পক্ষিমিনার (১৯৭৯)

পক্ষিমিনার (১৯৭৯)
ওলেগ সের্গেইভিচ কোরাবেলনিকভ- অনুবাদ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য।

এই নরদেহ পক্ষিমিনার
শ্বাপদের বাস অন্দরে তার
মুখে শত মুখ ফেলে যায় ছায়া
ভূচর অথবা উড়ন্ত মায়া
একই দেহে তারা খেলা করে যায়
মহানাগ জাগে শোণিতধারায়

.

১.

সে-বছর গরমকালে তাইগার একটা বিরাট এলাকায় দাবানল শুরু হয়েছিল। আগুন নেভাতে গোটা একটা সেনাবাহিনী নামিয়ে দেয়া হয় ও-এলাকায়। কিন্তু তাদের সমস্ত চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে তীব্র ঝোড়ো হাওয়ায় ভর করে সে আগুন ক্রমশই ছড়িয়ে যেতে থাকে। শুধু বড়ো বড়ো নদীর ধারাগুলোই যা একটু বাধা দিতে পেরেছিল তাকে। তবে সে-ও আর কতটুকু।

সে দাবানলের তাড়া খেয়ে তাইগার সমস্ত জীবজন্তু সেখান থেকে পালানো শুরু করে। শুধু গাছ আর ঘাস, মাটির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বড়ো নিবিড়, তারা নিঃশব্দে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিল সেই আগুনের কবলে পড়ে। তবে, মৃত্যুর আগে তারা অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা একটা করেছিল বৈকি। নিজেদের অজস্র বীজ তারা ছড়িয়ে দিয়েছিল পলাতক পাখিদের ডানায়, পশুদের লোমের নিরাপদ আবরণে। আশা করেছিল, ওরা পালাতে পারলে তাদের বীজেরাও হয়তো নিশ্চিত মৃত্যুর থেকে অনেক দূরে সরে যেতে পারবে।

ঘন ঘন বিস্ফোরণে সে-সময় বারংবার কেঁপে উঠছিল মহারণ্য। বুলডোজারগুলো উন্মাদের মতো গর্জন তুলছিল তাদের জ্বলন্ত গভীরে। ঘন ধোঁয়া, আগুনের তীব্র হলকা, কোনো কিছুতেই তারা থামতে জানে না।

যুদ্ধক্ষেত্রটায় ইয়েগর ঠিক মানিয়ে নিতে পারছিল না নিজেকে। প্রাণপণ লড়তে থাকা এই মানুষজন, মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে থাকা অজস্র গাছ আর তাদের ফাঁকে ফাঁকে জ্বলন্ত তাইগার বুক ছেড়ে পালাতে থাকা অসংখ্য জীবজন্তু, এই সবই তার কাছে একেবারে অচেনা ছবি।

নিতান্ত হঠাৎ করেই তার এই দাবানলের এলাকায় এসে হাজির হওয়া। আগুন নেভাবার কাজে সে আদৌ এখানে আসেনি। আসলে সে সময়টা তাইগার বুকে দূরদূরান্তে ছড়িয়ে থাকা ছোটো ছোটো গ্রামগুলোতে সফর করছিল ইয়েগর। পশমের সুতো কাটবার নকশাকাটা তকলি, পুরনো কালের সামোভার, চির ধরা, কালচে মেরে যাওয়া ঠাকুরদেবতার ছবি গ্রামগঞ্জের নানান বাড়িতে অবহেলায় ছড়িয়ে থাকা এইসব জিনিসপত্রের সন্ধানে তার এ-মুল্লুকে আসা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো কালের স্মৃতিজড়ানো এই জিনিসপত্রগুলো উধাও হয়ে যাচ্ছে একে একে। ওরই মধ্যে যতটুকু খুঁজেপেতে বের করে এনে বাঁচিয়ে রাখা যায়, এই ছিল তার ইচ্ছে। এতে তাদের স্লাভদের সংস্কৃতির শেকড়টার একটা খোঁজ হয়তো মিলতে পারে এই তার আশা।

মাঝখান থেকে এই আগুনটা এসে তার কাজে ভালোরকম একটা বাধা তৈরি করে দিয়েছে। ফলে সে-মুহূর্তে তার অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না, অন্তত যতদিন

না আগুনটাকে আটকানো যায়। নইলে দাবানলের ভেতর দিয়ে নদীর উজানের দিকে আরও এগোনোটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারত।

এদিকে ছুটিও তখন ফুরিয়ে আসছে তার। এই অবস্থায় এমন একটা বাধা এসে পড়ায় মনে মনে খানিক মুষড়েই ছিল সে। আগুন নেভাতে আসা সেনাবাহিনীর একটা দল যে খুদে গ্রামটায় ঘাঁটি গেড়েছে সেই গ্রামটা তখন তারও ঠিকানা।

তবে এইখানটায় গত কয়েকদিন এলোমেলো ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে অনেক কিছু জেনেছে ইয়েগর। বুঝতে পেরেছে অনেক কিছু। চোখের সামনে আগুনের গ্রাসে ধ্বংস হয়ে যেতে থাকা ওই বিপুল অরণ্য, জ্বলন্ত গাছগুলোর অতিকায় পত্রমুকুট থেকে ধেয়ে আসা তীব্র উত্তাপের হলকা, ফুটন্ত নদী, পুড়ে আংরা হয়ে যাওয়া জীবজন্তুদের শরীর, পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া ভাস্টের পর ভার্স্ট শ্মশানভূমি এই সবকিছুর সামনে, তার নিজের জীবনের দুঃখগুলোকে আর তত গুরুত্বপূর্ণ ঠেকছিল না তার। ডিভোর্স, ইনস্টিটিউটের চাকরিটা চলে যাওয়া, একেবারে এলোমেলো হয়ে ওঠা তার গোটা জীবনটা… নাহ, তাইগার দাবানলের তীব্র উত্তাপ, সেই সবকিছু তুচ্ছ যন্ত্রণাকে তার বুক থেকে ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছে এই ক’ দিনে।

হাত-পা গুটিয়ে একদিন বসে থাকতে থাকতে অবশেষে একদিন হাওয়ার ঝাঁপটা খানিক কমতে একরকম মরীয়া হয়েই ফের পথে বের হল ইয়েগর। যাবে সে তাইগার গভীরে দাঁড়ানো একটা পুরনো মঠের খোঁজে। সে মঠের সন্ধান তাকে যারা দিয়েছে তারা বলেছিল, জায়গাটা বহুযুগ হল পরিত্যক্ত। শুনে তার আশা হয়েছিল, কপাল ভালো থাকলে ওর ভেতর হয়তো কিছু কিছু অমন পুরনো জিনিসপত্র মিলেও যেতে পারে।

সঙ্গে জিনিসপত্র বিশেষ কিছু সে নেয়নি। একটা কুড়ুল, একটা ছুরি, সিগারেট, দেশলাই আর একটা কম্পাস।

সেদিন সকালটা বেশ শান্তই ছিল। হাওয়ার বেগ কম। কাজেই ইয়েগর ধরেই নিয়েছিল, আগুন সেদিন বেশি জোর ছুটবে না। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর ঘটে আরেক। রওনা হবার খানিক বাদে, একরকম নিশ্চিন্ত হয়েই ভেজা মাটির একটা ঢাল বেয়ে ঝোঁপঝাড়ের কাঁটা বাঁচিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, এমন সময় হঠাৎ তার খেয়াল হল, বাতাসে পোড়া গন্ধ! এদিক ওদিক ফিরে চাইতে নজরে পড়ল বেশ খানিক দূরে ঝোঁপঝাড় থেকে হালকা ধোঁয়ার ফিতে উঠছে। সেই সঙ্গে কাঠকুটো পোড়বার পট পট আওয়াজ। তার মানে আগুন আর দূরে নেই।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ইয়েগর। তারপর কান পেতে শব্দগুলো খানিক শুনে বুঝতে পারল, আগুন তার দিকেই এগিয়ে আসছে।

তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালাতে না পাড়লে বিপদ। এদিক ওদিক তাকাতে ইয়েগর দেখে খানিক দূরে ঘন জঙ্গলের বেড়া ভেদ করে একদল এল্ক ছুটে বেরিয়েছে। জন্তুগুলো

বের হয়ে এসে তাকে দেখতে পেয়ে ঘাবড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে ফের ঝোঁপঝাড় ভেঙে জঙ্গলের আরেকটা দিকে চলে গেল। তার পায়ের নিচের ঝোঁপঝাড় বেয়ে সড়সড় শব্দ তুলে ছোটোখাটো জীবজন্তুর দল ছুটে পালাচ্ছিল। চারপাশে পাখিদের হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। ঝোঁপঝাড়গুলো মড়মড় করে দুলছে। ছুটন্ত জন্তুদের পায়ের চাপে ভেঙে যাচ্ছিল ছড়িয়ে থাকা শুকনো ডালপালা।

এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিয়ে ইয়েগর দ্রুত মনস্থির করে নিল। সামনে ছড়িয়ে থাকা চওড়া ঘাসজমিটা বেয়ে ছুটে পালাবার কোনো মানে নেই। বাঁচতে হলে কোনো উঁচু জায়গায় গিয়ে উঠতে হবে। জমিটার অর্ধেকটা ছুটে পার হয়ে সে বাঁদিকে খাড়া আকাশমুখো একটা টিলা বাইতে শুরু করল। টিলাটার গায়ে ঘন জঙ্গল। পায়ের নিচে ঘাসের আস্তর পিছল হয়ে আছে। সেইসব পেরিয়ে কোনোমতে তার মাথার কাছে পৌঁছে পেছন ফিরে ইয়েগর দেখে আগুনও ততক্ষণে তার নাগাল ধরে ফেলেছে প্রায়। তার ঠিক পাশের টিলাটার মাথার গাছগুলো দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করেছে। সতর্ক চোখে সেদিকে তাকিয়ে দেখে ইয়েগর আন্দাজ করল, আর বড়োজোর মিনিট পনেরো। তার মধ্যেই সেখান থেকে আগুন এই টিলায় পৌঁছে যাবে এসে। এইবার প্রাণভয়ে দৌড়োনো শুরু করল ইয়েগর। তার পেছনে তীব্র উত্তাপে ফাটতে থাকা কাঠের শব্দ বুঝিয়ে দিচ্ছিল, মৃত্যু আর বেশি দূরে নেই।

পিছল ঘাসের বুকে আছাড় খেতে খেতে কোনোমতে উত্রাইয়ের মাঝামাঝি অবধি এসে পৌঁছেছে যখন সে, ঠিক তখন একটা আশ্চর্য শব্দ কানে এল ইয়েগরের। গানের শব্দ!

উত্রাইটার একেবারে তলায় কেউ গান গাইতে গাইতে হেঁটে যাচ্ছে। শান্ত গলার স্বর। শব্দগুলো অচেনা। গায়ক যে-ই হোক সে একলা নয়। কারণ তার প্রত্যেকটা লাইন গাইবার সঙ্গে সঙ্গেই একটা দল সুরে বেসুরে তার সঙ্গে ধুয়া ধরছিল। অনেকটা শ্মশানযাত্রার গানের মতো শোনায় জিনিসটা।

শুনে ইয়েগর ভাবল, বোধ হয় এলাকার লোকজন উত্রাইয়ের নিচের কোনো অদেখা সঁড়িপথ বেয়ে গান গাইতে গাইতে চলেছে। আর, এত নিশ্চিন্তে গান গাইছে যখন, তখন বোধ হয় ওখানটা গিয়ে একবার পৌঁছুতে পারলে তত ভয়ের আর কিছু থাকবে না।

ততক্ষণে আরও খানিক নিচে নেমে এসেছে ইয়েগর। একলা গলার গানটার কথাগুলো এইবার আরও স্পষ্ট। তবে সেগুলোর মানে যে কী সে তার বোধগম্য হচ্ছিল না। আবার তার একেকটা লাইন গাইবার পরেই একটা করে চাবুক আছড়াবার শব্দ উঠছিল। আর সেই সঙ্গেই বেড়ে উঠছিল সুরে বেসুরে ধুয়ার গর্জন।

এই ধুয়ার গর্জনটা খানিক অবাক করছিল ইয়েগরকে। এতে কোনো আলাদা আলাদা শব্দ নেই। একটানা একটা আওয়াজ কেবল। সে আওয়াজ তার অচেনা নয়।

এইবার ঢাল বেয়ে সরসর করে গড়িয়ে নেমে চলল ইয়েগর। খানিক নামতেই উঁচু ঘাসের জঙ্গলের ভেতর থেকে যে দৃশ্যটা তার চোখে পড়ল তাতে খানিক অবাক হয়ে একটুক্ষণের জন্য থমকে গেল সে। এঁকে বেঁকে যাওয়া একটা সরু রাস্তা বেয়ে একটা বুড়োমানুষ হেঁটে চলেছে। হাতে তার একটা ছোটো চাবুক। আর তার পেছন পেছন দশ বারোটা নেকড়ের একটা দল হেঁটে আসছে। দলটার আচরণ একটু অদ্ভুত। লেজগুলো পায়ের ফাঁকে গুটিয়ে তারা লোকটার পিছু পিছু বেশ বাধ্য ছেলের মতো চলেছে, আর বুড়োর চাবুক শব্দ তুললেই একসঙ্গে সুরে বেসুরে একটানা হাঁক তুলছে। বুড়োর অবশ্য সেদিকে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। আপনমনে হাঁটতে হাঁটতেই সে তার গান গেয়ে যায়, আর একেকটা লাইন গাইবার পর চাবুকটা একবার করে আছড়ায়।

খানিক সে দেখে না পারতে ইয়েগর হাঁক দিয়ে বলল, “ও বুড়ো, তোমার পেছনে নেকড়ের দল ধাওয়া করেছে যে! পালাও, নয়তো জ্যান্ত ছিঁড়ে খাবে যে!”

শুনে বুড়ো ঘুরে একবার ইয়েগরের দিকে দেখল, তারপর কোনো জবাব না দিয়ে ফের গান গাইতে গাইতে চলল। নেকড়েরা ইয়েগরের দিকে ঘুরেও দেখল না। লোকটার পটলচেরা চোখ আর হলদেটে চামড়া দেখে ইয়েগর অনুমান করল সম্ভবত ইওয়েঙ্ক উপজাতির মানুষ হবে সে।

ওদিকে আগুন ততক্ষণে তার পেছন পেছন আরও খানিক এগিয়ে এসেছে। ইয়েগর অতএব আর দেরি করল না। বাকি পথটা তাড়াহুড়ো করে নেমে এসে, শোভাযাত্রাটার শেষ নেকড়েটার খানিক দূর দিয়ে সে শুড়িপথটা পেরিয়ে একটা নালা ধরে ছুট দিল। কিন্তু আগুন ততক্ষণে গতি বাড়িয়েছে। ছুটতে ছুটতেই বাতাস বেয়ে তার উত্তাপ এসে লাগছিল ইয়েগরের শরীরে। বেড়ে উঠছিল তার গর্জন। সে আন্দাজ করছিল, আর সম্ভবত দৌড়ে সে এই আগুনের কাছে পার পাবে না।

আর তারপর, টিলার চূড়ার গাছগুলোর মাথা হঠাৎ জ্বলে উঠল দাউ দাউ করে। পেছন ফিরে ইয়েগর দেখল সেখান থেকে তরল ধাতুর মতো আগুনের একটা স্রোত চুড়া টপকে হুহু করে নেমে আসছে বাতাসের ভর করে। ভয়ে বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়ে গেল তার। পাগলের মতো এলোমেলো ছুট দিল সে নালা ধরে। তীব্র ঝাঁঝালো ধোঁয়ায় ভরে উঠছিল তার ফুসফুস।

ঠিক তখনই ঘন ধোঁয়ার ভেতর থেকে কে যেন মেয়েদের গলায় তার নাম ধরে ডেকে উঠল, “আমার পেছন পেছন এসো ইয়েগর। আরে ওদিকে নয় বোকাটা। ওদিকে নয়। একদম ঘাবড়াবে না.”

বলতে বলতেই মেয়েদের গলাটা হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল। গলাটা তার জোরে নয় একেবারেই, অথচ কী আশ্চর্য পরিষ্কার। যেন সে তার ঠিক পেছনটাতে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে তার কানে! তাড়াতাড়ি পেছন ঘুরে দেখল ইয়েগর। সেখানে

পাহাড়ের গায়ের ফাটল বেয়ে একটা সরু ফিতের মতো জমি এগিয়ে গিয়েছে পুড়তে থাকা তাইগার গভীরে। যতদূর চোখ চলে, জমিটার চারপাশে যেন নরকের আগুন জ্বলে চলেছে দাউ দাউ করে। অথচ ওই সরু পথটাকে সে আগুন ছোঁয়নি। যেন কোনো অদৃশ্য দেয়াল তাকে ঘিরে আছে। দু’ ধারে আগুনের সমুদ্রের ভেতরে ওই সরু জমিটুকুর বুকে সবুজের মেলা। তার ঝোঁপঝাড়ে মাকড়শারা জাল বুনেছে। শান্ত, স্নিগ্ধ হাওয়ার বুকে সে জাল ছবির মতো স্থির।

ইয়েগর সেই পথটার বুকে নেমে এল। এখানে গ্রীষ্মের সকালের মতো ঠাণ্ডা হাওয়া চলছে। বড়ো বড়ো পদক্ষেপে সে হেঁটে চলেছিল রাস্তাটা ধরে। তার পেছন থেকে জেগে ওঠা আগুনের নিঃশ্বাসের শব্দ বুঝিয়ে দিচ্ছিল, তার ছেড়ে আসা এলাকার বাধা সরে গিয়ে নিঃশব্দে দাবানলকে জায়গা করে দিচ্ছে। পেছন ঘুরে না তাকিয়েও সে টের পাচ্ছিল বড়ো বড়ো জ্বলন্ত ডালপালা আছড়ে পড়ে মুছে দিচ্ছে তার পেরিয়ে আসা পথের সব চিহ্ন। অথচ তার সামনের পথটুকুতে তেমনই গ্রীষ্মের শান্ত সকাল। সেখানে, তার থেকে খানিক দূরে হঠাৎ হঠাৎ কোনো পাইনগাছের আড়াল থেকে ভেসে ওঠে একচিলতে সুন্দর মুখ, কোনো আঙুরলতার ঝোঁপের ভেতর থেকে হঠাৎ করেই বের হয়ে এসে ইশারা করে কোনো নগ্ন হাত। কখনো-বা শান্ত হাসির একটা ঝলক ভেসে আসে তার সামনে থেকে। তবে খানিক দাঁড়িয়ে তাকে এমনভাবে পথে দেখিয়ে নিয়ে চলা মানুষটাকে খুঁজে দেখবার সাহস তখন ইয়েগরের নেই। পেছনে ধেয়ে আসা উত্তাপের হলকা তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল আগুন তার পিছু ছাড়েনি।

ভয়ে সময়ের জ্ঞান চলে গিয়েছিল ইয়েগরের। দু’ পাশে আগুনের বেড়াজালের মধ্যে ক্রমাগত আছড়ে পড়তে থাকা গাছদের শব্দ শুনতে শুনতে তার মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল ধরেই ছুটে চলেছে সে ওই নিরাপদ জমির ফালিটুকুর বুক বেয়ে। অবশেষে একসময় আগুনের শব্দ পিছিয়ে পড়ল অনেকটা দূরে। জমিটার দু’ পাশের গাছপালাদের গায়ে পোড়ার দাগ তখনও চোখে পড়ে, কিন্তু তাতে আগুনের স্পর্শ নেই আর। এইবার আস্তে আস্তে গতি কমাল ইয়েগর। নিরাপদ জমির ফালিটা এসে প্রকাণ্ড এক সিডারগাছের গুঁড়ির সামনে শেষ হয়েছে। এখানে আগুন নেই। কেবল পোড়া অরণ্যের মৃতদেহ ছড়িয়ে আছে সামনে।

পেছনে তাকিয়ে ইয়েগর দেখল, বহুদূরে অরণ্যের বুকে তখনও আগুনের লেলিহান জিভ উঁকি দিচ্ছে ইতিউতি। এতটা পথ দৌড়ে এসে বড়ো ক্লান্ত ঠেকছিল তার এবারে। অরণ্যের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একলা এই সিডারটা বেঁচে রইল কীভাবে, সে নিয়ে ভাববার মতো অবস্থা তার নয় তখন। গাছটার গোড়ায় একটুকরো ঘাসজমির বুকে বসে তার গুঁড়িতে গা এলিয়ে দিল সে।

হঠাৎ মাথার অনেক ওপরে গাছটার শরীর থেকে খড়মড় করে শব্দ উঠল একটা। একরাশ কাঠিকুটো ঝরে পড়ল তার মাথায়। টুপটাপ করে ঝরে পড়া দু-একটা সিডারের মোচা মাটিতে জমে থাকা ছাইয়ের গাদায় ডুবে গেল। আর তারপর মাথার ওপর থেকে ফের ভেসে এল খিলখিল হাসির শব্দটা।

“কে গো তুমি?” জিজ্ঞাসা করে যেই না ইয়েগর মাথাটা ওপরদিকে ঘোরানো, সঙ্গে সঙ্গে হাসির শব্দটা বদলে হয়ে গেল কাঠবিড়ালির ডাক আর তারপর ফের তা পালটে গেল নীলকণ্ঠ পাখির ডাকে। আর সেই সঙ্গে সঙ্গেই তার চোখের সামনে চেহারা বদলে যাচ্ছিল সিডারগাছটার। তার পাতাগুলো দেখতে দেখতে পুড়ে কালো ধুলোর মতো ঝরে পড়ল, তার বিরাট গুঁড়িতে, সটান কাণ্ডে, রিক্ত ডালগুলোর গায়ে আগুনে পোড়া কালো রঙ ধরল। দেখতে দেখতে চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা আর দশটা পোড়া গাছের পটভূমিতে মিশে গেল তার চেহারাটা।

এইবার তার মাথার ওপর থেকে ভেসে এল একটা পেঁচার ডাক। কোনো অদৃশ্য ডানা ঝটপট করে উঠল বাতাসে। আর তারপর একটা শান্ত, মিঠে গলা যেন বহুদূর থেকে তার নাম ধরে ডাক দিয়ে উঠল, “উঠে পড়ো ইয়েগর। রওনা হও। পথ লম্বা। জীবন ছোটো। নদীর দিকে এগিয়ে যাও।”

সন্ধের মুখমুখ ইয়েগর শেষমেশ দাবানল-বিধ্বস্ত এলাকাটার একটা প্রান্তে এসে পৌঁছোল। একটা সরু নদী পাক খেয়ে এগিয়ে গিয়েছে এখানে। তার একপাশে পোড়া অরণ্য। অন্যপাশে ঘন সবুজ সতেজ তাইগা। এত ধ্বংস, মৃত্যু আর পোড়া ছাই দেখবার পর সেই শান্ত, জীবন্ত অরণ্যের দিকে চোখ রেখে কেমন অদ্ভুত ঠেকছিল ইয়েগরের। একটুক্ষণ সেইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে নদীর জলে ঝাঁপ দিল ইয়েগর। তারপর পিঁপড়ে আর সুগন্ধী পাতা-লতার টুকরো মেশা সেই জল প্রাণ ভরে খেয়ে অনেকক্ষণ ধরে তার জলে স্নান করল সে।

স্নানের শেষে ময়লা শার্টটা তার জলে ধুয়ে নিয়ে নদীর অন্য পাড়ে উঠে এল ইয়েগর। এইখানে সবুজ ঘাসের ওপর গা এলিয়ে দিয়ে নদীর উলটো পাড়ের দিকে চোখ ফেরাল সে। কেমন যেন ভিনগ্রহের দৃশ্য বলে মনে হচ্ছিল তার ও-জায়গাটাকে। আদিগন্ত ছাই দিয়ে ঢাকা। তার বুকে ইতিউতি অজস্র পোড়া গাছের কঙ্কাল আকাশের দিকে নগ্ন হাতগুলো মেলে দাঁড়িয়ে আছে।

সঙ্গের কম্পাসটার কাঁচ ভেঙে গিয়েছিল। জিনিসটার দিকে একনজর দেখে সেটাকে নদীর মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিল ইয়েগর। ও দিয়ে আর তার কাজ হবে না কোনো। এইবার গাছের গায়ে গজানো সোনালি ‘লিচেন’ দের দেখে দিক ঠিক করে নিয়ে উত্তরমুখো রওনা দিল সে। জঙ্গলে পথ হারাবার ভয় তার ছিল না। এদিকে আসবার আগে এই এলাকার একটা ম্যাপ দেখেছিল ইয়েগর। তাতে যে নদীটা দেখা গিয়েছিল, সম্ভবত সেই

নদীটা পার হয়েই সে এইখানে এসে উঠেছে। ম্যাপে ওর কাছাকাছি একট গ্রামও দেখিয়েছিল। কাছাকাছিই সেটা হবে হয়তো কোথাও।

তবে হাঁটা শুরু করবার পর অনেক খুঁজেও মানুষের পায়ে চলা কোনো পথের চিহ্ন খুঁজে পেল না ইয়েগর। চারপাশে শুধু নাম-না-জানা একধরনের লম্বা লম্বা ঘাস, ঝোঁপঝাড়, শ্যাওলা আর লিচেনের দল ভিড় করে আছে। ঘাসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ছোটো ছোটো জলের কুণ্ডিতে পা ভিজে ওঠে তার। সারা গায়ে পোকামাকড়ের হুল ফোটে।

আর সবচাইতে বড়ো সমস্যা যেটা এইবার আস্তে আস্তে দেখা দিচ্ছিল, সেটা হল খিদে। চলতে চলতেই পাইনের ছাল ছিঁড়ে নিয়ে খানিক চিবিয়ে নিচ্ছিল সে। ওর শাঁস ভারি মিঠে লাগে খেতে। কখনো-বা পুরুষ্টু লতা ছিঁড়ে নিয়ে তার রস খেয়ে নেয়া খানিক। ভেজা জমিতে গজিয়ে ওঠা লিলির গোড়া খুঁড়ে তার কন্দও খেয়ে দেখল সে দু-একবার। এ-গাছগুলো তাইগা এলাকা থেকে হারিয়েই গিয়েছে প্রায়। তবে খেতে কন্দগুলো মোটেই সুবিধের নয়। কেমন কাদা কাদা, বিস্বাদ।

এইসব টুকিটাকি খাবারে তার খিদেটা কমবার বদলে বেড়েই উঠছিল ক্রমশ। বড়ো দুর্বল ঠেকছে। মাঝে মাঝে খানিক বসে জিরিয়ে নিয়েও সে দুর্বলতা কাটতে চায় না।

তারপর রাত এল। অরণ্যের নিস্তব্ধতার বুকে তার প্রথম একলা রাত। ছোট্ট একট আগুন জ্বালল ইয়েগর। তাতে ছ’টা দেশলাই কাঠি নষ্ট হল। বাকি রইল মোটে দশখানা। গায়ের ছেঁড়াখোঁড়া আধপোড়া পোশাকে শীত মানে না। শীত কাটাতে আগুনের কাছ ঘেঁষে শুতে গিয়ে মুখটা তার তাতে পুড়ে যাবার দাখিল আর ওদিকে পিঠের দিকটা তখন জমে যাচ্ছে ঠাণ্ডায়। না পারতে শেষমেশ উঠে গিয়ে একটা ছোটো রুপোলি ফারের গাছ কেটে তার ডালপাতা দিয়ে একটা গদিমতো বানিয়ে তাইতে শুয়ে বাকি ডালপাতাগুলো গায়ের ওপর মুড়ি দিয়ে নিল সে। পাছে আগুন লেগে যায় তাই বিছানাটা সাবধানে আগুন থেকে খানিক দূরে সরিয়ে বানিয়েছে ইয়েগর। সেখানে শুয়ে শুয়ে হাজারো চিন্তা তার মাথায় ভিড় করে আসছিল। খানিক বাদে একটু তন্দ্রামতন আসতে সে স্বপ্নে তার ফেলে আসা শহরটাকে দেখল। অনেকদিন হল সে-শহর ছেড়ে এসেছে সে। সেখানকার ভাঙা জীবনটার সঙ্গে অনেকদিন কোনো যোগাযোগ আর নেই তার। কিন্তু তবুও শহরটাকে আর একবার দেখবার বড়ো ইচ্ছে হচ্ছিল তার। স্বপ্নে সে তার মসণ কালো পথ বেয়ে হেঁটে যায়। হালকা, পরিষ্কার বাতাস এসে তার মুখে চোখে লাগে। পথের দু’ধারে নিকেলের আস্তর লাগানো গাছগুলো থেকে বড়ো বড়ো অ্যালুমিনিয়ামের পাতা দোলে। অনেকটা পাতাল রেলের টিকিটের মতো গড়ন সেই পাতাদের। উলটোদিক থেকে পথ বেয়ে তার দিকে কেউ একজন হেঁটে আসছে। সে মানুষ, না অন্যকিছু তা বোঝা যায় না। দূরে কেউ একটা গান গাইছিল চিৎকার করে।

গলাটা শুনে স্বপ্নের ভেতরেই একটু স্বস্তি হচ্ছিল তার। অন্তত একটা জীবন্ত মানুষের গলা তো পাওয়া যাচ্ছে! আবার তারই পাশাপাশি একটা ব্যাখ্যাহীন ভয়ও জাগিয়ে তুলছিল সেই গলাটা। যেন কোনো অশুভ ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে ওর মধ্যে। সেই ভয়টাই অবশেষে ঘুম ভাঙিয়ে দিল তার। একটা দমচাপা আশঙ্কার অনুভূতি হচ্ছিল সারা শরীর জুড়ে। চোখ খুলে সে দেখল আগুনটা কখন যেন নিভু নিভু হয়ে এসেছে। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে সে আগুনে বেশ কয়েক টুকরো কাঠ ছুঁড়ে দিল, আর তার পরেই শব্দটা কানে এল তার। মানুষের গলা!

.

০২.

আস্তে, খুব আস্তে পট পট শব্দ করে জ্বলতে থাকা আগুনটার কাছ থেকে খানিক দূরে সরে গেল ইয়েগর। তারপর নিঃশ্বাস বন্ধ করে কান খাড়া করে রইল। শব্দটা কান্নার। দূরে কোথাও কেউ একজন কাঁদছে। মেয়েদের গলা। ভারি মিষ্টি। কিছু বলতে বলতে বিলাপ করে চলেছে গলাটা। কথাগুলো ইয়েগর বুঝতে পারছিল না। অর্থহীন কিছু শব্দ। কাঁদছে? না গান গাইছে? শব্দটার দিকে মুখ ঘুরিয়ে ইয়েগর এইবার একটা হাঁক দিল। শব্দটা হালকা একটা প্রতিধ্বনি তুলে মিলিয়ে যেতে না যেতে অন্য গলাটা যেন তার জবাবে তার আওয়াজটা বাড়িয়ে তুলল খানিক। ইয়েগর এইবার উঠে গিয়ে আগুনটা ভালো করে নিভিয়ে দিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই হাঁটা লাগাল শব্দটাকে লক্ষ করে। মাঝে মাঝেই থেমে দাঁড়িয়ে একটা করে হাঁক দেয় সে। সঙ্গে সঙ্গেই তার জবাব আসে মেয়েটার কান্না কিংবা গানের শব্দে। তার কথাগুলো বোঝা যায় না সে ঠিক, কিন্তু গলাটা যে মানুষের তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

চলতে চলতেই পথে একটা টিলা পড়ল। বেশ উঁচু। তার গায়ের ঘাস শিশির পড়ে পিছল হয়ে আছে। অন্ধকারের মধ্যে কোনোক্রমে হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে তার মাথায় উঠে এসে থমকে যেতে হল ইয়েগরকে। উধাও হয়েছে গলার শব্দটা। খানিক অপেক্ষা করে কান পেতে শুনে-টুনে নিয়ে এইবার ইয়েগর বেশ কয়েকবার হাঁক দিয়ে উঠল। কিন্তু কোথায় কী? কেউ জবাব দিল না। ইয়েগর তখন কী আর করে, রাগ দেখিয়ে খানিক থুতু যে ছুড়বে অন্ধকারে তারও জো নেই। গলা শুকিয়ে কাঠ। তখন সে চুপচাপ বসে অন্ধকারের মধ্যে তাইগার গভীর রাতের গান শুনতে লাগল। তাইগা গান গায়। তার বুক জুড়ে থাকা বুকে হাঁটা, বাতাসে ভাসা অসংখ্য রাতচরা প্রাণীর ঠোঁটে, বুকে, ডানায় সেই সুর জাগে। কিন্তু তাদের মধ্যে একটা কোনো গলার সঙ্গেও মানুষের গলার মিল নেই কোনো।

খানিক সেই শুনে-টুনে বিরক্ত হয় ইয়েগর ফের একটা আগুন জ্বালাল। বাকি রাতটুকু যদি এইখানেই খানিক ঘুমিয়ে নেয়া যায়! আর ঠিক তখনই ফিরে এল গলাটা। এইবার একেবারে কাছে। এত কাছে যে হঠাৎ সে গলাটা পেয়ে খানিক চমকে উঠেছিল ইয়েগর। চমকাবার আরেকটা কারণ, এইবার গলাটা কী বলছে তা সে বুঝতে পারছে পরিষ্কার। অদেখা মেয়েটার মিষ্টি চঞ্চল গলা আসলে সুর করে তার নাম ধরেই ডাকছে, “ইয়ে-গ র, ইয়ে-গ-র, এদিকে এসো…”

ডাকটা শুনে ইয়েগর আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। বড়ো খিদে পেয়েছে তার। শরীর আর বইছে না। জনপ্রাণীহীন এই তাইগার অরণ্যে গভীর রাতে একটা মেয়ের গলায় তার নাম ধরে ডাক… সেটা যতই সন্দেহজনক হোক, কিন্তু মানুষেরই গলা

তো! ডাকটাকে লক্ষ্য করে অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে টিলার ঢাল ধরে তার উলটোদিকে নেমে চলল সে।

খানিক বাদে তার একেবারে তলায় নেমে এসে একটা সরু নালার বুকে স্থির হয়ে দাঁড়াল ইয়েগর। এদিক ওদিক অন্ধকারে ঘুরে দেখে নিয়ে মুখের দু’ পাশে হাতদুটো জড়ো করে নিয়ে প্রাণপণে হাঁক দিয়ে উঠল, “কোথায় তুমি-ই-ই…”

জবাবে নালা দিয়ে বলয়ে চলা জলের ছলছল শব্দ ভেসে এল কেবল। কেউ উত্তর দিল না। ক্লান্ত শরীরটা টানতে টানতে জল ভেঙে নালাটার পাড়ে উঠে এল ইয়েগর। তারপর ছুটন্ত জলে মুখ ডুবিয়ে আকণ্ঠ জল খেয়ে ফের একবার হাঁক দিতে গেল…

“ও ইয়েগর..”

গলাটা এইবার তার ঠিক পেছনে। চমকে উঠে একটা পাক খেয়ে পেছন দিকে ঘুরতে গিয়ে টাল সামলাতে পারল না ইয়েগর। কাদামাটির বুকে আছাড় খেয়ে পড়তে পড়তেই তার কানে এল চাপা একটা হাসির শব্দ। যেন কেউ মুখে হাত দিয়ে হেসে উঠেছে তার দুর্দশা দেখে।

“হাসছ কেন তুমি?” অন্ধকারের দিকে মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল ইয়েগর, “তুমি কে? বনের আগুন থেকে তুমিই কি আমাকে পথ দেখিয়ে বের করে এনেছ? তাহলে এখন এমন লুকিয়ে আছ কেন?”

“ও ইয়েগর..” মিষ্টি গলাটা ফের একবার ডেকে উঠল তার নাম ধরে, আর তারপরেই খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ে বলল, “এই তো আমি। এইখানে। আমার কাছে এস…”

ভারি কোমল হয়ে উঠেছে গলাটা। প্রায় ফিসফিস করা সেই ডাকে কামনার আবছা আভাস।

রাগ হচ্ছিল ইয়েগরের। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে। এ কেমন রসিকতা এই মেয়ের? খানিক বাদে সে বলল, “আমায় নিয়ে খেলা করছ তুমি? মজা করছ?

করো। যত খুশি মজা করো। আমি এইখানেই দাঁড়িয়ে থাকব। কোথাও যাব না।”

এই বলে নালার ধারের ভেজা মাটির ওপরেই বসে পড়ল ইয়েগর। মাটি ভেজা বলে আর তখন তার কোনো চিন্তা নেই, কারণ নালার জলে নেমে তার আগেই একেবারে ভিজে গিয়েছে সে। তাছাড়া ভূতপ্রেত এইসবে ইয়েগর ভয় পায় না কখনও। মানুষকে তো নয়ই।

“এ মা। এখানে বসে পড়লে কেন?” এইবার মেয়েটার ফিসফিসে গলাটা তার একেবারে কাছে ঘেঁষে এসেছে। ইয়েগরের গায়ে তার নিঃশ্বাসের ছোঁয়া লাগছিল। সে নিঃশ্বাসে উষ্ণতা নেই। যেন নদীর বুক থেকে উঠে আসা হাওয়া। এইবার আর ঘুরে দেখবার চেষ্টা করল না ইয়েগর। তার বদলে ডানহাতটা দিয়ে পেছন দিকে আচমকা ধাক্কা দিল একটা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তুলতুলে নরম, পিচ্ছিল কিছু একটা তার আঙুলগুলোকে ছুঁয়ে সরে গেল নাগালের বাইরে।

“এইখানটায় এসো না! আমি তোমার জন্য কখন থেকে অপেক্ষা করছি তা জানো?” ফের একবার ফিসফিস করে উঠল না-দেখা মেয়েটার গলা। একটু হাসির শব্দও উঠল বুঝি সেই সঙ্গে। সেই চাঁদডোবা রাত, বাতাসের ভেজা ছোঁয়া, নদীর ছলছল, আর না দেখা মেয়েটা ইয়েগরের মনে কোনো একটা স্মৃতি জাগাচ্ছিল। কোথাও পড়েছে? নাকি দেখেছে সে এর আগে? কে জানে! কিন্তু সে স্মৃতিতে কোনো ভয়ের ছোঁয়া ছিল না। একটা মেয়েই তো! ওতে ভয় পাবার কী আছে? কিন্তু তবুও সবকিছুকে ছাপিয়ে একটা অজানা, আসন্ন বিপদের অনুভূতিও তার পিছু ছাড়ছিল না সেই মুহূর্তে। কাজেই এইবার ইয়েগর উঠে দাঁড়াল। মুখোমুখি হয়ে দেখা যাক একবার। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার সামনের বাতাসের আবছা সাদামতো কিছু একটা মৃদু ঝলসে উঠেই ফের গলে মিশে গেল অন্ধকার বাতাসে।

“বার বার এভাবে লুকিয়ে পড়ছ কেন তুমি?” ইয়েগরের গলায় এইবার সামান্য হলেও একটা চ্যালেঞ্জের সুর উঠে এসেছে। হাতে ধরা কুড়ুলটার ফলায় আঙুল বুলিয়ে নিচ্ছিল সে। “যতবারই কাছাকাছি আসছি, ফের লুকিয়ে পড়ছ তুমি। সামনে এসে আলাপ করো না!”

কথাটা বলবার সঙ্গে সঙ্গেই হঠাৎ কিছু একটা এসে তার বুকে সজোরে ধাক্কা মারল একটা। ছিটকে গিয়ে চিত হয়ে পড়ে গেল ইয়েগর। একটা ব্যথার ঝলক ছড়িয়ে গেল তার সারা শরীর জুড়ে। হাত থেকে কুড়ুলটা ছিটকে গিয়েছিল। কিন্তু সেটা চামড়ার ফিতে দিয়ে কোমরের সঙ্গে বাঁধা ছিল বলে বেশি দূর যেতে পারেনি।

“আমার ইয়েগর,” মেয়েটার গলাটা এইবার একেবারে তার কানের কাছে এগিয়ে এসেছে, “আমার প্রিয়তম, আমার ভালোবাসার ইয়েগর…” একটা ঠাণ্ডা হাত এইবার তার মুখটাকে ছুঁল এসে।

“এই যা! যা তুই এখান থেকে।” চিৎকার করে উঠে ছিটকে দূরে সরে গেল ইয়েগর, “কে তুই আমি জানি না। কিন্তু আমার সঙ্গে…”

বলতে বলতেই কাঁপা কাঁপা হাতে একটা দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে সামনে তুলে ধরল সে। কিন্তু তার হলদেটে কাঁপা কাঁপা আলোয় নদীর ধারে ছড়িয়ে থাকা কয়েকটা পাথরের ফাঁকে ফাঁকে বুনো ঘাসের দল মাথা নাড়ছিল শুধু।

কাঠিটা নিভে আসছিল দ্রুত। পোড়া কাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে অন্ধকারের মধ্যেই চারপাশ হাতড়ে কাঠিকুটো জড়ো করতে শুরু করল ইয়েগর। আগুন জ্বালতে হবে একটা। অন্ধকারের মধ্যে তখন ফের তার কাছে ঘেঁষে এসেছে সেই না-দেখা মেয়ে। ঠাণ্ডা হাত দিয়ে তার বুকে, পিঠে, হাত-পায়ে বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছিল সে। কাজ করতে করতেই ইয়েগর বার বার মাছি তাড়াবার মতো করে ছোঁয়াটাকে সরিয়ে দিতে চায়, তবুও বারবারই সে ফিরে আসে তাকে ঘিরে। সেই করতে করতেই গাছগাছালির ডাল ভেঙে, ঘাস উপড়ে জড়ো করে তাতে আগুন লাগাল ইয়েগর। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাতাসে লাফ দিয়ে উঠল আগুনের শিখা। চারপাশের অন্ধকার দূরে সরে গেল খানিক। সেই আগুনটার একেবারে ধার ঘেঁষে বসে ইয়েগর ভাবছিল, ফের কখন নতুন উৎপাত শুরু হয়।

তা সে উৎপাত শুরু হতে দেরি হল না বিশেষ। হঠাৎ হিসহিস শব্দ করে, চারপাশে ফুলকি ছড়িয়ে লাফ দিয়ে উঠেই নিভে গেল আগুনটা। ঠিক যেন কেউ সেটাকে চেপে ধরে নিভিয়ে দিল। আর সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধকারের ভেতরে খিলখিল করে হেসে উঠল গলাটা। যেন একটা যুদ্ধ জয় করে ফেলেছে সে। আওয়াজটা আসছিল তার ডানদিক থেকে। ইয়ের চট করে সেদিকে ঘুরে দেখল। সঙ্গে সঙ্গে হাসিটা তার বাঁদিকে সরে গেল। তারপর সামনে পেছনে ডাইনে বাঁয়ে, মাথার ওপর থেকে বারবার সেই গা জ্বালানো হাসির আওয়াজ। অথচ কোনো পায়ের শব্দ নেই, ডানা ঝাঁপটাবার আওয়াজ নেই কোথাও। শেষমেশ তিতিবিরক্ত হয়ে ইয়েগর যেই বলেছে, “পেত্নী, তোকে একবার ধরতে পারলে আমি…” কথাটা শেষ হবার আগেই মাথার ওপর থেকে গলাটা বলে উঠল, “বজ্জাত কোথাকার! কী করবি তুই আমার?” আর সঙ্গে সঙ্গেই ঠাণ্ডা, ওজনদার কিছু একটা এসে ইয়েগরের পিঠে লাফ দিয়ে পড়ল। দুটো শক্তপোক্ত হাত পেছন থেকে তার বুকে জড়িয়ে ধরেছে। সেই সঙ্গে তার কানে গা জ্বালানো গলাটা কানের কাছে বলে চলেছে, “সোনা আমার, লক্ষ্মী আমার, আমার কাছে আয়… কাছে আয়…”

গায়ের জোরের ভারি গর্ব ছিল ইয়েগরের এতকাল। কিন্তু দেখা যাচ্ছিল মেয়েটার গায়ের জোর তার চাইতে অনেক বেশি। যতই শরীর আঁকিয়ে বাঁকিয়ে চেষ্টা করে ইয়েগর, কিন্তু সেই বাঁধন সে আর ছাড়াতে পারে না। শেষমেশ নিরুপায় হয়ে হঠাৎ সামনে দিকে ঝুঁকে পড়ে একটা পা পেছনে বাঁকিয়ে একটা সপাট লাথি ছুড়ল সে। পা টা গিয়ে লাগল

তলতলে প্লাস্টিসিনের মতো নরম কিছু একটা জিনিসের গায়ে। ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে চিত হয়ে পড়ে গিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই হাঁটুদুটো বুকের কাছে গুটিয়ে তুলে হাতে ছুরিটা ধরে তৈরি হয়ে গেল ইয়েগর। এ কিছু করতে এলে লাথি আর ছুরি দুই-ই চালিয়ে দেয়া যাবে একসঙ্গে। কাজটা অবশ্য কঠিন। একে তো ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, তায় মেয়েটার গায়ে অসুরের মতো জোর আর মাথায় বেজায় চালাকি বুদ্ধি। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হল তাকে চোখে দেখা যায় না।

অত কসরত করে ইয়েগর তখন হাঁফাচ্ছে, অথচ মেয়েটার মধ্যে বোঝা যাচ্ছিল ক্লান্তির কোনো চিহ্নই নেই। ফের একইরকম শান্ত গলায় সে বলে উঠল, “আহা, কী হল ইয়েগর? আমার আদর ভালো লাগছে না বুঝি? আমায় বুঝি তুমি ভালোবাসো না? একটিবার আমায় জড়িয়ে ধরে দেখো, আমার যে খুব শীত করছে! উ-হুঁ-হুঁ…”

বলতে বলতেই হঠাৎ দুটো বরফ ঠাণ্ডা হাত এসে তার শার্টের কলারটা ছিঁড়ে ফেলে তার বুকে আঙুলগুলো বুলিয়ে নিল একবার।

“শয়তান, তুই..” বলতে বলতে ইয়েগর ছুরিটা সটান চালিয়ে দিল সামনের দিকে। কিন্তু কোথায় কী? খানিক হাওয়া কেটে ঘুরে এল ছুরিটা। বরফ-ঠাণ্ডা হাতদুটো ততক্ষণে ফের তার সারা গায়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। খানিক বাদে তরল নাইট্রোজেনের মতো ঠাণ্ডা দুটো পুষ্ট ঠোঁট এসে চেপে বসল তার গালে।

হাসছিল মেয়েটার গলাটা। শান্ত, একেবারে শান্ত গলার হাসি। এইবার ইয়েগরের বুকে ভয় ঢুকল একটু। এ তাকে নিয়ে খেলছে। এ খেলা কখন শেষ হবে? যখন এ সর্বশক্তি নিয়ে হামলাটা করবে তখন?

“কী চাও তুমি আমার কাছে?” হাঁফাতে হাঁফাতে কোনোমতে বলে উঠল ইয়েগর, “আমি তোমার কোন ক্ষতিটা করেছি?”

“কিচ্ছু চাই না। শুধু তুমি আমায় দূরে সরিয়ে দিও না গো। আমায় একটুখানি জড়িয়ে ধরো! ধরো না!”

“ঠিক আছে। কাল সকাল হোক। সূর্য উঠুক। তখন…”

“উঁহু। রাতে… এক্ষুনি!”

“পারব না। কিছুতেই না। তুমি খুব ঠাণ্ডা। একটু আগুন জ্বালাই আগে। তারপর তুমি যা বলবে…”

“না, সোনা। আগুন জ্বাললে হবে না যে।” বলতে বলতেই যেন একটা গোটা বরফের চাঙড় এসে লাফ দিয়ে পড়ে মাটির সঙ্গে ঠেসে ধরল ইয়েগরকে।

ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছিল ইয়েগরের গোটা শরীর। তার ওপর চেপে বসা ভারটার গায়ে মাছ আর জলজ ঘাসের মেটে গন্ধ। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে আসতেই শরীরের শেষ শক্তি বিন্দুটা অবধি একত্র করে একবার হাতে ধরে ছুরিটাকে সে গেঁথে দিল নমনীয় শরীরটার

পিঠে। কিন্তু ছুরিটা কোনো কিছুতে বাধা না পেয়ে সটান তার বেল্টের বকলসটায় ঠেকে ঠক করে শব্দ তুলল একটা। না পারতে ইয়েগর তখন দু’ হাতে প্রাণপণে রবারের স্তূপের মতো জিনিসটাকে চেপে ধরছিল, যদি ওইভাবে ধরে সেটাকে ছিঁড়ে আনা যায় বুকের ওপর থেকে।

“জোরে… আরও জোরে জড়িয়ে ধরো সোনা!” কানের কাছে মেয়েটার গলাটা ফিসফিস করে চলছিল তার, “আহু, কত ওম তোমার গায়ে!”

সরু সরু বরফগলা জলের ধারা একরাশ চুলের মতোই ছড়িয়ে পড়ছিল ইয়েগরের গালে মুখে। মুখের ওপর ঝরে পরা অজস্র চুমুর দিকে খেয়াল না করে ইয়েগর তখন শরীরটাকে দু’হাতে প্রাণপণে চেপে ধরবার জন্য কসরত করে যাচ্ছে। কিন্তু শত চেষ্টাতেও আলিঙনটাকে একটুও হালকা করতে পারছিল না সে।

খানিক বাদে ইয়েগর খেয়াল করল, তার শরীরটা ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে, আর মেয়েটার শরীরটা খানিক গরম হয়ে উঠছে যেন। হাতদুটো তার অবশ হয়ে গেছে ততক্ষণ।

“আমায় মেরে ফেলবি তুই। আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু কেন? কী দোষ করেছি আমি?”

“আমায় একটুখানি ওম দাও, আমি চলে যাব।” বলে উঠল মেয়েটা। আর সেই সঙ্গে ফের তার ঠোঁটদুটো নেমে এল ইয়েগরের ঠোঁটে। এবার সেই চুমুতে সামান্য উষ্ণতা ছিল।

ততক্ষণে ইয়েগরের গোটা শরীরটা একেবারে অসাড় হয়ে এসেছে। নিঃশ্বাসটুকুও নিতে পারছিল না সে আর। তার মনে হচ্ছিল যেন বুকে একটা জগদ্দল পাথর নিয়ে সে কোনো বরফগলা নদীর জলের তলায় ডুবে রয়েছে। পাথরটা তার শরীরের সমস্ত উষ্ণতাটুকুকে শুষে খেয়ে তার গোটা শরীরটাকে গলিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে নদীর স্রোতে। তার গোটা অস্তিত্বটাকে রেণু রেণু করে মিশিয়ে দিয়ে চলেছে হিমশীতল একটা স্রোতের ধারায়।

মৃত্যুর জন্য নিজেকে তৈরি করে নিল ইয়েগর। তার গলা দিয়ে তখন কেবল সামান্য একটা ঘরঘর শব্দ বের হয়ে আসছিল।

ঠিক তখনই নদীর অন্য পাড়ে একটা শিঙা বেজে উঠল। কোনোমতে চোখ খুলে ইয়েগর দেখে রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ভোরের আলো ফুটছে আকাশে। এইবার সেই আলোয় বুকের ওপর উপুড় হয়ে থাকা মেয়েটার মুখটা দেখতে পেল সে। যেন ঘন কুয়াশায় গড়া একটা অপূর্ব সুন্দর মুখ। আধো অন্ধকারের মধ্যে একদলা ফসফরাসের মতো আভা ছড়াচ্ছিল তা থেকে। তার স্বচ্ছ দুটো চোখ শান্তভাবে তাকিয়ে ছিল ইয়েগরের মুখের দিকে। একটা শেষ চেষ্টায় ইয়েগর হঠাৎ মাথাটা উঁচিয়ে মেয়েটার কপালে একটা

তো মেরে তার গালে দু’ পাটি দাঁত বসিয়ে দিল। কিন্তু কুয়াশায় গড়া সেই উষ্ণ মাংসকে ভেদ করে দাঁতগুলো একে অন্যের সঙ্গে ধাক্কা খেল এসে।

ফের একবার ভেসে এল শিঙার সুরেলা আওয়াজ। এইবার আরও জোরে। আলো বেড়ে উঠছিল। আকাশ আর নদীর আবছা আলোর মধ্যে গাছদের অন্ধকার চেহারাগুলো নজরে আসছে এইবার। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা পাথরগুলোও দেখা যাচ্ছে একটু একটু। একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে এলিয়ে পড়ল ইয়েগর। শরীরের শেষ শক্তি-বিন্দুটিও উধাও হয়ে গেছে তার। সারা শরীর জুড়ে অবশিষ্ট আছে কেবল সুতীব্র ঠাণ্ডার একটা অনুভূতি। মেয়েটাকে এখন আর ততটা ভারী ঠেকছিল না ইয়েগরের। মুখটাও এখন অনেকটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এইবার হঠাৎ দুটো কোমল হাত ইয়েগরের বুকে একটু বুলিয়ে দিল সে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইয়েগর টের পেল, একটুখানি শক্তি যেন ফিরে এসেছে তার গায়ে।

এইবার তাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। তখনও খানিক ঝাপসা শরীরটা তার ছিপছিপে, সতেজ। লম্বা চুলের গোছা স্রোতের মতো নেমে এসেছে সেই শরীরকে ঘিরে। তার চোখদুটো গভীর, উদাস। উঠে বসতে চেষ্টা করল ইয়েগর। কিন্তু পারল না। তার আদেশ মানছিল না তার শরীর। একটা গভীর শৈত্য তার গভীরে ছেয়ে রয়েছে তখন। তার রক্তমাংসে বরফের স্তূপ জমে উঠেছে যেন বা। চূড়ান্ত ক্লান্তিতে নিজেকে ভারহীন ঠেকছিল তার। যেন তার গোটা শরীরটাই হারিয়ে গেছে সে-মেয়ের হিমশীতল আদরে।

“তুমি আমায় তোমার উষ্ণতার অর্ঘ্যে পুজো করেছ ইয়েগর।” মেয়েটা কথা বলে। উঠল এইবার, “কাল রাতে আমার অস্তিত্বের সঙ্গে গলে মিশে এক হয়ে গেছ তুমি। এইবার তুমি আমার… তুমি আমাদেরই একজন।” বলতে বলতে মেয়েটা তাকে ছেড়ে নদীর দিকে এগিয়ে গেল। আস্তে আস্তে ঘোলা জলে শরীরটা মিশে গেল তার। কিন্তু তাতে সামান্যতম বদল এল না নদীর স্রোতে। সেই দেখতে দেখতে কখন যে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছে ইয়েগর জানে না।

ঘুম ভেঙে ইয়েগর দেখে বেলা দুপুর হয়েছে। সূর্যটা মাথার ঠিক ওপরে। তার হালকা ওম গায়ে মেখে নিতে নিতে মাটিতে শুয়ে শুয়েই গতরাত্রের ঘটনাগুলো একটা দুঃস্বপ্নের মতো ফিরে আসছিল তার স্মৃতিতে। আস্তে আস্তে একটা হাত মুখে বুলিয়ে দেখল সে একবার। আর তারপরেই খেয়াল করল, কেমন যেন শুকনো কোঁচকানো চেহারা হাতটার। যেন তা অন্য কারও হাত! ভয় পেয়ে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াতে গিয়েছিল ইয়েগর। কিন্তু তার দুর্বল শরীর তখনো তার হুকুম মানতে তৈরি নয়। হাতটা ততক্ষণে তার মুখ ছেড়ে বুক হয়ে পায়ের কাছে গিয়ে পৌঁছে তারপর তার শরীরকে ছেড়ে গেছে। একটু অবাক হয়েই সেটার দিকে দেখছিল ইয়েগর। ওটা আদৌ তার হাত নয়! সেই নেকড়েওয়ালা ইওয়েঙ্ক বুড়ো যেন কোত্থেকে এসে তার পাশে উদয় হয়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তার শরীরে!

পটলচেরা দুটো উদাসীন চোখ তার হলদেটে মুখ থেকে তাকিয়ে ছিল ইয়েগরের দিকে। ইয়েগরের সঙ্গে চোখাচোখি হতে সে তার ঠোঁটদুটো কামড়াল একবার।

“ওহো, তুমি তবে সেই নেকড়েওয়ালা বুড়ো!” ইয়েগর দুর্বল গলায় বলে উঠল এবার, “আমায় একটু জল দেবে? খুব তেষ্টা পেয়েছে।”

জবাবে বুড়ো উঠে গিয়ে খানিক দূরে বসে তার চাবুকটার রশি ঠিকঠাক করতে শুরু করে দিল।

“তুমি রাশিয়ান বোঝো?” এইবার সেদিকে তাকিয়ে ফের বলে উঠল ইয়েগর, “আমায় একটু জল এনে দাও! জল… শুনতে পাচ্ছ?” বলতে বলতে ইয়েগর নদীর দিকে কোনোক্রমে মুখটা ঘুরিয়ে মুখের কাছে হাতদুটো জড়ো করে জল খাবার ভঙ্গি করে দেখাল কয়েকবার।

“নড়াচড়া কোরো না।” এইবার খানিক নাকি সুরে বুড়ো কথা বলে উঠল, “মাভকা তো দেখছি তোমার শরীরের সব ওম চুষে খেয়ে ছিবড়ে করে দিয়ে গেছে একেবারে। এমনিতেই আর বেশিক্ষণ বাঁচবে না তুমি। ও আর জল খেয়েই বা কী, না খেয়েই বা কী?

“ঠিক আছে। মরি তো মরব। এখন একটু জল তো দাও মুখে! তেষ্টায় ছাতি ফেটে গেল যে!”

“উঁহু। সে হবে না।”

“ও বুড়ো, নদীটা তো তোমার পাশেই। একটু জল…”

“আহা! ‘নদী তো তোমার পাশেই “ ভেঙিয়ে উঠল বুড়ো, “আমি কি দেখতে পাই নাকি? জল খেয়ে আর কী হবে শুনি? এক্ষুনি তো মরবে।”

“উফ! তোমার কোন পাকা ধানে মইটা দিয়েছি আমি বলো তো! একটু জল চাইছি তাও…”

“ধুস! একটা মড়া আবার কোন পাকা ধানে মই দেবে আমার?”

“দেখো, মরবার আগে মড়া মড়া বলে ডাকবে না বলে দিচ্ছি!” এইবার রেগে উঠছিল ইয়েগর।

বুড়ো সেকথার কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ তার চাবুকটার মেরামতি সেরে উঠে। দাঁড়িয়ে টুকটুক করে রওনা দিল। খানিক বাদেই তার গানের শব্দ উঠল পাহাড়ের গায়ে। আর সেই সঙ্গে ধুয়া ধরল তার নেকড়েদের ডাক।

রাগে শরীরে নতুন করে শক্তি ফিরে আসছিল ইয়েগরের। কোনোক্রমে কাত হয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে সে নদীটার দিকে এগিয়ে গেল। তারপর জলে মুখ ডুবিয়ে প্রাণভরে জল খেয়ে অবশ শরীরটাকে কষ্টেসৃষ্টে টানটান করে মেলে দিল সূর্যের আলোয়। খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছিল তার। খানিক বাদে শরীরে একটু বল হতে উঠে দাঁড়াল সে। খানিক দূরে পুনর্নবার একটা বড়সড় ঝোঁপ দেখে টলতে টলতে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে তার ডাঁটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে বেশ খানিক রস চুষে খেল। তারপর গায়ের শার্টটা খুলে মাটিতে বিছিয়ে তার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল রোদের মধ্যে।

বিকেল পড়ে আসছিল। সূর্য আস্তে আস্তে ঢলে পড়ছিল পশ্চিম আকাশের গায়ে। সেদিকে চোখ ধরে রেখে ইয়েগর ঠিক করল, যেভাবে হোক বেঁচে তাকে থাকতেই হবে। আর সেটা করতে হলে তাকে এই জায়গাটা ছেড়ে কাছাকাছি কোনো লোকালয়ের খোঁজে বের করতে হবে। ঠিক তখনই পেছনে নদীর ভেতর থেকে একটা ছপাৎ করে শব্দ উঠতে ইয়েগর চমকে সেদিকে ঘুরে তাকাল। দেখে, জলের ভেতর থেকে বড়সড় একটা মাছ ঘাই মেরে লাফিয়ে উঠে পাড়ে এসে পড়েছে। নুড়িপাথরগুলোকে ছিটকে দিতে দিতে ধড়ফড় করছিল মাছটা। সেদিকে চোখ রেখে ইয়েগর একটা লাফ দিল। দুর্বল শরীর নিয়ে লাফটা দিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকতে যে পারবে না এইটুকু সে আন্দাজ করেছিল। সেটা হিসেব করেই সে এমনভাবে লাফটা মেরেছিল যাতে আছড়ে গিয়ে সে মাছটার ওপরেই পড়ে। মাছটা একটা বড়ো মাপের ট্রাউট। গায়ে বেজায় শক্তি। তার ওপরে পড়ে বেশ অনেকক্ষণ প্রাণপণে চেপে ধরে থাকতে অবশেষে তার ছটফটানি থামল।

নদীটার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল ইয়েগর। “হুম। তার মানে কাল রাত্তিরের ফুর্তির দাম মেটাচ্ছ তুমি, তাই না? ভালো। তবে ভেবো না এত সহজে তোমায় ছেড়ে দেব। আমি। বেঁচে থাকলে এইখানে আমি ফের ঘুরে আসব এই বলে যাচ্ছি।”

দেশলাইয়ের বাক্সটা খুলে একবার দেখে নিল ইয়েগর। মাত্র আটটা কাঠি বেঁচে আছে। আর। ভিজে গিয়ে মাথাগুলো জুড়ে গেছে সেগুলোর। এর একেকটা কাঠি জ্বালানো মানে তার বেঁচে থাকবার আশা খানিকটা করে কমে যাওয়া। যত্ন করে কাঠিগুলোকে ছাড়িয়ে নিয়ে সেগুলোকে পড়ন্ত রোদে শুকোতে দিল ইয়েগর। তারপর সেগুলোকে হাতের তালুতে ঘষে, ফুঁ দিয়ে দিয়ে বেশ খানিক শুকনো করে নিয়ে ফের বাক্সটায় ঢুকিয়ে রেখে মাছটাকে কাঁচাই খেয়ে নিয়ে ফের গিয়ে উঠল গতরাত্রের সেই টিলাটার মাথায়। সেখান থেকে সাবধানে চারপাশে তাকিয়ে দেখে নিল সে একবার। কোথাও দাবানলের ধোঁয়া টোঁয়া নজরে পড়ে কি না। কিন্তু নাহ! চারদিক সবুজে সবুজ হয়ে আছে। আগুনের চিহ্নও নেই কোনোদিকে।

খানিক বাদে সূর্যের দিকে নজর ফেলে দিক ঠিক করে নিল সে। তারপর জুতোদুটো পায়ে গলিয়ে পকেটে দেশলাই বাক্সটা ভরে ছুরিটা কোমরে বেঁধে নিয়ে টিলাটার মাথায় নুড়িপাথরের একটা ঢিবি বানাল। পরে কখনো এইখানটা ফিরে এলে জায়গাটাকে ওই ঢিবি দেখে চিনে নেয়া যাবে। কাজটা শেষ করে পায়ের তলা দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটার দিকে চোখ ফেলে ইয়েগর হাঁক দিল, “মাভকা, মাথাটা তুলে একবার দেখ হে! আমি চললাম গো সুন্দরী।”

নদী কোনো জবাব দিল না। তার ঢেউগুলো একই ছন্দে বয়ে চলল শুধু। কেবল অনেক দূরে শিঙার শব্দটা একটা মধুর সুর তুলে তার সপ্তকে চড়ে একেবারে হঠাৎ করেই থেমে গেল।

পরদিন জঙ্গল বেয়ে বেশ খানিক ঘোরাঘুরি করে ইয়েগর নিশ্চিত হল, সে একেবারে হারিয়েই গেছে। কেউ যে তার খোঁজে জঙ্গলে লোক পাঠাবে না একথা তার জানা ছিল, কিন্তু তবুও সেদিন সকালে হঠাৎ দূর থেকে একটা হেলিকপ্টারের শব্দ পেয়ে খানিক আশা হয়েছিল তার। কিন্তু খানিক বাদেই সে শব্দ মিলিয়ে গেল। আর ফিরে এল না।

আসলে দাবানলের এলাকা ছেড়ে সেই না-দেখা মেয়েটার পিছু পিছু ইয়েগর সেই এক রাত্রে প্রায় একশো কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছিল। কেমন করে তা সম্ভব সেসব ইয়েগরের জানবার কথা নয়। হেলিকপ্টারের শব্দ মিলিয়ে যাবার পর ফের সে জঙ্গল বেয়ে চলা শুরু করল। এ জায়গাটায় হাজারো গাছ উপড়ে পড়ে আছে জঙ্গলের মধ্যে। তাদের ডালপালা আর শেকড় এড়িয়ে পথ চলা দায়। তবুও ওরই মধ্যে এগোতে এগোতেই, গত দুটো দিনের ঘটনাগুলো নিয়ে মনের ভেতর নাড়াচাড়া করছিল সে। আগুনের মধ্যে দিয়ে ওই আশ্চর্য জাদু রাস্তাটা… তারপর তাকে ভুলিয়ে এনে মাভকার রাতভর ঠাণ্ডা আদর… এদের কোনোটারই কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছিল না সে। পাহাড়ে ইয়েতি আছে, মহাকাশে ইউএফও, লক নেস-এর গভীরে প্লেসিওসরাস, এই আজগুবিদের কথা মেনে নিতে তার বিশেষ সমস্যা নেই। কারণ এরা তার রোজকার জীবনে সামনে এসে দাঁড়ায় না।

কিন্তু মাভকা এবারে তাকে একটা কঠিন সমস্যার সামনে এনে ফেলে দিয়েছে। গোটা একটা রাত তার সঙ্গে কাটাবার পরেও গেঁয়ো গালগল্পের জলপরি যে সত্যি সত্যি থাকতে পারে একথা কিছুতেই নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছিল না সে। তাকে ঘিরে অচেতন প্রকৃতি নিজেকে নিয়ে বুঁদ হয়ে আছে, আর তার মধ্যে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইয়েগর, একমাত্র চেতনাওয়ালা জীব, দুনিয়ার মালিক। এই তো সে শিখে এসেছে চিরটা কাল! হ্যাঁ, আজ হয়তো সে খানিক বিপদে আছে, কিন্তু তাই বলে সেই মালিকানায়।

আর কোনো ভাগীদার আছে সেকথা মেনে নেয়া দূরস্থান, ভাবাও তার কাছে কঠিন।

নামহীন নদীটা, একইরকম নামহীন একটা অরণ্যের বুক বেয়ে বয়ে যাচ্ছিল। নির্জন দুপুরবেলা ঝোঁপঝাড়গুলোর ভেতর থেকে গবলিনরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিল। নদীর বুকে ঘূর্ণিগুলোর মধ্যে জলপরিরা দুপুরের খাওয়া শেষ করছিল। একজন জলদানব নদীর গভীরে বসে জং ধরা একটা হারপুন দিয়ে দাঁত খুঁটছিল। পুরনো বিশাল গাছদের গায়ে নখে ধার দিচ্ছিল অজানা, উদ্ভট সব জন্তুরা। জঙ্গলের গভীরে কোনো এক জায়গায় কফিনের মধ্যে শুয়ে ছিল বাবা ইয়াগা। পেটে গেঁথে রাখা অ্যাসপেন কাঠের টুকরোটাকে খুলে ফেলবার জন্য শরীরটায় মোচড় দিচ্ছিল সে। আরেক জায়গায় নেকড়ে-মানুষরা, একটা খোঁটার মাথায় গেঁথে দেয়া একটা ছুরির ওপর দিয়ে লাফ মেরে নেকড়ের রূপ ধরে

মাটি ছুঁচ্ছিল এক এক করে। একটা পুরনো গাছের খোঁদলের ভেতর বসে জুজুবুড়ো তার প্যাঁচার মতো চোখদুটো পিটপিট করে যাচ্ছিল। জঙ্গলের মাঝখানটায় একটা পায়ে চলা পথের ওপর একজন বাস্তূপরি বসে ছিল, কোনো মানুষ সে রাস্তায় গেলে যদি তার সঙ্গ ধরতে পারে সেই আশায়। একজায়গায় স্লাভ পিশাচ বেলবগ ভালুকের মাংস চিবোচ্ছিল পরম আনন্দে। তার মুখটা মরা মশার রক্তে লাল হয়ে আছে।

আর তাদের সেই জমজমাট বসতির মাঝখানে একজন একেবারে সাধারণ সাদাসিধে মানুষ দাঁড়িয়ে একা একা একটা পাইনগাছের গায়ে কোপের পর কোপ বসাচ্ছিল। মরতে বসা গাছটাকে ঘিরে বেশ কিছুদূর অবধি কাঠের টুকরো ছিটকে যাচ্ছিল। অনেক দূর থেকে নেকড়ের একটা দল কাঠের গায়ে ধাতুর কামড়ের সেই শব্দগুলো শুনে কান খাড়া করে উঠছিল। মানুষ জন্তুটার সঙ্গে খুব একটা ভাব-ভালোবাসা তাদের নেই।

.

০৩.

গাছটা ইয়েগরই কাটছিল। তার কারণ ছিল একটা। আসলে নদীটার দিকে চোখ ফেললে একটু ভয় ভয় ঠেকলেও ওর কাছছাড়া হবার কোনো মতলব ছিল না তার। জঙ্গলের ভেতর এলোমেলো ঘুরে বেড়ানোর চাইতে নদীর স্রোত ধরে এগোনো অনেক সহজ। কাজেই সে মতলব করেছিল, একটা ছোটো ভেলা বানিয়ে নদীর বুক বেয়েই এগোবে এবারে।

নদীর কাছাকাছি পাহাড়ের একটা ঢালের গায়ে জুতসই ক টা পাইনগাছ বেছে নিয়ে প্রথমে কুড়ুলটায় ভালো করে ধার দিল সে। তারপর গাছ কাটা শুরু করে দিল। তবে খিদে আর ক্লান্তিতে মাঝেমধ্যেই কাজ ছেড়ে বসে হাঁফাচ্ছিল ইয়েগর। দু-একবার তো মাথা ঘুরে উঠে মাটিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।

বনের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে গত কয়েকদিনে ইয়েগরের একটা উন্নতি হয়েছিল। কানটা তার সবসময় খাড়া থাকত। গাছ কাটার ফাঁকে একবার হাঁফ ছাড়তে বসেছে, তা শোনে পেছনে কেউ যেন খুব পা টিপে টিপে হেঁটে আসছে। আওয়াজটা পেতেই তৈরি হয়ে গেল ইয়েগর। উঠে দাঁড়িয়ে কুড়ুলের ডাঁটি বাগিয়ে ধরে একটা পাইনের গায়ে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল সে। অমনি পায়ের আওয়াজ বন্ধ হয়ে গিয়ে একটা খচমচ শব্দ উঠল পেছনে। সেদিকে ঘুরে ইয়েগর দেখে এ সেই নেকড়েওয়ালা ইওয়েঙ্ক বুড়ো। একটা ছোটো ঢিবির মাথায় হাঁটুদুটো পেটে ঠেস দিয়ে উবু হয়ে বসে আছে। রাগ রাগ চোখে সে অর্ধেক কাটা গাছটার দিকে দেখছিল।

“হুম। তা আছ কেমন?” ইয়েগরই প্রথম কথা বলল। তারপর কুড়ুলটা তুলে ধরে দেখিয়ে ফের বলল, “বেঁচে আছি গো বুড়ো। মরিনি। তা তোমার নেকড়ের পাল কোথায় গেল?”

“তুমি গাছটাকে খুন করছ কেন?

“তাতে তোমার কী হে? আমার কাঠের দরকার তাই গাছ কেটে তার বন্দোবস্ত করছি। সে নিয়ে মাথাব্যথা করবার তুমি কে?”

“আমি দিওবা-গুও।” বুড়ো জবাব দিল, “দুনিয়াসুদ্ধ লোক আমায় চেনে, আর তুমি আমায় চেনো না? আমায় দেখে আর দশজনের মতো ভয়ডরের বালাইও তো দেখছি না!

“ধুত্তোরি তোর ভয়! চুলোয় যা বজ্জাত।” বলে ফের মুখ ঘুরিয়ে গাছের গায়ে কোপ মারল সে।

“উফ! উফ! লাগে যে! আমায় মারছ কেন?”

“এখনই হয়েছে কী?” গাছ কাটতে কাটতেই জবাব দিল ইয়েগর, “এখন তো কেবল একটা গাছ কাটছি। এবার যখন সত্যি সত্যি ঠ্যাঙে এসে কোপ বসাব তখন টের পাবে মার কাকে বলে।”

বলতে বলতেই দ্বিগুণ উৎসাহে কুড়ুল চালাল ইয়েগর। আর সেই সঙ্গে সঙ্গেই বেড়ে গেল বুড়োর আর্তনাদের বহর। ব্যথায় যেন ছটফট করছে সে, “উফ! উফ! কেন আমার জঙ্গলটাকে এভাবে মারছ তুমি? কী ক্ষতি করেছে ও তোমার?”

“ক্ষতি করবে কোন দুঃখে? আরে আমায় তো প্রাণটা বাঁচাতে হবে, নাকি? বোঝ না নাকি কিছু?”

“আরে বাঁচবে যদি তো প্রাণভরে যত খুশি বাঁচো না! কে মানা করছে?” বুড়ো শান্ত গলায় জবাব দিল, “নদীর ধারে প্রাণটা যখন যায়নি তখন যদ্দিন খুশি বেঁচে নাও। বেঁচে থাকা তো দারুণ জিনিস!”

“আরে জানি জানি। ওসব আর তোমায় বলতে হবে না।” বলতে বলতেই ফের গাছের গায়ে কুড়ুল চালাল ইয়েগর। “ওইসব বুমার্কা জ্ঞানবাণী আমায় আর শুনিও না তো!”

“তুমি বেজায় বদ লোক দেখছি!” বুড়ো দেখা গেল এইবার খানিক রেগে উঠছে, “সবাই, সবকিছু বেঁচে থাকতে চায়, আর তুমি গাছটাকে চোখের সামনে মেরে ফেলছ? ওতে করে আমাকেও তুমি মেরে ফেলছ যে!

“হা হা। নদীর ধারে কী হয়েছিল মনে আছে? একটা ফোঁটা জল চেয়ে মরছিলাম। কী করেছিলে তখন, অ্যাঁ? দয়া করেছিলে আমায়? তেষ্টায় আমার প্রাণটা যখন যাচ্ছিল তখন তো দিব্যি সেখান থেকে উঠে চলে গেলে। আর এখন এসেছে গাছের প্রাণ বাঁচানোর ওকালতি করতে? সোজা কথা বলছি, মানে মানে এখান থেকে বিদেয় হও। আমি আমার কাজ করি।”

“আহা, কী আশ্চর্য! তোমায় দয়া করতে যাব কেন? তুমি তো মানুষ! দুনিয়াজোড়া। কত মানুষ আছে বলো তো! আর আমি? আমি হলাম একদম একলা।”

“মানুষ দু-একটা কমলে অসুবিধে কী? অনেক আছে তো। তাছাড়া তোমরা নিজেরাও তো নিজেদের কত লোকজনকে মেরে ফেলো। তাহলেই বলল, একটা মানুষ কমবেশি হলে কী যায় আসে?

“কিন্তু আমার কথা আলাদা। আমি পৃথিবীতে একলা। একদম একলা। আমি হেন দুটি দিওবা নেই দুনিয়ায়। জঙ্গলে আগুন লাগলে আমার ব্যথা লাগে। একটা গাছ কাটলে, একটা জংলি জানোয়ারের প্রাণ গেলে আমার ব্যথা লাগে।”

“দেখো, বাজে কথা বেশি বোলো না।” ইয়েগর ঝাঁঝিয়ে উঠল এবার, “খালি খালি মানুষের দোষ দিচ্ছ যে বড়ো? জঙ্গলে জন্তুরা বুঝি কেউ কাউকে খুন-টুন করে না? তাদের অত দরদ দেখাবার তুমি কে হে?”

“বললাম তো, আমি দিওবা-নগুও।”

“ভালো। এবার তোমার নেকড়েদের নিয়ে বিদেয় হও। আমায় জ্বালিও না।” বলতে বলতেই ইয়েগর গাছটার গায়ে ফের কুড়ুলের ফলা বিধিয়ে দিল।

বুড়ো বিষমুখে মাথা নাড়ল একবার, “এই যে তাইগা, নেকড়ে, আমি, মাভকা… আমাদের সবার মা হল মৌ-ন্যামি, মানে ধরিত্রী। আমাদের সবারই তাই একটাই আত্মা। এই যে তুমি গাছটায় কুড়ুল মারছ, তাতে গোটা জঙ্গলটার ব্যথা লাগছে। আমার ব্যথা লাগছে। টের পাও না তুমি? অবশ্য পাবেই বা কী করে? মানুষ তো আর মৌ-ন্যামির সন্তান নও! সে হল পাতালরানি সিরাদা-ন্যামির ছেলেপুলে। তাই তোমাদের কলজেগুলো এত ঠাণ্ডা। দয়ামায়া, বুদ্ধি কিছুই নেই।”

“পাগল-ছাগলের কথায় আমি পাত্তা দিই না।” কুড়ুল চালাতে চালাতেই ইয়েগর বলল, “তুমি তোমার ওসব গালগপ্পো অন্য জায়গায় গিয়ে শুনিও।”

শুনে বুড়ো হঠাৎ থেমে গিয়ে ভুরু কুঁচকে দেখল ইয়েগরের দিকে। তারপর বলল, “মাভকার সঙ্গে একটা গোটা রাত কাটাবার পরেও এসব পাগল-ছাগলের কথা বলে মনে হচ্ছে বুঝি? কেন যে ‘ইচ্ছেধারী’ টা শিঙে খুঁকে ওকে আটকাতে গেল! মেরে ফেললেই ভালো হত।”

“দিওবা, এখনও বলছি, বিদেয় হও।” বলতে বলতে কুড়ুলটা নামিয়ে ধরল ইয়েগর, “আমায় জ্বালিও না বলে দিচ্ছি।”

“জ্বালাব না মানে? এই বনটাই তো আমার শরীর! তুমি তাকে কেটেকুটে একশা করছ, তাতে আমার আত্মায় ব্যথা লাগছে, আর আমি বলব না?”

“আত্মা মানে? কার আত্মার কথা বলছ?” ইয়েগর এইবার দাঁতে দাঁতে ঘষছিল, “তোমার আত্মা তো তোমার ওই হাড়হাভাতেমার্কা শরীরটায় কোনোমতে খাবি খাচ্ছে।”

“সে তো তোমাদের দোষে!” বুড়োও গলা চড়াল, “জঙ্গলে আগুন দিয়ে, গাছ কেটে, জীবজন্তুদের মেরে, নদীতে বিষ দিয়ে তাণ্ডব করছ যুগ যুগ ধরে। সেইজন্যই তো আমার শরীরের এই হাল হয়েছে।”

“হয়েছে তো হয়েছে। তাতে আমার কী?” বলতে বলতে ইয়েগর পাইনগাছটার গায়ে ফের একবার কুড়ুলের কোপ মারল।

সঙ্গে সঙ্গেই ব্যথায় ঝাঁকিয়ে উঠল বুড়ো, “তুমি লোকটা বড্ড খারাপ হে! এইবার আমি রেগে যাচ্ছি। আগে তোমায় দিয়ে পাইনগাছটার চোট সারাই করাব। তারপর নেকড়ের পালের হাতে তুলে দেব তোমায়। জানো তো নেকড়েরা মানুষ পেলে কী করে?”

“আরে যা যা পাগল বুড়ো!” ইয়েগর কুড়ুল চালাতে চালাতে জবাব দিল। “ভালো কথায় বলছি, গায়ের শার্টটা ছিঁড়ে সরু সরু ফালি বানিয়ে গাছটার কাটা জায়গাটা ব্যান্ডেজ করে দাও।”

“দুঃখিত মহারাজ। ফার্স্ট এইড বক্স সঙ্গে আনিনি।” কুড়ুল চালাতে চালাতে কথাটা বলতেই ইয়েগর টের পেল কানের কাছে একটা মৌমাছি গুনগুনিয়ে উঠছে। এক হাতে একটা চাপড় মেরে মৌমাছিটাকে ভাগিয়ে দিল সে। কিন্তু তার কয়েক মিনিটের মধ্যে দেখা গেল বিরাট একটা মৌমাছির ঝাঁক ডেকে এনেছে সেটা। ইয়েগরের মাথা ঘিরে একটুকরো মেঘের মতোই ঘুরতে ঘুরতে গোঁ গোঁ ডাক ছাড়ছিল ঝাঁকটা।

“এখনো বলো, আমার গাছটার চোট সারিয়ে দেবে?” মৌমাছির ডাকের মধ্যে দিয়ে বুড়োর গলাটা শুনে দাঁতে দাঁত চেপে ইয়েগর বলল, “কক্ষনো না।”

সঙ্গে সঙ্গেই মৌমাছির ঝাঁকটা তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল এসে। তাদের হাত এড়িয়ে পালানো কঠিন। শত চেষ্টাতেও তাদের একজনেরও নাগাল পাওয়া যায় না। চোখের পলকে ইয়েগরের চোখদুটো হুল খেয়ে ফুলে উঠে বন্ধ হয়ে গেল। বিষের জ্বালায় অস্থির হয়ে সে ধুলোর একটা ঝড় তুলে ঢালটা দিয়ে গড়িয়ে পড়ে নদীর জলে ঝাঁপ দিল।

জলটা কনকনে ঠাণ্ডা। সেখানে ডুব দিয়ে থাকলে দম বন্ধ হয়ে আসে। ওদিকে মাথা তোলাও মুশকিল। কারণ, মাথার ওপর মৌমাছির ঝাঁক অপেক্ষায় রয়েছে। মাথা ভাসালেই ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা দল বেঁধে। তারপর একটু বাদে জলের তলায় কেউ তার পায়ে একটা জোরদার কামড় দিল। তারপর ফের একটা কামড়। দু-নম্বরটা অনেকটা করাতের টানের মতো পা-টাকে যেন চিরে দিয়ে গেল তার। জিনিসটা যে ঠিক কী, সেটার কোনো আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছিল না। জলের নিচে অদৃশ্য থেকে সেটা ইয়েগরকে ঘিরে

ঘোরে আর একেকবার শরীরের একেক জায়গায় করাতের মতো দাঁত দিয়ে হামলা চালায়।

পারতে শেষমেশ ইয়েগর জল ছেড়ে ডাঙায় ছুটে এসে বালি খুঁড়ে তার নিচে লুকোবার চেষ্টায় ছিল, ঠিক তখনই বালির তলা থেকে কিছু একটা উঠে এসে তার পেটে একটা মোক্ষম কামড় দিল। তারপর তো সেটা কিচ কিচ করে ডাক ছাড়ে আর তার পেটে, পিঠে, থাইতে কামড় লাগায়।

নাস্তানাবুদ হতে হতেই সে শোনে বুড়ো হাসি হাসি গলায় বলছে, “গাছটার চোট সারাবি এবার? নাকি আরও কিছুক্ষণ…”

“কসাইগুলোকে হটাও আগে আমার কাছ থেকে!” বলে আর্তনাদ করে উঠল ইয়েগর।

সঙ্গে সঙ্গেই আক্রমণকারীরা উধাও। ভেজা মাটিতে মুখ গুঁজে খানিকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইল ইয়েগর। তারপর খানিক দম নিয়ে উঠে টলতে টলতে রওনা হল। সারা শরীর দাঁত আর হুলের ঘায়ে ফুলে ফুলে উঠেছে তার। কোনোমতে ফের ঢাল বেয়ে উঠে অর্ধেক কাটা গাছটার গোড়ায় গিয়ে দাঁত চেপে সেখানটায় বসে পড়ল সে।

“হতচ্ছাড়া বজ্জাত বুড়ো!” বলতে বলতে ফুলে ওঠা ঠোঁট দুটো কোনোরকমে ফাঁক করে একদলা থুতু ছুড়ল সে সামনের মাটিতে।

“জামাটা ফালি ফালি করে ভেঁড়ো।” দিওবা শান্ত গলায় বলল, “পাইনগাছটার চোট সারাও প্রথমে। তারপর নদীটাকে ধুতে হবে।”

“নদী ধুতে হবে… মানে? পাগল হলে নাকি? নদী কি ধোয়া যায় নাকি?”

“মানুষ জলে বিষ দিয়ে নদীর মাছ সব মারতে পারে, আর তাকে ধুয়ে সাফ করতে পারে না? ওসব জানি না। নাও, এখন আগে গাছটার বন্দোবস্ত করো।”

“পাগল বুড়ো কোথাকার।” বলতে বলতে লজ্জায় অধোবদন হয়ে ইয়েগর গায়ের শার্টটা খুলে ফালি ফালি করে ছিঁড়ে ফেলল। জামাটা পুরনো। সুতো পচে এসেছে। সামান্য টান দিতেই এবড়োখেবড়ো হয়ে ছিঁড়ে গেল সেটা। মৌমাছির কামড়ে ফুলে ওঠা চোখ দুটোকে কোনোক্রমে সামান্য ফাঁক করে ইয়েগর ফালিগুলো দিয়ে পাইনটার কাটা জায়গাটা বাঁধছিল। ক্ষত থেকে বের হয়ে আসা আঠালো ধুনোর রস তার হাতে এসে লাগছিল। ফালির পর ফালি বাঁধতে বাঁধতেই সজ্ঞানে এরকম একটা পাগলামি করতে বাধ্য হয়ে একটা তিক্ততা ছেয়ে ফেলছিল তাকে।

“তোমায় আমি দেখে নেব বুড়ো!” কাজটা করতে করতেই ভাঙা গলায় সে একবার চিৎকার করে উঠল।

“গাছটার চোট সারাও আগে।” বুড়ো শান্ত গলায় জবাব দিল, “যখন আমার যন্ত্রণা হচ্ছিল আমায় তুমি দয়া করোনি। এখন নিজের ওপরেই দয়া দেখাও খানিক। শরীরে জ্বালা হচ্ছে, তাই না? গাছটার জ্বালা কমাও, তাহলে নিজের জ্বালাও কমবে। ব্যথা দিলে ব্যথা পাবে। তোমাদের মানুষদের নিয়ে এই হল মুশকিল, সিধে কথা তোমরা বোঝে না। মারধোর না দিলে, প্রাণের ভয় না দেখালে তোমাদের দিয়ে কোনো কাজ হয় না।” বলতে বলতেই মাথা নাড়াচ্ছিল বুড়ো।

খানিক বাদে পাইনের গায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে তার দুটো মাথা দিয়ে একটা সুন্দর বো বেঁধে দিল ইয়েগর। “হয়েছে? তোমার গাছের সেবাটা ভালো করে করেছি? নাকি…”

“হুম। চলোলা। এবার নদীটা ধোয়া শুরু করো। কী যে নোংরা হয়েছে!”

“সাবান-টাবান কিছু নেই সঙ্গে…” ইয়েগ গজগজ করে বলল। “দরকার নেই। সাবান ছাড়াই ধোয়া যাবে।”

“কী করে ধুতে হবে সেটা তবে দেখিয়ে দাও। তুমি অর্ধেক ধোবে, আমি অর্ধেক ধোবো।”

দু’জন মিলে নদীর ধারে যেতে ইয়েগর ভয়ে ভয়ে বলল, “ফের তোমার মাছ লেলিয়ে দেবে না তো?”

“উঁহু। নাও, জলে ঝাঁপ দাও দেখি।”

“এই দিই।” বলে ইয়েগর খানিক দৌড়ে এসে সটান ঝাঁপ দিয়ে পড়ল জলে। তারপর প্রাণপণে ডুবসাঁতার দিয়ে নদীর উলটো পাড়ের দিকে রওনা দিল। ভয়ে তার গায়ে তখন অসুরের শক্তি। কিন্তু তাও নদীর স্রোত তাকে ভাটার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

শেষমেশ সে অন্য পাড়ে যেখানটায় গিয়ে উঠল, সেখান থেকে এদিকের পাইনগাছটা আর চোখেই পড়ে না। এখানটায় জমিটা খানিক নাবাল আর ঘাসে ঢাকা। ইয়েগর সাবধানে একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিল। বুড়োকে কোথাও চোখে পড়ছে না।

তবুও সাবধানের মার নেই ভেবে সে খানিকক্ষণ সেই ঘাসে ডুবে চুপচাপ শুয়ে রইল।

খানিক বাদে দম ফিরে পেলে উঠে বসে গায়ের কাটাকুটিগুলো ভালো করে দেখল ইয়েগর। কোনোটাই মারাত্মক কিছু নয়, কিন্তু ওতে বিপদের ভয় আছে। সঙ্গে কোনো ব্যান্ডেজ বা ওষুধ নেই। সামান্য কোনো সমস্যা হলেও এই নির্জন তাইগায় তা থেকে প্রাণ যেতে পারে।

আস্তে আস্তে নদীর জলে নেমে সে ফের একবার ক্ষতগুলো ভালো করে ধুয়ে নিল। একটা কলাগাছ পেলে ওর পাতার রস লাগানো যেত, কিন্তু খুঁজেপেতে সে গাছের কোনো চিহ্ন মিলল না। তাইগায় ও-গাছ হয় না। বাইরে থেকেও কেউ কখনো সে গাছের বীজ

এখানে নিয়ে আসেনি। কারণ, বাইরের মানুষের পা কখনো পড়েনি তাইগার এই একেবারেই কুমারী বনাঞ্চলে।

খানিকক্ষণ সেই ব্যর্থ খোঁজাখুঁজি করে ইয়েগর পকেট থেকে দেশলাইটা বের করে দেখল একবার। কাঠিগুলো নদীর জলে ভিজে ফুলে উঠেছে একেবারে। সেগুলোকে খানিক আঙুলে ধরে ঘুরিয়ে দেখে শেষে টোকা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল ইয়েগর। ও দিয়ে কাজ হবে না আর কোনো।

সেগুলোকে জলে ভেসে যেতে দেখতে দেখতে ইয়েগর নিজের মনেই বলছিল, ‘দাবানলের তাড়া খেয়ে, নদীতে আধডোবা হয়ে, ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে, মৌমাছি আর মাছের হামলা সয়ে তাও প্রাণে বেঁচে আছ হে! তার মানে সহজে তোমার প্রাণ যাবে না। চলো দেখা যাক!’ এই বলে নদীর পাড়ের জলা এলাকাটার মধ্যে দিয়ে সে রওনা হল।

খানিক বাদে শুকনো একটুকরো জমিতে পৌঁছে সেখান থেকে এগিয়ে যাওয়া একটা পায়ে চলা পথের মুখে এসে একটু থমকে দাঁড়াল ইয়েগর। তারপর কী ভেবে চার হাতপায়ে উবু হয়ে বসে পড়ে পথটার দিকে খানিক চোখ ফেলে তার মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। হারিয়ে যাবার পর থেকেই যে জিনিসটা দেখবার জন্য তার মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে, অবশেষে সে জিনিসের চিহ্ন দেখা গেছে ওই রাস্তাটার গায়ে মানুষের চিহ্ন। নরম মাটির বুকে একটা লম্বাটে, সরু দাগ। কেউ কোনো ভারী জিনিস টেনে নিয়ে গেছে এইখান দিয়ে।

দাগটা দেখেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে হাঁক দিল ইয়েগর, “শুনছেন? কেউ কি আছেন?”

তার গলার আওয়াজটা চারপাশের পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ফের প্রতিধ্বনি হয়ে তার মাথার ওপর দিয়ে ভেসে গেল। আর ঠিক তখনই তার কেমন যেন মনে হল, সামনের মধুলতার ঝোঁপটার ঠিক পেছন থেকে কেউ তাকে দেখছে। হয়তো নিজের হাঁকডাকের প্রতিধ্বনির শব্দের জন্য ইয়েগর তার আসবার শব্দ পায়নি।

ঝোঁপটার দিকে ঘুরে কাউকে দেখতে পেল না ইয়েগর। খানিক অপেক্ষা জোরে সে হাঁক দিল, “আরে লুকিয়ে আছ কেন? বের হয়ে এসো না! ভয় কী? আমি মানুষ। রাক্ষস টাক্ষস নই।”

“আগে কুড়ুলটা ফেলো।” ঝোঁপের আড়াল থেকে ভারি মিষ্টি একটা গলা কথা বলে উঠল তার জবাবে।

“এটা কি মাভকা নাকি?” বলতে বলতে ঘাবড়ে এগিয়ে দু-পা পিছিয়ে গেল ইয়েগর, “তাই যদি হয় তাহলে এক্ষুনি ভাগো এখান থেকে।”

ঝোঁপের ভেতর থেকে এইবার ভারি নরম, মিষ্টি একটা হাসির শব্দ ভেসে এল, “ধুৎ! আমি মাভকা হতে যাব কেন?”

হাসিটা শুনলে বেশ ভরসা জাগে। ইয়েগর হাতের কুড়ুলটা মাটিতে নামিয়ে রাখল। তারপর বলল, “আমায় ভয় পাবার কিছু নেই। কোনোমতে প্রাণটুকু টিকে আছে। তোমার গ্রাম কি কাছাকাছি? কিছু খাবার এনে দিতে পারবে আমায়? খিদেয় চোখে অন্ধকার দেখছি আমি।”

এইবার মধুলতার ঝোঁপটার পেছন থেকে মেয়েটা বেরিয়ে এল। ঠিক মেয়েও বলা যায় না। এইটুকুন একটা বাচ্চা। ভারি রোগা। ছবির মতো সুন্দর। গালে রাস্পবেরির রসের দাগ। গায়ে একটা লাল সারাফান, মাথায় সাদা রুমাল।

দেখে ইয়েগর একটু নিশ্চিন্ত হল। বলে, “এখানে কোত্থেকে এসে উদয় হলি তুই? আমি তো ভেবেছিলাম এ মুলুকে আর মানুষের দেখাই পাব না কোনোদিন।”

বলতে বলতেই খানিক নিশ্চিন্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল ইয়েগর। ফুলে ওঠা ঠোঁট দুটো ছড়িয়ে হাসবার চেষ্টাও করল খানিক। তারপর বলল, “গোল গোল চোখ করে দেখছিস কী? আমার মুখচোখের অবস্থা দেখলে ভয় খাবারই কথা। তবে আমি বুনো ভূত-টুত কিছু নই। আমি ইয়েগর। তাইগার জঙ্গলে হারিয়ে গিয়ে কয়েকটা ভূতপেত্নীর খপ্পরে পড়েছিলাম। মজা দ্যাখ, তাও মরিনি আমি। আয়, আমার পাশে একটুখানি বোস। আমি একটু ঘুমুই। তারপর আমরা একসঙ্গে তোদের গ্রামে যাব, কেমন?

ছোট্ট মেয়েটা জবাব দিল না কোনো। শুধু মধুলতার ঝোঁপটার পাশে হাসি মুখে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার মুখে দেখে ইয়েগর বুঝতে পারছিল তাকে সে একটুও ভয় পাচ্ছে না। বোধ হয় ওর বাড়ির বড়োরা কাছাকাছিই কোথাও রয়েছে। এই কথাটা মনে হতেই মনটা ভারি শান্ত হয়ে গেল ইয়েগরের। গত কয়েকটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত লড়াই করতে করতে কেটেছে তার। প্রতিটা মুহূর্তে তার মনে হয়েছে এই হয়তো শেষ। অনিঃশেষ এই চাপা আতঙ্কের ভার হঠাৎ করেই তাকে ছেড়ে উধাও হল যেন। রয়ে গেল একটা বিরাট খালি ভাব আর সাংঘাতিক খিদে। পেটে সেই খিদের আঁচড়ানি সইতে সইতেই মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা আশ্চর্য আনন্দ হচ্ছিল তার। সুন্দর, শক্তিমান এই মানুষজাতির একজন সদস্য সে। আর সে একা নয়।

“আমায় কিছু খাবার এনে দিবি? আর সেই সঙ্গে তোর বাড়ির বড়দেরও একটু ডেকে আন না! আমি মোটে উঠতে পারছি না রে।”

মেয়েটা কোনো জবাব দিল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে ঠোঁটদুটো কয়েকবার ছুঁচলো করল যেন এক্ষুনি সে শিস দিয়ে উঠবে। তারপর নিচু হয়ে তার শিরপা-র লম্বা ঝুলের পেছনের ঘাসের ভেতর থেকে রাস্পবেরির একটা ঝুড়ি বের করে এনে ইয়েগরের দিকে বাড়িয়ে ধরল। ইয়েগর তার থেকে একমুঠো রাস্পবেরি তুলে নিয়ে সটান মুখে পুরে দিল।

আর তারপরেই তার খেয়াল হল, এখনও তো রাস্পবেরির পাকবার সময় হয়নি! এইখানটা আসতে আসতেই তো সে অনেকগুলো রাস্পবেরির ঝোঁপ দেখেছে। তাতে সবে গুটি ধরেছে এখন। কাঁচা। টক। সবুজ। কিন্তু মেয়েটার ঝুড়ির রাস্পবেরি তো একেবারে পাকা। আর কী সুগন্ধ তাতে! দেখলেই বোঝা যায় একেবারে সদ্য গাছ থেকে তোলা হয়েছে তাদের।

তবে সে-মুহূর্তে তার এমন সাংঘাতিক খিদে পেয়েছিল যে এইসব প্রশ্ন করে নিজেকে বা মেয়েটাকে বিব্রত করবার কোনো ইচ্ছেই হচ্ছিল না তার। খানিক বাদে মেয়েটার হাতে খালি ঝুড়িটা ফিরিয়ে দিয়ে ইয়েগর জিজ্ঞাসা করল, “হ্যাঁ রে, তোর কাছে খানিক রুটি হবে?

মেয়েটা অমনি নিচু হয়ে পায়ের কাছে ঘাসের ভেতর থেকে একটা বড়সড় রুটির টুকরো বের করে আনল। দেখে ইয়েগ একটু অবাক হল, কিন্তু সেই সঙ্গে রুটিটা মহা তৃপ্তি করে চেটেপুটে খেয়ে নিল।

“তা হ্যাঁ রে, ঘাসের ভেতর আর কী কী লুকোনো আছে রে তোর?”

মেয়েটা কাঁধ নাচিয়ে হাসল একটুখানি। হাসিটায় কোনো শিশুভাব ছিল না। একেবারে বড়োদের মতো ভঙ্গি তার। ব্যাপারটা ইয়েগরের নজর এড়াল না। তবে তাইগার গভীরে

এইসব কঠোর এলাকায় মানুষজন হয়তো একটু তাড়াতাড়িই বড়ো হয়ে যায়।

“আর কী চাই বলো তোমার?”

“এইবার আমি একটু ঘুমোতে চাই রে।” ইয়েগর জবাব দিল, “শরীরটা ভেঙে পড়ছে আমার একেবারে। আমি একটু ঘুমুই, আর তুই সেই ফাঁকে গিয়ে তোদের বড়োদের ডেকে নিয়ে আয় এখানে। পারলে একটু জামাকাপড়ও নিয়ে আসিস, বুঝলি? দেখতেই তো পাচ্ছিস গায়ে আমার একটা জামা ইস্তক নেই।”

শুনে মেয়েটা মাথা নেড়ে ঝোঁপঝাড়ের ভেতর মিলিয়ে গেল। ইয়েগর খেয়াল করল, তার পায়ের শব্দ উঠল না কোনো। তার পোশাক সামান্য খসখস শব্দও তুলল না ঝোঁপের গায়ে ঘষা লেগে। তার পায়ের নিচে একটা কাঠিকুটোর মচমচানিও শোনা গেল না।

ঘুমে চোখ জুড়ে আসবার আগে ইয়েগর শুধু সেই ঝোঁপগুলোর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “ফিরে আসিস কিন্তু। আমায় একেবারে ছেড়ে চলে যাস না। আমি তোর জন্য এইখানে বসে থাকব।” কথাগুলো বলতে বলতেই চোখ জড়িয়ে এল তার। মাথার নিচে কুডুলটাকে বালিশ বানিয়ে, তাকে ঘিরে আসা মশার ঝাঁকের গুনগুনানির তোয়াক্কা না করে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল ইয়েগর। যেন অতল সাগরের বুকে জেগে ওঠা অন্ধকার একটা ঘূর্ণি এসে টেনে নিয়ে গেল তাকে চেতনাহীন অন্ধকারের দেশে।

.

০৪.

ইয়েগরের নতুন বাসা একটা গাছের ভেতর। উঁহু, কোনো গাছের খোঁদল বা ডালের ওপর নয়। পুরো গাছটা জুড়েই তার বাস। তার শেকড় থেকে পাতা সবকিছু জুড়ে ছড়িয়ে থাকে ইয়েগরের শরীর। তার মধ্যে দিয়ে মাটি থেকে রস উঠে ছড়িয়ে যায় পাতায় পাতায়। প্রত্যেক বছর তার কাণ্ডে একটা করে বয়সের রিং যোগ হয়। বাতাসে ইয়েগরের শরীরটা মড়মড় শব্দ করে দোলে।

এই নতুন শরীরটা ইয়েগরকে একদম অবাক করেনি। উলটে ব্যাপারটাকে তার বেশ স্বাভাবিকই ঠেকে। স্বাভাবিক আর সুবিধেজনক। বিরাট একটা মাঠের মধ্যে বেড়ে উঠছে সে। তার শেকড় ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর গভীরে, মাটির আড়ালে জড়িয়ে যাচ্ছে আরও কত না গাছের শেকড়ের সঙ্গে।

বেশ একটা অন্ধকার, উষ্ণ আর আরামের অনুভূতি সবসময় জড়িয়ে থাকে তাকে। প্রত্যেক মুহূর্তে ইয়েগর তীব্রভাবে টের পায়, সে বেঁচে আছে। বেড়ে ওঠা, কেবল বেড়ে ওঠা। এছাড়া আর কিছু চাই না তার। একটাই শুধু ভাবনা আছে তার মনে। তা হল, কবে পাখিরা আসবে তার ডালে। সেখানে তারা বাসা বাঁধবে। অজানা বুলিতে কত না গান শোনাবে তাকে! তবে সে ভাবনায় কোনো অস্থিরতা ছিল না তার। সে তো জানে এমনটাই হবে। সেটাই নিয়ম। তাই সে শান্ত হয়ে পাখিদের আসবার অপেক্ষায় থাকে।

কেউ একজন তার শরীরের পাশটায় ছুঁল হঠাৎ এসে। সে তার একটা ডাল একটু নাড়িয়ে দিল। তারপর অলসভাবে ভাবল, বোধ হয় কোনো কাঠঠোকরা এসেছে তার ছাল থেকে পোকা খুঁটে নিতে। পোকাগুলো কিংবা ওই কাঠঠোকরাটা এই দুই-ই তার শরীরেরই অংশ বলেই মনে হয় তার।

কিন্তু নাহ, কাঠঠোকরা নয়। কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। “ইয়েগর…” নড়েচড়ে উঠে চোখ না খুলেই একটুখানি সাড়া দিল সে। “উঠে পড়ো হে ইয়েগর।” গলাটা আবার ডাক দিল তাকে।

“এরই মধ্যে ওঠবার সময় হয়ে গেল?” বলতে বলতে চোখ মেলে চেয়ে দেখল ইয়েগর। কোথায় গাছ? সে তো মানুষই আছে! একটা বড়সড় রাশিয়ান স্টোভের পাশে নরম চামড়ার বিছানায় শুয়ে আছে সে। ভুরু অবধি লাল টুপি দিয়ে ঢাকা একটা দাড়িওয়ালা লোক ঝুঁকে পড়ে ডাকছিল তাকে। এইবার তার মনে পড়ল, নদীর ধারে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। তার মানে তাকে এইখানে বয়ে এনে শোয়ানো হয়েছে। তাড়াতাড়ি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে চারদিকে তাকিয়ে দেখল সে। পশমের তৈরি ঢিলে একটা শার্ট আর প্যান্ট তার পরনে। দুটোই একেবারে নতুন। খানিক বাদে কী খেয়াল হতে গায়ে মুখে একবার হাত বুলিয়ে নিল সে। কোথাও কাটাকুটির কোনো চিহ্ন নেই। কোথাও

কোনো ব্যথা নেই। জ্বালা নেই। মাথাও ঘুরছে না এতটুকু। ঘুমের মধ্যেই শরীর একেবারে সেরে গেছে তার।

খুশি খুশি মুখে লোকটার দিকে তাকিয়ে ইয়েগর বলল, “ধন্যবাদ।

“আরে দেখো কাণ্ড! এ আমাদের ধন্যবাদ দিচ্ছে!” বলতে বলতেই তার মাথার ওপর থেকে একটা গলা ঝরঝরিয়ে হেসে উঠল।

ইয়েগর ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। লোকটার পরনে বেশ পুরনো ধরনের একটা কোট। হয় সেটা চাষাভুষোদের ভারী পোশাক আর্মিক, কিংবা ঘরে বোনা জিপুনও হতে পারে। লোকটার মাথার লাল টুপিতে সাদা বর্ডার। তার দাড়ি লালচে। চাষিদের একটা সাদা শার্ট পরেছিল সে কোটের নিচে। তার কলার ডান কাঁধের ওপর ফিতে দিয়ে বাঁধা।

“ধন্যবাদ স্যার।” ইয়েগর হাতটা বাড়িয়ে রেখেই ফের একবার বলল। জবাবে লোকটা ভালোমানুষ মার্কা একটা হাসি দিল। তারপর হাত-টাত না মিলিয়ে জানালার পাশে গিয়ে একটা লম্বা বেঞ্চের ওপর বসে পড়ল।

মাথার ওপর থেকে গলাটা এইবার ফের কথা বলল, “দেখছ দেখছ, এ কেমন হাতটা বাড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে?”

চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল ইয়েগর। ঘরটার দেয়ালগুলো খরখরে। সরু জানালাগুলো অর্ধ স্বচ্ছ কিছু দিয়ে ঢাকা। সেখান দিয়ে বাইরেটা চোখে পড়ে না। ঘরের ভেতর একটা বড়ো টেবিল। দেয়ালের গা ধরে ধরে লম্বা লম্বা বেঞ্চ আর দরজার ঠিক পাশে পাথরের তৈরি একটা রাশিয়ান চুলো।

চুলোর ঠিক ওপরটায় একটা ছেলে বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছিল। ঢালু ছাদের প্রায় কাছাকাছি উঠে বসেছে সে। ইয়েগরের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে জিভ বের করে ভেঙিয়ে দিল তাকে।

ইয়ের তাকে জিজ্ঞাসা করল, “গ্রামটার নাম কী রে?”

শুনেই ছেলেটা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বার জোগাড়। ইয়েগরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক লোকটা অবশ্য হাসল না। বেশ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করল, “এইখানে গ্রাম! মানে?”

অতএব ইয়েগর বুঝল, এখানে কোনো গ্রাম নেই। বাড়িটা নির্জন তাইগার অরণ্যের বুকে একলা দাঁড়িয়ে আছে। পুরনোকালে কিছু কিছু মানুষ এইভাবে পুরুষানুক্রমে গভীর জঙ্গলে নির্জনে বাস করতেন। এঁরাও সম্ভবত তেমন কোনো মানুষ হবেন। হয়তো কোনোদিন অন্য মানুষজনের বসতিতে পা-ও দেননি তাঁরা। আর সেজন্যই হয়তো পোশাকগুলো এঁদের এত পুরনো ধাঁচের। হয়তো সেজন্যই হাত মেলাবার প্রথাটাই এঁদের কাছে অজানা।

তবে সেসব ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবার ইচ্ছে ইয়েগরের ছিল না। এঁরা তার জন্য যা করেছেন সেটা অমূল্য। এখন আরেকটা শেষ উপকার যদি এরা করেন…।

একবার গলা ঝেড়ে নিয়ে ইয়েগর বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। গ্রাম নয় না-ই থাকল, কিন্তু এখান থেকে বেরিয়ে কোনো শহর-টহরে যাবার রাস্তা যদি একটু বলে দেন। আমি তবে আর একটুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রওনা হয়ে যাব।”

“এখান থেকে বের হবার কোনো রাস্তাঘাট নেই।” বয়স্ক লোকটা গম্ভীরভাবে বলল। “তার মানে? আমায় কি আপনাদের সঙ্গেই থাকতে হবে?”

“থাকো না যদ্দিন খুশি। কে মানা করছে!” বলতে বলতে লোকটা জানালার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার ঝাপসা ঢাকনার ভেতর দিয়ে কী যেন দেখতে লাগল।

“আর, আমি এখানে থাকতে না চাইলে?”

“তাহলে চলে যাও! এত বড়ো তাইগাটায় জায়গার তো অভাব নেই কোনো!”

“সে তো ঠিকই।” ইয়েগর দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা, “কিন্তু মুশকিল হল, রাস্তাঘাট না জানলে চলে যাবটা কোথায়?”

শুনেই লোকটা হঠাৎ লাফ দিয় ইয়েগরের সামনে এগিয়ে এসে তার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বিড়বিড় করে বলে, “নিজে এসেছিস, আমরা ডাকিনি। যেথা খুশি যাবি, আমরা ডাকিনি…”

ইয়েগর ওর মধ্যে কেবল একটাই শব্দ খেয়াল করছিল, ‘…আমরা ডাকিনী… আমরা ডাকিনী…’

কথাগুলো বলতে বলতেই লোকটা সমস্ত ভদ্রটা-টদ্ৰতা ভুলে চার হাত-পায়ে উপুড় হয়ে পড়েছে মেঝের ওপর। তারপর মেঝে জুড়ে কিলবিল করে হামাগুড়ি দেয় আর চিৎকার করে,

“দাও হে কর, কোন নগর, কত হে ইনকাম? পাও হে সুখ আরেকটুক, আরও বেশি আরাম।”

জবাবে চুলোর মাথায় পা তুলে বসে থাকা ছেলেটা হেসে গড়িয়ে পড়বার জোগাড়। বয়স্ক লোকটা ছড়া কাটা থামিয়ে ইয়েগরের দিকে তাকিয়ে এবার বলল, “কী হে, একটু আধটু ভয়-টয় পেলে নাকি?”

“আজ্ঞে না।” বলতে বলতে ইয়েগর চামড়া বিছানাটার ওপরে ফের একবার আসনপিড়ি হয়ে বসে পড়ে বলল, “পাগল সাজা হচ্ছে? আপনার মতলবটা কী ঠিক করে বলুন তো।”

লোকটা তার দিকে খানিক বিরক্ত চোখে তাকিয়ে দেখল এবার। তারপর বলল,

“তাহলে এইটে দেখলে বোধ হয় খানিক ভয় পেতে পারো। দেখো দেখি…”

বলতে বলতেই জানালা দিয়ে চুঁইয়ে আসা আলোটার সামনে সে এক্কেবারে খাড়া উঠে দাঁড়িয়েছে। আর তারপর ইয়েগরের চোখের সামনে কেমন যেন চেপটে যেতে লাগল মানুষটা। ইয়েগর ঘাবড়ে গিয়ে একটা লাফ দিয়ে চুলোটার কাছে সরে এল। তার সামনে লোকটা তখন বেঁকেচুরে তালগোল পাকিয়ে একটা মাংসের দলায় বদলে যাচ্ছে। তার বড়সড় মুণ্ডুটা ততক্ষণে তার বুকের ভেতরে ঢুকে গেছে। পাগুলো গুটিয়ে এসে পাক খেয়ে খেয়ে দড়ির মতো জড়িয়ে গিয়ে একটামাত্র থামের মতো মোটা পায়ে বদলে গেছে। দেখতে দেখতে এক পায়ে দাঁড়ানো একটা মাংসের দলার বুক থেকে একটা দাঁতালো মুখ গজিয়ে উঠল। দাঁতের ফাঁকে একটা লম্বা বেগুনি রঙের জিভ লকলক করছিল।

ওদিকে চুলোর মাথায় বসে ছেলেটা হাসতে হাসতে প্রায় ফোঁপাচ্ছে ততক্ষণে। সেদিকে একনজর তাকিয়ে ইয়েগ দেখে, ছেলেটাও বদলে গেছে। উপস্থিত তাকে দেখতে একটা কালচে দলার মতো লাগছে। যেন একটা বড়সড় অ্যামিবা। মোচড় দিতে দিতে সেটা যে এরপর কোন চেহারা নিতে যাচ্ছে কে জানে।

ইয়েগরের মন চাইছিল একছুটে ঘরটা ছেড়ে পালিয়ে যায়। অনেক কষ্টে ইচ্ছেটাকে দমন করল সে। কুড়ুলটার অভাব টের পাচ্ছিল সে এখন। হাতের কাছে ওটা থাকলে….

খানিক বাদে দেখা গেল বয়স্ক লোকটা আস্তে আস্তে ফের মানুষের চেহারায় ফিরে আসছে। তবে এবারে সে অন্য মানুষ। রোগাভোগা একটা বুড়ো। এলোমেলো চুল, মুখে দাঁত নেই একটাও। পরনে লোমওয়ালা জন্তুর ছাল একখানা। একজায়গায় দাঁড়িয়ে টুকটুক করে লাফ দিচ্ছিল বুড়ো, যেন শরীরটাকে ঝাঁকিয়ে-টাকিয়ে ঠিকঠাক করে নিচ্ছে। খানিক বাদে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ফোকলা মুখের হাসি চড়িয়ে সে বলল, “তা, ভয় কি লাগল একটু আধটু?”

“উঁহু। এক ফোঁটাও নয়। অনেক চেষ্টায় গলার কাঁপুনি আটকে কোনোমতে ঘরঘর করে বলল ইয়েগর, “শুধু বুঝতে পারলাম, তোমরা মানুষ নও। ঠিক আছে, যা উপকার আমার করেছ সেজন্য অনেক ধন্যবাদ। এবার আমি চলি। আমার ছুরি আর কুড়ুলটা ফেরত দেবে কি? ওগুলো ছাড়া রাস্তায় একলা একলা… মানে বুঝতেই তো পারছ।”

তবে মুখে যতই সাহসী ভাব দেখাক, সেই মুহূর্তে ইয়েগরের মনটা এতটাই খারাপ হয়ে আছে যে পারলে সে মাটিতে উবু হয়ে বসে চিৎকার করে কাঁদে। যদি গোড়া থেকেই এরা মানুষ মানুষ ভাব না দেখাত তাহলে হয়তো এতটা দুঃখ তার হত না। কিন্তু এরা মানুষ সেজে তার কাছে এসেছে, তাকে খাইয়েছে, বিশ্রাম দিয়েছে, আদর করে তার গায়ের ব্যথা সারিয়েছে। কিন্তু তারপর যখন সে টের পেয়েছে এরা আদৌ মানুষ নয়, আর মানুষের দুনিয়ায় ফেরবার রাস্তাও এরা তাকে দেখিয়ে দেবে না, তখন একাকিত্বের অনুভূতিটা ফের দ্বিগুণ শক্তিতে ফিরে এসেছে তার মধ্যে। সীমাহীন তাইগার গভীরে সে একা। এ তাইগা মানুষের নিয়তি, তার জীবন, মৃত্যু, সৌভাগ্য, দুর্ভাগ্য কোনো কিছুর ধার ধারে না।

“আমি এবারে রওনা দেব।” বলতে বলতে এইবার ঘরটার দরজার দিকে এগিয়ে গেল ইয়েগর।

“একটুখানি দাঁড়াও ইয়েগর।” হঠাৎ পেছন থেকে একটা চেনা গলা এসে কানে ধরা দিতে থেমে গেল সে। হাসি মুখে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে, চুলোর ওপর বসে থাকা ছেলেটা এইবারে বনের মধ্যের সেই ছোট্ট, ঝলমলে মেয়েটার রূপ ধরেছে। তেমনই সুন্দর তার পোশাক। চুলে তেমনই একটা লাল রিবন বাঁধা।

“সব চোখে ধুলো দেয়া সাফাইয়ের খেলা।” এই বলে নিজেকেই যেন বা সান্ত্বনা দিতে দিতে ইয়েগর ঘরটা ছেড়ে রওনা হয়ে গেল।

তাইগায় সন্ধে নামছিল। ভ্যাপসা রোদে শুকিয়ে ওঠা শুকনো ঘাস আর ফুলের তীব্র সুবাস ভাসছিল বাতাসে। আকাশে ধূসর মেঘের আনাগোনা। বৃষ্টি আসবে। বাড়িটার উঁচু বারান্দা ছেড়ে নেমে এসে ইয়েগর চারদিকটা একবার ভালো করে দেখে নিল। জায়গাটা একেবারে অচেনা। ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছগাছালি, অতিকায় সব পাইনগাছ, তাদের গায়ে সবুজে সাদায় মেশা লিচেন আর মসের বাহার, লম্বা লম্বা ফার্নের ফাঁকে ফাঁকে বিরাট বড়ো বড়ো পাথরের ড্যালা… যতদূর চোখ চলে এই একই দৃশ্য। কোনো পায়ে চলা রাস্তা, কোনো ক্যাম্প ফায়ারের জায়গা, কোনো চাকার দাগ, এমনকি একটুকরো সমান জমিও দেখা যায় না কোথাও। আর এই সবকিছুর মধ্যে লম্বা লম্বা ফার্নগুলোর ফাঁকে ফাঁকে পাথরের ড্যালাগুলোর মতো কিংবা অতিকায় পাইনগাছগুলোর মতোই যেন বা, নিজে থেকে গজিয়ে উঠেছে ঘরটা। মানুষের বাসার একটা প্যারডির মতো দেখায় সেটাকে এই বিজন তাইগার বুকে। যেন কোনো অজানা রসিকতায় এই মাটির বুক থেকে আর পাঁচটা জীবন্ত জিনিসের মতোই গজিয়ে উঠেছে সেও।

ইয়েগর তার পরনের শার্টটার কলারের সুতো দুটো শক্ত করে বেঁধে নিয়ে হাঁটা দিল এবার। কোনদিকে যাচ্ছে সে নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই কোনো সে মুহূর্তে। থেকে লাভও নেই। সবটাই তো সমান অচেনা!

“ই-য়ে-গ-র…” মেয়েটার ডাক ভেসে এল পেছন থেকে, “কোথায় যাচ্ছ তুমি?”

জবাবে পেছন ঘুরে মেয়েটার দিকে ফিরে প্রাণভরে খানিক গালাগাল দিল ইয়েগর। একাকিত্ব, তিক্ততা আর হতাশা মিলে তখন তার ভেতরে একটা বিষের সমুদ্র পাক খেয়ে উঠছে। সে বিষ, গালাগাল আর অভিশাপ হয়ে তার মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে। তাইগা, তার সূর্য, আকাশ, তার বুকে আশ্রয় করে থাকা হাজারো অ-মানুষ শত্রু– প্রকৃতির একচ্ছত্র মালিক মানুষের প্রতিভূ ইয়েগরকে নিয়ে যারা খেলা করবার সাহস পায়, তাদের সবার উদ্দেশ্যে সে ছড়িয়ে দিচ্ছিল তার অভিশাপ আর গালাগালের স্রোত। যা পারে করে

নিক ওরা। নেকড়ে লেলিয়ে দেবে? গভীর রাতে স্যাঁতসেঁতে, শীতল মাভকার মৃত্যু চুমু? প্রাণে মেরে ফেলবে তাকে? মারুক। কিন্তু শেষ দম অবধি সে মানুষ থাকবে। ওদের বশ মানবে না। মানুষ রাজার জাত। তাইগার এই অলুক্ষুণে অ-মানুষের দল তাকে মেরে ফেললেও মানুষকে হারাতে এরা পারবে না। যেমন পারে না স্বয়ং প্রকৃতি। মানুষের প্রাণ নিলেও শেষমেশ সেই মানুষের কাছেই বশ মানতে হয় তাকে।

অবশেষে একসময় তার চিৎকার থেমে এল। বুকের ভেতরে একটা ফাঁকা অনুভূতি নিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল ইয়েগর। তারপর হঠাৎ কাঠকুটো যা হাতের কাছে মেলে তাই তুলে নিয়ে সে ছুঁড়তে শুরু করল বাড়িটাকে লক্ষ্য করে।

গোটা সময়টা ধরে সেই ছোট্ট মেয়েটা বাড়িটার বারান্দায় চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। তার ছাতলা ধরা রেলিংয়ে ঝুঁকে মুখটা গম্ভীর করে সে তাকিয়ে ছিল ইয়েগরের দিকে। ইয়েগরের ছুঁড়ে দেয়া কাঠকুটোর টুকরোগুলো উড়ে তার কাছাকাছি এগিয়ে গিয়েই হঠাৎ উলটোদিকে ঘুরে শিসের মতো শব্দ করে ধেয়ে আসছিল ইয়েগরের দিকে। প্রথমে কয়েকটা ছোটোখাটো ধাক্কা খেয়ে ইয়েগরের সম্বিৎ খানিক ফিরেছিল। আর শেষমেশ মাঝারি আকারের একটুকরো কাঠ এসে তার বুকে ধাক্কা দিতে কোনোমতে টাল সামলাল ইয়েগর। তারপর যুদ্ধবিগ্রহের ভাবনা ছেড়ে কাঠকুটোর একটা স্কুপের ওপর বসে খানিক বিশ্রাম নিয়ে শরীরটাকে টানতে টানতে রওনা দিল। বুকের ভেতরটা তার তখন একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে।

“ধুস! আমি ভাবলাম কোথায় আমাদের খোকন নেকড়ে ধরতে যাবে,”

একটা বয়স্ক গলা কোথা থেকে যেন বিড়বিড় করে উঠল, “তা না! ফ্যাকাশে-মুখোটার মাথায় দেখছি ঘিলু বলে বস্তু নেই কোনো।”

ইয়েগরের জবাব দেবার ইচ্ছে ছিল না কোনো। এখন তাকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য একটা ছক বানাতে হবে ফের। একেবারে কেচে গণ্ডুষ করে শুরু করতে হবে নতুন করে। যে-কোনো রাস্তায় প্রাণটা ধরে রেখে সভ্য জগতে ফিরতে হবে তাকে, তা সে এই তাইগার অপদেবতার দল যতই তার পেছনে লাগুক।

অবশ্য বেচারাদের আর দোষ কী? মানুষের ওপর তাদের রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। শক্তি, জ্ঞান, যুদ্ধ সব ব্যাপারেই মানুষ তাদের থেকে অনেক এগিয়ে। গোটা পৃথিবীটাই প্রায় এখন তার বশ। আর এই বেচারারা…

হ্যাঁ। ইয়েগর এদের দেখিয়ে দেবে, মানুষ হবার আসল অর্থ কী। দেখিয়ে দেবে, হার সে মানতে জানে না। দেখিয়ে দেবে, এদের সবার চাইতে সে সেরা।

এই শেষের কথাটা মনে আসতেই গত কয়েকদিন এদের হাতে নাকাল হবার ছবিগুলো চোখে ভেসে উঠতে নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছিল ইয়েগরের। এমনকি খানিক আগে ওই ঘরটা থেকে ওভাবে পালিয়ে আসা… নাহ!

আস্তে আস্তে ফের ঘরটার দিকে ফিরে এল ইয়েগর। মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে কড়া চোখে তাকিয়ে বলল, “আমার কুড়ুলটা ফেরত দে। ছুরিটাও দিবি। আর, একটা দেশলাই। খানিক খাবারও নিয়ে আয় পুঁটুলি বেঁধে। যা।”

মেয়েটা কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে তাকিয়ে রইল তার দিকে। ওর চোখের তারার রঙ হালকা। তাকে ঘিরে ঘন রঙের বর্ডার। ভারি সুন্দর দেখতে মেয়েটাকে। দুধের মতো সাদা তার গায়ের রঙ। তাতে রোদপোড়ার কোনো চিহ্ন নেই কোথাও।

“এত সুন্দর দেখতে তুই, অথচ মানুষ নোস। তুই… তোরা ঠিক কী রে? কোনো নাম আছে তোদের?”

“তোমার যে নামে ইচ্ছে হয় সেই নামেই ডাকো না আমাকে!” মেয়েটা হেসে জবাব দিল, “আমার কাছে সব সমান।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি তোকে মাশা বলে ডাকি? আমাদের মানুষদের মধ্যে একটা গল্প আছে মাশাকে নিয়ে। সে হল গিয়ে পরিদের মেয়ে। জঙ্গলের মধ্যে ভালুকদের নিয়ে থাকে।”

আধা কল্পনার অপদেবতাদের দুনিয়া–তার পরি, পিশাচ, জুজু, বাস্তূপরি, বেলবগ, দানো, হাকিনী, ডাকিনী–এদের ব্যাপারে কিছু কিছু পড়াশোনা ছিল ইয়েগরের। তবে সে মুহূর্তে হাজার চেষ্টা করেও তার কোনো কিছুই মনে করতে পারছিল না সে। শুধু একটা পুরনো প্রবাদ বারবার মাথায় ঘুরে আসছিল তার, ‘অপদেবতারা মানুষের কাছে মানুষের রূপ ধরে আসে।’

এরাও সম্ভবত ঠিক সেটাই করছে। রাশিয়ান রূপকথার মাশা, ঠাকুরদা ভূত, দুষ্টু ভূতের খোকা এমন সব চেহারা ধরে হাজির হচ্ছে ইয়েগরের সামনে। সব সাজানো। সব নকল। চোখের ভুল।

“আচ্ছা, তোমার আরেক নাম কি ইচ্ছেধারী? যেমন খুশি রূপ নিতে পারা। অপদেবতা?” ইয়েগর আন্দাজে ঢিল ছুড়ল একটা।

“কেউ কেউ আমায় ও-নামটা ধরেও ডাকে বটে,” মেয়েটা জবাব দিল, “কিন্তু নামে কিছু যায় আসে না।”

“হুম। দিওবা বলে কাউকে চেন নাকি?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। দিওবাকে কে না চেনে? ও তো এইখানকার চিরকেলে বাসিন্দা। আমরা সবাই ওর পরে এখানে এসে জুটেছি।”

এইসব কথাবার্তা চলতে চলতেই ঘরের ভেতর থেকে এক ছোকরা বের হয়ে এল হঠাৎ। পরনে কালো স্যুট, পেটেন্ট লেদারের জুতো, ফুলছাপ শার্ট, বো টাই আর গোল সানগ্লাস।

“বেশ মানিয়েছে না? কী বলো ইয়েগর!” বলতে বলতে নিজের জ্যাকেটের তলার দিকটা ধরে টনছিল সে, “এই রূপটা দেখলে আর ভয়-টয় লাগছে না, তাই না?” বলতে বলতেই দুটো চোখ একসঙ্গে একবার টিপে দিয়ে সে কী হাসি তার!

“ধুৎ! কীসের এখন আর তখন! তোমায় দেখে ভয়ডর আমার কখনোই লাগেনি, সে তুমি ভালোই জানো। মানুষ না হলেও চেহারায় তো মানুষেরই মতো প্রায়। ভয়টা পাব কীসে?”

“অ্যাঁ! কী বললি? এত বড় সাহস?” লোকটা হঠাৎ চোখ গোল গোল করে বলে উঠল, “মানুষের সঙ্গে আমাদের তুলনা কোরো না। একদম নয়! পৃথিবীতে আমরা তোমাদের চাইতে কত পুরনো সে আন্দাজ কিছু আছে তোমার?”

“ও। তা তাহলে তোমাদের সংখ্যা এত কম কেন? অপদেবতার গোটা জাতটা ঝাড়ে মূলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, নাকি?”

“সেকথা তো আমরা তোমাদের জিজ্ঞেস করব ইয়েগর। তোমরা হলে গিয়ে মানুষ। পাতালদেবীর ছেলেপুলে সব। বন কেটে বসত বানাও। বিষ দিয়ে নদী মারো। যা কিছু জ্যান্ত সবকিছুকেই ধুয়েমুছে দিতে চাও।

“ওতে তোমাদের কোন লাভ হচ্ছে তা আমরা জানি না। কিন্তু আমরা তো পৃথিবীর সন্তান। আকাশ-বাতাস, নদী, পাহাড়, গাছ সবকিছুর সঙ্গে আমাদের প্রাণটাও বাঁধা যে। ওরা মরছে তাই আমরাও মরে মরে শেষ হয়ে যাচ্ছি। কিছু বুঝলে?”

“উঁহু, ইয়েগর বলে উঠল, “কি বুঝিনি। তাছাড়া যদি মরেও শেষ হও, তাতে কার কোন ক্ষতি? কোন কাজটায় লাগো তোমরা দুনিয়ার? প্রকৃতির আত্মা! হাহ! দিব্যি আছ। কাজ নেই, কর্ম নেই, ইচ্ছেমতো পাখি, মাকড়শা, ফারগাছ যা খুশি হয়ে যাচ্ছ। খাসা। কোনো ভাবনা নেই, চিন্তা নেই, দিব্যি গাছের মতো জীবন। হাজার বছর ধরে কোনো বদল নেই।

“এহেন অকর্মার একটা দল উড়ে-পুড়ে গেলে তাতে কার কোনো ক্ষতিটা হবে? না হে ইচ্ছেধারী, দুনিয়ায় কারও কোনো কাজে আসবে না তোমরা। মানুষ সে তুলনায় ঠিকঠাক রাস্তা ধরেছে। দুনিয়াটাকে পালটে ফেলে নিজের হাতে গড়ি আমরা। রাস্তাটা কঠিন, মাঝেমধ্যে তাতে খানিক ভুলও হয়, তবে সে তো হবেই! তাহলেই বলো! তোমরা হাজার বছর ধরে কেবল ফুর্তিই করে গেলে। আর আমরা কষ্ট করে, হাজারো পরিশ্রম করে পৃথিবীটাকে পালটে ফেলে নতুন করে গড়ছি, কে তবে পৃথিবীর আসল আত্মা? আমরা, না এই তোমরা, যারা কেবল ফুর্তি করবার জন্যই বেঁচে আছ? এইটে আগে ভালো করে বুঝে নাও, তারপর আমাকে বোঝাতে এসো, বুঝলে? অনেক হয়েছে। এবার আমি যাই।”

মানুষটা এতক্ষণ চুপচাপ তার কথাগুলো শুনছিল। কথা শেষ করে ইয়েগর থামতে সে মাথা নেড়ে শান্ত গলায় বলল, “আমাদের ছেড়ে পালানো তোমার হবে না ইয়েগর।” বলতে বলতেই লোকটার চারপাশে একটা কুয়াশার আবরণ গড়ে উঠছিল। তার মধ্যে দেখতে দেখতে ভেঙেচুরে যাচ্ছিল তার শরীরটা।

ইয়েগর তাড়াতাড়ি সেদিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। লোকটা ফের কোন রূপ নেবে সেসব দেখবার আগ্রহ তার ছিল না আর। কিন্তু কুয়াশাটার মধ্যে থেকে খানিক বাদে একঝাঁক প্রজাপতি বের হয়ে এল। দল বেঁধে উড়তে উড়তে তারা গাছগুলোর মাথা ছাড়িয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গিয়ে একসময় চোখের আড়ালে মিলিয়ে গেল।

“তোদের পাখিতে খাক।” এই বলে নিচের দিকে চোখ ঘুরিয়ে ইয়েগর মাশাকে বলল, “তা তুমিই বা আর বাকি রইলে কেন? শুরু করে দাও। গিরগিটি, আরশোলা, বাবা ইয়াগা, ভালুক, এল্ক যা হোক কিছু একটা রূপ ধরে ফেলল। চাইকি শিঙওয়ালা শয়তানও সাজতে পারো। মানুষের শরীর তোমাকে মানায় না।”

“তাহলে এইটা? এইটা মানায়?” বলতে বলতেই মাশা বাতাসে ভেসে উঠে কয়েক সেকেন্ড থরথর করে কেঁপে একটা চোখ ঝলসানো রঙের পাখি হয়ে গেল। শুধু তার মাথাটা মানুষের মতো।

“হ্যাঁ। এইটা মানায়। এইটে তো অ্যালকোনস্ট-এর শিরিন পাখি। আমি বইতে পড়েছি। তা এসো হে। শিরিন পাখি যা করে সেই কাজটাই করো। গান ধরো একখানা। তবে যা-ই করো ভয় আমায় তোমরা দেখাতে পারবে না, এই বলে রাখলাম।”

“গান শুনতে চাও? তাহলে শোনো।” বলে বাতাসে ভেসে থাকা শিরিন মিঠে গলায় গান ধরল। সে গানের কোনো কথা নেই। কেবলই সুর। ইয়েগরের চোখের সামনে গোটা তাইগার প্রান্তর যেন সেই সুরের মূর্ঘনায় বদলে যাচ্ছিল। আর সে নিজে গলে মিশে এক হয়ে যাচ্ছিল সুরটার সঙ্গে। তারপর সেই সুরের সঙ্গে হাওয়ায় ভেসে ছড়িয়ে পড়তে

পড়তেই তাইগার প্রান্তর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র গাছের প্রতিটি পাতা, তাদের প্রতিটি শিরা-উপশিরায়, ছোটোবড়ো প্রতিটি প্রাণীর অস্তিত্বে মিশে যাচ্ছিল তার অস্তিত্ব।

শিরিনের প্রত্যেকটা গান, প্রত্যেকটা অনুভূতি তার কাছে নতুন। অচেনা এবং অপ্রতিরোধ্য। তাকে বাধা দেবার কোনো ইচ্ছেই ছিল না ইয়েগরের। সমস্ত চেতনা দিয়ে সেই সুর শুনতে শুনতে সে টের পাচ্ছিল, সে আর ইয়েগর নামের একটা আলাদা অস্তিত্ব নয়। তার চেতনা গলে মিশে এক হয়ে যাচ্ছে সম্পূর্ণ তাইগার সঙ্গে।

.

০৫

অন্ধকারের ভেতর কেউ একটা হাঁটছিল। মেঝের কাঠের পাটাতনগুলোতে কাঁচকোঁচ শব্দ উঠছিল। কেউ যেন ফিসফিস করে কিছু বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আশপাশ দিয়ে খালি পায়ে চলবার আওয়াজ। মাঝে মাঝে নরম নরম হাত এসে ছুঁয়ে যাচ্ছিল ইয়েগরকে। ভারী হয়ে থাকা চোখে পাতাদুটো অনেক কষ্টে খুলল ইয়েগর। জায়গাটা তার চেনা। নিনার সঙ্গে ডিভোর্সের আগে এই অ্যাপার্টমেন্টটাতেই থাকত তারা।

এখন রাত। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো উঁকি মারছে। চারপাশে কোনো শব্দ নেই কোথাও।

“নিনা! এই শুনছ?” হঠাৎ ডাক দিয়ে উঠল ইয়েগর। বলতেই খাটের মাথার কাছে থেকে কেউ একজন ঝুঁকে পড়ল তার মুখের ওপর। চাঁদের আলোয় ইয়েগর দেখছিল, লোকটার গায়ের রঙ ফ্যাকাশে। কেমন যেন ঝাপসামতো চেহারা। গালে না-কাটা দাড়ি। চোখের পল্লবগুলো পপলারের আঁশের মতো জড়ানো। বার বার চোখ পিটপিট করতে করতে লোকটা ফোঁপাচ্ছিল আর দাঁত কড়মড় করছিল ইয়েগরের ওপর ঝুঁকে থেকে।

দেখবার সঙ্গে সঙ্গেই ইয়েগর ঘাবড়ে গিয়ে ছিটকে গেল দেয়ালটার দিকে। তারপর সেখানে ঠেস দিয়ে বসে হাতদুটো মুঠো পাকিয়ে সে বলল, “কে রে?”

জবাবে ঝাপসা মতন লোকটা বেশ মিষ্টি একটা গলায় বলে, “আজ্ঞে ভয় পাবেন না। আমি একজন সামান্য বাস্তূপরি। এই বাড়িতেই আমার বাস। এই শহরে আমিই শেষ বাস্তূপরি। কোনোমতে এখনও টিকে আছি। আমি বড়ো একা। তাই একজন মানুষের সন্ধানে ছিলাম। বড়ো কষ্টে আপনার নাগাল পেয়েছি। এখন যদি দয়া করে একটু রুটি আর জল দেন… বড়ো খিদে পেয়েছে আমার।”

“বাস্তূপরি! হুম। তার মানে অপদেবতা। তোমায় আমি খেতে দেব! তোমার জাতের লোকজন আমায় কম জ্বালিয়েছে অ্যাদ্দিন ধরে? এখন এমনকি শহরেও তাড়া করে এসেছে, অ্যাঁ? যাক গে। নিনা কোথায়?”

“কেউ নেই… কেউ নেই…” বলতে বলতে ফের একটু কেঁদে নিল বাস্তপরিটা। তারপর হাতের তেলোয় নাকটা মুছে নিয়ে কান্নাভরা গলাতেই খুকখুকিয়ে একটু হেসে বলে, “বোধ হয় সবাই মরে গেছে। একা তুমি টিকে আছ। ও ইয়েগর, আমায় অন্তত একটুকরো রুটি দাও। নিদেন একটা পেস্ট্রি। খিদেয় পেট চুঁইছুঁই করছে আমার।”

তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ইয়েগর। ঘরটার মধ্যে পায়চারি করতে করতে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিল সে। একদম একইরকম রয়েছে। ঘরটা। চেয়ারের পেছনে তার জামাকাপড়গুলো তেমনই ঝোলানো আছে। শুধু তার ওপর ধুলো জমেছে একরাশ। রেফ্রিজারেটরটা খুলে দেখা গেল তার মধ্যে ছাতা ধরে আছে। স্বাভাবিক। ইলেকট্রিসিটি কানেকশন নেই বোধ হয় অনেকদিন। বেসিনের কলগুলোয় জং ধরেছে। গোটা ফ্ল্যাটটাই ধুলোয় ঢাকা একেবারে।

ঘরের ভেতরের দিক থেকে এইবার তার জানালার দিকে নজর গেল ইয়েগরের। সেদিকে চোখ পড়তে শরীরটা কেমন যেন গুলিয়ে উঠল তার। ঘন অন্ধকারে একটাও আলো জ্বলছে না কোথাও। পথে গাড়িঘোড়ার শব্দ নেই কোনো। বাইরে চাঁদের আলোয় সার সার বাড়ি ভূতুড়ে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে। তাদের কোনো জানালাতেই আলোর চিহ্ন নেই। কোনো ছায়ার নড়াচড়া নেই।

ঘাবড়ে গিয়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে বাইরে বের হয়ে এল ইয়েগর। তারপর চিৎকার করতে করতে ছুট দিল রাস্তা ধরে। কিন্তু তার গলার শব্দ ফাঁকা বাড়িগুলোর গায়ে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলল কেবল। কেউ তার উত্তর দিল না। রাস্তাটা একসময় গিয়ে একটা হাইওয়েতে মিশল। হাইওয়েটা বহুদূরের জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেছে। ইয়েগর সেই হাইওয়ে ধরে ভূতের মতো হেঁটে যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে দিনের আলো ফুটছিল তাকে ঘিরে। একসময় সূর্য উঠল। দোয়েলরা শিস দিতে শুরু করল। পায়ের কাছে গঙ্গাফড়িংদের শব্দ উঠছিল। একসময় হাইওয়ে শেষ হয়ে একটা ছোটো নদী সামনে পড়ল। ইয়েগর হেঁটে হেঁটে নদীটা পার হয়ে গেল। একটা ছোটো মাছ জলের ভেতর তার পায়ে কামড়েও দিল একটুখানি। একটা তীব্র একাকিত্ব ঘিরে ফেলছিল ইয়েগরকে। এতটা একা কখনও অনুভব করেনি সে।

তারপর হঠাৎ মানুষের গলা কানে এল তার। শব্দটাকে লক্ষ্য করে ছুটতে ছুটতে ইয়েগর একটা বিরাট ক্ষেতের কাছে এসে পৌঁছোল। সেখানে অনেক মানুষজন। ঘুরে বেড়াচ্ছে, কথাবার্তা বলছে। ভিড়টার মধ্যে থেকে হঠাৎ নিনা বের হয়ে তার কাছে এগিয়ে এল। তারপর তার কাঁধে হাতদুটো জড়িয়ে চোখে চোখ রাখল সে। ইয়েগর সব ভুলে নিনার শরীরটাকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরল দু’ হাতে। তার চোখে তখন জল এসেছে।

“বেঁচে আছ তুমি! মানুষজন সবাই বেঁচে আছে! আহ!”

নিনা হাসল। মাথাটা ঝাঁকিয়ে চুলগুলো দুলিয়ে দিল একবার। তারপর বলল, “আমরা মানুষজন নই। সবাই ইচ্ছাধারী। কেউ কেউ পরি। শুধু তুমিই একলা মানুষ রয়ে গেছ পৃথিবীতে।”

মুখে কথা ফুটছিল না ইয়েগরের। মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে কান্নার ধাক্কায় শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল তার। নিনা তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। তারপর একসময় সে তার কানে কানে বলল, “তুমি চাইলে আমি একটা

আপেলগাছ হয়ে যেতে পারি। কিংবা ধরো একটা পাখি! একটা মাছ!”

নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে মানা করছিল ইয়েগর। গলায় স্বর ফুটছিল না তার। তাই দেখে নিনার মুখে একটু হাসি ফুটল বুঝি। মাথা ঝাঁকিয়ে, মুখে মিষ্টি হাসিটি মেখে। সে সোজা হয়ে দাঁড়াল তার সামনে। তারপর পা থেকে শেকড় বের করে, সারা শরীরে পাতার সাজ পরে দেখতে দেখতে একটা আপেলগাছ হয়ে গেল। তখন ইয়েগরও টের পাচ্ছিল, তার পা থেকে বের হয়ে আসা শেকড়রা মাটির গভীর থেকে গভীরতর অঞ্চলে ঢুকে যাচ্ছে। মাটির গভীরে ছড়িয়ে থাকা পাথরদের ফাঁকে ফাঁকে পথ খুঁজে নেমে যাচ্ছে জলের সন্ধানে।

তারপর তার হাতগুলো নিজে নিজেই আকাশের দিকে উঁচু হয়ে উঠল। সেখান থেকে বের হয়ে এল কত না ডাল, পাতার বাহার। হঠাৎ সে টের পেল সে এক রূপবান। পপলার। হঠাৎ অকারণ আনন্দের একটা ঝলক ছুটে গেল তারা সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে। আর ঠিক তখনই সে শুনতে পেল কে যেন বলছে, “কেঁদো না ইয়েগর। ঘুমের মধ্যে কাঁদছ কেন তুমি? গালদুটো ভিজে গেছে যে তোমার একেবারে!”

চোখ খুলে ইয়েগর দেখল মাশা তার মুখের ওপর উপুড় হয়ে আছে। ঠাণ্ডা আঙুলগুলো দিয়ে বড়ো আদরে তার গালদুটো মুছিয়ে দিচ্ছিল সে। নিজেকে এত ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত লাগছিল ইয়েগরের যে মেয়েটার ওপরে খেঁকিয়ে ওঠবারও আর ইচ্ছে হচ্ছিল না তার। চুপচাপ শুয়ে আকাশের দিকে চোখ রেখে সে কাঁদছিল। তার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতেই মাশা ফের একবার রূপ বদলে নিল। আর সে সেই ছোট্ট মেয়েটি নেই। এখন এ পূর্ণ যুবতী। তার মাথায় লম্বা চুলের মোটা বিনুনি। নড়াচড়া করলেই তার বুকের ওপর একটা হার ঝমঝম শব্দ তুলছিল। একটা বিস্তীর্ণ ঘাসজমির বুকে শুয়ে ছিল ইয়েগর। তাকে ঘিরে লম্বা লম্বা ডেইজির ঝাড়। সেখানে মৌমাছির গুনগুন। আকাশে মেঘ ছিল না এক ফোঁটা। বাতাসের মধুর গন্ধ ছিল।

“চোখ খুলে দেখো দেখি ইয়েগর।” মাশা বলে উঠল হঠাৎ, “আমাদের সঙ্গে থাকাটা কি সত্যিই খুব খারাপ? নাও, ওঠো। চোখ মোছো শিগগির।”

“উঁহু। দাঁড়াও।” ঘরের সেই অন্য ইচ্ছাধারীর গলাটা বেজে উঠল তার পাশ থেকে, “শুধু একটা কথা বলো আমায় ইয়েগর। আমাদের জঙ্গলে তুমি এলে কেন? তোমাদের

ওই কুচ্ছিত শহর-বাজারে কি প্রাণ ভরছিল না তোমার? আমরা কখনো তোমাদের ওখানে জ্বালাতে যাই?

ইয়েগর তর্ক করতে চাইছিল না। তাছাড়া ঘুরে যে একবার দেখবে এবারে সে কোন রূপ ধরে হাজির হয়েছে সেই ইচ্ছেটুকুও তার হচ্ছিল না তখন। তবে কান্নাটা তার থেমে গেছে ততক্ষণে। সূর্যের আলোয় তার ভেজা গাল শুকিয়ে উঠতে এইবার সে কথা বলল, “তোমার সঙ্গে কথা বলে লাভ কী? আমরা কেউ কাউকে হাজার চেষ্টা করলেও বুঝতে পারব না। যেভাবে খুশি সেভাবে থাকো তোমরা এই জঙ্গলে। শুধু দয়া করে আমায় আমার সভ্য দুনিয়ায় ফিরে যাবার রাস্তাটুকু দেখিয়ে দাও, তাহলেই হবে। এর বেশি তো কিছু চাইছি না আমি তোমাদের কাছে।”

“আরে, কে বলল আমরা তোমায় আটকে রেখেছি? যখন ইচ্ছে বিদেয় হও না এখান থেকে?” হঠাৎ ডেইজির ঝোঁপের ভেতর লুকিয়ে থাকা অন্য একটা গলা ভেসে এল, “কিন্তু তোমরা আমাদের যত উৎপাত করেছ, তার পরেও তোমার জাতের একজনকে দয়া করব কিংবা তোমার ইচ্ছেপূরণ করব সেটা তুমি ভাবলে কী করে?”

“মানুষ তোমাদের যত উৎপাত করেছে সেই সবকিছুর জন্য একা আমায় দোষ দিচ্ছ কেন?” বলতে বলতে ফের একবার রেগে উঠছিল ইয়েগর, “ঠিক আছে। যা ইচ্ছে করো তোমরা আমায় নিয়ে। আর আমি…”

“এই দ্যাখো! তোমায় নিয়ে আবার করবটা কী? কোন কাজটায় লাগবে তুমি আমাদের, অ্যাঁ? আর শোনো, যদি তোমাকেই দোষ দিতাম তাহলে অ্যাদ্দিনে তুড়ি মেরে তোমাকে সার বানিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিতাম, বুঝলে?”

“আহা, তোমাদের কত দয়া!” টিটকিরির সুরে কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে ইয়েগর উঠে দাঁড়াল।

“আচ্ছা, একটা চুক্তিতে আসা যায় না?” মাশা বলে উঠল হঠাৎ।

“চুক্তি? কীসের চুক্তি? কী চাও তোমরা আমার কাছে? তাইগার সম্পূর্ণ অধিকার তোমাদের ছেড়ে দিতে হবে?”

“তোমাদের এই ব্যাপারটাই সবচেয়ে মজার, বুঝলে ইয়েগর!” কথাগুলো বলতে বলতে ডেইজির ঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছেধারীটি এইবার সামনে বের হয়ে এল। চেহারায় সে ডেইজির একটা ডাঁটার চাইতেও বেঁটে। বেরিয়ে এসেই চটপট খড়কুটো দিয়ে ছোট্ট একটা আসন বুনে নিয়ে তার ওপর আসনপিড়ি হয়ে আরাম করে বসল সে। “সবসময় তোমরা গোটা প্রকৃতিটাকে তোমাদের জমিদারি বলে ধরে নাও। পৃথিবীর সবকিছুর মালিক কেবল তোমরাই, তাই না? সবকিছুকেই তোমাদের মতো হতে হবে? বন থেকে ভালুক ধরে নিয়ে যাও, তারপর সেটাকে মানুষের প্যান্ট-জামা পরিয়ে, টুপি পরিয়ে সাইকেল চাপতে বলো। তোমাদের গল্পগাথায় রাজ্যের জন্তুজানোয়ারকে দিয়ে

বোকা, পাজি, পাগল মানুষজনের মতো ব্যবহার করাও। কেন জানো? সমস্ত জানোয়ার যদি মানুষের নকল করে তাহলে তোমরা খুশি হও। মানুষের মতো, কিন্তু মানুষের চাইতে বোকা। এটা বেশ মজার, তাই না? মজার, কিন্তু ভেবে দেখো তো, আর সব জীবজন্তুর জন্য সেটা কতটা অপমানের।

“শোনো হে ইচ্ছেধারী অপদেবতা।” ইয়েগর জবাব দিল, “অপমান নয়। এ হল বরং তার উলটো। কেন আমরা এসব করি সেটা কখনো আমাদের দিক থেকে ভেবে দেখেছ? মানুষ কতটা একা বলল তো! গোটা পৃথিবীর আর কেউ আমাদের ভাষা বোঝে না। নিজেদের মধ্যে ছাড়া আর কারও সঙ্গে একটা কথা বলতে পারি না আমরা। এমন একলা একলা থাকতে কার ভালো লাগে বলো দেখি! তাই আমরা জন্তুদের মানুষের পোশাক পরাই। আমাদের গল্পগাথায় তাদের মানুষের ভাষা উপহার দিয়ে কল্পনায় তাদের সঙ্গে কথা বলি। আর তোমরা? কখনও আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছ? একলা মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছ কখনো? হাত বাড়িয়ে দিয়েছ? ভয় দেখানো ছাড়া আর কী করেছ তোমরা আমাদের বলো তো! সাধে আমরা যুগে যুগে তোমাদের অপদেবতা বলে ডেকে এসেছি? চিরকাল তাই বলে ডাকবও। সে ছাড়াও দুনিয়ার কোন উপকারটা তোমরা করেছ অ্যাদ্দিনে?”

“আর তোমরা? তোমরা মানুষরাই বা কোন উপকারটা করেছ? উলটে তো…”

“হ্যাঁ। মানছি, পৃথিবীর অনেক ক্ষতি আমরা করেছি। কিন্তু ভালোও তো কম করিনি। আর তোমরা? দেখলাম তো এই ক’ দিন ধরে। ভালোমন্দ কোনটা করেছ তোমরা পৃথিবীর? কোনোটাই না। শুধু স্বার্থপরের মতন নিজেদের নিয়ে নিজেদের আনন্দেই আছ।”

কথাটা শুনে বেঁটে ইচ্ছেধারী তার আসন ছেড়ে ছোট্ট একটা লাফ মেরে মাটিতে নেমে এল। তারপর হাত মুঠো করে পায়চারি করতে করতে বলে, “ভুল। ভুল। তোমরা যাকে ভালোমন্দ, আলো-কালো বলে ভাগ করো, আমরা একই সঙ্গে তার সবকিছু। আমরাই বাঘ, আর আমরাই হরিণ, গোলাপও আমরা, তার মধ্যে মাকড়শাটাও আমরাই। সব মিলিয়ে, সমস্ত প্রাণ-অপ্রাণ মিলিয়ে আমরা একটাই অস্তিত্ব।

“আর তোমরা, কেবল একলা তোমরা। আমাদের এই মিলিত অস্তিত্বের বাইরে একলা একলা দাঁড়িয়ে আছ। তোমাদের দেখবার চোখ আলাদা। মাপবার মাপকাঠি আলাদা। তোমাদের ওই ভালোমন্দের নকল মাপকাঠিতে যতই প্রকৃতিকে ভাগ করে দেখতে চাও, লাভ হবে না ইয়েগর। প্রকৃতি এক। অখণ্ড। তার মধ্যে শুভ বা অশুভ বলে আলাদা কোনো ভাগ চলে না। আর আমরা, সেই অখণ্ডতার সঙ্গে মিশে থাকা একটাই অস্তিত্ব।”

“আমাদের সঙ্গে থেকে যাও ইয়েগর।” এইবার মাশা বলে উঠল, “চাইলে ঠিক আমাদের মতোই হয়ে যেতে পারো তুমি। প্রকৃতির সঙ্গে মিশে, তার সঙ্গে এক হয়ে…”

“তোমাদের সঙ্গে থেকে যাব?” ইয়েগর ঘাবড়ে গিয়ে বলে উঠল, “কেন? একে অন্যের কোন কাজটায় আসব আমরা? না হে। অনেক ধন্যবাদ। সকাল থেকে রাত্তির অবধি একদিন শুয়োপোকা হয়ে পাতা চিবোনো, আবার একদিন পাখি হয়ে গাছে গাছে লাফঝাঁপ… গাছ, ভালুক, কাঠঠোকরা… আজ্ঞে না। এর একটাও হবার কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমার নেই। দুঃখিত। ইচ্ছেধারী, শয়তান, পরি, নেকড়ে, খরগোশ, কিছু হবার লোভ নেই আমার। মানুষ হয়েই দিব্যি ভালো আছি আমি। পৃথিবীর সেরা জীব মানুষ হয়েই থাকতে চাই।”

“অন্তত একবার পরখ করে তো দেখো ইয়েগর!” মাশা মিনতি করে বলল, “যদি ভালো লেগে যায়!”

“নাহ। আমার মোটেই ভালো লাগবে না। তোমাদের কাছ থেকে এহেন কোনো উপকারের কোনো দরকার নেই আমার।” বলতে বলতে সে হাতের কুড়ুলটাকে একবার ওপর দিকে ছুঁড়ে দিল। বাতাসে ভেসে উঠল ধারালো কুড়ুল। তার ইস্পাতের ফলায় ঝলক দিয়ে উঠল রোদ। তারপর ফের সেটাকে গর্বিত হাতে লুফে নিল ইয়েগর।

মাশা চুপ করে তাকিয়ে দেখছিল তার দিকে। একটু বাদে মাথা নেড়ে সে বলল, “আজ রাতে ইয়েগর, আজ রাতে তুমি সবকিছু দেখবে। আজ রাতে তুমি আমাদের সবটা বুঝতে পারবে।”

“আমারও তাই মনে হচ্ছে, বুঝলে?” বামন ইচ্ছেধারী মাথা নাড়ল। “আজ রাতে সবকিছু দেখবার পর হয়তো তোমার মতামত খানিক বদলাবে। দেরি কোরো না। তোমার তো গর্ব হওয়া উচিত হে। আমাদের বনভোজন এর আগে কোনো মানুষের দেখবার সৌভাগ্য হয়নি। তাদের চোখে সেসব ধাই দেবে না! তবে হ্যাঁ, তুমি দেখতে পাবে। কেন জানো? কারণ যতই তুমি নিজেকে মানুষ ভাবো, এই মুহূর্তে তুমি অর্ধেকেরও কম মানুষ। আজ রাতে এই নিয়ে একটু খাটাখাটুনি করে আমরা তোমার বাকিটুকুকেও আমাদের দিকে টেনে নিয়ে আসব খন।”

“যতক্ষণ প্রাণ আছে তোমরা আমার কিচ্ছু বদলাতে পারবে না।” ইয়েগর জবাব দিল, “যতদিন বাঁচব, মানুষ হয়েই বাঁচব আমি। তোমরা দেখে নিও।”

“আজ রাতে!” জবাবে ফের একবার কথাটা বলতে বলতেই গুটিয়ে ছোটো হয়ে যাচ্ছিল মাশা, “আজ রাতে…” ফিসফিস করে বলতে বলতেই বাদামি লোমভরা একটা চামড়ায় ঢেকে যাচ্ছিল তার শরীর।

“আজ রাতে…” শেষবারের মতো বাতাসে কথাটা ভাসিয়ে দিয়ে একটা বুনো ছাগল হয়ে গেল মাশা। তারপর ইয়েগরের সামনে দাঁড়িয়ে, ভেজা চোখের ঠাণ্ডা চাউনি তার সারা শরীরে একবার বুলিয়ে দিয়ে সে টুকটুক করে হাঁটতে হাঁটতে বনের দিকে এগিয়ে গেল।

ওদিকে বামন ইচ্ছেধারী ততক্ষণে দু-জোড়া স্বচ্ছ ডানা বাড়িয়ে দিয়েছে শরীরের দু ধারে। ভনভন করে ডাক ছাড়ছিল তার ডানারা। তারপর পাক খেতে খেতে বাতাসে ভেসে যেতে যেতেই সে বলে গেল, “উঁহু… কখন যে রাত আসবে…”

তারপর তারা দু’জন আকাশ আর মাটি বেয়ে চলতে চলতে কাছাকাছি দাঁড়ানো একটা ঝোঁপের সঙ্গে মিশে গেল। আর তাদের কোনো নির্দিষ্ট চেহারা রইল না। তাইগা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র শরীর, অজস্র অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে থেকে তারা তখন অজস্র রূপ নিয়েছে। তারাই অরণ্য, তারাই নদী, তারাই সমস্ত পাখি, সমস্ত জীব, তারাই সম্পূর্ণ প্রকৃতি। তাদের শরীরকে আলাদা করে একটামাত্র চেহারায় বন্দি করা যায় না। চেতনায় তাদের ছবিকে একটামাত্র চেতনার ছবি হিসেবে আলাদা করে ধরা যায় না।

.

০৬.

মানুষের সময় যে ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ডের বাঁধা গতের ধারায় কাটে, সেই লাইন-বন্দি কাল-স্রোতের সব অর্থ হারিয়ে গেছে ইয়েগরের চেতনা থেকে। ঘণ্টা-মিনিটের হিসেবের বাইরে, অতীত-ভবিষ্যতের বিভাজনহীন এক সন্তত সময়স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ক্রমাগত মৃত্যু ও উত্থানের মধ্যে এই অরণ্যের ক্রমাগত আনাগোনার অনন্ত চক্রের সমষ্টি সেই নিরবচ্ছিন্ন, বহুমাত্রিক সময়স্রোত।

ইয়েগরের নিজের চেতনার অন্দরেও তখন কিছু একটা জিনিস অনবরত মরে চলেছিল। আর তার জায়গায় সপ্রাণ হয়ে মাথা জাগাচ্ছিল অন্য একটা চেতনা। সেই অনাগত চেতনা ধীরে ধীরে তার গভীরে বেড়ে উঠে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তার অসন্তত খণ্ডিত অস্তিত্বকে। তাকে নিবিড়ভাবে, পাকাপাকি মিশিয়ে দিচ্ছিল, মাটি, ঘাস, নদী ও আকাশের অস্তিত্বের সঙ্গে। এতদিন তার কাছে অপরিচিত থেকে যাওয়ায় বিশ্বের সম্পূর্ণ চেতনাকে এইবার নিজের চেতনা বলে চিনে নিচ্ছিল ইয়েগর। তবে এতকাল যে খণ্ডিত চেতনা নিজেকে ইয়েগর বলে পরিচয় দিত সে আর এই ইয়েগর পুরোপুরি এক নয়। একজন শহরবাসী হিসেবে, বেলবগ, ইচ্ছাধারী, পরি, জলপরি এমন অজস্র অপদেবতা আর উপদেবতাদের কথা সে শুনেছে। কিন্তু কখনো তাদের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করেনি। তার কাছে এরা ছিল কেবলই দূর অতীতের মানুষজনের কল্পনার ফসল। রূপকথার চরিত্র বলেই তাদের মেনে চলেছে সে চিরকাল।

অথচ এইবার বাস্তব দুনিয়ায় তাদের দেখা পেয়েছে সে। জানতে পেরেছে, স্লাভদের দুনিয়ায় স্মরণাতীত কাল থেকে তাদের বসবাস। একসময় মানুষের সঙ্গে পাশাপাশি বসত করত তারা। কিন্তু তারপর মানুষ যখন পৃথিবীর রাজা হয়ে উঠল, সেদিন থেকেই আস্তে আস্তে মানুষের দুনিয়া থেকে উধাও হয়ে গেল তারা। গলে মিশে হারিয়ে গেল

রাশিয়ার অরণ্যে, মাটিতে, নদীর স্রোতে। এইবার সে স্লাভদের আসল প্রকৃতির স্পর্শ পেয়েছে এই নির্জন তাইগার বুকে। তার নিজের জাতটা, প্রকৃতির থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার অনেক আগে, যে ভূমিতে একদিন জন্ম নিয়েছিল, আজ সেই ভূমি ও প্রকৃতির গভীরে এসে দাঁড়িয়েছে সে। এই কি তবে তার শেকড়ের সন্ধানে যাত্রা? নিজের অচেনা মাতৃভূমির বুকে ফিরে আসা? যে মাতৃভূমিতে জলপরিরা মাছদের দেখভাল করে। বৃক্ষদেবতারা গাছের মধ্যে বসবাস করে আজও। যে দেশে অরণ্যের আত্মা নিজেকে কিশোরীর রূপে বদলে দেয়। সে কিশোরী ক্লান্ত পথহারা মানুষের মুখে খাবার জুগিয়ে যায় গভীর অরণ্যে। যে কিশোরীর শরীর ঝরনার বহতা জলের সুগন্ধ ছড়ায়।

এই সর্বব্যাপী চেতনার সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যেতে… কেমন লাগবে? একলা বিচ্ছিন্ন মানুষ হয়ে বাঁচাকে শেষ করে দিয়ে… কিংবা ঠিক তার উলটো, প্রকৃতির সঙ্গে যে যোগসূত্রগুলো মানুষ ভেঙে ফেলেছে স্বেচ্ছায়, সেই যোগসূত্রগুলোকে ফের ফিরিয়ে এনে, মানুষ যখন প্রকৃতির সঙ্গে একীভূত হয়ে বেঁচে ছিল, যখন মানুষের দেহ শত-লক্ষ পশুপাখির চেতনার মিলিত আবাস ছিল, যখন মানুষের আত্মা সমস্ত জীবিত অস্তিত্বের সঙ্গে একইভাবে সংলগ্ন ছিল, সেই সময়কার মতো ফের একবার একটা বিরাট চেতনার অংশ হয়ে বেঁচে থাকতে… কেমন লাগবে?

ইয়েগর জানে না, তেমনটা হলে ‘তার’ কী হবে। তবে একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিত।

তেমনটা হলেও, তার ভেতরে ‘সে’ বেঁচে থাকবেই।

এমনটাই ভাবতে ভাবতে সে বনের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল। একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে আছে গোটা অরণ্য। একটা পাখিও ডাকছে না। কোনো গাছের একটা পাতাও নড়ছে না বাতাসে। শুধু তার পায়ের নীচে শুকনো ডালপালার ভেঙে যাবার শব্দ, আর ঘাসবনের সড়সড়।

এখানে রাস্তা নেই কোনো। যেদিকে দু-চোখ যায় চলতে থাকলেই হল, কারণ ইয়েগর জানত, দিনের শেষে যে-কোনো পথই তাকে ঠিক সেই সান্ধ্য আসরে পৌঁছে দেবে।

সন্ধের মুখ মুখ ইয়েগর এসে পৌঁছোল একটা বড়সড় খাদের সামনে। খাদটার ভেতরে কোমর সমান উঁচু ফার্নের জঙ্গল। খাদ পেরিয়ে ওপাড়ে গিয়ে ওঠবার মতলবে ছিল ইয়েগর। কিন্তু তার ভেতরে গিয়ে নেমে বেশ একটু মুশকিলে পড়ে গেল সে। একে তো কোমর সমান শিশিরভেজা জঙ্গল ভেঙে চলা। তায় আবার একটু বাদেই সূর্য ডুবে গিয়ে সন্ধে নেমে এল একেবারে ঝপ করে।

ফার্নের জঙ্গল তবুও ফুরোয় না। খাদটা যেন ক্রমেই আকারে বেড়ে উঠছে।

ফার্নগুলোও লম্বা হতে হতে তার মাথা ছাড়িয়ে উঠছে। জায়গায় জায়গায় তারা এতই ঘন যে কুড়ুল চালিয়ে তাদের মধ্যে দিয়ে রাস্তা করে নিয়ে এগোতে হচ্ছিল ইয়েগরকে। খানিক বাদে এমন অবস্থা হল যে, অন্ধকারে ফার্নের জঙ্গল ভেঙে কোনদিকে কতদূর

যাচ্ছে সেসব একেবারে গুলিয়ে গেল ইয়েগরের। শেষমেশ না পারতে ওই জঙ্গলের মধ্যেই খানিক জায়গা পরিষ্কার করে নিয়ে সেইখানটায় জুড়ে বসল সে।

ততক্ষণে আকাশে সরু একফালি চাঁদ উঠেছে। তার আবছা আলোয় ফার্নের পাতার ছায়ায় লুকিয়ে বসেছিল ইয়েগর। মাটি থেকে উঠে আসা গরম ভাপ তাকে ঘিরে আচ্ছন্নতার জাল বুনে তুলছিল ক্রমশ। একটা আশ্চর্য তন্দ্রা… স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যেকার দেয়াল ঘুচে যায় যে তন্দ্রায়…।

..এমনি করে কতক্ষণ যে কেটে গেছে তা ইয়েগরের খেয়াল ছিল না। হঠাৎ দূরে একটা শিঙার শব্দ শুনে ধড়মড় করে উঠে বসল সে। চাঁদ ততক্ষণে আরও খানিক উঁচুতে উঠে এসেছে। খানিক দূরে কারা যেন আগুন জ্বেলেছে। ফার্নের পাতাগুলো, তাদের রসালো কাণ্ড সেই আগুনের হলকায় তিরতির করে কাঁপছিল।

শিঙেটা এইবার ফের একবার বেজে উঠল। আর তার পেছন পেছন ভেসে এল আরও বড়ো একটা শিঙের শব্দ আর সেই সঙ্গে ঢোলের আওয়াজ। শব্দটা শুরু হতেই ফার্নের পাতাগুলো যেন জ্যান্ত হয়ে উঠে নড়াচড়া শুরু করল ইয়েগরের চারদিকে। তাদের তলার দিকগুলো থেকে ছোটো ছোটো কুঁড়ি গজিয়ে উঠে টুপটাপ করে খসে পড়ছিল মাটির ওপর। মাটিতে পড়েই কুঁড়িগুলো আশ্চর্য নীল রঙের ফুল হয়ে ফুটে উঠছিল। এমন ফুল ইয়েগর কখনো দেখেনি।

ডানার শব্দ, পায়ের শব্দ, গলার আওয়াজ মিলে ততক্ষণে অন্ধকার সেই জায়গাটা গমগম করে উঠেছে। ইয়েগর ফের শুয়ে পড়ল। উঁকি মেরে দেখবার কোনো কৌতূহল হচ্ছিল না তার। তার চাইতে যতক্ষণ এদের নজর এড়িয়ে থাকা যায়।

তার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সেই নীল ফুলগুলো থেকে ভারি মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছিল। নাকে সেই গন্ধ যেতে মাথা ঝিমঝিম করছিল ইয়েগরের।

হঠাৎ ফার্নের জঙ্গলের ভেতর থেকে একটা কোঁকড়া-চুলো বেড়ালের মুখ বেরিয়ে এল। ইয়েগরের দিকে সবুজ চোখের একটা ঝলক দিয়ে সেটা ফের সেটা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল। আড়াল থেকে বেড়াল মার্কা গলায় কেউ বলে উঠল, “ইয়েগরকে পাওয়া গেছে।”

“অ্যাঁ? শুয়ে শুয়ে মধু খাচ্ছে নাকি?” জবাবে খরখরে একটা গলা বলে উঠল।

“উঁহু!” বেড়াল গলা জবাব দিল। আর তারপর ফুলো ফুলো নোমওয়ালা একটা কালো বেড়াল ফার্নের জঙ্গল থেকে এক লাফে বের হয়ে এসে ইয়েগরের পেটের ওপর উঠে বসল। বেড়ালটার দাঁতগুলো বেশ বড়ো বড়ো। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে তাদের ছুঁচলো মাথাগুলো দেখা যাচ্ছিল।

“তুমি কে? “কুর্দিশ।” এই বলে বেড়ালটা তার লম্বা জিভ বের করে ইয়েগরের গালটা

চেটে দিল। তার মুখে ফুলের মধুর গন্ধ ছিল।

“আরে মধু খাচ্ছ না কেন? কী-ই-ই-ই যে ভালো খেতে!” বুড়িদের মতো খরখরে গলায় কথাগুলো বলতে বলতেই এবার ফার্নের ঝোঁপ থেকে অন্ধকার একটা ছায়া হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল। তাকে দেখতে একটা বিরাট মাকড়শার মতো ঠেকে।

“ও আবার কে?”

“ও হল ডাকিনী কিকিমোরা। বেশ ভয় ভয় লাগে না দেখলে?” বলতে বলতেই কুর্দিশ তার ধারালো দাঁত দিয়ে একটা নীল ফুল কুচ করে ছিঁড়ে মুখে পুরে নিয়ে মহানন্দে দু-বার মিউ মিউ করে ডেকে নিল।

কনুইতে ভর দিয়ে এইবার মাথাটা একটু তুলল ইয়েগর। “আহা, দারুণ! কই হে কিকিমোরা। সামনে এসো। ভালো করে দেখি একবার তোমায়!” বলতে বলতে ছায়াটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে।

বলবার সঙ্গে সঙ্গেই কপালের ওপর একটা বোম্বাই চড় পড়ল তার। “কিকিমোরার সঙ্গে বেশি ঠিসি-ঠাট্টা কোরো না, বুঝলে?” কুর্দিশ ফুলটা চুষতে চুষতে বলে উঠল, “কেউ বেশি চালাকি দেখাতে গেলেই ওর হাতে থাবড়া খায়। তার চাইতে একটা জিনিস বলি। সুড়সুড়ি খাবে? কিকিমোরা চমৎকার সুড়সুড়ি দেয় কিন্তু।”

সামনে এসে দাঁড়ানো ছায়াটার দিকে একনজর তাকিয়ে দেখে মাথা নাড়ল ইয়েগর। “নাহ, থাক। উপস্থিত সুড়সুড়ি না খেলেও চলবে।”

“তোমার যেমন ইচ্ছে। তাহলে চলো এবার আমার সঙ্গে। সবার সঙ্গে আলাপ-টালাপ হোক।” বলতে বলতেই কুর্দিশ আরেকটা ফুল মুখে ফেলে তার মধুটা চুষে নিয়ে ছিবড়েটা ছুঁড়ে ফেলল মাটিতে।

ইয়ের খানিক অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল। আগুনটার দিকে যাবার কোনো ইচ্ছে তার হচ্ছিল না। কিন্তু উপায় কী? একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে ঘুরে দাঁড়াল ইয়েগর। তারপর লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটা দিল আগুনটাকে লক্ষ্য করে। সেখান থেকে হাসির শব্দ, চ্যাঁচামেচি, শিঙার আওয়াজ, ঢোলের বাদ্য তখন ক্রমশই বেড়ে উঠছিল। তার পায়ে পায়ে ছুটতে ছুটতে কুর্দিশ তখন বলে যাচ্ছে, “শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ার দিন ফার্নের ফুল ধরে। তখন আমরা সবাই এইখানটা এসে হাজির হই। কিছু আছে এখানকার লোকজন, আর কিকিমোরাদের মতো বাইরে থেকে আসা কয়েকজন… মানে এখন অবধি যারা টিকে।

আছে আর কী। এইবার তাদের সবার সঙ্গেই দেখা হয়ে যাবে তোমার।”

“যত ফালতু কথা।” ইয়েগর মাথা নাড়ল, “ফার্নে আবার ফুল ফোটে নাকি? এরা তো স্পের ছড়িয়ে…”

“হ্যাঁ হ্যাঁ। ঠিক ঠিক।” কুর্দিশ সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল। “একদম ফালতু।” বলতে বলতেই আরও একটা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে চুষতে চুষতে সে বলে, “কিন্তু বেজায় সোয়দের

ফালতু! সে যাই হোক, এখানে এলাকার যত ইচ্ছেধারী, বনপরি, জলপরি, দৈত্য, ডাকিনী, বৃক্ষদেবতা সব্বার সঙ্গেই দেখা হয়ে যাবে দেখো। সে ছাড়া স্ট্রাইবগ, বেলবগ, শেরনোবগ, পখভিস্ট, লাডো, রাজ্যের ইম্প, সব এসে ঠাঁই নিয়েছে তাইগায়। এমনকি পেরুন অবধি আছে।”

“আর মাভকা?”

“আছে তো! পলুদনিৎসা, পুকুরের পাঁক-পিশাচ, খামারের ভূত, এমন আরও অনেকেই আছে। আসলে মধুর নেশা বড়ো জব্বর নেশা হে। যে, যে কাজেই থাক না কেন, আজকের রাতে এই ফার্ন বনে হাজিরা দিতে কেউ ভোলে না। এমনকি মৌ-ন্যামি, দ্যালি-ন্যামি, কৌ-ন্যামি সব এসে হাজির হয়।”

“এককথায় দুনিয়ার সব অপদেবতার মেলা, তাই তো?” কুড়ুলের কোপে ফার্ন কেটে রাস্তা বানাতে বানাতে ইয়েগর বলল, “আজ তার মানে তাইগার বুকে ডাকিনী মহা সম্মেলন। মরুক গে যাক। আমি তোমাদের ভয় খাই নাকি?”

“আহা, ভয় খাবার কথা উঠছে কেন?” কুড়ুলের ঘায়ে ছিটকে পড়া ফার্নের পাতাগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে মুখে লুফতে লুফতেই কুর্দিশ তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল, “তুমি তো এখন আমাদের একজন হয়েই গেছ।”

“হুম। আসলে ফুল ফোঁটা ফার্নের গল্প আমাদের দুনিয়ায় বেশ চালু। লোকজন তাইগার বুকে বহুকাল ধরে ও-জিনিস খুঁজছে, কিন্তু কখনো ওর নাগাল পায়নি। তা আজ তোমরা যখন আমায় এখানে নিয়েই এসেছ, সেই থেকেই মালুম, তোমরা ধরে নিয়েছ আমি আর মানুষ নেই।” বলতে বলতেই মুচকি হাসল ইয়েগর। “কিন্তু ব্যাপার হল, আসলে আমি এখনও মানুষই আছি।”

“মানুষ! হি হি! বটে!” বলতে বলতে কুর্দিশ হঠাৎ হাউমাউ করে ডাক ছেড়ে এক লাফে ইয়েগরের কাঁধে উঠে বসে তার ঘাড়ের কাছে নখ বিঁধিয়ে দিয়েছে। “কোথায় হে! মানুষের নামগন্ধও তো আর দেখছি না তোমার গায়ে।”

“অ। তা সে তুমি যা খুশি ভাবতে থাকো না! কে মানা করেছে? শুধু ঘাড়ে নখ-টখ কি বেঁধালেই নয়? ফার্নের মধু খাচ্ছিলে দিব্যি, তাই করো না!”

কুর্দিশ সঙ্গে সঙ্গে তার কানের কাছে মুখটা এনে গরম নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “একটা ইয়েগর, শুধু একটা ফুল একটু চুষে দেখো! কী যে ভা-আ-আ-আ-লো…”।

কথাগুলো বলতে বলতেই হঠাৎ ইয়েগরের সামনে থেকে ফার্নের জঙ্গল সরে গিয়ে সেখানে একটা মাঠ দেখা দিয়েছিল। সেখানে তখন একটা গনগনে আগুন জ্বলেছে। তা থেকে বাতাস বেয়ে নীল নীল ধোঁয়া আর ফুলকির ঝার উঠে যাচ্ছে শোঁ শোঁ শব্দ করে। আর তার চারপাশে শয়ে শয়ে নানান চেহারার ফুর্তিবাজ জীব এসে জড়ো হয়েছে। তাদের গলায় ফার্নের ফুল ফোঁটা পাতার রঙিন মালা। সবাই মিলে তারা মাঠ কাঁপিয়ে

হল্লা জুড়েছে সেখানে। নাচ, গান, শিঙে আর বাঁশির বাদ্য, ঘনঘন মিহি, মোটা গলার চিৎকার, লাফালাফি, মাঠ জুড়ে ছুটোছুটি, কখনও বা আগুনের ওপরে লাফ দিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া…

আলোয় ভরা এলাকাটার ঠিক বাইরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল ইয়েগর। “আর এগোচ্ছি আমি। এখান থেকে সব দিব্যি দেখা যাচ্ছে। তুমি যাও। আমি এখানেই রইলাম।”

“ইয়েগ-অ-অ-র!” হঠাৎ একটা চেনা গলা ডাক দিয়ে উঠল তার নাম ধরে। গলাটা ইয়েগরের চেনা। মাভকা!

মাভকা ততক্ষণে ভিড় ছেড়ে তার দিকে দিব্যি ভেসে আসছে। তার ছিপছিপে শরীরে পোশাক নেই কোনো। রুপোলী একটা জলের ধারার মতোই তার চলন। চলতে চলতে জলের মতোই ইচ্ছেমতো আকার বদলায় সে। জলের মতোই হিংস্র। জলের মতোই প্রাণদায়ী।

“কেমন আছ তুমি?” বলতে বলতেই হাতের কুড়ুলটা মাভকার দিকে উঁচিয়ে ধরল ইয়েগর, “আরেকবার আদর করবার মতলবে আছ নাকি হে জলপরি?”

মাভকা কুড়ুলটার দিকে ভ্রূক্ষেপও না করে তার একেবারে কাছে এগিয়ে এল। ভেজা, ভ্যাপসা আর ঠাণ্ডা একটা হাওয়া যেন পোশাকের মতো ঘিরে ছিল তার শরীরকে। খানিকক্ষণ অন্যমনস্ক চোখে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে ঠাণ্ডা নীলচে একটা হাসি ছড়িয়ে সে বলল, “আমার জন্য মনখারাপ করছিলে নাকি নাগর?”

“মনখারাপ মানে? মরতেই বসেছিলাম যে!” কথাগুলো বলে ইয়েগর কুর্দিশের দিকে ফিরে বলে, “এই মাভকাটাকে যদি আমার কাছ থেকে ভাগাতে পারো তাহলে যা চাইবে তাই দেব তোমায়।”

বেড়ালটা ভারি চিন্তাশীল একটা ভাব করে বলে, “মাভকাকে কেউ ভাগাতে পারে না। হে! আরে, জল ছাড়া কেউ বাঁচে নাকি? তবে ঘাবড়াবার কারণ নেই। আজ রাতে মাভকা তোমায় ছোঁবে না।”

“ধুত্তোরি তোর জল! চুলোয় যা আপদ কোথাকার!” বলতে বলতে ইয়েগর মাঠটার একেবারে উলটোদিকে গিয়ে দাঁড়াল।

মাভকা কিন্তু এবার আর তার পেছন পেছন এল না। তার বদলে হঠাৎ একটা গলিত আয়নার মতো সে বয়ে গেল ফার্নের জঙ্গলটার দিকে।

ততক্ষণে ইয়েগরের নজরে পড়েছে, আগুনের পাশ থেকে নাচতে নাচতে অন্য একটা দল তার দিকে এগিয়ে আসছে। খানিক বাদেই দলটা এসে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর তার হাত ধরে আগুনটার একদম পাশে ডেকে নিয়ে এল। তাদের একেকজনের মুখ একেকরকম। ছোটো, বড়ো, বিচ্ছিরি, সুন্দর, লম্বা, বেঁটে, ফোলা, চ্যাপটা, শুড়ওয়ালা, শিঙওয়ালা, গন্নাকাটা, মোটকা ঠোঁট সবরকমই আছে। ইয়েগরকে ঘিরে ধরে তারা তাকে ভয় দেখাবার মতলবে মুখচোখ ঘুরিয়ে নানান ভঙ্গি করে, আর সেই করতে গিয়ে হেসে হেসে খুন হয় সব।

কিন্তু ইয়েগর পালাল না। এদের কেউ খুব কাছাকাছি চলে এলে কেবল সে তার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়াটা এড়িয়ে যাচ্ছিল। কুর্দিশ অবশ্য তার সঙ্গ ছাড়েনি। তার পিঠে লটকে থেকেই কানের কছে ফিসফিসিয়ে যাচ্ছিল সে, “এগুলো সব নানান জাতের পরি। এদের মধ্যে ইচ্ছেধারী আছে একটা। চিনতে পারছ?”

যেই না কুর্দিশের একথা বলা, অমনি ভিড়টার থেকে চেনা টুপি আর গগলস পরা একটা মুখ বের হয়ে এল।

“আছ কেমন হে দোস্ত?” হাঁক দিয়ে উঠল মুখটা, “আহা, কী সুন্দর রাত গো! নাচো হে ইয়েগর। একটু নাচো। মনটা খানিক হালকা হয়ে ভেসে উঠুক। সেই থেকে শুধুমুদু দুর্ভাবনা করে করে মনটাকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছ। এবারে একটু আদরও দাও! নাকি? চলো চলো। মধু খাও একটু। আহা মধু। বড়ো ভালো…”

“তোমাদের মধুর নিকুচি করেছে!” ইচ্ছেধারীর দিকে তাকিয়ে গরগর করে উঠল ইয়েগর, “আমায় একদম ওসব খাবার জন্য জোর করবে না বলে দিচ্ছি।”

“হা হা হা… জোর করবই।” বলে পরির দলে হেসে উঠল। তারপর বলে, “চল তোকে পেরুনের কাছে নিয়ে যাব। সিধে করে ছেড়ে দেবে তোকে। এহ! বলে নাকি মধু খাবে না! চল!”

বলতে বলতে ইয়েগরকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে ঠেলে উঁতিয়ে আগুনটার একেবারে সামনে ধরে নিয়ে চলল।

কুর্দিশ কিন্তু তখনও ইয়েগরকে ছাড়েনি। লোমে ঢাকা সামনের থাবা দুটো দিয়ে প্রাণপণে তার গলাটা জড়িয়ে ধরে ঝুলছিল সে। তবে ইয়েগর বা তার শত্রু কাদের সাহায্য করছে সে সেইটে বোঝা যাচ্ছিল না ভালো করে। ঝুলতে ঝুলতেই ইয়েগরের কানে কানে সে বলছিল, “বাধা দেবার চেষ্টা কোরো না ইয়েগর। বুঝতেই পারছ তাতে লাভ নেই। কাজেই রোমে গেলে… ওই যা বলে-টলে আর কী! সবই তো জানো!”

পরির দল আগুনের পাশে দাঁড় করানো একটা মূর্তির সামনে ইয়েগরকে টানতে টানতে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। মূর্তিটা বিরাট বড়ো। তার মাথাটা রূপোর তৈরি। তার লম্বা দাড়িতে সোনালি আভা। দুটো লোহার পায়ের ওপর তার কাঠের শরীরটা শক্তপোক্তভাবে আটকানো। লোহার পা-দুটোয় জং ধরা। তার ডানহাতে একটা লম্বা, গিটওয়ালা লাঠি।

ইয়েগরকে তার সামনে ধরে রেখে পরিদের গোটা দলটা মিহিতে মোটায়, সুরে, বেসুরে মহা হট্টগোল শুরু করে দিল। বলে, “পেরুন! হে পেরুন! ইয়েগরকে সুবুদ্ধি দাও

বাবা। ওর মাথাভর্তি ভুষিতে একটু বুদ্ধির আগুন জ্বালিয়ে দাও মহারাজ। এ আমাদের মধু খেতে চায় না! কী মহাপাপের কথা, ভাবো দেখি একবার!”

শুনেই মূর্তিটা হঠাৎ গা মোচড় দিয়ে উঠল। তার কাঠের শরীরটা ভেতর থেকে চাপ খেয়ে ফুলে ফুলে উঠছে যেন। তার সোনালি দাড়ি ঝুমঝুম শব্দ করে দুলছিল। খানিক বাদে সেসব আওয়াজ-টাওয়াজ থামিয়ে পেরুনের মুখটা তার রুপোলী ভুরু উঁচিয়ে গভীর নীল দুটো চোখ মেলে ইয়েগরের দিকে তাকাল। তারপর হাতের লাঠিটা মাটিতে ঠুকে গম্ভীর গলায় বলে, “মধু খা বলছি ইয়েগর!”

“কভি নেহি।” ইয়েগর বুক ঠুকে জবাব দিল, “ও-জিনিস আমি খাবোই না। আমি তোমাদের মতো ভূত-পেত্নী নাকি? আমি ইয়েগর। মানুষ। আমি মানুষ হয়েই থাকতে চাই।”

“মানুষ তুই আগে ছিলি। এইবার পরি হবি। তাতে ভালোমন্দ হলটা কী? বাঁচতে চাইলে, খা বলছি!”

“আগে মরি, তারপর খাইও।” তিতকুটে গলায় টিটকিরি দিয়ে উঠল ইয়েগর, “কিন্তু জ্যান্ত থাকতে তুমি আমায় ওসব খাওয়াতে পারবে না এই বলে দিলাম।”

শুনে পেরুনের লোহার ঠ্যাং-দুটো মাটির ওপর দুপুদুপিয়ে উঠল। তার হাতের লাঠিটা ইয়েগরের চোখের সামনে প্রথমে হলদে, তারপর একেবারে চোখ ঝলসানো সাদা রঙ ধরল। এইবার লাঠিটাকে পেরুন মাটিতে ঠুকতেই চোখ ঝলসানো সাদা আগুনের ফুলঝুরি ছড়িয়ে গেল তার থেকে। পরির দল সঙ্গে সঙ্গে হাউমাউ করতে করতে ইয়েগরকে সেইখানে ছেড়ে হাওয়া। আগুনের পাশে তখন ইয়েগর আর পেরুন মুখোমুখি। অবশ্য কুর্দিশ ইয়েগরের সঙ্গেই ছিল। তবে তা না থাকবার মতোই। ইয়েগরের কাঁধে বসে সে তখন অত হট্টগোলের ভেতরেও দিব্যি একটা ঘুম দিয়েছে।

হঠাৎ পেরুন কাঁচকোঁচ, মড়মড় শব্দটব্দ করে কোনোমতে নিচের দিকে ঝুঁকে ইয়েগরের মুখের দিকে তাকাল। তারপর বেশ নরম গলায় বলে, “ব্যাপারখান কী হে দাদুভাই? এমন আচরণ তো উচিত কাজ নয়। তোমরা স্লাভরা তো চিরটা কাল আমায় বেশ শ্রদ্ধাভক্তিই করতে। কিন্তু ইদানীং দেখছি আমায় নিয়ে ঠিসি-ঠাট্টা, রঙ্গরসই চলছে বেশি। কেন হে? একই মাটি থেকে আমাদের জন্ম, সে কি তোমরা ভুলে গেলে নাকি?”

ততক্ষণে ঠাণ্ডা পড়ে গেছে বেশ। অবশ হয়ে আসা হাতদুটো ঘষতে ঘষতে ইয়েগর জবাব দিল, “আজ্ঞে না। তেমন কিছু তো মনে করতে পারছি না! না হে পেরুন। তোমায় আমি জানিই না। তবে হ্যাঁ, আমি তোমার নাতি-টাতি কিছু নই, সেটা অবশ্য জানি।”

“অ। পণ্ডিত হয়েছ! বাপঠাকুদার ভগবান ছেড়ে ওই দাড়িওয়ালা কোঁকড়া-চুলো ভগবানটার পুজো করতে শিখেছ? আরে শোন, পুরনো কালে তোর বাপঠাকুরদা নিজেদের পেরুন আর ডাঝবগ-এর নাতি মনে করত। আর এখন? নিজেদের শেকড়

খুঁজতে তুই ইদানীং পুব-পশ্চিম-ঈশেন-নৈঋত তোলপাড় চালাচ্ছিস বলে খবর পাই। খোঁজ না! কিন্তু কোথাও পাবি না এই বলে দিলাম। কেন জানিস? তোদের শেকড় পোঁতা আছে এইখানে। এই রাশিয়ার তাইগার বুকে।”

এই বলে পেরুন ফের একবার তার সফেদ ঝলক দেয়া ডাণ্ডাটা মাটিতে ঠুকল। সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে ওজোনের গন্ধ ছড়িয়ে একরাশ ফুলকি উড়ে গেল তার থেকে।

“একই রক্ত বইছে আমাদের গায়ে।” ভারি নরম গলায় প্রায় ফিসফিস করে পেরুন বলছিল, “মধুটা খেয়ে দেখ, তোর জন্মভূমির বুকের মধু রে দাদুভাই। তাহলেই নিজের হারিয়ে যাওয়া আসল ঠিকানার খোঁজ পাবি।”

বলতে বলতেই পেরুন একটা শিং-এর পাত্র ভর্তি টলটলে নীল, সুগন্ধী মধু ইয়েগরের মুখের সামনে এনে ধরল।

“ওরে ব্যাটা ভিতু,” পেরুনের গলায় গুরুজনের সোহাগভরা বকুনির আভাস ছিল, “মধু খেয়ে তুই পরি হয়ে যাবি বলে ভয় পাচ্ছিস? ওসব বাজে কথা। এ-মধু তোর আত্মার সব কালিঝুলি ধুয়ে নেবে রে। তোর অতীতের সঙ্গে, পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যের সঙ্গে, এই রাশিয়ার মাটির সঙ্গে মিলিয়ে এক করে দেবে তোকে। আয়… নে…”।

“আ-আমি খাব না!” বলতে বলতেই কাঁপা কাঁপা হাতে শিংটা তুলে নিল ইয়েগর। তারপর সেটা ঠোঁটে ছোঁয়াতে গিয়েও ফের একবার থমকে গিয়ে বলে, “মাটির সঙ্গে এক হয় তো মরে গেলে। আমার মধ্যে যে মানুষটা আছে তাকে তুমি মারতে চাও? তুমি…”

“বোকা কোথাকার। এইটে খাবার পর তুই সত্যিকার মানুষ হবি রে। যার কোনো অতীত নেই, পূর্বপুরুষের কোনো স্মৃতি নেই, সে হল শেকড় ছাড়া গাছের মতো। দাঁড়িয়ে থাকবার শক্তি পাবে কোথায় সে? খা দাদুভাই!”

ইয়েগর শিংটা তার ঠোঁটে তুলে ধরল। তার ভেতরে ঘন নীল মধুর মধ্যে বুড়বুড়ি কাটছিল। একটা মাদক সুগন্ধ তার থেকে উঠে এসে ছেয়ে যাচ্ছিল তার নাকে। কয়েক মুহূর্ত সেই ঘ্রাণ নিয়ে সে পেরুনের দিকে ফিরে তাকাল। চোখের দৃশটি বদলে গেছে তখন ইয়েগরের। পেরুনের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “তাই হোক। তোমার ওপর ভরসা রাখলাম আমি। আমার পূর্বপুরুষরা তোমায় ভক্তি করেছেন। আমিও তোমায় আমার শ্রদ্ধা দিলাম। তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক পিতামহ।”

জ্বালা ধরানো তীব্র সুগন্ধী মধু, শিরায় শিরায় আগুন ছড়িয়ে তার গলা বেয়ে নেমে যাচ্ছিল।

“খা রে ব্যাটা। চেটেপুটে সবটুকু খেয়ে নে।” তাকে ঘিরে থাকা ইচ্ছেধারী, বনপরি, জলপরি, দৈত্য, ডাকিনী, বৃক্ষ –দেবতার দল তার হাত ধরে হুল্লোড় তুলছিল।

শিংটা নামিয়ে রাখতে তার কাঁধে বসে কুর্দিশ আদুরে গরগরানি ছাড়ল একটা, “বাস রে! তোমাকে রাজি করাতে তো কালঘাম ছোটবার জোগাড় হয়েছিল সবার।” বলতে বলতেই গরম, খরখরে জিভে ইয়েগরের গালটা একবার চেটে দিল সে। “দেখলে তো! মরোনি। কিচ্ছু হয়নি। বোকা ছেলে কোথাকার। এত ভয় পাচ্ছিলে কেন তবে?”

তখন সেই অধিদেবতার দল নাচতে নাচতে হল্লা করতে করতে টেনে নিয়ে চলেছিল ইয়েগরকে। মধুটা খাবার পর তার ভেতরে যে বদলটা আসা শুরু হয়েছে তখন সেইটাকে দু-দণ্ড সুস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে টের পাবার ফুরসত তাকে দিচ্ছিল না তারা।

খানিক বাদে তাকে আগুনের পাশে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে তারা তার মুখটা আগুনের দিকে ঘুরিয়ে ধরল। সেখানে একটা দৈত্য বসে ছিল। তার বিরাট শরীরটা, রক্ত খেয়ে পুঁটুলি হয়ে থাকা মশায় ঢাকা। মশাগুলোকে তাড়াবার কোনো চেষ্টাই করছিল না দৈত্য। কেবল মাঝে মাঝে মুখটায় হাত বুলিয়ে নিচ্ছিল একেকবার। ওতে কয়েকটা করে মশা পিষে গিয়ে মুখ জুড়ে তার রক্তের আঁকিবুকি বানিয়ে দিচ্ছিল।

“ও হল গিয়ে বেলবগ।” বলে কুর্দিশ তাকে একটা ঠেলা দিল। “ভয় নেই। বেলবগ দৈত্য হলেও লোকটা ভালো।”

ততক্ষণে বেলবগ তার দিকে ঘুরে তাকিয়েছে। মোটা গলায় হেঁকে সে বলে, “কী হে ইয়েগর, আরেক পাত্তর হবে নাকি?”

“মন্দ কী?” ইয়েগর মাথা নাড়ল।

সঙ্গে সঙ্গেই পাশ থেকে কেউ মধুভরা আরেকখানা শিং এনে ধরিয়ে দিল তার হাতে। সেটা হাতে নিয়ে বেলবগের দিকে তাকিয়ে ইয়েগর বলে, “তুমি খাচ্ছ মধু, সে ভালো কথা। কিন্তু মশাগুলো তোমার সব রক্ত খেয়ে গেল যে!”

“আরে ও নিয়ে ভেবো না। ওরা তো বাজে রক্ত চুষে বের করে দিচ্ছে।” মাথা নাড়ল বেলবগ, “এই যে ধরো আমার স্বভাবটা এত মিঠে। সেইটে বজায় রাখা অতই সহজ? এই মশারা সবসময় আমার সব বদবুদ্ধি বদরাগ শুষে নিয়ে আমায় সাফ রাখে। তোমার ক টা লাগবে নাকি? আমি দিতে পারি। নিয়ে পেলে-পুষে নিজের ঝাঁক বানিয়ে নিতে পারো চাইলে।”

“আহা, থাক থাক।” ইয়েগর মাথা নাড়ল, “তার চাইতে আরও খানিক মধু খাওয়া যাক বরং।” বলে কোনোদিকে দৃকপাত না করে ইয়েগর তার দ্বিতীয় পাত্রটাও গলায় উপুড় করে দিল।

“হুম। ভালো মধু তো খেয়ে দেখলে। এবার তবে খানিক মন্দ মধু চেখে দেখবে নাকি?” হঠাৎ তার পাশ থেকে কে যেন সাবধানী গলায় বলে উঠল, “এসো, আমার সঙ্গে একপাত্তর…”

কথাটা যে বলছিল তার চেহারাটা মানুষেরও হতে পারে, আবার কোনো জন্তুরও হতে পারে। শরীরটা ধাতুর তৈরি। ঝাপসা মুখটা বারবার তার চেহারা বদলে চলেছে। ইয়েগর ঘুরে তাকাতে সে একটা সিংহের থাবা বাড়িয়ে ধরল তার দিকে। থাবার নখে একটা গ্লাস আটকানো।

“এ হল শেবগ।” কুর্দিশ তার কানে কানে বলে দিল, “এটাও খেয়ে দেখ খানিক। ভালো আর মন্দ তো দুই ভাই।”

“বেশ বেশ। ভালোমন্দ দুইই চেখে দেখি তবে।” বলে হাসতে হাসতে ইয়েগর গ্লাসটা তুলে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে সেটা শেষ করে দিয়ে পাশে এগিয়ে আসা একটা হাতে সেটা ধরিয়ে দিল। অধিদেবতা আর অপদেবতাদের দলটা ফের তার হাতের ডানা ধরে টেনেটুনে নিয়ে রওনা হল, আর তারপর হঠাৎ হাসির হররা তুলে তাকে কারো একটা চওড়া পিঠের ওপর বসিয়ে দিল।

ইয়েগর টলমল করে উঠে সিধে হয়ে বসতে গিয়ে চারপাশে হাত-টাত ঘুরিয়ে একশা। মধ্যে থেকে তার একটা হাত গিয়ে দাড়িওয়ালা একটা মুখে সপাটে একটা চড়ই কষিয়ে দিল। ততক্ষণে ভিড়ের ভেতর থেকে কেউ চেঁচিয়ে উঠেছে, “সামলে বোস ইয়েগর!”

বলতে না বলতেই যে পিঠটার ওপর ইয়েগর বসে ছিল সেটা থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। তারপর মাটিতে খুরের ধাক্কা মেরে তারা গোল হয়ে ঘুরতে শুরু করল। কয়েক পাক ঘোরবার পর সেই দাড়িওয়ালা মুখটা ফের তার দিকে ঘুরে তাকিয়ে গলা ঝাড়ল একবার। এইবার ইয়েগর খেয়াল করল, সে ওই দাড়িওয়ালার পিঠেই বসে আছে। লোকটার শরীরটা ঘোড়ার।

“তা, খানিক ঘুরে আসা যাক, নাকি হে?” ঘোড়ামানুষ বলে উঠল, “আমার নাম পোলকান।”

এই বলে ইয়েগরের জবাবের অপেক্ষা না করেই সে সামনে জ্বলতে থাকা আগুনটার মাথায় লাফ দিয়ে উঠল। গরমের একটা হলকা এসে ইয়েগরের শরীরটাকে ঝলসে দিয়ে গেল যেন। প্রাণপণে পোলকানের পিঠটা জড়িয়ে ধরে উপুড় হয়ে পড়ল সে। তার সঙ্গে সেঁটে থাকা কুর্দিশও নরম দুটো থাবা দিয়ে ইয়েগরের গলাটা জড়িয়ে ধরল। তারপর কানের কাছে গরগর করে জিজ্ঞাসা করল, “কেমন? মজা না?”

ফার্নের নীল মধু ততক্ষণে ইয়েগরের মাথায় চড়ে বসেছে। একটু একটু ঘুরছিল মাথাটা তার। তাকে পিঠে নিয়ে পিেলকান তখন মাঠে জড়ো হওয়া হাজারো অতিথির মধ্যে দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। ছোটার মধ্যেই আগুনের আলোয় উদ্ভাসিত অ-মানুষী মুখগুলো ধরা দিচ্ছিল ইয়েগরের চোখে। তাইগার বিস্তীর্ণ এলাকার অসংখ্য আশ্রয় থেকে পায়ে, বুকে, ডানায় ভর করে এইখানে এসে হাজির হয়েছে তারা। কিন্তু এই মুহূর্তে আর তাদের কুৎসিত লাগছিল না ইয়েগরের চোখে। যেন তার ভালো আর মন্দের সংজ্ঞাগুলোই

কয়েক মিনিটের মধ্যে বদলে গিয়েছে একেবারে। পাশ দিয়ে হঠাৎ বাদুড়ের মতো ডানাওয়ালা একটা সাপ মাশাকে পিঠে নিয়ে উড়ে গেল। মাশা সেই আগের মতোই আছে, অথচ যেন ঠিক আগের মতো নয়। অন্ধকার বাতাসে তার খোলা চুল উড়ছিল। খানিক মানুষ আর খানিক পরি সেই মেয়ে উড়তে উড়তে কী যে সুন্দর হাসি ছড়িয়ে দিচ্ছিল চারপাশে! ইয়েগরকে দেখে তার দিকে একবার হাত নেড়ে সে হঠাৎ অনেক উঁচুতে উড়ে গেল। ততক্ষণে তার কাঁধে জড়িয়ে থাকা জীবন্ত লোমের চাদরটি চারপাশে ছড়িয়ে থাকা মুখগুলোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে চলেছে ইয়েগরকে। “ও হল ক্রোডো। আর ওই যে, স্বয়ং ইয়ারিলো। ও হচ্ছে লেডা। মহা বজ্জাত আর যাকে বলে একেবারে। থাক গে। ওই দেখো! লাডো এসেছে। ভারি মিষ্টি, তাই না?” বলতে বলতে গলাটা ভারি আদুরে গরগরে হয়ে উঠছিল কুর্দিশের, “এই তাঁদোড়গুলো হল লাডোর ছেলেমেয়ে। লায়লা, মালিনা, ডিডো, কালিনা, আর বড়োটা… ওই যে, ওর নাম পোলেয়া। আর ওই দেখো, ওদিকে, ওই চার মাথাওয়ালাকে দেখছ? ওর নাম শ্বেতভিড। ভারি দয়ালু যোদ্ধা। আর ওই যে লোমে ঢাকা জন্তুগুলো, উফ! ওগুলো হল ভোলোটা। কাউকে ভয় দেখাবার জন্য এরা পারে না হেন কাজ নেই। সবাই এসেছে। মানে, যারা প্রাণ বাঁচাতে পেরেছে সেইরকম সবাই। মানুষের হাত থেকে লুকিয়ে বাঁচবার জন্য এই এক তাইগাই তো বাকি আছে ওদের হাতে! কিন্তু তবুও… কদ্দিন টিকবে আর বলো তো!”

“চিরকাল।” গর্জন করে বলে উঠল ইয়েগর। তারপর উত্তেজনায় পোলকানের পেটে লাথি কষিয়ে দিল একখানা। সঙ্গে সঙ্গে পোলকান উঁচু হয়ে উঠে বিরাট লাফ দিল একটা। অমনি হাত ছেড়ে গিয়ে তার পিঠ থেকে ছিটকে পড়ল ইয়েগর।

“ভয় নেই, ভয় নেই।” কানের কাছে কুর্দিশ বলে উঠল ঠিক তখনই, “তুমি তো উড়তে পারো।”

অমনি ইয়েগর খেয়াল করল, সে মোটেই নিচের দিকে আছড়ে পড়ছে না। বরং আকাশেই গোল হয়ে চক্কর কেটে চলেছে সে। মাধ্যাকর্ষণ বস্তুটাই যেন হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে তাকে ছেড়ে। তবে মাধ্যাকর্ষণ উধাও হলেও পরির দল মোটেই উধাও হয়নি। তারাও তখন দিব্যি তাকে ঘিরে উড়ছে আর সুযোগ পেলেই হেসে হেসে খানিক সুড়সুড়ি কিংবা কনুইয়ের গুতো দিয়ে যাচ্ছে তাকে।

সেই পুঁচকে ইচ্ছেধারী ইয়েগরের ঠিক মাথার ওপরে এসে উড়ছিল। হঠাৎ সে বলে, “কী হে? আমাদের মধু বস্তুটা তাহলে খারাপ কিছু নয়, বলো? সন্ধেটা কাটছে কেমন

জবাবে ইয়েগর হা হা করে হাসতে হাসতে বলে, “ভাগো হিঁয়াসে!”

তার এখন প্রাণভরে হাসতে ইচ্ছে করছে। আকাশের বুকে ডিগবাজি খেয়ে উড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। তার এখন চারদিকে ঘিরে আসা ওই না-মানুষী অপদেবতাদের জড়িয়ে ধরে

ভালোবাসতে মন চাইছে। তাদের সঙ্গে নাচবার ইচ্ছে হচ্ছে তার। চিৎকার করে গান গাইতে মন চাইছে। আগুনের জ্বলন্ত শিখার মধ্যে দিয়ে বারেবারে উড়ে যেতে চায় সে। তার ঝলসানো উত্তাপকে গায়ে মেখে নিয়ে, নীল ফুল থেকে নিংড়ে নেয়া জ্বালা ধরানো নীল নির্যাস বারংবার গলায় ঢেলে… তার ভেতরে উথলে ওঠা আনন্দের ঢেউ হঠাৎ বিচিত্র একটা চিৎকার হয়ে উঠে এল তার গলা বেয়ে, “আহা কী দারুণ রাত! কী যে অপূর্ব, অসামান্য রাত!”

আর ঠিক তখনই তার চোখে পড়ল তার পুরনো পরিচিত দিওবা-গুও, পা-দুটো বুকের কাছে গুটিয়ে আগুনের ধারে বসে আছে। তার নেকড়েরা গোল হয়ে ঘিরে বসে আছে তাকে। চোখ পিটপিট করতে করতে আপনমনেই গান গাইছিল বুড়ো। আর তার নেকড়েরা ধুয়া ধরছিল তার সঙ্গে।

সাইবেরিয়ার মাটির পুরনো দেবতাদেরও দেখা যাচ্ছিল আগুনের পাশে তাইগা ও তুন্দ্রার আত্মা তাঁরা। ছোটোখাটো চেহারা। মোটাসোটা, গোলগাল। ভালুকের চর্বি মেখে চকচকে দু’ জনের মুখ। স্লাভ ঈশ্বরদের হাতে হাত ধরে আপন খেয়ালে নেচে যাচ্ছিলেন তাঁরা। তাঁদের ঠোঁটে জীবনের গান। গানের সে জীবন মৃত্যুহীন, অক্ষয়, প্রাচুর্যে ভরা।

শুধু অনাথ দিওবা-গুও একলা একলা বসে ছিল। কারো সঙ্গে মেশবার ইচ্ছে নেই তার। কেবল তার চোখেই ধরা পড়েছে অমৃতের মৃত্যু, অক্ষয়ের ক্ষয়, প্রাচুর্যের অন্তের ইঙ্গিত। তার গানে সেই শোকের ছায়া পড়ছিল।

ওদিকে ইয়েগর তখন অজস্র ছোটোবড়ো শিং থেকে বারে বারে গলায় ঢেলে চলেছে নীল ফুলের আগুনে নির্যাস। স্ট্রাইবগ আর ডাঝবগ-এর পাত্র থেকে পান করেছে সে। তার ঠোঁটে চুমু এঁকে দিয়েছে লাডো। সুন্দরী লায়লা-মালিনার বাঁশি গান শুনিয়েছে তাকে।

হঠাৎ উড়তে উড়তেই সেই দুঃখে আনন্দে গানে ডুবে থাকা দেবতা, অপদেবতা, পরি আর দৈত্যদের দিকে তাকিয়ে সে হেঁকে উঠল, “ওহে বিবর্তনের শুকিয়ে যাওয়া ডালপালাদের দল, তোমরা মরবে না। আমি মরতে দেব না তোমাদের। বিপন্ন প্রজাতিদের তালিকায় তোমাদের নাম তুলে দেব আমি। শুনতে পাচ্ছ? বিপন্ন প্রজাতি! হা হা। তারপর আর কেউ কখনো তোমাদের ছুঁতে আসবে না। যেমনভাবে চাও, ঠিক তেমনভাবেই বেঁচে থাকো তোমরা। কিন্তু বেঁচে থাকো।”

জবাবে পরির দল হাসল। পোলকান তার খুর ঠুকল মাটিতে। পাশ দিয়ে উড়ে যেতে যেতে জলপরিরা ইয়েগরকে তাদের ঠাণ্ডা শরীর দিয়ে ছুঁয়ে আদর করে গেল। তাকে ঘিরে সেই অগুনতি অস্তিত্ব দপদপিয়ে উঠছিল বারবার। পাক খাচ্ছিল, ঢেউ তুলছিল, হঠাৎ হঠাৎ গলে মিশে গিয়ে যেন আগুনের সাগর হয়ে ঢেকে দিচ্ছিল তাকে। সেই অগ্নিসাগরের বুক থেকেই ফের তারা অসংখ্যবার অসংখ্য রূপ ধরে জন্ম নিচ্ছিল, ফের মৃত্যুর ডাকে

মিশে যাচ্ছিল সেই সাগরের বুকে, লক্ষ-কোটি কণা জুড়ে নিজেদের সৃষ্টি করে ফের ভেঙে দিচ্ছিল, মৃত্যু, পুনরুত্থান, আবির্ভাব, তিরোভাব, উত্থান, পতন…

অবশেষে একসময় মাঠটার একধারে মাটিতে নেমে এল ইয়েগর। কুর্দিশ ততক্ষণে উধাও হয়েছে তাকে ছেড়ে। কেবল মাশা দাঁড়িয়ে ছিল তার পাশে। নগ্ন, সুন্দর, পবিত্র। তার চোখদুটো ইয়েগরের দিকে তুলে ধরা। তার মুখে কোনো কথা ছিল না। ঠোঁটে হাসি ছিল না। কাছে এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল ইয়েগর। মাশা তার হাতদুটো তার কাঁধে ছড়িয়ে দিল।

ইয়েগর টের পাচ্ছিল, মাশা মিশে যাচ্ছে তার শরীরে। তার রক্ত-মাংস-মেদ-মজ্জায় দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছে মাশা। এমনভাবে মিশে যাচ্ছে যেন তার আলাদা কোনো অস্তিত্বই ছিল না কখনো।

ইয়েগর আর ভয় পাচ্ছিল না। মাশাকে সে অস্বীকার করল না। বরং আরও গভীরভাবে আঁকড়ে ধরল তার মিলিয়ে যেতে থাকা শরীরটিকে।

তারপর একসময় সে খেয়াল করল, মাশার কোনো চিহ্ন বেঁচে নেই আর। তার হাতদুটো তার নিজের শরীরকেই জড়িয়ে রয়েছে কেবল। আর তারপর, হঠাৎ সে টের পেল, আর সে একা নয়। আর সে কেবল ইয়েগর নয়। এখন সে একসঙ্গে দুটি শরীর। এখন সে একসঙ্গে দুটি আত্মা।

ভালোবাসার জনকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে যে অস্তিত্বকে লাভ করবার জন্য অন্ধভাবে হাতড়ে বেড়ায় মানুষ, অর্ধনারীশ্বরের যে যুগ্ম অস্তিত্বে পৌঁছোবার পথ সে চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলেছে, সে পথের ঠিকানা ইয়েগরকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে আজ।

কিন্তু, সে আর ইয়েগর নয়। গায়ে সেঁটে থাকা ফারের পোশাকটার হাতা ধরে, সেটা খুলে ফেলবার জন্য টান দিতে বড়ো যন্ত্রণা হল তার। যেন সে নিজের চামড়াতেই টান লাগিয়েছে। কারো দিকে নজর ছিল না তার আর। উপুড় হয়ে শুয়ে উষ্ণ, প্রাণদায়ী মাটির শরীরে মুখ ঠেকিয়ে সে তখন শেকড় ছড়িয়ে দিচ্ছিল তার বুকে। যেন এক বিশাল জ্ঞানবৃক্ষ হয়ে উঠছিল ইয়েগর। তার ডালে ডালে ফল ধরেছে। ভালোমন্দের জ্ঞানের ফল। প্রকৃতির আত্মাকে চিনে নেবার ফল।

পরদিন সকালে বৃষ্টি এল। প্রথমে ঝিরঝিরে, তারপর আস্তে আস্তে মুষলধারে বৃষ্টির ধারা নেমে এল তাইগার বুকে। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা অগুনতি গাছের পাতা ও শেকড়রা সেই জল খেয়ে পুষ্ট হল, তাদের শিরা-উপশিরায় জমাট বেঁধে থাকা ঘন রস ফের সচল হল। ধুয়েমুছে, নতুন করে গড়ে, মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে তাদের নতুন জীবন দিয়ে চলল সেই বৃষ্টি। আগের রাতে ফুটে ওঠা মধুফুলদের নীল পাপড়ির দল সেই বৃষ্টি ঘা খেয়ে তলিয়ে গেল মাটির নিচে। তারপর সব কাজ সারা হলে সেই বৃষ্টির অবিরল ধারা ঝরে পড়তে থাকল মাটিতে শুয়ে থাকা পুরুষটির শরীরে।

মাঠটার ঠিক মাঝখানে বড়ো শান্তিতে ঘুমোচ্ছিল ইয়েগর। তার চারপাশে কেউ কোথাও নেই। সুন্দরী তাইগা উপুড় হয়ে ছিল তাকে ঘিরে। তাকে নিদালি গান শোনাচ্ছিল অলস গলায়। স্বপ্ন পাঠাচ্ছিল তার ঘুমের গভীরে। বড়ো সুন্দর সেইসব স্বপ্নেরা।

সেই স্বপ্নে গাছপালা, পশুপাখি, ঘাসবন, সকলেই তার কাছে এসে নিজের নিজের ভাষায় কথা বলে যাচ্ছিল তার সঙ্গে। সেইসব কথার অর্থ বুঝতে কোনো অসুবিধে হচ্ছিল

ইয়েগরের। মানুষ ওদের যেসব আলাদা আলাদা নামে ডাকে, সেইসব নামে ডাকবারও দরকার হচ্ছিল না কোনো। কারণ সে আর ওই প্রাণেরা তো আলাদা নয়। তারা তো সকলে মিলে একটাই অস্তিত্ব! যা কিছু শ্বাস নেয়, বাড়ে, নড়ে, যা কিছু জন্মায়, মরে, ধুলো হয়ে গিয়ে ফের সৃষ্টি হয়, অ্যামিবা থেকে ঐরাবত সেই সবকিছুই তো আসলে সে-ইয়েগর! চিরজীবী, চিরতরুণ ইয়েগর! পরিবর্তিত হই, সেইটেই আমার আমিত্ব। পরিবর্তনই একমাত্র ধ্রুব। অতএব সেই অমোঘ নিয়ম মেনে ইয়েগরও বদলাচ্ছিল। কিন্তু বদলে গেলেও অরণ্য বা মানুষের জন্য ভালোবাসাটুকু বদলাচ্ছিল না তার।

.

০৭.

এর সপ্তাহ খানেক বাদে কয়েকজন ইওয়েঙ্ক দল বেঁধে নদী পার হবার সময় ইয়েগরকে দেখতে পায়। নদী-পাশে একটা ছোটো টিলার মাথায় নুড়ির তৈরি একটা খুদে ঢিবির পাশে বসে ছিল সে। বসে বসে অদৃশ্য কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলছিল।

লোকগুলো প্রথমে খানিক ঘাবড়ে গিয়েছিল তাকে দেখে। তার কথাবার্তা অসংলগ্ন। বারবার শুধু একটাই কথা বলে চলেছিল মানুষটা, সে আর কেবল একলা নয়। তাইগার সমস্ত অরণ্য, সমগ্র জীবজগত তার অংশ। ইওয়েঙ্করা তাকে ধুয়েমুছে সাফ করল। খাবার খাওয়াল। তারপর একটা বলগা হরিণের পিঠে চাপিয়ে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে এসে শহরে খবর পাঠাল।

শহর থেকে হেলিকপ্টার আসবার জন্য যখন তারা অপেক্ষা করছিল, ইয়েগর সেই সময়টা একলা একলা সেখানকার মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াত। বলগা হরিণ আর পাহারাদার কুকুরদের সঙ্গে তার যত কথাবার্তা। আর কী আশ্চর্য, ভয়ানক কুকুরগুলোর একজনও তাকে কামড়াতে আসত না।

ইওয়েঙ্ক ভেড়াওয়ালারা ইয়েগরের যত্ন-আত্তির ত্রুটি করত না। তারা ভাবত, বেচারা তাইগার বুকে পথ হারিয়ে ঘুরতে ঘুরতে পাগলই হয়ে গেছে বুঝি। তাদের সব প্রশ্নের জবাবে কেবল দুটোই উত্তর ছিল তার মুখে হ্যাঁ, আর না। তাদের কথাবার্তাগুলোকেও সে মন দিয়েই শুনত শুধু। তার হাবভাবে মনে হত মানুষে আর বলগা হরিণে বিশেষ তফাত সে করতে পারে না।

অবশেষে একদিন হেলিকপ্টার এল। ইওয়েঙ্কদের ক্যাম্প থেকে প্রথমে ইয়েগরকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হল ভূতত্ত্ববিদদের একটা ফিল্ড স্টেশনে। তারপর সেখান থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হল বড়ো শহরের হাসপাতালে। হাসপাতালের আলো-হাওয়াভরা ঘরটাতে সে ছাড়া আরও তিনজন রোগী ছিল। তার পাশের বিছানায় ছিলেন ছায়াপথের শাসক। আকাশের তারাদের মরণ-বাঁচন উপস্থিত তাঁর ইচ্ছাধীন না হলেও, সে-ঘরের প্রতিবেশীদের ঘুম হওয়া বা না হওয়াটা পুরোপুরিই তাঁর ইচ্ছাধীন ছিল। অতএব রাত হলেই ইয়েগর নিজেকে একটা গাছে বদলে নিয়ে পরদিন সকাল অবধি নিশ্চিন্তে ঘুমোত।

ডাক্তারবাবু ইয়েগরের সঙ্গে অনেক গল্পসল্প করতেন রোজ। ইয়েগরের কথাবার্তায়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের কেতা মোতাবেক কোনোরকম সন্দেহ দেখাতেন না ডাক্তারবাবু। তাঁর চেষ্টা ছিল ক্রমাগত কথা বলে বলে যদি এর পাগলামোটার শেকড়ে পৌঁছোনো যায়।

কয়েকদিন বিশ্রাম নেবার পর মনটা শান্ত হলে ইয়েগর ডাক্তারদের মতলবটা বুঝে গেল। অতএব তাঁদের সামনে আর দশটা মানুষের মতোই সাধারণ কথাবার্তা চালু করে দিল সে। কাজটা তার পক্ষে কঠিন নয়। কারণ এখন তো সে ইচ্ছে করলেই যে-কোনো প্রাণী হয়ে যেতে পারে। তাই সাধারণ মানুষ হয়ে যেতে আর কষ্ট কী?

কয়েকদিন এইরকম করে সাধারণ মানুষ হয়ে থাকবার পর ডাক্তাররা বুঝল, ইয়েগর ভালো হয়ে গেছে। নিজেদের কাজটা তারা ভালোভাবে করতে পেরেছে ভেবে খুশি হয়ে তারা ইয়েগরকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেবার কাগজপত্র তৈরি করতে বসল।

কিন্তু এরপর একদিন একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটে গেল। গ্যালাক্সির শাসক মশাই মহাকাশে একটা ব্ল্যাক হোলে তাঁর যানটাকে এনার্জি নেবার জন্য গুঁজে দিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ঠিকঠাক করে ব্ল্যাক হোলটার শক্তি বুঝতে না পারায় তার ধাক্কা খেয়ে তিনি মাঝরাতে খাট থেকে মেঝেতে আছড়ে পড়ে হাতটা ভেঙে ফেলেন।

তবে ছায়াপথের শাসক বলে কথা। সামান্য হাত ভাঙার ব্যথায় হইচই করা তাঁর সাজে না। অতএব তিনি কাউকে কিছু না বলে ফের বিছানায় উঠে বসে ভাঙা হাতটা ধরে একা একাই ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন।

ব্যাপারটা খেয়াল করে ইয়েগর আর ডাক্তারকে ডাকল না। তার বদলে বুদ্ধের ভাঙা হাতটা ধরে ভালো করে তাকিয়ে দেখল সেটার দিকে। কেমন অদ্ভুতভাবে বেঁকে আছে। হাতটা। নড়বড়ে হয়ে দুলছে। খানিক বাদে তার চামড়া আর মাংসের মধ্যে দিয়ে ইয়েগরের চোখ এগিয়ে গেল আঘাতটার গভীরে। সেখানে হাড়টা মাঝখান থেকে জটিলভাবে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আছে। ভাঙা জায়গাটাকে মোলায়েমভাবে হাতের তেলোয় চেপে ধরল সে। টের পাচ্ছিল, তার হাত থেকে কিছু একটা স্রোত বয়ে চলেছে আহত হাতটার ভেতরে।

খানিকক্ষণ সেইভাবে বসে থাকার পর বুড়োমানুষটার কাতরানির শব্দ থেমে এল। আর কোনো ব্যথা নেই তার হাতে। এইবার ইয়েগর চাপ দিয়ে দিয়ে খুব যত্ন করে ভাঙা হাড়টাকে সেট করল, তারপর অসাড় করে দেয়া জায়গাটার ওপর হাতের আঙুলগুলো চেপে ধরল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আঙুলগুলো থেকে বের হয়ে আসা আবছা আলোটা তীব্র ঔজ্জ্বল্যে ঝিকিয়ে উঠল। তারপর ছোটো ছোটো ধারালো ঝলকে চামড়ার আড়াল পেরিয়ে ছুঁয়ে যেতে লাগল তার ভেতরে থাকা ভাঙা হাড়গুলোকে। প্রায় আধঘণ্টা বাদে দেখা গেল হাতটা সম্পূর্ণ সেরে উঠেছে। বৃদ্ধ শাসক আবার হাত নাড়িয়ে চাড়িয়ে তাঁর যোদ্ধাদের হুকুম-হাকাম দিতে পারছেন।

এরপর এক বিশ্বব্যাপী হুকুমনামায় তিনি ইয়েগরকে অর্ডার অব দ্য সুপারনোভায় ভুষিত করলেন ও শ্বেত বামনদের শাসনভার তার হাতে দেবার জন্য প্রয়োজনীয় সোপর্দনামা জারি করলেন। এই সম্মান প্রদর্শনের জন্য ইয়েগর তাঁকে অনেক ধন্যবাদ জানাল এবং সেদিন থেকে সে ছায়াপথের মালিকের সেরা বন্ধু হয়ে উঠল।

জানা গেল সেনাপতিমশাইয়ের আসল নাম ভ্যাসিলি পেট্রোভিচ। বয়স পঞ্চাশের ওপরে। হাসপাতালে আসবার আগে তিনি একজন জৈব-পদার্থবিদ ছিলেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ সুস্থ বলে দাবি করতেন। সকলেই করে। নিজের দায়িত্বের বিষয়েও তিনি সম্পূর্ণ সচেতন। একদিন ইয়েগরকে ধরে বসিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিলেন, গোটা গ্যালাক্সিটাই আসলে একটা জীবন্ত প্রাণী এবং তিনি, ভ্যাসিলি পেট্রোভিচ, সেই প্রাণীটির মস্তিষ্ক। তার যাবতীয় চেতনার কেন্দ্রবিন্দু। কোটি কোটি নক্ষত্রের জন্মমৃত্যু, তাদের নিয়তির নিয়ন্তা তিনি। এই গুরুদায়িত্ব তাঁর ঘুম কেড়ে নিয়েছে, আস্তে আস্তে তার চাপই পাগল করে দিতে চলেছে তাঁকে। তিনি শান্তি চান। অথচ সিগনাস নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে যুদ্ধের শব্দ ভেসে আসছে। লক্ষ লক্ষ তারা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সেই যুদ্ধের আগুনে। তিনি ঘুমোতে চান। অথচ অগণিত গ্রহে প্রাণ সৃষ্টি হয়ে চলেছে। সেই নতুন সৃষ্ট প্রাণেরা মহাকাশ জুড়ে ভেসে বেড়ায়। তারা সময়ের ধারাকে বিকৃত করে। তারা মহাশাসকের কথা শোনে না। তাই তিনি দরকারে কঠিন সাজা দেন সেইসব সভ্যতাকে। কখনো সুপারনোভা গড়ে, কখনো একেকটা সম্পূর্ণ সভ্যতাকে ব্ল্যাক হোলের গর্ভে চালান করে, কখনো-বা তাদের নক্ষত্রকে ধুলো করে মহশূন্যে ভাসিয়ে দিয়ে। কিন্তু গ্যালাক্সিতে অগণিত তারা। অগণিত অশান্তি। কিন্তু তিনি তো কেবলমাত্র একজন মানুষ। গ্যালাক্সির শাসক তিনি। কিন্তু গোটা গ্যালাক্সিতে এমন একচিলতে জায়গাও নেই যেখানে তিনি একটু শান্তিতে ঘুমোতে পারেন।

“সবকিছু ঠিক কেমনটা হলে ভালো লাগবে বলুন তো আপনার? কী হলে আপনি শান্তি পাবেন?” ইয়েগর তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল।

জবাবে তিনি বললেন, “যদি আমি তারাদের ধুলো হতে পারতাম! না না, হাইড্রোজেনের একটা পরমাণু… সময়ের একটা কোয়ান্টাম… উঁহু, আমি সব জায়গায়, সব সময়ে… স্থানকালহীন অনস্তিত্বে… নাহ। আমি আর বাঁচতেও চাই না। আমি শুধু একটু শান্তি চাই। একটু ঘুমোতে চাই।”

সেই রাত্রে গ্যালাক্সি শাসকের ফের ঘুমের সমস্যা দেখা দিল। মাঝরাত্রে সিরিয়াস নক্ষত্রের উদ্দেশ্যে আদেশনামা পাঠানো শুরু করলেন তিনি। কাউকে তিরস্কার, কাউকে পুরস্কার বিতরণ চলল অনেকটা সময় ধরে। শেষমেশ নার্স এসে তাঁকে ঘুমের একটা কড়া ইঞ্জেকশন দিতে ভ্যাসিলি পেট্রোভিচ শান্ত হলেন।

ইয়েগর বুঝল, ক্লান্ত বৃদ্ধের একটু সাহায্য দরকার। গভীর রাত্রে তাঁর বিছানার পাশে উঠে এসে তাঁর কপালে আঙুল ছোঁয়াল সে। আস্তে আস্তে আঙুলগুলো তাঁর কপালের দু পাশে, তাঁর গালে, মুখে, ঘাড়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেল।

পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে উঠে ভ্যাসিলি পেট্রোভিচ খানিকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইলেন। তারপর একটুখানি হেসে ইয়েগরের দিকে ফিরে বললেন, “আমি কাল রিটায়ার করেছি, বুঝলে? আমার জায়গায় কাজটা যে নিয়েছে সে খুব দক্ষ লোক। আমার দায়িত্ব শেষ। এইবার আমি একজন রিটায়ার্ড বুড়ো। কিছু খেতে পেলে ভালো হয়।”

সেই দিনটা থেকেই খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে লাগলেন ভ্যাসিলি পেট্রোভিচ। কয়েকদিনের মধ্যেই ডাক্তাররা বললেন, রোগের কোনো চিহ্ন নেই আর তাঁর মনে। তারপর একই দিনে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেয়া হল ইয়েগর আর ভ্যাসিলি পেট্রোভিচকে।

চলে যাবার আগে ইয়েগরকে হাসপাতালের বড়ো ডাক্তারবাবু ডেকে পাঠালেন একবার। বিখ্যাত চিকিৎসাবিদটি ইয়েগরের কেস ফাইলটার পাতা উলটেপালটে দেখলেন খানিকক্ষণ। তারপর সেটা দুম করে বন্ধ করে দিয়ে তার ওপর আঙুলের টোকা দিতে দিতে বললেন, “ইয়েগর, তোমার এখন অসুখ নেই কোনো। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে, তাইগায় হারিয়ে যাবার আগে তুমি যেমন ছিলে এখন তার চাইতেও শরীর স্বাস্থ্য বেশি ভালো হয়ে গেছে তোমার। আমাদের চিকিৎসায় এমনটা ঘটেছে এইটে ভাবতে আমার ভালোই লাগবে, বুঝলে! কিন্তু আমি জানি সেটা ভুল। কেন জানো? কারণ এখানে ভর্তি থাকতে থাকতেই অন্তত বার দুয়েক তুমি এমন দুটো কাজ করে দেখিয়েছ। যেগুলো করা মানুষের চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাধ্যে নেই এখনো। আমি ভ্যাসিলি পেট্রোভিচের কথা বলছি। দু-দু’ বার তুমি তার চিকিৎসা করেছ। আমি সব জানি। কিন্তু প্রশ্ন। হল, কী করে? কোন পদ্ধতিতে?”

“জানি না।” ইয়েগর মাথা নাড়ল, “পারি যে এইটুকু জানি কেবল। আরও অনেক কিছুই পারি। কিন্তু কেমন করে পারি তা আমার বুদ্ধির বাইরে।”

“হুম। আচ্ছা ইয়েগর, বায়ো এনার্জেটিকস বলে কোনো বিষয়ে কখনো কোথাও পড়েছ?”

“পড়েছিলাম বোধ হয় একবার। অনেকদিন আগে। এখন আর সেসব মনে-টনে নেই। শুধু একটাই কথা আমি জানি। এ গ্রহের যাবতীয় প্রাণ একটাই চেতনার সঙ্গে জোড়া।”

“বায়োফিল্ড! এ বিষয়ে অনেক চালু তত্ত্ব আছে ইয়েগর। আচ্ছা, তুমি তোমার শক্তির দু-একটা নমুনা আমায় দেখাবে একটু? ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। যা-ই করো না কেন তুমি, তোমার ফিট সার্টিফিকেটখানা বাতিল হবে না।”

ইয়েগর মাথা নাড়ল। তারপর নিজেকে হাজারো জাতের পাখির একটা বিরাট দলে বদলে নিয়ে সারাটা ঘর জুড়ে উড়ে বেড়ালো খানিকক্ষণ। পাখিরা ঘরের জানালায়, দেয়ালে, ঘুলঘুলিতে বসে যার যার ভাষায় গান শোনাল।

সেদিকে তাকিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বড়ো ডাক্তার বললেন, “ইন্টারেস্টিং। দারুণ ইন্টারেস্টিং। তা, এখান থেকে বেরিয়ে তুমি কী করবে বলে ঠিক করেছ ইয়েগর? উপস্থিত গান-টানগুলো থামাও। নইলে গোটা হাসপাতাল এসে, কী হচ্ছে দেখবার জন্য আমার দরজায় লাইন দেবে।”

জবাবে পাখিদের একটা দল মানুষের গলায় বলে উঠল, “ঠিক করেছি খুব আনন্দ করে বেঁচে থাকব। আর সেই সঙ্গে আমাদের সমস্ত উপদেবতা, অপদেবতাদের বাঁচাবার জন্য লড়ে যাব।”

“আমি তোমায় বিশ্বাস করি।” বলতে বলতেই মাথা নাড়লেন বড়ো ডাক্তার, “না না। মন রাখা ভদ্রতা করছি না। সত্যিই তোমায় বিশ্বাস করতে চাই আমি। কিন্তু যা বলছ, যা করছ, তার কিছু বুঝতে পারছি না যে। মনে হচ্ছে আসলে আমিই পাগল নই তো? কোথায় শিখলে তুমি এসব?”

“সহজ।” বলতে বলতেই সমস্ত পাখিগুলো জুড়ে গিয়ে আস্তে আস্তে একটা ইয়েগর হয়ে যাচ্ছিল, “আমি শরীরের সীমাকে পেরিয়ে যাবার কৌশল জেনেছি। আর আমি একা নই।”

“আমায় তুমি শেখাবে?” বড়ো ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, “খুব কি কঠিন?”

“শুধু আপনাকে নয়। সবাইকে শেখাব আমি। না সহজ নয়। বড় কঠিন। কিন্তু শেখাটা সম্ভব। এবার আমি যাই?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়। যখন খুশি। আমি তোমায় আটকাব না। কিন্তু একটা প্রশ্ন। এখান থেকে তো তুমি যখন খুশি চলে যেতেই পারতে। তাহলে কেন…”

“ওভাবে যদি চলে যেতাম, তবে তারপর কী হত আমার?” ইয়েগর হাসল, “এই যে এখন এইভাবে এখান থেকে বের হচ্ছি, এখন আমার হাতে আপনার সই করা কাগজ আছে একখানা। তাতে লেখা আছে আমি একেবারে সুস্থ। লেখা আছে আমি শহরের অন্য লোকজনের সঙ্গে থাকতে পারি। কাজও পেতে পারি।”

“হ্যাঁ, তা বটে। তবে কাগজ-টাগজ যা-ই হতে নাও না কেন, বাইরে বেরিয়ে লড়াইটা তোমার খুব একটা সহজ হবে না কিন্তু।”

“জানি তো!” বড়ো ডাক্তারের ঘর থেকে বেরিয়ে ভ্যাসিলি পেট্রোভিচকে সঙ্গে করে ইয়েগর হাসপাতালের দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। প্রাক্তন গ্যালাক্সি শাসক আসলে দুনিয়ায় একেবারে একা। হাসপাতালে থাকাকালিন তাঁর স্ত্রী মারা গিয়েছেন। ছেলেমেয়েরা দূরদূরান্তে ছড়িয়ে আছে। ইয়েগর কাজেই তাঁকে নিজের কাছেই এনে তুলল।

ফের নিজের পুরনো কাজে ফিরে গেল ইয়েগর। ভ্যাসিলি পেট্রোভিচের একটা পেনশনের বন্দোবস্ত হয়েছিল। সারাটা দিন একা একাই তিনি তাদের অ্যাপার্টমেন্টটাতে কাটাতেন। নানা উদ্ভট যন্ত্রপাতির মডেল তৈরি করবার নেশায় পেয়েছিল তাঁকে। প্রায় দিনই সন্ধেবেলা দুই বন্ধু মিলে বেজায় তর্কবিতর্ক চলত। কিন্তু তাতে কেউ কাউকে হারাতে পারত না।

“আরে ধুস! পৃথিবীর প্রকৃতির সঙ্গে এক হয়ে যাওয়াটা আবার কী? যতসব বাজে কথা।” ভ্যাসিলি বলে চলতেন, “ও তো মানুষের বিবর্তনের একটা গোড়ার ধাপ হবে কেবল। ওই ধাপটা পেরিয়ে তারপর একদিন মানুষ গোটা ব্রহ্মাণ্ডের চেতনার সঙ্গে এক হয়ে যাবে। এইসব মহাকাশযান-টান দিয়ে কিস্যু হবে না, বুঝলে? আদিম জিনিস সব। এসব টিনের কৌটো ছেড়ে সরাসরি মহাকাশ বেয়ে চলাফেরাটা রপ্ত করে ফেলতে হবে আমাদের।

“যে-কোনো প্রাণীর রূপ ধরতে পারো তুমি, এই বলছ তো? ব্রহ্মাণ্ডের আত্মার সঙ্গে এক হয়ে গেলে পরে মানুষ দেখবে আলো, হাওয়া, মাধ্যাকর্ষণক্ষেত্র এইসব কিছুর চেহারাও ধরতে পারবে। বায়োফিল্ড খুব ভালো জিনিস। কিন্তু আদতে সে হল গিয়ে ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে ছেয়ে থাকা একক যে শক্তি, তারই একটা অংশ।

“তুমি বলছ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে তার মাথায় চেপে বসে কাজটা আমরা ভালো করিনি, তাই তো? আমি বলব, গোটা গোটা ব্রহ্মাণ্ডটার সঙ্গে লড়াই করে তাকে জয় করবার চেষ্টা করাটা তার চাইতে আরও খারাপ। প্রকৃতিকে তো মানুষ জয় করেই ফেলেছে। কিন্তু তার ফলটা কী হয়েছে, সে তো হাতেনাতেই টের পাচ্ছি আমরা। তাহলেই ভাবো!

এইভাবে দিনের পর দিন ভ্যাসিলি পেট্রোভিচ তাঁর যুক্তি সাজাতেন। ইয়েগর তাঁর সঙ্গে বেজায় তর্ক করত। নানান যুক্তি দিত। তারপর যুক্তিতে এঁটে উঠতে না পারলে হঠাৎ একটা ভালুক হয়ে গিয়ে তাঁর মুখে থাবা চাপা দিয়ে ধরত।

মুখ চাপা ভাসিলি প্রাণপণে চিৎকার করবার চেষ্টা করতেন, “মুখ বন্ধ করে দেবার এটা কোনো যুক্তি হল নাকি? আমি কিন্তু এবার নিজেকে নিউট্রন স্রোতে বদলে নিয়ে তোমায় মজা দেখিয়ে ছাড়ব, এই বলে দিলাম।”

একদিন হাসপাতালের বড়ো ডাক্তারবাবু ঠিকানা খুঁজে খুঁজে ইয়েগরদের অ্যাপার্টমেন্টে এসে হাজির। সেখানে এসে ইয়গরের ফ্ল্যাটে ভ্যাসিলি পেট্রোভিচকে দেখে তিনি খানিক অবাক। খানিক কথাবার্তার পর তিনি ইয়েগরকে বললেন, “আমায় যে তুমি কিছু কিছু বিদ্যে শেখাবে বলেছিলে!”

“কেন শিখতে চান?”

“আমি একজন ডাক্তার। আমি মানুষের অসুখ সারাতে চাই। কিন্তু তবুও অনেক সময় সারাতে পারি না ইয়েগর। আমার কষ্ট হয়। কী মনে হয় জানো, কোনো অসুস্থকে বাঁচিয়ে তোলবার ক্ষমতা থাকলেও তুমি সেটা কাজে লাগাবে না, এটা অমানবিক। আমাকে শেখাও ইয়েগর। তাহলে দেবদেবতাদের বাঁচাবার যুদ্ধে আমিও তোমার পাশে দাঁড়াব। আমার বয়েস কম ইয়েগর। আমি ভালো সৈনিক হতে পারব।”

“বেশ।” মাথা নাড়ল ইয়েগর, “শেখাব আপনাকে।” এরপর থেকে প্রত্যেকদিন সন্ধেবেলা বড়ো ডাক্তার তার কাছে আসা শুরু করলেন। ভ্যাসিলি পেট্রোভিচের অজস্র টিটকিরি বিনা প্রতিবাদে সহ্য করতেন তিনি এবং সেইসব সহ্য করতে করতেই মেডিক্যাল কলেজ বা অন্য কোনো স্কুল যে বিদ্যে তাঁকে শেখায়নি তার পাঠ নিচ্ছিলেন তিনি ইয়েগরের কাছে। বড়ো ডাক্তারের পড়াশোনা অনেক। বিশ্বাস করবার ক্ষমতাও অসীম। কখনো-বা ইয়েগরের শিক্ষায় ফিলিপিনো আদিবাসীদের বিনা অস্ত্রে টিউমার সারাই করবার গুজবের প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন ভেবে খুশিয়াল হয়ে উঠতেন। কখনো চেতনাকে চতুর্থ মাত্রায় তুলে নিয়ে গিয়ে দেহকে জানবার তত্ত্ব বানিয়ে তাই নিয়ে তর্ক জুড়তেন। এই শেষের তত্ত্বটা শুনে ভ্যাসিলি পেট্রোভিচ হাসতে হাসতে গড়িয়েই পড়েছিলেন প্রায়।

সেদিন যত টিটকিরি খেয়েছিলেন বড়ো ডাক্তার তেমনটা তিনি আর কখনো খাননি। আর সেই করতে করতেই অবশেষে একদিন ডাক্তার টের পেলেন, রহস্যটা তিনি বুঝতে পারছেন। কেমন করে যে পারছেন তা তিনি জানেন না। শুধু এইটুকুই টের পারছিলেন, চেতনার গভীরে একটা দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। এই দেয়ালটাই তাঁকে শুধু মানুষের সীমাবদ্ধ খাঁচায় বন্দি করে রেখেছে। বন্দিশালার এই দেয়ালটা পেরোতে পারলে একমাত্র

তবেই মানুষের গণ্ডি ছাড়িয়ে তিনি আরও উন্নত, আরও বিস্তৃত কোনো অস্তিত্বের নাগাল পাবেন।

সে-বছর বসন্তের শেষের দিকে ইয়েগর ফের শহর ছেড়ে রওনা দিল। টুকিটাকি কয়েকটা কেনাকাটা সেরে সে সোজা রওনা হয়ে গেল তাইগার গভীরে। ভ্যাসিলি পেট্রোভিচ তাদের শহরে অ্যাপার্টমেন্টে বসে তাঁর বিচিত্র যন্ত্রপাতিদের মডেল গড়ে চললেন। সেসব যন্ত্রের নীল লেন্সদের মহাকাশের হাজারো তারার দিকে তাক করে তাতে চোখ রেখে তিনি সবার আড়ালে নিজের গ্যালাক্সি শাসকের দিনগুলোর কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। বড় ডাক্তার ওদিকে ইয়েগরের শিখিয়ে যাওয়া কায়দাগুলো ক্রমাগত অভ্যেস করে চলেছেন। ধীরে ধীরে চেতনার গভীরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই দেয়ালটাকে পেরোবার কৌশল তাঁর দখলে আসছিল। ধীরে ধীরে দুরারোগ্য অসুখগুলোকেও অবলীলায় সারিয়ে তুলছিলেন তিনি। রুখে দিচ্ছিলেন অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকেও।

কিছুদিন পরে ইয়েগর যখন ফিরে এল, দেখা গেল সে একলা আসেনি। তার সঙ্গে একজন দাড়িওয়ালা অতিথিও ছিলেন। মানুষটার একটা অদ্ভুত অভ্যাস ছিল, দুটো চোখ তিনি একসঙ্গে অনবরত পিটপিট করতেন। ইয়েগর আর এই নতুন লোকটা শহরে ফিরেই একসঙ্গে বেশ কয়েকদিনের জন্য উধাও হয়ে গিয়েছিল। তারপর অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসবার পর থেকে দু’ জনে মিলে কোনো দুর্বোধ্য ব্যাপার নিয়ে সারাদিন ঝগড়াঝাঁটি চালাত। মাঝেমধ্যে ঝগড়াটা হাতাহাতিতে বদলে গেলে ভ্যাসিলি পেট্রোভিচ উঠে এসে তাদের টেনে আলাদা করে দিতেন আর ভয় দেখাতেন, সদ্য বানানো মেসন কামান দিয়ে দুটোকেই নাকি খতম করে দেবেন একেবারে।

পরের হেমন্ত অবধিও বাঁচলেন না ভ্যাসিলি পেট্রোভিচ। মৃত্যুশয্যায় তিনি ইয়েগরকে বললেন, “আমার শরীরটাকে মহাকাশে সমাধি দিতে পারবে তুমি? সেখানে আমি আস্তে আস্তে সূর্যের টানে তার দিকে এগিয়ে যাব, তারপর একদিন তার বুকে আছড়ে পড়ে এক ঝাঁক ফোটনে বদলে গিয়ে ছড়িয়ে যাব ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে। সময় আমায় আর ছুঁতে পারবে না। সারা ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে বেঁচে থাকব আমি। চিরকাল।”

ওদিকে ডাক্তার তাঁর কথা রেখেছিলেন। এদেশের সমস্ত লৌকিক দেবতা, অধিদেবতা, অপদেবতা, পরি, দানব, পিশাচদের সংরক্ষিত জীবদের তালিকায় জায়গা দেবার জন্য অনেক আবেদন নিবেদন পাঠালেন তিনি সব জায়গায়। কেউ তাঁর কথা শুনল না। তারপর এদের নিয়ে অনেক প্রবন্ধ লিখলেন তিনি। কোনো পত্রিকা তাদের ছাপাল না। আর এই সবকিছু করতে করতেই তিনি বুকে একটা বিশ্বাসকে বড়ো যত্নে জ্বালিয়ে রেখে চললেন–একদিন মানুষ আর তাঁর জন্মভূমি এই ভঙ্গুর গ্রহটার মধ্যে যুদ্ধের শেষ হবে।

একদিন তারা একে অন্যের বন্ধু হবে। একদিন…