পরদিন সকালেই কমলা খুড়ামশায়ের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইল। যখন নির্জনে একটু অবকাশ পাইল অমনি সে শৈলজাকে জড়াইয়া ধরিল; শৈল কমলার চিবুক ধরিয়া কহিল, “কী বোন, এত খুশি কিসের ?”
কমলা কহিল, “আমি জানি না দিদি, কিন্তু আমার মনে হইতেছে, যেন আমার জীবনের সমস্ত ভার চলিয়া গেছে।”
শৈল। বল্-না, সব কথা বল্-না আমাকে। এই তো কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা ছিলাম, তার পরে তোর হইল কী ?
কমলা। এমন কিছুই হয় নাই, কিন্তু আমার কেবলই মনে হইতেছে, আমি যেন তাঁহাকে পাইয়াছি, ঠাকুর যেন আমার ’পরে সদয় হইয়াছেন।
শৈল। তাই হোক বোন, কিন্তু আমার কাছে কিছু লুকোস নে।
কমলা। আমার লুকাইবার কিছুই নাই দিদি, কী যে বলিবার আছে, তাও খুঁজিয়া পাই না। রাত পোহাইতেই সকালে উঠিয়া মনে হইল আমার জীবনটা সার্থক— আমার সমস্ত দিনটা এমন মিষ্ট, আমার সমস্ত কাজ এমন হালকা হইয়া গেছে, তাহা আমি বলিতে পারি না। আমি ইহার চেয়ে আর বেশি কিছুই চাই না— কেবল ভয় হয় পাছে এটুকু নষ্ট হয়— আমি যে প্রতিদিন এমন করিয়া দিন কাটাইতে পারিব, আমার ভাগ্য যে এত প্রসন্ন হইবে, তাহা আমি মনে করিতেই পারি না।
শৈল। আমি তোকে বলিতেছি বোন, তোর ভাগ্য তোকে এইটুকু দিয়াই ফাঁকি দিবে না, তোর যাহা পাওনা আছে তার সমস্তই শোধ হইবে।
কমলা। না না দিদি, ও কথা বলিয়ো না— আমার সমস্ত শোধ হইয়াছে, আমি বিধাতাকে কোনো দোষ দিই না, আমার কোনো অভাব নাই।
এমন সময় খুড়া আসিয়া কহিলেন, “মা, তোমাকে তো একবার বাহিরে আসিতে হইতেছে, রমেশবাবু আসিয়াছেন।”
খুড়া এতক্ষণ রমেশের সঙ্গেই কথা কহিতেছিলেন। রমেশকে বলিতেছিলেন “আপনার সঙ্গে কমলার কী সম্বন্ধ, তাহা আমি সমস্তই জানিয়াছি। এখন আপনার প্রতি আমার পরামর্শ এই যে, আপনার জীবন এখন পরিষ্কার হইয়া গেছে, এখন আপনি কমলার সমস্ত প্রসঙ্গ একেবারে পরিত্যাগ করুন। কমলা সম্বন্ধে যদি কোনো গ্রন্থি কোথাও মোচন করিবার প্রয়োজন থাকে তবে বিধাতার উপর সে ভার দিন, আপনি আর হাত দিবেন না।”
রমেশ ইহার উত্তরে কহিতেছিল, “কমলা সম্বন্ধে সকল কথা নিঃশেষে পরিত্যাগ করিবার পূর্বে নলিনাক্ষের কাছে সকল ঘটনা না জানাইয়া আমার নিষ্কৃতি হইতেই পারে না। এ পৃথিবীতে কমলার কথা তুলিবার সমস্ত প্রয়োজন হয়তো শেষ হইয়া গেছে, হয়তো শেষ হয় নাই— যদি না হইয়া থাকে তবে আমার যেটুকু বক্তব্য সেটুকু সারিয়া ছুটি পাইতে চাই।”
খুড়া কহিলেন, “আচ্ছা, আপনি একটুখানি বসুন, আমি আসিতেছি।”
রমেশ ঘুরিয়া বসিয়া জানলা হইতে শূন্যদৃষ্টিতে লোকপ্রবাহের দিকে চাহিয়া রহিল; কিছুক্ষণ পরেই পায়ের শব্দে সতর্ক হইয়া দেখিল, একটি রমণী ভূমিতে মাথা ঠেকাইয়া তাহাকে প্রণাম করিল। যখন সে প্রণাম করিয়া উঠিল তখন রমেশ আর বসিয়া থাকিতে পারিল না; তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “কমলা !” কমলা স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
খুড়া কহিলেন, “রমেশবাবু, কমলার সমুদয় দুঃখকে সৌভাগ্যে পরিণত করিয়া ঈশ্বর তাহার চারি দিক হইতে সমস্ত কুয়াশা কাটিয়া দিতেছেন। আপনি তাহাকে পরম সংকটের সময় যেমন রক্ষা করিয়াছেন, তাহার জন্য যে বিষম দুঃখ আপনাকে স্বীকার করিতে হইয়াছে, তাহাতে আপনার সঙ্গে সম্বন্ধ ছেদনের সময় কোনো কথা না বলিয়া কমলা বিদায় লইতে পারে না। আপনার কাছে ও আজ আশীর্বাদ লইতে আসিয়াছে।”
রমেশ ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া সবলে রুদ্ধ কণ্ঠ পরিষ্কার করিয়া লইয়া কহিল, “তুমি সুখী হও কমলা— আমি না জানিয়া এবং জানিয়া তোমার কাছে যা-কিছু অপরাধ করিয়াছি, সব মাপ করিয়ো।”
কমলা ইহার উত্তরে কিছুই বলিতে পারিল না, দেওয়াল ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
রমেশ কিছুক্ষণ পরে কহিল, “যদি কাহাকেও কিছু বলিবার জন্য, কোনো বাধা দূর করিবার জন্য, আমাকে তোমার প্রয়োজন থাকে তো বলো।”
কমলা জোড়হাত করিয়া কহিল, “আমার কথা কাহারো কাছে বলিবেন না, আমার এই মিনতি রাখিবেন।”
রমেশ কহিল, “অনেক দিন তোমার কথা কাহারো কাছে বলি নাই, খুব গোলমালে পড়িলেও চুপ করিয়া কাটাইয়াছি। অল্পদিন হইল, যখন মনে করিয়াছিলাম তোমার কথা বলিলে তোমার কোনো ক্ষতি হইবে না, তখনই কেবল একটি পরিবারের কাছে তোমার কথা প্রকাশ করিয়াছি। তাহাতেও বোধ হয় তোমার অনিষ্ট না হইয়া ভালোই হইতে পারে। খুড়ামশায় বোধ হয় খবর পাইয়া থাকিবেন— অন্নদাবাবু, যাঁহার মেয়ের সঙ্গে— ”
খুড়া কহিলেন, “হেমনলিনী, জানি বৈকি। তাঁহারা সব শুনিয়াছেন ?”
রমেশ কহিল, “হাঁ। তাঁহাদের কাছে আর কিছু বলা যদি প্রয়োজন বোধ করেন তবে আমি যাইতে পারি-কিন্তু আমার আর ইচ্ছা নাই— আমার অনেক সময় গেছে এবং আরো আমার অনেক গেছে, এখন আমি মুক্তি চাই— হাত-নাগাদ সমস্ত দেনা-পাওনা শোধ করিয়া দিয়া এখন বাহির হইতে পারিলে বাঁচি !”
খুড়া রমেশের হাত ধরিয়া সস্নেহকণ্ঠে কহিলেন, “না রমেশবাবু, আপনাকে আর কিছুই করিতে হইবে না। আপনাকে অনেক বহন করিতে হইয়াছে, এখন ভারমুক্ত হইয়া নিজেকে স্বাধীনভাবে চালনা করুন, সুখী হউন, সার্থক হউন, এই আমার আশীর্বাদ !”
যাইবার সময় রমেশ কমলার দিকে চাহিয়া কহিল, “আমি তবে চলিলাম।”
কমলা কোনো কথা না কহিয়া আর-একবার ভূতলে মাথা ঠেকাইয়া রমেশকে প্রণাম করিল।
রমেশ পথে বাহির হইয়া স্বপ্নাবিষ্টের মতো চলিতে চলিতে ভাবিতে লাগিল, ‘কমলার সঙ্গে দেখা হইল, ভালোই হইল; দেখা না হইলে এ পালাটা ভালো করিয়া শেষ হইত না। যদিও ঠিক জানিলাম না, কমলা কী জানিয়া কী বুঝিয়া সে রাত্রে হঠাৎ গাজিপুরের বাংলা ছাড়িয়া চলিয়া আসিল, কিন্তু ইহা বুঝা গেছে, আমি এখন সম্পূর্ণই অনাবশ্যক। এখন আমার আবশ্যক কেবল নিজের জীবনটুকু লইয়া, এখন তাহাকেই সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করিয়া পৃথিবীতে বাহির হইলাম— আমার আর পিছনে ফিরিয়া তাকাইবার কোনো প্রয়োজন নাই।’