নেবুচানেজারের শীলমোহর
ইন্দ্রনাথ, শার্লক হোমস তো চুরুটের ছাই নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছে, তুমি বরং লেখো পায়ের ছাপ নিয়ে। আখেরে কাজ দেবে। বললাম আমি।
ইন্দ্রনাথ গম্ভীর হয়ে বললে–লিখব না এমন কোনও কথা নেই। লিখলেই বুঝবে সময় আর এনার্জি ব্যয় করে গোয়েন্দা গল্প লেখার নামে ছাইভস্ম না লিখে এদিকে মন দিলে কাজের কাজ করতে।
উত্তপ্ত স্বরে বললাম–লিখলেই পারো। গোয়েন্দা গল্প যদি এতই অপাঠ্য হত, তাহলে–
গোয়েন্দা গল্প যে অপাঠ্য, তা আমি বলিনি। আমি শুধু বলছি, দুর্বল কলমে ভালো ভালো সেগুলো সস্তার রোমাঞ্চ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ডিটেকশন একাধারে আর্ট এবং সায়ান্স। সে জন্যে দরকার শাণিত পর্যবেক্ষণ শক্তি। তা না হলে নামকরা আর্টিস্ট আর সায়ান্টিস্টরা নামকরা ডিটেকটিভ হতে পারত। কিন্তু তোমাদের লেখায় অতি উন্নত ডিটেকশনের বাষ্পটুকুও থাকে না, থাকে খানিকটা সস্তার চমক আর সাসপেন্স। পায়ের ছাপ নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে বলে আমাকে ঠাট্টা করছ, কারণ হাঁটতে হাঁটতে পায়ের ছাপের দিকে নজর রেখেছি। কিন্তু বন্ধু, ছাপগুলো তো তোমার সামনেও আছে। চোখ তোমারও আছে। পায়ের মালিকদের সম্বন্ধে কিছু বলো দেখি শুনি।
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে শর্টকাট করতে গিয়ে ভিজে মাটির ওপর অগণিত পদচিহ্ন ঘাড় হেঁট করে দেখতে দেখতে যাচ্ছিল ইন্দ্রনাথ। তাই টিপ্পনী কাটতে গিয়ে সত্যি সত্যিই চটিয়ে দিলাম বন্ধুবরকে। জঙ্গলের পথে না এলেও চলত। কিন্তু স্টেশনের এক কুলিই পথটা বাতলে দিলে। আর শুরু হল ওর পদচিহ্ন পর্যবেক্ষণ। মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল ছোটখাট গর্তের সামনে। পথসঙ্গী যদি এভাবে পথ চলে, তাহলে বিরক্ত হওয়া স্বাভাবিক। ইন্দ্রনাথের কিন্তু হৃক্ষেপ ছিল না তাতে। তন্ময় হয়ে পদচিহ্ন দেখতে দেখতে যেন মনে মনে আঁকছিল পায়ের মালিকদের চেহারা আর চরিত্রের ছবি।
বিব্রত হয়ে বললাম–খালি পা হলে বলা যেত। কিন্তু জুতো পরলে অসুবিধে আছে। যেমন এই ছাপটা। ঢেউতোলা রাবারের সোল। এর বেশি আর কিছু বলা সম্ভব নয়।
ভুল। জুতো পরলে বরং আরও তথ্য জানা যায়। এ জন্যে শুধু ভাবলে চলে না, চোখ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখার ক্ষমতাকে ট্রেনিং দিয়ে ধারালো করতে হয়। এখানকার মাটি সামান্য ভিজে, ছাপগুলো মোমের ছাঁচের মতোই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। ঢেউতোলা রাবার শোলের জুতো দামি জুতো। আঙুলের ডগা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত সমস্ত ছাপটা সমানভাবে পড়েছে অর্থাৎ জুতোটার তলায় স্পঞ্জ লাগানো অ্যামবাসাডর সু। এ জুতো সাধারণ লোকে পরে না। সঙ্গীর সম্বন্ধে কিছু বলতে পারো?
সঙ্গী! পাশাপাশি দুজোড়া ছাপ রয়েছে বলেই কি একজন অপরজনের সঙ্গী?
পায়ের ছাপ তাই বলছে! প্রথম থেকেই যদি ছাপগুলো লক্ষ্য করতে, তাহলে বুঝতে কেন এ কথা বললাম। প্রথমেই ধরা যাক পদক্ষেপ। দুজনেই খুব লম্বা–সেটা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে জুতোর মাপ থেকে, কিন্তু লম্বা হওয়া সত্ত্বেও দুজনেই ছোট ছোট পা ফেলে হেঁটেছে। কেন?
কেন? প্রতিধ্বনি করলাম আমি।
যার পায়ে চামড়ার জুতো, তার ছোট ছোট পা ফেলার একটা কারণ আছে। কারণটা বোঝা যাচ্ছে ছড়ি ফেলার ধরন দেখে। ছড়িটা ধরা হয়েছে আড়ষ্টভাবে প্রতিবারই ছড়ির ওপর একটু ভরও দেওয়া হয়েছে–যেন পথ চলতে ছড়িটা বিলক্ষণভাবে সাহায্য করেছে। ছড়ির দাগ রয়েছে প্রতি দু-পা অন্তর। যখনই বাঁ-পা মাটিতে পড়েছে, তখনই ছড়িও পড়েছে বাঁ-পায়ের উল্টোদিকে। যার সোজা মানে এই যে, পায়ের মালিক বয়েসে প্রবীণ, কাহিল অথবা অক্ষম। কিন্তু রাবার-সোল জুতো যার পায়ে, সে সাধারণ ভাবেই হেঁটেছে–প্রতি চার পা অন্তর একবার মাটি ছুঁয়েছে ছড়ি। অস্বাভাবিক ছোট পদক্ষেপে হাঁটার কারণটা শারীরিক নয়, সঙ্গীর পায়ে পা মিলিয়ে চলতে হচ্ছে। বলেই।
তারপর দেখো, দুজোড়া পা সাধারণ পাশাপাশিই চলেছে, কেউ কারও পায়ের ছাপ মাড়িয়ে যায়নি। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটেছে পথ যেখানে সরু। তখন দুজনকে আগেপিছে চলতে হয়েছে। এই রকম দুটো ক্ষেত্রে একবার দেখলাম রাবার সোলের ছাপ মাড়িয়ে গেছে চামড়ার সোল। আরেকবার দেখলাম, চামড়ার সোলের ওপর পড়ছে রাবার সোল। এই থেকেই পাকাপাকি সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে। যে দুজনেই একসঙ্গে পথ চলেছে, মধ্যে মধ্যে আগেপিছে হলেও সঙ্গ ছাড়েনি।
খুবই সোজা, বললাম আমি। তুমি যা বললে, তা হল থিওরির ব্যাপার। পায়ের ছাপ আর তার মানে নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কতকগুলো থিওরি আওড়ালে। কিন্তু এর মধ্যে পর্যবেক্ষণ বা চোখকে ট্রেনিং নেওয়ার প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে?
তিক্তকণ্ঠে ইন্দ্রনাথ জবাব দিলে–বুঝিয়ে দিলে সবই সোজা। আর চোখের ট্রেনিং না থাকলে এটুকুও যে জানা যায় না, তার প্রমাণ তো তুমি নিজেই। বেশ তো, দু-দুটো ছড়ির ছাপ তোমার সামনেই রয়েছে। ভালো করে দ্যাখো, দেখে বলো দেখি আশ্চর্য কিছু দেখতে পাচ্ছে কিনা।
বললাম, সবগুলোই তো একই রকম মনে হচ্ছে। রাবার সোল লোকটার ছড়ি অবশ্য একটু বেশি লম্বা। আর চামড়ার-সোল লোকটার ছড়ির গর্ত একটু বেশি গভীর। কারণটা খুব সম্ভব ছড়িটা ছোট হওয়ার ফলেই চাপ বেশি পড়ছিল ছড়ির ওপর–তাই গর্তও হয়েছে গভীর।
বিদ্রুপের হাসি হেসে ইন্দ্রনাথ বললে–আসল পয়েন্টটাই মিস্ করে গেলে। চাক্ষুষ প্রমাণগুলো দেখবার ক্ষমতা তোমার নেই বলেই এই ব্যর্থতা। পরিষ্কার পয়েন্ট, বিশেষ কয়েকটা ক্ষেত্রে তা রীতিমতো দরকারিও বটে।
বটে? শুনতে পারি পয়েন্টটা কি?
অবশ্যই পারো। তোমাকে ট্রেনিং দেওয়ার জন্যেই আমার এত লেকচার দেওয়া। কিন্তু সিদ্ধান্তে তোমাকে নিজেকেই পৌঁছোতে হবে, আমি বলব না।
পয়েন্টাটা বলবে তো?
বলছি। প্রথমেই দ্যাখো, ছোট ছড়ির ছাপগুলো ছড়িধারীর ডানদিকে পড়েছে। দ্বিতীয়, প্রতিটি ছাপই সামনের দিকে আর ডাইনের দিকে সব চাইতে কম গভীর।
উবু হয়ে বসে আবার দেখলাম ছাপের সারি। ইন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছে।
বললাম–কিন্তু তাতে কি প্রমাণিত হয়?
আমার সেইরকম গা-জ্বালানো হাসি হেসে ইন্দ্রনাথ বললে–চাক্ষুস প্রমাণ সামনেই আছে। সবজান্তা বন্ধু, চোখ দিয়ে তার চুলচেরা বিচার কর, তাহলেই পাবে উত্তর।
কিন্তু তোমার হেঁয়ালিটাই তো ধরতে পারলাম না, খেঁকিয়ে উঠে বলি আমি। ছাপগুলো একদিকে কম গভীর, তার কারণ ছড়ির ফেরুলটা সেইদিকেই বেশি ক্ষয়েছে। কিন্তু আবার বলছি, তাতে কি কিছু প্রমাণিত হয়? কেন ছড়ির মালিক ছড়ির ফেরুল একদিকে বেশি খইয়েছে, এটাই কি তোমার সিদ্ধান্ত?
শান্ত হও বন্ধু, শান্ত হও। এত অল্পে ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে গোয়েন্দা হওয়া যায় না। দার্শনিকের মতো নির্বিকার থেকে দাগটার কম গভীরতা নিয়ে মাথা ঘামাও। পয়েন্টটা রীতিমতো ইন্টারেস্টিং।
গোল্লায় যাক তোমার ছড়ির ছাপ। ছড়ি আমার নয়, ছড়ির মালিককেও আমি চিনি না। সুতরাং তা নিয়ে অত রিসার্চেরও দরকার নেই। আরে, ত্রিপুরারিবাবু যে!
জঙ্গল যেখানে শেষ হয়েছে, সেইখানেই ফ্রেমে আঁটা ছবির মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন সলিসিটর ত্রিপুরারি আঢ্যি। আমাদের দেখেই হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলেন।
নমস্কার ইন্দ্রনাথবাবু! নমস্কার মৃগাঙ্কবাবু! আমি জানতাম সময় বাঁচাতে এ পথই ধরবেন আপনারা। তাই এগিয়ে নিতে এলাম।
ইন্দ্রনাথ নমস্কার ফিরিয়ে দিয়ে বললে–আপনার টেলিগ্রামে দেখলাম মৃত্যুটা সন্দেহজনক আত্মহত্যা বলে মনে হচ্ছে। তদন্তের সুযোগ আছে তো?
আছে কিনা বলতে পারব না। সে আপনারা এক্সপার্টরা বুঝবেন। নিহত ব্যক্তির পঞ্চাশ হাজার টাকার লাইফ ইন্সিওর্যান্স ছিল। মৃত্যুটা যদি আত্মহত্যা বলেই প্রমাণিত হয়ে যায়, তাহলে এসটেটের পঞ্চাশ হাজার টাকা লোকসান হয়ে যাচ্ছে। সেইজন্যেই ভাবছিলাম উপযুক্ত ফি দিয়ে এক্সপার্টকে দিয়ে যদি কিছু প্রমাণ করা যায় মৃত্যুটা নেহাতটা দুর্ঘটনা, তাহলে পঞ্চাশ হাজার টাকা এসটেটে চলে আসে। বলে ধূর্ত চোখ নাচিয়ে অর্থব্যঞ্জক হাসি হাসলেন ত্রিপুরারি আঢ্যি।
প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতটা এড়িয়ে গেল ইন্দ্রনাথ। উৎকোচ-প্রস্তাবে কঠিন হয়ে উঠল চোয়ালের রেখা।
বললে নীরস স্বরে–কেসটার আদ্যোপান্ত বলুন।
যেতে যেতেই বলছি। মৃত ব্যক্তির নাম প্রহ্লাদ চক্রবর্তী। আমার বন্ধু সলিসিটর কৃষ্ণদাস চক্রবর্তীর ভাই। আজ সকালে অফিসে গিয়ে খবর পেয়েই আমার কাছে দৌড়ে আসে কৃষ্ণদাস। ওর সঙ্গেই এসেছি এখানে। কৃষ্ণদাস বাড়ির মধ্যে অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্যে।
গত রাতে খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে এক চক্কর বেড়াতে বেরিয়েছিল প্রহ্লাদ। গরমকালে খাওয়ার পর বেড়ানো ওর চিরকালের স্বভাব। চাকরবাকররা দেখেছে তাকে বেরিয়ে যেতে। তারপর আর কেউ তাকে জীবিত অবস্থায় দেখেনি। কখন যে সে ফিরে এসেছে, তা কেউ জানে না। সেটা অবশ্য স্বাভাবিক। কেননা, প্রহ্লাদের বৈঠকখানা, ছোট্ট কারখানা, পড়ার ঘর আর মিউজিয়াম বাড়ি থেকে আলাদা। লাগোয়া হওয়ার ফলে একটা দরজা খুললেই এ-বাড়ি ও-বাড়ি এক হয়ে যায়। বৈঠকখানায় ঢোকার আলাদা দরজা আছে। সাধারণত রাত্রে বেড়িয়ে ফিরে এই দরজা দিয়েই বাড়ির মধ্যে ঢুকে সিধে শুতে চলে যেত প্রহ্লাদ–চাকরবাকররা জানতেও পারত না।
গত রাতেও তাই করেছে প্রহ্লাদ। কিন্তু আজ সকালে শোবার ঘরে গিয়ে ওর বিধবা পিসি দেখলে বিছানা নির্ভজ, কেউ শোয়নি। প্রহ্লাদেরও পাত্তা নেই। এ-বাড়ি থেকে বৈঠকখানায় যাওয়ার দরজা ঠেলে দেখা গেল ওদিক থেকে বন্ধ। অগত্যা চাকর নারাণকে ডাক দেয় পিসি। বাইরে গিয়ে দেখে সেদিককার দরজাও বন্ধ। হাঁকাহাঁকি করেও যখন সাড়া পাওয়া গেল না, তখন নারাণ দেখতে লাগল জানলা খোলা আছে কিনা। কিন্তু জানলাগুলোও বন্ধ। শেষকালে কারখানা ঘরে একটা বড় স্কাইলাইটের রড খুলে ফাঁক দিয়ে কোনওমতে ভেতরে ঢোকে নারাণ। তারপর বৈঠকখানায় ঢুকে দেখে টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে প্রহ্লাদ। মারা গেছে আগেই। টেবিলের ওপর একটা হুইস্কির বোতল, সোডার বোতল, একবাক্স চুরুট, ছাইদানিতে একটা আধপোড়া চুরুট আর একবাক্স পটাসিয়াম সায়ানাইট বড়ি।
তৎক্ষণাৎ ডাক্তারকে খবর পাঠানো হয়। খবর যায় কৃষ্ণদাসের অফিসেও। নটা নাগাদ ডাক্তার এসে বললেন, সায়ানাইড পয়জনিং। তবে পোস্টমর্টেম না করলে খুঁটিনাটি বলা সম্ভব নয়। চাকরা বাকররা ধরাধরি করে চেয়ার থেকে প্রহ্লাদকে নিয়ে শুইয়ে দিয়েছে সোফার ওপর। না দিলেই ভালো করত। কেন না, প্রহ্লাদ মরে কাঠের মতো শক্ত হয়ে গেছে।
পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে? জিগ্যেস করে ইন্দ্রনাথ।
না। প্রহ্লাদ আত্মহত্যাই করেছে–সন্দেহজনক মৃত্যু নয়। তা সত্ত্বেও সবাই ভাবলাম আপনার মতো একজন এক্সপার্টকে ডাকা ভালো বিশেষ করে মৃত্যুটা যদি আকস্মিক হয়–
শুনে তাই মনে হচ্ছে। পরিষ্কার আত্মহত্যা। কৃষ্ণদাসবাবুর কাছে নিশ্চয় প্রহ্লাদ চক্রবর্তীর মনের অবস্থার খবর পাওয়া যাবে?
তা পাবেন। যা শুনলাম, সম্প্রতি বড় উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল প্রহ্লাদ। এসে গেছি।
সামনেই পুরোনো আমলের সাদাসিদে একটা একতলা বাড়ি। বাগানের ফটক পেরিয়ে ভেতরে পা দিলাম আমরা। সদর দরজা খুলে গম্ভীরমুখে বেরিয়ে এলেন এক ভদ্রলোক। মাথায় কঁচাপাকা চুল। সাদা গোঁফ। সোনার চশমা। আলাপ হল। প্রহ্লাদ চক্রবর্তীর দাদা সলিসিটর কৃষ্ণদাস চক্রবর্তী।
বাড়ির মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে কৃষ্ণদাসবাবু বললেন–প্রহ্লাদ যে আত্মহত্যা করবে ভাবাই যায়। না। সেরকম ছেলে তো ও নয়। আমাদের বংশেও আত্মহত্যা কেউ কখনো করেনি। কিন্তু কেন যে ও–
কথা বলতে-বলতে হলঘরে প্রবেশ করলাম এবং এক প্রান্তের দরজা পেরিয়ে প্রহ্লাদ চক্রবর্তীর বৈঠকখানায় এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল এক ভয়ানক দৃশ্য। সোফার ওপর কিম্ভুতকিমাকার ভঙ্গিমায় শায়িত এক মৃতদেহ। কিম্ভুতকিমাকার এই কারণে যে মৃতদেহ শুয়ে রয়েছে চেয়ারে বসার ভঙ্গিতে দু-পা হাঁটু মুড়ে সে এক আশ্চর্য পোজে। পরিধানের বুশশার্ট, ট্রাউজার্স, আর জুতো। দূর থেকেই জুতোর শুকতলা লক্ষ্য করে চমকে উঠলাম আমি।
সোলটা রাবার সোলের, ঢেউ তোলা! ঠিক যেমনটি একটু আগেই ভিজে মাটিতে দেখে এসেছি।
টেবিলের ওপর পোড়া চুরুট সমেত ছাইদানি, হুইস্কির বোতল, সোডার বোতল, চুরুটের বাক্স আর পটাশিয়াম সায়ানাইডের প্যাকেট।
স্থির চোখে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে ছিল ইন্দ্রনাথ। জুতোর শুকতলা দেখে আমিও উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। কাছে গিয়ে দেখলাম। দামি জুতো, তলায় ফোম রাবারের স্তর লাগানো অ্যামবাসাডর মোকাসিন।
ত্রিপুরারিবাবু বললেন–আপনারা দেখুন। আমরা পাশের ঘরে আছি। দরকার পড়লে ডাক দেবেন।
বলে, দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ভেতর বাড়িতে উধাও হলেন দুই প্রৌঢ় বন্ধু।
সঙ্গে-সঙ্গে আমি চাপা গলায় বললাম–ইন্দ্র, দেখেছ?
দেখেছি। সোফার সামনে দাঁড়িয়ে জবাব দিল ইন্দ্রনাথ।
অবিকল সেই জুতো। কে জানে হয়তো ইনিই কাল রাতে হেঁটেছিলেন জঙ্গলের রাস্তায়।
হ্যাঁ ইনিই। তাতে কোনও সন্দেহ নেই, বলে, বাঁ-পায়ের শুকতলার খাঁজে গাঁথা একটা কাঁটা পেরেক দেখিয়ে বলল, তখনি লক্ষ্য করেছিলাম পেরেকের ছাপ। কিন্তু বলিনি পাছে আবার তর্ক আরম্ভ করে দাও বলে।
কিন্তু পায়ের ছাপটা যদি এই ভদ্রলোকেরই হয়, তাহলে তো সঙ্গে সেই আশ্চর্য ছড়িওলা লোকটিকেও আমাদের দরকার। ভাবছি, কে হতে পারে লোকটা। পাড়ার কেউ নয় তো?
তা হতে পারে। ছাপগুলোও খুব টাটকা, খুব সম্ভব কাল রাতের। আর তা যদি হয় তাহলে ভদ্রলোককে আমাদের প্রয়োজন। কেননা, প্রহ্লাদ চক্রবর্তীকে সবশেষে জীবিত অবস্থায় তিনিই দেখেছেন। অবশ্য তা নির্ভর করছে, কোন সময়ে মাটির ওপর পায়ের ছাপ পড়েছে, তার ওপর।
বলে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লাশটা পরীক্ষা করতে আরম্ভ করল ইন্দ্রনাথ। মৃতদেহ পরীক্ষার বিশেষ কয়েকটা পদ্ধতি আছে আমার এক ডাক্তার বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম। ইন্দ্রনাথ দেখলাম বিদ্যেটায় বেশ ওস্তাদ। তীক্ষ্ণ চোখে দেখল মুখের ভেতর আর তালুর ওপর। তারপর ঘরটা মোটামুটি পরীক্ষা করে নিয়ে গেল পাশের ছোট্ট ওয়ার্কশপে। ল্যাবরেটরি বেসিনের কোণ-টোণগুলোয় অনেকক্ষণ ধরে উঁকিঝুঁকি দিল। তাক থেকে নামিয়ে আনল একটা খালি গেলাস। আলোর সামনে ধরে উল্টেপাল্টে দেখে আবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তাকের ওপর। ভিজে গেলাস উলটো করে শুকোতে দেওয়া হয়েছিল, তাই একটা আবছা জলের রেখা গোল হয়ে ফুটে রয়েছে তাকের ওপর। ফিরে এল বৈঠকখানায়। বাইরের দরজার ছিটকিনিটা দেখল নেড়ে।
তারপর বলল নিরাশ মুখে–নাঃ, কিচ্ছু নেই। পটাসিয়াম সায়ানাইডের বড়িগুলো দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, মৃত্যুটা হঠাৎ নয়, দুর্ঘটনা নয়–প্ল্যানমাফিক। চুরুটের বাক্সটা দেখছি আনকোরা, দুটো চুরুট নেই। একটা আধপোড়া অবস্থায় অ্যাসট্রেতে পড়ে–কিন্তু ছাই যা জমেছে তা একটা চুরুটের পক্ষে অনেক বেশি। চল, কৃষ্ণদাসবাবুকে দু-চারটে প্রশ্ন করা যাক।
হলঘরে প্রবেশ করতেই সাগ্রহে চোখ তুললেন দুই প্রৌঢ়।
ত্রিপুরারিবাবু জিজ্ঞেস করলেন–কিছু পাওয়া গেল?
আপাতত না। জবাব দিল ইন্দ্রনাথ। আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। আচ্ছা কৃষ্ণদাসবাবু, বাইরের দরজাটায় দেখলাম মাঝে খিল আর তলায় ছিটকিনি। প্রহ্লাদবাবু কোনটা বন্ধ করেছিলেন?
ছিটকিনিটা। খিল খোলা ছিল।
ও। ত্রিপুরারিবাবুর মুখে শুনলাম, সম্প্রতি একটু উদ্বিগ্ন ছিলেন আপনার ভাই। কারণটা জানেন?
তেমন কিছুই নয়। ওর চাইতেও অনেক বড় উদ্বেগের মধ্যে ওর দিন গেছে। প্রহ্লাদ শক্ত নার্ভের ছেলে, আত্মহত্যার মতো দুর্বলতা ওর ছিল না। যাই হোক, আমি যা শুনেছি, বলছি।
কিছুদিন আগে ভূপর্যটক নীলমাধব রাউত মেসোপটেমিয়া থেকে ফিরে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের কিউরিও দোকানি জন মার্টিনকে একটা ছোট্ট সোনার সিলিন্ডার শীলমোহর বিক্রি করেন। শীলমোহরটা নাকি নীলমাধববাবু বাগদাদের মাইলখানেকের মধ্যেই কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। কীভাবে পেয়েছিলেন তা জানি না। কিন্তু সিলিন্ডার সমেত উনি কলকাতায় ফিরে এসেই ছোটেন মার্টিনের কাছে কিছু টাকার আশায়। জন মার্টিন আটশো টাকা দিয়ে কিনে নেয় শীলমোহরটা।
নীলমাধববাবু জানতেন সিলিন্ডারটা সোনার, তার বেশি কিছু জানতেন না। জন মার্টিনও বিশেষ কিছু জানত না। যদিও পুরোনো জিনিস কেনাবেচাই তার ব্যবসা, কিন্তু এক্সপার্ট নয়। তবে জন মার্টিনের একটা মহৎ গুণ আছে–নকল করার গুণ। পুরোনো জিনিসকে ঘষে-মেজে এমন নিখুঁত করে তোলে যে মাথা ঘুরে যায় কিউরিওলোভীদের। কাজটা অবশ্য বেআইনি নয়। জন মার্টিন আগে জুয়েলারের দোকানে কাজ করত। ঘড়ির কাজও মোটামুটি জানে। হাতের কাজে জুড়ি নেই তার। তাই ধরেছে এই লাভজনক ব্যবসা। ভাঙাচোরা পুরোনো দুষ্প্রাপ্য বস্তু জোগাড় করে জোড়াতালি দিয়ে ঠিক আগের মতোই করে দেয়–তারপর হাঁকে কড়া দাম। এর মধ্যে জোচ্চুরি নেই। সুতরাং জন মার্টিনকে জালিয়াত বলাটা ঠিক হবে না। কিন্তু কিউরিও সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ নয় জন মার্টিন। তাই নীলমাধব রাউতের কাছে পাওয়া সোনার সিলিন্ডারের মাথামুন্ডু কিছু বোঝেনি। শুধু বুঝেছে জিনিসটা অত্যন্ত প্রাচীন আর নকল নয়। অতএব সোনার যা দাম, তার ডবল দাম দিয়ে কিনে নিয়েছে।
দিন পনেরো আগে প্রহাদ গেছিল জন মার্টিনের দোকানে কি একটা মেরামতের কাজ নিয়ে। মার্টিন জানত আমার ভায়াটির ব্যাবিলনের দুপ্রাপ্য জিনিসপত্র সংগ্রহের বাতিক আছে। এ ব্যাপারে প্রহাদ সত্যিই জিনিয়াস, ভাই বলে বলছি না। তাই শীলমোহরটা ওকে দেখায় মার্টিন। দেখেই প্রহ্লাদ বোঝে, জিনিসটা আদত-নকল নয়। শুধু তাই নয়, রীতিমতো প্রাচীন এবং ইন্টারেস্টিং কিউরিও। তাই আর না ভেবেই, এমনকী চোঙাটা আসলে কি, তা খুঁটিয়ে না দেখেই বারোশো টাকার চেক দিয়ে বাড়িতে নিয়ে যায়। প্রহ্লাদ জানত, কিউরিও হিসেবে সোনার সিলিন্ডারটা সত্যিই মূল্যবান এবং বারোশো টাকা অনায়াসেই দেওয়া যায়। বাড়ি এসে মোমের ওপর সিলিন্ডারটা গড়িয়ে ছাপ নিয়ে পরীক্ষা করতেই চক্ষুস্থির হয়ে গেল ভায়ার। চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার। মোমের ছাঁচে ফুটে উঠেছে খোঁচা খোঁচা উঁচু উঁচু কতকগুলো হরফ…তুরাণী হরফ–যেমনটি প্রাচীন ব্যাবিলনে আর পারস্যে দেখা যেত। নিদারুণ উত্তেজিত হয়ে তৎক্ষণাৎ লিপিটার পাঠোদ্ধার করে ফেলে প্রহ্লাদ। আর তখনই বোঝা গেল এ শীলমোহর যে-সে লোকের নয়–স্বয়ং নেবুচাডনেজারের।
চোখের সামনে সেই সুপ্রাচীন শীলমোহর দেখেও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনি প্রহ্লাদ। এ যে বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে পড়া! সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ালো ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে। ব্যাবিলোনিয়ান এক্সপার্ট চমকে উঠল শীলমোহর দেখে। কিনতে চাইল মিউজিয়ামের জন্যে। কিন্তু এমন দুষ্প্রাপ্য মহামূল্যবান বস্তু হাতছাড়া করার পাত্র নয় প্রহ্লাদ। তবে এক্সপার্টের অনুরোধে শীলমোহরটার ওজন, মাপ আর কাদামাটির ওপর একটা গড়ানে ছাপ রেখে দিলে মিউজিয়ামে দর্শনার্থীদের জন্যে।
এখন হয়েছে কি, শীলমোহরটা হাতছাড়া করার আগে নীলমাধব রাউত নিজেও কাদামাটির ওপর কয়েকটা গড়ানে ছাপ তুলে রেখেছিলেন। সেইগুলোই জন মার্টিনের কাছে আবার নিয়ে আসতেই মার্টিন সাহেব কয়েক টাকা দিয়ে সবগুলো কিনে কিউরিও হিসাবে সাজিয়ে রাখল শো-কেসে।
একজন আমেরিকান অ্যাসিরিওলজিস্ট শো-কেসের ছাঁচগুলো দেখেই ঢুকে পড়ে দোকানে। বিনাবাক্যব্যয়ে কিনে নেয় কয়েকটা ছাঁচ। তারপর জন মার্টিনকে জেরা করতে থাকে কোত্থেকে এসেছে কিউরিওগুলো। মার্টিন অতশত না ভেবে নাম ঠিকানা দেয় নীলমাধব রাউতের। শীলটা সম্বন্ধে অবশ্য তখনো কিছু বলেনি। কেননা শীলমোহরের সঙ্গে মাটির ছাঁচের যে সম্পর্ক আছে, তা-ই তো জানত না মার্টিন। নীলমাধববাবু ধাপ্পা দিয়েছিলেন, কাদামাটির ছাঁচগুলোও নাকি খাস মেসোপটেমিয়া থেকে আমদানি। আমেরিকান এক্সপার্টের পাক্কা চোখে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়েছিল, মাটির ছাঁচটা সদ্য তৈরি। আর আসল শীলমোহরটাও নিশ্চয় এখনও নাগালের বাইরে যায়নি।
তাই নীলমাধব রাউতের সঙ্গে দেখা করে আবার পেট থেকে কথা বার করবার চেষ্টা করতে থাকে অ্যাসিরিয়ান এক্সপার্ট। তখনই সন্দেহ হয় নীলমাধবের। শীলমোহরটা যে তার কাছেই ছিল, তা স্বীকার করেন নীলমাধব। কিন্তু এখন তা কোথায় আছে, তা কিছুতেই বলতে রাজি হলেন না এক্সপার্ট। অদ্ভুত চেহারার সোনার চোঙাটা নেবুচাডনেজারের শীলমোহর আর তার দাম দেড় লাখ থেকে দু-লাখের মধ্যে শুনে মাথা ঘুরে গেল রাউতমশায়ের। সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকান এক্সপার্টকে নিয়ে দৌড়লেন জন মার্টিনের দোকানে।
এবার কিন্তু মার্টিন সাহেবের মনেও সন্দেহ দেখা দিল। কিছুতেই বলতে চাইল না কার কাছে শীলটা। উপরন্তু, কাদামাটির ছাঁচটা যে আসলে সোনার শীলমোহর থেকেই, এ সন্দেহ হওয়ায় একটা ছাঁচ নিয়ে দৌড়োল ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে। যেতেই ফাঁস হয়ে গেল সব কিছু। ব্যাপার আরও ঘোরালো হয়ে দাঁড়ালো আমেরিকান অ্যাসিরিওলজিস্ট প্রফেসর কিটম্যানের পেট আলগা হওয়ায়। হোটেলে ফিরে বন্ধুবান্ধবের কাছে নেবুচানেজারের সোনার শীলমোহরের গল্প করায় সাড়া পড়ে গেল কিউরিও-পাগলদের মধ্যে। দলে দলে আমেরিকান গোছা গোছা নোট নিয়ে রোজ হানা দিতে লাগল জন মার্টিনের দোকানে–দাম নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই–শীলমোহর চাই-ই চাই। কিন্তু জন মার্টিনের পেট থেকে যখন কিছুই বার করা গেল না, তখন ছুটল ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে। সেখানে যেতেই তারা বললে, হ্যাঁ শীলমোহরটা আছে আমার ভাই প্রহ্লাদ চক্রবর্তীর কাছে। ঠিকানাও দিলে। কিন্তু প্রহ্লাদের কলকাতার ঠিকানা বলতে টেম্পল চেম্বার্সে আমারই অফিসের ঠিকানা। ফলে, শুরু হল পত্রাঘাতের পর পত্রাঘাত। সমানে চিঠি মারফত অনুনয় বিনয় পৌঁছতে লাগল জন মার্টিন আর নীলমাধব রাউতের কাছেও।
পাগল হতে বসলেন নীলমাধব রাউত। তিনি হামলা করতে লাগলেন জন মার্টিনের ওপর। মার্টিন সাহেব নাকি তাকে ঠকিয়েছে। হয় সে শীলমোহরটা ফেরত দিক, আর নইলে উপযুক্ত দাম দিক। জন মার্টিনের অবস্থাও তাই। সে-ও সমানে তর্জন গর্জন শুরু করে দিলে আমার ভায়ার ওপর। আর কোটিপতি কিউরিও-পাগলরা লাখ লাখ টাকা নগদে দেওয়ার লোভ দেখাতে লাগল দিনের পর দিন। বেচারা প্রহ্লাদের মনের অবস্থা তখন কহতব্য নয়। একদিক দিয়ে ওর সহানুভূতি ছিল নীলমাধব রাউতের ওপর। আপনারা তো জানেন, ভদ্রলোক কি পরিশ্রম করে সারা পৃথিবী ঘুরেছেন। যেখানে গেছেন, বাংলার আর ভারতের নামগান করে পাথেয় সংগ্রহ করেছেন। জন মার্টিনের সম্বন্ধে ওর কোনও মাথা ব্যথাই ছিল না। মার্টিন যদি তার ব্যবসা না বোঝে তো কার কি। কোনও জিনিসের কত দাম, তা মার্টিনের জানা উচিত ছিল। সব চাইতে জ্বালাতন আরম্ভ করল আমেরিকানরা। অবর্ণনীয় সেই উৎপাত। উৎপাতটা বসতবাড়ি পর্যন্ত পৌঁছোতো যদি না গোড়া থেকেই ঠিকানাটা গোপন করে যেত প্রহ্লাদ।
শেষ পর্যন্ত নেবুচানেজারের শীলমোহর নিয়ে যে কি করত প্রহ্লাদ, তা আমি জানতাম না। তবে একদিনের জন্যে আমার প্রাইভেট অফিসটা ধার নেয় ও। সারাদিন ধরে ইন্টারভিউ নেয় নীলমাধববাবু, জন মার্টিন, প্রফেসর কিটম্যান আর অন্যান্য কিউরিও প্রেমিকদের। ইন্টারভিউ হয়েছে তিন দিন আগে। সারাটা দিন মশাই জালিয়ে মেরেছে লোকগুলো। যত্তোসব বদ্ধ উন্মাদের দল। একজন
তো যাবার সময় নিজের ছড়ির বদলে আমার ছড়ি নিয়েও উধাও হল।
তাই নাকি? বেড়াবার ছড়ি?
হ্যাঁ। বড় শখের ছড়ি। বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া।
তার বদলে কি ছড়ি রেখে গেছে বলুন তো?
দেখলে কোনও তফাত বুঝবেন না। হুবহু একই রকম। ভুলটা হয়েছে যদিও সেই জন্যেই। হাতে নিয়েই আমার কীরকম সন্দেহ হল। তারপর হাঁটতে গিয়েই বুঝলাম এ ছড়ি সে ছড়ি নয়।
অস্বাভাবিক ছড়ি বলুন?
এক রকম তাই।
লম্বাই খাটো বুঝি?
না না, তা নয়। তফাতটা ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। আমি আবার ল্যাংড়া মানুষ তো। বাঁহাতে ছড়ি নিয়ে না হাঁটলে ঠিক মৌজ আসে না, হয়তো সেইজন্যেই…সে যাক মশাই, আমার পুরোনো ছড়ি ফিরে পেলেই খুশি হই আমি। আপনি একটু বসুন, ছড়িটা দেখাচ্ছি।
ভেতরবাড়ি গেলেন কৃষ্ণদাসবাবু। ফিরে এলেন অনতিকাল পরেই। হাতে একটা সেকেলে ফ্যাশনের মালাক্কা বেতের ছড়ি। হাতটা হাতির দাঁতে সুন্দরভাবে বাঁধাই। বহু ব্যবহারে বিরঙ হলেও তাক লেগে যায় কারুকাজের সূক্ষ্মতা দেখে। হাতির দাঁত আর মালাক্কা বেতের জোড়মুখ চওড়া রুপোর পটি দিয়ে বেড় দেওয়া।
দুই চোখে অপরিসীম আগ্রহ নিয়ে কৃষ্ণদাসবাবুর হাত থেকে ছড়িটা তুলে নিল ইন্দ্রনাথ এবং দু-হাতে ধরে চোখের একদম কাছাকাছি এনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এমনভাবে দেখতে লাগল যে অবাক হয়ে গেলাম আমি। একটা ছড়ি বই তো নয়, তা সে যত সুন্দরই হোক না কেন, কিন্তু খুনের সঙ্গে যার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই তা নিয়ে অযথা মাথাব্যথা কেন ভেবে আশ্চর্য হলাম। ইন্দ্রনাথ কিন্তু একাগ্রমনে তীক্ষ্ণ চোখে একে একে দেখতে লাগল হাতির দাঁতের হাতল, রূপোর পটি আর পেতলের ফেরুটা। বিশেষ করে ফেরুলটা নিয়েই ও এত বেশি তন্ময় হয়ে রইল যেন জিনিসটা অতি দুষ্প্রাপ্য অতি দুর্লভ কোনও চমকপ্রদ বস্তু।
বিচিত্র হেসে ত্রিপুরারিবাবু বললেন–ওহে কৃষ্ণদাস, ইন্দ্রনাথবাবুকে ভার দাও, তোমার ছড়ি নির্ঘাত ফেরত পাবে।
ছড়িটা ফিরিয়ে দিয়ে ইন্দ্রনাথ বললে–তা পাবেন। সেদিন ইন্টারভিউতে কারা এসেছিলেন, তার একটা লিস্ট দিলেই হবে।
লিস্ট আমার অফিসেই আছে, দেওয়া যাবে-খন। কিন্তু যা বলছিলাম। সেদিন শীলটা নিয়ে ওদের মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছে, তা জানি না। আদৌ প্রহ্লাদ বিক্রি করবে কিনা, তাও আমাকে বলেনি। তবে কতকগুলো নাম ঠিকানা ইত্যাদি নাকি লিখে রেখেছিল। কাগজগুলো খুঁজে বার করা দরকার। কেননা, অভিশপ্ত শীলমোহরটা বিদেয় না করা পর্যন্ত শান্তি নেই আমার।
শীলটা কোথায়? জানতে চাইল ইন্দ্রনাথ।
কেন, যেখানে থাকার কথা সেখানেই, মানে আয়রন সেফে। কিন্তু আর ওখানে রাখা চলবে না। ব্যাঙ্কে সরাতে হবে।
সেফে আছে তো?
না থাকার কোনও কারণ নেই বলেই সহসা উঠে দাঁড়ালেন কৃষ্ণদাসবাবু। এখনো পর্যন্ত অবশ্য আমি খুলে দেখিনি। দেখাই যাক না আছে কিনা।
বৈঠকখানা ঘরের দিকে পা বাড়ালেন কৃষ্ণদাসবাবু। আমরাও পিছু পিছু এলাম। চৌকাঠেই থমকে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক। আড়ষ্ট লাশটার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললেন–চাবিটা রয়েছে কিন্তু ওর পকেটে। তারপর বেশ অনিচ্ছাসত্ত্বেও পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ালেন সোফার সামনে। পকেট-টকেট হাতড়ে অনেকক্ষণ পরে বার করলেন একগোছা চাবি।
পেয়েছি। কিন্তু সিন্দুকের চাবি..খুব সম্ভব এইটা, বলে একটা চাবি আলাদা করে গিয়ে দাঁড়ালেন লোহার সিন্দুকের সামনে। চাবি ঢুকিয়ে ঘোরাতেই কড়াত করে খুলে গেল ভারী ডালাটা।
বাঁচা গেল! আছে শীলটা। আপনার কথায় বুকটা ছাঁত করে উঠেছিল ইন্দ্রনাথবাবু। প্যাকেটটা খোলার দরকার আছে কি? স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন কৃষ্ণদাসবাবু। ইন্দ্রনাথের হাতে তুলে দিলেন ছোট্ট একটা পুলিন্দা। ওপরে ইংরাজিতে লেখা নেবুচানেজারের শীলমোহর।
মৃদু হেসে ইন্দ্রনাথ বললে–একেবারেই নিশ্চিন্ত হওয়াই ভালো।
তা মন্দ বলেন নি।বলে সুতো কেটে গালমোহর ভেঙে পুলিন্দা খুলে ফেললেন কৃষ্ণদাসবাবু।
ভেতর থেকে বেরুল একটা ছোট্ট কার্ডবোর্ডের বাক্স। ডালা খুলে হাতের তেলোয় বাড়িয়ে দিলেন এতটুকু একটা সিলিন্ডারফিনফিনে সেলোফেন পেপারে মোড়া।
মোড়ক খুলে বস্তুটা তুলে ধরলেন কৃষ্ণদাসবাবু। সওয়া ইঞ্চি লম্বা একটা সোনার সিলিন্ডার। ব্যাস আধ ইঞ্চির মতো। এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত একটা লম্বালম্বি ছিদ্র।
সিলিন্ডারের আগাগোড়া ছোট্ট অথচ অতি সূক্ষ্ম কারুকাজ। আপাতদৃষ্টিতে তা অর্থহীন। কিন্তু বিশেষজ্ঞের চোখে এরই মধ্যে ধরা পড়েছে সারি সারি হরফে সাজানো এক সাংকেতিক লিপি– যুগযুগান্ত পূর্বে যে লিপিকারের মৃত্যু হয়েছে, ধরণীর বুক থেকে মুছে গেছে যার রাজ্যপাট।
কার্ডবোর্ডের বাক্স থেকে বেরুল ভাঁজ করা আর একটা ছোট্ট কাগজ। ভাঁজ খুলে কৃষ্ণদাসবাবু বললেন–মাপজোক ওজনগুলো এতেই লিখে রেখেছে প্রহ্লাদ। থাক, কাজে লাগবে।
চঞ্চল তীক্ষ্ণ চোখে শীলমোহরটার দিকে তাকিয়ে ছিল ইন্দ্রনাথ। এখন সন্তর্পণে দুই আঙুল দিয়ে ধরে সিলিন্ডারটা আনল চোখের ইঞ্চি কয়েক দূরে। ধীরে ধীরে দুই চোখে ফুটে উঠল বিচিত্র বিস্ময়। আমিও যেন আবিষ্ট হয়ে পড়ছিলাম সোনার চোঙার সূক্ষ্ম লিপি দেখে। কত ছোট অথচ কত অর্থবহ। একবার দেখলেই মনের মধ্যে গভীর দাগ কেটে যায়। হাজার হাজার বছর আগে সুদূর সেই পৌরাণিক যুগে মহাপরাক্রমশালী এক নৃপতির হাতে শোভা পেয়েছে এই শীল, হয়তো তিনি সর্বক্ষণ অঙ্গে ধারণও করেছেন। কত সহস্র হতভাগ্যের জীবনদীপ নিভে গেছে এই শীলাঙ্কিত আদেশের বলে, কত সহস্রের ভাগ্যের চাকা সুদিনের মুখ দেখেছে এরই নির্দেশে।
আমি যখন আবেগবিহ্বল, ইন্দ্রনাথ তখন বৈজ্ঞানিক তন্ময়তায় বিভোর। চুলচেরা বিশ্লেষণী দৃষ্টি দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে শীলটির প্রতিটি বৈশিষ্ট্য। তাতেও সন্তুষ্ট হল না। নিত্যসঙ্গী রিসার্চ কে থেকে বেরুলো ম্যাগনিফাইং গ্লাস। প্রান্তদুটো অনেকক্ষণ দেখার পর কেন্দ্রের ছিদ্রের মধ্যে দিয়েও চোখ চালাল।
অবশেষে কৃষ্ণদাসবাবুর হাতে ধরা কাগজের টুকরোটায় চোখ বুলিয়ে বললে–দেখছি একটা ডায়ামিটারেরই মাপ রয়েছে, খুব সম্ভব এক্সপার্ট ভদ্রলোক ভেবেছিলেন শীলটা অরিজিনাল, তাই দুটো মাপ নেননি। কিন্তু আমি তো তা দেখছি না। এর ডায়ামিটার এক এক জায়গায় এক এক রকম। চোঙা যেরকম পরিষ্কার গোলাকার হওয়া উচিত, এটা সেরকম নয়। দু-পাশও সমান্তরাল নয়।
বলতে বলতে রিসার্চ কেসের আরেক পকেট থেকে ইন্দ্রনাথ বার করল ক্যালিপার মাপকাঠি। সিলিন্ডারের এক প্রান্তে দুপাশে ক্যালিপারের চোয়াল দুটো ঠেকিয়ে মনে মনে হিসেব করে নিলে ভার নিয়ার স্কেলের রিডিংটা। তারপর সিলিন্ডারের ওপর দিয়ে আস্তে আস্তে সরিয়ে অপর প্রান্তে ক্যালিপার নিয়ে যেতেই শুধু চোখেই দেখা গেল, চোয়াল দুটো আর সিলিন্ডারের গা স্পর্শ করছে না, খানিকটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে।
মাপকাঠির মুখ দুটো সিলিন্ডারের পাশে ঠেকিয়ে আবার রিডিং নিল ইন্দ্রনাথ। তারপর বললে–দু-মুখে তফাত প্রায় দু-মিলিমিটারের মতো।
ত্রিপুরারিবাবু বললেন–মিউজিয়ামের এক্সপার্ট ভদ্রলোকের আপনার মতো অত হিসেবী চোখ নেই। অঙ্ক-টঙ্কও নিশ্চয় কম জানেন। তাছাড়া এত নিখুঁত মাপজোকে কিছু আসে যায় না।
আমি বলব, আসে যায়, ঝটিতি জবাব দিল ইন্দ্রনাথ। ভুল মাপজোকেই বরং কোনও প্রয়োজন নেই।
সবার দেখা হয়ে যাবার পর শীলটা আবার কাগজে মুড়ে প্যাক করে ফেললেন কৃষ্ণদাসবাবু। তারপর আয়রন সেফের যথাস্থানে রেখে সদলবলে ফিরে এলাম হলঘরে।
ত্রিপুরারিবাবু জিগ্যেস করলেন–ইন্দ্রনাথবাবু, সব তো দেখলেন। এখন বলুন তো ইন্সিওয়েন্সের প্রশ্নটার কিছু সুরাহা হল কিনা।
না।
তবে?
যতক্ষণ পুলিশী তদন্ত শেষ না হচ্ছে, ততক্ষণ এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া সমীচীন হবে না। এখন আমরা চলি। সারাদিন অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে আপনাদের।
ত ঠিক, নিরাশমুখে বললেন ত্রিপুরারিবাবু। আমি আর এগোলাম না।
ঠিক আছে, আমরা নিজেরাই যাচ্ছি। অত্যন্ত বিনীতভাবে এগিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত করে ফটকের বাইরে পা দিল ইন্দ্রনাথ।
দু-পা এগিয়ে আমি বললাম–বড় গোলমেলে কেস। কোনও সুরাহাই হল না। অবশ্য সব সময়েই যে লক্ষ্যভেদ করা যাবে, এমন কোনও কথা নেই।
ঠিক বলেছ। আমাদের প্রাথমিক কাজ হল চোখ কানের সদ্ব্যবহার করে ফ্যাক্টগুলো মনে মনে সাজিয়ে নেওয়া। অঙ্কক সিদ্ধান্ত আসবে পরে। সেই জন্যেই আবার জঙ্গলের শর্টকাট ধরতে হবে আমাদের।
কেন বলো তো! ট্রেনের এখনো অনেক দেরি।
সেইজন্যেই তো। পায়ের ছাপগুলোর ছাঁচ নিয়ে যেতে চাই। কাজে লাগতে পারে।
বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?
নিশ্চয় না।
বাধা দিলাম না। জানি তো, ইন্দ্রনাথ রুদ্রের গাণিতিক মন উদ্দেশ্য ছাড়া কখনো এনার্জি ব্যয় করে না। সুতরাং অচিরেই পৌঁছোলাম জঙ্গলের সেই কাদামাটি অঞ্চলে এবং সবচাইতে স্পষ্ট দুজোড়া পদচিহ্ন বেছে নিয়ে রিসার্চ কেস থেকে ইন্দ্রনাথ একে একে বার করল প্লাস্টার টিন, জলের বোতল, চামচে আর ছোট্ট একটা অ্যালকাথিন বাটি।
উদ্যোগপর্ব দেখে কৌতুক অনুভব করলাম। শেষ পর্যন্ত বারম্ভে লঘুক্রিয়া না হয়। অ্যামবাসাডর জুতোর চিহ্ন নিঃসন্দেহে মৃত ব্যক্তির। কিন্তু তাতে কি? আরেক জনের পায়ের ছাপের ছাঁচ তুলেও কোনও লাভ আছে কি? লোকটা এখনো অজ্ঞাত। এখানে তার হাজির থাকাটাও এমন কিছু সন্দেহজনক নয়–অন্তত এখনো পর্যন্ত।
দু-জোড়া পদচিহ্নের ওপর তরল প্লাস্টার ঢেলে দিল ইন্দ্রনাথ এবং তারপর যা করল তা রীতিমতো দুর্বোধ্য।
বাটির মধ্যে আরো খানিকটা প্লাস্টার গুলে অজ্ঞাত ব্যক্তির পায়ের ছাপের পাশেই ছড়ির দুটো গর্তে ঢেলে দিল। তারপর রিসার্চ কেস থেকে একরীল সুতো বার করে গজ দুয়েক ছিঁড়ে নিয়ে দু-হাতে টান করে এমনভাবে ধরল যাতে সুতোটা গর্তদুটোর ঠিক মাঝখান দিয়ে যায়। আস্তে আস্তে প্লাস্টার জমে যেতে সুতোও আটকে রইল তার মধ্যে।
কিন্তু এখনো গর্ত থেকে তোলার মতো শক্ত হয়নি প্লাস্টার ছাঁচ। তাই এবার পায়ের ছাপের ছাঁচগুলো তুলে নিয়ে রাখলে কেসের মধ্যে। তারপর আস্তে আস্তে তুলল ছড়ির গর্তের ছাঁচদুটো। একই ছড়ির দু-দুটো তুষারশুভ্র ফেরুল ছাঁচের দিকে অনিমেষ নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পেনসিল দিয়ে একটা ছাঁচের ওপর কি চিহ্ন দিতে লাগল ইন্দ্রনাথ।
আমি বললাম–দুটো ছাপের মধ্যে ফাঁকটুকু সুতোর মাপ থেকেই জানা যাবে, তাই না?
এত কাণ্ড অবশ্য সেজন্যে করিনি, বলল ইন্দ্রনাথ। এ থেকে বোঝা যাবে ঠিক কোনও দিকে হেঁটেছে লোকটা, ছড়ির সামনে পেছনটাও জানা যাবে।
খুবই উচ্চস্বরের মৌলিক পদ্ধতি, কোনও সন্দেহই নেই তাতে। কিন্তু লাভটা কি? এত কাণ্ড করে কিছু প্রমাণ করা গেলেও না হয় বুঝতাম।
কৌতূহল চাপতে না পেরে দু-চারটে প্রশ্ন করেছিলাম। কিন্তু চিরাচরিত পন্থা অবলম্বন করল ইন্দ্রনাথ, অর্থাৎ হঠাৎ মৌন হয়ে গেল। একবার শুধু বললে, ক্লাইম্যাক্সে না পৌঁছোনো পর্যন্ত টুকটাক সাক্ষ্য জোগাড় করতেই হবে। কিন্তু ক্লাইম্যাক্সটা কোথায়, তার জবাব পেলাম না।
হাওড়ায় পৌঁছে ইন্দ্রনাথ একটা ট্যাক্সি নিয়ে গেল লালবাজারে। বলে গেল–সন্ধেবেলা মেসে এসো। অনেক কথা আছে।
সন্ধেবেলা যেতেই দেখি চিৎপাত হয়ে শুয়ে ইন্দ্রনাথ কচি টানছে আর কড়িকাঠ নিরীক্ষণ করছে। আমাকে দেখেই বলে উঠল–এসো মৃগ, এসো। কিন্তু কোনও প্রশ্ন নয়। কেসটা এখনো ধোঁয়াটে। একদিকে ঢিল ছুঁড়েছি, দেখি লাগে কিনা। কাল সকালে হাতে কাজ আছে?
না। কিন্তু কখন?
কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে আটটায় এখানে চলে এসো। শীলমোহর রহস্য নাটিকার শেষ অঙ্কটা দেখবার সৌভাগ্য হলেও হতে পারে। নাও হতে পারে। সবটাই তোমার কপাল আর আমার হাতযশ!
.
পরের দিন সকাল। ফ্রি স্কুল স্ট্রিট।
কাটায় কাটায় সাড়ে আটটায় সময়ে ইন্দ্রনাথের মেসের সামনে হাজির হয়ে দেখেছিলাম একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। সিঁড়িতে পা দিতে না দিতেই বন্ধুবর নিজেই তরতর করে নেমে এসেছিল নীচে।
ট্যাক্সি সঙ্গে সঙ্গে ছেড়েছে এবং যথা সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে।
ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে একটা মস্ত কালো ঢাকা গাড়ির পাশে আসতেই ওদিক থেকে উঁকি দিল সহাস্য মুখ। আমাদের প্রিয় বন্ধু ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর জয়ন্ত চৌধুরী। পরনে আদ্দির পাঞ্জাবি। মুখে বর্মা চুরুট।
ইন্দ্রনাথ বললে–রিপোর্ট কী?
কাল সন্ধে থেকেই তোমার কথামতো সাদা পোশাকে দুজন গোয়েন্দা পাহারা দিচ্ছে। এখনও কিছু ঘটেনি।
ঘটবেই যে এমন কোনও কথা নেই। যুক্তির সিধে সড়কে চলেছি, যা সম্ভাব্য তা যদি সত্য হয়, তাহলে কেল্লা ফতে। নইলে ফস্কাগেরো।
এরকম কথা এর আগেও তোমার কাছে হাজার খানেক বার শুনেছি। কিন্তু..ওই যে…ওই যে…এসে গেছে তোমার লোক।
একটা দোকানের পাল্লা খুলে ফুটপাত নামল এক প্রৌঢ়। নেমে দরজায় তালা দিয়ে এগোলো ফুটপাত ধরে। লোকটা মাথায় দিব্বি লম্বা। শীর্ণ। ট্রাউজার্স ঢাকা লম্বা লম্বা বকের মতো পা। চলার ধরনটা কেমন জানি অদ্ভুত। বোধহয় শিরদাঁড়ায় কোনও ব্যারাম আছে। তাই ডান হাতের ছড়িতে ভর দিয়ে হাঁটছে আড়ষ্টভাবে মন্থর চরণে। অপর হাতে ঝুলছে একটা কাঠের চৌকোণা বাক্স।
মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ শিহরণ বয়ে গেল ছড়িটা দেখে। হাতির দাঁতের হাতল। চওড়া রূপোর পটি। শক্ত মালাক্কা বেত। ঠিক যেমনটি দেখে এসেছি কৃষ্ণদাস চক্রবর্তীর হাতে। হুবহু একই রকম।
আমরা কথা বলতে বলতে যে রকম হাঁটছিলাম হাঁটতে লাগলাম। ধীর চরণে আমাদের পেরিয়ে গেল জন মার্টিন (নিঃসন্দেহে লোকটা জন মার্টিন, তা না হলে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের দোকান থেকে বেরোবে কেন?) আমরা পেছনে এসেই ঘুরে গিয়ে অনুসরণ করলাম। ঠিক তখনি লক্ষ্য করলাম দুজন পালোয়ান গোছের শক্তসমর্থ পুরুষ দূর থেকে পিছু নিয়েছে জন মার্টিনের। দমকল স্টেশনের সামনে এসেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেল মার্টিন। সঙ্গে সঙ্গে চাপাকণ্ঠে বলল ইন্দ্রনাথ জয়ন্ত, আর দেরি নয়। গাড়ি কই?
মুখের কথা খসতে না খসতেই সেই ঢাকা মস্ত কালো গাড়িটা নিঃশব্দে ব্রেক কষলো পাশে। টপাটপ ভেতরে লাফিয়ে উঠলাম আমরা তিনজনে। মুশকো চেহারার লোকদুটোও যেন তৈরি ছিল, দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে টুক করে উঠে বসল ভেতরে। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় নিঃশব্দে পিছনে সামনে এগিয়ে গেল গাড়ি।
সামনের ট্যাক্সিটা তখন লিন্ডসে স্ট্রিট দিয়ে চলেছে সিধে চৌরঙ্গী রোডের দিকে। রেড সিগন্যাল থাকায় সামান্যক্ষণ দাঁড়াতে হল। তারপরেই ডান দিকে মোড় নিয়ে চলল এসপ্ল্যানেডের দিকে। সুরেন ব্যানার্জি রোডের কাছাকাছি গিয়ে বাঁ-দিকে মোড় দিয়ে ঢুকে পড়ল রানী রাসমণি রোডের মধ্যে। তারপর সুভাষ বোসের স্ট্যাচু প্রদক্ষিণ করে তিরবেগে এসে দাঁড়াল গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের সামনে।
জন মার্টিন ভাড়া মিটিয়ে নামবার আগেই আমরা হোটেলের হলে ঢুকে বসে পড়লাম দেওয়াল ঘেঁষা সোফাসেটে। মিনিটখানেকের মধ্যেই লাঠি ঠুকঠুক করতে করতে ঢুকল জন মার্টিন। ঢুকে থমকে দাঁড়াল। ইতস্তত দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগল যেন কারো আশায়।
হলের এককোণে একজন শ্বেতকায় ব্যক্তি বসে ম্যাগাজিন দেখছিল। লাল মুখ। কদমছাঁট সোনালি চুল। পরনে সিনথেটিক ফাইবারের ট্রাউজার্স আর বুশশার্ট। দশাসই চেহারা।
জন মার্টিনের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ম্যাগাজিন রেখে এগিয়ে এল শ্বেতকায় পুরুষ।
আর ঠিক তখনি, সোফা ছেড়ে উঠে জন মার্টিনের কাঁধে হাত রাখল জয়ন্ত।
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ঘুরে দাঁড়াল জন মার্টিন। তার চোখের তারায় নিবিড় শঙ্কা।
কর্তব্যকঠিন স্বরে জয়ন্ত বললে–মিঃ মার্টিন। আমি একজন ডিটেকটিভ অফিসার।
বলতেই, ছাইয়ের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেল জন মার্টিন। চোখে চোখ রেখে শক্ত গলায় বললে জয়ন্ত–আপনার হাতে যে ছড়িটা দেখছি, তা তো আপনার নয়।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল জন মার্টিন। বলল–ঠিক বলেছেন। কার ছড়ি, তা জানি না। আপনার জানা থাকলে ফিরিয়ে দিতে পারেন। আসলে ভুল করে ছড়ি বদলাবদলি করে ফেলেছি। দয়া করে আমারটা যদি আমাকে ফিরিয়ে দেন তো উপকৃত হব।
বলে, ছড়িটা এগিয়ে দিল জন মার্টিন। জয়ন্ত সেই ছড়িটা নিয়ে এগিয়ে দিলে ইন্দ্রনাথের হাতে। আমরা দুজনেই ততক্ষণে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম জয়ন্তর দুপাশে।
এইটাই তো? বললে জয়ন্ত।
নিরুত্তরে ছড়িটার আগাপাশতলা দ্রুত চোখ বুলিয়ে গেল ইন্দ্রনাথ। তীক্ষ্ণ সন্ধানী এক্সরে চোখ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিলে প্রতিটি বৈশিষ্ট্য। বিশেষ করে পরীক্ষা করল ফেরুলটা। পকেট থেকে ক্যালিপার গজ বার করে দু-জায়গার ব্যাসের মাপও নিলে এবং নোটবই খুলে আগে থেকেই লেখা কিছুর সঙ্গে মিলিয়ে নিলে ফলাফলটা।
অধীর হয়ে পড়েছিল জন মার্টিন। আঙুল মটকাতে মটকাতে এখন বললে–আরে মিস্টার, খামোকা দাঁড় করিয়ে রেখেছেন কেন আমাকে? এত মাপজোকের দরকার আছে কি? বললাম না আমার ছড়ি নয়।
সত্যি কথাই বলেছেন, বললে জয়ন্ত। সেই কারণেই আপনার সঙ্গে কিছু প্রাইভেট কথা আছে। কথা ছিল এই ছড়িটা সম্বন্ধেই।
এই সময়ে উদ্বিগ্নমুখে ছুটতে ছুটতে এল হোটেল ম্যানেজার। পেছন পেছন সাদা পোশাক পরা একজন গোয়েন্দা। জয়ন্ত ঘুরে দাঁড়াতেই ম্যানেজার জানালে, কথাবার্তাগুলো প্রাইভেট অফিস রুমে হলেই ভালো হয়। প্রকাশ্যে হওয়াটা হোটেলের মর্যাদার পক্ষে হানিকর।
জয়ন্ত বললে–তাই ভালো। চলুন।
আমরা পা বাড়িয়েছি, এমন সময়ে শ্বেতাকায় ভদ্রলোক নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল জন মার্টিনের সামনে। বাক্সটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললে–দিন আমাকে।
মাঝখানে এসে দাঁড়াল জয়ন্ত–এখন নয়। মিঃ মার্টিন আপনার সঙ্গে পরে কথা বলবেন।
বাক্সটা আমার। আপনি কে?
পুলিশ অফিসার। বাক্সটা যদি আপনারই হয়, তাহলে বরং আমাদের সঙ্গে এসেই নজর রাখুন।
শুনেই আমসির মতো শুকিয়ে গেল শ্বেতকায় পুরুষের মুখ। চোখে মুখে ফুটে উঠল রীতিমতো অস্বস্তি। জন মার্টিনের মুখের রক্তও আবার যেন ব্লটিং পেপার দিয়ে নিমেষে কে শুষে নিল।
ম্যানেজারের পেছন পেছন আমরা এলাম নিভৃত একটা সুসজ্জিত প্রকোষ্ঠে। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বিদায় নিল ম্যানেজার।
জয়ন্ত বলল–মিঃ জন মার্টিন, বাক্সটার মধ্যে কি আছে আমি জানতে চাই।
জবাব এল শ্বেতকায় আগন্তুকের দিক থেকে–উত্তরটা আমি দিচ্ছি। ওর মধ্যে আছে ভারতীয় মুর্তিশিল্পের একটা নিদর্শন। জিনিসটা আমার।
খুলে দেখান।
টেবিলের ওপর বাক্সটা রেখে দড়ির বাঁধনটা আস্তে আস্তে খুলতে লাগল জন মার্টিন আর কপাল থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরে পড়তে লাগল বাক্সের ওপর। আলতারাপ খুলে ডালা খুলতেই দেখা গেল একটা প্লাস্টারের ছাঁচ। দেখেই চিনতে পারলাম আমি। শ্রবণবেলাগোলার গোমতেশ্বরের নগ্নমূর্তি। ষাট ফুট লম্বা গোমতেশ্বরের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছইঞ্চি প্রতিমূর্তির মধ্যে।
খড় আর কাগজের দলা দিয়ে প্যাক করা ছিল মূর্তিটা। দলগুলো একে একে বার করে আনতে লাগল জন মার্টিন। স্পষ্ট দেখা গেল, আঙুলের ডগাগুলো কাঁপছে থর থর করে। সবশেষে মূর্তিটা সন্তর্পণে বাইরে এনে তুলে দিল জয়ন্তর হাতে।
শূন্য বাক্সটার মধ্যে সন্ধানী চোখ বুলিয়ে মূর্তিটা হাতে নিল জয়ন্ত। বলল–ভিজে ভিজে মনে হচ্ছে।
ইন্দ্রনাথ পাশে দাঁড়িয়েছিল। তন্নিষ্ঠ হয়ে তাকিয়েছিল সাদা গোমতেশ্বরের দিকে। এখন আস্তে আস্তে মূর্তিটা তুলে নিলে নিজের হাতে, তারপর হাতের তালুতে আলতো করে বসিয়ে অনুভব করতে লাগল মনে মনে। এই সময়ে আমার চোখ পড়ল জন মার্টিনের ওপর। অবাক হয়ে গেলাম তার মুখচ্ছবি দেখে। নিঃসীম আতঙ্কে বিস্ফারিত তার দুই চক্ষু। স্নায়বিক উত্তেজনায় কাঁপছে ঠোঁটের পাশের মাংসপেশী। শ্বেতকায় ভদ্রলোক কিন্তু একেবারেই নির্বিকার।
নির্বিকার ভাবটা ঘুচে গেল আচমকা। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে চেঁচিয়ে উঠল বিকট গলায়–করছেন কি, করছেন কি! পড়ে যাবে যে!
বলতে বলতেই ইন্দ্রনাথের তালু থেকে খসে পড়ল গোমতেশ্বর এবং ধেয়ে গেল পাথরে বাঁধানো মেদিনী লক্ষ্য করে। দুর্ঘটনা যে ইচ্ছাকৃত, তা ওর হাতের চেটো উপুড় করা ভঙ্গিমা দেখেই বুঝলাম।
মেঝের ওপর দমাস করে পড়েই টুকরো টুকরো হয়ে গেল গোমতেশ্বর প্রতিমূর্তি। তুষারশুভ্র অংশগুলো ছিটকে গেল দৃষ্টির আড়ালে।
আর, ধ্বংসাবশেষের মধ্যে থেকে ছোট্ট একটা হলদে রঙের ধাতুর সিলিন্ডার ধীরে ধীরে গড়িয়ে গেল মেঝের ওপর।
তৎক্ষণাৎ বাঘের মতোই সেদিকে ঝাঁপ দিল আগন্তুক এবং ততোধিক ক্ষিপ্রতায় তারও আগে হেঁট হয়ে চট করে মেঝে থেকে সিলিন্ডারটা কুড়িয়ে নিল জয়ন্ত।
বলল–ওহে ইন্দ্রনাথ, জিনিসটা কি বললো তো?
নেবুচাডনেজারের শীলমোহর।
কার সম্পত্তি?
প্রহ্লাদ চক্রবর্তীর।
কিন্তু তিনি তো!
পরশু রাতে খুন হয়েছেন!
কথাটা শেষ হতে না হতেই অস্ফুট চিৎকার করে মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়ল জন মার্টিন–বুঝলাম জ্ঞান হারিয়েছে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজা লক্ষ্য করে অবিশ্বাস্য বেগে ধেয়ে গেল শ্বেতকায় পুরুষ। কিন্তু চৌকাঠেই মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়ে গেল গাঁট্টাগোট্টা গোয়েন্দা দুজনের সঙ্গে এবং পরমুহূর্তেই ক্লিক শব্দে মণিবদ্ধে এঁটে দিল লৌহবলয়।
.
বাড়ি ফিরলাম হাঁটাপথে। হাঁটতে হাঁটতে ইন্দ্রনাথকে বললাম,–পায়ের ছাপ আর ছড়ির ডগার ছাঁচগুলো তাহলে কোনও কাজেই এল না। মিছে পণ্ডশ্রম করলে।
উঁহু। এর পরেই তো প্রয়োজন ওদের। জন মার্টিনকে ফাঁসি দেওয়ার পক্ষে শীলমোহরটা যদি যথেষ্ট প্রমাণ না হয়, তখন এই ছাঁচগুলোই হবে অকাট্য প্রমাণ।
সত্যি তাই হয়েছিল। মামলা চলার সময়ে কেটে বেরিয়ে গেল জন মার্টিন শীলমোহরটা নাকি একজন এসে দোকানে বিক্রি করে গেছিল। লোকটাকে সে চেনে না। ঠিক সেই মুহূর্তে জন মার্টিনের পা আর ছড়ির ছাঁচ হাজির করা হল আদালতে এবং অবিসম্বাদিতভাবে প্রমাণ হয়ে গেল যে হত্যার রাত্রে প্রহ্লাদ চক্রবর্তীর বাড়ির কাছেই হাজির হয়েছিল জন মার্টিন। এরপর স্বীকারোক্তি আদায় করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি।
যাই হোক, আমি জিগ্যেস করলাম–কিন্তু মার্টিনকে তুমি সন্দেহ করলে কী করে বলো তো? জঙ্গলের মধ্যে ছড়ির গর্ত দেখে কি? আমি তো সন্দেহ করার মতো অদ্ভুত কিছুই দেখতে পেলাম না।
অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য একটাই ছিল। গর্তগুলো যে ছড়ির সে ছড়ির প্রকৃত মালিক ছড়িধারী নয়।
ইন্দ্রনাথ, তুমি নিশ্চয় জ্যোতিষী নও? সামান্য কতকগুলো ছড়ির ছাপ দেখে ছড়ির আসল মালিক কে, তা কি বলা সম্ভব?
সম্ভব। আর সেইটাই হল অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য। সমস্ত ব্যাপারটাই নির্ভর করছে কীভাবে ছড়ির ফেরুল ক্ষয়েছে তার ওপর। যে ছড়ির হাতলটা সাদাসিধে গোল মত, তার ফেরুল সমান ভাবে চারদিকে ক্ষয়ে যায়। কিন্তু যে ছড়ির হাতলটা বেঁকা, তার ফেরুল ক্ষয়ে যায় হাতলটা যে দিকে বেঁকা ঠিক তার উল্টো দিকে, অর্থাৎ ছড়ির সামনের দিকে। তার কারণ, হাতল বেঁকা ছড়িকে একটা বিশেষ কায়দায় একই দিকে বাগিয়ে ধরতে হয়–ফলে একই অবস্থায় ক্রমাগত ছড়ি ধরার ফলে ফেরুলের বিশেষ একটা দিকই সমানে ক্ষইতে থাকে। কিন্তু সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টটা কি জানো? ক্ষওয়াটা কিন্তু ঠিক হাতলের উল্টো দিকে হয় না, সামান্য একদিকে ঘেঁষে। কারণ? ছড়ি নিয়ে হাঁটার সময়ে হাতলটা আমরা পেছনে দুলিয়ে হাঁটি। যখন এগিয়ে যাই, ছড়িটাকে দুলিয়ে পেছন থেকে সামনে নিয়ে আসি–আপনা হতেই ছড়িটা তখন পায়ের কাছ থেকে বাইরের দিকে সরে গিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। আসবার সময়ে আবার পা ঘেঁষেই আসে। ফলে ছড়ির ফেরুল সব সময়েই ভেতর দিকে একটু বেশি ক্ষয়। সেই কারণেই, ডান হতে ছড়ি নিয়ে যে হাঁটে, তার ফেরুল ক্ষয় সামান্য বাঁদিকে। আর বাঁহাতে ছড়ি নিয়ে যে হাঁটে, তার ফেরুল ক্ষয় সামান্য ডান দিকে। কিন্তু ডান হাতে ছড়ি নিয়ে হাঁটা যার অভ্যাস, সে ল্যাটা মানুষের ছড়ি নিয়ে হাঁটলে জমির ওপর যে ছাপ পড়বে, তাতে দেখা যাবে ফেরুটা খয়েছে ডান দিকেই বেশি–ডান দিক দিয়ে দুলিয়ে ছড়ি পেছন থেকে সামনে আনার ফলে ক্ষয়টা আরো বেশি মনে হবে। তখনই বুঝতে হবে, ছড়ির মালিকেরা ছড়ি বদলাবদলি করেছে। আমি যে ছাপ দুটো কাল তুললাম, তাতেও দেখা গেল এই বৈশিষ্ট্য, অর্থাৎ ফেরুটা ক্ষয়েছে ডান দিকেই। অতএব ছড়িটা যার সে ল্যাটা মানুষ। তা সত্ত্বেও ছড়ি নিয়ে ডান হাতে হাঁটা হয়েছে। অতএব, ছড়ির মালিক অন্য কেউ।
লোকটাকে যখন চিনিই না, তখন ছাপটার বৈশিষ্ট্যটুকু নিয়ে শুধু মাথা ঘামালাম, তার বেশি না। কিন্তু প্রহ্লাদ চক্রবর্তীর পা দেখার সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম, জঙ্গলের মধ্যে যে জুতোর ছাপ দেখেছি, সে জুতো আর ও জুতো একই। অর্থাৎ প্রহ্লাদবাবু জঙ্গলের রাস্তায় হেঁটেছিলেন। সুতরাং সঙ্গের ছড়িধারী কলোকটিকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ মাথা ঘামানোর দরকার হয়ে পড়ল। তারপরেই কৃষ্ণদাসবাবু তাঁর ছড়ি হারানোর কাহিনি বললেন। ছড়িটাও দেখালেন। কি দেখলাম জানো? দেখলাম, ছড়িটা যার সে ডান হাতেই ছড়ি ব্যবহারে অভ্যস্ত–প্রমাণ–ফেরুলের বাঁদিক ওয়া। কৃষ্ণদাসবাবু যে ছড়ি পেয়েছেন, তার মালিক ডানহাতে ছড়ি ধরায় অভ্যস্ত। আর জঙ্গলের রাস্তায় যে হেঁটেছে, তার ছড়ির মালিক বাঁ-হাতে ছড়ি ধরায় অভ্যস্ত, একেই বলে কাকতালীয়। এ থেকে কি সিদ্ধান্তে এলাম? প্রহ্লাদবাবুর অজ্ঞাত সঙ্গীটি কৃষ্ণদাসবাবুর টেম্পল চেম্বার্সের অফিসে ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলেন অর্থাৎ শীলমোহর দখল করতে যারা উন্মাদ, লোকটি তাদের অন্যতম। কথাটা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে আর একটা প্রশ্ন মাথার মধ্যে দেখা দিল–লোকটা কি শীলমোহর নিয়ে যেতে পেরেছে? আয়রনসেফ খুলে দেখলাম পেরেছে।
আয়রনসেফের শীলমোহরটা তাহলে–
নকল।
সর্বনাশ!
খুব যত্ন করে করলেও খুবই খারাপ নকল। ইলেকট্রোটাইপ। চোঙাটার সবদিকে সমতাও রাখতে পারেনি জালিয়াত হত্যাকারী। ব্যাবিলোনিয়ান এক্সপার্ট যে মাপজোক লিখে রেখেছিলেন, তার সঙ্গেও মিললো না, আর মাঝের ফুটোর দু-প্রান্তে মাটি মাখিয়ে ময়লা করলেও মাঝখানটা সদ্য ড্রিলিংয়ের জন্য চক্ চক্ করছিল।
কিন্তু জন মার্টিনই যে জালিয়াত, তা জানলে কী করে?
তখনও আমি সঠিক জানতাম না। তবে অনুমান করেছিলাম। কেননা, জন মার্টিনের কাছে আছে শীলটার গড়ানো ছাপ যা থেকে ইলেকট্রো তৈরি করা সম্ভব। আর চ্যাপ্টা ইলেকট্রো গোল করে চোঙা বানিয়ে নেওয়ার মতো কারিগরি জ্ঞান তার আছে। কিউরিও নকল করায় জুড়ি নেই তার। সব চাইতে বড় কথা, চোরাই শীলমোহর পাচার করার ক্ষমতা তার আছে–কেননা কিউরিও কেনাবেচাই তার ব্যবসা। অবশ্য সবটাই অনুমিতি আর যুক্তিসিদ্ধ সম্ভাবনা। তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম সিদ্ধান্তটা বাজিয়ে নেওয়ার জন্যে। জন মার্টিনকে দোকান ঘর থেকে ডান হাতে ছড়ি ধরে বেরিয়ে আসতে দেখেই বুঝলাম। কিস্তিমাত।
শীলমোহরটা যে গোমতেশ্বরের মূর্তির মধ্যে লুকানো ছিল, সেটাও কি অনুমান?
ইন্ডিয়া থেকে আমেরিকায় শীলমোহরের মতো ছোট্ট একটা জিনিস স্মাগল করে নিয়ে যাওয়ায় সব চাইতে নিরাপদ পন্থা হল জিনিসটাকে প্লাস্টার ছাঁচের মধ্যে গেঁথে নেওয়া। আমি এই রকমই একটা কিছু আন্দাজ করছিলাম। মূর্তি দেখে আর সন্দেহ রইল না। হাতে নিয়ে বুঝলাম তখনও ভিজে ভিজে। অর্থাৎ মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে তৈরি ছাঁচ–প্লাস্টার এখনও শুকিয়ে খটখটে হয়নি। তাই ভেঙে ফেললাম। আমার ভুল হলেও ক্ষতি ছিল না। পাঁচ দশ টাকা দিলে ওরকম ছাঁচ অনেক পাওয়া যায়।
প্রহ্লাদবাবুকে জন মার্টিন কী করে বিষ খাওয়ালো বলো তো?
সেটা এখনো সঠিক জানি না, অনুমান করতে পারি। খুব সম্ভব, সঙ্গে করেই খানিকটা সায়ানাইড সলিউশন নিয়ে গেছিল মার্টিন। সুযোগ বুঝে মিশিয়ে দেবে হুইস্কির গেলাসে। এক চুমুক খেয়েই মিনিটখানেকের মধ্যে শেষ হয়ে গেছেন প্রহ্লাদবাবু। তবে গেলাসটা ধুয়ে তাকে রেখে যাওয়াটা ভুল হয়েছে জন মার্টিনের।
একটা হেঁয়ালির কিন্তু এখনো সমাধান হয়নি। দরজায় ছিটকিনি ভেতর থেকে দেওয়া ছিল। লোকটা বেরোল কী করে?
খুব সহজে। খিলটা ভোলা ছিল। লাগানো ছিল শুধু ছিটকিনি। লক্ষ্য করেছ নিশ্চয় ছিটকিনির ফুটোটা মেঝের ওপর। অর্থাৎ ছিটকিনিটা ঘাঁটি থেকে নামিয়ে মেঝের ওপর রেখেছে জন মার্টিন। তারপর বাইরে গিয়ে দরজা টেনে বন্ধ করে দিতেই ছিটকিনি পড়ে গেছে মেঝের ফুটোয়।
নেবুচানেজারের সোনার শীলমোহরের চাঞ্চল্যকর মামলা অনেক দিন ধরে চলেছিল। শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেয়ে যায় আমেরিকান ভদ্রলোক। কিন্তু ফাঁসি হয়ে যায় জন মার্টিনের।
* প্রসাদ (অগাস্ট, ১৯৬৮) পত্রিকায় প্রকাশিত।