নৈশকাহিনী
আমার এই নৈশকাহিনী রাত্রির কোনও ঘটনা নিয়ে নয়। আমার এই কাহিনীর বিষয়বস্তু হল নেশা।
আমার বিষয় অবশ্য ঠিক নেশা নয়, নেশার পরিমাপ নিয়ে এই আলোচনা। এক টিপ নস্যি, আড়াই প্যাকেট সিগারেট, তিন হেঁচকির জর্দা, সাত ছিলিম গাঁজা কিংবা চার পেগ হুইস্কি—একেক রকম নেশার সামগ্রীর মাপ হয় একেকভাবে—অন্তত এতকাল এই ছিল আমার সাবেকি ধারণা।
আমার সেই ধারণা গত রবিবার ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। যথারীতি রবিবার দিন বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। ফেরার পথে, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে, হঠাৎ প্রায় বিনা নোটিশে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি শুরু হল। জায়গাটা জগুবাবুর বাজারের কাছাকাছি, চারদিকে পাতাল রেলের গর্ত, কাদা-জল, লোহা-ইট। দৌড়নো দূরের কথা, এর মধ্যে তাড়াতাড়ি হাঁটাও বিপজ্জনক। একটু দূরেই ডি এন মিত্র স্কোয়ার, যা লোকমুখে বহুদিন হল গাঁজা পার্ক বলে পরিচিত। স্কোয়ারটি কয়েক বছর হল পাতাল রেলের দখলে, কিন্তু তার নাম বা নামকরণের কারণ এখনও বদলায়নি।
কোনও উপায় ছিল না। জলে ভিজে একেবারে চোপসানো অবস্থায় স্কোয়ারের সামনের ছাদ-ঢাকা, বাঁশের বেড়া দেওয়া পুরনো ঘরটার চাতালে যথাসাধ্য ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। বৃষ্টি ও বাতাসের হাত থেকে সামান্য রক্ষা পাওয়া গেল।
চাতালের এদিক-ওদিকে কয়েকটি চক্র বসেছে। আট-দশ জন করে একেকটি চক্র। নানা বয়সের, নানা চেহারার অনেক রকম লোক, সকলেই ঘাস খাচ্ছেন। ঘাস মানে ইংরেজি গ্রাস, গ্রাস মানে গাঁজা। মদের আড্ডর সঙ্গে গাঁজার আড্ডার পার্থক্য হল যে এখানে সকলেই নিঃশব্দ। নিঃশব্দে একজনের হাত থেকে অন্যের হাতে কলকে চলে যাচ্ছে, তিনি চার-পাঁচ টান দিয়ে পরের জনের হাতে তুলে দিচ্ছেন। রাস্তার মুচি, অফিসের বাবু, বাসের পকেটমার সকলে পাশাপাশি গোল হয়ে বসে। রসদ ফুরিয়ে গেলে, সঙ্গে সঙ্গে সবাই পয়সা দিয়ে আবার পুরিয়া এনে কলকে ভরে নিচ্ছে। সকলেই শিবনেত্র, কেউ কেউ সম্পূর্ণ চোখ বুজে আত্মস্থ, শুধু সময়মতো হাত উঠে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তীর কাছ থেকে কলকে গ্রহণের জন্য। বৃষ্টিভেজা বাতাস আমোদিত হয়ে উঠেছে গঞ্জিকাধূম্রের ঘন গন্ধে।
এখানে খুব বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে একা একাই নেশা হয়ে যাবে। অথচ বৃষ্টি আরও জোরে এসেছে এবং বাতাস অন্তত একশো কিলোমিটার বেগে বইছে। বাইরের ঝড় বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচিয়ে এবং গঞ্জিকাচক্রের ধোঁয়া থেকে নাক বাঁচিয়ে একটা পাশে কোনওরকমে দাঁড়িয়ে ছিলাম, এমন সময়ে এক ভদ্রলোক আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন।
একটু আগেই ভদ্রলোককে দেখেছি নিমীলিত নয়নে খুব আয়েসের সঙ্গে দু’জন পাতাল রেলের মিস্ত্রির মাঝখানে বসে ধূমপান উপভোগ করছিলেন। তাঁর বোধহয় নেশা করা শেষ হয়েছে, এবার বাড়ি ফিরবেন বলে উঠে এসেছেন।
বৃষ্টির মধ্যে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকলে যা হয়, একটু পরেই আমাদের মধ্যে আলাপ শুরু হল। ভদ্রলোক নিজেই উপযাচক হয়ে আমার সঙ্গে আলাপ করলেন।
ভদ্রলোকের উপাধি ভুলে গেছি। যতদূর মনে পড়ছে নাম বলেছিলেন ভূপতি। ভূপতিবাবু মধ্যবয়সি, রোগা পাকাটে চেহারা। সামান্য ময়লা তাঁদের ধুতি ও আদ্দির পাঞ্জাবি গায়ে। দেখলেই বোঝা যায় উৎসব অনুষ্ঠানে এঁর পাঞ্জাবিতে গিলে করা থাকে এবং গলায় পাকানো চাদর থাকে। মোটামুটিভাবে কলকাতার আধা বনেদি পুরনো লোক। কথাবার্তায় প্রকাশ পেল শ’দেড়েক হাতে-টানা রিকশা ছিল ভূপতিবাবুর এই দু’-চার মাস আগেও। তার মধ্যে একটির মাত্র লাইসেন্স ছিল। সেই একটি লাইসেন্সেই দেড়শোটি গাড়ি চলত। এখন পুলিশের অত্যাচারে সত্তরটা রিকশা নিজেদের পুরনো বাড়ির উঠোনে লুকিয়ে ফেলেছেন। গোটা তিরিশেক রিকশা ভবানীপুর আর বালিগঞ্জ থানায় ধরে নিয়ে গেছে। দিনকাল ভাল যাচ্ছে না, তাই সময় পেলেই দুঃখ-চিন্তা ভুলতে এখানে এসে এক ছিলিম গাঁজা টেনে যান।
কিছুক্ষণ কথাবার্তার পরে, বৃষ্টি তখন একটু ধরে এসেছে, হাওয়ার বেগও বেশ কম, ভূপতিবাবু রাস্তায় নামলেন, আমিও নামলাম। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভদ্রতার খাতিরে এমনি একটা প্রশ্ন, ‘বাড়ি যাচ্ছেন?’ ভূপতিবাবু একটু থেমে উত্তর দিলেন, ‘এই সন্ধ্যাবেলা বাড়ি যাব কি মশায়? ওই গলির মধ্যে ময়রার দোকানে একটু দুধ খেতে যাচ্ছি। গাঁজার সঙ্গে দুধটা দরকার।’ হঠাৎ ভূপতিবাবু কথা পালটিয়ে আমাকে বললেন, ‘আপনি বোধহয় ভাবছেন ভদ্রলোক গাঁজা খায় কী করে?’ আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘না না, সে কী কথা!’ ভূপতিবার কিন্তু আমার দিকে এগিয়ে এলেন, বললেন, ‘দেখুন মশায়, আমাকে ভুল বুঝবেন না। সব রকম নেশা-ভাং করে দেখেছি, অনেক মদ খেয়েছি, নামকরা মাতাল ছিলাম আমি, ভবানীপুরের সব ডাকসাইটে মাতালেরা আমাকে দেখে লুকিয়ে পড়ত। কিন্তু গাঁজা, গাঁজার সঙ্গে কারও তুলনা হয় না।’
ভর সন্ধ্যায়, বৃষ্টির মধ্যে গেঁজেলের পাল্লা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভদ্রতাসূচক কী একটা মৃদু আপত্তি জানিয়ে আমি কেটে পড়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ভূপতিবাবু ছাড়ার পাত্র নন। তিনি আমাকে চেপে ধরলেন, সত্যি সত্যি আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে পড়লেন, বললেন, ‘কোন নেশা বড়, কোনটা ছোট— এ নিয়ে যার যা ইচ্ছে বলে কিন্তু এ বিষয়ে আমি বিস্তর চিন্তা করেছি, মনে মনে অনেক গবেষণা করেছি, অবশেষে একটা বৈজ্ঞানিক হিসেব বের করেছি আর সেই হিসেবে গাঁজাই সর্বোত্তম।’
‘আপনার এই বৈজ্ঞানিক হিসেবটা কী রকম?’
বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ভূপতিবাবু বললেন, ‘আরে মশায়, নেশা মাপতে হবে আঙুল দিয়ে।’
‘আঙুল দিয়ে!’ আমি একটু বিস্মিত হলাম, তারপর একটু ভেবে নিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, মদ কিংবা সিদ্ধির শরবত আঙুল দিয়ে মাপা যেতে পারে। মদের বেলায় দু’ আঙুলে এক পেগ, তিন আঙুলে দেড় পেগ, এ রকম হিসেব হতে পারে।’
আমাকে কথা শেষ করতে দিলেন না ভূপতিবাবু, উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘থামুন তো, খালি মদ আর মদ। আপনারা ফরসা জামাকাপড়ওলা লোকেরা খালি মদের কথা বলেন। মদ তো পাঁচ-আঙুলে নেশা।’
আমি আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললাম, ‘পাঁচ-আঙুলে নেশা আবার কী?’
‘অশত্থতলার নেশা বুঝতে পারছেন না,’ ভূপতিবাবু এবার নিজের বিষয় পেয়ে গিয়ে আমাকে প্রাঞ্জলভাবে বোঝাতে লাগলেন, ‘যত বেশি আঙুল তত বেশি উচ্চমানের নেশা। সবচেয়ে খারাপ নেশা হল এক আঙুলের। দেখবেন ওড়িয়া পানের দোকানে পাওয়া যায়, কালো মতন খবরের কাগজে জড়িয়ে বেচে, গুড়াখু, আঙুলে লাগিয়ে দাঁত মাজতে হয়, এটা হল সবচেয়ে নিকৃষ্ট নেশা।’ একটু থেমে ভূপতিবাবু বললেন, ‘এর চেয়ে খারাপ অবশ্য চা। মাত্র আধ আঙুলের ব্যাপার। একটা আঙুল অর্ধেক করে পেয়ালার হাতলে ঢুকিয়ে দিলেই হল। তবে চা ঠিক নেশা নয়।’ বলে ভূপতিবাবু আমার দিকে তাকিয়ে একটু শুকনো হাসলেন, বোধহয় ওঁর সন্দেহ হচ্ছিল আমি খুব চা-খোর, ওঁর বিশ্লেষণে দুঃখিত হতে পারি। কিন্তু তিনি আর আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ব্যাখা করে যেতে লাগলেন, ‘এর পরেই আসে নস্যি, দু’ আঙুলের নেশা। দু’ আঙুল দিয়ে এক টিপ নাকে ঢোকানো, অতি বিশ্রী, নিচু নেশা মশায়। এর চেয়ে সিগারেট একটু ভাল। বিড়িও ওই একই। দু’ আঙুলে ধরে বুড়ো আঙুল অর্ধেক কাত করে মুখে দিয়ে টান, ওই আড়াই আঙুলের নেশা খুব উঁচু জাতের নয়, তবে ফেলনাও নয়।’
ভূপতিবাবুর এই বিশ্লেষণ কখন শেষ হবে কে জানে, এদিকে আবার বৃষ্টি এসে গেল মনে হচ্ছে অথচ শুনতেও খারাপ লাগছে না, এ রকম আগে আর কখনও শুনিনি তো। ভূপতিবাবু সামান্য বিরতি দিয়ে আবার শুরু করে দিয়েছেন, ‘এর মধ্যে আরও অনেক রকম নেশা আছে সেসব বাদ দিচ্ছি। আপনি মদের কথা বলছিলেন, মদ হল পাঁচ-আঙুলে নেশা। পাঁচ আঙুলে গেলাস ধরে মুখে তুলতে হবে। সোজা বোতল থেকে গলায় ঢেলে খেলেও ওই পাঁচ আঙুল। সিদ্ধির শরবতও অবশ্য তাই। দুটোই ভাল জাতের নেশা। তবে গাঁজার কাছে কিছু নয়।’ এই বলে দুটো হাত জোড় করে একটি কাল্পনিক কলকে মুখের কাছে ধরে দু’বার জোরে জোরে টান দিয়ে বললেন, ‘একেবারে পুরো দশ আঙুলের নেশা। দু’হাতের দশ আঙুলে কলকে ধরতে হবে। এর চেয়ে বড় নেশা হয় না।’
বৃষ্টি প্রায় এসে গেল আবার, চলে আসছিলাম, ভূপতিবাবু হাতের মুঠোটা দিয়ে আমার কবজিটা শক্ত করে ধরে বললেন, ‘শেষ কথাটা শুনে যান, কুড়ি আঙুলের নেশা, সেও ওই গাঁজাই। কাটিহারের মেলায় গেলে দেখবেন, অশত্থতলায় দারুণ ভিড়, ছিলিম মহারাজ গাঁজা খাচ্ছেন। দুই হাতে এক কলকে, দুই পায়ে এক কলকে। দুই হাত, দুই পা, দুই কলকে এসে গেছে মুখে, বৃশ্চিকাসনে গঞ্জিকা সেবন করছেন ছিলিম মহারাজ, দুই কলকে দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া বেরচ্ছে।’
এতক্ষণে প্রচণ্ড বৃষ্টি এসে গেছে। ভূপতিবাবুর হাত এক ঝাঁকুনি দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আবার ভিজতে ভিজতে বাড়ির দিকে এগোলাম।