1 of 2

ন্যাপা – লীলা মজুমদার

ন্যাপা – লীলা মজুমদার

অস্বাভাবিক মানুষ ও অস্বাভাবিক ঘটনা যে হরদম চোখে পড়ে এ বিষয় তো কোন সন্দেহ নেই-ই, এমনকি এমন বহু ঘটনার কথাও শোনা যায় যাকে যুক্তি দিয়ে বিচার করতে গেলে অসম্ভব বলে মনে হতে পারে। কিন্তু কে না জানে যে সে সব ঘটনাও হামেশাই ঘটে থাকে।

হামেশাই ঘটে থাকে বলছি বটে, তবে সব সময় নিজেদের জীবনে ঘটে না, তাই চাক্ষুষ প্রমাণ দিতে পারে এমন সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু যাদের কথা অবিশ্বাস করা যায় না, এ-রকম বহু লোকের নিজেদের জীবনে না হোক, তাদের নিকট আত্মীয়স্বজনদের কিংবা অন্তরঙ্গ বন্ধুদের জীবনে সেসব ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকতে শোনা যায়।

যেমন ধরুন আমার মার সই মিস গাঙ্গুলীর কথা। বিয়ে-থা করেননি, নামকরা খ্রীশ্চান বাড়ির মেয়ে, নামটা অবিশ্যি পালটে দিয়েছি, নইলে সবাই চিনে ফেলবেন শেষটা—ভবানীপুরের দিকে একটা মেয়েদের হোস্টেল চালান। আমার মামাবাড়ির পুরোন চাকর বনমালীও সেখানে বহু বছর কাজ করছে। সব জানাশোনা লোকের ব্যাপার, বুঝতেই পারছেন, এঁরা কেউই সেরকম একটা বানিয়ে মিথ্যে কথা বলবার মানুষও নন, অথচ ঘটনাটা শুনে কী বলবেন তা ভেবে পাবেন না।

সারাদিন বনমালী ন্যাপাকে আগলিয়েছে, এখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, আর ভাল লাগছে না। মানুষের ভাইবোন কেন হয়? ন্যাপাটা পাজির একশেষ, আর কেউ হলে বনমালী তার সঙ্গে কথাটি বলত না, অথচ মায়ের পেটের ভাই বলে যেই না জেল থেকে ছাড়া পেল, অমনি বনমালীও তাকে নিয়ে গিয়ে রান্না ঘরে ঢোকাতে বাধ্য হল।

‘ওর জুড়ি রাঁধুনে সারাটা পৃথিবী ঘুরে আর একটা খুঁজে পাবেন না দিদি, নিদেন একটা ট্রায়েল দিন তো।’

কথাটা মিথ্যেও নয়। একবেলা ন্যাপার রান্না খেয়েই দিদিমণিদের মুখে তার প্রশংসা আর ধরে না। আর ন্যাপাকে পায় কে!

তবু কাজটা ভাল হয়নি। ন্যাপার মনে কী আছে কে জানে! দুষ্টবুদ্ধি জাগতেই বা কতক্ষণ? বাড়ির ভিতরে তো বনমালী আর বাইরের ফটকে দরোয়ান ছাড়া আর একটা ব্যাটাছেলে নেই। সারাদিন দিদিরা ইস্কুলে পড়ায়, বাড়ি-ঘর খাঁ-খাঁ করে, জিনিসপত্র এধারে-ওধারে ছডানো পড়ে থাকে। ন্যাপার যা স্বভাব, বনমালীর মনে শান্তি নেই। অথচ মায়ের পেটের ভাইটাকে সে-ই যদি আশ্রয় না দেয় তো আর কে দেবে?

যাক, তবু যতক্ষণ রান্নাঘরে কাজে মেতে থাকে ততক্ষণ রক্ষা। বাস্তবিক রাঁধে খাসা। ছেলেবেলা থেকে ওর হাতে জাদু আছে, বেশ ভাল মাইনেতে সাহেব-বাড়িতে করে খেতে পারত, অথচ তবু যে কেন দুর্বুদ্ধি জাগে কে জানে! যাকগে, এখন রাতের খাবার জন্য টেবিলটা লাগাতে হবে, এসব ভেবে তো কোন লাভ নেই।

দরজার কোণা থেকে বনমালী লক্ষ্য করে দেখল, মোড়ের বাড়ির বুড়ি মাসিমা এসেছেন। সবাই মিলে টেবিল ঘিরে বসেছেন। কথাও কানে আসছে। মাসিমা একবার কথা বলতে শুরু করলে আর রক্ষা নেই, কিন্তু শুনতে বেশ মজাও লাগে।

‘হ্যাঁ, একদম চেঁছেপুঁছে সব নিয়ে এলাম ব্যাঙ্ক থেকে। আমাকে সন্দেহ করে এত বড় আস্পর্ধা! বুঝলি উমাশশী, প্রত্যেকটি জিনিস আমার বাবা আমার মার জন্য গড়িয়ে দিয়েছিলেন। মা মরবার সময় সমান দুই ভাগ করে আমার হাতে দিলেন। একটা ভাগ আমার, একটা ভাগ ভাদুর বউয়ের জন্যে। সে একেবারে চুলচেরা ভাগ ভাই। জোড়া ভেঙে ভেঙে একটা বালা আমাকে একটা ওকে; একটা ইয়ারিং আমাকে, একটা ওকে। যেমন দুটি রুমালে বেঁধে দিয়েছিলেন, তেমনি ব্যাঙ্কে তুলে দিয়েছিলাম, এই দশ বছরে একবারও খুলিনি। ওরাও মফস্বলে ঘুরেছে, সাহস করে কিছু নেয়নি। এখন এখানে এসে বসেছে, অমনি বউ কিনা আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। আজ ভারি রেগে গেছি, এই পুঁটুলিসুদ্ধ ওর মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দেব।’

উমাদিদি কিছু বলবার আগেই কম বয়সের মণিদিদি বলে উঠলেন, ‘কই মাসিমা, দেখি, দেখি কি রকম গয়না!’

মাসিমাও তাই চান, দুই পুঁটুলি খুলে টেবিলের উপর ঢেলে দিলেন। কালোপানা কাঠের উপর ছোট ছোট দুটি সোনার ঢিবির মত জ্বলজ্বল করতে লাগল। বনমালীর চোখ ঝলসে গেল। এত গয়না যে ওই থানকাপড়-পরা বুড়ি মাসিমার থাকতে পারে, এটা বনমালীর ধারণা ছিল না। ইস, লাল নীল সাদা সবুজ পাথর বসানো একেবারে তাল-তাল সোনা গো। ওর দাম কত হাজার টাকা হবে কে জানে? এর ছোটপানা একটা বেচলেই বনমালীর মার ইন্‌জেকশনগুলোর দাম উঠে যাবে। বুড়ি মাসিমা তো আচ্ছা, এই রাজার ধনরত্ন তুলে রেখে দিয়ে মিলের থানকাপড় আর রবারের চটি পরে বেড়ায়, বুড়ো বয়স অবধি ইস্কুলে সেলাই শেখায়। একটা ভাল জিনিস কোনদিন কেনে না, খায় না।

দিদিমণিরা জিনিসগুলোর উপর ঝুঁকে পড়ে নেড়ে চেড়ে দেখছে, এক-একটার উপর আলো পড়ে আর অমনি ঝিলমিলিয়ে ওঠে। বনমালীর চোখ জ্বালা করে। ভয়ে-ভয়ে একবার পিছন ফিরে দেখে, ভাগ্যিস, ন্যাপা রান্নাঘরে ব্যস্ত আছে। বনমালীর বুক ঢিপ ঢিপ করতে থাকে। আঃ বাঁচা গেল, মাসিমা আবার ওগুলোকে পুঁটুলি বেঁধে ফেলছেন।

মণিদিদির হাতে তখনও লাল পাথর বসানো মালাটা রয়েছে।

‘আপনার কী সাহস মাসিমা! এত সব দেখে আমাদেরই চুরি করে নিতে ইচ্ছে করবে, আর আপনি ওই ব্যাগ নিয়ে সন্ধেবেলা এতটা পথ একা হেঁটে বাড়ি গিয়ে, তবে লোহার সিন্দুকে তুলবেন। ভয়ডর নেই আপনার প্রাণে?’

মাসিমাও অমনি পুঁটুলি বাঁধা বন্ধ করে একগাল হেসে বললেন, ‘আরে, আমার বাবার জ্বালায় কি আমাদের ভয়টয় পাবার জো ছিল! জানিস তো বাবা মস্ত বড় উকিল ছিলেন, রাশি রাশি টাকা রোজগারও করতেন, দুই হাতে খরচও করতেন। সোনাদানায় রুপোর বাসনে আর তার চেয়েও দামী কাট-কাঁচের ফুলদানি আর ঝাড়লণ্ঠনে বাড়ি বোঝাই ছিল। এক-একটা বিলিতি ছবিরই কত দাম ছিল। তার কিছুই নেই অবশ্যি এখন, রিটায়ার করে বাবা বিদেশ ঘুরে বেরিয়ে সব উড়িয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছিলেন, শুধু মার গায়ের গয়নাগুলো ছাড়া। তা, হ্যাঁ, কী যেন বলছিলাম, ভয় পাব কী, এই দৈত্যের মতো দুটো কুকুর ছিল যে আমাদের। সারাদিন বাঁধা থাকত, সারা রাত ছাড়া থাকত। একটার রঙ ছিল হলদে, আর কালো পোড়া হাঁড়ির মত এই প্রকাণ্ড মুখ, তার নাম ছিল রোনো। হাঁউমাঁউ করে তেড়ে এলে তাই দেখে ভয়ে প্রাণ উড়ে যেত। কিন্তু আসলে কিছু বলত না। শুধু ধারালো ছুঁচলো দাঁত দিয়ে কুটকুট করে জামার সব বোতাম কেটে ফেলে দিত। সে এক মজার ব্যাপার। অন্যটার নাম ছিল কিম্। কী সুন্দর সে দেখতে ছিল, সে আর কী বলব! এই লম্বা চকচকে লাল লোম সারা গায়ে, মখমলের মত চোখ, ঝালরের মত ল্যাজ। মুখে কিচ্ছু বলত না। নিঃশব্দে ছুটে এসে এক লাফে টুঁটি কামড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করত। বাড়ির লোকদের কিছু বলত না। পাঁচ-সাতশো টাকার জন্য এখানে কত চুরি-ডাকাতি খুন-খারাবির কথা শোনা যেত, আর আমাদের বাড়িতে হাত বাড়ালেই হাজার টাকার আসবাবে হাত ঠেকে যেত, অথচ ওই দুই কুকুরের জন্য কুটোটা কখনও চুরি যেত না। আরে তোরা কী বলিস, গোছ-গোছা জড়োয়া চুড়ি হাতে দিয়ে মার সঙ্গে তোদের এই বাড়িতেই চায়ের নেমন্তন্ন খেয়ে কত রাত করে বাড়ি ফিরেছি। সঙ্গে ওই দুটো কুকুর থাকতে শুধু আমাদের কাছাকাছি কেন, এই ফুটপাথ দিয়ে লোক চলেনি। এখানে তখন স্যার গিরীন্দ্র থাকতেন। কত নাম করা লোকে যাওয়া-আসা ছিল এ-বাড়িতে, কী সুন্দর সাজানো-গোছানো ছিল। কী ভালই যে বাসতাম আমরা ওই কুকুর দুটোকে—’

কানের কাছে একটা ফোঁস শব্দ শুনে বনমালী চমকিয়ে উঠল। ন্যাপার চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকম জ্বলজ্বল করছে। ‘যা ভাগ, তোর কাজকম্ম নেই নাকি?’

ন্যাপা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘কারও অত সোনাদানা থাকা উচিত না, কারও না।’

‘ন্যাপা তোর পায়ে পড়ি। আবার কিছু পাকিয়ে বসিস না। এই সবেমাত্র ছাড়া পেয়েছিস, বুড়ো মাকে আর জ্বালাসনি বলছি, ও ন্যাপা শোন্‌ বলছি।’

কিন্তু ন্যাপা ততক্ষণে হাওয়া।

মাসিমা পুঁটুলি দুটোকে ততক্ষণে বেঁধে-ছেদে, হাতে ঝোলানো কালো কাপড়ের থলির মধ্যে পুরে, হাতাটা হাতে নিয়ে উঠে পড়েছেন। থলিটাকে তুলে ধরে বললেন, ‘তোরাই বল, কার বাবার সাধ্যি বুঝবে এই থলির মধ্যে আবার সাত রাজার ধন থাকতে পারে! আর ভয়ের কথা মনেও আনিস না, চল্লিশ বছর আগে, কুকুর দুটো মরে গেছে, কিন্তু ভয়টা আমাদের তখন থেকেই ঘুচে গেছে। তবে শরীরটা আজকাল বড় সহজে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, এই যা। কুকুর দুটোর জন্য মাঝে মাঝে বড় মন-কেমন করে।’

মাসিমা চটি পায়ে দিয়ে বিদায় নেন, দিদিমণিরাও নিজেদের মধ্যে গয়নার বিষয় বলাবলি করতে উঠে পড়েন।

এতক্ষণ পরে বনমালী টেবিল লাগায়। তার মন ভাল নেই। ভয়ে প্রাণ উড়ে যাবার যোগাড়। রান্নাঘরে ন্যাপা নেই। খাবারদাবারগুলো উনুনের পাশে গাদাগাদি করে গরমে রাখা।

কোনমতে সে সব টেবিলে পৌঁছে দিয়ে, বনমালী উমাদিদিকে বলল, ‘আর আমি পারছি না দিদি, বড্ড শরীর খারাপ লাগছে।’ বলে ঊর্ধ্বশ্বাসে খিড়কিদোরের দিকে ছুটল।

বেশি দূরে যেতে হল না। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ন্যাপা এসে গায়ের উপর আছড়িয়ে পড়ল। সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে, মুখে গলায় রক্তের ছোপ, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। ধড়াস করে খিড়কি-দোর বন্ধ করে বনমালী বলল, ‘ন্যাপা, আবার কী সর্বনাশ করে এলি রে, বল্‌ শিগগির?’

দেয়ালে ভর দিয়ে বিবর্ণ মুখে ন্যাপা বলল, ‘মাইরি বলছি, কারও অনিষ্ট করিনি। আমার পিছন পিছন কাউকে আসতে দেখলে দাদা?’

‘কই, না তো, কে আবার আসবে?’

রান্নাঘরের রকের উপর বসে পড়ে ন্যাপা বলল, ‘কী জানি! মনে ভাবলাম ওর গোটা দুত্তিন হাতিয়ে নিলেই আমাদের এ-জন্মের ভাবনা-চিন্তা ঘুচে যাবে। মোড়ের মাথায় গিয়ে ওই অন্ধকার জায়গাটায় লুকিয়ে থাকি, উনি পার হয়ে গেলে পর, পিছন থেকে মাথায় এক বাড়ি দিয়ে—অমন করে তাকাচ্ছ কেন, কাউকে কোনদিন প্রাণে মেরেছি বলতে পার? মারিনি, কিছু করিনি। উনিও পার হয়ে গেছেন, আমিও যেই লাঠি তুলেছি, অমনি কোথা থেকে সে যে কী বিকট দুটো কুকুর এসে আমাকে আক্রমণ করল সে আর কী বলব দাদা! এই প্রকাও কালো পোড়া হাঁড়ির মত মুখ, বুকের উপর বাঘের মত থাবা তুলে লাফিয়ে উঠে পট-পট করে জামার সব কটা বোম দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিল গো! অন্যটা দেখতে কী সুন্দর, লাল লাল লম্বা লম্বা লোম, আগুনের ভাঁটার মত চোখ করে আমার গলাটা ছিঁড়ে নিতে চেষ্টা করছিল। ওইখানেই লাঠি ফেলে দিয়ে কোনরকমে পালিয়ে বেঁচেছি। উঃ! কোত্থেকে যে এল বুঝলাম না। তারপর দৌড়তে দৌড়তে একবার ফিরে দেখি ওনার সঙ্গে সঙ্গে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে ঘরের দাওয়ায় গিয়ে উঠল। আশ্চর্যের বিষয়, এত কাণ্ড ঘটে গেল, বুড়ি একবার ফিরেও দেখল না।

বনমালীর হাত-পা কাঁপছিল, মুখে কথা সরল না। কোন মতে ন্যাপাকে ধরে তুলল, ‘ন্যাপা, প্রতিজ্ঞা কর, অমন কাজ আর করবি নে। কী বাঁচা বেঁচেছিস রে ন্যাপা! জানিস, আমি নিজের কানে শুনলাম মাসিমা বলছেন, ওই কুকুর দুটো ওনাদের বড় আদরের ছিল, চল্লিশ বছর হল মরে গেছে। ও কি, ও ন্যাপা, আবার বসে পড়লি যে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *