ন্যায় বিচার
প্রচণ্ড শকে মানুষের যেটা হয়, জিনার সেটা হল, সেটা আত্মপরিচয়লোপ। পাগলের মতো নয়। ঠিক তার আগেকার বিভ্রান্ত অবস্থা। হাত-পাগুলোর দিকে সে অপাঙ্গে তাকিয়ে থাকে, এ কার হাত? কার পা? এগুলো তো সে চেনে না। সে কি একটা স্বপ্নের মধ্যে বাস করছে? এই যে মানুষটার ছায়া পড়ে রোজ আয়নায়, লাল ব্লাউজ কালো তাঁত, নীল ব্লাউজ সবুজ ছাপ। গুচ্ছ গুচ্ছ চুল ঘাড়ে পিঠে কাঁধের পাশে, চোখের তলায় কালি, নাকটা জেগে আছে,—এই মানুষটা কে? একে যেন কত জন্ম আগে কোন আলাদা গ্রহে চিনত সে—এ কোথা থেকে এল? ‘জিনা জিনা’ বলে কাকে ডাকছে ওই লক্ষ্মীশ্রী মুখ! ও-ই বা কে?
—হ্যালো…ও মাসিমা? হ্যাঁ আমি মল্লিকা বলছি। জিনা? জিনা তো বাথরুমে। বেরোতে একটু দেরি আছে। কিছু বলব মাসিমা?
—না, খোঁজ নিচ্ছিলাম। ভাল তো সব?
ভাল নয়। কিন্তু ভাল-ই বলতে হয়।—হ্যাঁ সবাই ভাল। হ্যাঁ বাবা একটা লাঠি নিয়ে; হ্যাঁ তেপায়া মতো লাঠি…। হিল দিয়েছে একটা। একটু তো দেরি হবেই।
ভারী নিশ্চিন্তে আছে দমদম।
—জিনা একটু খেয়ে নে…
—চিবোতে পারছি না…অবশেষে সে বলে।
মল্লিকা তরল খাবার আনে। খেয়ে নেয় জিনা। কল্যাণবাবুর পরামর্শে ওষুধ দেয় মল্লিকা, জিনা চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ে।
তৃতীয় দিনও নিখিল বাড়ি এল না। বিমান বলল, এবার তো একটা খোঁজ নিতে হয়। অফিসে খোঁজ নেব?
কল্যাণবাবু বললেন, তোমার দরকার থাকে নাও, আমার দরকার নেই।
ডাক্তার এনেছে মুকুট, সঙ্গে ঋত্বিক। পরীক্ষা করলেন। কঠিন খাবার গিলতে পারছে না জিনা। সব শুনেছেন ডাক্তার। ইশারায় সবাইকে সরে যেতে বললেন। তারপর সামনে বসে বললেন, আমার দিকে তাকান তো দেখি একবার। হ্যাঁ, দেখি! চোখের মণির মধ্যে আলো ফেলে কী দেখলেন তিনিই জানেন, বললেন, কিছু মনে করবেন না মিসেস সরকার, কার জন্যে জীবনপাত করছেন! এরা কি আপনার মন খারাপের যোগ্য? খুব বেঁচে গেছেন এ লোকের সন্তানের জন্ম আপনাকে দিতে হয়নি। লোকটাকে ঝেড়ে ফেলে দিন মন থেকে, মনখারাপও ঝরে পড়ে যাবে। নতুন করে জীবন শুরু করুন। এত সুন্দর স্বাস্থ্য, এত সুন্দর একটা জীবন আপনার…
শ্লেষে জিনার ঠোঁট বেঁকে গেল। উনি বললেন, আরে নতুন করে জীবন শুরু করা সহজ নয় আমি কি জানি না? কিন্তু কতটুকু বয়স আপনার? উঠুন, খাওয়া দাওয়া করুন, জীবন আপনিই শুরু হয়ে যাবে।
খুব শকে মানুষের যেটা প্রথম হয় সেটা হল আত্মপরিচয় লোপ। কিন্তু তারপর যেটা হয় সেটা হল নতুন একটা আত্মপরিচয় লাভ। আস্তে আস্তে তার মনে হতে লাগল সে যা-যা জানত তার সবই ভুল। নিজেকে সে যা ভেবেছিল তা-ও ভুল, তা হলে সে কে? একদিন উঠে সে চান করতে গেল নিজে নিজেই। খুব ভাল করে আয়নায় দেখতে লাগল নিজের মুখ। যদি কোথাও কোনও অভিজ্ঞান পাওয়া যায়। ওই প্রতিচ্ছবিরই ভুরুতে, কানের লতিতে, চিবুকের ভাঁজে, সেই আসল জিনাকে খুঁজতে থাকে সে অনেক অনেক ক্ষণ ধরে।
মল্লিকা একদিন দেখল তার প্রিয় সাদা সালোয়ার-কামিজ পরে বেরিয়ে এসেছে জিনা। ড্রেসিং টেবলের ড্রয়ার থেকে কী একটা স্প্রে বার করে সারা শরীরে সুগন্ধ ছড়াল। চুলগুলো পুরো ভেজায়নি। পেছনে একটা চিমটে মতো ক্লিপ দিয়ে আটকে রেখেছে। আলমারি থেকে এক থাক শাড়ি-পোশাক বার করল, ড্রেসিং টেব্ল থেকে প্রসাধনের জিনিস, ড্রয়ার থেকে সম্ভবত তার নিজের উপার্জনের টাকা, সব একটা সুটকেসে ভরতে লাগল।
মল্লিকা ভয়ে ভয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছিস, জিনা?
—কদিন থাকতে দেবে?—
—সে কী? থাকতে দেব মানে?
—ঝুম্পাদের ঘরে, জায়গা হবে?
—কেন হবে না? আয়।
সে বলল, আমি এখন একটু বেরোব। কিছু খেতে দেবে?
—আমার সব রান্না হয়ে গেছে। তুই আয় না!
খেতে বসে খাপছাড়াভাবে জিনা বলে উঠল, তোমরা আমার কাছ থেকে কী আশা কর? এখন?
—তুই কি আমাদের ছেড়ে চলে যাবি?
—‘দের’টা কে?
—কেন আমি, আমার মেয়েরা, বাবা…
—জানি না। সময়ের নিয়মে সব ক্ষীণ হয়ে যায় তো যাবে। গেলে কিছু করার থাকবে না।
—এখন কোথায় যাচ্ছিস?
—ঠিক করিনি। আমায় একটু ভাবতে হবে। এখানে ভাবতে পারছি না।
—আমি সঙ্গে যাই না!
—পাতাল রেলে ঝাঁপিয়ে পড়ব, ভাবছ! ওসব করছি না।
এইসময়ে সিঁড়ির মাথায় কল্যাণবাবুর স্বর শোনা গেল। লাঠি ঠুকে ঠুকে তিনি মাঝের দরজা দিয়ে এদিকে চলে এসেছেন জিনার খোঁজে।
—জিনা কি খাচ্ছে? বউমা?
—হ্যাঁ বাবা, বেরোবে।
—আচ্ছা, বেরোবার আগে ওকে একবার একটু ওপরে আসতে বলো।
জিনা বিরক্ত গলায় বলল, কী বলবার আছে আর এ-বাড়ির কারুর? আমাকে?
খাওয়া শেষ করে সে অনিচ্ছুক কঠিন মুখে ওপরে উঠে গেল।
বাইরে খুব উজ্জ্বল রোদ উঠেছে আজ। এখনও গায়ে বিঁধছে না ঠিক। কিন্তু শিগরিরই প্রবল হয়ে উঠবে জানান দিচ্ছে। শীতশেষের রোদের এই আসন্ন প্রখরতা, তীক্ষ্ণতা এসব সাপেদের, ভালুকদের, আরও নানা সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীদের ঘুম ভাঙাচ্ছে। প্রাণ সঞ্চার হচ্ছে অনাগত প্রাণহীন শরীরে। ভেতরে কেমন একটা অজানা অচেনা স্পন্দন। পাতাল রেলের কামরায় বসে বসে জিনা নিজেকে বলতে লাগল—জীবনের প্রথম ত্রিশটা বছর আমার কেটে গেল শীতঘুমে। বেঁচে ছিলাম অথচ চেতনা ছিল না। ওইরকম নিশ্চৈতন্য সুখের ভাতঘুম আমাকে বছরের পর বছর শিখিয়েছিল আমার পরিবার। কেউ একবারও ভাবেনি, চাকরি ছাড়াও মানুষের কাজ থাকে, প্রজনন ও সন্তানপালন ছাড়াও ভিন্নতর দায় থাকে। ভাবেনি বলেই কি নাগচৌধুরী পরিবারের ক্যাপসুলে-মানুষ মেয়ের জীবনে মহাজাগতিক অন্ধকার নেমে আসে? সে অন্ধকার কেমন করে পার হতে হয় পরিবার তো তাকে শেখাতে পারবে না! কী লজ্জা! উঃ জিনার বিয়েটা এমন দাঁড়াল! ছিঃ জামাই এরকম! কী দুর্দৈব! কারুর বেলা হয় না তো এমন! জিনাটারই ভাগ্য খারাপ! আস্তে আস্তে আদরে ময়লা ধরবে, পেতলে-ভরনে কলঙ্ক পড়ার মতো। তারপর জিনাকে নিয়ে বিব্রত হতে থাকবে সবাই। কত সহজে জেঠু এক একটা মেয়ের বিয়ে স্থির করেন! একটা মেয়েকে একটা লোকের সঙ্গে জুড়ে দিলেই হল। গাঁটছড়া একটা। ভাল চাকরি করে? বাড়ি আছে? পরিবারে সব বেঁচে-বর্তে আছেন তো? পড়শিরা কী বলছেন? নাঃ কোনও বদখেয়াল নেই। দাম্পত্য জীবনের যেসব তালিকা তাদের মেয়েমহলে আলোচিত হত, তার মধ্যে শাশুড়ি-ননদ প্রবলভাবে ছিল। কিন্তু বেশ্যা? কখনও শোনেনি। কারও সঙ্গে কারও বনল না, প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য কারণে। বিচ্ছেদ হয়ে গেল। কেউ বা অপরকে ভালবাসল, বিচ্ছেদ হয়ে গেল। এমনটা আকছার শোনা যাচ্ছে আজকাল। যদিও তাদের পরিবারের চৌহদ্দির মধ্যে এমন জিনিস ঘটেনি। কিন্তু তাকে বলতে হবে তার বিবাহিত স্বামী বিবাহের প্রথম দিনটি থেকেই তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে, আর সে এতই বোকা যে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি তার স্বামী বেশ্যাসক্ত। সেই জিনার স্বামী, যে জিনা সম্পর্কে পাঁচজনের ধারণা এ মেয়েকে নিয়ে কোনও সমস্যা হবে না, কারণ এর ভেতরে অফুরন্ত আনন্দের উৎস আছে, মানিয়ে নিতে তার জুড়ি নেই, রূপ-গুণ সবই দেখবার মতো। সারারাত তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে উলটেপালটে সম্ভোগ করে, লোকটা আবার সন্ধেবেলায় চলে যেত ওই নোংরা গলির পানের পিক লাগা সিঁড়ি বেয়ে, নোংরা ভাষা গন্ধ স্পর্শের মধ্য দিয়ে একটি অতি সাধারণ নিম্নশ্রেণীর মেয়ের কাছে যে নাকি ন’ বছর বয়স থেকে দেহ-বিক্রি করছে? কী অপমান! কী ভীষণ ঘেন্না! নিজের শরীরটাকেই তার নোংরা কাপড়ের মতো ছেড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
দিন দুয়েক এরকম রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াল সে। পাতাল রেলের টিকিট কাটে অফিস-টাইমটার পরে। এ-মুড়ো ও-মুড়ো বার বার যায় আসে, যায় আসে। ইচ্ছে হলে কামরা বদল করে, নয়তো এক জায়গাতেই বসে থাকে অনড়। এইভাবেই ইতিকর্তব্য স্থির করে ফেলে। পাতাল থেকে উঠে আসে একদিন। সারা দিন নানান কাজে ঘোরাঘুরি করে। ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে। পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয় ডাকে কোনও কোনও দরকারি মানুষকে। চলেও যায় কারও কারও প্রাইভেট চেম্বারে, পরামর্শ নেয়।
এইজন্যেই মুকুটদের সঙ্গে মেলামেশায় বড্ড আপত্তি ছিল লোকটার। যদি জেনে ফেলে? এইজন্যেই মুকুটকে, ঋত্বিককে এত গালাগাল! ভাবতেও পারেনি ওর অগোচরে ইতিমধ্যেই জিনা পৌঁছে গেছে পাপের অন্দরমহলে ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ নিয়ে। কিচ্ছু জানত না। জিনা কখনও ঘরের ঘেরাটোপ থেকে বেরোতে পারে? অমন সিল্কের পরদা দেওয়া রুপোলি খাঁচার ঘেরাটোপ! বয়স্ক-শিক্ষা! শখ হয়েছে দুদিন শখ করে হয়তো বস্তিটস্তিতে যাবে। যেমন তার খ্যাপা বাবা গিয়ে থাকেন। তারপর আর ভাল লাগবে না। ফিরে এসে নিজের ছেলেভোলানো খেলাঘর নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকবে। বাজার করবে, রান্না করবে ভাল ভাল, পার্টি জমাবে, সারা সন্ধে টিভি দেখবে, আড্ডা মারবে, আর সারা রাত্তির তাকে ‘খুশি’ করতে পারবে না!
সন্ধের বেশ পরে জিনা ডাফ স্ট্রিটের বাড়িতে ফিরে এল। মল্লিকা জানলায় ছিল, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ঝুম্পা কফি নিয়ে এল। মাম্পি—তিনটে প্লেটে তিনটে ধোসা। মল্লিকাকে দেখা যাচ্ছে না। সে আড়াল থেকে এইসব উদাসীনতা-ভেদী তির পাঠাচ্ছে। স্নেহ কাড়া মুখের মাম্পি। নিষ্পাপ, সদ্য কৈশোরের অকলঙ্ক সৌরভ তার গায়ে। ঝুম্পা, যে বুদ্ধি আর বৌদ্ধিক জগতের আকর্ষণে একদম আলাদা, সম্পর্কের জটিলতা, মানবীয় সমাজ-সংসারের পাপের দিকে যার দৃষ্টি এখনও পড়েইনি। শুধু এই সঙ্গটুকুই জিনাকে ভোলাবে, ভোলাতে পারবে, অন্তত কিছুক্ষণের জন্যেও সে সহজ হবে।
কফি আর ধোসা শেষ করে জিনা ঝুপ করে শুয়ে পড়ল মাম্পির বিছানায়। তার হাতে মাম্পির একটা টেক্সট বুক, ইকোলজির চ্যাপ্টারটা উলটেপালটে খুলে আলগা চোখে আলগা মনে পড়ছে, বলল, রাত্তিরে আর খেতে পারব না। ঘুমিয়ে পড়লে ডাকিসনি। তোরা যতক্ষণ খুশি আলো জ্বেলে পড়। খালি বেশি চেঁচাসনি।
বাইরে সাদা মাতিজ এসে থামল। একটা হর্ন দেয়, তারপর ঘষ্ষ্ করে একটা আওয়াজ তুলে গ্যারাজে ঢুকতে থাকে গাড়িটা। শুধু জিনা নয়, বাড়িসুদ্ধু সবারই মুখস্থ এই শব্দ পরম্পরা। মাম্পি ঝুম্পার দিকে তাকাল। ঝুম্পা বইয়ের ওপর উপুড় হয়ে পড়ল। লজ্জাশৌচ শেষ হল নিখিলবাবুর।
রাত দশটা নাগাদ থালা-বাটিতে নিখিলের খাবার সাজিয়ে মল্লিকা এ ঘরে এল। নিচু গলায় বলল, দিয়ে আয়।
ঝুম্পা বলল, আমি না। মাম্পি তুই যা।
কী আর করা। মাম্পি থালাটা নিয়ে চলে গেল। ঠিক কী হয়েছে ওরা জানে না। এ বাড়িতে ছোটরা ছোটদের মতোই থাকে। কেননা এটা ছোট্ট ফ্ল্যাটের সংসার নয়। ছোটদের আর বড়দের মাঝখানে আড়াল রাখার জায়গা এখানে অনেক। ঝুম্পার উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত টিভি থাকত শুধু কল্যাণবাবুর ঘরে। ঝুম্পা অনুমান করেছে ব্যাপারটা নারীঘটিত! মাম্পি শুধু বোঝে সাঙ্ঘাতিক কোনও মনোমালিন্য হয়েছে দুজনের মধ্যে। দু-একবার দিদিকে বা মাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে ধমক খেয়েছে শুধু।
—কে পাঠাল? খাবার দেখে কাকা জিজ্ঞেস করল।
—মা।
—কাকিমা কোথায়?
—ঘুমোচ্ছে।
যাক, তবে সব ঠিক আছে।
দিন তিনেক সময়মতো খাবারদাবারের সরবরাহ পাবার পর নিখিল সন্ধেরাত্তিরে মাঝের দরজা খুলে দাঁড়াল। এখন সে সকাল সকাল বাড়ি ফিরছে।
—জিনা! জিনা কি এখানে আছে?
কেউ উত্তর দিল না।
পঞ্চম দিনে সে সোজা বাবার ঘরে চলে গেল।
—বাবা?
চোখ তুলে তাকালেন কল্যাণবাবু।
—আপনি ওকে একবার ডেকে পাঠান। আমার কতকগুলো কথা বলবার আছে।
—আমি ডাকলেই সে আসবে কেন? —বইয়ের পাতায় চোখ নামিয়ে নিলেন তিনি।
—আমার সিরিয়াস কিছু কথা আছে। বাবা আপনি একবার…
হাতের কাছে বেলটা একবার বাজালেন কল্যাণবাবু।
ডলি এসে দাঁড়াল। তিনি বললেন, জিনাকে একবার ডেকে দাও তো! জিনা বউদি, ছোট বউদি এসব সম্পর্কবাচক শব্দ আর তিনি ব্যবহার করছেন না।
একটু পরে জিনা এসে ঢুকল। এই কদিনে সে এতটাই বদলে গেছে যে চমকে যেতে হয়। বেশ কয়েক কে.জি. ওজন কমে গেছে। গায়ের রং রোদ-পোড়া। কিন্তু সবচেয়ে পরিবর্তন তার চোখ এবং ঠোঁটের চেহারায়। এইগুলো সব সময়ে হাসত। এখন কঠিন ভাবহীনতা সেখানে। নিখিলকে দেখেই সে চলে যাচ্ছিল।
কয়েক পা এগিয়ে নিখিল তার পথ আটকাল। চাপা গলায় বলল, আমায় মাফ করো জিনা। এই দেখো আমি নাক-কান মলছি। এ একটা বিশ্রী অভ্যেস। বাজে। তুমি প্লিজ আমায়… আর কখনও এমন হবে না। আমি তোমাকে ভালবাসি। বাবা…ওকে একটু বুঝিয়ে বলুন। আমি অনুতপ্ত, আমার ভুল হয়ে গেছে।
জিনার দেয়ালে পিঠ। সে সামনের দেয়ালের দিকে চেয়ে রয়েছে।
—একটা বাজে অভ্যেস। স্বীকার করছি জিনা। এর জন্যে তুমি আমায় যে শাস্তি দাও যা করতে বলো—ক’মাস পরেই আমরা ইয়োরোপে ঘুরতে যাব।
তুমি প্যারিস দেখতে চেয়েছিলে! সব ঠিক হয়ে যাবে। একবার, একবারটির মতো…।
—আপনি বনমালা রাহাকে শাস্ত্রমতে হোক, রেজিস্ট্রি করে হোক বিয়ে করুন।
—কী-ই? —চিরে গেল নিখিলের রুষ্ট কণ্ঠস্বর।
—বেশ্যাকে বিয়ে? বাজারের বেশ্যাকে? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?
—করতে আপনাকে হবেই। আপত্তি করলে শুনব না। আমি এক্ষুনি ডিভোর্স দিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু শর্ত বনমালা রাহাকে বিয়ে করে স্বীকার করতে হবে, সে আপনার স্ত্রী। তার ছেলে আপনার ছেলে।
—কে কার ছেলে? মুখ ভেংচিয়ে উঠল নিখিল, ওই বেশ্যা মাগিটার ছেলে আমার?
—না হলেও ওকে অ্যাকসেপ্ট করতে হত। কিন্তু ও আপনার, সেটা আপনিও জানেন।
—সোনাগাছির বেবুশ্যে একটা! থুঃ! লাথি মারি আমি অমন বিয়ের মুখে।
কল্যাণবাবু বললেন, এ ঘর থেকে তুমি বেরিয়ে যাও।
পায়ের কাছে একটা মোড়ায় লাথি মেরে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেল নিখিল।
জিনা নীরস গলায় বলল, আমি ওর অফিসে সব খোঁজ নিয়েছি। পুরো ঘটনা জানিয়ে দিয়েছি। ওর বস, কোম্পানি ওর ওপর সন্তুষ্ট নয়। উনি ডিসিশন নিচ্ছেন শিগগির ওকে ভি.আর.এস. নিতে বলবেন। বেশি পাওনা ওর হবে না, যা শুনলাম জলের মতো দেনা করেছে। আমার ওপর নির্ভর করছে ওর চাকরি। ভাল করে ওকে বুঝিয়ে দেবেন ব্যাপারটা। সে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
এইবার কল্যাণবাবু পুরোপুরি বুঝতে পারলেন জিনাকে। সে একই সঙ্গে শাস্তি এবং সুবিচার দুটোই দিতে চাইছে। তেমন করে হয়তো সে জানে না কিন্তু জিনা নিজেই একটা নতুন সামাজিক শক্তি। একা সে দাঁড়িয়েছে একটা দীর্ঘদিন চলে-আসা পাপাচরণের বিরুদ্ধে। তার সংস্থা নেই, প্রতিষ্ঠান নেই, ট্রেনিং নেই, অভিজ্ঞতা নেই, আছে খালি প্রবল ন্যায়বোধ আর ইচ্ছাশক্তি। এবং পৌরুষ, যদি এই দৃঢ় ইচ্ছাশক্তিকে পৌরুষ বলা যায়। জিনা একা। আজ হয়তো একা। কিন্তু সে একা যে প্রশ্ন তুলেছে অচিরে সেই প্রশ্ন যুগ-মানসে অনন্য দৃঢ়তায় খাড়া হয়ে যাবে। এভাবেই সব বিপ্লবের শুরু হয়। জনমানসে নয়, ব্যক্তিমানসে।
যুগের পর যুগ অসহায় নারীকে বহুভোগ্যা করেছে বহুলোভী কামুক। ভোগ করে উচ্ছিষ্ট ভাঁড়ের মতো ফেলে দিয়েছে। সমাজ-বেষ্টনীর ভেতরে স্ত্রী, বাইরে গণিকা। কাউকেই তার প্রাপ্য দেয়নি অথচ নিয়ে গেছে তাদের কাছ থেকে সমস্ত সুখ। সুসজ্জিত শৃঙ্খলাবদ্ধ বিধিবদ্ধ সামাজিক জীবনের সুখ-শান্তি-জৌলুস, আবার স্বৈরাচারের নিষ্ঠুর মজা। সন্তান উৎপাদন করেছে গণিকালয়ে, তারপর নামহীন, পরিচয়হীন তাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে পৃথিবীর আঁস্তাকুড়ে। এর জন্য অনেক করুণার অশ্রু বর্ষিত হয়েছে, আহা-উহুতে ভরে গেছে পৃথিবী। কিন্তু বিচারের কথা কেউ কখনও ভাবেনি। ব্যভিচারী নারীকে অক্লেশে শাস্তি দিয়ে গেছে সমাজ। ব্যভিচারী পুরুষের জন্যে ক্ষমা, ভয়, প্রশ্রয়, বড় জোর একটু ঘৃণা। পুরুষরা তো বহুচারী হয়েই থাকে। আহা! প্রকৃতিই এমন করে তৈরি করেছে এই বেচারা শক্তিমানদের।
প্রকৃতি একা পুরুষকেই এভাবে সৃষ্টি করেছে এ কথা কি সত্যি? কল্যাণবাবু ভাবেন নানা দেশের প্রচলিত শাস্ত্রে-সাহিত্যে মেয়েদের সম্পর্কে প্রচুর কটুক্তি আছে। নারীরা বহুগামী, স্বৈরাচারী, স্বভাব শিথিল…অনেক অনেক। কেন এত কটূক্তি? এ সবই কি কপোলকল্পিত? না-ও তো হতে পারে? প্রথম যুগগুলোতে সকলেই তো ছিল স্বেচ্ছাগামী! বহু যুগের ওপার থেকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন সেইসব সুন্দরীদের, যারা স্বেচ্ছাবিহার করত। বসন্তোৎসবের নামে কুঞ্জ বনে বনে অবাধ যৌনলীলায় মেতে উঠত। পরিবারের প্রয়োজনে, সন্তান পালন, গৃহ ও সমাজকে ধারণ করবার জন্য এক দিক থেকে শেকল পরানো হতে লাগল তাদের ওপর। আর এক দিক থেকে চলল নীতিশিক্ষা বর্ষণ—পরপুরুষ গমন পাপ, না জেনেও তা করে অহল্যা পাষাণ হয়েছিলেন, এক পুরুষের প্রতি অনুগত থাকাই পুণ্য, তাতে অক্ষয় স্বর্গলাভ হয়, এইভাবে চলতে চলতে একদিন মৃত পুরুষের চিতায় তাদের তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হল সমাজ। এই পলিসি-মেকিং-এর রাশ যদি সে সময়ে নারীর হাতে থাকত তা হলে? তা হলে হয়তো আজ যাকে বেশ্যাপল্লি বলা হচ্ছে সেইরকমই হত নারীমহলের অন্দরের চেহারা। মেয়েরাও ইচ্ছামতো বিহার করত, তারপর ফিরে যেত ঘরের সুখ, শান্তি, স্বস্তির মধ্যে, নিশ্চিন্ততার জন্যে যেমন আজকের স্বেচ্ছাচারী পুরুষ যায়। সমাজ-ব্যবস্থার মূল ভিত যদি হয় পরিবার, যদি সে পরিবার-প্রথাকে মান্য করতে হয়, তা হলে তো সবাইকেই তা করতে হবে! মেয়েদের মধ্যে যদি নিষ্ঠা দীর্ঘদিনের ট্রেনিং-এ ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়ে থাকে তা হলে পুরুষদের ক্ষেত্রেই বা তা হবে না কেন? ব্যতিক্রম চিরকাল ছিল, থাকবে। কিন্তু এক যাত্রায় পৃথক ফলের নীতি থাকবে কেন?
জিনা পরিবারকে স্বীকার করার পুরো অর্থ সহজ বুদ্ধিতে এখন বুঝেছে— সমস্তটা নেব আর এক তৃতীয়াংশ, এক চতুর্থাংশ মাত্র ফেরত দেব এ হয় না। পারিবারিক মর্যাদা ছাড়া নারীকে ব্যবহার করা মানে পরিবার-সিসটেমকে অগ্রাহ্য করা। নারীর অমর্যাদা তো বটেই, এই কোণ থেকে মুকুটরা সমস্যাটাকে দেখেনি। তারা ভাবে—আর্থিক অবস্থা তৃতীয় পৃথিবীর যা, তাতে করে এইসব মেয়ের অন্নসংস্থানের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। সুতরাং যতই খারাপ হোক, ব্যাপারটা চলুক। বরং যদি মেয়েগুলোর দুর্দশা একটু কমানো যায়। এভাবে আপসমুখী চিন্তা করে কোনও সভ্যতা বাঁচতে পারে না। প্র্যাগম্যাটিক হও। কিন্তু লক্ষ্যটাকে অন্তত ঘোষণা করো, বাঁচিয়ে রাখো, যাতে জমি তৈরি হলেই আসল কাজ শুরু করতে পার। মুকুটরা যা ছ-সাত বছরে সম্ভব করতে পারেনি, জিনা তা পেরেছে মাত্র দেড় বছর সময়ে। মুক্তির ইচ্ছা জাগিয়েছে। মুক্তি সম্ভব করেছে একজনের। আর এক জনেরটা করার দিকে পা বাড়িয়েছে। অথচ জিনার কোনও ট্রেনিং নেই।
বনমালাকে পুত্রবধূ ভাবতে তাঁর নিজের ভেতর থেকে প্রচণ্ড প্রতিরোধ আসছে। তিনি অস্বীকার করছেন না। এর ফলে হয়তো নিখিল, তাঁর নিজের পুরো পরিবার সামাজিক দিক থেকে ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু পরিবারের একজন যদি রত্নাকর হয় অন্যদের তার পাপের ভাগ তো নিতেই হয়। তারা চাক বা না চাক। এবং এটাই সুবিচার। একবার যদি জিনিসটা সম্ভব করতে পারেন, একটা কাজের কাজ হয়। কী আর হবে? আগেকার মতো ধোপা-নাপিত তো আর বন্ধ করে দিতে পারবে না কেউ। মল্লিকার মেয়েদের দরকার হলে বিদেশে পাঠিয়ে দেবেন, এখানকার গণ্ডি থেকে দূরে। নিজেরা বুঝেশুনে বিয়ে করবে। জিনা অনায়াসেই সরে যেতে পারত নিজের পরিত্রাণ নিয়ে। কিন্তু সে জিনিসটাকে যতটা তার নিজের ওপর অবিচার হিসেবে দেখছে, ঠিক ততটাই দেখছে বনমালার প্রতি অবিচার হিসেবে। ‘ফ্রেশ মাইন্ড’ সজীব নতুন মন না হলে এ ভাবনা সম্ভব হত না।
সারাদিন ঘুরেফিরে একটা কথাই তাঁকে কুরে কুরে খেতে লাগল, নিখিল কেন এ কাজ করল! তার জীবনে জিনার আয়ু আর বনমালার আয়ু তো মোটের ওপর একই দেখা যাচ্ছে। ঠিক আছে কুসঙ্গে পড়ে যদি এ মতি তার হয়েই ছিল, জিনার মতো একটি মেয়েকে সে বিয়ে করতে গেল কেন? আবার করলই যদি কেন ফিরে আসতে পারল না? এখন তো দেখা যাচ্ছে, জিনাকে ছাড়তেও সে রাজি নয়?
অনেকটা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই তিনি পরদিন নিখিলকে ডেকে পাঠালেন। সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ বাড়ি ফিরেছে নিখিল। ডলি কল্যাণবাবুর ঘরে দুজনের কফি দিয়ে গেল।
টাইটা খুলে ফেলেছে নিখিল। শার্টটা কোমরের কাছে মুচড়ে মুচড়ে আছে। পায়জামাটা নোংরা। ঘরে ঢুকে রুক্ষ স্বরে বলল, বিছানাটা ঘাঁটা, কেউ পরিষ্কার পর্যন্ত করেনি, জামাকাপড় কাচা হয়নি, সকালবেলায় এক কাপ চা পেলাম না। রাত্তিরে লঙ্গরখানার ভিক্ষে খেতে হচ্ছে, এভাবে আর ক’দিন চলবে?
একজনের জীবনটাই ঘেঁটে দিলে, আর সামান্য বিছানা ঘাঁটা নিয়ে নালিশ করছ, বাপধন? —কল্যাণবাবু ভাবলেন। মুখে বললেন, তুমি বরং একজন লোক রেখে দাও।
—আপনিও সমানে আশকারা দিয়ে যাচ্ছেন, নইলে বাড়ির বউয়ের এত সাহস হয়? ভদ্রবাড়ির মেয়ে, ভদ্রবাড়ির বউ হয়ে খারাপ পাড়ায় যেতে লজ্জা করেনি ওর? কে বলতে পারে সেখান থেকে নষ্ট হয়ে এসেছে কিনা! ওসব এন জি ও ফি-ও অনেক দেখা আছে আমার।
কল্যাণবাবু এত অবাক হয়ে গিয়েছিলেন যে কথার মাঝখানে বাধা দিতে পারেননি। এখন শুধু বলতে পারলেন, তোমার স্পর্ধা তো কম নয়!
—বুড়ো বয়সে ভিমরতি ধরেছে আপনার। কার বাবা আপনি? আমার না ওর? দিনের পর দিন যে মেয়ে সোনাগাছি যায়..তার আর…
—তুমি অনাচার করতে যেতে পার আর অন্যের সেবার জন্যে গেলে গালি দিচ্ছ?
নিখিলের মুখে একটা বিচিত্র হাসি উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল। সে বলল, আপনি নিজেও তো পুরুষ মানুষ না কী?
—তোমরা যেমন সন্তানই হও, আমি তোমাদের বাবা…
—তা হলে বোঝেন না কেন যাই?
—না বুঝি না।
—তা হলে আপনাকে বোঝানো আমার কর্ম না। পুরুষ হলে তার দরকার হয়।
—পুরুষের তো অনেক কিছুই দরকার হয়। বিড়ি-সিগারেট-মদ-ভাঙ-চরস-কোকেন-এল.এস.ভি-মরফিন-সাপের বিষ। আরও কিছু নতুন বস্তু উঠলে সেগুলোও দরকার হতে থাকবে। কেমন, কিনা?
—সেক্স হল বেসিক নিড।
—তো তারই জন্যে তো মানুষ বিবাহাদি করে!
—আপনি বুঝবেন না বিবাহিত স্ত্রী আর এইসব স্ত্রীলোকে অনেক তফাত!
—তা বেশ তো! আমি বুঝেছি তোমার কথা। ওই মেয়েটিকে তুমি নিয়ে এসো শাস্ত্রমতে। জিনা যেমন বলছে। ও তোমার স্ত্রীলোকের প্রয়োজন মেটাচ্ছে। আর আমি যদ্দূর বুঝেছি স্ত্রী হতেও ওর তেমন অসুবিধে নেই। আমাদের সমপর্যায়ের নয়। তো কী করা যাবে? তুমি ওকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিজের সমাজের যোগ্য করে নাও। মেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি শেখে। আমার কথা যদি বল তো বনমালা মেয়েটিকে অ্যাক্সেপ্ট করতে আমার কোনও অসুবিধে হবে না!
—আমার হবে—নিখিল গরম হয়ে বলল, অ্যাবসার্ড টু দা পাওয়ার ইনফিনিটি। একটা বারোভাতারি মা…
—শোনো নিখিল, খারাপ কথা, গালিগালাজ দিতে হলে যেসব জায়গায় এসব চলে সেখানে যাও। আমি বুঝতে পারছি না, তোমার মতো বেয়াড়া ছেলে আমার হল কী করে!
—হয়তো আমি তা হলে আপনার ছেলে নই! —বিশ্রী হেসে উঠল নিখিল।
পাশ থেকে লাঠিটা তুলে নিলেন কল্যাণবাবু। তারপর সপাটে মারলেন এক বাড়ি। —জাহান্নামে যাও। এখানে তোমার স্থান নেই। এ বাড়ি আমি জিনাকে দিয়ে যাব, আর ওই কুটুসকে, যদি সৎভাবে মানুষ হয়ে ও একটা ভদ্রস্থ সুনাগরিক হয়ে উঠতে পারে। যা—ও।