নোবল প্রাইজ
সব জিনিসেরই দুটি দিক আছে–একটি সদর, আর-একটি মফস্বল। শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন বলে বহলোক যে খুশি হয়েছেন, তার প্রমাণ তো হাতেহাতেই পাওয়া যাচ্ছে; কিন্তু সকলে যে সমান খুশি হন নি, এ সত্যটি তেমন প্রকাশ হয়ে পড়ে নি। এই বাংলাদেশের একদল লোকের, অর্থাৎ লেখকসম্প্রদায়ের, এ ঘটনায় হরিষে-বিষাদ ঘটেছে। আমি একজন লেখক, সুতরাং কি কারণে ব্যাপারটি আমাদের কাছে গুরুতর বলে মনে হচ্ছে সেইকথা আপনাদের কাছে নিবেদন করতে ইচ্ছা করি।
প্রথমত, যখন একজন বাঙালি লেখক এই পুরস্কার লাভ করেছেন তখন আর-একজনও যে পেতে পারে, এই ধারণা আমাদের মনে এমনি বদ্ধমূল হয়েছে যে, তা উপড়ে ফেলতে গেলে আমাদের বক ফেটে যাবে। অবশ্য আমরা কেউ রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ নই, বড়জোর তাঁর স্বপক্ষ কিংবা বিপক্ষ। তাই বলে পড়তাটা যখন এদিকে পড়েছে তখন আমরা যে নোবেল প্রাইজ পাব না এ হতে পারে না। সাহিত্যের রাজটিকা লাভ করা যায় কপালে। তাই বলছি, আশার আকাশে দোদুল্যমান এই টাকার থলিটি চোখের সম্মুখে থাকাতে লেখাজিনিসটে আমাদের কাছে অতি সকঠিন হয়ে উঠেছে।
স্বর্গ যদি অকস্মাৎ প্রত্যক্ষ হয় আর তার লাভের সম্ভাবনা নিকট হয়ে আসে, তাহলে মানুষের পক্ষে সহজ মানুষের মত চলাফেরা করা অসম্ভব হয়ে আসে, তাহলে মানুষের পক্ষে সহজ মানুষের মত চলাফেরা করা অসম পড়ে। চলাফেরা দরে যাক, তার পক্ষে পা ফেলাই অসম্ভব হয়—এই ভয়ে, পাছে হাতের স্বর্গ পায়ে ঠেলি। তেমনি নোবেল প্রাইজের সাক্ষাৎ পাওয়া অবধি লেখা সম্বন্ধে দায়িত্বজ্ঞান আমাদের এত বেড়ে গেছে যে, আমরা আর হালকাভাবে কলম ধরতে পারি নে।
এখন থেকে আমরা প্রতি ছত্র সুইডিশ অ্যাকাডেমির মুখ চেয়ে লিখতে বাধ্য। অথচ যেদেশে ছমাস দিন আর ছমাস রাত, সেদেশের লোকের মন যে কি করে পাব তাও বুঝতে পারি নে। এইটুকু মাত্র জানি যে, আমাদের রচনায় অর্ধেক আলো আর অর্ধেক ছায়া দিতে হবে; কিন্তু কোথায় এবং কি ভাবে, তার হিসেব কে বলে দেয়। সুইডেন যদি বারোমাস রাতের দেশ হত, তাহলে আমরা নির্ভয়ে কাগজের উপর কালির পোঁচড়া দিয়ে যেতে পারতুম; আর যদি বারোমাস দিনের দেশ হত, তাহলেও নয়, ভরসা করে শাদা কাগজ পাঠাতে পারতুম। কিন্তু অবস্থা অন্যরপ হওয়াতেই আমরা উভয়সংকটে পড়েছি।
দ্বিতীয় মুশকিলের কথা এই যে, অদ্যাবধি বাংলা আর বাঙালিভাবে লেখা চলবে না। ভবিষ্যতে ইংরেজি তরজমার দিকে এক নজর রেখে এক নজর কেন, পরো নজর রেখেই আমাদের বাংলাসাহিত্য গড়তে হবে। অবশ্য আমরা সকলেই দোভাষী, আর আমাদের নিত্য কাজই হচ্ছে তরজমা করা। কিন্তু সব্যসাচী হলেও এক তীরে দুই পাখি মেরে উঠতে পারি নে। আমরা যখন বাংলা লিখি, তখন ইংরেজির তরজমা করি কিন্তু সে না জেনে; আর যখন ইংরেজি লিখি, তখন বাংলার তরজমা করি–সেও না জেনে। কিন্তু এখন থেকে ঐ কাজই আমাদের সজ্ঞানে করতে হবে, মুশকিল ত ঐখানেই। মনোভাবকে প্রথমে বাংলাভাষার কাপড় পরাতে হবে, এই মনে রেখে যে আবার তাকে সে কাপড় ছাড়িয়ে ইংরেজি পোশাক পরিয়ে সুইডিশ অ্যাকাডেমির সম্মুখে উপস্থিত করতে হবে। এবং এর দরুন মনোভাবটির চেহারাও এমনি ত’য়ের করতে হবে যে, শাড়িতেও মানায় গাউনেও মানায়।
এক ভাষাতে চিন্তা করাই কঠিন, কিন্তু একসঙ্গে যুগপৎ দুটি ভাষাতে চিন্তা করাটা অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু কায়ক্লেশে আমাদের সেই অসাধ্যসাধন করতেই হবে। একটি বাঙালি আর-একটি বিলেতি— এই দুটি স্ত্রী নিয়ে সংসার পাতা যে আরামের নয়, তা যাঁরা ভুক্তভোগী নন তাঁরাও জানেন। তাছাড়া, এ উভয়ের প্রতি সমান আসক্তি না থাকলে এ দুই সংসার করাও মিছে। সর্বভূতে সমদৃষ্টি, চাই কি, মানুষের হতেও পারে; কিন্তু দুটি পত্নীতে সমান অনরোগ হওয়া অসম্ভব, কেননা মানুষের চোখ দুটি হলেও হদয় শুধু একটি। স্বৈণ হতে হলে একটিমাত্র স্ত্রী চাই। এমনকি, দুই দেবীকে পুজা করতে হলেও পালা করে ছাড়া উপায়ান্তর নেই। অতএব দাঁড়াল এই যে, বছরের অর্ধেক সময় আমাদের বাংলা লিখতে হবে, আর অর্ধেক সময় ইংরেজিতে তার তরজমা করতে হবে। ফিরেফিরতি সেই সুইডেনের কথাই এল; অর্থাৎ আমাদের চিদাকাশে ছমাস রাত আর ছমাস দিনের সৃষ্টি করতে হবে, অথচ দৈবশক্তি আমাদের কারও নেই।
তৃতীয় মুশকিল এই যে, সে তরজমার ভাষা চলতি হলে চলবে না। সে ভাষা ইংরেজি হওয়া চাই, অথচ ইংরেজের ইংরেজি হলেও হবে না। দেশী আত্মা এমনিভাবে বিলেতি দেহে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া চাই, যাতে তার পবজন্মের সংস্কারটুকু বজায় থাকে। ফুল ফোটাতে হবে বিলেতি, কিন্তু তার গায়ে গন্ধ থাকা চাই দেশী কুড়ির। প্রজাপতি ওড়াতে হবে বিলেতি, কিন্তু তার গায়ে রং থাকা চাই দেশী পোকার। এককথায়, আমাদের পূর্বের সূর্য পশ্চিমে ওঠাতে হবে। এহেন অঘটনঘটনপটিয়সী বিদ্যা অবশ্য আমাদের নেই।
কাজেই যে কার্য আমরা একদিন বাংলায় করতে চেষ্টা করে অকৃতকার্য হয়েছি–রবীন্দ্রনাথের লেখার অনুকরণ— তাই আবার দোকর করে ইংরেজিতে করতে হবে। ইউরোপে আসল জিনিসটি গ্রাহ্য হচ্ছে বলে নকল জিনিসটিও যে গ্রাহ্য হবে, সে আশা দুরাশা মাত্র। ইউরোপ এদেশে মেকি চালায় বলে আমরাও যে সেদেশে মেকি চালাতে পারব–এমন ভরসা আমার নেই।
ফলে, আমরা শাদাকে কালো আর কালোকে শাদা যতই কেন করি নে, আমাদের পক্ষে নোবেল প্রাইজ ছিকেয় তোলা রইল। কিন্তু যদি পাই? বিড়ালের ভাগ্যে সে ছিকে যদি ছেড়ে! সেও আবার বিপদের কথা হবে। নোবেল প্রাইজ পাওয়ার অর্থ শুধু অনেকটা টাকা পাওয়া নয়, সেইসঙ্গে অনেক খানি সম্মান পাওয়া। অনর্থ এক্ষেত্রে অর্থ নয় কিন্তু তৎসংসষ্ট গৌরবটুকু। বাংলা লিখে আমরা কি অর্থ কি গৌরব, কিছুই পাই নে। বাংলাসাহিত্যে আমরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই, এবং পুরস্কারের মধ্যে লাভ করি তার চাটটকু। স্বদেশীর শুভ-ইচ্ছার ফুলচন্দন কালেভদ্রেও আমাদের কপালে জোটে না বলে ইউরোপ যদি উপযাচী হয়ে আমাদের মাথায় সাহিত্যের ভাইফোঁটা দেয়, তাহলে তার ফলে আমাদের আয়বৃদ্ধি না হয়ে হ্রাস হবারই সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
প্রথমেই দেখুন যে, নোবেল প্রাইজের তারের সঙ্গেসঙ্গেই আমরা শত, শত চিঠি পাব। এবং এই অসংখ্য চিঠি পড়তে এবং তার উত্তর দিতেই আমাদের দিন কেটে যাবে, সাহিত্য পড়বার কিংবা গড়বার অবসর আর আমাদের থাকবে না। এককথায় সমাজের খাতিরে, ভদ্রতার খাতিরে, আমাদের সাহিত্যের ফলফল ছেড়ে শুধু শুষ্কপত্র রচনা করতে হবে। এই কারণেই বোধ হয় লোকে বলে যে, নোবেল প্রাইজ লাভ করার অর্থ হচ্ছে সাহিত্যজীবনের মোক্ষ লাভ করা।
আর-এক কথা, টাকাটা অবশ্য ঘরে তোলা যায় এবং দিব্য আরামে উপভোগ করা যায়, কিন্তু গৌরব-জিনিসটে ওভাবে আত্মসাৎ করা চলে না। দেশসুদ্ধ লোক সে গৌরবে গৌরবান্বিত হতে অধিকারী। শাস্ত্রে বলে ‘গৌরবে বহুবচন’; কিন্তু তার কত অংশ নিজের প্রাপ্য, আর কত অংশ অপরের প্রাপ্য সেসম্বন্ধে কোনো-একটা নজির নেই বলে এই গৌরব-দায়ের ভাগ নিয়ে স্বজাতির সঙ্গে একটা জ্ঞাতিবিরোধের সৃষ্টি হওয়া আশ্চর্য নয়। অপরপক্ষে যদি একের সম্মানে সকলে সমান সম্মানিত জ্ঞান করেন, এবং সকলের মনে কবির প্রতি অকৃত্রিম ভ্রাতৃভাব জেগে ওঠে। তাতেও কবির বিপদ আছে। ত্রিশ দিন যদি বিজয়াদশমী হয়, এবং ত্রিশকোটি লোক যদি আত্মীয় হয়ে ওঠেন, তাহলে নররূপধারী একাধারে তেত্রিশকোটি দেবতা ছাড়া আর কারও পক্ষে অজস্র কোলাকুলির বেগ ধারণ করা অসম্ভব। ও অবস্থায় রক্তমাংসের দেহের মুখ থেকে সহজেই এইকথা বেরিয়ে যায় যে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’। এবং ওকথা একবার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলে তার ফলে কবিকে কেঁদে মরতে হবে।
তাই বলি, আমাদের বাঙালি লেখকদের পক্ষে নোবেল প্রাইজ হচ্ছে। দিল্লির লাড্ডু–যো খায়া ওভি পস্তায়া, যো না খায়া ওভি পস্তায়া।
মাঘ ১৩২০