পঞ্চনদের তীরে
প্রাচীন ঐতিহাসিক ভারতের সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ স্বদেশভক্ত বীর ও সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত সম্বন্ধে ভারতীয় জনসাধারণের পরিষ্কার ধারণা নেই৷ ভারতব্যাপী দেশাত্মবোধের এই নবজাগরণের যুগেও দেশীয় বিদ্যামন্দিরের পাঠ্য ইতিহাসে এখনকার ছেলেমেয়েদের এ-সম্বন্ধে সচেতন করবার চেষ্টা দেখা যায় না৷ আমাদের সত্যিকার জাতীয় জীবনের এই অসাড়তা লক্ষ করলে হতাশ হতে হয়৷
‘পঞ্চনদের তীরে’ উপন্যাস বটে, কিন্তু এর আখ্যানবস্তু কোথাও ঐতিহাসিক ভিত্তি ছেড়ে অগ্রসর হবার চেষ্টা করেনি৷ যে-সময়ের কথা আমি বলতে বসেছি, সে-সময়কার ঐতিহাসিক সূত্র এখনও নানা স্থানে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে, সেই কারণে স্থলবিশেষে উপন্যাসের মর্যাদা ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করবার জন্যে কিছু-কিছু কল্পনার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি, কিন্তু সে-কল্পনাও কোথাও ঐতিহাসিক সত্যকে বাধা দেয়নি৷
ধরুন, শশীগুপ্তের কথা৷ ওই দেশদ্রোহীর শেষ জীবন অতীতের অন্ধকারের মধ্যে চিরদিনের জন্যে লুপ্ত হয়ে গেছে, ইতিহাসও তার সম্বন্ধে নীরব৷ কিন্তু তার একটা পরিণাম না দেখালে উপন্যাস হয় অসম্পূর্ণ৷ অতএব ওখানে কল্পনা ব্যবহার করা ছাড়া উপায়ান্তর নেই এবং গোঁড়া ঐতিহাসিকরাও সেইজন্যে আপত্তি প্রকাশ করবেন বলে মনে হয় না৷ তারপর ধরুন, সুবন্ধু প্রভৃতি সম্পর্কীয় ঘটনাবলি৷ প্রাচীন ইতিহাসকে ভালো করে গল্পের ভিতর দিয়ে দেখাবার জন্যেই ওদের অবতারণা করা হয়েছে৷ সুবন্ধু প্রভৃতি ভাগ্যান্বেষী সৈনিক বটে, কিন্তু সেকালকার ভারতে ওদের মতন লোকের ভিতরেও যে অতুলনীয় বীরত্ব ও স্বদেশভক্তির অভাব ছিল না, Massaga নামক স্থানে আলেকজান্ডারের দ্বারা সাত হাজার ভারতীয় ভৃতক-সৈন্যের (mercenaries) হত্যাকাণ্ডেই তার জ্বলন্ত প্রমাণ পাওয়া যায়৷ তারা প্রত্যেকে সপরিবারে প্রাণ দিল, তবু বিদেশি শত্রুর অধীনে চাকরি স্বীকার করল না! অতএব কাল্পনিক হলেও সুবন্ধু প্রভৃতিকে আমরা ঐতিহাসিক ভারতীয় চরিত্র বলে গ্রহণ করতে পারি অনায়াসেই৷
পঞ্চনদের তীরে স্বাধীন ভারতের পুনঃ দেখানোই হচ্ছে আমার মুখ্য উদ্দেশ্য৷ সেই কারণে, সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের পরবর্তী জীবন দেখাবার প্রয়োজন বোধ করিনি, প্রসঙ্গক্রমে সর্বশেষে দু-চারটি ইঙ্গিত দিয়েছি মাত্র৷
এই বইখানি কেবল যারা বয়সে বালক তাদের জন্যই লেখা হল না৷ পরীক্ষা করে দেখেছি, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস সম্বন্ধে এদেশের বয়স্ক পাঠকরাও বালকদের চেয়ে কম অজ্ঞ নন৷ বইখানি লেখবার সময়ে তাঁদের কথাও বার বার মনে হয়েছে৷ ইতি-
প্রথম পরিচ্ছেদ – গোড়ার কথা
‘পঞ্চনদের তীরে,
বেণী পাকাইয়া শিরে
দেখিতে দেখিতে গুরুর মন্ত্রে জাগিয়া উঠিল শিখ-
নির্মম, নির্ভীক৷’
রবীন্দ্রনাথের অপূর্ব গাথার কথা তোমরা সকলে নিশ্চয়ই জান৷
কিন্তু পঞ্চনদের তীরে শিখরাই কেবল জেগে ওঠেনি, এখানেই সর্বপ্রথমে জাগ্রত হয়েছিল আর্য ভারতবর্ষের বিরাট আত্মা৷
পঞ্চনদের তীরেই হয়েছে বারে বারে ভারতবর্ষের উত্থান এবং পতন৷ কত কত বার ভারত উঠেছে পড়বার জন্যে এবং পড়েছে ওঠবার জন্যে৷ আহত হয়েছে, নিহত হয়নি৷
এই পঞ্চনদের তীরে কোন স্মরণাতীত কালে অনার্য জনপদের উপরে বন্যাপ্রবাহের মতো ভেঙে পড়েছিল আর্য অভিযানের পর অভিযান৷ এবং তারপর এই পঞ্চনদের তীরেই দেখা গেল যুগে যুগে কত জাতির পর জাতির মিছিল-পার্সি, গ্রিক, শক, হুন, তাতার, মোগল ও পাঠান৷ যে-পথে তারা মহাভারতকে সম্ভাষণ করতে বেরিয়েছিল, সেই চিরবিখ্যাত খাইবার গিরিসংকট আজও অটল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তেমনি উদ্ধত ভ্রূকুটিভঙ্গে! কত মহাকাব্য আবৃত্তি করতে পারে ওখানকার প্রতি ধূলিকণা!
কেবল ব্রিটিশসিংহের গর্জন ভেসে এসেছে ভারত সাগরের ওপার হতে৷ কিন্তু মহাসাগরকে সেকালের ভারতবর্ষ এক হিসাবে কখনো খুব বড়ো করে দেখেনি-কারণ সমুদ্রপথ ছিল তারই নিজস্ব দিগ্বিজয়ের পথ৷ ওপথে বেরিয়েছে সে নিজে দেশে দেশে বাণিজ্য করতে, ধর্মপ্রচার করতে, রাজ্যজয় করতে, উপনিবেশ স্থাপন করতে-কাম্বোডিয়ায়, জাভায় এবং মিশরে৷ এবং মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া থেকে গ্রিসে ও রোমে৷ ও পথে তাকে জয় করবার জন্যে আর কেউ যে আসতে পারে, প্রাচীন ভারতবর্ষের স্বপ্নে এ কাহিনি ছিল না৷
তোমরা কী ভাবছ? আমি গল্প বলছি, না ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করছি? কিন্তু একটু ধৈর্য ধরো৷ তোমরা ‘অ্যাডভেঞ্চারে’র কথা শুনতে ভালোবাসো৷ এবারে যে বিচিত্র ‘অ্যাডভেঞ্চারে’র কথা বলব, তা হচ্ছে মহাভারতের ও মহাগ্রিসের মহাঅ্যাডভেঞ্চার!
মধ্য-এশিয়া থেকে দক্ষিণ দিকে যখন আর্য অভিযান শুরু হয়, তখন তাদের একদল আসে ভারতবর্ষে, আর একদল যায় পারস্যে৷ অর্থাৎ ভারতবাসী আর্য আর পারস্যবাসী আর্যরা ছিলেন মূলত একই জাতি৷ প্রাচীন ভারতের ও প্রাচীন পারস্যের ধর্মের মধ্যেও এই একত্বের যথেষ্ট প্রভাব আবিষ্কার করা যায়৷ কিন্তু বহু শতাব্দী বিভিন্ন দেশে বাস করে ভারতবাসীরা ও পারসিরা নিজেদের একজাতীয়তার কথা সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেল৷
আর্য হিন্দুরা বাস করতেন উত্তর-ভারতে৷ এবং ভারতের দক্ষিণ প্রদেশকে তাঁরা অনার্যভূমি বলে অত্যন্ত ঘৃণা করতেন৷ এমনকী অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গকেও তাঁরা আমলে আনতেন না, কোনো নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ এ-অঞ্চলে এলে তাঁকে পতিত বলে মনে করা হত৷ সেই পুরোনো মনোভাব আজও একেবারে লুপ্ত হয়নি৷ আজও উত্তর-ভারতের ব্রাহ্মণরা বাঙালি ব্রাহ্মণদের শ্রদ্ধার চোখে দেখেন না৷
কিন্তু এই ঘৃণিত অনার্যভূমি বা পূর্ব-ভারতের বর্ণসংকর ক্ষত্রিয়রাই পরে ধর্মে আর বীরত্বে সারা ভারতের মধ্যে অগ্রগণ্য হয়ে উঠলেন-অদৃষ্টের এমন পরিহাস! বাংলাদেশের আশেপাশেই মাথা তুলে দাঁড়াল শিশুনাগবংশ, নন্দবংশ, মৌর্যবংশ (যে-বংশে জন্মান চন্দ্রগুপ্ত ও অশোক), ও গুপ্তবংশ প্রভৃতি, খাঁটি আর্য না হয়েও এইসব বংশের বীরবৃন্দ ক্রমে সমগ্র ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য বিস্তার করে ফেললেন৷
ধর্মেও দেখি এই অঞ্চলে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে বৌদ্ধমতের আবির্ভাব এবং বুদ্ধদেবও সৎক্ষত্রিয় ছিলেন না৷
এই সময়েই ভারতীয় হিন্দুদের করতলগত পঞ্চনদের তীরে প্রথম বিদেশি শত্রু-অর্থাৎ পারস্যের রাজা প্রথম দরায়ুস মুক্ত তরবারি হাতে করে দেখা দেন৷ প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ছিল না৷ সুতরাং আসল ব্যাপারটা কী হয়েছিল জানা যায় না৷ কিন্তু পারসিরা বলে, তারা ভারতবর্ষ জয় করেছিল৷ তবে ঐতিহাসিকদের মত হচ্ছে, পারসিরা সিন্ধুনদের তীরবর্তী দেশগুলি ছাড়িয়ে বেশিদূর এগোতে পারেনি৷ তার বাইরে গোটা ভারতবর্ষের অধিকাংশ প্রদেশে তখন যে-সব পরাক্রান্ত রাজারাজড়া বাস করতেন, তাঁদের স্বাধীনতা ও শক্তি ছিল অক্ষুণ্ণ৷
পারসিদের অধীনে যে জনকয়েক করদ ভারতীয় রাজা ছিলেন, এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই৷ কারণ গ্রিসের সঙ্গে যখন পারস্যের শক্তি-পরীক্ষা হয় বারংবার, তখন পরবর্তী যুগেও সিন্ধুতটবাসী কয়েকজন ভারতীয় রাজা পারসিদের সাহায্য করবার জন্যে সৈন্য পাঠাতে বাধ্য হয়েছিলেন৷
পট পরিবর্তন করলেই দেখি, এর পরের দৃশ্য হচ্ছে একেবারে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে৷ ভারতবর্ষে তখন বৈদিক হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে বৌদ্ধধর্ম৷ পঞ্জাবে তখন বীর ও সৎক্ষত্রিয় বলে মহারাজা পুরুর বিশেষ খ্যাতি৷ পূর্ব-ভারতে অর্ধ-আর্য নন্দবংশ রাজত্ব করছে৷ চন্দ্রগুপ্ত তখন যুবক, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যুদ্ধবিদ্যা শিখে তিনি শক্তি সঞ্চয় করছেন- ভারতবর্ষের সিংহাসনের দিকে তাঁর লোলুপ দৃষ্টি৷
প্রতীচ্যের প্রধান নাট্যশালা তখন গ্রিসে৷ এই গ্রিকরাও ছিলেন উত্তর-ভারতীয় হিন্দু ও পারসিদের মতো আর্য, তাঁদেরও পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন স্মরণাতীতকাল পূর্বে মধ্যএশিয়ার আদি আর্যস্থান থেকে৷ অধিকাংশ ইউরোপে তখন অসভ্য বর্বরদের বাস এবং রোম হচ্ছে শিশু,- মহা গ্রিসের শৌর্য-বীর্য ও সভ্যতার যবনিকা সরিয়ে তার দৃষ্টি ভবিষ্যতের বিরাট অপূর্বতা তখনও দেখতে পায়নি৷
গ্রিসে তখন নূতন নাটক রচনার চেষ্টা করছে মাসিডনিয়া-আর্যাবর্তে অর্ধ-আর্য পূর্ব-ভারতের চন্দ্রগুপ্তের মতো৷ এবং মাসিডনিয়ার বাসিন্দাদেরও কুলীন গ্রিকরা মনে করতেন অর্ধ-গ্রিক ও অর্ধ-বর্বরের মতো৷
মাসিডনিয়ার অধিপতি ফিলিপ নিজের বাহুবলে গ্রিকজগতে কৌলীন্য অর্জন করেছিলেন৷ অকালে শত্রু-কবলে ফিলিপ যখন অপঘাতে মারা পড়লেন, তখন তাঁর পুত্র আলেকজান্ডার পেলেন সিংহাসনের সঙ্গে পিতার স্বহস্তে শিক্ষিত দুর্ধর্ষ, বিপুল সৈন্যবাহিনী৷ তাঁর বয়স তখন বিশ বৎসর মাত্র৷ কিন্তু এই বয়সেই তিনি লাভ করেছিলেন পিতার রাজনৈতিক বুদ্ধি ও যুদ্ধপ্রতিভা এবং মাতা ওলিম্পিয়াসের ধর্মোন্মাদ, আবেগ-বিহ্বলতা ও কল্পনাশক্তি৷
কৌলীন্য-গর্বিত গ্রিকরা অর্ধ-সভ্য বালক রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রকাশ করল৷ কিন্তু আলেকজান্ডার তখনই খাপ থেকে তরবারি খুলে সৈন্যদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন মূর্তিমান ঝড়ের মতো এবং অত্যন্ত অনায়াসে সমস্ত বিদ্রোহ দমন করে দেখিয়ে দিলেন, তিনি বালক বটে, কিন্তু দুর্বলও নন, নির্বোধও নন! যার বাহুবল ও বীরত্ব আছে, পৃথিবীতে তার চেয়ে বড়ো ক্ষত্রিয় আর কেউ নেই৷
খাঁটি হিন্দু সংস্কৃতি আর সভ্যতার অধঃপতনের সময়েই ভারতবর্ষে অর্ধ-আর্য চন্দ্রগুপ্ত ও সম্রাট অশোক প্রভৃতির আবির্ভাব৷ তাঁদের প্রতিভা ভারতীয় সংস্কৃতি আর সভ্যতাকে আজও করে রেখেছে বিশ্বের বিস্ময়৷
এবং আদিম গ্রিক সংস্কৃতি ও সভ্যতার অধঃপতনের যুগেই অর্ধ-গ্রিকরূপে গণ্য আলেকজান্ডার আত্মপ্রকাশ করেন৷ গ্রিক সভ্যতার বাণী সারা পৃথিবীতে প্রচার করবার ভার নিলেন তিনিই৷ কুলীন গ্রিকরা তাঁকে ঘৃণা করতেন বটে, কিন্তু তিনি না থাকলে গ্রিক সভ্যতার মহিমা আজ এমন অতুলনীয় হতে পারত না৷ তাঁর প্রতিভায় গ্রিক সংস্কৃতির খ্যাতি প্রতীচ্যের সীমা পেরিয়ে ভারতের পঞ্চনদের তীরে ও মধ্য-এশিয়ায় বিস্তৃত হয়ে পড়েছিল৷
গ্রিসের প্রতিবেশী ছিল তখন প্রাচ্যের সব-চেয়ে পরাক্রান্ত রাজ্য পারস্য৷ পারসিরা একাধিকবার গ্রিকদের আক্রমণ করেছিল৷ গ্রিকরা কোনো রকমে আত্মরক্ষা করতে পেরেছিল বটে, কিন্তু তাদের দুর্দশা হয়েছিল যৎপরোনাস্তি৷ নিজেকে সমগ্র গ্রিসের দলপতিরূপে প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে তরুণ বীর আলেকজান্ডার বলেন, ‘গ্রিস আমার স্বদেশ৷ প্রাচ্যের পারসিরা আমার স্বদেশের উপর যখন অত্যাচার করছে, আমিও পারস্য সাম্রাজ্য অধিকার করে প্রতিশোধ নেব৷’
পারস্য সাম্রাজ্য তখন পারস্যেরও বাইরে এশিয়া-মাইনরে, মিশরে, ব্যাবিলনে ও ভারতে সিন্ধুনদের তট পর্যন্ত বিস্তৃত৷ পারস্যের সিংহাসনে বসেছেন তখন তৃতীয় দরায়ুস কোডোমেন্নাস৷ তিনি মহাসম্রাটরূপে পরিচিত বটে, কিন্তু তাঁর যুদ্ধপ্রতিভা ছিল না৷
ইসসাস রণক্ষেত্রে প্রথমে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের শক্তি পরীক্ষা হয় (খ্রি. পূ. ৩৩২)৷ ছয় লক্ষ সৈন্য নিয়ে দরায়ুস আক্রমণ করলেন আলেকজান্ডারকে৷ সংখ্যায় গ্রিকরা যথেষ্ট দুর্বল ছিল এবং দরায়ুসের যুদ্ধপ্রতিভা থাকলে সেইদিনই মিলিয়ে যেত আলেকজান্ডারের দিগ্বিজয়ের স্বপ্ন৷ কিন্তু অতিশয় নির্বোধের মতো দরায়ুস একটি সংকীর্ণ ক্ষেত্রের মধ্যে নিজের বিপুল বাহিনী চালনা করলেন৷ ফলে সংখ্যায় ঢের বেশি হয়েও পারসিরা কিছুই করতে পারল না৷ তারা পঙ্গপালের মতো দলে দলে মারা পড়ল, বাদবাকি ইউফ্রেটেস নদী পেরিয়ে পালিয়ে গেল৷
পরে পরে আরও অনেকগুলি যুদ্ধে জয়লাভ করে আলেকজান্ডার পারস্য সাম্রাজ্যের অধিকাংশ দখল করলেন৷ পারস্যের রাজধানী বিখ্যাত নগর পার্সিপোলিসকে অগ্নিশিখায় আহুতি দেওয়া হল এবং এক স্বদেশি বিশ্বাসঘাতকের হস্তে দরায়ুস মারা পড়লেন৷
বিজয়ী আলেকজান্ডার তখন সগর্বে পৃথিবীর চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করলেন৷ কিন্তু ইউরোপে ও আফ্রিকায় তখনকার সভ্যজগতে নিজের কোনো যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী দেখতে পেলেন না৷ রোমের জন্ম হয়েছে, কিন্তু আগেই বলেছি, সে তখন শিশু৷
হঠাৎ আলেকজান্ডারের মনে পড়ল ভারতবর্ষের কথা৷ ভারতীয় সভ্যতার খ্যাতি তখন দেশ-দেশান্তর অতিক্রম করে গ্রিসেও গিয়ে উপস্থিত হয়েছে৷ বাণিজ্যপথেও ভারতীয় পণ্যদ্রব্যের আদর কম নয়৷ ভারতেও পারসিদের সাম্রাজ্যের অংশ আছে৷ এবং যুদ্ধক্ষেত্রেও পারসিদের পক্ষে উত্তর-ভারতীয় দীর্ঘদেহ সরলবাহু আর্য বীরদের পরাক্রম আলেকজান্ডার স্বচক্ষে দেখবার সুযোগ পেয়েছিলেন৷
আলেকজান্ডার বললেন, ‘আমি ভারত জয় করব৷ পারস্য সাম্রাজ্যের শেষ চিহ্নও আর রাখব না৷’
সেনাপতিরা ভয় পেয়ে বললেন, ‘বলেন কী সম্রাট! সে যে অনেক দূর! আপনার অবর্তমানে গ্রিসে যে বিদ্রোহ উপস্থিত হবে!’
আলেকজান্ডার কোনোদিন প্রতিবাদ সহ্য করতে পারতেন না৷ অধীর স্বরে বললেন, ‘স্তব্ধ হও তোমরা! পারসিরা যা পেরেছে, আমার পক্ষে তা অসম্ভব নয়৷ আমি ভারত জয় করব!’
যুবক দিগ্বিজয়ীর ক্রুদ্ধ দৃষ্টির সামনে প্রাচীন সেনাপতিরা নীরবে মাথা নত করলেন৷
কিন্তু আলেকজান্ডার কি সত্যসত্যই ভারত জয় করতে পেরেছিলেন? পঞ্চনদের তীরে কয়েকটি যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন বটে, কিন্তু মুলতানের যুদ্ধে আহত হয়ে তিনি প্রায় মৃত্যুমুখে এগিয়ে গিয়েছিলেন৷ এবং এই ভারতেই তিনি যে প্রথম পরাজয়ের অপমান সহ্য করতে বাধ্য হন, অধিকাংশ ঐতিহাসিকই সে সম্বন্ধে নীরব৷ ভারত জয় না করেই গ্রিকরা আবার স্বদেশের দিকে ফিরতে-বা পলায়ন করতে বাধ্য হয়েছিল৷ আলেকজান্ডার ভারতের মাত্র একপ্রান্তে পদার্পণ করেছিলেন৷ এবং স্বদেশে প্রস্থান করবার সময়ে বড়ো বড়ো সেনাপতি ও অনেক সৈন্যসামন্ত উত্তর-ভারতের ওই অধিকৃত অংশ রক্ষা করবার জন্যে রেখে গিয়েছিলেন৷ কিন্তু পূর্ব-ভারতের মহাবীরদের কবলে পড়ে তাদের যে অভাবিত দুর্দশা হয়, পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকরাও সে কাহিনি গোপন রাখতে পারেননি৷ এ-সব কথা যথাসময়েই তোমাদের কাছে বলা হবে৷
মনে রেখো, আলেকজান্ডারের যুগে ভারতে বৈদিক হিন্দুধর্ম প্রচলিত ছিল৷ হিন্দুরা তখন মূর্তিপূজাও করতেন না, দেবমন্দিরও গড়তেন না৷ কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, হিন্দু ও বৌদ্ধরা মূর্তি ও মন্দির গড়তে শেখেন গ্রিকদের কাছ থেকেই৷ এ-কথা কতটা সত্য জানি না, তবে গ্রিকদের ভারতে আসবার আগে বুদ্ধদেবের মূর্তি যে কেউ গড়েনি, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – অভিনেতা দিগ্বিজয়ী
মহাবীর আলেকজান্ডার! শতাব্দীর পর শতাব্দী যাঁর নামগানে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে, প্রতীচ্যের যিনি প্রথম দিগ্বিজয়ী, এশিয়া আফ্রিকা ও ইউরোপে যাঁর প্রভাব আজও কেউ ভোলেনি, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কেমনধারা লোক ছিলেন? আগে সেই পরিচয়ই দিই৷
বয়সে তিনি ছাব্বিশ বৎসর পার হয়েছেন মাত্র-যে-বয়সে নেপোলিয়নও পৃথিবীতে অপরিচিত এবং যে-বয়সে বাঙালির ছেলে কলেজের বাইরেকার জগতে গিয়ে দাঁড়ালে প্রায় শিশুর মতোই অসহায় হয়ে পড়ে! এই ছাব্বিশ বৎসরের যুবক দিগ্বিজয়ী গ্রিস, মিশর, পারস্য ও ব্যাবিলন প্রভৃতি দেশে জয়পতাকা উড়িয়ে ঝড়ের মতো ছুটে চলেছেন ভারতবর্ষের দিকে৷
দীর্ঘদেহ, বিরাটবক্ষ, গৌরবর্ণ-বাল্যকাল থেকে নিয়মিত ব্যায়ামে দেহের প্রত্যেক মাংসপেশী পুষ্ট ও লোহার মতো শক্ত! মাথায় দুলছে সিংহের কেশরের মতো স্ফীত, কুঞ্চিত ও সুদীর্ঘ কেশমালা; প্রশস্ত ললাট-কিন্তু চুলের তলায় তার অধিকাংশ করেছে আত্মগোপন; মেঘের মতো কালো ভুরুর ছায়ায় বড়ো বড়ো দুই চক্ষে মাঝে মাঝে জ্বলছে স্বপ্নসংগীতের ইঙ্গিত; টানা, উন্নত নাক; দৃঢ়-সংবদ্ধ ওষ্ঠাধরে দৃঢ়প্রতিজ্ঞার ভাব! এই বীর্যবান অথচ কমনীয় যুবকের দেহকে আদর্শ রেখে গ্রিক ভাস্কররা দেবতার মর্মরমূর্তি গড়বার চেষ্টা করেছিলেন৷ সে-সব মূর্তি আজও বিদ্যমান৷
কিন্তু আলেকজান্ডার নিরেট কাঠগোঁয়ার যোদ্ধা ছিলেন না৷ অমর গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল ছিলেন তাঁর শিক্ষাগুরু৷ অস্ত্রচালনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মস্তিষ্কচালনাও করতে শিখেছিলেন৷
আলেকজান্ডারের চরিত্র ছিল অদ্ভুত৷ কখনো তিনি হতেন পাহাড়ের মতো কঠোর, কখনো বজ্রের মতো নিষ্ঠুর, আবার কখনো-বা শিশুর মতো কোমল! নিজেকে তিনি ভাবতেন সর্বশক্তিমান দেবতার মতো এবং সেইজন্যে অনেক সময়েই পৌরাণিক দেবতার পোশাক পরে থাকতেন৷ এই অহমিকার জন্যেই আলেকজান্ডার যাত্রাপথের নানা স্থানে করেছিলেন নিজের নামে নব নব নগরের প্রতিষ্ঠা৷ অনেকের মতে, আফগানিস্থানের কান্দাহার শহরের নাম আলেকজান্দ্রিয়ারই অপভ্রংশ৷
ভারতবর্ষ আক্রমণ করবার আগে, আশপাশের শত্রুনাশ করে যাত্রাপথ সুগম করবার জন্যে আলেকজান্ডার দিগ্বিজয়ী রূপে প্রায় মধ্য-এশিয়ার বুক পর্যন্ত গিয়ে পড়েছিলেন-কোথাও কেউ তাঁর অগ্রগতিতে বাধা দিতে পারেনি৷
আলেকজান্ডার যখন তুর্কিস্তানের বিখ্যাত শহর সমরখন্দে বিশ্রাম করছেন, সেই সময়েই আমরা প্রথম যুবনিকা তুলব৷
শিবিরের এক অংশে একাকী বসে আলেকজান্ডার একমনে বই পড়ছেন৷ বই পড়তে তিনি বড়ো ভালোবাসতেন৷ স্বদেশ থেকে বহুদূরে এসে পড়ে, পথে-বিপথে হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে ঘূর্ণী হাওয়ার মতো ছুটোছুটি করে এতদিন তিনি বই পড়বার সময়ও পাননি এবং বইয়ের অভাবও ছিল যথেষ্ট৷ সম্প্রতি সে অভাব মিটেছে, গ্রিস থেকে তাঁর হুকুমে ঈস্কিলাস, এইরিপিদেস ও সোফোক্লেস প্রভৃতি কবি এবং অন্যান্য পণ্ডিতদের রচিত নানারকম চিত্তাকর্ষক গ্রন্থ এসে পড়েছে৷
আলেকজান্ডার সানন্দে বই পড়তে পড়তে শুনতে পাচ্ছেন, শিবিরের বাহির থেকে মাঝে মাঝে জাগছে বুকেফেলাসের-অর্থাৎ ‘ষণ্ডমুণ্ডে’র হ্রেষা-রব!
এই ষণ্ডমুণ্ড হচ্ছে আলেকজান্ডারের বড়ো আদরের ঘোড়া,-একে তিনি কখনো নিজের কাছ থেকে তফাতে রাখতেন না৷
ষণ্ডমুণ্ডের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয়ের কাহিনিও রীতিমতো গল্পের মতো৷
তাঁর পিতা ফিলিপ তখন মাসিডনিয়ার রাজা এবং আলেকজান্ডার তখন ছোট্ট এক বালক! একজন অশ্ব-ব্যবসায়ী মহাতেজীয়ান এক ঘোড়া নিয়ে এল রাজা ফিলিপের কাছে বিক্রয় করতে৷
ঘোড়াকে পরীক্ষা করবার জন্যে ফিলিপ তাঁর পল্টনের জনকয় পাকা ঘোড়সওয়ারকে আহ্বান করলেন৷ কিন্তু কোনো সওয়ার তার পিঠে চড়বার চেষ্টা করলেই সেই তেজী ঘোড়া এমন ভয়ানক খেপে ওঠে যে, কেউ ভরসা করে আর তার কাছে এগোতেই চাইল না৷
ফিলিপ বললেন, ‘এ তো ভারি বদমেজাজি ঘোড়া দেখছি! এ আপদ এখনই দূর করে দাও৷’
এতটুকু ছেলে আলেকজান্ডার তখন এগিয়ে এসে বললেন, ‘মহারাজ, আপনার সওয়াররা ঘোড়া চেনে না তাই এমন চমৎকার ঘোড়ার পিঠে চড়তে পারছে না৷’
ফিলিপ বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আলেকজান্ডার! তোমার ছোটো মুখে এত বড়ো কথা শোভা পায় না! তুমি কি নিজেকে আমার সওয়ারদের চেয়ে পাকা বলে মনে কর?’
আলেকজান্ডার দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘আজ্ঞে হাঁ মহারাজ! আমি বাজি রেখে এখনই ওই ঘোড়ার পিঠে চড়তে রাজি আছি৷’
পল্টনের পাকা ঘোড়সওয়াররা শিশুর মুখ-সাবাসি শুনে সকৌতুকে অট্টহাস্য করে উঠল৷
ফিলিপ বললেন, ‘বেশ, চেষ্টা করে দেখো৷’
আলেকজান্ডার ঘোড়ার দিকে এগিয়ে গেলেন৷ তিনি এতক্ষণ ধরে লক্ষ করছিলেন যে, মাটির উপরে নিজের ছায়া দেখেই ঘোড়াটা চমকে চমকে উঠছে! তিনি প্রথমে পিঠ চাপড়ে তাকে আদর করলেন৷ তারপর লাগাম ধরে ঘোড়ার মুখটা সূর্যের দিকে ফিরিয়ে দিলেন, কাজেই সে আর নিজের ছায়া দেখতে পেল না৷ তারপর অনায়াসেই ঘোড়ার পিঠে চড়ে তাকে যথেচ্ছভাবে চারিদিকে ছুটোছুটি করিয়ে আনলেন৷
বুড়ো বুড়ো সেপাই-সওয়ারদের মুখ চুন, মাথা হেঁট!
ফিলিপ প্রথমটা বিস্ময়ে অবাক হয়ে রইলেন, তারপর অভিভূত স্বরে আলেকজান্ডারকে ডেকে বললেন, ‘বাছা, নিজের জন্য তুমি মস্ত কোনো রাজ্য জয় করো, আমার এ ক্ষুদ্র মাসিডন তোমার যোগ্য নয়৷’
ফিলিপ সেইদিনই বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর ছেলে বড়ো সহজ ছেলে নয়৷ তাঁর অনুমানও সত্য হয়েছিল৷ কারণ ওই ষণ্ডমুণ্ডেরই পিঠে চড়ে আলেকজান্ডার পরে সারা বিশ্ব জয় করেছিলেন৷
আজ শিবিরের বাইরের সেই ষণ্ডমুণ্ডই মাঝে মাঝে হ্রেষারব করে তার প্রভুকে জানিয়ে দিচ্ছিল যে, এতক্ষণ তাকে ভুলে থাকা উচিত নয়-মনিবকে পিঠে নিয়ে মাঠে-বাটে ছুটোছুটি করবার জন্যে তার পাগুলো নিশপিশ করছে যে! কিন্তু আলেকজান্ডার কাব্যরসে মগ্ন হয়ে তখন অন্য জগতে গিয়ে পড়েছেন-কল্পনালোকে বিচরণ করা ছিল তাঁর চিরদিনের স্বভাব৷ এই কল্পনাই দেখিয়েছে তাঁকে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন!
কল্পনা চিরদিনই প্রত্যেক মানুষকে স্বপ্ন দেখায়৷ কিন্তু শতকরা ছিয়ানব্বই জন লোক কেবল স্বপ্ন দেখেই খুশি থাকে, সেই স্বপ্নকে সফল করবার জন্যে কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে তারা চায় না৷ আলেকজান্ডারের প্রকৃতি ছিল অন্য ধাতুতে গড়া৷ কাজে ফাঁকি দিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখতেন না, স্বপ্নের মধ্যেই থাকত তাঁর নতুন নতুন কাজের বীজ৷
আচম্বিতে শিবিরের বাইরে উঠল জনতার বিপুল কোলাহল, আলেকজান্ডার বই থেকে মুখ তুলে গোলমালের কারণ অনুমান করবার চেষ্টা করলেন৷
শুনলেন, নানা কন্ঠে চিৎকার হচ্ছে-‘আমরা ভারতবর্ষে যেতে চাই না!’-‘ভারতবর্ষ আক্রমণ করে আমাদের কোনো লাভ নেই!’ ‘কে জানে সেখানে আমাদের অদৃষ্টে কী আছে?’
আলেকজান্ডার সচমকে ভাবলেন,-এ কী বিদ্রোহ? তাঁর নিজের হাতে গড়া বহু যুদ্ধবিজয়ী এই মহাসাহসী গ্রিক সৈন্যদল, যাদের মুখ চেয়ে তিনি নিজে কত আত্মত্যাগ করেছেন, যারা তাঁরই দৌলতে কোনোদিন পরাজয়ের মুখ দেখেনি,-তারাও আজ ভারতবর্ষের ভয়ে ভীত, তাঁর কথাও শুনতে নারাজ?
এই সেদিনের কথা তাঁর মনে পড়ল৷ প্রখর সূর্যকরে জ্বলন্ত এশিয়ার তপ্ত বুক মাড়িয়ে সসৈন্যে তিনি অগ্রসর হয়েছেন,-বাতাসে অগ্নিদাহের জ্বালা, জলবিন্দুশূন্য পথ আকাশের শেষ-সীমায় কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ জানে না, মাঝে মাঝে শুষ্ক শৈল, লোকালয়ের চিহ্নমাত্র নেই!
কয়েকজন সৈনিক যখন একটি গর্তের মধ্যে একটুখানি জল আবিষ্কার করল,-তখন সেই বিপুল বাহিনীর হাজার হাজার লোকের দেহ দারুণ পিপাসায় ছটফট করছে! চারিদিকে জলাভাবে হাহাকার! ইস্পাতের শিরস্ত্রাণ খুলে জনৈক সৈনিক জলটুকু সংগ্রহ করল৷ কিন্তু সে জল একজনমাত্র লোকের পক্ষে যথেষ্ট নয়!
সৈনিক বলল, ‘এ জল মহারাজকে উপহার দেব৷ রাজার দাবি আমাদের আগে৷’
সৈনিকরা জলপূর্ণ শিরস্ত্রাণ নিয়ে এল-আলেকজান্ডারের কন্ঠ তখন তৃষ্ণায় টা-টা করছে৷
মহারাজ সাগ্রহে তাড়াতাড়ি সৈনিকের হাত থেকে শিরস্ত্রাণ টেনে নিয়ে ঠোঁটের কাছে তুললেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নজরে পড়ল, তৃষ্ণার্ত সৈনিকরা হতাশ ভাবে শিরস্ত্রাণের দিকে তাকিয়ে আছে৷ আলেকজান্ডার ঠোঁটের কাছ থেকে শিরস্ত্রাণ নামিয়ে ভাবলেন, ‘সকলেরই ইচ্ছা জলটুকু পান করে, অথচ এই জল মাত্র একজনের যোগ্য৷ কিন্তু আমি রাজা বলে এই জল যদি পান করি, তাহলে এত লোকের তৃষ্ণার জ্বালা আরও বাড়িয়ে তোলা হবে!’
আলেকজান্ডার তখনই শিরস্ত্রাণ উপুড় করে ধরলেন এবং দেখতে দেখতে শুকনো মাটি তা নিঃশেষে শুষে নিল৷
মহারাজের উদারতা ও স্বার্থত্যাগ দেখে হাজার হাজার কন্ঠ তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল৷
আলেকজান্ডার সৈনিকদের কন্ঠে এমনি জয়ধ্বনি শুনতেই অভ্যস্ত ছিলেন,-কিন্তু তাদেরই কন্ঠে জেগেছে আজ বিদ্রোহের বেসুরো চিৎকার!
বাপ যেমন ছেলেদের চেনে, আলেজকান্ডারও তেমনি তাঁর সৈন্যদের ধাত চিনতেন৷ কাজেই কিছুমাত্র সংকুচিত না হয়ে তখনই তিনি তাঁবুর বাইরে গিয়ে দেখলেন সেখানে অনেক গ্রিক এসে বৃহৎ এক জনতার সৃষ্টি করেছে এবং তাদেরই পুরোভাগে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাঁর অদ্বিতীয় বন্ধু ক্লিটাস৷
বন্ধু ক্লিটাস-জীবন-রক্ষক ক্লিটাস! আলেকজান্ডারের মনে পড়ল ছয় বৎসর আগেকার একদিনের কথা! গ্রানিকাশের রণক্ষেত্রে যখন দুইজন পারসি সেনাপতি একসঙ্গে তাঁর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং যখন তাদের উদ্যত অস্ত্রের কবল থেকে আলেকজান্ডারের মুক্তি পাবার কোনো উপায়ই ছিল না, তখন এই মহাবীর ক্লিটাসই সেখানে আবির্ভুত হয়ে সিংহবিক্রমে তাঁর প্রাণরক্ষা করেছিলেন৷ সেই দিন থেকেই ক্লিটাস হয়েছেন তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু৷
আলেকজান্ডার তাঁবুর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ব্যাপার কী, ক্লিটাস?’
ক্লিটাস বললেন, ‘সৈন্যরা কেউ ভারতবর্ষে যেতে রাজি নয়৷’
‘কেন?’
‘ওরা বলছে, গৌগেমেলার রণক্ষেত্রে দরায়ুসের সেনাদলে ওরা ভারতীয় সৈন্যদের যুদ্ধ করতে দেখেছে৷ দূর বিদেশে পরের জন্যে তরবারি ধরে সেই কয় শত ভারতীয় বীর যে কৃতিত্ব দেখিয়েছিল, ওদের আজও তা মনে আছে৷ আজ আমরা চলেছি তাদেরই স্বদেশে-যেখানে সংখ্যায় হব আমরা তুচ্ছ, আর তারা হবে অগণ্য৷ ওরা তাই ভয় পেয়েছে, হাজার হাজার মাইল পথ পেরিয়ে শত শত নদী, বন, পাহাড়ের ওপারে সেই দুর্গম ভারতবর্ষে যাবার ইচ্ছা ওদের নেই৷’
আলেকজান্ডার ঘৃণাভরে বললেন, ‘গ্রিক সেনার ভয়! দেবাশ্রিত আমার সৈন্য, ভারতবর্ষের নামে তাদের ভয় হয়েছে! ক্লিটাস, তুমিও কি ওদের দলে?’
‘হাঁ সম্রাট! আমারও মনে হচ্ছে, এই মিথ্যা দুঃসাহস দেখিয়ে আমাদের কোনোই লাভ হবে না!’
আলেকজান্ডার পরিপূর্ণ কন্ঠে বললেন, ‘শোনো ক্লিটাস! শোনো সৈন্যগণ! আমাদের আর ফেরবার কোনো উপায়ই নেই৷ আমাদের স্বদেশ আজ বহুদূরে, আমাদের চতুর্দিকে আজ বিদেশি শত্রু! আমরা যদি আজ দেশের দিকে ফিরি, তাহলে শত্রুরা ভাববে আমরা তাদের ভয়েই পালিয়ে যাচ্ছি৷ আজ আমাদের বাহুবল দেখে যে লক্ষ লক্ষ শত্রু মাথা লুকিয়ে আছে, তারা তখন চারিদিক থেকে পঙ্গপালের মতো বেরিয়ে গ্রিক সৈন্যদের আক্রমণ করে টুকরো টুকরো করে ফেলবে৷ শত্রুর শেষ রেখে ফিরতে গেলে আমাদের কারুকে আর বাঁচতে হবে না৷ বিশেষ, ভারতবর্ষ হচ্ছে পারস্য-সাম্রাজ্যের অংশ, এখন তাকে জয় করতে না পারলে আমাদের দিগ্বিজয়ও ব্যর্থ হয়ে যাবে!’
ক্লিটাস বললেন, ‘কিন্তু ভারতবর্ষে গিয়ে তাকে জয় করতে না পারলে আমাদের কী অবস্থা হবে?’
আলেকজান্ডার ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, ‘সে-কথা ভাবব আমি৷ তোমাদের কর্তব্য আমার আদেশ পালন করা৷’
ক্লিটাস বললেন, ‘নিশ্চিন্ত মৃত্যু জেনেও আপনার আদেশ পালন করতে হবে?’
‘হাঁ, সেইটেই হচ্ছে সৈনিকের ধর্ম৷ মৃত্যুর চেয়েও বড়ো সেনাপতির আদেশ৷’
হাজার হাজার সৈনিক হঠাৎ একসঙ্গে বলে উঠল, ‘অন্ধের মতো আমরা কারুর আদেশ পালন করব না-আমরা কেউ ভারতবর্ষে যাব না৷’
কিন্তু লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণ নিয়ে যাঁরা খেলা করতে পারেন, জনতার হৃদয় জয় করবার অনেক কৌশলই তাঁদের জানা থাকে৷
আর একজন দিগ্বিজয়ী-নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, মিষ্টি কথায় কারুকে বশ করতে না পারলে পাগলের মতো খেপে উঠতেন এবং তাঁর সেই প্রচণ্ড রাগ দেখে অবাধ্যরা মুষড়ে পড়ে বাধ্য না হয়ে পারত না৷ অথচ নেপোলিয়ন স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করে গেছেন, সে-সব রাগ তাঁর লোক-দেখানো মৌখিক অভিনয় মাত্র, মনে মনে হেসে বাহিরে তিনি করতেন ক্রোধ প্রকাশ!
দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারও ছিলেন অভিনয়ে খুব পটু৷ ক্রুদ্ধ স্বরেও যখন ফল হল না, তখন তিনি ভিন্ন উপায় অবলম্বন করলেন৷ অত্যন্ত নিরাশ ভাবে দুঃখ-ভাঙা স্বরে ধীরে ধীরে বললেন, ‘সৈন্যগণ! আমি সম্রাট বটে, কিন্তু তোমাদের সঙ্গে করেছি বন্ধুর মতো আচরণ! তোমাদের জন্যে আমি আমার ক্ষুধার অন্ন, তৃষ্ণার জল এগিয়ে দিয়েছি, তোমাদের গৌরবের জন্যে আমি সিংহাসনের বিলাসিতা ছেড়ে বারবার সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে ছুটে গিয়েছি৷ তোমরা কেবল আমার বন্ধু নও, আমার সন্তানের মতো৷ তোমাদের কোনো প্রার্থনাই আমি অপূর্ণ রাখতে পারব না৷ ভারতবর্ষ জয় করা ছিল আমার উচ্চাকাঙ্খা, কিন্তু তোমরা যখন অসম্মত, তখন আমারও রাজি না হয়ে উপায় নেই৷ বেশ, তোমরা যা চাও তাই হবে৷ আজ থেকে আমিও আর তোমাদের সেনাপতি নই-তোমরাও হলে স্বাধীন! আমি তোমাদের ত্যাগ করলাম, আমাকে এখানে একাকী রেখে তোমরা গ্রিসে ফিরে যাও৷ আমার আর কোনো বক্তব্য নেই-‘ বলতে বলতে তাঁর দুই চোখ ছলছল ও কন্ঠ অশ্রুরুদ্ধ হয়ে এল৷
বীরত্বের অবতার ও গ্রিসের সর্বেসর্বা সম্রাট আলেকজান্ডারের এই কাতর দীনতা ও আর্তস্বর সৈন্যরা সহ্য করতে পারলে না, তারা এককন্ঠে বলে উঠল, ‘সম্রাট-সম্রাট! আপনি আমাদের ত্যাগ করবেন না, আপনার সঙ্গে আমরা মৃত্যুর মুখেও ছুটে যেতে প্রস্তুত৷ আমরা ভারতবর্ষে যাব-আমরা ভারতবর্ষে যাব!’
আলেকজান্ডারের মুখে আবার হাসির রেখা ফুটল, উচ্ছ্বসিত স্বরে তিনি বললেন, ‘এই তো আমার সৈন্যদের যোগ্য কথা! ক্লিটাস, হতভম্বের মতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছ কী? যাও, আমার সৈন্যদের জন্যে আজ বিরাট এক ভোজের আয়োজন করো গে! কালই আমরা ভারতবর্ষের দিকে যাত্রা করব৷’
হাজার হাজার সৈন্যের মুখ থেকে তখন বিদ্রোহের সমস্ত চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তারা একসঙ্গে অসি কোষমুক্ত করে শূন্যে আস্ফালন করতে করতে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বলে উঠল, ‘জয়, সম্রাট আলেকজান্ডারের জয়! ভারতবর্ষ, ভারতবর্ষ! পঞ্চনদের তীরে!’
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ভারতবর্ষের জয়
আলেকজান্ডার আদেশ দিয়েছেন, সমরখন্দে গ্রিকদের শিবিরে শিবিরে তাই আজ উঠেছে বিপুল উৎসবের সাড়া৷ পানাহার, নাচ, গান, বাজনা, কৌতুক ও খেলাধুলা চলেছে অশান্ত ভাবে-সৈনিকদের নিশ্চিন্ত ছেলেমানুষি দেখলে কে আজ বলবে যে, এদের ব্যবসা হচ্ছে অকাতরে নিজের জীবন দেওয়া ও পরের জীবন নেওয়া!
আলেকজান্ডারের বৃহৎ শিবির আজ লোকে লোকারণ্য৷ সৈন্যদের মধ্যে যাঁরা গণ্যমান্য ব্যক্তি তাঁরা সবাই সেখানে এসে আমোদ-আহ্লাদ করছেন৷ সেকালকার গ্রিকদের ভোজসভার একটি ছোট্ট ঐতিহাসিক ছবি এখানে এঁকে রাখলে মন্দ হবে না৷
শিবিরের মাঝখানে রয়েছে খান-কয় রৌপ্যখচিত কাঠের কৌচ-কাঠের গায়ে রঙিন নকশা৷ কৌচের উপর ‘কুশন’ বা তাকিয়ায় ভর দিয়ে পা ছড়িয়ে বা অর্ধশায়িত অবস্থায় রয়েছেন অতিথিরা৷ এমনি অর্ধশায়িত অবস্থায় পানাহার করতে শিখেছেন এঁরা পারসি প্রভৃতি প্রাচ্য জাতির কাছ থেকেই৷ কৌচের সামনে আছে আরও নীচু কতকগুলো ছোটো টেবিল, তাদের পায়াগুলো হাতির দাঁতে তৈরি৷ এইসব ছোটো টেবিলের উপরে খাবারদাবার ও পানপাত্র সাজানো৷
গ্রিকরা সেকালে ছিল অতিরিক্তরূপে মাংসপ্রিয়৷ তারা মাছও খেত, তবে মাংসের কাছে মাছকে তুচ্ছ বলে মনে করত৷ শাকসবজি ব্যবহার করত খুব কম৷ মদ খাওয়া তাদের কাছে দূষণীয় ছিল না, প্রকাশ্যেই সবাই মদ্যপান করত৷ মদের সঙ্গে খেত পেঁয়াজ৷
আলেকজান্ডারের হাতে রয়েছে একটি চিত্রিত পানপাত্র, সেটির গড়ন ষাঁড়ের মাথার মতন৷ সামনেই দুটি সুন্দরী মেয়ে মিষ্টি সুরে বাঁশি বাজাচ্ছে এবং আর একটি রূপসি মেয়ে তারই তালে তালে করছে নৃত্য৷ আলেকজান্ডার মদ্যপান করতে করতে একমনে নাচ দেখছেন৷-প্রাচীন গ্রিকরা নাচ-গান বড়ো ভালোবাসত৷
সুগন্ধ জলে পূর্ণ পাত্র নিয়ে দলে দলে রাজভৃত্য দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ সেই জলে হাত ধুয়ে অতিথিরা আসন গ্রহণ করছেন৷ তাঁরা তরকারি বা ঝোল-মাখা হাত মুছবেন বলে প্রত্যেক টেবিলেই নরম রুটি সাজানো রয়েছে৷ রুটিতে হাত মোছবার নিয়ম ইউরোপে এই সেদিন পর্যন্ত ছিল৷
হঠাৎ আলেকজান্ডারের দৃষ্টি ক্লিটাসের দিকে আকৃষ্ট হল৷ ক্লিটাস গম্ভীরভাবে কৌচের উপরে বসে আছেন৷ তাঁর মুখে কালো ছায়া৷
আলেকজান্ডার বললেন, ‘বন্ধু, অমন মুখ গোমড়া করে ভাবছ কী?’
ক্লিটাস তিক্ত হাসি হেসে বললেন, ‘ভাবছি কী? ভাবছি আজ তুমি কী অভিনয়টাই করলে!’
ভুরু কুঁচকে আলেকজান্ডার বললেন, ‘অভিনয়?’
‘হাঁ, হাঁ, অভিনয়! তোমার চমৎকার অভিনয়ে নির্বোধ সৈন্যরা ভুলে গেল বটে, কিন্তু আমি ভুলিনি৷ নিজের যশ বাড়াবার জন্যে তুমি চলেছ ভারতবর্ষের দিকে, আর তোমার যশ বাড়াবার জনে আমরা চলেছি সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে!’
আত্মসংবরণ করবার জন্যে আলেকজান্ডার আবার মদ্যপান করে অন্যমনস্ক হবার চেষ্টা করলেন, কারণ তাঁর রাগী মেজাজ তখন গরম হয়ে উঠেছে৷ ক্লিটাস তাঁর প্রিয়তম বন্ধু বটে, কিন্তু ভুলে যাচ্ছে তিনি সম্রাট!
ক্লিটাস আবার ব্যঙ্গভরে বললেন, ‘আলেকজান্ডার রণক্ষেত্র ছেড়ে নাট্যশালায় চাকরি নিলে তুমি আরও বেশি যশস্বী হতে পারবে,-বুঝেছ?’
ক্রোধে প্রায়-অবরুদ্ধ স্বরে আলেকজান্ডার বললেন, ‘ক্লিটাস-ক্লিটাস! চুপ করো!’
‘কেন চুপ করব? জানো আমি তোমার জীবনরক্ষক? গ্রানিকাশের যুদ্ধের কথা কি এখনই ভুলে গেছ? আমি না থাকলে পারসিরা তো সেই দিনই তোমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলত, তারপর কোথায় থাকত তোমার দিগ্বিজয়ের দুঃস্বপ্ন? শঠ, কপট, নট! আমাদের প্রাণ নিয়ে তুমি ছিনিমিনি খেলতে চাও?’
‘ক্লিটাস!’
‘থামো থামো, আমি তোমার চালাকিতেও ভুলব না, তোমার চোখরাঙানিকেও ভয়
করব না!’
অন্যান্য সেনাপতিরাও প্রমাদ গুণে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বললেন, ‘ক্লিটাস, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তুমি কাকে কী বলছ? উনি যে আমাদের সম্রাট!’
অত্যন্ত তাচ্ছিল্যে সঙ্গে ক্লিটাস বললেন, ‘যাও, যাও! আলেকজান্ডার তোমাদের সম্রাট হতে পারে, কিন্তু আমার কেউ নয়! আমি ওর আদেশ মানব না!’
মদের বিষ তখন আলেকজান্ডারের মাথায় চড়েছে, সকলের সামনে এত অপমান আর তিনি সইতে পারলেন না৷ দুর্জয় ক্রোধে বিষম এক হুংকার দিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে উঠলেন এবং চোখের পলক পড়বার আগেই পাশ থেকে একটা বর্শা তুলে নিয়ে ক্লিটাসের বুকে আমূল বসিয়ে দিলেন৷ ক্লিটাসের দেহ গড়িয়ে মাটির উপরে পড়ে গেল, দুই-একবার ছটফট করল, তারপরেই সব স্থির৷
এই কল্পনাতীত দৃশ্য দেখে সকলেই বিস্মিত ও হতভম্ব হয়ে গেলেন-থেমে গেল বাঁশির তান, গায়কের গান, নর্তকীর নাচ, উৎসবের আনন্দধ্বনি!
আলেকজান্ডার পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে স্তম্ভিত চোখে দেখলেন, ক্লিটাসের নিঃসাড় নিস্পন্দ দেহের উপর দিয়ে ঝলকে ঝলকে রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে!
দেখতে দেখতে আলেকজান্ডারের নিষ্পলক বিস্ফারিত চক্ষু অশ্রুজলে পরিপূর্ণ হয়ে গেল এবং তারপরেই শিশুর মতো ব্যাকুল ভাবে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলে উঠলেন, ‘ক্লিটাস-ভাই, আমার জীবনরক্ষক! কথা কও বন্ধু, কথা কও!’
কিন্তু ক্লিটাস আর কথা কইলেন না৷
ক্লিটাসের বুকে তখনও বর্শাটা বিঁধে ছিল৷ আলেকজান্ডার হঠাৎ হেঁট হয়ে পড়ে বর্শাটা দুই হাতে উপড়ে তুলে নিয়ে নিজের বুকে বিদ্ধ করতে উদ্যত হলেন৷
একজন দেহরক্ষী এক লাফে কাছে গিয়ে বর্শাসুদ্ধ তাঁর হাত চেপে ধরল৷ সেনাপতিরাও চারিদিক থেকে হা-হা করে ছুটে এলেন৷
আলেকজান্ডার ধস্তাধস্তি করতে করতে পাগলের মতন বলে উঠলেন, ‘না-না! আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও! যে বন্ধু আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে, আমি তাকেই হত্যা করেছি! আমি আমি মহাপাপী! আমার মৃত্যুই শ্রেয়!’
প্রধান সেনাপতি বৃদ্ধ পার্মেনিও, তিনি আলেকজান্ডারের পিতা রাজা ফিলিপের আমলের লোক৷ তিনি এগিয়ে এসে বললেন, ‘বাছা আলেকজান্ডার, তুমি ঠান্ডা হও৷ যা হয়ে গেছে তা শোধরাবার আর উপায় নেই৷ তুমি আত্মহত্যা করলে কোনোই লাভ হবে না৷’
আলেকজান্ডার কাতর স্বরে বললেন, ‘আত্মহত্যা করে আমি ক্লিটাসের কাছে যেতে চাই৷’
পার্মেনিও বললেন, ‘তুমি আত্মহত্যা করলে গ্রিসের কী হবে? এই বিপুল সৈন্যবাহিনী কে চালনা করবে? কে জয় করবে দুর্ধর্ষ ভারতবর্ষকে? তোমারই উচ্চাকাঙ্খা ছিল সারা পৃথিবী জয় করা-আমাদের স্বদেশ গ্রিসের গৌরব বর্ধন করা! আলেকজান্ডার, গ্রিস যে তোমাকে ছাড়তে পারে না, তার প্রতি তোমার কি কর্তব্য নেই?’
পার্মেনিও ঠিক জায়গায় আঘাত দিয়েছিলেন, আলেকজান্ডার আবার প্রকৃতিস্থ হয়ে দৃঢ় স্বরে বলে উঠলেন, ‘ঠিক বলেছেন সেনাপতি, স্বদেশের প্রতি আমার কর্তব্য আছে-আমি আত্মহত্যা করলে গ্রিস পৃথিবীর সম্রাজ্ঞী হতে পারবে না৷ আমাদের কর্তব্য হচ্ছে এখন ভারতবর্ষ জয় করা! এত দূরে এসে, এত রক্তপাত করে আমাদের ফেরা চলে না! সেনাপতি, আপনি এখনই বাইরে গিয়ে আমার নামে হুকুম দিন, সৈন্যরা ভারতবর্ষে যাত্রা করবার জন্যে প্রস্তুত হোক!’
সম্রাটের মন ফিরেছে দেখে, পার্মেনিও সানন্দে শিবিরের বাইরে খবর দিতে ছুটলেন৷
অনতিবিলম্বেই হাজার হাজার সৈনিকের সম্মিলিত কন্ঠে সমুদ্রগর্জনের মতো শোনা গেল-‘ভারতবর্ষ! ভারতবর্ষ! ভারতবর্ষ!’
রাজপথ দিয়ে যাচ্ছিল তিনজন অশ্বারোহী সৈনিক-সুবন্ধু, চিত্ররথ, পুরঞ্জন৷ নাম শুনে বিস্মিত হবার দরকার নেই, কারণ তারা ভারতের ছেলে৷ সেই গৌরবময় যুগে ভারতের বীর ছেলেরা তরবারি সম্বল করে ভাগ্যান্বেষণের জন্যে সুদূর পারস্য ও তুর্কিস্তান প্রভৃতি দেশেও যেতে ইতস্তত করত না, ইতিহাসেই সে সাক্ষ্য আছে৷ কালিদাসের কাব্যেও দেখবে, রাজা রঘু ভারতের মহাবীরদের নিয়ে পারসি ও হুনদের দেশে গিয়ে হাজার হাজার শত্রুনাশ করে এসেছেন৷ সুবন্ধু, চিত্ররথ ও পুরঞ্জন সেই ডানপিটেদের দলেরই তিন বীর৷ গ্রিক বাহিনীর মিলিত কন্ঠে ভারতবর্ষের নাম শুনে তারা সবিস্ময়ে ঘোড়াদের থামিয়ে ফেলল৷
একজন গ্রিক সৈনিক উত্তেজিত ভাবে শিবিরের দিকে যাচ্ছে দেখে সুবন্ধু বলল, ‘ওহে বন্ধু, কোথা যাও? তোমাদের সৈন্যরা কি আজ বড্ড বেশি মাতাল হয়ে পড়েছে? তারা ভারতবর্ষ ভারতবর্ষ’ বলে অত চ্যাঁচাচ্ছে কেন?’
গ্রিক সৈনিক ব্যস্ত স্বরে বলল, ‘এখন গল্প করবার সময় নেই৷ সম্রাট হুকুম দিয়েছেন, এখনই আমাদের শিবির তুলতে হবে৷’
‘কেন, তোমরা কোথায় যাচ্ছ?’
গ্রিক সৈনিক গর্বিত স্বরে বলল, ‘আমরা ভারতবর্ষ জয় করতে যাচ্ছি-’ বলেই দ্রুতপদে চলে গেল৷
সুবন্ধু বলল, ‘সর্বনাশ!’
পুরঞ্জন বলল, ‘এও কি সম্ভব?’
সুবন্ধু বলল, ‘আলেকজান্ডারকে দিগ্বিজয়ের নেশা পেয়ে বসেছে৷ তাঁর পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়৷’
চিত্ররথ বলল, ‘ভারতবর্ষ আমাদের জন্মভূমি৷ এ দুঃসংবাদ সেখানে কেউ এখনও শোনেনি৷’
পুরঞ্জন শুষ্কস্বরে বলল, ‘দুর্জয় গ্রিকবাহিনী, অপ্রস্তুত ভারতবর্ষ! এখন আমাদের কর্তব্য?’
সুবন্ধু কিছুক্ষণ নীরবে গ্রিক শিবিরের কর্মব্যস্ততা লক্ষ করতে লাগল-তার দুই ভুরু সংকুচিত, কপালে দুশ্চিন্তার রেখা৷ কোনো গ্রিক তাঁবুর খোঁটা তুলছে, কেউ ঘোড়াকে সাজ পরাচ্ছে, কেউ নিজে পোশাক পরছে, সেনাপতিরা হুকুম দিচ্ছেন, লোকজনেরা ছুটাছুটি করছে!
চিত্ররথ বলল, ‘এখনই বিরাট ঝটিকা ছুটবে ভারতবর্ষের দিকে৷ আমরা তিনজন মাত্র, এ ঝড়কে ঠেকাব কেমন করে?’
সুবন্ধু হঠাৎ ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘চলো চিত্ররথ! চলো পুরঞ্জন! এই ঝটিকাকে পিছনে-অনেক পিছনে ফেলে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে দূর-দূরান্তরে!’
-‘দূর-দূরান্তরে! কোথায়?’
-‘আমাদের স্বদেশে-ভারতবর্ষে! ঝটিকা সেখানে পৌঁছাবার আগেই আমরা গিয়ে ভারতবর্ষকে জাগিয়ে তুলব!’
ওদিকে অগণ্য গ্রিক কন্ঠে জলদগম্ভীর চিৎকার জাগল-‘জয় জয়, আলেকজান্ডারের জয়!’
সুবন্ধু, চিত্ররথ ও পুরঞ্জন একসঙ্গে তিরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়ে প্রাণপণ চিৎকারে বলে উঠল, ‘জয় জয়, ভারতবর্ষের জয়!’
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – প্রথম ও দ্বিতীয় বলি
‘জয় জয়, ভারতর্ষের জয়৷’
সেই পূর্ণকন্ঠের জয়ধ্বনি প্রবেশ করল আলেকজান্ডারের শিবিরের মধ্যে৷
তারপরই সম্মিলিত গ্রিক কন্ঠে জাগল আবার সেই সমুদ্রগর্জনের মতো গম্ভীর ধ্বনি-‘জয় জয়, আলেকজান্ডারের জয়!’
আলেকজান্ডার ভারতের ভাষা জানতেন না৷ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার সৈন্যদের সঙ্গে বিদেশি ভাষায় কারা চিৎকার করে কী বলছে?’
তখনই দোভাষী এসে জানাল, ‘তিনজন ভারতের সৈনিক এখান দিয়ে যাচ্ছিল৷ আমরা ভারত আক্রমণ করতে যাব শুনে তারা ভারতের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে৷’
আলেকজান্ডার বিস্মিত কন্ঠে বললেন, ‘আশ্চর্য ওদের সাহস! মাত্র ওরা তিনজন, অথচ আমার সৈন্যদের সামনে দাঁড়িয়ে ভারতের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে!’
‘সম্রাট, ওরা দাঁড়িয়ে নেই,-বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে যেতে চিৎকার করছে!’
দুই ভুরু কুঁচকে আলেকজান্ডার খানিকক্ষণ ধরে কী ভাবলেন৷ তারপর বললেন, ‘ঘোড়া ছুটিয়ে ওরা কোন দিকে গেল?’
‘দক্ষিণ দিকে৷’
‘দক্ষিণ দিকে? তার মানে ভারতবর্ষের দিকে!’ আলেকজান্ডার হঠাৎ এক লাফে উঠে দাঁড়ালেন৷ তারপর চিৎকার করে বললেন, ‘তেজী ঘোড়ায় চড়ে আমার সৈনিকেরা এখনই ওদের পিছনে ছুটে যাক! ওদের বন্দি করো! ওদের বধ করো! নইলে আমরা মহা বিপদে পড়ব!’
হুকুম প্রচার করবার জন্যে দোভাষী তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে গেল৷ আলেকজান্ডার অস্থির চরণে শিবিরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বললেন, ‘আমার সৈন্যরা মূর্খ৷ কেন তারা ওদের ছেড়ে দিল?’
কয়েকজন গ্রিক সেনানী সেইখানে উপস্থিত ছিলেন৷ একজন এগিয়ে এসে বললেন, ‘সম্রাট, তুচ্ছ কারণে আপনি এতটা উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? ওই তিনজন মাত্র পলাতক সৈনিক আমাদের কী অপকার করতে পারে?’
আলেকজান্ডার বললেন, ‘তোমরাও কম মূর্খ নও! এই কি তুচ্ছ কারণ হল? বুঝতে পারছ না, আমাদের এই অভিযানের কথা ভারত যত দেরিতে টের পায়, ততই ভালো! শত্রুদের প্রস্তুত হতে অবসর দেওয়া যে আত্মহত্যার চেষ্টার মতো! সারা ভারত যদি অস্ত্রধারণ করবার সময় পায়, তাহলে আমাদের অবস্থা কী হবে? ওই তিনজন সৈনিক ভারতে ছুটে চলেছে তাদের স্বদেশকে সাবধান করবার জন্যে৷ বন্দি করো, তাদের বধ করো, তাদের কন্ঠরোধ করো!’
-‘সম্রাট, এখান থেকে ভারত শত-শত ক্রোশ দূরে! সেখানে যাবার আগেই পলাতকরা নিশ্চয়ই ধরা পড়বে!’
সত্যই তাই! সমরখন্দ এবং ভারতবর্ষ! তাদের মাঝখানে বিরাজ করছে শত-শত ক্রোশব্যাপী পথ ও বিপথের মধ্যে আমুদরিয়া প্রভৃতি নদী, হিন্দুকুশ প্রভৃতি পর্বত, বিজন অরণ্য, বৃহৎ মরুপ্রান্তর এবং আরও কত কী বিষম বাধা! এত বাধা-বিপত্তিকে ঠেলে দুর্গম পথের তিন যাত্রী কি আবার তাদের স্বদেশের আশ্রয়ে ফিরে আসতে পারবে? কত সূর্য ডুববে, কত চন্দ্র উঠবে, কত তারকা ফুটবে, বাতাস কখনো হবে আগুনের মতো গরম ও কখনো হবে তুষারের মতো শীতল, আকাশ কখনো করবে বজ্রপাত এবং কখনো পাঠিয়ে দেবে প্রবল ঝঞ্ঝার দলবল, বনে বনে গর্জন করে জাগবে হিংস্র জন্তুরা, আনাচে-কানাচে অতর্কিতে আবির্ভুত হবে তাদের চেয়ে আরও নিষ্ঠুর দস্যুরা এবং সেই সঙ্গে তাদের লক্ষ করে ধেয়ে আসছে দৃঢ়-পণ নিয়ে ত্রিশজন অশ্বারোহী গ্রিক সৈনিক! ভারতের ছেলে আর কি ভারতে ফিরবে?
শেষোক্ত বিপদের কথা আগে তারা টের পায়নি৷ প্রত্যাবর্তন আরম্ভ করে তাদের বেগমান অশ্বেরা অনেকখানি পথ এগিয়ে যাবার সুযোগ পেয়েছিল৷ ত্রিশজন গ্রিক সৈনিক সাজসজ্জা করে বেরোতে কম সময় নেয়নি৷ ভারতের তিন ভাগ্যান্বেষী বীর স্বদেশে ফেরবার পথঘাটও ভালো করে জানত, গ্রিকদের যা জানা ছিল না৷ তিনজন ভারতবাসী কখন কোন পথ অবলম্বন করছে, গ্রামে গ্রামে দাঁড়িয়ে পড়ে সে খবর সংগ্রহ করতেও গ্রিকদের যথেষ্ট বিলম্ব হয়ে যাচ্ছিল৷
কিন্তু গ্রিকরা নিশ্চিতভাবেই তিন বীরের পিছনে এগিয়ে চলেছে৷ কেবল তাই নয়, তারা ক্রমেই তাদের নিকটস্থ হচ্ছে৷
সেদিন সকালে আমুদরিয়া নদী পার হয়ে তিন বন্ধুতে বিশ্রাম করছিল৷ হঠাৎ সুবন্ধু চমকে দাঁড়িয়ে উঠে নদীর পরপারে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল৷
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে চিত্ররথ ও পুরঞ্জনও দেখল, একখানা ধুলোর মেঘ নদীর ওপারে এসে থেমে পড়ল৷
ধীরে ধীরে ধুলোর মেঘ উড়ে গেল এবং সেই সঙ্গেই দেখা গেল, একদল অশ্বারোহী সৈনিকের উজ্বল শিরস্ত্রাণ ও বর্মের উপরে পড়ে ঝকমক করে উঠছে প্রভাতের সূর্যকিরণ!
সুবন্ধু সচকিত কন্ঠে বললে, ‘গ্রিক সৈন্য!’
চিত্ররথ বলল, ‘ওরা পার-ঘাটে গিয়ে ঘোড়া থেকে তাড়াতাড়ি নেমে পড়ল! ওরা নদী পার হতে চায়!’
পুরঞ্জন বললে, ‘এত শীঘ্র অত-বড়ো শিবির তুলে ওরা কি অভিযান আরম্ভ করে
দিয়েছে?’
সুবন্ধু ঘাড় নেড়ে বলল, ‘আসল বাহিনী হয়তো শিবির তোলবার চেষ্টা এখনও ব্যস্ত হয়ে আছে৷’
‘তবে কি ওরা অগ্রবর্তী রক্ষীর দল?’
‘হতে পারে৷ কিন্তু আমার বিশ্বাস, ওরা আমাদেরই খুঁজছে৷ নইলে ওরা প্রায় আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই এখানে এসেছে কেন? এ-পথ তো ভারতে যাবার পথ নয়-এ-পথ তো কেবল আমাদের মতো সন্ধানী লোকেরাই জানে! ওরা নিশ্চয় আমাদের উদ্দেশ্য ধরে ফেলেছে-ওরা নিশ্চয় আমাদের বন্দি করতে এসেছে!’
‘কিন্তু আমরা বন্দি হব না৷ নদী পার হতে ওদের সময় লাগবে৷ ততক্ষণে আমরা অনেক দূরে এগিয়ে যেতে পারব৷ ভারতে যাবার কত পথ আছে, সব পথ ওরা জানবে কী করে?
‘ঘোড়ায় চড়ো, ঘোড়ায় চড়ো! ভারত এখনও বহু দূর-‘
তিন বীরকে পিঠে নিয়ে তিন ঘোড়া ছুটল আবার ভারতের দিকে৷
ওপারে গ্রিকদের ব্যস্ততা আরও বেড়ে উঠল, মুখের শিকার আবার হাতছাড়া হল দেখে৷
আবার দিন যায় রাত আসে, রাত যায় দিন আসে৷ দিকচক্রবাল-রেখার উপরে ফুটে উঠল হিন্দুকুশের মর্মভেদী শিখরমালা৷ গ্রিকরা হতাশ হয়, তিন ভারতবীরের চোখে জ্বলে আশার আলো৷ হিন্দুকুশের অন্দরে গিয়ে ঢুকতে পারলে কে আর তাদের নাগাল ধরতে পারবে? হিন্দুকুশের ওপার থেকে ডাকছে তাদের মহাভারতের প্রাচীন আত্মা! স্বদেশগামী ঘোড়াদের খুরে খুরে জাগছে বিদ্যুৎগতির ছন্দ!
বিস্তীর্ণ এক সমতল প্রান্তর-একান্ত অসহায়ের মতো দুপুরের রোদের আগুনে পুড়ে পুড়ে দগ্ধ হচ্ছে৷ প্রান্তরের শেষে একটা বেশ উঁচু পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে পথ জুড়ে৷ তিন ঘোড়া পাশাপাশি ছুটছে সেই দিকেই৷
পাহাড়ের খুব কাছে এসে হঠাৎ পুরঞ্জনের ঘোড়া প্রথমে দাঁড়িয়ে-তারপর মাটির উপরে শুয়ে পড়ল৷ দু-একবার ছটফট করেই একেবারে স্থির!
পুরঞ্জন মাটির উপরে হাঁটু গেড়ে বসে ঘোড়াকে পরীক্ষা করতে লাগল, সুবন্ধু ও চিত্ররথও নিজেদের ঘোড়া থেকে নামল৷
মৃতের মতো বর্ণহীন মুখ ঊর্ধ্বে তুলে পুরঞ্জন অবরুদ্ধ স্বরে বলল, ‘আমার ঘোড়া এ-জীবনে আর উঠবে না!’
সুবন্ধু বলল, ‘এখন ঘোড়া যাওয়ার মানেই হচ্ছে, শত্রুর হাতে বন্দি হওয়া৷ আমাদেরও ঘোড়ার অবস্থা ভালো নয়৷ এদের কোনোটাই দুজন সওয়ার পিঠে নিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটতে পারবে না৷’
চিত্ররথ পিছন দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করে ত্রস্ত স্বরে বলল, ‘ওদিকে চেয়ে দেখো-ওদিকে চেয়ে দেখো!’
সকলে সভয়ে দেখল, দূর অরণ্যের বক্ষ ভেদ করে একে একে বেরিয়ে আসছে গ্রিক সৈনিকের পর গ্রিক সৈনিক! তাদের দেখেই তারা উচ্চস্বরে জয়নাদ করে উঠল!
সুবন্ধু ব্যস্তভাবে বলল, ‘কী করি এখন? পুরঞ্জনকে এখানে ফেলে রেখে কী করেই বা আমরা পালিয়ে যাই?’
পুরঞ্জন দৃঢ়স্বরে বলল, ‘শোনো সুবন্ধু! আমি এক উপায় স্থির করেছি৷ এখন এই উপায়ই হচ্ছে একমাত্র উপায়৷’
গ্রিকরা তখন ঘোড়া ছুটিয়ে দ্রুততর বেগে এগিয়ে আসছে৷ সেইদিকে দৃষ্টি রেখে সুবন্ধু বললে, ‘যা বলবার শীঘ্র বলো৷ নইলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বন্দি হতে হবে৷’
পুরঞ্জন সুদীর্ঘ একটা নিশ্বাস টেনে বুক ফুলিয়ে বলল, ‘ভারতের ছেলে এত সহজে বন্দি হয় না! শোনো সুবন্ধু! সামনের উঁচু পাহাড় আর পিছনে গ্রিক সৈন্য-ঘোড়া ছুটিয়ে আমরা আর কোথাও পালাতে পারব না! কিন্তু পাহাড়ের ওই সরু পথটা দেখছ তো? পাশাপাশি দুজন লোক ও-পথে উপরে উঠতে পারে না! চলো, ঘোড়া ছেড়ে ওই পথে আমরা উপরে গিয়ে উঠি৷ গ্রিকদেরও ঘোড়া ছেড়ে ওই পথেই এক-একজন করে উঠতে হবে৷ আমি আর চিত্ররথ পাহাড়ে উঠে ওই পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে শত্রুদের বাধা দেব৷’
সুবন্ধু বিস্মিত স্বরে বলল, ‘আর আমি?’
‘ভগবানের আশীর্বাদ নিয়ে তুমি ছুটে যাও ভারতের দিকে৷ তুমি একলা দু-চারদিন লুকিয়ে এগোতে পারবে৷ তারপর নতুন তাজা ঘোড়া কিনে যথাসময়ে ভাঙিয়ে দেবে ভারতের নিশ্চিন্ত নিদ্রা!
‘আর তোমরা?’
‘যতক্ষণ পারি শত্রুদের ঠেকিয়ে রাখব৷ তারপর স্বদেশের জন্যে হাসতে হাসতে প্রাণ দেব?’
‘সে হয় না পুরঞ্জন! স্বদেশের জন্যে প্রাণ দেবার আনন্দ থেকে আমিই বা বঞ্চিত হব কেন?’
পুরঞ্জন কর্কশ স্বরে বলল, ‘প্রতিবাদ কোরো না সুবন্ধু, এখন কথা কাটাকাটির সময় নেই! গ্রিকরা যাচ্ছে ভারতবর্ষে, স্বদেশের জন্যে প্রাণ দেবার অনেক সুযোগ তুমি পাবে! এখন সবচেয়ে বড়ো কর্তব্য তুমি পালন করো, শত্রুদের আমরা বাধা দিই৷ -চিত্ররথ! তুমি নীরব কেন? তোমার কি ভয় হচ্ছে?’
চিত্ররথ সদর্পে বলল, ‘ভয়! ক্ষত্রিয় মরতে ভয় পায়? আমি চুপ করে আছি-কারণ মৌনই হচ্ছে সম্মতির লক্ষণ!’
পুরঞ্জন তরবারি কোষমুক্ত করে পাহাড়ের দিকে ছুটতে ছুটতে বলল, ‘তাহলে এসো আমার সঙ্গে! বলো-জয় ভারতবর্ষের জয়!’
ভারতবর্ষের নামে জয়ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস পরিপূর্ণ করে তিনজন ভারতসন্তান সামনের পাহাড়ের দিকে বেগে ছুটে চলল৷
সেখানে গিয়ে পৌঁছেই সুবন্ধু বুঝল, পুরঞ্জন ভুল বলেনি, এই সরু পথ রুখে দাঁড়ালে দুজন মাত্র লোক অনেকক্ষণ ধরে বহু লোককে বাধা দিতে পারবে!
প্রায় সত্তর-আশি ফুট উপরে গিয়ে পথটা আবার আরও সরু হয়ে গেছে৷
পুরঞ্জন বলল, ‘এই হচ্ছে আমাদের দাঁড়াবার জায়গা! এখন অগ্রসর হও সুবন্ধু, আমাদের পিতৃভূমির পবিত্র পথে! জয়, ভারতবর্ষের জয়!’
সুবন্ধু ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলল, ‘ভাগ্যবান বন্ধু! দু-দিন পরে বিরাট ভারতবর্ষ দেবে কৃতজ্ঞ হৃদয়ে তোমাদেরই নামে জয়ধ্বনি! এসো একবার শেষ আলিঙ্গন দাও! তারপর আমি চলি ঘুমন্ত ভারতের পথে, আর তোমরা চলো জাগন্ত মৃত্যুর পথে!’
পুরঞ্জন সজোরে সুবন্ধুকে বুকের ভিতরে চেপে ধরে বলল, ‘না বন্ধু, মৃত্যুর পথ এখন ভারতের দিকেই অগ্রসর হয়েছে! আমরাও বাঁচব না, তোমরাও বাঁচবে না, বিদায়!’
চিত্ররথকে আলিঙ্গন করে সুবন্ধু যখন বেগে ছুটতে লাগল তখন তার দুই চোখ দিয়ে ঝরছে ঝরঝর করে অশ্রুর ঝরনা!
চিত্ররথ তার বিরাট দেহ নিয়ে সেই দেড়-হাত সরু পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে অট্টহাস্য করে বলল, ‘ভাই পুরঞ্জন, কাঁধ থেকে ধনুক নামাও! দেখছ, নির্বোধ গ্রিকদের কেউ ধনুকবাণ আনেনি৷ আমাদের ধনুকের বাণগুলোই আজ ওদের উপরে উঠতে দেবে না৷’ বলেই সে নিজের ধনুক হাতে নিল৷
ওদিকে ত্রিশজন গ্রিক সৈনিক তখন পাহাড়ের তলদেশে এসে হাজির হয়েছে৷ এখানে ঘোড়া অচল এবং পদব্রজেও উপরে উঠে একসঙ্গে আক্রমণ করা অসম্ভব দেখে তারা দল বেঁধে দাঁড়িয়ে পরামর্শ করতে লাগল৷
তাদের অধ্যক্ষ তরবারি নেড়ে নীচে থেকে চেঁচিয়ে বলল, ‘ওরে ভারতের নির্বোধরা! ভালো চাস তো এখনও আত্মসমর্পণ কর, নইলে মৃত্যু তোদের নিশ্চিত!’
পুরঞ্জন ও চিত্ররথ কোনো জবাব দিল না, কেবল ধনুকে বাণ লাগিয়ে পাথরের মূর্তির মতন স্থির হয়ে রইল৷
অধ্যক্ষ চিৎকার করে বলল, ‘শোনো গ্রিসের বিশ্বজয়ী বীরগণ! সম্রাটের আদেশ, হয় ওদের বন্দি, নয় বধ করতে হবে! প্রাণের ভয়ে ওই কাপুরুষরা নীচে যখন নামতে রাজি নয়, তখন ওদের আক্রমণ করা ছাড়া উপায় নেই! যাও, তোমরা ওদের বন্দি করো, নয় ইঁদুরের মতো টিপে মেরে ফেলো!’
ঢাল, বর্শা, তরবারি নিয়ে গ্রিকরা পাহাড়ে-পথের উপরে উঠতে লাগল-কিন্তু একে একে, কারণ পাশাপাশি দু-জনের ঠাঁই সেখানে নেই, এ-কথা আগেই বলা হয়েছে৷
সঙ্গে সঙ্গে পুরঞ্জন ও চিত্ররথের ধনুকের ছিলায় জাগল মৃত্যুবীণার অপূর্ব সংগীত,-সাহসী যোদ্ধাদের চিত্তে চিত্তে নাচায় যা উন্মত্ত আনন্দের বিচিত্র নূপুর!
গ্রিকরা ঢাল তুলে আত্মরক্ষার চেষ্টা করল, কিন্তু বৃথা! মিনিট-তিনেকের মধ্যেই চার জন গ্রিক সৈনিকের দেহ হত বা আহত হয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নীচের দিকে নামতে লাগল!
চিত্ররথ তার প্রচণ্ড কন্ঠে চিৎকার করে বলল, ‘আয় রে গ্রিক কুক্কুরের দল! ভারতের দুই জোড়া বাহু আজ তোদের ত্রিশজোড়া বাহুকে অক্ষম করে দেবে!’
পুরঞ্জন ধনুক থেকে বাণ ত্যাগ করে বলল, ‘তোরা যদি না পারিস, তোদের সর্দার ডাকাত আলেকজান্ডারকে ডেকে আন!’
পাঁচ-ছয়বার চেষ্টার পর গ্রিকদের দলের এগারো জন লোক হত বা আহত হল৷
পুরঞ্জন সানন্দে বলল, ‘দু-ঘণ্টা কেটে গেছে! সুবন্ধুকে আর কেউ ধরতে পারবে না৷ জয়, ভারতবর্ষের জয়৷’
গ্রিক সেনাধ্যক্ষ মনে মনে প্রমাদ গুণল, ও-পথ হচ্ছে সাক্ষাৎ মৃত্যুর পথ! ত্রিশ জনের মধ্যে এগারো জন অক্ষম হয়েছে, বাকি আছে উনিশ জন মাত্র! দুজনের কাছে ত্রিশ জনের শক্তি ব্যর্থ, সম্রাট শুনলে কী বলবেন!
হঠাৎ একজন সৈনিক এসে খবর দিল, ‘পাহাড়ে ওঠবার আর একটা নতুন পথ পাওয়া গেছে!’
সেনাধ্যক্ষ সানন্দে বলল, ‘জয় আলেকজান্ডারের জয়! আমরা নয় জন এইখানেই থাকি৷ বাকি দশ জন নতুন পথ দিয়ে উপরে উঠে গিয়ে শত্রুদের পিছনে গিয়ে দাঁড়াক! তারপরে দুই দিক থেকে ওদের আক্রমণ করো!
বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেল! শত্রুদের কেউ আর উপরে ওঠবার চেষ্টা করছে না দেখে চিত্ররথ আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘পুরঞ্জন, তাহলে আমরা কি অনন্তকালের জন্যে এইখানেই ধনুকে তির লাগিয়ে বসে থাকব?’
পুরঞ্জন বলল, ‘হাঁ, যত সময় কাটবে, সুবন্ধু ততই দূরে গিয়ে পড়বে৷ আমরা তো তাইই চাই!’
পাহাড়ের গায়ে ছায়া ক্রমেই দীর্ঘতর হয়ে উঠতে লাগল৷ সূর্য গিয়েছে আকাশের পশ্চিমে৷
আচম্বিতে পাহাড়ের উপর জেগে উঠল ঘন ঘন পাদুকার পর পাদুকার শব্দ!
চিত্ররথ মুখ ফিরিয়ে দেখেই কঠোর হাসি হেসে বলল, ‘পুরঞ্জন, এ-জীবনে শেষবারের মতো ভারতের নাম করে নাও! জয় ভারতবর্ষের জয়! চেয়ে দেখো, শত্রুরা আমাদের পিছনে!’
‘শত্রুরা আমাদের দুই দিকেই! দেখো চিত্ররথ, নীচে থেকেও ওরা উপরে উঠছে!’
‘পুরঞ্জন, আমার ধনুকের জন্যে আর দুটি মাত্র বাণ আছে!’
‘চিত্ররথ, আমার ধনুকের জন্যে আর একটিমাত্র বাণও নেই!’
‘তাহলে আবার বলো, -জয়, ভারতবর্ষের জয়!’
‘জয়, ভারতবর্ষের জয়! নাও তরবারি, ঝাঁপিয়ে পড়ো মৃত্যুর মুখে!’
পুরঞ্জন ও চিত্ররথের তরবারি নাচতে লাগল অধীর পুলকে, অস্তগামী সূর্যের শেষ কিরণ আরক্ত করে তুলল তাদের সাংঘাতিক আকাঙ্খাকে৷ তিন জন গ্রিক সৈনিকের মৃতদেহ পাহাড়ের কালো দেহকে লালে লাল করে তুলল বটে, কিন্তু তারপর আর আত্মরক্ষা করতে পারল না ভারতের বীরত্ব! ত্রিশ জনের বিরুদ্ধে মাত্র দুই জন দাঁড়িয়ে চৌদ্দ জন শত্রুনাশ করেছে, কিন্তু তারপরেও অবশ্যম্ভাবীকে আর বাধা দেওয়া গেল না! গ্রিক তরবারির মুখে পুরঞ্জনের দক্ষিণ বাহু বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটির উপরে গিয়ে পড়ল, কিন্তু তখনও সে কাতর হল না, বাম হাতে বর্শা নিয়ে শত্রুদের দিকে বেগে তেড়ে গেল আহত সিংহের মতো গর্জন করে৷
পরমুহূর্তেই পুরঞ্জনের ছিন্নমুণ্ড দেহ ভূমিতলকে আশ্রয় করল৷
চিত্ররথেরও সর্বাঙ্গ দিয়ে ঝরছে তখন রক্তের রাঙা হাসি! প্রায় বিবশ দেহে পাহাড়ের গা ধরে উঠে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে সে বলে উঠল, ‘নমস্কার ভারতবর্ষ! নমস্কার পঞ্চনদের তীর!’ তারপরেই আবার এলিয়ে শুয়ে পড়ে অন্তিম নিশ্বাস ত্যাগ করল৷
গ্রিক সেনাধ্যক্ষ চমৎকৃত ভাবে দুই মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই যদি ভারতের বীরত্বের নমুনা হয়, তাহলে আমাদের অদৃষ্ট নেহাত মন্দ বলতে হবে!’
আর একজন সৈনিক বলল, ‘এরা ছিল তো তিন জন, কিন্তু আর-একটা লোককে দেখতে পাচ্ছি না কেন?’
সেনাধ্যক্ষ চমকে উঠে বলল, ‘ঠিক বলেছ, তাই তো! সে পালাতে পারলে এত রক্তারক্তি, হত্যাকাণ্ড সব ব্যর্থ হবে!’
গ্রিকরা ব্যস্ত হয়ে পাহাড়ের আরও উপরে উঠতে লাগল৷
কিন্তু সুবন্ধু পাহাড় ছেড়ে নেমে গেছে পাঁচ ঘণ্টা আগে৷ স্বদেশের পথ থেকে তাকে আর কেউ ফিরিয়ে আনতে পারবে না৷ পুরঞ্জন ও চিত্ররথের আত্মদান বিফল হবে না৷
তখনও ভীমার্জুনের বীরত্বগাথা প্রাচীন কাব্যের সম্পত্তি হয়নি৷ ভারতের বীরগণ তখন ভীমার্জুনকে প্রায় সমসাময়িক বলে মনে করতেন৷ ভারতের ঘরে ঘরে, পঞ্চনদের তীরে তাই তখন বিরাজ করত লক্ষ লক্ষ পুরঞ্জন ও চিত্ররথ!
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – স্থান-কাল-পাত্রের পরিচয়
বিরাট হিন্দুকুশের তুষার অরণ্য ভেদ করে আপাতত আমরা আর সুবন্ধুর অনুসরণ করব না৷ ভারতের ছেলে ভারতে ফিরে আসছে, যথাসময়েই আবার তাকে অভ্যর্থনা করে নেব সাদরে৷ এখন এই অবকাশে আমরা গল্পসূত্র ছেড়ে অন্যান্য দু-চারটে দরকারি কথা আলোচনা করে নিই৷ কী বল?
স্বদেশকে আমরা সবাই ভালোবাসি নিশ্চয়, কারণ, বনমানুষ ও সাধারণ জানোয়াররা পর্যন্ত স্বদেশ থেকে নির্বাসিত হলে সুখী হয় না৷ আফ্রিকার গরিলাদের অন্য দেশে ধরে নিয়ে গেলে প্রায়ই তারা মারা পড়ে৷ তাদের যত যত্নই করা হোক, যত ভালো খাবারই দেওয়া হোক, তবু তাদের মনের দুঃখ ঘোচে না৷ এই দুঃখই হচ্ছে তাদের স্বদেশপ্রীতি৷ গরিলাদের স্বদেশপ্রীতি আছে, আমাদের থাকবে না?
অবশ্য আমাদের-অর্থাৎ মানুষদের মধ্যে-গরিলার চেয়েও নিম্নশ্রেণির জীব আছে দু-চারজন৷ লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করতে হচ্ছে, তারা বাস করে এই ভারতবর্ষেই৷ তারা দু-তিন বছর বিলাতি কুয়াশার মধ্যে বাস করে দেশের মাটি, দেশের মায়া, দেশের ভাষা, দেশের সাজ-পোশাক ভুলতে চায় এবং নিজেদের ব্যর্থ নকল সাহেবিয়ানা নিয়ে গর্ব করতে লজ্জিত হয় না! তোমরা যখনই সুযোগ পাবে, এদের মূর্খতার শাস্তি দিতে ভুলো না৷
হ্যাঁ, স্বদেশকে আমরা ভালোবাসি৷ কিন্তু সে ভালোবাসার পরিমাণ হয়তো যথেষ্ট নয়৷ এই বর্তমান যুগেই দেশের কতটুকু খবর আমরা রাখতে পারি? প্রাচীন ভারতের খবর আমরা প্রায় কিছুই জানি না বললেও হয়৷ বিদেশি রাজার তত্ত্বাবধানে স্কুল কলেজে যে-সব ইতিহাস আমরা মুখস্থ করি, তার ভিতরে স্বাধীন ভারতের অধিকাংশ গৌরব ও বর্ণবৈচিত্র্যকে অন্ধকারের কালো রং মাখিয়ে ঢেকে রাখা হয় এবং নানাভাবে আমাদের বোঝাবার চেষ্টা করা হয় যে, ইউরোপীয়রা আসবার আগে ভারতে না ছিল উচ্চতর সভ্যতা, না ছিল প্রকৃত সুশাসন, না ছিল যথার্থ সাম্রাজ্য৷ কিন্তু তোমরা যদি চন্দ্রগুপ্ত, অশোক, সমুদ্রগুপ্ত, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত-বিক্রমাদিত্য, কুমারগুপ্ত, স্কন্দগুপ্ত ও হর্ষবর্ধন প্রভৃতি প্রাচীন ভারতীয় সম্রাটদের জীবনচরিত পড়ো তাহলে বুঝবে যে, সমগ্র পৃথিবীর কোনো সম্রাটই তাঁদের চেয়ে উচ্চতর সম্মানের দাবি করতে পারেন না৷ তাঁদের যুগে ভারত সভ্যতা, সাহিত্য, জ্ঞানবিজ্ঞান, ললিতকলা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে যত উচ্চে উঠেছিল, আজকের অধঃপতিত আমরা তা কল্পনাও করতে পারব না৷ এইচ জি ওয়েলস স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করেছেন, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট বলতে অশোককেই বোঝায়৷ অশোক ছিলেন আসমুদ্র হিমাচলের অধীশ্বর, কিন্তু তিনি রাজ্যশাসন করেছেন প্রেমের দ্বারা৷ রণক্ষেত্রে ভারতের নেপোলিয়ন উপাধি লাভ করেছেন সমুদ্রগুপ্ত, তাঁর দেশ ছিল বাংলার পাশেই পাটলিপুত্রে৷ সমগ্র ভারত জয় করেও তিনি তৃপ্ত হননি, ললিতকলা ও সাহিত্যক্ষেত্রেও তাঁর নাম প্রসিদ্ধ হয়ে আছে৷ সম্রাট হর্ষবর্ধনও কেবল দুর্ধর্ষ দিগ্বিজয়ী ছিলেন না, সংস্কৃত সাহিত্যেও তিনি একজন অমর নাট্যকার ও কবি বলে পরিচিত (‘নাগানন্দ’, ‘রত্নাবলী’ ও ‘প্রিয়দর্শিকা’ প্রভৃতি তাঁরই বিখ্যাত রচনা)৷ তাঁর মতন একাধারে শ্রেষ্ঠ কবি ও দিগ্বিজয়ী সম্রাট পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই৷ সমুদ্রগুপ্ত সম্বন্ধেও ওই কথা বলা যায়৷
এমন সব সন্তানের পিতৃভূমি যে ভারতবর্ষ, আলেকজান্ডার দিগ্বিজয়ীরূপে সেখানে এসে কেমন করে অম্লান গৌরবে স্বদেশে ফিরে গেলেন? তোমাদের মনে স্বভাবতই এই প্রশ্নের উদয় হতে পারে৷ এর জবাবে বলা যায় : ঐতিহাসিক যুগে বিরাট ভারত-সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতিরূপে সর্বাগ্রে দেখি চন্দ্রগুপ্তকে৷ তিনি আলেকজান্ডারের সমসাময়িক হলেও গ্রিকদের ভারত আক্রমণের সময়ে ছিলেন স্বদেশ থেকে নির্বাসিত, সহায়-সম্পদহীন ব্যক্তি৷ তাঁর হাতে রাজ্য থাকলে আলেকজান্ডার হয়তো বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারতেন না৷ আলেকজান্ডার উত্তর-ভারতের এক অংশ মাত্র অধিকার করেছিলেন, তাও তখন বিভক্ত ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে এবং সে-সব রাজ্যে রাজাদের মধ্যে ছিল না একতা৷ তখন আলেকজান্ডারের প্রধান শত্রু রাজা পুরুর চেয়েও ঢের বেশি বিখ্যাত ও শক্তিশালী ছিলেন পাটলিপুত্রের (বর্তমান পাটনার) নন্দবংশীয় রাজা৷ তাঁর নিয়মিত বাহিনীতে ছিল আশি হাজার অশ্বারোহী, দুই লক্ষ পদাতিক, আট হাজার যুদ্ধরথ ও ছয় হাজার রণহস্তী৷ দরকার হলে এদের সংখ্যা ঢের বাড়তে পারত, কারণ এর কয়েক বৎসর পরেই দেখি, মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই পাটলিপুত্রের ফৌজ দাঁড়িয়েছে এইরকম : ছয় লক্ষ পদাতিক, ত্রিশ হাজার অশ্বারোহী, নয় হাজার রণহস্তী এবং অসংখ্য রথ৷ সুতরাং পাটলিপুত্রের রাজা নন্দের সঙ্গে আলেকজান্ডারের শক্তিপরীক্ষা হলে কী হত বলা যায় না৷ আলেকজান্ডার পাটলিপুত্রের দিকে আসবার প্রস্তাবও করেছিলেন বটে, কিন্তু সেই প্রস্তাব শুনেই সমগ্র গ্রিকবাহিনী বিদ্রোহের ভাব প্রকাশ করেছিল এবং তার প্রধান কারণই এই যে ক্ষুদ্র রাজা পুরুর দেশেই গ্রিকরা ভারতীয় বীরত্বের যেটুকু তিক্ত আস্বাদ পেয়েছিল, তাদের পক্ষে সেইটুকুই হয়ে উঠেছিল যথেষ্টের বেশি৷
তারপর আর এক প্রশ্ন৷ ভারতবর্ষে আমরা গ্রিক বীরত্বের যে-ইতিহাস পাই, তা বহুস্থলেই অতিরঞ্জিত, কোথাও কল্পিত এবং কোথাও অমূলক কি না? আমার বিশ্বাস, হাঁ৷ কারণ এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক চিত্রকর নিজের ছবিই নিজে এঁকেছেন৷ এই খবরের কাগজের যুগে, সদা-সজাগ বেতার, টেলিগ্রাফ ও টেলিফোনের রাজ্যেও নিত্যই দেখছি যুদ্ধে নিযুক্ত দুই পক্ষই প্রাণপণে সত্যগোপন করছে, হেরে বলছে হারিনি, সামান্য জয়কে বলছে অসামান্য৷ সুতরাং সেই কল্পনাপ্রিয় আদ্যিকালে গ্রিকরা যে সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের মতো ইতিহাস লিখেছিল, তা কেমন করে বলি? গ্রিকরা যে কোথাও হারেনি, তাই বা কেমন করে মানি? আধুনিক ইউরোপীয় লেখকরাই গ্রিক ঐতিহাসিকদের কোনো কোনো অতিরঞ্জিত ও অসত্য কথা দেখিয়ে দিয়েছেন৷ আর একটা লক্ষ করবার বিষয় হচ্ছে, ভারতের বুকের উপর দিয়ে এত বড়ো একটা ঝড় বয়ে গেল, তবু হিন্দু, বৌদ্ধ বা জৈন সাহিত্যে তার এতটুকু ইঙ্গিত বা উল্লেখ দেখা যায় না! এও অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক৷ এবং গ্রিকরা যে অকারণে ভয় পায়নি, তার কিছুদিন পরেই সে-প্রমাণ পাওয়া যায়৷ সে এখন নয়, যথাসময়ে বলব৷
গ্রিকদের সঙ্গে ভারতবাসীদের প্রথম মৃত্যুমিলন হয় যে নাট্যশালায়, এখন সেই অঞ্চলের তখনকার অবস্থার সঙ্গে তোমাদের পরিচিত করতে চাই৷ গল্প বলা বন্ধ রেখে বাজে কথা বলছি বলে তোমাদের অনেকেই হয়তো রাগ করবে৷ কিন্তু আমাদের দেশের পুরোনো ইতিহাসের সঙ্গে লোকের পরিচয় এত অল্প যে, স্থান-কাল সম্বন্ধে একটু ভূমিকা না দিলে এই ঐতিহাসিক কাহিনির আসল রসটুকু কিছুতেই জমবে না৷
সীমান্তের যে প্রদেশগুলি উত্তর-ভারতবর্ষের সিংহদ্বারের মতো এবং সর্বপ্রথমেই যাদের মধ্য দিয়ে আসবার সময়ে গ্রিকদের তরবারি ব্যবহার করতে হয়েছিল প্রাণপণে, সে-যুগে তাদের কতকগুলি বিশেষত্ব ছিল৷
ভারতের উত্তর-সীমান্তের দেশগুলিতে আজকাল প্রধানত মুসলমানদের বাস৷ কিন্তু মহম্মদের জন্মের বহু শত বৎসর আগেই আলেকজান্ডার এসেছিলেন ভারতবর্ষে৷ সুতরাং পৃথিবীতে তখন একজনও মুসলমান ছিলেন না (একজন ক্রিশ্চানও ছিলেন না, কারণ যিশুখ্রিস্ট জন্মাবার তিনশো সাতাশ বৎসর আগে আলেকজান্ডার সসৈন্যে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করেছিলেন)৷
ভারতে প্রচলিত তখন প্রধানত বৈদিক হিন্দুধর্ম৷ ইউরোপীয় গ্রিকরা ছিলেন পৌত্তলিক৷ কিন্তু আগেই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, হিন্দুরা খুব সম্ভব তখন প্রতিমা ও মন্দির গড়ে পূজা করতেন না, অথবা করলেও তার বেশি চলন হয়নি৷ অনেক ঐতিহাসিকের মত হচ্ছে, এদেশে মন্দির ও প্রতিমার চলন হয় গ্রিকদের দেখাদেখি৷ ভারতে তখন জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মেরও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠা হয়েছে বটে, কিন্তু জিন ও বুদ্ধেরও কোনো মূর্তি গড়া হয়নি৷ প্রথম বুদ্ধমূর্তিরও জন্ম গ্রিক প্রভাবের ফলে৷
সীমান্তের দেশগুলিতে বাস করত তখন কেবল ভারতের লোক নয়, বাইরেকার নানান জাতি৷ একদিক থেকে আসত চীনের বাসিন্দারা আর একদিক থেকে আসত মধ্য-এশিয়ার শক ও হুন প্রভৃতি যাযাবর জাতিরা এবং আর-এক দিক থেকে আসত পারসি ও গ্রিক প্রভৃতি আর্যরা৷ এমনই নানা ধর্মের নানা জাতির লোকের সঙ্গে মেলামেশা করার ফলে সীমান্তবাসী বহু ভারতীয়ের মনের ভাব হয়ে উঠেছিল অনেকটা সার্বজনীন৷ এ-অবস্থায় দেশাত্মবোধের ও হিন্দুত্বের ভাবও অনেকটা কমজোরি হয়ে পড়াই স্বাভাবিক৷ হয়তো সেই কারণেই সীমান্তপ্রদেশ আজ হিন্দুর সংখ্যা এত অল্প৷
তোমরা শুনলে অবাক হবে, সে-যুগেও ভারতে বিশ্বাসঘাতকের অভাব হয়নি৷ এ-লোকটি আগে ছিল পারসিদের মাহিনা-করা সৈনিক, পরে হয় আলেকজান্ডারের বিশ্বস্ত এক হিন্দু সেনাপতি৷ এর নাম শশীগুপ্ত, গ্রিকরা ডাকত সিসিকোটস বলে৷ গ্রিকদের সঙ্গে সেও ভারতের বিরুদ্ধে তরবারি ধারণ করে এবং সেও ছিল উত্তর-ভারতের বাসিন্দা৷ আলেকজান্ডারের ভারত আগমনের পরে সীমান্তের আরও বহু বিশ্বাসঘাতক হিন্দু গ্রিকবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল বা দিতে বাধ্য হয়েছিল৷
সে-যুগে সীমান্তের একটি বিখ্যাত রাজ্য ছিল তক্ষশীলা৷ বর্তমান রাওয়ালপিন্ডি শহর থেকে বিশ-বাইশ মাইল দূরে আজও প্রাচীন তক্ষশীলার ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়৷ কিন্তু এই ধ্বংসাবশেষ দেখে অভিভূত হলেও তক্ষশীলার অতীত গৌরবের কাহিনি আমরা কিছুই অনুমান কতে পারব না৷ কারণ প্রাচীন প্রাচ্য জগতে তক্ষশীলা ছিল অন্যতম প্রধান নগর৷ জাতকের মতে, তক্ষশীলা হচ্ছে গান্ধার রাজ্যের অন্তর্গত শহর, ‘মহাভারতে’র রাজা ধৃতরাষ্ট্রের মহিষী ও দুর্যোধনের মাতা গান্ধারী এই দেশেরই মেয়ে৷ বর্তমান পেশোয়ারও ওই গান্ধারেরই আর একটি স্থান, কিন্তু তখন তার নাম ছিল ‘পুরুষপুর’৷ ওখানকার লোকদের দেহ ছিল যে সত্যিকার পুরুষের মতো, আজও পেশোয়ারিদের দেখলে সেটা অনুমান করা যায়৷
তক্ষশীলা জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার জন্যও অত্যন্ত খ্যাতি অর্জন করেছিল৷ প্রাচীন ভারতের অন্যতম শিক্ষাকেন্দ্র বারাণসীও নানা বিদ্যার জন্যে তক্ষশীলার কাছে ঋণী৷ বিশেষ করে চিকিৎসাবিদ্যা শেখবার জন্যে তক্ষশীলায় তখন সারা ভারতের ছাত্রদের গমন করতে হত৷ পাটনা বা পাটলিপুত্রের রাজা বিম্বিসারের সভা-চিকিৎসক জীবককে শিক্ষালাভের জন্যে তক্ষশীলায় সাত বৎসর বাস করতে হয়েছিল৷ পরে সম্রাট কণিষ্কের যুগে তক্ষশীলার আরও উন্নতি হয়, কারণ পুরুষপুরেই ছিল কণিষ্কের রাজধানী৷ প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি শকবংশীয় বৌদ্ধ ভারতসম্রাট কণিষ্ক পুরুষপুরে একটি অপূর্ব মন্দির প্রতিষ্ঠিত করেন, প্রাচীন জগতে যা পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য বলে গণ্য হত৷ মন্দিরটি কাঠের৷ তেরো তলা৷ এবং উচ্চতায় চারিশত ফুট-অর্থাৎ কলকাতার মনুমেন্টের চেয়ে কিছু কম তিনগুণ বেশি লম্বা৷ দ্বিতীয় শতাব্দীতে নির্মিত সে মন্দির এখন আর নেই, গজনির মুসলমান দিগ্বিজয়ী মামুদ তাকে ধ্বংস করেছিলেন৷
তক্ষশীলার কাছেই ছিল রাজা হস্তীর রাজ্য৷ পরের পরিচ্ছেদে গল্প শুরু হলেই তোমরা এঁর কথা শুনবে৷
আলেকজান্ডার যখন ভারতে পদার্পণ করেন, সেই সময়ে দুই প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে তক্ষশীলার যুদ্ধ চলছিল৷ তার একটি হচ্ছে ক্ষুদ্র পার্বত্য রাজ্য, নাম ‘অভিসার’ (আজও এর সঠিক অবস্থানের কথা আবিষ্কৃত হয়নি)৷ আর একটি হচ্ছে অপেক্ষাকৃত বৃহৎ রাজ্য, ইতিহাস-বিখ্যাত পুরু ছিলেন তার রাজা৷ ঝিলম ও চিনাব নদের মধ্যবর্তী স্থলে ছিল পুরুর রাজ্য বিস্তৃত এবং তার নগরের সংখ্যা ছিল তিন শত৷ সুতরাং বোঝা যায় পুরু বড়ো তুচ্ছ রাজা ছিলেন না৷ তাঁর সৈন্যসংখ্যাও ছিল পঞ্চাশ হাজার৷
কিন্তু সীমান্তে এখনকার মতন তখনও পার্বত্য খণ্ডরাজ্য ছিল অনেক৷ গ্রিকদের বিবরণীতে বহু দেশের নাম পাওয়া যায়, কিন্তু তাঁরা ভারতীয় নাম আয়ত্তে আনতে পারতেন না বলে বিকৃত করে লিখতেন৷ এই দেখো না, চন্দ্রগুপ্তকে তাঁরা বলতেন, স্যান্ড্রাকোটস! কাজেই গ্রিকদের পুঁথিপত্রে সীমান্তের অধিকাংশ দেশের নাম পড়ে আজ আর কিছু ধরবার উপায় নেই, বিশেষ একে-তো সেইসব খণ্ডরাজ্যের অনেকগুলিই পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে, তার উপরে বাকি যাদের অস্তিত্ব আছে, মুসলমান ধর্ম অবলম্বন করে তারাও আপনাদের নূতন নূতন নাম রেখেছে-যেমন ‘পুরুষপুর’ হয়েছে ‘পেশোয়ার’৷ কোনো কোনো গ্রিক নামের সঙ্গে আবার আসল নামের কিছুই সম্পর্ক নেই৷ যেমন ঝিলম নদ গ্রিকদের পাল্লায় পড়ে হয়েছে Hydaspes এবং চিনাব নদ হয়েছে Akesines!
যাক, নাম নিয়ে বড়ো আসে-যায় না৷ কারণ নাম বা রাজ্য লুপ্ত হোক, সীমান্তের দেশগুলি আগেও যেমন ছিল এখনও আছে অবিকল তেমনি৷ উপরন্তু সেখানকার জড় পাহাড় ও পাথরের মতোই জ্যান্ত মানুষগুলিরও ধাত একটুও বদলায়নি! আজও তাদের কাছে জীবনের সবচেয়ে বড়ো আমোদ হচ্ছে মারামারি, খুনোখুনি, যুদ্ধবিগ্রহ৷ যখন বাইরের শত্রু পাওয়া যায় না, তখন তারা নিজেদের মধ্যেই দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধিয়ে দেয়৷ প্রথম বয়সে আমি ও-অঞ্চলে বৎসর খানেক বাস করেছিলাম৷ সেই সময়েই প্রমাণ পেয়েছিলাম, মানুষের প্রাণকে তারা নদীর জলের চেয়ে মূল্যবান বলে ভাবে না৷ বর্তমান পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি ব্রিটিশরাজ পর্যন্ত তাদের অত্যাচারে সর্বদাই তটস্থ, সর্বদাই বাপু-বাছা বলে ও মোটা টাকা ভাতা দিয়ে তাদের মাথা ঠান্ডা রাখবার চেষ্টায় থাকেন৷ কারণ উড়োজাহাজের বোমা, মেশিনগানের গোলা ও ব্রিটিশসিংহের গর্জন এদের কোনোটিই তাদের যুদ্ধ-উন্মাদনাকে শান্ত করতে পারে না৷ মরণখেলা তারা খেলবেই এবং মরতে মরতে মারবেই৷
আলেকজান্ডারের যুগে তারা মুসলমান ছিল না, হয়তো আর্য ও সভ্যও ছিল না, কিন্তু হিন্দুই ছিল বলে মনে করি৷ এবং তাদের শৌর্য-বীর্য ছিল এখনকার মতোই ভয়ানক! ভারতের বিপুল সিংহদ্বারের সামনে এই নির্ভীক, যুদ্ধপ্রিয় দৌবারিকদের দেখে গ্রিক দিগ্বিজয়ীকে যথেষ্ট দুর্ভাবনায় পড়তে হয়েছিল৷ এদের পিছনে রেখে ভারতবর্ষের বুকের ভিতরে প্রবেশ করা আর আত্মহত্যা করা যে একই কথা, সেটা বুঝতে তাঁর মতো নিপুণ সেনাপতির বিলম্ব হয়নি৷ তাই ভারত-বিজয়ের স্বপ্ন ভুলে বিরাট বাহিনী নিয়ে সর্বাগ্রে তাঁকে এদেরই আক্রমণ করতে হয়েছিল এবং তখনকার মতো এদের ঢিঢ করবার জন্যে তাঁর কেটে গিয়েছিল বহুকাল৷
যে রঙ্গমঞ্চের উপরে অতঃপর আমাদের মহানাটকের অভিনয় আরম্ভ হবে, তার পৃষ্ঠপটের একটি রেখাচিত্র এখানে এঁকে রাখলাম৷ এটি তোমরা স্মরণ করে রেখো৷ শত শত যুগ ধরে এই পৃষ্ঠপটের সুমুখ দিয়ে এসেছে দিগ্বিজয়ের স্বপ্ন দেখে, দেশ লুন্ঠনের আকাঙ্খা নিয়ে, অথবা সোনার ভারতে স্থায়ী ঘর বাঁধবে বলে পঙ্গপালের মতো লক্ষ লক্ষ বিদেশি৷ তাদের দৌরাত্ম্যে আজ সোনার ভারতের নামমাত্র অবশিষ্ট আছে, কিন্তু এখানে আর সোনা পাওয়া যায় না৷
তোমরা গল্প শোনবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছ?
মনে আছে, ভারতপুত্র সুবন্ধু ফিরে আসছে আবার তার পিতৃভূমিতে,-দুই চক্ষে তার উন্মত্ত উত্তেজনা, দুই চরণে তার কালবৈশাখীর প্রচণ্ড গতি?
তারপর সুবন্ধু কিনেছে একটি ঘোড়া, কিন্তু পথশ্রমে ও দ্রুতগতির জন্যে সে মারা পড়ল৷ দ্বিতীয় ঘোড়া কিনলে, তারও সেই দশা হল৷ কিন্তু তার তৃতীয় অশ্ব মাটির উপর দিয়ে যেন উড়ে আসছে পক্ষীরাজের মতো!
বহুযুগের ওপার থেকে তার ঘোড়ার পদশব্দ তোমরা শুনতে পাচ্ছ?
সুবন্ধু এসে হাজির হয়েছে ভারতের দ্বারে৷ কিন্তু তখনও কারুর ঘুম ভাঙেনি৷ . . . জাগো ভারত! জাগো পঞ্চনদের তীর!
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – রাজার ঘোড়া
তক্ষশীলার অদূরে মহারাজা হস্তীর রাজ্য৷ মহারাজা হস্তীর নাম গ্রিকদের ইতিহাসে স্থান পেয়েছে, কিন্তু তাঁর রাজধানীর নাম অতীতের গর্ভে হয়েছে বিলুপ্ত৷
তবু তাঁর রাজধানীকে আমার চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি৷ কাছে, দূরে পাহাড়ের পর পাহাড় এবং গিরিনদীর বুকে বুকে নাচছে গাছের শ্যামল ছায়া, আকাশের প্রগাঢ় নীলিমা৷ এক-একটি পাহাড়ের শিখরের উপরেও আকাশ-ছোঁয়া মাথা তুলে আছে সুরক্ষিত গিরিদুর্গ- তাদের চক্ষুহীন নির্বাক পাথরে পাথরে জাগছে যেন ভয়ানকের ভ্রূভঙ্গ!
রাজধানীর বাড়িঘর কাঠের৷ সেকালে ভারতবাসীরা পাথর বা ইট ব্যবহার করত বড়োজোর বনিয়াদ গড়বার জন্যে৷ অনেক কাঠের বাড়ি তিন-চার-পাঁচ তলা কি আরও বেশি উঁচু হত৷ কাঠের দেয়ালে দরজায় থাকত চোখ-জুড়ানো কারুকার্য৷ কিন্তু সে-সব কারুকার্য বর্তমানের বা ভবিষ্যতের চোখ আর দেখবে না, কারণ কাঠের পরমায়ু বেশি নয়৷ তবে পরে ভারত যখন পাথরের ঘরবাড়ি তৈরি করতে লাগল, তখনকার শিল্পীরা আগেকার কাঠের-খোদাই কারুকার্যকেই সামনে রাখল আদর্শের মতো৷ ওইসব পুরোনো মন্দিরের কতকগুলি আজও বর্তমান আছে৷ তাদের দেখে তোমরা খ্রিস্টপূর্ব যুগের ভারতীয় কাঠের বাড়ির সৌন্দর্য কতকটা অনুমান করতে পারবে৷ ভারতের প্রতিবেশী ব্রহ্ম ও চীন প্রভৃতি দেশ কাঠের ঘরবাড়ি মন্দির গড়ে আজও প্রাচীন প্রাচ্য সভ্যতার সেই চিরাচরিত রীতির সম্মান রক্ষা করছে৷
খ্রিস্ট জন্মাবার আগে তিনশো সাতাশ অব্দের জুন মাসের একটি সুন্দর প্রভাত৷ শীত-কুয়াশার মৃত্যু হয়েছে৷ চারিদিক শান্ত সূর্যকরে সমুজ্জ্বল৷ শহরের পথে পথে নাগরিকদের জনতা৷ তখন পৃথিবীর কোথাও কেউ পর্দা প্রথার নাম শোনেনি, তাই জনতার মধ্যে নারীর সংখ্যাও অল্প নয়৷ নারী ও পুরুষ উভয়েরই দেহ সুদীর্ঘ, বর্ণ গৌর, পরনে জামা, উত্তরীয়, পাজামা৷ দুর্বল ও খর্ব চেহারা চোখে পড়ে না বললেই হয়৷
চারিদিকে নবজাগ্রত জীবনের লক্ষণ৷ দোকানে-বাজারে পসারি ও ক্রেতাদের কোলাহল, জনতার আনাগোনা, নদীর ঘাটে স্নানার্থীদের ভিড়, দলে দলে মেয়ে জল তুলে কলসি মাথায় নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসছে, পথ দিয়ে রাজভৃত্য দামামা বাজিয়ে নূতন রাজাদেশ প্রচার করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে, স্থানে স্থানে এক-এক দল লোক দাঁড়িয়ে তাই নিয়ে আলোচনা করছে এবং অনেক বাড়ির ভিতর থেকে শোনা যাচ্ছে বৈদিক মন্ত্রপাঠের গম্ভীর ধ্বনি৷
নগর-তোরণে দুজন প্রহরী অভিসার ও তক্ষশীলা রাজ্যের নূতন যুদ্ধের ব্যাপার নিয়ে গল্প করছে এবং অনেকগুলি নাগরিক তাই শোনবার জন্যে তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে৷
প্রথম প্রহরী বলছে, ‘তক্ষশীলার বুড়ো রাজার ভীমরতি হয়েছে৷’
দ্বিতীয় প্রহরী বলল, ‘কেন?’
‘এই সেদিন মহারাজ পুরুর কাছে তক্ষশীলার সৈন্যেরা কী মার খেয়ে পালিয়ে এল, কিন্তু বুড়ো রাজার লজ্জা নেই, আবার এরই মধ্যে অভিসারের রাজার সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়েছে, সেদিন নাকি একটা মস্ত লড়াইও হয়ে গেছে৷’
‘লড়াইয়ে কী হল?’
‘পাকা খবর এখনও পাইনি৷ কিন্তু যুদ্ধে যে-পক্ষই জিতুক, দুই রাজ্যেরই হাজার হাজার লোক মরবে, ঘরে ঘরে কান্না উঠবে, জিনিসপত্তরের দাম চড়বে৷’
একজন মুরুব্বিগোছের নাগরিক বলল, ‘রাজাদের হবে খেয়াল, মরবে কিন্তু প্রজারা!’
প্রহরী বলল, ‘কিন্তু সব রাজা সমান নয়, মহারাজা হস্তীর রাজত্বে আমরা পরম সুখে আছি! আমাদের মহারাজা মস্ত যোদ্ধা, কিন্তু তিনি কখনো অন্যায় যুদ্ধ করেন না!’
নাগরিক সায় দিয়ে বলল, ‘সত্য কথা৷ মহারাজা হস্তী অমর হোন!’
ঠিক সেই সময় দেখা গেল, মূর্তিমান ঝড়ের মতো চারিদিকে ধুলো উড়িয়ে ছুটে আসছে এক মহাবেগবান ঘোড়া এবং তার পিঠে বসে আছে যে সওয়ার, ডানহাতে জ্বলন্ত তরবারি তুলে শূন্যে আন্দোলন করতে করতে চিৎকার করছে সে তীব্র স্বরে!
নগর-তোরণে সমবেত জনতার মধ্যে নানা কন্ঠে বিস্ময়ের প্রশ্ন জাগল :
‘কে ও? কে ও?’-‘ও তো দেখছি ভারতবাসী! কিন্তু অত চেঁচিয়ে ও কী বলছে?’- ‘পাগলের মতো লোকটা তরোয়াল ঘোরাচ্ছে কেন?’
অশ্বারোহী কাছে এসে পড়ল-তার চিৎকারের অর্থও স্পষ্ট হল৷
সে বলছে-‘জাগো! জাগো! শত্রু শিয়রে! অস্ত্র ধরো, অস্ত্র ধরো!’
একজন প্রহরী সবিস্ময়ে বললে, ‘কে শত্রু? তক্ষশীলার বুড়ো রাজা আমাদের আক্রমণ করতে আসছে নাকি?’
নগর-তোরণে এসেই অশ্বারোহী ঘোড়া থেকে লাফিয়ে পড়ে উত্তেজিত সুরে বলে উঠল, ‘আমাকে মহারাজা হস্তীর কাছে নিয়ে চলো!’
প্রহরী মাথা নেড়ে বললে, ‘সে হয় না৷ আগে বলো কে তুমি, কোথা থেকে আসছ?’
গম্ভীর স্বরে সুবন্ধু বলল, ‘আমি ভারতসন্তান সুবন্ধু৷ আসছি হিন্দুকুশ ভেদ করে শত শত গিরি নদী অরণ্য পার হয়ে!’
‘কী প্রয়োজনে?’
সুবন্ধুর বিরক্ত দুই চোখে জাগল অগ্নি৷ অধীর স্বরে বললে, ‘প্রয়োজন? ওরে ঘুমন্ত, ওরে অজ্ঞান, যবন আলেকজান্ডার মহাবন্যার মতো ধেয়ে আসছে হিন্দুস্থানের দিকে, তার লক্ষ লক্ষ সৈন্য রক্তগঙ্গার তরঙ্গে ভাসিয়ে দেবে আর্যাবর্তকে, এখন কি তোমাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করবার সময় আছে? নিয়ে চলো আমাকে মহারাজের কাছে! শত্রু ভারতের দ্বারে উপস্থিত, প্রত্যেক মুহূর্ত এখন মূল্যবান৷’
মন্ত্রণাগার! রাজা হস্তী সিংহাসনে৷ অপূর্ব তাঁর দেহ-দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে যথার্থ পুরুষোচিত৷ ধবধবে গৌরবর্ণ, প্রশস্ত ললাট, আয়ত চক্ষু, দীর্ঘ নাসিকা, দৃঢ়-সংবদ্ধ ওষ্ঠাধর, কবাট বক্ষ, সিংহ-কটি, আজানুলম্বিত বাহু৷ তাঁকে দেখলেই মহাভারতে বর্ণিত মহাবীরদের মূর্তি মনে পড়ে৷
রাজার ডানপাশে মন্ত্রী, বাঁ-পাশে সেনাপতি, সামনে কক্ষতলে হাত জোড় করে জানু পেতে উপবিষ্ট সুবন্ধু-সর্বাঙ্গ তার পথধূলায় ধূসরিত৷
রাজার কপালে চিন্তার রেখা, যুগ্ম ভুরু সংকুচিত৷ সুবন্ধুর বার্তা তিনি শুনে অনেকক্ষণ মৌনব্রত অবলম্বন করে রইলেন৷ তারপর ধীর গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কোন পথ দিয়ে ভারতে এসেছ?’
‘খাইবার গিরিসংকট দিয়ে৷’
‘যবন সৈন্য কোন পথ দিয়ে আসছে?’
‘কাবুল নদের পার্শ্ববর্তী উপত্যকা দিয়ে৷ কিন্তু তারা এখন আর আসছে না মহারাজ, এতক্ষণে এসে পড়েছে৷’
‘তুমি আর কী কী সংবাদ সংগ্রহ করেছ, বিস্তৃত ভাবে বলো৷’
সুবন্ধু বলতে লাগল, ‘মহারাজ, নিবেদন করি! আলেকজান্ডার তাঁর দুজন বড়ো বড়ো সেনাপতিকে সিন্ধুনদের দিকে যাত্রা করবার হুকুম দিয়েছেন৷ তাঁদের নাম হেফাইসমান আর পার্ডিক্কাস৷ এই খবর নিয়ে প্রথমে আমি মহারাজার কাছে যাই৷ কিন্তু বলতেও লজ্জা করে, তক্ষশীলার মহারাজার মুখ এই দুঃসংবাদ শুনে প্রসন্ন হয়ে উঠল৷ তিনি বললেন, যবন আলেকজান্ডার আমার শত্রু নন, আমি আজকেই বন্ধু রূপে তাঁর কাছে দূত পাঠাব৷ তিনি এসে স্বদেশি শত্রুদের কবল থেকে আমাকে উদ্ধার করবেন৷ আমি বললাম, ‘সে কী মহারাজ, আলেকজান্ডার যে ভারতের শত্রু!’ তিনি অম্লানবদনে বললেন, ভারতে নিত্য শত শত বিদেশি আসছে, আলেকজান্ডারও আসুন, ক্ষতি কী? যে তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলবে, তিনি হবেন কেবল তারই শত্রু৷ তবে তাঁকে দেশের শত্রু বলব কেন? আর ভারতের কথা বলছ? ভারত কি আমার একলার? বিশাল ভারতে আছে হাজার হাজার রাজা, সুযোগ পেলেই তারা আমার রাজ্য লুট করতে আসবে, তাদের জন্যে আমি একলা প্রাণ দিতে যাব কেন? যাও সুবন্ধু, এখনই তক্ষশীলা ছেড়ে চলে যাও, নইলে আমার বন্ধু, সম্রাট আলেকজান্ডারের শত্রু বলে তোমাকে বন্দি করব৷’ আমি আর কিছু না বলে একেবারে আপনার রাজ্যে উপস্থিত হয়েছি৷ এখন আপনার অভিমত কী মহারাজ?’
হস্তী একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, ‘আমার অভিমত? যথাসময়ে শুনতে পাবে৷ মন্ত্রীমহাশয়, আলেকজান্ডার যে পারস্য জয় করে দিগ্বিজয়ে বেরিয়েছেন, সে খবর আমরা আগেই পেয়েছিলাম৷ কিন্তু তাঁর সেনাপতিরা যে এত শীঘ্র ভারতে প্রবেশ করেছেন, এ খবর আপনি রাখেননি কেন? আমার রাজ্যে কি গুপ্তচর নেই?’
মন্ত্রী লজ্জিত স্বরে বললেন, ‘মহারাজ, একচক্ষু হরিণের মতো আমাদের দৃষ্টি সজাগ হয়ে ছিল কেবল খাইবার গিরিসংকটের দিকেই, কারণ বহিঃ শত্রুরা ওই পথেই ভারতে প্রবেশ করে৷ যবন সৈন্যরা যে নতুন পথ দিয়ে ভারতে আসবে, এটা আমরা কল্পনা করতে পারিনি!’
হস্তী বিরক্তস্বরে বললেন, ‘এ অন্যমনস্কতা অমার্জনীয়৷ আচ্ছা সুবন্ধু, তুমি বললে আলেকজান্ডার তাঁর দুই সেনাপতিকে এদিকে পাঠিয়েছেন৷ কিন্তু তিনি নিজে এখন কোথায়?’
‘মহারাজ, আলোকজান্ডার নিজে তাঁর প্রধান বাহিনী নিয়ে সীমান্তের পার্বত্য রাজাদের দমন করতে গিয়েছেন৷’
‘হুঁ! দেখছি এই যবনসম্রাট রণনীতিতে অত্যন্ত দক্ষ৷ এরই মধ্যে সীমান্তের পার্বত্য রাজাদের মতিগতি তিনি বুঝে নিয়েছেন! এই যুদ্ধপ্রিয় বীরদের পিছনে রেখে ভারতে ঢুকলে যে সর্বনাশের সম্ভাবনা এ সত্য তিনি জানেন৷’
সেনাপতি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সুবন্ধু, যবনসম্রাটের অধীনে কত সৈন্য আছে?’
‘কেউ বলছে এক লক্ষ, কেউ বলছে লক্ষাধিক৷ আমার মতে, অন্তত দেড় লক্ষ৷ কারণ পথে আসতে আসতে আলেকজান্ডার অসংখ্য পেশাদার সৈন্য সংগ্রহ করেছেন৷’
হস্তী বললেন, ‘কিন্তু বিদেশি যবনরা ভারতে ঢুকবার নতুন পথের সন্ধান জানল কেমন করে?’
সুবন্ধু তিক্তস্বরে বলল, ‘ভারতের এক কুসন্তান পিতৃভূমির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে যবনদের পথ দেখিয়ে আনছে৷ নাম তার শশীগুপ্ত, সে নাকি আলেকজান্ডারের বিশ্বস্ত এক সেনাপতি৷ মহারাজ, এই শশীগুপ্তের সঙ্গে রণস্থলে একবার মুখোমুখি দেখা করব, এই হল আমার উচ্চাকাঙ্খা! আর্যাবর্তের শত্রু আর্য! এ কল্পনাতীত!’ বলতে বলেত তার বলিষ্ঠ ও বৃহৎ দেহ রুদ্ধ ক্রোধে যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠল৷
হস্তী একটু হেসে বললেন, ‘শান্ত হও সুবন্ধু, শশীগুপ্ত এখন তোমার সামনে নেই৷ মন্ত্রীমহাশয়, এখন আমাদের কর্তব্য কী? শিয়রে শত্রু, এখনও আমরা ঘুমাব, না জাগব? হাত জোড় করব, না তরবারি ধরব? গলবস্ত্র হব, না বর্ম পরব? আপনি কী বলেন?’
বৃদ্ধ মন্ত্রী মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘দেড় লক্ষ যবন-সৈন্যের সামনে আমাদের পঁচিশ-ত্রিশ হাজার সৈন্য কতক্ষণ দাঁড়াতে পারবে মহারাজ? ঝড়ের মুখে একখণ্ড তুলোর মতো উড়ে যাবে!’
সুবন্ধু বলল, ‘মন্ত্রীমহাশয়, বৃশ্চিক হচ্ছে ক্ষুদ্র জীব, কিন্তু বৃহৎ মানুষ তাকেও ভয় করে৷ ক্ষুদ্র হলেই কেউ তুচ্ছ হয় না৷’
মন্ত্রী হেসে বললেন, ‘যুবক তোমার উপমা ঠিক হল না৷ মানুষ বৃশ্চিককে ভয় করলেও এক চপেটাঘাতে তাকে হত্যা করতে পারে৷’
সুবন্ধু বললে, ‘মানলাম৷ কিন্তু আলেকজান্ডারের মূল বাহিনী এখানে আসতে এখনও অনেক দেরি আছে৷ তাঁর দুই সেনাপতির অধীনে বোধ হয় পঞ্চাশ হাজারের বেশি সৈন্য নেই৷’
‘যুবক, তুমি কেবল বর্তমানকে দেখছ, ভবিষ্যৎ তোমার দৃষ্টির বাইরে! আজ আমরা অস্ত্র ধরব, কিন্তু কাল যখন যবনসম্রাট নিজে আসবেন সসৈন্যে, তখন আমরা কী করব?’
সুবন্ধু বলল, ‘আপনার মতো বিজ্ঞতা আমার নেই বটে, কিন্তু ভবিষ্যৎকে আমি ভুলিনি মন্ত্রী-মহাশয়! ভারতে আসবার পথের উপরেই আছে আপনাদের গিরিদুর্গ৷ সেই গিরিদুর্গে গিয়ে আপনারা যবন-সেনাপতিদের পথরোধ করুন৷ যদি দু-মাস দুর্গ রক্ষা করতে পারেন, যবনসম্রাট স্বয়ং এলেও আপনাদের ভয় নেই৷’
‘কেন?’
‘ইতিমধ্যে আমি আমার দেশে-মহারাজা পুরুর রাজ্যে ফিরে যাব৷ আমাদের মহাবীর মহারাজকে কে না জানে? তাঁর কাছ থেকে তক্ষশীলার কাপুরুষতা দুঃস্বপ্নেও কেউ প্রত্যাশা করে না৷ তাঁর জীবনের সাধনাই হচ্ছে বীরধর্ম৷ যবনরা আর্যাবর্তে ঢুকতে উদ্যত শুনলেই তিনি ক্রুদ্ধ সিংহের মতো গর্জন করে এখানে ছুটে আসবেন! তার উপরে অভিসার রাজ্যের শত্রু তক্ষশীলা যখন যবনদের পক্ষ অবলম্বন করবে, অভিসারের রাজা তখন নিশ্চয়ই থাকবে আপনাদের পক্ষে৷’
মন্ত্রী জবাব দিলেন না, হতাশভাবে ক্রমাগত মাথা নাড়তে লাগলেন৷
হস্তী আবার একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘সুবন্ধু, আমাকে ভাবতে সময় দাও-কারণ এ হচ্ছে জীবন-মরণের প্রশ্ন! যবনরা প্রবল, আমরা দুর্বল৷ তুমি তিন দিন বিশ্রাম করো, আমি ইতিমধ্যে সমস্ত সংবাদ সংগ্রহ করি!’
কিন্তু তিন দিন পরে সুবন্ধুর কাছে মহারাজা হস্তীকে মতামত প্রকাশ করতে হল না৷
চতুর্থ দিনের প্রভাতে মহারাজা যখন রাজকার্যে ব্যস্ত, রাজসভার মধ্যে হল গ্রিকদের এক ভারতীয় দূতের আবির্ভাব৷
মহারাজা হস্তী দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে মুখ তুললেন৷ প্রশস্ত ললাট চিহ্নিত হল চিন্তার রেখায়৷ কিন্তু সংকুচিত ধনুকের মতো যুগ্ম ভুরুর তলায় চক্ষে যেন জাগল তীক্ষ্ণ অগ্নিবাণ-মুহূর্তের জন্যে৷ তারপরেই মৃদুহাস্য করে বললেন, ‘কী সংবাদ, দূত?’
‘সমগ্র গ্রিস ও পারস্যের সম্রাট আলেকজান্ডার এসেছেন অতিথিরূপে ভারতবর্ষে৷ আপনি কি তাঁকে অভ্যর্থনা করতে প্রস্তুত আছেন?’
‘দূত, তুমি হিন্দু৷ তুমি তো জানো, অতিথিকে অভ্যর্থনা করা হিন্দুর ধর্ম!’
‘এ-কথা শুনলে সম্রাট আলেকজান্ডার আনন্দিত হবেন৷ তাহলে মিত্ররূপে আপনি তাঁকে সাহায্য করবেন?’
‘কী সাহায্য, বলো!’
‘সম্রাট আলেকজান্ডার বেরিয়েছেন দিগ্বিজয়ে৷ সৈন্য আর অর্থ দিয়ে আপনাকে তাঁর বন্ধুত্ব ক্রয় করতে হবে৷’
‘সম্রাট আলেকজান্ডার আমাদের স্বদেশে এসেছেন দিগ্বিজয়ে৷ ভারতের বিরুদ্ধে আমার ভারতীয় সৈন্যরা অস্ত্রধারণ করবে, এই কি তাঁর ইচ্ছা?’
‘আজ্ঞে হাঁ মহারাজ! সম্রাটের আর একটি ইচ্ছা এই যে, সুবন্ধু নামে গ্রিকদের এক শত্রু আপনার রাজ্যে আশ্রয় পেয়েছে৷ তাকে অবিলম্বে বন্দি করে আমার হাতে অর্পণ করতে হবে৷’
মহারাজা হস্তী ফিরে সুবন্ধুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যুবক, এই দূতের সঙ্গে তুমি কি গ্রিকশিবিরে বেড়াতে যেতে চাও?’
সুবন্ধু অভিবাদন করে বলল, ‘আপনি আদেশ দিলে শিরোধার্য করব! কিন্তু দূতকে বহন করে নিয়ে যেতে হবে আমার মৃতদেহ৷’
‘দূত, তুমি কি সুবন্ধুর মৃতদেহ বহন করে নিয়ে যেতে পারবে? দেখছ, সুবন্ধুর দেহ ক্ষুদ্র নয়, আমারই মতো বৃহৎ! আমার মতে, পতঙ্গের উচিত নয় যে মাতঙ্গকে বহন করতে যাওয়া৷ পারবে না, কেবল হাস্যাস্পদ হবে৷’
‘আপনার একথা থেকে কি বুঝব, আপনি সম্রাট আলেকজান্ডারকে অতিথিরূপে অভ্যর্থনা করতে প্রস্তুত নন?’
দূতের কথার জবাব না দিয়ে মহারাজা হস্তী বাঁ-পাশে ফিরে তাকালেন৷ সেনাপতি নিজের কোষবদ্ধ তরবারি নিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে নাড়াচাড়া করছেন৷ হাসতে হাসতে মহারাজা বললেন, ‘কী দেখছ সেনাপতি? অনেক দিন যুদ্ধ করনি, তোমার তরবারিতে কি মরচে পড়ে গেছে?’
‘না মহারাজ, মরচে-পড়া অসুখ আমার তরবারির কোনোদিন হয়নি!’
‘তবে?’
‘তরবারি নাড়লে-চাড়লে সংগীতের সৃষ্টি হয়৷ তাই আমি তরবারি নাড়াচাড়া করছিলাম৷’
‘বেশ করছিলে৷ অনেকদিন আমি তরবারির গান শুনিনি৷ শোনাতে পারবে?’
‘আদেশ দিন মহারাজ!’
হস্তী আচম্বিতে সিংহাসন ত্যাগ করে দাঁড়িয়ে উঠলেন৷ চোখের নিমিষে নিজের খাপ থেকে তরোয়াল খুলে শূন্যে তুলে জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, ‘শোনাও তবে মুক্ত তরবারির রক্তরাগিণী-নাচাও তবে জীবনের বুকে মৃত্যুর ছন্দ! প্রাচীন আর্যাবর্তে এ রাগিণীর ছন্দ নূতন নয়-ভীম, অর্জু ন, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ কত বীর কতবার ধনুকের টংকারে অসির ঝংকারে এই অপূর্ব সংগীতের সাধনা করে গেছেন, ভারত যে যুগযুগান্তরেও তাঁদের সাধনা ভুলবে না-‘
বৃদ্ধ মন্ত্রী বাধা দিয়ে হতাশভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘মহারাজ-মহারাজ-‘
বাধা দিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে হস্তী বললেন, ‘থামুন মন্ত্রীমহাশয়! তরবারি যেখানে গান গায় বৃদ্ধের স্থান সেখানে নয়! সেনাপতি, ডাক দাও তোমার দেশের ঘরে ঘরে দুরন্ত বেপরোয়া বাঁধনখোলা যৌবনকে, গগনভেদী অট্টহাসির মধ্যে লুপ্ত হয়ে যাক হিসেবি বিজ্ঞতার বাণী!’
দূত বলল ‘মহারাজ, উত্তর!’
হস্তীর চক্ষে আবার জাগ্রত অগ্নি৷ বজ্রকন্ঠে তিনি বললেন, ‘উত্তর চাও, দূত? কাকে উত্তর দেব? যবনসম্রাট অতিথি হলে আমি তাঁর প্রশ্নের উত্তর মুখেই দিতাম, কিন্তু তিনি এসেছেন দস্যুর মতো ভারতের স্বর্ণভাণ্ডার লুন্ঠন করতে৷ দস্যুর উত্তর থাকে তরবারির সংগীতে! যাও!’
পরদিনের প্রভাতসূর্যও পৃথিবীর বুকে বহিয়ে দিয়েছেন স্বর্ণরশ্মির বিপুল বন্যা৷ সূর্য হচ্ছেন আর্যাবর্তের দেবতা৷ আজও ভারত তাঁর স্তবের মন্ত্র ভোলেনি৷
মহারাজা হস্তীর রাজ্যে সেদিন প্রভাতে কিন্তু স্তব জেগেছিল রণদেবতার৷ গম-গমা-গম বাজছে ভেরি, ভোঁ-ভোঁ-ভোঁ বাজছে তুরি, আর বাজছে অসি ঝন-ঝনা-ঝন! সূর্যকরে জ্বলন্ত বর্ম পরে সশস্ত্র ভারতবীরবৃন্দ রাজপথে চরণতাল বাজিয়ে অগ্রসর হয়েছে, গৃহে গৃহে ছাদে ছাদে, বাতায়নে, অলিন্দে দাঁড়িয়ে ভারতের বীরনারীরা লাজাঞ্জলি বৃষ্টি করতে করতে সানন্দে দিচ্ছেন উলুধ্বনি, দিচ্ছেন মঙ্গলশঙ্খে ফুৎকার! চলেছে রণহস্তীর শ্রেণি, চলেছে হ্রেষারব তুলে অশ্বদল, চলেছে ঘর্ঘর শব্দে যুদ্ধরথের পর যুদ্ধরথ! স্বাধীন ভারতের সে অপূর্ব উন্মাদনা আজও আমার সর্বাঙ্গে জাগিয়ে তুলছে আনন্দরোমাঞ্চ!
নগরতোরণের বাইরে এসে দাঁড়াল তেজস্বী এক অশ্ব-মহারাজা হস্তীর সাদর উপহার! অশ্বপৃষ্ঠে উপবিষ্ট বলিষ্ঠ এক সৈনিক যুবক-বিপুল পুলকে তার মুখ-চোখ উদ্ভাসিত! সে সুবন্ধু৷
আদর করে অশ্বের গ্রীবায় একটি চাপড় মেরে সুবন্ধু বলল, ‘চলরে রাজার ঘোড়া, বাতাসের আগে উড়ে চল, মহারাজা পুরুর দেশে চল, আমার বাপ-মায়ের কোলে ছুটে চল! আজ বেজেছে এখানে যুদ্ধের বাজনা, কাল জাগবে পঞ্চনদের তীরে তীরে তরবারির চিৎকার! চল রে রাজার ঘোড়া, বিদ্যুৎকে হারিয়ে ছুটে চল-তোর সওয়ার আমি যে নিয়েছি মহাভারতকে জাগাবার ব্রত! আগে সেই ব্রত উদযাপন করি, তারপর তোকে নিয়ে ফিরে আসব আবার সৈনিকের স্বর্গ রণক্ষেত্রে! তারপর ভারতের জন্যে বুকের শেষ রক্তবিন্দু অর্ঘ্য দিয়ে হাসতে হাসতে সেই দেশে চলে যাব-যে-দেশে গিয়েছে ভাগ্যবান বন্ধু চিত্ররথ, যে-দেশে গিয়েছে ভাগ্যবান বন্ধু পুরঞ্জন! চলরে রাজার ঘোড়া, উল্কার মতো ছুটে চল! . . .’
সপ্তম পরিচ্ছেদ – অখণ্ড ভারত-সাম্রাজ্যের স্বপ্ন
ছুটে চলেছে তেজীয়ান ঘোড়া, যেন শরীরী ঝটিকা! পৃষ্ঠে আসীন সুবন্ধু, যেন তীব্র অগ্নিশিখা!
কখনো জনাকীর্ণ নগর, কখনো শান্ত গ্রাম, কখনো রৌদ্রদগ্ধ প্রান্তর, কখনো দুর্গম অরণ্য এবং কখনো বা অসমোচ্চ পার্বত্য প্রদেশের মধ্য দিয়ে, পথ ও বিপথের উপর দিয়ে, সেতুহীন নদীর বুকের ভিতর দিয়ে সুবন্ধুর দুরন্ত ঘোড়া এগিয়ে চলল তুরন্ত গতিতে! দেখতে দেখতে সুদূরের মেঘস্পর্শী তুষারধবল পর্বতমালা দৃষ্টিসীমা থেকে মিলিয়ে গেল ক্ষীণ হতে ক্ষীণতরে স্বপ্নের মতো৷
সুবন্ধু যেতে যেতে লক্ষ করল, ইতিমধ্যেই এ-অঞ্চলের হাটে-মাঠে-বাটে নগরে গ্রামে বিষম উত্তেজনায় সাড়া পড়ে গিয়েছে! অসংখ্য যবন সৈন্য নিয়ে বিদেশি দিগ্বিজয়ী আসছে ভারত-লুন্ঠনে, এ-দুঃসংবাদ এখানকার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে দাবানলের মতো৷
বীরত্ব প্রকাশের নূতন অবসর পাওয়া গেল বলে নগরে নগরে বলিষ্ঠ যুবকরা তরবারি, বর্শা, বাণ ও কুঠার নিয়ে শান দিতে বসেছে বিপুল উৎসাহে; এবং উচ্চকন্ঠে প্রতিজ্ঞা করছে-একাধিক ভারতশত্রুকে বধ না করে তাদের কেউ প্রাণ দেবে না৷
এক জায়গায় হঠাৎ অশ্ব থামিয়ে সুবন্ধু বলে উঠল, ‘না বন্ধু, না৷ তোমরা সকলেই যদি প্রাণ দিতে চাও, তাহলে ভারতের মঙ্গল হবে না৷’
জনৈক যুবক সবিস্ময়ে বলল, ‘দেশের জন্যে আমরা প্রাণ দিতে চাই৷ প্রাণের চেয়ে বড়ো কী আছে মহাশয়?’
সুবন্ধু বলল, ‘পারস্যসম্রাট যখন ভারত আক্রমণ করেছিলেন, তখনও ভারতীয় বীরেরা দলে দলে প্রাণ দিতে পেরেছিল-ভারতে কখনো প্রাণ দেবার জন্যে লোকের অভাব হয়নি৷ কিন্তু তবু পারস্যের কাছে উত্তর-ভারত পরাজিত হয়েছিল! তোমরা অন্য প্রতিজ্ঞা করো৷’
‘কী প্রতিজ্ঞা?’
‘প্রতিজ্ঞা করো, যুদ্ধজয় না করে, গ্রিকদের ভারত থেকে না তাড়িয়ে কেউ রণক্ষেত্র ত্যাগ করবে না৷ ভাই, প্রাণ দেওয়া সোজা, কিন্তু যুদ্ধজয় করা বড়ো কঠিন৷’
সুবন্ধু আবার ঘোড়াকে ছুটিয়ে দিল৷
যেতে যেতে দেখল, বৃদ্ধ শিশু ও নারীর দল নগর ত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলেছে৷ তাদের সঙ্গে সঙ্গে আছে বিলাসী ধনী, কৃপণ ও কাপুরুষের দলও! সুবন্ধুর দুই চক্ষে জাগল ঘৃণাভরা ক্রোধ৷ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মনে মনে বলল, ‘বিলাসী ধনী, কৃপণ, কাপুরুষ! পৃথিবীর অভিশাপ!’
মাঠে মাঠে দেখল, দলে দলে চাষা ফসলভরা খেতের দিতে তাকিয়ে হাহাকারে ভরিয়ে তুলেছে আকাশ-বাতাস!
সুবন্ধুর মন করুণায় বেদনায় ভরে উঠল৷ বলল, ‘হা হতভাগ্য চাষির দল! এদের না আছে অর্থের শক্তি, না আছে অস্ত্রের শক্তি, না আছে বিদ্যার শক্তি! নাগরিক ধনী আর মহাজনরা এদের রাখে পায়ের তলায়, তবু এরা বিনিময়ে দেয় তাদের ক্ষুধার খোরাক৷ কঠিন পৃথিবীর শুকনো ধুলোমাটিকে স্নিগ্ধ সুন্দর করে রচনা করে শ্যামল মহাকাব্য এই দরিদ্র মহাকবির দল৷ কিন্তু দেশে যখন যুদ্ধ বাধে তখন কি বিদেশি আর কি স্বদেশি সৈন্যেরা চলে যায় এদেরই অপূর্ব রচনাকে নিঃশেষে ধ্বংস করে৷ সারা বছরের শ্রম আর আশা বিফল হয়ে যায় একদিনের যুদ্ধযাত্রায়, -চোখে জাগে কেবল অনাহার আর দুর্ভাগ্যের ছবি৷’
পূর্বাকাশ ছেড়ে পশ্চিমের অস্তাচলে এসে সূর্যের রাঙামুখ ক্রমেই ম্লান হয়ে পড়ছে-আর অল্পক্ষণের মধ্যেই পাখিদের কন্ঠে উঠবে বেলা-শেষের বিদায়ী সংগীত৷
অশ্বের পিঠ চাপড়ে সুবন্ধু বলল, ‘চলরে রাজার ঘোড়া, আরও একটু তাড়াতাড়ি চল রে ভাই৷ অন্ধকারে অন্ধ হবার আগে একটা আশ্রয় খুঁজে নিতে হবে যে!’
সন্ধ্যার কিছু আগেই পাওয়া গেল একটি গ্রামের প্রান্তে এক পান্থশালা৷ সুবন্ধু জানত, পনেরো ক্রোশের মধ্যে আর কোনো পান্থশালা বা নগর নেই৷ সুতরাং এইখানেই রাত্রিযাপন করবে বলে সে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে পড়ল৷
সেকালে সৈনিকের সবচেয়ে প্রিয় ছিল অসি ও অশ্ব৷ নিজের শ্রান্তিকে আমলে না এনে সুবন্ধু আগে তাই তার অতিশ্রান্ত ঘোড়ার পরিচর্যায় নিযুক্ত হল৷ জল এনে তার সর্বাঙ্গের ধুলোকাদা ধুয়ে দিল, তারপর তাকে দলন-মর্দন করতে লাগল৷
পান্থশালার সমুখ দিয়ে যে-প্রশস্ত রাজপথ চলে গিয়েছে তা এই গ্রামের নিজস্ব পথ নয়, কারণ মহারাজা পুরুর রাজ্য থেকে সীমান্তে যাবার জন্যে এইটিই হচ্ছে প্রধান পথ৷
হঠাৎ দূর থেকে অনেকগুলো ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনে সুবন্ধু চমকে মুখ তুলে দেখল, পথের উপরে ধূলিমেঘের সৃষ্টি হয়েছে৷ সে কৌতূহলী চোখে সেইদিকেই তাকিয়ে রইল৷
তারপরই দেখা গেল একদল অশ্বারোহীকে৷ সংখ্যায় তারা পঞ্চাশজনের কম হবে না৷ কে এরা?
অশ্বারোহীর দলও পান্থনিবাসের সামনে এসে থামল৷ দলের পুরোভাগে ছিল যে অশ্বারোহী, ঘোড়া থেকে নেমে সে গম্ভীর স্বরে বলল, ‘কে এই পান্থশালার অধিকারী?’ তার কন্ঠস্বর শুনলেই বোঝা যায়, এ ব্যক্তি আজন্ম আদেশ দিতে অভ্যস্ত৷
অধিকারী সসম্ভ্রমে কাছে ছুটে গিয়ে নত হয়ে অভিবাদন করল৷
অশ্বারোহী তার দিকে তাকিয়েও দেখল না৷ তেমনই হুকুমের স্বরে বলল, ‘আজ রাত্রে আমি এখানে থাকব৷ আমার আর আমার লোকজনদের থাকবার ব্যবস্থা করো৷’
অধিকারী মৃদু স্বরে বলল, ‘আজ্ঞে হঠাৎ এত লোকের ব্যবস্থা করি কী করে?’
অশ্বারোহী মুহূর্তের জন্যে অধিকারীর মুখের দিকে তাকাল অত্যন্ত অবহেলাভরে৷ সেই দুই চক্ষের দীপ্তি দেখেই অধিকারীর দেহ ভয়ে সংকুচিত হয়ে পড়ল৷
পাঁচটি স্বর্ণমুদ্রা বার করে অধিকারীর দিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে অশ্বারোহী অধীর স্বরে বলল, ‘যাও! নিজের মঙ্গল চাও তো প্রতিবাদ কোরো না৷’
স্বর্ণমুদ্রাগুলি তাড়াতাড়ি কুড়িয়ে নিয়ে অধিকারী সেখান থেকে দ্রুতপদে সরে পড়ল৷
সুবন্ধু সবিস্ময়ে অশ্বারোহীকে লক্ষ করতে লাগল৷ বয়স বোধহয় বিশ-বাইশের বেশি হবে না, কিন্তু তার দেহ এমন দীর্ঘ, বলিষ্ঠ ও পরিপুষ্ট যে, সহজে ধরা যায় না৷ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ৷ ভাবভঙ্গি অসাধারণ সম্ভ্রান্তজনের মতো এবং মুখেচোখে অতুলনীয় প্রতিভা, বীরত্ব ও ব্যক্তিত্বের আভাস৷
অশ্বারোহীর দৃষ্টি এতক্ষণ পরে সুবন্ধুর দিকে আকৃষ্ট হল৷ কয়েক মুহূর্ত তীক্ষ্ণনেত্রে তার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে তিনি পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বললেন, ‘বন্ধু, দেখছি তুমি সৈনিক!’
সুবন্ধু অভিবাদন করে হেসে বলল, ‘আজ্ঞে, আমাকে কেউ শুধু বন্ধু বলে ডাকে না, কারণ আমার নাম সুবন্ধু!’
‘তুমি সুবন্ধু কি কুবন্ধু জানি না, কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তুমি বীর৷ আমার চোখ মিথ্যা দেখে না৷ কিন্তু তোমার কি আর কোনো পরিচয় নেই?’
‘আমি ভারতসন্তান৷’
‘সে গর্ব আমিও করতে পারি!’ ‘
‘আমার ব্রত ভারতকে জাগানো৷’
‘আমারও ওই ব্রত৷’
‘তাই যদি হয়, তবে সীমান্তের দিকে না গিয়ে আপনি ফিরে আসছেন কেন? আপনি কি জানেন না, ভারতের রক্তপান করবার জন্যে সীমান্তে এসে হাজির হয়েছে যবন দিগ্বিজয়ী?’
মৃদু হাস্যে ওষ্ঠাধর রঞ্জিত করে অশ্বারোহী বললেন, ‘জানি সুবন্ধু! কারণ আমি আলেকজান্ডারের বন্ধুরূপে গ্রিক শিবিরেই ছিলাম৷’
সুবন্ধু সচমকে দুই পা পিছিয়ে গিয়ে ক্ষিপ্র হস্তে অসি কোষমুক্ত করতে উদ্যত হল৷
অশ্বারোহী হাস্যমুখে শান্ত স্বরে বললেন, ‘সুবন্ধু, তোমার তরবারিকে অকারণে ব্যস্ত কোরো না৷ আমি আলেকজান্ডারের বন্ধু হতে পারি কিন্তু ভারতের শত্রু নই! আমার নাম চন্দ্রগুপ্ত, নন্দবংশে জন্ম৷’
সুবন্ধু বিপুল বিস্ময়ে বলল, ‘মহারাজা নন্দ-‘
বাধা দিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, ‘ও নাম আমার সামনে উচ্চারণ কোরো না! তুমি কি জানো না, দুরাত্মা নন্দ প্রাচীন, পবিত্র নন্দবংশের কেউ নয়? সে ক্ষৌরকারপুত্র, ষড়যন্ত্রের ফলে মগধের সিংহাসন লাভ করেছে?�’*
সুবন্ধু থতমত খেয়ে বলল, ‘শুনেছি, রাজকুমার! কিন্তু-‘
উত্তেজিত চন্দ্রগুপ্ত আবার তাকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, সেই পাপিষ্ঠ আমার প্রাণদণ্ডের হুকুম দিয়েছিল-কারণ আমি আসল রাজবংশের ছেলে আর প্রজারা আমাকে ভালোবাসে৷ তারই জন্যে আজ আমি ভবঘুরের মতো দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি! মগধের রাজসিংহাসন ক্ষৌরকার-পুত্রের কবল থেকে উদ্ধার করবার জন্যে আমি গিয়েছিলাম গ্রিক দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারের কাছে সাহায্য চাইতে৷’
সুবন্ধু ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, ‘অর্থাৎ আপনি বিদেশি দস্যুকে যেচে দেশে ডেকে আনতে গিয়েছিলেন?’
চন্দ্রগুপ্ত দুই ভুরু সংকুচিত করে বললেন, ‘সুবন্ধু, আগে আমার সব কথা শোনো, তারপর মত প্রকাশ করো৷ ভেবে দেখো, নন্দের অধীনে আছে বিশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য, দুই লক্ষ পদাতিক সৈন্য, দুই হাজার যুদ্ধরথ আর চারহাজার রণহস্তী৷ এদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারি আমার এমন সহায় নেই৷ তাই আমি আগে গ্রিকদের সাহায্যে আমার পূর্বপুরুষদের সিংহাসন উদ্ধার করতে চেয়েছিলাম৷ মহাপদ্ম নন্দের যে পুত্র এখন মগধের রাজা সে বিলাসী, অত্যাচারী, কুচরিত্র৷ তার উপরে নীচ বংশে জন্ম বলে প্রজারা তাকে ঘৃণা করে৷ বর্তমান নন্দরাজা যুদ্ধনীতিতেও অজ্ঞ৷ কাজেই গ্রিকদের সঙ্গে মগধের ন্যায্য রাজা আমাকে দেখলে সমস্ত প্রজা আর সৈন্যদল আমার পক্ষই অবলম্বন করত, নন্দ যুদ্ধ করলেও জিততে পারত না৷ তারপর একবার সিংহাসনে বসতে পারলেই আমি আমার স্বাধীনতা ঘোষণা করতাম৷ তখন স্বদেশ থেকে অত দূরে-পূর্বভারতের প্রায় শেষপ্রান্তে গিয়ে পড়ে, আমার বিপুল বাহিনীর সামনে গ্রিকদের কী শোচনীয় অবস্থা হত, বুঝতে পারছ কি? আমি কেবল ভারতীয় যুদ্ধরীতিতে নয়, গ্রিক যুদ্ধরীতিতেও অভিজ্ঞ৷ গ্রিকদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হলে আমি তাদের রীতিই গ্রহণ করতাম৷ আরও একটা ভাববার কথা আছে! আজ গ্রিকরা দলে ভারী বটে, কিন্তু তারা যখন কাবুল থেকে সুদূর মগধে গিয়ে পৌঁছোত, তখন পথশ্রমে আর ধারাবাহিক যুদ্ধের ফলে তাদের অর্ধেকেরও বেশি সৈন্য মারা পড়ত৷ সে-অবস্থায় ইচ্ছা থাকলেও তারা আমার স্বাধীনতায় বাধা দিতে সাহস করত না৷ এখন বুঝলে সুবন্ধু, কেন আমি গ্রিক দস্যুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে গিয়েছিলাম? আমি চেয়েছিলাম কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে৷’
সুবন্ধু বলল, ‘আপনার অসাধারণ বুদ্ধি দেখে বিস্মিত হচ্ছি৷ কিন্তু আলেকজান্ডার কি আপনাকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে?’
‘আলেকজান্ডার অত্যন্ত চতুর ব্যক্তি, বোধ হয় আমার মনের কথা ধরে ফেলেছেন৷ গর্বিত স্বরে আমাকে বললেন-চন্দ্রগুপ্ত, আমি যখন মগধ আক্রমণ করব, নিজের ইচ্ছাতেই করব! তোমার সাহায্য অনাবশ্যক৷-ধূর্ত যবন ফাঁদে পা দিল না৷’
‘এখন আপনি কোথায় চলেছেন?’
‘মগধের রাজধানী পাটলিপুত্রে৷’
‘পাটলিপুত্রে!’
‘হ্যাঁ৷ শত্রুর কাছে যাচ্ছি বলে বিস্মিত হয়ো না৷ এক গুপ্তচর মুখ খবর পেলাম, মগধের প্রজারা নন্দের অত্যাচার আর সইতে না পেরে প্রকাশ্য বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত হয়েছে৷ তাদের পরামর্শদাতা হচ্ছেন বিষ্ণুগুপ্ত (চাণক্য) নামে কূটনীতিতে অভিজ্ঞ এক শক্তিশালী ব্রাহ্মণ৷ বিষ্ণুগুপ্ত আমাকে বিদ্রোহীদের নেতা হবার জন্যে আহ্বান করেছেন৷ তাই আমি দেশে ফিরছি আর পথে যেতে যেতে সাধ্যমতো সৈন্য সংগ্রহ করছি৷ সুবন্ধু, এই অল্প পরিচয়েই আমি বুঝেছি তুমি বীর, বুদ্ধিমান, স্পষ্টবক্তা৷ তোমার মতন সৈনিক লাভ করা সৌভাগ্য৷ তুমিও আমার সঙ্গী হবে?’
সুবন্ধু আবার অভিবাদন করে বলল, ‘মগধের ভবিষ্যৎ নরপতি, আমি আপনার জয় কামনা করি৷ কিন্তু ক্ষমা করবেন, আপাতত মগধের গৃহযুদ্ধে যোগ দেবার অবসর আমার নেই৷ আমার সামনে রয়েছে এখন মহত্তর কর্তব্য!’
‘কী কর্তব্য সুবন্ধু?’
‘গ্রিকদের আগমনবার্তা নিয়ে আমি চলেছি দেশ জাগাতে জাগাতে মহারাজা পুরুর কাছে৷ সীমান্তে গ্রিকদের বাধা দেবার জন্যে মহারাজা হস্তী আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, মহারাজা পুরুর কাছে তিনি সাহায্য চান৷’
চন্দ্রগুপ্ত বললেন, ‘তাহলে যাও সুবন্ধু, তুমি তোমার কর্তব্য পালন করো৷ কিন্তু তুমি আমার একটি ভবিষ্যদ্বাণী শুনে রাখো৷’
‘আদেশ করুন৷’
‘এই গ্রিক দিগ্বিজয়ীকে তুমি চেনো না৷ তিনি কেবল লক্ষাধিক সৈন্যের নেতা নন, রণনীতিতে তাঁর অসাধারণ প্রতিভা৷ তিনি কিছুতেই মহারাজা পুরুর সঙ্গে মহারাজ হস্তীর মিলন ঘটতে দেবেন না৷ মহারাজা পুরু প্রস্তুত হবার আগেই তিনি তাঁর বিরাট বাহিনী নিয়ে যেমন করে পারেন মহারাজা হস্তীকে পরাস্ত করবেনই৷ তারপর তিনি করবেন মহারাজ পুরুর পঞ্চাশ হাজার সৈন্যকে আক্রমণ-আমি মহারাজার সৈন্যবল জানি৷ লক্ষাধিক গ্রিকের সামনে পঞ্চাশ হাজার ভারতবাসী কতক্ষণ দাঁড়াতে পারবে৷’
‘তাহলে আপনি কী বলেন রাজকুমার, ভারতবাসীরা নিশ্চেষ্ট ভাবে বসে বসে করুণ নেত্রে দেখবে, তাদের স্বদেশের বুকের উপর দিয়ে বিদেশি যবনদের উন্মত্ত বিজয়যাত্রা? সে দৃশ্যটা খুব জমকালো হবে সন্দেহ নেই, কিন্তু আমাদের মনুষ্যত্বের-আমাদের পুরুষত্বের মর্যাদা কোথায় থাকবে?’
চন্দ্রগুপ্ত বললেন, ‘না সুবন্ধু, আমি তা বলি না৷ নিশ্চেষ্টভাবে দাসত্ব-শৃঙ্খল পরার চেয়ে মানুষের বড়ো কলঙ্ক আর নেই৷ তার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়৷ আমার চোখের সামনে যদি একটা উজ্জ্বল স্বপ্ন না থাকত, তাহলে আমিও আজ বীরের মতো প্রাণ দেবার জন্যে মহারাজ পুরুর পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম৷’
‘সে কী স্বপ্ন রাজকুমার?’
সুদূর দিকচক্রবাল-রেখায় যেখানে পশ্চিম আকাশের আলোকনেত্র ধীরে ধীরে মুদ্রিত হয়ে আসছে, সেই দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে চন্দ্রগুপ্ত কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন৷ তারপর পরিপূর্ণ দৃপ্ত স্বরে বললেন, ‘অখণ্ড ভারতসাম্রাজ্যের স্বপ্ন৷ এই গ্রিক ঝটিকা থেকে যদি আত্মরক্ষা করতে পারো তাহলে তুমি দেখে নিয়ো সুবন্ধু, মগধের সিংহাসন অধিকার করতে পারলে আমার বাহু বিস্তৃত হবে হিন্দুকুশের শিখর পর্যন্ত৷ মগধের অগাধ সৈন্যসাগরের মধ্যে মুষ্টিমেয় গ্রিক দস্যুরা যাবে অতলে তলিয়ে৷ সমগ্র বিচ্ছিন্ন ভারতকে আমি একত্রে দাঁড় করাব এক বিশাল রাজছত্রতলে৷’
‘আপনার উজ্জ্বল স্বপ্ন সত্য হোক, সার্থক হোক৷ কিন্তু তার আগেই মহারাজা পুরু যদি গ্রিকদের পরাজিত করেন?’
‘তাহলে অসম্ভবকে সম্ভবপর করেছেন বলে মহাবীর পুরুকে আমি অভিবাদন করব৷’
অষ্টম পরিচ্ছেদ – আবার ইতিহাস
আলেকজান্ডার কী উপায়ে উত্তর-ভারতের পশ্চিম অংশ জয় করেছিলেন, সে ইতিহাস এখানে সবিস্তারে বলবার দরকার নেই৷ স্কুলের প্রত্যেক ছেলেই সে কাহিনির সঙ্গে পরিচিত৷ আমরা কেবল এখানে গুটিকয় ইঙ্গিত দিতে চাই৷
পূর্ব-পরিচ্ছেদে চন্দ্রগুপ্তের যে ভবিষ্যদ্বাণী বলা হয়েছে, তাই-ই সত্য হল! যুদ্ধরীতিতে পরিপক্ক আলেকজান্ডার মহারাজা পৌরব বা পুরু আগমনের আগেই হস্তীকে আক্রমণ করলেন৷ ছোটো রাজ্যের রাজা হস্তী, সৈন্যবল তাঁর সামান্য, বিপুল গ্রিক বাহিনীর অগ্রগতিতে বাধা দেবেন কেমন করে? তবু তিনি অসম্ভবও সম্ভব করেছিলেন, বালির বাঁধে সমুদ্রকে ঠেকিয়ে রাখার মতো সুদীর্ঘ একমাসকাল গ্রিকদের এগোতে দেননি ভারতের বুকের ভিতরে!
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এর মধ্যে মহারাজ পুরু প্রস্তুত হতে পারলেন না৷
কেবল স্বদেশপ্রীতি ও বীরত্বের দ্বারা যুদ্ধজয় করা যায় না, অসংখ্য শত্রুকে বাধা দেবার জন্যে চাই প্রচুর সৈন্যবল-মহারাজ হস্তীর যা ছিল না৷ ফলে যা হবার তাই হল, মহাসাগরে মিলিয়ে গেল ক্ষুদ্র নদী,-গ্রিকদের সম্মিলিত কন্ঠের জয়নাদে ভারতপ্রান্তের আকাশ-বাতাস, পাহাড়, নগর, অরণ্য কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল৷ এর পর মহাবীর হস্তীর পরিণাম কী হল ইতিহাস সে সম্বন্ধে নীরব৷ খুব সম্ভব, যুদ্ধক্ষেত্রে রক্তাক্ত তরবারি নাচিয়ে তিনি বীরের কাম্য মৃত্যুকেই বরণ করে নিয়েছিলেন৷
হতভাগ্য দেশ ভারতবর্ষ৷ এমন এক ঐতিহাসিক বীরের নির্ভীক নিঃস্বার্থ আত্মদানের কাহিনি আমরা একেবারেই ভুলে গিয়েছি৷ রাজা হস্তী অন্য দেশে জন্মালে যুগে যুগে শত শত কবি ও ঔপন্যাসিকের কল্পনা তাঁর অমর নাম নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত৷ কোথায় দিগ্বিজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডারের সর্বজয়ী বিরাট বাহিনী, আর কোথায় এক ক্ষুদ্র পার্বত্য রাজা হস্তীর মুষ্টিমেয় সৈন্যদল৷ পতঙ্গ যেন মাতঙ্গকে একমাস শক্তিহীন করে রেখেছিল! এই আশ্চর্য বীরত্বগাথা আমরা শুনতে পেয়েছি কেবল গ্রিক ঐতিহাসিকের মুখেই৷ কিন্তু ভারতের কেউ তাঁর নাম মনে রাখেনি, অথচ ভারতের নির্ভরযোগ্য সত্যিকার ঐতিহাসিক যুগে সর্বপ্রথম বীর হচ্ছেন মহারাজা হস্তী! তাঁর আগে পঞ্চপাণ্ডব, ভীষ্ম, দ্রোণ ও কর্ণ প্রভৃতি বীরের কথা আমরা শুনি বটে, কিন্তু তাঁরা ঐতিহাসিক যুগের কেউ নন৷ কবির কল্পনা বলে কেউ তাঁদের উড়িয়ে দিলে জোর করে প্রতিবাদ করবার উপায় নেই৷
অভিসারের মহারাজাও পুরুর সঙ্গে যোগ দেবার জন্যে সৈন্য সংগ্রহ করছিলেন, কিন্তু মহারাজা হস্তীর পরিণাম দেখে ভয়ে ভয়ে তিনি আলেকজান্ডারের সঙ্গে সন্ধি করে ফেললেন৷
আলেকজান্ডার সীমান্তের কোনো রাজাকেই অন্য রাজাদের সঙ্গে মিলে শক্তিবৃদ্ধি করতে দিলেন না, নিজের বৃহত্তর বাহিনী নিয়ে একে একে তাদের প্রত্যেককেই পরাস্ত করলেন৷ গ্রিক ঐতিহাসিকরা এই সব হিন্দু রাজা ও রাজ্যের নাম করেছেন বটে, কিন্তু বিদেশি ভাষার কবলে পড়ে ওইসব নাম এতটা বিকৃত হয়েছে যে, সেগুলিকে ভারতীয় নাম বলে চেনার কোনো উপায়ই নেই৷ বড়ো বড়ো পণ্ডিতও এ-কাজে হার মেনেছেন৷
তবে অসংখ্য সৈন্যের অধিকারী হয়েও আলেকজান্ডারের ভারতীয় যুদ্ধযাত্রা মোটেই নিরাপদ হয়নি৷ তিনবার তাঁকে আহত হতে হয়েছিল৷ প্রথম দুইবার ভারতের উত্তর সীমান্তে এবং শেষবার মুলতানে-যখন তিনি ভারত-জয়ের আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে স্বদেশে প্রস্থান করেছিলেন৷ শেষবারের আঘাত এমন সাংঘাতিক হয়েছিল যে, আলেকজান্ডারের জীবনের আশাই ছিল না৷
এই তিনবারই আলেকজান্ডার হাজার হাজার বন্দিকে হত্যা করে নির্দয় ও অমানুষিক প্রতিশোধ নিয়েছিলেন৷ দ্বিতীয় বারের হত্যাকাণ্ডের জন্যে গ্রিক ঐতিহাসিকরা পর্যন্ত তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার সমর্থন করতে পারেননি৷
মাসাগা (সম্ভবত আধুনিক মালাকাণ্ড গিরিসংকটের উত্তরে) নগরে সাত হাজার পেশাদার ভারতীয় সৈন্য ছিল৷ তারা চাকরির খাতিরে সেখানে গিয়েছিল ভারতের সমতল প্রদেশ থেকে৷ মাসাগা নগরের পতনের পর তারা যখন আত্মসমর্পণ করে, আলেকজান্ডার তাদের আশ্রয় দিয়ে গ্রিক ফৌজে গ্রহণ করতে চান৷ কিন্তু সেই সাত হাজার হিন্দুবীর একবাক্যে বললে, ‘আমরা পেশাদার সেপাই বটে, কিন্তু বিদেশির অধীনে চাকরি নিয়ে স্বদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে পারব না৷ আমরা দেশে ফিরে যাব৷’
আলেকজান্ডার তখন তাদের কিছু বললেন না৷ কিন্তু রাত্রে তারা যখন স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে নিশ্চিন্ত ঘুমে অচেতন হয়ে আছে, তখন হঠাৎ সৈন্য নিয়ে গোপনে তাদের আক্রমণ করলেন৷ ঘুম ভাঙবার আগেই তাদের অনেকে বিশ্বাসঘাতকদের তরবারির আঘাতে অনন্ত নিদ্রায় নিদ্রিত হল৷ বাকি সবাই বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কা সামলে নিয়ে পরিবারবর্গকে ঘিরে দাঁড়াল তরবারি হস্তে, সগর্বে! দৃঢ়স্বরে তারা বলল, ‘প্রাণ দেব, তবু দেশের শত্রুর অধীনে চাকরি করব না৷’ সেই সাত হাজার হিন্দু বীর সেদিন একে একে লড়তে লড়তে প্রাণ দিয়েছিল-গ্রিক রক্তে ভারতের মাটি রাঙা করে! বলতে আজও আমার বুক ফুলে উঠছে যে, অতীতের সেই গৌরবময় দিনে হিন্দু বীরবালারাও গ্রিক সৈন্যদের বিরুদ্ধে অস্ত্রচালনা করেছিলেন! এ উপন্যাসের কথা নয়, গ্রিক ঐতিহাসিকের কথা!
সীমান্তের পথ হল নিষ্কণ্টক!
আলেকজান্ডার বললেন, ‘চলো এইবার পঞ্চনদের দেশে৷ রাজা পুরু সেখানে প্রস্তুত হচ্ছে, তার অধীনে আছে মাত্র পঞ্চাশ হাজার সৈন্য৷ তাকে মারতে পারলেই সমস্ত ভারত লুটিয়ে পড়বে আমাদের পায়ের তলায়৷’
পুরুর সৈন্য সংখ্যা যে পঞ্চাশ হাজারের বেশি ছিল না, এ-বিষয়ে মতান্তর নেই৷ কিন্তু ভারতের গৌরব খর্ব করবার জন্যে কিনা জানি না, আধুনিক ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা আলেকজান্ডারের সৈন্য সংখ্যা কম ছিল বলে জানাবার চেষ্টা করেন৷ ভারতের নিজের ইতিহাস-অন্তত আসল ইতিহাস বলতে যা বোঝায় তা নেই, তাই আমরা আধুনিক ইউরোপের কথা অমূলক বলে প্রতিবাদ করতে পারি না৷
কিন্তু আধুনিক ইউরোপের এই চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন দিগ্বিজয়ী গ্রিকদেরই প্রাচীন লেখক৷ প্লুটার্কের লেখা আলেকজান্ডারের জীবনীতে আমরা অন্য কথা পাই৷ কারণ তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, একলক্ষ বিশ হাজার পদাতিক ও পনেরো হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে আলেকজান্ডার ভারতবর্ষে প্রবেশ করেন৷
তারপর অন্যান্য ঐতিহাসিকরাও স্বীকার করেছেন যে, তক্ষশীলার রাজা অম্ভি, অভিসারের রাজা ও অন্যান্য বশীভূত রাজারাও আলেকজান্ডারকে সৈন্য, হস্তী ও অশ্ব দিয়ে সাহায্য করেছিলেন; এবং আলেকজান্ডার নিজেও যে-পথে আসতে আসতে পেশাদার সৈন্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলেন, পূর্ব-উক্ত মাসাগার হত্যাকাণ্ডেই সে প্রমাণ পাওয়া যায়৷ মাসাগারে সাত হাজার বীরের মৃত্যুর একমাত্র কারণ, তারা গ্রিক ফৌজে যোগ দিতে চায়নি৷ তাদের মতো স্বদেশভক্ত পৃথিবীর সব দেশেই দুর্লভ৷ সুতরাং এ-কথা জোর করে বলা যায় যে, ভারতের হাজার হাজার পেশাদার সৈন্যও আলেকজান্ডারের বাহিনীকে করে তুলেছিল বৃহত্তর৷ আমাদের মতে, আলেকজান্ডার যখন পুরুর সঙ্গে শক্তিপরীক্ষায় অগ্রসর হন, তখন তাঁর অধীনে অন্তত দুই লক্ষের কম সৈন্য ছিল না,-বরং এর উপরে আরও পঞ্চাশ হাজার যোগ করলেও অত্যুক্তি হবে না৷
পুরুর দুর্ভাগ্য! যথাসময়ে প্রস্তুত হতে পারেননি বলে তাঁকে একাকীই অন্তত চারগুণ বেশি গ্রিক সৈন্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হল! বুদ্ধিমান হলে পুরুও অন্যান্য রাজার মতন আলেকজান্ডারের অধীনতা স্বীকার করতে পারতেন৷ কিন্তু পুরুর বিরাট বক্ষের তলায় ছিল ভীমার্জুনের আত্মা, বিনা যুদ্ধে তিনি স্বদেশকে যবনের হাতে তুলে দিতে রাজি হলেন না৷
পুরু মহাবীর হলেও আমাদের এই কাহিনির নায়ক নন, কাজেই তাঁর কথা সবিস্তারে বলে লাভ নেই! কেবল এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে জুলাই মাসের প্রথমে, ঝিলম নদের তীরে আলেকজান্ডারের সঙ্গে যে-যুদ্ধে পুরু পরাজিত হন, ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের মত মেনে তাকে আমরা মহাযুদ্ধ বলে স্বীকার করতে পারব না৷ পরে পানিপথের একাধিক যুদ্ধে সমগ্র ভারতের ভাগ্য যেমন বার বার পরিবর্তিত হয়েছিল, ঝিলমের যুদ্ধের পরে তেমন কিছুই হয়নি, ভারতবর্ষের অধিকাংশই ছিল আলেকজান্ডারের নাগালের বাইরে৷ তার প্রধান কারণ, পুরু ছিলেন উত্তর-ভারতের মাত্র এক অংশের রাজা, তাঁর পতনের সঙ্গে সমগ্র ভারতের বিশেষ যোগ ছিল না৷
ঝিলমের যুদ্ধে মহাবীর ও অতিকায় পুরু অসম্ভবের বিরুদ্ধেও প্রাণপণে লড়াই করেছিলেন, কিন্তু শেষটা দেহের নয় স্থানে আহত হয়ে প্রায়-মূর্ছিত অবস্থায় বন্দি হলেন৷ আলেকজান্ডারের শিবিরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল৷ তাঁর সেই সাড়ে ছয় ফুট দীর্ঘ বিপুল দেহের দিকে সবিস্ময়ে তাকিয়ে আলেকজান্ডার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করব?’
পুরু সগর্বে মাথা তুলে বললেন, ‘এক রাজা আর-এক রাজার সঙ্গে যেমন ব্যবহার করেন!’
পুরুর বীরত্ব ও পরাক্রম দেখে আলেকজান্ডার এতটা অভিভূত হয়েছিলেন যে, তিনি কেবল তাঁকে মুক্তি দিলেন না, তাঁর নিজের রাজ্যের উপরেও আরও অনেক দেশ দান করলেন৷
পঞ্চনদের তীরে উড়তে লাগল গ্রিক দিগ্বিজয়ীর পতাকা! কিন্তু আলেকজান্ডার বুঝলেন, তিনি এখনও বৃহত্তর ভারতসীমান্তেই দাঁড়িয়ে আছেন৷
যুদ্ধজয়ের আনন্দোচ্ছ্বাস যখন কমল, আলেকজান্ডার তখন একদিন সেনাপতিদের আহ্বান করে বললেন, ‘সৈন্যদের মধ্যে প্রচার করে দাও, আমি এইবার মগধের দিকে যাত্রা করব!’
গ্রিক অশ্বারোহী সৈন্যদের নেতা স্পষ্টবক্তা কইনোস সবিস্ময়ে বললেন, ‘সে কী সম্রাট! আজ আট বৎসর হল আমরা স্বদেশ থেকে বেরিয়েছি৷ এখনও আপনি এগিয়ে যেতে চান?’
‘হ্যাঁ সেনাপতি! কারণ মগধের রাজাই ভারতের সবচেয়ে বড়ো রাজা৷ মগধ জয় করতে না পারলে ভারত জয় করা হবে না৷’
অন্যান্য সেনাপতিরাও জানালেন, গ্রিক সৈন্যদের অধিকাংশই হত বা আহত হয়েছে৷ এখন আর আমাদের মগধের দিকে যাবার সাহস নেই৷ এর মধ্যেই গ্রিক সৈন্যদের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব প্রকাশ পেয়েছে৷
কইনোস বললেন, ‘শুনেছি মগধের নন্দরাজার সৈন্য আছে লক্ষ লক্ষ৷ মগধ আক্রমণ করলে আমাদের পরাজয় অনিবার্য৷’
আলেকজান্ডার আর কোনো কথা না বলে অভিমানভরে চলে গেলেন৷ দুই দিন আর শিবিরের ভিতর থেকে বেরোলেন না৷ মাথা ঠান্ডা করে অনেক ভেবে, তৃতীয় দিনে বাইরে এসে বললেন, ‘তাঁবু তোলো! আমরা গ্রিসে ফিরে যাব৷’
আধুনিক ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা স্বীকার করেন না বটে, কিন্তু ভারতবর্ষ জয় করতে এসে গ্রিকদের এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন হচ্ছে পলায়নেরই নামান্তর৷ জীবনে আর কখনো আলেকজান্ডার এমন ভাবে পিছু হটেননি৷ প্রাচীন ঐতিহাসিক দায়াদরাস স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, (মেগাস্থেনেসের ভ্রমণকাহিনির আলোচনা প্রসঙ্গে) ‘মাসিডনের রাজা আলেকজান্ডার সবাইকে হারিয়েও মগধের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সাহসী হননি৷ মগধের সৈন্যবলের কথা শুনে তিনি ভারতজয়ের ইচ্ছা দমন করেন!’
আলেকজান্ডার তো উত্তর ভারতের চতুর্দিকে গ্রিক সৈন্য, সেনাপতি ও শাসনকর্তা রেখে মানে মানে সরে পড়লেন, কিন্তু আমাদের বন্ধু সুবন্ধুর কী হল? এইবার তার সঙ্গে দেখা করে আবার গল্পের সূত্র ধরব!
নবম পরিচ্ছেদ – আনন্দের অশ্রুজল
‘সেনাপতি, এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে আপনাকে আর আমাদের সঙ্গে কষ্ট করে আসতে হবে না! আমরাই আপনার আদেশ পালন করতে পারব৷’
‘না বসুমিত্র, ব্যাপারটাকে তোমরা সামান্য মনে কোরো না৷ আমরা শৃগাল মারতে নয়, যাচ্ছি সিংহ শিকার করতে! আমরা একবার বিফল হয়েছি আবার বিফল হলে আমার মান আর রক্ষা পাবে না৷ ঘোড়ায় চড়ো, অগ্রসর হও৷’
একশোজন সওয়ার চালিয়ে দিল একশো ঘোড়াকে! একশো ঘোড়ার খুরের শব্দে রাজপথ যেন জীবন্ত হয়ে উঠল-নিবিড় মেঘের মতো ধুলায় ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল চতুর্দিক এবং সৈনিকদের বর্মে বর্মে জ্বলতে লাগল শত সূর্যের চমক!
অরণ্যের বক্ষ ভেদ করে চলে গিয়েছে প্রশস্ত সেই পথ৷ মাঝে মাঝে গ্রাম৷ সৈনিকদের ঘোড়া এত দ্রুত ছুটেছে যে মনে হচ্ছে, গ্রামগুলো যেন কৌতূহলে ও আগ্রহে কাছে এসেই আবার সশস্ত্র সওয়ারদের দেখে ভয়ে দূরে পালিয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি!
প্রায় ক্রোশ-তিনেক পরে পথটা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে তিন দিকে চলে গিয়েছে! যাঁকে সেনাপতি বলে সম্বোধন করেছিল হঠাৎ তিনি ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে হাত তুলে চেঁচিয়ে বললেন, ‘সবাই ঘোড়া থামাও!’
একশো ঘোড়া দাঁড়িয়ে পড়ল৷
সেনাপতি বললেন, ‘দেখো, বসুমিত্র, তিনটে পথই কুরুক্ষেত্রের মহাপ্রান্তরের তিন দিকে গিয়ে পড়েছে৷ পঁচিশজন সওয়ার ডানদিকে যাক আর পঁচিশ জন যাক বাম দিকে৷ বাকি পঞ্চাশজনকে নিয়ে আমি যাব সামনের পথ ধরে৷ গুপ্তচরের খবর যদি ঠিক হয়, তাহলে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরেই আমাদের শিকারকে ধরতে পারব৷ সে ধু-ধু-প্রান্তরের মধ্যে কেউ আমাদের চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না৷’
বসুমিত্র সেনাপতির হুকুম সকলকে জানাল৷ তখনই সওয়াররা তিন দলে বিভক্ত হয়ে আবার গন্তব্য পথে অগ্রসর হল৷ পাঠকদের সঙ্গে আমরাও যাই সেনাপতির সঙ্গে!
ঘণ্টা-দুই পরেই পথ গেল ফুরিয়ে এবং আরম্ভ হল পবিত্র কুরুক্ষেত্রের ভয়াবহ প্রান্তর৷ হ্যাঁ, এ-প্রান্তর পবিত্র এবং ভয়াবহ! মহাভারতের অমর আত্মা একদিন এখানে যত উচ্চে উঠেছিল, নেমেছিল আবার ততখানি নীচে! ভারতের যা-কিছু ভালো, যা-কিছু মন্দ এবং যা-কিছু বিশেষত্ব, কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধের মধ্যেই করেছিল আত্মপ্রকাশ৷ নরের সঙ্গে নারায়ণের মিতালি, শ্রীকৃষ্ণের মুখে গীতার বাণী, ভীমার্জুনের অতুলনীয় বীরত্ব, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের মানবতা, কুরু-পাণ্ডবের ভ্রাতৃবিরোধ, অন্যায় যুদ্ধে ভীষ্মের, দ্রোণের ও অভিমন্যুর পতন প্রভৃতির মতো শত শত কাহিনি যুগ-যুগান্তরকে অতিক্রম করে আজও ভারতের জীবনস্মৃতির ভিতরে দুলিয়ে দিচ্ছে বিচিত্র ভাবের হিন্দোলা! মানুষ যে কখনো দেবতা হয় এবং কখনো হয় দানব, কুরুক্ষেত্রই আমাদের তা দেখিয়ে দিয়েছে৷ বহুকাল আগে আমি একবার দাঁড়িয়েছিলাম গিয়ে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে৷ কিন্তু সেখানে গিয়েই মনে হল, এ তো প্রান্তর নয়,-এ-যে রক্তে রাঙা সমুদ্র! কুরুক্ষেত্রের প্রত্যেক ধূলিকণাকে ভারতের মহাবীররা স্মরণাতীত কাল আগে যে-রক্তের ছাপে আরক্ত করে গিয়েছিলেন, বিংশ-শতাব্দীর সভ্যতাও তা বিলুপ্ত করতে পারেনি৷ আর আমরা যে-যুগের কথা বলছি সে-যুগে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে কুরু ও পাণ্ডব পক্ষের যুদ্ধে-মৃত লক্ষ লক্ষ বীরের কঙ্কাল ধুলায় ধুলা হবারও সময় পায়নি! সে বিপুল প্রান্তরে রাত্রে তখন কোনো পথিকই চলতে ভরসা করত না৷ এ-যুগেও সেখানে গিয়ে আমি প্রাণের কানে শুনেছি, শত পুত্রের শোকে দেবী গান্ধারীর কাতর আর্তনাদ, অভিমন্যুর শোকে বিধবা উত্তরার কান্না এবং শরশয্যায় শায়িত ভীষ্মের দীর্ঘশ্বাস!
কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরের তিন দিকে ছুটছে তিন দল অশ্বারোহী৷ খানিক অগ্রসর হয়েই তারা দেখতে পেল, দূরে মৃদু কদমে ঘোড়া চালিয়ে যাচ্ছে একজন সওয়ার৷
সে আমাদের বন্ধু-ভারতের বন্ধু সুবন্ধু৷ কেউ যে তার পিছনে আসছে এটা সে অনুমান করতে পারেনি, তাই তার ঘোড়া অগ্রসর হচ্ছে ধীরে ধীরে৷ সন্দেহ করবার কোনো হেতু ছিল না, কারণ উত্তর-পশ্চিম ভারত আজ যবন গ্রিক দিগ্বিজয়ীর কবলগত, মহারাজা হস্তীর পতন হয়েছে এবং আলোকজান্ডারের প্রধান শত্রু মহারাজা পুরু আজ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শক্তিহীন৷ ভারতের তরবারি কোষবদ্ধ!
আচম্বিতে পিছনে বহু অশ্বের পদশব্দ শুনে সুবন্ধু ঘোড়া থামিয়ে ফিরে দেখল৷ কিন্তু তখনও সে আন্দাজ করতে পারল না যে, ওরা আসছে তাকেই ধরবার জন্যে৷ ভাবল, এই ভারতীয় সওয়ারের দল যাচ্ছে অন্য কোনো কাজে৷
খানিক পরেই সওয়ারের দল খুব কাছে এসে পড়ল৷ তখন সে বিস্মিত নেত্রে দেখল, সকলকার আগে আগে আসছে ভারতের কুপুত্র, আলেকজান্ডারের অন্যতম সেনাপতি ও পথ-প্রদর্শক শশীগুপ্ত৷
সুবন্ধুর মনে কেমন সন্দেহ হল৷ সে তাড়াতাড়ি নিজের অশ্বের গ্রীবায় করাঘাত করে বলল, ‘চল রে রাজার ঘোড়া, বিশ্বাসঘাতকের ছায়া পিছনে ফেলে হাওয়ার আগে উড়ে চল!’
তার ঘোড়ার গতি বাড়তেই পিছন থেকে শশীগুপ্ত চেঁচিয়ে বলল, ‘ঘোড়া থামাও সুবন্ধু! আর পালাবার চেষ্টা করে লাভ নেই! ডানদিকে চেয়ে দেখো, বাঁ-দিকে চেয়ে দেখো! তোমাকে আমরা প্রায় ঘিরে ফেলেছি!’
সত্য কথা! হতাশ হয়ে সুবন্ধু একটা বড়ো গাছের তলায় গিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে পড়ল৷
শশীগুপ্তও ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে বলল, ‘বসুমিত্র, সুবন্ধুকে বন্দি করো!’
সুবন্ধু বলল, ‘যুদ্ধের পালা শেষ হয়েছে, আলোকজান্ডার দেশের পথে ফিরে গেছেন! সেনাপতি, এখন আমাকে বন্দি করে আপনাদের কী লাভ হবে?’
মৃদু হাস্য করে শশীগুপ্ত বলল, ‘কী লাভ হবে? তুমি কি জানো না, সম্রাট আলেকজান্ডারের অনুগ্রহে আমি এক বিস্তীর্ণ প্রদেশের শাসনকর্তার পদ পেয়েছি? ভারতে গ্রিকসাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে কোথায় কে কোন চক্রান্ত করছে, সেদিকেও দৃষ্টি রাখা হচ্ছে আমার আর এক কর্তব্য!’
সুবন্ধু বলল, ‘সেনাপতি শশীগুপ্তের কাছে যে যবনের অন্নজল অত্যন্ত পবিত্র, এ-সত্য আমার জানা নেই৷ কিন্তু আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী?’
শশীগুপ্ত ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, ”কার অন্নজল পবিত্র সেকথা আমি এক নগণ্য সৈনিকের মুখে শুনতে ইচ্ছা করি না৷”
সুবন্ধু হাসতে হাসতে বলল, ‘আমি যে নগণ্য সৈনিক মাত্র, সে-সত্যও আপনার অজানা নেই! কিন্তু সৈনিককে বন্দি করবার জন্যে আপনার মতো গণ্যমান্য পুরুষকে সসৈন্যে আসতে হয়েছে কেন সে-কথাটা স্পষ্ট করে বললে খুশি হব৷’
‘কোথায় যাচ্ছ তুমি?’
‘মগধে!’
‘কেন?’
‘যবনসাম্রাজ্যে সুবন্ধু বাস করে না!’
‘তোমার উত্তর সত্য নয় সুবন্ধু! গ্রিকদের বিরুদ্ধে তুমি মহারাজা হস্তীকে আর পুরুকে উত্তেজিত করেছিলে৷ এইবারে তুমি মগধে গিয়েও বিদ্রোহ প্রচার করতে চাও?’
‘সেনাপতি শশীগুপ্ত, বিদ্রোহ আমাকে আর প্রচার করতে হবে না৷ আলেকজান্ডার এখনও ভারতের মাটি ছাড়েননি, এরই মধ্যে তো চারিদিকেই উড়ছে বিদ্রোহের ধ্বজা! পুষ্কলাবতীর গ্রিক শাসনকর্তা নিহত হয়েছে, কান্দাহারও করেছে বিদ্রোহ ঘোষণা! আপনার অবস্থাও নিরাপদ নয়, তাই আপনি গ্রিক সম্রাটের কাছে সৈন্য সাহায্য প্রার্থনা করেছেন! কিন্তু নূতন গ্রিক সৈন্য আর আসবে না সেনাপতি, আলেকজান্ডার এখন নিজেই কাবু হয়ে পালিয়ে যাবার জন্যে ব্যতিব্যস্ত!’
‘ওসব কথা আমি তোমার মুখে শুনতে ইচ্ছা করি না৷ আমি জানি, মহারাজা পুরু যুদ্ধে হেরেছেন বটে, কিন্তু আজও পোষ মানেননি৷ তিনি খাপ থেকে আবার তরবারি খুলতে চান, আর সেই খবর দেবার জন্যেই তুমি ছুটেছ মগধে! কিন্তু তোমার বাসনা পূর্ণ হবে না৷’
সুবন্ধু আবার হাসির ঢেউ তুলে বলল, ‘আপনি আমাকে বন্দি করতে পারবেন?’
‘সে-বিষয়েও তোমার সন্দেহ আছে নাকি? চেয়ে দেখো, আমরা একশো জন!’
‘হিন্দুকুশের ছায়ায় আমার দুই বন্ধু কজন গ্রিককে বাধা দিয়েছিল, এরই মধ্যে সে-কথা ভুলে গেলেন নাকি?’
‘আমি ভুলিনি৷ কিন্তু তুমি ভুলে যেয়ো না, শেষ পর্যন্ত তাদের মরতেই হয়েছিল!’
‘হ্যাঁ, সেই কথাই বলতে চাই৷ জানি আমিও মরব৷ কিন্তু শশীগুপ্ত, আমি আত্মসমর্পণ করব না৷’
সুবন্ধু অশ্রদ্ধাভরে তাকে নাম ধরে ডাকল বলে অপমানে শশীগুপ্তের মুখ রাঙা হয়ে উঠল৷ চিৎকার করে বলল, ‘বসুমিত্র! সুবন্ধুকে বন্দি করো৷’
‘আমি তো মরবই, কিন্তু তার অনেক আগেই ঘরের শত্রু বিভীষণকে বধ করব!’ চোখের নিমেষে সুবন্ধু বাঘের মতো লাফ মেরে একেবারে শশীগুপ্তের গায়ের উপরে গিয়ে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে তার জ্বলন্ত অসি কোষমুক্ত হয়ে শশীগুপ্তের মাথার উপরে করল বিদ্যুৎচিত্রের সৃষ্টি৷
কিন্তু বসুমিত্রের সাবধানতায় শশীগুপ্ত সে-যাত্রা বেঁচে গেল প্রাণে৷ বসুমিত্র জাগ্রত ছিল, সে তৎক্ষণাৎ নিজের তরবারি তুলে সুবন্ধুর তরবারিকে বাধা দিল৷
শশীগুপ্ত সভয়ে পিছিয়ে গেল৷ কিন্তু তারপরেই নিজেকে সামলে নিয়ে বিষম রাগে প্রায় অবরুদ্ধ স্বরে বলল, ‘বধ করো-বধ করো! ওকে কুচিকুচি করে কেটে ফেলো!’
একশো ঘোড়ার সওয়ারের হাতে হাতে অগ্নিবৃষ্টি করল এক শত তরবারি! সুবন্ধু দুই পা পিছিয়ে এসে গাছের গুঁড়ির উপরে পৃষ্ঠরক্ষা করে তরবারি তুলে তীব্র স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ! আমাকে বধ করো! কিন্তু বন্দি আমি হব না! নিজে মরব-শত্রু মারব৷’
বসুমিত্র কিন্তু সেনাপতির হুকুম তামিল করবার জন্যে কোনো আগ্রহই দেখাল না৷ প্রান্তরের একদিকে চিন্তিত ভাবে তাকিয়ে সে বলল, ‘সেনাপতি, পূর্বদিকে চেয়ে দেখুন৷’
পূর্বদিকে চেয়েই শশীগুপ্ত সচকিত স্বরে বলল, ‘ও কারা বসুমিত্র? ঘোড়া ছুটিয়ে আমাদের দিকেই আসছে! ওদের পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ওরা এ-অঞ্চলের কোনো দেশের সৈন্য নয়! ওরা কারা, বসুমিত্র?’
বসুমিত্র উৎকন্ঠিত স্বরে বললে, ‘কিছুই তো বুঝতে পারছি না! একটা অগ্রবর্তী দল আসছে, গুণতিতে চার-পাঁচশোর কম হবে না! কিন্তু ওদের পিছনে, আরও দূরে তাকিয়ে দেখুন সেনাপতি, পূর্বদিকে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তর ভরে গিয়েছে সৈন্যে সৈন্যে! সংখ্যায় ওরা হাজার-কয় হবে! পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তের বনের ভিতর থেকেও বেরিয়ে আসছে কাতারে কাতারে আরও সৈন্য!’
শশীগুপ্ত তাড়াতাড়ি নিজের ঘোড়ার উপরে চড়ে বলল, ‘বসুমিত্র, অগ্রবর্তী দল আমাদের খুব কাছে এসে পড়েছে! ওরা ভেরি বাজিয়ে আমাদের থামতে বলছে৷ কিন্তু দেখছ, ওদের পতাকায় কী আঁকা রয়েছে?’
বসুমিত্র বলল, ‘পতাকায় আঁকা রয়েছে, ময়ূর৷’
‘হ্যাঁ, মৌর্যবংশের নিদর্শন! বসুমিত্র, ওরা মগধের সৈন্য, -আমাদের শত্রু! সংখ্যার ওরা দেখছি অগণ্য৷ এখন আমাদের পক্ষে এ-স্থান ত্যাগ করা উচিত৷ সৈন্যগণ, পশ্চিম দিকে ঘোড়া ছোটাও৷’
সুবন্ধু শূন্যে তরবারি নাচিয়ে হেঁকে বলল, ‘সে কী শশীগুপ্ত? আমি তো মরতে প্রস্তুত! তোমরা আমাকে বধ করবে না?’
শশীগুপ্ত তার দিকে অগ্নি-উজ্জ্বল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিজের ঘোড়া চালিয়ে দিল পশ্চিম দিকে৷
বসুমিত্র এক লাফে ঘোড়ার পিঠে উঠে বলল, ‘সুবন্ধু, এ-যাত্রাও তুই বেঁচে গেলি৷’
সুবন্ধু হা-হা করে অট্টহাসি হেসে বলল, ‘মরতে আমি ভালোবাসি, আমি তো মরতে ভয় পাই না তোদের মতো! ওরে ভারতের কুসন্তান, ওরে বিশ্বাসঘাতকের দল! স্বদেশের জন্যে প্রাণ দিতেও যে কত আনন্দ, সে-কথা তোরা বুঝবি কেমন করে?’
কিন্তু তার কথা তারা কেউ শুনতে পেল না, কারণ তখন তাদের ঘোড়া ছুটছে ঊর্ধ্বশ্বাসে৷
‘হ্যাঁ সুবন্ধু ঠিক বলেছ! স্বদেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার মতো আনন্দ আর নেই!’
শত শত ঘোড়ার খুরের আওয়াজ হঠাৎ থেমে গেল সুবন্ধুর কানের কাছে৷ চমকে সে ফিরে দেখল, তার সামনেই তেজীয়ান এক অশ্বের পৃষ্ঠদেশে বসে আছেন সহাস্যমুখে চন্দ্রগুপ্ত!
সুবন্ধু সবিস্ময়ে তাঁর দিকে ফিরে তাকিয়েই, ভূতলে জানু পেতে বসে বিস্মিত স্বরে বলল, ‘মহারাজা চন্দ্রগুপ্ত! এ যে স্বপ্নেরও অগোচর!’
প্রথম যৌবনের নৃত্যচঞ্চল ভঙ্গিতে এক লাফে ঘোড়ার পিঠ ছেড়ে নীচে নেমে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, ‘রাজবংশে জন্ম বটে, কিন্তু এখনও মহারাজা হতে পারিনি, সুবন্ধু৷’
প্রথম সম্ভাষণের পালা শেষ হলে সুবন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কিন্তু মহারাজ, কোথা থেকে দেবদূতের মতন অকস্মাৎ আপনি এখানে এলেন? আপনার সঙ্গে এত সৈন্যই বা কেন? আপনি কি মগধের সিংহাসন অধিকার করেছেন?’
চন্দ্রগুপ্ত দুঃখিত ভাবে মাথা নেড়ে বললেন, ‘না সুবন্ধু, মগধের সিংহাসনে বসবার যোগ্যতা এখনও আমার হয়নি৷ ধননন্দের বিপুল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে আমি পরাজিত হয়েছি৷’
‘হা ভগবান, আমি যে আপনার উপরে অনেক আশা করেছিলাম!’
‘আশা করেছিলে?’
‘আজ্ঞে হাঁ মহারাজ! আমি যে মহারাজা পুরুর প্রতিনিধি রূপে বিজয়ী মহারাজা চন্দ্রগুপ্তকে আহ্বান করবার জন্যে মগধে যাত্রা করেছিলাম! পথের মধ্যে আমাকে বন্দি বা বধ করবার জন্যে এসেছিল শশীগুপ্ত-‘
‘তারপর আমাদের দেখে তারা শেয়ালের মতো পালিয়ে গেল! কেমন, এই তো? বুঝেছি৷ কিন্তু আশ্বস্ত হও সুবন্ধু, একবার পরাজিত হলেও আমি হতাশ হইনি! বিশাল মগধ-সাম্রাজ্য একদিনে জয় করা যায় না৷ মগধের সিংহাসন অধিকার করবার জন্যেই আমি যাচ্ছি সীমান্তের দিকে!’
সুবন্ধু বিস্মিত ভাবে চন্দ্রগুপ্তের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মহারাজ ক্ষমা করবেন৷ আপনার কথার অর্থ আমি বুঝতে পারছি না৷ সীমান্তের দিকে যতই অগ্রসর হবেন মগধের সিংহাসন থেকে তো ততই দূরে গিয়ে পড়বেন৷’
মৃদু হাস্যে ওষ্ঠাধর রঞ্জিত করে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, ‘ঠিক কথা৷ গুরু বিষ্ণুগুপ্ত (চাণক্য) একটি চমৎকার উপমা দিয়ে আমার প্রথম বিফলতার কারণ বুঝিয়ে দিয়েছেন৷ শিশুর সামনে এক থালা গরম ভাত ধরে দাও! শিশু বোকার মতো গরম ভাতের মাঝখানে হাত দিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলবে৷ কিন্তু সে যদি বুদ্ধিমানের মতো ধার থেকে ধীরে ধীরে ভাত ভাঙতে শুরু করে, তাহলে তার হাত পুড়বে না৷ তাই গুরুদেবের সঙ্গে পরামর্শ করে আমি স্থির করেছি, সীমান্ত থেকে রাজ্যের পর রাজ্য জয় করতে করতে ধীরে ধীরে অগ্রসর হব পাটলিপুত্রের দিকে৷ আমি নির্বোধ, তাই প্রথমেই রাজধানী আক্রমণ করতে গিয়ে শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছিলাম৷’
সুবন্ধু উৎফুল্ল কন্ঠে বলে উঠল, ‘মহারাজা চন্দ্রগুপ্তের জয় হোক! মহাপুরুষ বিষ্ণুগুপ্ত ঠিক পরামর্শ দিয়েছেন! তাহলে প্রথমেই আপনি কোথায় যাবেন স্থির করেছেন?’
‘পঞ্চনদের দেশে সবচেয়ে শক্তিশালী পুরুষ হচ্ছেন মহারাজা পুরু৷ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, একবার পরাজিত হলেও মহারাজা পুরু স্বাধীন হবার সুযোগ কখনো ত্যাগ করবেন না৷ আমি প্রথমেই তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করব৷’
‘আপনি প্রার্থনা করবেন কী, আপনার সাহায্য প্রার্থনা করবার জন্যেই তো মহারাজা পুরু আমাকে মগধে যেতে আদেশ দিয়েছেন! মহারাজের বিশ্বাস, মগধের রাজা এখন আপনি৷’
‘তবেই তো সুবন্ধু, তুমি যে আমায় সমস্যায় ফেললে! মহারাজা পুরু যখন শুনবেন, আমি যুদ্ধে পরাজিত, তখন আর কি আমার সঙ্গে যোগ দিতে ভরসা করবেন?’
সুবন্ধু উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, ‘ভরসা করবেন না? তাহলে আপনি চেনেন না মহারাজ পুরুকে? সিংহ কবে শৃঙ্খলে বন্দি হতে চায়? আলেকজান্ডার আমাদের মহারাজকে বিশ্বাস করেন না৷ তিনি ভালো করেই জানেন, পুরুষসিংহ পুরুর তরবারি গ্রিকদের রক্তপাত করবার আগ্রহে অধীর হয়ে আছে! তাই নিহত নিকানরের জায়গায় তিনি সেনাপতি ফিলিপকে নিযুক্ত করে আদেশ দিয়েছেন যে, মহারাজা পুরুর উপরে তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখতে৷ গ্রিকদের দাসত্ব করা মহারাজার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে৷ কিন্তু তিনি একা কী করতে পারেন? উত্তর-ভারত ছেয়ে গেছে গ্রিকে গ্রিকে৷ ভারতের সোনার ভাণ্ডার লুন্ঠন করবার জন্যে নিত্য নূতন গ্রিক এসে এখানে বাসা বাঁধছে! তারা খেলার পুতুলের মতো নাচাচ্ছে তক্ষশীলা আর অভিসারের রাজাকে৷ তারা যবনদের সেবা করেই খুশি হয়ে আছেন! কিন্তু উত্তর-ভারতের অন্যান্য ছোটো ছোটো রাজারা বিদ্রোহের জন্যে প্রস্তুত- কেউ কেউ ইতিমধ্যেই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন৷ তবে এ-বিদ্রোহ সফল হবে না, যদি কোনো নেতা এসে সবাইকে একতার বাঁধনে বাঁধতে না পারে৷’
চন্দ্রগুপ্ত আচম্বিতে তাঁর অসি কোষমুক্ত করে ঊর্ধ্বে তুলে পরিপূর্ণ স্বরে বললেন, ‘তাহলে নেতার পদ গ্রহণ করব আমি সুবন্ধু, আমি নিজেই! আলেকজান্ডারকে আমি দেখাতে চাই, ভীমার্জুনের স্বদেশে আজও বীরের অভাব হয়নি!’
সুবন্ধু বিষণ্ণ ভাবে মাথা নেড়ে বলল, ‘জানি মহারাজ, ভারতে আপনার মতো দু-চারজন বীরের তরবারিতে এখনও মরচে পড়েনি৷ কিন্তু দু-চারজনের তরবারি কি ভারতের শৃঙ্খল ভাঙতে পারবে?’
চন্দ্রগুপ্ত প্রান্তরের পূর্বদিকে অসি খেলিয়ে দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘দু-চারজন বীর নন সুবন্ধু, ওদিকে দৃষ্টিপাত করো! আমি পরাজিত বটে, কিন্তু আজ আর সম্বলহীন নই! চেয়ে দেখো, আমি কত বীর নিয়ে ভারতকে স্বাধীন করতে চলেছি৷’
এতক্ষণ সুবন্ধু ওদিকে তাকাবার অবসর পায়নি৷ এখন ফিরে তাকিয়ে সবিস্ময়ে দেখল, কুরুক্ষেত্রের বিপুল প্রান্তরের পূর্বপ্রান্ত পরিপূর্ণ হয়ে গেছে অগণ্য সৈন্যে সৈন্যে! হাজার হাজার সৈন্য প্রান্তরের উপরে এসে দাঁড়িয়েছে এবং আরও হাজার হাজার সৈন্য এখনও অরণ্যের ভিতর থেকে দলে দলে বেরিয়ে আসছে-যেন তাদের শেষ নেই!
চন্দ্রগুপ্ত গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘আমাদের সঙ্গে যদি যোগ দেয় মহারাজা পুরুর সৈন্যদল, তাহলে কি আমরা ভারতকে আবার স্বাধীন করতে পারব না?’
সুবন্ধু জানু পেতে আবার চন্দ্রগুপ্তের পদতলে বসে পড়ে অভিভূত স্বরে চিৎকার করে উঠল, ‘জয়, স্বাধীন ভারতের জয়! জয়, মহারাজ চন্দ্রগুপ্তের জয়!’
তার দুই চোখ ভরে গেল বিপুল আনন্দের অশ্রুজলে!
দশম পরিচ্ছেদ – বিশ্বাসঘাতকের মৃত্যুফাঁদ
মহাভারতের রক্তে রাঙা কুরুক্ষেত্র! ভীষ্ম-দ্রোণের ধনুকের টংকার, যুধিষ্ঠিরের শান্ত বাণী, ভীমার্জুনের সিংহনাদ, দুর্যোধনের হুংকার, শ্রীকৃষ্ণের চালিত যুদ্ধরথের ঘর্ঘর ধ্বনি, গান্ধারী সুভদ্রা ও উত্তরার পাথর-গলানো করুণ আর্তনাদ কত কাল আগে স্তব্ধ হয়েছে, এ-বিপুল প্রান্তর কতকাল ধরে জনশূন্য স্মৃতির মরুভূমির মতো পড়ে ছিল!
আজ আবার সেখানে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে মুক্ত জনতার কলকন্ঠ৷ একদিন এই কুরুক্ষেত্রে গিয়ে গৃহবিবাদে মত্ত হয়ে মহা মহা বীররা করেছিলেন স্বেচ্ছায় ভারতের ক্ষাত্রবীর্যের সমাধি রচনা, কিন্তু আজ সেই সমাধির মধ্যেই আবার জাগ্রত হয়েছে ভারতের চিরপুরাতন কিন্তু চিরনূতন আত্মা, হিন্দুস্থানকে যবনের কবল থেকে মুক্ত করবার জন্যে৷
শিবিরের পর শিবিরের সারি, প্রত্যেক শিবিরের উপরে উড়েছে রক্তপতাকার পর রক্তপতাকা! শত শত রথ, অসংখ্য হস্তী, দলে দলে অশ্ব! কোথাও চলেছে রণবাদ্যের মহলা, কোথাও হচ্ছে অস্ত্রক্রীড়া এবং কোথাও বসেছে গল্পগুজব বা পরামর্শের সভা!
এই প্রকাণ্ড শিবির-নগরের ঠিক মাঝখানে রয়েছে মস্ত বড়ো এক তাঁবু-তাকে তাঁবু না বলে কাপড়ে তৈরি প্রাসাদ বললেই ঠিক হয়! তার উপরে উড়ছে ময়ূর আঁকা বৃহৎ এক পতাকা, মৌর্য বংশের নিজস্ব নিদর্শন!
সেই বিচিত্র শিবির-প্রাসাদের সবচেয়ে বড়ো কক্ষে আজ রাজসভার বিশেষ এক অধিবেশন৷ দ্বারে দ্বারে সতর্ক প্রহরীরা তরবারি বা বর্শা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে জীবন্ত মূর্তির মতো৷ শতাধিক সভাসদ যথাযোগ্য আসনে নীরবে বসে আছেন৷ মাঝখানে উচ্চাসনে উপবিষ্ট চন্দ্রগুপ্ত৷ তাঁর পাশে আর একটি উচ্চাসন, কিন্তু শূন্য৷
হঠাৎ প্রধান প্রবেশপথ থেকে প্রহরীরা সসম্ভ্রমে দুই পাশে সরে গেল এবং সভার মধ্যে ধীরচরণে গম্ভীর মুখে প্রবেশ করলেন এক শীর্ণদেহ গৌরবর্ণ ব্রাহ্মণ! তাঁর মুণ্ডিত মস্তক, উন্নত প্রশস্ত ললাট, দুই চক্ষু বিদ্যুৎ-বর্ষী, গোঁফ-দাড়ি কামানো, ওষ্ঠাধর দৃঢ়-সংবদ্ধ, পরিধানে পট্টবস্ত্র ও উত্তরীয়, পায়ে কাষ্ঠ-পাদুকা৷ তাঁর ভাবভঙ্গি এমন অসাধারণ ব্যক্তিত্বময় যে, তাঁকে দেখলেই মাথা যেন আপনি নত হয়ে পড়ে৷ ইনিই হচ্ছেন ভারতের চিরস্মরণীয় চাণক্য (কৌটিল্য বা বিষ্ণুগুপ্ত)!
সভাস্থ সকলেই ভূমিতলে দণ্ডবৎ হয়ে প্রণাম করলেন৷ হাত তুলে সকলকে আশীর্বাদ করে চাণক্য অগ্রসর হয়ে চন্দ্রগুপ্তের পাশের আসনে গিয়ে বসলেন৷
একবার সভার চারিদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করে চাণক্য বললেন, ‘চন্দ্রগুপ্ত, তুমি আজ আমায় আবার সভায় আহ্বান করেছ কেন?’
চন্দ্রগুপ্ত বললেন, ‘গুরুদেব, আজ একমাস ধরে আমরা অলস হয়ে এখানে বসে আছি!’
চাণক্যের দুই ভুরু সংকুচিত হল৷ কিন্তু তিনি শান্ত স্বরেই বললেন, ‘জানি চন্দ্রগুপ্ত৷ একমাস কেন, দরকার হলে আমাদের দুই মাস ধরে এইখানেই বসে থাকতে হবে৷ সুবন্ধু এখনও পুরুর কাছ থেকে ফিরে আসেনি!’
চন্দ্রগুপ্ত বললেন, ‘কিন্তু সুবন্ধু যখন এতদিনেও ফিরল না, তখন আমার সন্দেহ হচ্ছে যে মহারাজা পুরু নিজের মত পরিবর্তন করেছেন!’
চাণক্য গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘না! তাহলেও সুবন্ধু এতদিনে ফিরে এসে আমাদের সে-খবর দিত৷ আমার বিশ্বাস, মহারাজা পুরু ভালো করে প্রস্তুত হচ্ছেন বলেই সুবন্ধু এখনও অপেক্ষা করছে৷ পুরুর চারিদিকেই সতর্ক গ্রিকদের পাহারা, তার মধ্যে গোপনে প্রস্তুত হতে গেলে যথেষ্ট সময়ের দরকার৷ পুরু যতদিন না বিদ্রোহ ঘোষণা করেন ততদিন-‘
চাণক্যের কথা শেষ হবার আগেই সভার দ্বারপথের কাছে একটা গোলমাল উঠল৷ তারপরেই দেখা গেল, দুই হাতে প্রহরীদের ঠেলে সভার ভিতর ছুটে এল ধূলি-ধূসরিত দেহে সুবন্ধু!
চন্দ্রগুপ্ত ব্যগ্র কন্ঠে বলল, ‘এই যে সুবন্ধু!’
সুবন্ধু চিৎকার করে বলল ‘মহারাজ! বিশ হাজার গ্রিক সৈন্য আর ত্রিশ হাজার ভারতীয় সৈন্য নিয়ে শশীগুপ্ত আপনাকে আক্রমণ করতে আসছে! প্রস্তুত হন, শীঘ্র প্রস্তুত হন!’
চন্দ্রগুপ্ত সচকিতভাবে আসন থেকে নেমে পড়লেন, সভাসদরা সবিস্ময়ে উঠে দাঁড়ালেন- অটল মূর্তির মতো নিজের আসনে বসে রইলেন কেবল চাণক্য৷
চন্দ্রগুপ্ত উচ্চস্বরে ডাকলেন, ‘সেনাপতি!’
সেনাপতি এগিয়ে এসে অভিবাদন করে বললেন, ‘আদেশ দিন মহারাজ!’
‘এখনই তুর্যধ্বনি করে-‘
চাণক্য বাধা দিয়ে তেমনি শান্ত স্বরেই বললেন, ‘একটু অপেক্ষা করো চন্দ্রগুপ্ত, অতটা ব্যস্ত হয়ো না৷ সুবন্ধু, মহারাজা পুরুর খবর কী?’
সুবন্ধু উৎফুল্ল স্বরে বলল, ‘আচার্য, মহারাজা পুরু বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন, তাঁর রাজধানী থেকে গ্রিকরা বিতাড়িত হয়েছে৷ মহারাজা নিজে সসৈন্যে আপনাদের সঙ্গে যোগ দেবার জন্যে দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছেন-আমি তাঁরই অগ্রদূত!’
চাণক্য বললেন, ‘শশীগুপ্ত এ সংবাদ জানে?’
‘মহারাজের বিদ্রোহের খবর পেয়েই চতুর শশীগুপ্তও গ্রিকদের নিয়ে আপনাদের আক্রমণ করতে আসছে!’
চাণক্য অল্পক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ‘বুঝেছি৷ শশীগুপ্ত চায় আলেকজান্ডারের পদ্ধতি অবলম্বন করতে৷ অর্থাৎ সে আগে আমাদের ধ্বংস করবে, তারপর আক্রমণ করবে মহারাজা পুরুকে৷’
চন্দ্রগুপ্ত অধীর স্বরে বললেন, ‘আদেশ দিন গুরুদেব, আমরা সজ্জিত হই৷’
সে-কথা কানে না তুলে চাণক্য বললেন, ‘আচ্ছা সুবন্ধু, শশীগুপ্ত বোধ হয় এখনও জানতে পারেনি যে, মহারাজা পুরুও এইদিকে আসছেন?’
‘না আচার্য, শশীগুপ্ত এ-পথে যাত্রা করবার দু-দিন পরে আমাদের মহারাজা রাজধানী থেকে বেরিয়েছেন, সুতরাং মহারাজা আসবার আগেই শশীগুপ্ত এখানে এসে পড়বে৷’
‘শশীগুপ্ত এখন কত দূরে আছে?’
‘তাদের আর আমাদের মাঝখানে আছে মাত্র এক দিনের পথ৷’
‘তাহলে চন্দ্রগুপ্ত, কালকেই তোমার সঙ্গে শশীগুপ্তের দেখা হবে৷’
চন্দ্রগুপ্ত দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘আদেশ দিন গুরুদেব, আমরাই এগিয়ে গিয়ে শশীগুপ্তকে আক্রমণ করি৷ সেনাপতি-‘
চাণক্য ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, ‘চন্দ্রগুপ্ত, বালকের মতো ব্যস্ত হয়ো না৷ এই ব্যস্ততার জন্যই তুমি একবার মগধ আক্রমণ করতে গিয়ে পরাজিত হয়েছ, কিন্তু এবারের সুযোগ ত্যাগ করলে আর কোনোদিন তুমি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না৷’
চন্দ্রগুপ্ত কুন্ঠিত স্বরে বললেন, ‘গুরুদেব, এ সুযোগ, না দুর্যোগ?’
‘সুযোগ চন্দ্রগুপ্ত, দুর্লভ সুযোগ! মহা-ভাগ্যবানের জীবনেও এমন সুযোগ একবারমাত্রই আসে৷’
‘ক্ষমা করবেন গুরুদেব, আপনার কথার অর্থ আমি বুঝতে পারছি না! আমার অধীনে সৈন্য আছে মোটে পঁয়ত্রিশ হাজার, আর শশীগুপ্ত আক্রমণ করতে আসছে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য নিয়ে৷ এটা কি বিপদের কথা নয়?’
চাণক্য সস্নেহে চন্দ্রগুপ্তের মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘বৎস, আশ্বস্ত হও৷ চিন্তার কোনোই কারণ নেই৷ সুবন্ধু, মহারাজা পুরুর অধীনে কত সৈন্য আছে?’
‘গ্রিকদের অধীনতা স্বীকার করবার পর মহারাজা পুরুর রাজ্য আর লোকসংখ্যা অনেক বেড়েছে৷ ইচ্ছা করলে তিনি এখন আশি হাজার সৈন্য নিয়ে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে পারেন৷’
‘তিনি আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসছেন কত সৈন্য নিয়ে?’
‘চল্লিশ হাজার৷’
‘শুনছ চন্দ্রগুপ্ত?’
কিছুমাত্র উৎসাহিত না হয়ে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, ‘শুনে কী লাভ গুরুদেব? মহারাজা হস্তীর সঙ্গেও মহারাজা পুরু যদি মিলতে পারতেন, তাহলে আজ ভারতের মাটিতে গ্রিকদের পদচিহ্ন পড়ত না৷ এবারেও মহারাজা পুরু আসবার আগেই অসংখ্য শত্রুর চাপে আমরা মারা পড়ব৷ সেইজন্যেই আমি এগিয়ে গিয়ে ব্যুহ রচনা করবার আগেই শত্রুদের আক্রমণ করতে চাই৷ কিন্তু দেখছি, আপনার ইচ্ছা অন্যরকম৷’
চাণক্য আবার সুবন্ধুর দিকে ফিরে বললেন, ‘মহারাজ পুরু শশীগুপ্তের খবর রাখেন তো?’
‘সেই খবর পেয়েই তো তিনি শশীগুপ্তের চেয়েও দ্রুতগতিতে ছুটে আসছেন!’
চাণক্যের দুই চক্ষে আগুন জ্বলে উঠল! এতক্ষণ পরে আসন ছেড়ে নেমে দাঁড়িয়ে তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘চন্দ্রগুপ্ত! এই ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে আমি বিশ হাজার গ্রিক দস্যু আর ত্রিশ হাজার বিশ্বাসঘাতক ভারতবাসীর মৃত্যুশয্যা রচনা করব-আর তাদের রক্ষে নেই!’
‘গুরুদেব!’
‘যাও চন্দ্রগুপ্ত, সৈন্যদের সজ্জিত হবার জন্যে আদেশ দাও৷ অর্ধচন্দ্র ব্যুহ রচনা করে উচ্চভূমির উপরে শত্রুদের জন্য অপেক্ষা করো!’
‘অপেক্ষা করব?’
‘হাঁ, আক্রমণ করবে না, অপেক্ষা করবে৷ পথশ্রমে ক্লান্ত শত্রুরা কাল এসে দেখবে, তোমরা যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত! সে-অবস্থায় কাল তারা নিশ্চয়ই আক্রমণ করতে সাহস করবে না৷ তারা আগে বিশ্রাম আর ব্যুহ রচনা করবে৷ পরশুর আগে যুদ্ধ হওয়া অসম্ভব!’
‘তারপর?’
‘তারপর তাদেরই আগে আক্রমণ করবার সুযোগ দিয়ো, তোমরা করবে কেবল আত্মরক্ষা! শত প্রলোভনেও উচ্চভূমি ছেড়ে নীচে নামবে না৷ যদি এক দিন কাটিয়ে দিতে পারো-‘
হঠাৎ চন্দ্রগুপ্তের মুখ সমুজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ তীক্ষ্ণবুদ্ধি চাণক্যের চরণতলে বসে পড়ে বিপুল আনন্দে তিনি বললেন, ‘গুরুদেব, গুরুদেব! আমি মূর্খ, তাই এতক্ষণ আপনার উদ্দেশ্য বুঝতে পারিনি৷ পরশু দিন যদি আমরা আত্মরক্ষা করতে পারি, তাহলেই তার পরদিন মহারাজা পুরু এসে পড়ে পিছন থেকে শত্রুদের আক্রমণ করবেন! তারপর পঁচাত্তর হাজার ভারতসৈন্যের কবলে পড়ে-‘
সুবন্ধু আনন্দে যেন নাচতে নাচতে বলে উঠল, ‘ধন্য আচার্যদেব, ধন্য! এ যে অপূর্ব মূত্যু-ফাঁদ!’
চন্দ্রগুপ্তের নত মাথার উপরে দুই হাত রেখে চাণক্য অশ্রুভারাক্রান্ত কন্ঠে বললেন, ‘আজ আমার কাঁদতে ইচ্ছা করছে চন্দ্রগুপ্ত! বৎস, সেই দিনের কথা মনে করো! তোমার পিতা যুদ্ধে মৃত, তোমার বিধবা মাতা কুসুমপুরে (পাটলিপুত্রে) নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন৷ গরিবের ছেলের মতো পথে পথে তুমি খেলা করে বেড়াচ্ছিলে, সেই সময়ে তোমার সঙ্গে আমার দেখা৷ তোমার ললাটে রাজচিহ্ন আর তোমার মুখে প্রতিভার জ্যোতি দেখে তোমার পালক-পিতার কাছ থেকে আমি তোমাকে ক্রয় করি৷ তারপর জন্মভূমি তক্ষশীলায় নিয়ে এসে তোমাকে আমি নিজের মনের মতো শিক্ষা-দীক্ষা দিই৷ মৌর্য রাজপুত্র! এইবার তোমার গুরুদক্ষিণা দেবার মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হয়েছে! আমি চাই ভারতের স্বাধীনতা! আমি চাই অখণ্ড ভারত সাম্রাজ্য! আমি চাই হিন্দু ভারতবর্ষ! আসন্ন যুদ্ধে তোমার জয় সুনিশ্চিত! এই একটিমাত্র যুদ্ধজয়ের ফলে সারা ভারতবর্ষে আর কেউ তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে সাহস করবে না, তোমার সামনে খুলে যাবে মগধের দুর্গদ্বার৷ ওঠো বৎস, অস্ত্রধারণ করো!’
একাদশ পরিচ্ছেদ – যুদ্ধ
আবার কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ!
মৃত্যু-উৎসবে আজ বাজছে ভেরি, বাজছে তুরি, বাজছে শিঙা, বাজছে কত শঙ্খ! রণোন্মত্ত অশ্বদলের হ্রেষা, মদমত্ত হস্তীযূথের বৃংহতি এবং সেইসঙ্গে মহা ঘর্ঘর রব তুলে ও রক্তসিক্ত রাঙা কর্দমে দীর্ঘ রেখা টেনে বেগে ছুটছে যুদ্ধরথের পর যুদ্ধরথ! নীলাকাশের বুকে মূর্তিমান অমঙ্গলের ইঙ্গিতের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে শকুনি উড়তে উড়তে পৃথিবীর দিকে ক্ষুধিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখছে, কুরুক্ষেত্রের ধু-ধু-ধু প্রান্তর জুড়ে সূর্যকরের বিদ্যুৎ সৃষ্টি করেছে হাজার হাজার শাণিত তরবারি, ভল্ল, কুঠার, খড়্গ ও লক্ষ লক্ষ তিরের ফলা! থরথর কাঁপছে ধরণীর প্রাণ প্রায় লক্ষ যোদ্ধার প্রচণ্ড পদভারে৷ ধনুক-টংকারের তালে তালে জাগছে খড়্গে খড়্গে চুম্বনরব, বীরের হুংকার, সাহসীর জয়ধ্বনি, ক্রুদ্ধের চিৎকার, সেনাধ্যক্ষের উচ্চ আদেশবাণী, আহতের আর্তনাদ, কাপুরুষের ক্রন্দন! সেই দুই বিপুল বাহিনীর কোনো অংশ ফিরছে বামদিকে, কোনো অংশ ফিরছে ডানদিকে,-অনন্ত জনতা সাগরে যেন তরঙ্গদল উচ্ছ্বসিত আবেগে জেগে উঠছে ও ভেঙ্গে পড়ছে!
সেদিনের যুদ্ধের সঙ্গে আজকের যুদ্ধের কিছুই মেলে না৷ আজকের যুদ্ধ হচ্ছে যন্ত্রের যুদ্ধ এবং মানুষের ব্যক্তিগত বীরত্বকে ধর্তব্যেরই মধ্যে গণ্য করে না! আজকের সৈন্যরা লড়াই করে যেন বাতাসের সঙ্গে! নানা যন্ত্র কর্ণভেদী নানা কোলাহল তুলে ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় মানুষের দৃষ্টি দিল অন্ধ করে,-প্রতিদ্বন্দ্বিরা কেউ কারুকে চোখেও দেখল না, কিন্তু আহত ও হত দেহের রক্তে রণস্থল গেল আচ্ছন্ন হয়ে এবং যুদ্ধ হল শেষ৷ মানুষের বীরত্বের উপর স্থান পেয়েছে আজ যন্ত্রের শক্তি৷ যে পক্ষের যন্ত্র দুর্বল, হাজার হাজার মহাবীর আত্মদান করেও বাঁচতে পারবে না সে-পক্ষকে৷
নিজের পঁয়ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে উচ্চভূমির উপরে চন্দ্রগুপ্ত যে-অর্ধচন্দ্র ব্যুহ রচনা করেছিলেন, আজ প্রায় সারাদিন ধরে অর্ধ লক্ষ ভারতের শত্রু তা ভেদ করবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করেছে! ব্যুহের সামনে হাজার হাজার মৃতদেহের উপরে মৃতদেহ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠছে,-সেখানে শত্রু-মিত্র একাকার হয়ে গিয়ে সৃষ্ট হয়েছে যেন মৃত নরদেহ দিয়ে গড়া অপূর্ব ও ভীষণ এক দুর্গ-প্রাচীর!
গ্রিক সেনাপতি ও শশীগুপ্ত পাশাপাশি দুই ঘোড়ার উপরে বসে যুদ্ধের গতি নিরীক্ষণ করছিলেন৷
গ্রিক সেনাপতি ঊর্ধ্বদিকে তাকিয়ে দেখলেন, সূর্য জ্বলছে পশ্চিম আকাশে৷
শশীগুপ্তকে নিজের ভাষায় ডেকে তিনি বললেন, ‘সিসিকোটাস! বেলা পড়ে এল৷ যুদ্ধ আজ বোধ হয় শেষ হবে না৷’
শশীগুপ্ত বললেন, ‘সংখ্যায় আমাদের চেয়ে অনেক কম বলে শত্রুরা প্রতি আক্রমণ না করে কেবল আত্মরক্ষাই করছে৷ ওরা উঁচু জমির উপরে না থাকলে এতক্ষণে যুদ্ধ শেষ হয়ে যেত৷’
সেনাপতি দৃঢ় স্বরে বললেন, ‘কিন্তু এ-যুদ্ধ আজকেই শেষ করতে চাই৷’
‘কী করে সেনাপতি?’
‘আমাদের ডানপাশে আর বাঁ-পাশে যত গজারোহী অশ্বারোহী আর রথারোহী সৈন্য আছে, সবাইকে মাঝখানে এনে এইবারে আমরা শত্রু ব্যুহের মধ্যভাগ আক্রমণ করব৷’
‘কিন্তু সেনাপতি, তাহলে আমাদের দুই পাশ যে দুর্বল হয়ে পড়বে!’
‘পড়ুক৷ বীর গ্রিকদের কাপুরুষ ভারতবাসীরা ভয় করে৷ ওরা নিশ্চয়ই আমাদের প্রতি আক্রমণ করবে না৷’
* * *
উচ্চভূমির উপরে হাতির পিঠে চাণক্য স্থির হয়ে বসেছিলেন পাথরের মূর্তির মতো৷ তাঁর মুখও স্থির মুখোশের মতো, মনের কোনো ভাবই তা প্রকাশ করে না!
হঠাৎ সুবন্ধু বেগে ঘোড়া চালিয়ে চাণক্যের হাতির পাশে এসে ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠল, ‘গুরুদেব! গুরুদেব!’
‘বৎস?’
‘শত্রুদের সমস্ত গজারোহী আর অশ্বারোহী রথারোহী সৈন্য মাঝখানে এসে আমাদের আক্রমণ করবার উদ্যোগ করছে৷’
‘সেটা আমি দেখতেই পাচ্ছি!’
‘শত্রুদের ব্যুহের দুইপাশ এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে৷ এখন যদি আমাদের রথ, গজ আর অশ্ব শত্রুদের ব্যুহের দুই পাশ আক্রমণ করে, তাহলে-‘
বাধা দিয়ে চাণক্য বললেন, ‘তাহলে আমাদের সুবিধা হতেও পারে, না হতেও পারে৷ সংখ্যায় আমরা কম-শত্রুদের ঘিরে ফেলবার বা সহজে কাবু করবার শক্তি আমাদের নেই৷ এ সময়ে আমাদের ব্যুহ বিশৃঙ্খল হলে ভালো হবে না৷ আমরা কেবল এইখানে দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষাই করব৷’
‘তবে কি শত্রুদের ঠেকাবার জন্যে আমরাও সমস্ত রথ, গজ আর অশ্বকে মাঝখানে এনে হাজির করব?’
চাণক্যের ওষ্ঠাধারে ফুটল অল্প হাসির আভাস! বললেন, ‘সুবন্ধু, তুমি বীর বটে, কিন্তু যুদ্ধ-রীতিতে নিতান্ত কাঁচা! তোমার কথামতো কাজ করলে আমাদেরও দুই পাশ দুর্বল হয়ে পড়বে আর সংখ্যায় বলিষ্ঠ শত্রুরা আমাদের ঘিরে ফেলবে চারিদিক থেকে!’
‘কিন্তু গুরুদেব, শত্রুদের অত রথ, গজ আর অশ্ব যদি আমাদের ব্যুহের মাঝখানে একত্রে আক্রমণ করে, তাহলে আর কি আমরা আত্মরক্ষা করতে পারব?’
পারব সুবন্ধু, পারব,-অন্তত আজকের জন্যে আমরা আত্মরক্ষা করতে পারব৷ ওই শোনো, রণকুশল চন্দ্রগুপ্তের শব্দসংকেত! ওই দেখো, আমাদের যে পাঁচ হাজার সর্বশ্রেষ্ঠ সৈন্য এতক্ষণ যুদ্ধে যোগ না দিয়ে পিছনে অপেক্ষা করছিল, এইবার তারাও ব্যুহের মধ্যভাগ রক্ষা করতে এগিয়ে আসছে! আরও দেখো, চন্দ্রগুপ্তের আদেশে আমাদের ধনুকধারী সৈন্যেরা ইতিমধ্যেই মাঝখানে এসে প্রস্তুত হয়েছে! সাধু চন্দ্রগুপ্ত, সাধু! তুমি মিথ্যা আমার শিষ্যত্ব গ্রহণ করনি৷’
তবু সুবন্ধুর সন্দেহ ঘুচল না৷ দ্বিধাভরে সে বলল, ‘কিন্তু-‘
‘মূর্খ, এর মধ্যে আর কোনো ‘কিন্তু’ নেই! আমরা আছি উচ্চভূমির উপরে৷ শত্রুদের রথ, গজ আর অশ্ব এর উপরে দ্রুতগতিতে উঠতে পারবে না৷ আমাদের ধনুকধারীরা সহজেই দূর থেকে তাদের প্রতি লক্ষ্য স্থির রাখতে পারবে৷ তির এড়িয়ে যারা কাছে এসে পড়বে, তাদের বাধা দেবে আমাদের নূতন, অক্লান্ত, শ্রেষ্ঠ সৈন্যদল৷ সুবন্ধু, আকাশের দিকে চেয়ে দেখো! বেলা আছে আর অর্ধপ্রহর মাত্র! এই সময়টুকু কাটিয়ে দিতে পারলেই সন্ধ্যার অন্ধকারে চারিদিক ছেয়ে যাবে- আমরাও সময় পাব আরও একরাত্রি! তারপর ভরসা তোমাদের রাজা পর্বতক!’*
গ্রিক সেনাপতি বিরক্ত মুখে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিলেন, সাগর শৈলের তলদেশে গিয়ে অনন্ত সাগরের প্রচণ্ড তরঙ্গদল যেমন বিষম আবেগে ভেঙে পড়ে আবার ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে বারংবার, তাঁর গজারোহী রথারোহী ও অশ্বারোহীর দল তেমনি ভাবেই উচ্চভূমির উপরে উঠতে গিয়ে প্রতি বারেই মারাত্মক বাধা পেয়ে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে! সারথি, যোদ্ধা ও অশ্বহীন কত রথ নিশ্চল হয়ে গ্রিক সৈন্যদলের সামনে বাধা সৃষ্টি করছে, হিন্দুদের অব্যর্থ তিরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে কত হস্তী পাগলের মতো পালিয়ে এসে স্বপক্ষেরই মধ্যে ছুটাছুটি করে শত শত গ্রিক সৈন্যকে পায়ের তলায় থেতলে মেরে ফেলেছে! হিন্দু ব্যুহ দুর্ভেদ্য!
পশ্চিম গগনের অস্তাচলগামী সূর্যের পানে তাকিয়ে শশীগুপ্ত হতাশভাবে বললেন, ‘সেনাপতি, আজ যুদ্ধ শেষ হওয়া অসম্ভব!’
মাথা নেড়ে তিক্ত কন্ঠে গ্রিক সেনাপতি বললেন, ‘না সিসিকোটাস আজ আমি অসম্ভবকেও সম্ভব করতে চাই! বর্বর ভারত আজও ভালো করে গ্রিক বীরত্বের পরিচয় পায়নি! তুমি এখনই আমার আদেশ চারিদিকে প্রচার করে দাও! আমার ফৌজের ডান পাশ আর বাঁ পাশও একসঙ্গে অগ্রসর হোক! সর্বদিক দিয়ে আক্রমণ করো, শত্রুদের একেবারে ঘিরে ফেলো!’
সেনাপতির মুখের কথা শেষ হতে না হতেই দেখা গেল, একজন গ্রিক সেনানী ঘোড়ায় চড়ে বেগে কাছে এসে দাঁড়াল৷
সেনাপতি বলেন, ‘কী আরিস্টোনটেস? তোমার মুখ মাছের তলপেটের মতো সাদা কেন? তোমার চোখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি ভয়ানক ভয় পেয়েছ৷ গ্রিক সেনানীর চোখে ভয়! ব্যাপার কী?’
সেনানী চিৎকার করে বলল, ‘নতুন শত্রু৷ নতুন শত্রু!’
সেনাপতি কর্কশ স্বরে বললেন, ‘অ্যারিস্টোনটেস, আমি অন্ধ নই! হিন্দু বর্বরেরা যে নতুন সৈন্যদল নিয়ে আমাদের বাধা দিচ্ছে, সেটা আমি দেখতেই পাচ্ছি!’
সেনানী আবার চিৎকার করে বলল, ‘ওদিকে নয়-ওদিকে নয়! আমাদের পিছন দিকে তাকিয়ে দেখুন৷’
সচমকে ঘোড়া ফিরিয়ে সেনাপতি মহা বিস্ময়ে দেখলেন, কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে যেখানে গ্রিক সৈন্যরেখা শেষ হয়েছে সেখান থেকে আরও খানিক দূরে আত্মপ্রকাশ করেছে, মস্ত একদল পল্টন৷ দেখতে দেখতে প্রান্তরের শূন্যতা অধিকতর পূর্ণ হয়ে উঠছে এবং সেই বিপুল বাহিনীর আকার হয়ে উঠছে বৃহত্তর! সেই বহুদূরব্যাপী সৈন্যস্রোতের যেন শেষ নেই!
রুদ্ধশ্বাসে সেনাপতি বললেন, ‘সিসিকোটাস, ওরা কারা?-শত্রু না মিত্র?’
শশীগুপ্ত স্তম্ভিত কন্ঠে বললেন, ‘সেনাপতি, ওরা আমাদের মিত্র নয়! দেখছেন না, ওদের মাথার উপরে উড়ছে মহারাজা পুরুর পতাকা?’
দাঁতে দাঁত ঘষে তীব্র স্বরে সেনাপতি বললেন, ‘বিশ্বাসঘাতক পোরাস!’
শশীগুপ্ত সভয়ে বললেন, ‘দেখুন সেনাপতি! আমাদের পিছনের সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে শুরু করেছে! আবার এদিকেও দেখুন, চন্দ্রগুপ্তের ব্যুহের দুই পাশ থেকে রথারোহী গজারোহী আর অশ্বারোহীর দলও অগ্রসর হয়ে আমাদের দুই পাশ আক্রমণ করতে আসছে৷ আমরা ফাঁদে ধরা পড়েছি-আর আমাদের বাঁচোয়া নেই!’
নিষ্ফল আক্রোশে কপালে করাঘাত করে গ্রিক সেনাপতি বললেন, ‘মূর্খ, আমরা হচ্ছি মূর্খ! এইবারে বুঝলাম, ওই ভারতীয় বর্বররা কেন এতক্ষণ ধরে কেবল আমাদের আক্রমণ সহ্য করছিল৷ ওরা এতক্ষণ ধরে পোরাসেরই অপেক্ষায় ছিল৷ ওরা জানত পোরাস আসছে আমাদের পিছনদিক আক্রমণ করতে! এর জন্যে তুমিই দায়ী সিসিকোটাস! কেন তুমি পোরাসের গতিবিধির উপরে দৃষ্টি রাখবার জন্যে গুপ্তচর নিযুক্ত করে আসনি?’
শশীগুপ্ত বললেন, ‘সেনাপতি, আমার গুপ্তচর আছে অসংখ্য! কিন্তু মহারাজা পুরু যদি তাদের চেয়েও চতুর ও দ্রুতগামী হন, তাহলে আমি কী করতে পারি বলুন?’
সেনানী আরিস্টোনটেস ব্যাকুল স্বরে বলল, ‘সেনাপতি, আমাদের সামনের সৈন্যরাও পালিয়ে যাচ্ছে যে!’
সেনাপতি শূন্যে তরবারি তুলে উচ্চকন্ঠে বললেন, ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও গ্রিক সৈন্যগণ! শৃগালের ভয়ে সিংহ কোনোদিন পালিয়ে যায় না! ভুলে যেয়ো না, তোমরা গ্রিক! যদি মরতে হয়, গ্রিকদের মতো লড়তে লড়তেই প্রাণ দাও৷’
শশীগুপ্ত বললেন, ‘কেউ আর আপনার কথা শুনবে না সেনাপতি, বৃথাই চিৎকার করছেন! আসুন, আমরাও রণক্ষেত্র ত্যাগ করি৷’
ভীষণ গর্জন করে গ্রিক সেনাপতি বললেন, ‘স্তব্ধ হও! আমি তোমার মতো দেশদ্রোহী দুরাত্মা নই, তুচ্ছ প্রাণের ভয়ে পালিয়ে গিয়ে গ্রিসের নাম কলঙ্কিত করব না!’
নীরস হাসি হেসে শশীগুপ্ত বললেন, ‘তাহলে আপনি তাড়াতাড়ি স্বর্গে যাবার চেষ্টা করুন, কিন্তু আমি আরও কিছুদিন পৃথিবীর সুখ ভোগ করতে চাই’-এই বলেই তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে অন্যান্য পলাতকদের দলের ভিতরে মিলিয়ে গেলেন!
আর গ্রিক সেনাপতি? তিনি সদর্পে, উন্নত শিরে, অটলভাবে অশ্বচালনা করলেন চন্দ্রগুপ্তের পতাকার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে৷
সূর্য তখন নেমে গিয়েছে দিকচক্রবাল-রেখার নীচে৷ তখনও আকাশ আরক্ত এবং তেমনই আরক্ত কুরুক্ষেত্রের মহাপ্রান্তর৷ পলাতক গ্রিকরা এবং তাদের সঙ্গী দেশদ্রোহী ভারতীয় সৈনিকরা পালিয়েও কিন্তু আত্মরক্ষা করতে পারল না৷ এদিক থেকে চন্দ্রগুপ্তের অর্ধচন্দ্রব্যুহের মতো, ওদিক থেকেও পুরুর অর্ধচন্দ্রব্যুহের দুই প্রান্ত যখন মিলিত হয়ে প্রকাণ্ড এক পূর্ণমণ্ডল রচনা করল, তখন তার মধ্যে যেন বেড়াজালে ধরা পড়ল ভারতের অধিকাংশ শত্রু! তারপরে আরম্ভ হল যে বিরাট হত্যাকাণ্ড, যে বীভৎস বিজয়গর্জন, যে ভয়াবহ মৃত্যুক্রন্দন, পৃথিবীর কোনো ভাষাই তা বর্ণনা করতে পারবে না! কুরুক্ষেত্রের প্রান্তর হয়ে উঠল যেন ছিন্ন হস্ত, ছিন্ন পদ, মুণ্ডহীন দেহ এবং দেহহীন মুণ্ডের বিপুল ডালা! বহুকালের বিশুষ্ক কুরুক্ষেত্রের তৃষ্ণার্ত বুক আজ আবার রক্তসমুদ্রে অবগাহন করবার সুযোগ পেল৷ পরদিনের জন্যে ভোজসভা প্রস্তুত রইল জেনে আসন্ন অন্ধকারে শকুনির দল বাসার দিকে ফিরে গেল!
মৃত্যু-আহত দিনের ম্লান শেষ আলোকে মৌর্য রাজবংশের ময়ূরচিহ্নিত পতাকা বিজয়-পুলকে যেন জীবন্ত হয়ে উঠল৷
পতাকার তলায় চাণক্যের চরণে নত হয়ে প্রণাম করলেন যুবক চন্দ্রগুপ্ত!
চাণক্য প্রসন্নমুখে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘বৎস, এ-যুদ্ধ চরম যুদ্ধ! নদীর মতো আজ তুমি পাহাড় কেটে বাইরে বেরোলে, এখনও দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে বটে, কিন্তু আর কেউ তোমাকে বাধা দিতে পারবে না৷ অদূর ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিপাত করে আজ আমি স্পষ্ট দেখছি, ভারতসাম্রাজ্যের একমাত্র সম্রাট চন্দ্রগুপ্তকে!’
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – রাজার ঘোড়ার সওয়ার
কিন্তু আনন্দের এই মাহেন্দ্রক্ষণে ভারতবন্ধু সুবন্ধুকে কেউ দেখতে পেল না৷ রক্তসিক্ত কুরুক্ষেত্রের প্রান্তর পার হয়ে তার অশ্ব বায়ুবেগে ছুটে চলেছে এক অরণ্যপথ দিয়ে৷
এবং তার খানিক আগে আগে তেমনই বেগে ঘোড়া ছুটিয়েছে আর একজন সওয়ার! দেখলেই বোঝা যায়, সে সুবন্ধুর নাগালের বাইরে যেতে চায়!
কিন্তু সুবন্ধুর ঘোড়া বেশি তেজীয়ান-এ-যে সেই রাজার ঘোড়া! প্রতিমুহূর্তেই সে অগ্রবর্তীর বেশি কাছে এগিয়ে যাচ্ছে৷
হঠাৎ সুবন্ধু তার ভল্ল তুলল৷ লক্ষ্য স্থির করে অস্ত্র ত্যাগ করল এবং সেই তীক্ষ্ণধারার ভল্ল প্রবেশ করল অগ্রবর্তী অশ্বের উদরদেশে৷
আরোহীকে নিয়ে অশ্ব হল ভূতলশায়ী৷ অশ্ব আর উঠল না, কিন্তু আরোহী গাত্রোত্থান করে দেখল ঠিক তার সমুখেই ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফ মেরে নেমে পড়ল সুবন্ধু!
অশ্বহীন আরোহী বলল, ‘যুদ্ধে আমরা পরাজিত৷ আমি পলাতক৷ তবু তুমি আমার অনুসরণ করছ কেন?’
সুবন্ধু হা-হা রবে অট্টহাসি হেসে বলল, ‘আমি তোমার অনুসরণ করছি কেন? শশীগুপ্ত, সে কথা কি তুমি বুঝতে পারছ না?’
‘না৷’
‘আলেকজান্ডারকে তুমিই যে ভারতে পথ দেখিয়ে এনেছিলে এটা তুমি অস্বীকার করবে না তো?’
‘আমি ছিলাম গ্রিকসম্রাটের সেনাপতি৷ প্রভুর আদেশ পালন করতে আমি বাধ্য৷’
‘প্রভুর আদেশে তাহলে তুমি মাতৃহত্যা করতে পার?’
শশীগুপ্ত জবাব দিল না৷
‘মহারাজা চন্দ্রগুপ্ত চান গ্রিকশৃঙ্খল থেকে ভারতকে মুক্ত করতে৷ পাছে মহারাজা পুরুর সাহায্য পেয়ে তিনি অজেয় হয়ে ওঠেন, সেই ভয়ে তুমি গ্রিক সেনাপতিকে নিয়ে আবার স্বদেশের বিরুদ্ধে তরবারি তুলেছিলে৷’
‘আমি-‘
‘চুপ করো৷ আগে আমাকে শেষ করতে দাও৷ যুদ্ধে আজ মহারাজ চন্দ্রগুপ্তের জয় হয়েছে৷ তোমাদের পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের মধ্যে পঁয়ত্রিশ হাজার সৈন্য শুয়ে আছে কুরুক্ষেত্রে রক্তশয্যায়৷ তাই তুমি আবার ফিরে চলেছ নিজের মুল্লুকে৷ তুমি আবার সৈন্য সংগ্রহ করে আলেকজান্ডারের প্রত্যাবর্তনের জন্যে অপেক্ষা করতে চাও৷ কেমন, এই তো?’
শশীগুপ্ত ঘৃণাভরে বললেন, ‘একজন সাধারণ সৈনিকের সঙ্গে আমি কথা কাটাকাটি করতে চাই না৷ পথ ছাড়ো৷’
‘পথ ছাড়ব বলে তোমার পথ আগলাইনি৷ তুমিই হচ্ছ ভারতের প্রধান শত্রু৷ তোমাকে আজ আমি বধ করব৷’
‘তুমি আমাকে হত্যা করবে! জানো, আমি সশস্ত্র?’
‘আমি হত্যাকারী নই, সম্মুখযুদ্ধে আমি তোমাকে বধ করব! অস্ত্র ধরো, এই আমি তোমাকে আক্রমণ করলাম৷’
মুক্ত তরবারি তুলে সুবন্ধু বাঘের মতো শশীগুপ্তের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল৷
নিজে তরবারি তুলে বাধা দিয়ে শশীগুপ্ত এমন ক্ষিপ্রহস্তে তরবারি খেলিয়ে তাকে প্রতি-আক্রমণ করলেন যে, সুবন্ধুর বুঝতে বিলম্ব হল না, তাকে লড়তে হবে এক পাকা খেলোয়াড়ের সঙ্গে৷ সে অধিকতর সাবধান হল৷
মিনিট পাঁচেক ধরে দুই তরবারির ঝঞ্ঝনা-সংগীতে বনপথ ধ্বনিত হতে লাগল৷ শশীগুপ্তের হস্ত ছিল সমধিক কৌশলী, কিন্তু সুবন্ধুর পক্ষে ছিল নবীন যৌবনের ক্ষিপ্রতা৷
যুদ্ধের শেষ ফল কী হত বলা যায় না, কিন্তু এমন সময় হঠাৎ এক অদ্ভুত অঘটন ঘটল৷
একবার সুবন্ধুর আকস্মিক আক্রমণ এড়াবার জন্য শশীগুপ্ত এক লাফ পিছিয়ে তাঁর ভূপতিত ঘোড়ার দেহের উপরে গিয়ে পড়লেন৷
ঘোড়াটা মরেনি, তখনও মৃত্যযন্ত্রণায় প্রবল বেগে চার পা ছুড়ে বিষম ছটফট করছিল৷ তার এক পদাঘাতে শশীগুপ্তের দেহ হল প্রপাত-ধরণীতলে এবং আর-এক প্রচণ্ড পদাঘাতে তাঁর দেহ ছিটকে গিয়ে পড়ল ছয়-সাত হাত তফাতে৷
সুবন্ধু হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ৷ কিন্তু শশীগুপ্তের দেহ নিস্পন্দ হয়ে সমানে পড়ে রইল দেখে সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল৷
সবিস্ময়ে স্তম্ভিত নেত্রে প্রায়-অন্ধকারে মুখ নামিয়ে দেখল, অশ্বের পদাঘাতে শশীগুপ্তের খুলি ফেটে হু-হু করে রক্ত বেরোচ্ছে, সে কলঙ্কিত দেহে প্রাণের কোনো চিহ্নই বর্তমান নেই৷
অল্পক্ষণ শশীগুপ্তের মৃতদেহের দিকে নীরবে তাকিয়ে থেকে সুবন্ধু ধীরে ধীরে বলল, ‘শশীগুপ্ত, তোমার আত্মা যদি এখানে হাজির থাকে তাহলে শুনে রাখো তুমি দেশদ্রোহী কাপুরুষ! তোমার অদৃষ্টে বীরের মৃত্যু লেখা নেই! মানুষ হয়েও তুমি পশুজীবন যাপন করতে, তাই মরলেও আজ পশুর পদাঘাতে আর আজ রাত্রে তোমার দেহেরও সৎকার করবে বনের হিংস্র পশুরা এসে! চমৎকার!’
অরণ্যের সান্ধ্য অন্ধকার ভেদ করে বহুদূর থেকে ভেসে এল মৌর্য শিবিরের উৎসব-কোলাহল! সেই উৎসবে যোগ দেবার জন্য সুবন্ধু তাড়াতাড়ি রাজার ঘোড়ার পিঠের উপরে চড়ে বসল৷
অবশিষ্ট – পঞ্চনদের জাগ্রত ভারত
তারপর?
তারপর যা হল, আজও ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়৷ এর মধ্যে আর গল্প বলবার সুযোগ নেই, তোমাদের শুনতে হবে কেবল ঐতিহাসিক সত্যকথা৷
মহারাজা পুরু বা পর্বতককে দলে পেয়ে চন্দ্রগুপ্ত হয়ে উঠলেন একেবারেই অজেয়৷
আলেকজান্ডার ভারতে প্রবেশ করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে, ভারত ত্যাগ করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে৷
তারই দুই বৎসর পরে-অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দে ভারতবর্ষের দিকে দিকে রটে গেল, বাবিলনে গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন৷
যদিও এ-সংবাদ পাবার আগেই পঞ্চনদের তীরে তীরে উড়েছে চন্দ্রগুপ্তের বিজয় পতাকা, তবু তখনও পর্যন্ত যারা আলেকজান্ডারের প্রত্যাগমনের ভয়ে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারেনি, তারাও একসঙ্গে করল চন্দ্রগুপ্তের পক্ষাবলম্বন৷
তখন চন্দ্রগুপ্তের প্রচণ্ড খড়্গাঘাতে পঞ্চনদের শিয়র থেকে ছিন্নমূল হয়ে লুটিয়ে পড়ল গ্রিকদের বিজয় পতাকা৷
অবশ্য এজন্যে চন্দ্রগুপ্তকে বহু যুদ্ধ জয় করতে হয়েছিল৷ তাদের কাহিনি কেউ লিখে রাখেনি বটে, কিন্তু শেষ পরিণাম সম্বন্ধে সব ঐতিহাসিকেরই এক মত৷ চন্দ্রগুপ্তের বীরত্বে পঞ্চনদের তীর থেকে গ্রিক প্রভুত্ব হল বিলুপ্ত৷ বহু গ্রিক তখনও ভারত ত্যাগ করল না বটে, কিন্তু এখানে তারা আর প্রভুর মতো, বিজেতার মতো বাস করত না৷
কিন্তু হতভাগ্য বীর পুরু বা পর্বতক স্বাধীনতার সুখ বেশিদিন ভোগ করতে পারেননি৷ চন্দ্রগুপ্তকে সাহায্য করেছিলেন বলে ভারত প্রবাসী সমস্ত গ্রিকই ছিল তাঁর উপরে খড়্গহস্ত৷ সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৩১৭ অব্দে য়ুদেমস্ নামে এক গ্রিক দুরাত্মা মহারাজা পুরুকে গোপনে হত্যা করে তাঁর একশো বিশটি হাতি চুরি করে ভারত ছেড়ে পালিয়ে যায়৷
পঞ্চনদের তীর থেকে বিজয়ী চন্দ্রগুপ্ত আবার সসৈন্যে যাত্রা করলেন তখনকার ভারতে সর্বশ্রেষ্ঠ মগধ সাম্রাজ্যে৷ বলা বাহুল্য এরও মূলে ছিল চাণক্যের মন্ত্রণা৷
নন্দরাজের উপরে চাণক্যের জাতক্রোধের একটা কারণের কথা শোনা যায়৷ চাণক্য ছিলেন মগধরাজ ধননন্দের দানশালার অধ্যক্ষ এবং ধননন্দ ছিলেন অতিদানশীল রাজা৷ চাণক্যকে তিনি তাঁর নামে এক কোটি টাকা পর্যন্ত দান করবার অধিকার দিয়েছিলেন৷ কিন্তু চাণক্যের উদ্ধত স্বভাব ও স্বাধীন ব্যবহার সইতে না পেরে শেষটা তিনি তাঁকে পদচ্যুত করে তাড়িয়ে দেন এবং চাণক্যও প্রতিজ্ঞা করেন, তিনি এই অপমানের প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বেন না৷
দ্বিতীয়বার মগধ সাম্রাজ্য আক্রমণ করে চন্দ্রগুপ্ত যুদ্ধে জয়ী হলেন৷ নিহত ধননন্দের সিংহাসন এল তাঁর হাতে৷ মহা সমারোহে সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের অভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন হল৷
কিছুদিন পরে পঞ্চনদের তীরে হল আবার নূতন বিপদের সূচনা৷
আলেকজান্ডারের অন্যতম প্রধান সেনাপতি সেলিউকস (উপাধি ‘নিকাটর’ অর্থাৎ দিগ্বিজয়ী) তখন গ্রিকদের প্রাচ্য সাম্রাজ্যের অধিকারী৷ সেই দাবি নিয়ে তিনিও আবার খ্রিস্টপূর্ব ৩০৫ অব্দে ভারত আক্রমণ করতে এলেন৷
কিন্তু আলেকজান্ডারের অনুকরণ করতে গিয়ে সেলিউকস একটা মস্ত ভুল করে বসলেন৷ আলেকজান্ডার যখন আসেন, উত্তর-ভারত ছিল তখন পরস্পর বিরোধী ছোটো ছোটো রাজ্যে বিভক্ত, কোনো যথার্থ বড়ো রাজার সঙ্গে তাঁকে শক্তিপরীক্ষা করতে হয়নি৷ এবং আগেই বলেছি, তিনিও শক্তিশালী মগধ-রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ না করেই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছিলেন৷
কিন্তু সেলিউকসের আবির্ভাবের সময়ে চন্দ্রগুপ্ত কেবল মগধের অধিপতি নন, তিনি সমগ্র উত্তর-ভারত বিজয়ী এবং তাঁর অধীনে প্রস্তুত হয়ে আছে ত্রিশ হাজার অশ্বারোহী, নয় হাজার গজারোহী ও ছয় লক্ষ পদাতিক সৈন্য৷ এর সামনে পড়লে স্বয়ং আলেকজান্ডারই যে দুরবস্থায় পড়তেন, সেটা অনুমান করা কঠিন নয়৷
ভারতে আবার যবন এসেছে শুনেই জাগ্রত সিংহের মতো চন্দ্রগুপ্ত ছুটে গেলেন পঞ্চনদের তীরে৷ ভারতসৈন্য বন্যার মতো ভেঙে পড়ল পররাজ্যলোভী গ্রিকদের উপরে এবং ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাদের খড়কুটোর মতন! সিন্ধুনদের কাছে এই মহাযুদ্ধ হয়৷ গ্রিক ঐতিহাসিকরা আলেকজান্ডারের ছোটো ছোটো যুদ্ধেরও বড়ো বড়ো বর্ণনা রেখে গেছেন! কিন্তু এত বড়ো যুদ্ধের কোনো বর্ণনাই গ্রিক ইতিহাসে পাওয়া যায় না৷ কারণ এ-যুদ্ধ যে তাঁদের নিজেদের পরাজয় কাহিনি! তাঁরা কেবলমাত্র স্বীকার করেছেন, চন্দ্রগুপ্তের কাছে পরাজিত হয়ে গ্রিক সেনাপতি সন্ধি স্থাপন করেন৷
সেলিউকসের চোখ ফুটল৷ তাড়াতাড়ি হার মেনে তিনি নিজের সাম্রাজ্য থেকে আফগানিস্থান ও বেলুচিস্থানকে চন্দ্রগুপ্তের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হলেন ক্ষতিপূরণস্বরূপ৷ ভারত সম্রাটের মন ঠান্ডা রাখবার জন্যে তাঁর সঙ্গে নিজের মেয়েরও বিবাহ দিলেন৷ এবং চন্দ্রগুপ্ত খুশি হয়ে শ্বশুরকে উপহার দিলেন পাঁচ শত হাতি৷
গ্রিকরা ভারত থেকে বিদায় হল৷ পঞ্চনদের তীর নিষ্কণ্টক৷
চন্দ্রগুপ্ত যখন গ্রিকদের বিরুদ্ধে প্রথম অস্ত্রধারণ করেন তখন তাঁর বয়স পঁচিশ বৎসরের বেশি নয়৷ তারপর মাত্র আঠারো বৎসরের মধ্যে তিনি পঞ্চনদের তীর থেকে যবন প্রভুত্বের সমস্ত চিহ্ন মুছে দেন, প্রায় সমগ্র ভারতব্যাপী অখণ্ড সাম্রাজ্য স্থাপন করেন এবং দিগ্বিজয়ী সেলিউকসকে বাধ্য করেন মাথা নামিয়ে হার মানতে৷ সেই সুদূর অতীতেই তিনি প্রমাণিত করেন, ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি বিশ্বজয়ী গ্রিকরাও ভারতীয় হিন্দু বীরদের সমকক্ষ নয়৷
চন্দ্রগুপ্তের জীবনের একমাত্র ব্রত ছিল, বিধর্মীদের কবল থেকে আর্যাবর্তকে উদ্ধার করে তার পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনা৷
এ-ব্রত যখন উদযাপিত হল, তখন সিংহাসন আর তাঁর ভালো লাগল না৷ সেলিউকসের দূত মেগাস্থেনেস স্বচক্ষে দেখে চন্দ্রগুপ্তের বৃহৎ সুশাসিত সাম্রাজ্যের যে উজ্জ্বল ও সুদীর্ঘ বর্ণনা করে গেছেন, আজও তা পাওয়া যায়৷ কিন্তু এই প্রভুত্বের ও ঐশ্বর্যের বাঁধনও আর তাঁকে বেঁধে রাখতে পারল না৷ সেলিউকসের দর্পচূর্ণ করবার পর ছয় বৎসর তিনি রাজত্ব করেছিলেন৷ তারপর পুত্র বিন্দুসারের হাতে রাজ্যভার দিয়ে তিনি যখন জৈন সন্ন্যাসীরূপে মুকুট খুলে চলে যান, তখনও তাঁর বয়স পঞ্চাশ পার হয়নি! ভারতের মতো রাজতপস্বীর দেশেই এমন স্বার্থত্যাগ সম্ভবপর! পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট ও রাজর্ষি অশোকও তাঁর যোগ্য পৌত্র!
জৈন পুরাণের মত ইতিহাস মেনে নিয়েছে৷ গ্রিক-বিজেতা ও ভারতের স্বাধীন হিন্দু-সাম্রাজ্যের স্রষ্টা চন্দ্রগুপ্ত সন্ন্যাস গ্রহণ করে মহীশূরে বাস করতেন৷ উপবাসব্রত নিয়ে তিনি দেহত্যাগ করেন!
জন্ম ও রাজ্যলাভ বাংলার পাশে পাটলিপুত্রে, প্রধান কর্তব্যের ক্ষেত্র পঞ্চনদের তীরে উত্তর-ভারত এবং স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ সুদূর দাক্ষিণাত্যে,-চন্দ্রগুপ্তের আশ্চর্য জীবনের সঙ্গে জড়িত সমগ্র ভারতবর্ষ! প্রত্যেক ভারতবাসী তাঁকে নিজের আত্মীয় বলে গ্রহণ করে চরিত্রগঠন করুক, অদূর ভবিষ্যতে আবার তাহলে ফিরে আসবে আমাদের সোনার অতীত-অতীতের মতো গৌরবোজ্জ্বল নূতন ভারতবর্ষ!
_____________________________
* প্রাচীন সংস্কৃত নাটক ‘মুদ্রারাক্ষসে’ ও আধুনিক বাংলা নাটক ‘চন্দ্রগুপ্তে’ প্রকাশ, চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন শূদ্র বা দাসীপুত্র৷ কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকরা এ-মতে সায় দেন না৷ তাঁরা বলেন চন্দ্রগুপ্ত আসল নন্দবংশেরই ছেলে এবং যে নন্দকে তিনি রাজ্যচ্যুত করেছিলেন, শূদ্রের ঔরসে জন্ম হয়েছিল তাঁরই৷
-লেখক৷
* একাধিক সংস্কৃত বিবরণীতে প্রকাশ, রাজা পর্বতকের সাহায্যেই চন্দ্রগুপ্ত গ্রিকদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন৷ বৌদ্ধ বিবরণীতেও ওইরকম কথা আছে৷ Cambridge History of India-র মতে গ্রিকদের ‘পুরু’ই হচ্ছেন ‘পর্বতক’৷ আধুনিক ঐতিহাসিকরাও এই মত গ্রহণ করেছেন৷-লেখক