পঞ্চদশ অধ্যায় – সংস্কৃত অভিধান ও কোষকাব্য
সংস্কৃত ভাষার ইতিহাসে একদিকে রয়েছে বৈদিক সাহিত্য অপরদিকে লৌকিক সাহিত্য। শিক্ষা, ব্যাকরণ ও নিরুক্ত বেদাঙ্গের অন্তর্গত। এই তিন শাস্ত্ৰ পৃথক্ পৃথক্ উক্ত হলেও এরা পরস্পর সংপৃক্ত। এর দ্বারা বৈদিক ভাষার ব্যাখ্যা মেলে, আবার ধ্রুপদী সংস্কৃত বা লৌকিক সংস্কৃততে ব্যাকরণের ধ্বনি, বর্ণ শব্দ ও অর্থ অত্যন্ত সূক্ষ্ম বিচারে আলোচিত হয়েছে নানা অভিধান ও কোষ গ্রন্থগুলিতে। ব্যাকরণ ও শব্দার্থের ব্যাখ্যা ব্যতীত দর্শনশাস্ত্র, অলঙ্কার শাস্ত্রের নানা পারিভাষিক শব্দও আলোচনায় স্থান পেয়েছে। ব্যাকরণ হল শব্দানুশাসন ও শব্দকোষ বা অভিধান হল নামানুশাসন বা লিঙ্গানুশাসন। অর্থাৎ শব্দের লিঙ্গ নির্দেশপূর্বক অর্থের অনুশাসন বা অভিধান। ভাষায় ব্যবহৃত শব্দ সমূহের সংগ্রহমূলক যে অভিধান তা সমস্ত ভাষার ইতিহাসকেই সমৃদ্ধ করে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই সমস্ত অভিধানগুলিকে শাব্দিকগণ ‘শব্দকোষ’, অর্থাশাস্ত্র’, ‘শব্দার্থশাস্ত্র,’ ‘শব্দার্থ সংগ্রহ’, ‘পদার্থ সংগ্রহ’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছেন।
সুপ্রাচীনকালের কোষগ্রন্থ নিঘন্টু বর্তমান ছিল, কিন্তু নিঘন্টু বর্তমানে উপলব্ধ না হওয়ায় নিঘন্টুতে যে সমস্ত বৈদিক শব্দাবলীর প্রতিশব্দ ও ব্যাখ্যা লিপিবদ্ধ ছিল, সেই সমস্ত বিষয় বর্তমানে যাস্কাচার্যের নিরুক্ততে পাওয়া যায়। নিঃ+উক্ত=নিরুক্ত নিঃশেষ রূপে পদসমূহ উক্ত হয়েছে যাতে তাই নিরুক্ত। বেদার্থের প্রয়োজনে নিরুক্ত অপরিহার্য। নিঘন্টু বৈদিকযুগের একটি অন্যতম ও একমাত্র শব্দকোষ বলা যায়। মোট তিনটি কাণ্ডে বিভক্ত এই গ্রন্থ পাঁচটি অধ্যায় সম্বলিত। সমার্থক শব্দের এমন সুদীর্ঘ তালিকা বোধ করি চিন্তারও অতীত। পৃথিবীবাচক, স্বর্ণবাচক, বায়ু ও জলবাচক, ক্রিয়াবাচক, বিশেষবাচক ইত্যাদি ছাড়াও দুরূহ শব্দসমূহের অর্থের বিস্তৃত আলোচনা, এই গ্রন্থের মান্য সম্পদ। যাস্কাচার্য তাঁর নিরুক্ত নামক গ্রন্থে এই অতিমূল্যবান অপরিহার্য গ্রন্থের বিষয়গুলিকে যত্নসহকারে স্থান দিয়েছেন। যাস্কাচার্য তাঁর নিরুক্তে নামপদ, বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের উল্লেখপূর্বক উপসর্গ ও নিপাতের আলোচনা করেছেন। যাস্কের গ্রন্থে ভাষাতত্ত্বেরও নিদর্শন পাওয়া যায়। তাঁর উত্তরসূরীগণ যথাক্রমে ঔর্ণনাভ ও শাকপুণির কথার উল্লেখও নিরুক্তে দৃষ্ট হয়। যাস্কাচার্য বুদ্ধের পূর্ববর্তী বলে ধারণা করা হয়। খ্রি. পূ. ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের মধ্যবর্তী কোন সময়ে তিনি বিদ্যমান ছিলেন। কিন্তু নিঘন্টু কার রচনা এই নিয়ে কোন স্পষ্ট ধারণা করা যায় না।
পরবর্তীকালে সংস্কৃত অভিধান রচনায় অনেকেই নিযুক্ত ছিলেন। গ্রন্থকার অমরসিংহ রচিত অমরকোষ বা লিঙ্গানুশাসনম অন্যতম গ্রন্থ। গ্রন্থকারের নামানুসারে গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছে। ব্যাকরণ শাস্ত্রে যেরূপ পাণিনি সেইরূপ কোষ গ্রন্থে অমরকোষ, এই দু’য়ের ব্যুৎপত্তি না ঘটলে সংস্কৃতশিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। অমরকোষ সঙ্কলিত শব্দসংখ্যা প্রায় ১০,০০০, প্রাচীন সংস্কৃত অভিধানে বর্তমানের ন্যায় বর্ণানুক্ৰমিক নয়, সেখানে সমার্থক, নানার্থক, এইরূপ পর্যায়ে সংকলিত ছিল।
সংস্কৃত শব্দের আভিধানিক অর্থ ছাড়াও লিঙ্গ প্রভৃতির নিরূপণ খুব সুচারু রূপে সম্পন্ন হয়েছে। অমরসিংহের এর জন্মকাল সম্বন্ধে নিশ্চিতকরে বলা খুব কঠিন। বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় কালিদাসের সাথে অমরসিংহও কৃতিত্ত্বের সাথে বর্তমান ছিলেন। ষষ্ঠ শতাব্দীতে অমরকোষ চীনাভাষায় অনুদিত হয় অতএব ৬ষ্ঠ শতাব্দীর পূর্ববর্তী কোন এক সময়ে কবির জন্ম একথা বলা যায়। পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের অভিমত হল অমরসিংহ পঞ্চমশতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করে ছিলেন। গ্রন্থের মঙ্গলাচরণ থেকে জানা যায় যে তিনি বৌদ্ধ ছিলেন। অমরসিংহের গ্রন্থ অমরকোষকে অবলম্বন করে অসংখ্য টীকাকার অজস্র টীকা রচনা করেছেন। তন্মধ্যে ক্ষীরস্বামী, বররুচি, বামন, রুদ্রট, নারায়ণ শর্মা, মহেশ্বর, ভাজি দীক্ষিত, রামতর্কবাগীশ উল্লেখযোগ্য। বৃহস্পতিকৃত পদচন্দ্রিকাও উল্লেখযোগ্য টীকা, নারায়ণ শর্মার অমরকোষ পঞ্জিকা এবং ভট্টোজীদীক্ষিতের পুত্র ভানুজিদীক্ষিত কৃত ব্যাখ্যাসুধা অন্যতম গ্রন্থ। সর্বোপরি ক্ষীরস্বামী কৃত টীকাই অধিকতর মর্যাদার অধিকারী বা অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলা হয়।
সংস্কৃত ভাষায় অপর কোষগ্রন্থ হল ‘অনেকার্থ সমুচ্চয’, বা ‘শাশ্বতকোষ’। এই শাশ্বতের আবির্ভাবকাল সঠিকভাবে বলা না গেলেও ষষ্ঠ শতকের পূর্ববর্তী কোন এক সময়ে তাকে স্থাপন করা চলে। কারণ চীনাভাষায় অমরকোষ অনুদিত হয় ষষ্ঠশতকে। এবং অমরকোষের প্রসিদ্ধ টীকাকার ক্ষীরস্বামী শাশ্বতের উল্লেখ করেছেন। অতএব তিনি অমরকোষের পূর্ববর্তী ছিলেন একথা নিঃসন্দেহে মেনে নেওয়া যায়। ‘অভিধানরত্নমালা’ নামক অভিধান গ্রন্থের রচয়িতা হলেন ভট্টহলায়ুধ। ‘কবিরহস্য’ তাঁর অপর একগ্রন্থ। তিনি দশম শতাব্দীতে বিদ্যমান ছিলেন।
বেদান্তভাষ্য রচয়িতা রামানুজের গুরু যাদবপ্রকাশ “বৈজয়ন্তী’ নামে একখানি কোষগ্রন্থ রচনা করেন। শঙ্করাচার্যের দ্বৈতবাদ ও রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ এই দুইয়েরই শিষ্য ছিলেন তিনি। দ্বাদশশতাব্দীর ঐ বৈয়াকরণ সংস্কৃত অভিধান শাস্ত্রে উল্লেখযোগ্য।
এই দ্বাদশ শতকেরই পুরোভাগে মহেশ্বর রচনাকরেন বিশ্বপ্রকাশ। মেদিনীকর রচিত ‘মেদিনীকোষও’ সমসাময়িক রচনা। দ্বাদশ শতাব্দীতে কবি হেমচন্দ্র চারটি কোষগ্রন্থের রচয়িতা—প্রথমতঃ—অভিধানচিন্তা-মনি, দ্বিতীয়তঃ—অনেকার্থ সংগ্রহ; তৃতীয়তঃ—নিঘন্টুকোষ, ও চতুর্থতঃ বা শেষতঃ—দেশীনামমালা। অসংখ্য শব্দ- সম্বলিত আলোচ্য শব্দকোষ সত্যিই কোষ সাহিত্যে উল্লেখের দাবী রাখে। দেশীনামমালা প্রাকৃতে রচিত গ্রন্থ। এই গ্রন্থে প্রাকৃতশব্দ সমূহের অর্থ ও ব্যাখ্যা দৃষ্ট হয়। শব্দকল্পদ্রুমের নাম আমাদের সকলেরই জানা, একদল সংস্কৃত পণ্ডিতের সমবেত চেষ্টায় কাজটি সম্পন্ন হয়েছিল, রাধাকান্তদেবের পৃষ্ঠপোষকতায়। এছাড়াও পদ্মনাভের ‘ভুরি-প্রয়োগ’, কেশবের কল্পদ্রুমকোষ ইত্যাদি অভিধান অথবা কোষগ্রন্থ বলে জ্ঞানিগুণী জনের নিকট সমাদৃত হয়ে আসছে।