নোংরা

নোংরা

হাবুল মফস্বল কলেজ হইতে বি. এ. পাস করিয়া কলিকাতায় এম. এ. পড়িতে আসিতেছে। জোড়াসাঁকোয় তাহার কাকার বাড়ি, কয়েক দিন হইতে সেখানে একটু সাড়া পড়িয়া গিয়াছে। বউয়ে-ঝিয়ে, ছেলে-মেয়ের পরিবারটি একটু বড়, সতর্কতা সত্ত্বেও একটু অপরিচ্ছন্নতা আসিয়াই পড়ে। গৃহিণী বলিতেছেন, “আমি উদয়াস্ত খিটখিট ক’রে হার মানলাম, এইবার তোমরা জব্দ হবে। সে এমন শুচিবেয়ে ছেলে না, একটু কোথাও ময়লা দেখলে হুলুস্থুল কাণ্ড বাধাবে।”

বধূ নিজের দুরন্ত ছেলেমেয়ে দুইটি আর ছোট দেওর-ননদগুলিকে খেলায়-ধূলায়, সাজে-গোজে পরিচ্ছন্নতায় অভ্যস্ত করাইতেছে; একটু এদিক-ওদিক হইলেই শাসাইতেছে, “ওই গাড়ির শব্দ, দেখ তো র‍্যা, বোধ হয় হাবুল ঠাকুরপো এল।” শিশুমহলে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়ায় বেশ সুফলও পাওয়া যাইতেছে।

স্কুলগামী ছেলেমেয়ে পাঁচটি। তাহারা পড়ার ঘরদুয়ার ঝাড়িয়া-ঝুড়িয়া বইয়ে সাদা কাগজের মলাট দিয়া, এক প্রকার সশঙ্ক আগ্রহের সহিত হাবুলের প্রতীক্ষা করিতেছে; ওদিকে তাহাদের স্কুলে পর্যন্ত হাবুলদাদার অলৌকিক পরিচ্ছন্নতার সংবাদ প্রচার করিয়া সেখানেও একটু বিস্ময়ের গুঞ্জন তুলিয়াছে। বড় মেয়েটি আবার একটু বেশি কল্পনাপ্রবণ, চোখ-মুখ কুঞ্চিত করিয়া সহপাঠিনীদের বলিতেছে, “এত্তোটুকু ধুলো কি বালি একটু দেখুক দিকিন হাবুলদা তোমার গায়ে, এই একরত্তি, হুঁ মশাই?” পরিণামটুকু তাদের কল্পনার উপর ছাড়িয়া দিয়া আরও ভয়ঙ্কর করিয়া তুলিতেছে।

ঠিক এতটা না হলেও ছেলেটি এ বিষয়ে একটু বাতিকগ্রস্ত বটে। আসিল, দিব্য ফিটফাট; ট্রেনে, জাহাজে যে এই বারোটি ঘণ্টা কাটাইয়া আসিল, চেহারায় তাহার চিহ্ন খুবই কম, পরিচ্ছদে নাই বলিলেও চলে, জুতা জোড়াটি পর্যন্ত কখন এরই মধ্যে কেমন করিয়া ঝাড়িয়া ঝকঝকে করিয়া লইয়াছে।

ব্যাগটা রাখিয়া কাকীমাকে প্রণাম করিতে ঝুঁকিয়া হঠাৎ একটু পাশে সরিয়া গেল। বলিল, “একটু স’রে এস এদিকে কাকীমা, একটু যেন নোংরা ওখানটা।”

ছেলেমেয়েরা সসম্ভ্রম কৌতূহলে এক স্থানে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, বড় মেয়েটি আগাইয়া গিয়া চারিটি আঙুল দিয়া জায়গাটা মুছিয়া দেখিল, তকতকে শানের উপর একটু জলের সঙ্গে সামান্য যেন ময়লা। সরিয়া আসিয়া চোখ বড় করিয়া সবাইকে দেখাইয়া সেটুকু কাগজে মুছিয়া রাখিতে গেল, সহপাঠিনীদের দেখাইবে—হাবুলদার প্রমাণ

হাবুল প্রশ্ন করিল, “বৌদি কোথায় কাকীমা? সেই দাদার বিয়ের সময় দেখেছিলাম। সামনে আসতে লজ্জা হচ্ছে নাকি তাঁর?’

বউদি সে ভাবের উৎকট রকম লাজুক নয়। রান্নাঘর হইতে হাতমুখ মুছিয়া আসিতেই ছিল, মাঝপথে ননদের সপ্রমাণ রিপোর্ট পাইয়া, ফিরিয়া গিয়া একবার আরশিটা দেখিয়া লইতেছিল। একটু দেরি যে হইয়া গেল, তাহার কারণ, সুন্দরী স্ত্রীলোকের আরশির সামনে দাঁড়াইলে একটু দেরি হইয়া যায়ই। শাশুড়ির ডাকে আসিয়া হাজির হইল। একটি মিষ্টি হাসি দিয়া দেবরকে অভ্যর্থনা করিয়া বলিল, “এস ভাই, ভাল আছো তো?”

“মন্দ নয়।”—বলিয়া হাবুল পায়ের ধূলা লইল, এবং সত্য ধূলা লাগিয়াছে কি না, একবার ত্বরিতে দেখিয়া লইয়া হাতটা কপালে ঠেকাইয়া হাসিয়া বলিল, “ভাগ্যিস কাকীমা ডেকে দিলেন, নইলে মোটে আছি কি না সে খোঁজই নিতে বড়! অন্যায় বললাম কাকীমা?”

কাকীমা হাসিয়া বলিলেন, “ওই আরম্ভ করলি! উনি তো এসেছিলেনই বাপু।”

বউদি বলিল, “না ভাই, আমি এক টেরেয় ওদিকে একটু কাজে ছিলাম; কেউ এলে- গেলে ওদিক থেকে টের পাওয়ার জো নেই?”

“কাজ, রন্ধন তো?”

“পেটুকের জাত তোমরা, শুধু ওটিকেই চেন বটে, কিন্তু তা ছাড়া আমাদের আর কাজ নেই নাকি?”

“আঁচলের কোণে মসলার ছোপ লাগবে আর কোন কাজে?”

বধূ লজ্জিতভাবে আঁচলের দিকে চাহিয়া মুখ নীচু করিল; এত সাবধান হওয়া সত্ত্বেও অপযশটুকু লাগিয়াই গেল। আচ্ছা চোখ তো। ননদ আসিয়া পাশ ঘেঁষিয়া দাঁড়াইল। সঙ্গোপনে আঁচলটা তুলিয়া ধরিয়া বধূর দিকে চাহিয়া ফিসফিস করিয়া বলিল, “ইস, আমাদের তো চোখেই পড়ে না।”

হাবুল বলিল, “তা হোক, তোমার বউ কিন্তু কাকীমা ছেলেমেয়েগুলিকে বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখেছে।”

কাকীমা বলিলেন, “তা বলতে নেই বাপু, সেদিকে বেশ নজর আছে।”

স্বীয় প্রশংসায় একটু সঙ্কুচিত হইয়া বধূ বলিল, “দাঁড়াও, যশ কতক্ষণ টেকে দেখ।”

ছোটদের মধ্যে মৃদু একটু চাঞ্চল্য পড়িল, তাহাদের প্রশংসা হইতেছে। ও জিনিসটা তাহাদের বরাতে সচরাচর জোটে না। একজন নিজের পরিষ্কার জামাটির উপর হাত বুলাইয়া নূতন করিয়া একটু ঝাড়িয়া লইল। দেখাদেখি পাশেরটিও তাহাই করিল এবং ক্রমে পদ্ধতিটা সংক্রামক হইয়া উঠিল। একটি ছোট মেয়ের হাতে একটি ধূলিমলিন পেয়ারা লুকানো ছিল। সেটি তাড়াতাড়ি ফেলিয়া দিল এবং দেহ ও পরিচ্ছদ দুইটিই পরিষ্কার রাখিবার উৎসাহে ফ্রকের মাঝ-বরাবর হাতটা বেশ ভাল করিয়া টানিয়া লইল। ইহাতে যখন সকলে হাসিয়া উঠিল, মেয়েটি লজ্জায় রাঙা হইয়া উঠিয়া বধূকে জড়াইয়া তাহার হাঁটু দুইটির মাঝখানে মুখটা গুঁজিয়া দিল।

“ছাড়, আমার কাপড়ও খাবি এই সঙ্গে?”—বলিয়া বধূ মেয়েটিকে সরাইয়া দিবার চেষ্টা করিয়া কৃতকার্য না হওয়ায় দেবরের দিকে চাহিয়া বলিল, “দেখলে তো, সোজা এই ভূত-পেত্নীদের সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে থাকা ঠাকুরপো? বলছ তো—”

অতি-পরিচ্ছন্নতাটা যে বাড়ির স্বাভাবিক অবস্থা নয়, হাবুল সেটা বুঝিতে পারিয়াছিল এবং এটাও আঁচিয়া লইয়াছিল যে, তাহারই পরিচ্ছন্নতা-বাতিকের জন্য পরিবারটি একটু সচেতন হইয়া উঠিয়াছে। মনে মনে একটু লজ্জিত হইয়া বলিল, “তা তোমার যে এত পরিষ্কার-বাই, তা আমার জানা ছিল না বউদি। দাদার ছোট মেয়ে বুঝি ওটি? এস তো আমার কাছে মা; মা তোমার মেমসাহেব, নেবে না।”

ভাজ ব্যস্তভাবে মানা করা সত্ত্বেও পেয়ারা-রসসিক্ত মেয়েটিকে বুকে তুলিয়া লইল। ছেলেরা যেন স্তম্ভিত হইয়া গেল, এত বড় অঘটন তাহারা জন্মে দেখে নাই।

কাকীমা বলিলেন, “ওরে ওর জুতোর ধূলোয় তোর জামাটা গেল হাবু, নামিয়ে দে। ওমা! তোর অমন শুচিবাই গেল কোথায়?”

হাবুলের সমস্ত শরীরটা ঘিনঘিন করিতেছিল, মরীয়া হইয়া মেয়েটির পেয়ারাচিবানো মুখে একটা চুম্বন দিয়া বলিল, “এসব চিরকাল থাকবে নাকি কাকীমা? সে ছিল একটা রোগ, যখন ছিল তখন ছিল।”

বড় মেয়েটি একটু নিরাশ হইয়া পড়িল, ‘হায়, তাহার পূজার প্রতিমার ভিতরে খড়!”

.

হাবুল দিন-পাঁচেক কোন রকমে যথাসম্ভব আত্মগোপন করিল, তাহার পর নবাগমনের সঙ্কোচটা কটিয়া গেলে নিজমূর্তি ধারণ করিল।

কলেজ হইতে আসিয়াছে। হাত-মুখ ধুইয়া মাঝে মাঝে নাক উঁচু করিয়া শরীরে, কাপড়ে কিংবা ঘরে কোথায় অতি-সূক্ষ্ম ময়লা আছে তাহাই উপলব্ধি করিতেছিল। খুড়তুতো বোন শৈল—সেই স্কুলের ছাত্রী বড় মেয়েটি—আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “চা আনব দাদা?”

“তোর নখ দেখি?”

শৈল হাত দুইটি উপুড় করিয়া সামনে ধরিল। ঘটনাক্রমে নখ ছিল না, শৈল আজই ক্লাসে বসিয়া দাঁতে খুঁটিয়া শেষ করিয়াছে। হাবুল বলিল, “যাও, জেনে রেখো, নখের ময়লা বিষ, পেটে গেলে— “

শৈল বলিল, “তা জানি, ম’রে যায় লোকে।”

ভগ্নীর স্বাস্থ্য-জ্ঞানটা তাহার চেয়েও এত উৎকট রকম প্রবল দেখিয়া হাবুল হঠাৎ কিছু বলিতে পারিল না। একটু থামিয়া বলিল, “হুঁ, জারম কাকে বলে জান?—রোগের বীজাণু?”

শৈল ভাবিতে লাগিল।

“কিসে একজনের শরীর ঘাঁটাঘাঁটি ক’রে আর সুবিধে পেলে তাকে মেরেও ফেলে অন্যজনের শরীরে রোগ নিয়ে যেতে পারে?”

শৈল আর একটু ভাবিল, তাহার পর হেঁয়ালির উত্তর দেওয়া গোছের করিয়া বলিয়া উঠিল, “ডাক্তারে।”

হাবুল বিরক্ত হইয়া বলিল, “কোন্ বিদুষী তোমাদের হাইজিন পড়ান? জাম এক রকম খুব ছোট পোকা, এত ছোট যে একটা সূচের ডগায় লক্ষ লক্ষ থাকতে পারে; তারা যতরকম রোগ ছড়িয়ে বেড়ায়, বুঝেছ তো? এখন, এদের থেকে বাঁচতে হ’লে আমাদের কি করতে হবে?”

“সূচ কিনব না।”

হাবুলের ধৈর্য চরম সীমায় পৌঁছিয়া গিয়াছিল, তবুও সংযতকণ্ঠে বলিল, “পরিষ্কার থাকতে হবে, কেননা ধুলো কাদা, পচা জিনিস—এইসব নানান রকম ময়লাতে এদের জন্ম আর বৃদ্ধি। টিটেনাস কাকে বলে, জান?—ধনুষ্টঙ্কার?”

“অর্জুনের—”

“না, না, অজুনের ধনুষ্টঙ্কার নয়, সে এক রকম রোগ। যা, চা-টা নিয়ে আয়।”

দেরি হইয়া যাইতেছে দেখিয়া বউদিদি নিজেই চা লইয়া আসিল। হাবুল বলিল, ‘একটা সাধারণ রোগের নাম পর্যন্ত জানে না, এরা পরিষ্কার থাকার মানে কি বুঝবে বল তো বউদি? কাজেই তুমি সর্বদা খড়্গহস্ত হয়ে থাকলেও কোন ফল হচ্ছে না, আমি ঠিক করেছি, এদের সবাইকে একত্র করে আমি রোজ বিকেলে খানিকটা ক’রে লেকচার দোব। শৈল, সবাইকে ডেকে আনবি।”

বউদি বলিল, “রোগের নাম মুখস্থ করবার জন্যে?”

“শুধু রোগের নাম কেন? সৌন্দর্যের দিক থেকেও তো পরিষ্কার থাকার একটা মূল্য আছে! ওই, ওই দেখ না, তোমার জ্যেষ্ঠ রত্নটি। এই একটু আগে ফুটফুটে দেখাচ্ছিল—ভূত সেজে এল দেখ না! শৈল, যা, ওকে বাইরেই ঝেড়েঝুড়ে নিয়ে আয়। যা যা, এখুনি এসে ওর মাকে জড়িয়ে ধরবে। হুঁ, এদের রোগের কথা বললে কি বুঝতে পারবে? এদের বলতে হবে, বিশ্রী দেখায়। ছেলেপুলে মানুষ করা সোজা নাকি যে—আচ্ছা, তুমি প্রসূতি-বিজ্ঞান পড়েছ বউদি?”

“নামও শুনি নি, নাও তোমার চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

স্বাস্থ্য এবং সৌন্দর্যতত্ত্ব সম্বন্ধে লেকচার শুনিয়া বাড়িতে ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা চঞ্চলতা পড়িয়া গেল, এবং হাবুলকে কেন্দ্র করিয়াই ব্যাপারটা চলিতে লাগিল বলিয়া তাহার দুর্ভোগটা বাড়িল বই কমিল না। তাহাদের মধ্যে, কোন্ রকম ময়লায় কি জাম বৃদ্ধি পায়, সেই লইয়াই তর্ক হয়, ময়লার আধারটি—পুরানো ন্যাকড়া, ময়লা কাগজ, পচা কি ছাতা-ধরা কোন জিনিস হাবুলের নিকট হাজির হয়। সময় নাই, অসময় নাই, প্রায়ই দুই- তিনজনে মিলিয়া একজনকে ধরিয়া হাজির করিতেছে—কাপড়ে কি শরীরে কোথায় একটু ময়লা আছে—হাবুলের কাছে বামালসুদ্ধ নালিশ। হাবুলের পড়িবার ক্ষতি হইতেছে, তাহা ছাড়া এই সব টানা-হিঁচড়ানিতে তাহার ঘরের পরিচ্ছন্নতাও কিছু বৃদ্ধি পায় না। সে আশা করিতেছে, এদের অজ্ঞতাটা দূর হইলে এবং সৌন্দর্যের জ্ঞানটা একটু ফুটিলে সব ঠিক হইয়া যাইবে। ওদিকে আক্রোশের ভাবটা বাড়িয়া যাওয়ায় ওরা সব ক্রমাগতই পরস্পরের জামাকাপড় নানা ফন্দিতে নোংরা করিয়া মকদ্দমা সাজানোয় হাত রপ্ত করিতেছে।

একমাত্র শৈল সম্বন্ধে এ কথা বলা চলে না। সে দাদাকে দেবতা বলিয়া মানিয়া লইয়াছে। দেবতার মতই তাহাকে সুদূরে রাখিয়া সসম্ভ্রম পরিচ্ছন্নতার সহিত পূজা করিতেছে, যত রকম ময়লার যত রকম রোগ হইতে পারে, অবিচল নিষ্ঠার সহিত তাহাদের নাম মুখস্থ করিতেছে এবং তাহার দেবতার প্রাত্যহিক জীবনের খুঁটিনাটিগুলোকে কল্পনা এবং ভাষায় মণ্ডিত করিয়া তাহার কয়েকটি মুগ্ধ সহপাঠিনীদের মধ্যে ভাগবতরস বিতরণ করিতেছে।

এদিকে সংবাদ এই। ওদিকে কাকা এবং হাবুলের খুড়তুতো বড় ভাই ভিতরে ভিতরে চিন্তান্বিত হইয়া উঠিতেছিলেন; অবসরমত দুইজনের মাঝে মাঝে এই সমস্যা লইয়া পরামর্শও হইতেছিল। অবশেষে একদিন কাকা বলিলেন, “হাবুল, তুই দেখতে পাচ্ছি পাড়ার স্যানিটারি ইন্সপেক্টর দাঁড়িয়ে গেছিস, এ তো কাজের কথা নয়। একটা বছর বাদে তোকে অমন শক্ত এগ্‌জামিন দিতে হবে, তুই লেখাপড়া করবি কখন? আমি বলি, তেতলার কোণের ঘরটা নে। দিব্যি নিরিবিলি ঘর, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালবাসিস, সেখানে কোন রকম বালাই জুটবে না।”

হাবুল বলিল, “তা বেশ, কিন্তু এদের আমি অনেকটা ঠিক ক’রেও এনেছিলাম কাকা।”

বারান্দার ও-কোণে বড় নাতিটির আবির্ভাব। বাঁ হাতে একটা সাবান, ডান বগলে একটা ভিজা বিড়ালছানা ছটফট করিতেছে। কাকা সেই দিকে চাহিয়া বলিলেন, “হ্যাঁ, তা দেখছি। যাক্ তুই ওপরেই গিয়ে থাক্। চাকরটাকে বলে দিচ্ছি খাট, আলমারি, টেবিল সব দিয়ে আসুক।”

.

কাকার প্রতি একটু রাগ হইল, কিন্তু উপরে গিয়া কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটুকু কাটিয়া গেল। মাঝারি গোছের ঘরটি, সামনে প্রশস্ত তেতলার ছাদ। সকালের ঝোঁকে হাবুল সমস্ত স্থানটি চাকর আর ভক্ত শৈলর সাহায্যে ঝকঝকে তকতকে করিয়া লইল, এবং কলেজ হইতে ফিরিয়া যখন দেখিল, যেখানকার যেটি অনাহত শ্রীতে ঠিক সেইখানেই বিরাজ করিতেছে, ঘরের কোণে যত্ন করিয়া সঞ্চিত ভিন্ন ভিন্ন জারমের আধার জড়ো করা নাই এবং বিছানার উপরও কোনও শিশু হাবুলকে সৌন্দর্য এবং পরিচ্ছন্নতা দেখাইবার আগ্রহে জুতার ফিতা বাঁধিতেছে না, তখন সে সত্যই একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিল।

দুই দিন পরে আরও একটা আশ্চর্য ব্যাপার চোখে পড়িল। ছেলেমেয়েগুলি প্রকৃতই যেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হইয়া উঠিতেছে। হাবুল যে উপরে আছে এবং যে কোন মুহূর্তেই নামিয়া আসিতে পারে, এই ধারণাটি অনেক বেশি কাজ হইতেছে। মোট কথা, সে নাই বলিয়াই একটি অটল গাম্ভীর্যের কাল্পনিক মূর্তিতে সবার সামনে বিরাজ করিতেছে। আহারের জন্য কিংবা কলেজ হইতে আসা কি কলেজ যাওয়ার সময় যখন সবার প্রত্যক্ষ হয়, তখন সবাই সসম্ভ্রমে দৃষ্টি নত করিয়া তটস্থ হইয়া থাকে।

দেবতারা দূরে থাকিয়া বৎসরে এক-আধবার আমাদের মধ্যে আনাগোনা করেন—এই বন্দোবস্তই ভাল, আমাদেরই একজন হইয়া থাকিলে উভয় পক্ষেরই অনিষ্টের সম্ভাবনা।

বাড়ির বাহিরেও হাবুলের যশ এই অনুপাতেই বৃদ্ধি পাইতেছে। সর্বদা দেখা যায় না বলিয়া ছেলেমেয়েদের কল্পনায় কিছু আটকাইতেছে না। শৈলকে কোন প্রশ্ন করিলে শৈল অতিমাত্র গম্ভীর হইয়া বলে, “নীচেতেই তিনি ভারি থাকেন কিনা আজকাল!”

“তুই যাস না ওপরে?”

“রক্ষে কর ভাই; ত্রিসীমানার মধ্যে পা দেওয়ার জো আছে?”

কথাটি কিন্তু সম্পূর্ণ সত্য নয়। তেতলার ছাদে, সিঁড়ির ঘরের সঙ্গে লাগোয়া আর একটি ঘর আছে। আকারে ঠিক চতুষ্কোণ নয়, খানিকটা গিয়া একটা ফালি বাঁকিয়া গিয়াছে, ঘরটা দাঁড়াইয়াছে উল্টানো ইংরেজি L অক্ষরের মত। পূর্বে কাঠকুটা থাকিত। সম্প্রতি শৈল এটি দখল করিয়াছে। ছাদের এ কোণটায় তাহার ঘর, মাঝে পনরো-ষোল হাত জায়গা, তাহার পরই হাবুলের ঘরটি।

শৈলর সহসা উপরে উঠিয়া আসার কারণটা বুঝিয়া উঠা যায় না;—হইতে পারে, সে পরিচ্ছন্নতাসূত্রে হাবুলদাদার সহিত একটা সম-আভিজাত্য অনুভব করে বলিয়া একই স্তরে থাকিতে চায়; হইতে পারে, তাহার পুতুলের সংসার বাড়িয়া গিয়াছে, এবং নীচে দুইটি ভাইপো ভাইঝি এবং ছোট বোনটির লোলুপ দৃষ্টি এড়ানো ক্রমেই সুকঠিন হইয়া উঠিতেছে। মোট কথা, সখীদের নিকট যাহাই বলুক, শৈল সমস্ত দুপুরটা আজকাল উপরেই হাবুলের ত্রিসীমানার মধ্যেই কাটায়। তবে এটা হয় লুকাইয়া, হাবুলকে ব্যাপারটা জানানো হয় নাই। তাহার কারণ বলিতে গেলে শৈলর খেলাঘরের সঙ্গিনী নৃত্যকালীর কথা পাড়িতে হয়।

প্রথমত শৈলর সহিত নৃত্যকালীর সখিত্বটা সম্ভব হইল কি করিয়া, সেই একটা সমস্যা; সেটাকে নিতান্ত একটা আকস্মিক ব্যাপার বলিয়া ধরিয়া লইলেও হাবুলের নিকট দীক্ষাপ্রাপ্তির পরও সখিত্ব যে কি করিয়া বজায় আছে, সে তো একেবারেই দুর্বোধ্য বলিয়া মনে হয়।

মেয়েটি যৎপরোনাস্তি নোংরা। সমস্ত অবয়বটি ধূলামাটিতে এতই প্রচ্ছন্ন যে তাহার আসল রঙটি যে কি, বলা একটু কঠিন। আত্মীয়েরা কুণ্ঠিতভাবে বলে, শ্যামবর্ণ; যাহাদের নিন্দায় আনন্দ আছে, তাহারা প্রমাণ করিয়া দেয়—কালো। মাথাটা একটা আগাছার জঙ্গলের মত, চুল খুব ঘন, কিন্তু যত্নের অভাবে বাড়ে নাই। কোঁকড়ানো কোঁকড়ানো একরাশ স্তবক পরস্পরের সঙ্গে জড়াজড়ি করিয়া অর্ধেকটা পর্যন্ত নামিয়া গিয়াছে। খোঁপা হয় না, তবে কালেভদ্রে ঘাড়ের উপর অর্ধচন্দ্রাকারের দুইটা সুস্পষ্ট বেড়াবেণী দেখা যায়। দুই-এক দিন থাকে, তাহার পর কখন গ্রন্থি খুলিয়া গিয়া বিশৃঙ্খলভাবে এলাইতে এলাইতে আবার আগেকার অবস্থায় ফিরিয়া আসে। দেখিলে মনে হয়, মাথার পিছনে কবে কি হইতেছে, মেয়েটির সে লইয়া মোটেই মাথাব্যথা নাই।

সারাদিন খেলায় মত্ত থাকে, আর ফলপাকড়ের অত্যন্ত ভক্ত, এবং খেলা ও দুনিয়ার ফলপাকড় হইতে আহৃত ধূলা, কাদা, রস-কষ প্রভৃতি যত রকমের নোংরা সব হাতে-মুখে কাপড়ে-চোপড়ে জমা করিয়া বেড়ায়। সৌন্দর্যচর্চার মধ্যে স্নানটা মাঝে মাঝে করে; তাহাতে ময়লাগুলি গায়ে ভাল করিয়া বসিয়া যায়।

স্বভাব-নোংরা মেয়েদের মাঝে মাঝে একটু অসুখ-বিসুখ করা ভাল, মা বোনের যত্নআত্তি পায় তাহা হইলে—একটু নজর পড়ে। দুর্ভাগ্যক্রমে নৃত্যকালীর সে বালাই নাই; সে অটুট স্বাস্থ্য এবং অসংস্কৃত শরীর ও বেশভূষা লইয়া দূরে দূরেই কাটাইয়া দিতেছে।

গুণের মধ্যে মেয়েটির স্বভাব বড় নরম, অন্তত তাহার চোখ দুইটি এত নরম যে, তাহাকে কাছে কাছে রাখিয়া নিশ্চিন্ত তৃপ্তির সঙ্গে বেশ একটি কর্তৃত্বের ভাব উপভোগ করা যায়। খেলাঘরের জগতে এ একটা মস্তবড় লোভনীয় জিনিস। শৈল বলিল, “তোমার ছেলে ভাই, হাবুলদাদার মত তিনটে পাশ দিয়ে চারটে পাশের পড়া করছে ব’লে যে আমার ন হাজার টাকা তোমার ছিচরণে ঢালতে হবে, সে আমি পারব না। আমার মেয়ে সুন্দর, তার একটা কদর নেই? আমি বরাভরণটরণ নিয়ে পাঁচ হাজারের ওপর উঠছি না; এইতেই তোমায় রাজী হতে হবে।”

অথচ এই কয়দিন আগে, এই নৃত্যকালীকেই শৈলর অপোগণ্ড ছেলেটিকে নগদ এগারো হাজার টাকা দিয়া লইতে হইয়াছে।

অন্য সঙ্গিনী হইলে বাঁকিয়া বসিত, অন্তত ঠেস দিয়া দুটা কথা বলিত তো নিশ্চয়। নৃত্যকালী সঙ্গে সঙ্গে চুলের গুচ্ছ বাঁয়ে হেলাইয়া বলিল, “হব রাজী।”

অনুমান হয়, এই সব কারণেই, হাজার নোংরা হইলেও নৃত্যকালী অপরিহার্য। নোড়ানুড়ি লইয়া খেলা চলে, তাহাতে পরিষ্কারও বেশ থাকা যায়, কিন্তু যতই অপরিষ্কার হউক না কেন, কাদা লইয়া খেলায় একটা বিশেষ সুখ এবং সুবিধা আছে, যেমনটি ইচ্ছা ভাঙা গড়া চলে।

নৃত্যকালীকে কিন্তু রাখা হয় খুব সঙ্গোপনে। ঘরের যে ফালিটুকু ভিতরের দিকে চলিয়া গিয়াছে, নৃত্যকালী চুপিচুপি আসিয়া সেই দিকটায় বসিয়া থাকে। হাবুল যদি সিঁড়ি দিয়ে উপরে যায় কিংবা নিচে আসে, ওর অস্তিত্বের খবরই পায় না। শৈলর কড়া হুকুম আছে, যেন ভুলিয়াও কখনও হাবুলদাদার ঘরের দিকে না যায়, কি জোরে শব্দ না করে।

বলে, “তা যদি কর জলার পেত্নী, তো হাবুলদাদা টের পেলে সঙ্গে সঙ্গে আলসে ডিঙ্গিয়ে তোমায় নিচে ফেলে দেবে, আর তোমার সঙ্গে খেলার জন্যে আমার দশা যে কি করবে, ভেবেই পাই না।”

হাবুলের অশুচিতার ভয়ে ঘর ছাড়িয়া কম যাওয়া-আসা করার জন্যই হউক অথবা যে জন্যই হউক, প্রায় মাস-খানেক বেশ কাটিল। তাহার পর নৃত্যকালী একদিন হঠাৎ ধরা পড়িয়া গেল।

যদি বলা যায় হাবুলই ধরা পড়িল, তাহা হইলেও বড় একটা ভুল হয় না। ব্যাপারটা ঘটিল এই রকম—

বৈশাখের দুপুরবেলা। হাবুলদের কলেজ গরমের ছুটিতে বন্ধ হইয়াছে। হাবুল ঘরে বসিয়া একটা কবিতার বই পড়িতেছিল; হঠাৎ একটা ঘর-ছাড়ানো ভাবে মনটা কেমন হইয়া গেল। সে বাহিরে আসিয়া দুইটা নারিকেল গাছের মাথা একত্র হইয়া ঘরের আড়ালে যেখানে একটি নিবিড় ছায়া ফেলিয়াছে, সেইখানটায় দাঁড়াইল।

স্তব্ধতাটুকু বেশ লাগিল।—ঝিরঝিরে বাতাস দিতেছে, তাহাতে বিশ্রান্ত পল্লীর এখান ওখান হইতে কতকগুলো চাপা সুর মাঝে মাঝে কানে আসিতেছে। সামনা-সামনি খানিকটা দূরে একটা দোতলা বড়ির খোলা জানালা দিয়া দেখা যায়, একটি মেয়ে মেঝেয় বসিয়া উবু হইয়া একান্ত মনে কি লিখিতেছে। চুলগুলো মুখের উপর দুই পাশ ঢাকিয়া ভূমিতে লুটাইতেছে। ডান দিকে একটা একতলা বাড়ির চিলেকোঠার দেওয়ালে দুইটা পায়রার খোপ আঁটা; ভিতরের পায়রাগুলো ব্যস্ত, খোপের উপরে দুইটা পায়রা গায়ে গায়ে সাঁটিয়া চাপিয়া বসিয়া আছে। হাবুল মাঝে মাঝে এই দম্পতিটিকে দেখিতেছিল; মাঝে মাঝে মেয়েটির দিকে দেখিতেছিল, লিপিনিরতাকে লইয়া যে কি ভাঙাগড়া করিতেছিল, সে-ই জানে।

সহসা দেখিল চিলেকোঠার পাশের ঘরটি হইতে বাহির হইয়া শৈল নীচে নামিয়া গেল।

তাহার বড় কৌতূহল হইল, “শৈল আবার ওখানে করে কি? খেলাঘরের বাই আছে নাকি? সে যে একটা মস্ত নোংরামির ব্যাপার! কই, এতদিন তো জানিতে দেয় নাই, বা রে শৈলী!”

দেখিতে হয়। হাবুল অগ্রসর হইয়া দুইটা সিঁড়ি বাহিয়া ঘরটিতে প্রবেশ করিল; ভিতরে গিয়া দাঁড়াইতেই তাহার চক্ষুস্থির।

যতদূর নোংরা হইতে হয় একটি মেয়ে মেঝেয় পা ছড়াইয়া এবং বালিঝরা নোনা-ধরা দেওয়ালে নিশ্চিন্তভাবে ঠেস দিয়া বসিয়া আছে। পাশে একতাল কাদা; হাতের আঙুলগুলা কাদা দিয়া কি একটা গড়িতে ব্যস্ত, তেলো দুইটা শুকনা কাদায় সাদা হইয়া গিয়াছে; বাঁ গালে কানের কাছটায় সেই রকম বড় দাগ, বোধ হয় হাত দিয়া ঘাম মুছিয়া থাকিবে। আঁচল ভূমিতে বিছানো, তাহার উপর কতকগুলা রাংচিতের পাতা আর ছোট ছোট আগাছার ফল, তাহাদের নীল বেগুনে রসে আঁচলটায় ছোপ ধরিয়া গিয়াছে; এক পাশে তেল-লঙ্কামাখানো থেঁতো-করা খানিকটা কাঁচা আম।

হাবুলের ছায়ায় ঘরটা একটু অন্ধকার হইতেই মেয়েটি মুখ তুলিয়া সঙ্গে সঙ্গে যেন একেবারে কাঠ হইয়া গেল।

হাবুল ফিরিয়া যাইতেছিল, ঘুরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “শৈল কোথায়?”

মেয়েটি উত্তর দিতে পারিল না, শুধু জিভ দিয়া শুকনা ঠোঁট দুইটি একটু ভিজাইয়া লইল এবং আঁচলটা একটু টানিয়া লইল। হাবুল প্রশ্ন করিল, “তোমার নাম কি?”

চুপচাপ। মুখর সেই সাদা দাগটা ঘামে ভিজিয়া একটি তরল কাদার রেখা গালের মাঝামাঝি গড়াইয়া আসিল। মুখখানা ফ্যাকাশে হইয়া গিয়াছিল, একটু একটু করিয়া রাঙিয়া উঠিতে লাগিল।

হাবুলের কৌতুক বোধ হইতেছিল, উত্তরের আশা না থাকিলেও প্রশ্ন করিল, “তুমি এত নোংরা কেন?”

ইহাতে মেয়েটি একটু গুটিসুটি মারিয়া গেল। বোধ হয় শৈলর সতর্কতার কথা মনে পড়িল, এইবার বুঝি তাহা হইলে আসিয়া ডিঙাইয়া ফেলিয়া দেয়!

হাবুল ঠায়-নতদৃষ্টি এই জড়ভরতের মত মেয়েটির দিকে চাহিয়া রহিল। কেন, বলা শক্ত, আরও বলা শক্ত এইজন্য যে, অমন দারুণ নোংরামির মাঝখানে দাঁড়াইয়া তাহার মুখে কোনও বিকারের চিহ্ন লক্ষিত হইল না। একটু পরে হঠাৎ কি যেন মন হইল, আর দাঁড়াইল না। দুয়ার পর্যন্ত গিয়া আবার ফিরিয়া আসিল, বলিল, “হ্যাঁ, দেখ, আমি যে এসেছিলাম, কিংবা তোমাদের খেলাঘরের কথা জানি—একথা শৈলকে বলো না। বলবে না তো?”

মেয়েটি বলিল, “না।”

উত্তর পাইয়া হাবুল আর একটু দাঁড়াইল। জিজ্ঞাসা করিল, “পুতুল খেলছিলে বুঝি?”

কোনও উত্তর হইল না।

“শৈলর সঙ্গে পড় বুঝি?”

উত্তর নাই। এদিকে মনের মধ্যে কি রকম একটা গোলযোগ সৃষ্টি হওয়ায় প্রশ্নও যোগাইতে ছিল না। যাইবার জন্য ফিরিয়া আবার ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “তুমি রোজ এসো, আসবে তো?”

মেয়েটি সাহস করিয়া ঘাড় পর্যন্ত নাড়িল না, বোধ হয় বুঝিতে পারিয়াই হাবুল বলিল, “আমি কিছু বলব না, আসবে তো?”

মেয়েটি ঘাড় নাড়িল। এমন সময় সিঁড়ির নীচের ধাপে পায়ের শব্দ হইল। হাবুল তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া গেল।

.

তাহার পরদিন হাবুল জানালাটি অল্প খুলিয়া সিঁড়ির দিকে উৎকণ্ঠিতভাবে চাহিয়া রহিল এবং শৈল একসময় পা টিপিয়া টিপিয়া নামিয়া গেলে নোংরা ঘরটিতে আসিয়া প্রবেশ করিল। দেখিল, মেয়েটি নাই। আরও দুই দিন নিরাশ হইয়া সে বুঝিল, নিজের অপরিচ্ছন্নতার অপরাধে সে ভয় পাইয়াছে। তখন হাবুলের একটি দীর্ঘশ্বাস পড়িল এবং নিজের পরিচ্ছন্নতার অপরাধে মনটি বড়ই ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিল। সিঁড়ির দিকে চাহিয়াই ছিল, অনেকক্ষণ পরে শৈল আসিলে ডাক দিল। শৈল ক্ষণেকের জন্য চোখের একটু আড়াল হইয়া মুঠার মধ্য হইতে কি গোটা-কতক জিনিস এক পাশে ফেলিয়া দিয়া হাতটা শেমিজে মুছিয়া লইল এবং শেমিজটা কাপড়ে ভাল করিয়া ঢাকিয়া সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। মুখটি শুকাইয়া গিয়াছে।

হাবুল আসিয়া তাহার পিঠে হাত দিয়া বলিল, “আমার ভয়ে খেলার জিনিসগুলা বুঝি ফেলে দেওয়া হ’ল? খেলা একটু চাই বইকি, তাতে রাগ করব কেন? শুধু অপরিষ্কার না হ’লেই হ’ল—বেশি রকম অপরিষ্কার। মাটির পুতুল গড়তে জানিস?”

শৈল মাথা নাড়িয়া জানাইল, “না।”

“জানতে হয়; সে একটা শিল্প যে—চারুশিল্প। তোমাদের বন্ধুদের মধ্যে কেউ জানে না?”

শৈল একটু ভাবিল। সে সাহস সঞ্চয় করিয়া বলিল। “নেত্য বেশ জানে, অনেক রকম।”

“তার কাছে শিখে নিলেই পার। নেত্য আবার কে? নৃত্যধন?”

“না, নেত্যকালী, আমার সই—গঙ্গাজল। বড্ড নোংরা যে, মিশতে ঘেন্না করে।”

হাবুল একটু হাসিয়া, কৃত্রিম রোষের সহিত চোখ দুইটা বোনের মুখের উপর ফেলিয়া বলিল, “এই বুঝি শিক্ষা হচ্ছে তোমার? কাউকে ঘেন্না করতে আছে, তাও আবার নিজের সইকে? বরং তাকে পরিষ্কার হতে শেখাও না—বরং তাকে কাছে রেখে।”

শৈল একটু মাথা নীচু করিয়া রহিল, তাহার পর বাহির হইয়া গেল। হাবুল আবার তাহাকে ফিরাইয়া বলিল, “তা ব’লে যেন আমার ঘরের দিকে কাউকে এনো না, খবরদার। নোংরা হ’লে আমার কাছে গঙ্গাজলেরও খাতির নেই, ব’লে দিলাম।”

পরের দিন জানালার অল্প ফাঁক দিয়া তাহার প্রায় ঘণ্টা খানেক একভাবে চাহিয়া থাকিবার পর শৈল ছাদে আসিল। একবার সিঁড়ির দিকে ঝুঁকিয়া চাহিয়া অদৃশ্য কাহাকে থামিবার জন্য ইশারা করিল এবং পা টিপিয়া টিপিয়া হাবুলের ঘরের দিকে অগ্রসর হইল। দেখিল, হাবুল নাক ডাকাইয়া ঘুমাইতেছে। তাহার পর আবার তেমনই ভাবে ফিরিয়া গিয়া নৃত্যকালীকে সিঁড়ি হইতে ইশারায় ডাকিয়া লইয়া ঘরে ঢুকিল। হাবুলের ঘুম প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভাঙিয়া গেল। উঠিয়া আবার ঘণ্টা-খানেকের একটি দীর্ঘ যুগ জানালার ফাঁকে চাহিয়া থাকিবার পর হাবুল দেখিল, শৈল কি জন্য নীচে নামিয়া গেল। তখন হাবুল শৈলর চেয়েও নিঃশব্দ পদক্ষেপে খেলাঘরটিতে গিয়া প্রবেশ করিল, কান দুইটিকে যথাসম্ভব সিঁড়ির নিম্নতম ধাপের কাছে মোতায়েন করিয়া রাখিল।

নৃত্যকালী মাটির তাল হইতে খানিকটা কাটিয়া লইতেছিল, মুখ তুলিয়া চাহিল। কেন, তাহা ভগবান প্রজাপতিই জানেন। আজ তাহার চোখে ভয়ের বিশেষ কোন চিহ্ন ছিল না, শুধু একটা অবোধ কৌতূহলের ভাব, শাড়িটা আজ একটু যেন ফরসা, তাহাতে ধূলা-কাদার ছোপ আরও স্পষ্ট করিয়া জাগিয়া আছে। কাঁধে অসংলগ্ন বেড়াবেণী লতাইয়া আছে।

হাবুল বলিল, “শৈলকে খুঁজতে এসেছিলাম; কোথা গেছে বলতে পার?”

“নীচে গেছে।”

উত্তরটা বোকার মত হইল। উপরে যখন নাই, তখন নীচে তো গেছেই। কিন্তু তাহাতে আবার প্রশ্ন করার সুযোগ থাকায় হাবুল খুশিই হইল। জিজ্ঞাসা করিল, “কি করতে গেছে বলতে পার?”

“পারি।”

নিজের অদৃষ্টে প্রসন্ন হাবুল প্রশ্ন করিল, “কি করতে?”

“আরও কাদা মেখে নিয়ে আসতে, আর খ্যাংরাকাঠি।”

হাবলের মনে হইল, স্বরটি মিষ্ট। ‘কাদা’ ‘খ্যাংরাকাঠি’–এই রকম নোংরা কথাগুলাও এত মিষ্ট লাগিল। বলিল, “কাদা? সেই তোমাদের বাড়ি থেকে তো? এ বাড়িতে তো নেই।”

“হ্যাঁ।”

হাবুল থেবড়ি কাটিয়া সামনেটিতে বসিয়া পড়িল। বলা বাহুল্য, স্থানটুকু বেশ পরিষ্কার ছিল না। বলিল, “তুমি বেশ পুতুল গড়তে পার, না?”

নৃত্যকালী মাথাটা একটু নিচু করিয়া ঠোটের এক কোণে লজ্জিতভাবে একটু হাসিল।

হাবুল বলিল, “আমায় একটি গ’ড়ে দিতে হবে।”

অবশ্য শুধু বলিবার সুখটুকুর জন্যই বলিল, কেননা ভগ্নীকে মৃৎশিল্পে উৎসাহিত করিলেও, পুতুলের যা সব নমুনা সামনে পড়িয়া ছিল, সেগুলিকে চারুশিল্পের উৎকর্ষ বলিয়া মনে করে এতটা দুর্দশা তাহার তখনও হয় নাই।

মেয়েটি মুখের উপর বাঁ হাত চাপিয়া আর একটু ঝুঁকিয়া পড়িয়া ভাল ভাবেই হাসিয়া ফেলিল। যখন হাত সরাইয়া লইল, দেখা গেল, ডান গালের নীচে আঙুলের ডগার কাদায় তিনটি দাগ লাগিয়া গিয়াছে। হাবুল বলিল, “ও কি হ’ল? ইয়েতে যে দাগ লেগে তিনটি দাগ লেগে গেল!”

নৃত্যকালী বুঝিতে না পারিয়া মুখের দিকে চাহিতেই বলিল, “ইয়েতে—মানে— ইয়ে—তোমার গালে আর কি। না, হয় নি, আর একটু মোছ, আর একটু—ওই পাশটায় এখনও রয়েছে, সমস্তটা টেনে মুছে দাও দিকিন, আঃ, রয়েছে যে এখনও একটু—”

মোটেই আর কিছু ছিল না এবং অবর্তমান কাদা মুছিতে সুকুমার গালটির যে অবস্থা হইয়া উঠিয়াছিল, তাহাতে হাবুল ভিন্ন আর যে কেহই দয়া অনুভব করিত।

হাবুল বলিল, “আমি না হয় দোব ঠিক করে?”

কোঁচার খুঁট তুলিয়াছিল, বোধ হয় দিতও; কিন্তু নীচে যেন শৈলর স্বর শোনা গেল। হাবুল তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িয়া বলিল, “সেদিন যে এসেছিলাম, বল নি তো শৈলকে?”

নৃত্যকালী মাথা নাড়িল, “না।”

দুয়ারের নিকট হইতে ফিরিয়া হাবুল বলিল, “আর হ্যাঁ, আর এখন যে ওকে খুঁজতে এসেছিলাম, সে কথাও ব’লে কাজ নেই, ভাববে—একটু খেলছি, তাতেও হাবুলদাদার এসে বাগড়া দেওয়া—”

.

মাঝের চার পাঁচ দিনের এদিককার ইতিহাস আর দিলাম না। আশা করি, আন্দাজ করিয়া লইতে কাহারও বিশেষ বেগ পাইতে হইবে না।

অপরদিকে খবর এই যে, হাবুল আবার অপরিচ্ছন্নতা বিষয়ে যেন আরও সতর্ক হইয়া উঠিয়াছে। বউদিদিকে বলিল, “তোমরা গুরুজন, বলা ঠিক হয় না; কিন্তু তোমরা যদি সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাক, ছেলেমেয়েরা একটা আদর্শ পায়। এই ধর, তুমি যদি সর্বদা একটা স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে থাক—

বউদিদি বলিল, “রক্ষে কর ভাই! বরং তুমিই একটি আদর্শ বিয়ে ক’রে নিয়ে এসে আলমারিতে সাজিয়ে রাখ না কেন?”

নিজের কথাটা ঠাট্টায় উড়াইয়া দিলেও দেবরের খুঁতখুঁতানির চোটে বউদিদিকে আবার কচিগুলার দিকে কড়া নজর দিতে হইল। তাহাদের সন্ত্রাসটা ছিলই, আবার একচোট উগ্রতরভাবে জাগিয়া উঠিল। শৈল নৃত্যকালীকে বারংবার সাবধান করিতে লাগিল, “তোকে ব’লে ব’লে হার মানছি পোড়ারমুখী, কিন্তু যদি একদিন ঘুণাক্ষরেও হাবুলদার নজরে প’ড়ে যাস তো তোর যে কি দুগ্‌গতি করে ছাড়বে তা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। আমি তো তোকে এনে ভয়ে যেন কাঁটা হয়ে থাকি। মুয়ে আগুন, আবার ঠোঁট চেপে হাসি! কোত্থেকে যে হাসি আসে পোড়ার মুখে, তা তো বুঝি না—”  

সেদিন নৃত্যকালী আগে হইতে আসিয়া বসিয়া আছে, ঘরে ঢুকিয়াই চাপা গলায় প্রশ্ন করে, “হাবুলদাদার ঘরের ওদিকে যাস নি তো?”

নৃত্যকালী বলে, “নাঃ।”

শৈল বলে, “খবরদার! আর দরকারই বা কি আমাদের ওদিকে যাবার ভাই? তুমি বাপু, খুব পরিষ্কার আছ তো আছ; আমরা দুটিতে না হয় নোংরাই; থাক কোণে তোমার ঘেন্না নিয়ে। কি বল্ ভাই গঙ্গাজল?”—এই ভাবে নিশ্চিতকে সুনিশ্চিত করিবার জন্য যেমন এক দিকে শাসায়, অপর দিকে তেমনি আবার নৃত্যকালীর আত্মসম্মান জাগ্রত করিবার চেষ্টা করে।

নৃত্যকালী বলে, “হুঁ।”

মেয়েটি আজকাল বেশ প্রতারণা শিখিয়াছে। কালই প্রায় ঘণ্টাখানেক হাবুলের ঘরে গিয়া গল্পসল্প করিয়াছিল। শৈল বাহিরে কোথায় গিয়াছিল বলিয়া হাবুল ডাকিয়া লইয়া গিয়াছিল।

এর পর আরও দুই দিন কাটিল। হাবুল অত্যন্ত কবিতা পড়িতেছে এবং বাকিটা সময় নীচে আসিয়া চারিদিকে অপরিচ্ছন্নতা আবিষ্কার করিয়া জর্জরিত হইয়া উঠিতেছে। বলিতেছে, “তোমরা সব শেষ পর্যন্ত আমায় বাড়িছাড়া না করে ছাড়বে না দেখছি, আমার অদৃষ্টে লেখাই আছে হস্টেল—”  

দুপুরবেলা। আজ শৈলদের স্কুলে প্রাইজ-বিতরণ। সাজিয়া-গুজিয়া বাহির হইতেছে, দুয়ারের সামনেই নৃত্যকালীর দেখা। শৈল জিজ্ঞাসা করিল, “যাবি না ইস্কুলে প্রাইজ দেখতে?”

নৃত্যকালী নাসিকাটি কুঞ্চিত করিয়া বলিল, “ভাল লাগে না।”

শৈল বলিল, “মুয়ে আগুন। কি ভাল লাগে তবে, শুনি?”

নৃত্যকালী তাহাকে কাটাইয়া গেলে, হঠাৎ ঘুরিয়া বলিল, “ওমা! তুই যে আজ এসেন্স মেখেছিস লা! পেত্নীর ভাবন দেখে বাঁচি না।”

“কই, ধ্যাৎ।”—বলিয়া নৃত্যকালী ভিতরে চলিয়া গেল।

বারান্দায় মাদুর বিছাইয়া হাবুলের কাকীমা শুইয়া ছিলেন, ভাড়াটেদের নূতন বউটি পাকা চুল তুলিতেছিল, পুত্রবধূ উপুড় হইয়া শুইয়া একটা নাটক পড়িয়া শুনাইতেছিল। নৃত্যকালীকে দেখিয়া বলিল, “নেত্য, একটু জল গড়িয়া দিয়ে যা তো দিদি, আর পারি না উঠতে!”

নৃত্য জল দিয়া উপরের দিকে চলিয়া গেল। ভাড়াটেদের বউটি বলিল, “মেয়েটি নোংরা তাই, নইলে—”

কাকীমা বলিলেন, “হ্যাঁ, বেশ ছিরি আছে। আর নোংরাই কি থাকবে চিরদিনটা গা? বয়েস হয়ে আসছে—যা শুচিবেয়ে আমাদের হাবুলটা নইলে ইচ্ছে ছিল -–”

পুত্রবধূ কিছু বলিল না; ঠোঁটের কোণে একটি অতি-সূক্ষ্ম হাসি চাপিয়া অন্যমনস্কভাবে সিঁড়ির দিকে চাহিয়া ছিল; বইয়ে চোখ ফিরাইয়া আনিয়া বলিল “হুঁ শোন—”

হাবুল নিরাশ হইয়া খেলাঘর হইতে বাহির হইতেছিল। দেখিল, সিঁড়ির দরজায় নৃত্যকালী দাঁড়াইয়া; প্রশ্ন করিল, “খেলবে না?”

নৃত্যকালী প্রশ্ন করিল, “সই আছে?”

হাবুলও যেন শৈলর স্কুলে যাওয়ার কথাটা মোটেই জানে না, এই ভাবে উত্তর করিল, “আছে বোধ হয় নীচে, আসবে’খন; তুমি ততক্ষণ চল ও ঘরে। বাপ রে, যা গরম এ ঘরটায়!”

ঘরে গিয়া হাবুল টেবিলের সামনে চেয়ারটিতে বসিল; নৃত্যকালী একটু দূরে, পাশটিতে গিয়া দাঁড়াইল।

হাবুল জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার বুঝি ইস্কুলে যেতে ভাল লাগে না নৃত্য?” নৃত্য হাসিল মাত্র।

“কি ভাল লাগে?”

কথাটা বড় ব্যাপক, বোধ হয় মিলাইয়া দেখিয়া উত্তর হাতড়াইতেছিল; হাবুল প্রশ্ন করিয়া বসিল, “আমার কাছে আসতে?”

নৃত্য একবার চোখ তুলিয়া লজ্জিতভাবে ঘাড় নাড়িল, “হ্যাঁ।”

হাবুল জিজ্ঞাসা করিল, “কেন? বলতে পার?”

“সইয়ের দাদা ব’লে।”

হাবুল বলিল, “আমারও তোমার কাছে থাকতে ভাল লাগে নৃত্য।”

একটু থামিয়া প্রশ্ন করিল, “কেন তা জিজ্ঞেস করলে না?”

নৃত্যকালী চোখ তুলিয়া চাহিতে বলিল, “বোনের সই ব’লে।”

কথাটার মধ্যে কোথায় কি ছিল, নৃত্য খিলখিল করিয়া হাসিয়া ফেলিল, সঙ্গে সঙ্গে দুই হাতে মুখটা ঢাকিতে গিয়া আঁচলটা নীচে পড়িয়া গেল! তখন হাবুল যে হাবুল, একদিন প্রণাম করিতে গিয়া সামান্য একটু ময়লার জন্য কাকীমাকে সরাইয়া লইয়াছিল, সেই শুচিবিলাসী হাবুল, পরম আগ্রহ-সহকারে ভুলুণ্ঠিত অঞ্চলটি উঠাইয়া লইল এবং তাহাতে শুচিতার নিতান্ত অভাব থাকিলেও প্রায় বুকের কাছে তুলিয়া ধরিয়া বলিল, “বাঃ, চমৎকার পাড়টি তো!”

মেয়েটি আজ বেশি হাসিতেছে; আবার খিলখিল করিয়া হাসিয়া বলিল, “ভাল কোথায়? কালো নাকি ভাল হয়?”

একরঙা, কোন-রকম-নক্সাবিহীন কালো পাড়। একে কালোই, ময়লা কাপড়ে আবার সত্যই তেমন ভাল দেখাইতেছিল না। হাবুল একটু অপ্রস্তুত হইয়া বলিল, “ভাল মানে— ভাল, অর্থাৎ—তোমার গায়ে বেশ ভাল দেখাচ্ছে।”

সাহস বাড়িয়া যাওয়ায় অঞ্চলটা মুঠায় ভরিয়া লইয়া নিজের নাকে চাপিয়া ধরিল, বোধ করি অধরেও একটু চাপিল, তাহার পর প্রশ্ন করিল, “এসেন্স লাগিয়েছ বুঝি নৃত্য? আমার বড্ড ভাল লাগে, বুঝেছ?”

নৃত্যকালী মুখ নীচু করিয়া একটু হাসিল, এবং একটু বোধ হয় বেশি করিয়া বুঝিয়াই বলিল, “এবার থেকে ফরসা কাপড়ও প’রে আসব, আজ দিদি—”

হাবুল হঠাৎ এতটা সচকিত হইয়া গেল যে, তাহার হাত হইতে আঁচলটা আবার মাটিতে পড়িয়া গেল। চোখ দুইটা কপালে তুলিয়া বলিল, “না না, অমন কাজ ক’রো না। সবাই জানে আমি নোংরা দু-চক্ষে দেখতে পারি না, নিশ্চিন্দি আছি…. পরিষ্কার হতে গেলেই সর্বনাশ! ভাববে, মেয়েটা হঠাৎ কেন—তুমি বরং কাপড়টা কেচে এসেন্সের গন্ধটাও ধুয়ে ফেলে দিও।”

ছেলেমানুষ, অবুঝ, তাহাকে এমনি বলিয়া নিশ্চিন্ত হইতে পারিল না। বোধ হয় সেইজন্য টেবিলের উপর হইতে নৃত্যের হাতটা—আলতা আর পুঁইফলের নীল ছোপ-ধরা- হাতটা—তুলিয়া লইয়া নিজের গালে চাপিয়া ধরিয়া বলিল, “এই আমার গা ছুঁয়ে দিব্যি করছ? ফেলবে ধুয়ে? আর, কখনও পরিষ্কার হতে যাবে না? হ’লে ভয়ংকর রাগ করব কিন্তু আমি।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *