দ্বিতীয় অঙ্ক
[একই ঘর। এককোনায় পিয়ানোর পাশে ক্রিসমাস ট্রি। গাছটায় রঙিন ফিতা জড়ানো। অগোছালো। নিভে যাওয়া মোমবাতির অংশগুলো এখানে-ওখানে। নোরার বাইরে যাবার কাপড় সোফার উপর পড়ে আছে। ঘরের মধ্যে একা নোরা অস্থিরভাবে পায়চারি করছে। একপর্যায়ে সোফার পাশে এসে থামে এবং ক্লোকটা তুলে নেয়।]
নোরা : [ক্লোকটা আবার রেখে দেয়।] কেউ আসছে মনে হয়। [শোনার জন্য দরজার কাছে গিয়ে কান পাতে] নাহ্—কেউ তো নয়। অবশ্য আজ আর কেউ আসবে না, বড়দিন—কালকেও আসবে না। কিন্তু যদি…[নোরা দরজা খুলে বাইরে দেখে] না, একেবারে খালি—চিঠির বাক্সে কিছু নেই। [আবার ঘরে চলে আসে] যতসব বাজে কথা। এ-কথা সে বলতেই পারে না। ওরকম কিছু হয়ও না। এটা সম্ভব নয়—আমার তিন—তিনটি বাচ্চা! [একটা বড়সড় কার্ডবোর্ডের বাক্স নিয়ে আয়া বাঁ-দিকের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে।]
আয়া : ফ্যান্সি-ড্রেসের বাক্সটা শেষমেশ পেয়েছি।
নোরা : যাক ভালোই হল। ওখানে টেবিলের উপর রাখো।
আয়া : [টেবিলে রাখে] একেবারে বিচ্ছিরি অবস্থা।
নোরা : পুরোটাই কেটেকুটে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
আয়া : না, না, সেটা করতে হবে না। একটু ধৈর্য লাগবে, তাহলেই পুরোটা আবার ঠিক করা যাবে।
নোরা : হ্যাঁ, আমি গিয়ে মিসেস লিন্ডেকে নিয়ে আসি। ও একটু সাহায্য করতে পারবে।
আয়া : না, না, তার দরকার নেই। এই আবহাওয়ায় কোথাও বেরোবে না। একেবারে মরণ-ঠাণ্ডা লেগে যাবে মা, যেয়ো না।
নোরা : এরচেয়েও কঠিন ব্যাপার জীবনে আছে। যাহোক, বাচ্চারা কী করছে? আয়া : কী আর করবে, খেলনাপাতি নিয়ে খেলছে। কিন্তু
নোরা : আমার কথা খুব বেশি বলছে নাকি?
আয়া : বুঝতেই তো পার, মায়ের কাছে থাকলেই ওরা ভালো থাকে।
নোরা : কিন্তু আমি তো আগের মতো আর ওদের সঙ্গে থাকতে পারছি না। আয়া : ঠিক আছে, বাচ্চামানুষ যে-কোনোকিছুতেই তাড়াতাড়ি মানিয়ে নিতে পারে।
নোরা : তোমার তাই মনে হয়? আচ্ছা আমি যদি একেবারে চলে যাই ওরা আমাকে ভুলে যাবে?
আয়া : একেবারে চলে যাই মানে? কী সব কথা!
নোরা : না বল, দাইমা, মাঝে মাঝে আমি ভাবি— অচেনা অজানা মানুষের কাছে কীভাবে তুমি নিজের বাচ্চা ছেড়ে দিয়েছ। একবারও বুকে লাগেনি?
আয়া : করতে হয়েছে, যাতে আমি আমার ছোট্ট নোরার কাছে দাইমা হয়ে থাকতে পারি।
নোরা : কিন্তু সেটা চাইলেই বা কী করে?
আয়া : কেন? এরকম একটা সুন্দর সুযোগ! কোনও হতভাগ্য কি এ সুযোগ হাতছাড়া করবে? তাছাড়া সেই অলক্ষ্মী ব্যাটাছেলে তো আমার জন্য কিছু করেনি!
নোরা : তোমার মেয়ে বোধহয় তোমাকে একেবারেই ভুলে গেছে।
আয়া : না, তা সে ভোলেনি। বিয়ে ঠিক হবার পর সে আমাকে চিঠি লিখেছে—বিয়ের পরও লিখেছে।
নোরা : [আয়াকে জড়িয়ে ধরে] লক্ষ্মী দাইমা, আমার সেই ছোট্টবেলায় তুমিই আমার মা ছিলে, এমন মা আমি আর দেখিনি।
আয়া : নোরা আমার! আমি ছাড়া তোমার আর তো কোনও মা ছিল না।
নোরা : আমি জানি, আমার বাচ্চাদেরও যদি মা না থাকে—তাহলে তুমিই— দেখ তো কীসব বাজে বকছি। [বাক্সটা খোলে] তুমি বরং ওদের কাছে যাও। আমি একটু শুধু… কালকে দেখো আমাকে কেমন লাগে।
আয়া : সেটা আমি জানি নোরা, মামণি। সারা অনুষ্ঠানে তোমার মতো সুন্দরী আর কেউ যাবে না। [সে বাঁ-দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়]।
নোরা : [বাক্স খুলে এটা-ওটা বার করতে শুরু করে—একটু পরেই সবকিছু সরিয়ে রাখে] ওহ্—সাহস করে একবার যদি বেরোতে পারতাম! একবার যদি নিশ্চিত হতে পারতাম যে এখানে কেউ আসবে না—আমার অনুপস্থিতির সময়টাতে এখানে কিছুই ঘটবে না। কীসব অর্থহীন চিন্তা—কেউ আসবে না। না, এসব চিন্তা করাই উচিত না। এসব হিজিবিজি চিন্তা একেবারেই মুছে ফেলা উচিত। বাহ্, কী সুন্দর দস্তানা দুটো। না, চিন্তা কোরো না নোরা। চিন্তা কোরো না। এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ-ছয়—[সে চিৎকার করে] আহ্—ওরা আসছে আবার!
[সে দরজার দিকে যেতে শুরু করে—কিন্তু দ্বিধাদ্বন্দ্বে দাঁড়িয়ে যায়। হলঘরের দিক থেকে মিসেস লিন্ডে এসে প্রবেশ করে। সে তার বাইরের কাপড়চোপড় হলঘরে রেখে আসে]
নোরা : ওহ্ ক্রিস্টিনা, তুমি! বাইরে কেউ নেই তো? বেশ, এস, তুমি আসাতে ভালোই হল।
লিন্ডে : ওরা বলল তুমি আমাকে খোঁজ করতে গিয়েছিলে?
নোরা : হ্যাঁ, আমি তোমার ওখান দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, একটা ব্যাপারে তুমিই আমাকে সাহায্য করতে পার। এস, এস, এখানে সোফাটায় বস। বিষয়টা হল, উপরতলায় স্টেনবোর্গদের ওখানে আগামীকাল রাতে একটা ফ্যান্সি— ড্রেস পার্টি আছে। ক্যাপরিতে যে ট্যারান্টেলা নাচ শিখেছিলাম জেলেমেয়ের পোশাক পরে হেলমার আমাকে সেটা নাচতে বলছে।
লিন্ডে : ওমা—তাই নাকি! তাহলে তুমি সত্যি সত্যি নর্তকীর মতো নাচবে?
নোরা : হ্যাঁ, টোরভাল্ড বলে আমার নাকি নাচা উচিত। দেখ, এই হল কাপড়চোপড়। আমরা যখন বাইরে ছিলাম টোরভাল্ড আমার জন্য এটা বানিয়েছিল—দেখ তো দশা, ছিঁড়ে টিড়ে—আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কীভাবে…..
লিন্ডে : আরে এটা ঠিক করা কোনও কঠিন কাজ নাকি? কয়েক জায়গা সেলাই করে ইস্ত্রি করলেই ঠিক হয়ে যাবে। সুইসুতো আছে? আর কিছু লাগবে না।
নোরা : ওহ্ তুমি যে কী ভালো, ক্রিস্টিনা!
লিন্ডে : [সেলাই করতে করতে] তাহলে আগামীকাল একেবারে নর্তকীর সাজে। বলছি শোনো, এ কারণেই কাল আমি পলকের জন্য একবার আসব। এসে তোমার সাজগোজ দেখে যাব। এই দেখ ভুলে যাচ্ছি— গতকালের সন্ধ্যাটা কিন্তু দারুণ কেটেছে— সেজন্য তোমাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ।
নোরা : [উঠে ঘরের ওপাশে যেতে যেতে] ওহ্—গতকাল…. না, অন্যসব বছরের মতো হয়নি—ইশ্! তুমি যদি আরও আগে শহরে আসতে ক্রিস্টিনা! এটা ঠিক, কীভাবে ঘর সাজাতে হয় এবং আরামদায়ক আর আকর্ষণীয় করতে হয় টোরভাল্ড সেটা জানে।
লিন্ডে : তুমিও কম জানো না। আচ্ছা, গতরাতে ডাক্তার র্যাংককে খুব মনমরা লাগল। সে কি সবসময়ই এরকম নাকি?
নোরা : মন খারাপ প্রায় সবসময়ই থাকে। কাল একটু বেশি ছিল মনে হয় ডাক্তারের শরীরটা ভালো না–বেচারা! মেরুদণ্ডে ক্ষয় ধরেছে। কী করবে বল—ওর বাবা ছিলেন একটা জঘন্য লোক—একাধিক মেয়েমানুষ এবং ওই জাতীয় ব্যাপার—এ ধরনের মানুষের ছেলেপুলের জীবন বড় কষ্টে কাটে।
লিন্ডে : [সেলাই করা থামায়] কিন্তু, তুমি এসব কোত্থেকে জানলে নোরা?
নোরা : [হাঁটাহাঁটি করতে করতে] আরে শোনো, তিন-তিনটে ছেলেমেয়ে হতে হতে ডাক্তারিবিদ্যা-জানা কিছু মহিলার সাথে দেখাও হয়ে যায়, যোগাযোগ হয়ে যায়। ওদের কাছ থেকেই শোনা এসব গল্প।
লিন্ডে : [একটু চুপ করে থাকে। তারপর সেলাই শুরু করে।] ডাক্তার র্যাংক প্রতিদিন তোমাদের এখানে আসেন?
নোরা : হ্যাঁ, হ্যাঁ। টোরভাল্ড আর ডাক্তার তো ছেলেবেলা থেকেই বন্ধু। সেই সুবাদে সে আমারও খুব কাছের মানুষ। ডাক্তার এখন আমাদের পরিবারের একজনই বলতে পার।
লিন্ডে : লোকটা কেমন বল তো? মানে, আন্তরিক তো? সে বোধহয় কথা দিয়েই লোককে খুশি করতে পছন্দ করে।
নোরা : মোটেও না। কিন্তু কেন? তোমার এমন চিন্তা হল কেন?
লিন্ডে : কাল যখন তুমি পরিচয় করিয়ে দিলে তখন সে বলল না—তোমাদের বাড়িতে আমার নাম অনেকবার শুনেছে? কিন্তু পরে আমি খেয়াল করলাম। তোমার স্বামী আমাকে চিনতে পারল না—তোমার স্বামীই যদি আমার নাম না শুনে থাকে তবে ডাক্তার র্যাংক শুনবে কোত্থেকে?
নোরা : হ্যাঁ, একথাটা ঠিক ক্রিস্টিনা। আসলে কী, টোরভাল্ডের কথা আর কী বলব! আমি ছাড়া তার একমুহূর্ত চলে না। সবসময় একেবারে লেগে থাকে প্রথমদিকে তো বাবার বাড়ির লোকজনের কথা বলাই যেত না, পুরনো দিনের মানুষের কথা বলব তো ব্যাস, অশান্তি—ঈর্ষা হত। শেষে আমি আর বলতাম না। কিন্তু ডাক্তার র্যাংক অন্যধরনের লোক। সে পুরনো দিনের কথা, মানুষের গল্প— এগুলো শুনতে ভালোবাসে, আমিও বলি।
লিন্ডে : নোরা, অনেক ব্যাপারে তুমি এখনো বাচ্চাই রয়ে গেছ। অনেক দিক থেকে তোমার চেয়ে আমার বয়স বেশি—অভিজ্ঞতাও বেশি। একটা কথা তোমাকে বলি—ডাক্তার র্যাংক-এর সাথে এরকম মাখামাখি তোমার ঠিক না। বরং বন্ধ করাই ভালো।
নোরা : কী বন্ধ করব?
লিন্ডে : একজন ধনী ভক্তের কথা তুমি আমাকে গতকাল বলেছিলে—যে তোমাকে প্রচুর ধনসম্পত্তি দেবে বলে তুমি কল্পনা কর।
নোরা : দুঃখজনকভাবে সে ধনী ব্যক্তিটি কাল্পনিকই। তার কোনও অস্তিত্ব নেই। কিন্তু তাতেই বা কী?
লিন্ডে : ডাক্তার র্যাংক কি ধনী নাকি?
নোরা : হ্যাঁ, তা অবশ্য।
লিন্ডে : এবং তার সম্পদ ভোগ করারও কেউ নেই?
নোরা : কেউ না, তবে—
লিন্ডে : সে প্রতিদিনই এ বাড়িতে আসে?
নোরা : হ্যাঁ। সে-কথা তো তোমাকে বললাম।
লিন্ডে : তার মতো একজন মানুষ এত নির্বোধ হয় কী করে?
নোরা : তুমি যে কী বলছ আমি কিছুই বুঝি না।
লিন্ডে : ভান করো না নোরা। তুমি কি মনে কর বারোশ ডলার তুমি কার কাছ থেকে ধার করেছ সেটা আমি বুঝি না?
নোরা : তুমি কি পাগল নাকি? এটা ভাবলে কী করে? আমার বাড়িতে যে প্রতিদিন আসে তার থেকে ধার করব? নিতান্তই অসম্ভব ব্যাপার!
লিন্ডে : ডাক্তারের কাছ থেকে নাওনি?
নোরা : না, না। দিব্যি দিয়ে বলছি ডাক্তারের কাছ থেকে নয়। এ-কথা কখনও মুহূর্তের জন্যেও আমার মাথায় ঢোকেনি। তাছাড়া তখন তার ধার দেবার মতো টাকাপয়সাও ছিল না—টাকা তো হল পরে।
লিন্ডে : ভাগ্যিস সেরকম কিছু করনি।
নোরা : না, ডাক্তারকে বলার কথা আমার মাথায়ই ঢোকেনি। তবে একথা তাকে বললে—
লিন্ডে : মাথায় ঢুকলেও হয়তো সেটা তুমি করতে না।
নোরা : অবশ্যই না। সেরকম প্রয়োজন হবে সে আশঙ্কাও করি না। তবে আমি একশ ভাগ নিশ্চিত ডাক্তারকে বললে-
লিন্ডে : তোমার স্বামীকে না জানিয়ে?
নোরা : যেটা করেছি তাকে না জানিয়েই তো করেছি, সেখান থেকে আগে আমাকে মুক্তি পেতে হবে। অবশ্যই মুক্তি পেতে হবে।
লিন্ডে : হ্যাঁ, সে–কথাই আমি গতকাল বলেছিলাম, তবে—
নোরা : [পায়চারি করতে করতে] একজন পুরুষমানুষ যত সহজে এসব ঠিক করতে পারে; একজন মহিলার পক্ষে–
লিন্ডে : হ্যাঁ, বিশেষ করে তার স্বামী—
নোরা : না, না। এসব অর্থহীন, বাজে [থামে] আচ্ছা—পাওনাগণ্ডা শোধ করে দিলেই তো বন্ড ফেরত পাওয়া যাবে। তাই না?
লিন্ডে : অবশ্যই।
নোরা : এবং ওই ভয়াবহ জঘন্য জিনিসটা ছিঁড়ে কুটিকুটি করে জ্বালিয়েও তো দেয়া যাবে কী বল?
লিন্ডে : [নোরার দিকে অপলক তাকায়। সেলাইকাজ রেখে দেয়, তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়] নোরা, আমার কাছে তুমি কিছু একটা লুকাচ্ছ।
নোরা : হ্যাঁ, সেটা কি পরিষ্কার বোঝা যায়?
লিন্ডে : গতকাল সকালের পর থেকে তোমার কিছু-একটা হয়েছে—ব্যাপার কী বল তো?
নোরা : [ক্রিস্টিনার কাছে গিয়ে] ক্রিস্টিনা, [কান পেতে বাইরে শোনে] চুপ, টোরভাল্ড আসছে। তুমি ভিতরে গিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে একটু বস। টোরভাল্ড এইসব সেলাইফোড়াই পছন্দ করে না— যাও— আয়াকে বল তোমাকে সাহায্য করবে।
লিন্ডে : [জিনিসপত্রগুলো গুটিয়ে নেয়] ঠিক আছে—তবে পুরো ব্যাপারটা না—জেনে কিন্তু আমি যাচ্ছি না। [ক্রিস্টিনা বাঁ-দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়, টোরভাল্ড হলঘরের দিক থেকে এসে প্রবেশ করে।]
নোরা : [টোরভাল্ডের কাছে যেতে যেতে] ওহ্ টোরভাল্ড, আমি তোমারই পথ চেয়েছিলাম।
টোরভাল্ড : কে দরজি নাকি?
নোরা : না ক্রিস্টিনা, কাপড়চোপড়ের ব্যাপারে একটু সাহায্য করছে। কাল দেখো আমাকে কেমন সুন্দর লাগে।
টোরভাল্ড : পরামর্শটা কেমন দিলাম?
নোরা : সাংঘাতিক! আর আমি যে তোমার কথামতো কাজ করলাম সেটা? টোরভাল্ড : [নোরার থুতনি ধরে একটু তোলে] সেটা? স্বামীর কথামতো কাজ করবে এর মধ্যে আবার বিশেষ কী? আচ্ছা ঠিক আছে, মুখরা রমণী, আমি জানি কথাটা তুমি ওভাবে বলতে চাওনি। ঠিক আছে, যাও, তোমাকে থামাতে চাই না—ওগুলো তুমি এখন পরে পরে দেখবে তাই না?
নোরা : তোমার কাজ আছে?
টোরভাল্ড : হ্যাঁ। [একগাদা কাগজ দেখায়] ব্যাংকে গিয়েছিলাম। [তার পড়ার ঘরের দিকে যেতে উদ্যত হয়]
নোরা : টোরভাল্ড–
হেলমার : [হেসে] বল—
নোরা : তোমার ছোট্ট কাঠবিড়ালি যদি অনুনয় বিনয় করে কিছু চায়— হেলমার : মানে?
নোরা : তুমি কি সেটা করবে?
হেলমার : খুব স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টা কী সেটা আমাকে আগে জানতে হবে।
নোরা : সে যা চায় তাই যদি তুমি কর তাহলে তোমার কাঠবিড়ালি আনন্দে ছুটোছুটি করবে।
হেলমার : তাহলে বলেই ফেল।
নোরা : স্বরের কারুকাজ করে গাইবে তোমার পাখি—সারা ঘরময় নেচে নেচে-
হেলমার : আমার পাখি তো সেটা সবসময়ই করে।
নোরা : আমি অপ্সরী হয়ে জোছনাধারায় তোমার জন্য নাচব টোরভাল্ড।
হেলমার : ব্যাপার কী! নোরা, আজ সকালে যা নিয়ে কথা হয়েছে সেটা নয় তো?
নোরা : [কাছে এসে] হ্যাঁ টোরভাল্ড—আমি তোমাকে অনুরোধ করছি ভিক্ষা চাইছি—
হেলমার : আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, তুমি ওইকথা আবার ওঠাচ্ছ?
নোরা : আমার কথা রাখতেই হবে—ক্রোগস্ট্যাড-এর চাকরিটা রেখে দাও।
হেলমার : নোরা, লক্ষ্মীটি, বোঝার চেষ্টা কর। তার জায়গাতেই তো আমি মিসেস লিন্ডেকে নিচ্ছি।
নোরা : সেটা দারুণ ভালো কাজ করেছ। কিন্তু ক্রোগস্ট্যাডের পরিবর্তে তুমি অন্য কোনও কেরানিকে বরখাস্ত করতে পারতে।
হেলমার : এবার কিন্তু তুমি একেবারেই গোঁয়ার্তুমি করছ—এবং করছ কারণ তোমার কোনও দায়িত্বজ্ঞান নেই। ওর মতো একটা মানুষের পক্ষ হয়ে তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছ—এবং কথা বলবে এ-কথাও তাকে দিয়েছ তুমি কি আশা কর যে আমি …
নোরা : না, ব্যাপারটা তা নয় টোরভাল্ড, আমি তোমার জন্যই করছি। তুমি নিজেই তো বলেছ লোকটা কীসব অশ্লীল কাগজপত্রে লেখালিখি করে। কখন কোন্ ক্ষতি করবে টেরও পাবে না। আমি সে ভয়েই মরে যাচ্ছি—
হেলমার : ওহ্—তাই বলো। পুরনো সেই ঘটনা মনে করে তুমি ভয় পাচ্ছ।
নোরা : কী বলছ তুমি? কোন্ ঘটনা?
হেলমার : নিশ্চয়ই তুমি তোমার বাবার কথা চিন্তা করছ?
নোরা : হ্যাঁ, ঠিক তাই। মনে কর তো কীসব আজেবাজে কথা তারা লিখেছে বাবার সম্পর্কে—কীভাবে তাকে অপদস্থ করেছে। আমার মনে হয় তুমি যদি আন্তরিকভাবে কাজটা না করতে অথবা মন্ত্রণালয় যদি তোমাকে না পাঠাত তাহলে হয়তো ওরা তাকে চাকরিচ্যুত করে ছাড়ত।
হেলমার : তোমার বাবা আর আমার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে, নোরা। একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে তোমার বাবার নামধাম একেবারেই সন্দেহাতীত ছিল না——কিন্তু আমার ব্যাপারে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। এবং আশা করি যতদিন আমি এই পদে আছি ততদিন এরকমই থাকবে।
নোরা : কখন কে কোন্ ক্ষতি করবে কেউ জানে না। আমরা চাইলে এখন নির্ঝঞ্চাট আনন্দে দিন কাটাতে পারি টোরভাল্ড—তুমি, আমি, বাচ্চারা। আনন্দে আর শান্তিতে। দুশ্চিন্তার একটু ছায়াও থাকবে না আমার এই সুখের ঘরে—আমি তো এই চাই টোরভাল্ড, সেইজন্যই অনুরোধ করছি…..
হেলমার : তার হয়ে অনুরোধ করে তুমি তার থাকার পথ আরও অসম্ভব করছ। ব্যাংকের সবাই এরমধ্যেই জানে আমি ক্রোগস্ট্যাডকে বরখাস্ত করছি, এখন যদি লোকমুখে এটা ছড়িয়ে পড়ে যে নতুন ম্যানেজার তার বউয়ের কথায় ওঠে বসে—তাহলে—
নোরা : আচ্ছা, সেটা কি কোনও ব্যাপার?
হেলমার : না—মোটেই না। তোমার গোঁয়ার ইচ্ছেটা পূরণ হওয়াটাই আসল ব্যাপার। আমার অফিসের কর্মচারীরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করুক, সবাই আঙুল উঁচিয়ে বলুক ওই লোকটাকে বাগে আনা একদম সোজা- তার ওপর বাইরের প্রভাব বেশ কাজ করে। বলুক। এসব বলতে থাকুক— তোমার কাছে এটা কোনও ব্যাপারই না। এর ফল আমার জন্য ভালো হবে না এ-কথা তোমাকে বলতে পারি। এছাড়াও আর একটা ব্যাপার আছে, আর সে কারণেই আমি যতদিন ব্যাংকে আছি তাকে রাখা যাবে না।
নোরা : কী সেটা?
হেলমার : অবশ্য উপায়ন্তর না থাকলে নীতি-টিতি কিছুটা উপেক্ষা করা যেতে পারে।
নোরা : হ্যাঁ। হ্যাঁ। পারে, টোরভাল্ড।
হেলমার : শুনেছি, সে কাজও নাকি ভালো করে। তাছাড়া আমরা একসাথে স্কুলে পড়েছি। থাকে না? মানুষের এমন বন্ধুত্ব থাকে না যে পরবর্তী জীবনে ওরকম মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল বলেই দুঃখপ্রকাশ করতে হয়, অনুশোচনা করতে হয়? তোমাকে খুলেই বলি, আমাদের নামও এক ছিল। ওর কোনও বোধশোধ নেই, ও এখনও সেইসব খোলাখুলি বলে বেড়ায়। সবার সামনেই। আসলে ও মনে করে আমার সাথে সুসম্পর্ক থাকাটা তার অধিকার। এবং সবসময় ‘টোরভাল্ড এইটা’ ‘টোরভাল্ড ওইটা’ বলতে থাকে। কিন্তু তার যে-ধরনের বদনাম সমাজে, তাতে ওইমুখে আমার নাম উচ্চারণ করলেও আমার খারাপ লাগে। ও ব্যাংকে থাকলে ব্যাংকের চাকরিই আমার অসহ্য মনে হবে।
নোরা : তুমি এ-কথা বলতে পার না টোরভাল্ড।
হেলমার : কেন নয়?
নোরা : এই যুক্তিটি বড় খেলো। হালকা।
হেলমার : কী বলছ তুমি? খেলো? তুমি কি আমাকে সেইরকম মনে কর?
নোরা : না, না, লক্ষ্মী টোরভাল্ড, তা মনে করি না। বরং এর উল্টোটাই মনে করি। আমি বলেছি কারণ—
হেলমার : ঠিক আছে বাদ দাও। তুমি বলেছ আমার উদ্দেশ্য যুক্তিযুক্ত নয় সুতরাং আমিও যুক্তিসঙ্গত কথা বলিনি। অযৌক্তিক, খেলো! আচ্ছা ঠিক আছে। এখুনি বন্দোবস্ত করছি—চিরদিনের জন্য! [হলের দরজার দিকে গিয়ে হেলমার ডাক দেয়] হেলেনা!
নোরা : কী করছ তুমি?
হেলমার : [কাগজের মধ্যে খোঁজাখুঁজি করে] বন্দোবস্ত করছি।
[হেলেনা প্রবেশ করে] নাও—কাগজটা নিচে নিয়ে যাও—একজন কাউকে খুঁজে এটা দিয়ে আসতে বল। এক্ষুনি—ভুল কর না। ঠিকানা লেখাই আছে। দাঁড়াও—এই নাও টাকা।
হেলেনা : জি আচ্ছা। [চিঠিটা নিয়ে চলে যায়। ]
হেলমার : [আবার কাগজপত্র গুছিয়ে] ঠিক আছে, এইবার বল নোরা।
নোরা : [রুদ্ধশ্বাস] টোরভাল্ড—চিঠিতে কী আছে?
হেলমার : ক্রোগস্ট্যাড-এর নোটিশ।
নোরা : পাঠিও না টোরভাল্ড। ওকে ডাকো। ডাকো। এখনও সময় আছে।
টোরভাল্ড! ডাকো। অন্তত আমার জন্য—ডাকো। তোমার জন্য, বাচ্চাদের জন্য ডাকো। শোনো, তুমি বুঝতে পারছ না ওই ছোট্ট চিঠি আমাদের কী সর্বনাশ করতে পারে, তুমি ভাবতেই পার না।
টোরভাল্ড : এখন আর হয় না।
নোরা : হ্যাঁ, তাই, এখন আর হয় না।
হেলমার : নোরা, আমার কাছে সত্যি অপমানজনক হলেও তোমার উদ্বেগকে আমি ক্ষমা করতে পারি। হ্যাঁ, হ্যাঁ। এটা আমার অপমান। তার মতো একটা আজেবাজে লোকের প্রতিশোধ নেয়াকে আমি ভয় করি এটা ভাবাও তো অপমানকর। তবে তোমার উদ্বেগের মধ্যে ভালোবাসার স্পর্শ আছে। আমাকে তুমি ভালোবাস। আর সে কারণেই তোমাকে ক্ষমা করলাম। [নোরাকে কাছে টেনে নেয়।] ঠিক আছে, নোরা, লক্ষ্মী নোরা, এ ব্যাপারটি তাহলে মীমাংসা হয়ে গেল। যাই ঘটুকনা কেন এই বিশ্বাসটুকু রেখো যে সেটা ঠেকাবার প্রয়োজনীয় শক্তি আমার আছে। আর আমি একাই সেটা সামলাতে পারব।
নোরা : [বিমূঢ়ভাবে] তুমি কী বলছ?
হেলমার : যা বললাম তাই বলছি।
নোরা : [একটু সচেতন হয়ে] সেটা তোমাকে কখনও করতে হবে না। কখনও না।
হেলমার : ঠিক আছে, তাহলে আমরা দু-জনে ভাগাভাগি করে করব। তুমি আর আমি। স্বামী-স্ত্রীতে মিলে। হ্যাঁ, তাই করব। [আদর করতে করতে] কি, খুশি তো? এই—এই—এই—ওরকম ভয়-পাওয়া ঘুঘুর মতো তাকিও না তো। পুরো জিনিসটা তো কল্পিত ভয় ছাড়া কিছু নয়। যাও, এবার তোমার ট্যারান্টেলা তালের সাথে একটু মহড়া দিয়ে নাও। আমি ভিতরের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিচ্ছি, যত ইচ্ছা চিৎকার করতে পার, শব্দ করতে পার, একটুও কানে যাবে না। [যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়ায়] ডাক্তার র্যাংক এলে আমি ঘরে আছি বোলো। [কাগজপত্র নিয়ে নোরার দিকে একটু মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগায়। ]
নোরা : [ভয়ে কিছুটা দিশেহারা। শিকড়-প্রোথিত বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে।] ও করবেই। ওকে ফেরানো যাবে না। করবেই। কোনওকিছুই ওকে ফেরাতে পারবে না। না, না, তা হতে পারে না। একটা কিছু—অন্য একটা পথ—[দরজার বেল বাজে]
র্যাংক! হ্যাঁ, একটা কিছু করতেই হবে। যাহোক একটা কিছু।
[হাত দিয়ে মুখ মোছে। নিজেকে একটু সংযত করে গিয়ে হলঘরের দরজা খোলে। ডাক্তার র্যাংক তার পশমি কোটটা ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই দৃশ্য থেকে রাতের অন্ধকার ধীরে ধীরে নামতে থাকে]
নোরা : শুভসন্ধ্যা ডাক্তার, বেল শুনেই বুঝেছিলাম। টোরভাল্ড মনে হয় তার ঘরে একটু বিশেষ কাজ করছে—আপনি বরং একটু পরে যান।
র্যাংক : আপনিও কি ব্যস্ত?
নোরা : [ডাক্তার প্রবেশ করলে নোরা দরজাটা লাগিয়ে দেয়।] আপনার জন্য সবসময়ই আমার সময় আছে। জানেন তো?
র্যাংক : ধন্যবাদ। যতদিন পারি এ সুযোগটা আমি নেব
নোরা : ও কী কথা? যতদিন পারেন মানে?
র্যাংক : হ্যাঁ। ভয় পেয়ে গেলেন?
নোরা : না, বলার ভঙ্গিটাই যেন কেমন লাগল। কী, কোনও ঘটনা?
র্যাংক : হ্যাঁ। অনেকদিন ধরে যা ভেবে এসেছি সেইরকম কিছু একটা। অবশ্য এত তাড়াতাড়ি যে এসে যাবে সেটা ভাবতে পারিনি।
নোরা : [ডাক্তারের বাহু চেপে ধরে] কিছু কি জানতে পেরেছেন? আমাকে খুলে বলুন তো ডাক্তার র্যাংক।
র্যাংক : [স্টোভের পাশে বসে] পায়ের নিচে মাটি সরে যাচ্ছে—এখন আর কিছু করার নেই।
নোরা : [স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে] তাহলে প্রসঙ্গ আপনি…
র্যাংক : আর কে? নিজের সাথে ছলনা করে কোনও লাভ নেই। মিসেস হেলমার, আমার রোগীদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে দুর্ভাগা। গত কিছুদিন ধরে আমার নিজের অভ্যন্তরীণ অবস্থার অডিট করছিলাম। হায়! একেবারে দেউলিয়া! মাসখানেকেরও কম সময়ের মধ্যে গির্জা-চত্বরে ডাক্তার র্যাংক-এর শরীর পচতে শুরু করবে।
নোরা : আরে—না। ওরকম ভয়ানক কথা বলবেন না তো!
র্যাংক : ব্যাপারটা আসলেই ভয়ানক। সবচেয়ে ভয়ানক কাজ একটি এখনও বাকি আছে। সেটাই আগে করতে হবে। এখনও একটি টেস্ট বাকি আছে। সেটা করতে হবে। এটা শেষ হলেই ভালো করে বোঝা যাবে—চূড়ান্ত ক্ষয়টা কবে থেকে শুরু হচ্ছে। কিন্তু একটা কথা আমি আপনাকে অত্যন্ত গোপনে বলতে চাই, হেলমারের মতো সুবেদী মানুষ এটা সইতে পারবে না। ও কুশ্রী কিছু সইতে পারে না। ও যেন আমার রোগশয্যার পাশে কখনও না যায়।
নোরা : ডাক্তার র্যাংক, কিন্তু
র্যাংক : কোনও কারণেই আমি তাকে সেখানে দেখতে চাই না। তার জন্য আমার ঘরের তালা বন্ধ। চরম বিনাশ এসে গেছে জানতে পারলেই আমি আপনাকে কালো ক্রস দিয়ে একটি কার্ড পাঠাব। এটা পেলেই বুঝবেন আমার অসহ্য চূড়ান্ত সময় শুরু হয়ে গেছে
নোরা : না। আপনি আজকে বড় বেশি হেঁয়ালি করছেন—আর করছেন এমন এক সময়ে যখন আপনাকেই আমার অত্যন্ত খোশমেজাজে পাওয়া দরকার।
র্যাংক : হেঁয়ালি! মৃত্যুর কাছাকাছি এসে? তা-ও আবার অন্যের অপরাধের শাস্তি হিসেবে? এর মাঝে বিচার কোথায় বলুন তো! যাই হোক, সান্ত্বনা এইটুকুই যে এমন কোনও পরিবার নেই যেখানে কোনওনা—কোনওভাবে এধরনের অপ্রতিরোধ্য প্রতিশোধের ঘটনা ঘটছে না।
নোরা : [দু–কান হাত দিয়ে ঢেকে] কী ছাই বলছেন? মনটা ভালো করুন তো বিষণ্ণতা ঝেড়ে ফেলুন।
র্যাংক : হ্যাঁ, তাই। পুরো ব্যাপারই একটা কৌতুক ছাড়া কিছু নয়। আমার মেরুদণ্ডটি, আহা বেচারা! আমার বাবার লাগামবিহীন আনন্দ-ফুর্তির ভার বহন করছে ভারবাহী সুবেদারের মতো।
নোরা : [বাঁ-দিকের টেবিলের ধারে] তিনি অ্যাসপারাগাস খুব পছন্দ করতেন, তাই না?
র্যাংক : হ্যাঁ। এবং ট্রাফলস।
নোরা : ট্রাফলস? হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই। বোধহয় ঝিনুকও, তাই না?
র্যাংক : ঝিনুক? ও হ্যাঁ, ঝিনুকও
নোরা : আর পোর্ট এবং শ্যাম্পেনের মতো সবকিছুই। কী লজ্জার কথা, তাই না? এতসব ভালো ভালো জিনিস মেরুদণ্ডের হাড়গুলো আক্রমণ করে বসল!
র্যাংক : এবং বিশেষ করে সেই হতভাগ্য হাড় যা এইসব আনন্দের ছোয়াটুকু পর্যন্ত পায়নি।
নোরা : হ্যাঁ, সেটাই সবচেয়ে দুঃখের বিষয়।
র্যাংক : [নোরার দিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ] হুম্–
নোরা : [একটু পরে] হাসলেন কেন?
র্যাংক : কই, আপনিই তো হাসলেন।
নোরা : না, আপনি মুচকি হেসেছেন ডাক্তার র্যাংক।
র্যাংক : [উঠতে উঠতে] আপনি দারুণ দুষ্টু তো! এতটা আমি ভাবিনি।
নোরা : আমি আজকে অদ্ভুত মেজাজে আছি।
র্যাংক : তাই তো মনে হচ্ছে।
নোরা : [তার কাঁধে দুটি হাত রেখে] ভাই ডাক্তার র্যাংক, আপনার মরারও দরকার নেই আর টোরভাল্ড এবং আমাকে ছাড়ারও দরকার নেই।
র্যাংক : ওহ্, এসব আপনারা অল্পতেই কাটিয়ে উঠবেন—যারা চলে যায় মানুষ তাদের তাড়াতাড়ি ভুলে যায়।
নোরা : [উদ্বেগের সঙ্গে তার দিকে তাকিয়ে] এ-কথা আপনি বিশ্বাস করেন?
র্যাংক : মানুষ নতুন বন্ধুত্বে জড়ায়—আর তারপর…
নোরা : নতুন বন্ধুত্বে কে জড়ায়?
র্যাংক : আমি চলে গেলে টোরভাল্ড এবং আপনি জড়াবেন। আমার তো মনে হয় আপনি এরমধ্যেই শুরু করে দিয়েছেন। মিসেস লিন্ডে গতরাত্রে এখানে কী করছিল?
নোরা : আহা–বেচারি ক্রিস্টিনার প্রতি এতটা ঈর্ষান্বিত হবেন না।
র্যাংক : কেন হব না? এই বাড়িতে সে-ই আমার জায়গা নেবে। আমার চলে যাবার পর আমার মনে হয় এই মহিলা….
নোরা : চুপ চুপ। অত জোরে না, ভেতরে আছে।
র্যাংক : বাহ্—এই তো। আজও সে এখানে?
নোরা : আমার পোশাকটা একটু সেলাই করে দিচ্ছে—শুধু সেজন্যেই। হায় ঈশ্বর আপনি দেখি কেমন অচেনা হয়ে উঠছেন! [সোফায় বসে] না, এবার একটু মনটা ভালো করুন তো ডাক্তার। কালকে দেখবেন আমি কী চমৎকার নাচি। আপনি ভাববেন আপনার জন্যেই নাচছি এবং টোরভাল্ডের জন্য তো অবশ্যই। [বাক্সের ভিতর থেকে এটা-ওটা বার করতে করতে] আসুন, এখানে বসুন। আমি আপনাকে কতগুলো জিনিস দেখাচ্ছি।
র্যাংক : কী?
নোরা : দেখুন। এদিকে দেখুন
র্যাংক : সিল্কের মোজা।
নোরা : রঙ ঠিক ত্বকের মতো। কি, ভালো লাগছে না? এখানে আলোটা তেমন পরিষ্কার না বলে ঠিকমতো বুঝতে পারছেন না। কিন্তু কালকে… না, না, না, আপনি শুধু পায়ের দিকে দেখবেন। না, অন্যসবও দেখতে পারেন।
র্যাংক : হুম্–
নোরা : অমন শ্যেনদৃষ্টিতে কী দেখছেন? পায়ে লাগবে না মনে হচ্ছে?
র্যাংক : এ ব্যাপারে আমি কোনও মন্তব্য করতে পারছি না।
নোরা : [মুহূর্তের জন্য তার দিকে তাকিয়ে] আপনার নিজের প্রতি লজ্জিত হওয়া উচিত। [ডাক্তারের গালে মোজা দিয়ে মৃদু আঘাত করে।] নিন। [মোজাটা আবার গোল করতে থাকে।]
র্যাংক : আর কোনও সুন্দর জিনিস দেখাবেন না?
নোরা : আর কিছু না। আপনি কিন্তু ভারি দুষ্টু। [জিনিসগুলো ওলটপালট করতে করতে সে গুনগুন করে।]
র্যাংক : [একটু বিরতির পর] এইরকম আন্তরিকভাবে আপনার পাশে বসে আপনার সঙ্গে যখন কথা বলি তখন ভাবতেই পারি না বুঝলেন, সত্যি বলছি, ভাবতেই পারি না যে আসা-যাওয়ার জন্য এরকম একটা বাড়ি যদি আমার না থাকত তাহলে আমার কী হত—আসলেই ভাবতে পারি না।
নোরা : [হেসে] আমার বিশ্বাস আমাদের কাছে এলে আপনার বেশ আপন-আপন মনে হয়।
র্যাংক : [আরও শান্তভাবে—সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে] তারপর একসময় এসবকিছু ফেলে চলে যাওয়া।
নোরা : অর্থহীন বাজে কথা। কে বলছে আপনি আমাদের ছেড়ে যাচ্ছেন?
র্যাংক : [আগের মতো] কৃতজ্ঞতার ছোট্ট কোনও চিহ্নও রেখে যেতে পারব না। চলতি পথে অনুশোচনার একটু-আধটু আলতো প্রকাশ! একটি শূন্যস্থান ছাড়া আর কিছুই না, তা-ও আবার যেতে-না-যেতেই অন্যজন ভরে ফেলবে।
নোরা : আচ্ছা ধরুন—আপনার কাছে যদি একটা কিছু চাই… না…
র্যাংক : একটা কিছু কী?
নোরা : আন্তরিক বন্ধুত্বের প্রমাণ।
র্যাংক : হ্যাঁ।
নোরা : না, ধরুন কঠিন ধরনের কোনও সাহায্য।
র্যাংক : আমি অত্যন্ত খুশি হব যদি একবার—অন্তত একবার এরকম সুযোগ পাই।
নোরা : আচ্ছা—কিন্তু সেটা কী তা তো আপনি জানেন না।
র্যাংক : তাহলে বলুন।
নোরা : না—ডাক্তার র্যাংক, আমি বলতে পারি না। সত্যিই একটা বড়কিছু। উপদেশ বা সাহায্য নয়, কাজটা করে দিতে হবে।
র্যাংক : অসুবিধা নেই। যত বড় তত ভালো। কিন্তু কাজটা কী সেটা তো জানতে হবে। সেটাই আগে বলুন। নাকি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না?
নোরা : বিশ্বাস করার মতো আপনার চেয়ে কাছের আর কেউ নেই আমার। আপনিই আমার সবচেয়ে কাছের এবং বিশ্বস্ত বন্ধু সেটা আমি জানি। সুতরাং আপনাকেই বলব—। ডাক্তার, একটা ব্যাপার ঠেকানোর জন্য আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে। আপনি তো জানেন টোরভাল্ড কী পরিমাণে আমাকে ভালোবাসে—কী অবিশ্বাস্যরকম গভীর সে ভালোবাসা তা তো আপনার অজানা নয়—আমার জন্য প্রাণ দিতেও সে দ্বিধা করবে না।
র্যাংক : [নোরার দিকে একটু সরে এসে] নোরা, আপনার কি মনে হয় টোরভাল্ড একাই শুধু–
নোরা : [একটু চমকে] একাই শুধু, মানে… র্যাংক : হাসিমুখে আপনার জন্য প্রাণ দেবে-
নোরা : [দুঃখিত] আহ্…
র্যাংক : আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি মরার আগে অন্তত আপনাকে একবার বলে যাব। এবং বলার জন্য এর চেয়ে ভালো সময় তো আর পাওয়া যাবে না। নোরা, এখন তো বুঝতে পারছেন? আমাকে আপনি যে-কোনও কারও চেয়ে যে বেশি বিশ্বাস করতে পারেন এটাও এখন নির্ঘাত বুঝতে পারছেন।
নোরা : [শান্ত এবং ধীরভাবে উঠতে উঠতে] আমি যাই।
র্যাংক : [বসে থেকেই নোরাকে যাওয়ার জায়গা করে দেয়] নোরা… নোরা : [দরজার কাছে গিয়ে] হেলেনা, বাতি নিয়ে এস। [স্টোভের কাছে গিয়ে] ডাক্তার, এটা সত্যি ভয়াবহ।
র্যাংক : আপনাকে অন্য কারও মতো গভীরভাবে ভালোবাসা—এটাকে আপনি ভয়াবহ বলছেন?
নোরা : না। এ-কথা আমাকে বলা। সত্যি বলছি এর কোনও দরকার ছিল না।
র্যাংক : কী বলছেন আপনি? তাহলে কি আপনি জানতেন? [হেলেনা বাতি নিয়ে প্রবেশ করে। টেবিলে বাতিটা রেখে যেমন এসেছিল তেমনি বেরিয়ে যায়। ] র্যাংক : নোরা—মিসেস হেলমার—আমি জিগ্যেস করছি আপনি কি বুঝতে পেরেছিলেন?
নোরা : পেরেছিলাম কি পারিনি কী করে বলব? আমার কোনও ধারণাই নেই। ডাক্তার, এরকম নির্বোধ আপনি কী করে হলেন? বিশেষ করে যখন সবকিছু সুন্দরভাবে চলছিল—
র্যাংক : যাহোক, আপনি তো এখন জেনেই গেলেন যে আমি দেহমন সবটুকু দিয়ে আপনার কথা রাখব—সুতরাং আমাকে এখন বলতে পারেন। ব্যাপারটা কী বলুন তো?
নোরা : [তার দিকে তাকিয়ে] এতকিছুর পরেও?
র্যাংক : প্লিজ বলুন না ব্যাপারটা কী?
নোরা : আর কোনওকালেই আপনাকে বলা যাবে না।
র্যাংক : প্লিজ, আমাকে এভাবে শাস্তি দেবেন না। আপনি চাইলে আমি শপথ করে বলছি, একজন পুরুষমানুষ যা পারে আমি তার সবটুকু আপনার জন্য করব।
নোরা : আমার জন্য আপনার এখন আর কিছুই করার নেই। তাছাড়া, আসলে আমার কোনও সাহায্যের প্রয়োজনও নেই। এতক্ষণ বানিয়ে বানিয়ে বললাম সব। আমি একটু কল্পনা করতে ভালোবাসি সে তো জানেনই। সত্যি—কল্পনা। সত্যি বলছি। [মুচকি হেসে] আপনি চমৎকার লোক ডাক্তার র্যাংক। বাতিটা চলে আসাতে আপনার নিজের কাছেই কেমন লজ্জা-লজ্জা করছে, তাই না?
র্যাংক : না… তেমন না। তবে মনে হয় আমার চলে যাওয়া উচিত— চিরতরে।
নোরা : না, সেটা আপনি করবেন না। আপনি নিয়মিত আসবেন যেমন আসতেন। টোরভাল্ড আপনাকে ছাড়া চলতে পারে না সেটা তো জানেন।
র্যাংক : সে না হয় টোরভাল্ড। আপনার ব্যাপারে বলুন।
নোরা : আমি তো আপনাকে দেখলে সাংঘাতিক খুশি। সবসময়ই।
র্যাংক : সেটাই আমাকে প্রতারণা করেছে। আপনি আস্ত একটা রহস্য। ভাবলাম আপনি হেলমারের সাথে যেমন, খুব শীঘ্র আমার সাথেও তেমনি হবেন।
নোরা : কেউ কেউ আছে যাদের মানুষ কেবলই ভালোবাসে আবার কেউ কেউ আছে যাদের সঙ্গটাই শুধু কাম্য।
র্যাংক : হ্যাঁ, এরমধ্যেই কিছু একটা আছে।
নোরা : যখন আমি আমার বাবার বাড়িতে ছিলাম তখন স্বাভাবিকভাবেই আমি আমার বাবাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম, কিন্তু একটু ফাঁক পেলেই আমি চাকরবাকরদের ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়তাম—এতে আমি সাংঘাতিক আনন্দ পেতাম। তারা আমাকে সবসময় মজার কথা শোনাত কিন্তু কখনও শিক্ষকের মতো বক্তৃতা করত না।
র্যাংক : আহ্—আমি এখন তাহলে তাদের জায়গা নিয়েছি।
নোরা : [লাফ দিয়ে উঠে র্যাংকের কাছে গিয়ে] ওহ্ ডাক্তার, আমি সে-কথা বলিনি। তবে আপনি এটা নিশ্চয় বুঝতে পারেন যে টোরভাল্ডের সঙ্গে থাকাটা আমার বাবার কাছে থাকার মতোই মনে হয়।
[হলঘর থেকে হেলেনা প্রবেশ করে]
হেলেনা : মাফ করবেন, ম্যাডাম। [একটি কার্ড নোরার হাতে দিয়ে তার কানে কানে ফিসফিস করে কথা বলে]
নোরা : [কার্ডটি দেখে] ওহ্—। [কার্ডটি তার পকেটে রাখে]
র্যাংক : কি, খারাপ কিছু?
নোরা : না, না, সেরকম কিছু না। এটা হচ্ছে ইয়ে….. মানে আমার নতুন পোশাক র্যাংক : কিন্তু…? আপনার পোশাক ওই ঘরে না?
নোরা : এ্যা—হ্যাঁ, ওটা—হ্যাঁ। এটা অন্য একটা—আমি বানাতে দিয়েছিলাম। একটু গোপনে। টোরভাল্ডকে জানাতে চাইছিলাম না।
র্যাংক : এটাই তাহলে আপনার গভীর গোপন
নোরা : হ্যাঁ, তাই। আপনি টোরভাল্ডের কাছে যান। পড়ার ঘরে আছে। তাকে একটু ভিতরে ধরে রাখুন। যতক্ষণ পর্যন্ত না…
র্যাংক : ঘাবড়াবেন না। আমি যাচ্ছি। কোনওমতেই ফসকাতে পারবে না। [সে হেলমারের ঘরে যায়]
নোরা : [হেলেনাকে] ও কি রান্নাঘরে অপেক্ষা করছে?
হেলেনা : হ্যাঁ, ম্যাডাম। পিছনের সিঁড়ি দিয়ে উঠেছে।
নোরা : তুমি বলনি এখানে একজন লোক আছে?
হেলেনা : বলেছি। সে কথা শোনে না।
নোরা : ও কি যাচ্ছে না?
হেলেনা : আপনার সঙ্গে দেখা না করে সে যাবে না।
নোরা : ওহ্, আচ্ছা ঠিক আছে, তাকে ভিতরে আসতে বল। কেউ যেন টের না পায়। হেলেনা–শোনো, এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বোলো না। টোরভাল্ডকে একটু চমকে দেবার জন্য এসব করছি।
হেলেনা : জি—সেটা আমি বুঝি [সে চলে যায়]।
নোরা : ওহ্ ভয়াবহ—অবশেষে যা চাইনি তাই ঘটছে। না-না-না—তা হয় না—এটা আমি হতেই দেব না।
[সে গিয়ে হেলমারের দরজার খিড়কি টেনে দেয়। হেলেনা হলঘরের দরজা খুলে ক্রোগস্ট্যাডকে ভিতরে এনে আবার দরজা লাগিয়ে দেয়। ক্রোগস্ট্যাডকে দেখে মনে হয় সে কোথাও যাচ্ছে—উঁচু বুট, পশমি টুপি— বাইরে যাওয়ার পোশাক পরা।]
নোরা : [তার কাছে গিয়ে] আস্তে কথা বলবেন, আমার স্বামী কিন্তু ঘরে।
ক্রোগস্ট্যাড : তাতে কী হয়েছে?
নোরা : কী চান আপনি?
ক্রোগস্ট্যাড : একটা জিনিস জানতে এসেছি।
নোরা : তাড়াতাড়ি বলুন। কী জানতে চান?
ক্রোগস্ট্যাড : আমাকে বরখাস্ত করা হয়েছে সেটা আপনি জানেন?
নোরা : আমি ঠেকাতে পারলাম না মিস্টার ক্রোগস্ট্যাড। আমার সাধ্যমতো আপনার জন্য আমি সব করেছি কিন্তু কাজ হল না।
ক্রোগস্ট্যাড : আপনার স্বামী আপনাকে নিশ্চয়ই অতটা ভালোবাসে না—বাসে? সে জানে আমি আপনার গোপন রহস্য খুলে ফেলতে পারি। তারপরও সে কী করে সাহস করল—
নোরা : আপনি কী করে বুঝলেন সে জানে?
ক্রোগস্ট্যাড : ইয়ে—মানে আমি সেটা ঠিক ভাবিনি—এতটা সাহস দেখানো টোরভাল্ড হেলমারের পক্ষে সম্ভব নয়।
নোরা : মিস্টার ক্রোগস্ট্যাড, কথা বলার সময় দয়া করে সম্মান রেখে কথা বলবেন।
ক্রোগস্ট্যাড : হ্যাঁ, নিশ্চয়ই—যতটুকু যার প্রাপ্য। আপনি সবকিছু গোপন রাখতে চান তো? বেশ, আপনি কী করেছেন সে সম্পর্কে অত্যন্ত পরিষ্কার একটা ধারণা আপনার আছে, অন্তত গতকালের চেয়ে পরিষ্কার। কি, আছে না?
নোরা : আছে। এত পরিষ্কার যে আপনি কখনও এত পরিষ্কার করে বোঝাতেও পারবেন না।
ক্রোগস্ট্যাড : তা ঠিক—আমি এক মূর্খ আইনজীবী!
নোরা : আপনি কী চান বলুন তো?
ক্রোগস্ট্যাড : আপনি কেমন আছেন তাই দেখতে এসেছি মিসেস হেলমার। আমি সারাদিন ধরে আপনার কথা ভেবেছি। একজন সামান্য লোক—মানে ধরুন, এই আমার মতো লোকেরও তো কিছুটা ‘মায়া দয়া’ আছে। এটা তো আপনি বুঝতে পারেন।
নোরা : তাহলে সেটাই দেখান। আমার বাচ্চাদের কথা একটু ভাবুন।
ক্রোগস্ট্যাড : আপনি অথবা আপনার স্বামী কি আমার বাচ্চাদের কথা ভেবেছেন? থাক, সে-কথা থাক। আমি বলতে চাই এ নিয়ে আপনাকে অতটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে হবে না। এখন এই মুহূর্তে আমি কোনও অভিযোগ করব না।
নোরা : আপনি করবেন না সেটা আমার মনে হয়েছে।
ক্রোগস্ট্যাড : দুইপক্ষের সমঝোতার মাধ্যমেও ব্যাপারটি মীমাংসা হতে পারে। অন্য কিছু প্রয়োজন নেই। আমরা তিনজনে মিলেই এটাকে মিটমাট করে ফেলতে পারি।
নোরা : এ ব্যাপারে আমার স্বামীকে কখনওই কিছু জানানো যাবে না।
ক্রোগস্ট্যাড : সেটা আপনি কী দিয়ে ঠেকাবেন? যদি পুরো ঋণ পরিশোধ করে ফেলেন তো সে-কথা ভিন্ন।
নোরা : সে তো আর এই মুহূর্তে পারছি না।
ক্র্যোগস্টাড : দু-একদিনের মধ্যে টাকা জোগাড় করার কোনও পথ কি আপনি বের করেছেন?
নোরা : সে পথও নেই।
ক্রোগস্ট্যাড : যাহোক, সেটা পারলেও অবশ্য হচ্ছে না। আপনি যদি দু-হাতে টাকশাল নিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়ান তাহলেও আপনি বন্ড ফেরত পাচ্ছেন না।
নোরা : ওটা দিয়ে আপনি কী করতে চান? বলুন–
ক্রোগস্ট্যাড : রেখে দেব। শুধু আমার কাছে থাকবে। এ বন্ড যার প্রয়োজনে লাগবে না, এ সম্পর্কে তার জানারও দরকার নেই। সুতরাং আপনার যদি বেপরোয়া কোনও পরিকল্পনা থাকে….
নোরা : আছে।
ক্রোগস্ট্যাড : আপনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার চিন্তা করেছেন নাকি?
নোরা : করেছি।
ক্রোগস্ট্যাড : অথবা এর চেয়েও খারাপ কিছু–
নোরা : আপনি কী করে জানলেন?
ক্রোগস্ট্যাড : ওসব চিন্তা না-করাই ভালো।
নোরা : আমি এসব চিন্তা করেছি আপনি কী করে জানলেন?
ক্রোগস্ট্যাড : আমরা সবাই প্রথম প্রথম এরকম চিন্তাই করি। আমিও তাই করেছিলাম কিন্তু সাহসে কুলোয়নি।
নোরা : [নিষ্প্রভ] আমারও না।
ক্রোগস্ট্যাড : না, আপনারও সে সাহস নেই। কি, আছে?
নোরা : না। নেই। সে সাহস নেই।
ক্রোগস্ট্যাড : তাছাড়া, এটা অত্যন্ত বোকার মতো কাজ হবে। এতে হয়তো কিছুটা পারিবারিক অশান্তি হবে—সেটাই সামাল দেয়া—এই তো! তারপর— আমার পকেটে আপনার স্বামীকে লেখা একটি চিঠি আছে।
নোরা : বিস্তারিত লিখেছেন?
ক্রোগস্ট্যাড : ভদ্রভাবে যতটুকু সম্ভব।
নোরা : এ চিঠি তাকে দেখাবেন না। ছিঁড়ে ফেলুন। যে করেই হোক আমি টাকা জোগাড় করব।
ক্রোগস্ট্যাড : ক্ষমা করবেন মিসেস হেলমার, একটু আগে আমি আপনাকে বলেছি—
নোরা : না, আমি আপনার পাওনা টাকার কথা বলছি না। আমার স্বামীর কাছে আপনি কত টাকা চান তাই বলুন। আমি যেভাবেই হোক জোগাড় করব।
ক্রোগস্ট্যাড : আপনার স্বামীর কাছে আমি কোনও টাকা চাইছি না।
নোরা : তাহলে কী চাইছেন?
ক্রোগস্ট্যাড : বলব আপনাকে। বলব। সমাজে আমার অবস্থান আমি ফেরত চাই, মিসেস হেলমার। আমি এই জীবন থেকে ফিরে স্বাভাবিক হতে চাই— সেক্ষেত্রে আমি চাই আপনার স্বামী আমাকে সাহায্য করুক। গত আঠারো মাসে আমি কোনও অসৎ কাজ করিনি। এই পুরো সময় আমি অত্যন্ত কঠিন অবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কাটিয়েছি। আমি ধীরে ধীরে আমার অবস্থানে ফিরে আসার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। এখন আবার আমাকে নিচে ফেলে দেয়া হচ্ছে। এটাকে তো আমি আমার প্রতি অনুগ্রহ বলে মেনে নিতে পারি না। আমি আপনাকে বলছি আমি আবার ফিরতে চাই। আমি আবার ব্যাংকে ফিরে যেতে চাই—একটু ভালো পদে। আপনার স্বামীকে এই কাজটুকু আমার জন্য অবশ্যই করতে হবে।
নোরা : এটা সে কখনওই করবে না।
ক্রোগস্ট্যাড : আমি তাকে চিনি—সে করবে। যতটা সে বলে অতটা সাহস তার নেই। একবার ঢুকতে পারলে দেখবেন বছরখানেকের মধ্যে আমিই ম্যানেজারের ডানহাত হয়ে যাব। নিল্স ক্র্যোগস্ট্যাড ব্যাংক চালাবে টোরভাল্ড হেলমারের দরকারও হবে না।
নোরা : আপনি বেঁচে থাকতে সেটা হবে না।
ক্রোগস্ট্যাড : মানে আপনি কি বলতে চান যে আপনি….
নোরা : হ্যাঁ, এখন আমার সে সাহস হচ্ছে।
ক্রোগস্ট্যাড : ওভাবে আপনি আমাকে ভয় দেখাতে পারেন না। আপনার মতো এমন সুন্দরী আদুরে মহিলা….
নোরা : আপনি দেখবেন—দেখবেন—
ক্রোগস্ট্যাড : কোথায়? শীতল বরফের নিচে? ঠাণ্ডা কালো অতল অন্ধকার জলের নিচে? তারপর কোনও এক বসন্তে আপনি ভেসে উঠবেন। কেশবিহীন কুৎসিত অচেনার মতো।
নোরা : আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?
ক্রোগস্ট্যাড : আপনিও তো দেখাচ্ছেন। মানুষ এরকম করে না মিসেস হেলমার তাছাড়া এসবে কী এমন ভালো হবে? চিঠিটা তখনও আমার পকেটে থাকবে।
নোরা : তখনও? যদি মনে করেন আমি…
ক্রোগস্ট্যাড : আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে তখনও আপনার নাম-ধাম-সম্মান আমার হাতের মুঠোয় থাকবে।
[নোরা নির্বাক উঠে দাঁড়ায়। ক্রোগস্ট্যাডের দিকে তাকিয়ে থাকে।]
ক্রোগস্ট্যাড : হ্যাঁ, আমি আপনাকে সাবধান করতে এসেছি। বোকার মতো কিছু করবেন না। চিঠিটা পাওয়ার সাথে সাথে হেলমার কিছু একটা করবে আশা করি। মনে রাখবেন, আপনার স্বামীই কিন্তু আবার আমাকে এসব করতে বাধ্য করছে। এজন্য আমি তাকে কোনওদিন ক্ষমা করব না। চলি, মিসেস হেলমার। [সে হলঘরের দিকে চলে যায়।]
নোরা : [ হলঘরের দিকে গিয়ে দরজাটা একটু খুলে শোনার চেষ্টা করে।] চলে যাচ্ছে, চিঠিটা তো রেখে যায়নি। না, না, এ হতে পারে না। [একটু একটু করে দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে ফেলে] শুনুন—ওকি! ও তো ওঁৎ পেতে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে! সিঁড়ি বেয়ে তো নিচে নামছে না। তাহলে কি মত পরিবর্তন করল? সেকি….?
[চিঠির বাক্সে একটি চিঠি পড়ল। ক্রোগস্ট্যাডের পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে— সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে মিলিয়ে গেল।]
নোরা : [চাপা চিৎকার করে টেবিলের দিকে দৌড়ে চলে যায়। সামান্য নীরবতা] বাক্সে ফেলে গেল চিঠিটা? [প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে হলঘরের দরজার কাছে যায়।] হ্যাঁ, তাই তো! ওহ্ টোরভাল্ড, টোরভাল্ড—সর্বনাশ আর ঠেকানো গেল না—
লিন্ডে : [পোশাক নিয়ে বাঁ-দিকের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে।] নাও—সারাবার মতো আর কোনও জায়গা আছে বলে মনে হয় না। দেখি, একটু পরো তো।
নোরা : [মোটাগলায় ফিসফিস করে] এদিকে একটু এস, ক্রিস্টিনা।
লিন্ডে : [পোশাক সোফার উপর ছুড়ে দেয়।] কী ব্যাপার বল তো? তোমাকে ওরকম লাগছে কেন?
নোরা : এদিকে এস। ওই চিঠিটা দেখতে পাচ্ছ? চিঠির বাক্সের কাচের ভেতর দিয়েই তো দেখা যাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছ?
লিন্ডে : হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। তো কী হয়েছে?
নোরা : ক্রোগস্ট্যাডের চিঠি।
লিন্ডে : নোরা। টাকাটা কি তুমি ক্রোগস্ট্যাডের কাছ থেকে নিয়েছিলে?
নোরা : হ্যাঁ। কিন্তু টোরভাল্ড তো এখন সবকিছু জেনে যাবে।
লিন্ডে : যাক। আমার কথা মানো। তোমাদের দু-জনের জন্যে এটাই সবচেয়ে ভালো হবে।
নোরা : তুমি তো সবকিছু জানো না। আমি একটা সই জাল করেছি।
লিন্ডে : কী সর্বনাশ!
নোরা : শুধু একটি কথা আমি বলতে চাই ক্রিস্টিনা—তুমি সাক্ষী থেকো।
লিন্ডে : সাক্ষী? কিন্তু আমি কী? আমি তো…..।
নোরা : আহা—আমি যদি পাগল হয়ে যাই— খুব সহজে কিন্তু হয়েও যেতে পারি!
লিন্ডে : নোরা!
নোরা : অথবা যদি আমি এখানে আর না থাকি, মানে ধর, এমন কিছু যদি ঘটে যায়!
লিন্ডে : নোরা। নোরা, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?
নোরা : আর ধর এমন যদি কেউ থাকে যে সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেবে—সব বদনাম—সব দোষ। তুমি বোধহয় বুঝতে পারছ—
লিন্ডে : হ্যাঁ—কিন্তু তুমি এটা কীভাবে ভাবো…?
নোরা : সেজন্যেই তো বলছি ক্রিস্টিনা, এটা সত্য নয়—তুমি সাক্ষী থেকো। আমি সম্পূর্ণভাবে সুস্থ এবং এই মুহূর্তে কী করছি কী বলছি সেটা খুব ভালো করেই জানি এবং আমি এই কথা তোমাকে বলছি—এই ঘটনা সম্পর্কে অন্য কেউ কিছু জানে না, আমি একাই সব করেছি—এটুক মনে রেখো।
লিন্ডে : সেটা আমি রাখব। কিন্তু আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।
নোরা : তুমি কীভাবে বুঝবে? আমরা একটা অভাবনীয় কিছু দেখতে যাচ্ছি।
লিন্ডে : অভাবনীয়?
নোরা : হ্যাঁ, তাই। অভাবনীয়। কিন্তু ঘটনাটা যে সাংঘাতিক ক্রিস্টিনা! এটা না ঘটাই উচিত। পৃথিবীর কোনওকিছুর বিনিময়েই যেন না ঘটে।
লিন্ডে : আমি সোজাসুজি ক্রোগস্ট্যাডের সঙ্গে কথা বলছি, দাঁড়াও।
নোরা : না। তার কাছে যেও না। ও তোমার ক্ষতি করবে।
লিন্ডে : একটা সময় ছিল যখন তাকে বললে হাসিমুখে সে আমার জন্য সব করত।
নোরা : ক্রোগস্ট্যাড?
লিন্ডে : সে থাকে কোথায়?
নোরা : কী করে বলব? দাঁড়াও—[পকেট হাতড়িয়ে] এই তার কার্ড। কিন্তু চিঠিটা? বাক্সের ভেতর যে চিঠিটা?
হেলমার : [তার ঘরের ভেতর থেকে দরজায় আঘাত করে] নোরা।
নোরা : [ভয়ে আঁতকে ওঠে] কি, কী হয়েছে? কী চাও তুমি?
হেলমার : [নেপথ্যে] না, না, ঘাবড়াবার কিছু নেই, আমরা ওদিকে আসছি না। তুমি দরজা বন্ধ করেছ—কি, পোশাক পরে দেখছ নাকি?
নোরা : হ্যাঁ, হ্যাঁ, কাপড়টা পরছি। আমাকে দারুণ লাগছে হেলমার।
লিন্ডে : [কার্ডটা পড়ে] সে তো ওই মোড়ের কোনাটাতে থাকে।
নোরা : হ্যাঁ, কিন্তু তাতে তো কাজ হচ্ছে না, ওখানে গিয়ে কী হবে? চিঠি তো আমাদের বাক্সে।
লিন্ডে : চাবিটা তোমার স্বামীর কাছে?
নোরা : ওই তো সবসময় রাখে।
লিন্ডে : কিন্তু ক্রোগস্ট্যাড তো মুখবন্ধ চিঠি ফেরত চাইবে। সে একটা—না-একটা বাহানা খুঁজে বের করবেই।
নোরা : কিন্তু মুশকিল হল টোরভাল্ড তো এইসময়েই প্রতিদিন…
লিন্ডে : তাকে থামাও। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসছি। যাও তার কাছে ঘরের ভেতর যাও। [সে হলঘরের ভেতর দিয়ে তড়িঘড়ি বেরিয়ে যায়। ]
নোরা : [হেলমারের দরজার কাছে যায়—দরজা খুলে ঘরের মধ্যে উঁকি দেয়।] টোরভাল্ড!
হেলমার : [ভিতরের ঘর থেকে] বেশ, বেশ, আমি কি আবার আমার নিজের ঘরে আসতে পারি? এস র্যাংক, দেখি কতদূর হল। [দরজার কাছে এসে] আরে কী ব্যাপার?
নোরা : কী টোরভাল্ড?
হেলমার : র্যাংক তো আমাকে বলল দারুণ একটা দৃশ্য দেখব।
র্যাংক : [দরজার কাছ থেকে] আমি তো তাই ভেবেছিলাম—তাহলে হয়তো আমার ভুল হয়েছে।
নোরা : আগামীকালের আগে কোনও প্রশংসাও নয়।
হেলমার : কিন্তু নোরা, তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে—মহড়াটা কি বেশি হয়ে গেল নাকি?
নোরা : না, মহড়া দেইনি।
হেলমার : দেয়া উচিত ছিল কিন্তু।
নোরা : হ্যাঁ, জানি উচিত ছিল। কিন্তু তুমি একটু সাহায্য না করলে তো আমি কিছুই করতে পারছি না, টোরভাল্ড। আমি সবকিছু কেমন যেন ভুলে গেছি।
হেলমার : আরে দাঁড়াও, ঘষেমেজে ঠিক করতে কতক্ষণ?
নোরা : হ্যাঁ, তাই কর টোরভাল্ড। কথা দাও তাই করবে। ভেতরে ভেতরে কেমন ঘাবড়ে যাচ্ছি—অত মানুষ—আজ সন্ধ্যাটা পুরোপুরি কিন্তু আমার সঙ্গে থাকবে—অন্য কোনও কাজ নয়—কেমন? একবার কলমও ধরতে পারবে না। কি, বল থাকবে—টোরভাল্ড?
হেলমার : কথা দিচ্ছি থাকব। এই সন্ধ্যায় আমার যা-কিছু তার সবটুকু তোমার জন্য নিয়োজিত। বেচারি! দাঁড়াও তাই যদি করতে হয় তো আমাকে প্রথম—[হলঘরের দরজার দিকে যায়]।
নোরা : কী হল? ওদিকে কী?
টোরভাল্ড : দাঁড়াও, চিঠিপত্র আসছে কিনা দেখছি।
নোরা : না, না, টোরভাল্ড, এখন দেখতে হবে না।
টোরভাল্ড : কেন নয়?
নোরা : না, না, এখন না। ওখানে কিছু নেই।
টোরভাল্ড : আমি দেখেই আসছি। [যেতে উদ্যত; নোরা পিয়ানোর সামনে বসে ট্যারান্টেলার মুখটা বাজায়
হেলমার : [দরজার কাছে থেমে] বাহ্!
নোরা : তুমি দেখিয়ে না দিলে কাল কিন্তু আমি নাচতেই পারব না।
হেলমার : নোরা, সত্যি তুমি ভয় পেয়ে গেছ নাকি?
নোরা : হ্যাঁ, সাংঘাতিকভাবে। এখন একটু রিহার্স করি—ডিনারের আগে এখনও অনেকটা সময় আছে। এখানে বসে একটু বাজাও টোরভাল্ড, লক্ষ্মী টোরভাল্ড। সমালোচনা দরকার, ভুলত্রুটিগুলো একটু ধরিয়ে দাও। তুমি তো সবসময়ই তাই কর।
হেলমার : সেটা যদি চাও তো আমি করব। এটা করতে তো আমার ভালোই লাগে।
[সে পিয়ানোর সামনে বসে। নোরা বাক্স থেকে খঞ্জনির মতো একটা কিছু বের করে। এরপর একটা চাদর বের করে চট করে জড়িয়ে নেয়। এক লাফে মেঝের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে নাচের জন্য তৈরি হয়ে নেয়।] বাজাও—আমি নাচ শুরু করছি।
[হেলমার বাজায়, নোরা নাচে। ডাক্তার র্যাংক হেলমারের পিছনে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে।]
হেলমার : [বাজাতে বাজাতে] লয়টা আর একটু ধীরে। আর একটু কমাও।
নোরা : আমি যে শুধু এভাবেই পারি।
হেলমার : ওরকম তাড়াহুড়া কোরো না নোরা।
নোরা : এভাবেই তো হবে।
হেলমার : [বাজনা থামায়] কী করছ তুমি? এই তো ভুল হচ্ছে।
নোরা : [হাসতে হাসতে খঞ্জনিটা বাজিয়ে] দেখলে? বলিনি তোমাকে?
র্যাংক : দাও, আমি বাজাই
হেলমার : হ্যাঁ, নাও। বাজাও। তুমি বাজালে আমি আর একটু ভালো করে দেখাতে পারব।
[ব্যাংক পিয়ানোর সামনে বসে বাজাতে থাকে। নোরা বেপরোয়া হয়ে নাচতে থাকে।
হেলমার স্টোভের পাশে দাঁড়িয়ে অবিরাম তাকে নির্দেশ দিচ্ছে। নোরা এদের কিছু শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। তার চুল খুলে ঘাড়ের উপর এসে পড়েছে—সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই সে নেচে যায়। প্রবেশ করে মিসেস লিন্ডে।]
মিসেস লিন্ডে : [প্রবেশ পথে বিস্মিত থমকে দাঁড়ায়] আহ্!
নোরা : [নাচতে নাচতে] একটু মজা হচ্ছে ক্রিস্টিনা।
হেলমার : কিন্তু এমনভাবে নাচছ যেন তোমার জীবন পুরোটাই নির্ভর করছে এই নাচের ওপর।
নোরা : তাইতো করছে।
হেলমার : র্যাংক থামো। এটা পাগলামি ছাড়া আর কিছু হচ্ছে? থামো! [র্যাংক বাজনা থামায়। নোরা হঠাৎ থেমে যায়।]
হেলমার : [নোরার কাছে গিয়ে] এটা তো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। যা কিছু শিখিয়েছিলাম তুমি দেখি সব ভুলে বসে আছ।
নোরা : [খঞ্জনিটা একপাশে ছুড়ে ফেলে] তাহলেই দেখ।
হেলমার : তোমার তো দস্তুরমতো প্রশিক্ষণ লাগবে।
নোরা : হ্যাঁ, কতটা লাগবে বলে দাও। শেষমুহূর্ত পর্যন্ত আমাকে শেখাতে হবে টোরভাল্ড। কথা দাও, শেখাবে না?
হেলমার : হ্যাঁ, কথা তো দিয়েছি।
নোরা : আজ এবং আগামীকাল পুরোটা সময় তুমি আমাকে ছাড়া আর কিছু ভাববে না। একটি চিঠিও খুলবে না—এমনকি চিঠির বাক্সও খুলতে পারবে না।
হেলমার : হায়, হায়। সেই লোকটার ভয় তোমার এখনো যায়নি দেখছি।
নোরা : হ্যাঁ, সেটাও আছে।
হেলমার : নোরা, তোমার চেহারা দেখেই বুঝতে পারি ওর কাছ থেকে একটা চিঠি এর মধ্যেই এসেছে।
নোরা : আমি জানি না, হতেও পারে। তবে ওরকম কিছু পড়াও এখন তোমার ঠিক হবে না। এই কাজটা শেষ হবার আগে ওরকম সাংঘাতিক কিছু একটা তোমার-আমার মাঝে না-আসাই উচিত।
র্যাংক : [হেলমারকে শান্তভাবে] ওকে ঘাবড়ে দেয়াটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না।
হেলমার : [নোরার গলা জড়িয়ে ধরে] ঠিক আছে, তোমার মত মতোই হবে—তবে আগামীকাল রাতে তোমার নাচ শেষ হবার পর—
নোরা : তখন তুমি মুক্ত।
হেলেনা : [ ডানদিকের দরজার কাছে] খাবার দিয়েছি, ম্যাডাম।
নোরা : হেলেনা, শ্যাম্পেন দিও।
হেলেনা : ঠিক আছে, ম্যাডাম। [সে চলে যায়]
হেলমার : বাহ্ বাহ্—তাহলে নৈশভোজ হচ্ছে, কী বল!
নোরা : শ্যাম্পেনভোজ—সকাল পর্যন্ত চলবে। [ডাকে] মাকারুনও দিও হেলেনা—একবারেই বেশি বেশি করে দিও।
হেলমার : [তার হাত ধরে] বেশ, বেশ। তবে অতটা উন্মাদ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ো না। আমার পোষমানা গানের পাখি হয়ে থেকো কেমন?
নোরা : হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা হব। কিন্তু এখন খাবারঘরের দিকে যাও দেখি। আপনিও ডাক্তার র্যাংক। ক্রিস্টিনা, তুমি আমার চুলগুলো একটু সোজা করে বেঁধে দাও না।
র্যাংক :[যেতে যেতে শান্তভাবে] কোনও খবর আছে নাকি? মানে, কোনও সম্ভাবনা?
হেলমার : আরে না, না। তোমাকে বলেছি না—বাচ্চাদের মতো অল্পতেই সে বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ে। [তারা ডানদিক দিয়ে বেরিয়ে যায়]
নোরা : কী হল?
লিন্ডে : সে তো শহরে নেই।
নোরা : সে তোমার চেহারা দেখেই বুঝেছি।
লিন্ডে : কাল রাতে ফিরবে—আমি একটা চিরকুট লিখে রেখে এসেছি।
নোরা : এসব না করলেও পারতে—না থামালে কী হয়। আর যাই হোক অভাবিত অলৌকিক কিছু একটার জন্য অনিশ্চিত অপেক্ষাও তো কম কথা নয়।
লিন্ডে : তুমি কিসের অপেক্ষা করছ?
নোরা : বুঝবে না। যাও, ভিতরে ওদের কাছে যাও। আমি মিনিটখানেকের মধ্যে আসছি।
[মিসেস লিন্ডে খাবারঘরের দিকে চলে যায়।]
নোরা : [ধাতস্থ হবার জন্য মুহূর্ত কয়েক দাঁড়ায়। তারপর ঘড়ি দেখে।] মাঝরাতের এখনো সাত ঘণ্টা বাকি। তারপর আগামীকাল মাঝরাত পর্যন্ত আরও চব্বিশ ঘণ্টা। তারপর ট্যারান্টেলা শেষ হয়ে যাবে। চব্বিশ আর সাত মাত্র একত্রিশ ঘণ্টা বেঁচে আছি আমি।
হেলমার : [ডানদিকের দরজার কাছে এসে] আমার ছোট্ট পাখিটি কোথায় গেল—ছোট্ট পাখি?
নোরা : [হাতদুটো প্রসারিত করে হেলমারের দিকে যেতে যেতে] এই যে এইখানে তোমার ছোট্ট পাখি।