পঞ্চম অঙ্ক

পঞ্চম অঙ্ক

(তারপর পত্র ও সুরক্ষিত গহনার পেটিকাসহ সিদ্ধার্থকের প্রবেশ।)

সিদ্ধার্থক—কী আশ্চর্য, কী আশ্চর্য!

চাণক্যের নীতি যেন একটি লতা। কলসভরা জলের ধারা দিয়ে সিঞ্চিত করলে লতা যেমন যথাকালে প্রভূত ফল দেয়, দেশ-কাল-অনুসারে বুদ্ধির যথাযথ প্রয়োগে চাণক্যনীতিও তেমনি পরিণামে বিপুল কার্য সাধন করে!॥১॥ তাই আমি আর্য চাণক্যের পূর্বের লেখানো অমাত্য রাক্ষসের নাম-মুদ্রাঙ্কিত এই পত্র সঙ্গে রেখেছি। তাঁরই নাম-মুদ্রাঙ্কিত গহনার পেটিকাটিও নিয়েছি। চলেছি বটে পাটলিপুত্রে, এবার তবে এগোনো যাক্। (পরিক্রমা করে এবং দেখে) এ যে ভিক্ষু আসছে! যদিও জানি, এর দর্শন অলক্ষুণে, তবুও একে আমার দরকার। কাজেই একে এড়িয়ে যাব না।

ভিক্ষু—(প্রবেশ করে) ‘অহৎ’দের উদ্দেশে আমার প্রণাম। বুদ্ধির গাম্ভীর্যে এঁরা সংসারে লোকোত্তর উপায়ে সিদ্ধিলাভ করেন ॥২॥

সিদ্ধার্থক—ভদন্ত, প্ৰণাম।

ভিক্ষু—শ্রাবক, ধর্মসিদ্ধি হোক্। (ভালো করে দেখে) শ্রাবক, দেখে মনে হচ্ছে তুমি কোথাও যাবার জন্য তৈরি হয়ে বেরিয়েছ।

সিদ্ধার্থক—ভদন্ত, বুঝলেন কিসে?

ভিক্ষু শ্রাবক, এতে বোঝার কী আছে? পথে টানতে পটু তোমার হাতের চিঠিটিই যে তার চিহ্ন, তাইতেই বুঝেছি।

সিদ্ধার্থক—ভদন্ত ধরে ফেলেছেন। ভিন্‌ দেশে চলেছি। তা ভদন্ত বলুন দেখি—দিনটা আজ কেমন?

ভিক্ষু—(হেসে) শ্রাবক, মাথাটি মুড়োবার পরে জিগ্যেস করছ—নক্ষত্রটা কেমন!

সিদ্ধার্থক—ভদন্ত, এখনই আর গেলাম কই? বলুন। যাত্রার পক্ষে সময়টা যদি অনুকূল হয়, তবে যাব। নইলে যাওয়া বন্ধ রাখব।

ভিক্ষু—শ্রাবক, মলয়কেতুর শিবিরে পরিস্থিতিটা সম্প্রতি অনুকূল নয়।

সিদ্ধার্থক—ভদন্ত, বলুন দেখি কিসে এমন হল?

ভিক্ষু—শ্রাবক, শোন। আগে এই শিবিরে লোকের যাতায়াতে কোনো কড়াকড়ি ছিল না। এখন, এখান থেকে কুসুমপুর কাছে হওয়ায় ছাড়পত্র ছাড়া কাউকে বেরোতে বা ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। তাই যদি ভাগুরায়ণের কাছ থেকে ছাড়পত্র যোগাড় করে থাক, তবে নিশ্চিন্তে যাও। না হলে থাক। চৌকিদারদের হাতে পড়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় রাজ-দরবারে গিয়ে পড়ো না।

সিদ্ধার্থক—ভদন্ত কি জানেন না যে আমি অমাত্য রাক্ষসের ঘরের লোক? তাই, নাই বা রইল ছাড়পত্র, বেরোতে গেলে কার সাধ্য আমাকে আটকায়?

ভিক্ষু—(কড়া গলায়) শ্রাবক, রাক্ষসের লোকই হও, আর পিশাচের লোকই হও, ছাড়পত্র ছাড়া সেখানে থেকে বেরোবার জো নেই।

সিদ্ধার্থক—ভদন্ত, রাগ করবেন না। আমার যেন কার্যসিদ্ধি হয়।

ভিক্ষু—শ্রাবক, যাও তোমার কার্যসিদ্ধি হোক্। আমিও গিয়ে ভাগুরায়ণের কাছ থেকে ছাড়পত্র চেয়ে নিই। (উভয়ে নিষ্ক্রান্ত)

প্রবেশক সমাপ্ত।

(তারপর পশ্চাতে এক পুরুষ-সহ ভাগুরায়ণের প্রবেশ)

ভাগুরায়ণ—(স্বগত) সত্যি, আর্য চাণক্যের নীতি কী বিচিত্র!

ক্ষণে বীজের অঙ্কুরোদ্গম দেখা যায়, আবার ক্ষণে খুঁজে পাওয়া যায় না বলে দুৰ্জ্জেয়। কখনও এর প্রকাশ পূর্ণাঙ্গ, আবার প্রয়োজনের অনুরোধে কখনও অতি সূক্ষ্ম। এখনই মনে হচ্ছে, এর বীজগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। আবার পরক্ষণেই দেখা যাচ্ছে তার ফলের প্রাচুর্য। আহা, নয়জ্ঞ ব্যক্তির নীতি নিয়তির মতোই বহুরূপী ॥৩॥

(প্রকাশ্যে) ভদ্র ভাসুরক, কুমার চান না, আমি দূরে থাকি। অতএব এই সভামণ্ডপেই আমার বসার ব্যবস্থা কর।

পুরুষ—এই আসন, আর্য বসুন।

ভাগুরায়ণ—(বসে) ভদ্র, যদি কেউ ছাড়পত্রের জন্য আমার কাছে আসতে চায়, পাঠিয়ে দিও।

পুরুষ—আর্যের যা আদেশ। (নিষ্ক্রান্ত)

ভাগুরায়ণ—(স্বগত) এর যে কী কষ্ট! আমার ওপর কুমার মলয়কেতুর এত স্নেহ, অথচ তাঁকেই ঠকাতে হবে। হায়, কী দুঃসহ কাজ! অথবা—

নশ্বর ধনের লোভে বংশ, লজ্জা, আত্মযশ, মান-মর্যাদা—সব কিছুতে জলাঞ্জলি দিয়ে বিত্তবানের কাছে দেহ বিক্রি করে ফেলে বিচারের স্তর যে পেরিয়ে গেছে, সেই পরাধীন ব্যক্তি মনিবের আজ্ঞা পালন করতে গিয়ে এখন কেন কোনটা হিত, কোনটা অহিত—একথা চিন্তা করছে? ॥৪॥

(তারপর মলয়কেতুর প্রবেশ, পেছনে প্রতিহারী)

মলয়কেতু—(স্বগত) হায়! রাক্ষসের প্রতি নানা সন্দেহে আমার মন ব্যাকুল হওয়ায় কর্তব্য স্থির করতে পারছি না। কারণ, নন্দবংশের প্রতি রাক্ষসের রয়েছে প্রগাঢ় অনুরাগ। নন্দবংশের সঙ্গে সংসৃষ্ট মৌর্যের প্রতি রাক্ষসের ভক্তি জন্মাবার পেছনেও সেই অনুরাগ। কিন্তু মৌর্য এখন কৃতী চাণক্যকে যে মন্ত্রীপদ থেকে বিতারিত করেছে। তবে কি রাক্ষস চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করবেন? অথবা, প্রভুর প্রতি তার ভক্তির দৃঢ়তা অক্ষুণ্ণ রেখে সে নিজের পণ রক্ষা করবেন? এইভাবে ভাবিত আমার মন যেন কুমোরের চাকায় পড়ে খালি ঘুরছে ॥৫॥

(প্রকাশ্যে) বিজয়া, ভাগুরায়ণ কোথায়?

প্রতিহারী—কুমার, শিবির থেকে যারা বেরোতে ইচ্ছুক, তিনি তাদের ছাড়পত্র দিচ্ছেন।

মলয়কেতু—বিজয়া, একটু দাঁড়াও। এ উল্টোদিকে তাকিয়ে আছে, দুহাতে চোখ দুটো এর চেপে ধরি।

প্রতিহারী—কুমার যা আদেশ করেন।

পুরুষ—(প্রবেশ করে) আর্য এই যে এক ভিক্ষু ছাড়পত্রের জন্য আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।

ভাগুরায়ণ—নিয়ে এস।

পুরুষ—আচ্ছা। (নিষ্ক্রান্ত )

ভিক্ষু—(প্রবেশ করে)—শরণাগতের ধর্মসিদ্ধি হোক!

ভাগুরায়ণ—(দেখে স্বগত) আরে, এ যে রাক্ষসের মিত্র জীবসিদ্ধি! (প্রকাশ্যে) ভদন্ত, রাক্ষসের কোনো কাজের ব্যাপারে যাওয়া হচ্ছে না তো?

ভিক্ষু—(কানে আঙুল দিয়ে) এসব অলক্ষুণে কথা থাক্। শ্রাবক, সেখানেই যাব যেখানে রাক্ষস বা পিশাচের নামও শোনা যায় না।

ভাগুরায়ণ—বন্ধুর ওপর ভালোবাসার রাগটা জোর হয়েছে। তা, রাক্ষস ভদন্তের প্রতি কী অন্যায় করল?

ভিক্ষু—শ্রাবক, রাক্ষস আমার প্রতি কোনো অন্যায় করেনি। মন্দভাগ্য আমি নিজেই নিজের প্রতি অন্যায় করেছি।

ভাগুরায়ণ—ভদন্ত আমার কৌতূহল বাড়িয়ে দিচ্ছেন। শুনতে চাই।

মলয়কেতু—(স্বগত) আমিও শুনতে চাই।

ভিক্ষু—শ্রাবক, এ কথা শোনার মতো নয়, শুনে কী হবে?

ভাগুরায়ণ—যদি গোপনীয় হয়, তবে থাক্ ভিক্ষু—শ্রাবক, গোপনীয় নয়, কিন্তু অতি নৃশংস।

ভাগুরায়ণ—গোপনীয় না হলে বলুন।

ভিক্ষু—শ্রাবক, কথাটা গোপনীয় নয়, তবুও বলব না।

ভাগুরায়ণ—আমিও ছাড়পত্র দেব না।

ভিক্ষু—(স্বগত) অত অনুরোধ যখন করছে, তখন বলাই উচিত। (প্রকাশ্যে) কী আর করি? শ্রাবক শুনুন। হতভাগা আমি তো প্রথমে পাটলিপুত্রে থাকতাম; যখন রাক্ষসের সঙ্গে আমার মিত্রতা হয়। সেই সময়ে রাক্ষস গোপনে বিষকন্যা পাঠিয়ে মহারাজ পর্বতেশ্বরকে বধ করে।

মলয়কেতু—(সাশ্রুনেত্রে স্বগত) কী? রাক্ষস মেরেছে আমার বাবাকে, চাণক্য নয়?

ভাগুরায়ণ—ভদন্ত, তারপর, তারপর?

ভিক্ষু–তারপর, আমি রাক্ষসের মিত্র—এ কথা রাষ্ট্র করে নিষ্ঠুর চাণক্য আমাকে নির্যাতিত করে নগর থেকে বের করে দিল। নানা দুষ্কর্মে সিদ্ধহস্ত রাক্ষস এখন আবার তেমনি কিছু আরম্ভ করেছে, যা আমাকে জীবলোক ছেড়ে যেতে বাধ্য করবে।

ভাগুরায়ণ—ভদন্ত, আমরা শুনেছি, প্রতিশ্রুত রাজ্যার্ধ দেবার দায় থেকে মুক্ত হতে ধূর্ত চাণক্য এই দুষ্কর্ম করেছে, রাক্ষস করেনি।

ভিক্ষু—(কানচাপা দিয়ে) পাপ-প্রসঙ্গ থাক্। চাণক্য বিষকন্যার নামও শোনেনি।

ভাগুরায়ণ—ভদন্ত, এই যে ছাড়পত্র দিচ্ছি। আসুন, কুমারকে শুনিয়ে দিন।

মলয়কেতু—(কাছে গিয়ে) সখা, আমার শত্রুকে কেন্দ্র করে যে আলোচনা আমি তার বন্ধুর মুখ থেকে শুনলাম, তাইতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। যার ফলে, বহুদিন হয়ে গেলেও আমার পিতৃহত্যারূপে বিপদ্ আজ যেন দ্বিগুণ হয়ে মন তোলপাড় করছে ॥৬॥

ভিক্ষু–(স্বগত) আরে, হতভাগা মলয়কেতু শুনে ফেলেছে! ব্যস্, আমার কাজ হয়ে গেছে! (নিষ্ক্রান্ত)

মলয়কেতু—(চাক্ষুষ যেন কাউকে দেখছে, এমনিভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে) রাক্ষস; রাক্ষস, ঠিক, ঠিক। ‘এ আমার বন্ধু’ এই বিশ্বাসে তোমার ওপর সমস্ত কাজের ভার দিয়ে বাবা নিশ্চিন্ত ছিলেন। কিন্তু তুমি তাঁকে হত্যা করে বন্ধুবান্ধব সবাইকে কাঁদিয়েছ। তুমি নামেও যেমন রাক্ষস, কাজেও তেমনি রাক্ষস ॥৭॥

ভাগুরায়ণ—(স্বগত) রাক্ষসের প্রাণ রক্ষা করতে হবে, এটাই আর্যের আদেশ। তবে তাই হোক্। (প্রকাশ্যে) কুমার, ব্যাকুল হবেন না। কুমার আসন গ্রহণ করলে আমি কিছু নিবেদন করতে চাই।

মলয়কেতু—(উপবেশন করে) সখা, কী বলতে চাও?

ভাগুরায়ণ—কুমার, এ সংসারে অর্থশাস্ত্র নিয়ে যাদের কারবার, তাদের কাছে অরি, মিত্র বা উদাসীন[২] এই শ্রেণিবিচার প্রয়োজন-নির্ভর। সাধারণ লোকের মতো খামখেয়ালিপনা এর পেছনে নেই। কেননা সে সময়ে রাক্ষসের ইচ্ছা ছিল, সর্বার্থসিদ্ধিকে রাজা করেন, কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের চেয়েও বলীয়ান্ সার্থকনামা রাজা পর্বতেশ্বর ছিলেন তাঁর সেই অভিপ্রায়ের অন্তরায়। অতএব তিনি তখন রাক্ষসের পরম শত্রু। তাঁর প্রতিই রাক্ষস যে এই আচরণ করেছে, এতে আমি বেশি দোষের কিছু দেখি না। কুমার, ভেবে দেখুন—নীতির এমনি প্রভাব যে প্রয়োজনের অনুরোধে এ মিত্রকে শত্রুতে এবং শত্রুকে মিত্রে পরিণত করে। পূর্ববৃত্তান্ত সব ভুলে গিয়ে মানুষ জীবদ্দশাতেই যেন জন্মান্তর লাভ করে ॥৮॥

অতএব এ ব্যাপারে রাক্ষসকে তিরস্কার করে কাজ নেই। যতদিন না নন্দের রাজ্য পুনরুদ্ধার হচ্ছে, ততদিন একে হাতে রাখা দরকার। তারপর একে আর রাখবেন না ছাড়াবেন, সেটা কুমারের এক্তিয়ার।

মলয়কেতু—বেশ, সখা, তুমি ঠিকই ভেবেছ। কারণ অমাত্যকে বধ করলে প্রজাদের মধ্যে বিক্ষোভ সৃষ্টি হবে। আর তখন জয়ের ব্যাপারটা হবে সন্দেহের বিষয়।

পুরুষ—(প্রবেশ করে) কুমারের জয় হোক্। আর্য, সেনানিবাসের ভারপ্রাপ্ত দীর্ঘরক্ষ জানাচ্ছে, এই লোকটি ছাড়পত্র ছাড়াই শিবির থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। পত্র-হাতে লোকটিকে আমরা ধরেছি। আৰ্য একে দেখুন!

ভাগুরায়ণ—ভদ্র, নিয়ে এস।

পুরুষ—আর্যের যা আদেশ। (নিষ্ক্রান্ত)

সিদ্ধার্থক—(স্বগত) প্রভুভক্তিকে আমার প্রণাম। আমাদের মতো মানুষের কাছে এই প্রভুভক্তি যেন সাক্ষাৎ জননী, যা গুণের দিকটাই আমাদের সামনে তুলে ধরে, দোষের বিষয়ে আমাদের উদাসীন করে ॥৯॥

পুরুষ—আর্য, এই সেই হোক।

ভাগুরায়ণ—(দেখার অভিনয় করে) ভদ্র, লোকটি কি আগন্তুক? না কি, এখানকার কারো সেবক?

সিদ্ধার্থক—আর্য, আমি অমাত্য, রাক্ষসের সেবক।

ভাগুরায়ণ—ভদ্র, কেন তবে তুমি ছাড়পত্র ছাড়াই শিবির থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলে?

সিদ্ধার্থক—আর্য, কাজের চাপে তাড়াতাড়ি করছিলাম।

ভাগুরায়ণ—কেমন সে কাজের চাপ, যা রাজার নির্দেশকে লঙ্ঘন করায়?

মলয়কেতু—সখা ভাগুরায়ণ, পত্রটি নিয়ে যাও।

ভাগুরায়ণ—(সিদ্ধার্থকের হাত থেকে নিয়ে পত্রের মুদ্রা দেখে) কুমার, এই যে পত্র! এতে রাক্ষসের নাম মুদ্রিত রয়েছে।

মলয়কেতু—মুদ্রিত চিহ্নটি বাঁচিয়ে পত্রটি খুলে দেখাও।

ভাগুরায়ণ—(তাই করে দেখাল।)

মলয়কেতু—(পাঠ করতে লাগল) ‘মঙ্গল হোক। কোনো স্থান থেকে কোনো ব্যক্তি যথাস্থানে কোনো ব্যক্তিবিশেষকে জানাচ্ছেন : আপনি সত্যবাদী। আমাদের প্রতিপক্ষকে ছাড়িয়ে দিয়ে আপনি সত্যবাদিতার পরিচয় দিয়েছেন। পূর্বে কিছু লোক আপনার কাছে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল, আপনি তখন সন্ধির মূল-স্বরূপ তাদের কতকগুলো বস্তু দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সম্প্রতি সত্যনিষ্ঠ আপনি তাদের সেগুলো দিয়ে খুশি করুন। এরা এইভাবে অনুগৃহীত হলে নিজেদের বর্তমান আশ্রয়-ত্যাগ করে উপকারী আপনাকে আশ্রয় করবে। আপনি সত্যপরায়ণ। ভোলেননি নিশ্চয়, তবুও মনে করিয়ে দিচ্ছি। এদের মধ্যে কেউ কেউ শত্রুর কোষ ও হস্তী কামনা করে। কেউ কেউ চায় তার রাজ্য। সত্যবাদী যে তিনখানি অলঙ্কার পাঠিয়েছেন, তা পাওয়া গেছে। আমিও শুধুই পত্র না পাঠিয়ে তার সঙ্গে কিছু তত্ত্ব পাঠালাম, গ্রহণ করবেন। পত্রবাহক আমার অতি আপনজন, বাকি যা শোনার তার মুখ থেকে শুনবেন।’ সখা ভাগুরায়ণ, এ কেমন পত্র?

ভাগুরায়ণ—ভদ্র সিদ্ধার্থক, এ কার পত্র?

সিদ্ধার্থক—আর্য, জানি না।

ভাগুরায়ণ—ওহে ধূর্ত, পত্র নিয়ে যাচ্ছ, কার জান না? এসব না হয় থাক। জবানি তুমি কাকে শোনাবে?

সিদ্ধার্থক—(ভয়ের অভিনয় করে) আপনাদের।

ভাগুরায়ণ—কী বললে? আমাদের?

সিদ্ধার্থক মহাশয়রা আমাকে ধরেছেন। আমি কী বলছি জানি না।

ভাগুরায়ণ—(সরোষে) এখনই জানবে। ভাসুরক! বাইরে নিয়ে গিয়ে যতক্ষণ না কবুল করে, মারতে থাক।

পুরুষ—অমাত্যের যা আদেশ। (তার সঙ্গে বেরিয়ে গিয়ে আবার এসে) আর্য, মারতে থাকলে বিশেষ আবদ্ধ এই পেটিকাটি তার বগল থেকে পড়ে গেল।

ভাগুরায়ণ—(দেখে) কুমার, এতেও সেই রাক্ষসের নাম মুদ্রণচিহ্ন।

মলয়কেতু—সখা, বুঝি পত্রের সঙ্গে সেই তত্ত্ব। মুদ্রণচিহ্ন বাঁচিয়ে এটিও আমাকে খুলে দেখাও।

ভাগুরায়ণ—(তাই করে দেখাল।)

মলয়কেতু—(দেখে) আহা, এ যে সেই অলঙ্কার, যা আমি নিজের গা থেকে খুলে রাক্ষসকে পাঠিয়েছিলাম। স্পষ্ট এ পত্ৰ চন্দ্রগুপ্তকে লেখা।

ভাগুরায়ণ—কুমার, কুয়াশা এখনি কেটে যাবে। ভদ্র, আবার পেটাও পুরুষ আর্যের যা আজ্ঞা। (বেরিয়ে গিয়ে সিদ্ধার্থকের সঙ্গে আবার এসে) মারের চোটে বলছে, “কুমারের কাছেই বলব’।

মলয়কেতু—তাই হোক।

সিদ্ধার্থক—(পায়ে পড়ে)—অভয় দিয়ে আর্য আমাকে অনুগ্রহ করুন।

মলয়কেতু—ভদ্র, পরাধীনের তো অভয় আছেই। যেমন ঘটেছে বল।

সিদ্ধার্থক—কুমার, শুনুন। অমাত্য রাক্ষস এই পত্র দিয়ে আমাকে চন্দ্রগুপ্তের কাছে পাঠিয়েছেন।

মলয়কেতু—জবানিটা এবার শুনতে চাই।

সিদ্ধার্থক—কুমার, অমাত্য আমাকে বলতে চেয়েছেন : আমার প্রিয় মিত্র এই পাঁচজন রাজা আপনার প্রতি স্নেহশীল। এঁরা হলেন—কুলূতরাজ চিত্রবর্মা, মলয়নগরের রাজা সিংহনাদ, কাশ্মীর দেশের রাজা পুষ্করাক্ষ, সিন্ধুরাজ সিন্ধুসেন এবং পারস্যরাজ মেঘনাদ। এঁদের মধ্যে প্রথম তিনজন রাজা মলয়কেতুর রাজ্য চান, অন্য দুজন চান তাঁর হস্তীবল এবং রাজকোষ। তাই সদাশয় আপনি চাণক্যকে কর্মচ্যুত করে যেমন আমার প্রীতি উৎপাদন করেছেন, তেমনি পূর্বের প্রতিশ্রুতি মতো এঁদের স্বার্থেও আপনার যা করণীয় তা করুন।’ এই হল গিয়ে জবানি।

মলয়কেতু—(স্বগত) এ কী! চিত্রবর্মারাও আমার সঙ্গে বৈরিতা করছে? অথবা সেইজন্যই এদের রাক্ষসের প্রতি এত বেশি অনুরাগ। (প্রকাশ্যে) বিজয়া, রাক্ষসকে দেখতে চাই।

প্রতিহারী—কুমারের যা আজ্ঞা। (নিষ্ক্রান্ত)

(তারপর নিজ বাটীতে আসনে উপবিষ্ট চিন্তান্বিত রাক্ষসের প্রবেশ, সঙ্গে পুরুষ)

রাক্ষস—(আত্মগত) আমাদের সেনাবাহিনী চন্দ্রগুপ্তের সৈন্যে ছেয়ে গেছে জেনে, বস্তুত আমার মনে কোনো স্বস্তি নেই। কারণ, সাধ্যের সঙ্গে অন্বয়-ব্যাপ্তির নিয়মে নিয়ত যা বাঁধা, সপক্ষে যার নিশ্চিত অভাব, সেই হেতু থেকেই বাদীর প্রতিজ্ঞাসিদ্ধি হয়। কিন্তু যা নিজেই প্রমাণ-সাপেক্ষ বা সপক্ষে ও বিপক্ষে যা সমান কিংবা যা পক্ষের বিরুদ্ধ, তাকে হেতু বলে স্বীকার করলে বাদীর নিগ্রহ হয়। অনুরূপ, (শত্রুক্ষয়) কার্যে যে অবশ্যই পটু, বংশানুক্রমে যে অনুগত, নিজেদের লোকজনের সঙ্গে যার ঘনিষ্ঠতা, প্রতিপক্ষের সঙ্গে যার কোনো সংস্রব নেই, তেমন সৈন্য দিয়েই প্রভুর কার্যসিদ্ধি হয়। কিন্তু যে নিজেই এখনো পথে আসেনি বা সপক্ষে ও বিপক্ষে যার সমান সদ্ভাব কিংবা নিজ পক্ষের প্রতি যে বিরুদ্ধভাবাপন্ন, তেমন সৈন্যের ওপর নির্ভর করলে প্রভুর নিগ্রহ হয় ॥১০।

অথবা, (চন্দ্রগুপ্তের প্রতি) যাদের বিরাগের হেতুগুলো জানা গেছে এবং পূর্বেই যারা আমাদের প্রলোভনে পা দিয়েছে, তেমন লোকে সৈন্যবাহিনী ভরে গেছে। তাই এক্ষেত্রে সন্দেহ করা উচিত নয়। (প্রকাশ্যে) ভদ্র প্রিয়ংবদক, আমার নির্দেশমতো কুমারের অনুগামী রাজাদের বল : দিনে দিনে কুসুমপুর এখন কাছে আসছে। অতএব সৈন্যদের যথাযথভাবে বিভক্ত ও সজ্জিত করে অভিযানে বেরিয়ে পড়তে হবে। কেমন করে, সেটা বলছি। পুরোভাগে, আমার পেছনে পেছনে খস ও মগধ যোদ্ধারা ব্যূহ রচনা করে চলতে থাকবে। মধ্যে থাকবে যবন রাজার সঙ্গে গান্ধার বীরেরা, সাবধানে তাদের এগোতে হবে। পশ্চাদ্‌ভাগে চীন ও হূণ সৈন্যদের সঙ্গে থাকবে পরাক্রান্ত শক নৃপগণ। কৌলুত-প্রমুখ অবশিষ্ট রাজারা সারাপথে কুমারকে বেষ্টন করে চলবে[৪] ॥ ১১॥

প্রিয়ংবদক—আচ্ছা। (নিষ্ক্রান্ত)

প্রতিহারী—(প্রবেশ করে) অমাত্যের জয় হোক। অমাত্য, কুমার আপনাকে দেখতে চান।

রাক্ষস—ভদ্রে, একটু দাঁড়াও। কই হে, কে আছে এখানে?

পুরুষ—(প্রবেশ করে) আদেশ করুন অমাত্য।

রাক্ষস—শকটদাসকে বল যে, কুমার আমাকে অলঙ্কার পরিধানে বাধ্য করেছিলেন। তাই অলঙ্কারহীন অবস্থায় কুমার-দর্শনে যাওয়া সমীচীন নয়। অতএব, সেই যে তিনখানি অলঙ্কার ক্রয় করা হয়েছিল, তার মধ্য থেকে একখানি দাও।

পুরুষ—আচ্ছা (বেরিয়ে গিয়ে আবার এসে) অমাত্য, এই অলঙ্কার।

রাক্ষস—(অলঙ্কার-পরিধানের অভিনয় ও উত্থান) ভদ্রে, রাজার কাছে যাবার পথ দেখিয়ে চল।

প্রতিহারী—আসুন অমাত্য।

রাক্ষস—(স্বগত) বড় চাকরি জিনিশটা নির্দোষ লোকের পক্ষেও বড় ভয়ের। কেননা প্রথমত মনিবকে ভয় করে চলতে হয়। তারপর মনিবের অনুগ্রহপুষ্ট পার্শ্বচরদের জন্য অন্তরে ভয় লেগেই থাকে। আবার অতি উচ্চপদে যারা ওঠে, তাদের দেখে দুর্জনরা হিংসা করে। বস্তুত যারা উচ্চপদে আরোহণ করে, তাদের মনে প্রতি মুহূর্তেই দুঃসহ পতনের দারুণ ভয় থাকে।।১২।।

প্রতিহারী—(পরিক্রমা করে) অমাত্য, এই যে কুমার। এঁর সম্মুখে অগ্রসর হোন অমাত্য।

রাক্ষস—(দেখে) এই যে, কুমার বসে আছেন, পায়ের আগায় যাঁর দৃষ্টি নিশ্চল, অথচ মনের শূন্যতায় যিনি বিশেষ কিছুই দেখছেন না। করতলে ন্যস্ত তাঁর নম্র মুখচন্দ্র দেখে মনে হচ্ছে, যেন দুর্বহ কাজের ভারে তা নত হচ্ছে ॥১৩।

(তারপরে অগ্রসর হয়ে) কুমার, জয়যুক্ত হোন।

মলয়কেতু—আর্য, প্রণাম করি। এই আসন, বসুন।

রাক্ষস (তাই করলেন)।

মলয়কেতু—আর্যকে বহুক্ষণ দেখিনি বলে উদ্বিগ্ন ছিলাম।

রাক্ষস—কুমার, অভিযানের ব্যবস্থা করতে গিয়ে কুমারের কাছ থেকে আমাকে এ অনুযোগ শুনতে হল।

মলয়কেতু—আর্য, অভিযানের কী রকম ব্যবস্থা করলেন, শুনতে চাই।

রাক্ষস—কুমারের অনুগামী রাজাদের এরকম আদেশ দিয়েছি : (“পুরোভাগে, আমার পেছন পেছন”… ইত্যাদি পূর্বোক্ত পাঠ)।

মলয়কেতু—(স্বগত) কী! যারা আমাকে মেরে চন্দ্রগুপ্তকে তুষ্ট করতে চায়, তারাই ঘিরে থাকছে আমাকে? (প্রকাশ্যে) আর্য, কুসুমপুরে যাচ্ছে বা সেখান থেকে আসছে—এমন কি কেউ আছে?

রাক্ষস—যাতায়াতের প্রয়োজন এখন ফুরিয়েছে। অল্পদিনের মধ্যে আমরাই যাচ্ছি। মলয়কেতু—(স্বগত) জানা গেল। (প্রকাশ্যে) যদি এই হয়, তবে পত্র-হাতে এই লোকটিকে আর্য পাঠিয়েছেন কেন?

রাক্ষস—(দেখে) আহা, সিদ্ধার্থক! ভদ্র, এ কী?

সিদ্ধার্থক—(অশ্রুসহ লজ্জার প্রকাশ) অমাত্য, মাফ করুন। মারের চোটে আমি রহস্য গোপন রাখতে পারিনি।

রাক্ষস—ভদ্র, কিসের রহস্য? আমি তো কিছু বুঝলাম না।

সিদ্ধার্থক—সত্যি বলছি, মারের চোটে আমি (অর্ধেক বলে সভয়ে অধোমুখে অবস্থান)। মলয়কেতু- ভাগুরায়ণ, মনিবের সামনে ভয়ে বা লজ্জায় এ কিছু বলবে না। তুমি নিজেই আর্যকে বল।

ভাগুরায়ণ—কুমারের যা আদেশ। অমাত্য, এ বলছে যে, অমাত্য আমাকে পত্র দিয়ে এবং মুখে যা বলবার তা বুঝিয়ে দিয়ে চন্দ্রগুপ্তের কাছে পাঠিয়েছেন।

রাক্ষস—ভদ্র সিদ্ধার্থক, এ কি সত্য?

সিদ্ধার্থক—(লজ্জার অভিনয় করে) ভীষণ প্রহারের চোটে আমি একথা বলে ফেলেছি।

রাক্ষস—এ মিথ্যা। মার খেয়ে লোকে কী না বলে?

মলয়কেতু—সখা ভাগুরায়ণ, পত্রখানি দেখাও। জবানী এই ভৃত্য বলবে। ভাগুরায়ণ—অমাত্য, এই পত্ৰ।

রাক্ষস—(পাঠ করে) কুমার, এ শত্রুর চাল।

মলয়কেতু—পত্রের সঙ্গে তত্ত্ব-স্বরূপ আর্য এই অলঙ্কারও পাঠিয়েছেন। তাহলে কী করে এটা শত্রুর চাল?

রাক্ষস—(অলঙ্কার নিরীক্ষণ করে) এ জিনিশ কুমার আমায় পরতে পাঠিয়েছিলেন। আর আমি সিদ্ধার্থকের কোনো এক কাজে তাকে দান করেছিলাম।

ভাগুরায়ণ—এমন জিনিশ, বিশেষ করে যে জিনিশ কুমার প্রসন্ন হয়ে নিজের গা থেকে খুলে পাঠিয়েছিলেন, তা বক্‌শিস দেবার এই কি ক্ষেত্র?

মলয়কেতু—আর্য লিখেছেন—জবানি যা-কিছু শুনবার, তা অতি আপন এই লোকটির কাছ থেকে শুনবেন।

রাক্ষস—কিসের জবানি, কার জবানি? এই পত্রই তো আমার নয়।

মলয়কেতু—এ তবে কার নাম মুদ্রিত করা?

রাক্ষস—খলেরা নাম-মুদ্রণ জাল করতে পারে।

ভাগুরায়ণ—কুমার, অমাত্য ঠিকই বলেছেন। ভদ্র সিদ্ধার্থক, এ পত্র লিখেছে কে?

সিদ্ধার্থক—(রাক্ষসের মুখের দিকে তাকিয়ে নীরবে নতমুখে অবস্থান)।

ভাগুরায়ণ—ভদ্র, আবার নিজেকে মার খাইয়ে লাভ কী বল?

সিদ্ধার্থক—আর্য শকটদাস।

রাক্ষস—কুমার, যদি শকটদাস লিখে থাকে, তবে ধরুন আমিই লিখেছি। মলয়কেতু—বিজয়া, শকটদাসকে দেখতে চাই।

প্রতিহারী—কুমারের যা আজ্ঞা।

ভাগুরায়ণ—(স্বগত) নিশ্চিন্ত না হয়ে আর্য চাণক্যের চরেরা কোনো বিষয়ে কথা বলে না। যা হোক, শকটদাস এসে যদি চিনে ফেলে যে, এই সেই পত্র তবে পূর্বের ঘটনা প্রকাশ করে দেবে। তাহলে (আমাদের প্রতি) মলয়কেতুর সন্দেহ জন্মাবে এবং গোটা চালটাই মাঠে মারা যাবে। (প্রকাশ্যে) কুমার, শকটদাস কখনো অমাত্য রাক্ষসের সুমুখে (এ পত্র) ‘আমার লেখা’ বলে স্বীকার করবে না। অতএব এর লেখা অন্য কিছু আনা হোক। অক্ষরের মিল দেখলেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে।

মলয়কেতু—বিজয়া, তাই কর।

ভাগুরায়ণ—কুমার, এ মুদ্রাটিও নিয়ে আসুক।

মলয়কেতু—দুটোই নিয়ে এস।

প্রতিহারী—কুমারের যা আদেশ। (বেরিয়ে গিয়ে আবার এসে) কুমার, শকটদাসের নিজের হাতে-লেখা এই একখানি পত্র, আর এই মুদ্রা।

মলয়কেতু—(দুটোই দেখার অভিনয় করে) আর্য, হাতের লেখা মিলছে।

রাক্ষস—(স্বগত) হাতের লেখা মিলছে? কিন্তু শকটদাস যে আমার সুহৃদ, হাতের লেখা মিলতে পারে না। তবে কি শকটদাস ভুলে গেল তার প্রভুভক্তি? স্ত্রী-পুত্রের কথাটাই বড়ো করে ভাবল? অক্ষয় যশ ছেড়ে সে কি ক্ষণিক অর্থের প্রতি লুব্ধ হল? ॥১৪॥

অথবা সন্দেহের কী আছে? এই মুদ্রা সর্বক্ষণ তার হাতের আঙুলেই থাকে। সিদ্ধার্থক তার সুহৃদ্। কূটনৈতিক কৌশলের উপজীব্য এই পত্রখানি যে তারই লেখা, তা অন্য পত্রের লেখার মিল থেকে বোঝা যাচ্ছে। প্রভুভক্তি ভুলে গিয়ে শকটদাস প্রাণ বাঁচাতে ভেদনীতি-নিপুণ শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যে এই জঘন্য কাজ করেছে, তা সুস্পষ্ট ॥১৫।

মলয়কেতু—(দেখে) আর্য লিখেছেন : মহাশয় যে তিনখানি অলঙ্কার পাঠিয়েছেন, তা পাওয়া গেছে। এ কি তাদেরই একখানি? (ভালো করে দেখে স্বগত) এ কী! এ অলঙ্কার যে বাবা আগে পরতেন! (প্রকাশ্যে) আর্য, এ অলঙ্কার পেলেন কোথায়?

রাক্ষস—বণিকদের কাছ থেকে কিনে নিয়েছি।

মলয়কেতু—বিজয়া, চিনতে পার এই অলঙ্কার?

প্রতিহারী—(ভালো করে দেখে, সাশ্রুনেত্রে) কী করে না চিনি? এ যে পুণ্যশ্লোক পর্বতেশ্বর আগে পরতেন।

মলয়কেতু—(সজল চোখে) হায় পিতঃ, আপনি ছিলেন আমাদের বংশের অলঙ্কার। অলঙ্কার ছিল আপনার প্রিয়। আপনার অঙ্গের যোগ্য এই অলঙ্কারগুলো আপনিই ব্যবহার করতেন। এগুলো পরলে আপনার মুখ হত চাঁদের মতো উজ্জ্বল, দেখাত আপনাকে তারায় ভরা শরতের সন্ধ্যার মতো ॥১৬॥

রাক্ষস—(স্বগত) কী বলছে? পর্বতেশ্বর আগে এগুলো পরতেন? বোঝা যাচ্ছে, এ তাঁরই অলঙ্কার। চাণক্যের পাঠানো বণিক এগুলো আমাদের কাছে বিক্রি করেছে।

মলয়কেতু—আর্য, যে অলঙ্কারগুলো আগে বাবার গায়ে ছিল, বিশেষ করে পরে যেগুলো চন্দ্রগুপ্তের দখলে ছিল, সেগুলো আপনি কিনে নিয়েছেন, একথা কি খাটে? অথবা, এ কথাই খাটে। কেননা—অধিক লাভের আশায় চন্দ্রগুপ্ত এগুলো বিক্রি করেছে। আর আপনি নিষ্ঠুরভাবে আমাকেই এর মূল্য ধার্য করেছেন ॥১৭॥

রাক্ষস—(স্বগত) সত্যিই শত্রুর চাল কি সুন্দর খেটে যাচ্ছে। কারণ—এ চিঠি আমার নয়—এ জবাব টেকে না। কেননা, মুদ্রাটি আমার। শকটদাসের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব চুকে গেছে—একথা লোকে মানবে কেন? রাজা হয়ে মৌর্য গয়না বিক্রি করবে- এ কি কেউ ভাবতে পারে? তাই ইতর লোকের মতো যাচ্ছেতাই জবাব দেওয়ার চেয়ে স্বীকার করাই ভালো ॥১৮॥

মলয়কেতু—আর্যকে আমি এটা জিগ্যেস করছি।

রাক্ষস- কুমার, যে আর্য তাকে জিগ্যেস কর। আমি এখন অনার্য হয়ে গেছি।

মলয়কেতু—সেই মৌর্য আপনার প্রভুর পুত্র। আর, আমি আপনার বন্ধুর পুত্র,

রাক্ষস–আপনার পরিচর্যায় আমি রত। মৌর্য, আপনাকে অর্থ দেবে তার খুশি মতো। আর আমাকে আপনি খুশি করার জন্য যখন যা ইচ্ছা দান করেন। সেখানে আপনি মন্ত্রিত্বের সম্মান পেলেও তা হবে আপনার দাসত্ব, কিন্তু এখানে আপনিই প্রভু। এর চেয়ে বড় কোন্ স্বার্থলিপ্সা আজ আপনাকে অনার্য করে তুললে? ॥১৯॥

কুমার, এইসব অশোভন কথা বলে আপনিই এর উত্তর দিয়ে দিয়েছেন। যাক্, আপনার দোষ কী? [‘সেই মৌর্য আপনার প্রভুর…’ ইত্যাদি শ্লোকে মধ্যম পুরুষের স্থলে উত্তম পুরুষ (আপনি>আমি) এবং উত্তম পুরুষের স্থলে মধ্যম পুরুষের (আমি>আপনি) ব্যবহার করে পুনরায় পাঠ।]

মলয়কেতু—(পত্র ও গহনার পেটিকা দেখিয়ে) এগুলো তবে কী?

রাক্ষস—(সাশ্রুনেত্রে) নিয়তির খেলা। কারণ, দাসত্ব অবজ্ঞার বিষয় হলেও আমি নন্দরাজাদের দাসত্ব করে তাঁদের পুত্রদের অপেক্ষায় কোনো অংশে হীন ছিলাম না। কারণ, আমার সেই প্রভুরা ছিলেন কৃতজ্ঞ, বিবেচক এবং সজ্জন। লোকচরিত্র তাঁরা বিচার করতেন। এমন রাজাদের যে নিষ্ঠুর নিয়তি নিহত করেছে, মানুষের পৌরুষঘাতী সেই নিয়তির বিরাট খেলা এটা ॥২০।।

মলয়কেতু—কী? এখনও লুকোচ্ছেন? এ কিনা নিয়তির খেলা! লোভের খেলা নয়? অনার্য, আমার সরল-হৃদয় পিতা তোমাকে কী বিশ্বাসই করতেন! কৃতঘ্ন তুমি (তাঁকে মারবে বলে) ক্রমবর্ধমান মাত্রায় তীব্র বিষ প্রয়োগ করে একটি সাংঘাতিক বিষকন্যা তৈরি করে রেখেছিলে এবং শেষ পর্যন্ত তাকে দিয়ে পিতাকে পরিণত করলে : কেবল ইতিবৃত্তে। এখন আমার শত্রুর মন্ত্রিত্বের ওপর টান বেড়ে যাওয়ায় তুমি আমার সর্বনাশের জন্য শত্রুর কাছে আমাকে, হায়, একখণ্ড মাংসের মতো বিকোতে বসেছ? ॥২১॥

রাক্ষস—(স্বগত) এ আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়া! (প্রকাশ্যে। কানচাপা দিয়ে) এ পাপ অসহ্য, অসহ্য! পর্বতেশ্বরের ওপর বিষকন্যা আমি প্রয়োগ করিনি।

মলয়কেতু—কে তবে পিতাকে হত্যা করেছে?

রাক্ষস—এ ব্যাপারে জিগ্যেস করতে হয় দৈবকে।

মলয়কেতু—(সক্রোধে) দৈবকে জিগ্যেস করতে হয়, ভিক্ষু জীবসিদ্ধিকে নয়?

রাক্ষস—(স্বগত) কী! জীবসিদ্ধিও চাণক্যের চর! হায়, শত্রুরা আমার হৃদয় পর্যন্ত দখল করেছে?[৫]

মলয়কেতু—(সক্রোধে) ভাসুরক, শিখর সেনকে আমার আদেশ জানিয়ে দাও : কুলূতরাজ চিত্রবর্মা, মলয়রাজ সিংহনাদ, কাশ্মীররাজ পুষ্করাক্ষ, সিন্ধুরাজ সুষেণ এবং পারস্যরাজ মেঘনাদ—এই পাঁচজন রাজা রাক্ষসদের সঙ্গে মিত্রতা করে আমাকে শেষ করে চন্দ্রগুপ্তকে তুষ্ট করতে চাইছে। এদের মধ্যে প্রথম তিনজন আমার রাজ্য চায়, গভীর গর্তে ফেলে এদের মাটি চাপা দাও। বাকি দুজন চায় আমার হস্তীবল, হাতি দিয়েই এদের মেরে ফেল।[৬]

পুরুষ—আচ্ছা। (নিষ্ক্রান্ত।)

মলয়কেতু—(সক্রোধে) রাক্ষস, রাক্ষস, বিশ্বাসহন্তা রাক্ষস আমি নই। আমি মলয়কেতুই। তবে যাও, সর্বপ্রাণে চন্দ্রগুপ্তকে গিয়ে আশ্রয় কর। জেনে রেখ—দুর্নীতি একাই যেমন ত্রিবর্গকে উচ্ছন্নে দিতে পারে, তেমনি বিষ্ণুগুপ্ত ও মৌর্য তোমাকে সঙ্গে করে এলেও আমি সবাইকে একাই শেষ করতে পারি ॥২২॥

ভাগুরায়ণ—কুমার সময় নষ্ট করে কাজ নেই। এখন কুসুমপুর অবরোধের জন্য আমাদের সেনাদের আদেশ দিন। যাত্রা করুক আমাদের সেনারা। এদের অশ্বগুলোর খুর-পুট-সংঘাতে উত্থিত ধূলিস্তম্ভ গৌড়বধূদের লোধরেণু সুবাসিত কপোলদেশ ধূসর করে ভ্রমরকান্তি কুঞ্চিত কেশদামের কৃষ্ণতা কমিয়ে দিয়ে গজমদ প্লাবিত ভূমিমূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ুক গিয়ে শত্রুদের মাথায় ॥২৩॥

(পরিজনসহ মলয়কেতু নিষ্ক্রান্ত। )

রাক্ষস—(আবেগ-ভরে) হা ধিক্! কী কষ্ট! সেই বেচারী চিত্রবর্মারাও মারা পড়ল। তবে কি মিত্র বিনাশের জন্যই রাক্ষসের এত চেষ্টা, শত্রু বিনাশের জন্যে নয়? মন্দভাগ্য আমি তবে এখন কী করি? তপোবনে যাব কি? আমার মনে এত প্রতিহিংসা যে তপোবনে গিয়েও শান্তি পাব না। তবে কি শত্রু বেঁচে থাকতেই (আত্মঘাতী হয়ে) প্রভুর অনুগমন করব? না, সে তো স্ত্রীলোকের কাজ। তবে কি অসি হাতে শত্রুসৈন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব? তাও সঙ্গত নয়। চন্দনদাসকে মুক্ত করবার জন্য আমার মন যে উৎকণ্ঠিত হয়ে আছে। এ মন যদি কৃতঘ্ন না হয়, তবে সেই তো আমায় অমন কাজে বাধা দেবে। [সকলে নিষ্ক্রান্ত।]

॥ পঞ্চম অঙ্ক সমাপ্ত ॥

***

প্রসঙ্গকথা –পঞ্চম অঙ্ক

১. মুদ্রা= রাজকীয় চিহ্নযুক্ত লেখ্যাদি। অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে মুদ্রাধ্যক্ষ এক মাষক খাজনা নিয়ে মুদ্রা প্রদান করবেন। মুদ্রা অর্থাৎ উক্তবিধ প্রবেশপত্র/ছাড়পত্র থাকলে তবেই জনপদে প্রবেশ ও সেখান থেকে নিষ্ক্রমণ সম্ভব হত। মুদ্রাহীন ব্যক্তির প্রবেশ বা নির্গমনের প্রচেষ্টার শাস্তিস্বরূপ বিবিধ দণ্ডের কথাও অর্থশাস্ত্রে (২/৩৪) বলা হয়েছে।

২. ‘বিজিগীষু রাজার রাজ্যের অব্যবহিত পরবর্তী রাজ্যের রাজাই বিজিগীষুর শত্রু’ বা অরি, ‘শত্রুরাজ্যের অব্যবহিত পরবর্তী রাজ্যের রাজাই বিজিগীষু রাজার মিত্র এবং বিজিগীষু রাজার মিত্ররাজ্যের অব্যবহিত পরবর্তী রাজ্যের রাজাই বিজিগীষু রাজার উদাসীন’। (যাজ্ঞবল্ক্য)

যে রাজা শত্রুও নয়, মিত্রও নয়, তাকেই উদাসীন বলা হয় (ঊর্ধ্বে আসীন অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা বলবত্তম) : এই প্রসঙ্গে মনুসংহিতায় বলা হয়েছে—

অনন্তরমরিং বিদ্যাদরিসেবিনমেব চ।
অরেরনন্তরং মিত্রমুদাসীনং তয়োঃ পরম্। (৭/১৫৮)

বিশদ জানার জন্য অর্থশাস্ত্র (৬/২) দ্রষ্টব্য!

৩. গুল্মস্থান= সেনানিবাস বা রক্ষীপুরুষদের সংস্থান। কুল্লুকভট্টের মতে গুল্ম= সৈন্যৈকদেশ। ‘গুল্ম : … সৈন্যরক্ষণে’– বিশ্ব

৪. ‘খস’ বা ‘খশ’ অতি প্রাচীন পার্বত্য জাতিরূপে প্রসিদ্ধ। হিমালয়ের কুমায়ুন পর্বতে, বাংলার উত্তর-পূর্ব দিকে খাসিয়া এবং গারো পাহাড়ে এদের বাস। দক্ষিণ বিহারের অধিবাসীরা মগধ বলে পরিচিত ছিল। কাবুল ও পেশোয়ারের নিকটবর্তী দেশের প্রাচীন অধিবাসীরাই এখানে ‘গান্ধার’ বলে উল্লিখিত। হূণ বলতে এখানে শ্বেত হূণদের কথাই বলা হয়েছে। হূণদের অনুপ্রবেশকাল ভূমিকায় ‘রচনাকাল’ প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে। আনন্দরাম বড়ুয়া মহাভারতে উল্লিখিত চীনদের সঙ্গে এই ‘চীন’দের অভিন্নতায় কথা বলেছেন।

৫. চাণক্যের গুপ্তচরদের পক্ষে তথা চাণক্যের পক্ষে রাক্ষসের এই হৃদয়-বিদারী স্বগতোক্তি বিরাট কৃতিত্বেরই স্বীকৃতি। রাক্ষসের বিমূঢ় আর্তিপ্রকাশের পক্ষে ভাষাও কত গভীর ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠেছে!

৬. শ্বভ্র= গর্ত। মলয়কেতুর স্থুল অথচ নিষ্ঠুর রসিকতা লক্ষণীয় : যারা রাজ্য (ভূমি) চেয়েছিল, তাদের ভূগর্ভস্থ বিবরে নিক্ষেপ করে মাটিচাপা দিয়ে মারতে হবে, আর যারা হস্তীবল চেয়েছিল, হাতির পায়ের চাপেই তাদের গতাসু হতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *