শহরের বাহিরে ক্যাণ্টন্মেণ্টের অধিকারের মধ্যে ফাঁকা জায়গায় অন্নদাবাবুরা একটি বাংলা ভাড়া করিয়া বাস করিতেছেন।
অন্নদাবাবুরা কাশীতে পৌঁছিয়াই খবর পাইলেন, নলিনাক্ষের মাতা ক্ষেমংকরীর সামান্য জ্বরকাসি ক্রমে ন্যুমোনিয়াতে দাঁড়াইয়াছে। জ্বরের উপরেও এই শীতে তিনি নিয়মিত প্রাতঃস্নান বন্ধ করেন নাই বলিয়া তাঁহার অবস্থা এরূপ সংকটাপন্ন হইয়া উঠিয়াছে।
কয়েক দিন অশ্রান্তযত্নে হেম তাঁহার সেবা করার পর ক্ষেমংকরীর সংকটের অবস্থা কাটিয়া গেল। কিন্তু তখনো তাঁহার অতিশয় দুর্বল অবস্থা। শুচিতা লইয়া অত্যন্ত বিচার করাতে পথ্যজল প্রভৃতি সম্বন্ধে হেমনলিনীর সাহায্য তাঁহার কোনো কাজে লাগিল না। ইতিপূর্বে তিনি স্বপাক আহার করিতেন, এখন নলিনাক্ষ স্বয়ং তাঁহার পথ্য প্রস্তুত করিয়া দিতে লাগিল এবং আহার সম্বন্ধে মাতার সমস্ত সেবা নলিনাক্ষকে স্বহস্তে করিতে হইত। ইহাতে ক্ষেমংকরী সর্বদা আক্ষেপ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “আমি তো গেলেই হত, কেবল তোদের কষ্ট দিবার জন্যই আবার বিশ্বেশ্বর আমাকে বাঁচাইলেন।”
ক্ষেমংকরীর নিজের সম্বন্ধে কঠোরতা অবলম্বন করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার চারি দিকে পারিপাট্য ও সৌন্দর্যবিন্যাসের প্রতি তাঁহার অত্যন্ত দৃষ্টি ছিল। হেমনলিনী সে কথা নলিনাক্ষের কাছ হইতে শুনিয়াছিল। এইজন্য সে বিশেষ যত্নে চারি দিক পরিপাটি করিয়া এবং ঘর-দুয়ার সাজাইয়া রাখিত এবং নিজেও যত্ন করিয়া সাজিয়া ক্ষেমংকরীর কাছে আসিত। অন্নদা ক্যাণ্টন্মেণ্টে যে বাগান ভাড়া করিয়াছিলেন সেখান হইতে প্রত্যহ ফুল তুলিয়া আনিয়া দিতেন, হেমনলিনী ক্ষেমংকরীর রোগশয্যার কাছে সেই ফুলগুলি নানা রকম করিয়া সাজাইয়া রাখিত।
নলিনাক্ষ মাতার সেবার জন্য দাসী রাখিতে অনেক বার চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু তাহাদের হস্ত হইতে সেবা গ্রহণ করিতে কোনোমতেই তাঁহার অভিরুচি হইত না। অবশ্য, জল তোলা প্রভৃতির জন্য চাকর-চাকরানি ছিল বটে, কিন্তু তাঁহার একান্ত নিজের কাজগুলিতে বেতনভুক্ কোনো চাকরের হস্তক্ষেপ তিনি সহ্য করিতে পারিতেন না। যে হরির মা ছেলেবেলায় তাঁহাকে মানুষ করিয়াছিল সে মারা গিয়া অবধি অতি বড়ো রোগের সময়েও কোনো দাসীকে তিনি পাখা করিতে বা গায়ে হাত বুলাইতে দেন নাই।
সুন্দর ছেলে, সুন্দর মুখ তিনি বড়ো ভালোবাসিতেন। দশাশ্বমেধঘাটে প্রাতঃস্নান সারিয়া পথে প্রত্যেক শিবলিঙ্গে ফুল ও গঙ্গাজল দিয়া বাড়ি ফিরিবার সময় এক-এক দিন কোথা হইতে হয়তো একটি সুন্দর খোট্টার ছেলেকে অথবা কোনো ফুট্ফুটে হিন্দুস্থানি ব্রাহ্মণকন্যাকে বাড়িতে আনিয়া উপস্থিত করিতেন। পাড়ার দুটি-একটি সুন্দর ছেলেকে তিনি খেলনা দিয়া, পয়সা দিয়া, খাবার দিয়া বশ করিয়াছিলেন; তাহারা যখন-তখন তাঁহার বাড়ির যেখানে-সেখানে উপদ্রব করিয়া খেলিয়া বেড়াইত, ইহাতে তিনি বড়ো আনন্দ পাইতেন। তাঁহার আর-একটি বাতিক ছিল। ছোটোখাটো কোনো একটি সুন্দর জিনিস দেখিলেই তিনি না কিনিয়া থাকিতে পারিতেন না। এ-সমস্ত তাঁহার নিজের কোনো কাজেই লাগিত না; কিন্তু কোন্ জিনিসটি কে পাইলে খুশি হইবে, তাহা মনে করিয়া উপহার পাঠাইতে তাঁহার বিশেষ আনন্দ ছিল। অনেক সময় তাঁহার দূর আত্মীয়-পরিচিতেরাও এইরূপ একটা-কোনো জিনিস ডাক-যোগে পাইয়া আশ্চর্য হইয়া যাইত। তাঁহার একটি বড়ো আবলুস কাঠের কালো সিন্ধুকের মধ্যে এইরূপ অনাবশ্যক সুন্দর শৌখিন জিনিসপত্র, রেশমের কাপড়-চোপড় অনেক সঞ্চিত ছিল। তিনি মনে মনে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন, নলিনের বউ যখন আসিবে তখন এগুলি সমস্ত তাহারই হইবে। নলিনের একটি পরমাসুন্দরী বালিকাবধূ তিনি মনে মনে কল্পনা করিয়া রাখিয়াছিলেন–সে তাঁহার ঘর উজ্জ্বল করিয়া খেলিয়া বেড়াইতেছে, তাহাকে তিনি সাজাইতেছেন-পরাইতেছেন, এই সুখচিন্তায় তাঁহার অনেক দিনের অনেক অবসর কাটিয়াছে।
তিনি নিজে তপস্বিনীর মতো ছিলেন; স্নানাহ্নিক-পূজায় প্রায় দিন কাটিয়া গেলে এক বেলা ফল দুধ মিষ্ট খাইয়া থাকিতেন; কিন্তু নিয়মসংযমে নলিনাক্ষের এতটা নিষ্ঠা তাঁহার ঠিক মনের মধ্যে ভালো লাগিত না। তিনি বলিতেন, “পুরুষমানুষের আবার অত আচার-বিচারের বাড়াবাড়ি কেন?’ পুরুষমানুষদিগকে তিনি বৃহৎবালকদের মতো মনে করিতেন; খাওয়াদাওয়া-চালচলনে উহাদের পরিমাণবোধ বা কর্তব্যবোধ না থাকিলে সেটা যেন তিনি সস্নেহ প্রশ্রয়বুদ্ধির সহিত সংগত মনে করিতেন, ক্ষমার সহিত বলিতেন, “পুরুষমানুষ কঠোরতা করিতে পারিবে কেন!’ অবশ্য, ধর্ম সকলকেই রক্ষা করিতে হইবে, কিন্তু আচার পুরুষমানুষের জন্য নহে, ইহাই তিনি মনে মনে ঠিক করিয়াছিলেন। নলিনাক্ষ যদি অন্যান্য সাধারণ পুরুষের মতো কিঞ্চিৎ পরিমাণে অবিবেচক ও স্বেচ্ছাচারী হইত, সতর্কতার মধ্যে কেবলমাত্র তাঁহার পূজার ঘরে প্রবেশ এবং অসময়ে তাঁহাকে স্পর্শ করাটুকু বাঁচাইয়া চলিত, তাহা হইলে তিনি খুশিই হইতেন।
ব্যামো হইতে যখন সারিয়া উঠিলেন ক্ষেমংকরী দেখিলেন, হেমনলিনী নলিনাক্ষের উপদেশ-অনুসারে নানাপ্রকার নিয়মপালনে প্রবৃত্ত হইয়াছে, এমন-কি, বৃদ্ধ অন্নদাবাবুও নলিনাক্ষের সকল কথা প্রবীণ গুরুবাক্যের মতো বিশেষ শ্রদ্ধা ও ভক্তির সহিত অবধান করিয়া শুনিতেছেন।
ইহাতে ক্ষেমংকরীর অত্যন্ত কৌতুক বোধ হইল। তিনি একদিন হেমনলিনীকে ডাকিয়া হাসিয়া কহিলেন, “মা, তোমরা দেখিতেছি, নলিনকে আরো খ্যাপাইয়া তুলিবে। ওর ও-সমস্ত পাগলামির কথা তোমরা শোন কেন? তোমরা সাজগোজ করিয়া, হাসিয়া-খেলিয়া আমোদ-আহ্লাদে বেড়াইবে; তোমাদের কি এখন সাধন করিবার বয়স? যদি বল “তুমি কেন বরাবর এই-সব লইয়া আছ’, তার একটু কথা আছে। আমার বাপ-মা বড়ো নিষ্ঠাবান ছিলেন। ছেলেবেলা হইতে আমরা ভাইবোনেরা এই-সকল শিক্ষার মধ্যেই মানুষ হইয়া উঠিয়াছি। এ যদি আমরা ছাড়ি তো আমাদের দ্বিতীয় কোনো আশ্রয় থাকে না। কিন্তু তোমরা তো সেরকম নও; তোমাদের শিক্ষাদীক্ষা তো সমস্তই আমি জানি। তোমরা এ যা-কিছু করিতেছ এ কেবল জোর করিয়া করিতেছ; তাহাতে লাভ কী মা? যে যাহা পাইয়াছে সে তাহাই ভালো করিয়া রক্ষা করিয়া চলুক, আমি তো এই বলি। না না, ও-সব কিছু নয়, ও-সমস্ত ছাড়ো। তোমাদের আবার নিরামিষ খাওয়া কী, যোগ-তপই বা কিসের! আর নলিনই বা এতবড়ো গুরু হইয়া উঠিল কবে? ও এ-সকলের কী জানে? ও তো সেদিন পর্যন্ত যা-খুশি-তাই করিয়া বেড়াইয়াছে, শাস্ত্রের কথা শুনিলে একেবারে মারমূর্তি ধরিত। আমাকেই খুশি করিবার জন্য এই-সমস্ত আরম্ভ করিল, শেষকালে দেখিতেছি কোন্দিন পুরা সন্ন্যাসী হইয়া বাহির হইবে। আমি ওকে বার বার করিয়া বলি, “ছেলেবেলা হইতে তোর যা বিশ্বাস ছিল তুই তাই লইয়াই থাক্; সে তো মন্দ কিছু নয়, আমি তাহাতে সন্তুষ্ট বৈ অসন্তুষ্ট হইব না।’ শুনিয়া নলিন হাসে; ঐ ওর একটি স্বভাব, সকল কথাই চুপ করিয়া শুনিয়া যায়, গাল দিলেও উত্তর করে না।”
অপরাহ্নে পাঁচটার পর হেমনলিনীর চুল বাঁধিয়া দিতে দিতে এই-সমস্ত আলোচনা চলিত। হেমের খোঁপা-বাঁধা ক্ষেমংকরীর পছন্দ হইত না। তিনি বলিতেন, “তুমি বুঝি মনে কর মা, আমি নিতান্তই সেকেলে, এখনকার কালের ফ্যাশান কিছুই জানি না। কিন্তু আমি যতরকম চুল-বাঁধা জানি এত তোমরাও জান না বাছা। একটি বেশ ভালো মেম পাইয়াছিলাম, সে আমাকে সেলাই শিখাইতে আসিত, সেইসঙ্গে কতরকম চুল-বাঁধাও শিখিয়াছিলাম। সে চলিয়া গেলে আবার আমাকে স্নান করিয়া কাপড় ছাড়িতে হইত। কী করিব মা, সংস্কার, উহার ভালোমন্দ জানি না–না করিয়া থাকিতে পারি না। তোমাদের লইয়াও যে এতটা ছুঁই-ছুঁই করি, কিছু মনে করিয়ো না মা। ওটা মনের ঘৃণা নয়, ও কেবল একটা অভ্যাস। নলিনদের বাড়িতে যখন অন্যরূপ মত হইল, হিন্দুয়ানি ঘুচিয়া গেল, তখন তো আমি অনেক সহ্য করিয়াছি, কোনো কথাই বলি নাই; আমি কেবল এই কথাই বলিয়াছি যে, যাহা ভালো বোঝ করো–আমি মূর্খ মেয়েমানুষ, এতকাল যাহা করিয়া আসিলাম তাহা ছাড়িতে পারিব না।”
বলিতে বলিতে ক্ষেমংকরী চোখের এক ফোঁটা জল তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়া মুছিয়া ফেলিলেন।
এমনি করিয়া, হেমনলিনীর খোঁপা খুলিয়া ফেলিয়া তাহার সুদীর্ঘ কেশগুচ্ছ লইয়া প্রত্যহ নূতন-নূতন রকম বিনানি করিতে ক্ষেমংকরীর ভারি ভালো লাগিত। এমনও হইয়াছে, তিনি তাঁহার সেই আবলুস কাঠের সিন্ধুক হইতে নিজের পছন্দসই রঙের কাপড় বাহির করিয়া তাহাকে পরাইয়া দিয়াছেন। মনের মতো করিয়া সাজাইতে তাঁহার বড়ো আনন্দ। প্রায়ই প্রতিদিন হেমনলিনী তাহার সেলাই আনিয়া ক্ষেমংকরীর কাছে দেখাইয়া লইয়া যাইত; ক্ষেমংকরী তাহাকে নূতন-নূতন রকমের সেলাই সম্বন্ধে শিক্ষা দিতে আরম্ভ করিলেন। এ-সমস্তই তাঁহার সন্ধ্যার সময়কার কাজ ছিল। বাংলা মাসিকপত্র এবং গল্পের বই পড়িতেও উৎসাহ অল্প ছিল না। হেমনলিনীর কাছে যাহা-কিছু বই এবং কাগজ ছিল, সমস্তই সে ক্ষেমংকরীর কাছে আনিয়া দিয়াছিল। কোনো কোনো প্রবন্ধ ও বই সম্বন্ধে ক্ষেমংকরীর আলোচনা শুনিয়া হেম আশ্চর্য হইয়া যাইত; ইংরাজি না শিখিয়া যে এমন বুদ্ধিবিচারের সহিত চিন্তা করা যায় হেমের তাহা ধারণাই ছিল না। নলিনাক্ষের মাতার কথাবার্তা এবং সংস্কার-আচরণ সমস্ত লইয়া হেমনলিনীর তাঁহাকে বড়োই আশ্চর্য স্ত্রীলোক বলিয়া বোধ হইল। সে যাহা মনে করিয়া আসিয়াছিল তাহার কিছুই নয়, সমস্তই অপ্রত্যাশিত।