নোয়াখালিতে গান্ধীজির দিনগুলি – সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত
১৯৪৬’ এর ৬ নভেম্বর। বেলা এগারোটা নাগাদ সোদপুর স্টেশন থেকে গান্ধীজিকে নিয়ে একটি স্পেশাল ট্রেন গোয়ালন্দের দিকে রওনা হল। গান্ধীজি নোয়াখালি চলেছেন। শহিদ সুরাবর্দির নেতৃত্বাধীন বাংলার প্রাদেশিক সরকার গান্ধীজির কামরায় একটি মাইক্রোফোনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ট্রেনটি কুষ্ঠিয়া স্টেশনে পৌঁছলে হিন্দু—মসুলমানের এক বিরাট জনতা গান্ধীজিকে দেখবার জন্য স্টেশন চত্বর ঘিরে ফেলে। প্ল্যাটফর্মে ভিড়ের জন্য গান্ধীজি কামরা থেকে নামতে পারলেন না। কামরায় বসেই তিনি অপেক্ষামান জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। সমবেত হিন্দু—মুসলমানদের তিনি বললেন, তিনি কেন নোয়াখালি যাচ্ছেন এবং নোয়াখালির কতগুলি প্রত্যন্ত গ্রামে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর কীভাবে নির্যাতন হয়েছে। সরকারি প্রশাসন ও পুলিশ কী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল সেসব। তিনি তাঁর বাঙালি শ্রোতাদের বললেন, ‘আমার অসহযোগ আন্দোলনের সেই দিনগুলির কথা মনে পড়ছে, যে দিনগুলিতে আমি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেছিলাম। সেই দিনগুলি ছিল অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক ভাগ্যকে কংগ্রেসের সঙ্গে গ্রথিত করেছিলেন।’
ঠিক ৪৭ বছর আগে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর রাতে নোয়াখালির তিনটি থানা রামগঞ্জ, বেগমগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুরের প্রত্যন্ত চর এবং উপকূলবর্তী গ্রামগুলির হিন্দুরা নির্বিচারে আক্রান্ত হল। গান্ধীজি তখন দিল্লিতে। অক্টোবরের (১৯৪৬) মাঝামাঝি খবরের কাগজের খবর এবং গান্ধীজির নিজস্ব সূত্র মারফত নোয়াখালির বিভীষিকার বিস্তৃত সংবাদ তিনি পেলেন। এর দু’মাস আগে (১৬ আগস্ট, ১৯৪৬) কলকাতায় মুসলিম লিগের ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের’ ভয়াবহ দাঙ্গা ঘটে গিয়েছে। কলকাতার ওই দাঙ্গার নারকীয় বীভৎসতা ২০/২১ আগস্ট দেখতে এসে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অন্যতম সমর নায়ক ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের নার্ভ ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু গান্ধীজি শহরের মানুষের এই দাঙ্গায় ভেঙে পড়েননি। কিন্তু নোয়াখালির দাঙ্গা কেন তাঁকে এত বিচলিত করেছিল?
কলকাতার ১৬ আগস্টের দাঙ্গার বদলা বিহারে আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় অন্তর্বর্তী সরকারের এক নম্বর মন্ত্রী হিসাবে জওহরলাল নেহরু নিখিল ভারত মুসলিম লিগের সভাপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রী মনির আবদুর রব নিশতারকে নিয়ে বিহারে গেলেন। নেহরু ও নিশতার দিল্লিতে ফিরে এসে বিহারের পরিস্থিতি নিয়ে গান্ধীজির সঙ্গে আলোচনা করলেন। আবদুর রব নিশতার চাইলেন গান্ধীজির অবিলম্বে বিহারে যাওয়া দরকার। কিন্তু গান্ধীজির কাছে তখন নোয়াখালির বিশদ রিপোর্ট এসে গেছে।
গান্ধীজি স্থির করলেন, আগে নোয়াখালি। তারপর বিহার। নোয়াখালির পথে তিনি ২৯ অক্টোবর (১৯৪৬) বেলা সাড়ে পাঁচটায় সোদপুর আশ্রমে পৌঁছলেন। গান্ধীজি সোদপুরে পৌঁছানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এলেন প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, অন্নদাপ্রসাদ চৌধুরি, সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ, কিরণশঙ্কর রায় ও বরিশালের সতীন সেন। তাঁরা ত্রিপুরা ও নোয়াখালি সম্পর্কে গান্ধীজিকে রিপোর্ট দিলেন। সতীন সেন গান্ধীজিকে জানালেন, নোয়াখালি দাঙ্গার প্রতিক্রিয়া হিসাবে পূর্ববাংলার সংখ্যালঘু হিন্দুদের মনে আতঙ্ক ও ভীতি দেখা দিয়েছে. ১ নভেম্বর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী শহিদ সুরার্বদি প্রায় প্রতিদিনই সোদপুরে এসে গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করে, তাঁকে নোয়াখালি না যাওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করলেন। গান্ধীজি তাঁর বক্তব্য শুনলেন এবং তাঁকে বললেন, ‘শহিদ, তোমার কি লুকোবার কিছু আছে? তবে তুমি কেন আমাকে নোয়াখালি না যেতে বলছ?’ ৩ নভেম্বর গান্ধীজি বাংলার গভর্নর রজার ফ্রেডারিক বারোজের সঙ্গে দেখা করে নোয়াখালির পরিস্থিতি নিয়ে কথা বললেন। এই আলোচনার সময় উপস্থিত ছিলেন ফোর্ট উইলিয়ামের সামরিক অধিনায়ক মেজর জেনারেল রয় বুচার।
মেজর জেনারেল গান্ধীজি বললেন, তিনি নোয়াখালিতে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করতে চান। গান্ধীজি তাঁকে সাফ জবাব দিলেন, সামরিক বাহিনী যদি প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে থেকে কাজ করে, তাহলেই সামরিক সাহায্যের কোনও প্রয়োজন নেই। কারণ, তাতে কোনও ফল হবে না। ৪ নভেম্বর গান্ধীজি তাঁর নোয়াখালি যাত্রার প্রস্তুতি চূড়ান্ত করে ফেললেন এবং পরিকল্পনামাফিক সব কিছু করার জন্য তাঁর সেক্রেটারি নির্মলকুমার বসুকে নির্দেশ দিলেন। ৬ নভেম্বর সকালে ট্রেনে ওঠার আগে গান্ধীজি সোদপুর আশ্রম থেকে দু’খানা চিঠি লিখলেন। একখানা সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে এবং অন্যটি জওহরলাল নেহরুকে। সর্দারকে তিনি যে চিঠি দিলেন, তার বয়ান ছিল এরূপ : কলকাতার হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় বেরিয়েছে যে, তুমি এলাহাবাদে সাংবাদিকদের কাছে সুরাবর্দি ও মুসলিম লিগকে এই বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছ, যদি বাংলার প্রাদেশিক সরকার হিন্দু হত্যা বন্ধ না করে, তা হলে বিহারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং অন্য প্রদেশগুলিতেও এর প্রতিক্রিয়া পড়বে। তোমার এই বিবৃতি সত্য কি? জওহরলাল নেহরুকে লিখলেন : বিহারের ঘটনা সম্পর্কে খবরের কাগজগুলিতে যে সব খবর বেরিয়েছে তার একাংশ যদি সত্য হয়, তাহলে বিহারের প্রাদেশিক সরকারের সরকার পরিচালনার কোনও অর্থই থাকে না। সব অপকর্মের জন্য গুণ্ডারাই কেবল দায়ী, এটা আমি মানতে রাজি নই এবং এটা অসত্য।…
৬ নভেম্বর বেলা তিনটায় গান্ধীজি গোয়ালন্দ স্টিমারঘাটে পৌঁছলেন। গোয়ালন্দে দিগন্তবিস্তারী পদ্মা। একটু দূরেই ব্রহ্মপুত্রের প্রবল জলরাশি এসে মিশে পদ্মাকে করেছে আরও প্রমত্তা। ইংরেজ স্টিমার কোম্পানি গান্ধীজির জন্য একটি আলাদা স্টিমারের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। এই স্টিমার গান্ধীজিকে চাঁদপুর নিয়ে যাবে। রেল স্টেশন থেকে একটু হেঁটে স্টিমার ঘাটে গিয়ে দেখা গেল হাজার হাজার ছোট বড় নৌকা পদ্মার বুকে ভাসছে। নৌকার গলুইতে ছইয়ের ভিতর লোকেরা বসে আছে গান্ধীজিকে দেখবার জন্য। এছাড়া আরও অসংখ্য নৌকা ঘিরে রয়েছে স্টিমারের দু’পাশে।
স্টিমারের ওপর জেটির দু’পাশে কোম্পানির সাহেব ও ভারতীয় অফিসাররা দাঁড়িয়ে। দাঁড়িয়ে রয়েছে স্টিমারের সারেং ও খালাসিরা। তারা কেউ কেউ গান্ধীজিকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। গান্ধীজি স্টিমারের দোতলায় উঠে গিয়ে ডেকের উপর দাঁড়িয়ে নৌকায় অপেক্ষমান হাজার হাজার মানুষকে নমস্কার করলেন। জনতা তাঁর কথা শুনতে চাইল। তখন ডেকের উপর বসে তিনি তাঁদের বললেন : আমি নোয়াখালিতে যাচ্ছি কেবল একটি কথা হিন্দুদের বলতে। সেটি হল, হিন্দুর যেন বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে না যায়। নোয়াখালি জেলায় হিন্দুরা সংক্যায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হলেও তাদের মুসলমানদের সঙ্গেই বাস করতে হবে। আত্মসম্মানের সঙ্গে কোনও আপস না করেই হিন্দুদের তা করতে হবে। চাঁদপুরে স্টিমার পৌঁছল সন্ধ্যায়।
৭ নভেম্বর সকাল দশটায় চাঁদপুর থেকে ট্রেন ছাড়ল নোয়াখালির চৌমোহনির উদ্দেশ্যে। প্রতিটি স্টেশনে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। গাড়িতে বসেই প্রত্যেক স্টেশনে অপেক্ষমান জনতাকে গান্ধীজি বললেন, সাহস ও নির্ভীকতা নিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। ভয়কে ভয় করলে চলবে না। বাঙালির কাছে এটা যেন রবীন্দ্রনাথেরই কথা। লাকসাম জংশন স্টেশনে গান্ধীজিকে ট্রেন থেকে নামতেই হল। লাকসাম স্টেসনের কাছে নোয়াখালির শরণার্তীদের জন্য একটি বড় শরণার্থী শিবির স্থাপন করা হয়েছিল। নোয়াখালির উপদ্রুত গ্রামগুলি থেকে অত্যাচারিত কয়েক হাজার হিন্দু ওই শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল। গান্ধীজি প্ল্যাটফর্মে নেমে কিছু শরণার্থীর সঙ্গে কথা বললেন এবং সেখানে একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিলেন। বিকালে ট্রেন চৌমোহনি পৌঁছলে গান্ধীজি ট্রেন থেকে নামলেন। এই চৌমোহনিতে যোগেন্দ্রনাথ মজুমদারের বাড়িতে গান্ধীজির কয়েকদিনের জন্যে থাকার ব্যবস্থা করা হল।
চৌমোহনিতেও একটি ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে দাঙ্গা পীড়িতদের জন্য। এই শিবিরটি পরিচালনার দায়িত্ব সম্মিলিতভাবে গ্রহণ করেছে কংগ্রেস, আর এস পি এবং খাদি সংগঠন অভয় আশ্রমের কর্মীবৃন্দ। ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় ত্রাণ শিবিরের কাছে গান্ধীজির প্রার্থনা সভার আয়োজন করলেন এই কর্মীরা। গান্ধীজি প্রার্থনাসভায় যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বেরিয়েই দেখলেন, দু’জন লোক ঘরের বাইরে একটি বেঞ্চে পাশাপাশি চিন্তিত মুখে বসে আছেন। তাঁদের মধ্যে একজন সাহেব। গান্ধীজিকে দেখেই তাঁরা উঠে দাঁড়লেন। ইংরেজ ভদ্রলোক গান্ধীজিকে নমস্কার করে বললেন, ‘আমি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ই এফ ম্যাকিনার্নি।’ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভারতীয়কে দেখিয়ে ইংরেজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, ‘ইনি এস এম আবদুল্লা, আমার জেলার পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট।’ গান্ধীজি আবদুল্লার দিকে এগিয়ে গিয়ে সহাস্যে বললেন, ‘তুমি হলে সেই আবদুল্লা, তোমার কথা আমাকে অনেকে বলেছে। তারা বলেছে, তুমি একটি কুখ্যাত লোক। তুমি নোয়াখালিতে আক্রান্ত মানুষদের রক্ষা তো করোইনি; বরং অনেকক্ষেত্রে আক্রমণকারীদের উৎসাহ দিয়েছো। এটা কি সত্যি?’নোয়াখালির পুলিশ সুপার, এস এম আবদুল্লা গান্ধীজির সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। গান্ধীজি আবদুল্লার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, ‘যা হোক এখন তো তুমি আমার সঙ্গে এসো।’ যে পুলিশ সুপার আবদুল্লার বিরুদ্ধে নোয়াখালির হিন্দুদের অভিযোগ পুঞ্জীভূত, সেই আবদুল্লাকেই সঙ্গে নিয়ে মহাত্মা গান্ধী প্রার্থনাসভায় এলেন। মহাত্মাজির সঙ্গে আবদুল্লাকে দেখে প্রার্থনাসভার শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। গান্ধীজি আবদুল্লাকে তাঁর পাশে বসতে বললেন।
চৌমোহনিতে তিনদিন থাকার পর গান্ধীজি নোয়াখালির দত্তপাড়া গ্রামে প্রবেশ করলেন। এই গ্রাম থেকেই আরম্ভ হল নোয়াখালির উপদ্রুত গ্রামগুলিতে তাঁর ঐতিহাসিক যাত্রা। দত্তপাড়া, কাজিরখিল, শ্রীরামপুর, লক্ষ্মীপুর এই চারটি গ্রামে তিনি তাঁর আস্তানা করে নিলেন। যে গ্রামগুলিতে মেয়েরা বেশি নির্যাতিতা হয়েছিলেন সেই গ্রামগুলিতে পাঠিয়ে দিলেন সুশীলা নায়ার ও সুচেতা কৃপালনিকে। নোয়াখালি এমনি একটি জেলা যেখানে বছরে ন’ মাস জল ডুবে থাকে পথঘাট। নৌকা যেখানে বলতে গেলে প্রধান পরিবহন। জল কাদা ভেঙে বাঁশ ও সুপারি গাছের সাঁকো পেরিয়ে প্রায় সাড়ে চার মাস তিনি নোয়াখালি অবস্থান করেছিলেন। যে গ্রামগুলিতে গান্ধীজি শিবির স্থাপন করেছিলেন, সেখানকার আক্রান্ত ও আক্রমণকারী উভয় সম্প্রদায়ের বাড়ি বাড়ি গিয়েছেন। আটকে রাখা ধর্মান্তরিত হিন্দুদের উদ্ধার করেছেন। যে সকল মৌলভী হিন্দুদের ধর্মান্তরিত হিন্দুদের উদ্ধার করেছেন। যে সকল মৌলবী হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করেছিলেন, তাঁদের বাড়ি গিয়ে তিনি কোরান চেয়েছেন। বলেছেন, ‘আমাকে দেখিয়ে দাও, এই ধর্মান্তরণ করে তুমি আল্লাহ’র কতখানি কাছে যেতে পারবে?’ সেইসব মুসলমানরা তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন, অপরাধ স্বীকার করেছেন। গান্ধীজির সামনে আল্লাহের কাছে কৃতকর্মের জন্য প্রার্থনা করেছেন।
কেন গান্ধীজি নোয়াখালিতে এলেন, কেন নোয়াখালিকে সারা ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে তিনি এত গুরুত্ব দিলেন?
এর জবাব গান্ধীজি নোয়াখালিতে বসেই দিয়েছেন তাঁর ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময়কার সেক্রেটারি কৃষ্ণদাসকে। কৃষ্ণদাসকে তিনি বলেছেন, ‘আমি কেন বাংলার এই প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে এতদিন ধরে পড়ে আছি? এই জেলার হিন্দুরা এতই সংখ্যালঘিষ্ঠ যে তাঁদের অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে হয়। কিন্তু কেন তাঁরা সন্মান ও মর্যাদা নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান প্রতিবেশীদের মতোই থাকতে পারবেন না?’
নোয়াখালির পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট এস এম আবদুল্লা, যাঁকে ওই জেলার প্রতিটি হিন্দু ‘হিন্দু—বিদ্বেষী’ বলে মনে করত, সেই আবদুল্লা গান্ধীজির এক অনুগত ভক্তে পরিণত হলেন। তিনি গান্ধীজিকে জানিয়েছিলেন, কিভাবে মুসলিম লিগে নেতা ও সক্রিয়বাদীরা জেলার প্রশাসনকে কব্জা করে ফেলেছে। সদরে বসে পুলিশ সুপার এবং তাঁর অধস্তন অফিসাররা গ্রাম এলাকার পরিস্থিতির খবর পাচ্ছেন না। গান্ধীজির সঙ্গে আবদুল্লার এই মানসিক ও আত্মিক নৈকট্য মুখ্যমন্ত্রী সুরার্বর্দি খুবই অপছন্দ করলেন। তিনি ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একদিন টেলিগ্রামে আবদুল্লাকে নোয়াখালি থেকে মুর্শিদাবাদে বদলি করে দিলেন। সরকারি অফিসার হিসাবে তিনি ওই নির্দেশ মেনে নিয়ে গান্ধীজির আশীর্বাদ চাইলেন।
দেশ ভাগ হতে চলেছে। কলকাতায় মুসলমানের আক্রান্ত হচ্ছেন। আগস্ট মাসের (১৯৪৭) প্রথম সপ্তাহে গান্ধীজি চলে এলেন সোদপুরে। মুর্শিদাবাদ থেকে সেই নোয়াখালির এস এম আবদুল্লা একদিন সোদপুর চলে এলেন। গান্ধীজি তাঁকে দেখে বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘সেকি তুমি ‘অপশন’ দিয়ে পাকিস্তান যাওনি?’ আবদুল্লা গান্ধীজিকে বললেন, তাঁর পাকিস্তান যাওয়ার ইচ্ছা নেই। তিনি কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। গান্ধীজির নির্দেশ নিতে তাই তিনি এসেছেন। গান্ধীজিকে তাঁকে বললেন, ”তুমি পাকিস্তানে ‘অপশন’ দাও। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে তোমার মতো অফিসারের প্রয়োজন আছে। সেখানকার হিন্দু সংখ্যালঘুরা আবার নিজেদের বিপন্ন বোধ করছে। তুমি তাদের সেবা ও সাহায্য করতে পারবে।’ এস এম আবদুল্লা গান্ধীজির অনুমতি নিয়ে পাকিস্তান ‘অপশন’ দিয়ে চলে গেলেন। এরপর গান্ধীজির সঙ্গে আবদুল্লার আর দেখা হয়নি। প্যারেলাল তাঁর ”গান্ধী দি লাস্ট ফেজ” গ্রন্থে লিখেছেন : গান্ধীজির হত্যার পর তাঁর স্মৃতিরক্ষার জন্য যে জাতীয় তহবিল গড়ে তোলা হল, সেই তহবিলে এক হাজার এক টাকার যে প্রথম মানিঅর্ডারটি এসেছিল সেটি হল ঢাকা থেকে এস এম আবদুল্লার।”