প্ৰথম পৰ্ব - ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি
দ্বিতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মক্কা জীবন
তৃতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মদিনা জীবন
চতুর্থ পর্ব - খোলাফায়ে রাশেদূন (৬৩২-৬৬৩ খ্রি.)
পঞ্চম পর্ব - উমাইয়া রাজবংশ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
ষষ্ঠ পর্ব - আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)
পরিশিষ্ট

পঞ্চম অধ্যায় : আব্বাসীয় খিলাফতের শেষার্ধ (৮৩৩-১২৫৮ খ্রি.)

পঞ্চম অধ্যায় – আব্বাসীয় খিলাফতের শেষার্ধ [৮৩৩-১২৫৮ খ্রি.] 

আল-মুতাসিম [৮৩৩-৮৪২ খ্রি.] 

সিংহাসন লাভ : ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে মামুনের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা আবু ইসহাক মুহম্মদ আল-মুতাসিবিল্লাহ উপাধি ধারণ করে আব্বাসীয় সিংহাসনে আরোহণ করেন। 

তুর্কী বাহিনী : রোমান সাম্রাজ্যের দেহরক্ষী বাহিনীর (Praetorian guards ) অনুকরণে আল-মুতাসিম আরব ও পারস্য সৈন্যদের ক্ষমতা হ্রাসের জন্য তুর্কীবাহিনী গঠন করেন। তুর্কী সৈন্যদের স্বেচ্ছাচারিতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে তিনি বাগদাদ হতে ৬০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে সামাররা অথবা ‘সুর-রা-মান-রাতে’ (দর্শকদের আনন্দদানকারী) ৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী স্থানান্তর করেন। নতুন রাজধানীতে তিনি বুলকাওয়ারা নামে একটি অপূর্ব সুন্দর রাজপ্রাসাদ, ২,৫০,০০০ সৈন্যের জন্য সেনানিবাস এবং ১ লক্ষ ৬০ হাজার অশ্ব রাখবার জন্য আস্তাবল নির্মাণ করেন। 

বিদ্রোহ দমন : ১৭,০০০ দুর্ধর্ষ জাঠ বিদ্রোহী ভারত থেকে ইরাকে অতর্কিত আক্রমণ করলে খলিফা তাদের পরাজিত ও বিতাড়িত করেন। মাজেন্দ্রানে পাপিষ্ঠ বাবেক পুনরায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত হলে তাকে দমন করবার জন্য খলিফা তুর্কী সেনাপতি আফসীনকে প্রেরণ করেন। বাবেক যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হলে মাজেন্দ্ৰান অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। বাবেকের পতনে প্রায় ৭,০০০ মুসলিম ও খ্রিস্টান মহিলা মুক্তিলাভ করে। 

বায়জানটাইনদের সাথে যুদ্ধ : আল-মুতাসিমের রাজত্বে বায়জানটাইনগণ মুসলিম সাম্রাজ্য আক্রমণ করে। সম্রাট থিওফিলাস মুতাসিমের জন্মস্থান জিবত্রা ভস্মীভূত করলে খলিফা ৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে একটি বিরাট সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। আনকারা নামক স্থানে শত্রুপক্ষকে বিধ্বস্ত করে থিউফিলাসের জন্মভূমি এমোরিয়াম শহর ধূলিসাৎ করা হয়। খলিফা কনস্টান্টিনোপল দখলের পরিকল্পনা করেন কিন্তু সামাররায় ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটিত হওয়ায় তিনি সম্রাট থিওফিলাসকে সন্ধিতে আবদ্ধ করে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন। 

মাজিয়ান বিদ্রোহ : ৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে মাজিয়ান নেতা মাজিয়ারের বিদ্রোহ দমনের জন্য খলিফা মামুন আবদুল্লাহ-ইবন-তাহিরকে প্রেরণ করেন। মাজিয়ার যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। মাজিয়ানদের সঙ্গে গোপন সম্বন্ধ থাকার অভিযোগে মুতাসিম তাঁর সুযোগ্য সেনাপতি আফসীনকে বন্দী করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন এবং সেখানে অনাহারে তাঁর মৃত্যু হয়। 

চরিত্র : দীর্ঘদিন রোগগ্রস্ত থাকবার পর মুতাসিম ৮৪২ খ্রিস্টাব্দে পরলোকগমন করেন। দৈহিক ও মানসিক ক্ষমতার অধিকারী মুতাসিম নির্দয় ও রুক্ষ স্বভাবের শাসক ছিলেন। শিল্পানুরাগী মুতাসিম মুতাজিলা মতবাদ প্রচার করবার চেষ্টা করেন এবং এই কারণে আহম্মদ-ইবন-হাম্বলকে নির্যাতন করতে তিনি দ্বিধা করেন নি। মৃত্যুকালে তিনি আল-ওয়াসিককে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। 

আল-ওয়াসিক (৮৪২-৪৭ খ্রি.) 

আল-মুতাসিমের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র আবু জাফর হারুন ‘আল-ওয়াসিক বিল্লাহ’ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে উপবিষ্ট হন। উদার, মহানুভব, শিক্ষিত, শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক আল-ওয়াসিক প্রায় ছয় বছরকাল নির্বিঘ্নে রাজত্ব করেন। কথিত আছে যে, তিনি একশত রাগ ও সুর রচনা করেন। সমৃদ্ধির স্বাক্ষরস্বরূপ বলা হয় যে তাঁর সাম্রাজ্যে কোন ভিক্ষুক ছিল না। ৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে আল-ওয়াসিকের মৃত্যু হলে আব্বাসীয় সিংহাসনে পর পর ২৮ জন খলিফা উপবিষ্ট হন। ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, “পরবর্তী দুই শতাব্দী যাবৎ তাদের ইতিহাস খলিফাগণের ক্ষমাতহীনভাবে সিংহাসনারোহণ এবং পরিতাপহীন মৃত্যুবরণের এক বিভ্রান্তিকর চিত্র তুলে ধরে।” 

আল-মুতাওয়াক্কিল (৮৪৭-৮৬১ খ্রি.) 

খলিফা আল-ওয়াসিকের মৃত্যুর পর ৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ভ্রাতা আল-মুতাওয়াক্কিল সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর নিষ্ঠুরতার জন্য ঐতিহাসিকগণ তাঁকে ‘আরবদের নীরো’ (Nero of the Arabs) বলে অভিহিত করেন। গোঁড়া সুন্নী মতাবলম্বী খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল শিয়া ও মুতাজিলাদের নির্যাতন করেন। মুতাজিলাদের সরকারি কার্য হতে বহিষ্কার, অমুসলমানদের রাজকার্যে নিযুক্তিতে অনীহা প্রভৃতি তাঁর গোঁড়া ধর্মান্ধতার পরিচায়ক। বিখ্যাত তুর্কী সেনাপতি ঈতাখের সাথে মতদ্বৈধতা হেতু তাঁকে হত্যা করা হয়। আল-মুতাওয়াক্কিল গোঁড়া সুন্নী মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং শিয়াদের নির্যাতন করেন। কারবালায় হুমাইনের মাজার তিনি ধূলিসাৎ করেন এবং সেখানে ওরস উদযাপন নিষিদ্ধ করেন। ইহুদী এবং খ্রিস্টানগণ মুসলমানদের তুলনায় অধিক কর প্রদান করত। আল-মুতাওয়াক্কিলের রাজত্বকালে সামাররা এবং আবুদুলাফে অপূর্ব কারুকার্যখচিত ইস্টকনির্মিত দুটি মসজিদ নির্মিত হয়। 

রাজকার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য আল-মুতাওয়াক্কিল সাম্রাজ্যকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেন : পশ্চিমাঞ্চল তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র আল-মুনতাসিরকে এবং পূর্বাঞ্চল অপর পুত্র আল-মু’তাজকে প্রদান করা হয়। মু’তাজকে খলিফা অধিক স্নেহ করতেন। খলিফা তাঁর নামে মুদ্রাঙ্কন করেন। এই পক্ষপাত নীতি তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র আল-মুনতাসিরকে ক্ষিপ্ত করে তোলে এবং ৮৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কয়েকজন তুর্কী সেনাপতির সাহায্যে রাত্রিতে পিতাকে হত্যা করে সিংহাসন লাভ করেন। মুতাসিমের গঠিত তুর্কী বাহিনীর দোর্দণ্ডপ্রতাপে জনসাধারণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠে এবং তাদের হাতে খলিফাগণ ক্রীড়নক হয়ে পড়েন। মুতাওয়াক্কিলের অপমৃত্যু তুর্কীবাহিনীর ষড়যন্ত্রের ফল; কারণ খলিফা তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। পরবর্তী খলিফা মুকতাদির তাদের সেনাপতিকে “আমীর উল- উমরাহ” উপাধিতে ভূষিত করলেও তারা খলিফাকে হত্যা করে। পরবর্তী খলিফা আল- কাহির বর্বর তুর্কী সৈন্যদল কর্তৃক সিংহাসনচ্যুত হন এবং দৃষ্টিশক্তি হারান। খলিফা আর- রাজীর আমলে আমীর-উল-উমরাহ-এর নাম খলিফার সাথে খুৎবায় পাঠ করা হত এবং মুদ্রায় তাদের নাম অঙ্কিত হত। পরবর্তী আব্বাসীয় খলিফা আল-মুত্তাকীয়ও তাদের হাতের ক্রীড়নক ছিলেন। তুর্কীদের নিষ্ঠুরতা এবং পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য খলিফা আল-মুত্তাকী বুয়াইয়াদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। তুর্কীদিগকে বিতাড়িত করে বুয়াইয়া আমীরগণ বাগদাদে শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন এবং স্বাধীন সালতানাৎ কায়েম করেন। 

আল-মুতাওয়াক্কিলের পরবর্তী খলিফাগণ 

৮৬১ খ্রিস্টাব্দে আল-মুতাওয়াক্কিলের মৃত্যু হতে ১২৪২ খ্রিস্টাব্দে আল-মুসতাসিমের সিংহাসনারোহণ পর্যন্ত ছাব্বিশজন আব্বাসীয় খলিফা রাজত্ব করেন। এই সমস্ত বিলাসপ্রিয় এবং শক্তিহীন খলিফাগণ হচ্ছেন আল-মুনতাসির (৮৬১-’৬২), আল- মুস’তায়ীন (৮৬২-’৬৬), আল-মু’তাজ (৮৬৬-৬৯), আল-মু’হতাদী (৮৬৯-’৭০), আল-মুতামিদ (৮৭০-’৯২), আল-মু’তাজিদ (৮৯২-৯০২), আল-মুতাফী (৯০২- ৯০৮), আল-মুকতাদির (৯০৮-’৩২), আল-কাহির (৯৩২-৩৪), আর-রাজী (৯৩৪- ‘৪০), আল-মুত্তাকী (৯৪০-’৪৪), আল-মুসতাকফী (৯৪৪-’৪৬), আল-মুতী (৯৪৬- ‘৭৪), আত-তা’ই (৯৭৪-’৯১), আল-কাদির (৯৯১-১০৩১), আল-কাইম (১০৩১- ‘৭৫), আল-মুকতাদী (১০৭৫-৯৪), আল-মুসতাহজির (১০৯৪-১১১৮), আল- মুসতারসিদ (১১১৮-৩৪), আর-রশীদ (১১৩৪-’৩৬), আল-মুতাফী (১১৩৬-’৬০), আল-মুসতানজিদ (১১৬০-’৭০), আল-মুসতাদী (১১৭০-৮০), আল-নাসির (১১৮০- ১২২৫), আজ-জাহির (১২২৫-’২৬), আল-মুসতানসির (১২২৬-৪2 )। 

আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের যুগের ইতিহাস বিষাদগ্রস্ত এবং বৈচিত্র্যহীন। ৮৯২ খ্রিস্টাব্দে আল-মুতাজিদ সামাররা হতে বাগদাদে রাজধানী পুনরায় স্থানান্তরিত করেন। আল-মুতাফীর আমলে ধর্মভ্রষ্ট কারামাতি সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হয়। আল-মুসতানসির বাগদাদে তাঁর নামানুসারে মুসতানসারিয়া বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। তুর্কীবাহিনীর নির্যাতন, বুয়াইয়া ও সেলজুকদের অভ্যুত্থান, ক্রুসেডের যুদ্ধ প্রভৃতি এই অধঃপতিত যুগের অন্যতম ঘটনাবলি যা আব্বাসীয় খিলাফতের পতনকে ত্বরান্বিত করে। 

আল-মুসতাসিম (১২৪২-১২৫৮ খ্রি.) 

আল-মুসতানসিরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র এবং সর্বশেষ আব্বাসীয় খলিফা আল- মুসতাসিম ১২৪২ খ্রিস্টাব্দে খিলাফতে অধিষ্ঠিত হন। এই দুর্বল, বিলাসপ্রিয় খলিফার রাজত্বকাল অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণে ভরপুর ছিল। হানাফী ও হাম্বলী সম্প্রদায়ের দ্বন্দ্ব এবং শিয়া ও সুন্নী সম্প্রদায়ের সংঘাত রাজ্যে অরাজকতার সৃষ্টি করে। তাঁর পুত্র আবুবকরকে তিনি শিয়াদের বাসস্থান ও কারখানা ধুলিসাৎ করতে আদেশ দেন। শিয়াদের দাসে পরিণত করা হয়। শিয়া সম্প্রদায়ের প্রতি এহেন নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে শিয়া উজীর মোহাম্মদ-বিন-কামী তাতারের মঙ্গল নেতা হালাকু খানকে বাগদাদ আক্রমণের আমন্ত্রণ জানান। খোদার অভিশাপ’ (Scourge of God) হালাকু খান গুপ্তঘাতক দলকে নিশ্চিহ্ন করে বাগদাদের দিকে রওয়ানা হন। খলিফা আত্মসমৰ্পণ করতে অস্বীকার করলে হালাকু খান বাগদাদ শহর অবরোধ করেন। দুর্বল খলিফা তাঁর সৈন্যবাহিনী দ্বারা দুর্ধর্ষ এবং রক্তপিপাসু মোঙ্গলদের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারেন নি। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদ নগরী ধ্বংস করা হয় এবং মুসতাসিমকে তাঁর পরিবারবর্গসহ হত্যা করা হয়। বাগদাদ নগরীর ধ্বংসযজ্ঞ বর্ণনা করতে হলে গীবনের মত ঐতিহাসিকের দক্ষতা প্রয়োজন। ছয় সপ্তাহ ধরে বাগদাদে নারকীয় লুঠতরাজ, নিরীহ জনসাধারণকে নিধন, অনুপম প্রাসাদ, মসজিদ, সমাধি প্রভৃতি ধুলিসাৎ করা হয়। শিক্ষায়তন ও গ্রন্থাগার ভস্মীভূত করা হয়। কমপক্ষে বিশ লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়! আমীর আলী বলেন, “পাঁচ শতাব্দী ধরে সঞ্চিত জ্ঞানভাণ্ডার নিমেষে মানবজাতি হারাল এবং একটি সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হল….. জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাদপীঠ, সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র এবং সারাসিনীয় জগতের চক্ষু এবং কেন্দ্র ‘বাগদাদ নগরী’ চিরতরে ধ্বংসপ্রাপ্ত হল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *