নেশা লাগে খুনের স্বাদে
কেঁদে ফেললেন প্রৌঢ়া। বললেন–আমার দৃঢ়বিশ্বাস সাংঘাতিক কিছু একটা হয়েছে আমার ছেলের।
এ ঘটনা যখন ঘটে, তখন আমি ছিলাম ব্লুমফনটিনের অপরাধী তদন্ত বিভাগের চিফ। আমারই অফিসঘরে বসে ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন প্রৌঢ়া-দিন তিনেক আগে আমার ভাইয়ের সঙ্গে গাড়িতে করে কোথায় যায় সে। কোথায় জানি গুপ্তধন খুঁড়ে বার করার মতলব ছিল ওদের। তারপর থেকেই আর কোনও পাত্তা নেই ওদের। বুঝতেই পারছেন আমার মনের অবস্থাটা।
ভদ্রমহিলা যে কার্ড পাঠিয়েছিলেন, তাতে তার নাম লেখা ছিল মিসেস লুইসা মোলার। বিধবা। ছেলের নাম জন ফ্রেডারিক মোলার। বয়স আটাশ বছর। প্রৌঢ়ার দৃঢ়বিশ্বাস কোনও সাংঘাতিক কারণেই ফ্রেডারিক নাকি নিপাত্তা হয়ে গিয়েছে।
জিজ্ঞাসা করলাম–কিন্তু আপনি এত উদ্বিগ্ন হচ্ছেন কেন, তা তো বুঝলাম না। আপনার ভাইয়ের সঙ্গেই তো রয়েছে আপনার ছেলে, অজানা-অচেনা লোকের সঙ্গে তো নেই। তাছাড়া, কোনও অ্যাকসিডেন্ট হয়নি গাড়িটার। হলে এতক্ষণে তা জানতে পারতাম। খুব সম্ভব যে গুপ্তধনের সন্ধানে ওঁদের এই অভিযান, তা নিশ্চয় সহজে খুঁজে পাচ্ছে না ওরা। তাই এত দেরি।
কিন্তু এ যুক্তিতে সান্ত্বনা পাবার পাত্রী নন মিসেস মোলার। বললেন–আমার ভাইকে নিশ্চয় আপনি চেনেন না। অপরাধের ইতিহাস আছে তার জীবনে। শেষবার পুলিশের হামলায় জড়িয়ে পড়ার সময় কাকে জানি ও বলছিল আমার ছেলেই নাকি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তার সঙ্গে। যদিও সম্পূর্ণ অসত্য এই অভিযোগ, তবুও ও শাসিয়ে ছিল জেল থেকে একবার খালাস পেলেই জনকে শায়েস্তা করে ছাড়বে সে। মাত্র এক হপ্তা হল জেলের বাইরে পা দিয়েছে ও।
মিসেস মোলার বিদায় নেওয়ার পর তাঁর গুণধর ভাইয়ের পুরোনো রেকর্ড ঘাঁটতে বসলাম। ভায়ার নাম স্টিফেনাস লুই ভ্যানউইক। ডোসিয়ারটা বার করতেই তার মধ্যে পেলাম সব তথ্য। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স লোকটার। অরেঞ্জ ফ্রি স্টেটের একটা খামারবাড়িতে অতিবাহিত হয়েছে তার যৌবন। এরপর এক শহর থেকে আর এক শহরে টো-টো করে ঘুরেছে স্টিফেনাস। শয়ন করেছে হট্টমন্দিরে এবং ভোজন জুটিয়েছে উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে। সম্প্রতি শ্রীঘর গিয়েছিল কয়েক শো পাউন্ড আত্মসাৎ করার অপরাধে। দীর্ঘ আঠারো মাস ঘানি টানতে হয়েছে বাছাধনকে এ যাত্রা। ধড়িবাজ-শিরোমণি প্রবঞ্চকদের মতোই তার যেমন আত্মপ্রত্যয়ের অভাব ছিল না, তেমনই অভাব ছিল না এন্তার অবিশ্বাস্য গল্পের। এই কারণেই নজরবন্দী রাখা হয়েছিল বটে, সেই সঙ্গে আরও একটি মন্তব্য জুড়ে দেওয়া হয়েছিল রিপোর্টের অন্তে। তার প্রতিভার প্রকৃতি দেখে বিশেষজ্ঞের ধারণা মাঝে মাঝে নাকি মানসিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা দেখা যেতে পারে তার প্রকৃতিতে।
যে পুলিশ অফিসারের দায়িত্বে তৈরি হয়েছিল এই ডোসিয়ার, তিনি বিশ্বাস করতেন একদিন না একদিন খুনজখম জাতীয় কোনও গুরু অপরাধ করে বসবে ভ্যানউইক। এ জাতীয় সিদ্ধান্তে তিনি এসেছিলেন ভ্যানউইকের ছেলেবেলার ইতিহাস জানার পর। হামেশাই দুটো বেড়ালের লেজে গাঁট বেঁধে ছেড়ে দিত বালক ভ্যানউইক। তারপর শুরু হত চামড়ার চাবুক দিয়ে বেধড়ক পিটানো। তীব্র যন্ত্রণার মধ্যে শেষনিঃশ্বাস ফেলত অসহায় জীবগুলো। আর তাই দেখে, তাদের চরম বেদনা সমস্ত অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করে আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠত খুদে ভ্যানউইক।
আরও অনেক তথ্য পাওয়া গেল ডোসিয়ারে। অনর্গল কঁচা মিথ্যে কথা বলায় তার নাকি জুড়ি নেই। বলার ধরনটিও বড় মার্জিত এবং ভদ্র। এই মহাগুণটি তার ছিল বলেই নাছোড়বান্দার মতো লেগে থেকে শিকারের পকেট হালকা করতে তাকে বেশি বেগ পেতে হত না।
মিসেস মোলারের কান্নাকাটির পরেই ব্লুমফনটিনের সুপ্রীমকোর্টে মাস্টারস অফিসে খোঁজখবর নিলাম আমি। এই অফিসেই ক্লার্কের কাজ করত তার ছেলে। দক্ষিণ আফ্রিকায় যে চারটি প্রদেশ আছে, অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট তাদেরই অন্যতম এবং এই প্রদেশেরই রাজধানী হল এই ব্লুমফেনটিন শহরটি। হিরের খনির সুবিখ্যাত কেন্দ্র কিমবার্লি থেকে প্রায় শখানেক মাইল দুরে ছোট এই শহরটায় সে সময় ১৯৩০ সালে, শুধু শ্বেতাঙ্গই ছিল প্রায় ৩০,০০০। ব্রিটেনের সঙ্গে লড়াইয়ে ট্রান্সলের সঙ্গে বুয়োরস-এর রিপাবলিকান গভর্নমেন্ট যোগদান করার পর থেকে উত্তেজনার লেশমাত্রও ছিল না সে শহরে। আইন অনুরাগী নাগরিকদের কেন্দ্র হওয়ার সুখ্যাতি অর্জন করেছিল ব্লুমফনটিন। খুনজখম জাতীয় অপরাধের নামও একরকম ভুলেই গিয়েছিল সবাই।
সুপ্রীমকোর্টের অফিসাররা আমাকে জানালেন যে, দিনকয়েক আগে ভাগ্নের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল ভ্যানউইক। আন্তরিকভাবেই বিস্তর আলোচনা হয় দুজনের মধ্যে। বাইরে থেকে কোনওরকম বিদ্বেষ বা অস্বাভাবিক কিছু দেখা যায়নি ওদের কথায়-বার্তায় আচরণে। ভ্যানউইক বিদায় নেওয়ার পর দারুণ উত্তেজিত হয়ে এক সহকর্মীর কাছে ফলাও করে গল্প করতে থাকে মোলার, যে সে নাকি তার মামার সঙ্গে গুপ্তধন খুঁড়তে বেরোবে শিগগিরই। ব্লুমফনটিন থেকে দেড়শো মাইল দূরে ওয়াটারভালে নাকি মাটির নীচে পোঁতা আছে এই সম্পদ।
জুলাই মাসের বারো তারিখে মামাকে নিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে মোলার। গাড়ির পেছনে ছিল একটা গাঁইতি আর একটা কোদাল। ওয়াটারভালের খামারবাড়িতেই মানুষ হয়েছিল ভ্যানউইক। কাজে কাজেই দুজন গোয়েন্দাকে পাঠিয়ে দিলাম তখুনি যদি কোনও হদিশ পাওয়া যায় এই আশায়। ঘণ্টা কয়েক পরেই এদেরই একজনের কাছ থেকে টেলিফোন এল। সেইদিনই সন্ধ্যার সময়ে খাবার বাড়ি ছেড়ে রওনা হয়েছে ভ্যানউইক আর তার ভাগ্নে। মিসেস সি জে হফম্যান ওই অঞ্চলেই থাকেন। রাতের অন্ধকারে তাঁর বাড়িতে নাকি ভ্যানউইক এসেছিল। গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল তার। তাই মেরামত করার জন্যে একটা টর্চের দরকার হয়ে পড়েছিল। কিন্তু টর্চ দিয়ে ভ্যানউইককে সাহায্য করতে পারেননি মিসেস হফম্যান। বলেছিলেন, রাতটা যদি তার বাড়িতেই কাটানো মনস্থ করে ভ্যানউইক তাহলে না হয় একটা শয্যার বন্দোবস্ত করে দিতে পারেন তিনি। ভ্যানউইক কিন্তু রাজি হয়নি। আর দেরি না করে যেমন করেই হোক তখুনি নাকি তার যাত্রা আবার শুরু করা দরকার।
ওয়াটারভাল তল্লাসি করার নির্দেশ পাঠালাম ফোন মারফত। তারপর খবরের কাগজের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলাম মোলারের অন্তর্ধান কাহিনি এবং ভ্যানউইককে অনুরোধ জানলাম সে যেন তদন্তে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে আসে আমাদের পাশে। বহু প্রচলিত এই টোপ যে তাঁকে আকৃষ্ট করবে, এরকম কোনও দৃঢ় বিশ্বাস আমার ছিল না। কিন্তু আশ্চর্য! জোহানেসবার্গ স্টারে খবরটা পড়ামাত্র প্রথম ট্রেন ধরেই সে রওনা হয়েছিল ব্লুমফনটিন অভিমুখে। নিশ্চয় আমাদের বুদ্ধিশুদ্ধি গুলিয়ে গেছে এবং ওকে ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করিনি আমরা–এই ধারণার বশবর্তী হয়েই যে আমাদের ফাঁদে পা দিয়েছিল ও, সে বিষয়ে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই আমার।
ইতিমধ্যে আমার অনুচরেরা ওয়াটারভালে একটা শিয়ালের গর্তের হদিশ পেল। সম্প্রতি খোঁড়াখুঁড়ির চিহ্ন ছিল গর্তটার ওপর। তৎক্ষণাৎ মাটি সরিয়ে ফেলে ওরা এবং আবিষ্কার করে মোলারের কুণ্ডলী পাকানো লাশ। জমি থেকে প্রায় আড়াই ফুট নীচে মাটির মধ্যে মুখ গুজড়ে পড়েছিল দেহটা। জ্যাকেটের পেছনে ছিল একটা ছিদ্র। সে ছিদ্র শরীরের মধ্যেও প্রবেশ করেছে অনেকখানি। তীক্ষ্ণাগ্র কোনও হাতিয়ার দিয়ে চোট মারার ফলেই এই ছিদ্রের সৃষ্টি। ট্রাউজারের বোতাম দুটোও ছিঁড়ে গিয়েছিল কি এক অজানা কারণে।
পোস্টমর্টেমে হাজির থাকার জন্যে মোটর হাঁকিয়ে গেলাম ওয়াটারভালে। মোটামুটি একটা ছাউনির নীচে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল লাশটা। মোমের ল্যাম্প জ্বেলে শুরু হল পরীক্ষা পর্ব। চোকের সামনে বীভৎস দৃশ্য দেখেও নিজেদের সংযত করার বিদ্যে আয়ত্ত করতে হয় পুলিশ অফিসারদের। কিন্তু জন মোলারের সেই ভয়ঙ্কর পরিণতি কোনওদিনই ভোলবার নয়। ডিমের খোলা ফেটেফুটে গেলে যেরকম দেখতে হয়, ঠিক সেইভাবেই ঘেঁতো করা হয়েছিল বেচারার মাথার খুলিকে। আর শিরদাঁড়ার মূলে ওই আঘাতচিহ্নের সৃষ্টি যদি মোলারের জ্ঞান টনটনে থাকার সময়ে করে থাকে, তাহলে যে কি অসীম যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে জ্ঞান লোপ পেয়েছে ওর, তা আর না বললেও চলে!
শিয়ালের গর্তে কিন্তু ধস্তাধস্তির কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কাছাকাছি একটা ডোবার নীচে গাঁইতি আর কোদালটা পাওয়া গিয়েছিল। এস ভ্যান ডবলিউ চিহ্নিত একজোড়া কাদামাখা মোজাও খুঁজে পেয়েছিল গোয়েন্দারা। ব্লুমফনটিনে ফিরে এসে দেখলাম কয়েক ঘণ্টা আগেই খবরের কাগজের আবেদন পড়ে পুলিশ স্টেশনে হাজির হয়েছে ভ্যানউইক।
নির্বিকার মুখে ফাঁড়ির ভেতর লম্বা লম্বা পা ফেলে ঢুকে ডিউটি অফিসারকে বলেছিল ভ্যানউইক–কাগজে পড়লাম আমার সঙ্গে দেখা করতে চান আপনারা। তাই প্রথম ট্রেনেই ফিরে এলাম যদি আপনাদের কোনও কাজে লাগি এই আশায়।
ভ্যানউইককে এরপর জানানো হল যে আর তার সাহায্যের দরকার নেই। কেননা তার ভাগ্নের লাশ খুঁজে পাওয়া গেছে এবং খুনের অপরাধেই এখন তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ডিউটি অফিসারের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ছিল যথেষ্ট। তাই ভ্যানউইকের কাছ থেকে তখুনি কোনও বিবৃতি নিতে সরাসরি অস্বীকার করলেন তিনি। তার কারণ সেই মুহূর্তেই যদি বিবৃতি নেওয়া হয় ওর কাছ থেকে তাহলে পরে হয়তো বলপূর্বক বিবৃতি আদায়ের অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারেন তিনি এবং এই এক চালেই ফেঁসে যেতে পারে কেসটা।
অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই শোকাবহ শেষ দৃশ্যটার পূর্ণ অভিনয় করার জন্যে ভ্যানউইককে ওয়াটারভালে নিয়ে যাওয়ার আর্জি পেশ করলেন প্রতিবাদী পক্ষের আইনবিদ। বিচারবিভাগও মঞ্জুর করল সে আর্জি। সাক্ষ্য দেওয়ার জন্যে একজন ফটোগ্রাফার আর একজন ডাক্তারও গেলেন সেই দলে। শিয়ালের গর্তের কাছে এসে ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন তা বলতে শুরু করল ভ্যানউইক।
আগের বছর প্রতারণার দায়ে গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় হুঁশিয়ার ভ্যানউইক একটা বাক্সের মধ্যে তিন হাজার পাউন্ডের নোট ঠেসে বাক্সটাকে লুকিয়ে রেখেছিল বিশেষ একটা গোপন স্থানে। ওয়াটারভালের সেই বিশেষ স্থানটিতে। ওরা যখন পৌঁছোল তখন অমানিশার অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে এক দিগন্ত থেকে আর এক দিগন্তে।
জমির উপরিভাগ থেকে আঠারো ইঞ্চির মধ্যে দুটো গর্ত দেখতে পেলাম আমরা। দুটো গর্তই বুজিয়ে ফেলা হয়েছে মাটি দিয়ে। ঠিক কোন গর্তটিতে যে বাক্সটি লুকিয়েছে তা যখন স্থির করতে পারলাম না, তখন স্থির করলাম দুটোই খুঁড়ে দেখা যাক। বেশ খানিকটা মাটি তুলে ফেলার পর কোদালটা সরিয়ে রেখে গাঁইতি তুললাম। বাক্সের ওপর যে পাথরটা চাপা দিয়ে গিয়েছিলাম, এই পাথরটা চড় দিয়ে উঠিয়ে ফেলার জন্যেই তুলেছিলাম গাঁইতিটা।
এই সময়ে মোলার বললে তার বড় তেষ্টা পেয়েছে। জিগ্যেস করলে কোথায় জল পাওয়া যাবে। বললাম, খানিক দূরেই একটা জলের কল আছে। কলটা দেখার জন্যেই ও যখন ধপ করে বসে পড়ল গর্তের কিনারায় তখনই আচমকা আমার মনে হল গাঁইতি তোলার সময়ে হয়তো অজান্তে ওকে জখম করে ফেলেছি আমি। পেছন ফিরে দেখি টলমল করছে ও কিনারার ওপর। গাঁইতি ফেলে ওকে ধরতে গেলাম আমি কিন্তু তার আগেই মাথা নীচের দিকে করে পড়ে গেল ও গর্তের মধ্যে। এবং পড়ল আমারই ওপরে। সামলাতে না পেরে আমিও ছিটকে পড়লাম একদিকে। কানে ভেসে এল শুধু একটা ধপাস শব্দ।
কান খাড়া করেও যখন আর তার কোনও শব্দ শুনতে পেলাম না তখন গর্তের মধ্যে হাতড়াতে হাতড়াতে খুঁজে পেলাম ওর নেতিয়ে পড়া দেহ। মাথার নীচেই পড়েছিল গাঁইতিটা। দেখলাম। বড় মারাত্মক জখম হয়েছে বেচারি। আর, তার পরেই অন্ধকার হয়ে গেল সব কিছু। এর পরে যে কি হয়েছে তা এখনও মনে করতে পারছি না আমি। এই শোচনীয় পরিণতির আকস্মিকতার আঘাত বোধহয় সামলাতে পারিনি তাই লোপ পেয়েছিল চেতনা।
এরপর কী কী ঘটনা মনে পড়ে তোমার? প্রশ্ন করেন মিঃ এফ. পি. ডি. ওয়েট–কয়েদির কৌন্সলি।
গাড়ির কাছে আবার ফিরে আসার পরেই চেতনা ফিরে আসে আমার। মাথা ঘুরছিল। ইচ্ছে হয়েছিল গলা ছেড়ে আর্ত চিৎকার করি, ঈশ্বরের কাছে আবেদন জানাই যেন আমাকেও শেষ করে ফেলেন তিনি এইভাবে। গাড়ির মধ্যে উঠে বসেছিলাম তারপর। গাড়িতে স্টার্ট দেওয়ার পর ভাবলাম, অনেক…অনেক দূর চলে যেতে হবে আমায়, তা না হলে শান্তি পাব না আমি।
এরপর আবার অভিনয় করে দেখানো হল সেই শোচনীয় দুর্ঘটনা। গর্তের মধ্যে নেমে গাঁইতি তুললে ভ্যানউইক। আর, কিনারায় বসে রইল তার কৌন্সলি নিহত মোলার যে অবস্থায় বসেছিল হুবহু সেইভাবে। ফটোগ্রাফ নেওয়া হল এই দৃশ্যের এবং দেখা গেল শূন্যে আন্দোলিত গাঁইতির ফলাটা বাস্তবিকই আঘাত হানছে কিনারায় ঝুঁকে-বসা মানুষটার এমন একটা স্থানে যেখানে চোট পাওয়ার পরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে হতভাগ্য জন মোলার।
আগাগোড়া সমস্ত দৃশ্যটা দেখে ডাক্তারও বললেন যে বাস্তবিকই মোলারের পতন এবং মৃত্যুটি নিছক দুর্ঘটনা ছাড়া হয়তো আর কিছুই নয়। বললেন–আমার তো মনে হয় তা খুবই সম্ভব। জ্যাকেট ছেদা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক ওই জায়গাতেই মারাত্মক চোট পেয়েছে মোলার। আর তার পরেই ভ্যানউইক যেভাবে দেখাল, ঠিক ওইভাবেই সে তাল সামলাতে না পেরে গড়িয়ে পড়েছে গর্তের মধ্যে।
মোজা ফেলে যাওয়া অথবা ডোবার মধ্যে গাঁইতি আর কোদাল রেখে যাওয়ার রহস্য কিন্তু ব্যাখ্যা করতে পারেনি ভ্যানউইক। জিনিসগুলো বলা ওর পক্ষে সম্ভব নয় এই কারণে যে তখনও নাকি ওর মনের আচ্ছন্নতা কাটেনি এবং সে সময়ে কি করেছে না করেছে তার বিন্দুমাত্র মনে নেই ওর। কিছুদিনের জন্যে মানসিক চিকিৎসালয়ে থাকতে হয়েছিল ভ্যানউইককে। কাজেই মোলারের মৃত্যুর রাতেও যে সে স্মৃতিহীনতায় আক্রান্ত হয়েছিল, তা বোঝা গেল ওর কাহিনি থেকে। মনোসমীক্ষকেরাও সমর্থন জানালেন এ কাহিনি শুনে। তাঁরা বললেন, ওই রকম অবস্থার মধ্যে পড়লে তার পক্ষে স্মৃতি হারিয়ে ফেলা খুবই সম্ভব।
এ কেস যে শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা যাবে না এবং সাফল্য যে এক রকম অসম্ভব তা প্রতিবাদী পক্ষের বিপুল তোড়জোড় দেখেই বুঝলাম। ১৯৩০ সনের ২১ অক্টোবর ফ্রি স্টেটের বিচারপতি-সভাপতি স্যার ইটিন ভিলিয়ার্স এবং ব্লুমফনটিন ক্রিমিন্যাল সেশনের জুরির সামনে হাজির করা হল ভ্যানউইককে। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অম্লানবদনে সে বললে অ্যাডভেঞ্চার করতে বেরিয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেছে মোলার। বিশেষজ্ঞ সাক্ষীদেরও ডাকা হল তার এই কাহিনিকে সমর্থন জানানোর জন্যে।
অভিযোগ সমর্থন করার জন্যে উঠে দাঁড়িয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মিঃ ডব্লিউ. জি. হোল. কে. সি. বললেন, ভ্যানউইকের বর্ণনা মতো কিনারায় বসে ঝুঁকে পড়ে জলের কল দেখা মোলারের পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়। তাছাড়া, কাহিনির সত্যতা প্রমাণের জন্যে যে ফটোগ্রাফ তোলা হয়েছে। সেগুলিও সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য নয়। কেননা, ফটোগ্রাফার নিজেও স্বীকার করেছে ক্যামেরা একপাশে সরিয়ে বিশেষ এক কোণ থেকে তোলা হয়েছিল ছবিগুলো। কাজে কাজেই কাহিনির সত্যতা প্রমাণিত হওয়া দুরে থাকুক, সম্পূর্ণ মিথ্যা একটা ধারণাই প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস রয়েছে এসব ছবির মধ্যে। যেভাবে মোলার ঝুঁকে বসেছিল কিনারার ওপর এবং যেভাবে শূন্যে আন্দোলিত গাঁইতিটা এসে পড়েছিল তার পিঠের ওপর–তা কৌশলে তোলা ছবি দিয়ে সৃষ্ট চোখের ধাঁধার জন্যেই সম্ভবপর বলে মনে হতে পারে–প্রকৃতপক্ষে তা একেবারেই অসম্ভব। এ শুধু ক্যামেরার বাহাদুরি ছাড়া আর কিছুই নয়।
ঘণ্টা তিনেক পরে জুরিরা ফিরে এসে রায় দিলেন আসামী নির্দোষ। বুক ফুলিয়ে কাঠগড়া থেকে নেমে এল ভ্যানউইক। আইনের প্রহসনে এতটুকু আঁচড়ও লাগল না তার দেহে।
পরের দিন রাস্তায় দেখা হয়ে গেল একজন জুরির সঙ্গে। আমাকে দেখেই পথের ওপরেই তিনি দাঁড় করালেন আমাকে। তারপর, যেন দারুণ অন্যায় করেছেন, এমনিভাবে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিমায় বললেন–এ ছাড়া আর কী করার ছিল বলুন? ভেবে দেখলাম, বিচারপতি নিজেই ওকে খালাস দেওয়ার পক্ষপাতী। তাই তাঁর বিরুদ্ধে যাওয়া সঙ্গত মনে করলাম না আমরা।
উত্তরে আমি বললাম–লিখে রাখতে পারেন, আজ থেকে ছ-মাসের মধ্যে আরও একটা খুনের অপরাধে ভ্যানউইককে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। দ্বিতীয়বার আর পিছলে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না ওর পক্ষে। তবে তার আগে আরও একটা প্রাণ নষ্ট হবে, এই যা দুঃখ।
তিনমাস পরে আর একটা নৃশংস হত্যার খবর এল। নিহত ব্যক্তি জাতিতে ব্রিটিশ। নাম সিরিল প্রিগ টাকার। ট্রান্সলে প্রিটোরিয়ার কাছে অ্যাপলেডুর্নয়ে একটা খামারবাড়ির মালিক সে। তারই বাড়ির কাছে মাটির মধ্যে থেকে উদ্ধার করা হল তার দেহ। একটা বাক্সের মধ্যে লাশটা ঠেসে পুঁতে রাখা হয়েছিল একটা বড় ফাটলের মধ্যে। যে হাতুড়ি দিয়ে তাকে পিটিয়ে মারা হয়েছিল, রক্তমাখা সেই হাতিয়ারটাও ওয়াগন-হাউসের মধ্যে কাঠের গাদার নীচে পাওয়া গেল।
সন্দেহভাজন হত্যাকারীর চেহারার বিবরণ ছড়িয়ে দেওয়া হল দেশময় পুলিশের দপ্তরে দপ্তরে। ছোটখাটো মানুষটি, টাক মাথা, ঝুলে পড়া গোঁফ। সম্ভবত ফ্রি স্টেটেরই বাসিন্দা সে। টাকারের সঙ্গে খামারবাড়ি কেনা সম্পর্কে কথাবার্তা চলছিল তার।
আমার ভবিষ্যত্বাণী অর্ধ সময়ের মধ্যেই অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। এবার কিন্তু মস্তিষ্ক বিকৃতির দোহাই শুনলেন না জুরিরা। পূর্ব-পরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত হত্যার রায় দিলেন তাঁরা। মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত হল ভ্যানউইক। শেষ কটা দিন বাইবেল পড়ে এবং ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেই কেটে গেল তার। ১৯৩১ সালের ১২ জুন ফাঁসির দড়িতে দু-দুটো নরহত্যার প্রায়শ্চিত্ত করে গেল সে।
কিছুদিন পরেই আবার আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন মিসেস মোলার। মৃত্যুর ঠিক আগে তাঁর কাছে একটা চিঠি লিখেছিল ভ্যানউইক। চিঠিখানা আমার হাতে দিলেন উনি।
বোন লুইসা,
ক্ষমা চাওয়ার জন্যে তোমার কাছে যেতে পারছি না আমি। যে শোক তোমায় দিয়েছি জানি না তার কোনও ক্ষমা আছে কিনা। বোন, আমিই খুন করেছি তোমার ছেলেকে। যিশুর দোহাই আমাকে ক্ষমা করো।
স্বীকার করছি, অকারণে তার জীবন-প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছি আমি। যেখানে তাকে খুন করেছিলাম, আমার কোনও টাকাকড়িই পোঁতা ছিল না সেখানে। এই প্রথম আদালতে কেস জিতলাম আমি। আগাগোড়া ডাহা মিথ্যে বলেছি আমি। অন্যান্য কেসে সত্য বলেছিলাম বলেই শাস্তি পেয়েছি বার বার।
নিছক টাকার লোভেই দ্বিতীয় খুনটা করে ভ্যানউইক! বিক্রয়দলিল জাল করে টাকারের খামারবাড়ির মালিক হয়ে বসার মতলবেই ভদ্রলোককে সরিয়ে দেয় পৃথিবী থেকে। লাশটাকে ফাটলের মধ্যে কবর দেওয়ার পর ধারণা ছিল শত চেষ্টা করলেও তা উদ্ধার করা কারোর পক্ষেই সম্ভব হবে না। একটা খুন করে অনায়াসেই যখন বুড়ো আঙুল দেখাতে পেরেছে সে আইনের রক্তচক্ষুকে, তখন আরও একটা করলেই বা ধরছে কে?
ভাগ্নে নিধনের মোটিভ পরিষ্কার হয়ে যায় যদি ধরে নেওয়া যায়–সত্যি সত্যিই সে বিশ্বাস করত যে মোলার তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আগের চুরির ব্যাপারে। লুকোনো চোরাই টাকা উদ্ধারের অ্যাডভেঞ্চারে একসঙ্গে দুজনের যাওয়া থেকেই এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে আগের চুরির ব্যাপারে মোলারেরও হাত ছিল। শেষ মুহূর্তের অনুতাপের দহনে জ্বলতে জ্বলতে ভ্যানউইক ভাগ্নের নাম মুছে দিয়েছিল এ কলঙ্ক কাহিনি থেকে। বোনকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছিল, তার ছেলে এমন কোনও জঘন্য কাজ করেনি যে তার জন্যে লজ্জিত হতে হবে পরিবারের আর সবাইকে।
অসুন্দর পথে নোংরা জীবন-পর্বে বোধ করি এইটাই তার একমাত্র সুন্দর কীর্তি।
* উইলিয়াম বিনী (দঃ আফ্রিকা) রচিত কাহিনি অবলম্বনে।