এ দিকে ক্ষেমংকরী নলিনাক্ষকে ডাকিয়া কহিলেন, “আমি তোমার পাত্রী ঠিক করিয়াছি।”
নলিনাক্ষ একটু হাসিয়া কহিল, “একেবারে ঠিক করিয়া ফেলিয়াছ?”
ক্ষেমংকরী। তা নয় তো কী? আমি কি চিরকাল বাঁচিয়া থাকিব? তা শেনো, আমি হেমনলিনীকেই পছন্দ করিয়াছি–অমন মেয়ে আর পাইব না। রঙটা তেমন ফর্সা নয় বটে, কিন্তু–
নলিনাক্ষ। দোহাই মা, আমি রঙ ফর্সার কথা ভাবিতেছি না। কিন্তু হেমনলিনীর সঙ্গে কেমন করিয়া হইবে? সে কি কখনো হয়?
ক্ষেমংকরী। ও আবার কী কথা। না হইবার তো কোনো কারণ দেখি না।
নলিনাক্ষের পক্ষে ইহার জবাব দেওয়া বড়ো মুশকিল। কিন্তু হেমনলিনী–এতদিন যাহাকে কাছে লইয়া অসংকোচে গুরুর মতো উপদেশ দিয়া আসিয়াছে, হঠাৎ তাহার সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাবে নলিনাক্ষকে যেন লজ্জা আঘাত করিল।
নলিনাক্ষকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া ক্ষেমংকরী কহিলেন, “এবারে আমি তোমার কোনো আপত্তি শুনিব না। আমার জন্য তুমি যে এই বয়সে সমস্ত ছাড়িয়া দিয়া কাশীবাসী হইয়া তপস্যা করিতে থাকিবে, সে আমি আর কিছুতেই সহ্য করিব না। এইবারে যেদিন শুভদিন আসিবে সেদিন ফাঁক যাইবে না, এ আমি বলিয়া রাখিতেছি।”
নলিনাক্ষ কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া কহিল, “তবে একটা কথা তোমাকে বলি মা। কিন্তু আগে হইতে বলিয়া রাখিতেছি, তুমি অস্থির হইয়া পড়িয়ো না। যে ঘটনার কথা বলিতেছি সে আজ নয়-দশ মাস হইয়া গেল, এখন তাহা লইয়া উতলা হইবার কোনো প্রয়োজন নাই। কিন্তু তোমার যেরকম স্বভাব মা, একটা অমঙ্গল কাটিয়া গেলেও তাহার ভয় তোমাকে কিছুতেই ছাড়িতে চায় না। এইজন্যই কতদিন তোমাকে বলিব-বলিব করিয়াও বলিতে পারি নাই। আমার গ্রহশান্তির জন্য যত খুশি স্বস্ত্যয়ন করাইতে চাও করাইয়ো, কিন্তু অনাবশ্যক মনকে পীড়িত করিয়ো না।”
ক্ষেমংকরী উদ্বিগ্ন হইয়া কহিলেন, “কী জানি বাছা, কী বলিবে, কিন্তু তোমার ভূমিকা শুনিয়া আমার মন আরো অস্থির হয়। যতদিন পৃথিবীতে আছি নিজেকে অত করিয়া ঢাকিয়া রাখা চলে না। আমি তো দূরে থাকিতে চাই, কিন্তু মন্দকে তো খুঁজিয়া বাহির করিতে হয় না; সে আপনিই ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়ে। তা, ভালো হোক মন্দ হোক, বলো তোমার কথাটা শুনি।”
নলিনাক্ষ কহিল, “এই মাঘ মাসে আমি রঙপুরে আমার সমস্ত জিনিসপত্র বিক্রি করিয়া, আমার বাগানবাড়িটা ভাড়ার বন্দোবস্ত করিয়া ফিরিয়া আসিতেছিলাম। সাঁড়ায় আসিয়া আমার কী বাতিক গেল, মনে করিলাম, রেলে না চড়িয়া নৌকা করিয়া কলিকাতা পর্যন্ত আসিব। সাঁড়ায় একখানা বড়ো দেশী নৌকা ভাড়া করিয়া যাত্রা করিলাম। দু দিনের পথ আসিয়া একটা চরের কাছে নৌকা বাঁধিয়া স্নান করিতেছি, এমন সময় হঠাৎ দেখি, আমাদের ভূপেন এক বন্দুক হাতে করিয়া উপস্থিত। আমাকে দেখিয়াই তো সে লাফাইয়া উঠিল, কহিল, “শিকার খুঁজিতে আসিয়া খুব বড়ো শিকারটাই মিলিয়াছে।’ সে ঐ দিকেই কোথায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটি করিতেছিল তাঁবুতে মফস্বল-ভ্রমণে বাহির হইয়াছে। অনেকদিন পরে দেখা, আমাকে তো কোনো মতেই ছাড়িবে না, সঙ্গে সঙ্গে ঘুরাইয়া বেড়াইতে লাগিল। ধোবাপুকুর বলিয়া একটা জায়গায় একদিন তাহার তাঁবু পড়িল। বৈকালে আমরা গ্রামে বেড়াইতে বাহির হইয়াছি–নিতান্তই গণ্ডগ্রাম, একটি বৃহৎ খেতের ধারে একটা প্রাচীর-দেওয়া চালাঘরের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িলাম। ঘরের কর্তা উঠানে আমাদের বসিবার জন্য দুটি মোড়া আনিয়া দিলেন। তখন দাওয়ার উপরে ইস্কুল চলিতেছে। প্রাইমারি ইস্কুলের পণ্ডিত একটা কাঠের চৌকিতে বসিয়া ঘরের একটা খুঁটির গায়ে দুই পা তুলিয়া দিয়াছে। নীচে মাটিতে বসিয়া স্লেট-হাতে ছেলেরা মহা কোলাহল করিতে করিতে বিদ্যালাভ করিতেছে। বাড়ির কর্তাটির নাম তারিণী চাটুজ্জে। ভূপেনের কাছে তিনি তন্ন তন্ন করিয়া আমার পরিচয় লইলেন। তাঁবুতে ফিরিয়া আসিতে আসিতে ভূপেন বলিল, “ওহে, তোমার কপাল ভালো, তোমার একটা বিবাহের সম্বন্ধ আসিতেছে।’ আমি বলিলাম, “সে কী রকম?’ ভূপেন কহিল, “ঐ তারিণী চাটুজ্জে লোকটি মহাজনি করে, এতবড়ো কৃপণ জগতে নাই। ঐ-যে ইস্কুলটি বাড়িতে স্থান দিয়াছে, সেজন্য নূতন ম্যাজিস্ট্রেট আসিলেই নিজের লোকহিতৈষিতা লইয়া বিশেষ আড়ম্বর করে। কিন্তু ইস্কুলের পণ্ডিতটাকে কেবলমাত্র বাড়িতে খাইতে দিয়া রাত দশটা পর্যন্ত সুদের হিসাব কষাইয়া লয়, মাইনেটা গবর্মেণ্টের সাহায্য এবং ইস্কুলের বেতন হইতে উঠিয়া যায়। উহার একটি বোনের স্বামীবিয়োগ হইলে পর সে বেচারা কোথাও আশ্রয় না পাইয়া ইহারই কাছে আসে। সে তখন গর্ভিণী ছিল। এখানে আসিয়া একটি কন্যা প্রসব করিয়া নিতান্ত অচিকিৎসাতেই সে মারা যায়। আর একটি বিধবা বোন ঘরকন্নার সমস্ত কাজ করিয়া ঝি রাখিবার খরচ বাঁচাইত, সে এই মেয়েটিকে মায়ের মতো মানুষ করে। মেয়েটি কিছু বড়ো হইতেই তাহারও মৃত্যু হইল। সেই অবধি মামা ও মামীর দাসত্ব করিয়া অহরহ ভর্ৎসনা সহিয়া মেয়েটি বাড়িয়া উঠিতেছে। বিবাহের বয়স যথেষ্ট হইয়াছে, কিন্তু এমন অনাথার পাত্র জুটিবে কোথায়? বিশেষত উহার মা-বাপকে এখানকার কেহ জানিত না, পিতৃহীন অবস্থায় উহার জন্ম ইহা লইয়া পাড়ার ঘোঁট-কর্তারা যথেষ্ট সংশয়প্রকাশ করিয়া থাকেন। তারিণী চাটুজ্জের অগাধ টাকা আছে সকলেই জানে, লোকের ইচ্ছা–এই মেয়ের বিবাহ উপলক্ষে কন্যা সম্বন্ধে খোঁটা দিয়া উহাকে বেশ একটু দোহন করিয়া লয়। ও তো আজ চার বছর ধরিয়া মেয়েটির বয়স দশ বলিয়া পরিচয় দিয়া আসিতেছে। অতএব, হিসাবমত তার বয়স এখন অন্তত চৌদ্দ হইবে। কিন্তু যাই বল, মেয়েটি নামেও কমলা, সকল বিষয়েই একেবারে লক্ষ্মীর প্রতিমা। এমন সুন্দর মেয়ে আমি তো দেখি নাই। এ গ্রামে বিদেশের কোনো ব্রাহ্মণ যুবক উপস্থিত হইলেই তারিণী তাহাকে বিবাহের জন্য হাতে-পায়ে ধরে। যদি বা কেহ রাজি হয়, গ্রামের লোকে ভাংচি দিয়া তাড়ায়। অতএব এবারে নিশ্চয় তোমার পালা।’ জান তো মা, আমার মনের অবস্থাটা তখন একরকম মরিয়া গোছের ছিল; আমি কিছু চিন্তা না করিয়াই বলিলাম, “এ মেয়েটিকে আমিই বিবাহ করিব।’ ইহার পূর্বে আমি স্থির করিয়াছিলাম, একটি হিন্দুঘরের মেয়ে বিবাহ করিয়া আনিয়া আমি তোমাকে চমৎকৃত করিয়া দিব; আমি জানিতাম, বড়ো বয়সের ব্রাহ্মমেয়ে আমাদের এ ঘরে আনিলে তাহাতে সকল পক্ষই অসুখী হইবে। ভূপেন তো একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেল। সে বলিল, “কী বল!’ আমি বলিলাম, “বলাবলি নয়, আমি একেবারেই মন স্থির করিয়াছি।’ ভূপেন কহিল, “পাকা?’ আমি কহিলাম, “পাকা’। সেই সন্ধ্যাবেলাতেই স্বয়ং তারিণী চাটুজ্জে আমাদের তাঁবুতে আসিয়া উপস্থিত। ব্রাহ্মণ হাতে পইতা জড়াইয়া জোড়হাত করিয়া কহিলেন, “আমাকে উদ্ধার করিতেই হইবে। মেয়েটি স্বচক্ষে দেখুন, যদি পছন্দ না হয় তো অন্য কথা–কিন্তু শত্রুপক্ষের কথা শুনিবেন না।’ আমি বলিলাম, “দেখিবার দরকার নাই, দিন স্থির করুন।’ তারিণী কহিলেন, “পরশু দিন ভালো আছে, পরশুই হইয়া যাক।’ তাড়াতাড়ির দোহাই দিয়া বিবাহে যথাসাধ্য খরচ বাঁচাইবার ইচ্ছা তাঁহার ছিল। বিবাহ তো হইয়া গেল।”
ক্ষেমংকরী চমকিয়া উঠিয়া কহিলেন, “বিবাহ হইয়া গেল–বল কী নলিন!”
নলিনাক্ষ। হাঁ, হইয়া গেল। বধূ লইয়া নৌকাতেই উঠিলাম। যেদিন বৈকালে উঠিলাম, সেইদিনই ঘণ্টা-দুয়েক বাদে সূর্যাস্তের এক দণ্ড পরে হঠাৎ সেই অকালে ফাল্গুন মাসে কোথা হইতে অত্যন্ত গরম একটা ঘূর্ণিবাতাস আসিয়া এক মুহূর্তে আমাদের নৌকা উল্টাইয়া কী করিয়া দিল, কিছু যেন বোঝা গেল না।
ক্ষেমংকরী বলিলেন, “মধুসূদন!” তাঁহার সর্বশরীরে কাঁটা দিয়া উঠিল।
নলিনাক্ষ। ক্ষণকাল পরে যখন বুদ্ধি ফিরিয়া আসিল তখন দেখিলাম, আমি নদীতে এক জায়গায় সাঁতার দিতেছি, কিন্তু নিকটে কোনো নৌকা বা আরোহীর কোনো চিহ্ন নাই। পুলিসে খবর দিয়া খোঁজ অনেক করা হইয়াছিল, কিন্তু কোনো ফল হইল না।
ক্ষেমংকরী পাংশুবর্ণ মুখ করিয়া কহিলেন, “যাক, যা হইয়া গেছে তা গেছে, ও কথা আমার কাছে আর কখনো বলিস নে–মনে করিতেই আমার বুক কাঁপিয়া উঠিতেছে।”
নলিনাক্ষ। এ কথা আমি কোনোদিনই তোমার কাছে বলিতাম না, কিন্তু বিবাহের কথা লইয়া তুমি নিতান্তই জেদ করিতেছ বলিয়াই বলিতে হইল।
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “একবার একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়াছিল বলিয়া তুই ইহজীবনে কখনো বিবাহই করিবি না?”
নলিনাক্ষ কহিল, “সেজন্য নয় মা, যদি সে মেয়ে বাঁচিয়া থাকে?”
ক্ষেমংকরী। পাগল হইয়াছিস? বাঁচিয়া থাকিলে তোকে খবর দিত না?
নলিনাক্ষ। আমার খবর সে কী জানে? আমার চেয়ে অপরিচিত তাহার কাছে কে আছে? বোধ হয় সে আমার মুখও দেখে নাই। কাশীতে আসিয়া তারিণী চাটুজ্জেকে আমার ঠিকানা জানাইয়াছি; তিনিও কমলার কোনো খোঁজ পান নাই বলিয়া আমাকে চিঠি লিখিয়াছেন।
ক্ষেমংকরী। তবে আবার কী।
নলিনাক্ষ। আমি মনে মনে ঠিক করিয়াছি, পূরা একটি বৎসর অপেক্ষা করিয়া তবে তাহার মৃত্যু স্থির করিব।
ক্ষেমংকরী। তোমার সকল বিষয়েই বাড়াবাড়ি। আবার এক বৎসর অপেক্ষা করা কিসের জন্য?
নলিনাক্ষ। মা, এক বৎসরের আর দেরিই বা কিসের। এখন অঘ্রাণ; পৌষে বিবাহ হইতে পারিবে না; তাহার পরে মাঘটা কাটাইয়া ফাল্গুন।
ক্ষেমংকরী। আচ্ছা, বেশ। কিন্তু পাত্রী ঠিক রহিল। হেমনলিনীর বাপকে আমি কথা দিয়াছি।
নলিনাক্ষ কহিল, “মা, মানুষ তো কেবল কথাটুকুমাত্রই দিতে পারে, সে কথার সফলতা দেওয়া যাঁহার হাতে তাঁহারই প্রতি নির্ভর করিয়া থাকিব।”
ক্ষেমংকরী। যাই হোক বাছা, তোমার এই ব্যাপারটা শুনিয়া এখনো আমার গা কাঁপিতেছে।
নলিনাক্ষ। সে তো আমি জানি মা, তোমার এই মন সুস্থির হইতে অনেক দিন লাগিবে। তোমার মনটা একবার একটু নাড়া পাইলেই তাহার আন্দোলন কিছুতেই আর থামিতে চায় না। সেইজন্যই তো মা, তোমাকে এরকম সব খবর দিতেই চাই না।
ক্ষেমংকরী। ভালোই কর বাছা–আজকাল আমার কী হইয়াছে জানি না, একটা মন্দ-কিছু শুনিলেই তার ভয় কিছুতেই ঘোচে না। আমার একটা ডাকের চিঠি খুলিতে ভয় করে, পাছে তাহাতে কোনো কুসংবাদ থাকে। আমিও তো তোমাদের বলিয়া রাখিয়াছি, আমাকে কোনো খবর দিবার কোনো দরকার নাই; আমি তো মনে করি, এ সংসারে আমি মরিয়াই গেছি, এখানকার আঘাত আমার উপরে আর কেন।