পঞ্চম অধ্যায় – খিলাফত আমলের প্রশাসনিক ব্যবস্থা
খিলাফত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) মদিনায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দ্বারা কলহরত আরব গোত্র ও গোষ্ঠীগুলোকে একীভূত করে এক মহান জাতিতে পরিণত করেন। সৈয়দ আমীর আলীর ভাষায়, “এই অল্প (দশ বছর) সময়ের মধ্যে তিনি যে কাজ সমাধা করেন তা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ অত্যাশ্বর্য কীর্তিসমূহের অন্যতম বলে চিরকাল অম্লান থাকবে।” মহানবী শুধু একটি কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠাই করেন নি, বরং প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা এবং বিচার বিভাগীয় সমস্ত ক্ষমতার প্রকৃত রূপরেখা নির্ধারণ করেন। শরীয়তের উপর ভিত্তি করে তিনি যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন তাই পরবর্তীকালে খোলাফায়ে রাশেদূনের সময় অনুসৃত হয়। নবী করীমের ওফাতের পর চারি জন খলিফা হযরত আবুবকর (রা), হযরত ওমর (রা), হযরত ওসমান (রা), হযরত আলী (রা) ত্রিশ বছর ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। এই সময়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্রে রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়।
খিলাফত ইসলামী শাসনব্যবস্থার প্রধান প্রশাসনিক কাঠামো। মজীদ খাদ্দুরীর ভাষায়, “খিলাফত ছিল ধর্মীয় ভিত্তিতে রাষ্ট্রের পার্থিব শাসন কাঠামো।” খিলাফত শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে খলিফা বা প্রতিনিধি ও উত্তরাধিকারী হতে। ইবন খালদূন বলেন যে, “হযরত মুহাম্মদ (স)-এর পর যারা ইসলামী প্রজাতন্ত্রে তাঁর আদর্শ ও নীতি অনুযায়ী ধর্মীয় ও পার্থিব ক্ষমতার অধিকারী হয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করেন তাদেরকে ‘খলিফা’ বলা হয়। পবিত্র কুরআনে খলিফার উল্লেখ থাকলেও এটি কোন পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে বলে মনে হয় না। সাধারণ অর্থে আল্লাহ খিলাফত সম্বন্ধে বলেন, ‘নিশ্চয় আমি দুনিয়ায় (আদমের সৃষ্টির পূর্বে ফেরেশতাদের উদ্দেশে) খলিফা প্রেরণ করব।” (২ : ২৮) মহানবী রাষ্ট্রের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এবং একই সঙ্গে তিনি ছিলেন প্রবর্তক, প্রচারক, রাষ্ট্রপ্রধান, সেনাধ্যক্ষ ও আইনপ্রণেতা। রাসূলে করীম বলেন, “তোমাদের পূর্বে বনি ইসরাইল গোত্রের নবী ও পয়গম্বরই নেতৃত্বদান এবং রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব পালন করতেন। একজন পয়গম্বর অপর একজনের স্থলে আসতেন। কিন্তু যেহেতু আমি আল্লাহর সর্বশেষ প্রেরিত নবী, তোমাদের মধ্য হতে খলিফাগণই অর্থাৎ প্রতিনিধিগণই রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন।” কুরআন ছাড়াও হাদিস ও শরিয়তে খিলাফতের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ‘খলিফাত-ই-রাসূল উল্লাহ’ অথবা ‘খলিফাতুল খলিফাহ’ (খলিফার খলিফা) উপাধি ব্যবহৃত হলেও রাসূলে করীমের ওফাতের পর ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রথম চারজন শাসক শুধু ‘খলিফা’ উপাধিতে সন্তুষ্ট ছিলেন। ‘খলিফা’ ছাড়াও হযরত ওমর (রা) সর্বপ্রথম ‘আমির-উল-মু’মিনীন’ (বিশ্বাসীদের অধিকর্তা) উপাধি ধারণ করেন। প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে খিলাফত ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ হতে অটোমান তুর্কী সাম্রাজ্যের সর্বশেষ খলিফা সুলতান দ্বিতীয় আবদুল মজিদের রাজত্বকাল (১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত বজায় ছিল। নব্য-তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্ক খিলাফত বিলুপ্ত করেন।
খিলাফতের মর্যাদা, দায়িত্ব ও বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে আল-মাওয়ার্দী বলেন যে, খলিফা স্বৈরাচারী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেননি। খলিফা রাজশক্তির অধিকারী ছিলেন না বরং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তিনি নির্বাচিত হতেন। আল-মাওয়ার্দীর মতে, খলিফাকে অবশ্যই কুরাইশ বংশোদ্ভূত হতে হবে। তিনি শারীরিক ও মানসিক রোগ-ব্যাধি মুক্ত হবেন। কেবল একজন চরিত্রবান মুসলমান পুরুষ খলিফা হবার যোগ্যতা রাখেন। কুরআন ও হাদিসের উপর তাঁকে ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনা ও যুদ্ধ পরিকল্পনায় তাঁকে পারদর্শী হতে হবে। ইসলাম ধর্মের শুচিতা রক্ষা করা এবং অধর্ম দূর করে মুসলিম রাষ্ট্রে শরিয়তের আইন প্রতিষ্ঠা তাঁর বিশেষ দায়িত্ব হবে। সকল প্রকার সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের দক্ষতা তাঁকে অর্জন করতে হবে। খিলাফতের ধ্যান-ধারণা নিয়ে সুন্নী জামাতের সঙ্গে খারিজী ও শিয়া সম্প্রদায়ের বৈষম্য রয়েছে। খারিজিগণ প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক মতবাদে বিশ্বাসী থাকায় তাদের মতে কেবল কুরাইশ বংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সমগ্র মুসলিম জাতি হতে খলিফা নির্বাচন করা প্রয়োজন। তাদের মতে, এমনকি একজন মুক্ত দাস এবং মহিলাও খলিফা হতে পারেন। খলিফা নির্বাচিত হবেন, মনোনীত নহে। তাঁরা কেবল হযরত আবুবকর ও হযরত ওমরকে ন্যায়সঙ্গত খলিফা বলে মনে করেন। হযরত ওসমান, হযরত আলী ও উমাইয়া খলিফাদের ইসলামী আদর্শ হতে বিচ্যুত মনে করে তাদের খলিফা হিসেবে স্বীকার করে না।
ফাতেমীয় বংশের উদ্যোগে মিসরে ইসলামের একমাত্র প্রভাবশালী শিয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয় ৯০৯ সালে এই বংশ তিউনিসে শাসনকার্য শুরু করে। সাঈদ ইবন-হুসাইন ওবায়দুল্লাহ আল-মাহদী উপাধি ধারণ করে বংশানুক্রমিক রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। শিয়া সম্প্রদায় প্রথম তিনজন খলিফাকে ক্ষমতা দখলকারী (usurper) মনে করে এবং হযরত আলীকে প্রথম খলিফা ও ইমাম হিসেবে মর্যাদা দেয়। হযরত আলীর কন্যা ফাতেমার নাম হতে ফাতেমীয় বংশের নামকরণ হয়। শিয়াগণ উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলিফাদের অবৈধ সিংহাসন দখলকারী মনে করে। ইমাম মতবাদ শিয়া সম্পদ্রায়ের মধ্যে বিশেষ প্রাধান্য লাভ করেছে। তারা মনে করে হযরত আলী ও তাঁর উত্তরাধিকারিগণ রাসূলের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক ক্ষমতার অধিকারী। তিনি নিষ্পাপ ও সকল অনাচারের ঊর্ধ্বে। তিনি শিয়াদের হেদায়ত করবেন অর্থাৎ ‘মাহদী’ পুনর্জন্ম লাভ করবেন ও সাময়িকভাবে চোখের অন্তরালে গেলেও পুনরায় আবির্ভাব করে বিপথগামীদের সত্য পথ প্রদর্শন করবেন।
খিলাফত উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত রাজতন্ত্র নহে। ঐশীতন্ত্রভিত্তিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত খিলাফতে খলিফা নির্বাচিত হতেন। নির্বাচনের জন্য একটি নির্বাচকমণ্ডলী বা ‘আহল-আল-ইমামাহ’ গঠন করা হত। এই নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্যগণকে অবশ্যই মেধাবী, ন্যায়পরায়ণ, চরিত্রবান, শিক্ষিত ও প্রভাবশালী হতে হত। নির্বাচকমণ্ডলীর ক্ষমতা ও দায়িত্ব ছিল অপরিসীম। তাঁরা যাকে খলিফা নির্বাচিত করতেন তাঁকে সে দায়িত্ব পালন করতে হত এবং নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্যদের হস্ত চুম্বন দ্বারা তাদেরকে আনুগত্য বা সম্মতি প্রকাশ করতে হত। নির্বাচকমণ্ডলীর সিদ্ধান্ত ছিল চূড়ান্ত এবং তা কেহ লঙ্ঘন বা প্রতিরোধ করতে পারত না। প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে মক্কা ও মদিনার নেতৃবৃন্দ এই নির্বাচকমণ্ডলীতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেন। অবশ্য পরবর্তী পর্যায়ে শাসন বিকেন্দ্রীকরণের ফলে এবং মদিনা হতে রাজধানী আরব দেশের বাইরে স্থানান্তরিত হলে অন্যান্য গোষ্ঠীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। নির্বাচকমণ্ডলীর রায় প্রকাশিত হলে নির্বাচিত খলিফাকে শপথ (বাইয়াৎ) গ্রহন করতে হয়। শপথ সাধারণত দুই প্রকারের; যথা— ‘খাস’ শপথ অর্থাৎ নির্বাচক মণ্ডলীর সদস্যদের হস্তচুম্বন দ্বারা স্বীকৃতি প্রকাশ এবং সমবেত জনগণের সামনে হাত তুলে আনুগত্য প্রকাশ বা ‘আম’ শপথ। উল্লেখ্য যে, খিলাফতের ইতিহাসে নির্বাচন ও মনোনয়ন উভয় পদ্ধতিই প্রচলিত ছিল।
খিলাফতের দীর্ঘ ইতিহাসে (৬৩২-১৯২৪) নানারূপ বিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। রাসুলুল্লাহর মৃত্যুর পর মুসলিম রাষ্ট্রের হেদায়েতের জন্য পর পর চারজন খলিফা হযরত আবুবকর (রা), হযরত ওমর (রা), হযরত ওসমান (রা) এবং হযরত আলী (রা) শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এই সময়কাল খোলাফায়ে রাশেদূন নামে পরিচিত। আমীর আলী বলেন, “মদিনায় ত্রিশ বছর ধরে এই সাধারণতন্ত্র কায়েম ছিল।” নব- প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের সংহতি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য তাঁরা বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ও নীতি গ্রহণ করেন। খোলাফায়ে রাশেদূনের শাসন-ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক নীতি উদার ও জনকল্যাণকর ছিল। সকল নাগরিকের সমান অধিকার ছিল। বলাই বাহুল্য যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নাগরিকত্ব মুসলিম ব্যতীত ইহুদী, খ্রিস্টান ও সেবিয়তগণও লাভ করে। আমীর আলীর ভাষায়, “গণতন্ত্রের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের মিশ্রণে যে সমাজ ব্যবস্থার সৃষ্টি হয় ইসলামের আইন-কানুনগুলোর প্রবণতা স্বাভাবিকভাবে সেই দিকেই বৃদ্ধি পায়।”
হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ওফাতের পর রাসূলের কোন জীবিত পুত্র সন্তান না থাকায় এবং তিনি কোন উত্তরাধিকারী মনোনীত না করায়, মুসলিম জাহানের নেতৃত্ব নিয়ে জটিলতা ও রাজনৈতিক সঙ্কটের সূচনা হয়। হিট্টি বলেন, “সুতরাং ইসলামকে সর্বপ্রথম খিলাফত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।” গণতান্ত্রিক ভাবধারায় প্রভাবান্বিত হয়ে রাসূলে করীম মুসলিম উম্মার জন্য প্রতিনিধি বা খলিফা নিযুক্ত বা মনোনীত না করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর দায়িত্ব অর্পণ করে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রথম খলিফা নির্বাচনে মুসলিম নেতৃবৃন্দ ঐক্য ও সমঝোতার পরিচয় দিতে পারেন নি। ফলে মক্কা থেকে আগত মোহাজেরিন ও মদিনাবাসী আনসারদের মধ্যে খলিফা নির্বাচন নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। ইসলামের এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী আনসারগণ ‘ছাকিফা বনি-সায়িদা’ নামক কক্ষে সমবেত হয়ে খাজরাজ গোত্রের দলপতি সাদ বিন-আবু ওবায়দাকে খলিফা নির্বাচনের দাবি জানান। অপর দিকে মোহাজিরগণ দাবি করেন যে, যেহেতু তারা সর্বপ্রথম ইসলামে দীক্ষা লাভ করেন এবং মক্কা হতে আগমন করে মদিনায় ইসলাম প্রচার করেন, সেহেতু তাদের মধ্য হতে একজন যোগ্য প্রার্থীকে খলিফা নিযুক্ত করতে হবে। উপরন্তু, হযরত আলী (রা)-এর অসমর্থকগণ প্রচালনা শুরু করে যে, যেহেতু তিনি রাসূলের চাচাত ভাই ও জামাতা সেহেতু তিনিই একমাত্র নবীর উত্তরাধিকারী হতে পারেন। অভিজাত কুরাইশ বংশও তাদের দাবি পেশ করে। তাদের যুক্তি যে, রাসূল কুরাইশ বংশোদ্ভূত এবং কুরাইশগণই তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি, শৌর্য-বীর্য, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অধিকারী; এমতাবস্থায় কেবল কুরাইশ বংশের কোন সদস্য খলিফা নির্বাচিত হলেই রাজনৈতিক অচলাবস্থার নিরসন হবে। হযরত আবুবকরও উপরিউক্ত প্রস্তাব করলে আনসারগণ দাবি করে যে, কুরাইশ এবং আনসারদের মধ্য হতে দুইজন খলিফা নির্বাচন করা হউক। হযরত ওমর এর ঘোর বিরোধিতা করেন। হযরত আবুবকর হযরত ওমর অথবা আবু ওবায়দাকে খলিফার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু হযরত আবুবকরের বয়োজ্যেষ্ঠতা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সূক্ষ্ম বিচার- বুদ্ধি, নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ, ইসলামে তাঁর অবদান ও প্রভাবের কথা চিন্তা করে হযরত ওমর এবং আবু ওবায়দা তাঁদের দাবি প্রত্যাহার করেন। অতঃপর হযরত ওমর প্রাচীন আরব রীতি অনুসারে হযরত আবুবকরের হস্তচুম্বন দ্বারা আনুগত্য স্বীকার করে তাকে ইসলামের প্রথম খলিফা হিসেবে ঘোষণা করেন। অন্যান্য সাহাবিগণ-আনসার ও মোহাজেরিনগণও হযরত আবুবকরকে খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দান করেন।
৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে হযরত আবুবকর (রা) তাঁর মৃত্যুর পূর্বে ইসলামী উম্মার জন্য একজন উত্তরাধিকারী মনোনয়নের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। ইসলামের ঐক্য, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য তিনি আবদুর রহমান-বিন-আউফ, হযরত ওসমান, হযরত আলী প্রমুখ বিশিষ্ট মুসলিম নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে হযরত ওমরকে মনোনয়ন দান করেন। হযরত ওমরের বলিষ্ঠ মনোবল, চারিত্রিক দৃঢ়তা, ন্যায়নিষ্ঠা, কর্মদক্ষতার কথা চিন্তা করে তাঁকে মনোনীত করা হয়। হযরত আবুবকরের মত হযরত ওমর মৃত্যুর পূর্বে ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি নির্বাচনী পরিষদ গঠন করে। এই পরিষদের সদস্য ছিলেন হযরত ওসমান, হযরত আলী, তালহা, যুবাইর, আবদুর রহমান বিন আউফ এবং সা’দ-বিন- আবি ওয়াক্কাস। তালহা ব্যতীত বাকি পাঁচজন আয়েশার কক্ষে আলোচনার জন্য মিলিত হন। আবদুর রহমান স্বীয় দাবি প্রত্যাহার করে আপোষের চেষ্টা করেন। যুবাইর হযরত ওসমান ও হযরত আলী উভয়কেই সমর্থন করেন। সা’দ ওসমানকে, ওসমান আলীকে এবং আলী ওসমানকে খলিফার যোগ্য বলে বিবেচনা করেন। ফলে বয়োজ্যেষ্ঠতা, ইসলামে অবদান এবং রাসূলের দুই কন্যা-বিবি রোকাইয়া ও বিবি উম্মে কুলসুমকে বিবাহ করায় “যুনুরাইন” খেতাবধারী হযরত ওসমান দুই ভোট লাভ করে হযরত আলীর অগ্রগামী থাকেন। আবদুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হিসেবে হযরত ওসমানের নাম ঘোষণা করেন। হযরত ওসমানের হত্যায় মুসলিম রাষ্ট্র বিপন্ন হয়ে পড়ে এবং খিলাফতকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়। মূলত হযরত ওসমানের খিলাফত লাভে হযরত আলীর সমর্থকেরা সন্তুষ্ট হতে পারে নি। সন্ত্রাসপূর্ণ পরিস্থিতিতে হযরত ওসমানের উত্তরাধিকারী খলিফা নির্বাচন দুরূহ হয়ে পড়ে। ইবন সা’বার নেতৃত্বে হযরত আলীর সমর্থকেরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে থাকে। অপরদিকে তালহা ও যুবাইরের সমর্থক কুফাবাসীরা বিদ্রোহ করে। বনু হাশেমের প্রতিদ্বন্দ্বী বনু উমাইয়ার বংশধর মুয়াবিয়া দামেস্কে হযরত ওসমানের রক্তমাখা পোশাক ও তার স্ত্রী বিবি নাইলার কর্তিত আঙ্গুল প্রদর্শন করে উত্তেজনার সৃষ্টি করতে থাকে। এমন এক সংকটজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মদিনার নাগরিকবৃন্দ ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে হযরত আলীকে খলিফার গুরুদায়িত্ব গ্রহণের সাদর আহ্বান জানায়।
খোলাফায়ে রাশেদূনের সময়কাল প্রশাসনিক দিক থেকে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ত্রিশ বছরের শাসনকালে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ছিল হযরত ওমরের শাসনকাল। বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন, বিচক্ষণ ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় অধিকারী হযরত ওমরই প্রকৃত অর্থে ইসলামের শাসন ব্যবস্থায় প্রতিভূ ছিলেন। হিট্টি বলেন, “শূন্য হতে আরম্ভ করে আরবীয় মুসলিম খিলাফত (ওমরের সময়) বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হয়।” তিনিই প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্রের সংহতি রক্ষাকারী ও সংগঠক। শাসন-ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করে তিনি একটি আদর্শ রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। জনকল্যাণকর নীতি ও আরব জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা তাঁরই কৃতিত্ব। তিনিই প্রথম পরামর্শ সভা (মজলিস-উস-শূরা) এবং হিজরী সনের প্রচলন করেন। স্বৈরাচারী ও একনায়কত্বের পরিপন্থী হযরত ওমর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসন পরিচালনা করেন।
৬৬১ খ্রিস্টাব্দে হযরত আলীর মৃত্যুর পর শুধু খোলাফায়ে রাশেদূনের পরিসমাপ্তি ঘটে নি, বরং যে আদর্শ, রীতি-নীতি ও পদ্ধতির উপর খোলাফায়ে রাশেদূনের মর্যাদা ও গৌরব প্রতিষ্ঠিত ছিল তা বিলুপ্ত হয়। ইসলামী গণতন্ত্র ও শরীয়তের বিধির পরিবর্তে উমাইয়া আমলে রাজতন্ত্র, একনায়কত্ব ও স্বেচ্ছাচারিতা কায়েম হয়। উত্তরাধিকার সূত্রে রাজ্যলাভ (hereditary succession) নির্বাচনকে নির্মূল করে। মজলিস-উস-শূরার কার্যকারিতাও বিলুপ্ত হয়। বায়তুল-মাল ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়। খোলাফায়ে রাশেদূনের সময়ে বিলাসিতা, বৈদেশিক প্রভাবে অনাচার, হেরেম প্রথা, সিংহাসন, রাজদণ্ড, মুকুট, দাস-দাসী, নৃত্যগীত, মদ্যপান প্রভৃতি অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু মুয়াবিয়া কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত উমাইয়া যুগে (৬৬১-৭৫০) অনাচার ও অনৈসলামিক কার্যকলাপ শুরু হয়। মূইর যথার্থই বলেন, “মুয়াবিয়ার দামেস্কের সিংহাসনে আরোহণ খিলাফতের পরিসমাপ্তি ও রাজতন্ত্রের সূচনা করে।” রাজতন্ত্রের প্রভাব ইসলামের মৌলিক ধর্মীয় চেতনাবোধও লোপ পেতে থাকে। উমাইয়া খিলাফতে মোট ১৪ জন খলিফা রাজত্ব করেন এবং তাদের মধ্যে ৪ জন সরাসরি মনোনীত হন। ছলে-বলে-কৌশলে হযরত আলীর নিকট হতে মুয়াবিয়া ক্ষমতা দখল করে গণতন্ত্রের পরিবর্তে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং তদীয় পুত্র ইয়াজিদকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। এর পর হতে ৭৫০ খ্রি. পর্যন্ত প্রত্যেক খলিফা স্বীয় পুত্র অথবা ভ্রাতাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।
মজলিস-উস-শূরা (মন্ত্রণা পরিষদ)
রাসূলুল্লাহ তাঁর প্রধান সাহাবীদের নিয়ে যে পরামর্শ সত্য গঠন করেন প্রধানত তাই “মজলিস-উস্-শূরা’ নামে পরিচিত। রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ, প্রশাসনিক কাঠামোর রূপরেখা দান, রাষ্ট্রীয় শাসনকার্য পরিচালনার বিভিন্ন পন্থা প্রভৃতি এই শূরা নির্ণয় করত। মদিনার শূরা মোহাজেরিন ও আনসারদের নিয়ে গঠিত হয়। এতে এমনকি অমুসলমান প্রতিনিধি ও থাকত। মদিনায় মসজিদে এই মজলিস-উস্-শূরার সভা অনুষ্ঠিত হত। রাসূলুল্লাহর মৃত্যুর পর খোলাফায়ে রাশেদূনের সময়ে এই মজলিস-উস্-শূরা একটি শক্তিশালী সভায় পরিণত হয়। সাধারণত নামাজের পর মজলিসের বৈঠক বসত। খলিফাগণ এই মন্ত্রণালয়ের সুচিন্তিত পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। খলিফা ওমরের ভাষায়, “পরামর্শ ব্যতীত কোন খিলাফত চলতে পারে না।” এটি নিঃসন্দেহে ইসলামী গণতান্ত্রিক পদ্ধতির পরিচায়ক। বিজিত অঞ্চলের ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা, বৈদেশিক বণিকদের অধিকার ও দায়িত্ব, প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ, যুদ্ধাভিযানে খলিফার ভূমিকা, সৈন্যদের বেতন কাঠামো নির্ধারণ, সুষ্ঠু শাসন-ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং দৈনন্দিন শাসনকার্য পরিচালনা প্রভৃতি বিষয়ে মজলিস-উস্-শূরা পরামর্শ দান করতেন। কোন জটিল বিষয়ের সমাধান না হলে একাদিক্রমে শূরায় বৈঠক চলত। মজলিস-উস্-শূরার অনুমোদনক্রমে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কার্য বিভিন্ন ব্যক্তির উপর ন্যস্ত করা হত; যেমন- হযরত আবুবকরের খিলাফতে বিচার এবং যাকাত বিতরণের দায়িত্ব ছিল হযরত ওমরের উপর। হযরত আবুবকর এবং হযরত ওমরের শাসনামলে হযরত আলী রাষ্ট্রীয় পত্রাদি লিখতেন এবং যুদ্ধবন্দীদের তদারক করতেন। সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, খিলাফতের শাসন পরিচালনার ব্যাপারে অতি নগণ্য ব্যক্তিও অংশগ্রহণ এমনকি পরামর্শ দান করতে পারতেন। কুফা,
বসরা ও সিরিয়ায় রাজস্ব আদায়কারী নিযুক্তির ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণের পরামর্শ গ্রহণকরা হত। এভাবে শাসক ও জনসাধারণের মধ্যে সৌহার্দ্যভাব গড়ে উঠত।
প্রশাসনিক বিভাগ
খোলাফায়ে রাশেদূনের সময় শাসনকার্য সুষ্ঠুরূপে পরিচালনার জন্য এবং প্রশাসনিক ও সাময়িক প্রয়োজনে সমগ্র ইসলামী রাষ্ট্রকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়। বাহরাইন ও আহওয়াজ নিয়ে একটি প্রদেশ গঠিত হয়। সিজিস্তান, মেকরান ও কিরমান অপর একটি প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাবারিস্তান, খোরাসান এবং উত্তর পারস্য নিয়ে আর একটি প্রদেশ ছিল। ইরাক দুটি প্রশাসনিক কেন্দ্রে বিভক্ত হয়, যেমন কুফা ও বসরা। বায়জানটাইনদের দ্বারা শাসিত অঞ্চলসমূহ মুসলমানদের দখলে আসলে খলিফা সমগ্র বিজিত প্রদেশকে কয়েকটি ‘জুনদ’ অথবা সামরিক প্রদেশে বিভক্ত করেন; যেমন-দামেস্ক, হিমস্, গ্যালিলী হতে আরম্ভ করে সিরিয়ার মরুভূমি পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল উরদুন তথা জর্দান নামে পরিচিত ছিল। এছাড়া এহাড্রিলনের সমতল ভূমির দক্ষিণে অবস্থিত ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইন একটি প্রদেশ ছিল। হযরত ওমরের শাসনামলে মিসর বিজিত হলে সমগ্র দেশটিকে দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়। রোমানদের সময়ে মিসরে যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু ছিল তা মুসলিম আমলেও অপরিবর্তিত থাকে। মিসরের প্রশাসনিক বিভাগ ‘পাগাকী’ নামে পরিচিত ছিল; এই ‘পাগাকীর’ উপর রাজস্ব আদায় এবং অপরাপর প্রশাসনিক কার্য পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল।
প্রাদেশিক শাসন-ব্যবস্থা
হযরত ওমরকে যথার্থই ইসলামী শাসন-ব্যবস্থার প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তাঁর আমলে সমগ্র আরব জাহান চৌদ্দটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল; যথা- মক্কা, মদিনা, সিরিয়া, জাজিরা, বসরা, কুফা, মিসর, ফিলিস্তিন, ফারস, খোরাসান, কিরমান, মেকরান, সিজিস্তান ও আজারবাইজান। প্রাদেশিক শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রতি প্রদেশে একজন শাসনকর্তা বা ‘ওয়ালী’ নিযুক্ত করা হত। মজলিস-উস্-শূরার অনুমোদনক্রমে এই শাসনকর্তাদের নিযুক্ত করা হত। তাঁরা তাঁদের কার্যক্রমের জন্য খলিফার নিকট দায়ী থাকতেন। ওয়ালিগণ নামাজে ইমামতী এবং জুমার নামাজের খোৎবা পাঠ করতেন। ন্যায়নিষ্ঠ, শ্রদ্ধাভাজন, কর্তব্যপরায়ণ লোকদের ওয়ালী নিযুক্ত করা হত এবং তাঁরা প্রদেশের প্রশাসন প্রধানের দায়িত্ব পালন করতেন। স্বৈরাচার হতে জনগণকে অব্যাহতি প্রদানের জন্য ওয়ালীদের উপর কঠোর দৃষ্টি রাখা হত। আয়ের তুলনায় অধিক সম্পত্তি লাভের অভিযোগে হযরত ওমর আবু হোরায়রা এবং আমর-বিন- আল-আসের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। খলিফার প্রতিনিধি হিসেবে প্রদেশের আইন-শৃঙ্খলা, সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ, সামরিক অভিযান প্রেরণ ইত্যাদি কার্যাবলির দায়িত্বও তাঁর উপর ন্যস্ত ছিল। এমনকি বিচারকের অবর্তমানে তাঁকে বিচারকার্যও সমাধা করতে হত। রাজস্ব ব্যবস্থার তদারক ও প্রাদেশিক কোষাগারও তাঁর দায়িত্বে ছিল। কোষাগারের দায়িত্বে নিয়োজিত কোষাধ্যক্ষ খলিফার নিকট হিসাব দাখিল করতেন। প্রত্যেক প্রদেশে একটি প্রশাসন ভবন (দিওয়ান) এবং শাসনকর্তার বাসস্থান (দার-উল- আমরা) ছিল। প্রাদেশিক প্রশাসনে অপরাপর যে সমস্ত কর্মচারী নিয়োজিত ছিলেন তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আমিন। শাসন-ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রতিটি প্রদেশকে কয়েকটি জেলায় ভাগ করা হয় এবং জেলার শাসনকর্তা আমিন নামে পরিচিত ছিলেন। প্রশাসনিক কার্যক্রমের জন্য তিনি ওয়ালীর নিকট দায়ী ছিলেন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রত্যেক প্রদেশে কাযী অর্থাৎ বিচারক নিযুক্ত করা হত। এছাড়া ছিলেন ‘সাহিব-উল-খারাজ’ অর্থাৎ রাজস্ব সচিব, ‘সাহিব উল- বায়তুল মাল’ অর্থাৎ অর্থ সচিব, ‘সাহিব আল-আহদিস’ অর্থাৎ পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তা। দুর্নীতি বন্ধ করবার জন্য কর্মচারীদের উপযুক্ত বেতন দেওয়া হত এবং দুষ্কর্মের জন্য কর্মচারীদের বরখাস্ত এবং প্রয়োজনে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হত।
রাজস্ব-ব্যবস্থা
ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য একটি সুসমাঞ্জস্যপূর্ণ রাজস্ব ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়। রাষ্ট্রের রাজস্বের প্রধান উৎস ছিল (ক) ‘যাকাত’, (খ) ‘খারাজ’, (গ) ‘জিজিয়া’, (ঘ) ‘আল-ফে’, (ঙ) ‘আল-উশর’, (চ) ‘উশুর’ ও (ছ) ‘গনিমাহ’।
রাসূলুল্লাহ যাকাতকে শুধু ইসলামের একটি অন্যতম বিধান হিসাবেই কায়েম করেন নি, বরং রাষ্ট্রীয় আয়ের একটি উৎস হিসেবেই চিহ্নিত করে গেছেন। খলিফাগণ যাকাতের গুরুত্ব উপলব্ধি করে এর কোন রদবদল করেন নি। বিত্তশালী মুসলমানদের উদ্বৃত্ত ধন-সম্পদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ দুস্থ জনগণের মধ্যে বিতরণের নির্দেশ কুরআন শরীফে রয়েছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েমের সঙ্গে সঙ্গে রাজস্বের একটি অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে ‘যাকাত’ উৎপাদিত ফসল অথবা শস্য, স্বর্ণ-রৌপ্য, উট, মেষ, ঘোড়া ও ছাগলের উপর ধার্য হয়। রাসূলুল্লাহের সময় ধার্য করা না হলেও হযরত ওমর ঘোড়ার উপর ‘যাকাত’ ধার্য করেন; এর প্রধান কারণ ঘোড়া ব্যবসার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি।
ভূমি রাজস্ব সাধারণত খারাজ নামে পরিচিত। আরব দেশের বাইরে ইসলামের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে জমির পরমাণ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে হযরত ওমরের খিলাফতে যে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তার ফলে এরূপ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, বিজিত অঞ্চলে আরব সৈন্যবাহিনী কোনরূপ জমিজমা রাখতে পারবে না। আরব সৈন্যবাহিনী তথ্য আরব জাতীয়তাবাদকে সংরক্ষিত করবার জন্য তিনি এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। অধিকৃত অঞ্চল পূর্ববর্তী জমির মালিকদের অধিকারেই থাকে এবং তাদের একটি নির্দিষ্ট হারে ‘বায়তুল মালে’ কর দিতে হত। হযরত ওমরের আমলে উসমান ইবন-হুনাইফ আল-আনসারীকে ইরাকে ভূমি জরীপ করবার জন্য পাঠানো হয়। এই জরিপের ফলে নির্ধারিত হয় যে, ভূমি রাজস্ব প্রদানের উপযোগী জমির পরিমাণ ৩৬,০০০,০০০ জরিব। স্থিরীকৃত হয় যে, এক জরীব জমির উৎপাদিত গমের উপর এক দিরহাম বার্ষিক কর ধার্য করা হবে এবং উপরোল্লিখিত এই জমিতে বার্লি উৎপাদিত হলে রাজস্ব হবে এক দিরহামের অর্ধেক। খেজুর ও আঙ্গুর উৎপন্ন হলে এক জরীব জমির উপর দশ দিরহাম কর ধার্য করা হয়। অপরাপর উৎপাদিত ফসলের উপর করের হার ছিল : তুলা – ৫ দিরহাম; তিল – ৮ দিরহাম।
বলা বাহুল্য, অনুর্বর জমির উপর কোন খারাজ ধার্য করা হত না। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম জরিপের ফলে রাজস্ব অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং এর পরিমাণ ১২,৮০,০০,০০০ দিরহামে দাঁড়ায়। সিরিয়া ও মিসরের অধিকৃত অঞ্চলে জরিপ কার্য পরিচালনা করা সম্ভবপর হয় নাই এবং সেখানে রোমীয় রাজস্ব ব্যবস্থাই প্রচলিত থাকে। তবুও সিরিয়া হতে হযরত ওমরের রাজত্বে ১,৪০,০০,০০০ দিনার রাজস্ব আদায় হয়। মিসরের ক্ষেত্রে অবশ্য তিনি খুবই উদার মনোভাব প্রকাশ করেন। কারণ ইরাক অপেক্ষা মিসর ছিল অনুর্বর। পূর্ববর্তী ব্যবস্থা অনুযায়ী জমির উৎপাদনের কিয়দংশ শস্য অথবা অর্থের আকারে রাজস্ব গ্রহণ করা হত। এই রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারিত হত প্রত্যেক বছরের উৎপাদিত শস্যাদির পরিমাণের উপর। এর হার ছিল এক জরীব জমির গমের উপর এক দিনার ও তিন ইরদাব (৫ বুশেলের সমান)। পারস্যে রাজস্ব ব্যবস্থার কোনরূপ পরিবর্তন সাধিত হয় নি, পূর্ববর্তী ব্যবস্থাই বলবৎ ছিল।
ইসলামী রাষ্ট্রকে অমুসলমানদের দেয় একটি বিশেষ করকে বলা হয় ‘জিজিয়া’। জিজিয়া কর বাধ্যতামূলক ছিল এবং এর বিনিময়ে অমুসলমানগণ জান-মালের নিরাপত্তা লাভ করত। উপরন্তু, তাদের সামরিক বাহিনীতে যোগদান হতে অব্যাহতি দেওয়া হত। নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও অক্ষম এবং সামরিক বিভাগে কর্মরত অমুসলমানদের এই কর হতে রেহাই দেওয়া হত। এমনও নজির আছে যে, শত্রুর আক্রমণ হতে রক্ষা করতে অসমর্থ হওয়ায় অমুসলমানদের জিজিয়া মওকুফ করে দেওয়া হয়। এরূপ একটি দৃষ্টান্ত দেখা যায় ইয়ারমুক যুদ্ধের পূর্বে যখন হিম্স, দামেস্ক প্রভৃতি স্থান হতে মুসলিম বাহিনী অপসারিত হয় তখন অমুসলমানদের প্রদত্ত জিজিয়া ফেরত দেওয়া হয়। ‘জিজিয়া’র ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, এটি ইসলাম কর্তৃক প্রবর্তিত কোন নতুন কর নয়; পারস্য (সাসানীয়) এবং বায়জানটাইনদের অধীনে নব-অধিকৃত অঞ্চলের অধিবাসীদের এই কর প্রদান করতে হত। মাথাপিছু এই করের পরিমাণ ছিল বার্ষিক ৪ দিনার, ধর্মযাজকদের জন্য ২ দিনার, মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের লোকদের জন্য ১ দিনার। আমর-ইবন-আল-আস প্রত্যেক বয়স্ক লোকের উপর মিসরে দুই দিনার জিজিয়া কর ধার্য করেন।
বেওয়ারিশ ও খাস জমি, বিদ্রোহীদের নিকট হতে বাজেয়াপ্ত জমি এবং অনাবাদ ও অন্যান্য ভূমি হতে যে রাজস্ব আদায় হত তাই ‘আল-ফে’ নামে পরিচিত। এই সমস্ত জমি হতে সংগৃহীত কর জনহিতকর কার্যে ব্যবহৃত হত। উল্লেখযোগ্য যে, ‘খারাজ’ অপেক্ষা ‘আল-ফে’র পরিমাণ কম ছিল। ‘আল-ফে’ ছাড়াও রাষ্ট্রীয় চারণ ভূমি ‘হিমা’ নামে পরিচিত ছিল। রাসূলুল্লাহর সময়ে এই ব্যবস্থা প্রচলিত হয়। খোলাফায়ে রাশেদূন-এর আমলে আল-ফে হতে প্রায় ৭,০০,০০০ দিরহাম আদায় হত।
জমির উৎপাদিত শস্য হতে অপর এক ধরনের রাজস্ব আদায় করা হত এবং এই সমস্ত জমির বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, যে সমস্ত জমিতে নিয়মতান্ত্রিকভাবে পানি-সিঞ্চন করবার ব্যবস্থা ছিল, সমস্ত জমি হতে উৎপন্ন ফসলের এক-দশমাংশ আল-উশর রাজস্ব হিসাবে গ্রহণ করা হত। যে সমস্ত জমিতে পানি সেচের ব্যবস্থা সন্তোষজনক ছিল না সে সমস্ত ভূমি হতে উৎপন্ন ফসলের বিশ ভাগের একভাগ মুসলিম রাষ্ট্রকে কর দিতে হত। লক্ষণীয় যে, ক্ষুদ্র ভূখণ্ড হতে এই ধরনের কর গ্রহণ করা হত না, কেবলমাত্র বৃহৎ জমিদারী হতে এই কর আদায় করা হত।
ইসলামী রাষ্ট্রের অপর একটি করের উৎস হচ্ছে “উশূর’ বা বাণিজ্য কর। কোন বিদেশী বণিক ইসলামী রাষ্ট্রে আগমন করলে তাদের শতকরা দশ দিরহাম হারে এই কর দিতে হত। অমুসলিম বণিকদের ৫% এবং মুসলমান ব্যবসায়ীদের ২.৫% হারে আমদানিকৃত পণ্যের উপর কর ধার্য করা হত অবশ্য পণ্যের দাম ২০০ দিরহামের কম হলে কর মওকুফ করা হত।
‘গনিমাহ’ অর্থ যুদ্ধলব্ধ ধনসম্পদ। এ সমস্ত লুণ্ঠিত সম্পদের পাঁচ ভাগের এক ভাগ বায়তুল মালে এবং বাকি চার ভাগ সৈন্যদের মধ্যে বিতরণ করা হত। সরকারি কোষাগারে যে এক-পঞ্চমাংশ জমা হত তা ‘খুম্ম্স’ নামে পরিচিত। হযরত ওমরের সময়ে ‘খুমসে’র যে অংশ রাসূলুল্লাহ ও তাঁর আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিতরণ করা হত তা সৈন্যবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র ও সরঞ্জাম ক্রয়ে ব্যবহৃত হত।
রাসূলুল্লাহর সময়ে রাষ্ট্রীয় অর্থ প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বণ্টন করে দেওয়ার ফলে কোষাগার অর্থাৎ ‘বায়তুল-মাল’ গঠনের বিশেষ কোন প্রয়োজনীয়তা ছিল না এবং এই ব্যবস্থা হযরত আবুবকরের সময়েও অব্যাহত ছিল; কিন্তু হযরত ওমরের সময়ে ইসলামের সম্প্রসারণের ফলে বিজিত অঞ্চল হতে অফুরন্ত রাজস্ব আদায় হতে থাকলে প্রাপ্ত অর্থ নিরাপদে সংরক্ষণের জন্য ‘বায়তুল-মাল’ গঠিত হয়। এই কোষাগার স্থাপনের পরামর্শ দেন ওয়ালিদ ইবন-হিশাম এবং আবদুল্লাহ ইবন-উল-আরফান প্রথম কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। কোষাগারের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য অপরাপর কর্মচারী নিযুক্ত করা হয়। মদিনায় ও নব-গঠিত প্রদেশসমূহে বায়তুল-মাল স্থাপিত হয়। প্রদেশে সাধারণত শাসনকর্তার বাসগৃহের সংলগ্ন স্থানে কোষাগার নির্মিত হত যাতে এর উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভবপর হয়।
উত্তর আফ্রিকার ত্রিপলি থেকে ভারত উপমহাদেশের সীমান্ত পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্র বিস্তৃতি লাভ করলে হযরত ওমর বিভিন্ন প্রদেশ হতে প্রেরিত রাজস্ব গ্রহণ ও পুনর্বণ্টনের উপযুক্ত ব্যবস্থার জন্য একটি রাজস্ব বিভাগ অথবা ‘দিওয়ান’ প্রতিষ্ঠা করেন। সংগৃহীত অর্থ রাজকীয় কার্যে ব্যয়ের জন্য একটি সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হত। সামরিক ব্যয় ছাড়া বেসামরিক খাতেও অর্থ বরাদ্দ করা হত। বিভিন্ন খাতে অর্থ ব্যয় করবার পর উদ্বৃত্ত অর্থ আরব ও অনারব মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করা হত এবং এই ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট নীতি অনুসৃত হত। ভাতা গ্রহণকারীদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করা হত এবং ভাতার হার ছিল নিম্নরূপ :
রাসূলুল্লাহর বিধবা প্ৰত্যেক পত্নী – ১২,০০০ দিরহাম
বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী – ৫,০০০ দিরহাম
বদরের যুদ্ধের পূর্বে ইসলাম গ্রহণকারী আনসার ও মোহাজের – ৪,০০০ দিরহাম
বদরের যুদ্ধের পূর্বে ইসলাম গ্রহণকারী আনসার ও মেহাজেরদের সন্তান সন্তুতিগণ – ২,০০০ দিরহাম
মক্কার অধিবাসী ও অপরাপর লোকজনের প্রত্যেকে – ৮০০ দিরহাম
অন্যান্য মুসলমানগণ – ৬০০ থেকে ২০০ দিরহাম
মুসলমানদের মধ্যে অতিরিক্ত অর্থ বণ্টনের ব্যবস্থা ইতিহাসে বিরল। অনুর্বর আরব দেশের ধন-সম্পদ তাদের কালাতিপাতের জন্য যথেষ্ট ছিল না এবং এই কারণে যাতে সম্পদ একই হস্তে কেন্দ্রীভূত হতে না পারে এবং বিশেষ করে যাতে দুস্থ মুসলমানদের আর্থিক অনটন দূরীভূত হয় সে কারণে অতিরিক্ত অর্থ বণ্টন করা হত। ধন-সম্পদ সুষম বণ্টনের ফলে ধনতন্ত্র সৃষ্টি সম্ভবপর ছিল না। অবশ্য হযরত ওমরের খিলাফতের পর এই ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়।
শাসন নীতি
হযরত ওমর প্রশাসনিক দূরদর্শিতার অধিকারী ছিলেন। তাঁর খিলাফতের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তিনি ইসলামী শাসন ব্যবস্থার এরূপ রূপরেখা নির্ধারণ করেন যা পরবর্তীকালেও অনুসৃত হয়। তিনি নির্দেশ দেন যে আরবীয় মুসলমানগণ বিজিত দেশে জমিজমা অধিকার করতে পারবে না। তিনি আরবদের একটি শক্তিশালী সামরিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে সামাজিক ও বৈবাহিক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার জন্য এই নির্দেশ দেন। আরব জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে হযরত ওমর মিসরে আরব সৈন্যবাহিনীকে জমিজমা দখল হতে নিবৃত্ত করেন এবং অনারব বিজিত অঞ্চলের জমিজমা পূর্ববর্তী মালিকদের বংশপরস্পরায় ভোগদখল করবার নির্দেশ দেন। কেবল মিসরেই নহে, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া এবং ইরানেও ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে এই নীতি বলবৎ ছিল। বিজিত অঞ্চলে সৈন্যবাহিনী সাধারণত ছাউনিতে থাকত। এই সমস্ত ছাউনি অথবা সেনানিবাস প্রতিষ্ঠিত হয় হিম্স, কুফা, বসরা, জাজিরা, আহওয়াজ, তাবারীয়া, লুদ, রামলা, ফুসতাত ও আলেকজান্দ্রিয়ায়। এই সমস্ত সামরিক ঘাঁটিতে সৈন্যরা বসবাস করত এবং তাদের স্থানীয় কোন জমিজমা ক্রয়, দখল বা ভোগ করবার অধিকার ছিল না। এর ফলে পূর্ববর্তী জমির মালিকগণ উৎপাদনে নির্বিঘ্নে মনোনিবেশ করতে পারত। ফলে হযরত ওমরের সময়ে রাজস্ব অস্বাভাবিক পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। আরব জাহানের ঐক্য ও সংহতি অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্য হযরত ওমর খাইবারের ইহুদী এবং নাজরানের খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে আরব-ভূখণ্ড হতে বিতাড়িত করেন।
সেনাবাহিনী
খোলাফায়ে রাশেদূনের সময়ে মুসলিম সেনাবাহিনী ছিল অত্যন্ত দক্ষ, সুশৃঙ্খল এবং বিশাল! অন্যথায় রাসূলুল্লাহর মৃত্যুর ত্রিশ বছরের মধ্যে মদিনা কেন্দ্রিক ইসলামী রাষ্ট্র সুদূর বিস্তৃত হতে পারত না। হযরত আবুবকরের খিলাফতে মুসলিম বাহিনী সুদৃঢ় ছিল। অন্যথায় রাষ্ট্রদ্রোহী আন্দোলনকে সমূলে উৎপাটিত করা সম্ভবপর হত না। সামরিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার ফলে হযরত আবুবকর আরব-ভূখণ্ডের সমস্ত বিদ্রোহই কঠোর হস্তে দমন করেন এবং তিনি রাসূলুল্লাহর ইচ্ছানুসারে জায়েদের পুত্র উসামাকে বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযানে প্রেরণ করেন। হযরত ওমরের খিলাফতে মুসলিম সৈন্যবাহিনী সুসংঘবদ্ধ ও সুগঠিত ছিল এবং আরব ও অনারব মুসলমানগণ সৈন্যবাহিনীর সদস্য ছিল। তিনি নিয়মিত সৈন্যবাহিনী গঠন করে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেন; যথা- অশ্বারোহী, পদাতিক এবং তীরন্দাজ। এছাড়া সৈন্যবাহিনীতে আরও দুটি নতুন শ্রেণী গঠিত হয়— স্কাউট অথবা গুপ্তচর দল এবং সার্ভিস কোর। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যগণ ঢাল, তলোয়ার, দীর্ঘ বর্শা ব্যবহার করত। অশ্বারোহিগণ বর্ম ও লৌহ শিরস্ত্রাণ পরিধান করত।
সামরিক বাহিনীর প্রধান সোপান অশ্বারোহী দলের জন্য ছাউনিতে আস্তাবল নির্মিত হয়। জরুরী অবস্থা মোকাবিলা করবার জন্য ৪,০০০ অশ্বারোহী সৈন্যের একটি বাহিনী সর্বদা প্রস্তুত রাখা হত। পদাতিকগণ পায়জামা এবং জুতা পরিধান করত। এই বাহিনীর প্রধান কাজ ছিল, যুদ্ধক্ষেত্রে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি ব্যুহ রচনা করা। সৈন্যসমাবেশের এই অভিনব পন্থা আরবদের জানা ছিল এবং শত্রুর মোকাবিলা করবার জন্য এতে পাঁচটি ভাগ ছিল : অগ্রভাগ, মধ্যভাগ, পশ্চাৎভাগ, ডান ভাগ এবং বাম ভাগ। সর্বাপেক্ষা অগ্রবর্তী দলকে বলা হত ‘মোকাদ্দমা’—এই দলটিই শত্রুপক্ষকে আক্রমণের সূচনা করত। মধ্যবর্তী দল ‘কলব’ নামে পরিচিত। এই দরটি সৈন্যাধ্যক্ষকে পরিবেষ্টিত করে রাখত। এছাড়া ডান, বাম ও সর্বপশ্চাতের বাহিনীর নাম ছিল যথাক্রমে ‘মায়মানা’, ‘মায়সারা’ ও ‘মাকাহ’।
সৈন্যবাহিনীর সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য একজন অধিনায়ক নিযুক্ত হতেন। তিনি ‘আমীর’ নামে পরিচিত এবং খলিফার নিকট তাকে জবাবদিহি করতে হত। দুটি বাহিনী একত্রে যুদ্ধযাত্রা করলে একজন সর্বাধিনায়ক বা সিপাহসালার হিসাবে কাজ করতেন। একটি সৈন্যবাহিনী কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হত এবং এক একটি বিভাগ ‘কায়েদের’ নেতৃত্বে যুদ্ধ করত। এরূপে এক একটি সৈন্যবাহিনীতে দশটি কায়েদের বাহিনী থাকত। প্রতিটি কায়েদের বাহিনীতে একশত জন সৈন্য কার্যরত থাকত। প্রতিটি কায়েদ আবার কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপদলে বিভক্ত হত এবং দশজন সৈন্যের এই উপদলটির নেতৃত্ব দিতেন এক একজন আমীর-উল-আশরাহ অর্থাৎ সেনাপতি। পদাতিক ছাড়াও যুদ্ধক্ষেত্রে ফলাফল নির্ধারণে তীরন্দাজ বাহিনীর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া স্কাউটদের প্রধান কর্তব্য ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে সেনাধ্যক্ষের নিকট সংবাদ প্রদান। হযরত ওমর সর্বপ্রথম দেহরক্ষী সৈন্যবাহিনী নিয়োগ করেন। সর্বাধিনায়ক প্রাত্যহিক জামাত ও জুমার নামাজে ইমামতি করতেন। প্রথমদিকে প্রধান সামরিক অধিকর্তা ‘আমীর’ নামে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে ইসলামের সম্প্রসারণের ফলে অনারব মুসলমানগণ সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করলে তাদের তত্ত্বাবধান করবার জন্য ‘আরীফ’ নামে একজন সামরিক কর্মচারী নিয়োগ করা হয়। উপজাতীয়দের দ্বারা গঠিত এই বাহিনীর সঙ্গে মূল সেনাবাহিনীর যোগাযোগ এবং প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনই ছিল আরীফের প্রধান কর্তব্য। এটি সাধারণত বায়জানটাইন সেনাবাহিনীর ‘ডেকোরিয়ান’ পদের সমতুল্য ছিল। কোন কোন ক্ষেত্রে সৈন্যদের স্ত্রী-পুত্রও সেনাবাহিনীতে থাকত। যুদ্ধক্ষেত্রে রসদ সরবরাহের দায়িত্ব হযরত ওমর ‘আহরা’ নামক একটি সংস্থার উপর ন্যস্ত করেন। আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে প্রাচীর নির্মাণ অথবা পরিখা খনন করা হত।
খোলাফায়ে রাশেদূনের সময়ে সর্বমোট নয়টি জুনদ্ বা সামরিক বিভাগ ছিল। এইগুলো কুফা, বসরা, দামেস্ক, ফুসতাত, হিস, প্যালেস্টাইন, উরদুন এবং মদিনায় অবস্থিত ছিল। এছাড়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সামরিক ঘাঁটি ছিল। সৈন্যদের বাসগৃহ ছিল এবং তাদের চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত ছিল। প্রত্যেক সৈন্যকে বার্ষিক ৩০০ হতে ৬০০ দিরহাম বেতন দেয়া হত। এছাড়া প্রত্যেক সৈন্যের স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা ভাতা পেত। প্রথমদিকে সৈন্যদের উপর হতে এবং পরে উশূর কর হতে বেতন দেয়া হত। উপরন্তু, যুদ্ধলব্ধ ধন-সম্পদের জত(৪,৫) ভাগ সৈন্যদের মধ্যে বিতরণ করা হত। তদুপরি সরকার পরিচালিত রন্ধনশালা ও সরবরাহ কেন্দ্র হতে খাদ্যদ্রব্য, পোশাক ও জুতা সরবরাহ করা হত। প্রথমদিকে সৈন্যবাহিনীতে মোট ৩০০০ হতে ৫০০০ সৈন্য ছিল। পরবর্তীকালে ঐ সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা ৯০,০০০-এ দাঁড়ায়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সিফফিনের যুদ্ধে হযরত আলী মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে ৯০,০০০ সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনী সমাবেশ করেন। প্রত্যেক জুনদে কমপক্ষে ৪,০০০ অশ্ব এবং ৩৬,০০০ অশ্বারোহী সৈন্য মোতায়েন থাকত।
নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, নিষ্ঠা মুসলিম সেনাবাহিনীর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। অভিযান পরিচালনা ও উহার আনুষঙ্গিক কার্যাবলি; যেমন- রসদ সংগ্রহ, যানবাহন, তাঁবু সংস্থান ইত্যাদি কাজেও তারা অপূর্ব দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে। আত্মরক্ষার অভিনব পন্থাও মুসলিম বাহিনীর অজানা ছিল না। অক্ষমতা অথবা কাপুরুষতার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা ছিল।
তিনদিকে পানি দ্বারা বেষ্টিত আরব-ভূমির অধিবাসিগণ স্বাভাবিকভাবে সমুদ্রচারী হয়ে উঠে এবং এ কারণে হযরত ওসমানের খিলাফতে আরব নৌবহর গঠন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। বলাবাহুল্য নৌবাহিনী ব্যতীত পারস্য ও বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের বহু অঞ্চল দখল করা সম্ভবপর ছিল না। হযরত ওসমান (রা) সর্বপ্রথম একটি আরব নৌবহর গঠন করেন এবং আবদুল্লাহ বিন-কায়েসকে নৌ-অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। তাঁর আমলে বায়জানটাইনদের বিরুদ্ধে অসংখ্যবার নৌ-অভিযান প্রেরিত হয়। মুসলিম নৌবহর ৬৪৯ ও ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে ভূমধ্যসাগরে সাইপ্রাস এবং রোড্স অধিকার করে। ৬৫২ খ্রিস্টাব্দে একটি বিশাল বায়জানটাইম নৌবহর উত্তর আফ্রিকার মুসলিম নৌবাহিনী কর্তৃক বিধ্বস্ত হয়। উপরন্তু, ভারত উপ-মহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে বিশেষ করে সিন্ধু অঞ্চলে আরব নৌবহর প্রেরিত হয়।
বিচার বিভাগ
খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে বিচার বিভাগ ছিল অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ ও সুগঠিত। খলিফাই ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারপতি। তিনি নিম্ন আদালতের রায়ের আপীল মঞ্জুর করতেন। বিচার বিভাগকে সুবিন্যস্ত করবার জন্য প্রত্যেক প্রদেশে একজন প্রধান বিচারক নিয়োগ করা হত। প্রত্যেক জেলায় ছিলেন একজন কাযী। কাযীকে নিযুক্ত করবার অধিকার ছিল মজলিস-উস-শূরার। কৌলিন্য, সত্যবাদিতা, সততা ও আইন সম্বন্ধে জ্ঞানের ভিত্তিতে যোগ্য ব্যক্তিকেই কাযী নিযুক্ত করা হত। হযরত ওমরের দূরদর্শিতার ফলে আইন বিভাগ প্রশাসন বিভাগ হতে পৃথক হয়ে যায়। শরীয়ত, কুরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াস অনুযায়ী বিচারকগণ বিচারকার্য সমাধা করতেন।
ধর্মীয় ব্যবস্থা
খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও বিধি-নিষেধগুলো পালনের জন্য কোন পৃথক বিভাগ ছিল না। খলিফা, সৈন্যবাহিনী ও জনগণই এই কাৰ্য সমাধা করতেন; মদিনার মসিজিদে ইমামতি ও হজ্ব অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব ছিল খলিফার। অনুরূপভাবে প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ নামাজে ইমামতি ও খুৎবা পাঠ করতেন। মসজিদকে কেন্দ্র করে মুসলিম স্থাপত্যের উন্মেষ হয় এবং খোলাফায়ে রাশেদূনের সময়ে ইসলামী কর্তৃত্ব সম্প্রসারিত হলে বিজিত অঞ্চলের সামরিক ছাউনিতে মসজিদ নির্মিত হয়; হযরত ওমরের শাসনামলে আরব দেশে ৪০০০ মসজিদ ছিল।
খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে অমুসলমান প্রজাগণ রাষ্ট্রের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারতেন। অমুসলমান প্রজাগণ সাধারণত ‘জিম্মী’ নামে পরিচিত ছিল। ওয়েলহাউসেন বলেন, “ওমর অমুসলমান প্রজাবর্গের সুযোগ-সুবিধার দিকে সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন এবং তাদের কল্যাণ সাধনে আত্মনিয়োগ করেন।” ধর্মমন্দির বা গীর্জার উপর হতে কর নিষ্কৃতি ইসলামের ন্যায়নিষ্ঠা ও উদারতার জ্বলন্ত প্রমাণ। এমনকি হযরত ওমর বায়তুল মাল হতে দুস্থ ও নিঃস্ব জিম্মীদের ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেন। মজলিস-উস-শূরাতে জিম্মীদের প্রতিনিধি থাকত। শাসনকার্য পরিচালনায় খ্রিস্টান ও পারসিকদের এবং ব্রাহ্মণদের পরামর্শ গ্রহণ করা হত। হিট্টির ভাষায়, “মুসলিম আইনের বাইরেও তারা তাদের নিজস্ব আইন-কানুনের সুযোগ গ্রহণ করতে পারতন এবং সে সব ক্ষেত্রে তাদের স্ব স্ব ধর্মীয় প্রধানগণ তাদের বিচার করতেন।” ইসলামের এসব উদারনীতি ও সাম্যবাদ বহু অমুসলমানকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে আকৃষ্ট করে।
পুলিশ বিভাগ
খোলাফায়ে রাশেদূনের শাসনামলে প্রথমদিকে পুলিশ বাহিনী ছিল না। জনগণের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য জনগণকেই সচেষ্ট থাকতে হত। হযরত ওমর রাত্রে প্রহরার ব্যবস্থা করেন। হযরত আলীর খিলাফতে একটি সুসংগঠিত পুলিশ বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিভাগ ‘শূরতা’ নামে পরিচিত ছিল এবং এর কর্মাধ্যক্ষকে ‘সাহিব-উস-শূরতা’ বলা হত। প্রত্যেক প্রদেশ এবং শহরে পুলিশ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হয়। শান্তি বজায় রাখা ছাড়াও বাজার পরিদর্শন, ওজন ও মাপ পর্যবেক্ষণ, অপরাধ দমন, ফেরারী আসামী গ্রেফতার এবং পৌরসভার কার্যাবলি ‘শূরতা’র অন্তর্গত ছিল।
শিক্ষা ব্যবস্থা
শিক্ষা বিস্তারে খলিফাগণ বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রতিটি মসজিদের সংলগ্নে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং কুরআন, হাদিস, ফিকহ সম্বন্ধে এই সকল মসজিদে শিক্ষা দেওয়া হত। হযরত ওমরের খিলাফতে একটি সু-পরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। খিলাফতের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয়, মকতব ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। কারিগণ কুরআন-হাদিসের আলোকে শিক্ষা বিস্তারে নিয়োজিত ছিলেন; সকল স্তরের জনগণ শিক্ষালাভে আকৃষ্ট হয়। সিরিয়ার একটি মক্তবে ছাত্রসংখ্যা দাঁড়ায় ১৬০০। ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়াও আইন অথবা ফিকহ্, ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব, অঙ্ক, দর্শন প্রভৃতির চর্চা করা হত। উল্লেখযোগ্য যে, হযরত আলীর সময়ে কুফা এবং বসরা দুইটি প্রধান শিক্ষা কেন্দ্রে পরিণত হয়।
জনহিতকর কার্য
প্রাদেশিক প্রশাসনের আওতায় জনহিতকর কার্যাবলি পরিচালনা করা হত। পৃথক কোন জনহিতকর বিভাগ খোলাফায়ে রাশেদূনের সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। কৃষিকার্যের উন্নতির জন্য সিরিয়া, ইরাক, মিসর ও দক্ষিণ পারস্যে জমি জরিপ করা হয়। প্রদেশ ও জেলায় জনসাধারণের মঙ্গলার্থে মসজিদ, পান্থশালা ও সেতু নির্মিত হয়; এছাড়া খাল খনন, সরকারি ভবন নির্মাণ, কোষাগার স্থাপন এই কার্যাবলির অন্তর্গত ছিল। ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস নদীতীরে বাঁধ নির্মাণ, কোষাগার স্থাপন এই কার্যাবলির অন্তর্গত ছিল। ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস নদীতীরে বাঁধ নির্মাণ এবং পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব একশ্রেণীর কর্মচারীর উপর ছিল। হযরত ওমরের অনুমতিক্রমে আরব ও মিসরের মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে আমর-ইবন-আল-আস একটি খাল খনন করেন। এটি ‘আমির-উল-মুমেনীন’ খাল নামে পরিচিত। এছাড়া নহর-ই-সাদ, নহর-ই-মালিক এবং নহর-ই-মুসা প্রভৃতি খাল খনন করে বহু অনাবাদী জমি চাষের সুবন্দোবস্ত করা হয়।
সামাজিক অবস্থা
খোলাফায়ে রাশেদূনের সময় আনসার, মোহাজের, বিভিন্ন আরব গোত্র ও বিজিত দেশের অমুসলমানদের নিয়ে সমাজ গঠিত ছিল। অবশ্য সামাজিক স্তর বিন্যাস ছিল; যেমন- আরব-গোত্রীয় মুসলমানগণ প্রথম শ্রেণীর, বিজিত দেশসমূহের নব-দীক্ষিত মুসলমানগণ দ্বিতীয় শ্রেণীর এবং ইহুদী, খ্রিস্টান ও পারসিক অমুসলমান সম্প্রদায় তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত ছিল। ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে অনারব গোত্র আরব গোত্রের সঙ্গে সংস্রব স্থাপন করতে পারত এবং সামরিক বিভাগে যোগ দিয়ে আরবদের সমপর্যায়ে আসতে পারত। ইসলাম ধর্মে দীক্ষা লাভ করেও অনেক পারসিক মওলায় পরিণত হয়। আরব গোত্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অনারবদের ‘মওলা’ বলা হয়।
খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে জীবন প্রণালী ছিল খুব সরল, সাধারণ এবং অনাড়ম্বরপূর্ণ। আল-বয়ানে-বর্ণিত আছে যে, বিশাল রাষ্ট্রের অধিপতি হয়েও খলিফাগণ অতি সাধারণ ও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। পর্ণকুটির ছিল তাঁদের বাসস্থান এবং পোশাক ছিল অতি সাধারণ। সর্বদা প্রহরারত প্রাসাদে খলিফাগণ বাস করতেন না। সাধারণ বাসগৃহ ছিল ইটের তৈরি একতলা এবং চত্বরে থাকত একটি কুয়া। মুসলিম স্থাপত্যের উন্মেষ হয় খোলাফায়ে রাশেদূনের সময়। হযরত ওমরের সময় ইসলামের সম্প্রসারণের সঙ্গে মুসলিম বাহিনী বিজিত অঞ্চলে বসবাস আরম্ভ করে এবং সে স্থানে মসজিদ স্থাপিত হয়। মদিনায় রাসূলুল্লাহ্ কর্তৃক নির্মিত ‘মসজিদ আল-নববীর’ অনুসরণে বসরা, কুফা ও ফুসতাতে মসজিদ নির্মিত হয়। আরব দেশের বাইরে প্রথমে বসরায় ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে ওকবা ইবন-গাজওয়ান একটি অতি সাধারণ মসজিদ নির্মাণ করেন। পরবর্তী পর্যায়ে বসরার শাসনকর্তা আবু মুসা-আল-আসয়ারী পোড়া ইট দ্বারা এটি পুনর্নির্মাণ করেন। ৬৩৮-৩৯ খ্রিস্টাব্দে কুফা বিজিত হবার পর সর্বাধিনায়ক সা’দ ইবন আবি-ওয়াক্কাস একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে মুয়াবিয়ার সময়ে জিয়াদ এর সংস্কার করেন। মিসর বিজিত হলে আমর-ইবন-আল-আস ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে ফুসতাতে (কায়রো) একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। বলা বাহুল্য যে, এ সমস্ত মসজিদের মাল – মসলা ছিল খুব নগণ্য, অস্থায়ী এবং অনাড়ম্বরপূর্ণ। এ সমস্ত ইমারত মুসলিম স্থাপত্যের প্রাথমিক পর্বের স্বাক্ষর বহন করে রয়েছে।
বেদুঈনদের পোশাক এখানকার মত সেকালেও ছিল আলখাল্লা, এক টুকরা চামড়ার বেল্ট দিয়ে বাঁধা ঢিলা পায়জামা ও মাথায় পাগড়ী। মহিলাগণ ব্যবহার করতেন ঢিলা পায়জামা, পিরহান ও দোপাট্টা। কিন্তু যুদ্ধ ও অশ্বারোহণের সময় তারা পায়জামা ও শার্ট পরিধান করতেন। অপেক্ষাকৃত ধনী ব্যক্তিগণ রেশমী ও পশমী কাপড় ব্যবহার করতেন। তাদের বাসগৃহও সুন্দররূপে সাজানো থাকত এবং কার্পেট ও ধাতব পদার্থের মূল্যবান আসবাবপত্র দ্বারা সেই গৃহশোভাও বর্ধন করা হত।