ন্যান্সিমণি

ন্যান্সিমণি

এখন বর্ষা, এদিকে রোজই বৃষ্টি হচ্ছে। বন-পাহাড়, লাল মাটির উদলা রাস্তা, ভেজা; বিষণ্ণ। বৃষ্টির পর রোদ উঠলেই টিয়ার দল তিরের ঝাঁকের মতো ওড়াউড়ি করছে এদিক থেকে ওদিকে। পেয়ারার বনে ঝাঁপাঝাঁপি করে, কিছু পেয়ারা খেয়ে, কিছু কামড়ে ফেলে; ভীষণ ব্যস্ত-সমস্ততাতে আবার উড়ে যাচ্ছে অন্য গন্তব্যের দিকে। তিতিরগুলো করুণ গলায় কাঁদে এইসব বিধুর বিকেলে। টুপটাপ করে জল পড়ে গাছগাছালির পাতা থেকে। দূরাগত এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো শব্দ করে পুরুষালি গন্ধ বয়ে নিয়ে বৃষ্টি আসে, পাহাড় পেরিয়ে, কোনো নরম সবুজ নারীর জঘনের মতো ঘন বনে রোমাঞ্চের কাঁটা তুলে। চোখের সামনে তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে তরতাজা নতুন লাগানো গাছ, বিমুগ্ধ মায়ের চোখের সামনের প্রথম সন্তানের মতো।

এই সময় কোথাওই যেতে ইচ্ছে করে না আমার। এই আলস্য, এই অবকাশের আদিগন্ত কর্মহীনতার নিরবচ্ছিন্নতার আনন্দ ছেড়ে। কিন্তু ডেরার হাতার গা-দিয়ে বয়ে-যাওয়া পাহাড়ি নদীতে এখন ঢল নেমেছে। একদল সবে স্কুল-ছুটি-হওয়া ছেলে-মেয়ের মতো কলকল করতে করতে বয়ে চলেছে জলরাশি, পাথরে লাফিয়ে উঠে, আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে। চালোয়া মাছ আর পাহাড়ি পুঁটি ধরবার জন্যে অর্ধ-উলঙ্গ ছেলে-মেয়েরা নানারকম গবেষণা ও প্রক্রিয়া চালাচ্ছে এখন নদীতে। এই জঙ্গলে-ঘেরা পরিবেশে গোরুর গলার কাঠের ঘণ্টা-বাজা নরম নিভৃত উত্তেজনাহীন একঘেয়েমিতে ছেদ টেনেছে ওরা।

ধানের বীজ কিনতে রওনা হয়েছি আমি ছাতা হাতে, সঙ্গে বাড়ির মালি। চলেছি, স্টেশানের দিকে। আজ বড়ো হাট আছে, চাঁদোয়া-টোরীতে। সেই হাটে গেলেই ভালো ধানের বীজ পাওয়া যাবে। সেই ধান এসে ছড়াব নীচু জমিতে। ঝরনার ধারে ধারে। ধান হবে প্রথম শীতে। নিজেদের খেতের ধান, হাতের ধান; বড়ো মিষ্টি লাগে খেতে। এই ধানের চালে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ছোঁয়াচ লেগে তা বাজার-কেনা অন্য চালের সঙ্গে একেবারেই আলাদা হয়ে পড়ে। অর্থসংস্থান আদৌ কতখানি হয়; অথবা লোকসানের বোঝাই বা কতখানি, তা নিয়ে আমার মতো কমবয়েসি ও অনভিজ্ঞ শহুরে-চাষি কখনো ভাবে না। নিজের খেতের মোটা, লাল, মিষ্টি ধানের চাল চামনমণি চালের চেয়েও বেশি দামের।

টোরী স্টেশানের আগে একটাই স্টেশান পড়ে। তার নাম মহুয়া-মিলন। পৃথিবীর সমস্ত সময় করতলগত করে খয়েরি অজগরের মতো ট্রেনটা চলেছে পাহাড়-জঙ্গলের নগ্নতার নির্মোক ছিঁড়ে। ফিসফিস করে বৃষ্টি পড়ছে। এখানের ট্রেনগুলো দেখলে বোঝা যায় যে, ভারত সত্যিই এক স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র! কেউই প্রায় টিকিট কেনে না। ফার্স্ট-ক্লাসের টিকিট যারা কেনে তারাও অন্য মানুষ এবং ছাগল-শুয়োর-হাঁস-মুরগির সঙ্গে একীভূত হয়ে একই কামরায় সহাস্যে সহাবস্থান করে বিনা প্রতিবাদ এবং অনুযোগে। এত লোক নামল যে, টোরী স্টেশানে ট্রেনটা প্রায় খালিই হয়ে গেল। দূর দূর বহু জায়গা থেকে লোক এসেছে হাটে। খিলাড়ির সিমেন্ট-ফ্যাক্টরি আর কয়লা-খাদ থেকেও। অন্যদিক থেকেও আসে লাতেহারের লোক অবধি।

স্টেশানে পা দিয়েই আমার দুটি চোখ আটকে গেল। চারদিকের আফ্রিকার আগ্নেয়গিরির লাভামিশ্রিত কালো মাটির রঙের মধ্যে হঠাৎ একটা গাঢ় কমলা রঙা পুর্টোলেকা ফুল অবাক করল আমাকে। তার গায়ের রং টাটকা-তোলা পাকা কমলালেবুর মতো, গায়ে একটি কমলা রঙা শাড়ি, সাদা হাত-কাটা ব্লাউজ। খালি পা। তার ঠোঁটে শ্রীরামপুরের ইটের মতো ফিকে লালচে পানের দাগ। দুটি পা বুকের কাছে গুটিয়ে সে প্ল্যাটফর্মে বসে আছে, সামনে একটি ঝুড়ি নিয়ে। তার পাশে একটি অল্পবয়েসি ওঁরাও ছোকরা। কালো ফুলপ্যান্ট আর সাদা গেঞ্জি পরা।

যথাসম্ভব কম ঔৎসুক্য দেখিয়ে মালিকে জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েটি কে?

মালি বলল, ন্যান্সিমণি!

নাম শুনে অবাক হলাম ন্যান্সিরা সাধারণত ডিয়ার বা ডার্লিং হয় মণি হয় না।

ওর জাত কী?

মালি হাঁটতে হাঁটতে হাটের দিকে যেতে যেতে বলল, কেরেস্টান। ও মেমসাহেব হচ্ছে।

বুঝলাম, ন্যান্সিমণি অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান। এই অঞ্চলে অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানরাই প্রথমে এসে বসতি করে। আজও কিছু কিছু নিরুপায় মানুষ রয়ে গেছে, যারা অস্ট্রেলিয়া বা কানাডায় যেতে পারেনি, অথবা যায়নি এই আশ্চর্য রূপসি বনাঞ্চলের প্রেমে পড়ে গিয়ে। এই সম্প্রদায়ের কিছু দরিদ্রতম মানুষ তাঁদের এককালীন সমস্ত দম্ভ ও জাঁককে কবর দিয়ে বড়ো করুণ জীবনযাত্রা যাপন করেন এখানে।

মালি আবার বলল, সাহেব হলে কী হয়? সাহেবরা তো এখন খেতেই পায় না। তেমনই সাহেব। ন্যান্সিমণি ওই ছেলেটার সঙ্গে থাকে। ও মুসলমান। নাম তসলিম। জাত বদলে, মুসলমান হয়ে বিয়ে করেছে। জাত না-বদলালে মুসলমানরা কাউকে বিয়ে করে না।

ও। আমি বললাম।

তো, ও থাকে কোথায়? তোমার ন্যান্সিমণি?

কেন? গঞ্জেই থাকে। কঙ্কার ওদিকে। শুনেছি সারাদিন ঘুঁটে দেয়। গোরু আছে দুটো। তসলিম খিলাড়ির কয়লা-খাদে কাজ করে। শুনেছি, ওদের ডেরা একেবারে শুনশান সান্নাটা জায়গায়। করোরই যাতায়াত নেই ওদিকে। আমিও যাইনি কখনো।

ছেলেপিলে নেই ওদের?

না:। ও বাঁজা। ভারি ছেনাল মেয়েছেলে…যার তার সঙ্গে…

আলোচনার বিষয় আমার আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে আমি চুপ করে গেলাম।

মালিটা ভেবেছে কী নিজেকে? ও যেন নিজেও ন্যান্সিমণির লেভেলের মানুষ, এমনভাবেই কথা বলছে। পয়সা নেই বলে বেচারি ন্যান্সিমণিকে নিয়ে সকলেই আলোচনা করবে?

কথাটা হৃদয়ংগম করেই আমার বুক ভেঙে যেতে লাগল। ভয়ও করতে লাগল। তাকে, প্রথমবার দেখেই এমন দরদ উথলাল কেন?

মালিকে ধমকে বললাম, যে-জিনিস তুই নিজের চোখে না দেখেছিস তা কখনো বলবি না। বললেই, মার খাবি আমার কাছে। আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিল।

মালি হেসে বলল, বাবু, এই দুনিয়াতে কিছু কিছু ঘটনা থাকে, যা নিজের চোখে না-দেখেই বিশ্বাস করতে হয়। কারণ, সেসব ঘটনা কখনোই কারো চোখের সামনে ঘটে না। বলেই, ধূর্তামির হাসি হাসল।

কথা বাড়ালে বিপদ দেখে বললাম, কোথায় ধান? চল সেই দিকেই যাই।

মস্ত হাট। গোরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, আনাজপাতি, গোরুর মাংস, পাঁঠার মাংস, শুয়োরের মাংস এসব বিক্রি হচ্ছে। মাছ বিশেষ নেই। পাহাড়ি নদীতে-ধরা সামান্য চালোয়া ও অন্যান্য মাছ ছাড়া। কিন্তু যে-কারণে আলস্যের নির্মোক ছিঁড়ে এত দূরে এলাম, সেই বস্তুটিই নেই। ধান ওঠেনি আজও। কেন ওঠেনি, তা কেউই বলতে পারল না। একজন শুধু বলল, কুরু বস্তি থেকে একটি লোকই আসে ধানের বীজ নিয়ে প্রতিহাটে, কিন্তু তার বউকে কাল রাতে সাপে কেটেছে, তাই-ই সে আসেনি। ঊরুতে কেটেছে সাপে। কালো গহুমন সাপ।

তার বউকে কেটেছে কালো সাপ ঊরুতে, আমাকে কেটেছে কমলা-রঙা সাপ—বাঁ-দিকের বুকে। কুরুর বস্তির বউ যদি বা বাঁচে, বাঁচতেও পারে, কিন্তু আমি মরেছি। আমি জানি যে, আমি মরেছি নি:সন্দেহে।

স্টেশনে ফিরে যখন এলাম, তখন বেলা পড়ে গেছে। ট্রেন লেট। এখানে লেট হওয়ার কোনো মা-বাপ নেই। এখানের বাসিন্দাদেরও সত্যিকারের কোনো মা-বাপ নেই। কিন্তু এদের মিথ্যে মা-বাবাদের মাঝে-মাঝে দেখা যায়। পাঁচ বছর বাদ বাদ নির্বাচনের আগে, জিপগাড়ি আর মোটরগাড়ির ভিড়ে, রাজহাঁসের গায়ের মতো সাদা খদ্দরের পোশাক আর খুনির মতো মুখের কতগুলো পাজি লোকের গমগমে বক্তৃতাতে বোঝা যায় যে, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, সব প্রতিশ্রুতিই টিয়া-ঠোকরানো পেয়ারার মতো ভোটাভুটির পরই হতাশার মাটিতে ঝরে যায় এবং তা এদেশীয় রাজনীতিকদের মতো খল ও চতুর শিয়ালেই খেয়ে যায় রাতের বেলা। গত তেত্রিশ বছরের সমস্ত প্রতিশ্রুতির এক-শো ভাগও রাখা হলে এই অঞ্চল এবং হয়তো এই দেশ এমন থাকত না। তবু, এদের উত্তেজনা বলতে ওইটুকুই! ওই তামাশা! প্রতি পাঁচ বছর বাদে বাদে ভোট দেওয়ার বদলে পাঁচটা-দশটা টাকা পাওয়া, পেটভরে মাটিতে বসে খিচুড়ি খাওয়া এক-দু-দিন—এই-ই…এই-ই…সব।

উত্তেজনা ওদের যেমন নেই, আমারও ছিল না। কিন্তু ন্যান্সিমণিকে দেখার পর থেকেই আমার উত্তেজনার কোনো সীমা নেই। মাঝে মাঝে এমনই হয়। কাউকে কাউকে হঠাৎ দেখে মনে হয়, যেন কৈশোরের পর থেকে বহুবার শেষরাতের অস্পষ্ট, আরক্ত, কাউকেই-বলা-যায়-না এমন সব স্বপ্নে এই সুন্দর মুখটিকেই দেখেছিলাম। যেন এরই সঙ্গে দেখা হবে বলে এত বছর চান করেছিলাম, দাড়ি কামিয়েছিলাম, প্রেমের গান শুনেছিলাম এবং গল্প পড়েছিলাম।

আমি, শিক্ষিত, শহুরে, মার্জিত-রুচি, সভ্য একজন মানুষ। আমি এক আকাশ মেঘের নীচের ভেজা ইউকালিপটাস গাছের ভুরভুরে মিষ্টি গন্ধের মধ্যে খোলা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে এমন একজন ঘুঁটে-কুড়ানিকে কেন যে এমনভাবে দেখতে গেলাম আর আমার সর্বনাশ ডেকে আনলাম তা অপদেবতারাই জানেন। আমার খিদে গেল, ঘুম গেল, জীবনের আর সমস্ত ভালো কিছু সম্বন্ধে ঔৎসুক্য ও স্পৃহা হঠাৎই বুকের মধ্যে মরে গেল। আমি জানি যে, যে-কটা প্রিয় বই নিয়ে এসেছিলাম এবারে কলকাতা থেকে, তার একটাও পড়া হবে না। ফিকশান তো ঘটনার আর কল্পনারই নামান্তর। আমি এখন জীবনের এক উত্তাল কেন্দ্রবিন্দুতে এসে স্থির দাঁড়িয়েছি। তসলিম-এর সঙ্গে কল্পনায় নানারকম যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেছে। ওকে কোনভাবে, কোথায় ওয়েলেইড করে বন্দুক দিয়ে মারা যায় তাও ভাবছি। বন্দুক ছুড়লে আওয়াজ হবে, তার চেয়ে কোথাও কোনো নির্জন জায়গায় টাঙ্গির একটা ক্লিন-কোপ অথবা টিপিক্যাল সভ্যবাবুদের মতো মসৃণ মাফিয়া কায়দায় ওর মালিকের মাধ্যমে ওর চাকরিটা কোয়াইটলি খেয়ে দেওয়া। তার পর? ন্যান্সিমণি তো আমারই। আমারই একার।

ন্যান্সিমণিকে বিয়ে করতেও আমার এতটুকু আপত্তি নেই। ওকে রানির মতো করে রাখব আমি। দাস-দাসী, বেয়ারা-বাবুর্চি। ছোট্ট লাল-রঙা ফিয়াট কিনে দেব একটা। মাথায় হলুদ সিল্কের স্কার্ফ জড়িয়ে, ডান হাতে প্ল্যাটিনামের বালা আর বাঁ-হাতে রুপোলি ব্যাণ্ড-লাগানো ছোট্ট রূপোলি ঘড়ি পরে ও জঙ্গলের পথে গাড়ি চালাবে। পাশে বসে থাকব আমি। ভেজা জঙ্গলের ফুল পাতার গন্ধ-ভরা হাওয়া হু হু করে লাগবে এসে নাকে। ন্যান্সিমণিকে আমি আমার সম্পূর্ণ মালিকানায় পেতে চাই। একবারের জন্যে নয়; একদিনের জন্যে নয়; চিরদিনেরই জন্যে।

ঘোরের মধ্যে ট্রেনে চড়লাম, ঘোরের মধ্যেই অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে কাদাময় বনপথে সাপ-বিছের ভয় বেমালুম ভুলে ঘোরের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছোলাম।

মালিকে বললাম, তাড়াতাড়ি খিচুড়ি চাপাও। আমার ঘুম পেয়েছে খুব।



পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে—চা-টা খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম স্টেশানে। এমন ঘুমন্ত ছোট্ট জায়গায় স্টেশানই হচ্ছে পাবলিক-রিলেশানস অফিস, খবরের কাগজ, পরনিন্দা-পরচর্চা এবং পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চেরহেডকোয়ার্টাস। স্টেশন মাস্টারের ঘরের মধ্যে অথবা বারান্দার বেঞ্চে চোখ কান খুলে বসে থাকলে স্যাটেলাইটের পক্ষেও যে খবর পাওয়া দুরূহ সেই খবরও আপনিই কর্ণগোচর হয়। সেই ভরসাতেই গেলাম। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়; ন্যান্সিমণি কোথায় থাকে, তার বাড়ির ঠিক লোকেশানটা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করা নিজেকে। মালিকে আর কিছু জিজ্ঞেস করাতে বিপদ ছিল।

বেলা এগারোটা নাগাদ একটা ভবঘুরে বিশ্বনিন্দুক ছোঁড়া এল। ও স্টেশানে মরশুমি ফল বেচে। মিসেস কার্ডির দোকানের পাশে বসে। তাকেই কতগুলো ট্যানজেন্ট ও হাইলি ইমপার্সোনাল প্রশ্ন করে জানা গেল ঠিক কোথায় ন্যান্সিমণির বাড়ি। এও জানা গেল, ন্যান্সিমণি তার স্বামীর ওপর মোটেই সন্তুষ্ট নয়। খিলাড়ির কয়লা-খাদে কাজ করে বলেই বিয়ে করেছিল, বিয়ের পর জানা গেছে যে, ও আসলে ওয়াগন-ব্রেকার। কয়লার ওয়াগন ভেঙে কয়লা এনে বিক্রি করে সকলের বাড়ি বাড়ি। সবরকম নেশা-ভাং করে। ন্যান্সিমণিকে মারধোরও করে। ন্যান্সিমণি শিগগিরি ওকে ছেড়ে দিয়ে নাকি অন্য মরদ ধরবে।

স্টেশান থেকে ডেরাতে ফিরে আসতে আসতে খুব খুশি খুশি লাগতে লাগল। তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশের জন্যে এ যে একেবাররে আইডিয়াল সিচুয়েশান। মানে, অ্যাট দিস জাংচার অফ দেয়ার লাইভস—সম্পর্কটাকে ডিভাস্টেটিংলি পাংকচার করে দিয়ে পৃথ্বীরাজের মতো ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়ে সামনে আমার আগুন-পারা বউকে বসিয়ে টগবগিয়ে ফিরে আসা। ন্যান্সিমণির জন্যে সমাজ-সংস্কার, অতীত-বর্তমান এমনকী ভবিষ্যতের সবটাই আমি ভুলে যেতে রাজি।

চান করে খেতে বসে ভাবছিলাম কী অজুহাতে দুপুরবেলায় ওই নির্জন বনের মধ্যে একলা-থাকা আমার স্বপ্নের সুন্দরীর কাছে যাওয়া যায়? একমুহূর্ত ভাবতেই প্রবলেম সলভড হয়ে গেল।

খেয়ে দেয়ে, সামান্য জিরিয়ে নিয়ে, শিকারে বেরুবার জামাকাপড় পরে ফেললাম। পায়ে গামবুট। পথে বড়ো কাদা। কাদা, প্রেমকে ক্লেদাক্ত করে। তবে পাদুকা এবং পোশাক আদৌ অভিসারে যাওয়ার মতো হল না।

বাড়ি থেকে বেরোবার সময়ে মালিকে বললাম, তিতির মারতে যাচ্ছি। মশলা বেটে রাখতে। তিতিরের কাবাব আর রোস্ট হবে। সালিমের দোকান থেকে বাখরখানি রোটি নিয়ে এসে রাখবি। ব্যাস।

মালি সখেদে বলল, তিতির পিটাকে কেয়া হোগা হুজৌর, একঠো বড়কা শুয়োরোয়া ধড়কা দিজিয়ে খানেমে, মজা আয়েগা।

অভিসারে যাওয়ার সময় শুয়োরের নাম করায় আমার রাগ হয়ে গেল। বললাম, যা বলছি, তাই-ই কর। বেশি কথা বলিস না।

জায়গাটা দারুণ। একেবারে পঞ্চবটীরই মতো। দূর থেকে পর্ণকুটিরটাকেও মনে হয় যেন ছবি একটি। দুটি সাদা দুধেল গোরু হাম্বা-হাম্বা করে ডেকে উঠল। পাহাড় থেকে নেমে যখন নীচের ঢালে পা দিলাম তখন বৃষ্টিভেজা বনের গন্ধে, ছোটো ছোটো মৌটুসকি পাখিদের ফিসফিসে-কিসকিসে ডাকে মনটা বড়ো কান্না-কান্না লাগতে লাগল।

আর একটু এগিয়ে যা দেখলাম, তা আমি আমার বাইশ বছর বয়েসে আগে দেখিনি কখনো। মনে হল, আমার হৃৎপিন্ডটা ছিটকে বেরিয়ে যাবে খাঁচা থেকে। শুধুমাত্র কোনো কিছু দেখেই যে কারো এত কষ্ট-ভরা আনন্দ হতে পারে, এমন উত্তেজনা; তা আমার অজানা ছিল। দেখি, ঝিরঝির করে বয়ে-যাওয়া ওদের বাড়ির পেছনের পাহাড়ি নদীতে ন্যান্সিমণি চান করছে। শাড়ি-জামা খুলে রেখেছে পাথরে, আর অন্য পাথরে কেচে-রাখা ছাড়া শাড়ি জামা।

আমি কী করব ভাবছি। ন্যান্সিমণি আমার দিকে পাশ ফিরে বসে, জলে কোমর অবধি ডুবিয়ে চান করছে। লাল-ঠোঁট দুধলি হাঁসের মতো দুটি বুক দুলে উঠছে ওর নড়াচড়া করার সঙ্গে সঙ্গে। তাড়াতাড়ি আমি একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়তে যেতেই ঝোপের গায়ে সড়সড় করে শব্দ হল। ন্যান্সিমণি চোখ তুলে চেয়েই হাসল।

বলল, সো আর্লি? ইউ মাস্ট বি ক্রেইজি। গো টু মাই রুম। অ্যাম কামিং।

ব্যাপারটা কী হল বুঝতে না পেরে আমি তাড়াতাড়ি চলে এলাম ওখান থেকে। দরজা ভেজানো ছিল চাপ দিতেই খুলে গেল। ভেতরে বড়ো অন্ধকার—জানলা বন্ধ। আমি বাইরেই এসে, গাছের ছায়ায় একটা কাটা-গাছের গুঁড়িতে বসলাম। হাঁপাচ্ছিলাম আমি। ক্লান্তিতে নয়; উত্তেজনায়।

কিছুক্ষণ পর ন্যান্সিমণি এল। শুধু গায়ে, একটা কালো শাড়ি জড়িয়ে। তাকে কেমন যে দেখাচ্ছিল, তা বোঝাবার মতো ভাষা আমার নেই।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।

ও বলল, খাওয়ার সময়টুকু দেবে তো? না, তাড়া আছে খাঁ সাহেবের?

খাঁ সাহেব? আমি অবাক হলাম।

কিন্তু কিছুই বললাম না।

বললাম, না তাড়া নেই।

ন্যান্সিমণি দুটো শুকনো রুটি আর একটু ঝিঙের তরকারি আর গুড় নিয়ে এসে বসল বারান্দার মোড়াতে। খেতে খেতে বলল, চা খাবে?

আমার হাত-পা অসাড় লাগছিল।

বললাম, খেতে পারি।

ন্যান্সিমণির খাওয়াটাও কী আশ্চর্য সুন্দর! দারুণ পেলব আঙুল দিয়ে ছোটো ছোটো করে রুটির টুকরো ছিঁড়ে কেমন আলতো করে মুখে দিচ্ছিল। এমন কোনো মেয়ে, কোনো খাবার, তার সুরেলা আঙুলে ছিঁড়ে, সুচারু দাঁতে কাটবে বলেই বোধ হয় পুরুষেরা সারাদিন কাজ করে। অন্তত, তাদের করা উচিত।

খাওয়া শেষ করে ও ভেতরে গেল। গিয়ে দু-কাপ চা নিয়ে এল কলাই-করা গ্লাসে।

চা খেতে-খেতে বলল, বন্দুক নিয়ে কেন? আমার এখানে কোনো ভয় নেই। লোকে ভালোবাসতেই আসে এখানে। মারামারি করতে নয়।

তার পর চায়ে শেষচুমুক দিয়েই বলল, এসো।

আমি ঘরে ঢুকতেই ঘরের হুড়কো আটকে দিল ও ভেতর থেকে।

বলল, খাঁ সাহেব বাজার বড়ো খারাপ। কী দাম সব জিনিসের! আমি আজকাল কুড়ি করে নিচ্ছি। কিন্তু তোমার কাছ থেকে কিছু নেব না। তুমি সিমেন্ট কোম্পানির সাহেবদের বলে তসলিমকে একটা চাকরি করে দাও। তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ যে, আমি কেমন মেয়ে ছিলাম। যা এখন করছি তা করবার কথা ভাবলেও হয়তো আত্মহত্যা করতাম এক সময়ে। কিন্তু খিদে আর সম্ভ্রম বড়ো আজীব জিনিস। নিজের পেটের খিদে মেটাবার জন্য অন্যের পেটের অন্য খিদে মেটাচ্ছি। নিজের সম্ভ্রম বিকিয়ে, স্বামী-ছেলের ঘর করার সম্ভ্রমের পথ তৈরি করছি। বড়োই অসহায় আমি। তসলিমকে যে আমি বড়ো ভালোবাসি খাঁ সাহেব। আমার এই কাজটা তোমার করে দিতেই হবে। আদর কী করে করতে হয়, আর খেতে হয় তা তোমাকে আমি দেখাব খাঁ সাহেব। আমি লোক ঠকাই না।

একটানা এইসব কথা বলতে বলতেই ন্যান্সিমণি একটানে তার কাপড় খসিয়ে সম্পূর্ণ বিবস্ত্রা হয়ে গেল। বাইরের বর্ষার অন্ধকারের ভারে অন্ধকারতর ঘরে হঠাৎ কমলা-রঙা আগুন জ্বলে উঠল। আমি নিরুচ্চারে এক তীব্র অনভ্যস্ত দৃশ্যর ভালোলাগায় এবং ঘেন্নাতেও আর্তনাদ করে উঠলাম।

একটি দারুণ রোমান্টিক; নারী সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ; অবিবাহিত যুবকের বুকের মধ্যে সেইমুহূর্তে পৃথিবীর তাবৎ ঘুঘুর ডাক, বৃষ্টির শব্দ, চাঁদের মখমল-নরম রুপোঝুরি আলো সমস্তই রাতারাতি মরে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে আমি ঘরের বাইরে এলাম। সঙ্গে আমার টাকাও ছিল না যে, টাকা দিয়ে আসব কিছু ওকে। আমার পেছন পেছন আত্মবিস্মৃত ন্যান্সিমণি উলঙ্গ হয়ে দৌড়ে এল কিছুটা।—হয়তো অপমানিত হয়ে, হয়তো আমি মানুষটা সত্যি কে তা জানবার জন্যে; হয়তো প্রতিশোধ নেবারও জন্যে আমার ওপর।

কিন্তু আমি একবারও পেছনে না-চেয়ে থামলাম এক্কেবারে ডেরাতে এসে। গামবুট পায়ে কি দৌড়োনো যায়? গণ্ডারের মতো থপথপ করে দৌড়ে এলাম।

যা চাইলেও পাওয়া যায় না, তার জন্যেই আমার চিরদিনের কাঙালপনা। যা না-চাইতেই পাওয়া যায়, তা বড়ো খেলো, মূল্যহীন; অসার। ঘৃণারও হয়তো বা।

মালি বলল, তিত্বর কাঁহা!

আমি হাঁপাচ্ছিলাম। উত্তর দিলাম না।

মালি বলল, শুয়োরোয়া পিটা গৈল বাবু?

আমি বললাম, চুপ কর।

তিতিরও নয়, শুয়োরও নয়, একটা বড়ো সুন্দর কিন্তু নিরেট বোকা পাখি একটু আগে অসহায়ভাবে মারা গেছে। মরে গেছে যে প্রচন্ড কষ্ট পেয়ে আমারই বুকের মধ্যে চিরদিনের মতো। সেই প্রেমের পাখি আমার বুকের দাঁড়ে আর কখনো বসবে না এসে। তার ডাকে উতলা, উন্মত্ত, উদবেল করবে না আর কখনো আমাকে। মেয়েদের সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ আমার যা-কিছু কল্পনা, লজ্জা, দুর্বলতা, ঔৎসুক্য এবং মধুর অজ্ঞানতা সবই ন্যান্সিমণি তার নগ্ন শরীরের কমলা-রঙা আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *