রায়ের বংশধর। তাঁহাদের বংশাবলী এস্থলে প্রকাশ করা গেল।

জগবন্ধু রায়

নরসিংহ রায়

রাজকৃষ্ণ রায়

অন্নদা প্রসাদ রায়

আশুতোষ নাথ রায়

ইহা পূর্বে বর্ণিত হইয়াছে যে, এই রায় পরিবার মুরশিদাবাদের অন্তর্গত কাশীমবাজার নিবাসী। ইঁহারা প্রকৃতপক্ষে প্রজাহিতৈষী ভূম্যধিকারী বটেন; ইঁহাদের সাহায্যে সরাইল পরগণার মধ্যে দুইটি এন্ট্রান্স স্কুল, ৫ টি মাইনর ও ছাত্রবৃত্তি স্কুল ও কতকগুলি পাঠশালা পরিচালিত হইতেছে। রায় অন্নদাপ্রসাদ রায় বাহাদুর দয়ালু, দাতা ও প্রজাহিতৈষী জমিদার ছিলেন। তাঁহার অকাল মৃত্যুতে সরাইলবাসী বিশেষ ক্ষতিগ্রস্থ হইয়াছেন, তাঁহার পত্নী রাণী অন্নাকালী দেবী স্বীয় বুদ্ধিমত্তা ও দয়া দাক্ষিণ্যে সরাইলবাসীর বিশেষরূপ ভক্তি শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়াছেন। আমরা ভরসা করি তাঁহার পুত্রী স্বীয় পিতা মাতার গুণরাশি ও কার্য্য কলাপের অনুকরণ করিবেন।॥৫৩৩॥

তদনন্তর গঙ্গামণ্ডল ও লৌহগড়ের জমিদার, শোভাবাজার রাজবংশ; পাইটকাড়ার জমিদার, ভূকৈলাসের ঘোষাল রাজগণ; কাদবা প্রভৃতি পরগণার নবীন জমিদার মহারাজা দুর্গাচরণ লাহার নামোল্লেখ করা যাইতে পারে। গঙ্গা মণ্ডল ও লৌহগড়, শোভাবাজার রাজপরিবারের অবিভক্ত সম্পত্তি। ইহা রাজা বিনয়কৃষ্ণ বাহাদুর কিম্বা তৎসদৃশ অন্য কোন মহাত্মার নিজ সম্পত্তি হইলে প্রকৃতি বর্গের উপকারের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু এক্ষণ সে আশা দুরাশা মাত্র। পাইটকাড়ার অদৃষ্টে প্রায় তদ্রুপই ঘটিয়াছে।

স্থানীয় জমিদার :- স্থানীয় প্রধান ও প্রাচীন জমিদারগণ প্রায় সকলেই হৃতসর্বস্ব হইয়াছেন। অদ্যাপি যাহারা জমিদার আখ্যা দ্বারা পরিচিত হন,তন্মধ্যে হোমনাবাদের অন্যতম জমিদার সৈয়দ সাহেব বসরত আলী চৌধুরী সর্ব প্রধান। আমরা দুঃখের সহিত উল্লেখ করিতেছি যে, সৈয়দ সাহেব উন্মাদ, তাঁহার সম্পত্তি জজ সাহেবের অধীনে মেনেজার দ্বারা শাসিত হইতেছে।

হোমনাবাদের প্রাচীন জমিদার বংশজাত ইউছফ্ আলী চৌধুরী সাহেব দানশীল ও প্রজাহিতৈষী জমিদার বটেন। স্বীয় অবস্থা অনুসারে তিনি মুক্তহস্তে সৎকার্য্যে অর্থদান করিয়া থাকেন। তাঁহার ভগিনী নবাব ফয়জন্নেছা সাহেবা ভ্রাতার উপযুক্তা বটেন। উক্ত নবাবসাহেবা “রূপজালান” ॥৫৩৪॥ নামক একখানি উপখ্যান গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন। উহার ভাষা বিশুদ্ধ বাঙ্গালা। এই প্রাচীন ও দানশীল জমিদার বংশের বংশাবলী এস্থলে প্রকাশ করা গেল।

ইউছফ্ আলী চৌধুরী জমিদার বংশের বংশাবলী

হোমনাবাদের নবীন জমিদার তিলকচন্দ্র সিংহের পৌত্র বাবু আনন্দচন্দ্র সিংহরায় সদাশয়, বিদ্বান ও বিদ্যানুরাগী। তিনি নিজ ব্যয়ে কুমিল্লানগরে একটি এন্ট্রান্স স্কুল চালাইতেছেন।

মধ্যশ্রেণী :- প্রধানত ব্ৰাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য ও সম্ভ্রান্ত মুসলমান দ্বারা এই শ্রেণী গঠিত। মধ্যশ্রেণীর ভদ্রলোকগণই দেশের জীবনস্বরূপ। মধ্য শ্রেণী জ্ঞানে ও শিক্ষায় দিন দিন উন্নতিলাভ করিতেছেন; বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ উচ্চ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া পাশ্চাত্য জ্ঞানলোকে আলোকিত হইতেছেন। প্রতিযোগিতায় উচ্চ রাজকার্য্য প্রাপ্ত হইতেছেন। উকিল, ডাক্তার প্রভৃতি উন্নত ব্যবসায় অবলম্বন করিয়া যশস্বী হইতেছেন। অপর দিকে ব্রাহ্মণ মণ্ডলীর মধ্যে সংস্কৃত শিক্ষার গতি প্রতিরোধ হয় নাই। কিন্তু আর্থিক অবস্থার অবনতি, অবস্থা বৈপর্য্যয় মধ্যশ্রেণীর মধ্যে বিশেষরূপে পরিলক্ষিত হইতেছে। এই শ্রেণীর আর্থিক অবনতি দেশের পক্ষে বড়ই দুর্ভাগ্যের বিষয়। অধিকাংশ স্থলে ইহারা মধ্যস্বত্বের অধিকারী। দেশের প্রধান জমিদারগণ অধিকাংশ ভিন্ন দেশবাসী। জমিদার শ্রেণীর সহিত প্রাচীনকালে মধ্যশ্রেণীর বিশেষরূপ সদ্ভাব ছিল; নবীন ক্রেতা ভিন্ন দেশীয় জমিদারগণের সহিত মধ্য শ্রেণীর সেই ভাব ক্রমে বিলুপ্ত হইতেছে। স্বদেশী ও বিদেশী প্রবল জমিদারগণের মধ্যে কোন॥৫৩৬। কোন ব্যক্তি মধ্যশ্রেণীর বিনাশসাধন জন্য নানারূপ কৌশল অবলম্বন করিতেছেন। ইহা অতি আশ্চর্য্যের বিষয় যে, সাধারণ প্রজাগণের মঙ্গলসাধন জন্য গবর্ণমেন্ট যেরূপ সুদৃঢ় বিধি প্রণয়ণ করিতেছেন, মধ্যশ্রেণীর রক্ষার জন্য তদ্রুপ কোন বিধি গবর্ণমেন্ট দ্বারা প্রণীত হয় নাই। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ আইন প্রচারের পর হইতে মধ্যস্বত্বের তালুকের ভূমির মূল্য হইতে প্রজাস্বত্বের ভূমির মূল্য আশাতীতরূপ বৰ্দ্ধিত হইয়াছে। তালুকীস্বত্বের এক কাণী ভূমির মূল্য ২০ টাকা হইলে,তদ্রুপ প্রজাস্বত্বের এক কাণী ভূমির মূল্য ৪০/৫০ টাকার ন্যূন হইবে না। স্থান ও অবস্থান ভেদে তাহার মূল্য শতাধিক হইয়া থাকে। যেরূপ অবস্থা দাঁড়াইতেছে তাহাতে কোন কোন স্থলে মধ্যস্বত্বের বিনাশ অনিবার্য্য। ত্রিপুরা জেলা এক একটি বৃহদায়তন জমিদারিতে বিভক্ত, এজন্যই দেশের যাহাঁরা জীবন স্বরূপ, তাঁহারা মস্তকোত্তলন করিতে পারিতেন না; এবপ্রকার অবস্থায় মধ্যস্বত্বের বিনাশ সাধিত হইলে, দেশের ভয়ানক অকল্যাণ সাধিত হইবে। মধ্যস্বত্বের অধিকারীর সহিত প্রজাসাধারণের যেরূপ সদ্ভাব ও প্রীতি বৰ্ত্তমান আছে, জমিদার শ্রেণীর সহিত প্রজাসাধারণের তাহার বিপরীত ভাব সর্বত্র দেদীপ্যমান রহিয়াছে। আপদে বিপদে মধ্যশ্রেণী প্রজাসাধারণের অগ্রজের ন্যায় সাহায্যকারী; কিন্তু যে স্থানে মধ্যস্বত্বের অভাব সেই স্থানে প্রজাসাধারণের॥৫৩৭॥ মর্ম্মবিদারক ক্রন্দনধ্বনি প্রবল প্রতাপান্বিত জমিদারের কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইবার পূর্বে শূন্যমার্গে বিলীন হইয়া যাইতেছে। জমিদারবৃন্দের বিলাসভবন নিবাসী অপ্সরা কিম্বা কলাবত সমূহের মধুরনাদে প্রজাবৃন্দের কাতরনিনাদ ঢাকিয়া ফেলিতেছে, কিম্বা রাবণ সদৃশ পরক্রমশালী “মেনেজার” “নায়েব” প্রভৃতি উপাধিধারী ব্যক্তিবৃন্দের পরাক্রমে প্রজাসাধারণে উচ্চেঃস্বরে ক্রন্দন করিতে না পারিয়া নীরবে অশ্রুবিসর্জ্জন করিয়া থাকে। কিন্তু অত্যাচারের মাত্রা পূর্ণত্বপ্রাপ্ত হইলেই “নায়েব হত্যা” “তহশীলদার হত্যা” “কাছারি বাড়ী দাহ” ও “নরহত্যা” প্রভৃতি কার্য্য সম্পাদিত হয়। তৎকালে জমিদারগণ ইহার কারণ অনুসন্ধান করত অত্যাচার নিবারণের উপায় উদ্ভাবন না করিয়া “দুদ্দান্ত” প্রজাকুলের দমন জন্য মুক্তহস্তে অর্থব্যয় করিতে থাকেন।

প্রজা সাধারণ : – ত্রিপুরার প্রজাগণ মধ্যে নিদয় ও নিরীহ উভয় প্রকারের লোক দৃষ্ট হয়। দক্ষিণ ত্রিপুরাবাসী দুষ্ট প্রজাগণ অত্যাচারগ্রস্থ হইলে অনলক্রীড়া দ্বারা তাহার প্রতিশোধ লয়। পশ্চিম ও উত্তর ত্রিপুরাবাসী দুৰ্দ্দান্ত প্রজাগণ এইরূপ ঘৃণিত কাৰ্য্য না করিয়া যষ্ঠি হস্তে সম্মুখ সংগ্রামে অগ্রসর হইয়া থাকে। জনৈক ইংরেজ রাজপুরুষ ইহাদিগকে প্রাচীন “নবাবসৈন্য” বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন ॥৫৩৮॥

পাটের চাষ দ্বারা প্রজাসাধারণের অবস্থা অপেক্ষাকৃত উন্নত হইয়াছে। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ আইল দ্বারা ইহাদের অবস্থা বিশেষরূপ পরিবর্তিত হইতেছে।

.

টীকা

১. ১৭৮৯ খ্রিঃ ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৭৮৯ খ্রিঃ ১৫ নভেম্বর এবং ১৭৭০ খ্রিঃ ১০ ফেব্রুয়ারী যে সকল বিধি প্রচারিত হয় তদ্বারা এরূপ ঘোষণা করা হইয়াছিল যে, ঐ সকল বিধি দ্বারা ১০ বৎসরের জন্য যে জমা ধাৰ্য্য হইয়াছে, কোর্ট অব ডাইরেক্টর কর্তৃক অনুমোদিত হইলে তাহাই চিরস্থায়ী বলিয়া গণ্য হইবে। তদনন্তর কোর্ট অব ডাইরেক্টরের মঞ্জুরি প্রাপ্ত হইয়া ১৭৯৩ খ্রিঃ ২২শে মার্চ (১২০০ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে) লর্ড কর্ণওয়ালিস্ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ঘোষণা প্রচার করেন।

২. লর্ড কর্ণওয়ালিস বলেন “ জমিদারের দেয় রাজকর স্থির রূপে নির্ণীত হইল, এক্ষণে তাঁহারা তালুকদারের খাজনা বৃদ্ধির জন্য কোন রূপ আপতা করিতে পারেন না। কারণ ভূমিতে তাঁহাদের যে স্বত্ব ও অধিকার আছে, তালুকদারের ও তদ্রুপ স্বত্ব ও অধিকার রহিয়াছে। রাজকর পরিশোধ সম্বন্ধে তাঁহারা মারফতদার মাত্র। (Lord Cornwallis’ minute. 3rd Feb. 1970)

৪. Hunter’s Bengal MS Records Vol. IP 243.

৫. Field’s Landholding & p. 517.

৬. কোলব্রুক সাহেব এই তাম্রশাসনের পাঠোদ্বারের পূর্বক স্বকৃত ইংরেজী অনুবাদের সহিত প্রকাশ করেন। – Asiatic Researches. Vol IX and  Colebrooke’s Essays. Vol II p. 242

৭. Fifth Report pp. 294. 345.কিন্তু মেদিনীপুর জেলায় আএমা এক প্রকার রায়তীস্বত্বের ভূমি নির্ণীত হইয়াছে। Fields Landholding SS.P 710

৮. Fifth Report PP. 294. 345.

৯. ত্রিপুরার বর্তমান মহারাজ লালময়ী ময়নামতী পর্বতে তাঁহার স্বত্ব স্থির রাখিবার জন্য ভারত সচিবের সমীপে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর এক আবেদনপত্র প্রেরণ করেন। সেই আবেদনপত্র ও তৎসঙ্গীয় দলীলাদির ইংরেজী অনুবাদ পুস্তকাকারে মুদ্রিত হইয়াছিল Printed at the “Minerva” Press. 2 Uckoor Datta’s lane Calcutta). আমরা সেই মুদ্রিত পুস্তকের ১০ এবং ১১ পৃষ্ঠা হইতে উক্ত এগ্রিমেন্টের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা এস্থানে উদ্ধৃত করিতেছি।
ii) In behalf of Government other proceedings for the resumption of all sorts of rent free lands, towfeer, reclaimed lands from jungle and churs newly formed, Sc, appertaining to the landed estate Chakla Rosanabad, have been stopped and at no time shall any proceedings be instituted in behalf of resuming or assessing new rent on any kind of land appertaining to Chakla Rosanabad.

iii) Under this deed of settlement, save and except the right and powers vested in the zamindar under the regulations, no new right or powers have been granted to him, that is to say in reference to the rent which, under this agreement is become payable by the Moharaja. The Raja shall have no power or right to demand any Rent from a rentfree tenure held by him before the execuit on of this deed of settlement between the Moharaja and Government, as it was improper to demand or realize any rent from and rentfree hold- er it willbe so still.

১০. Letter No 525, from the commissioner and Sadar Board 16th Division. To the Secretary to the Government of Bengal. 22nd August 1844.

১১. Letter No.222. From the under Secretary to Government of Bengal. To the commissioner of Chittagang Division, 16th September 1844.

১২. মহারাজ ঈশানচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের প্রদত্ত ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ২১শে মে মোতাবেক ১২৬২ বঙ্গাব্দের ৮ই জৈষ্ঠ্যের কবুলিয়ত দ্রষ্টব্য।

১৩. সরাইলের প্রাচীন জমিদারগণ তাঁহাদের আমলা প্রভৃতি কর্মচারীগণকে অল্প জমায় যে ভূমি দান করিয়া গিয়াছেন তাহাই কারকোনা নামে পরিচিত।

১৪. Board’s Circular No. 76 Dated 26 Sept. 1837.

১৫. Letter from W. J. H. Morey. Esq. Collection of Tippera, to the Commissioner of the Chittagang, No. 6.4th May 1838.

১৬. এই অংশ যৎকালে মুদ্রিত হইতেছিল সেই সময় আমরা সংবাদ প্রাপ্ত হইলাম যে, এই স্বনামখ্যাত মহাপুরুষ পরলোকগমন করিয়াছেন।

১৭. মূল ৪৩৫ পূঃ দ্রষ্টব্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *