1 of 2

নোনা-মিঠা – সৈয়দ মুজতবা আলী

নোনা-মিঠা – সৈয়দ মুজতবা আলী

থার্মোমিটার দেখে, কাগজ-পত্র ঘেঁটে জানা যায়, লাল-দরিয়া এমন কিছু গরম জায়গা নয়। জেকবাবাদ পেশাওয়ার দূরে থাক, যাঁরা পাটনা-গয়ার গরমটা ভোগ করেছেন তাঁরা আবহাওয়া দফতরে তৈরী লাল-দরিয়ার জন্মকুণ্ডলী দেখে বিচলিত তো হবেন-ই না, বরঞ্চ ঈষৎ মৃদু হাস্যও করবেন। আর উন্নাসিক পর্যটক হলে হয়ত প্রশ্ন করেই বসবেন, ‘হাল্কা আল্‌স্‌টারটার দরকার হবে না তো!’

অথচ প্রতিবারেই আমার মনে হয়েছে, লাল-দরিয়া আমাকে যেন পার্ক সার্কাসের হোটেলে খোলা আগুনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শিক-কাবাব ঝলসাচ্ছে। ভুল বললুম ; মনে হয়েছে, যেন হাঁড়িতে ফেলে ঢাকনা লেই দিয়ে সেঁটে আমাকে ‘দম্‌-পুখ্‌তে’র রান্না বা ‘পুটপক্ক’ করেছে। ফুটবলীদের যে রকম ‘বগি’ টিম হয়, লাল-দরিয়া আমার ‘বগি সী’।

সমস্ত দিনটা কাটাই জাহাজের বৈঠকখানায় হাঁপাতে হাঁপাতে আর বরফভর্তি গেলাসটা কপালে ঘাড়ে নাকে ঘষে ঘষে, আর রাতের তিনটে যামই কাটাই রকে অর্থাৎ ডেকে তারা গুনে গুনে। আমার বিশ্বাস ভগবান লাল-দরিয়া গড়েছেন চতুর্থ ভূতকে বাদ দিয়ে।ওঁর সমুদ্রে যদি কখনো হাওয়া বয় তবে নিশ্চয়ই ‘কিম্‌-ভূত’ই বলতে হবে।

তাই সে রাত্রে ব্যাপারটা আমার কিম্ভুত বলেই মনে হল।

ডেক চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। ঠিক ঘুম নয়, তন্দ্রা। এমন সময় কানে এল, সেই লাল-দরিয়ায়, দেশ থেকে বহুদূরের সেই সাত সমুদ্রের এক সমুদ্রে—সিলেটের বাঙাল ভাষা। স্বপ্নই হবে। জানতুম, সে জাহাজে আমি ছাড়া আর কোনো সিলেটি ছিল না। এরকম মরমিয়া সুরে মাঝ রাতে কে কাকে ‘ভাই, হি কথা যদি তুলচস—’ বলতে যায়? খেয়ালী-পোলাও চাখতে, আকাশকুসুম শুঁকতে, স্বপ্নের গান শুনতে কোনো খরচা নেই ;—তাই ভাবলুম চোখ বন্ধ করে স্বপ্নটা আরো কিছুক্ষণ ধরে দেখি।

কিন্তু ঐ তো স্বপ্নের একটিমাত্র দোষ। ঠিক যখন মনে হবে, বেশ জমে আসছে, ঠিক তখনই ঘুমটি যাবে ভেঙে। এ-স্থলেও সে আইনের ব্যত্যয় হল না। চোখ খুলে দেখি, সামনে—আমার দিকে পিছন ফিরে দুজন খালাসি চাপা গলায় কথা বলছে।

বেচারীরা! রাত বারোটার পর এদের অনুমতি আছে ডেকে আসবার। তাও দল বেঁধে নয়। বাকি দিনের অসহ্য গরম তাদের কাটাতে হয় জাহাজের পেটের ভিতরে।

সিলেট নোয়াখালির লোক যে পৃথিবীর সর্বত্রই জাহাজে খালাসির কাজ করে সে কথা আমার অজানা ছিল না। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল, তারা কাজ করে মালজাহাজেই ; এই ফরাসী যাত্রীজাহাজে রাত্রি দ্বিপ্রহরে, তাও আবার নওয়াখালি চাটগাঁয়ের নয়, একদম খাঁটি আমার আপন দেশ সিলেটের লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে তার সম্ভাবনা স্বপ্নেই বেশি, বাস্তবে কম।

এরা কথা বলছিল খুবই কম। যেটুকু শুনতে পেলুম, তার থেকে কিন্তু একথাটা স্পষ্ট বোঝা গেল, এদের একজন এই প্রথম জাহাজের কামে ঢুকেছে এবং দেশের ঘরবাড়ির জন্য তার মন বড্ড উতলা হয়ে গিয়েছে। তার সঙ্গী পুরনো লোক ; নতুন বউকে যেরকম বাপের বাড়ির দাসী সান্ত্বনা দেয়, এর কথার ধরন অনেকটা সেই রকমের।

আমি চুপ করে শুনে যাচ্ছিলুম। শেষটায় যখন দেখলুম ওরা উঠি-উঠি করছে তখন আমি কোনো প্রকারের ভূমিকা না দিয়েই হঠাৎ অতি খাটি সিলেটিতে জিজ্ঞেস করলুম, ‘তোমাদের বাড়ি সিলেটে কোন গ্রামে?’

সিলেটের খালাসিরা দুনিয়ার তাবৎ দরিয়ায় মাছের মত কিলবিল করে এ সত্য সবাই জানে, কিন্তু তার চেয়ে ঢের বড় সত্য—সিলেটের ভদ্রসন্তান পারতপক্ষে কখনো বিদেশ যায় না। তাই লাল-দরিয়ার মাঝখানে সিলেটি শুনে আমার মনে হয়েছিল ওটা স্বপ্ন,—সেইখানে সিলেটি ভদ্রসন্তান দেখে ওদের মনে হল, আজ মহাপ্রলয় (কিয়ামতের দিন) উপস্থিত! শাস্ত্রে আছে, ঐ দিনই আমাদের সক্কলের দেখা হবে একই জায়গায়। ভূত দেখলেও মানুষ অতখানি লাফ দেয় না। দু’জন যেভাবে এক-ই তালে-লয়ে লাফ দিল তা দেখে মনে হল ওরা যেন ঐ কর্মটি বহুদিন ধরে মহড়া দিয়ে আসছে।

উভয় পক্ষ কথঞ্চিৎ শান্ত হওয়ার পর আমি কেস খুলে ওদের সামনে ধরলুম। দু’জনেই একসঙ্গেকানে হাত দিয়ে জিভ কাটল। আমাকে তার চেনে না বটে—আমি দেশ ছেড়েছি ছেলেবেলায়—তবে আমার কথা তারা শুনেছে, এবং আমার বাপঠাকুদ্দার পায়ের ধুলো তারা বিস্তর নিয়েছে, খুদাতালার বেহদ্‌ মেহেরবানি, আজ তারা আমার দর্শন পেল, আমার সামনে ওসব—তওবা, তওবা ইত্যাদি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার দেশের চাষারা ইয়োরোপীয় চাষার চেয়ে ঢের বেশি ভদ্র।

খালাসি জীবনের কষ্ট এবং আর পাঁচটা সুখ-দুঃখের কথাও হল। দুঃখের কথাই পনরো আনা তিন পয়সা। বাকি এক পয়সা সুখ—অর্থাৎ মাইনেটা, সেই এক পয়সাই পঁচাত্তর টাকা। ঐ দিয়ে বাড়িঘর ছাড়াবে, জমিজমা কিনবে।

শেষটায় শেষ প্রশ্ন শুধালুম, ‘আহারাদি?’ —রাত তখন ঘনিয়ে এসেছে।

বললে, ‘ঐ তো আসল দুঃখ হুজুর। আমি তো তবু পুরানো লোক। পাউরুটি আমার গলায় গিঁট বাঁধে না। কিন্তু এই ছেলেটার জান পান্তা ভাতে পোঁতা। পান্তা ভাত! ভাতেরই নেই খোজ, ও চায় পান্তা ভাত! মূলে নেই ঘর, পুব দিয়ে তিন দোর। হুঃ!’

আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘সে কি কথা! আমি তো শুনেছি, আর কিছু না হোক তোমাদের ডাল-ভাত প্রচুর খেতে দেয়। জাহাজের কাম করে কেউ তো কখনো রোগা হয়ে দেশে ফেরেনি।’

বললে, ‘ঠিকই শুনেছেন সায়েব। কিন্তু ব্যাপার হয়েছে কি, কোনো কোনো বন্দরে চাল এখন মাগ্‌গি। সারেঙ আমাদের রুটি খাইয়ে চাল জমাচ্ছে ঐসব বন্দরে লুকিয়ে চাল বিক্রি করবে বলে। সারেঙ দেশের জাতভাই কি না, না হলে অন্ন মারার কৌশল জানবে কি করে?’

আমি বললুম,‘নালিশ-ফরিয়াদ করোনি ?’

বললে, ‘কে বোঝে কার বুলি? এদের ভাষা কি জানি, ‘ফ্রিঞ্চি’ না কি, সারেঙই একটুখানি বলতে পারে। ইংরিজি হলেও না হয় আমাদের মুরুব্বিদের কেউ কেউ ওপরওলাদের জানাতে পারতেন। ঐ তো সারেঙের কল! ধন্যি জাহাজ ; ব্যাটারা শুনেছি কোলা ব্যাঙ ধরে ধরে খায়! সেলাম সায়েব, আজ উঠি। দেরি হয়ে গিয়েছে। আপনার কথা শুনে জান্‌টা—’

আমি বললুম, ‘ব্যস, ব্যস।’

॥ ২ ॥

মাঝ রাতের স্বপ্ন আর শেষ রাতের ঘটনা মানুষ নাকি সহজেই ভুলে যায়। আমার আবার চমৎকার স্মৃতিশক্তি—সব কথাই ভুলে যাই। তাই ভাতের কেচ্ছা মনে পড়ল, দুপুরবেলা লঞ্চের সময় রাইসকারি দেখে।

জাহাজটা ফরাসিস ফরাসিসে ভর্তি। আসলে এটা ইণ্ডো-চীন থেকে ফরাসী সেপাইলস্কর লাদাই করে ফ্রান্স যাবার মুখে পণ্ডিচেরীতে একটা ঢুঁ মেরে যায়। প্যাসেঞ্জার মাত্রই পল্টনের লোক, আমরা গুটিকয়েক ভারতীয়ই উটকো মাল। খানাটেবিলে আমার পাশে বসততা একটি ছোকরা সু-লিয়োৎনা—অর্থাৎ সাবঅলটার্ন। আমার নিতান্ত নিজস্ব মৌলিক ফরাসিসে তাকে রাত্রের ঘটনাটি গল্পচ্ছলে নিবেদন করলুম।

শুনে তো সে মহা উত্তেজিত। আমি অবাক! ছুরিকাঁটা টেবিলে রেখে মিলিটারি গলায় ঝাঁজ লাগিয়ে বলতে শুরু করলে, এ ভারি অন্যায়, অত্যন্ত অবিচার, ইনুই—অন-হার্ড-অব্‌—, ফাঁতাস্তিক—ফেনটাসটিক আরও কত কী!

আমি বললুম, ‘রোসো, রোসো। অত গরম হচ্ছ কেন? এ অবিচার তো দুনিয়ার সর্বত্রই হচ্ছে, আকছারই হচ্ছে। এই যে তুমি ইন্ডো-চীন থেকে সেখানে কি কোন ড্যানিয়েলগিরি করতে গিয়েছিলে, মো গাঁর্সো (বাছা)! ওসব কথা থাক, দুটি খাও।‘

ছোকরাটির সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল বলেই কথাটা বলবার সাহস হয়েছিল। বরঞ্চ ইংরেজকে এসব কথা বলবেন, ফরাসীকে বললে হাতাহাতি বোতল ফাটাফাটির সম্ভাবনাই বেশি।

চুপ মেরে একটু ভেবে বললে, ‘হুঁ। কিন্তু এ স্থলে তো দোষী তোমারই জাতভাই ইণ্ডিয়ান সারেঙ!’

আমি বিষম খেয়ে বললুম, ‘ঐ য্-যা!’

পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ এখনো দেখলুম না যেখানে মানুষ সুযোগ পেলে দুপুর বেলা ঘুমোয়। না । তবু যে কেন বাঙালীর ধারণা যে, সে-ই এ ধনের একমাত্র অধিকারী তা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। আপন আপন ডেক চেয়ারে শুয়ে চোখে ফেটা মেরে আর পাঁচটি ফরাসিসের সঙ্গে কোরাসে ঐ কর্মটি সবেমাত্র সমাধান করেছি, এমন সময় উর্দি-পরা এক নৌ-অফিসার আমার সামনে এসে অতিশয় সৌজন্য সহকারে অবনতমস্তকে যেন প্রকাশ্যে আত্মচিন্তা করলেন ; ‘আমি কি মসিয়ো অমুকের সঙ্গে আলাপ করার আনন্দ লাভ করছি?’

আমি তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে উঠে, আরো অবনতমস্তকে বললুম, ‘আদপেই না। এ শ্লাঘা সম্পূর্ণ আমার-ই।’

অফিসার বললেন, ‘মসিয়ো ল্য কমাদাঁ—জাহাজের কাপ্তান সাহেব—মসিয়োকে—আমাকে—তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দাভিবাদন জানিয়ে প্রার্থনা করেছেন যে, তিনি যদি মসিয়োর উপস্থিতি পান, তবে উল্লসিত হবেন।

পাপাত্মা আমি। ভয়ে আঁতকে উঠলাম। আবার কি অপকর্ম করে ফেলেছি যে, মসিয়ো ল্য কমাদাঁ আমার জন্য হুলিয়া জারি করেছেন! শুকনো মুখে, ঢোক গিলে বললম, ‘সে-ই হবে আমার এ-জীবনের সব চেয়ে বড় সম্মান। আমি আপনার পথ প্রদর্শনের জন্য ব্যাকুল।’

মসিয়ো ল্য কমাদাঁ যদিও যাত্রীজাহাজের কাপ্তান, তবু দেখলুম তাঁর ঠোঁটের উপর ভাসছে আরেকখানি জাহাজ এবং সেটা সর্বপ্রকার বিনয় এবং স্তুতি-স্তোকবাক্যে টইটম্বুর লাদাই। ভদ্রতার মানওয়ারী বললেও অত্যুক্তি হয় না। তবে মোদ্দা কথা যা বললেন, তার অর্থ আমার মত বহুভাষী পণ্ডিত ত্রিভুবনে আর হয় না, এমনকি প্যারিসেও হয় না।

এত বড় একটা মারাত্মক ভ্রমাত্মক তথ্য তিনি কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করবো করবো করছি, এমন সময় তাঁর কথার তোড় থেকেই বেরিয়ে গেল, তিনি তিন ‘শ’ তিরনব্বুই বার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে এই প্রথম একটি মহাপণ্ডিত আবিষ্কার করেছেন। যিনি তাঁর খালাসিদের কিচিরমিচিরের একটা অর্থ বের করতে পারেন। যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। তাহলে আমার মত আরো বহু লক্ষ পণ্ডিত সিলেট জেলায় আছেন। তারপর তিনি অনুরোধ করলেন, আমি যদি দয়া করে তাঁর খালাসিদের অসন্তুষ্টির কারণটি খোলসা করে বর্ণনা করি, তবে তিনি বড় উপকৃত হন। আমি তাই করলুম। তখন সেই খালাসিদের আর সারেঙের ডাক পড়লো। তারা কুরবানির পাঁঠীর মত কাঁপতে কাঁপতে উপস্থিত হল।

কাপ্তান আর জজ ভিন্ন শ্রেণীর প্রাণী। সাক্ষীর বয়স কত, সেই আলোচনায় জজেরা হেসে-খেলে সাতটি দিন কাটিয়ে দেন, কাপ্তানরা দেখলুম তিন মিনিটেই ফাঁসির হুকুম দিতে পারেন। মসিয়ো ল্য কমাদাঁ অতি শান্তকণ্ঠে এবং প্রাঞ্জল ফরাসীতে সারেঙকে বুঝিয়ে দিলেন, ভবিষ্যতে তিনি যদি আর কখনো এরকম কেলেঙ্কারির খবর পান, তবে তিনি একটিমাত্র বাক্যব্যয় না করে সারেঙকে সমুদ্রের জলে ফেলে তার উপর জাহাজের প্রপেলারটি চালিয়ে দেবেন।

যাক বাঁচা গেল। মরবে তো মরবে সারেঙটা!

পানির পীর বদরসায়েব। তাঁর কৃপায় রক্ষা পেয়ে ‘বদর বদর’ বলে কেবিনে ফিরলুম।

খানিকক্ষণ পরে চীনা কেবিনবয় তার নিজস্ব ফরাসীতে বলে গেল, খালাসিরা আমাকে অনুরোধ জানিয়েছে আজ যেন আমি মেহেরবানি করে কেবিনে বসে তাদের পাঠানো ‘ডাল-ভাত’ খাই।

গোয়ালন্দী জাহাজের মামুলি রাইসকারি খেয়েই আপনারা আ-হা-হা করেন, সেই জাহাজের বাবুর্চিরা যখন কোর্মা-কালিয়া পাঠায়, তখন কি অবস্থা হয়? নাঃ, বলবো না। দু-একবার ভোজনের বর্ণনা করার ফলে শহরে আমার বদনাম রটে গিয়েছে আমি পেটুক এবং বিশ্বনিন্দুক। আমি শুধু অন্যের রন্ধনের নিন্দা করতেই জানি। আমার ভয়ঙ্কর রাগ হয়েছে। তামাতুলসী স্পর্শ করে এই শপথ করলুম—নাঃ, থাক, আপনার বাড়িতে আমার মা-বোনদের আমি একটা লাসট্‌ চান্স দিলুম।

কাপ্তান্‌সাহেব আমার কাছে ‘চিরকৃতজ্ঞ’ হয়ে আছেন। খালাসিরা তাই এখন নির্ভয়ে খাবার নিয়ে আমার কেবিনে আসে।

করে করে জাহাজের শেষ রাত্রি উপস্থিত হল। সে রাত্রে খালাসিদের তৈরি গ্যালাব্যানকুয়েট খেয়ে যখন বাঙ্কে এ-পাশ ও-পাশ করছি, এমন সময় খালাসিদের মুরুব্বিটি আমার পায়ের কাছটায় পাটাতনে বসে হাতজোড় করে বললে, ‘হুজুর, একটি নিবেদন আছে।’

মোগলাই খানা খেয়ে তখন তবিয়ৎ বেজায় খুশ। মোগলাই কণ্ঠেই ফরমান জারি করলুম, ‘নির্ভয়ে কও।’

বললে, ‘হুজুর ইটা পরগণার ঢেউপাশা গাঁয়ের নাম শুনেছেন?’

আমি বললুম, ‘আলবাৎ! মনু গাঙের পারে।’

বললে, ‘আহা, হুজুর সব জানেন।’

মনে মনে বললুম, ‘হায়, শুধু কাপ্তেন আর খালাসিরাই বুঝতে পারলো আমি কত বড় বিদ্যেসাগর! যারা বুঝতে পারলে আজ আমার পাওনাদারের ভয় ঘুচে যেত তারা বুঝলো না।

বললে, ‘সেই গ্রামের করীম মুহম্মদের কথাই আপনাকে বলতে এসেছি, হুজুর। করীম ব্যাটা মহা পাষণ্ড, চোদ্দ বছর ধরে মার্সঈ (মার্সলেস) বন্দরে পড়ে আছে। ওদিকে বুড়ী মা কেঁদে কেঁদে চোখ দুটি কানা করে ফেলেছে, কত খবর পাঠিয়েছে। হা—কিছুতেই দেশে ফিরবে না। চিঠিপত্রে কিছু হল না দেখে আমরা বন্দরে নেমে তার বাড়ি গিয়েছিলুম, তাকে বোঝাবার জন্য। বেটার বউ এক বেঙখেকী, এমন তাড়া লাগালে যে, আমরা পাঁচজন মদ্দামানুষ প্রাণ বাঁচিয়ে পালাবার পথ পাইনে। তবে শুনেছি, মেয়েমানুষটা প্রথম প্রথম নাকি তার ভাতারের দেশের লোককে আদরকদর করতো। যবে থেকে বুঝেছে, আমরা তাকে ভাঙচি দিয়ে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার তালে আছি, সেই থেকে মারমুখো খাণ্ডার হয়ে আছে।’

আমি বললুম, ‘তোমরা পাঁচজন লেঠেল যে কর্মটি করতে পারলে না, আমি সেইটে পারব? আমাকে কি গামা পায়লওয়ান ঠাউরেছো?

বললে, ‘না, হুজুর, আপনাকে কিছু বলবে না। আপনি সুট টাই পরে গেলে ভাববে আপনি এসেছেন অন্য কাজে। আমাদের লুঙ্গি আর চেহারা দেখেই তো বেটি টের পেয়ে যায়, আমরা তার ভাতারের জাত-ভাই। আপনি হুজুর, মেহেরবানি করে না বলবেন না, আপনার যে কতখানি দয়ার শরীর সে কথা বেবাক খালাসি জানে বলেই আমাকে তারা পাঠিয়েছে। আপনার জন্যই তো আজ আমরা ভাত —’

আমি বললুম, ‘ব্যস, ব্যস, হয়েছে হয়েছে। কাপ্তান পাকড়ে নিয়ে শুধালো বলেই তো সব কথা বলতে হল। না হলে আমার দায় পড়েছিল।’

বললে, ‘তওবা, তওবা, শুনলেও গুনা হয়। তা হুজুর, আপনি দয়া করে আর না বলবেন না। আমি বুড়ীর হয়ে আপনার পায়ে ধরছি।’

বলে সত্য-সত্যই আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরলো। আমি হা-হা করো কি করো কি বলে পা দুটো ছাড়ালুম।

ওরা আমাকে যা কোর্মা-পোলাও খাইয়েছে তার বদলে এ কাজটুকু না করে দিলে অত্যন্ত নেমকহারামি হয়। ওদিকে আবার এক ফরাসিনী দজ্জাল। ঝটা কিংবা ভাঙা ছাতা নয়, পিস্তল হাতে নিয়ে তাড়া লাগানোই ওদের স্বভাব।

কোন্ মূর্খ বেরয় দেশভ্রমণে! কত না বাহান্ন রকমের যতসব বিদকুটে, খুদার খামোখা গেরো!

॥ ৩ ॥

বন্দরে নেবে দেখি, পরদিন ভোরের আগে বার্লিন যাবার সোজা ট্রেন নেই। ফাঁকি দিয়ে গেরোটা কাটাবো তারও উপায় আর রইল না। দু’জন খালাসি নেমেছিল সঙ্গে—ঢেউপাশার নাগরের বাড়ি দেখিয়ে দেবে বলে। তাদের পরনে লুঙ্গি, গায়ে রঙিন শার্ট, মাথায় খেজুরপাতার টুপি, পায়ে বুট, আর গলায় লাল কম্ফর্টার! ঐ কম্ফর্টারটি না থাকলে ওদের পোশাকি সজ্জাটি সম্পূর্ণ হয় না—বাঙালীর যে রকম রেশমী উড়ুনি।

দুই হুজুরে আমাকে ‘হুজুর হুজুর’ করতে করতে নিয়ে গেল বন্দরের এক সাবার্বে। সেখানে দূরের থেকে সন্তর্পণে ছোট্ট একটি ফুটফুটে বাড়ি দেখিয়ে দিয়েই তাঁরা হাওয়া হয়ে গেলেন। আমি প্রমাদ, গুনতে গুনতে এগলুম। পানির পীর বদরসায়েবকে এখন আর স্মরণ করে কোনো লাভ নেই। তাই সোঁদরবনের ডাঙার বাঘের পী র গাজীসাহেবের নাম মনে মনে জপতে লাগলুম—যাচ্ছি তো বাঘিনীরই সঙ্গে মোলাকাত করতে।

বেশ জোরেই বোতাম টিপলুম—চোরের মায়ের বড় গলা।

কে বলে খাণ্ডার? দরজা খুলে একটি ত্রিশবত্রিশ বছরের অতিশয় নিরীহ চেহারার গো-বেচারী যুবতী এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। ‘গো’-বেচারী বললুম তার কারণ আমাদের দেশটা গোরুর। আসলে কিন্তু ওদের দেশের তুলনা দিয়ে বলতে হয়, ‘মেরি হ্যাড্‌ এ লিটল ল্যাম্’-এর ভেড়াটি যেন মেরির রূপ নিয়ে এসে দাঁড়াল। ওদিকে আমি তৈরি ছিলুম পিস্তল, মেশিনগান, হ্যান্ড গ্রেনেডের জন্য। সামলে নিয়ে জাহাজে যে চোস্ত ফরাসিস আদব-কায়দার তালিম পেয়েছিলুম, তারই অনুকরণে, মাথা নিচু করে বললুম, ‘আমি কি মাদাম মা-ও-মের (মুহম্মদের ফরাসী উচ্চারণ) সঙ্গে আলাপ করে আনন্দ লাভ করছি? ইচ্ছে করেই কোন্ দিশী লোক সেটা উল্লেখ করলুম না। ফরাসীরা চীনা ভারতীয় এবং আরবের মধ্যে তফাত করতে পারে না। আমরা যে-রকম চীনা, জাপানী এবং বর্মী সবাইকে একই রূপে দেখি।

চেহারা দেখে বুঝলুম, মাদাম গুবলেট করে ফেলেছেন। বললেন, ‘আঁদ্রে, (প্রবেশ করুন) মসিয়ো। ভরসা পেয়ে বললুম, মসিয়ো মাওমের সঙ্গে দেখা হতে পারে কি?

‘অবশ্য।’

ড্রইংরুমে ঢুকে দেখি শেখ করীম মুহম্মদ উত্তম ফরাসী সুট পরে টেবিলের উপর রকমারি নকশার কাপড়ের ছোট ছোট টুকরোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।

আমি ফরাসীতেই বললুম, ‘আমি মাদ্রাজ থেকে এসেছি, কাল বার্লিন চলে যাবো। ভাবলুম, আপনাদের সঙ্গে দেখা করে যাই।’ সে যে ভারতীয় এবং তার ঠিকানা জানলুম কি করে সেকথা ইচ্ছে করেই তুললুম না।

ভাঙা ভাঙা ফরাসীতে অভ্যর্থনা জানালো।

আমি ইচ্ছে করেই মাদামের সঙ্গে কথাবার্তা জুড়ে দিলুম। মার্সেলেস সে কী সুন্দর বন্দর, কত রকম-বেরকমের রেস্তোরাঁ-হোটেল, কত জাত-বেজাতের লোক, কত শত রকমের বেশভূষা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আরো কত কি।

ইতিমধ্যে একটি ছেলে আর মেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে ঘরে ঢুকেই আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ালো।

কী সুন্দর চেহারা। আমাদের করীম মুহম্মদ কিছু নটবরটি নন, তার বউও ফরাসী দেশের আর পাঁচটা মেয়ের মত কিন্তু বাচ্চা দুটির চেহারায় কি অপূর্ব লাবণ্য। কে বলবে এরা খাটি স্প্যানিস নয়? সে দেশের চিত্রকরদের অয়েলপেন্টিঙে আমি এরকম দেবশিশুর ছবি দেখেছি। ইচ্ছে করে, কোলে নিয়ে চুমো খাই। কিন্তু আশ্চর্য লাগলো, পূর্বেই বলেছি, বাপের চেহারা তো বাঙলা দেশের আর পাঁচজন হাল-চাষের শেখের যা হয় তা-ই, মায়ের চেহারাও সাধারণ ফরাসিনীর মত। তিন আর তিনে তা হলে সব সময় ছয় হয় না। দশও হতে পারে—ইন্‌ফিনিটি অর্থাৎ পরিপূর্ণতাও হতে পারে। প্রেমের ফল তাহলে অঙ্কশাস্ত্রের আইন মানে না।

মাদাম ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ইনি তোদের বাবার দেশের লোক।’ ছেলেটি তৎক্ষণাৎ আমার কাছে এসে গা ঘেষে দাঁড়ালো। আমি আদর করতেই বলে উঠলো, ‘ল্যাঁদ,—সে ত্যঁ প্যাই-ঈ ফাঁতাস্‌তিক নেস্‌পা? —’ অর্থাৎ ‘ভারতবর্ষ ফেনটাসটিক দেশ, সে দেশের অনেক ছবি সে দেখেছে, ভারি ইচ্ছে সেখানে যায়, কিন্তু বাবা রাজি হয় না—তুমি, অল (কাকা), আমাকে নিয়ে চল, ঐ ধরনের আরো কত কী!

আমি আবার প্রমাদ গুনলুম। কথাটা যে দিকে মোড় নিচ্ছে তাতে না মাদাম পিস্তল বের করে।

অনুমান করতে কষ্ট হল না, আলোচনাটা মাদামের পক্ষেও অপ্রিয়। তিনি শুধালেন, ‘মসিয়োর রুচি কিসে?—চা, কফি, শোকোলা (কোকো), কিংবা—’

আমি বললুম, ‘অনেক ধন্যবাদ।’

তবু শেষটায় কফি বানাতে উঠে গেলেন।

সঙ্গে সঙ্গে করীম মুহম্মদ উঠে দাঁড়িয়ে সিলেটি কায়দায় পা ছুঁয়ে সেলাম করতে গেল। বুঝলুম, ওর চোখ ঠিক ধরতে পেরেছে। আমি সিলেটিতেই বললুম, ‘থাক থাক।’

যেভাবে তাকালো তার থেকে বুঝতে পারলুম, সে আমার পায়ের ধুলো নিতে যাচ্ছে না, সে পায়ের ধুলো নিচ্ছে তার দেশের মুরুব্বীদের যাঁর ভিতর রয়েছেন আমার পিতৃ-পিতামহও, সে তার মাথায় ঠেকাচ্ছে দেশের মাটির ধুলো, তার মায়ের পায়ের ধুলো। আমি তখন বারণ করবার কে? আমার কি দম্ভ! সে কি আমার পায়ের ধুলো নিচ্ছে?

শুধু একটি কথা জিজ্ঞেস করলে, ‘হুজুর কোন্ হোটেলে উঠেছেন?’ আমি নাম বললুম। স্টেশনের কাছেই।

আমি বললুম ‘বসো।’ সে আপত্তি জানালো না। তারপর দুজনই আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলুম। কারো মুখে কোন কথা নেই।

এমন সময় মেয়েটি কাছে এসে দাঁড়াল। আমি তার গালে চুমো খেয়ে বললুম, ‘মধু।’

বাপ হেসে বললে, ‘এবারে জন্মদিনে ওকে যখন জিজ্ঞেস করলুম, সে কি সওগাত চায়, তখন চাইলে ইণ্ডিয়ান বর। আমাদের দেশের মেয়েরা বিয়ের কথা পাড়লেই ঘেমে ওঠে।

তার গলায় ঈষৎ অনুযোগের আভাস পেয়ে আমি বললুম, মনে মনে নিশ্চয়ই পুলকিত হয়। আর আসলে তো এসব বাড়ির, দেশের-দশের আবহাওয়ার কথা। এরা পেটের অসুখের কথা বলতে লজ্জা পায়, আমরা তো পাইনে।

ইতিমধ্যে কফি এল। মাদাম বললেন, ‘মেয়ের নাম সারা (ইংরিজিতে Sarah), ছেলের নাম রোমাঁ।’ বাপ বললে, আসলে রহমান। বুঝলুম লোকটার বুদ্ধি আছে। সারা’ নাম মুসলমান মেয়েদেরও হয়। আর রহমানের উচ্চারণ ফরাসীতে মোটামুটি ‘রোমাঁ’-ই।

বেচারী মাদাম। কফির সঙ্গে দিলে দুনিয়ার যত রকমের কেক, পেট্রি, গাতো ব্রিয়োশ, ক্রোয়াসাঁ।

বুঝলুম, পাড়ার দোকানের যাবতীয় চায়ের আনুষঙ্গিক ঝেটিয়ে কিনে আনিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য, প্যাঁজের ফুলুরিও। মাদাম বললে, ‘ম মারি—ইল লেজ এম। আমার স্বামী এগুলো ভালোবাসেন।

ছেলেটা চেচিয়ে বললে, ‘মোয়া ওসি, মামি—আমিও মা।’

মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘মোয়া ওসি, মনোঁক্‌ল্‌—আমিও চাচা।’

আমি আর সইতে পারলুম না। কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি সে সম্বন্ধে আমি সমস্তক্ষণ সচেতন ছিলুম। রোমাঁর ভারত যাওয়ার ইচ্ছে, সারার ভারতীয় বরের কামনা এসব আমায় যথেষ্ট কাবু করে এনেছিল ; কিন্তু ফ্রান্সের সেরা সেরা মিষ্টির কাছে ফুলুরির প্রশংসা—এ কোন্ দেশের রক্ত চেঁচিয়ে উঠে আমাকে একেবারে অভিভূত করে দিলে।’

আমি দাঁড়িয়ে উঠে বললুম, ‘আজ তবে আসি। বার্লিনের টিকিট আমার এখনো কাটা হয় নি। সেটা শেষ না করে মনে শান্তি পাচ্ছিনে।

সবাই চেঁচামেচি করতে লাগলো। ছেলেটা বললে, ‘কিন্তু আপনি তো এখনো আমাদের অ্যালবাম দেখেন নি।’ বলেই কারো তোয়াক্কা না করে অ্যালবাম এনে পাতার পর পাতা উল্টে যেতে লাগলো। ‘এই তো বাজান (বাবা+জান, সিলেটিতে বাজান), কী অদ্ভুত বেশে এদেশে নেবেছিলেন, এটার নাম লুঙ্গি, না বাজান? কিন্তু ভারি সুন্দর, আমায় একটা দেবে, অকঁল্‌—চাচা? বাবারটা আমার হয় না, (মাদাম বললেন ‘চুপ’, ছেলেটা বললে ‘পাদোঁ’ অথাৎ বে-আদবি মাফ করো), এটা মা, বিয়ের আগে ক্যাল এ জনি কী সুন্দর—’

ওঃ!

গুষ্টিসুদ্ধ আমাকে ট্রাম টার্মিনাসে পৌঁছে দিতে এল। পৃথিবীর সর্বত্রই সর্ব মহল্লা থেকে অন্তত একটা ট্রাম যায়—বিনা চেঞ্জে—স্টেশন অবধি। বিদেশীকে সেই ট্রামে বসিয়ে দিলেই হল। মাদাম কিন্তু তবু পই-পই করে কণ্ডাক্টরকে বোঝালেন, আমাকে যেন ঠিক স্টেশনে নাবিয়ে দেওয়া হয়। ‘মসিয়ো এ(ত্‌) এত্রাজেঁর, স্ট্রেঞ্জার, বিদেশী, (তারপর ফিসফিস করে) ফরাসী বলতে পারেন না—’

মনে মনে বড় আরাম বোধ করলুম। যাক, তবু একটি বুদ্ধিমতী পাওয়া গেল, যে আমার ফরাসী। বিদ্যের চৌহদ্দী ধরতে পেরেছে।

মাদাম, কাচ্চাবাচ্চারা চেচালে, ‘ও রভোয়ার।’

করীম মুহম্মদ বললে, ‘সেলাম সায়েব।’

॥ ৪ ॥

আহারাদির পর হোটেলের লাউঞ্জে বসে উপরে ঘুমুতে যাব যাচ্ছি যাব যাচ্ছি করছি এমন সময় করীম মুহম্মদ এসে উপস্থিত। পরনে লুঙ্গি কম্‌ফর্টার!

ইয়োরোপের কোনো হোটেলে ঢুকে আপনি যদি লাউঞ্জে জুতো খুলতে আরম্ভ করেন, তবে ম্যানেজার পুলিস কিংবা অ্যাম্বুলেন ডাকবে। ভাববে, আপনি ক্ষেপে গেছেন। এ-তত্ত্বটি নিশ্চয়ই করীমের জানা ; তাই তার সাহস দেখে অবাক মানলুম। বরঞ্চ আমি-ই ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি তাকে বারণ করলুম। কিন্তু তারপর বিপদ, সে চেয়ারে বসতে চায় না। বুঝতে পারলুম, পরিবারের বাইরে এসে সে ঢেউপাশার ‘করীম্যা’ হয়ে গিয়েছে। জুতো পরবে না, চেয়ারে বসবে না, কথায় কথায় কদম্‌বোস্‌—পদচুম্বন—করতে চায়।

বিরক্ত হয়ে বললুম, ‘এ কি আপদ!’

লজ্জা পেয়ে বললে, হুজুরের বোধ হয় অস্বস্তি বোধ হচ্ছে সকলের সামনে আমার সঙ্গে কথা বলতে। তাহলে, দয়া করে, আপনার কামরায়—’

আমি উন্মা প্রকাশ করে বললুম, ‘আদপেই না।’ এবং এ-অবস্থায় শ্রীহট্টের প্রত্যেক সুসন্তান যা বলে থাকে, সেটাও জুড়ে দিলুম—‘আমি কি এ-ঘরে মাগনা বসেছি, না এদের জমিদারির প্রজা। কিন্তু তুমি এ রকম করছো কেন? তুমি আমার কেনা গোলাম না কি? চলো উপরে।’

সেখানে মেঝেতে বসে এক গাল হেসে বললে, ‘কেনা গোলাম না তো কি? আমার চাচাতো ভাই আছমত ছিল আপনাদের বাসার চাকর। এখনো আমি মাকে যখন টাকা পাঠাই সেটা যায় আপনার সাহেবের (পিতার) নামে। আমি আপনাদের বাসায় গিয়েছি, আপনার আম্মা আমাকে চীনির বাসনে খেতে দিতেন। আমি আপনাকে চিনি হুজুর।’

আমি শুধালুম, ‘বউকে ফাঁকি দিয়ে এসেছ?

বললে, ‘না, হুজুর। খেতে বসে রোমাঁর মা আমাকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে বললে। আপনাকে যে রাত্রে খেতে বলতে পারেনি তার জন্যে দুঃখ করলে। ও সত্যি বললে যে আপনাতে আমাতে বাড়িতে নিরিবিলি কথাবার্তা হবে না, তাই আপনাকে খাওয়ার জন্য অনুরোধ করেনি। আসবার সময় বললে, উনি যা বলেন তাই হবে।’

আমি শুধালুম, ‘বউ না বললে তুমি আসতে না?’

কিছুমাত্র না ভেবে বললে, “নিশ্চয়ই আসতুম। তবে ওকে খামকা কষ্ট দিতে চাইনে বলে, না বলে আসতুম।’ বলে লাজুক বাচ্চাটির মত ঘাড় ফেরালে। আমার বড় ভালো লাগলো।

আমি শুধালুম, ‘আমি তোমাদের বাড়িতে কি বলতে গিয়েছিলাম তোমরা জানলে কি করে? আর আমি শুনেছি, তোমার বউ দেশের লোককে তাড়া লাগায়? আমাকে লাগালো না কেন?’

যেন একটু লজ্জা পেয়ে বললো, “তা একটু-আধটু লাগায় বটে, হুজুর ওরা যে বলে বেড়ায় আমাকে রোমাঁর মা ভ্যাড়া বানিয়ে রেখেছে সে খবরটা ওর কানে পৌঁচেছে। তাই গেছে সে ভীষণ চটে। আসলে ও বড় শান্ত প্রকৃতির মেয়ে, ঝগড়াকাজিয়া কারে কয় আদপেই জানে না।

‘আর মানুষকে কি কখনো ভ্যাড়া বানানো যায়? কামরূপে না, কোনোখানেই না।

‘আপনি তা হলে সব কিছু শুনে বিবেচনা করুন, হুজুর।’

‘সতেরো বছর বয়সে আমি আর পাঁচজন খালাসির সঙ্গে নামি এই বন্দরে। কেন জানিনে, হুজুর, হঠাৎ পুলিস লাগালে তাড়া। যে যার জান নিয়ে যেদিকে পায়ে দিলে ছুট। আমি ছিটকে পড়লুম শহরের এক অজানা কোণে। জাহাজ আর খুঁজে পাইনে। শীতের রাতে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে শেষটায় এক পেপালের ’নিচে শুয়ে পড়লুম জিরবো বলে, যখন হুঁশ, হল তখন দেখি আমি এক হাসপাতালে শুয়ে। জ্বরে সর্বাঙ্গ পুড়ে যাচ্ছে—দেশে আমার ম্যালেরিয়া হত। তারপর ক’দিন কাটলো হুঁশে আর বেহুঁশে তার হিসেব আমি রাখতে পারিনি। মাঝে মাঝে আবছা আবছা দেখতে পেতুম, ডাক্তাররা কি সব বলাবলি করছে। সেরে উঠে পরে শুনতে পাই ওদের কেউই কখনো ম্যালেরিয়া রোগীর কড়া জ্বর দেখেনি বলে সবাই ভড়কে গিয়েছিল। আর জ্বরের ঘোরে মাঝে মাঝে দেখতে পেতুম একটি নার্সকে। সে আমায় জল খাইয়ে রুমাল দিয়ে ঠোঁটের দু’দিক মুছে দিত। একদিন শেষ রাতে কম্প দিয়ে এল আমার ভীষণ জ্বর। নার্স সব-ক’খানা কম্বল চাপা দিয়ে যখন কম্প থামাতে পারলো না তখন নিজে আমাকে জড়িয়ে ধরে পড়ে রইল। দেশে মা যে রকম জড়িয়ে ধরতো ঠিক সেই রকম। তারপর আমি ফের বেহুশ।

‘কিন্তু এর পর যখন জ্বর ছাড়লো তখন আমি ভালো হতে লাগলুম। শুয়ে শুয়ে দেশের কথা, মায়ের কথা’ভাবি আর ঐ নার্সটিকে দেখলেই আমার জানটা খুশিতে ভরে উঠতো। সে মাঝে মাঝে আমার কপালে হাত বুলিয়ে দিতো আর ওদের ভাষায় প্রতিবারে একই কথা বলতো। আমি না বুঝেও বুঝলুম, বলছে, ভয় নেই, সেরে উঠবে।

‘তারপর একদিন ছাড়া পেলুম। সঙ্গে সঙ্গে ছুটলুম বন্দরের দিকে। সেখানে এক জাত-ভাইয়ের সঙ্গে। অন্য এক জাহাজের—আমাদের জাহাজ তো কবে ছেড়ে দিয়েছে। সে সব কথা শুনে বললে, ভাগো, ভাগো, এখুনি ভাগো। তোমার নামে হুলিয়া জারি হয়েছে, তুমি জাহাজ ছেড়ে পালিয়েছ। ধরতে পারলেই তোমাকে পুলিস জেলে দেবে।’

‘ক বছর? কে জানে! এক হতে পারে চোদ্দও হতে পারে। আইন-কানুন হুজুর আমি তো কিছুই জানিনে।

‘কিন্তু যাই-ই বা কোথায়? যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি পুলিস।

‘খানা-পিনার কথা তুলবো না, হুজুর, সে তখন মাথায় উঠে গিয়েছে। কিন্তু রাতটা কাটাই কোথায়?

‘শেষটায় শেষ অগতির গতির কথা মনে পড়ল। হাসপাতাল ছাড়ার সময় সেই নার্সটি আমার সঙ্গে শেকহ্যাণ্ড করে দিয়েছিল একখানা চিরকুট। তখনো জানতুম না তাতে কি লেখা। যাকে দেখাই সে-ই হাত দিয়ে বোঝায় আরো উত্তর দিকে যাও। শেষটায় একজন লোক আমাকে একটা বড় বাড়ির দেউড়ি দেখিয়ে চলে গেল।

‘সেখানে ঘণ্টাতিনেক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রোঁদের পুলিস আমাকে সওয়াল করতে লাগলো। হাসপাতালে দু’মাস ওদের বুলি শুনে শুনে যেটুকু শিখেছিলুম তার থেকে আমেজ করতে পারলুম, ওর মনে সন্দ হয়েছে, আমি কি মতলবে ওখানে দাঁড়িয়ে আছি—আর হবেই না কেন? বুঝলুম, রাশিতে জেল আছেই। মনে মনে বললুম, কি আর করি, একটা আশ্রয় তো চাই। জেলই কবুল। চাচা মামু অনেকেই তো লাঠালাঠি করে গেছেন, আমি না হয় না করেই গেলুম।

‘এমন সময় সেই নার্সটি এসে হাজির। পুলিসকে কি একটা সামান্য কথা বলে আমাকে হাতে ধরে নিয়ে গেল তার ছোট্ট ফ্ল্যাটে—পুলিস যেভাবে তাকে সেলাম করে রা-টি না কেড়ে চলে গেল তার থাকে আন্দেশা করলুম, পাড়ার লোেক ওকে মানে।

‘আমাকে খেতে দিল গরম দুধের সঙ্গে কাঁচা আণ্ডা ফেটে নিয়ে। বেশির ওক্তে কি খেয়েছি জানিনে, হুজুর, কিন্তু হুশের পর দাওয়াই হিসেবেও আমি শরাব খাইনি। তাই ‘বরাণ্ডিটা’ বাদ দিল।

‘রাতে খেতে দিল রুটি আর মাংসের হাল্কা ঝোল। চারটি ভাতের জন্য আমার জান তখন কী আকুলি-বিকুলি করেছিল, আপনাকে কখনো সমঝাতে পারবো না, হুজুর।’

জাহাজের খালাসিদের স্মরণে আমি মনে মনে বললুম, সমঝাতে হবে না।’ বাইরে বললুম, ‘তারপর?’

একটুখানি ভেবে নিয়ে বললে, ‘স কথা বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে, সায়েব। আর কী-ই বা হবে বলে। ও আমাকে খাওয়ালে পরালে আশ্রয় দিলে—বিদেশে -বিভূঁইয়ে যেখানে আমার জেলে গিয়ে পাথর ভাঙবার কথা—এসব কথা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে না বললে কি তার দাম কমে যাবে।’

দাম কমবে না বলেই বলছি হুজুর, ‘সুজন নার্সের কাম করে—’

আমি শুধালুম, ‘কি নাম বললে?’

একটু লজ্জা পেয়ে বললে, ‘আমি ওকে সুজন বলে ডাকি—ওদের ভাষায় সুজান।’

বুঝলুম এটা ফরাসী SUZANNE এবং আরো বুঝলুম, যে-জাতের লোক আমাদের দেশের মরমিয়া ভাটিয়ালি রয়েছে তাদেরই একজনের পক্ষে নামের এটুকু পরিবর্তন করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা কিছু কঠিন কর্ম নয়। অতখানি স্পর্শকাতরতা এবং কল্পনাশক্তি এদের আছে।

আমি শুধালুম, ‘তার পর কি বলছিলে?’

বললে, ‘সুজন নার্সের কাম করে আমাকে যে এক বছর পুষেছিল তখন আমি তার বাড়ির কাজ করেছি। বেচারীকে নিজের রান্না নিজেই করতে হত—হাসপাতাল থেকে গতর খাটিয়ে ফিরে আসার পর। আমি পাক-রসুই করে রাখতুম। শেষ দিন পর্যন্ত সে আপত্তি করেছে, কিন্তু আমি কান দিনি।’

আমি শুধালুম, ‘কিন্তু তোমার পাড়ার পুলিস কোন গোলমাল করলে না।’

একটুখানি মাথা নিচু করে বললে, ‘অন্য দেশের কথা জানিনে, হুজুর, কিন্তু এখানে মহব্বতের ব্যাপারে এরা কোনরকম বাগড়া দিতে চায় না। আর এরা জানতো যে ওর বাড়িতে ওঠার এক মাস পরে ওকে আমি বিয়ে করি।

‘কিন্তু হুজুর, আমার বড় শরম বোধ হত। এ যে ঘর-জামাই হয়ে থাকার চেয়েও খারাপ! কিন্তু করিই বা কি?

‘আল্লাই পথ দেখিয়ে দিলেন।

‘সুজন আমাকে ছুটিছাটার দিনে সিনেমাটিনেমায় নিয়ে যেত। একদিন নিয়ে গেল এক মস্ত বড় মেলাতে। সেখানে একটা ঘরে দেখি, নানা দেশের নানারকম তাঁত জড়ো করে লোকজনকে দেখানো হচ্ছে তাঁতগুলো কি করে চালানো হয়, সেগুলো থেকে কি কি নকশার কাপড় বেরোয়। তার-ই ভিতর একটা দেখতে পেলুম, অনেকটা আমাদের দেশেরই তাঁতের মত।

‘আমার বাপ-ঠাকুদ্দা জোলার কাজ করেছে, ফসল ফলিয়েছে, দরকার হলে লাঠিও চালিয়েছে।

অনেক ইতি-উতি কিন্তু-কিন্তু করে সুজনকে জিজ্ঞেস করলুম, তাঁতের দাম কত? বুঝতে পারলো, ওতে আমার শখ হয়েছে। ভারি খুশি হল, কারণ আমি কখনো কোনো জিনিস তার কাছ থেকে চাইনি। বললে, ওটা বিক্রির নয়, কিন্তু মিস্ত্রী দিয়ে আমাকে একটা গড়িয়ে দেবে।

‘ওদেশে ধুতি, শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা কিনবে কে? আমি বানালুম স্কার্ফ, কম্‌ফর্টার। দিশী নকশায়। প্রথম নক্‌শার আধখানা ফুটতে না-ফুটতেই সুজনের কী আনন্দ। স্কার্ফ তাঁত থেকে নামাবার পূর্বেই সে পাড়ার লোক জড়ো করে বসেছে আজগুবি এক নূতন জিনিস দেখাবে বলে। সবাই পই-পই করে দেখলে, অনেক তারিফ করলে। সুজনের ডবল আনন্দ, তার স্বামী নিষ্কর্মা, ভবঘুরে নয়। একটা হুনুরী, গুণী লোক।

‘গোড়ার দিকে পাড়াতে, পরে এখানে-সেখানে বিস্তর স্কার্ফ বিক্রি হল। বেশ দু’ পয়সা আসতে লাগলো। তারপর এখানকার এক তাঁতির কাছে দেখে এলুম কি করে রেশমের আর পশমের কাজ করতে হয়। শেষটায় সুজন নিয়ে এল আমার জন্য বহুৎ কেতাব, সেগুলোতে শুধু কাশ্মীরী নকশা নয়, আরো বহুৎ দেশের বহু রকম-বেরকমের নকশাও আছে। তখন যা পয়সা আসতে লাগলো তারপর আর সুজনের চাকরি না করলেও চলে। সেই কথা বলতে সে খুশির সঙ্গে রাজি হল। শুধু বললে, যদি কখনো দরকার হয় তবে আবার হাসপাতালে ফিরে যেতে পারবে। রোমী তখন পেটে। সুজন সংসার সাজাবার জন্য তৈরি।

‘আপনি হয়তো ভাবছেন আমি কেন বুড়ীর কথা পাড়ছিনে। বলছি, হুজুর, রাতও অনেক ঘনিয়ে এসেছে, আপনি আরাম করবেন।

‘আপনি বিশ্বাস করবেন না, দু’পয়সা হতেই সুজন-ই বললে, “তোমার মাকে কিছু পাঠাবে না?” আমি আগের থেকেই বন্দরে ইমানদার লোক খুঁজছিলুম। রোমাঁর মা-ই বললে ব্যাঙ্ক দিয়েও নাকি দেশে টাকা পাঠানো যায়।

‘মাসে মাসে বুড়ীকে টাকা পাঠাই। কখনো পঞ্চাশ, কখনো একশ’। ঢেউপাশাতে পঞ্চাশ টাকা অনেক টাকা। শুনি বুড়ী টাকা দিয়ে গাঁয়ের জন্য জুম্মা-ঘর বানিয়ে দিয়েছে। খেতে পরতে তো পারছেই।

‘টাকা দিয়ে অনেক কিছুই হয়, দেশে বলে, “টাকার নাম জয়রাম, টাকা হৈলে সকল কাম” —কিন্তু, হুজুর, টাকা দিয়ে চোখের পানি বন্ধ করা যায় না। একথা আমি খুব ভালো করেই জানি। বুড়ীও বলে পাঠিয়েছে, টাকার তার দরকার নেই, আমি যেন দেশে ফিরে যাই।

‘আমার মাথায় বাজ পড়ল, সায়েব, যেদিন খবর নিয়ে শুনলুম, দেশে ফিরে যাওয়া মোটেই কঠিন নয় কিন্তু ফিরে আসা অসম্ভব। আমি এখন আমার মহল্লার মুরুব্বিদের একজন। থানার পুলিসের সঙ্গেও আমার বহুৎ ভাব-সাব হয়েছে। আমার বাড়িতে প্রায়ই তারা দাওয়াত-ফাওয়াত খায়। তারা প্যারিস থেকে পাকা খবর আনিয়েছে, ফিরে আসা অসম্ভব। মুসাফির হয়ে কিংবা খালাসি সেজে পালিয়ে এলেও প্যারিসের পুলিস এসে ধরে নিয়ে দেশে চালান দেবে। এমনকি তারা আমাকে বারণ করেছে আমি যেন ঐ নিয়ে বেশি নাড়া-চাড়া না করি। প্যারিসের পুলিস যদি জেনে যায় আমি বিনা পাসপোর্টে এদেশে আছি তা হলে তারা আমাকে মহল্লার পুলিসের কদর দেখাবে না। এদেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে। আপনি ‘কি বলেন, হুজুর?’

ডাহা মিথ্যা বলি কি প্রকারে? আমার বিলক্ষণ জানা ছিল, ফ্রান্স চায় টুরিস্‌ট্‌ সে দেশে এসে আপন গাঁটের পয়সা খরচা করুক, কিন্তু তার বেকারির বাজারে কেউ এসে পয়সা কামাক এ অবস্থাটা সে যে করেই হোক রুখবে।

আমি চুপ করে রইলুম দেখে করীম মুহম্মদ মাথা নিচু করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে।

অনেকক্ষণ পর মাথা তুলে বললে, ‘রোমাঁর মা আমার মনের সব কথা জানে। দেশের লোক ভাঙচি দেয়, আমি ভেড়া বনে গিয়েছি এ-কথা বলে—এসব শুনে সে তাদের পছন্দ করে না, কিন্তু মাঝে মাঝে ভোরের ঘুম ভেঙে গেলে দেখি সেও জেগে আছে। তখন আমার কপালে হাত দিয়ে সে বলে, তোমার দেশে যদি যেতে ইচ্ছে করে তবে যাও। আমি একাই বাচ্চা দুটোকে সামলাতে পারবো। এসব আরম্ভ হল, ও নিজে মা হওয়ার পরের থেকে।

‘আজ আপনার কথা তুলে বললে, এ ভদ্রলোকের শরীরে দয়ামায়া আছে। আমার ছেলেমেয়েকে কত আদর করলেন। আমি বললুম, সুজন, তুই জানিসনে, আমাদের দেশের ভদ্রলোক আমাদের কত আপনজন। এই যে ভদ্রলোক এলেন ওর সায়েব (পিতা) আমার বাবাকে পূতী-ছেলে বলে ডাকতেন। এদেশের ভদ্রলোক তো গরিবের সঙ্গে কথা কয় না। আপনি-ই বলুন, হুজুর।’

তার ‘আপনজন’! ঐটুকুই বাকি ছিল।

‘সুজন আজ বললে ওঁর কাছে গিয়ে তুমি হুকুম নাও। উনি যা বলেন তাই হবে। এইবার আপনি হুকুম দিন, হুজুর।’

আমি হাত জোড় করে বললুম, ‘তুমি আমায় মাপ করো।’

সে আমার পায়ে ধরে বললে, ‘আপনার বাপ-দাদা আমার বাপ-দাদাকে বিপদে-আপদে সলা দিয়ে হুকুম করে বাঁচিয়েছেন। আজ আপনি আমায় হুকুম দিন।’

আমি নির্লজ্জের মত পূর্ব-ঐতিহ্য অস্বীকার করে বললুম, ‘তুমি আমায় মাপ করো।’

অনেক কান্নাকাটি করলো। আমি নীরব।

শেষ রাত্রে আমার পায়ে চুমো খেল। আমি বাধা দিলুম না। বিদায় নিয়ে বেরবার সময় দোরের গোড়ায় তার বুক থেকে বেরল, ‘ইয়া আল্লা!’

১৩৬১ (১৯৫৪)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *