পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ – আত্মগ্লানি
রাঘবের পাপপুরী পরিত্যাগ করিয়া মহাপাতকী রত্নাপাখী রাজপথে আসিয়া এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে চলিল, “পাপাত্মাদিগের সংসর্গ আর করিব না, পাপ-সংস্পর্শেও আর থাকিব না। পাখীর বাগান—আমার বাসস্থান—আমার মহাপাতকের কীর্ত্তিস্তম্ভ, সেই কীৰ্ত্তিস্তম্ভ আজি স্বহস্তে ভস্মসাৎ করিয়া একদিকে চলিয়া যাইব। আমার জীবনের অবশিষ্ট কাল আমার আজীবনার্জ্জিত মহাপাতকের প্রায়শ্চিত্তে অতিবাহিত করিব। আমার চল্লিশ বৎসর বয়স হইয়াছে—এই দীর্ঘ জীবনে আমি ব্রাহ্মণের উপযুক্ত কোন্ কার্য্য করিয়াছি? আমার সমস্ত জীবন কেবল দুষ্কর্ম্মেই অতিবাহিত হইয়াছে—ব্যভিচার, চৌর্য্য ও নর হনন, কোন্ মহাপাতক আমাকর্তৃক অকৃত আছে? আমি ক্রমাগত পাতকের উপর পাতক, উপপাতক, মহাপাতক করিয়া আসিতেছি—তবে ব্রাহ্মণ আমি কিসে? ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করিয়াও আমি চণ্ডাল। আমি এই পবিত্র যজ্ঞোপবীত ধারণের উপযুক্ত নই—আমার স্কন্ধে রাখিয়া এই পবিত্র উপবীতের অবমাননা করিব না। আমি কৰ্ম্ম দোষে চণ্ডালত্ব প্রাপ্ত হইয়াছি—আমি চণ্ডাল—না আমি চণ্ডাল হইতেও অধম। চণ্ডালিনী কজ্জলার দয়া, ধৰ্ম্ম, পবিত্রতা আছে—আমার তাহার কিছুই নাই। আমি কজ্জলার প্রাণবধের চেষ্টা করিয়াছি; কিন্তু তাহার প্রাণ এখনও আমার নিমিত্ত কাঁদিতেছে—এখনও সে আমার মঙ্গল কামনা করিতেছে। কজ্জলা চণ্ডালিনী, আর আমি ব্রাহ্মণ?” এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে রতন শর্ম্মা সেই নিবিড় কাননমধ্যে নিজ অসূর্যম্পশ্য আবাস-মন্দিরে উপস্থিত হইয়া দেখিল, কজ্জলা একাকিনী মঞ্চোপরি বসিয়া গান করিতেছে। তাহাকে সমীপাগত দেখিয়া কোকিলা নীরব হইল।
রতন। কজ্জলা, তুই এখানে কেন?
কজ্জলা। তুই এখানে কেন?
র। আমার এই বাসা।
ক। আমি এখানে পাখী ধরতে এসেছি।
র। হাঁ কজ্জলা, এখনও তুই আমায় ভালবাসিস?
ক। যদিই বাসি, তা তোর কি?
র। না কজ্জলা, আমি তোর ভালবাসার উপযুক্ত নই—আমি চণ্ডাল, আমায় স্পর্শ করিলে তুই অপবিত্র হবি।
“আ মর্, তোকে আমি ছুঁতে যাব কেন?” এই কথা বলিয়া কজ্জলা গান করিল, –
“ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা তারে ভালবাস যারে রে
পরশনে ম্লান হবে হীরা কণ্ঠ-হারে রে।
ধ্যানে দরশন কর—
সেইরূপ নিরন্তর,
দেবত্ব রবে না আর ছুঁলে তব দেবতারে।”
রত্না গান শুনিয়া উন্মত্তের ন্যায় চীৎকার করিয়া বলিল, “না কজ্জলা, না, আমি স্পর্শ করিয়া তোকে অপবিত্র করিব না—তুই আমার হৃদয়াধিষ্ঠাত্রী দেবতা, তোর পবিত্র মূর্তি ও নিৰ্ম্মল প্রকৃতি ধ্যান করিয়া আমার জীবনের অবশিষ্টাংশ অতিবাহিত করিব; আমার এই কঠিন হৃদয় গলাইয়া তোর কোমল প্রকৃতির সহিত মিশাইয়া দিবার চেষ্টা করিব।”
কজ্জলা মুখ ফিরাইয়া চক্ষু মুছিল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ আবার রুক্ষ্মভাবে বলিল, ‘রাখ্, তোর ন্যাক্রার কথা রাখ্, এখন কাজের কথা ক’। কালরাত্রে কোথা ছিলি বল্ দেখি।”
রত্না। কেন?
কজ্জলা। কাল তোদের সেই নরকে তোকে খুজতে গিয়েছিলাম; কিন্তু সেখানে তোকে দেখতে পেলেম না, তুই ছিলি কোথা?
রত্না। কাল আমার পাপযজ্ঞে পূর্ণাহুতি দিতে গিয়াছিলাম।
কজ্জলা। তোর হিয়ালীর কথা আমি শুনতে চাই না, ঠিক করে বল, কোথা গিয়েছিলি।
রত্না। গোবিন্দরামের বাড়ীতে ডাকাতি করতে গিয়েছিলেম।
কজ্জলা। ফের তুই ডাকাতি করলি?
রত্না। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, তার গহনার বাক্স অপহরণ করব, সেই প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করে, আমার পাপ-যজ্ঞ উদযাপন করেছি, এখন থেকে আর আমি ডাকাতি করব না।
কজ্জলা। তুই ডাকাতি কর, আর নাই কর, আমার বয়ে গেল, আমি সেই গহনার বাক্সটি চাই।
রত্না। এখন তা আর আমি কোথা পাব? আমি সে বাক্স রাঘবকে দিয়েছি।
কজ্জলা। আচ্ছা, আমি সে বাক্স আদায় করতে পারি কি না তোকে দেখাব। হাঁরে কালামুখো, তোরা জুলিয়াকে তোদের সেই নরকে পূরেছিলি কেন?
রতন বিস্মিত হইয়া তাহার মুখপানে চাহিয়া বলিল, “তুই জুলিয়ার কথা কি বলছিস?”
কজ্জলা। তবে তুই সে কথা জানিস না? হাঁ, তুই কাল সেখানে ছিলিনি বটে।
রতন। রাঘব জুলিয়াকেও হত্যা করেছে না কি?
কজ্জলা। আমি সময়ে উপস্থিত না হলে, বোধ হয়, তাই করত। হাঁরে, তোরা মানুষ, না রাক্ষস? স্ত্রী-হত্যা করতেও কি তোদের মনে একটু কষ্ট হয় না?
রতন। কজ্জলা, ও কথা তুলে আর আমার হৃদয়ে আঘাত করিসনি, যা হবার তা হয়ে গেছে, আমায় মাপ কর। এখন তুই আমায় যা করতে বলবি, আমি তাই করব। ডাকাতি ছাড়তে বলেছিলি, ডাকাতি ছেড়েছি। পৈতা ফেলতে বলেছিলি, এই নে
এই বলিয়া রত্না যজ্ঞোপবীত স্কন্ধ হইতে উন্মোচন করিতে উদ্যত হইল।
তখন কজ্জলা অত্যন্ত ব্যাকুলতা ও ব্যাগ্রতাসহকারে তাহার হস্ত ধারণ করিয়া বলিল, “আহা! করেন কি? আমায় ক্ষমা করুন, আপনার পায়ে ধরি, আর আমায় পাপে ডুবাইবেন না, এ জন্মে ত আমার এই দশা, পর জন্মেও কি আবার আমায় দুঃখিনী করিবেন? এখন আমায় এই আশীর্ব্বাদ করুন, যত দিন বাঁচিব, আপনার চরণে যেন আমার মন থাকে, আর জন্মান্তরে যেন ঐ চরণ সেবা করিবার অধিকারিণী হই।”
এই বলিয়া নয়নজল মুছিতে মুছিতে কজ্জলা তথা হইতে প্রস্থান করিল।
তখন রত্নাকর সদৃশ অনুতাপী রতনশর্ম্মা স্বহস্তে আপনার আবাস মন্দিরে আগুন লাগাইয়া দিল এবং হৃদয়ের অন্তস্তল হইতে “পাপোহহং পাপকৰ্ম্মাহং” ইত্যাদি মন্ত্র উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারণ করিতে করিতে অন্তর্হিত হইল, পাখীর-বাগান পুড়িতে লাগিল।