ন্যাংটাকে ভগবানও ডরান

‘–ন্যাংটাকে ভগবানও ডরান—’

কী করে হঠাৎ একরাশ টাকা আমার হাতে এসে পৌঁছল, সেটা দফে দফে বুঝিয়ে বলা শক্ত। দরকারও নেই। মোটামুটি বলতে পারি, অনেকটা লটারি জেতার মতো।

কিন্তু বিপদ হল, টাকাটা যার মারফৎ এসেছিল, তাঁকে নিয়ে। তিনি লন্ডনের বিকটতম উন্নাসিক এক দর্জির দোকানে কাজ করেন। সে দোকান নাকি রাজ-পরিবারের বাইরের কারও জন্য অর্ডার নেয় না। সেই কর্ম-প্রতিষ্ঠানে না আছে সাইনবোর্ড, না আছে টেলিফোন-কেতাবে তাদের নাম, নম্বর। তাদের প্রাইভেট নম্বর শুধু রাজ-পরিবার জানেন। অন্য লোকে সন্ধান পাবেই-বা কী করে!

আমি বাস করতুম তারই বাড়িতে। বাড়ির জেল্লাই কিছু কম নয়। বাকিংহাম প্যালেস পেরিয়ে হাইড পার্ক গেটে তার ভবন। সে রাস্তাতেই থাকেন আর্টিস্ট এপসটাইন (না রোটেনস্টাইন, ঠিক জানিনে) ও চার্চিল সাহেব। আমি সেথায় আশ্রয় পেলুম কী করে? সেই খলিফের খলিফে গিয়েছিলেন হল্যান্ডে। সেথাকার রাজকন্যার বিয়ে হবে। বরের বিয়ের বেশভূষা তৈরি করতে। অতিশয় অনিচ্ছায়, দেশের আপন রাজার আদেশে। সেই বিদেশের রাজধানীতে পথ, হোটেলের নাম সব হারিয়ে যখন গা গার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তখন আমি তাকে কিছুটা সাহায্য করতে পেরেছিলুম। ব্যস! হয়ে গেল। তিনি সেখান থেকে পড়কে আমাকে লন্ডন নিয়ে এলেন। তদবধি তার ভবনে বাস। অবশ্য স্বীকার করব, লোকটি দ্র। আমি অন্যত্র সস্তা জায়গায় থাকলে যে কড়ি শুনতুম, তিনি সেটি সপ্তারম্ভে সহাস্যে নিতেন। পাছে আমি লজ্জিত হই, আমি মুফতে আছি।

আমি বললুম, কী ধরনের কাপড়ে স্যুটটি হবে সে বাবদে আমারও তো কিছু রুচি থাকতে পারে। দেখি, কাপড়ের নমুনা।

পাগলামিতে হাতেখড়ি হচ্ছে হেন লোককে যেভাবে ডাক্তার প্রণব রায়ের মতো লোক হ্যাঁন্ডিল করেন, সেইভাবে সদানন্দ হাস্য হেসে বললেন, বৎস, তোমাকে গুটিকয়েক প্রশ্ন শুধোই। তোমার যখন বিয়ে হয়, তখন গুরুজন তোমার ওই রুচির কথা শুধিয়েছিলেন?

সত্যের অনুরোধে আমাকে নিরুত্তর থাকতে হল।

 আর এ তো সামান্য স্যুট। অবশ্য তুমি কুতর্ক করতে পার, সামান্য জিনিসেই বরঞ্চ আপন রুচিমাফিক জীবনানন্দ লাভ করা যায়। কিন্তু এ তো সামান্য জিনিস নয়, এ ব্যাপারটি অসামান্য। ভেরি ভেরি ইমপরটেন্ট। নইলে কও, এরই মেহেরবানিতে আমি বাড়ি গাড়ি হাকালুম কী প্রকারে? অতএব বুঝিয়ে কই।

গভীর দম দিয়ে মি. সিরিল হজসন-জবসন ফজ-রোবসন বললেন, উপস্থিত নববসন্ত সমারম্ভ। তুমি এসব স্যুট পরবে নিদাঘের অন্তিম নিশ্বাস থেকে হেমন্তের শেষান্ত পর্যন্ত। এইবারে শোনো বস, তত্ত্বকথা। শিশির বসন্ত নিদাঘ হেমন্ত প্রতি ঋতু অনুযায়ী বকিঙহম প্রাসাদ ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের পরিচ্ছদ ধারণ করেন। কিন্তু প্রতি বসন্তে একই বর্ণনা, প্রতি শিশিরে একই সর্ষপবর্ণ– অর্থাৎ নুন-হলদে না, একই বর্ণ না, একই বর্ণনা করা চলবে না।

প্রতি ঋতুর সমারম্ভে আমাদের একটি গুহ্যতম– টপমোস্ট সিরিট সভা বসে আসছে ঋতুর বর্ণ স্থির করার জন্য। যে বর্ণ স্থির করা হল, সেটা অত্যন্ত গোপনে রাখতে হয়। নইলে রাস্তার যেদো-মেধো সেই রঙের স্যুট পরে যত্রতত্র ঘোঁতঘোঁত করে ঘুরে বেড়াবে। তা হলে ডুক অব এডেনবরা যখন অ্যাসকটে নামবেন– না, সেখানে হাঙ্গামা কম, প্রশ্ন শুধু ওয়েসকিট নিয়ে–

আমি বাধা দিয়ে বললুম, ওয়েসকিট কী?

 চ্যাংড়ারা হালফিল যাকে ওয়েস্টকোট বলে।

আমি চুপ করে ভাবলুম, আমাদের দর্জিরা যখন ওয়াসকিট বলে, তখন মোটামুটি শুদ্ধ উচ্চারণই করে, এবং লাটসাহেবের লাটু উচ্চারণের মতোই প্রাচীন শুদ্ধ উচ্চারণ। বললুম, তা ওয়েসকিট নিয়ে দুর্ভাবনা কিসের?

তিনি অনেকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, তোমার ব্লাইন্ড স্পটগুলো যে খোদায় কোথায় কোথায় রেখেছেন, বলা শক্ত। এদিকে শেপিয়ার-বাইরন পড়েছ, অন্যদিকে মর্নিং স্যুটের ওয়েসকিটের মহিমা জানো না।

আমি একগাল হেসে বললুম, টায় টায় মিলে যাচ্ছে। ফ্রান্সের শ্যামপেন প্রভিনসের এক সমঝদার আমায় বলেছিল, তাজ্জব লাগে মসিয়ো, এদিকে আপনি মলিয়ের সারত্র পড়েছেন অন্যদিকে আপনি উত্তম মদ্য বর্দো বুর্গনের বুকের (Bouquet) তফাত ধরতে পারেন না! তা সে যাক গে। স্যুটের রঙের কথা কী যেন বলছিলে!

হু, আসছে সিজনে সমঝদাররা যেসব রঙের ওপর–রঙের ওপর ঠিক না, রঙের শেডের ওপর নয়াস্-এর ওপর কৃপা করবেন সেই অনুযায়ী তোমার স্যুটগুলো তৈরি করা হবে।

আমি শঙ্কিত হয়ে বললুম, গুলো মানে? কটা?

আপন ওয়েসকিটের সর্বনিম্ন বোতামটির উপর–ইটি কখনও খাজে ঢোকানো হয় না, যবে থেকে স্যুক অব উইনজার ফ্যাশানটি প্রবর্তন করেন– হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, তা, তা, গোটা বিশেক। আপাতত। পরে দেখা যাবে।

এর পর আর শঙ্কার কোনও কথা ওঠে না। আমি বললুম, যে টাকাটা ফোকটে পেয়েছিলুম, সেটা গেল। উপস্থিত লন্ডনে একটা নাতিভদ্র লাউনজ স্যুটের কেমও নিদেন– পাউন্ড ৫০/-/-, আড়ভালোরেম, আমাদের দিশি টাকায় প্রায় আটশো

বাধা দিয়ে বললেন, পাগোল! একটা সুস্থ (সোবার) স্যুটের দাম নিদেন– পাউন্ড 120/–/–

যখন পুনরায় চৈতন্যময় জগতে ফিরে এলুম তখন মি. (পরে তিনি স্যার হন) হজসন-জবসন ফজ-রোবসন আমার গলায় সাইফন থেকে সোডা-জলের সঙ্গে কড়া ব্রান্ডি মিশিয়ে তাই দিয়ে চো– ওঁ করে চাঁদমারি মারছেন– দমকলের লোক যেরকম হৌজ দিয়ে আগুন মারে।

আমার কোনও কিছু বলার মতো অবস্থা নয়। মি. হজসন (ইত্যাদি) বললেন, আকছারই এ-রকমধারা হয়। আমরা দমকল ডাকিনে। সাইফন দিয়ে কাজ চালাই। এই পদিনই ডুক্ অব কে।

আমি ক্ষীণকণ্ঠে বললুম, তা হলে আমার এই দিশি কোত-পালুন বন্ধক দিয়ে দেশের টিকিট কাটতে হবে নাকি?

সঙ্গে সঙ্গে বললেন, প্যাট কেম দি রিপ্লাই, খোলা বাজারে না, কিসসুটি পাবে না। তবে হ্যাঁ, আলবত, ব্রিটিশ মুজিয়াম পুর্না সব আরকিওলজিকাল কুররা কিনছে। অশোকের দাস্তানা, অর্জুনের পোর্টেবল অ্যাটম বম, দ্রৌপদীর প্রেসারকুকার-কম্-ফ্রিজ। কিন্তু তুমি অত ভয় পাচ্ছ কেন? আচ্ছা বল তো, পশুদিন রোদার যে মূর্তিটি বিক্কিরি হল, তার পাথরের দাম কত? বুঝতে পারলে তো প্রশ্নটা? স্রেফ পাথরের দাম? প্লেন মেটেরেলের দাম?

আমি মিনমিনিয়ে বললুম, পাথরের দাম আর কত হবে? মার্বেল বটে। টাকা তিরিশেক।

ওস্তাদ সোৎসাহে বললেন, ইয়েহ্! আর মূর্তিটি বিক্রি হল পাউন্ড 50,000/-। এইবারে একটু চিন্তা কর। তোমাকে যে ডজন দুই স্যুট বানিয়ে দেব, বাজারে তার দাম হবে, নিদেন, হাজার তিনেক পৌন্ড। কিন্তু মেটেরেলের দাম? স্রেফ উলের দাম কত হবে? রঢ়ীয়াহ সে বঢ়িয়াহ? পাউন্ড 50/-/- পাউন্ড 100/-/- অর্থাৎ ১৪০০ টাকা? আমি আরটিস্ট, আমি রোদা।

একটুখানি ভরসা পেয়ে বললুম, তা, তা, ডজন দুই, মানে কি না, অতগুলো সুটের কি সত্যই দরকার?

***

এর পর ওস্তাদ অত্যন্ত টেকনিকাল ভাষায় যেকথা বলেন সে আমি বুঝতে পারিনি, মনেও নেই। অতএব এখন যদি তার ফিরিস্তি ঠিক ঠিক না দিতে পারি, তবে পাঠক অপরাধ নেবেন না।

তিনি হুড়হুড় করে বলে যেতে লাগলেন–

মর্নিং স্যুট– স্ট্রাইপট ট্রাউজারস– অরিজিনাল ওয়েসকিট তার টপ এনডে সাদা সিলকের পাইপিং দেব কি?– টাইয়ের উপরে ডাইমনড পিন্ না পার্ল দেব? কোণভাঙা কলারের জন্য কোন কোমপানি উত্তম? স্প্যাটার ডেশেজ।

তার পর দেমি। পাতলুন যথা পূর্বং। কিন্তু কোটটা টেল নয়।

সে না হয় হল। দুপুরের লাউ স্যুটটি কী প্রকারের হবে?

সন্ধেয়? ডিনার জ্যাকেট? টেলস্?

 ইতোমধ্যে যদি গলফ খেলতে লোকটা গিয়ে থাকে?

 কিংবা সাঁতার কাটতে?

 কিংবা খেঁকশেয়াল শিকার করতে ঘোড়ায় চড়ে, জোডপুরী?

 কিংবা সে যদি অসুস্থ হয়ে তাবৎ দিন বিছানায় শুয়ে থাকে, তবে তার ড্রেসিং গাউন কী হবে?

আমার মুখে বিরক্তি দেখে বললেন, এই যে তুমি এখন লাউনজ স্যুট পরে আছ, এ তো ইংরেজের ডাল-ভাত। এর ওপর তার কী ধরনের কটা স্যুট দরকার হয় তার ফিরিস্তি দেওয়া বড়ই শক্ত। সে থাক। উপস্থিত তোমার সঙ্গে কিঞ্চিৎ ভাষা বাবদে আলোচনা হোক। আচ্ছা বল তো স্মক কাকে বলে?

জানিনে।

তা হলে বানান করছি, smoking

এরকম বিদঘুটে উচ্চারণ হতে যাবে কেন? ফরাসিরা তাই করে। অবশ্যি যারা অল্পস্বল্প দুনিয়ার খবর রাখে তারা বলে স্মকি! তা সে যাক গে, কিন্তু ফরাসিতে অর্থ হল ডিনার জ্যাকেট, টেলজ না। আবার ইংরেজিতে স্মোকিং জ্যাকিট অন্য জিনিস। অসকার ওয়াইডের বড় প্রিয় ছিল, আর ছিল ফিনসি ওয়েসকিট

আমি বাধা দিয়ে বললুম, ওয়াইলডের কথা কও, শুনতে রাজি আছি। কিন্তু তোমার এই বাহান্ন রকমের স্যুটের সুবারিক দেমাক আমার আর বরদাস্ত হচ্ছে না।

সিরিল বললেন, বট্ট্যে? তুমি যখন পাঁচ রকম ঔচে (উচ্ছে) বর্ণনা দিতে দিতে বারির চূড়ান্তে পৌঁছে গিয়ে বল, ইংরেজ রাসৃটিক, তেহোর কদর বোঝে না, তখন আমি বাধা দিই? তুমি যখন বারোরকম অ্যামবল (অম্বল)–

***

শ্ৰীযুক্ত নীরদ চৌধুরী যাই বলুন, যাই কন, জামাকাপড় বাবদে আমরা মুক্ত।

রাস্তা দিয়ে নাগা সন্ন্যাসী যখন যায়, তখন তো আমরা শুধোইনে, এটা হিন্দু না মুসলমান ড্রেস!!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *