‘ন মানুষাচ্ছেষ্ঠতরং হি কিঞ্চিৎ’
মৌলবাদ শব্দটি বাংলায় নতুন, অভিধানে নেই। শর্টার অক্সফোর্ড অভিধানের মতে, ‘ঐতিহ্যবাহিত প্রচলিত শাস্ত্রমত সম্পর্কে দৃঢ় আনুগত্য।’ ‘হিন্দু’ শব্দটা ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক অর্থে প্রথম প্রয়োগ হয় চতুর্দশ শতকে বিজয়নগরের একটি শিলালেখে। আগে চলত ‘ব্রাহ্মণ্য’, তার আগে ‘বৈদিক’। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত কালে ইন্দো-ইরানীয়রা বারেবারে ভারতবর্ষে এসেছে; এদেরই শেষ দলটা সম্ভবত বেদ এনেছিল। কিন্তু তার আগে? প্রাগার্য সিন্ধু সভ্যতারও ধর্ম ছিল দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক জাতের ধর্ম যার লিখিত সাহিত্য ছিল না বলে যার বিষয়ে কোনও তথ্য আমাদের কাছে পৌঁছয়নি। সেই ‘মূল’ ভারতীয় ধর্মবিশ্বাসটি কিন্তু তথাকথিত মৌলবাদ না। যাযাবর, পশুচারী আর্যরা এসে এ দেশে বসবাস করল, কৃষিজীবী হতে শিখল, পাকা বাড়ি তৈরি করতে শিখল। তাদের ধর্ম কিছু তারা বাইরে থাকবার সময়েই নির্মাণ করেছিল, কিছু বা এ দেশের মাটিতে তৈরি করল, এ দুইয়ে মিলে হল বৈদিক ধর্ম। আমাদের জানা প্রাচীন ভারতীয় ধর্মের মধ্যে বৈদিক ধর্ম আজ ভারতবর্ষে প্রচলিত নয়। যজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ও আনুষঙ্গিক জাতিভেদের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিল বেদবিরোধী বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক প্রভৃতি কিছু মত। পশুহত্যা নিবারণের অর্থনৈতিক কারণও ছিল। হালের বলদে টান পড়েছিল যজ্ঞে বহুসংখ্যক পশু হত্যার ফলে, এরই এক প্রকাশ হল এই সব বেদবিরোধী ধর্মের অহিংসার ওপরে এত ঝোঁক। এই মতও মৌলবাদ হতে পারল না। কারণ, এ মতগুলির সমর্থকরা বরাবরই কতকটা পরস্পরবিরোধী এবং সংখ্যালঘু এবং এগুলির পরমায়ুও খুব কম ছিল। এ সব মতে যজ্ঞনির্ভর, বর্ণভেদ-নির্ভর যজ্ঞীয় ধর্মের মূলে কুঠারাঘাত করা হল, এবং সম্ভবত প্রাগার্য ধর্মানুষ্ঠান যা এতকাল বিজয়ী ইন্দো-ইরানিদের ধর্মমতের নীচে চাপা ছিল, কিন্তু মিশ্র বিবাহের ফলে অন্তঃসলিলা হয়ে জনজীবনে বর্তমান ছিল, সেগুলি এ বার মাথা তুলল। কিছুকাল যজ্ঞ এবং পূজা পাশাপাশি চলল; কিন্তু সম্ভবত গুপ্তযুগের কিছু আগে নতুন ভাবে গঠিত হল এক উপাসনাপদ্ধতি। এর নাম পূজা, এতে মন্দির আছে, বিগ্রহ আছে, নৈবেদ্য নিরামিষ-প্রধান, আমিষ নৈবেদ্য ব্যতিক্রম। তা ছাড়া আছে ব্রত, তীর্থ, দান, দেবে ও দ্বিজে ভক্তি, মানত, প্রায়শ্চিত্ত, ধ্যান নামজপ ইত্যাদি। এর শাস্ত্র হল ‘পুরাণ’, ‘ধর্মশাস্ত্র’ এবং ‘নিবন্ধ’ গ্রন্থগুলি। এই ধর্মই এখনও চলছে এবং ইচ্ছে করলে এর বিশ্বাসের কাঠামোকে হয়তো মৌলবাদ বলা চলত; হিন্দু মৌলবাদ। কী সেই বিশ্বাস?
হিন্দুর দেবতা বেদের দেবতা নয়, কারা সেই দেবতা? পুরাণে বৈদিক দেবমণ্ডলীর অধিকাংশই পরিত্যক্ত হয়ে নতুন যে সব দেবতার উদয় হল, তাদের অধিকাংশই আনকোরা। শিব (বেদের রুদ্র নয়), বিষ্ণু, নারায়ণ এবং তার দশটি বা চোদ্দোটি অবতার, কালী, লক্ষ্মী, দুর্গা, গঙ্গা। এদেরই সঙ্গে আছে বাঘাইচণ্ডী, ওলাইচণ্ডী, মনসা, ইতু, শীতলা, ঘেঁটু— এরা হিন্দুর দেবতা নয়? সে দিন রামকৃষ্ণ এসে উঠলেন এই সার্বজনীন দেবশালায়, আবার সিনেমা থেকে সোজা উঠে এল ‘সন্তোষী মা’। এবং নিত্য নতুন ‘মা’ ও ‘বাবার’ আবির্ভাব হচ্ছে, বর্ষাকালের ব্যাঙের ছাতার মতো। কাকে ফেলে কাকে রাখি। সবারই ভক্ত আছে, পাঁচালি আছে, মাহাত্ম্য আছে, পূজা, ব্রত, মানসিক, নৈবেদ্য সবই আছে। এর সঙ্গে আছে নানা জন্তুও— মা ভগবতীর গাভী, শিবের ষাঁড়, রামভক্ত হনুমান, নাগমাতা। আরও আছে জড়পদার্থ, শিবলিঙ্গ, শালগ্রাম শিলা ও বীরলিঙ্গ শিব। এবং সব ক’টিই শাস্ত্রপুত। এই বৃহৎ শাস্ত্রসম্ভারে এমন কিছু নেই যা দিয়ে সমস্ত হিন্দুজাতির জন্য একটি বোধ ও বিশ্বাসের কাঠামো গড়া যায়। এর একটা কারণ, অর্ধেক দেবতাই আঞ্চলিক। ভিন্ন অঞ্চলের লোকেরা তাদের নামও শোনেনি।
তা হলে কীসে হিন্দুর হিন্দুত্ব? এত অগণ্য পরস্পরবিরোধী শাস্ত্র দিয়ে কি কোনও সুনির্দিষ্ট ধর্মমত গঠন করা যায়, যার রূপ হবে মৌলবাদ? শাস্ত্রগুলির অধিকাংশই হয় পরস্পর বিরোধী, নয় পরস্পর নিরপেক্ষ।
অতএব প্রশ্ন ওঠে, হিন্দু কী বিশ্বাস করে? বিভিন্ন দেবতাকেন্দ্রিক সম্প্রদায়ের মানুষের বিশ্বাস হল, তার বিশিষ্ট আরাধ্য দেবতাটিই তাকে ঐহিক সুখ, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা, পরলোকে স্বর্গ বা পরজন্মে সৎকুলে, সুস্থদেহী পুরুষরূপে জন্ম এবং অন্তিম কামনা, মোক্ষ দিতে পারেন। কিন্তু এ বিশ্বাস তো বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিভিন্ন দেবতাভিত্তিক, কাজেই একটি কেন্দ্রীয় ধর্মগ্রন্থের বা মতগত সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। তা হলে সম্প্রদায়ের বাইরে হিন্দু হিসেবে হিন্দু কী বিশ্বাস করে? এই বিশ্বাস-সৌধটি যে চারটি স্তম্ভের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে তা হল আত্মা, পরলোক, কর্মবাদ ও জন্মান্তর। এবং এর একটিও প্রমাণসাপেক্ষ নয়, পুরোপুরি অনুমান-নির্ভর। আত্মা ও পরলোক যে কোনও ধর্মেরই মৌলিক উপাদান। জন্মান্তর ও কর্মবাদ পরস্পর-সম্পৃক্ত দু’টি মত। জন্মান্তরের দেখা পাই খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকে ব্রাহ্মণ সাহিত্যে, কর্মবাদ দেখা দেয় বৌদ্ধ জাতক ও রামায়ণ-মহাভারতে; প্রায় একই সময়ে এগুলি রচনার শুরু; খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম-চতুর্থ শতকে।
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ শতকে অহিংসার ধর্ম প্রবর্তনের সময়টা ছিল কৃষিতে উন্নতি, বৈদেশিক বাণিজ্যে সমৃদ্ধির স্ফীতি। শিল্পপণ্য ও কৃষিপণ্য দরিদ্র শ্রমিকদের দিয়ে উৎপন্ন করিয়ে আন্তর্দেশিক ও বহির্বাণিজ্যে রপ্তানি করে বেশ ফুলে ফেঁপে ওঠে মুষ্টিমেয় একটি শ্রেণি, যার মধ্যে বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ ও বিত্তবান অন্যান্যরাও ছিল। দেশে আর্থিক বৈষম্য এক দৃষ্টিকটু চেহারায় দেখা দিল। স্বভাবতই সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্ধন, নিরন্ন, অশিক্ষিত, স্বাস্থ্যহীন, রোগশোকে প্রতিকারহীন, ঋণগ্রস্ত ও পরিশোধে অসমর্থ। এরা নির্যাতিত হতে লাগল রাষ্ট্রিক ক্ষমতায় আসীন শক্তিমানদের হাতে। এরা দু’টি শ্রেণির। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকের জৈন গ্রন্থ ‘অঙ্গবিজ্জা’ বলেছে, সমাজে বর্ণ চারটি হলেও আসলে দু’টিই; অজ্জ বন্ন ও পেসস বন্ন বা মিল, অর্থাৎ বিত্তবান উচ্চবর্ণের পুরুষ, (অজ্জ) যে দাসদের প্রভু, সেই আর্য, আর পেসস হল বিত্তহীন, নিরন্তর প্রভুর সেবায় ক্লিষ্ট, সর্বতো ভাবে জর্জরিত, বাকি বর্ণের দাস। পেসস বা প্রেষ্য মানেই ভৃত্য, ‘মিলক্খু’, ম্লেচ্ছ হয়তো বিদেশি দরিদ্র কর্মকর। বঞ্চিতরা ভোগীদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার দিকে তাকিয়ে ভেবেই পায় না কোন দোষে তাদের, সংখ্যাগরিষ্ঠদের এই দুর্দশা। তখন তাদের বোঝানো হয় যে, পূর্বজন্মের গুরুতর সব পাপের ফলে এ জন্মের এ দুর্গতি। এ জন্ম উচ্চ ত্রিবর্ণের সর্বতো ভাবে দাসত্ব এবং সেবা করলে তাদের পরজন্মে ভাল, ধনী, উচ্চবর্ণের বংশে পুরুষরূপে জন্ম হবে। এখন, গত জন্মটাও অনুমানের ব্যাপার আগামী জন্মও শুধুমার কল্পনায় আছে। অর্থাৎ, কার্য বা কারণ কোনওটারই প্রমাণ নেই। কিন্তু এ সব শাস্ত্রনির্দেশ ও পুরোহিত বচনের ফলটা খুবই স্পষ্ট; সমস্ত বিদ্রোহী মনোভাব আতঙ্কে রুদ্ধ হয়ে যায়, প্রতিবাদও হয় না। হিন্দুধর্মের এ দু’টি মূল স্তম্ভের উদ্ভাবন হয় আড়াই হাজারেও বেশি বছর আগে; এ দু’টি তত্ত্ব— জন্মান্তর ও কর্মবাদ, পৃথিবীর কুটিলতম ও নিষ্ঠুরতম উদ্ভাবন। এর দ্বারাই নির্ধনের ওপরে ধনীর, তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষের ওপর উচ্চবর্ণের, এবং দুর্বলের ওপরে প্রবলের অত্যাচার কায়েম হয়ে রয়েছে। জন্মান্তর-কর্মবাদের প্রথম ‘প্রতিজ্ঞা’ হল বিত্তবান উচ্চকুলস্থ পুরুষই সমাজের নিয়ন্তা। এই গভীর জটিল কুচক্রের ভিত্তিতে যে-হিন্দুধর্ম বিধৃত হয়ে আছে তার কোনও একটি শাস্ত্র নেই, আছে অসংখ্য শাস্ত্র, দেড় হাজার বছরেরও বেশি দিন ধরে যার রচনা, রটনা এবং কুফল সমাজে প্রত্যক্ষ দেখা যায়। এইখানেই হিন্দুধর্মের অমানবিকতার উৎস। নিশ্চয়ই কিছু মানুষ আগেই ছিলেন, এখনও আছেন, পরেও থাকবেন, যাঁরা সত্যই কোনও ঈশ্বর বা দেবতাকে বিশ্বাস করেন। কিন্তু তাঁর অমায়িক, পরমতসহিষ্ণু, অহিন্দুকে তাঁরা অমানুষ মনে করেন না। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক পর্যন্ত কালে গ্রিক আক্রমণ থেকে যবন, শক, পহ্লব, কুষাণ, দরদ, মুরুণ্ড, হুন নানা জাতি তাদের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে এসে আর্যাবর্তের জনজীবনে সম্পূর্ণ মিশে গিয়ে একটি সংমিশ্র, সমৃদ্ধ সভ্যতার সৃষ্টি করল। তাদের কোনও স্বতন্ত্র চিহ্নই আজ এ দেশের জনজীবনে খুঁজে পাওয়া যায় না। তখনও ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম আগন্তুককে আপন করতে পারত, তাই মানুষের সঙ্গে সহজে মিলতে পারত মানুষ সেই মনোভাবকে কেন আজ বর্জন করবে এ দেশের মানুষ? কেন বলবে না মুসলমান আমার ভিন্নধর্মাবলম্বী ভাই? না হলে এত বিদ্বেষের বিষ জাতীয় জীবনকে জর্জরিত করবে না? হিন্দু মৌলবাদের নামে তাই আমরা নিষ্প্রতিবাদে সহ্য করব আজ? বিপদ এখানেই যে, হিন্দু ভারতবর্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সংখ্যালঘুকে সর্বতো ভাবে আশ্রয় দেবার নৈতিক দায়িত্ব তারই। মৌলবাদী মনোভাব তাকে শুধু যে এ দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত করে তা-ই নয়, সংখ্যালঘুর প্রতি অত্যাচার করা তার পক্ষে অনেক সহজ বলেই সমস্ত জাতীয় জীবনে সে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দিতে পারে। এ বিষের চিকিৎসা নেই। কাজেই এই সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করা আশু প্রয়োজন। নির্লিপ্ত জনসাধারণ, যারা প্রত্যক্ষ সাম্প্রদায়িক নয়, প্রকাশ্যে স্পষ্ট ভাবে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রকাশ ও প্রচার করা তাদের আজ আবশ্যিক নৈতিক কর্তব্য। ঔদাস্য এখানে মারাত্মক, কার্যত, সাম্প্রদায়িকতারই নামান্তর।
মৌলবাদী ধর্ম যে চেহারাই নিক না কেন, বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ, বজরঙ দল, শিবসেনা, আমরা বাঙালি, সন্তান দল বা জামাত-এ-ইসলামি, ইসলামিক সেবক সঙ্ঘ, আকালি বা ভিদ্রনওয়ালে, সবাই নিজের নিজের ভাবে ক্ষমতার লোভে লোলজিহ্ব এবং সে ক্ষমতায় আসবার জন্য প্রয়োজন হলেই নখদন্ত প্রকাশ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। তারা যদি ঈশ্বরকে বিশ্বপিতা বলে বিশ্বাস করত, তা হলে মানুষ মাত্রকেই ভাই বলে মনে করত। স্পষ্টতই তা তারা করে না, দলের বা দলের কাছাকাছি সাম্প্রদায়িক মানুষকেই শুধু ভাই মনে করে এবং বিশ্বপিতার অন্য সন্তান যদি অন্য প্রত্যয় আশ্রয় করে জীবনধারণ করে, তা হলে তাকে হত্যা করতে, তার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতে মুহূর্তমাত্র ইতস্তত করে না। এই হল মৌলবাদের রূপ, সৌভ্রাত্র সংহতি, মৈত্রী, বিশ্বমানবিকতা আছে এর সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে।
শুধু আমার মত ও পথই সত্য, বাকিরা সব ভ্রান্ত ‘বিপথগামী’ এই বিশ্বাসই মৌলবাদ। কিন্তু অন্য রকম অনেক কথাই তো আমাদের শাস্ত্রে আছে, তাতে মৌলবাদীদের অসুবিধে, তাই সেগুলোর উল্লেখ করা হয় না। হিন্দুধর্মে এবং জনমানসে উৎকীর্ণ বহু পরমতসহিষ্ণু কথাই আছে, সে সবকে ভুলে গিয়ে উপেক্ষা করতে পারলে আজ সুবিধে হয়। বেদান্ত দর্শনেও শংকরাচার্যের ভাষ্যে মাঝে মাঝেই দেখি, সর্বজীবে ব্রহ্ম, অর্থাৎ কুকুর, বেড়াল, ছুঁচো, প্যাচাতেও ব্রহ্ম আছে। এই উদার ব্রহ্মদৃষ্টি তবে কেন ঠেকে যায় মুসলমানে ডোমে-চণ্ডালে? এ কেমন ব্রহ্মদৃষ্টি যাতে ব্রহ্মের আধারভূত মানুষকে অশুচি এবং শত্রু জ্ঞান করা যায়? আমরা বলি, ‘সর্বজীবে শিব’, বলুন না এ কথাটা শিবসেনাকে? তার শিবদৃষ্টি কেন মুসলমান খ্রিস্টানে এসে ঠেকে যায়? মহাভারতের শান্তিপর্বে শুনি শরশয্যায় শায়িত ভীষ্ম ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, ‘গুহ্যং ব্রহ্ম যদিদং তে ব্রবীমি, ন মানুষ্যচ্ছ্রেষ্ঠতরং হি কিঞ্চিৎ।’ ‘একটি গোপন তত্ত্ব তোমাকে বলি, (যুধিষ্ঠির) মানুষের চেয়ে বড় আর কিছুই নেই।’ (১২:২৮৮:২০) মানে দেবতারাও মানুষের চেয়ে বড় নন, মানুষই সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এ দেশে যদি অজ্ঞাত-গোত্র পরিচয়ের কোনও শবের অন্ত্যেষ্টি করতে হয়, তবে তার উল্লেখ করতে হয় ‘মানবগোত্র’ বলে। সব গোত্রের ওপরে বিশ্বব্যাপী এই যে একটি গোত্র সংজ্ঞা এ তো আমরাই বলেছি। এ দেশেই তো উচ্চারিত হয়েছে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ আবার সেই একই কথা: দেবতা বলে কিছুকে মানুষের ঊর্ধ্বে স্বীকার করা গেল না। আমরাই তো বলেছি, ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?’ বা ‘জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।’ এই মহৎ উদার বোধের পরিসরে আজ আর হিন্দুধর্মকে কুলোনো গেল না? আজ যুদ্ধং দেহি রবে ধর্মের নামে জিগির তুলে আত্মধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে হবে? এ কি আত্মধর্ম প্রতিষ্ঠা না আত্ম-স্বার্থ প্রতিষ্ঠা? কী সেই স্বার্থ? রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক শক্তি দখলের লড়াইয়ে জেতা। এ কি এমনই জরুরি, যার জন্যে অকাতরে নরহত্যা ভ্রাতৃহত্যা করা যায়?
একটা ব্যাপার চোখে পড়ে, দেশে এখন সহস্র সমস্যা; দেশবাসীর অন্নবস্ত্র, শিক্ষাস্বাস্থ্য, বৃত্তি-নিরাপত্তা কিছুরই সমাধান হল না, সঙ্ঘ পরিবারের তা নিয়ে কোনও মাথাব্যথাও নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে উঠল কল্পিত মহাকাব্যনায়কের নামে একটি মন্দির। এই নিয়ে পুরো দেশকে উন্মত্ত করে তুলতে পারলে অন্য দিকে আর একটি সমস্যা সৃষ্টি হয়। অন্নবস্ত্র ইত্যাদি নিয়ে যে আন্দোলন আজ অত্যন্ত জরুরি, দেশটাকে টিকিসুদ্ধ মার্কিন মুলুকের কাছে বেচে দেওয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, যেখানে হিন্দু মুসলমান হাত ধরে এগোচ্ছিল সেই অগ্রগতি ধাক্কা খেল। শ্রমিকশ্রেণির অন্য পরিচয় প্রধান হয়ে উঠল। সে আর সম্মিলিত সংগ্রামী রইল না। সে হিন্দু বা মুসলমান বলে অভিহিত হল। এ ভাবে সংযুক্ত সংগ্রামকে খণ্ডিত করাও এই মৌলবাদ পুনরুত্থানের একটি বড় কীর্তি। দু’ সম্প্রদায়ের সমস্ত শক্তি সংহত করে এই বিভেদ প্রচেষ্টাকে আজ রুখতেই হবে।
ভারতবর্ষ গণতান্ত্রিক দেশ। ধর্মনিরপেক্ষ। এর মানে কিন্তু সর্বধর্ম-সমন্বয় নয়, এমনকী সর্বধর্মে সমদৃষ্টিও নয়, সকল ধর্ম সম্বন্ধেই রাষ্ট্রের সমান নিরপেক্ষ ঔদাসীন্য। অর্থাৎ, ধর্মের নামে কেউ বিশেষ সুবিধা ভোগ করতে পারবে না। কেউ বিশেষ অসুবিধেও ভোগ করবে না। ভারতবর্ষে জন্মে, ভারতবর্ষে জীবনযাপন করে ভারতবর্ষেই যার জীবনাবসান ঘটবে, সে যাই হোক, জাতি-বর্ণ-ধর্ম-বিশ্বাস-আচরণ মতবাদ নিরপেক্ষ ভাবে ভারতবর্ষে সে-ই প্রথম শ্রেণির নাগরিক, দ্বিতীয় শ্রেণিরও নয়, আগন্তুক ‘বিদেশি’ বা ‘অভারতীয়’ কোনও মতেই নয়। বিশ্বাসীর অন্তরে ধর্ম থাকলে রক্তপাত, হানাহানি, অগ্নিকাণ্ড, ধর্মস্থান ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা ঘটতে পায় না। আস্তিকতা, নাস্তিকতা সম্বন্ধে যেমন, তেমনই সম্প্রদায় সম্পর্কে ও যথার্থ নিরপেক্ষ ঔদাসীন্যই রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশিত। ধর্মের জন্য রাষ্ট্রের কাছে কেউ অন্য ভাবে পরিচিত হবে না। এইটেই সুস্থ এবং সভ্য মানুষের মনোভাব হওয়া উচিত।
আজ সময় এসেছে, আঙুল তুলে অপরাধীকে শনাক্ত করে বলবার, ‘তুমি ধর্মশিখণ্ডীর আড়াল থেকে যে তির নিক্ষেপ করছ, তা শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভেই। তোমার পরিচয় হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, যা-ই হোক, তুমি ভারতীয় জনতা পার্টির হও, ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের’ই হও, ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ’, ‘শিবসেনা’, ‘বজরঙ দল’, ‘আমরা বাঙালি’, ‘সন্তান দল’, ‘জামাত-এ-ইসলামি’, ‘আকালি’ যা-ই হও, তোমার নগ্ন ক্ষমতার লোভ আমি চিনেছি, তোমার রক্তাক্ত নখদন্ত আমরা দেখে ফেলেছি। আমরা সুস্থ, সৌভ্রাত্র ও সংহতিকামী ভারতবাসীরা সমবেত বজ্রকণ্ঠে নিঃসন্দিগ্ধ চিত্তে বলছি, তোমাকে আমাদের কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই। তুমি দেশের শত্রু, মানুষের প্রতিপক্ষ। আজ আমাদের শুভবুদ্ধি মোহনিমুক্ত; তা আমাদের বলাচ্ছে যে, মানুষের লক্ষ্য হবে এমন রাষ্ট্রব্যবস্থা, এমন সমাজব্যবস্থা, যার সংজ্ঞা নিরীশ্বর অমিতাভ বুদ্ধের ভাষায় বহুজনহিতায়, বহুজনসুখায়, লোকানুকম্পায়ৈ মহতো জনকায়স্যার্থায়। বহু মানুষের সুখের জন্য, বহু মানুষের হিতের জন্য, মানুষের প্রতি অনুকম্পার জন্য, বৃহৎ জনসমূহের স্বার্থের জন্য। দেশবাসী সমস্ত মানুষের সুখের, স্বস্তির, নিরাপত্তার, স্বাধীন, সুস্থ জীবনযাপনের পরিপন্থী যা-কিছু তা যে নাম ধরেই আসুক না কেন, তাকে আমরা আজ সর্বতো ভাবে প্রত্যাখ্যান করব, ভারতবর্ষের মানুষের নামে। কারণ আমরাও মনে করি, ‘ন মানুষাচ্ছেষ্ঠতরং হি কিঞ্চিৎ।’ আজ এই আমাদের উত্তর হিন্দু মৌলবাদের কাছে, এই আমাদের শপথ সমস্ত দেশবাসীর কাছে।