নেপালের পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরেছি। দারিদ্র্যটা বড় চোখে পড়ে। দেশের প্রেসিডেন্ট মহিলা। মেয়েরা ঘরের বাইরে; ইস্কুলে যাচ্ছে, চাকরি বাকরি করছে, ব্যবসা বাণিজ্য করছে। দেখে ভালো লাগে। খারাপ লাগে যখন দেখি ধর্মে আর কুসংস্কারে ছেয়ে আছে দেশ। অধিকাংশ নেপালি হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী, কিছু বৌদ্ধ ধর্মে, সামান্য ইসলামে আর ক্রিশ্চান ধর্মে। সংবিধান আর আইনের সঙ্গে ধর্ম জড়িয়ে নেই। কিন্তু সমাজে কুসংস্কারের যেরকম জাঁকালো উৎসব পালন হয়, দেখে গা শিউরে ওঠে।
গান্ধিমাই উৎসবে ক্ষমতার দেবী গান্ধিমাইকে তিন লক্ষ মোষ আর ছাগল উৎসর্গ করে মানুষ তুষ্ট করতে চায়, তুষ্ট হলে ভক্তদের সুখ শান্তি দেবে দেবী। কী ভয়ঙ্কর, কী নৃশংস সেই হত্যাযজ্ঞ। শুধু ছবি দেখলেই দিন রাত মন খারাপ থাকে। চোখের সামনে মোষদের কাতরানো দেখলে নিশ্চয়ই বুক ফেটে যায়। শুধু যে পশু বলি দেওয়া হয় নেপালে, তা নয়, মানুষও বলি দেওয়া হয়। বাবা মা’ই নিজেদের ছেলে মেয়েকে কোনো শুভ কাজে বলি দিয়ে দেবতাদের সুখী করতে চান। এই সেদিন সেতু তৈরি হলো, একটা বাচ্চা ছেলেকে বলি দিয়ে দেওয়া হলো।
৯৩ বছর আগেও সতীদাহ প্রথাকে নেপালে পবিত্র প্রথা বলে ঘোষণা করা হতো। ১৯২০ সাল অবধি ডাইনি-হত্যা প্রথাকেও পবিত্র বলে মনে করা হতো। এই ডাইনি-হত্যা এখনো চলছে। এই একবিংশ শতাব্দীতেও। এখনো চলছে দেউকি প্রথা, যে প্রথায় মেয়েদের উৎসর্গ করা হয় মন্দিরে, দেবতাদের উদ্দেশে। এখনো চলছে চৌপাড়ি প্রথা। মেয়েদের ঋতুস্রাবের সময় বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়, অস্পৃশ্য অবস্থায় দিন রাত কাটায় মেয়েরা ছোট্ট কুড়েঘরে। তাদের তখন নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় যাওয়ারও অধিকার থাকে না। তাদের অধিকার থাকে না মাছ মাংস ডিম দুধ, অথবা কোনো পুষ্টিকর খাবার। শুধু শুকনো ফল, শুকনো ভাত খেয়ে থাকতে হবে। শীতেও তাদের অধিকার নেই শীতের কম্বল ব্যবহার করার। বড়জোর ছোট কোনো চট ব্যবহার করতে পারে, ব্যস। স্নান করার অধিকার নেই। চৌপাড়ির সময় অনেক মেয়েই কিন্তু মারা যায়।
মানুষ গভীরভাবে বিশ্বাস করে যতদিন ঋতুস্রাব, ততদিন মেয়েরা অপবিত্র। বিশ্বাস করে, তখন যদি মেয়েরা দুধ খায়, যে গাভীর দুধ খাবে, সেই গাভী আর দুধ দেবে না। যে গাছ স্পর্শ করবে, সে গাছ আর ফল দেবে না। যদি কোনো বই পড়ে, দেবী সরস্বতী খুবই রাগ করবে। যদি কোনো পুরুষকে স্পর্শ করে, সেই পুরুষ অসুস্থ হয়ে পড়বে।
ঋতুস্রাবরত মেয়েরা বাড়িতে থাকলে হিন্দু দেবতারা অসন্তুষ্ট হবে, পরিবারের লোকেরা সংক্রামিত হবে, অসুস্থ হয়ে পড়বে, অসুস্থ হয়ে পড়বে বাড়ির পোষা পশুপাখিও। অসুস্থ তো হবেই, মরেও যেতে পারে। সে কারণে সবার চোখের আড়ালে তাদের চলে চেতে হয়। ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট এই প্রথাটি নিষিদ্ধ করে। কিন্তু প্রথা প্রথার মতোই চলছে। দিব্যি মানুষ পালন করছে এই প্রথা।
নেপালের মানবাধিকার কর্মীরা, যারা এইসব নারীবিরোধী প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন, তাঁরা এই সব প্রথাকে ‘কুরীতি’ বলেন। কুরীতি মানে খারাপ রীতি, খারাপ প্রথা। কুরীতি দূর করার জন্য সরকার থেকে খুব বেশি পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। সরকারই নাকি সময় সময় কুরীতি পালন করে। ঘটা করে সরকারি উদ্যোগে কুমারী প্রথা পালিত হয়। কুমারী প্রথাকে নেপালের সংস্কৃতি বলে গর্ব করা হয়। ঋতুস্রাব শুরু হয়নি এমন বাচ্চা মেয়েকে পুজো করাই কুমারী প্রথা। সরকারই যদি কুমারী প্রথায়, ডাইনি-হত্যা প্রথায় বিশ্বাস করে, তাহলে সাধারণ মানুষও পরম উৎসাহে এসবে বিশ্বাস করবে। করছেও।
কুরীতির সীমা নেই। ১২৫ রকম জাত হিমালয়ে। একটি জাততো বিশ্বাসই করে তারা জন্মেছে পতিতা হওয়ার জন্য। মা’বাবাই বাচ্চা মেয়েদের বিক্রি করে দেয় পতিতালয়ে। তারা বিশ্বাস করে এটি তাদের সংস্কৃতি এবং এই সংস্কৃতি পালন করা তাদের কর্তব্য।
পনেরোশ’ শতাব্দীতে বিহার থেকে কিছু লোক নেপালে এসে বাসা বেঁধে ছিল। ওদের কাজ ছিলো নেপালি জমিদারদের নাচ দেখিয়ে আর গান শুনিয়ে মুগ্ধ করা। জমিদার প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর ওদের টাকা পয়সা কমে যায়, তখন ওরা পতিতার ব্যবসায় নামে। সেই থেকে এখনো তাই চলছে। বংশ পরম্পরায় ওরা এখন পতিতাই হচ্ছে।
নেপালে বহুস্ত্রী প্রথা যেমন আছে, বহু স্বামী প্রথাও আছে। শিশু বিবাহ আছে, বলি প্রথা আছে। বিধবা প্রথা তো সাংঘাতিক নারী বিরোধী প্রথা। স্বামী মরে যাওয়ার পর রঙিন কাপড় পরা যাবে না, পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়া যাবে না, অলঙ্কার পরা যাবে না। বাঙ্গালিরা এই প্রথা তো এখনো পালন করে। তবে বাঙ্গালিদের না থাকলেও জলখানে প্রথা বলে একটি অদ্ভুত প্রথা আছে নেপালে। নেপালি সমাজে স্বামীকে ভগবান বলে মনে করা হয়। খুব ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে স্বামীর পা ধুয়ে, সেই পা ধোয়া জল খেতে হয় স্ত্রীদের। কাট্টো খানে প্রথা নামেও একটি প্রথা আছে। ওখানে অভিজাত বংশের কারো মৃত্যু হলে তার সৎকারের সময় কিছুটা মৃতদেহের মাংস ব্রাহ্মণকে খাওয়ানো হয়। নেপালি রাজবংশ রানা পরিবার তাই করতো। সম্ভবত এখনো করে।
কন্যাদান প্রথায় মেয়েকে ঋতুস্রাবের আগেই বিয়ে দিতে হয়। অল্প বয়সী মেয়েদের ঘরে আনা মানে স্বামীর পরিবারের মূল্য বেড়ে যাওয়া। মানুষ বিশ্বাস করে, স্বামীর পরিবারের যা কিছু পাপ ছিল এতকাল, সব মোচন হবে। এই প্রথার চর্চা করতে গিয়ে দেখা যায়, প্রচুর মেয়ের ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
মেয়েরা কামালারি প্রথারও শিকার। ধনীদের কাছে গরিবেরা টাকা পয়সা ধার নিয়ে যদি শোধ করতে না পারে, তবে তাদের ৬/৭ বছর বয়সী মেয়েকে ধনীর বাড়িতে ক্রীতদাসি হিসেবে থাকার জন্য পাঠিয়ে দেয়। ক্রীতদাসি হয়ে গেলে তাদের আর ইস্কুলে যাওয়া, ভবিষ্যৎ গড়া, শিক্ষা অর্জন, স্বনির্ভরতা কিছুই হয়ে ওঠে না।
ডাইনি-হত্যা প্রথাকে নেপালে বকশি প্রথা বলা হয়। এই প্রথায় নিরপরাধ মেয়েদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চলে। এই প্রথাকে বিলুপ্ত করার জন্য নারী সংগঠনগুলো চেষ্টা করছে। এই প্রথা পালন করলে শাস্তির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। জরিমানা ধার্য করা হয়েছে। কিন্তু কিছু করেও এই প্রথা পালন করা সম্পূর্ণ বন্ধ করা যাচ্ছে না।
তিন বছর আগে কাইলাই ডিস্ট্রিকের রাজ কুমারী রানাকে ডাইনি সন্দেহে নির্যাতন করা হয়। রাজকুমারীর এক আত্মীয় গ্রামবাসীকে বলল, রাজকুমারী মানুষ নয়, সে ডাইনি। অমনি শুরু হয়ে গেল অত্যাচার। ভোরবেলায় এক দল লোক এসে রাজকুমারীকে ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে গিয়ে উলঙ্গ করে আমগাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলে। বেদম পেটায়। ন্যাড়া করে দেয় মাথা। মল মূত্র খাওয়ায়, গায়ে ঢেলে দেয়। যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে দেয় লাঠি। সারা গ্রাম উলঙ্গ অবস্থায় ঘোরায়। সারা গ্রাম চিৎকার করতে থাকে ডাইনি ডাইনি বলে। কেউ আসেনি রাজকুমারীকে ওই অসহায় অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে। এই খবরটি নেপালের পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সরকার রাজকুমারীর চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছে। দেখা যাক, রাজকুমারী তাঁর ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের বিচার পান কি না। বিচার পেতে হলে সরকারকে পাশে দাঁড়াতে হবে।
যাবতীয় কুরীতির বিরুদ্ধে কিছু মানুষ প্রতিবাদ করছেন। নেপালের সেই গুটিকয় মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি আমি। বলেছি আমিও পাশে আছি। মানুষকে কুপ্রথা কুরীতির বিরুদ্ধে সচেতন করার জন্য পাহাড়ে পাহাড়ে যেতে হলে যাবো। জীবন যতদিন আছে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবো। জীবনতো আমাদের একটিই, এই জীবনের পরেতো আর জীবন নেই। যে জীবনটি পেয়েছি যাপন করার, সেটিকেই অর্থপূর্ণ করে যাই।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৩ মার্চ, ২০১৭