পঞ্চম অধ্যায় – গদ্য সাহিত্য ও গল্প সাহিত্য
কথা ও আখ্যায়িকা
শ্রব্য ও দৃশ্য ভেদে সংস্কৃত কাব্য দ্বিবিধ। শ্রব্য কাব্য মধ্যে কিছু গদ্যে লিখিত, কিছু অংশ পদ্যে লিখিত। আবার কিছু অংশ গদ্য ও পদ্য মিশ্রিত। প্রাচীন কাল থেকে সাহিত্যে পদ্যের প্রভাবই অধিক পরিলক্ষিত হয়। গদ্যের আবির্ভাব অপেক্ষাকৃত বহু পরের যুগে। ছন্দের অপূর্ব সুষমায়, গীতিধর্মী কাব্য সমূহ অতি সহজেই শ্রোতার মন হরণ করতে সক্ষম ছিল। যতদিন পর্যন্ত্য লিপির ব্যাপক প্রচলন হয় নি, ততদিন ছন্দোবদ্ধ পদ্যই শ্রোতার নিটক চিত্তাকর্ষক ছিল। তবে গদ্য সাহিত্যের আবির্ভাব পরবর্তী কালে হলেও এর বীজ নিহিত ছিল বহু প্রাচীন সাহিত্য যেমন কৃষ্ণ যর্জুবেদের তৈত্তিরীয় সংহিতায়, অথর্ববেদের কিয়দংশে, যজ্ঞের ব্যাখ্যায় ও ব্রাহ্মণ গ্রন্থ গুলিতে; উপনিষদে ও সূত্র সাহিত্যের ধারায়। খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টমশতাব্দীতে যাস্কাচার্য্য তাঁর নিরুক্ত গ্রন্থে অতিসরল প্রসাদগুণ বিশিষ্ট গদ্যের ব্যবহার করেছেন। দর্শন যুগের সূত্র সমূহের প্রাচীনবৃত্তি ও ভাষ্যগুলিও অত্যন্ত সরল গদ্যের আকারে লিখিত। পতঞ্জলির মহাভাষ্যের ভাষাও অতি প্রাঞ্জল, সমাস বাহুল্য বর্জিত, সহজ, সরল ভঙ্গিমায় রচিত। কেহ কে মহাভাষ্যের গদ্যাংশকে আদর্শ সংস্কৃত গদ্য বলেও গ্রহণ করেছেন। পতঞ্জলি তার মহাভাষ্যে ‘বাসবদত্তা’, ‘সুমনোত্তরা’ ও ‘ভৈরমথী’ নামে তিনটি গদ্য আখ্যায়িকার উল্লেখ করেছেন। যদিও এই সমস্ত গ্রন্থ লুপ্ত, এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে কোনরূপ তথ্যও পাওয়া যায় না। চরক, সুশ্রুত প্রভৃতি বৈদ্যকগ্রন্থের কোনও কোনও অংশগদ্যে রচিত এবং পুরাণের মধ্যে বিশেষতঃ বিষ্ণুপুরাণের গদ্যাংশ সমূহ অতিপ্রাচীন কালে রচিত বলে পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা মনে করেন। এবং এই বিষ্ণুপুরাণের হাত ধরেই সংস্কৃত সাহিত্য প্রসাদগুণ সমন্বিত গদ্যরূপের স্বাদ পেয়েছিল। বররুচির ‘মনোবতী’ নামক গদ্যকাব্য দণ্ডীকর্তৃক প্রশংসিত।
গদ্যকাব্যের স্বরূপ নির্ণয় করতে গিয়ে আচার্য দণ্ডী বলেছেন— ‘আপাদঃ পদসম্ভানো গদ্যমাখ্যায়িকা কথা।’ ১।২৩ ছন্দোবদ্ধহীন পদসমষ্টিই তাঁর মতে গদ্য বলে বিবেচিত। ‘বৃত্তবন্ধোজঝিতং গদ্যম’—অর্থাৎ ছন্দোবদ্ধ বৃত্তবন্ধ মাত্রেই গদ্যকাব্য বলে বিবেচিত হয়। সাহিত্যদর্পণকার বিশ্বনাথও এই মত পোষণ করেন। বামন তাঁর কাব্যালঙ্কার সূত্রবৃত্তিতে (১।৩।২১) বলেছেন—গদ্যকাব্যই কবিগণের প্রতিভা নির্ণয়ের কষ্টিপাথর স্বরূপ, এর দ্বারাই কবির প্রতিভার উৎকর্ষতা যাচাই করা সম্ভব। ‘গদ্যাং কবীনাং নিকষং বদন্তি। গদ্যকাব্যের মূলতঃ কথা ও আখ্যায়িকা এই দুই ভেদ স্বীকৃত। এই প্রসঙ্গে বলা যায় পাণিনি ব্যাকরণের বার্তিকসূত্রে কাত্যায়ন আখ্যায়িকার উল্লেখ করেছেন। পতঞ্জলির মহাভাষ্যে আখ্যায়িকার উল্লেখ দৃষ্ট হয়। ‘বৃহৎকথা’ নামটির মধ্যে ‘কথা’ শব্দটি রয়েছে। ‘পঞ্চতন্ত্র’ও কথা বিশেষ। এর অপর নাম ‘তন্ত্রাখ্যায়িকা’ কালিদাস পূর্ব যুগেও ‘মামিল্’ ও ‘রামিল্’ রচিত ‘শূদ্রকথা’র উল্লেখ দৃষ্ট হয়। অতএব ‘কথা’ ও ‘আখ্যায়িকার যাত্রা অতি প্রাচীন কাল থেকেই শুরু হয়েছিল। পুরাণে এই দ্বিবিধ ভেদ ছাড়াও অতিরিক্ত ভেদ স্বীকৃত। পুরাণকারের মতে
“আখ্যায়িকা কথা খণ্ডকথা পরিকথা তথা।
কথালিকেতি মন্যস্তে গদ্যকাব্যঞ্চ পঞ্চধা।।”
অতএব কথা আখ্যায়িকা ছাড়াও খণ্ডকথা, পরিকথা ও কথালিকা এই তিন প্রকার বর্তমান। এই প্রসঙ্গে দণ্ডী, ভামহ, রুদ্রট, হেমচন্দ্র, বিশ্বনাথ প্রভৃতি আলঙ্কারিকগণ নানামত পোষণ করে থাকেন। দণ্ডী যদিও কথা ও আখ্যায়িকার মধ্যে তেমন ভেদ স্বীকার করেন না তাঁর মতে কথা ও আখ্যায়িকা একই জাতীয়। গদ্যকাব্যের দুটি রূপ মাত্র—
তৎকথাখ্যায়িকেত্যেকা জাতিঃ সংজ্ঞা দ্বয়াঙ্কিতাঃ। আলঙ্কারিক ভামহ ‘কথা’ ও ‘আখ্যায়িকার’—পার্থক্য নির্দেশ করে বলেছেন[১] প্রথমতঃ আখ্যায়িকার নায়ক নিজ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করবেন। এর বিষয়বস্তু হবে লোকানুবর্তী। অপর পক্ষে ‘কথা’-র বিষয়বস্তু হবে কল্পিত এবং নায়ক ব্যতীত অপর কোন ব্যক্তি এর বক্তা হবেন। দ্বিতীয়তঃ—আখ্যায়িকা সরল গদ্যে রচিত হবে। তবে বক্তৃ ও অপরবক্ত ছন্দের প্রয়োগ থাকবে এবং উচ্ছ্বাসে বিভক্ত হবে। তৃতীয়তঃ–কন্যাহরণ, যুদ্ধ বিগ্রহ, দুঃখ বিরহাদির মধ্য দিয়ে নায়ক-কেই শেষ পর্যন্ত্য জয়ী করা হবে। এই আখ্যায়িকা সংস্কৃত ভাষাতেই রচিত হবে। অপরপক্ষে কথা কিন্তু সংস্কৃত অথবা অপভ্রংশেও রচিত হতে পারে। বহুল প্রচলিত উদাহরণ স্বরূপ বাণভট্টের হর্ষচরিত ‘আখ্যায়িকা ও কাদম্বরী ‘কথা’ বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। তথাপি ভামহের উপরিউক্ত সংজ্ঞার সাথে তা মেলে না। উপরন্তু বাণভট্ট স্বয়ং তাঁর কাদম্বরীকে ‘কথা’ বলেই অভিহিত করেছেন।[২] Peterson-এর মতে ভামহ নির্দিষ্ট সংজ্ঞা কাদম্বরী সম্বন্ধে কখনও প্ৰযুক্ত হতে পারে না। কথার উদাহরণ রূপে কাদম্বরীকে বল পূর্বক প্রয়োগ করা হয়েছে।
আচার্য রুদ্রটের মতে কথা কাব্যের শুরুতে পদ্যে দেবতা ও গুরুর উদ্দেশ্যে নমস্কার থাকবে। কবির বংশ সম্বন্ধে দু’চার কথা থাকবে। কাব্য রচনার প্রেরণা ইত্যাদি থাকবে। সংস্কৃতে রচিত হলে কথারূপ হবে গদ্যমূল। কাহিনীর অবতারণায় কথাস্তরের বিনিয়োগ হবে। কন্যালাভ ইত্যাদি বর্ণিত হবে। রুদ্রটের এই সংজ্ঞা কাদম্বরীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সাহিত্য দর্পণকার বিশ্বনাথও রুদ্রটের মতের সমর্থনে আখ্যায়িকার সংজ্ঞা নিরূপণ করেছেন।
গদ্য সাহিত্যের চরম উন্নতির নিদর্শন হিসাবে সুবন্ধু, বাণ ও দণ্ডীর নাম স্মরণীয়। গদ্যকাব্যের এ হেন সুবর্ণ যুগের পশ্চাতে নিশ্চয়ই একটা প্রস্তুতিপর্ব ছিল। রাতারাতি এমন উৎকৃষ্ট গদ্য সাহিত্য সৃষ্টি অসম্ভব। এর মূলে হয়ত প্রাচীন গল্পের ধারা এবং পদ্য কাব্যের ভাব সুষমা কাজ করেছিল। ‘বৃহৎকথা’, ‘পঞ্চতন্ত্র’, প্রভৃতি লোক সাহিত্যের যে ধারাটি প্রচলিত ছিল তা এক বিশেষ প্রকার ঐতিহ্যের সাক্ষ্যবহন করে। সংস্কৃত গদ্য কাব্য মূলতঃ সেই ধারার অনুসারী। সেই সাথে পদ্য কাব্যের অলঙ্কার, ছন্দ, গুণ, রীতি, রস ইত্যাদির সম্মিলিত প্রভাবও গদ্য সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে নিঃসন্দেহে। একঅর্থে বলা যায় পদ্য কাব্যের অনুপ্রেরণা না থাকলে গদ্য কাব্যের এমন ছন্দবদ্ধ সুসজ্জিত মাধুর্য প্রকাশ পেত না। পদ্যেই হউক অথবা গদ্যেই হউক ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম।’ পাশ্চাত্য সমালোচকগণ কথাস্তরের গদ্য সাহিত্যকে Prose Romance বলেছেন। পরবর্তী আধুনিক বাংলা সাহিত্যে যা ‘রসন্যাস’, অর্থাৎ আধুনিক সাহিত্যে উপন্যাস ও ছোটগল্পের মধ্যে সংস্কৃত সাহিত্যের কথা ও আখ্যায়িকার প্রভাব সুস্পষ্ট। কোন কোন পাশ্চাত্য পণ্ডিত যেমন—Peterson গ্রীক গদ্য কাব্যের প্রভাবে সংস্কৃত গদ্য কাব্য প্রভাবিত এইরূপ মত পোষণ করেন। আবার Levy- র মতে গ্রীক ও ল্যাটিন গদ্য কাব্য সংস্কৃত গদ্য কাব্য থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধারার। তাঁর মতে গ্রীক ও ল্যাটিন গদ্যে মূল আখ্যান-ভাগের উপরে অধিক মনোনিবেশ করা হয়। কিন্তু সংস্কৃত গদ্য সাহিত্য সমূহের ক্ষেত্রে রচনার মূল আখ্যান ভাগের প্রতি লেখকেরা প্রায়ই উদাসীনতা দেখিয়ে প্রকৃতির বর্ণনা, অলঙ্কার পরিপাট্য ইত্যাদির প্রতি অধিকতর যত্নশীল হয়ে থাকেন।
আমরা প্রাচীন যুগের গদ্য সাহিত্যের প্রকাশ প্রসঙ্গে অধ্যায়ের শুরুতে আলোচনা করেছি, অতএব বাণ, দণ্ডী ও-সুবন্ধুর পূর্বেও গদ্য সাহিত্য বর্তমান ছিল। অতএব গদ্য সাহিত্যাকাশে এরা পুরোধা নন, কিন্তু বর্তমানে সেগুলি নামেমাত্র বেঁচে আছে। তার কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনও বলতে শোনা যায় যে পরবর্তী কালীন বাণ, দণ্ডীও সুবন্ধুর যশের নিকট সেই সমস্ত সাহিত্য ম্লান হয়ে ক্রমশঃ বিলীণ হয়ে গেছে। গদ্য কাব্য মধ্যে যে সমস্ত কাব্য বিদ্যমান তন্মধ্যে দণ্ডাচার্য্যের দেশ- কুমারচরিতই প্রাচীন বলে প্রসিদ্ধ।
দণ্ডী
গদ্যকাব্য রচনায় দণ্ডী, সুবন্ধু ও বাণভট্ট এই তিনজনই অসাধারণ কৃতিত্ত্ব প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে অবিস্মরণীয় কীর্তির সাক্ষ্য রেখে গেছেন। দণ্ডীর তিনখানি গ্রন্থের পরিচয় পাওয়া যায়। সেইহেতু রাজশেখর বলেছেন-
“ত্রয়ো দণ্ডি প্রবন্ধাশ্চ ত্রিষু লোকেষু বিশ্রুতাঃ।”
সেগুলি যথাক্রমে—’দশকুমারচরিত’, কাব্যাদর্শ ও ‘অবস্তিসুন্দরী কথা’। এছাড়াও কাব্যাদর্শ উল্লিখিত ‘ছন্দোবিচিতি’ এবং ‘দ্বিসন্ধান’ নামক গ্রন্থের রচয়িতা হিসাবে কেহ কেহ দণ্ডীকেই স্মরণ করেছেন। অন্যান্য বহু সংস্কৃত কবিদের ন্যায় দণ্ডীর আবির্ভাব কাল সম্বন্ধেও কোন সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। কবি তাঁর অবন্তীসুন্দরী কথায় সামান্য কিছু আত্মপরিচয় দিয়েছেন। সেই অনুযায়ী তিনি কবি দামোদর (পাঠান্তরে ভারবি)-এর প্রপৌত্র ছিলেন। মাতা গৌরী দেবী ও পিতা কাঞ্চীনিবাসী বীরদত্ত। তাঁদের বংশ ছিল কৌশিক গোত্রীয় ব্রাহ্মণ বংশ। শৈশবে পিতৃমাতৃহীন দণ্ডী শ্রুত ও সরস্বতী নামে দুইজনের নিকট লালিত পালিত হয়।
“স বাল এর মাত্রা চপিত্রাচাপি ব্যযুজ্যতে।
অযুজ্যত গরীয়স্যা সরস্বত্যা শ্রুতেন চ।।”
প্রচলিত কিংবদন্তী ও লোকশ্রুতি অনুযায়ী কবি সম্বন্ধে আরও কিছু ধারণা পাঠক সমাজে প্রচলিত আছে। যেমন কবি দণ্ড্যাচার্যের পূর্বপুরুষগণের আদি নিবাস ছিল গুজরাটের আনন্দপুরে। বহু পরে দক্ষিণ ভারতের কাঞ্চীতে বসবাস শুরু করলে পল্লবরাজদের আনুগত্য লাভে সমর্থ হন। ৬৫৫ খ্রিঃ চালুক্যরাজ বিক্রমাদিত্য কাঞ্চী আক্রমণ করেন এবং পল্লবরাজ পরাজিত হন। স্বাভাবিক ভাবেই কাঞ্চীদেশে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। রাজনৈতিক অরাজকতার ফলে কবি দণ্ডী সেই দেশ পরিত্যাগ করে ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীকালে পল্লবরাজ নরসিংহ বর্মা কতক হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধৃত হলে কবি আবার কাঞ্চীতে প্রত্যাবর্তন করেন। এবং রাজার সভায় উচ্চপদে আসীন ছিলেন। সম্ভবতঃ ৬৩০-৬৬৮ খ্রিঃ পর্যন্ত্য। আলোচ্য ঐতিহাসিক তথ্যানুযায়ী কবি দণ্ডীকে সপ্তম শতাব্দীর কবি বলা যায়। দণ্ডী তাঁর কাব্যাদর্শ নামক গ্রন্থে আনুমানিক ৭ম শতাব্দীর আলঙ্কারিক ভামহ এবং প্রবরসেনের সেতুবন্ধ এর নাম উল্লেখ করেছেন। রাজতরঙ্গিনী অনুযায়ী যদি খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী প্রবরসেনের কাল বলে বিবেচিত হয়। তাহলে ষষ্ঠ শতকের শেষভাগে দণ্ডীর আবির্ভাব সঙ্গত। কাব্যালঙ্কার সূত্র প্রণেতা বামন দণ্ডীর সমালোচনা করেছেন। অতএব দণ্ডী ভামহ ও বামন এই দুই আলঙ্কারিকের মধ্যবর্তী সময়ে বর্তমান ছিলেন। দণ্ডীর রচনা বৈশিষ্ট্য তাঁকে বাণভট্টের পূর্ববর্তী হিসাবেই চিহ্নিত করে। বাণভট্ট ছিলেন হর্ষবর্ধনের সভাকবি। তাঁর আবির্ভাব যদি হয় সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগ তবে নিঃসন্দেহে দণ্ডীকে ষষ্ঠশতাব্দীর শেষ ভাগে অথবা সপ্তম শতাব্দীর প্রথমে স্থাপন করা চলে। এছাড়া দশকুমারচরিতের ভৌগোলিক বর্ণনানুযায়ী দশকুমারচরিত হর্ষবর্ধনের রাজত্বকাল অপেক্ষা প্রাচীন বলে প্রমাণিত হয়। এক্ষণে কেবলমাত্র আবির্ভাব কালই নহে, দশকুমার রচয়িতা দণ্ডী ও কাব্যাদর্শ রচয়িতা দণ্ডী একই ব্যক্তি কিনা এ বিষয়েও বিস্তর মতানৈক্য দেখা যায়। কেহ কেহ স্বীকার করেন ঐ দুই গ্রন্থের রচয়িতা দণ্ডী একই ব্যক্তি কারণ কাব্যাদর্শে কথা ও আখ্যায়িকার মধ্যে লক্ষণ ভেদ স্বীকৃত হয় নি। ‘দশকুমার চরিতে’ ঠিক সেই রূপ দৃষ্টি ভঙ্গি প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। আবার অনেকের মতে আলঙ্কারিক দণ্ডী যেরূপ গদ্যরীতির কথা বলেছেন দশকুমারচরিত তদপেক্ষা সম্পূর্ণ বিপরীত। অতএব এই দুই দণ্ডী পৃথক্ ব্যক্তি। এর সমর্থনে যুক্তি দেখিয়ে কেউ কেউ বলেছেন দশকুমারচরিত কবির অল্পবয়সের লেখা। কাব্যাদর্শ অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সের লেখা। অতএব পার্থক্য হওয়াই স্বাভাবিক। কেউ বা বলেন কাব্যাদর্শে যেরূপ আদর্শের কথা তিনি বলেছেন তা নিজ রচনা দশকুমারচরিতে অনুসৃত হয় নি। এ প্রসঙ্গে মনেরাখা কর্তব্য নিয়ম প্রচার করা সহজ কিন্তু, নিয়ম পালন করা কঠিন। কেহ কেহ অবন্তীসুন্দরী কথাকে দন্ডীর রচনা বলেই স্বীকার করেন না। কিন্তু রাজশেখরের উক্তি থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে ‘দশকুমারচরিত’, কাব্যাদর্শ ও অবন্তী সুন্দরী কথা’ এই তিন গ্রন্থ এক ব্যক্তি দণ্ডীর রচনা। তিনি তাঁর কাব্যাদর্শে বেদভীরীতির বিশেষ প্রশংসা করেছেন। সেইহেতু অনেকের অনুমান দণ্ডী দাক্ষিণাত্যবাসী ছিলেন। দণ্ডীর রচনাশৈলী অপেক্ষা সুবন্ধু ও বাণের রচনা বৈশিষ্ট্য অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন।
দশকুমার চরিত :—মহাকবি দণ্ডীর অনবদ্য রচনা ‘দশকুমারচরিত’ এর নামের মধ্য দিয়েই দশজন কুমার এর জীবন বৃত্তান্তের ধারণা পাঠকের মনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এইটি আখ্যায়িকা শ্রেণির কাব্য। গ্রন্থখানি অসম্পূর্ণ। হয়ত দণ্ডী দশকুমারচরিত সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন নি। অথবা তাঁর রচনার কিছু অংশ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে অন্য ব্যক্তি দ্বারা সেই অংশপূর্ণ হয়েছিল। চক্রপাণি দীক্ষিত নামক কোন এক দাক্ষিণাত্যবাসী গ্রন্থ শেষ করে প্রকাশ করেছেন। কারণ দশকুমারচরিতের আরম্ভ ও সমাপ্তি দুইই অসংলগ্ন। গ্রন্থটি পূর্বপীঠিকাতে পাঁচটি এবং উত্তর পীঠিকাতে আটটি মোট ১৩টি উচ্ছ্বাসে বিভক্ত। মূলগ্রন্থে আটটি পীঠিকাতে মোট আটজন রাজকুমারের কাহিনী পাওয়া যায়। হয়ত গ্রন্থের নামকরণের সার্থকতা বজায় রাখার জন্যই পরবর্তীকালে আরও দুই কুমারের চরিত্র যুক্ত হয়েছে। সমগ্র আখ্যান এর যদি তিনটি ভাগ কল্পনা করা হয় তাহলে ভূমিকাপর্ব, মূলপর্ব এবং খিল পর্ব মধ্যে মূলপর্বই দণ্ডী বিরচিত। বাকী দুই অংশ পরে সংযোজিত হয়েছে।
মগধরাজ রাজহংসের রাজধানী ছিল পুষ্পপুরী। মালবরাজ মানসার প্রথমে রাজহংসের নিকট পরাভব স্বীকার করলেও পরবর্তীকালে পাটলিপুত্র আক্রমণ করে রাজসিংহকে পরাজিত করতে সমর্থ হন। এর ফলে রাজ্যচ্যুত রাজহংস তাঁর তিন মন্ত্রী ধর্মপাল, পদ্মোপ্ত ও মিতবর্মার সাথে পত্নী-বসুমতী কে সঙ্গে নিয়ে বিন্ধ্যপর্বতে আশ্রয় নেন। রাজপুত্র রাজবাহনের সাথে চারজন মন্ত্রিপুত্র যথাক্রমে মিত্রগুপ্ত, মন্ত্রগুপ্ত প্রমতি ও বিশ্রুত একত্রে বড় হতে লাগলো। অপরদিকে মিথিলারাজ প্রহারবর্মা যখন রাজহংসের প্রতি সাহায্যের মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসছিলেন তখন গভীর বন মধ্যে শবর কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে তাঁর দুই পুত্র ও তাদের পরিচারিকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ভাগ্যবশতঃ সেই দুই পুত্র উপহার বর্মা ও অপহার বর্মা রাজবাহনের সাথে মিলিত হয়ে একত্রে সকল শাস্ত্র ও বিদ্যা শিক্ষা করতে থাকেন। আরও তিন মন্ত্রীপুত্ৰ যথাক্রমে পুষ্পোদ্ভব, অর্থপাল ও সোমদত্তও ভাগ্যবিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে এসে রাজবাহনের সাথে মিলিত হলে মোট দশজন কুমার একত্রে প্রতিপালিত হতে থাকলো। বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শী করে রাজবাহন তাঁদেরকে সৌভাগ্যলক্ষী অন্বেষনে দিগ্বিজয় যাত্রায় উৎসাহিত করেন। এমন সময় ব্রাহ্মণ বেশী এক কিরাতের সাথে রাজবাহনের সাক্ষাৎ হলে কিরাতের অনুরোধে তিনি সেই কিরাতের সাথে পাতালে যাত্রা করলেন।
সেখানে পাতালকন্যা কালিন্দীর সাথে কিরাতের বিবাহ বিষয়ে রাজবাহন যথেষ্ট সাহায্য করলেন। এদিকে রাজবাহনের সন্ধান করতে করতে বাকী নয়জন কুমার বিভিন্ন দিকে যাত্রা করলেন। অবশেষে রাজবাহনের সাথে একে একে তাঁদের সাক্ষাৎ হল এবং এই ভাবে দশজন কুমারের যে নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হলো সেই সব কাহিনী তারা একে একে বর্ণনা করতে লাগলেন। দশজন কুমারের অভিজ্ঞতার যে কাহিনী বর্ণিত হলো তাই আলোচ্য দশকুমার চরিতের মূল বিষয় বস্তু।
অবন্তীসুন্দরী কথা :— অবম্ভীসুন্দরীকথা’-র কবি সম্বন্ধে অনেকে দণ্ডীর নামের সাথে সংশয় প্রকাশ করেছেন কিন্তু প্রসিদ্ধ বৈয়াকরণ ও আলঙ্কারিক অপয দীক্ষিত ও প্রাচীন টীকাকারগণের সপ্রশংস উল্লেখ থেকে বলা যায়—”অবম্ভী সুন্দরী কথা’, ‘দশকুমার চরিত, এর রচয়িতা দণ্ডী। ‘অবন্তীসুন্দরী কথা’-র প্রারম্ভে কবি তাঁর আত্মজীবনীর সাথে ব্যাস, সুবন্ধু, গুণাঢ্য, শুদ্রক, ভাস, প্রবীর সেন, বাণ ও ময়ুর প্রভৃতির নাম উল্লেখ করেছেন। পণ্ডিতদের অনুমান এইটি পূর্বে দশকুমার চরিতের প্রারম্ভিক কাহিনী হিসাবে বর্ণিত ছিল যার সংক্ষিপ্ত সারই পরে পূর্বপীঠিকা বলে পরিচিত হয়। এর মূল আখ্যান ভাগ বৃহৎকথার অন্তর্ভূক্ত কোন কাহিনীর বিষয়বস্তু থেকে গৃহীত। এই গল্পে সমুদ্রদত্ত ও কাদম্বরী এবং শৌণক ও বন্ধুমতীর কাহিনীবিবৃত হয়েছে। বাণভট্টের কাদম্বরী গদ্যের সাথে এর বহুলাংশে মিল রয়েছে। এককথায় বলা যায় রচনা শৈলীর দিক দিয়ে দণ্ডী বাণভট্টকে সম্পূর্ণ রূপে অনুসরণ করেছেন। অবন্তীসুন্দরী কথায় লক্ষ্মীর বর্ণনা অতি প্রাঞ্জল।
দশকুমারচরিত পুরাতন গদ্য হলেও বহু আধুনিক উপন্যাসের উপাদান এতে বর্তমান। বাস্তবের উপর ভর করে সামাজিক চিত্রপটে রাজা, রাজপরিবার, মন্ত্রী, মন্ত্রীপুত্রের চরিত্র যেমন দেখিয়েছেন তেমনই পাশাপাশি অপ্রধান চরিত্রগুলি অর্থাৎ ধূর্তা রাজগণিকা, প্রতারক, বৌদ্ধভিক্ষু, যবন, নাবিক, ভগুজুয়ারী সন্ন্যাসী, তস্কর প্রভৃতিও অতি দক্ষতার সাথে অঙ্কিত হয়েছে। তাঁর রচনায় বিশেষতঃ সে যুগের অবক্ষয়িত মূল্য বোধ—রাষ্ট্রদ্রোহ, দাঙ্গা, খুন; জলযুদ্ধ, নারীহরণ প্রভৃতি ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রকাশ পেয়েছে। নগরজীবনের অবক্ষয়, বিলাসব্যাসন, লাম্পট্য, গণিকার প্রতি আসক্তি, ভণ্ডামির মধ্যদিয়ে যেমন প্রকাশ পেয়েছে তেমনি মানব জীবনের সৎ আদর্শ, আমোদ প্রমোদ ও আর্থিক পরিস্থিতির পাশাপাশি রাজরাজাদের শৌর্য-বীর্য, কূট কৌশল সবই পাঠকের মনকে আকর্ষণ করে। ব্যাকরণ ও কামশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্রে দণ্ডীর যে অবাধ বিচরণ ছিল তা তার দশকুমারচরিত পাঠে পাঠকমাত্রেই অবহিত হবেন। বীর, বীভৎস, করুণ, হাস্য, প্রভৃতি রসের ধারায় দণ্ডীর গদ্য ভাণ্ডার পরিপূর্ণ। দশকুমারচরিতে বৈদভী রীতিই প্রধান অবলম্বন হলেও কোথাও কোথাও গৌড়ী রীতির প্রয়োগে সমাস বহুল ওজোঃগুনের সমাবেশ লক্ষ্য করা যায়। তথাপি দণ্ডীর রচনা শৈলী কখনই পাণ্ডিত্যের ভারে ন্যুব্জ নয়। সহজ সরল প্রাঞ্জল ভাষায়, সাবলীল মনোহারী গ্রহিণীর পরিবেশনে তিনি অনন্য। দণ্ডী একজন কুশলী কথাশিল্পী। রাজশেখর দণ্ডীর তিনখানি গ্রন্থের বহুল জনপ্রিয়তার কথাই সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করেছেন। কারো কারো বিচারে বাল্মীকি ও ব্যাসের সাথে একই সরণীতে কবি দণ্ডীও কল্পিত হয়েছেন। যেমন কালিদাসের উপমা প্রয়োগ, ভারবির অর্থ গৌরব, সেইরূপ দণ্ডীর পদলালিত্য তাকে অন্যান্য কবিদের থেকে পৃথক করে রেখেছে। ললিতমধুর পদবিন্যাসে তার কাব্য হয়ে উঠত স্বর্গসুষমা মণ্ডিত। গঙ্গাদেবী তাঁর মথুরাবিজয় কাব্যে দণ্ডীর রচনাকে অমৃতের সাথে তুলনা করে বলেছেন—’আচার্য-দণ্ডিনো বা চমাচাণ্ডামৃতসম্পদাম্।
সুবন্ধু
‘বাসবদত্তা’ রচয়িতা কবি সুবন্ধু ত্রয়ীগদ্যকারের অন্যতম একজন। সংস্কৃত সাহিত্যের আধিকাংশ প্রাচীন কবিগণের ন্যায় সুবন্ধুর জীবন চরিতও আমাদের নিকট অন্ধকারাচ্ছন্ন। তবে প্রচলিত কিংবদন্তী অনুসারে কাশ্মীর নিবাসী ব্রাহ্মণ সুবন্ধু (৫ম-৭ম) শতকের কোন এক সময়ে বর্তমান ছিলেন। কবিকে বৈয়াকরণ বররুচির ভাগ্নে মনে করা হয়। তিনি বৈষ্ণব ও মীমাংসা দর্শনের প্রবক্তা ছিলেন বলেও অনেকে মনে করেন। কবি তাঁর কাব্যের মঙ্গলাচরণে, একটি শ্লোকের মধ্যে নিজেকে ‘সুজনৈকবন্ধুঃ’ বলে উল্লেখ করেছেন। বাসবদত্তার জনৈক টীকাকার শিবরাম মনে করেন সুজন নামে কবির এক ভাই ছিল। ৭ম শতকের বাণভট্ট, ৮ম শতকের বাক্পতিরক্ষা সুবন্ধুর প্রশংসা করেছেন। অতএব তাঁর পূর্ববর্তী সময়ই সুবন্ধুর কাল হিসাবে বিবেচিত হতে বাধা নেই। বামনও তাঁর কাব্যালকারে সুবন্ধুর বাসবদত্তা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
‘ন্যায়স্থিতিমিব উদ্যোতকস্বরূপম্।’
বৌদ্ধসঙ্গতিমিবালঙ্কারভূষিতাম্।
—সুবন্ধুর এই রচনাংশ প্রমাণ করে যে ন্যায় বার্তিককার উদ্যোতকর এবং ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্য ভাগে ধর্মকীর্তি রচিত বৌদ্ধ সঙ্গত্যলঙ্কার নামকগ্রন্থ বিখ্যাত বৌদ্ধ গ্রন্থের সাথে তিনি পরিচিত ছিলেন। অতএব ষষ্ঠশতাব্দীর শেষ ভাগ সুবন্ধুর আবির্ভাবকাল। পরবর্তীকালের বহু সংস্কৃত কবি সাহিত্যিক সুবন্ধুর নাম ও তাঁর রচনার প্রশংসা করেছেন। ১১৬৮ খ্রিস্টাব্দের কন্নড লিপিতে, ১২শ শতকের কবিরাজের রাঘবপাণ্ডবীয়তে, মঙ্খরচিত শ্রীকণ্ঠচরিতে সুবন্ধুর প্রশস্তি দেখা যায়। সুবন্ধু তাঁর বাসব দত্তায় আক্ষেপ করে বলেছেন যে বিক্রমাদিত্যের পর কবি ও কাব্যের পৃষ্ঠপোষকতা অন্তর্হিত হয়েছে। সম্ভবতঃ তিনি কালিদাসের কালের কথাই বলতে চেয়েছেন। সেহেতু হ্যোর্ণলের মতে ৬০০-৬১২ শতকই বাসবদত্তা কাব্যের রচনাকাল বলে মনে করা হয়। অধ্যাপক A. B. Keith সপ্তম শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোন এক সময়কে সুবন্ধুর কাল বলেছেন। Subandhu must be placed in the second quarter of the seventh century and that he was only a contemporary of Bana whose work came to fruition before Banas.
বাসবদত্তা :—সুবন্ধু রচিত ‘বাসবদত্তা’ কথাকাব্য। অতি পরিচিত উদয়নকথার সাথে এই কাহিণীর কোন সাদৃশ্য নেই, সম্পূর্ণ ভিন্ন। নায়িকার নাম এই কাহিনীতে ‘বাসবদত্তা’। কন্দপকেতু ও বাসবদত্তার প্রণয় কাহিনীই এই গল্পের মূল বিষয়। রাজা চিত্তামণির পুত্র কন্দপকেতু স্বপ্নদৃষ্টা পরমাসুন্দরী রাজকুমারীর সন্ধানে বন্ধু মকরন্দকে সাথে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন। অপরদিকে পাটলীপুত্রের কুসুম পুরবাসী রাজকন্যা বাসবদত্তা স্বপ্নে দেখা রাজকুমারে উদ্দেশ্যে তার সখী তমালিকাকে প্রেরণ করলেন। পথিমধ্যে কন্দপকেতু এক বৃক্ষতলে বিশ্রামরত অবস্থায় এক শুকদম্পতীর কথোপকথন থেকে জানতে পারে বাসবদত্তার স্বপ্নসংবাদ ও তমালিকাকে রাজকুমারের উদ্দেশ্যে প্রেরণের কথা। ইতিমধ্যে বাসবদত্তার পিতা শৃঙ্গার শেখর তাঁর মানোনীত এক রাজকুমারের সাথে মেয়ের বিবাহ স্থির করেছেন। ঘুরতে ঘুরতে একসময়ে কন্দৰ্প- কেতুর সাথে তমালিকার সাক্ষাৎ ঘটলো এবং উভয়ের আলাপে ও পরামর্শ ক্রমে কন্দপকেতু সবান্ধবে পাটলিপুত্রের কুসুমপুরে এসে উপস্থিত হলেন। তমালিকার গোপন চক্রান্তে কন্দপকেতু বাসবদত্তার সাথে মিলিত হলেন। এর ফলস্বরূপ কন্দপকেতু অশ্বারোহনে বাসবদত্তাকে সঙ্গে নিয়ে পাটলিপুত্র ত্যাগ করে স্বদেশ অভিমুখে যাত্রা করলেন। পথশ্রমে ক্লান্ত অবসন্ন বাসবদত্তা বিশ্রামরতা, তাকে একাকী রেখে কন্দপকেতু বনমধ্যে প্রবেশ করলেন ফল ইত্যাদি আহার অন্বেষণে। ঘুমন্ত রাজকুমারীকে একলা দেখে তথায় দুই ব্যাধের মনে তাকে ভোগ করার কামনা জেগে উঠল। ফলে উভয়ের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ বাঁধে। উভয়েই প্রাণ হারায়। ভীত সন্ত্রস্ত অসহায় বাসবদত্তা নিকটবর্ত্তী এক ঋষির আশ্রমে আশ্রয় নেয়। ঋষির আশ্রমের পরিবেশ নষ্ট হওয়ায় ও কিরাতদ্বয়ের মৃত্যুর উপলক্ষ্য হিসাবে ঋষি বাসবদত্তাকে দায়ী করেন ও তাঁকে অভিশাপ দেন। ঋষির অভিশাপে বাসবদত্তা প্রস্তরমূর্তি ধারণ করে। এদিকে কন্দৰ্প- কেতু বাসবদত্তাকে না খুঁজে পেয়ে মনের দুঃখে আত্মহত্যা করতে উদ্যত হলে দৈববাণী শুনতে পায় যে অচিরেই তুমি তোমার প্রেমিকাকে খুঁজেপাবে। বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে বাসবদত্তার অনুকরণে পাষাণ মূর্তি দেখে আবেগে দিশেহারা হয়ে জড়িয়ে ধরলে তার হাতের স্পর্শে বাসবদত্তা পুনরায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। প্রেমিক প্রেমিকার পুর্নমিলনের মধ্য দিয়ে কাব্য সম্পূর্ণতা লাভ করে।
লোককথার আধারে রচিত ‘বাসবদত্তা’-র কাহিনী বৈচিত্র্য অসামান্য না হলেও কবির রচনা চাতুর্যে কথা কাব্যটি পাঠক সমাজে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। দুরূহ গৌড়ী রীচিতে রচিত শৃঙ্গাররসাত্মক কথাকাব্য বাসবদত্তায় কবি তাঁর পাণ্ডিত্যের যথাসাধ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে গৌড়ী রীতির অর্থই হল দুরূহ বাক্-বিন্যাস। সমাসবাহল্য ওজ ও কাক্তিগুণ যুক্ত রচনা। অতএব কোমল মধুর সুকুমার বৃত্তিগুলি সেখানে একেবারেই অনুপস্থিত। কবির চিরায়ত শব্দের পরিবর্তে নিত্য নূতন শব্দের প্রয়োগ, বক্রোক্তি, শ্লেষাধিক্য সুবন্ধুর রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সমালোচকগণের মতে বাসবদত্তা অতিশ্লেষ প্রধান কাব্য। বক্রোক্তি মার্গের এক প্রাচীনগ্রন্থ বলা যেতে পারে। কবিরাজের ভাষায়-
সুবন্ধুবাণভট্টশ্চ কবিরাজ ইতি ত্রয়ঃ।
বক্রোক্তিমার্গ নিপুণাশ্চতুর্থো বিদ্যতেন বা।।
বাণ ও সুবন্ধুর গল্প বলার রীতিতে যথেষ্ট মিল রয়েছে। কিন্তু সুবন্ধু আখ্যানভাগের নব নব উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিতে যেমন ব্যর্থ হয়েছেন তেমনি চরিত্র চিত্রণে খুব বেশী দক্ষতার পরিচয় দিতে সমর্থ হন নি। সেদিক থেকে বাণভট্ট সিদ্ধহস্ত। তবে বর্ণনা চাতুর্যে, দীর্ঘ সমাসবদ্ধ পদের প্রয়োগেই শুধু নয়, অলঙ্কার ও ব্যাকরণের দক্ষতাও সুবন্ধুর কাব্যে প্রদর্শিত হয়েছে। সে যুগের কবিদিগের রচনা শৈলীর এইরূপ আড়ম্বড় মাঝে মাঝে পাঠকের ক্লন্তিকর হয়। কখনও বা দুরূহ ও দুর্বোধ্য রচনা ভেদ করে তার রসাস্বাদনে পাঠক সমাজ ব্যর্থ হয়।
এত সমালোচনা সত্ত্বেও বাণভট্ট অন্যান্য পণ্ডিতদের সাথে সুর মিলিয়ে সুবন্ধুর যশোগান করেছেন। বাণ তাঁর হর্ষচরিত আখ্যায়িকায় বলেছেন-
‘কবীনামগলদ্দৰ্পো নূনং বাসবদত্তয়া’। অর্থাৎ রচনার উর্ধ্বতায় ‘বাসবদত্তা’ কবিগণের দর্প চূর্ণ করেছে। বাণ নিজ রচনা কাদম্বরীকে অতিদ্বয়ী কথা বলেছেন। অর্থাৎ গুণাঢ্যের বৃহৎকথা ও সুবন্ধুর বাসবদত্তা এই দুই কথাকে অতিক্রম করার কথাই বলেছেন।
বাসবদত্তার জগদ্ধরকৃত টীকা তত্ত্বদীপনী, প্রভাকর কৃত চূর্ণীক, রামদেবের তত্ত্বকৌমুদী বিক্রম ঋদ্ধিকৃত ব্যাখ্যায়িকা এবং শিবরাম কৃত কাঞ্চন দর্পন টীকাগুলি বিশেষ প্রসিদ্ধ।
বাণভট্ট
“গদ্যং কবীনাং নিক্ষং বদন্তি।” এই উক্তি কবি বাণভট্টের ক্ষেত্রে একান্তই যথার্থ। তাঁর হর্ষচরিত ও কাদম্বরী তাঁকে সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্যে এক অনন্য পরিচয় দান করেছে। বাণভট্ট এমন একজন ব্যক্তি যাঁর জন্ম পরিচয় ও আবির্ভাব কাল সম্বন্ধে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়। হর্ষবর্ধনের রাজত্বকাল ৬০৬–৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ, অতএব কবি বাণভট্ট সপ্তমশতাব্দীর প্রথমার্ধে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ‘হর্ষচরিত’ গ্রন্থে কবি তাঁর জীবন চরিত লিপিবদ্ধ করেছেন এবং প্রধান যশস্বী কবিগণের ও তৎকৃত গ্রন্থের উল্লেখ করেছেন। ভাস, কালিদাস, প্রবর সেনের সেতুকাব্য, সাতবাহণ, ভট্টার-হরিশচন্দ্র ও বাসব দত্তার প্রসিদ্ধি সম্বন্ধে অবহিত হওয়া যায়। বাণভট্ট কাণ্যকুব্জাধিপতি শিলাদিত্য হর্ষবর্ধনের সভাসদই ছিলেন না, বাল্যবন্ধুও ছিলেন। আমরা জানি যে হর্ষবর্ধন কেবলমাত্র রাজাই ছিলেন না। তিনি ছিলেন সুপণ্ডিত ও কবি। কাদম্বরী গ্রন্থের প্রারম্ভেও বাণভট্টের বংশপরিচয় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বাণভট্ট, বাৎসায় গোত্রসম্ভূত কুবেরের প্রপৌত্র ছিলেন। অর্থপতির পৌত্র ও চিত্রভানুর পুত্র ছিলেন। বাণভট্টের মাতার নাম মধ্য রাজদেবী। পুত্র ভূষণ বাণভট্ট। শৈশবে মাতৃবিয়োগ হলে কবি বাণভট্ট পিতার নিকট প্রতিপালিত হন, কবির মাত্র চৌদ্দবৎসর বসয়ে পিতৃবিয়োগ হলে তিনি কিঞ্চিত উৎশৃঙ্খল হয়ে পড়েন, নানা ধরনের সঙ্গীদের সাথে মেলা মেশা করে অতঃপর দেশান্তরে বিদ্যালাভ করতে যান। একসময় হর্ষবর্ধনের রাজসভায় তিনি আহুত হন এবং সাদরে গৃহীত হলে ক্রমে তিনি রাজার প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। বাণভট্টের গুরু ছিলেন ভর্ৎসু। বাণভট্টের পূর্বসূরীগণও একাধারে সুপণ্ডিত, শাস্ত্রবিদ, ও অতিশয় সজ্জন, অতিথি বৎসল ছিলেন। কবি সম্বন্ধে বহু কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। তদনুযায়ী তাঁর স্ত্রী ছিলেন অত্যন্ত কোপণ স্বভাবা তথাপি কবি ছিলেন স্ত্রৈণ স্বভাবের। তাঁর শ্বশুর ময়ূর ভট্টও কবি ছিলেন। তিনি একশত শ্লোকে ‘সূৰ্যশতক’ কাব্য রচনা করেছিলেন। অভিমানিনী কন্যার অভিশাপে পিতা ময়ূরভট্ট কুষ্টরোগাক্রান্ত হন। অতঃপর সূর্যের আরাধনায় তাঁর রোগ মুক্তি হয়। বাণভট্ট যখন হর্ষবর্ধনের রাজসভায় যোগ দেন তখন তাঁর বয়স নিতান্তই স্বল্প। কিন্তু ‘হর্ষচরিত’ রচনা করেছিলেন হর্ষ- বর্ধনের রাজত্বের অবসানের সামান্য কিছুকাল পূর্বে। কারণ হর্ষচরিত রচনা কবি তাঁর পরিণত বয়সেই করেছিলেন। এছাড়া চণ্ডীশতক নামে একখানি শতক কাব্যও বাণভট্ট রচনা করেছিলেন। হর্ষচরিত অনুযায়ী বাণের বংশপরিচয় :—
হর্ষচরিত :—আখ্যায়িকা শ্রেণীর এই হর্ষচরিত’ বাণভট্টের প্রথম রচনা। মোট আটটি উচ্ছ্বাসে সমগ্র গদ্য কাহিনী বিধৃত। তন্মধ্যে প্রথম আড়াইটি উচ্ছ্বাসে কবি তাঁর নিজ বংশপরিচয় ও তাঁর বাল্যজীবনের কথা ব্যক্ত করেছেন। অতঃপর হর্ষবর্ধনের কথা আরম্ভ করেছেন। আত্মীয় বন্ধুবর্গের অনুরোধে বাণভট্ট তাঁর বাল্যবন্ধু ও বিশেষ প্রিয়পাত্র হর্ষের জীবনী লিখতে প্রয়াসী হন। স্থানেশ্বরাধিপতি সম্রাট হর্ষবর্ধন ছিলেন পুষ্যভূতি বংশের রাজা প্রভাকরন ও রাণী যশোমতীর পুত্র। তাঁর অপর ভাই রাজ্য-বর্ধন ও ভগিনী রাজ্যশ্রী। মৌখরীরাজ গ্রহবর্মার সাথে রাজ্যশ্রীর বিবাহ হয়। প্রভাকর বর্ধনের মৃত্যু এবং রাজ্যশ্রীর বিবাহের বিস্তৃত বিবরণ দৃষ্ট হয়। কিন্তু মালবরাজ কর্তৃক গ্রহবর্মার মৃত্যু এবং রাজ্যশ্রী বন্দী হলে প্রতিশোধ পরায়ণ রাজ্যবর্ধন মালবরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন করলেন। হর্ষবর্ধন অগ্রজের অনুমতি ক্রমে সিংহাসনে বসেন। রাজ্যবর্ধন যুদ্ধযাত্রা-কালে গৌড়রাজের চক্রান্তে নিহত হলে প্রতিহিংসা বশতঃ হর্ষবর্ধনের তথায় আগমন। মালবরাজের করাগার থেকে রাজ্যশ্রী পলায়ণ করে অগ্নিতে আত্মাহুতি দিতে উদ্যত হলে ঘটনাক্রমে হর্ষের সাথে রাজ্যশ্রীর মিলন হয়। এখানেই গল্পের যবণিকা পাত হয়।
ঐতিহাসিক পটভূমিতে রচিত হলেও ‘হর্ষচরিত’ ইতিহাসকে অতিক্রম করে সাহিত্যের শৈল্পীক মর্যাদাকেই গুরুত্ব দিয়েছে। হর্ষচরিত পাঠে পাঠককে ইতিহাস অপেক্ষা কাব্য মাধুরীই আধিক প্রভাবিত করে। গল্পের শুরুতে প্রভাকর বর্ধনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যে শোক বিহ্বল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল তা কবির ভাষায় অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। রাজ্যশ্রীর বিবাহ বর্ণনায় যেরূপ আড়ম্বড় বর্ণিত তা নৃত্য-গীত- বাদ্যের সমাবেশে যেন আরও অধিক মাত্রায় মনোহারী রূপে বর্ণিত হয়েছে। কবি যে শাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যায় দিবাকর মিত্রের আশ্রমে সর্বধর্মের সমাবেশ বর্ণনার মধ্য দিয়ে, এতদ্ব্যতীত বিন্ধ্যপর্বতের বর্ণনা, সন্ধ্যা বর্ণনা, যুদ্ধ বর্ণনায় কবির অসামান্য পাণ্ডিত্যের প্রতিফলন ঘটেছে। শব্দের সুরমূর্ছনায়, অলঙ্কারের আতিশয্যে, চরিত্র চিত্রনে কল্পনার রঙীন অথচ মধুর অনুভূতিতে, বর্ণনার বিচিত্র উপকরণে কবির কবিত্ব শক্তির পরিচয় সুস্পষ্ট। কোন কোন স্থানে জাগুণের প্রাধান্য, বর্ণনার ঘনঘটা, দীর্ঘসমাসবদ্ধ পদের সমাবেশ যে তাঁর রচনাকে ভারাক্রান্ত করেনি একথা বলা যায় না, তথাপি শান্ত সমাহিত বিষয় বর্ণনায়, প্রকৃতির নিখুঁত মাধুরী চিত্রণে সরল, সহজ প্রাঞ্জল ভাষা ও হৃদয়মথিত আবেগের সূক্ষ্ম অথচ দৃঢ় বলিষ্ঠ আবেদনই তাঁর কাব্যপ্রতিভার মূলধন স্বরূপ। এর মধ্য দিয়ে তাঁর সার্থক কবিসত্ত্বা অনুরণিত হতে দেখা যায়। ‘হর্ষচরিত’ যেন হঠাৎ করে সমাপ্ত হয়েছে বলে মনে হয়। বোধকরি মহামতি হর্ষের জীবনবৃত্তান্ত একজন কবির পক্ষে বর্ণনা করা অসম্ভব ছিল, সেই কারণে কয়েকটি বিশেষ দিকের প্রতি বাণ আলোকপাত করেছেন।
কাদম্বরী :— ‘কাদম্বরী’ নামক কথা কাব্য বাণকে যথার্থ কবি রূপে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘কাদম্বরী’ গুণাত্যের বৃহৎকথার কাহিনী অবলম্বনে রচিত। কারুর মতে ‘কাদম্বরী’ কবি বাণভট্টের স্বতন্ত্র কল্পনার ফসল, অথবা কবিরই প্রচ্ছন্ন আত্মকাহিনী। অপর মতানুযায়ী যদি তিনি বৃহৎকথা থেকে কাহিনীর মূল বিষয় আহরণ করে থাকেন তবে সেই কঙ্কালসার বিষয়ে তিনি মেদ—মাংস—মজ্জার যথাযথ প্রয়োগে তাকে চিন্ময়ীরূপ দান করে অসাধারণ কবিত্বশক্তির পরিচয় দিয়েছেন। বাণভট্ট ‘কাদম্বরী’ রচনাকালে পরলোক গমন করলে কবিপুত্র ভূষণভট্ট কাদম্বরী কাব্যটিকে সম্পূর্ণ রূপ দান করার দায়িত্ব নিজ স্কন্ধে তুলে নেন। তিনি বলেছেন যে—পিতার মৃত্যুর সাথে সাথে তাঁর অসমাপ্ত বাক্যের ন্যায়ই তার কথাকাব্য অসমাপ্ত অবস্থায় বিচ্ছিন্ন হল। কাদম্বরী কথা সমাপ্ত না হওয়ায় সাহিত্য রসিকদের যার পর নাই দুঃখ দেখে আমি এই কাব্য সম্পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে পুনরায় লিখতে শুরু করেছি। অতএব এই কাজে স্বকীয় কবিত্বের কোন অহঙ্কার নেই।[৫]
কাদম্বরীর কাহিনী পূর্বার্ধ ও উত্তরার্ধ এই দুটি ভাগে বিভক্ত। পূর্বার্ধ পর্যন্ত্য বাণভট্টের রচনা। উত্তরার্ধ পুত্র ভূষণভট্টের রচনা।
পূর্বার্থের কাহিনী—বিদিশাধিপতি শূদ্রকের রাজ সভায় অপরূপা সুন্দরী এক চণ্ডালকন্যা কর্তৃক পিঞ্জরাবদ্ধ এক শুকপাখির আগমনে গল্পের শুরু। শুকপাখী তার জীবনবৃত্তান্ত বলতে শুরু করল। মানুষের ভাষায় কাদম্বরী কাহিনীর বক্তা হল এই শুকপাখীটি। অত্যন্ত করুণ সে কাহিনী। শুকের পিতা তাকে লালন পালন করত। বিন্ধ্যাটবীর বনে নিষ্ঠুর ব্যাধের হাতে তার পিতার মৃত্যু হলে অসহায় শুক জাবালি মুনির পুত্র হারীতের দ্বারা লালিত পালিত হয়।
জাবালি তাকে তার পূর্বজন্মের কথা শোনান—পূর্বজন্মে পাখিটি বৈশম্পায়ন ছিল। এবং শূদ্রক ছিলেন চন্দ্রাপীড়। উজ্জয়িণীর রাজা তাড়াপীড়ের পুত্রই হলেন চন্দ্রাপীড়। তাড়াপীড়ের মন্ত্রী শুকনাসের পুত্র হলেন বৈশম্পায়ন। চন্দ্রাপীড় বন্ধু বৈশম্পায়ন সহ মাতৃদত্ত পরিচারিকা পত্রলেখাকে সঙ্গে নিয়ে দিগ্বিজয়ে বার হলেন। প্রথমে তারা হেমকূট পর্বতে কিরাতদের দূর্গ অধিকার করলেন। অতঃপর ইন্দ্রায়ুধ অশ্বে চড়ে যেতে যেতে হিমালয়ের পাদদেশে কিন্নর মিথুনের পশ্চাৎ অনুসরণ করতে করতে যুবরাজ চন্দ্রাপীড় অচ্ছোদসরসী নামে এক অতীব রমনীয় সরোবরের তীরবর্তী নির্জন অরণ্যে উপস্থিত হলেন। তথায় এক শিবমন্দিরে বীণাবাদনরতা অসাধারণ রূপলাবণ্যের অধিকারিণী গন্ধর্বরাজকন্যা তপস্বী মহাশ্বেতা দেবীর স্বর্গীয় সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি আকৃষ্ট হলেন।
চন্দ্রাপীড় কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হয়ে মহাশ্বেতা তাঁর আপনপরিচয় ও জীবনবৃত্তান্ত বর্ণনা করতে লাগলেন। একদিন মহাশ্বেতা তার জননীসহ অচ্ছোদ সরোবরে অবগাহন করতে গেলে লক্ষ্মীর মানস-পুত্র পুণ্ডরীকের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। উভয়ে প্রথম দর্শনেই পরস্পরের প্রতি যার পর নাই আকৃষ্ট হলেন এবং বাড়ি ফিরেও মহাশ্বেতা পুণ্ডরীকের বিরহে দিশাহারা বোধ করতে থাকলেন। সখী তরলীকার সাথে অচ্ছোদ সরোবরে প্রণয়ীর সাথে মিলনের আশায় গেলে দেখলেন যে ততক্ষণে বিরহব্যাথা সহ্য করতে না পেরে পুণ্ডরীক প্রাণত্যাগ করেছেন। এই দৃশ্যে দিশাহারা হয়ে পাগলের মত মহাশ্বেতাও প্রেমিকের চিতায় ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত এমন সময় দৈববাণী হল— ‘মহাশ্বেতা ধৈর্য্য ধর, একদিন তোমাদের মিলন হবে। সেই সময় থেকেই মহাশ্বেতা ব্রতচারিণী হয়ে তপস্যারত অবস্থায় অপেক্ষমানা। মহাশ্বেতার অভিন্নহৃদয়া সহচরী হলেন কাদম্বরী। কাদম্বরী মহাশ্বেতার দুঃখে কাতর, তাঁর প্রতিজ্ঞা হল মহাশ্বেতার বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত্য সেও বিবাহ করবে না। মহাশ্বেতার অনুরোধে রাজা চন্দ্রাপীড় অপরূপা সুন্দরী কাদম্বরীর সাথে সাক্ষাৎ করলে পরস্পর প্রেমাসক্ত হন। মহাশ্বেতার প্রচেষ্টায় তারা উভয়ে পুনরায় মিলিত হলেন। কিন্তু পিতার আদেশ অনুযায়ী চন্দ্রাপীড়কে রাজধানীতে ফিরে যেতে হল। কিছুদিন পরে পত্রলেখা দেশে ফিরে কাদম্বরীর মর্মান্তিক বিরহ বেদনা ব্যক্ত করলে চন্দ্রাপীড় অতিশয় ব্যথিত হলেন। পত্রলেখার মুখে কাদম্বরী কথা বর্ণনা কালেই কবি বাণভট্টের মৃত্যু হয়। অতএব এই খানেই কবিরচিত কাদম্বরী কথায় ছেদ পড়ে।
উত্তরাষ্ট্রের কাহিনী কবিপুত্র কর্তৃক এইভাবে বর্ণিত। কাদম্বরীর জীবন হানির আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে কেয়ূরক, মেঘনাধ ও পত্রলেখাকে রাজা কাদম্বরীর নিকট প্রেরণ করে পথে একবার শিবিরে বন্ধু বৈশম্পায়নকে দেখতে গেলেন। সেখানে গিয়ে মহাশ্বেতার কাছে জানতে পারলেন বৈশম্পায়ন কামাসক্ত হয়ে মহাশ্বেতাকে উপভোগ করতে চাইলে মহাশ্বেতার অভিশাপে সে শুক পক্ষীতে পরিণত হয়েছে। বন্ধুর এইরূপ মর্মান্তিক পরিণতি সহ্য করতে না পেরে চন্দ্রাপীড় প্রাণত্যাগ করলেন। এদিকে কাদম্বরী চন্দ্রাপীড়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে এসে এই সমস্ত দেখে অত্যন্ত বিরহে ‘মাত্মত্যাগে উদ্যত হলে দৈববাণী হলো যে-মহাশ্বেতা ও তুমি অবিলম্বে তোমাদের ১ Jয়জনের সাথে মিলিত হবে। বৃদ্ধ তাড়াপীড় ও মন্ত্রী শুকনাস সস্ত্রীক পুত্রদের সন্ধানে এসে যখন চন্দ্রাপীড় ও বৈশম্পায়নের সাক্ষাৎ পেলেন না, তখন তাঁরা মনের দুঃখে বনবাসী হলেন। জাবালির মুখ নিসৃত এইরূপ পূর্বকাহিনী অবগত হয়ে মহারাজ শূদ্রক এবং শূকপক্ষীর পূর্বস্মৃতি ফিরে এল। তাদের জীবনাবসান হলে চন্দ্রাপীড় পুনরায় প্রাণ ফিরে পেয়ে কাদম্বরীর সাথে মিলিত হলেন এবং বৈশম্পায়নও পুণ্ডরীকরূপে জন্ম নিয়ে প্রিয়তমা মহাশ্বেতার পাণি-প্রার্থী হলেন। রাজধানীতে তারা সস্ত্রীক ফিরে এলে পুণ্ডরীকের—উপর রাজ্যভার অর্পণ করে চন্দ্রাপীড় সস্ত্রীক কখনো পিতামাতার সেবায়, কখনো হেমকূট পর্বতে, কখনো বা চন্দ্রালোকে অথবা কাদম্বরীর ইচ্ছানুক্রমে রমণীয় স্থানে বিহার করে সুখে কালাতিপাত করতে থাকলেন। তিন জন্মের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে অমর প্রেমের কাহিনী। সেই কারণে কাদম্বরীর আখ্যান ভাগ কিছুটা জটিল বোধ হয়।
কাদম্বরী বাণভট্টের সর্বশ্রেষ্ঠ গদ্য কাহিনী। আখ্যানভাগের মূল বিষয়কে অতিক্রম করে কবি প্রতিভা বিচ্ছুরিত হয়ে কাব্যকে এক অনন্যসাধারণ মাত্রা দান করেছে। কাদম্বরী শব্দের অর্থ মদিরা বা সুরা। সুরা পানে যেরূপ মানুষ আহার নিদ্রা ভুলে মাদকতায় মত্ত হয়ে ওঠে সেইরূপ বিদগ্ধ পাঠকসমাজ কাদম্বরী কথা পাঠ করে তার রসাস্বাদন করে এক অসাধারণ আবেগে মত্ত হয়ে উঠে আহার-নিদ্রা ভুলে আনন্দের জোয়ারে ভেসে যান।—সেই হেতু যথার্থই বলা হয়ে থাকে—”কাদম্বরী রসজ্ঞানামাহারোঽপি ন রোচতে।” অতএব সেইদিক থেকে বিচার করলে কাদম্বরী নামেরও সার্থকতা রয়েছে, এছাড়া নায়িকার নামও এখানে কাদম্বরী। বাণভট্ট তাঁর সামান্য কয়েকটি রচনার মধ্য দিয়েই আমাদের হৃদয়ে চির অমর হয়ে আছেন। বাণের বর্ণনা শক্তি তুলনাহীন। রূপ—রস—গন্ধ—স্পর্শের অফুরন্ত বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তাঁর বিষয় বর্ণনা যেন অসামান্য। চিত্রের পৃষ্ঠে চিত্র, ভাবের উপর ভাবের সংযোজনে তিনি যেন অক্লান্ত কর্মী। এমন কোন্ তথ্য বা তত্ত্ব সেখানে বর্ণিত না হয়েছে যা কিনা জগত্ত জীবনের সীমায় ধরা পড়ে। অর্থাৎ তিনি সাধারণ ও বিশেষ সকল প্রকার বিষয়কেই সমান গুরুত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। বৈচিত্র্যপূর্ণ কাব্য সম্ভারে কাদম্বরীর শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত। প্রকৃতির বর্ণনা থেকে শুরু করে চরিত্র চিত্রণে, ভাবের গাম্ভীর্যে, বিরহ মিলনে কাদম্বরীর বিরহ যন্ত্রণায়, মহাশ্বেতার শুচিতায় তিনি অফুরন্ত বর্ণনা শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। জীবন ও জগৎ জুড়ে সৌন্দর্য্যের যে অনন্ত ধারা প্রবাহিত কবি তাকে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের মুক্ত বাতায়নের পথে শুধু অনুভবই করেননি, হৃদয়ে ধারণ করেছেন, তাতে অবগাহন করেছেন, তা কাদম্বরীর পাঠক মাত্রেই অবগত আছেন। সেইহেতু যথার্থই বলা হয়েছে—’বানোচ্ছিষ্টং জগৎ সর্বম্। কাদম্বরী কাব্যের রচনাশৈলী মূলতঃ পাঞ্চালী রীতির অনুসারী। আলঙ্কারিক বামনের মতে— “মাধুর্য সৌকুমার্যোপপন্না পাঞ্চালী।” বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গার রসাত্মক কাদম্বরীতে ক্ষেত্র বিশেষে বীর, করুণ, হাস্য ও অন্যান্য রসেরও সমন্বয় ঘাটছে, কেউ কেউ কাদম্বরীতে গৌড়ী রীতির প্রাধান্যের কথা বলেছেন। সমাসবহুল গৌড়ী রীতিতে ওজঃ গুণের সমৃদ্ধি যেন গদ্যের প্রাণস্বরূপ ‘ওজঃ সমানভূয়ত্ত্বমেতদ্ গদ্যস্য জীবিতম্।’ আবার কোমল বৈদভী রীতিও অনুসৃত হয়েছে উপদেশ ও কথোপকথন প্রসঙ্গে।
বাণের প্রশংসা করে বহু কবি, আলঙ্কারিক ও সাহিত্য সমালোচকেরা নানা স্তুতিবাক্য বলেছেন। বিদগ্ধমুখ মণ্ডনের কবি ধর্মদাস সূরি বাণের সুমধুর রসসিক্ত বাণীর প্রশংসা করে বলেছেন—
“রুচিরস্বরবর্ণপদা রসভাববতীজগম্মনোহরতি।
তৎ কিং তরুণী ন হি ন হি বাণী বাণস্য মধুরশীলস্য।”
বাগদেবীর সাথে তাঁর বাস্ফুরণের তুলনা করে গোবর্ধনাচার্য বলেছেন——বাণী বাণো বভূবেতি।’
মহিলাদেবী গঙ্গাদেবীর ভাষায়-
“বাণীপানি পরামৃষ্ট বীণানিক্কান হারিনীম্।,
ভাবয়স্তি কথং বাণ্যে ভট্টবাণস্য ভারতীম্।”
জয়দেব বাণের প্রশংসায় বলেছেন—হৃদয়বসতিঃ পঞ্চবাণস্ত বাণঃ। বাণ নামক পঞ্চশর মদনই কবিতাকামিনীর হৃদয়ে বাস করেন। কবি, সাহিত্য সমালোচনার এই সমস্ত স্তুতি কখনই ভাবের উচ্ছ্বাস নয়, এসবই হল তাঁদের হৃদয়স্থিত অনুভূতি ও গভীর বোধের বহিঃপ্রকাশ।
কিন্তু দোষবর্জিত নিরবিচ্ছিন্ন গুণের আধার রূপেও বাণকে কল্পনা করা যায় না। পাশ্চাত্য পণ্ডিতগনের মতে বাণের রচনা বহু দোষে দুষ্ট। কবি তাঁর গদ্যরচনার সময় এমনই নিবিষ্টচিত্তে মগ্ন হয়ে থাকেন যে কোন বিষয়ে বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি মুক্ত বিহঙ্গের মত দূর দেশে পাড়ি দিয়ে নিজেই যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। ফলে পূর্বের স্থানে বা মূল কাহিনীতে ফিরে আসতে পাঠককে অস্বস্তিতে পড়তে হয়। এছাড়া সমাসবদ্ধ দীর্ঘপদ, অলঙ্কারের আতিশয্য, ব্যাকরণ জ্ঞানের পরিচয় প্রদান, দ্ব্যর্থক শব্দচয়ন ইত্যাদির প্রতি অত্যন্ত আগ্রহ থাকায় স্থানে স্থানে রচনা দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে এবং পাঠকের মনে রসাস্বাদনের আকাঙ্খা তো দূরের কথা রীতিমত ভীতির সঞ্চার করে। বাণের রচনায় আমার বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় পাই। তিনি একটি মূল আখ্যানভাগের আধারে যে আরও কত ছোট ছোট কাহিনী একত্রে রচনা করতে পারেন। কাদম্বরী তাঁর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। কিন্তু বাণভট্টের কাব্য-শৈলীর বহুগুণাগুণ থাকা সত্ত্বেও একটি মারাত্মক দোষ হল তিনি সকল বিষয়েই মাত্রা অতিক্রম করে যান। সীমাজ্ঞান না থাকার ফলে তাঁর রচনা সুধী পাঠকের নিকট সময় সময় ক্লান্তিকর ও দূর্বোধ্য বোধ হয়। জার্মান সমালোচক Weber বলেছেন বাণভট্টের রচনা যেন ভারতের শ্বাপদ সঙ্কুল অরণ্যের সাথেই তুলনীয়। বাণের কাব্য কাননে পুষ্প সম্ভারের অপ্রাচুর্য নেই, কিন্তু তাতে প্রবেশ করাই ছিল দুষ্কর। অধ্যাপক Keith এর মতে— The demerits of Banas as stylist are deprosable. বাণের অর্ন্তদৃষ্টি ছিল অত্যন্ত সুক্ষ্ম। তিনি বহু দেশ ঘুরেছেন, বহু মানুষের সান্নিধ্যে এসেছেন। সেই হেতু তাঁর জীবন দর্শন-বোধ পাণ্ডিত্যের সাথে মিলিত হয়ে এক অপূর্ব বর্ণনা ক্ষমতার জন্ম দেয়। কিন্তু সেই বর্ণনা সীমালঙ্ঘন করায় তার মাহাত্ম্য হারায় সেই হেতু Dasgupta & De বলেছেন-His choice of subject may be good, but his choice of scale is fatal.
মনে রাখতে হবে যে যুগে কবি বাণভট্ট গদ্যরচনা করেছিলেন যে যুগ কিন্তু ছিল কাব্যে পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের যুগ। দীর্ঘসমাস যুক্ত পদ, অলঙ্কারের ঘনঘটা, শব্দ চাতুর্য বিশেষতঃ ওজগুণের প্রাধান্য তৎকালীন সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করত। সেই দিক থেকে বিচার করলে রাজসভায় রাজা ও সুপন্ডিত সভাসদগণের রুচি অনুযায়ী অর্থাৎ তাঁদের মনোরঞ্জনের জন্যই কাব্য রচিত হত। অতএব ব্যস্ত জনজীবনে অথবা সাধারণ পাঠকের বোধের সীমায় ধরা না পড়লেও ‘কাদম্বরী’ হলো সংস্কৃত সাহিত্যের অনবদ্য সৃষ্টি। গদ্য সাহিত্যের ত্রয়ী সুবন্ধু, দণ্ডী ও বাণভট্ট যে শিল্পের নিদর্শন প্রবর্তন করেছেন, সেই পথ অনুসরণ করেই পরবর্তী গদ্যকারেরা গদ্য রচনায় প্রয়াসী হয়েছেন। বাণকে অনুসরণ করে, কাদম্বরীর অনুকরণে পরবর্তীকালে শ্বেতাম্বর জৈন ধনপাল (১০১ শতকে) তিলক মঞ্জুরী নামক কাব্য প্রণয়ন করেছিলেন। বাণকে অনুসরণ করতে গিয়ে বাণের দোষ ত্রুটিগুলি সবই অনুসৃত হয়েছে কিন্তু বাণের গুণগুলি এককথায় যেন অনুপস্থিত।
ওডয়দেব আনুমানিক ১২শঃ শতকে গদ্যচিন্তামণি রচনা করেছেন। এই গদ্য কাহিনী অনুকরণ সর্বস্ব হলেও পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। তবে গদ্য অপেক্ষা পদ্য সৃষ্টিতেই কবির সাবলীলতার পরিচয় পাই। বামনভট্টবাণের বেমভূপালচরিত নামক গদ্যকাব্য। কবির আসল, নাম বামন। তিনি বাণভট্টের সাথে প্রতিযোগীতার মনোভাব নিয়েই কাব্য রচনায় প্রয়াসী হয়েছিলেন। সেইহেতু বামণভট্টবাণ নাম ধারণ করেছেন। আবার বাণভট্ট যেরূপ আপন পৃষ্ঠপোষক রাজাহর্ষের জীবন চরিত রচনা করেছেন, কবি বামনও তাঁর নিজ পৃষ্ঠ পোষক রাজা বেমভূপালের জীবন চরিত রচনা করেছেন। এছাড়া বিশ্বেশ্বর প্রণীত মন্দারমঞ্জুরী নামক গদ্যকাব্য। সোলের উদয়সুন্দরী কথাও অনুকরণ সর্বস্ব রচনা। পরবর্তী গদ্যকারগণ সকলেই নির্বিচারে গদ্যকার ত্রয়ীর অনুকরণ করে গেছেন। গতানুগতিক পথ পরিহার করে স্বতন্ত্র পথে হাঁটার কোন প্রচেষ্টা তাঁদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না।
গল্পসাহিত্য
যুগে যুগে মানুষ গল্প শোনার প্রতি এক দুর্নিবার আকর্ষণ বোধ করে এসেছে। জীবনের নানা জটিলতার মধ্যেও মানুষ তার বিনোদনের অন্যতম সামগ্রী হিসাবে গল্প শোনা ও গল্প বলাকে বেছে নিয়েছে। গল্প শোনার মধ্য দিয়ে কেবল যে চিত্ত বিনোদনের কাজই হয়েছে তাই নয়, মানুষ অবসর যাপনের সাথে সাথে গল্পকে অবলম্বন করে শিশুশিক্ষার কাজও সম্পন্ন করেছে। এই গল্পবলার ভঙ্গী বা কৌশল শ্রোতার কাছে গল্পটির গ্রহণযোগ্যতাকে বাড়িয়ে তোলে। আমরা দেখেছি একই ঊর্বশী পুরুরবার কাহিনী যা নাকি ঋগ্বেদে বর্ণিত ছিল, তাই আবার মহাভারত ও পুরাণের যুগ পেরিয়ে কালিদাসের নাটকে ব্যাপ্ত হয়েছে। একই বিষয় কিন্তু নব নব গল্প কথকের হাতে পড়ে তা নব নব ভঙ্গীতে এমন ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে যা ক্লান্তিকর বা একঘেয়ে তো নয়ই বরঞ্চ আরও অনেকবেশী চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠেছে। মহাভারতের মূল বিষয় কুরু পাণ্ডবের যুদ্ধ, কিন্তু শুধুমাত্র কুরু পাণ্ডবের যুদ্ধেই যদি মহাভারতের কাহিনী সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে বোধ করি তা এত আকর্ষণীয় ও সুখপাঠ্য হত না। অজস্র আখ্যান-উপাখ্যান, কল্পকথা যেমন রাজা যযাতির উপাখ্যান, সাবিত্রীও সত্যবানের ঘটনা, বিদুলার পুত্রানুশাসন, নল ও দময়ন্তীর উপাখ্যান, জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞ, কদ্রু-বিনতার উপাখ্যান, অগস্ত্যের সমুদ্র শোষণের গল্প, রাজা শিরির উপাখ্যান এমন হাজারো ঘটনার সমাবেশ মহাভারতের শুধু কলেবরই বৃদ্ধি করেনি তাকে অনেক বেশী মনোহারী ও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।
প্রাচীনকালে রাজ রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ সংস্কৃত সাহিত্যের ক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত বিষয় ছিল। সংস্কৃত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ সুকুমার মতি যুবরাজদিগের জটিল অর্থশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে আগ্রহ জন্মাবার কৌশল স্বরূপ নানাবিধ শিক্ষামূলক গল্প রচনা করতে শুরু করলেন। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ শিক্ষামূলক গল্পের মধ্য দিয়ে রাজকুমারগণকে জীবনের নানাবিধ জটিলতার মোকাবিলা করতে শিক্ষা দিতেন। এইভাবেই গল্পসাহিত্যের আবির্ভাব, কেবলমাত্র শিশুশিক্ষার উপযোগীই নয়, গল্পসাহিত্য ছোট বড় নির্বিশেষে সকলের মন জয়ে সমর্থ। কারণ আমাদের প্রত্যেকের ভিতরেই একটি করে শিশুসুলভ মন বর্তমান। সেইহেতু গল্প শোনা আমাদের যেন সহজাত প্রবৃত্তি।
সংস্কৃত গল্পসাহিত্যের ভাষা সহজ, সরল অনাড়ম্বড়, দীর্ঘ সমাস বর্জিত। অলংকারের বাহুল্য অথবা দুর্বোধ্য ভাষার আধিক্যও চোখে পড়েনা। গল্পের ছলে যেহেতু শিশুশিক্ষার কাজ সম্পন্ন হয়েছে সেহেতু এর সাথে অর্থ ও নীতিশাস্ত্রের একটা ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে। এইরূপ গল্পসাহিত্যের দুটি ভাগ—একটি ভাগের চরিত্রগুলি মানুষরূপী অপর ভাগের চরিত্রসমূহ পশুপক্ষী ও জন্তুজানোয়ারকে অবলম্বন করে সৃষ্ট। কাকের চতুরতা, শৃগালের ধূর্ততা, ব্যাঘ্রের হিংস্রতা, গৰ্দ্দভের নির্বুদ্ধিতা প্রভৃতি। এই ধরণের চরিত্র সৃষ্টির ফলে গল্পগুলি শিশুমনে খুব সহজেই প্রভাব ফেলে এবং গল্পের শিক্ষামূলক যে নীতি কথা সেটিও লোক শিক্ষার কাজকে সহজ ও সুন্দর ভাবে তরান্বিত করে। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর গল্পগুলিকে একটু স্বতন্ত্র মর্যাদা দেওয়া হয়। ইংরাজীতে যাকে বলে Fables. পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা সংস্কৃত কথা ও আখ্যায়িকাগুলিকে (ক) মানবোপাখ্যান ও (খ) মানবেতর (পশুপক্ষী) জীবোপাখ্যান আখ্যা দিয়েছেন। উভয়ই কল্পনা প্রসূত। প্রাচ্যদেশের অপূর্ব কল্পনাশক্তির দ্বারা কথা সাহিত্য গুলি অনেকবেশী মনোগ্রাহী ও আকর্ষণীয় এবিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।
কথা ও আখ্যায়িকা বিষয়ে আলঙ্কারিকদিগের মতামত এই অধ্যায়ের প্রথমে গদ্য সাহিত্যের প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে।
গুণাঢ্যের বৃহৎকথা :—গুণাঢ্যরচিত ‘বৃহৎকথা’ সংস্কৃত কথাসাহিত্যের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন গ্রন্থ বলে বিবেচিত। দুঃখের বিষয় সাতলক্ষ শ্লোক সম্বলিত এই গ্রন্থ আজ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। গুণাঢ্যের রচনা আজ নামে মাত্র পর্যবসিত হওয়ায় ভারতীয় গল্পসাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে। একদা ব্যাস, বাল্মীকির সাথেই গুণাত্যের কথা আলোচিত হয়েছে। বাণভট্ট, দণ্ডী ও সুবন্ধুর কথায় আমরা গুণাঢ্যের উল্লেখ দেখতে পাই। নবম খ্রিষ্টাব্দের কম্বোডীয় লিপিতে গুণাঢ্যের উল্লেখ দৃষ্ট হয়। ক্ষেমেন্দ্রের মতে গুণাঢ্যের জন্ম গোদাবরী নদীর তীরে প্রতিষ্ঠানপুর নামক গ্রামে। অন্ধ্রবংশীয় রাজা হাল সাতবাহন বা শালিবাহন তখন রাজত্ব করতেন। সাতবাহনের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন গুণাঢ্য। কিন্তু যেহেতু সাতবাহনের রাজত্বকাল সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ধারণা পাওয়া যায় না, সেহেতু গুণাঢ্যের আবির্ভাবকালও অনুমান নির্ভর। Bhuler- এর মতে প্রথম অথবা দ্বিতীয় শতকে, কিন্তু Keith এর মতে পঞ্চম শতাব্দী। আবার Weber গুণাঢ্যকে ষষ্ঠশতকে স্থাপন করার পক্ষপাতী। আমরা জানি ভাস উদয়ন- বাসবদত্তার প্রেক্ষাপট গুণাঢ্যের বৃহৎকথা অবলম্বনে রচনা করেছিলেন, অতএব ভাসের পূর্ববর্তী। কিন্তু ভাস নিজেই যখন সমস্যায় জর্জরিত, তখন তার উপর নির্ভর করে গুণাঢ্যের কাল কতখানি গ্রহণযোগ্য হবে, তবে সুবন্ধু সপ্তমশতকে গুণাঢ্যের উল্লেখ করায় Weber কর্তৃক অনুমিত ষষ্ঠশতক কে অনেকাংশ গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা যায়।
বৃহৎকথা পৈশাচী ভাষায় রক্ত দিয়ে লেখা। এর পিছনে একটি কাহিনী রয়েছে সেটি সোমদেবের মতে নিম্নরূপঃ—কোন এক সময়ে পার্বতীর অনুরোধক্রমে মহাদেব তাকে সাতজন বিদ্যাধর চক্রবর্তীর কাহিনী শোনান। মহাদেবের অনুচর ছিল পুষ্পদন্ত ও তাঁর স্ত্রী হলেন জয়া। আড়াল থেকে সেই গল্প শুনে পুষ্পদন্ত তাঁর স্ত্রী জয়াকে আনুপূর্বিক সম্পূর্ণ গল্প শোনালে জয়া সেই গল্প সকলকে শোনায়। এই ভাবে গল্প প্রচারের ঘটনা শুনে ক্রোধে পার্বতী পুষ্পদন্তকে অভিশাপ দেন মর্তে মানুষ হয়ে জন্মাবার জন্য। পুষ্পদন্তের ভ্রাতা অনুনয় বিনয় করলে তাকেও একইভাবে অভিশপ্ত হতে হল। অতঃপর জয়ার পরিচর্যায় সন্তুষ্ট হয়ে পার্বতী বললেন শাপমুক্তি হবে। যদি পুষ্পদন্ত কণভূতি নামক পিশাচের সাক্ষাৎ পায়, তখন সাক্ষাৎ পাওয়া মাত্র তার পূর্বজন্মের কথা স্মরণ হবে, তখন সেইসব কথা কণভূতিকে বর্ণনা করলে সে মুক্ত হবে। অপরদিকে মলয়বান্ যদি কণভূতির কাছ থেকে গল্পগুলি শুনে তা পুনরায় পৃথিবীতে প্রচার করে তাহলে তারও শাপমুক্তি ঘটবে।
অভিশপ্ত পুষ্পদন্ত কৌশাম্বীতে বররুচি কাত্যায়ণ হয়ে জন্ম নিলেন। ভ্রাতা মলয়বাণ গুণাঢ্যরূপে প্রতিষ্ঠানপুরে জন্ম নিলেন। তিনি রাজা সাতবাহনের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। একদিন রাজা সাতবাহন রাজঅন্তঃপুরে রানীদের সাথে জলকেলি করছেন। এমন সময় এক মহিষী বললেন ‘মোদকৈ’ঃ (মা + উদকৈঃ) অর্থাৎ আর জল দেবেন না। কিন্তু রাজার সন্ধিজ্ঞান না থাকায় রাজা এই কথার অর্থ ভুল করে বসলেন ভাবলেন রাণী তার কাছে মিষ্টি চাইছে। নিজের সংস্কৃত ভাষাজ্ঞানের অভাব হেতু এই ঘটনায় রাজা অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হলেন। গুণাঢ্য রাজাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন ছয় বৎসরের মধ্যে তার সংস্কৃত শিক্ষা সম্পন্ন করে দেবেন। এদিকে উপস্থিত বৈয়াকরণ শরবর্মা বললেন ছয়মাসেই সংস্কৃত ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করানো সম্ভব। এই কথা শুনে গুণাঢ্য প্রতিশ্রুতি বধ্য হলেন- শরবর্মা যদি ছয়মাসে এই কাজ সম্পন্ন করে দেখাতে সক্ষম হন তবে তিনি আর কোনদিন সংস্কৃত, প্রাকৃত অথবা দেশজ কোন ভাষার ব্যবহার করবেন না। দুর্ভাগ্য- বশতঃ শরবর্মার নির্দেশানুযায়ী রাজা সাতবাহন ছয়মাসেই সংস্কৃত ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করলে গুণাঢ্য রাগে দুঃখে অপমানে মৌন অবলম্বন করে বিন্ধ্য পর্বতে প্রস্থান করলেন।
অপরদিকে বৃদ্ধ কাত্যায়নরূপী পুষ্পদন্ত তীর্থভ্রমণে এসেছেন বিন্ধ্য পর্বতে। তথায় পার্বতীর মন্দিরে পিশাচ কণভূতির দর্শন পেয়ে পূর্বস্মৃতি রোমন্থন করে আড়াল থেকে শোনা মহাদেবের গল্পগুলি সমস্ত কণভূতিকে শ্রবণ করান। ফলস্বরূপ তাঁর শাপমুক্তি ঘটল। তিনি স্বর্গে গমন করলেন। অতঃপর বিন্ধ্য পর্বতেই ভ্রমণ করতে করতে কণভূতির সাথে দুই শিষ্যসহ গুণাঢ্যের সাক্ষাৎ হয়। পার্বতীর কথা অনুযায়ী কণভূতির কাছ থেকে গুণাঢ্য সেই সমস্ত গল্প শুনলেন। গুণাঢ্যের ইচ্ছা হল এমন শ্রুতিমধুর গল্পগুলি তিনি গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করবেন কিন্তু তা সম্ভব নয়। সংস্কৃত প্ৰাকৃত ইত্যাদি ভাষা তিনি বর্জন করেছেন। অবশেষে নিজরক্ত দিয়ে সেই সব গল্প পৈশাচী ভাষায় তিনি লিপিবদ্ধ করেন। শিষ্যদের পরামর্শক্রমে সেই লেখা রাজদরবারে পাঠালে রাজা এইরূপ পৈশাচী ভাষায় লিখিত বিষয় অবজ্ঞা করে ফেরৎ পাঠান। অপমানিত গুণাঢ্য সেইসব গল্প বনের পশুপাখিদেরই পাঠ করে শোনাতে থাকেন। দেখা গেল গল্পগুলি এমনই মর্মস্পশী যে তা পশুপাখিদেরও হৃদয় স্পর্শ করে, চোখে জল আনে। আহার নিদ্রা ভুলে গিয়ে তারা গল্প শ্রবণ করে। রাজা দেখলেন শিকার করে আনা পশুপক্ষীর আর সেই রূপ হৃষ্ট পুষ্ট দেহ নাই, মাংসের যেন আর পূর্বের মত স্বাদ নাই, তখন রাজা সম্বিত ফিরে পেলেন। অনুসন্ধান করে তথায় এসে রাজা সমস্ত উপলব্ধি করে যার পর নাই অনুতপ্ত হলেন, কিন্তু গুণাঢ্য ততদিনে ছয়টি গল্পের ভাগ অর্থাৎ একলক্ষ শ্লোক সম্বলিত ছয়টি গল্প পশুপক্ষীদের শুনিয়ে অগ্নিদগ্ধ করে ফেলেছেন। অবশিষ্ট রয়েছে একলক্ষ শ্লোকে সম্পূর্ণ একটি গল্প। তাই বৃহৎকথা নামে প্রচলিত।
পরবর্তীকালে এই বৃহৎকথাকে অবলম্বন করে কাশ্মীরী পণ্ডিত ক্ষেমেন্দ্র রচনা করলেন বৃহৎকথা মঞ্জরী। বুদ্ধস্বামী রচিত বৃহৎকথাশ্লোক সংগ্রহ। কাশ্মীরী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সোমদেব কৃত কথাসরিৎসাগরও উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীর প্রাচীনতম ও বৃহত্তম গল্প সঞ্চয়ন এই কথা সরিৎ সাগর। মূল পৈশাচী ভাষাকে সংস্কৃত ভাষায় পরিবর্তিত করে সহজবোধ্য ভাবে তিনি ‘বৃহৎকথাকেই নবরূপ দান করেছেন। কথিত আছে কাশ্মীররাজ অনন্তের (১০২৯-১০৬৪ খ্রিঃ) সভাকবি ছিলেন যথাক্রমে ক্ষেমেন্দ্র ও সোমদেব। মহারানী সূর্যমতীর চিত্তবিনোদনের জন্য ২৪০০০ শ্লোকে এই কথাসরিৎসাগর রচিত হয়েছিল। এই তিনটি গ্রন্থকে একত্রে বৃহত্রয়ী নামে অভিহিত করা হয়।
বেতালপঞ্চবিংশতি :—বেতাল পঞ্চবিংশতি নামের মধ্য দিয়েই বোঝা যায় এতে পাঁচশটি গল্পরয়েছে। এই সমস্ত কাহিনীর ইঙ্গিত ক্ষেমেন্দ্র ও সোমদেবের রচনাতেও বিদ্যমান। শিবদাস এই গ্রন্থের রচয়িতা। রাজা বিক্রমাদিত্যকে একজন সন্ন্যাসী প্রতিদিন একটি করে ফল উপহার দিতেন, রাজা সেই ফলের ভিতর থেকে একটি করে রত্ন প্রাপ্ত হতেন। একসময় রাজা সন্ন্যাসীর অনুরোধে-শ্মশানের এক বৃক্ষচূড়া থেকে এক শবদেহ আনার জন্য গেলেন, সেই শবদেহকে আশ্রয় করে এক বেতাল বাস করছিল। অতঃপর যতবারই বিক্রমাদিত্য শবদেহটি নামিয়ে আনেন ততবারই বেতাল তাকে একটি করে গল্প শোনায় এবং গল্পের শেষে একটি সমস্যার সমাধান করতে বলে। রাজা যেই মাত্র সেই সমস্যার উত্তর দেন সেইমাত্র মৌনতা ভঙ্গের অপরাধে শবদেহ আবার গাছে উঠে যায় এইভাবে চলতে চলতে বেতালের পাঁচশটি গল্প বলা হয়ে যায়। ভারতের সর্বত্র সমাদৃত এই গ্রন্থটি নানা ভাষায় অনূদিত। পদ্য গদ্য মিশ্রিত একখানি সংস্করণও দৃষ্ট হয়।
পঞ্চতন্ত্র :—দাক্ষিণাত্যের অন্তর্গত মহিলারোপ্য নামক স্থানে পঞ্চতন্ত্র রচিত। মহিলারোপ্য নগরীর রাজা অমর শক্তি। তাঁর জড়ধী পুত্র দিগকে নানারূপ শাস্ত্র সম্বন্ধে অবহিত করানোর উদ্দেশ্যে গ্রন্থকার লব্ধকীর্তি ব্রাহ্মণ বিষ্ণুশর্মা এই নীতিশিক্ষামূলক গ্রন্থ পঞ্চতন্ত্র রচনা করেছিলেন। পঞ্চতন্ত্রের রচনাকাল বিষয়ে Hertel তাঁর Histoty of the Beast Fable in India নামকগ্রন্থে বিশদ আলোচনা করেছেন। পঞ্চতন্ত্রে চাণক্য এবং তাঁর অর্থশাস্ত্র জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। অধ্যাপক Keith মনে করেন পঞ্চতন্ত্র গুপ্তরাজাদের আমলে রচিত হওয়া সম্ভব। মহাকবি কালিদাসের কুমার সম্ভবের দ্বিতীয় সর্গের পঞ্চান্ন নং শ্লোকটি দৃষ্ট হয়।” অনেকে শ্লোকটি পরবর্তীকালের সংযোজন বলে মনে করেন। নচেৎ পঞ্চতন্ত্রকে কালিদাস পরবর্তী বলতে হয়। মহাভারতের ‘দীনার’ শব্দটির ব্যবহারও দৃষ্ট হয়। অতএব পঞ্চতন্ত্র প্রথম শতকের প্রারম্ভে রচিত বলা যায়।
পঞ্চতন্ত্র বহুল পরিচিত গ্রন্থ, সেইহেতু বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় এই গ্রন্থ অনুদিত। ষষ্ঠ শতাব্দীতে প্রাচীন পারসিক (পহ্লবী) ভাষায়, অষ্টম শতাব্দীতে আরবীয় ভাষায় এবং একাদশ শতাব্দীতে হিব্রু ভাষায় ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে স্পেনদেশের ভাষায় অনুবাদ করা হয়। অতঃপর ষোড়শ শতাব্দীতে ইংরাজী ভাষায় লণ্ডন থেকে প্রকাশিত হয় স্যার টমাস নর্থ-এর উদ্যোগে। এই ভাবে ক্রমশঃ সারা ইউরোপে প্রায় পঞ্চাশটি ভাষায় অনূদিত হয়ে পঞ্চতন্ত্র সকলের সমাদর লাভ করে। মুল পঞ্চতন্ত্র লুপ্ত। পঞ্চতন্ত্রের মূল আখ্যান ভাগকে প্রায় অবিকৃত রেখে রচিত হয়েছিল তন্ত্রাখ্যায়িকা। সম্পূর্ণ বিশুদ্ধতা না থাকলেও এই গ্রন্থ সর্বাপেক্ষা মূলানুগ বলেই গণ্ডিতদের বিশ্বাস। আনুমানিক তৃতীয় থেকে চতুর্থশতকে এই গ্রন্থ রচিত হয়েছিল।
মূল আখ্যান ভাগ পাঁচটি তন্ত্রে বিভক্ত থাকা স্বাভাবিক। তন্ত্র শব্দটি এখানে ‘গল্পসংগ্রহ’ অর্থে প্রযোজ্য। এই ভাগগুলি হল – (১) মিত্রভেদ, (২) মিত্রপ্রাপ্তি, (৩) কাকোলুকীয় বা সন্ধিবিগ্রহ, (৪) লব্ধপ্রণাশ এবং (৫) অপরীক্ষিত কারক।
এগুলি একএকটি পরিচ্ছেদ সম্পূর্ণ পৃথক্ পৃথক্ গল্প। আবার সেই গল্পের সাথে বহু ছোট ছোট গল্প, কথা, কাহিনীযেন যুক্ত হয়ে গ্রন্থটিকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে। মূল রচনা গদ্যে রচিত হলেও মাঝে মাঝে নীতিমূলক ও উপদেশাত্মক শ্লোক যুক্ত রয়েছে।
বিষ্ণুশর্মা পঞ্চতন্ত্র সম্বন্ধে বলেছেন—
“সকলার্থ শাস্ত্রসারং জগতি সমালোক্যং বিষ্ণুশমেদম্।
তন্ত্রৈঃ পঞ্চভিরেতচ্চকার সুমনোহরং শাস্ত্রম্ ॥”
গল্পগুলিতে মানুষের পাশাপাশি নানা পশুপাখি জন্তুজানোয়ারও স্থান পেয়েছে। মূলগল্পে মানুষের পাশাপাশি পশু-পাখী স্থান পেলেও পরবর্ত্তীকালে গল্পগুলি দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পঞ্চতন্ত্র ও হিতোপদেশ এই দুই স্বতন্ত্র গ্রন্থে সংকলিত হয়। মানবচরিত্রের দোষগুণ সাধুতা, মানবিকতার পাশাপাশি মূর্খতা, শঠতাও আরোপিত হয়েছে সেইসব পশুপাখির চরিত্রে। কথামুখে গ্রন্থকার স্বয়ং বলেছেন—এতৎ পঞ্চতন্ত্রং নামনীতিসারং বালাববোধনার্থং ভূতলে প্রবৃত্তম।’ অর্থাৎ তাঁর এই রচনা শিশুপাঠ্য নীতিসার গ্রন্থ। এইভাবে গল্পকথার ছলে লেখক শুধু যে নীতিশাস্ত্র জ্ঞানই বিতরণ করেছেন তাই নয়, কখনও তা শুধুই নিছক গল্পমাত্র, কখনও বা সহজ সরল ভাব ও নৈপুণ্যে গল্পসাহিত্য হয়ে উঠেছে। ন্যায়নীতির হাতধরে গল্পবলার ছলে এযেন এক বাস্তবজীবনের আদর্শ প্রচারের অন্যতম বাহন। বিশ্বের দরবারে পঞ্চতন্ত্র এক অনন্য সাধারণ সম্পদ।
হিতোপদেশ :—বঙ্গদেশের রাজা ধবলচন্দ্রের সভাসদ ছিলেন পণ্ডিত নারায়ণ। হিতোপদেশেই উল্লিখিত আছে যে—পাটলীপুত্ররাজ সুদর্শনের পুত্রগণকে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যেই গ্রন্থকার পঞ্চতন্ত্রের অনুকরণে এই হিতোপদেশ নামক গ্রন্থখানি প্ৰণয়ন করেন। পঁচিশখানি গল্প পঞ্চতন্ত্র থেকে গৃহীত। বাকী ১৭টি গল্প লেখকের নিজস্ব সংযোজন। হিতোপদেশের তৃতীয় খণ্ড পঞ্চতন্ত্রের চতুর্থখণ্ডের অবিকল, যে কারণে হিতোপদেশ পঞ্চতন্ত্রেরই পরিবর্তিত সংস্করণ বলা হয়ে থাকে। তবে সহজ, সরল, সকলপ্রকার বাহুল্যবর্জিত সরস গল্পগুলি রচনা পরিপাট্যে অনেকাংশে পঞ্চতন্ত্রকেও যেন অতিক্রম করে গেছে। কামন্দকীয় নীতিসার ও অন্যান্য গ্রন্থের ছায়াও এই গল্প সংগ্রহে সুস্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। হিতোপদেশের একটি পুঁথিতে ১৩৭৩ খ্রিষ্টাব্দের উল্লেখ থাক।য় এই গ্রন্থ এর পূর্বে তা সহজেই অনুমিত হয়। গ্রন্থে ‘রবিবার’কে— ‘ভট্টারকার’ বলায় গ্রন্থটি ৯০০ খ্রিষ্টাব্দের পরবর্তী সময়ে বুঝা যায়। কারণ ঐ সময়ের পূর্বে ভট্টারকবারের প্রচলন ছিল না। কোন কোন পণ্ডিতের মতে নারায়ণ মাঘের পরবর্তী কবি ছিলেন। বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় অনুদিত এই হিতোপদেশ সর্বাধিক প্রচারিত একটি গ্রন্থ।
সিংহাসন দ্বাত্রিংশিকা বা বিক্রমার্ক্স চরিত :—-এই কথাসাহিত্য বত্রিশটি গল্প সমন্বিত। রাজা বিক্রমাদিত্যের নামের সাথে জড়িত এই গল্প সমূহের মধ্য দিয়ে বিক্রমাদিত্যের জয়গান করা হয়েছে। মূল রচনাটি লুপ্ত হওয়ায় বর্তমানে উক্ত গ্রন্থের রচয়িতা কে? এই নিয়ে সমস্যাসৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন সংস্করণে এক একটি পাঠে এক এক রচয়িতার নাম পাওয়া যায়। তন্মধ্যে কালিদাসের নামও দৃষ্ট হয়। কিন্তু অনেকে কালিদাসকে এর রচয়িতা বলে মেনে নিতে নারাজ। জৈন কবি ক্ষেমঙ্কর ২৪শ শতাব্দীতে গল্পগুলিকে গদ্যে একটি সারসংক্ষেপ রচনা করেছেন। জৈনগনের নিকট এই গ্রন্থ বিশেষ সমাদর লাভ করে। পতিগণের অনুমান ১৩শ শতাব্দীর পূর্বে এই গ্রন্থ রচিত হয় নাই।
কথিত আছে দেবরাজ ইন্দ্র একটি বিশেষ সিং হাসন রাজা বিক্রমাদিত্যকে উপহার দিয়েছিলেন। শালিবাহনের নিকট বিক্রমাদিত্য পরাজিত ও নিহত হলে তাঁর ঐ সিংহাসন ভূগর্ভস্থ হয়ে পড়ে। অতঃপর ভোজ রাজার চেষ্টায় ঐ সিংহাসন উদ্ধার করা হলে যেই মাত্র তিনি সিংহাসনে বসতে গেলেন অমনি সিংহাসন গাত্রে ক্ষোদিত ৩২টি শুওলিকা জীবন্ত হয়ে ওঠে। এবং প্রত্যেকে এক একটি গল্প শোনায়। এবং প্রতিটি গল্পেই মহারাজ বিক্রমাদিত্যের যশোগান করা হয়েছে। এই ৩২টি গল্পই আলোচ্য গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে।
সিংহাসন—দ্বাত্রিংশিকা-র অনুকরণে পরবর্তীকালে আরো কয়েকটি গ্রন্থ রচিত হয় যেমন—অনন্তরচিত বীরচরিত। শিবদাসকৃত শালিবাহনচরিত, বিক্রমসেনচরিত ইত্যাদির নাম স্মরণ করা যায়।
শুকসপ্ততি :—আনুমানিক ১২শ শতাব্দীর পরে কোন এক সময় চিন্তামনিভট্ট কর্তৃক শুকসপ্ততিকথা সংস্কৃত গল্পসাহিত্যের অনন্যসম্পদ। চতুর্দশ শতকের প্রারম্ভে এর ফার্সী সংস্করণ তুডীনামা প্রকাশিত হয়। সংস্কৃত ভাষাতেও একাধিক সংস্করণ ছিল। এছাড়াও তুর্কী ইত্যাদি অন্যান্য সংস্করণ সারা ইউরোপে শুক সপ্ততিকে পৌঁছে দিয়েছে। চিন্তামনি ভট্ট রচিত সহজ, সরল, দীর্ঘ সমাস বর্জিত শুকসপ্ততি পাঠকের হৃদয়ে সহজেই স্থান করে নিয়েছে। ৭০টি গল্পের এক অনবদ্য সংকলন।
দেবদাস নামে এক ব্যক্তির গৃহে একটি শুকপক্ষী ছিল। এবং তাঁর স্ত্রী ছিলেন পরমাসুন্দরী। সুন্দরী স্ত্রীর প্রতি রাজার কু নজর বশতঃ রাজা কৌশলে দেবদাসকে কাজের আছিলায় দেশান্তরে পাঠান। রাজা ভাবলেন দেবদাসের অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রীকে বাড়ির বাইরে একলা পেলেই তিনি আত্মসাৎ করবেন। দেবদাস শুক পাখির উপর সমস্ত দায়িত্ব অর্পন করে বিদেশে যাত্রা করলেন। এদিকে স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্ত্রীর মনে অভিসারিণী হওয়ার প্রবৃত্তি জন্মায়। প্রতিরাত্রে সেই স্ত্রী যেই না গৃহের বাইরে পা বাড়ায় অমনি শুক পাখীটি নানারূপ ভর্ৎসনা করে, তাঁকে তার অপকর্মের দরুণ ফল ভোগের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। অবশেষে খুব সুন্দর একটি গল্প বলে। এবং সেই রমণী গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। এইভাবে ৭০টি রাত্রি অতিবাহিত হল। গৃহস্বামী গৃহে প্রত্যাবর্তন করলে ক্রমান্বয়ে ৭০টি গল্পের অবতারণা করে কৌশলে শুকপক্ষী তার গৃহস্বামীর প্রতি কর্তব্য পালন করেছিল। প্রকারান্তরে গৃহবধূর চারিত্রিক পবিত্রতাও রক্ষা পেল। গল্প শোনার আকর্ষণ যে চিরন্তন, একথা যেমন প্রমাণিত হলো তেমনি গল্পকথকের বাচন ভঙ্গিও যে শ্রোতার নিকট কত আকর্ষণীয় হতে পারে তা দেখে বিস্মিত হতে হয়।
পুরুষ পরীক্ষা :—বাংলা পদাবলী সাহিত্যের সার্থক রূপকার বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি সংস্কৃত গল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রেও অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। চটুল, কৌতুকরস সিক্ত পরিহাস ছলে নীতি উপদেশাবলী সম্বলিত এমন কতকগুলি গল্প তিনি রচনা করেছেন যা বিচিত্রতায় ভরপুর। অসাধারণ বর্ণ ও রসের সমন্বয়ে গল্পগুলি চিত্তাকর্ষক ও মনোহারী হয়ে উঠেছে।
প্রস্তাবনায় উল্লিখিত তথ্য থেকে জানা যায় যে রাজা শিবসিংহের আদেশে বালক দিগের নীতিশিক্ষা এবং পুরনারীদিগের চিত্তবিনোদনের নিমিত্ত কবির এই জাতীয় কৌতুক রসাত্মক মনোহারী গল্পকথা লেখার প্রয়াস।
পঞ্চতন্ত্রের থেকে কিছু কিছু গল্প এই গ্রন্থে কবি স্বভঙ্গিমায় উপস্থাপিত করেছেন। এতদ্ব্যতীত কবি প্রকৃত পুরুষের সন্ধানে ব্রতী হয়েছেন। জগতে বহু পুরুষ বর্তমান কিন্তু কেবল আকার আকৃতিতে পুরুষ হলেই চলবে না, প্রকৃতপক্ষে কে পুরুষ এই পরীক্ষার বড় প্রয়োজন। পুরুষের নানাবিধ সৎগুণ যেমন দয়ালু, কর্তব্যনিষ্ঠ, সত্যনিষ্ঠ ইত্যাদির পাশাপাশি চোর, অসৎ প্রভৃতি নিকৃষ্ট গুণের অধিকারী পুরুষ চরিত্রগুলিও গল্পে স্থান পেয়েছে। গল্পসকল মনুষ্য চরিত্রকে কেন্দ্র করে রচিত।
ভোজ প্রবন্ধ :—ধারা রাজ্যের রাজা ভোজকে কেন্দ্র করে বল্লভ রচিত ভোজপ্রবন্ধও সংস্কৃত কথা সাহিত্যে এক অসামান্য সংযোজন। লেখক স্থান কাল উচিত অনুচিতের বেড়াজাল টপকে আপন খেয়ালে ইতিহাসখ্যাত জ্ঞাণী গুণীজন যথা কালিদাস, মাঘ, ভবভূতি, মল্লিনাথ প্রমুখ ব্যক্তির চরিত্র সম্পর্কীয় হাসি মজায় বেশ কয়েকটি গল্পের অবতারনা করেছেন। ভোজরাজের রাজদরবারে একে একে সবাইকে হাজির করে তাদের কবি প্রতিভার দ্বারা রাজার গুণকীর্তন এবং পরিবর্তে রাজার পারিতোষিক লাভ এইরূ। ঘটনার মধ্যদিয়ে গল্পের আকারে কাহিনী সন্নিবেশিত হয়েছে। পণ্ডিতদের অনুমান ১৬শ শতকের কোন এক সময়ে এই গ্রন্থের রচনাকাল। এছাড়াও রাজশেখরের প্রবন্ধকোষ, শিবদাস বিরচিত কথার্ণব, মেরুতুঙ্গের প্রবন্ধচিত্তামণি ইত্যাদি যুগে যুগে সংস্কৃত গল্প সাহিত্যের ভাণ্ডারকে পরিপূর্ণ করেছে।
পরবর্তীকালে ঊনবিংশ শতকে বলে প্রচলিত ‘আরব্যরজনী’ নামক বিখ্যাত গল্পগ্রন্থের সংস্কৃত অনুবাদ হয়। জগবন্ধু নামক এক পণ্ডিত বঙ্গদেশের কোন এক জমিদারের উৎসাহে এই কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। এই সময়েই বহুল প্রচারিত ঈশপের গল্পেরও সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদের কাজ সম্পন্ন হয়েছিল।
বৌদ্ধ ও জৈন কথাসাহিত্য :— পশুপক্ষী, জন্তু জানোয়ারের মধ্যে মনুষ্যচরিত্রের মিল খুঁজে পাওয়া এবং পশুপক্ষীর মুখে সংলাপ বসিয়ে গল্প বলা বা লেখার প্রবণতা বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যেও দেখতে পাওয়া যায়। বৌদ্ধ কথা সাহিত্যও ভারতীয় হিন্দুদের ন্যায় সংস্কৃত সাহিত্য ভাণ্ডারকে অমূল্য সম্পদ দান করেছে। বৌদ্ধকথা সাহিত্যগুলি অবদান ও জাতক নামে পরিচিত। অবদান কথার অর্থ মহৎকর্ম বা প্রশংসনীয় কাজ। বৌদ্ধ সাহিত্যে নৈতিক বা ধর্মনিষ্ঠ বিশেষ কীর্তিমূলক কাজকেই অৱদান বলা হয়েছে। বৌদ্ধধর্মের আচরণীয় বিবিধ প্রশংসনীয় কর্মসমূহ আখ্যান উপাখ্যানের আকারে অবদান সাহিত্য নামে প্রচারিত। অপরদিকে জাতকের গল্পগুলিতে বুদ্ধের পূর্ব পূর্ব জন্মের নানাকাহিনী গল্পের আকারে সন্নিবেশিত হয়েছে।
জাতক :—জাতকের অপর নাম বোধিসত্ত্ব কাহিনী। বুদ্ধ পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করেছেন। এই পূর্বপূর্ব জন্মে যে সমস্ত সৎকর্মের বা সৎ আচরণের দ্বারা বোধি সত্ত্বলাভ করেছেন, সেই বোধি সত্ত্বলাভের কাহিনী গুলিই জাতকের গল্প বলে খ্যাত। বুদ্ধ স্বয়ং সেই সমস্ত কাহিনীর প্রচারক ছিলেন। পরবর্তীকালে শিষ্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। বুদ্ধদেব এই সমস্ত কাহিনীর মধ্য দিয়ে শিষ্যগণকে উপদেশ দিতেন। বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পরে শ্রমণ ও ধর্মানুরাগীগণ ঐ সমস্ত জীবনবৃত্তান্তগুলিকে বৌদ্ধধর্মের আদর্শের রূপ দেয়। প্রকারান্তরে ঐ সমস্ত কাহিনীই জাতকের মূল উৎস। খ্রিষ্ট্রের জন্মের পূর্বেই এই সমস্ত জাতকের জন্ম। মূলজাতক পদ্য বা শ্লোকাকারে লেখা জাতকগুলি পরবর্তীকালে গদ্য বা গদ্য পদ্যে মিশ্রিত হয়ে আনুমানিক ৫ম বা ৬ষ্ঠ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সম্পূর্ণ পরিমার্জিত রূপে আত্মপ্রকাশ করে। সৎকর্ম, সদাচার, করুণা, মৈত্রী, প্রজ্ঞা, শীল প্রভৃতি মনুষ্যের আচরণ থেকে শুরু করে পশুপক্ষীর বিভিন্ন আচার আচরণ জাতকগুলিতে স্থান পেয়েছে। আমরা জানি যে বৌদ্ধ সাহিত্য সকলই বৌদ্ধধর্মের আদর্শের বাহক মাত্র, সেইহেতু সাহিত্য স্থানে স্থানে একঘেয়ে, গতানুগতিক ও বৈচিত্র্যতা বিহীন। তবুও বিষয়বস্তুর দিক থেকে বিচার করলে কাহিনী (fable) পরীর গল্প (fairy tale) এবং অভিযানাত্মক কাহিনী, হাস্যরসাত্মক কাহিনী, নীতিকথা ও ধর্ম-কাহিনীগুলি যা নাকি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমগ্র বিশ্বসাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করেছে।”
অবদান সাহিত্য :—অবদান সাহিত্যে জাতকের মত ধর্মকথা আলোচিত হয়নি ঠিকই কিন্তু বুদ্ধদেব ও তাঁর প্রচারিত ধর্ম ও সংঘের উদ্দেশ্যে আচরিত মহৎ কর্ম সমুহের নানা অবদানের কথা স্থান পেয়েছে। অবদানের দুটি প্রাধান ভাগ, প্রথমত প্রত্যুৎপন্নবস্তু (বর্তমান কাহিনী) ও অতীতবস্তু (প্রাচীন-কাহিনী) এই কাহিনীর মধ্য দিয়ে বৌদ্ধগণ প্রচার করতেন যে—যেমন কর্মকরা হবে, তার ফলও তদনুরূপই হবে। অবদান সাহিত্যের মধ্যে ‘অবদানশতক’ হল প্রাচীনতম-গ্রন্থ। আনুমানিক ২য় শতকের মধ্যে এই গ্রন্থ রচিত। গ্রন্থটিতে হীনযান পন্থী বৌদ্ধদের ধর্মীয় আদর্শের ধারা অনুসৃত হয়েছে। সমগ্র কাহিনী ২০টি বর্গে বিভক্ত। এক একটিতে সম্পূর্ণ এক একটি বিষয় আলোচিত হয়েছে। অবদানশতকের হাত ধরে ধর্ম প্রচারিত হলেও এই গ্রন্থ কিন্তু সাহিত্যের রস থেকে বঞ্চিত নয়। গ্রন্থটি ৩য় শতকে চীনাভাষায় অনূদিত হয়েছিল। ‘কর্মশতক’ হলো এইরূপই এক প্রাচীন গ্রন্থ। বোধিসত্ত্বাবদানমালা, আর্যশুর কর্তৃক রচিত জাতকমালা। ৩৪টি কাহিনী সম্বলিত এই জাতক মালা খুব সম্ভব ষষ্ঠ শতকের পূর্বে রচিত। অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল এই গ্রন্থ। দিব্যাবদান-হলো অপর একটি হীনযান পন্থাবলম্বী শিষ্যদিগের গ্রন্থ। এই গ্রন্থে মোট ৩৮টি উপাখ্যান রয়েছে, তন্মধ্যে কতিপয় কাহিনীর বিষয় বিনয়পিটক থেকে গৃহীত। পালি ভাষায় লিখিত গ্রন্থখানির ভাব ভাষা ও রচনা শৈলীর পরিপাট্যে, এমন এক বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায় যা ধর্মীয় ভাবনার প্রচারকে ও ঐতিহাসিক তাৎপর্যকেও সময়ে সময়ে অতিক্রম করে গেছে। এখানেও দেবতা, মানুষ ও পশুপক্ষীর আচার-আচারণ স্থান পেয়েছে। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে গল্পগুলি সংকলিত হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে কাশ্মীরীয় কবি ক্ষেমেন্দ্র রচিত অবদান কল্পলতা মহাযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ষট্ পারমিতার মহত্ত্ব এই অবদান সাহিত্যের মধ্য দিয়ে ব্যাখ্যাত হয়েছে ১০৮টি উপখ্যান সুচারু ভঙ্গিতে এই গ্রন্থে বর্ণিত। এছাড়াও মহাবস্তু অবদান ও সুবর্ণ বর্ণাবদান, এইরূপ বহু ছোট বড় অবদান সাহিত্য সংস্কৃত সাহিত্য ভাণ্ডারকে পরিপূর্ণতা দান করেছে।
জৈন সাহিত্যে কথানক কাব্য :—গল্প বলা ও শোনা চিরকাল সকলধর্মের মানুষের কাছেই তৃপ্তিদায়ক। জৈনগণও এই নিয়মের ব্যতিক্রমী নয়। সেইহেতু গল্প, আখ্যান, উপাখ্যান ও কাহিনী সকল সংস্কৃত, প্রাকৃত প্রভৃতি ভাষায় জৈনগণ সাহিত্যের মধ্য দিয়ে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। ‘কালকাচার্য কথানক’ হল এইরূপ একটি গদ্যপদ্যময় প্রাকৃত কথা সাহিত্য। কাব্য রচয়িতা সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে রাজা কালক কিভাবে জৈনধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন সেই কথাই এই কাব্যে ব্যক্ত হয়েছে। ভাবদেবসুরি লিখিত অনুরূপ একটি কথানক রয়েছে। গ্রন্থটি ১০২টি প্রাকৃত গাথায় সম্পূর্ণ। বৌদ্ধদিগের ন্যায় জৈনধর্মেরও সাহিত্যের মূলে ছিল ধর্মপ্রচার। ধর্মীয় আদর্শ, নীতিবোধ প্রচারের মাধ্যমরূপেই কথানকগুলির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। সংস্কৃত সাহিত্যের ন্যায় উচ্চমানের সাহিত্য না হলেও জৈন গল্প সাহিত্যের সংযোজন কখনই অবহেলার নয়।
পাদটীকা – গদ্যকাব্য
১. তুলঃ—
প্রকৃতানাকুলশ্রব্য শব্দার্থ পদবৃত্তিনা।
গদ্যেন যুক্তোদাত্তার্থা সোচ্ছ্বাসাখ্যায়িকা মতা।
বৃত্তমাখ্যায়তে তস্যাং নায়কেন স্বচেষ্টিতম্।
বন্ধুং চাপরবক্তং চ কালে ভাব্যর্থশংসি চ ॥
কবেরভিপ্রায়কৃতৈঃ কথনৈঃ কৈশ্চিদঙ্কিতা।
কণ্যাহরণসংগ্রাম বিপ্ৰলম্ভোদয়ম্বিতা।।
ন বক্তাপরবক্ত্রাভ্যাং যুক্তা নোচ্ছ্বাসবত্যপি।
সংস্কৃতে সংস্কৃতাচেষ্টা কথাপভ্রংশভাক্ তথা।।
অন্যৈঃ স্বচরিতং তস্যাং নায়কেন তু-নোচ্যতে।
স্বগুণাবিষ্কৃতিং কুর্যাদভিজ্ঞাতঃ কথংজনঃ।।
— কাব্যালঙ্কার’॥১।২৫-২৯
২. দ্বিজেন তেনাক্ষতকণ্ঠকৌণ্ঠ্যয়া মহামানোমোহমলীমসান্ধয়া।
অলব্ধ বৈদগ্ধ্য বিলাস মুগ্ধয়া ধিয়া নিবন্ধেয়মতিদ্বয়ী কথা।। – ‘কাদম্বরী’
৩. ‘কথায়াং সরসং বস্তু গদ্যৈরেব বিনির্মতম
ক্বচিদত্র ভবেদাৰ্যা ক্বচিদ্বক্তাপরবক্তকে।
আদৌ পদ্যৈনমস্কারঃ খলাদেবুত্তকীৰ্তনম্।।
আখ্যায়িকা কথাবৎ স্যাৎ কবের্বং শানুকীৰ্ত্তিনম্।
তস্যামন্যকবীনাঞ্চ বৃত্তং পদ্যং ক্বচিৎ ক্বচিৎ
কথাং শানাং ব্যবচ্ছেদ আশ্বাস ইতি বধ্যতে।
আর্যাবক্তা পরবক্তানাং ছন্দসা যেন কেনচিৎ।।
অন্যাপদেশে নাশ্বাসমুখে ভাব্যর্থসুচনম্।
—সাহিত্যদর্পন।
৪. সা বসবতা বিহতা নবকা বিলসত্তি নো কঙ্কঃ।
সরসীব কীর্তিশেষং গতবতি ভুবি বিক্রমাদিত্যে।
৫. যাতে দিবং পিতরি তদ্বচসৈব সার্ধং বিচ্ছেদমাপভূবিযন্তু কথা প্রবন্ধঃ।
দুঃখং সতাং তদাসমাপ্তিকৃতং বিলোক্য প্রারদ্ধ-এষা ময়া-ন কবিত্বদৰ্পাৎ।।
৬. পম্পাসরোবর, বিন্ধ্যাটবী, শুকনাসের প্রাসাদ,
চণ্ডিকার মন্দির এই সমস্ত বিষয় এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্তস্বরূপ।
৭. “His prose has been Compared to an Indian Jungle, where progress is rendered impossible by luxuriant under-growth until the traveller cuts out a path for himself, and where wild beasts lie in wait for him in the shape of recondite words, far fetched allusions, Vast Sentenees, undiscrimi nated epithets upon epithets in a multitude of aggressive compounds and a whole battalion of puns, similes, hy- perboles, alliterations and assonances.” Weber.
গল্পসাহিত্যঃ—
৮. ৭ম খ্রিষ্টাব্দে সুবন্ধু তার বাসবদত্তায় বলেছেন—
“বৃহৎ কথালিম্বৈরিব সালভঞ্জিকানিবহৈঃ”। বাসবদত্তা।
বাণভট্ট তার হর্ষচরিতে বলেছেন-
সমুদ্দীপিতকন্দা কৃতগৌরী প্রসাধনা।
হরলীলেব নো কস্য বিস্ময়ায় বৃহৎকথা ॥ হর্ষচরিত।
দণ্ডী তাঁর কাব্যাদর্শে বলেছেন—
কথাপি সর্বভাষাভিঃ সংস্কৃতেন চ বধ্যতে।
ভূতভাষাময়ীং প্রাহুরম্ভূতাৰ্থা বৃহৎকথা।। কাব্যাদর্শ।
৯. লিপিটি নিম্নরূপ :—
পাদরদঃ স্থিরকল্যাণো গুণাঢ্যঃ প্রাকৃত প্রিয়
অনীতির্যো বিশালাক্ষঃ শুরোন্যককৃতভীমকঃ।।
১০. শ্লোকটি নিম্নরূপ :—
বিষবৃক্ষোঽপি সংবদ্ধ স্বয়ং চ্ছেত্তুমসাম্প্রতম্।” (২।৫৫-কুমারসম্ভব )
১১. “The Jatakas are of inestimable value, not only as regards literature and art, but also they can-not serve as documents for the social conditions at the time of Buddha,-yet the narraters of the Jataka book offered us a glimpse in to the life of classes of Indian people of which other books of Indian literature only realy give us any information.”— winternitz.