নেপথ্যে – আর্থার সি. ক্লার্ক
বেশ আশ্চর্যজনক ব্যাপার, তাই না? কত দ্রুত কত কথাই আমি ভুলে গেছি। এখন বে আমার কোনও কথাই মনে নেই। সবই ভুলে গেছি। ইচ্ছে করলেও কিছুই এখন মনে করতে পারছি না। কী যে হয়েছে না!
মনে পড়ল এবং আমি জানতামও যে, প্রায় চল্লিশ বছর ধরে আমি আমার শরীরটা ব্যবহার করেছি, যেমন অন্যেরাও করে থাকে–সেইরকম।
কিন্তু কী আশ্চর্য, মুহূর্তে সব ভাবনা মিলিয়ে গেল–স্বপ্নদৃশ্যের মতো।
আমার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ (হাত-পা) কোথায় যে এখন! তোমরা কোথায়? এতদিন আমি তোমাদেরকে আমার ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেছি। তোমরা আমাকে অনেক সাহায্যও করেছিলে। কী করছিলে তোমরা? আবছা মনে-পড়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিকে সংকেত জানালাম। কোনও প্রত্যুত্তর পেলাম না। আমার কণ্ঠস্বর শূন্যে ঘোরাফেরা করতে লাগল।
চেঁচালাম। হ্যাঁ, অন্তত চেঁচাবার চেষ্টাই করলাম। সম্ভবত ওরা আমার কণ্ঠস্বর শুনেছিল; কিন্তু আমি ওদের উত্তর শুনিনি। প্রচণ্ড নীরবতা ঘিরে রইল আমাকে যতক্ষণ না আমি শব্দ কল্পনা করতে পারলাম। একটা শব্দ আমি মনে করতে পারলাম– হ্যাঁ, কী যেন বলে তাকে, বলে ‘সঙ্গীত; এর অর্থই-বা কী?
(তা অনেক শব্দ অন্ধকার ছাড়িয়ে আমার দিকে ঝুঁকে পড়ল আমার কাছ থেকে স্বীকৃতি পাবার আশায়। ওদের চিনতে না পারায় হতাশ হয়ে অন্ধকারেই মিলিয়ে গেল।) ওহে! তা হলে তোমরা ফিরে এসেছ? কত সন্তর্পণে তোমরা আমার মনের ভেতর ঢুকে গেছ, আমি টেরও পাইনি। তোমরা একে একে ফিরছ সেটা বুঝিনি কিন্তু তোমাদের উপস্থিতির কথা বুঝেছি এখন।
মনে হয় তোমরা বন্ধুভাবাপন্ন। তোমরা যা করেছ সে জন্যে আমি তোমাদের কাছে কৃত। কিন্তু তোমরা কারা? অবশ্য জানি তোমরা মানুষ নও। যখন অভিযান স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল–তখন কোনও মানুষই আমাকে উদ্ধার করতে পারেনি।
তোমরা বুঝতেই পারছ–আমি কৌতূহলী হয়ে উঠেছি। এটা অবশ্য একটা ভালো লক্ষণ, কী বলো? আর সত্যি কথা বলতে কি সেই যন্ত্রণাটাও এখন নেই। এবং আমি আবার ভাবতে পারছি–চিন্তা করতে পারছি।
হ্যাঁ, এখন আমি তোমাদের প্রশ্নের জবাব দেবার জন্যে তৈরি। আমার পক্ষে এইটুকু করাই সম্ভব।
আমার নাম শ্রীবসু। গ্যালাকটিক সার্ভের প্রথম পাইলট। মঙ্গল গ্রহের পোর্ট লাভলেতে জন্মেছি ২১ আগস্ট ১৮৯৫ সালে। আমার স্ত্রীর নাম শ্রীমতি রিনা। আমার তিন ছেলেমেয়ে। আমি একজন লেখকও বটে। মহাকাশভ্রমণ নিয়ে ইতিমধ্যে খানকয় বইও লিখেছি “বিয়ন্ড রিগল’ বইখানা তো বেশ জনপ্রিয়।
কী ঘটেছিল? সম্ভবত আমার থেকেও তোমরা তা ভালোই জানো। গ্রহান্তরে শত্রু জাহাজের পিছু নেবার উদ্দেশে যেইমাত্র আমি স্পেসশিপ উড়িয়ে দিয়েছিলাম, তখনই সংকেত বাজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমনই ব্যাপার, ফিরে যে আসব তারও সময় ছিল না। মনে পড়ছে। ক্যাবিনটা আলোর বন্যায় মুহূর্তেই ঝলসে উঠেছিল। প্রচণ্ড উত্তাপ বইছিল। আর এইটুকুই যথেষ্ট। আকস্মিক বিস্ফোরণ আমাকে মহাশূন্যে ছিটকে ফেলে দিয়েছিল।
কিন্তু কেমন করে বাঁচা সম্ভব হল? ঠিক সময়মতো কে আমার কাছে পৌঁছেছিল?
বলো, লুকিয়ো না কিন্তু। কেন আমি হাত-পা-এর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছিনে? দোহাই, কিছু লুকোবার চেষ্টা কোরো না। কোনওকিছু জানতে এখন তার ভয় নেই। বলো। ভেবো না সত্যি কথা শুনলে (তা সে যত নিষ্ঠুরই হোক-না কেন) ঘাবড়ে যাব। একবার দেশে ফিরতে পারলে আর ভয় কী, বায়োটেকনিশিয়ানরা আমার শরীরে প্রয়োজনীয় অঙ্গপ্রতঙ্গ জুড়ে দিতে পারবে।
সহজ প্রশ্নের উত্তর কেন যে দিতে পারছ না! তোমরা কি বলতে চাও আমাকে দেখতে কেমন, তা জানো না?
নিশ্চই কিছু গোপন করে যাচ্ছ।
মস্তক?
মস্তিষ্ক…? তা হলে…?
কিছুই না… ও, না…।
দুঃখিত। আমি কি খুব সময় নিয়েছি? আমাকে একটু ভাবতে দাও। (ওহো কী মজা, মনে পড়েছে!) আমার নাম শ্রী এস. বসু। আমার জন্ম পোর্ট লাভলেতে। জন্মেছি ২১ আগস্ট, ১৮৯৫ সালে। আমার এক, না, আমার দুই ছেলেমেয়ে।
আমাকে দয়া করে বলতে দাও। আমাকে ট্রেনিং-এর সময়ে শেখানো হয়েছিল, কেমন করে বাস্তবের মুখোমুখি হতে হয়। ধীরে ধীরে তোমাদের সব কথাই সহ্য করতে পারব।
আমি সত্যি মারা যাইনি। আমি জানি, আমি কে। এমনকি আমি ভাবতে পারছি আমি কী ছিলাম।
কিছুটা আশ্চর্যজনক চাতুরীর সঙ্গে আমাকে রেকর্ড করা হয়েছিল। তোমরা আমার মন আত্মা সবই রেকর্ডে ধরে রেখেছ জাহাজ বিস্ফোরণের সময়ে। অবশ্য আমি জানি না কী করে এটা সম্ভব হল। একজন আদিম মানুষের পক্ষে যেমন বিশ্বাস করা সম্ভব ছিল না একদিন মানুষের মুখের ভাষা, তার কথা, গান, শব্দ, সবই ধরে রাখা সম্ভব রেকর্ডের মাধ্যমে…
আমার সমস্ত স্মৃতি তেমনি করে রেকর্ডে তোমরা ধরে রেখেছ। শুধু তাই-ই নয় তোমরা আমাকেও ধরে রেখেছ।
আচ্ছা, তারপর কী ঘটেছিল? দয়া করে আরেকবার বলো, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
ও, কী আশ্চর্য! তোমাদের পক্ষে তাও সম্ভব?
হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি বুঝতে পেরেছ। তোমাদের আমি বেসিক প্ল্যান আর নকশা দেব বইকী। আমার ভাবনাগুলিকে মনোযোগসহ অনুসরণ করো।
এবার আবার গোড়া থেকে শুরু করছি। মস্তক। ডিম্বাকার গড়ন। ওপর দিকটা চুলে ঢাকা। নীলরঙা ঘন চুলে।
চোখ। চোখ এক মূল্যবান সম্পদ। অন্যান্য প্রাণী চোখ দেখে থাকবে নিশ্চয়? চোখ বিপদ থেকে রক্ষা করে। আমাকে এখন কিছু দেখাতে পারো কি? তবে দেখাও।
এখন মুখ। আশ্চর্য–দাড়ি কামাবার সময়ে কতবার মুখ দেখেছি, কিন্তু কীরকম যে দেখতে ততটা গোল নয়, কিছুটা সংকুচিত।
ও, না সেরকম নয়। খানিকটা অনুমানিক আর কি…
চোখ এবং মুখের মাঝামাঝি যেন কী একটা থাকে?
যদি মনে করতে না পারি, তবে আর কখনও আমি সমর-শিক্ষার্থী হব না। দেখে নিও। ও, মনে পড়েছে। নাক। উঁচু একটা নাক। আর-একটা যেন কী, মনে পড়ছে না, ভুলে গেছি, কিছুতেই মনে পড়ছে না। কিছুটা ফাঁক থেকে গেল মাথার ব্যাপারে। আমার নয়, পোর্ট লাভলের সব থেকে চৌকস কিশোর রজতের কথা বলছি।
রজত আমার নাম নয়। আমি কিশোর নই। আমার বয়স কুড়ি বছর। স্পেস সার্ভিস পাইলট–আমার পেশা। আমি একজন লেখক।
কেন যে আমার চিন্তাভাবনাগুলি এলোমেলো হয়ে পড়েছে।
আমাকে একটু সাহায্য করো। করবে?
সেই কিম্ভুতকিমাকার রূপ? আমাকে দেখতে কিম্ভুতকিমাকার, এসব কথাই কি তোমাদের বলেছিলাম?
যদি সেরকম কিছু বলে থাকি, তবে সেসব কথা তোমরা মন থেকে মুছে ফ্যালো।
আমি বরং গোড়া থেকে শুরু করি। কী বলো, সেটাই ভালো হবে, তা-ই না কি? বেশ তবে শোনো।
মস্তক। পুরোপুরি গোলাকার…
আঃ, খুব কঠিন কাজ। মনে পড়ছে না।
অন্য কোথাও থেকে শুরু করা যাক বরং।
ও হ্যাঁ আমি জানি—
ঊরুর হাড়–হাঁটুর এবং গোড়ালির মধ্যবর্তী পায়ের সামনের হাড়ের সঙ্গে যুক্ত… হাঁটুর এবং গোড়ালির মধ্যবর্তী পায়ের সামনের হাড় ঊরুর হাড়ের সঙ্গে ঊরুর হাড়… হাঁটুর এবং গোড়ালির মধ্যবর্তী পায়ের সামনের হাড়ের সঙ্গে… ঊরুর হাড়… সব অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সব এলোমেলো হয়ে পড়ছে। খুব দেরি হয়ে গেছে। রেকর্ডে কোনও গণ্ডগোল হয়ে থাকবে হয়তো। আমার নাম… আমার নাম…
মা–-তুমি কোথায়?
কোথায় তুমি?
মা… মা… মা… মা… মা…
‘কীভাবে? এখনই বলুন আমাকে। বলেই হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর ফাঁকে সে বন্দি করে ফেলল সর্বজ্যেষ্ঠা ঠাকুরমাকে।