ন্যায়পরায়ণতা

ন্যায়পরায়ণতা

 ইংলণ্ডদেশে লিয়োনার্ড নামে এক বালক ছিল। সে অতি দুঃখীর সন্তান। তাহার পিতা অতি কষ্টে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিতেন। দুর্ভাগ্য বশতঃ দ্বাদশ বর্ষ বয়ঃক্রম কালে, লিয়োনার্ডের পিতৃবিয়োগ হয়, তাহার জননীর এরূপ পরিশ্রমশক্তি ছিল না যে, তিনি আপনার ও পুত্রের ভরণ পোষণ নির্ব্বাহ করেন। লিয়োনার্ড প্রতিজ্ঞা করিল, অন্য কাহারও গলগ্রহ হইব না, এবং ভিক্ষা প্রভৃতি নীচ বৃত্তি দ্বারাও জীবিকা নির্ব্বাহের চেষ্টা করিব না, যে রূপে পারি, পরিশ্রম দ্বারা আপন ভরণ পোষণ সম্পাদন করিব।

 এইরূপ সঙ্কল্প করিয়া, লিয়োনার্ড কহিতে লাগিল, আমি এক প্রকার লিখিতে ও পড়িতে শিখিয়াছি, যদি আমি সচ্চরিত্র ও পরিশ্রমী হই, কেনই আমি জীবিকা নির্ব্বাহের উপযোগী অর্থ উপার্জ্জন করিতে পারিব না। এই স্থির করিয়া জননীর অনুমতি গ্রহণ পূর্ব্বক, সে এক সন্নিহিত নগরে উপস্থিত হইল। সেই নগরে তাহার পিতার এক পরম বন্ধু ছিলেন, তাঁহার নাম বেনসন। তিনি সঙ্গতিপন্ন লোক এবং বাণিজ্য করিতেন। লিয়োনার্ড, তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইয়া, আপন অবস্থা জানাইল, এবং বিনীত ভাবে প্রার্থনা করিল, আপনি কৃপা করিয়া, আমায় আপনার আশ্রয়ে রাখুন, এবং আমার দ্বারা যাহা নির্ব্বাহ হইতে পারে, ঐরূপ কোনও কর্ম্মে নিযুক্ত করুন। আমি অঙ্গীকার করিতেছি, প্রাণপণে পরিশ্রম করিয়া, কর্ম্ম নির্ব্বাহ করিব, প্রাণান্তেও অধর্ম্মাচরণে প্রবৃত্ত হইব না।

 দৈবযোগে সেই সময়ে বেন্‌সনের একটি সহকারী নিযুক্ত করিবার প্রয়োজন ছিল। এক অপরিচিত ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা অপেক্ষা, বন্ধুপুত্র লিয়োনার্ডকে নিযুক্ত করা পরামর্শসিদ্ধ বিবেচনা করিয়া, তিনি আহ্লাদ পূর্ব্বক তাহাকে নিযুক্ত করিলেন। লিয়োনার্ড স্বভাবতঃ অতি সুশীল, সচ্চরিত্র, পরিশ্রমী ও ন্যায়পরায়ণ, কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়া, যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত হইল, এবং সৎপথে থাকিয়া, প্রাণপণে যত্ন ও পরিশ্রম করিয়া, সুন্দররূপে কর্ম্ম নির্ব্বাহ করিতে লাগিল। যদি দৈবাৎ কখনও আবশ্যক কর্ম্ম করিতে বিস্মৃত হইত, অথবা ভ্রান্তিক্রমে কোনও কর্ম্ম প্রকৃতরূপে সম্পাদন করিতে না পারিত, সে তৎক্ষণাৎ আপনার দোষ স্বীকার করিত, এবং সাধ্য অনুসারে সেই দোষের সংশোধনে যত্নবান হইত।

 লিয়োনার্ডের সুশীলতা, সচ্চরিত্রতা ও শ্রমশীলতা দর্শনে, বেন্‌সন তাহার প্রতি সাতিশয় সন্তুষ্ট হইতে লাগিলেন, এবং ক্রমে তাহার উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিলেন ও তাহার হস্তে সকল বিষয়ের ভার দিতে আরম্ভ করিলেন। এই রূপে, অল্প দিনের মধ্যে, সে বিষয়কর্ম্মে নিপুণ, এবং স্বীয় প্রভুর প্রিয়পাত্র ও বিশ্বাসভাজন হইয়া উঠিল।

 বেন্‌সনের স্ত্রী পুত্র আদি পরিবার ছিল না। তিনি একটি স্ত্রীলোকের হস্তে সাংসারিক সমস্ত বিষয়ের ভার দিয়া রাখিয়াছিলেন, স্বয়ং কখনও কোনও বিষয়ে দৃষ্টিপাত বা কোনও বিষয়ের তত্ত্বাবধান করিতেন না। ঐ স্ত্রীলোকের ধর্ম্মজ্ঞান ছিল না, সুতরাং সে সুযোগ পাইলেই অপহরণ করিত। এক্ষণে, সে লিয়োনার্ডের উপর প্রভুর সম্পূর্ণ বিশ্বাস, ও সকল বিষয়ে তত্ত্বাবধানের ভার দেখিয়া, বিবেচনা করিল, এই বালক এখানে বিদ্যমান থাকিলে, আমার লাভের পথ এক কালে রুদ্ধ হইয়া যাইবে, এবং হয় ত, অবশেষে অপদস্থ ও অবমানিত হইয়া, এস্থান হইতে প্রস্থান করিতে হইবে, অতএব, কৌশল করিয়া ইহাকে এখান হইতে বহিষ্কৃত করা আবশ্যক, তাহা না হইলে, আমার পক্ষে ভদ্রস্থতা নাই।

 এই সিদ্ধান্ত করিয়া, সেই স্ত্রীলোক, অবসর বুঝিয়া, এক দিন, বেন্‌সনের নিকট, কৌশলক্রমে কহিতে লাগিল, মহাশয়। আপনি অতি সদাশয়, সকলকেই সজ্জন মনে করেন, আপনি এই বালকের উপর অধিক বিশ্বাস করিবেন না আপনি উহাকে যত সুশীল ও সচ্চরিত্র ভাবেন, ও সেরূপ নহে, অগ্রে সাবধান না হইলে, অবশেষে উহা দ্বারা আপনার অনেক অনিষ্ট ঘটিবে। আমার মনে সন্দেহ হওয়াতে, উহার দিকে দৃষ্টি রাখিয়া, আমি যত দূর জানিতে পারিয়াছি, তাহাতে উহার উপর অত্যন্ত বিশ্বাস করা কোনও ক্রমে উচিত নহে। আমি বহু কাল, আপনার আশ্রয়ে থাকিয়া প্রতিপালিত হইতেছি, আপনার অনিষ্ট সম্ভাবনা দেখিয়া, সতর্ক না করিলে, আমার অধর্ম্মাচরণ হয়, এজন্য আমি আপনাকে এ সকল কথা জানাইলাম।

 এই স্ত্রীলোকের উপর বেন্‌সনের বিলক্ষণ বিশ্বাস ছিল, কিন্তু লিয়োনার্ড যে অতিশয় সুশীল ও সচ্চরিত্র, সে বিষয়েও তাঁহার অণুমাত্র সংশয় ছিল না, এজন্য, তিনি, সেই স্ত্রীলোকের কথায় সহসা বিশ্বাস না করিয়া, বিবেচনা করিলেন, এই বালক যে অধর্ম্মপথে পদার্পণ করিবে, কোনও ক্রমে আমার এরূপ বিশ্বাস হয় না। কিন্তু অত্যন্ত অধার্ম্মিকেরাও বিশ্বাস জন্মাইয়া, সহজে আপন অভীষ্ট সিদ্ধ করিবার নিমিত্ত সম্পূর্ণ ধার্ম্মিকের ভাণ করিয়া থাকে। অতএব, এই স্ত্রীলোকের কথায় একেবারেই উপেক্ষা করিয়া নিশ্চিন্ত থাকা বিধেয় নহে, আমি গোপনে এই বালকের চরিত্র পরীক্ষা করিব।

 মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, বেনসন এক দিন লিয়োনার্ডকে কহিলেন, আমার এই এই বস্তুর অত্যন্ত প্রয়োজন হইয়াছে, যত মূল্যে হয়, সত্বর ক্রয় করিয়া আন। এই বলিয়া যত আবশ্যক তাহা অপেক্ষা অধিক টাকা তাহার হস্তে দিয়া, তিনি তাহাকে আপণে প্রেরণ করিলেন। লিয়োনার্ড, ঐ সমস্ত বস্ত ক্রয় করিয়া, অনতিবিলম্বে প্রত্যাগমন করিল, এবং, ক্রীত বস্তু প্রভুর সম্মুখে রাখিয়া, অবশিষ্ট টাকা তাঁহার হস্তে দিল। লিয়োনার্ড এবিষয়ে এক কপর্দ্দকও অপহরণ করে নাই, ইহা স্পষ্ট বুঝিতে পারিয়া, তিনি অপরিসীম হর্ষ প্রাপ্ত হইলেন, এবং ঐ স্ত্রীলোক যে, কেবল বিদ্বেষ বশতঃ, তাহার গ্লানি করিয়াছিল, তাহা বিলক্ষণ বুঝিতে পারিলেন।

 এক দিন, বেন্‌সন, অনবধানতা বশতঃ কার্য্যালয়ে কতকগুলি মোহর ফেলিয়া গিয়াছিলেন। লিয়োনার্ড সেই গৃহে প্রবিষ্ট হইয়া দেখিল, মোহর পড়িয়া আছে। সেই সময়ে ঐ স্ত্রীলোকও সেই স্থানে উপস্থিত হইল। সে, লোভে আক্রান্ত হইয়া, অথবা লিয়োনার্ডকে অপদস্থ করিবার অভিপ্রায়ে, তাহার নিকট প্রস্তাব করিল, এস, আমরা উভয়ে এই মোহরগুলি ভাগ করিয়া লই। লিয়োনার্ড শ্রবণমাত্রে, সেই ঘৃণিত প্রস্তাবে আন্তরিক অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করিয়া কহিল, আমি এই মোহর প্রভুর হস্তে দিব, ইহা তাঁহার সম্পত্তি, পরের ধন অপহরণ করা অতি অসৎ কর্ম্ম, আমি কোনও ক্রমে তোমার প্রস্তাবে সম্মত হইব না।

 এই বলিয়া, সেই মোহর লইয়া, লিয়োনার্ড বেন্‌সনের নিকট উপস্থিত হইল, এবং অমুক স্থানে এই মোহরগুলি পড়িয়া ছিল, এই বলিয়া তাঁহার হস্তে প্রদান করিল। বেন্‌সন, লিয়োনার্ডের ঈদৃশ অবিচলিত ন্যায়পরায়ণতা দর্শনে, নিরতিশয় প্রীতি প্রাপ্ত হইয়া তাহাকে তৎক্ষণাৎ বিলক্ষণ পুরস্কার দিলেন। ক্রমে ক্রমে এই বালকের উপর তাঁহার এরূপ শ্রদ্ধা ও অনুরাগ জন্মিল যে, পরিশেষে তিনি তাহাকে পুত্রবৎ পরিগৃহীত করিয়া, আপন সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *