নৌকা বাইচ ও জন্মাষ্টমীর উৎসব
স্কুলের ছাত্র হিসেবে সে আমলে গল্পের বই পড়া আর খেলাধুলার বাইরে অন্য কোনো বিনোদনের উপকরণ ছিল না বললেই চলে। খেলাধুলার মধ্যে আমার প্রিয় খেলা ছিল ফুটবল ও হকি। স্কুলের মাঠের চাইতে আমি হকি বেশি খেলেছি ঢাকার নবাববাড়ি তথা আহসান মঞ্জিলের চৌহদ্দির মধ্যে প্রাসাদের সামনের ছোট মাঠটিতে। আমি আর আমার সমবয়সী দু’তিনজন ওখানে খেলতে যেতাম। নবাববাড়ির কয়েকটি ছেলে দুর্দান্ত খেলতো। তরুণ ও যুবক খেলোয়াড়দের মধ্যে ইউসুফ রেজার নাম আগেই বলেছি। অসম্ভব ক্ষিপ্ৰগতি শর্ট কর্নার পেলে তার অব্যর্থ সুযোগ নিত।
নবাববাড়ির পেছনের দিকে নদীর ধার দিয়ে নির্মিত হয়েছিল সে যুগের জনপ্রিয় প্রভাতী ও বৈকালিন বেড়াবার জায়গা, বিখ্যাত বাকল্যান্ড বাঁধ। তখন ভিড় ছিল না, জলযানের মধ্যে দু’চারটে বজরা আর কিছু পানসি নৌকা বাঁধা থাকত এক অংশে। অন্য অংশে, বাদামতলী ঘাটের দিকে, কিছু পণ্যবাহী বড় বড় নৌকা এসে ভিড়ত। আমের দিনে বোঝাই করা আমের নৌকা। বাদামতলী ঘাটের লাগোয়া একটু পেছন দিকে ছিল আমপট্টি। গোটা অঞ্চলটায় আমের গন্ধ, খাবার পর পথের উপরেই ফেলে দেয়া আমের আঁটি ও খোসার স্তূপ, থিকথিকে কাদা, ব্যাপারিদের আনাগোনা, সব মিলে একটা অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু অন্যদিকে, অর্থাৎ নদীতীরে, বাকল্যান্ড বাঁধ ছিল খুবই রমণীয়, দূষণমুক্ত, চিত্ত প্রফুল্লকারী। আমরা ওখানে খুব বেশি বেড়াতে যেতাম না কিন্তু যখনই গিয়েছি খুব ভালো লেগেছে। প্রধানত সেটা ছিল প্রৌঢ় ও বৃদ্ধদের স্থান। তবে একটা সময়ে আমরা কিশোররাও সেখানে ভিড় জমাতাম। সেটা হলো নৌকা বাইচের সময়। খুব উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। বিভিন্ন গোষ্ঠীর সমর্থকরা ঢোল-করতাল সহযোগে নিজ নিজ দলের দাঁড়ি মাঝি মাল্লাদের অনুপ্রেরণা যোগাতেন। বার্ষিক নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা ছিল সত্যিই একটা জমজমাট ব্যাপার।
ওই সময়ে আরো দুটি উৎসবের কথা বেশ মনে আছে। প্রথমটি অবশ্য শোকের ব্যাপার কিন্তু কালের যাত্রার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হতে তা একটা উৎসবের রূপ পরিগ্রহ করেছিল। অন্তত অনেক মানুষের কাছে। যেমন ঘটেছে আজ আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারির ক্ষেত্রে। সেদিনের যে উৎসবের কথা বলতে যাচ্ছিলাম তা হলো মহররমের মিছিল। শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানরাই এতে অংশ নিত। মিছিল শুরু হতো হোসেনী দালান এলাকা থেকে। রূপালি কাজ করা নানা রকম ঝালর দেয়া জাফরি কাটা গম্বুজবিশিষ্ট, কতকটা তাজমহলের আকারের, তাজিয়া বানানো হতো। স্বাস্থ্যবান বলিষ্ঠ দেহ পেশিবহুল তেজী একটা শাদা ঘোড়াকে দুলদুল সাজানো হতো। লাঠি আর সড়কি হাতে যোদ্ধার ‘হায় হাসান, হায় হোসেন’ বলে মাতম করতে করতে রাস্তা দিয়ে ছুটে যেতো। ঢাকায় এখনো মহররমের মিছিল হয়, কিন্তু সেই জৌলুস আর নেই। তার একটা কারণ হয়তো মুগ্ধ আর বিস্মিত হওয়ার সেই কৈশোরিক মনই আর এখন আমার মধ্যে নেই।
দ্বিতীয় যে উৎসবটি প্রতি বছর আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করত তা হলো জন্মাষ্টমীর মিছিল। এটা ছিল মহররমের মিছিলের চাইতেও জমকালো। অসম্ভব ভিড় হতো এই মিছিল দেখার জন্য। সবচাইতে বেশি নবাবপুর রাস্তার দু’পাশে। বাড়ির বারান্দায়, ছাদে, দোকানের সামনে, রাস্তার কিনারায় চার-পাঁচ সারি করে মানুষ তিন-চার ঘণ্টা ধরে ওই মিছিল দেখত। নানারকম বিচিত্র সাজ পরা পদাতিক দল থাকত। বিভিন্ন পেশার মানুষ নিজস্ব পেশার জিনিসপত্রের প্রদর্শনীর আয়োজন করত … টায়ারের ওপর বসানো নানা আকারের গাড়ির ওপর নানা ভঙ্গিতে বসে দাঁড়িয়ে অংশগ্রহণকারীরা গান গাইতো, নাচত, পৌরাণিক চরিত্রে অভিনয় করত। সত্যিকার ফুল, কাগজের ফুল, আর অদ্ভুত সব মুখোশ ব্যবহৃত হতো ব্যাপক হারে। আমি একবার কয়েকজন সহপাঠীসহ আমাদের কলেজিয়েট স্কুলের কাছে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে জন্মাষ্টমীর মিছিল দেখেছিলাম। প্রচণ্ড ভিড়, রাস্তার সামনের দিকে প্রাপ্ত বয়স্করা দুর্ভেদ্য প্রাচীর বানিয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন। কিন্তু আমরা হাল ছেড়ে দিইনি। স্কুলের বারান্দা থেকে বেঞ্চি এনে চার বন্ধু তার ওপর দাঁড়িয়েছিলাম। চমৎকার দেখতে পেয়েছিলাম সবকিছু। হঠাৎ লক্ষ করলাম আমাদের দলে একজন বয়স্ক মানুষ এসে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। অল্প জায়গার মধ্যে ভারসাম্য রাখার প্রয়াসে তিনি আমার বাম কাঁধ আঁকড়ে ধরেছেন তাঁর বাহু দিয়ে। মুখ ঘুরিয়ে দেখি পরিচিত ব্যক্তি। মিছিল দেখার জন্য কী প্রচণ্ড উৎসাহ তাঁর। ভদ্রলোক গ্রন্থাগারিক ও লেখক। নাম বললে অনেকেই চিনবেন। আবু যোহা নূর আহমদ। কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। আমি যখন সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে বাংলা একাডেমীর প্রধানরূপে কর্মরত তখন তিনি মাঝে-মাঝে আমার ওখানে আসতেন। নস্টালজিয়ার সঙ্গে তখন আমরা ত্রিশ বছর আগের আমাদের সেই এক বেঞ্চিতে দাঁড়িয়ে জন্মাষ্টমীর মিছিল দেখার গল্প করেছি একাধিক দিন।