ন্যুডিসম-এর গোড়ার কথা

ন্যুডিস্‌ম-এর গোড়ার কথা

আদিম কাল হইতে ক্রমাগত সৃষ্টিকার্য করিয়া করিয়া সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা ক্রমে অথর্ব হইয়া পড়িলেন। তাঁহার দাঁত সমস্ত পড়িয়া গেল; চোখেও ছানি পড়িল।

কিন্তু সৃষ্টির নেশা সহজে ছাড়া যায় না; স্থবির বয়সে ব্রহ্মা হঠাৎ মানুষ সৃষ্টি করিয়া বসিলেন।

নারদ বীণ বাজাইয়া ব্ৰহ্মলোকের পথে যাইতেছিলেন, ব্রহ্মা তাঁহাকে ডাকিয়া বলিলেন, নারদ, একটু নূতন জীব সৃষ্টি করিয়াছি। দেখ তো কেমন হইল।

ব্রহ্মার নবতম সৃষ্টি উত্তমরূপে পর্যবেক্ষণ করিয়া নারদ বিমর্ষভাবে বলিলেন, পিতামহ, কাজটা ভাল হয় নাই।

ব্রহ্মা বলিলেন, কেন, দোষটা কি হইয়াছে?

নারদ কহিলেন, নিজের চক্ষেই দেখুন না! এ যে বীভৎস ব্যাপার! আপনার অনেক সৃষ্টিই তো দেখিয়াছি, কিন্তু এমন বিকট চেহারা আর কখনও দেখি নাই।

তাই নাকি! ব্রহ্মা শঙ্কিত হইলেন। নারদ, তোমার পরকলাটা একবার দাও তো—স্বচক্ষে দেখি।

নারদের পরকলা চোখে লাগাইয়া ব্রহ্মা দেখিলেন। স্বচক্ষে নিজের সৃষ্টি দেখিয়া প্লীহা চমকাইয়া গেল। একি! এমন কদাকার অশ্লীল মূর্তি জীবজগতে কুত্রাপি দেখা যায় নাই। তিনি ভাবিতে লাগিলেন, করিয়াছি কি! ইহাদের দেখিয়া আমার নিজেরই যে গা-ঘিনঘিন করিতেছে!

পরকলা খুলিয়া বলিলেন, হুঁ। নারদ, এখন কি করা যায় বল তো?

নারদ বলিলেন, যদি ভাল চান, এই দণ্ডে ওগুলাকে সংহারকর্তা শিবের কাছে পাঠাইয়া দিন। উহাদের পৃথিবীতে ছাড়িয়া দিলে আর রক্ষা থাকিবে না। ওই কদর্য চেহারা দেখিয়া সমস্ত জীবের মাথায় খুন চড়িয়া যাইবে, উহারা নিজেরাও পরস্পরের মূর্তি দেখিয়া ক্ষেপিয়া যাইবে। ফলে আপনার সৃষ্টি আর বাঁচিবে না।

তবু নিজের সৃষ্টি যতই কুৎসিত হউক, তাহার প্রতি স্রষ্টার একটা সহজ মায়া থাকে। ব্রহ্মা ঢোঁক গিলিয়া বলিলেন, তা বটে। কিন্তু এখনই ইহাদের শিবের কাছে পাঠাইলে আমাকে বড়ই হাস্যাস্পদ হইতে হইবে যে! তা ছাড়া, চিত্রগুপ্তের খাতায় ইহাদের নাম চড়িয়া গিয়াছে, হিসাবে গণ্ডগোল হইবে। নারদ, কোনও উপায়ে ইহাদের বাঁচানো যায় না?

নারদ দীর্ঘকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, আপনার সমস্ত সৃষ্টিই নগ্ন, নগ্নতাই তাহাদের সৌন্দর্য। কিন্তু এই মানুষগুলা ঠিক তাহার বিপরীত। অতএব এক কাজ করুন, উহাদের ওই কুদর্শন দেহ কোনও আবরণ দিয়া ঢাকিয়া দিন। চেহারা ঢাকা পড়িলে হয়তো উহারা রক্ষা পাইতে পারে।

ব্রহ্মা সহর্ষে বলিলেন, ঠিক বলিয়াছ। দাঁড়াও, আমি বস্ত্র সৃজন করিতেছি।

* * * *

অতঃপর সত্য ত্রেতা দ্বাপর তিন যুগ কাটিয়া গিয়াছে। ব্রহ্মা আরও অথর্ব হইয়াছেন; তাঁহার সৃষ্টিশক্তি একেবারে লোপ পাইয়াছে। বলা বাহুল্য, মানুষের পর তিনি আর জীব সৃষ্টি করেন নাই।

মানুষ কিন্তু ধীরে ধীরে পৃথিবীর অধীশ্বর হইয়া বসিয়াছে। নানাবিধ বস্ত্রের আবরণে দেহের কদর্যতা ঢাকিয়া তাহারা যতই নিজেকে সুন্দর প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা করিতেছে, ততই তাহাদের মনের কদর্যতা একেবারে উলঙ্গ মূর্তি ধরিয়া দেখা দিতেছে। লোভ দম্ভ ও কামুকতার এমন উচ্চ স্তরে তাহারা আরোহণ করিয়াছে যেখানে শৃগাল কুক্কুরাদি ইতর প্রাণীর প্রবেশ অসাধ্য। উপরন্তু এরূপ অসম্ভব বংশবৃদ্ধি করিয়াছে যে পৃথিবীপৃষ্ঠে অন্য জীবের স্থান সঙ্কুলান দুর্ঘট হইয়া পড়িয়াছে।

একদিন তিক্ত-বিরক্ত হইয়া পালনকর্তা বিষ্ণু কৈলাসে উপস্থিত হইলেন; দেখিলেন, শিব নিজের কণ্ঠ হইতে কিঞ্চিৎ হলাহল বাহির করিয়া এক প্রকার নূতন বিষ-বাষ্প তৈয়ারে নিযুক্ত আছেন। বিষ্ণু বলিলেন, শিব, আর তো পারি না। এই মানুষ জাতটাকে পালন করিতে করিতে আমার হাড় কালি হইল। কি করি বল তো?

শিব কহিলেন, উপবেশন কর এই ঢিবিটার উপর। পালন করাই যখন তোমার কর্তব্য তখন তুমি পালন করিবে না কেন? এই দেখ, আমি নিজের কাজে লাগিয়া আছি, কেবল ধ্বংস করিতেছি। শীঘ্রই একটা নূতন গ্যাস বাহির করিতে পারিব আশা হইতেছে।

বিষ্ণু বিরক্ত হইয়া বলিলেন, তুমি যদি মন দিয়া নিজ কর্তব্য করিতে তাহা হইলে কি ঐ পাজি নচ্ছার চোর লম্পট দাগাবাজ মনুষ্য জাতিটা বাঁচিয়া থাকিত! উহাদের দেখিলেই আমার পিত্ত জ্বলিয়া যায়; এতবড় শয়তান আর ত্রিভুবনে নাই।

শিব সহানুভূতির স্বরে বলিলেন, সে কথা সত্য। কিন্তু কি করিব ভাই বিষ্ণু, আমি তো চেষ্টার ত্রুটি করিতেছি না। প্লেগ দুর্ভিক্ষ মহাযুদ্ধ ভূমিকম্প—সব দিয়া চেষ্টা করিয়া দেখিয়াছি, বেটারা মরিয়াও মরে না। অতিকায় হস্তী, ডিনসার, টেরোডাক্টিল, কত বড় বড় জন্তু সাবাড় করিয়া দিলাম তাহার ইয়ত্তা নাই, কিন্তু মানুষ জাতটাকে পারিয়া উঠিলাম না। আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, বুড়া বয়সে প্রজাপতির ভীমরতি হইয়াছিল, হয়তো মানুষগুলোকে অমরত্ব বর দিয়া বসিয়া আছেন। জান তো, বুড়া বয়সের সন্তানের প্রতি মমতা বেশী হয়।

বিষ্ণু বলিয়া উঠিলেন, অ্যাঁ! বল কি? তবে তো আমি গেলাম। অনন্ত কাল ধরিয়া যদি এই মহা পাপিষ্ঠগুলাকে পালন করিতে হয়, তবে আর বাঁচিয়া থাকিয়া লাভ কি? তার চেয়ে, শিব, তোমার ত্রিশূলটা বাহির কর। আমার আর বাঁচিবার ইচ্ছা নাই।

এই সময় নারদের বীণাধ্বনি শুনা গেল; তিনি মিহি সুরে একটি গজলাঙ্গ ভাটিয়ালি গাহিতে গাহিতে এই দিকেই আসিতেছেন।

শিব তাঁহাকে ডাকিলেন, নারদ, বড়ই বিপদ। বিষ্ণু আত্মহত্যা করিতে চায়।

নারদ যথাবিধি উভয়ের স্তুতি করিয়া বলিলেন, সে কি কথা! লক্ষ্মী দেবীর সহিত ঝগড়া হইয়াছে নাকি?

বিষ্ণু বলিলেন, না। নারদ, তুমি তো ব্রহ্মা-বুড়ার মহা ভক্ত, সর্বদা তাঁর কাছেই ঘুরঘুর কর। বলিতে পার, মানুষকে তিনি অমরত্ব বর দিয়াছেন কিনা?

নারদ বলিলেন, কই, না, তেমন কিছু তো শুনি নাই। তবে, পাছে উহারা নিজেদের মধ্যে কাটাকাটি কামড়াকামড়ি করিয়া মরে, তাই বস্ত্র সৃজন করিয়াছিলেন।

বিষ্ণু উৎসুকভাবে বলিলেন, কি রকম? কি রকম?

নারদ তখন পুরাতন ইতিহাস প্রকাশ করিয়া বলিলেন, শুনিয়া দুই দেবতা উত্তেজিতভাবে পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করিতে লাগিলেন। নারদ সেই অবকাশে বীণ বাজাইতে বাজাইতে প্রস্থান করিলেন।

অবশেষে বিষ্ণু বলিলেন, শিব, তোমার ও বিষ-ফিষ রাখ, উহাতে কিছু হইবে না। এস, একটা নূতন চক্রান্ত কর।

নীলকণ্ঠ বিষটুকু পুনরায় মুখে ফেলিয়া বলিলেন, বেশ।

* * *

খ্রীস্টীয় বিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালে য়ুরোপ অঞ্চলে গুটিকয় ন্যুডিস্ট দেখা দিল। ক্রমে এই উলঙ্গ-সঙ্ঘ সংখ্যায় বাড়িতেছে।

শুনিতেছি, ভারতবর্ষেও নাকি দুই-একটি ন্যুডিস্ট-আখড়া খুলিবার ব্যবস্থা চলিতেছে; ডেহরি-অন-শোনের গুজবটা সত্য কিনা বিষ্ণু জানেন। মোট কথা, দেবতাদের চক্রান্ত অগ্রসর হইতেছে।

কিন্তু আর কত দেরি?

প্র. কার্তিক ১৩৪৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *