নেপথ্যে আততায়ী

নেপথ্যে আততায়ী

০১.

সূরজদাস নেহালিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল দিল্লিতে। ঐ সময় সেখানে দেশের বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের একটা সম্মেলন চলছিল। অনেক সাংবাদিকই সেখানে জুটেছিলেন। আমি জুটেছিলুম নেহাত খেয়ালবশে।

কারণ ‘দৈনিক সত্যসেবক’ পত্রিকা আমাকে দিল্লি পাঠিয়েছিল অন্য একটা অ্যাসাইনমেন্টে। আমার কাজ শেষ হওয়ার পর দৈবাৎ দেখা হয়ে যায় আমার এক সাংবাদিক বন্ধু সৌমেন চন্দ্রের সঙ্গে। সৌমেনই আমাকে জানায় কলকাতায় তার পরিচিত এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে সে এসেছে। এখানে একটা ব্যবসায়ীদের সম্মেলন চলেছে। তার পরিচিত ব্যবসায়ীটির কী উদ্দেশ্য তা সৌমেন জানে না। কারণ এ ধরনের সম্মেলনের খবর সাদাসিধেভাবে সব কাগজেই ছাপা হবে। এক্ষেত্রে সৌমেনকে মিঃ নেহালিয়া কী উদ্দেশ্যে নিয়ে এসেছেন সে তা এখনও বুঝতে পারছে না।

রিং রোডের ধারে দাঁড়িয়ে সৌমেনের সঙ্গে আমরা কথা বলছিলাম। পাশেই বিজ্ঞান ভবন। সেখান থেকে বেরিয়ে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক সিগারেট ধরাচ্ছিলেন। সৌমেন তাকে দেখিয়ে বলেছিল, ঐ দেখ সেই মিঃ নেহালিয়া। ভেতরে সিগারেট খেতে দেয় না, তাই আমার মতো ওঁকেও বাইরে বেরুতে হয়েছে। আয়, তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।

তার আগেই তিনি আমাদের দেখতে পেয়েছিলেন। সৌমেনকে দেখে মিষ্টি হেসে তিনি বললেন, কী আশ্চর্য! তুমি কখন বাইরে চলে এসেছ আমি লক্ষ করিনি। প্রেস কর্নারের দিকে তাকিয়ে তোমাকে দেখতে পাইনি।

তিনি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, সৌমেন বলেছিল, আপনার মতোই আমি সিগারেট খাওয়ার জন্য বাইরে এসেছিলুম। আর এসেছিলুম বলেই আমার এই বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মিঃ নেহালিয়া, এর নাম জয়ন্ত চৌধুরি। কলকাতার বিখ্যাত বাংলা পত্রিকার সাংবাদিক। আমাদের ইংরেজি পত্রিকা মেরেকেটে লাখখানেক বিক্রি হয় আর জয়ন্তদের প্রচার সংখ্যা পাঁচলাখের বেশি। জয়ন্ত, ইনি কিন্তু কলকাতারই একটা বড় বাণিজ্য সংস্থার মালিক মিঃ সূরজদাস নেহালিয়া।

মিঃ নেহালিয়া আমাকে সিগারেট অফার করতে আসছিলেন, আমি বলেছিলুম আমি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি।

মিঃ নেহালিয়া হাসতে হাসতে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, আপনি সিগারেট ছেড়েছেন কিন্তু আমি আপনাকে আর ছাড়ছি না।

এই সময় সৌমেন আমাকে মুখ টিপে হেসে চাপাস্বরে বলেছিল, মিঃ নেহালিয়া আজকাল সাংবাদিকদের বডিগার্ড করে চলাফেরা করেন। আমি আসলে ওঁর বডিগার্ডের রোলে আছি। তুইও আমার সঙ্গে জুটে যা।

মিঃ নেহালিয়া প্রায় অট্টহাসি হাসলেন। তারপর বললেন, চলে আসুন জয়ন্তবাবু। সৌমেন কেন যে বডিগার্ড কথাটা বলল আমি জানি না। তবে হ্যাঁ, ওর নিউজপেপার ওকে এখানে পাঠায়নি। আমি নিজের স্বার্থে নিয়ে এসেছি।

তখন মার্চ মাসের বিকেল। কে জানে কেন আমার মনে হল মিঃ নেহালিয়ার সৌমেনকে সঙ্গে নিয়ে আসার পিছনে কোনো গূঢ় উদ্দেশ্য আছে। তবে সেটা পরে সৌমেনের কাছেও জানা যেত কিন্তু ঐ যে বলেছি, নেহাত খেয়ালবশেই বিজ্ঞান ভবনের প্রকাণ্ড হলে ঢুকে গেলুম। সৌমেন আমাকে নিয়ে প্রেস কর্নারে গেল। সেখানে অনেক চেয়ার খালি ছিল। ওদিকে মিঃ নেহালিয়া ততক্ষণে মঞ্চে গিয়ে উঠেছিলেন।

এই ধরনের সম্মেলনে যে একঘেয়েমি থাকে তা বেশিক্ষণ বরদাস্ত করা যায় না। মিনিট পনেরো/কুড়ির মধ্যেই বুঝতে পেরেছিলুম এটা সরকারি বাণিজ্যনীতির বিরুদ্ধে দেশের বণিককুলের আসলে একটা প্রতিবাদসভা।

পাঁচটার সম্মেলন শেষ হওয়ার পর আমি সৌমেনের কাছ থেকে কেটে পড়েছিলুম। তবে আমরা কে কোথায় উঠেছি সেকথা পরস্পরকে জানাতে ভুলিনি। আমি উঠেছিলুম আমাদের পত্রিকার দিল্লি শাখার অফিসে। পরদিন সকালের ট্রেনে কলকাতা ফেরার কথা। ক্যান্টিনে নটার মধ্যেই ডিনার করে ঘরে এসে শুয়েছি, এমন সময় সৌমেনের ফোন এসেছিল। সে বলেছিল, জয়ন্ত তুই অমন করে চলে না গেলে ভালো হত। মিঃ নেহালিয়া তোকে খুঁজছিলেন। আমরা কাল বিকেলের প্লেনে কলকাতা ফিরছি। তুই মিঃ নেহালিয়ার কাঁধে চেপে কলকাতায় আরামে ফিরতে পারতিস।

আমি বলেছিলুম, কিন্তু আসল ব্যাপারটা কী বল তো সৌমেন। ঐ ভদ্রলোক তোকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন, তোদের কাগজে ব্যাপারটা বড়ো কভারেজ পাবে–নিশ্চয় এমন কিছুর জন্য নয়।

সৌমেন বলেছিল, ব্যাপারটা আমি কলকাতায় ফিরে তোকে জানাব।

কোনও ঘটনার সূত্রপাত হয়তো এভাবেই হয়। কিন্তু আমি তখন কল্পনাও করিনি অদূর ভবিষ্যতে কী গোলমেলে ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যাব। কলকাতায় ফেরার কয়েকদিন পরে সৌমেনের ফোন পেলুম। আমি তখন আমাদের পত্রিকার নিউজ রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিলুম। সৌমেন বলল, জয়ন্ত, কেটে পড়তে পারিস তো এখনই চলে আয়। আমি তোর জন্য মেট্রো সিনেমার নীচে অপেক্ষা করব।

বললুম, আমার কাজ এখন শেষ। কাজেই যেতে অসুবিধে নেই।

তখনই বেরিয়ে পড়লুম। আমার মাথায় ততক্ষণে সেই পুরনো চিন্তাটা ফিরে এসেছে। কলকাতায় ফিরেই খোঁজখবর নিয়ে জানতে পেরেছিলুম সূরজদাস নেহালিয়া একজন কোটিপতি ব্যবসায়ী। তার ব্যবসা নানা ধরনের। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে তার সংস্থার নানা শাখা আছে। দিল্লিতেও আছে, যদিও দিল্লিতে দেখা হওয়ার সময় সৌমেন একথা আমাকে জানায়নি। যাই হোক, সৌমেনকে কেন তিনি দিল্লির সম্মেলনে সঙ্গী করেছিলেন সেই কথাটা এবার তাহলে জানা যাবে।

আমার ফিয়াট গাড়িটা মেট্রোর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সৌমেন আমাকে দেখতে পেল। সে আমার গাড়িতে উঠে বলল, চল, গঙ্গার ধারে গিয়ে কোথাও বসি।

তখন বিকেল পাঁচটা। গঙ্গার ধারে গাড়ি পার্ক করে আমরা দুজনে অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি জায়গা দেখে একটা বেঞ্চে বসলুম। সৌমেন একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, তখন যদি জানতুম লোকটার মনে কী আছে তাহলে ককখনো ওর সঙ্গে যেতুম না। আমি বড্ড ঝামেলায় জড়িয়ে গেছি জয়ন্ত।

অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলুম। বললুম, ব্যাপারটা খুলে বলবি তো।

সৌমেন সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছাড়ল। তার পর কপালের এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল, সূরজদাস আমাকে বলেছিল ওর সঙ্গে দিল্লি গিয়ে এখানে-ওখানে ঘুরব। একটা কনফারেন্স অবশ্য আছে, সেখানে আমাকে প্রেস কর্নারে বসতে হবে। এটা নাকি নেহাত শো। দিল্লিতে তার ব্যবসার একটা ব্রাঞ্চ আছে। কিন্তু আসল কথাটা হল দিল্লিতে তার একটা বাংলো বাড়িও আছে। সেখানে এক ভদ্রমহিলা থাকেন।

কথা বলতে বলতে সৌমেন হঠাৎ থেমে গেল। তাকে তাড়া দিয়ে বললুম, তার পর?

সৌমেন এবার বিকৃত মুখে চাপাস্বরে বলল, ঐ মহিলার সঙ্গে সূরজদাসের একটা সম্পর্ক আছে। সেই সম্পর্কটা স্বামী-স্ত্রীর কি না বলা কঠিন। মোটকথা সূরজদাস তার দিল্লির বাড়িতে এক মহিলাকে রেখেছে। মহিলার নাম শালিনী। বয়স চল্লিশের মধ্যে। সুন্দরী বলা চলে। কিন্তু আমাকে সূরজদাস তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিল, এই আমার সেই নতুন বিজনেস পার্টনার সৌমেন চন্দ্র।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, তোকে আগে এটা বলেনি সূরজদাস?

সৌমেন বলল, না। সেইজন্যই তো আমি চমকে উঠেছিলুম। মহিলা আমাকে লক্ষ করছিলেন যেন বাঘিনী তার শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে তৈরি হচ্ছে।

বললুম, তাহলে কথাটা শুনে তোর ওপর মহিলাটি ঝাঁপিয়ে পড়লেন?

সৌমেন বলল, না। একটু পরেই মিসেস শালিনী কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, তোমাকে কলকাতার একজন স্মার্ট এবং সাহসী পার্টনার জোগাড় করে দিতে বলেছিলুম। সূরজদাস বলল, কেন, এই ইয়াং ম্যানকে দেখে তোমার স্মার্ট মনে হচ্ছে না? আর এর শরীর-স্বাস্থ্যও কেমন বলিষ্ঠ তা তো দেখতেই পাচ্ছ। রিসকের দিকটা সৌমেন সহজেই সামলাতে পারবে। তুমি এবার। ডিডটাতে সই করে ফেলল। এখানে আমাদের অফিসের কাউকে দায়িত্ব দিয়ে যাব। সে তোমাকে নিয়ে গিয়ে রেজিস্ট্রি করিয়ে নেবে। তার পর তুমি ওটা তোমার কোনো বিশ্বস্ত লোক দিয়ে আমার কাছে পাঠিয়ে দিও।

সৌমেন সিগারেটে শেষ টান দিয়ে জুতোর তলায় ঘষটে সেটা নেভাল। আমি জিজ্ঞেস করলুম, এই ডিডটা কীসের?

সৌমেন চাপাস্বরে বলল, এটাই আশ্চর্য জয়ন্ত। ঐ ডিডে মিসেস শালিনী তার সব শেয়ার আমার নামে হস্তান্তর করে দিচ্ছেন।

বললুম, তাহলে আগেই ওটা তৈরি করে নিয়ে গিয়েছিল সূরজদাস?

সৌমেন বলল, হ্যাঁ। অথচ এ বিষয়ে বিন্দুবিসর্গ আমাকে সে বলেনি। শুধু এটুকু বলেছিল,–তুমি মুখটি বুজে থাকবে।

বললুম, তার পর?

সৌমেন বলল, ডিডে প্রায় সাত লাখ টাকায় শেয়ার উল্লেখ করা ছিল। মিসেস শালিনী বলল, তাহলে তুমি চেকটা আমাকে লিখে দাও। তোমাকে আগেই বলেছিলুম অত ক্যাশ টাকা আমি সঙ্গে রাখতে পারব না। তা ছাড়া ব্যাঙ্কে জমা দিতে যাওয়াও আজকাল বড্ড রিসকি। সূরজদাস তার ফোলিও ব্যাগ থেকে একটা চেক বের করে তাকে দিল। সে বলল, আমার সবকিছু রেডি করাই আছে। এটা দিল্লি ব্যাঙ্কেরই একটা চেক। কাজেই তোমার কোনো অসুবিধা হবে না।

সৌমেন আবার চুপ করল। আমি বললুম, তার পর?

সৌমেন বলল, চেকটা দিয়ে ডিডে সই করিয়ে নিয়ে সূরজদাস মহিলাকে বলল, আজ রাত্রেই আমরা কলকাতা ফিরে যাচ্ছি। কাজেই যাবার পথে ডিডটা বরং ভানুপ্রতাপ সিংহের কাছে রেখে যাব। তুমি কথামতো কাজ করবে। এর পর বাইরে। বেরিয়ে গিয়ে আমি সূরজদাসকে চেপে ধরেছিলুম-আপনি এসব কীসের গন্ডগোলে আমাকে জড়ানোর জন্যে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন বুঝতে পারছি না। সূরজদাস বলেছিল, তোমাকে কিছু বুঝতে হবে না। ডিডটা তোমার নামে রেজিস্ট্রি হবে। তার পর ঐ ডিডের মতো অবিকল একটা ডিড আমার নামে তৈরি করে তুমি তোমার পার্টনারশিপ আমাকে ফেরত দেবে। এজন্যে তোমাকে আমি ভালো টাকাকড়ি দোব। শুধু একটাই কথা, এ বিষয়ে তুমি মুখ বুজে থাকবে। যা সব করার আমিই করব।

সৌমেন আবার একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, দিল্লিতে আমরা একটা হোটেলে ছিলুম। তার আগে অবশ্য ভানুপ্রতাপ সিংহ নামের একটা লোকের বাড়ি গিয়ে সূরজদাস ডিডটা দিয়ে এসেছিল। এবার সংক্ষেপে বাকিটা বলছি। আমাকে গতকাল সকালে নগদ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে একটা ডিড টাইপ করিয়ে নিয়েছে সূরজদাস। তারপর আমি তাকে সাত লক্ষ টাকার শেয়ার এবং পার্টনারশিপ বেচে দিচ্ছি এইরকম একটা ডিড রেজিস্ট্রি করিয়ে নিয়েছে। গতকালই তোর সঙ্গে যোগাযোগ করব ভেবেছিলুম। কিন্তু একটা জরুরি অ্যাসাইনমেন্টের জন্য আমাকে বাইরে যেতে হয়েছিল। আজ দুপুরে অফিসে ফিরেই দেখলুম আমার নামে একটা চিঠি এসেছে। এই দেখ চিঠিটা।

চিঠিটা হাতে নিয়ে শেষ দিনের আলোয় পড়ে ফেললুম। তাতে লেখা আছে :

প্রিয় সৌমেনবাবু,
 আপনি সূরজদাসের পাল্লায় পড়ে একটা কাজ করে ফেলেছেন। এবার তার পরিণাম আপনাকে ভুগতে হবে। গত পরশু মিসেস শালিনী নেহালিয়াকে দিল্লিতে তার বাংলো বাড়িতে কে বা কারা খুন করেছে। আপনি বিপদে পড়তে পারেন। তাই আপনি আমার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করুন।
ইতি—আপনার শুভার্থী।

ফোন নম্বরটা পাশেই লেখা আছে।

 চিঠিটা পড়ার পর বললুম, দিল্লিতে এক ভদ্রমহিলা খুন হয়েছেন, যিনি তোকে একটা কোম্পানির সাত লক্ষ টাকার শেয়ার বিক্রি করেছিলেন। এতে তোর কী বিপদ হবে বোঝা যাচ্ছে না। তবে ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে ঠেকছে। তুই ভদ্রলোককে ফোন করেছিস?

সৌমেন বলল, না। আমি তোর সাহায্য চাইছি।

ওর কথার ভঙ্গিতে হাসি পেল। বললুম, আমার সাহায্য মানে তো আমার ফ্রেন্ড-ফিলজফার-গাইড কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সাহায্য।

সৌমেনের মুখে ব্যাকুলতা ফুটে উঠল। সে বলল, ঠিক তাই। তোকে সোজাসুজি কর্নেল সাহেবের কথা বলতে আমার দ্বিধা ছিল। তুই ভাবতে পারিস এইভাবে আমি বন্ধুতার সুযোগ নিচ্ছি।

বললুম, সৌমেন, তুই এসব কী বলছিস?

সৌমেন বলল, কর্নেল সাহেব একজন বিখ্যাত মানুষ। সরাসরি তাঁর কাছে যাওয়ার সাহস আমার নেই। তা ছাড়া তিনি ব্যাপারটা বিশ্বাস নাও করতে পারেন। কিন্তু তুই আগাগোড়া আমার মুখে যা যা ঘটেছে সবই শুনেছিস। তাই আমার অনুরোধ তুই আমাকে কর্নেল সাহেবের কাছে নিয়ে চল।

যে সময়ের কথা বলছি তখনও দেশে সেলফোনের প্রচলন হয়নি। তা ছাড়া আমি জানতুম কর্নেলকে তার অ্যাপার্টমেন্টেই পাওয়া যাবে। কারণ আজ সকালেই তিনি ফোন করে আমার স্বাস্থ্যের খবর নিয়েছেন। অর্থাৎ গত রবিবার আমি তার ডেরায় অভ্যাস মতো যাইনি, এও একটা কারণ।

অতএব সৌমেনকে আমার গাড়িতে চাপিয়ে পার্ক স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে গেলুম। তারপর ফ্রি স্কুল স্ট্রিট পার হয়ে ইলিয়ট রোড এলাকায় কর্নেলের বাড়িতে পৌঁছলুম। লনের একপাশে গাড়ি পার্ক করে রেখে তিনতলায় উঠে গেলুম। তারপর ডোরবেলের সুইচ টিপতেই শিগগির দরজা খুলে গেল। কর্নেলের পরিচারক ষষ্ঠীচরণ চাপা হেসে বলল, দাদাবাবুকে যেন এক বচ্ছর দেখিনি। ছিলেন কোথায়?

–দিল্লিতে। বলে ছোট্ট ওয়েটিং রুমের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে কর্নেলের জাদুঘর সদৃশ বিশাল ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করলুম।

কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে যথারীতি একটা প্রকাণ্ড বই-এর পাতায় চোখ রেখেছিলেন। মুখ না তুলেই বললেন, শুনেছি তাড়া না খেলে বিড়াল কখনও গাছে চড়ে না। যাই হোক, বোসো। তোমার সঙ্গীকে কোথায় যেন দেখেছি মনে হচ্ছে। এও মনে হচ্ছে সমস্যাটা তারই।

বলে তিনি সৌমেনের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। সৌমেনকে বিব্রত দেখাচ্ছিল। কর্নেলের দৃষ্টি অনেক সময় আমার অন্তর্ভেদী মনে হয়। বললুম, আপনি কি সৌমেনকে কোথায় দেখেছেন তাই স্মরণ করছেন?

-সৌমেন, হ্যাঁ, সৌমেন চন্দ্র, তাই না? দ্য ডেইলি ট্রানজিশনের সাংবাদিক।

-সৌমেন অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ মনে পড়েছে। আপনার সঙ্গে জয়ন্ত হোটেল কন্টিনেন্টালে একটা পার্টিতে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। আমি অবশ্য বেশিক্ষণ আপনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাইনি। কিন্তু আশ্চর্য, আপনি তিন মাস আগের একটুখানি সাক্ষাৎকে মনে রেখেছেন–এ আমার সৌভাগ্য।

কর্নেল বইটা বুজিয়ে টেবিলে রেখে সহাস্যে বললেন, তোমাকে মনে রাখার একটা কারণ আছে। তোমাকে আমি আমার এক বন্ধুর ছেলের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছিলুম। তার নাম ছিল অর্ক। অর্ক মুখার্জি। কিন্তু তার চেহারার সঙ্গে তোমার খানিকটা মিল ছিল এবং আছে। তখন কথাটা জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাইনি। বাই এনি চান্স কৈলাশগড়ের কুমারবাহাদুর

কর্নেল হঠাৎ থেমে গেলেন। ষষ্ঠী ট্রেতে তিন কাপ কফি আর স্ন্যাক্স এনে রেখে গেল। সৌমেন অবাক হয়ে কর্নেলের কথা শুনছিল। এবার সে বলে উঠল, কৈলাশগড়ের কুমারবাহাদুর সুভদ্রনারায়ণ রায়চৌধুরি আমার দাদু। আমার বাবার সঙ্গে ওঁর বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছিল। অসবর্ণ বিয়ে।

কর্নেল আবার হেসে উঠলেন, হ্যাঁ। তোমরা সুবর্ণবণিক আর ওরা ব্রাহ্মণ। যাকগে, কফি খাও। কফি স্নায়ু চাঙ্গা করে।

কফি খেতে খেতে আমি সংক্ষেপে সৌমেনের কাহিনি কর্নেলকে শুনিয়ে দিলুম। তারপর সেই চিঠিটাও তার হাতে দিলুম। চিঠিটা পড়ে দেখার পর কর্নেল বললেন, সৌমেন, তুমি এই টেলিফোন থেকে ভদ্রলোককে রিং করো। আর আমি আমার ঘরে গিয়ে এই লাইনের যে এক্সটেনশন আছে সেখান থেকে ফোনে আড়ি পাতছি।

কথাটা বলে তিনি ব্যস্তভাবে উঠে তার বেডরুমে গেলেন। আমি সৌমেনকে বললাম, কুইক।

সৌমেন নার্ভাস মুখে রিসিভার তুলে ডায়াল করতে থাকল।

.

০২.

মার্চের সেই সন্ধ্যাটা ছিল টানটান উত্তেজনায় পূর্ণ। সৌমেনের টেলিফোনের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারছিলুম ভদ্রলোক তাকে পার্ক স্ট্রিটে মুনলাইট বারে দেখা করতে বলছেন। সময়কাল রবিবার সন্ধ্যা ছ’টা। মাত্র মিনিট পাঁচেক দুজনের মধ্যে কথা হল, তারপর রিসিভার রেখে সৌমেন আমার দিকে তাকাল। সে মৃদুস্বরে বলল, ভদ্রলোকের পরনে থাকবে ঘন নীল শার্ট এবং ছাইরঙা প্যান্ট। তার হাতে একটা ফোলিও ব্যাগ থাকবে। আমি মুনলাইট বারে ঢুকলে তিনি আমাকে ডেকে নেবেন। আমার আশ্চর্য লাগছে জয়ন্ত, ভদ্রলোক আমার পারিবারিক পরিচয়ও জানেন।

এইসময় কর্নেল এসে গেলেন। ইজিচেয়ারে বসে তিনি বললেন, ভদ্রলোক যিনিই হোন, খুব স্মার্ট এবং ধূর্ত। জয়ন্তের কাছে যা সব শুনেছি তাতে আমার ধারণা এই লোকটি সূরজদাস নেহালিয়া কোম্পানিরই কোনো পার্টনার অথবা এক্সিকিউটিভ। যাই হোক, মুনলাইট বারে আমি মাঝে মাঝে বিয়ার খেতে যাই। জয়ন্তও আমার সঙ্গে অনেক সময় গেছে। ওয়েটাররা সবাই আমার চেনা, বারের মালিকও অচেনা নয়। কাজেই তুমি নিশ্চিন্তে কাল সন্ধ্যা ছ’টায় সেখানে যাবে। কিন্তু সাবধান, আমাদের দিকে ভুলেও তাকাবে না।

আমি হেসে ফেললুম–কর্নেল, মানুষের চোখের দৃষ্টি সবকিছুর উপর পড়তে পারে। তাতে তার চেনা-অচেনা কিছু প্রমাণ হয় না। কাজেই আপনি বেচারাকে ভড়কে দেবেন না। সৌমেনও কম স্মার্ট নয়।

সৌমেন বলল, কর্নেল সাহেবকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।

–স্বচ্ছন্দে। আমি চাই কোনো কথা যেন আমার কাছে গোপন না থাকে।

সৌমেন একটু চুপ করে থেকে বলল, দিল্লি থেকে ফিরে সূরজদাসের ডিডে সই করার পর আমি আর তার ছায়া মাড়াইনি।

কর্নেল বললেন, তাহলে সে রেজিস্টারের অফিসে সৌমেন চন্দ্র সাজিয়ে অন্য কোনো যুবককে নিয়ে গিয়েছিল। তো এই ভদ্রলোকের চিঠি পাওয়ার পর তুমি কি সূরজদাসের সঙ্গে আর যোগাযোগ করেছিলে?

সৌমেন বলল, করব ভেবেছিলাম। কারণ দিল্লিতে সেই ভদ্রমহিলা হঠাৎ খুন হয়ে গেছেন। এ ব্যাপারেই তাকে চার্জ করার ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু আমি আগে জয়ন্তের মাধ্যমে আপনার সাহায্য পাব এটা ভেবে রেখেছিলুম। তাই উত্তেজনা দমন করেছিলুম।

কর্নেল বললেন, তুমি কোনও চিন্তা কোরো না। অন্তত কাল সন্ধ্যায় ঐ অজ্ঞাতপরিচয় লোকটির সঙ্গে তোমার কথাবার্তা হওয়া পর্যন্ত তুমি নিরাপদ। তুমি থাকো কোথায়?

সৌমেন বলল, নিউ আলিপুরে আমি একটা ফ্ল্যাট কিনেছি। সেখানে আমার মায়ের সঙ্গে থাকি।

–তার মানে বিয়ে করোনি।

 সৌমেন হাসবার চেষ্টা করে বলল, না। আমি জয়ন্তের মতো পণ না করলেও আপাতত ওসব দিকে পা বাড়াচ্ছি না।

এই সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল সাড়া দিলেন। তারপর চাপা গলায় কারুর সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বলার পর রিসিভার নামিয়ে রাখলেন।

কর্নেলকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল।

জিজ্ঞেস করলুম, কোনো প্রব্লেম মনে হচ্ছে কর্নেল?

কর্নেল এতক্ষণে চুরুট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, প্রব্লেম কি না জানি না, একটা কো-ইনসিডেন্স। কুমারবাহাদুর সুভদ্রনারায়ণ ফোন করেছিলেন। তাঁর নাতি অর্কের গাড়ি লক্ষ করে আজ সন্ধ্যায় কে বা কারা গুলি ছুঁড়েছে। পেছন দিকের কাঁচ ক্র্যাক করেছে। এছাড়া কোনও ক্ষতি হয়নি।

সৌমেন চমকে উঠে বলল, অর্ককে অ্যাটাক করেছিল কর্নেল? আমার মনে হচ্ছে আততায়ীরা ভুল করে তাকে আমি অর্থাৎ সৌমেন ভাবেনি তো?

কর্নেল বললেন, আমার তা মনে হয় না। কারণটা তোমারও জানা উচিত যেহেতু তুমি অর্ককে চেনো। তার জন্য কুমারবাহাদুরকে প্রায়ই অপদস্থ হতে হয়। সমস্যা হয়েছে ওর বাবাও বেঁচে নেই। সে আর তার বিধবা মা অর্থাৎ কুমারবাহাদুরের ছোট মেয়ে, তাঁর কাছেই থাকে। ঠিক আছে, জয়ন্ত, তুমি কি তোমার বন্ধুকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবে?

সৌমেন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, না, আমি নীচে গিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে নেব।

কর্নেল বললেন, তোমার একটা গাড়ি থাকা উচিত ছিল।

সৌমেন বলল, অফিস থেকে গাড়ি পেতে আমার অসুবিধা নেই। কিন্তু আমি পায়ে হেঁটে বা ট্রামে-বাসে যাতায়াত করতে ভালোবাসি।

আমি সৌমেনকে এগিয়ে দিতে গেলুম। নীচে গিয়ে সৌমেন বলল, ঠিক আছে। তুই শোবার আগে আমাকে একটা রিং করিস।

সৌমেনকে বিদায় দিয়ে কর্নেলের কাছে ফিরে এলুম। কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। সোফায় বসে আমি বললুম, আমার এই একটা ব্যাপার বড়ো আশ্চর্য লাগে কর্নেল। রাজ্যের যত রাজাগজা, জমিদার আর তাদের বংশধর যতসব কুমারবাহাদুরকে আপনি চেনেন। নিছক চেনা নয়, তাঁরা আপনার বন্ধু।

কর্নেল চোখ বন্ধ রেখেই বললেন, আমি ছিলুম ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে। আর ঐসব রাজা-জমিদার বা তাদের বংশধররা ছিলেন ব্রিটিশের পরম অনুগত। ব্যতিক্রম হয়তো ছিল, কিন্তু সৌমেন এবং অর্কের দাদু সুভদ্রনারায়ণ রায়চৌধুরি ছিলেন বেজায় রকমের ব্রিটিশ ভক্ত। তার ফলে যাঁরা স্বদেশি আন্দোলন করতেন তাঁদের কাছে তিনি ছিলেন পরম শত্রু। কিন্তু মজার ব্যাপারটা এবার বলি। তার নিজের ছেলে সূর্যনারায়ণ স্বদেশিদের হাতে হাত মিলিয়ে শেষ অবধি ত্যাজ্যপুত্র হন। সেটা ১৯৪২ সালের কথা। দেশে তখন অগাস্ট আন্দোলন চলছিল। সূর্যনারায়ণ পুলিশের গুলিতে মারা যান। আমার ধারণা সুভদ্রনারায়ণ মুখে যাই বলুন মনের গভীরে খুব আঘাত পেয়েছিলেন। সেই থেকে তিনি আমার মতো প্রকৃতির দিকে মন দিয়েছিলেন। তার বাড়িতে যে লাইব্রেরি আছে তা আমাদের মতো অনেকেরই পক্ষে ঈর্ষার কারণ। উদ্ভিদ আর প্রাণিজগৎ সম্পর্কে দুপ্রাপ্য বইয়ের অমন সংগ্রহ আর কোথাও দেখিনি।

বললুম, তাহলে বোঝা গেল আপনার সঙ্গে সৌমেনের দাদুর সম্পর্কের সূত্রটা কী।

কর্নেল হঠাৎ ষষ্ঠী বলে হাঁক দিলেন। বুঝলুম আর এক রাউন্ড কফি আসছে। কর্নেল কি সৌমেনের দাদুর টেলিফোন পেয়েই বড্ড বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন? আমি জানি মনের ভেতর উত্তেজনা থাকলে কর্নেল বারবার কফি পান করেন।

আমার অবশ্য আর একবার কফি খেতে ইচ্ছে করছিল। কারণ আমিও মনে মনে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম। কারণ যে ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে গেছি তাতে সত্যি একটা আকস্মিকতা কিংবা কো-ইনসিডেন্স জড়িয়ে আছে। আমি কস্মিনকালে কল্পনাও করিনি যে সৌমেন চন্দ্রের দাদু একজন রাজা-জমিদারের বংশধর। আমার সামনে একটা পটচিত্র খুলে গেল। তাতে দেখলুম সৌমেন এবং অর্ক পরস্পর মাসতুতো ভাই এবং তাদের চেহারাতেও নাকি কিছুটা সাদৃশ্য আছে।

আজ সন্ধ্যায় অর্কের গাড়ি লক্ষ্য করে কে বা কারা গুলি ছুঁড়েছে এবং সৌমেনের সন্দেহ আততায়ীরা তাকে সৌমেন বলে ভুল করেছিল। যদিও কর্নেলের মতে অর্কের স্বভাবচরিত্রও নাকি ভালো নয় এবং তার শত্রু থাকা সম্ভব। এদিকে আগামিকাল সন্ধ্যা ছ’টায় পার্ক স্ট্রিটের মুনলাইট বারে সৌমেন এক অজ্ঞাতপরিচয় লোকের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। মনে মনে আমি শিউরে উঠলুম। কোনো অঘটন ঘটবে না তো!

ততক্ষণে ষষ্ঠী কফি রেখে গেছে। কর্নেল বললেন, জয়ন্ত, তোমাকে খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। কাজেই শিগগির কফিতে চুমুক দাও।

কফির কাপ তুলে নিয়ে বললুম, হা, বস। আমি একটা কথা ভাবছিলুম। কাল সন্ধ্যায় মুনলাইট বারে ঢোকার আগে সৌমেনের কোনও বিপদের আশঙ্কা নেই। তো?

কর্নেল বললেন, তোমার এই কেসের ব্যাপারে এখনও আমি প্রায় অন্ধ। যতক্ষণ না সূরজদাস নেহালিয়ার সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছি ততক্ষণ আমাকে অন্ধকারে অনুমান করে পা বাড়াতে হবে। তবে তোমার আশঙ্কা আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না। বরং তুমি একটা কাজ করতে পারো। আগামিকাল সৌমেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওকে তোমার গাড়িতে চাপিয়ে মুনলাইট বারে পৌঁছে দিতে পারো। তোমার একটা লাইসেন্সড ফায়ার আর্মস আছে। তুমি ওকে গার্ড দিয়ে নিয়ে আসবে।

বললুম, আমিও ঠিক এই কথাটা ভাবছিলুম। বাই দ্য বাই, আমাদের হালদারমশায়ের খবর কী?

কর্নেল মৃদু হেসে বললেন, হালদারমশাই কাল সকালে আমার কাছে আসবেন। খুলে কিছু বলেননি তবে এটুকু টের পেয়েছি উনি কোনো কেস হাতে পেয়েছেন।

হাসতে হাসতে বললুম, তাহলে আমিও কাল সকালে আপনার ডেরায় উপস্থিত থাকব।

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, তোমাকে আমি এখন থেকেই আটকে রাখবো। অর্থাৎ তোমার সল্টলেকে ফেরার দরকার নেই। তোমার কাজের ছেলেটিকে রিং করে জানিয়ে দাও।

আমি অবশ্য মনে মনে তাই চাইছিলুম। কর্নেল-কাহিনির পাঠকরা জানেন কর্নেলের এই অ্যাপার্টমেন্টে আমার জন্য একটা ঘর বরাদ্দ আছে। কয়েক প্রস্থ পোশাকও আছে। তাছাড়া টুথব্রাশ, পেস্ট থেকে শুরু করে দাড়ি কাটার সরঞ্জামও। রাখা আছে। কারণ আমাকে মাঝে মাঝে এই ধরনের ঘটনা ঘটলে কর্নেলের সারাক্ষণের সঙ্গী হতে হয়। আমার গাড়িটা রাখারও অসুবিধে নেই। একসময় কর্নেলের একটা ল্যান্ডরোভার গাড়ি ছিল। গাড়িটা যখন-তখন বিগড়ে যেত, তাই তিনি সেটার হাত থেকে মুক্তি নিয়েছিলেন। কিন্তু নীচের গ্যারাজ ঘরটা ছাড়েননি। কারণ আমার গাড়ি রাখার দরকার হয় এবং আমি রাত্রিবাস করলে সেই গ্যারাজে আমার গাড়িটা রেখে দিই।

ষষ্ঠী কফির কাপ দিতে এলে কর্নেল বললেন, আজ রাতে তোর দাদাবাবুর নেমন্তন্ন।

ষষ্ঠীচরণ একগাল হেসে বলল, রাত আটটা বাজতে চলল, আর দাদাবাবু এখনও বসে আছেন। আমি কি বুঝিনি কিছু?

কর্নেল চোখ কটমট করে বললেন, কী বুঝেছিস?

-দাদাবাবু এখন আপনার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করবেন।

আমি বললুম, বাঃ। তুমি তো বেশ গোয়েন্দাগিরি শিখে ফেলেছ ষষ্ঠী।

ষষ্ঠীচরণ ফিক করে হেসে বলল, তা খানিকটা শিখেছি বৈকি দাদাবাবু। কাল সকালে টিকটিকিবাবু আসবেন। কাজেই বাবামশাই বড়ো একখানা ক্যাস হাতে পেয়েছেন তা কি বুঝিনি?

কর্নেল তাঁর বিখ্যাত অট্টহাসি হাসলেন। আমি বললুম, আপনার ষষ্ঠীচরণ প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাইকে টিকটিকি বলে সেটা ঠিকই, কিন্তু তার মতো পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় কেসকে ক্যাস বলতে শিখেছে শুনে আবার উদ্বিগ্ন হচ্ছি। আপনার ষষ্ঠী গোপনে গোয়েন্দাগিরিতে যেন আবার না নেমে পড়ে।

কর্নেল আবার ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে কফিতে চুমুক দিতে থাকলেন। কফি শেষ করার পর বললুম, হালদারমশায়ের ক্যাসটা কি তার আভাস পাননি?

কর্নেল কিছু বলার আগেই টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল বললেন, ফোনটা ধরো জয়ন্ত।

রিসিভার তুলে সাড়া দিতেই হালদারমশায়ের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল-কর্নেল স্যার, এদিকে এক সাংঘাতিক কাণ্ড বাধছে। আমার ক্লায়েন্ট ভদ্রমহিলা আমাকে ফোন করছিলেন আইজ সন্ধ্যা সাড়ে ছটা-সাতটার সময় ওনার পোলা ক্লাবে যাইতাছিল, সেই সময় সাউদার্ন অ্যাভেনুতে কোন হালায় গুলি করসে। পিছনের কাঁচ চিড় খাইসে। ওনার পোলা তখনই গাড়ির স্পিড বাড়াইয়া অলিগলি ঘুইরা বাড়ি ফিরসে।

বললুম, তারপর কী হল হালদারমশাই?

অমনই গোয়েন্দাপ্রবরের কণ্ঠস্বরে চমক খেল-কেডা? আপনি কর্নেল স্যার নন?

রসিকতা করে গলার স্বর বদলে বললুম, না। আমি লালবাজারের লোক।

ততক্ষণে কর্নেল কফির পেয়ালা রেখে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। এবার আমার হাত থেকে রিসিভারটা প্রায় কেড়ে নিয়ে বললেন, হালদারমশাই, আপনি পঁয়ত্রিশ বছর পুলিশে চাকরি করেছেন বলে গর্ব করেন। বুঝতে পারলেন না কে টেলিফোন ধরেছিল…হ্যাঁ, আপনি উত্তেজিত ছিলেন বলে জয়ন্তের গলার স্বর চিনতে পারেননি। যাই হোক, বলুন কী ব্যাপার।

এরপর প্রায় দশমিনিট ধরে কর্নেল ক্রমাগত হ্যাঁ, হুঁ দিয়ে গেলেন। তারপর বললেন, এই খবরটা আমি আগেই পেয়ে গেছি। আপনার ক্লায়েন্ট কে সেটা অবশ্যি এতক্ষণে বুঝতে পারলুম…হ্যাঁ, এখনই চলে আসুন। জয়ন্তকে আমি বেঁধে রেখেছি। আগে কফি খেয়ে নার্ভ চাঙ্গা করে নেবেন। তারপর ওকে আপনি থার্ড ডিগ্রিতে চড়াবেন।

রিসিভার রেখে কর্নেল গম্ভীর হয়ে গেলেন।

বললুম, আমার অবিশ্যি সন্দেহ হচ্ছিল এটা অর্কেরই কেস। কিন্তু সিওর হতে পারিনি।

কর্নেল বললেন, সারা জীবন দেখে আসছি, কোনো একটি ঘটনার সঙ্গে পরপর অনেকগুলো ঘটনা জড়িয়ে থাকে। আমায় মনে হচ্ছে জয়ন্ত, তুমি একটা জটিল রহস্যের একটুখানি সুত্র তোমার বন্ধু সৌমেনের কাছে পেয়েছ। আড়ালে অনেক দুর্ভেদ্য রহস্যজাল ছড়িয়ে আছে এখান থেকে দিল্লি অবধি।

চমকে উঠে বললুম, বলেন কী।

কর্নেল আমার কথার জবাব দিলেন না। পোড়া চুরুটটা অ্যাশট্রেতে ফেলে দিয়ে আর একটা চুরুট বের করে ধরালেন। তার পর আগের মতো হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। চুরুটের নীল ধোঁয়া তার প্রশস্ত টাকের ওপর উঠে ঘুরতে ঘুরতে মিলিয়ে যাচ্ছিল।

হালদারমশাই এলেন প্রায় আধঘন্টা পরে। ঘরে ঢুকে সটান এগিয়ে ধপাস করে সোফায় বসলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, কর্নেল স্যার না কইলেও আমি ট্যার পাইছিলাম আপনি ফোন ধরছেন।

বললুম, আপনি যাই বলুন হালদারমশাই, আপনার এই কথাটা মানতে পারছি না।

গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, আমি আপনারে চার্জ করতাম, কিন্তু তখনই কর্নেল স্যারের সাড়া পাইলাম।

কর্নেল বললেন, ওসব কথা থাক। আপনার ক্লায়েন্টের সঙ্গে কী দেখা করে এসেছেন?

হালদারমশাই বললেন, না। তবে ফোনে ওনারে কইর‍্যা দিচ্ছি পোলারে য্যান বাহার হইতে না দেন। ম্যাডাম কইলেন, তাঁর পোলার দাদুরে অর্থাৎ ম্যাডাম তার বাবার লগে কথা বলছেন। ওনার বাবা যে একজন কুমারবাহাদুর আমি জানতাম না। কারণ ম্যাডাম গণেশ অ্যাভিনিউয়ে আমার ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিসে যাইয়া কনট্যাক্ট করছিলেন।

এই সময় ষষ্ঠীচরণ হালদারমশায়ের জন্য স্পেশাল কফি এনে রেখে গেল। হারদারমশাই কফিপানে মন দিলেন।

গণেশ অ্যাভিনিউয়ে একটা তিনতলা বাড়ির ছাদের উপর অ্যাসবেসটাস ছাউনি দেওয়া একখানি ঘরে হালদারমশায়ের অফিস। নীচে থেকেই সাইনবোর্ডটা চোখে। পড়ে। তাতে লেখা আছে–হালদার প্রাইভেট ডিকেটটিভ এজেন্সি। তার তলায় লেখা আছে–এক্স পুলিশ ইনস্পেকটার মিঃ কে কে হালদার। তিনি মাঝে মাঝে। আমাদের বহুল প্রচারিত দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা এবং কদাচিৎ কোনো ইংরেজি দৈনিকে তাঁর ডিটেকটিভ এজেন্সির বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকেন।

তার কফি পান তখনও শেষ হয়নি এমন সময় আবার টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। তার পর বললেন, বলুন কুমারবাহাদুর…হ্যাঁ, আপনার উত্তেজনার কারণ আছে….. গায়ত্রী আপনার সঙ্গে কথা না বলেই প্রাইভেট ডিটেকটিভের শরণাপন্ন হয়েছে। বেশ তো, এটা দোষের কিছু নয়। আপনার শরীরের অবস্থা ভেবেই আপনাকে সে বিব্রত করতে চায়নি। তবে আপনি শুনলে খুশি হবেন গায়ত্রী যে প্রাইভেট ডিটেকটিভকে হায়ার করেছেন তিনি আমারই এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী। কাজেই আপনার চিন্তা নেই…হা, অর্কের ব্যাপারে যেমন আপনার তেমনি তার মায়ের উদ্বেগের কারণ আছে। যাই হোক, ব্যাপারটা এখন আমার হাতে এসে পড়েছে, আপাতত সেকথা খুলে বলতে চাইছি না। কারণ টেলিফোনে বলার মতো কথা নয়। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি যথাসময়ে। আপনার কাছে যাব।

এই সময় ডোরবেল বাজল। কর্নেল যথারীতি হাঁকলেন, ষষ্ঠী। একটু পরে ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের নরেশ ধর। ঘরে ঢুকেই তিনি মুচকি হেসে বললেন, বাঃ, একেবারে ত্র্যহস্পর্শ যোগ।

.

০৩.

বরাবর দেখে আসছি কর্নেল কোনো রহস্যের দিকে পা বাড়ালেই কোনো অজ্ঞাত সুত্রে লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের এই বিচক্ষণ এসে আই নরেশবাবুর টনক নড়ে। কিন্তু এক্ষেত্রে ঘটনা আপাতত দুটো। একটা ঘটনা হল–দিল্লিতে এক মহিলার হত্যাকাণ্ড এবং দ্বিতীয়টি এই কলকাতায় আজ সন্ধ্যায় জনৈক কুমারবাহাদুরের নাতির ওপর আততায়ীদের হামলা। নরেশবাবু নিশ্চয় দিল্লির ঘটনার সূত্রে এখানে আসেননি, এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েই বললুম, নরেশবাবু কি কোনো অভিজাত পরিবারের বখাটে ছেলের উপর হামলার কেস হাতে নিয়েছেন?

লক্ষ করছিলুম কর্নেল আমার দিকে চোখ কটমটিয়ে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু মুখের কথা বেরিয়ে গেছে, কী আর করা যাবে।

আমার কথা শুনে নরেশবাবু একটু হেসে বললেন, তা হলে বোঝা গেল এরকম একটা কেস মিঃ হালদারও হাতে নিয়েছেন।

হালদারমশাই এক টিপ নস্যি নিয়ে বললেন, তা লইছি নরেশবাবু। আপনি ঠিকই কইছেন। কিন্তু আপনিও কি সেই কেসের ব্যাপারেই কর্নেল স্যারের লগে কথা কইতে আইছেন?

ষষ্ঠীচরণ আবার এক কাপ কফি দিয়ে গেল। কর্নেল বললেন, নরেশবাবু কফি খান। তার পর কথা হবে।

নরেশবাবু কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, আমি কিন্তু দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা থেকে খবর নিয়ে জয়ন্তবাবুর সল্টলেকের ফ্ল্যাটে যাচ্ছিলুম। হঠাৎ খেয়াল হল জয়ন্তবাবুকে কর্নেল সাহেবের অ্যাপার্টমেন্টে পেতেও পারি।

চমকে উঠে বললুম, আমার কাছে যাচ্ছিলেন, কী ব্যাপার?

নরেশবাবু মুখে তেমনি হাসি রেখে বললেন, আমার ডিপার্টমেন্ট থেকে একজনের দিকে লক্ষ্য রাখা হয়েছে। তার গতিবিধির ব্যাপারে ফলো করে আমাদের লোকেরা আজ সন্ধ্যায় গঙ্গার ধারে জয়ন্তবাবুর সঙ্গে তাকে বহুক্ষণ ধরে কথা বলতে দেখেছে। তারপর আর তারা জয়ন্তবাবুর সঙ্গীকে ফলো করার প্রয়োজন বোধ করেনি। আমাকে খবরটা পৌঁছে দিয়েছে।

আমি হতবাক হয়ে শুনছিলুম। বললুম, কী সর্বনাশ! আমার বন্ধু সৌমেন চন্দ্রের পিছনে–

নরেশবাবু আমার কথার উপর বললেন, হ্যাঁ। কথাটা আমি কফি শেষ করে বলছি।

ঘরে একটা অস্বস্তিকর স্তব্ধতা। লক্ষ করছিলুম কর্নেল চোখ বুজে ধ্যানস্থ। দাঁতে কামড়ানো চুরুট থেকে নীল ধোঁয়া ঘুরপাক খেতে খেতে মিলিয়ে যাচ্ছে। এদিকে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশায়ের গোঁফের দুই ডগা তিরতির করে কাঁপছে এবং তিনি গুলি গুলি চোখে নরেশবাবুর দিকে তাকিয়ে আছেন। এটা গোয়েন্দাপ্রবরের উত্তেজনার চিরাচরিত লক্ষণ।

আমি ভেবে পাচ্ছিলুম না সৌমেনের পিছনে লালবাজারের গোয়েন্দা লেগে থাকার কারণ কী হতে পারে। একথা ঠিক দিল্লিতে যে মহিলা খুন হয়েছেন তার কাছ থেকে একটা কোম্পানির সাত লক্ষ টাকার শেয়ার সৌমেনের নামে হস্তান্তরিত হয়েছে। এতে সৌমেনের দোষটা কোথায়! আমি ভাবছিলুম পুরো ঘটনাটা নরেশবাবুকে আমার জানানো উচিত।

নরেশবাবু বেশ সময় নিয়ে কফি শেষ করলেন। তার পর বললেন, কর্নেল সাহেব, আগে আপনাকে জানানো দরকার আপনার স্নেহভাজন জয়ন্তবাবুর বিরুদ্ধে কোনো কেস আমাদের হাতে নেই।

কর্নেল সোজা হয়ে বসে একটু হেসে বললেন, জানি। কিন্তু জয়ন্তের যে বন্ধুর গতিবিধির দিকে আপনারা নজর রেখেছেন তার দাদু এদেশের অভিজাত সমাজের একজন খ্যাতনামা লোক।

নরেশবাবু একটু নড়ে বসে বললেন, বলেন কী। সৌমেন চন্দ্র একজন সাংবাদিক। আমরা জেনেছি সে থাকে নিউ আলিপুরের পশ এলাকায় একটা ফ্ল্যাটে। কিন্তু কেসটা আমার হাতে আসার পর একটু সন্দেহ হয়েছিল একটা সাধারণ ইংরেজি দৈনিকের সাংবাদিক ঐ রকম বিলাসবহুল এলাকার ফ্ল্যাটে থাকে। ফ্ল্যাটখানা নাকি সে খুব সম্প্রতি কিনেছে।

কর্নেল বললেন, জয়ন্ত, আমার মনে হচ্ছে নরেশবাবুর কেসের সঙ্গে দিল্লির কোনো অভিজাত মহিলার হত্যাকাণ্ডের সম্পর্ক আছে।

নরেশবাবু হেসে উঠলেন, না। আপনার সঙ্গে আমরা কোনোদিনই পেরে উঠব না। সুদূর দিল্লিতে একটা খুন হয়েছে আর কলকাতার এই অ্যাপার্টমেন্টে বসে আপনি তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ঐ কেসটা আপনি হাতে পেয়েছেন। কারণ মহিলার স্বামী কলকাতার এক বিগ ফিশ।

কর্নেল বললেন, না। বরং জয়ন্ত তুমি সৌমেনের দিল্লি যাওয়ার পর্বটা খুলে দাও।

কর্নেলের চোখের দিকে তাকালে আমি বুঝতে পারি আমাকে কী করতে হবে। এটা দীর্ঘকালের সংসর্গে আমার রপ্ত হয়েছে। আমি একটু গম্ভীর হয়েই বললুম, কিছুদিন আগে আমি দিল্লি গিয়েছিলুম। সেখানে দৈবাৎ সৌমেন চন্দ্রের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। এবার বাকিটা মন দিয়ে শুনুন।

আমি সতর্কভাবে দিল্লিপর্বের বর্ণনা দিলুম। তারপর আজ সন্ধ্যায় সৌমেনের মুখে যা শুনেছি তার অনেকটাই খুলে বললুম। শুধু ঐ উড়ো চিঠির কথাটা চেপে গেলুম। শেষে বললুম, আসলে সৌমেন খবরের কাগজে মিসেস শালিনীর খুন হওয়ার সংবাদ পড়ে অস্বস্তিতে পড়েছে। সে সাদাসিধে ছেলে। মিসেস শালিনী তাকে সাত লাখ টাকার শেয়ার হস্তান্তর করেছিলেন। যদিও তা সৌমেন শালিনীর স্বামী সুরজদাস নেহালিয়াকে ফেরত দিয়েছে তা সত্ত্বেও সে একটু ভয় পেয়েছে। পাছে দিল্লি থেকে পুলিশে এসে তাকে উত্ত্যক্ত করে সেই ভয়ে সে আমার মাধ্যমে কর্নেলের শরণাপন্ন হতে চেয়েছে। নরেশবাবু, আশা করি আমার এবং সৌমেনের ভূমিকাটা আপনার কাছে পরিষ্কার হয়েছে।

নরেশবাবু বললেন, আপনাকে অবিশ্বাসের আর কোনও কারণ নেই। কর্নেল সাহেবের মতো গার্জেন থাকতে আপনার কোনো দিক থেকে আশঙ্কার কারণ নেই। কিন্তু দিল্লি থেকে সি আই ডি কর্তা ব্রজেশ বর্মন কলকাতায় আমাদের কর্তা ডিসি ডিডি লাহিড়ী সাহেবকে রিং করেছিলেন। মিঃ বর্মন শুধু জানতে চেয়েছেন শেয়ার হস্তান্তরের ব্যাপারে সৌমেন চন্দ্রের ভূমিকাটি কী। কেনই বা স্বামীর পরামর্শে মিসেস শালিনী তাকে শেয়ার হস্তান্তর করেছিলেন।

কর্নেল বললেন, নরেশবাবু, সৌমেন ভবানীপুরের কুমারবাহাদুর সুভদ্রনারায়ণের বড়ো মেয়ের একমাত্র সন্তান। সৌমেনের মায়ের বিয়েটা ছিল অসবর্ণ। অর্থাৎ লাভ ম্যারেজ। যাই হোক, সৌমেন মিঃ নেহালিয়ার টাকায় ফ্ল্যাট কেনেনি এটা আমি সিওর। কুমারবাহাদুর আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বেশ কয়েকবার তাঁর কাছে শুনেছিলুম তাঁর বড় জামাই-এর ক্যানসারে মৃত্যুর পর মেয়ে সুনন্দার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়েছে। সুনন্দার স্বামী সাধারণ মধ্যবিত্ত ছিলেন। আমি তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলুম, আপনি বড় মেয়েকে বাড়িতে এনে রাখুন। কুমারবাহাদুর বলেছিলেন, তা সম্ভব নয়। কারণ সুনন্দার ছোটবোন গায়ত্রী তা হলে তাঁকে ছেড়ে এ বাড়ি থেকে চলে যাবে।

হালদারমশাই বলে উঠলেন, ক্যান? দিদির সঙ্গে তার বনিবনা নাই?

কর্নেল বললেন, না। গায়ত্রীর ধর্মে একটু বাতিক আছে। জাতপাতের প্রথার ব্যাপারে সে অন্ধ। সুবর্ণবণিকের ছেলেকে তার দিদি বিয়ে করেছে এটা সে সহ্য করতে পারেনি।

কথাটা বলে কর্নেল একটু হেসে উঠলেন, কে জানে কেন আমার মনে হল। তার হাসিটা তাৎপর্যময়।

নরেশবাবু ব্যাপারটা ধরেছেন মনে হল। তিনি মুচকি হেসে বললেন, আচ্ছা, কর্নেল সাহেব, দুই বোনের মধ্যে বয়সের তফাত কতটা আপনি জানেন?

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, মাত্র দুবছর। তবে নরেশবাবু, আপনার মুখের রেখা থেকে আমি কী যেন একটা কথা লক্ষ করছি।

নরেশবাবু চাপাস্বরে বললেন, অপরাধ নেবেন না, কর্নেল সাহেব। আমার মাত্র আর একটা প্রশ্ন আছে। দুই বোন কি একই কলেজে পড়তেন এবং সেটা ছিল কো-এডুকেশন কলেজ?

কর্নেল কিছু বলার আগেই হালদারমশাই বলে উঠলেন, খাইছে।

আমি বললুম, কে কাকে খেল হালদারমশাই?

গোয়েন্দাপ্রবর চাপাস্বরে বললেন, কর্নেল স্যারের সামনে কথাটা কইতে বাধে। তবু কইয়া ফেলি।

নরেশবাবু বললেন, হালদারমশাই, আপনি যা ভেবেছেন, আমিও তা ভেবেছি। দুই বোন একটি ছেলেকেই ভালোবাসত এবং সুনন্দাদেবী তাকে জয় করে নেন।

কর্নেল হেসে উঠলেন। বললেন, থাক। এ বিষয়ে আর কিছু বলছি না। এবার নরেশবাবু, সৌমেনের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলুন। আমার এই ঘরেই তাকে জেরা করবেন। তবে একটা দিন সময় চাই। আগামী পরশু সকাল নটায় এই ঘরে সৌমেনকে পেয়ে যাবেন।

নরেশবাবু আড়ামোড়া দিয়ে বললেন, শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে। আমি আর লাহিড়ী সাহেবের কাছে যাচ্ছি না। বরং কর্নেল সাহেব আপনি আপনার স্নেহভাজন লাহিড়ী সাহেবকে যা বলা উচিত বলবেন। সেই সঙ্গে এও বলবেন আমাকে আপনি এই কেসের ব্যাপারে একটা ক্ল দিয়েছেন এবং আমি সেইদিকে ছুটে বেড়াচ্ছি।

নরেশবাবু উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আমাদের কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি বললুম, আমার ইচ্ছে করছিল কাল সন্ধ্যায় পার্ক স্ট্রিটের মুনলাইট বারে যে নাটক হবে তার সম্পর্কে নরেশবাবু অর্থাৎ পুলিশকে আভাস দিয়ে রাখি। কারণ এখনও আমার ভয় করছে যে লোকটা সৌমেনকে ডেকেছে সে তার কোনও ক্ষতি করতে পারে।

কর্নেল বললেন, না জয়ন্ত। একটু ঝুঁকি আমাদের নিতেই হবে। আমরা সৌমেনের প্রায় পিছনে থেকেই বারে ঢুকব আর হালদারমশাই থাকবেন বারের বাইরে ফুটপাতের একটা পিলারের কাছে। হালদারমশাই আশা করি মুনলাইট বার চেনেন?

প্রাইভেট ডিটেকটিভ সহাস্যে বললেন, চিনি বৈকি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমি আধঘন্টা আগেই ওখানে হাজির থাকব।

বললুম, হ্যাঁ। উইথ আর্মস।

হালদারমশাই প্যান্টের পকেটে হাত ভরে তার সিক্স রাউন্ডার লাইসেন্সড রিভলবারটা বের করে বললেন, দ্যাখছেন তো আমি সব সময় রেডি থাকি।

বলে অস্ত্রটা তিনি প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন। তার পর একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন, কর্নেল স্যার, আমি তা হলে কাইল ম্যাডামেরে লইয়া আপনার এখানে আসতাছি।

কর্নেল হাত নেড়ে বললেন, না হালদারমশাই। আমি আর জয়ন্ত কাল সকালে ভবানীপুরে কুমারবাহাদুরের বাড়ি যাব। আশা করি এখন বুঝতে পেরেছেন আপনার ক্লায়েন্ট গায়ত্রীদেবী আমার সুপরিচিত।

হালদারমশাই সহাস্যে উঠে দাঁড়ালেন। তার পর বললেন, তা হইলে আমি কাইল মর্নিং-এ আমার ক্লায়েন্টের কাছেই যাব। তবে আপনি ওনার পোলা অর্কের সম্পর্কে যা কইলেন আমার অস্বস্তি হইতেছে। আচ্ছা, যাই গিয়া।

বলে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাই আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলেন।

কর্নেল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, সময় একেবারে রুদ্ধশ্বাসে ছুটেছে। সাড়ে নটা বাজে। থাক, আর কফি খাব না। জয়ন্ত তুমি তোমার ঘরে গিয়ে পোশাক বদলে নাও। এই রাতে আমরা কোথাও বেরুচ্ছি না।

ষষ্ঠীচরণ আমার ঘরের তালা খুলে দিয়েছিল। আমি তার আগেই নীচে কর্নেলের গ্যারেজে আমার গাড়ি রেখে এসেছিলুম। তারপর পোশাক বদলে মুখে জল দিয়ে মেজাজটা হালকা করে নিয়েছিলুম। তারপর রাত দশটায় ডিনার করে কর্নেল তাঁর অভ্যেসমতো আবার ড্রয়িংরুমে গিয়েছিলেন। জানতুম উনি লালবাজারের ডিসি ডিডি-১ মিঃ অরিজিৎ লাহিড়ীকে এতক্ষণে টেলিফোন করবেন। আমার কৌতূহল থাকা সত্ত্বেও বিছানায় শুয়ে পড়েছিলুম। সৌমেনের উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে গিয়ে কী অবস্থায় পড়ব কে জানে! ঘুমের মুহূর্ত অবধি এই কথাটা আমাকে উত্ত্যক্ত করছিল।

পরদিন সকাল নটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে কর্নেলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লুম। কর্নেল সকাল আটটাতেই তাকে ফোনে জানিয়েছিলেন তিনি যাচ্ছেন।

এদিন রবিবার। রাস্তাঘাটে গাড়ির সংখ্যা খুব কম। কর্নেলের নির্দেশমতো ভবানীপুরের অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে একটা উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাড়ির গেটে পৌঁছলুম। গেটে দারোয়ান ছিল। সে কর্নেলকে দেখামাত্র মিলিটারি ভঙ্গিতে স্যালুট ঠুকে গেট খুলে দিল।

লনের দুপাশে মরসুমি ফুলের বাহার। বাড়িটা অনেকখানি জায়গার উপর দাঁড়িয়ে আছে। পিছন দিকে পুবে একটা টেনিস লন দেখা যাচ্ছিল। পাঁচিলের ধারে দেশি-বিদেশি গাছপালা দাঁড়িয়ে আছে। পরিবেশটা খুব মনোরম বলা যায়। বিলুপ্ত প্রজাতির ক্যাকটাস আর নানা জাতের উদ্ভিদ চোখে পড়ছিল। তখনই মনে পড়ে গেল কর্নেল বলেছিলেন কুমারবাহাদুর সুভদ্রনারায়ণ তারই মতো প্রকৃতিপ্রেমিক।

গাড়ি পোর্টিকোর দিকে এগিয়ে যেতেই পোর্টিকোর খোলা বারান্দায় প্রায় কর্নেলের বয়সী এক ভদ্রলোককে দেখতে পেলুম। তিনি সহাস্যে বললেন, আসুন, আসতে আজ্ঞা হোক।

ভদ্রলোকের পরনে উজ্জ্বল সাদা পাজামা আর পাঞ্জাবি। বলিষ্ঠ শরীর। মাথার চুল একেবারে সাদা। কিন্তু কর্নেলের মতোই সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ তার ভঙ্গিতে টের পাওয়া যাচ্ছিল।

গাড়িবারান্দায় ঢুকে কর্নেল বললেন, আমি নামছি। তুমি গাড়িটা ওখানে পার্ক করে এসো। ঐ যে দেখছো কুমারবাহাদুর আর তার নাতির গাড়ি গ্যারাজে ঘুমোচ্ছে–ওখানেই তোমার গাড়িকে ঘুমোতে দিয়ে এসো।

এ ধরনের অভিজাত লোকের বাড়িতে কর্নেলের সঙ্গে কতবার যাতায়াত করেছি। একই ধরনের হলঘর, নতুন-পুরনোতে মেশানো ফার্নিচার, ফ্লাওয়ার ভাস, দেওয়ালে পূর্ব পুরুষদের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সব পেন্টিং।

ভদ্রলোক আমাদের অভ্যর্থনা করে পুরনো কার্পেট বিছানো কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় নিয়ে গেলেন। চওড়া বারান্দায় কয়েকটা বেতের চেয়ার এবং একটা বড়ো টেবিল ছিল। কুমারবাহাদুর বললেন, এখানে বসা যাক।

বলে তিনি আমার দিকে তাকালেন। পরক্ষণে একটু হেসে বললেন, সম্ভবত ইনি সেই প্রখ্যাত সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরি। যাকগে, আমার বহুদিনের একটা সাধ ছিল দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার এই ইয়াং হিরোকে স্বচক্ষে দর্শন করি। এযাবৎ কখনও সেই সুযোগ পাইনি। এবার কেন পেলুম তা আমার কাছে স্পষ্ট।

কর্নেল তার ডানদিকে বসে চাপাস্বরে বললেন, গায়ত্রী যে প্রাইভেট গোয়েন্দাকে হায়ার করেছেন সম্ভবত তিনি এসে গেছেন।

কুমারবাহাদুর একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, গায়ত্রী আমাকে কোনো কথা না জানিয়ে ছেলের জন্য গোয়েন্দা ভাড়া করতে যাবে, আমি ভাবতে পারিনি। আসলে কিছুদিন থেকে লক্ষ করছিলুম মাতাপুত্রে যেন একটা গোপন বিরোধ চলেছে। গায়ত্রীকে আমি শেষ অবধি চাপ দিয়ে কথাটা আদায় করে নিলুম। অর্ক নাকি কী একটা পুলিশ কেসে জড়িয়ে গেছে। তারপর অর্ককে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কথাটা বের করে নিলুম। সে ক্লাবের এক মেম্বার তমাল বোসের সঙ্গে মারামারি করেছে। ফিল্মের নায়িকা চন্দ্রিমাকে কেন্দ্র করেই এই ঝামেলা। তারপর তমাল বোস ক্লাবের ছায়া আর মাড়ায় না। গুন্ডা ভাড়া করে অর্ককে শায়েস্তা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আপনি অর্কের গাড়ির পিছনের কাঁচ দেখলেই বুঝতে পারবেন অর্ক কাল সন্ধ্যায় দৈবাৎ প্রাণে বেঁচে গেছে। আর একটা গুলি গাড়ির গা ঘেঁষে বেরিয়ে। গেছে। যাই হোক, আমি কাল আপনার সঙ্গে কথা বলার পর অর্ককে ওর গাড়িতে। চাপিয়ে থানায় নিয়ে গিয়েছিলুম। তমাল বোসের নামে এফ আই আর করার জন্য আমি গিয়েছিলুম কিন্তু অর্ক রাজি হল না। অগত্যা একটা জেনারেল ডায়েরি লিখিয়ে চলে এলুম।

এই সময় লক্ষ করলুম, শেষ প্রান্তের একটা ঘর থেকে জিনস্ টি-শার্ট পরা অবিকল সৌমেন চন্দ্রের মতো এক যুবক বেরিয়ে হনহন করে এগিয়ে এল। তারপর কর্নেলের দিকে তাকিয়ে একটু বাঁকা হেসে বলল, বাঃ! শুধু প্রাইভেট ডিটেকটিভই নয়, পিতাপুত্রী মিলে গোপনে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের মতো। প্রখ্যাত ব্যক্তিকেও আমার সেবায় ব্যবহার করেছেন।

কুমারবাহাদুর ঈষৎ ভর্ৎসনার সুরে বললেন, অর্ক তোমার মতো শিক্ষিত ছেলের কাছে বিশেষ করে আমাদের পরিবারের ট্রাডিশনের স্বার্থে ভদ্র ব্যবহার সবাই আশা করে।

অর্ক বলল, আমি অভদ্রতা করিনি। কর্নেল সাহেব, আপনি এ ব্যাপারে মাথা ঘামাবেন না। নিজেকে রক্ষার ক্ষমতা আমার যথেষ্ট আছে।

বলে সে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

.

০৪.

তারপরই এক পরিচারিকা এসে কফি ও স্ন্যাক্সের ট্রে টেবিলে রেখে চলে যাচ্ছিল। কুমারবাহাদুর বললেন, কমলা তোর দিদিমণি কি এখনও সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে। কথা বলছে?

মেয়েটি মৃদুকণ্ঠে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।

কুমারবাহাদুর বললেন, গায়ত্রীকে গিয়ে বলল কর্নেল সাহেব এসেছেন।

কমলা চলে গেল। আমরা কফিতে মন দিলুম। একটু পরেই হালদারমশাইকে স্মার্ট ভঙ্গিতে আসতে দেখলুম। বোঝা গেল অর্ক যে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিল, গোয়েন্দাপ্রবর সেই ঘরেই ছিলেন। কর্নেল তাকে দেখেই বলে উঠলেন, মর্নিং হালদারমশাই। আমরা আপনার অপেক্ষা করছিলুম।

হালদারমশাই একটা চেয়ার টেনে বসলেন।

কুমারবাহাদুর অবাক হয়ে বললেন, মিঃ হালদার দেখছি আপনার চেনা মানুষ কর্নেল সাহেব। কিন্তু ওঁকে আপনি হালদারমশাই বলছেন কেন?

কর্নেল একটা খালি কাপে হালদারমশায়ের জন্য কফি, চিনি এবং একটু বেশি পরিমাণে দুধ মিশিয়ে এগিয়ে দিলেন। তারপর একটু হেসে বললেন, ওঁকে একবার একটা কেসে হালদারমশায়ের রোল দিয়েছিলুম। একটা বিয়েবাড়িতে ডাকাতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আমি ওঁকে বলে রেখেছিলুম ডাকাতদের থাকার কথা বরযাত্রীদের ভিড়ে। আমি যখনই তাদের কাউকে শনাক্ত করতে পারব তখন বলে উঠব–হালদারমশাই হালদারমশাই আপনার বোনের চোখে পোকা।

কুমারবাহাদুর সহাস্যে বলে উঠলেন, ইন্টারেস্টিং। তারপর?

কর্নেল বলেন, তারপর সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড। হালদারমশাই কফির কাপ হাতে নিয়ে খি খি করে হেসে বললেন, আসলে পুলিশ জীবনের অভ্যাস। তখনই ফায়ার আর্মস বাহির কইর‍্যা মাথার ওপর এক রাউন্ড ফায়ার করছিলাম। অমনি উপরে আলোর বা ফাইট্যা চৌচির আর মেনলাইনের তার কাইট্যা বেবাক অন্ধকার। কুমারবাহাদুর বললেন, তাহলে তো ডাকাতদের সুবিধা হয়ে গিয়েছিল।

কর্নেল বললেন, না। আসলে আগেই সব প্ল্যান করা ছিল। কনেবৌকে তার প্রকৃত মামা দুহাতে তুলে নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছিল।

গল্পটা শেষ হল না। এক সুন্দরী ভদ্রমহিলা এসে কর্নেলকে নমস্কার করলেন।

কর্নেল বললেন, বসো গায়ত্রী। তোমাকে একটু রোগা দেখাচ্ছে।

 বারান্দার দেওয়াল সংলগ্ন একটা চেয়ার টেনে নিয়ে গায়ত্রী একটু তফাতে বসলেন। তারপর মৃদুস্বরে বললেন, মিঃ হালদার আমাকে জানিয়েছেন আপনি আসবেন। উনি নিশ্চয় সেই সাংবাদিক জয়ন্তবাবু।

আমরা পরস্পর নমস্কার বিনিময় করলুম।

কুমারবাহাদুর বললেন, তোমার পুত্রের যা মেজাজ দেখলাম, সে একেবারে বেপরোয়া হয়ে গেছে। আমি একেবারে সিওর যে তমাল বোস ওর পিছনে ভাড়াটে খুনিকে লাগিয়ে দিয়েছি।

গায়ত্রী বললেন, প্রথমে আমি ভেবেছিলুম কর্নেল সাহেবকেই সব জানাব। কিন্তু অর্ককে যে এভাবে মেরে ফেলার চেষ্টা হবে, এটা আমি কল্পনা করিনি। তাই ঠিক করেছিলুম প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ হালদার তমাল বোসকে টার্গেট করে পা ফেলবে এবং প্রয়োজনে তাকে ট্র্যাপ করে পুলিশের হাতে তুলে দেবে। তমালের ব্যাকগ্রাউন্ড আমি কিছুটা জানি।

কর্নেল বলেন, অর্কের সঙ্গে আমার কথা বলার দরকার ছিল। কিন্তু যা বুঝলুম ওকে এখন ঘাঁটানো ঠিক হবে না। পরে সময়-সুযোগ মতো অর্ককে আমি ডেকে নেবো।

হালদারমশাই বললেন, আমি যতদূর জানতে পারছি তমাল বোসের ওয়াইফ ফিল্ম লাইনের মাইরা। ফিল্মে তেমন সুবিধা করতে পারে নাই। ওদিকে তমালবাবুর কনট্রাকটারির ব্যবসা। হাতে পয়সাকড়ি আইয়া পড়লে যা হয়, ওনার মাথায় সিনেমা করার ঝোঁক চাপছিল।

কুমারবাহাদুর বাঁকা মুখে বললেন, ন্যাস্টি প্রসঙ্গ আপাতত থাক মিঃ হালদার। অর্ককে বাঁচাতে হলে আমার মনে হচ্ছে ঐ তমাল বোসকে যেভাবেই হোক ঢিট করতে হবে। একজন কনট্রাক্টরকে ঢিট করা খুব কঠিন নয়।

কর্নেল বললেন, গায়ত্রীকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই। আশা করি সঠিক জবাব দেবে।

গায়ত্রী শান্তভাবে বললেন, আপনার কাছে আমি যা জানি তাই বলব।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, তোমার দিদির সঙ্গে কি এখনও আগের মতোই সম্পর্ক? নাকি সম্পর্ক বদলেছে?

গায়ত্রী ঠোঁট কামড়ে ধরে কথাটা শুনছিলেন। বললেন, গতকাল দিদি হঠাৎ ফোন করেছিল। আমি ভেবেছিলুম অর্কের কেলেঙ্কারি ক্লাবের মেম্বারদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এবং সেই সূত্রে নিউ আলিপুরে পশ এলাকাতেও পৌঁছে গেছে। কিন্তু দিদি অর্ক প্রসঙ্গে কিছু বলল না। হঠাৎ কেঁদে ফেলল। তারপর আত্মসম্বরণ করে বলল, তার ছেলে সৌমেন নাকি কার প্ররোচনায় একটা অনিচ্ছাকৃত ঘটনার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। বাবার সঙ্গে কথা বলতে তার সাহস হচ্ছে না। তাই—

 তাঁর কথার উপরে কুমারবাহাদুর ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন, আমি কি বনের বাঘ না ভালুক? কর্নেল সাহেব, আমি স্পষ্টভাষী, আপনি তো জানেন। সুনন্দা বরাবর অকৃতজ্ঞ। এখন বলতে দোষ নেই আমার এবং গায়ত্রীর প্রচণ্ড বাধা সত্ত্বেও সে যখন। অমিতেশকে বিয়ে করেছিল তখন সে নিজেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। কয়েকবছর পরে তারা কী অবস্থায় আছে খোঁজখবর নিয়ে আমি আমার ম্যানেজার নগেনবাবুকে তার কাছে পাঠিয়েছিলুম। যাই হোক, নগেনবাবু পরিচিত এক ভদ্রলোকের সূত্রে নিউ আলিপুরে একটা ফ্ল্যাটের খোঁজ পেয়েছিল। সেই ফ্ল্যাটটা আমি সুনন্দার নামে কিনে দিয়েছিলুম। গায়ত্রী প্রথমে একটু মুখ ভার করে থাকলেও পরে বলেছিল কাজটা আমি ভালোই করেছি। একটা অভিজাত পরিবারের মেয়ে যেখানে-সেখানে থাকবে এটা ঠিক নয়।

কর্নেল চুরুটের একটা ধোঁয়া ছেড়ে গায়ত্রীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর বললেন, ফর ইয়োর ইনফরমেশন গায়ত্রী, আমার স্নেহভাজন তরুণ এই বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরী তোমার দিদির ছেলে সৌমেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তুমি জানো কিনা জানি না, সৌমেন একটা ইংরেজি দৈনিকের সাংবাদিক। কাজেই ঘটনাচক্রে দুই মাসতুতো ভাইয়ের উপর কোনো বিপদের মেঘ ঘনিয়ে এলে আমি যে ছাতি হাতে এগিয়ে যাব, সে-বিষয়ে তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো। ইতিমধ্যে হালদারমশাই নিশ্চয় তোমাকে আমার কথা বলেছেন।

গায়ত্রী বললেন, হ্যাঁ। আজ সকালেই আপনার কাছে মিঃ হালদার আমাকে নিয়ে যেতেন। আমি ওঁকে অবশ্য বলিনি যে আপনি আমার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, ঠিক আছে কুমারবাহাদুর, ঘটনাচক্রে যখন আপনার ফ্যামিলি একটু ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে তখন তা ট্যাকল করার জন্য আমাকে পা বাড়াতেই হবে। প্রসঙ্গত বলে রাখছি আমি প্রথমে একটা রহস্যের আভাস পেয়েছিলুম, যেটা আয়তনে তত বড় নয়। কিন্তু অর্ক বনাম তমাল বোসের কাহিনি শুনে বুঝতে পারছি রহস্যটা দুমুখো এবং বেশ কিছুটা জটিল। এবার আমি উঠি।

বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় গায়ত্রীকে আবার আশ্বাস দিয়ে এলেন কর্নেল–অর্কের সঙ্গে তিনি যেভাবেই হোক ভাব করে ফেলবেন।

হালদারমশাই সহাস্যে বললেন, ম্যাডাম, আমাগো কর্নেল স্যারের মধ্যে একটা আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। তরুণ-তরুণীরা সহজেই তার আপন হয়ে ওঠে। আপনি ভাববেন না।

ফেরার পথে হালদারমশাই আমাদের সঙ্গে এলেন। পার্ক স্ট্রিটে ঢুকে মুনলাইট বার পেরিয়ে গিয়ে আমাকে কর্নেল গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন। ফুটপাত ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করালুম। কর্নেল সামনের সিটেই ছিলেন। গাড়ি থেকে নেমে তিনি ফুটপাত দিয়ে এগিয়ে চললেন। লক্ষ করলুম তিনি মুনলাইট বারের দিকেই এগোচ্ছেন। আজ রবিবার, এগারোটাতেই বার খুলে যায়।

হালদারমশাই জানলা দিয়ে উঁকি মেরে বললেন, কর্নেল স্যার যান কোথায়?

আমি বললুম, আজ সন্ধ্যায় যে নাটকটা হবে তার মঞ্চ পরীক্ষা করতে গেলেন।

গোয়েন্দাপ্রবর গুলি গুলি চোখে তাকিয়ে বললেন, কন কী!

বললুম, বারের মালিক থেকে ওয়েটার সবাই কর্নেলের সুপরিচিত। তারা অবশ্যি কর্নেলের অন্য পরিচয় জানে না। কিন্তু ওঁর সাহেবি চেহারা আর সাদা দাড়ি দেখে ভক্তিতে নুইয়ে পড়ে।

হালদারমশাই একটিপ নস্যি নিলেন। তারপর আপন মনে বললেন, কী যে ঘটবে ভাবতে পারছি না।

মিনিট দশেক পরে কর্নেল ফিরে এসে বললেন, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। বারের মালিক আজ নিজেই রাত্রি অবধি বারে উপস্থিত থাকবেন। তাকে নাকি লালবাজার থেকে বলে দেওয়া হয়েছে আজ বারে বিকেলের দিকে খদ্দের সেজে কয়েকজন সাদা পোশাকের পুলিশ থাকবে। আমি বলে এলুম তাহলে আজ আমিও ওবেলা। বিয়ার খেতে আসব। মিঃ ডিসুজা উদ্বিগ্ন মুখে আমাকে বললেন, স্যার, আপনাকে আমি ইনভাইট করছি।

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট দিয়ে ইলিয়ট রোড এলাকায় কর্নেলের ফ্ল্যাটে পৌঁছলুম। ষষ্ঠীচরণ বলল, নালবাজার থেকে–

কথাটা বলেই জিভ কেটে শুধরে নিতে গেল। কিন্তু কর্নেল তাকে সে সুযোগ না দিয়ে বললেন, লালবাজার থেকে লাহিড়ীবাবু ফোন করেছিলেন তো?

ষষ্ঠীচরণ কাচুমাচু হেসে বলল, আজ্ঞে আমি কি শুদ্ধ কথা কইতে পারি না। আমি ওনারে বললুম বাবামশাই বেইরেছেন। কখন ফিরবেন তা বলে যাননি। তবে লাঞ্চো না খেলে ঠিক বলে যেতেন। কাজেই–

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, আজ হালদারমশাইও লাঞ্চো খাবেন। তবে এখন আমাদের কফি খাইয়ে দে। বাইরে কফি খেলে আমার মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়।

কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা নোটবই বের করলেন, তাতে কীসব লিখলেন এবং আবার ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখলেন। তারপর রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। সাড়া এলে তিনি বললেন, তোমার হটলাইনেই তোমাকে ধরলুম। আমি জানি এই লাইনে রিং হলে তুমি কোনো উপরওয়ালা ভেবে ব্যস্ত হয়ে ওঠো…ব্যস্ত হওনি? কিন্তু হবার কথা। কারণ আমাকে পার্ক স্ট্রিটের মুনলাইট বারের মিঃ ডিসুজা একটা গোপন খবর দিয়েছেন…. না না, উনি তোমাদের গোপন কথা ফাস করেছেন বলে ওঁকে কিছু বলল না…. বুঝলুম। কিন্তু তোমাদের প্ল্যানে আমার একটু আপত্তি আছে। সৌমেন চন্দ্রের সঙ্গে যে লোকটি দেখা করতে আসবে। সে নিশ্চয় বারের মধ্যে সৌমেনকে খুন করতে আসবে না…..আর খুনের মোটিভটাও জানা দরকার… কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের মাথার পেছনে এবং দুপাশে আরো কয়েকটা চোখ আছে। তুমি নরেশবাবুকে নির্দেশ দাও বারে আর যা কিছুই ঘটুক, আমি কিছু না বললে ওঁরা যেন চুপচাপ থাকেন… হ্যাঁ আমি আর জয়ন্ত বিয়ার খাবার নিমন্ত্রণ পেয়েছি। আর আমাদের হালদারমশাই বারের বাইরে উইথ আর্মস রেডি থাকবেন….ঠিক আছে অরিজিৎ, তোমরা যদি লোকটিকে ফলো করতে চাও করতে পারো। আমি আমার এই মার্কামারা চেহারা নিয়ে তাকে ফলো করতে চাই না…. ও কে।…রাখছি।

রিসিভার রেখে কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে আমার দিকে তাকালেন। বললুম, নরেশবাবু আরও কিছু ইনফরমেশন পেয়েছেন মনে হচ্ছে।

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, যা বুঝছি সৌমেনের মা নিশ্চয় কারও পরামর্শে ডিসি ডিডি-র শরণাপন্ন হয়েছে। মহিলাদের এই একটা বিচিত্র স্বভাব জয়ন্ত। ওরা সবতাতেই খুব শক্ত নির্ভরযোগ্য জায়গা খুঁজে নেয়।

আমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলুম। সৌমেনের মা কোনো সুত্রে জানতে পেরেছেন যে তার ছেলে উড়ো চিঠি লেখা একটা লোকের সঙ্গে মুনলাইট বারে দেখা করতে যাবে। সেটা সৌমেন আর আমি ছাড়া শুধু কর্নেলই জানেন। তাহলে কি সৌমেনই তার মাকে কথাটা জানিয়েছে? এখনই সৌমেনকে টেলিফোন করা উচিত। তাকে যদি বাড়িতে নাও পাই, অফিসে নিশ্চয়ই পাব।

আমি কর্নেলকে বললুম, ব্যাপারটা আমার আশ্চর্য লাগছে। সৌমেনকে একবার ফোন করা উচিত। তার মা আমাদের প্ল্যানকে নষ্ট করে দিয়েছে।

সায় দিয়ে হালদারমশাই বললেন, হঃ ঠিক কইছেন। অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট।

কর্নেল মৃদুস্বরে বললেন, হ্যাঁ। ভদ্রমহিলা কেসটাকে অকারণে জটিল করে ফেলেছেন।

আমি সৌমেনকে তার বাড়িতে ফোন করলুম। কিন্তু অনেকক্ষণ রিং হয়ে গেল, কেউ ফোন ধরল না। তখন ওর অফিসে ফোন করলুম। অফিসে ওকে পাওয়া গেল। সংক্ষেপে লালবাজারের ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলুম, তুই কি তোর মাকে এসব কথা বলেছিস?

সৌমেন যে ভয় পেয়েছে তা তার কণ্ঠস্বরেই বোঝা গেল। সে বলল, আমার খুব অবাক লাগছে জয়ন্ত। মা আমার এই ঝামেলায় বিন্দুবিসর্গও জানে না।

বললুম, তাহলে তোর মা লালবাজারের ডিসি ডিডি-ওয়ান মিঃ অরিজিৎ লাহিড়ীকে সব কথা জানিয়েছেন এবং তোর প্রোটেকশনের জন্য অনুরোধ করেছেন–এটা কী করে সম্ভব।

সৌমেন বলল, সেটাই তো বুঝতে পারছি না। তুই ফোনটা রাখ। আমি মায়ের সঙ্গে কথা বলে সব জেনে নিয়ে কর্নেল সাহেবের বাড়ি যাচ্ছি।

বললুম, ঠিক আছে। আমরা তোর জন্য অপেক্ষা করছি। তা ছাড়া আগের কথামতো আমার গাড়িতেই তুই মুনলাইট বারে যাবি।

রিসিভার রেখে কর্নেলকে বললুম, না। সৌমেন ওর মাকে এসব কথা বলেনি। তাহলে বোঝা যাচ্ছে ওর মা অন্য কোনো সূত্রে ব্যাপারটা জানতে পেরেছেন। তারপর উদ্বিগ্ন হয়ে লাহিড়ী সাহেবকে ফোন করেছেন।

একটা তিরিশ মিনিটে ডাইনিং রুমে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলুম। তখনও সৌমেনের কোনো সাড়া না পেয়ে অন্তত আমি যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। খাওয়ার পর হালদারমশাই সোফায় লম্বা হলেন। কর্নেল যথারীতি তার ইজিচেয়ারে বসে চোখ বুজে চুরুট টানতে থাকলেন। আর আমি ডিভানে অভ্যাসমতো ভাতঘুমের টানে গড়িয়ে পড়লুম। কিন্তু আমার উদ্বেগ ভাতঘুমকে বারবার তাড়িয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু অভ্যাসেরই জয় হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। হালদারমশায়ের আঁকুনিতে তখনই উঠে বসলুম। হালদারমশাই বললেন, সৌমেনবাবু ফোন করেছিলেন, উনি বাড়ি থেকে ট্যাক্সি করে আমাদের এখানে আসছেন।

আমি উত্তেজিতভাবে বললুম, আমাকে তখনই জাগিয়ে সৌমেনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল।

কর্নেল বললেন, ফোনটা তোমাকে দেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়নি। ফোন প্রথমে ধরেছিলেন হালদারমশাই, তারপর আমি। কিন্তু সৌমেন বলল, আমি এখনই বেরোচ্ছি। তারপর ফোন রেখে দিল।

আমি উঠে গিয়ে সোফায় বসলুম। তারপর সৌমেন হয়তো এখনও বেরোয়নি কিংবা পোশাক বদলাচ্ছে, এই ভেবে ওর বাড়িতে রিং করলুম। কিছুক্ষণ পরে মহিলাকণ্ঠে সাড়া এল, আমি বললুম, সৌমেনের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

মহিলা বললেন, আপনি কে বলছেন?

–আমার নাম জয়ন্ত চৌধুরি। আমি ওর বন্ধু।

 –আপনি কি সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। প্লিজ সৌমেনকে—

আমার কথার উপর তিনি বললেন, সৌমেন এইমাত্র বেরিয়েছে।

–আপনি কি সৌমেনের মা বলছেন?

–হ্যাঁ।

-একটা কথা জানতে চাইছি, আপনি লালবাজারের ডিটেকটিভ অফিসে ফোন করেছিলেন। আমার শুধু জানতে ইচ্ছে করছে আপনি কীভাবে সৌমেনের ঝামেলার কথা জানতে পেরেছেন।

একটু সময় নিয়ে সৌমেনের মা সুনন্দাদেবী বললেন, সৌমেনের বাবার এক বন্ধু মৃগাঙ্ক চৌধুরি আজ সকালে আমাকে সব জানিয়েছেন। মৃগাঙ্কবাবুর কাছেই জানতে পেরেছি জনৈক ব্যবসায়ী মিঃ নেহালিয়া সৌমেনের সরলতার সুযোগ নিয়ে তাকে বিপদে ফেলেছে।

বললুম, আজ সন্ধ্যায় মুনলাইট বারে সৌমেন কার সঙ্গে দেখা করতে যাবে সে কথাও কি আপনাকে মৃগাঙ্কবাবু বলেছেন?

-হ্যাঁ, তার পরামর্শেই আমি লালবাজারে ফোন করেছিলুম।

বলেই সুনন্দাদেবী ফোন রেখে দিলেন।

.

০৫.

কর্নেল যদিও কান করে আমাদের কথা শুনছিলেন, তিনি চোখ বন্ধ করে আবার একটা চুরুট টানতে মন দিলেন। ওয়াল ক্লকের দিকে তাকিয়ে দেখলুম সাড়ে তিনটে বাজে। সৌমেনের পৌঁছতে সময় লাগবে, কিন্তু কে এই মৃগাঙ্ক চৌধুরি? তিনিই বা কোন সূত্রে এসব গোপন কথা জানতে পেরেছেন?

ঘরে কিছুক্ষণ স্তব্ধতার পর হালদারমশাই একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন, হেভি মিস্ট্রি।

কর্নেল চোখ বুজে থেকেই বললেন, ঠিক বলেছেন হালদারমশাই। মিস্ট্রিটা সত্যিই খুব হেভি। তবে আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। আপনি কুমার বাহাদুরের বাড়িতে আপনার ক্লায়েন্ট গায়ত্রীদেবীকে একবার রিং করে দেখুন তিনি বাই এনি চান্স মৃগাঙ্ক চৌধুরি নামে কাউকে চেনেন কি না।

–ঠিক কইছেন।

 বলে হালদারমশাই উঠে এসে টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। কিছুক্ষণ পরে সাড়া পেয়ে বললেন, আমি মিসেস গায়ত্রীদেবীর লগে কথা কব।

বলে রিসিভারের মাউথপিসে হাত চাপা দিয়ে তিনি মুচকি হেসে বললেন, অগো বাড়ির সেই মাইয়াটা ফোন ধরছিল…হ্যালো, হ্যালো….হ্যাঁ, ম্যাডাম, আমি হালদার কইতাছি। দিস ইজ আর্জেন্ট। আপনি কি মৃগাঙ্ক চৌধুরি নামে কারেও চেনেন?… না, কথাটা পরে আপনারে জানাইয়া দিমু…কী কইলেন? কী কইলেন? চেনা ঠেকতাছে? আপনি একটু স্মরণ কইর‍্যা দেখুন….মনে পড়ল না? ঠিক আছে। মনে পড়লে আমারে জানাইবেন।

তিনি রিসিভার রেখে দিলেন। তারপর বললেন, আমার ক্লায়েন্টের মনে হইতাছে ওনারে তিনি চেনেন বা চিনতেন। হয়তো অনেক দিন আগের কথা, তাই মনে আসছে না।

কর্নেল বললেন, জয়ন্ত, তোমার কাছে কি মিঃ নেহালিয়ার কোনো নেমকার্ড আছে?

বললুম, না। উনি কোনো নেমকার্ড আমাকে দেননি। তবে সৌমেন এসে গেলে তার কাছে মিঃ নেহালিয়ার ফোন নাম্বার পাওয়া যাবে।

চারটে বাজল। কর্নেল ষষ্ঠীকে ডেকে কফি আনতে বললেন। তখনও সৌমেনের পাত্তা নেই। আবার আমার মধ্যে উদ্বেগ ফিরে এল।

এরপর আমাদের কফি খাওয়া শেষ হল। কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুটটা লাইটারে ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছাড়লেন। আমরা তিনজনেই গম্ভীর এবং উদ্বিগ্ন, তাতে ভুল নেই। একটু পরে আমি হাত বাড়িয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে সৌমেনের অফিসে রিং করলুম। রিপোর্টিং ডিপার্টমেন্ট থেকে কেউ বলল, সৌমেনবাবু সাড়ে বারোটায় বেরিয়েছেন। এখনও ফেরেননি।

রিসিভার রেখে কথাটা কর্নেলকে জানালুম। কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে বেরিয়ে পড়া ভালো। হালদারমশাই, আপনি গিয়ে মুনলাইট বারের সামনের ফুটপাতে অপেক্ষা করুন। জয়ন্ত, পোশাক বদলে নাও। সঙ্গে ফায়ার আর্মস নিতে ভুলো না। আমরা সাড়ে পাঁচটায় উঠব।

হালদারমশাই ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি আপন মনে যাই গিয়া বলে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।

আমি প্যান্টশার্ট পরে পকেটে আমার অস্ত্রটা নিয়ে ড্রইংরুমে এলুম। তখনও কর্নেল বেরোননি। তারপর হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। আমি ফোনের কাছে যেতে যেতে ফোনটা চুপ করে গেল। বুঝতে পারলুম এটার এক্সটেনশন লাইনে কর্নেলের ঘরে যে রিসিভারটা আছে, কর্নেল সেটা তুলেছেন। তবুও মনে মনে প্রচণ্ড উদ্বেগের চাপে কৌতূহল আমাকে নাড়া দিচ্ছিল। আমি খুব সাবধানে রিসিভারটা তুললুম। তারপর কর্নেলের কণ্ঠস্বর শুনলুম-হা, আমিই কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আমার কণ্ঠস্বরে আপনার সন্দেহের কোনো কারণ নেই।

যে টেলিফোন করেছে তার গলা কর্নেলের চেয়ে ভরাট। সে বলল, আমি বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পেরেছি–মুনলাইট বারে আমাকে আপনারা ফাঁদে ফেলবেন। তাছাড়া লালবাজারের হুলোরাও নাকি ওৎ পেতে থাকবে। অথচ এসবের কোনো দরকার ছিল না। আমি সৌমেনের হিতৈষী। ঐ শয়তানের বাচ্চা সূরজদাস যাতে ওকে কোনো বিপদে ফেলতে না পারে সেজন্য আমি ওকে কিছু পরামর্শ দিতে চেয়েছিলাম।

কর্নেল বললেন, আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনি মুনলাইট-এ এসে সৌমেনের সঙ্গে যতক্ষণ ইচ্ছা কথা বলুন, আমরা আপনাকে এতটুকু বিব্রত করব না। আর আমি লালবাজারকেও বলে দিচ্ছি ওরা যেন ওদের লোকজনকে ওখান থেকে সরিয়ে নেয়।

–আমি আপনাদের বিশ্বাস করি না। সৌমেন একটা নির্বোধ। তাই তাকে অন্তত আজ রাতের মতো কোথাও আটকে রাখতে চাই। সে এখন আমার পাশেই বসে আছে।

কথাটা শুনে চমকে উঠেছিলাম। কিন্তু ফোনে আড়ি পেতেছি জানলে কর্নেল কী ভাববেন, এ একটা সমস্যা। কিন্তু আমাকে অবাক করে কর্নেল বললেন, জয়ন্ত, তুমি ভদ্রলোককে বলল সৌমেনের সঙ্গে যেন উনি তোমাকে কথা বলতে দেন।

জয়ন্ত মানে আপনার সেই পুঁচকে চ্যালা! সে-ও নাকি সাংবাদিক? আমি জানি টিকটিকিদের লেজ থাকে। জয়ন্ত চৌধুরিও আপনার লেজ। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই জানেন, টিকটিকির লেজ খুব সহজেই ছিঁড়ে ফেলা যায়।

কর্নেলের হাসি শুনতে পেলুম। তিনি বললেন, বাঃ মিঃ বোস। আপনি একজন টিকটিকি বিশারদ, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু

–আমি বোস-টোস নই।

–আমার চোখ দুটো দেওয়াল ভেদ করে আপনার কাছে পৌঁছেছে তমালবাবু। আপনি অর্কের পিছনে লেগেছেন, আমার কাছে এই খবর ছিল। ভাড়া করা খুনি পাঠিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় তার উপর হামলাও করেছিলেন। এখন অর্কের মাসতুতো দাদা সৌমেনের শুভার্থী হওয়ার কারণ আপনাকে জিজ্ঞেস করতে চাইনে। শুধু এটুকু বলতে চাই সৌমেনের বোকামিকে কাজে লাগিয়ে আপনি কোনো শাঁসালো লোককে ব্ল্যাকমেল করতে চান। হ্যাঁ, এটাই আপনার প্ল্যান।

-আপনি একেবারে অন্তর্যামীর মতো কথা বলছেন।

–তমালবাবু, আপনি এখন কোথায় আছেন তাও কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি।

হাসির শব্দ শোনা গেল। তারপর তমাল বোস বলল, বাঃ। আপনার দৃষ্টিশক্তি সত্যি দেওয়াল ফুঁড়ে চলে যায়। বলুন তো আমরা কোথায় আছি?

আমি ভাবছিলুম কর্নেল। একটু অতিচালাকি করে ফেলছেন। এবার নিশ্চয় তিনি ভুল করবেন। কর্নেলকে বলতে শুনলুম-হ্যাঁ, আমি দেখতে পাচ্ছি আপনি সৌমেনকে মদের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ফিল্মের এক নায়িকার ফ্ল্যাটে শুইয়ে রেখেছেন। আরো শুনতে চান? নায়িকার নাম চন্দ্রিমা আর

আমার নাম হল তমাল বসু নার্ভাস হয়ে পড়েছে। সে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, ড্যাম ইট। আপনি যা পারেন করুন।

রিসিভার রেখে দেওয়ার জোরালো শব্দ শুনতে পেলুম। তারপর আমি ক্লান্তভাবে সোফায় বসে পড়লুম।

কর্নেল তার বেডরুম থেকে ড্রয়িংরুমে এলেন প্রায় আধঘন্টা পরে। ততক্ষণে আমি অধৈর্য হয়ে উঠেছিলুম। কিন্তু কর্নেলের ফোনে আড়ি পেতেছি, তাই কঁচুমাচু হয়ে বললুম, আপনি সত্যিই দেখছিলাম অন্তর্যামী। ফোনটা যে আমি তুলেছিলাম, সেটা আপনি কীভাবে যে টের পেলেন কে জানে!

কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে সহাস্যে বললেন, এই ঘরের ফোনটা অতি ব্যবহারে জরাগ্রস্ত। তাই কেউ তুললেই আমার বেডরুমের এক্সটেনশন লাইনে সহজেই টের পাই। তবে তুমি ভুল করোনি কারণ লোকটার সঙ্গে যে সব কথাবার্তা হল তা আমার মুখে শোনার চেয়ে তুমি স্বকর্ণে শুনেছ এতে আমাদের দুজনের পক্ষেই পা বাড়ানোর সুবিধে হল।

জিজ্ঞেস করলুম, আপনি কি লালবাজার মিঃ লাহিড়ীকে সব জানিয়ে এলেন?

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, মোটেও না। আমরা যথাসময়ে মুনলাইটে বিয়ার খেতে যাবো।

কথাটা শুনেই চমকে উঠেছিলুম। বললুম, কোথায় কোন ফিল্মের নায়িকার বাড়িতে সৌমেন সম্ভবত অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। এতক্ষণ আপনি তা হলে কী করছিলেন?

কর্নেল বললেন, আমি অন্য একটা জায়গায় ফোন করছিলুম। তবে নিজের পরিচয় দিইনি। যাই হোক, সেই ব্যাপারটা তুমি পরে জানতে পারবে।

ক্রমশ আবার বিস্ময় বেড়ে যাচ্ছিল। বললুম, ঠিক আছে। কিন্তু লোকটা যে কোনো ফিল্মের নায়িকার বাড়ি থেকে কথা বলছেন, আপনি কী করে বুঝলেন?

কর্নেল একটু পরে জবাব দিলেন, তোমার বোঝা উচিত ছিল ফিল্ম লাইনে তমাল বোস নামে একজন কনট্রাক্টর ঘোরাঘুরি করে। জনৈক ব্যর্থ নায়িকাকে নিয়ে নাকি অর্কের সঙ্গে তার শত্রুতা চলছে। এটুকু তো সকালেই শুনেছ।

বললুম, হ্যাঁ, সে তো জানি। কুমারবাহাদুরের বাড়ি গিয়ে ব্যাপারটা জেনে এসেছি।

কর্নেল বললেন, জয়ন্ত, মাঝে মাঝে তুমি সত্যিই বড্ড বোকা হয়ে ওঠো। কোন পাঠিকা যেন তোমাকে লিখেছিলেন–জয়ন্তবাবু, আপনি এত বোকা কেন?

বিব্রতভাবে বললুম, মানে, মাথাটা এখনও বোঁ বোঁ করে ঘুরছে।

কর্নেল বললেন, ওঃ জয়ন্ত, তুমি জয়শ্রী স্টুডিওর গোপাল কুণ্ডুকে একেবারে ভুলে গেছ!

কর্নেলের কথা শুনে প্রায় লাফিয়ে উঠলুম, কী সর্বনাশ! সত্যিই আমি বোকা। ফিল্ম লাইনের খোঁজখবর জোগাড় করতে দীর্ঘকাল গোপালবাবুই আপনার সূত্র তা মনেই ছিল না। এবার বোঝা গেল গোপালবাবুই তমাল বোস এবং কোনো ফিল্মের। মেয়ে চন্দ্রিমার খবর অপনাকে দিয়েছে।

কর্নেল ওয়াল ক্লকের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, আর এক কাপ কফি খেয়ে তবেই বেরুবো। তার আগে তুমি বরং এক কাজ করো। চন্দ্রিমার ফোন নাম্বার। আমি দিচ্ছি। গোপালবাবু এই নাম্বারটা আমাকে আজ সকালে দিয়েছেন। বরং আমি নাম্বারটা ডায়াল করে তোমাকে রিসিভারটা দিচ্ছি। ফোনে যেই সাড়া দিক, তুমি শুধু বলবে, আমি একটা ফিল্ম ম্যাগাজিন থেকে বলছি। চন্দ্রিমাদেবীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।

অবাক হয়ে বললুম, ওখানে তো এখনও তমাল বোস সৌমেনের বডি পাহারা দিচ্ছে। সে তো জানে না আপনি এই নাম্বারটা জানেন, একটু আগেই সে এখান থেকেই ফোন করেছিল। আমার কণ্ঠস্বরও সম্ভবত সে চিনে ফেলবে।

কর্নেল ততক্ষণে রিসিভার তুলে ডায়াল করার পর আমার হাতে সেটা দিলেন। কানে এল রিং হয়ে যাচ্ছে। ষষ্ঠীচরণও এই সময় ট্রেতে দুপেয়ালা কফি রেখে গেল।

একটু পরে মহিলাকণ্ঠে সাড়া এলো। বললুম, আমি চন্দ্রিমা দেবীর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

–আপনি কোত্থেকে বলছেন?

–আমি শমীক রায়। বিখ্যাত ফিল্ম ম্যাগাজিন দ্য ইভেন্টস অব ফিল্মওয়ার্ল্ড থেকে বলছি। ওঁর একটা ইন্টারভিউ আমাদের দরকার।

–একটু ধরুন।

আমি রিসিভার কানে রেখে ডানহাতে কফির কাপ তুলে নিলাম। মিনিট পাঁচেক পরে চেকনাই দেওয়া কণ্ঠস্বরে সাড়া এল, বলুন, আমি চন্দ্রিমা সেন বলছি।

আমি আগের কথাটা রিপিট করলুম। তারপর সবিনয়ে বললুম, আপনি আমাকে আগামিকাল অন্তত আধঘন্টাও যদি সময় দেন, তাহলে খুব খুশি হব। সঙ্গে ক্যামেরাম্যান থাকবে।

এই সময় কানে এল কোনও পুরুষ মানুষ চাপাস্বরে তাঁকে ধমক দিচ্ছে, হ্যাঁ স্পষ্টই তমাল বোস। তার পর হঠাৎ লাইনটা কেটে গেল।

বললুম, কর্নেল, ব্যাটাচ্ছেলে তমাল বোস চন্দ্রিমাকে কথা বলতে দিল না।

কর্নেল আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। শুধু বললেন, আমি ঠিক এটাই জানতে চেয়েছিলুম। কফি শেষ করে নাও। তারপর আমরা বেরুবো। পায়ে হেঁটে গেলে ততবেশি দূর নয়। কারণ আমি মুনলাইটে ঢুকতে চাই ঠিক সাড়ে ছটায়। তবে গাড়ি সঙ্গে থাকলে সুবিধা হয়। আমরা তো জানি না কখন আমাদের সামনে কী ঘটনা ঘটবে বলে অপেক্ষা করে আছে। তোমাকে আমার সামরিক জীবনের একটা গল্প এ প্রসঙ্গে শোনাতে পারি।

দ্রুত বললুম, নাঃ কর্নেল। এখন গল্প শোনার মুড আমার নেই।

কর্নেল আবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, এখনও ছটা বাজেনি। তবে আমরা নীচে গিয়ে খোলামেলা আকাশের নীচে একটু অপেক্ষা করতেই পারি। চলো ওঠা যাক।

আমরা দুজনে উঠে দাঁড়িয়েছি এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিয়ে বললেন, কী আশ্চর্য! ঠিক আছে তোমাকে কষ্ট করে আসতে হবে না। তুমি বরং ওখানেই অপেক্ষা করো। মানে–যেন তুমি তার জন্যই অপেক্ষা করছ। এতে তোমার পক্ষ থেকে উৎসাহটাই প্রকাশ পাবে…. নো প্রবলেম। সব কিছু ঠিক আছে।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে কর্নেল রিসিভার রেখে বললেন, তোমার কৌতূহল হচ্ছে কিন্তু এখন আমি তোমার কোনো প্রশ্নের উত্তর দেব না। যথাসময়ে তুমি সবই টের পাবে।

ষষ্ঠীকে ডেকে সতর্ক করে দিয়ে কর্নেল ড্রয়িংরুম থেকে বেরুলেন। তেতলার সদর দরজায় যে ল্যাচ-কি আছে সেটা ভেতর থেকে খুলে বাইরে বেরুনো যায়। কিন্তু বাইরে থেকে ঢুকতে হলে চাবি ছাড়া ঢোকা যায় না।

নীচের লনে গিয়ে বললুম, কর্নেল, গাড়ি নিয়ে এখনই বেরিয়ে পড়া যাক। বরং গঙ্গার ধারে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ঠিক সাড়ে ছটায় আমরা মুনলাইট বারে চলে আসব। আজ রবিবার। তত বেশি গাড়ির উপদ্রব নেই।

কর্নেল বললেন, ঠিক আছে। তাই চল।

আমরা পার্ক স্ট্রিট ধরে সোজা এগিয়ে তারপর পনেরো মিনিটের মধ্যেই আউট্রাম ঘাটের কাছে পৌঁছলুম। সেখানে দাঁড়িয়ে কর্নেল বললেন, অনেকদিন গঙ্গা দর্শন করিনি। তোমার ইচ্ছায় আমার কিছু পুণ্যলাভ হল।

বললুম, কাল আমি আর সৌমেন সন্ধ্যায় ওই বেঞ্চটায় বসেছিলুম। কাল এখানে তত ভিড় ছিল না। আজ রোববারে দেখছি প্রচণ্ড ভিড়।

সূর্যাস্তের পর গঙ্গার বুকে বেশ কিছুক্ষণ একটা গাঢ় রক্তিম উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছিল। কর্নেলের চুরুটটা শেষ হয়ে এসেছিল। তিনি চুরুটটা মাটিতে ফেলে জুতোর তলায় ঘষটে নিভিয়ে ফেললেন। তার পর বললেন, এবার ফেরা যাক। এবার বরং রেসকোর্সের পাশ দিয়ে ঘুরে আস্তে ড্রাইভ করো। রবীন্দ্রসদনের সামনে ঘুরে তারপর চৌরঙ্গীতে পড়া যাবে। মুনলাইট বারের কাছাকাছি কোথাও গাড়ি রাখবে।

কর্নেলের হিসেব মতো যখন মুনলাইট বারের সামনে পৌঁছলুম তখন ঠিক সাড়ে ছটা-ই বাজে। গাড়ি পার্কিং করতে হল একটু দূরে। কারণ বাঁদিকে সারবদ্ধ। গাড়ির লাইন। মুনলাইট বার একসময় ছিল আয়তনে ছোট। এখন আয়তনে বিস্তৃত হয়েছে। আলোর অবস্থা বারের ভিতরটা রহস্যময় করে রাখে।

ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল হালদারমশাই ফুটপাতে একটা থামে হেলান দিয়ে বারের দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন।

তিনি আমাদের দেখতে পেয়েই অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গেলেন। কর্নেল তার দিকে তাকালেন না। কিন্তু আমার চোখে চোখ পড়তেই হালদারমশাই গুলি গুলি চোখে তাকিয়ে কী যেন বলতে চাইলেন। কিন্তু আমি গম্ভীর মুখে কর্নেলকে অনুসরণ করলুম।

বারের ভিতরে আলো-অন্ধকারে সত্যিই একটা রহস্যময় পরিবেশ লক্ষ করলুম। কর্নেলকে দেখে একজন ওয়েটার স্যালুট ঠুকে কয়েকটা টেবিলের পর একটা খালি টেবিলের কাছে নিয়ে গেল। কর্নেল তাকে বললেন, দো বিয়ার, ব্যস!

আজ বারে ভিড় থাকা স্বাভাবিক। এই ছোট টেবিল আর দুপাশে দুটো চেয়ার যে কর্নেলের খাতিরেই রাখা হয়েছে তা বোঝা গেল।

কর্নেল ভিতরটা দেখে নিয়ে আমার দিকে একটু ঝুঁকে এসে চাপাস্বরে বললেন, আমার পিছনে দুটো টেবিল পরে কে বসে আছে লক্ষ করো।

কর্নেলের কথামতো সেদিকে তাকিয়েই ভীষণ চমকে উঠলাম। একী! জলজ্যান্ত সৌমেন বসে আছে। তার সঙ্গী নীল শার্টপরা ফর্সা রঙের এক ভদ্রলোক।

.

০৬.

আমি নিস্পলক তাকিয়েছিলুম। কর্নেল ভ্রু কুঁচকে বললেন, বিয়ার আসছে। ওদিকে আর তাকাবে না। সাবধানে।

একটু পরেই সেই ওয়েটার দুবোতল বিয়ার আর দুটো জগ রেখে গেল। কর্নেল তার জগে বোতলটা সাবধানে উপুড় করে ভর্তি করে নিলেন। দেখাদেখি আমিও তাই করলুম। এ মুহূর্তে ফেনিল এই পানীয় আমার নার্ভকে শান্ত করার জন্য জরুরি ছিল। কয়েক চুমুক খাওয়ার পর এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলুম কর্নেল তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরনোর সময় সৌমেনই তাকে ফোন করেছিল।

কিন্তু সমস্যা হল তাহলে ফিল্মনায়িকা চন্দ্রিমার ঘর থেকে কে ফোন করেছিল? সে যদি সত্যিই তমাল বোস হয় এবং লালবাজারের সাহায্যে কর্নেলের ফাঁদ পাতার ব্যাপারটা জেনে থাকে তাহলে তার তো এদিকে পা বাড়ানোর কথাই নয়।

আমি চাপাস্বরে বললুম, কর্নেল, তখন তমাল বোসের ফোন করার ব্যাপারটা আমাকে থামিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন, কোনো কথা নয়। চুপচাপ বিয়ার শেষ করো। আর যা কিছুই ঘটুক, তুমি যেন এক জগ বিয়ার খেয়েই মাথা খারাপ করে ফেলো না।

ফিল্মনায়িকা চন্দ্রিমার ঘর থেকে লোকটিই যদি ফোন করে থাকে তাহলে সে কোন সাহসে এখানে এল। প্রশ্নটা মাথায় মাছির মতো ভনভন করছিল। তা ছাড়া জগের অর্ধেক ততক্ষণে গিলে ফেলেছি। একটু-আধটু নেশা যে হয়েছে তা অস্বীকার করব না। আমি আবার একটু ঝুঁকে গিয়ে বললুম, কর্নেল, বারে লালবাজারের লোকেদের থাকার কথা অন্তত নরেশবাবু তো থাকবেনই। তাকে তো দেখতে পাচ্ছি না। আপনি কি মিঃ লাহিড়ীকে সব কথা বলে তাদের চলে যাবার ব্যবস্থা করেছেন?

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন তোমার ডান দিকে তিনটে টেবিলের পর নরেশবাবু বসে আছেন। কিন্তু তোমাকে বারবার বলছি ও সব কথা নয়।

ডাইনে তাকিয়ে নরেশবাবুর খোঁজ করলুম। আবছা আলোয় তাঁকে দেখতে পেলুম। তাঁর দৃষ্টি কোনাকুনি সৌমেনের উল্টোদিকে বসা লোকটার দিকে।

আরও কিছুক্ষণ কেটে গেল। তার পর আমি সৌমেনের টেবিলের দিকে তাকালুম। দেখলুম তার সঙ্গী শিস দিয়ে একজন ওয়েটারকে ডেকে কিছু জিগ্যেস করল। সে কয়েক পা এগিয়ে ইশারায় ওদিকটা দেখিয়ে কিছু বলল।

এই বার আমার চেনা। বুঝতে পারলুম সৌমেনের সঙ্গী বাথরুমে যাবে সে উঠে ঘরের শেষ দিকে বাঁদিকে ঘুরে অদৃশ্য হল। আমি চুপিচুপি কর্নেলকে বললুম, নীল শার্ট বাথরুমে গেল।

কর্নেল একবার পিছন ফিরে দেখে গম্ভীর মুখে বিয়ারে চুমুক দিলেন।

বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। কিন্তু সৌমেনের সঙ্গীকে ফিরে আসতে দেখলুম না। আরও একটু পরে নরেশবাবু উঠে এসে ইচ্ছাকৃতভাবে আমার ডান হাতে চিমটি কেটে সোজা এগিয়ে গেলেন। তার পর তিনি বাথরুমের দিকেই উধাও হলেন।

নরেশবাবু ফিরতে দেরি করছিলেন তারপর জোরালো হুইসলের শব্দ কানে এল।

সঙ্গে সঙ্গে বারের ভিতর এদিক-ওদিক থেকে কয়েকজন লোক বাথরুমের দিকে ছুটে গেল। এতে বারের ভিতর একটা চাপা চাঞ্চল্য লক্ষ করলুম। কেউ জড়ানো গলায় বলে উঠল, এটা কি ফুটবল খেলার মাঠ বাবা যে হুইসল দিচ্ছ?

আরেকজন তেমনি জড়ানো গলায় বলল, মাইরি, সত্যি এটা খেলার মাঠ হয়ে গেল। প্লেয়াররা দৌড়চ্ছে। কে কাকে গোল দিল রে বাবা!

আমি সৌমেনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সে যে চঞ্চল হয়ে উঠেছে তা বুঝতে পারছিলুম। বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল সে। তার পর এদিকে ঘুরে আমাকে এবং কর্নেলকে দেখামাত্র উঠে দাঁড়াল। আমি হাত তুলে ইশারায় তাকে ডাকলুম।

সৌমেন আমাদের টেবিলের কাছে এসে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, ভদ্রলোককে প্ল্যানমতো পুলিশ ধরতে পেরেছে কি না দেখে আয় জয়ন্ত।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি আর জয়ন্ত শিগগির সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাও। তার পর জয়ন্তের গাড়িতে উঠে বসবে। জয়ন্ত, তুমি সৌমেনকে নিয়ে সোজা আমাদের ডেরায় চলে যাবে। কুইক।

সৌমেনের হাত ধরে বেরিয়ে যাবার সময় পিছন দিকে কেউ ইংরেজিতে বলে উঠল, ব্যাক ডোর দিয়ে পাখি পালিয়েছে।

ঘুরে দেখলুম বারের ম্যানেজার মিঃ ডিসুজা কর্নেলের দিকে হাত নেড়ে সহাস্যে বলছেন, কর্নেল সরকার, প্লিজ, ডোন্ট থিঙ্ক দ্যাট এনি অফ আওয়ার ম্যান হ্যাঁজ হেল্পড দ্য ব্লু শার্ট।

সৌমেনের হাত ধরে বেরিয়ে দেখলুম হালদারমশাই দরজার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আমাদের দেখে নিজস্ব রীতিতে বলে উঠলেন, হালায় ধরছে?

বললুম, জানি না। আপনি কর্নেলের জন্য অপেক্ষা করুন। আমি সৌমেনকে, নিয়ে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে যাচ্ছি।

গোয়েন্দাপ্রবর গুলি গুলি চোখে দাঁড়িয়ে রইলেন। বোঝা গেল তিনি আমার সঙ্গে সৌমেনকে দেখে বারের ভিতরে ঠিক কী ঘটছে তা বোঝার চেষ্টা করছেন।

সৌমেনকে গাড়ির পিছনে বসতে বললুম। সে আমার কথার অর্থ বুঝতে পেরেছিল। তাই দুদিকের জানলার কাঁচ তুলে দিল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেলাম।

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে সৌমেনকে নিয়ে পৌঁছনোর পর ষষ্ঠীচরণকে বললুম, আমাদের জন্য দুকাপ চায়ের লিকার নিয়ে এস।

ষষ্ঠীচরণ সৌমেনের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে চলে গেল। এবার বললুম, নীল শার্ট তোকে কি হুইস্কি খাওয়াচ্ছিল?

সৌমেন তখনও ধাতস্থ হতে পারেনি। সে গলার ভিতরে বলল, হ্যাঁ, আমি এক পেগ হুইস্কির একটুখানি খেয়েছি। কারণ প্রতি মুহূর্তেই আমি অপেক্ষা করছিলুম আমাদের দুজনকেই পুলিশ অ্যারেস্ট করবে।

বললুম, ব্যাপারটা আমার কাছে আগে খুলে বল। তোর কথা ছিল তুই ট্যাক্সি করে এখানে আসবি আর আমি তোকে মুনলাইটে পৌঁছে দেব। তোর বাড়িতে ফোন করেছিলুম, তখন প্রায় চারটে বাজে কিংবা তারও একটু আগে। সময়টা মনে নেই। তোর মা বললেন, সৌমেন বেরিয়ে গেছে। হ্যাঁ, তার আগে তোর অফিসে বারোটা নাগাদ একটা ফোন করেছিলাম। শুনলুম তুই অফিসে এসেই আবার বেরিয়ে গেছিস।

সৌমেন বলল, আমি অফিস থেকেই উড়ো চিঠিতে লেখা ফোন নাম্বারে ভদ্রলোককে আবার ফোন করেছিলাম। উনি আমাকে বলেছিলেন, আপনার ভয়ের কোনো কারণ নেই আর আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী। কাজেই আপনি আগেই সোজা আমার কাছে চলে আসুন।

জিগ্যেস করলুম, সেটা কোথায়?

বালিগঞ্জ প্লেসে। কিন্তু যাওয়ার আগে আমি বাড়ি গিয়েছিলুম। মাকে শুধু জানিয়ে আসতে চেয়েছিলুম যদি রাত্রে আমার ফিরতে দেরি হয় তাহলে এই নাম্বারে কর্নেল সাহেবের কাছে ফোন করো। কিন্তু মা আমাকে বললেন, তোর মৃগাঙ্ককাকু এসেছিল। তার কাছে একটা কথা শুনে

আমি দ্রুত বললুম, জানি। মৃগাঙ্ক চৌধুরিই গোপন ব্যাপারটা জানার পর তোর মাকে বলেছিলেন। তোর মা তখনই লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে ফোন করে সব কথা খুলে বলেছিলেন। কিন্তু তার আগেই কর্নেল লালবাজারকে একই কথা বলে রেখেছিলেন। অর্থাৎ মুনলাইটে সাদা পোশাকে এস আই নরেশ ধর এবং কয়েকজন কনস্টেবল উপস্থিত থাকবে।

ষষ্ঠী চা নিয়ে এল। তারপর সেইরকম সন্দিগ্ধ মুখে চাপাস্বরে আমাকে জিগ্যেস করল, বাবামশাইকে কোথায় রেখে এলেন?

একটু হেসে বললুম, টিকটিকিবাবুর সঙ্গে তিনি পার্ক স্ট্রিটে আড্ডা দিচ্ছেন। চিন্তা কোরো না, যে কোনও সময় তিনি এসে পড়বেন।

ষষ্ঠী চলে গেল। তারপর সৌমেন বলল, মাকে একটু বকাবকি করেছি। কারণ মায়ের এই বাড়াবাড়িতে আমার ক্ষতির আশঙ্কা ছিল।

চায়ের লিকারে চুমুক দিয়ে বললুম, তার পর তুই কি বালিগঞ্জ প্লেসে তমাল বোসের কাছে গিয়েছিলি?

সৌমেন বলল, হ্যাঁ, ভদ্রলোকের নাম যে তমাল বোস তা আমি কিছুক্ষণ পর জানতে পারলাম। যে বাড়িতে আমি গিয়েছিলুম সেটা অবশ্য তমালবাবুর বাড়ি নয়। ওটা একটা ফিল্মস্টারের বাড়ি। তার নাম চন্দ্রিমা। অবশ্য আমিই রিস্কটা নিতে ভয় পাচ্ছিলুম। কারণ কর্নেল সাহেবের চেয়ে পুলিশ আমার মতে আনপ্রেডিক্টেবল এলিমেন্ট। তাই ঝামেলায় যাতে পড়তে না হয়, তমালবাবুকে বারের ভিতরে পুলিশ থাকার কথা জানিয়ে দিয়েছিলুম। কিন্তু ভুল অবশ্যি হয়েছিল মায়ের নাম না করে আমি তোর কথা তুলে সেই সূত্রে কর্নেল সাহেবের কথা বলেছিলাম। তমালবাবু প্রথমে ভেবেছিলেন আমি তোদের এসব কথা বলেছি। তাই মৃগাঙ্ককাকুর কথা তুলে তমালবাবুকে বলেছিলুম মৃগাঙ্ককাকুই কর্নেল সাহেবকে আপনার কথা বলেছেন।

জিগ্যেস করলুম, তোর এই মৃগাঙ্ককাকু কীভাবে তোর এই গোপন কথাটা জানতে পেরেছিলেন? তিনি তোর মাকে সেই কথা বলতে গিয়েছিলেন। এতে বোঝা যাচ্ছে তিনি সম্ভবত তোর বাবার বন্ধু অথবা কোনো সূত্রে আত্মীয়।

সৌমেন বলল, মৃগাঙ্ক চৌধুরি ফিল্মলাইনের লোক। উনি একজন বিখ্যাত চিত্র-প্রযোজক। তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস চন্দ্রিমার সূত্রেই তিনি কথাটা জানতে পেরেছিলেন। এর কারণ আমি তার ঘরে বসেই লক্ষ করছিলুম চন্দ্রিমা তমালবাবুর উপর বিরক্ত। সে বারবার উঠে যাচ্ছিল আর আবার এসে কথা শুনছিল।

বললুম, তাহলে বোঝা যাচ্ছে চন্দ্রিমা মৃগাঙ্কবাবুকে গোপন কথাটা জানিয়েছে তারপর শেষ পর্যন্ত তমালবাবুকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছে যাতে তিনি মুনলাইট বারে না যান।

সৌমেন বলল, আমিও তাকে নিষেধ করেছিলুম। ভদ্রলোকের ব্যবহার কিন্তু বেশ মিষ্টি।

কিছুক্ষণ পরে তিনি বলেছিলেন মুনলাইট বারে পুলিশ এবং কর্নেল সাহেবের উপস্থিত থাকার সম্ভাবনা আছে। সেটা একটু যাচাই করে দেখা যাক। বলে তিনি টেলিফোনের রিসিভার তুলে কর্নেল সাহেবকে ফোন করেছিলেন।

ফোন নাম্বার নিশ্চয়ই তুই দিয়েছিলি?

ফোন নাম্বার দিয়ে নিশ্চয় আমি কিছু ভুল করিনি। কারণ আমার মনে হয়েছিল লোকটা নিজেই যদি কর্নেলের সঙ্গে এভাবে জড়িয়ে পড়ে, আমার গায়ে। কোনও আঁচড় লাগবে না। তুই চিন্তা করে দেখ জয়ন্ত, লোকটাকে বারবার আমি অনুরোধ করছি আমাকে তার যা বলার কথা, তিনি এখানেই তো বলতে পারেন। বারে যাওয়ার দরকারটা কী! কিন্তু শেষ অবধি আমার মনে হয়েছিল লোকটা অত্যন্ত ধূর্ত অথবা একেবারে বোকার ধাড়ি। আমার সামনেই টেলিফোনে

তার কথার উপর বললুম, সব আমি জানি কারণ কর্নেল বেডরুমে যে টেলিফোনে তার কথার উত্তর দিচ্ছিলেন সেই টেলিফোনের এক্সটেনশন লাইন ড্রয়িংরুমে রয়েছে। তাই আমি দুই পক্ষের সব কথা শুনেছি। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না তবু কোন সাহসে তমাল বোস বারে তোকে নিয়ে এল।

সৌমেন বাঁকা হেসে বলল, এই জন্যই তো বললুম তমাল বোস ধূর্ত কিংবা বোকা। কর্নেলকে টেলিফোন করার পর রিসিভার রেখে আমাকে হাসতে হাসতে বলল, মুনলাইট বারে পুলিশ এবং ওই কর্নেল ভদ্রলোকের থাকার কথা আমি জেনে গেছি। কাজেই কলে লালবাজারে জানিয়ে দেবেন যে শিকারকে ফাঁদে ফেলা যাবে না। তারপর সত্যিই তমালবাবু যখন আমাকে বললেন চিন্তার কোনো কারণ নেই, মুনলাইট বার নিরাপদ করে দিয়েছি আমি ইতস্তত করে তাঁকে বলেছিলুম, আপনি এত সিওর হচ্ছেন কী করে? তমালবাবুর মতে কোনো ঘুঘু যখন জেনে যায় ওখানে ফাঁদ পাতা আছে এবং ঘুঘুশিকারিও যদি সে কথা জানতে পারে তা হলে সে ফঁদ পেতে সময় নষ্ট করবে কেন? তবু আমি তমালবাবুকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছিলাম। বলেছিলাম, কথাগুলো কি এখানেই বললে চলে না? তমালবাবু আমাকে অবাক করে বলেছিলেন, ব্রাদার, আমাদের মধ্যে যে কথা। হবে তাতে একজন তৃতীয় পক্ষও থাকবে। তাকেও সন্ধে ছটায় বারে থাকতে বলেছি।

হাসতে হাসতে বললুম, সেই তৃতীয় পক্ষ কি বারে এসেছিল?

সৌমেন বলল, না। তারপরই তমাল বোস কর্নেল সাহেবকে ঢুকতে দেখে চাপাস্বরে আমাকে বলেছিলেন, সৌমেনবাবু, আমার মনে হচ্ছে অন্যপক্ষ আমার চেয়ে বেশি ধূর্ত। কারণ তোমার মুখে কর্নেলের চেহারার যে বিবরণ শুনেছি তাতে আমার মনে হচ্ছে সেই বুড়ো ঘুঘুশিকারি এসে গেছে। বলে তমাল বোস একজন ওয়েটারকে ডেকে বাথরুমের কথা জেনে নিল। তার পর যা ঘটেছে, তুই সব দেখেছিস জয়ন্ত।

ততক্ষণে আমাদের চা খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। কর্নেলের জন্য এতক্ষণে একটু উদ্বিগ্ন হলুম। তিনি এখনও আসছেন না কেন! তা ছাড়া তমাল বোসের নামে পুলিশে তো কোনো কেস নেই, শুধু দিল্লিতে এক ভদ্রমহিলার হত্যাকাণ্ড এবং সেই সূত্রে সৌমেন আর আমাকে জড়িয়ে পুলিশ হত্যারহস্যটা ফাঁস করতে চায়। নাকি তমাল বোসই মিসেস শালিনীর হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জড়িত বলে পুলিশ কোনো সূত্র পেয়েছে? এমন হতে পারে কর্নেলও নরেশবাবুর কাছে আমার অজ্ঞাতসারে সেকথা জানিয়েছেন। তাই তিনি এত বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছেন।

সেই সময় ডোরবেল বাজল। আমি জানি ষষ্ঠী পিছনের করিডর দিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেবে। তাই সোফায় হেলান দিয়ে বসলুম। সৌমেন চাপাস্বরে বলল, আমার কেন জানি অস্বস্তি হচ্ছে।

আস্তে বললুম, বি স্মার্ট। ইংরেজি কাগজের রিপোর্টার তুই। কথাটা ভুলিস না।

পর্দা তুলে প্রথমে কর্নেল, তার পিছনে হালদারমশাই ঘরে ঢুকলেন।

হালদারমশাই আমাদের পাশ দিয়ে এগিয়ে সোফায় বসলেন। তারপর খি খি। করে একটু হেসে বললেন, কী একখান ঘটল চিন্তা করা যায় না।

কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে মাথার টুপি খুলে টেবিলে রাখলেন। তার পর রুমাল। বের করে প্রথমে টাক পরে মুখ মুছে দাড়ি ঝাড়লেন। বললেন, তমাল বোস ভাবতে পারেনি যে তার কথায় আমি পিছিয়ে যাব।

বললুম, তমাল বোসের পিছনে আপনি কি দৌড়াদৌড়ি করছিলেন এতক্ষণ? হালদারমশাই বলে উঠলেন, কর্নেল স্যার জানতেন তমালবাবুর গাড়ি সামনের ফুটপাতেই রাখা আছে। তিনি অবশ্য দৌড়ান নাই। আমারে কইছিলেন নীল শার্ট পরা এক ভদ্রলোক এই সামনের কোনো গাড়িতে উঠতে পারেন। তারে ধরতে হইব। আমি কথাটা শুইন্যাই লক্ষ রাখছিলাম। তারপর দেখলাম সেই লোকটা দৌড়াইয়া একখান লাল গাড়িতে উঠল, তার পর উধাও হইয়া গেল।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, তমাল বোস বেরিয়ে গেছে কিচেনের দরজা দিয়ে। ওপাশে একটা গলি আছে। তবে আমি ভেবেছিলুম গাড়ি চেপে আসার রিস্ক সে নেবে না, ট্যাক্সিতেই সে আসবে। কাজেই তাকে পাকড়াও করা সহজ হবে।

সৌমেন একটু কেশে বলল, প্রথমে ভদ্রলোক ট্যাক্সি চেপেই আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি ওঁর মতো নির্বোধরাই বড্ড বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়।

কর্নেল বললেন, লোকটা আমাকে টেলিফোন করেছিল। বলেছিল তোমাকে সে মদের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে।

সৌমেন একটু হেসে বলল, নাঃ। জয়ন্ত আমাকে সব বলেছে। ফিল্মস্টার চন্দ্রিমার ফ্ল্যাটেই আমাকে ডেকেছিলেন তমালবাবু। তবে আমি কথাবার্তা সবই শুনেছি। কিন্তু আমি জানতুম আপনি চুপচাপ বসে থাকবেন না।

এবার ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে চার পেয়ালা কফি আর দুপ্লেট স্ন্যাকস এনে রাখল। তারপর এঁটো চায়ের কাপপ্লেট তুলে নিয়ে চলে গেল।

কফি খেতে খেতে বললুম, সৌমেন বলছে মুনলাইট বারে তমাল বোসের যাওয়ার কারণ সেখানে নাকি আর একজন লোকের আসার কথা ছিল।

কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে কিছুক্ষণ পরে বললেন, আমি তাকে না চিনলেও স্পেশাল ব্রাঞ্চের একজন এস আই দুজন সঙ্গী নিয়ে বারে একটা লোকের জন্য অপেক্ষা করছিল। তমাল বোসের পিছনে যখন নরেশবাবুরা এগিয়ে গেছেন তখন লাল শার্ট আর টাই পরা একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক গেলাস খালি না করেই কাউন্টারে গিয়ে বিল মিটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। তার পরই দেখলুম তাঁকে তাগড়াই চেহারার তিনজন তোক ঘিরে ধরেছে। তারা তাকে টানতে টানতে বের করে নিয়ে গেল। সে এক ধুন্ধুমার অবস্থা। যাই হোক, যখন নরেশবাবু ও তার লোকেরা বারের সামনের দিকে এগিয়ে এলেন তখন আমি নরেশবাবুকে জানিয়ে দিলুম, পাখি উড়ে গেছে। তার গাড়ির নাম্বারটা আমার মুখস্থ হয়ে আছে। কিন্তু আপনাদের স্পেশাল ব্রাঞ্চের করিম সাহেব কাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেলেন? নরেশবাবু বললেন, লোকটার নাম ভানুপ্রতাপ সিংহ। সে নাকি দিল্লির লোক। যথাসময়ে সব জানতে পারব। আমি এ ব্যাপারটা তত জানি না।

.

০৭.

কর্নেলের কথা শুনে আমি ও সৌমেন দুজনেই চমকে উঠেছিলুম। সৌমেন বলল, ভানুপ্রতাপ সিংহ, সে তো মিঃ নেহালিয়ার দিল্লি অফিসের ম্যানেজার। আমার সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল।

আমি বললুম, মিসেস শালিনীর হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারেই সম্ভবত দিল্লি পুলিশ লালবাজারের সাহায্য চেয়েছে। কর্নেল ডিসি ডিডি মিঃ লাহিড়ীর কাছে নিশ্চিয় সবকিছু জানতে পারবেন।

কর্নেল ঘড়ি দেখে নিয়ে বললেন, সৌমেনকে মিঃ হালদার নিউ আলিপুরে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এলে ভালো হয়।

হালদারমশাই বললেন, আমি রেডি।

কিন্তু সৌমেন বলল, আমি একটা ট্যাক্সি ধরে চলে যাব। তমালবাবুর আর সাহস হবে না আমার জন্য গুণ্ডা লেলিয়ে দেওয়ার।

আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, তোর মাসতুতো ভাই অর্কের পিছনে লোকটা গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়েছিল, সে খবর তুই জানিস?

সৌমেন অবাক হয়ে বলল, না তো! অর্কের সঙ্গে তমালবাবুর বিরোধ কীসের?

একটু হেসে বললুম, অর্কের সঙ্গে তোর কোনও যোগাযোগ নেই?

 সৌমেন বলল, অর্ক ছোটবেলা থেকেই একটু গোঁয়ার। তা ছাড়া আমাদের প্রতি তার মায়ের মতোই কেমন একটা নির্লিপ্ত ভাব ছিল।

হালদারমশাই বলে উঠলেন, আপনার মাসিমা গায়ত্রীদেবী আমার ক্লায়েন্ট। তমাল বোসের লগে তার পোলার ভীষণ শত্রুতা। গতকাল সন্ধ্যায় অর্কবাবুকে তমাল বোসের ভাড়াটে গুণ্ডা অ্যাটাক করছিল। অর্কবাবু জোর বাইচ্যা গেছেন। গুলি লাগছিল অর্কবাবুর গাড়ির পিছনের কাছে। আর একখান গুলি জানলার নীচ দিয়া লাগছিল।

সৌমেন বলল, এ তো ভারি অদ্ভুত ঘটনা! আপনি তাহলে মাসিমাকে কেন বলছেন না তমাল বোসের নামে থানায় এফ আই আর করতে!

কর্নেল বললেন, আমি এই জন্যেই বলছিলুম হালদারমশাই তোমার সঙ্গে যেন যান। ওঁর কাছে তুমি তমাল বোসের অন্য ভূমিকাটাও জেনে নিতে পারবে। তোমার মা হয়তো ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে আবার লালবাজারে ফোন করতে পারেন।

হালদারমশাই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কর্নেল স্যার ঠিক কইছেন। চলেন, চলেন। আপনার মায়ের লগেও দেখা করুম। আফটার অল অর্ক তাঁর বোনের পোলা।

সৌমেন অগত্যা উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, জয়ন্ত, আমি বরং কর্নেল সাহেবের সঙ্গেই যোগাযোগ রেখে চলব। তমাল বোসকে পুলিশ ধরতে পারেনি। কাজেই তার দিক থেকে আমার বিপদের আশঙ্কা আছে।

আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সৌমেন হালদারমশায়ের সঙ্গে বেরিয়ে গেল। তারপর কর্নেল বললেন, জয়ন্ত, পোশাক বদলে এস। আমিও হালকা হয়ে আসি।

উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, নরেশবাবুকে আপনার বলা উচিত ছিল বারে ঢোকা মাত্র যেন তমাল বোসকে পাকড়াও করেন। খামোখা ওকে অতটা সময় দেওয়া ঠিক হয়নি।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, আমার প্ল্যানে কোনো ভুল ছিল না। সৌমেনকে তমাল বোস যে গোপন কথা বলবে সেকথাটার জন্যই আমরা অপেক্ষা করছিলুম। এখন দেখা যাচ্ছে ধূর্ত তমাল বোস সৌমেনকে তার গোপন কথা বলতে সময় নিচ্ছিল। এদিকে দিল্লির ভানুপ্রতাপ সিংহ সম্ভবত প্রতীক্ষা করছিল কখন তাকে তমাল বোস তার টেবিলে ডাকবে। জয়ন্ত, আমার ধারণা ওরা দুজনে সৌমেনের সাহায্যে মিঃ নেহালিয়ার কাছ থেকে কিছু আদায় করতে চায়।

বললুম, আপনি ব্ল্যাকমেল করার কথা বলছেন?

কর্নেল চিন্তিত মুখে বললেন, হ্যাঁ, সেটাও হতে পারে। তবে মিঃ নেহালিয়ার কাছে ওরা দুজনে একটা বড়ো দাও মারতে চেয়েছিল। এখন দেখা যাক, ভানুপ্রতাপকে জেরা করে পুলিশ কী বের করতে পারে।

বললুম, পুলিশ তো ওকে দিল্লি পুলিশের হাতে তুলে দেবে।

কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, তার আগে লালবাজার ওকে আজ সারা রাত জেরা করবে।

কর্নেল আস্তেসুস্থে নিজের ঘরে চলে গেলেন। আমিও এলুম আমার ঘরে। আগে পকেট থেকে ফায়ার আর্মসটা বের করে বিছানায় বালিশের তলায় রেখে। দিলুম। তারপর প্যান্টশার্ট ছেড়ে বাথরুমে গেলুম।

মার্চ মাসে কলকাতায় গ্রীষ্মের আভাস পড়েছে। কিন্তু রাতের দিকে ক্রমশ ঠান্ডাটা আরামদায়ক হতে হতে সহ্যের বাইরে চলে যায়। তাই ফ্যানের স্পিড কমিয়ে শুতে হয় এবং শেষ রাতে চাদর মুড়ি দিতে হয়।

পোশাক বদলে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি কর্নেল কার সঙ্গে কথা বলছেন। আমি তাঁর কাছাকাছি পৌঁছনোর আগেই তিনি রিসিভার রেখে সোজা হয়ে বসলেন। আমি সোফায় হেলান দিয়ে বসলুম। কর্নেলের দিকে তাকিয়ে দেখলুম তিনি চোখ বুজে সাদা দাড়িতে হাত বুলোচ্ছেন।

জিগ্যেস করলুম, আবার কিছু সিরিয়াস খবর এসেছে বুঝি?

কর্নেল চোখ খুলে বললেন, অরিজিৎকে ফোন করেছিলুম। ভানুপ্রতাপ সিংহ নিজেকে সুরজদাস নেহালিয়ার কোম্পানির লোক বলে পরিচয় দিয়েছে। তাই অরিজিৎ মিঃ নেহালিয়াকে টেলিফোনে ডেকেছে। দেখা যাক, কী হয়। আমি অরিজিৎকে অনুরোধ করলুম, কাল সকালে আমাকে যেন ঘটনাটা জানায়। অবশ্যি এও বললুম যদি তার পেশার দিক থেকে কোনো অসুবিধা থাকে, তাহলে আমি জানতে পীড়াপীড়ি করব না।

ষষ্ঠী এসে বলল, খাবার সময় হয়ে গেছে। দশটা বাজে।

 কর্নেল উঠে বললেন, চলো। খেয়েদেয়ে ষষ্ঠীকে বিশ্রাম দেওয়া যাক।

কর্নেল কয়েক পা এগিয়ে গেছেন, আমিও পা বাড়িয়েছি, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল বিরক্ত হয়ে বললেন, আঃ জ্বালাতন! জয়ন্ত, ফোনটা ধরো। যেই হোক শর্টে কথা সেরে নেবে কিংবা সকালে ফোন করতে বলবে।

আমি রিসিভার তুলে সাড়া দিতেই তার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

বললুম, আপনি কে বলছেন জানতে পারি?

–আমি অর্ক মুখার্জি, ভবানীপুর থেকে বলছি।

–আপনি যদি শর্টে কিছু জানাতে চান, আমাকে বলতে পারেন। কর্নেল এখন খুব ব্যস্ত।

–আপনি কে বলছেন?

–আমি জয়ন্ত চৌধুরি।

-আই সি। জয়ন্তবাবু, আপনার নামও আমি শুনেছি। কর্নেল সাহেব যদি সত্যি ব্যস্ত থাকেন, প্লিজ তাকে বলবেন কাল সকাল নটার মধ্যে আমি একটা জরুরি ব্যাপারে তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমার সঙ্গে থাকবেন ফিল্ম ওয়ার্ল্ডের একজন নামী লোক মিঃ মৃগাঙ্ক চৌধুরি। কর্নেল সাহেবকে বলবেন আমার নিউ আলিপুরের মাসিমা সুনন্দা চন্দ্র তাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে বলেছেন। কর্নেল সাহেব মাসিমাকে চেনেন।

–এক মিনিট। বলে মাউথপিসে হাত চাপা দিয়ে কর্নেলকে কথাটা বললুম।

কর্নেল বললেন, ঠিক আছে। আসতে বলো।

 আমি অর্ককে বললুম, ঠিক আছে। আপনারা কাল সকাল নটায় আসবেন।

থ্যাঙ্কস! মেনি থ্যাঙ্কস জয়ন্তবাবু। বলে অর্ক লাইন কেটে দিল।

 যেতে যেতে বললুম, আমি কিন্তু আজ সারাদিনই ভাবছিলুম যে কর্নেল কেন অর্কের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন না।

 কর্নেল মৃদু স্বরে বললেন, কুমার বাহাদুরের সঙ্গে দেখা করে এসেছি। অর্কের মায়ের সঙ্গেও কথা বলে এসেছি। কাজেই আমি জানতুম কোনো এক সময়ে অর্ক নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবে। কেউ যত সাহসীই হোক, তার অবচেতনায় মৃত্যুভয়, থাকতে বাধ্য। বিশেষ করে যদি তাকে কেউ হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করে তাহলে তো কথাই নেই। যাই হোক, আর এসব কথা নয়। খাবার টেবিলে আমি কথা পছন্দ করি না তুমি তো জানো। আপাতত মাথা থেকে সব মুছে দাও। এখন খাওয়া তারপর ঘুম। জয়ন্ত, ঘুম মানুষের স্নায়ুকে ধারাল অস্ত্রের মতো শান দিয়ে রাখে।

খাওয়ার পর সে রাতে কর্নেল অভ্যাসমতো ড্রয়িংরুমে গিয়ে চুরুট টানতে বসলেন না। লক্ষ করলুম তিনি বেডরুমে ঢুকে পড়লেন। আমিও বেডরুমে ঢুকে শুয়ে পড়লাম।

পরদিন সকাল আটটায় ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখলুম কর্নেল তখনও তার ছাদের বাগান থেকে নেমে আসেননি। ষষ্ঠী অনেকগুলো খবরের কাগজ সেন্টার টেবিলে রেখে মুচকি হেসে বললল, বাবামশাই বলে গিয়েছিলেন একটা কাঁটাগাছে বজ্জাত পোকার উপদ্রব হয়েছে। মনে করিয়ে দিইনি বলে আমাকে বকাবকি করে গেছেন। সেই গাছটার পেছনেই এখনও লেগে আছেন মনে হচ্ছে।

আমি বললুম, ষষ্ঠী, ক্যাকটাসকে এখনও তুমি কাঁটাগাছ বলা ছাড়লে না। কর্নেল নিশ্চয়ই তোমার উপর রেগে যান।

ষষ্ঠী হাসতে হাসতে বলল, বাবামশাই রাগলেই আমার মনে পড়ে যায়। তখন আমি ক্যাকটাস বলি। বাবামশাই বলেছিলেন ক্যাকটি বললেও ভুল হয় না।

সে হাসতে হাসতে চলে গেল। একটা খবরের কাগজ টেনে নিয়ে পাতা উল্টে কোথাও মুনলাইট বারের খবরটা পেলুম না। খবরটা অবশ্য তত বেশি জোরাল নয় যে ছাপতে হবে। তা ছাড়া খুনের ঘটনাটা দিল্লির, সেখানকার কাগজে ছাপা হতেই পারে। হয়তো ছাপা হয়েছিল, আমি লক্ষ করিনি। আমাদের দৈনিক সত্যসেবক কাগজটা খুলে খোঁজাখুঁজি করলুম। মুনলাইট বারের ঘটনাটা ছাপা হয়নি।

কর্নেল নেমে এলেন সাড়ে আটটায়। তারপর পোশাক বদলে ড্রয়িংরুমে এলেন।

বললুম, ষষ্ঠী বলছিল একটা ক্যাকটাসে নাকি পোকার উপদ্রব হয়েছে?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, কিছু কিছু পোকা আছে, তাদের প্রজাতির সংখ্যা একেবারে নগণ্য। কিন্তু তারা ক্যাকটাসের মাংস খেতে খুব ভালোবাসে। আমার সন্দেহ এই পোকাটা ক্যাকটাসটার শরীরে লুকিয়ে থেকেই এসেছিল। তোমার মনে। পড়তে পারে সোনারপুরের শ্রীলক্ষ্মী নার্সারির ভবেশ মজুমদার আমাকে এটা বিদেশ থেকে আনিয়ে দিয়েছিলেন।

ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে দু পেয়ালা কফি আর এক প্লেট স্ন্যাকস রেখে গেল। কর্নেল তাকে বলে দিলেন, নটা থেকে আমার কাছে গেস্ট আসা শুরু হবে। তুই কফির জল চড়িয়ে রাখবি। কেন আসবে তা জানিস?

ষষ্ঠী ফিক করে হেসে বলল, জানব না কেন? কাগজের দাদাবাবু, টিকটিকিবাবু আর লালবাজারের আরেক টিকটিকিবাবুর আসা দেখেই বুঝতে পেরেছি আপনার হাতে–

কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, বড়ো ক্যাস, বুঝলি ষষ্ঠী, হেভি ক্যাস পাইছি।  

ষষ্ঠী হাসতে হাসতে চলে গেল।

হালদারমশায়ের অনুপস্থিতিতে কর্নেল কদাচিৎ তার কথা নকল করতে চান। ঠিক ঠিক পারেন না তবে চেষ্টা করেন। আমাদের কফি খাওয়া শেষ হল। কর্নেল চুরুট ধরালেন। তারপরই ডোরবেল বাজল। কর্নেল যথারীতি হাঁক দিলেন, ষষ্ঠী।

একটু পরে ড্রয়িংরুমে প্রথমে যে ঢুকল তাকে সৌমেন ভেবে চমকে উঠেছিলুম। ছেলেদের মুখে নাকি বাবার মুখের আদলই পড়ে। কিন্তু এরকম মামুখো ছেলে সচরাচর দেখা যায় না। তখনই বুঝলুম এই সেই অর্ক। তার পিছনে ছিলেন একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক। তার পরনে চুস্ত আর রঙিন পাঞ্জাবি, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি।

প্রথামতো নমস্কার করে কর্নেলকে বলল, আমিই কাল ফোন করেছিলাম। আমার নাম অর্ক। আর ইনি নামকরা ফিল্ম প্রযোজক মৃগাঙ্ক চৌধুরি, আমাদের ফ্যামিলির সঙ্গে মৃগাঙ্কবাবুর যোগাযোগ অনেক দিনের। অবশ্য আমার মাসতুতো দাদা সৌমেনের বাবার সঙ্গেই মৃগাঙ্কবাবুর বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল।

কথাটা বলে সে আমাকে নমস্কার করল। তারপর মৃগাঙ্কবাবুকে বলল, ইনিই সম্ভবত জয়ন্ত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার বিখ্যাত সাংবাদিক।

কর্নেল বললেন, আপনারা বসুন।

আমি সরে গিয়ে কর্নেলের কাছাকাছি ওঁদের বসবার জায়গা করে দিলুম। দুজনে বসলেন, তারপর মৃগাঙ্কবাবু বললেন, আমাকে সৌমেন এবং অর্ক দুজনেরই সঙ্গে ঘটনাচক্রে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে। কারণ এদের দুজনেরই সঙ্গে জড়িয়ে আছে তমাল বোস নামে একটা লোক। দুর্ভাগ্যক্রমে মাত্র মাসখানেক আগে জয়শ্রী সিনে স্টুডিওতে তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সে কনট্রাক্টরি করে নাকি প্রচুর টাকা কামিয়েছে। বুঝতেই পারছেন তার কালো টাকার পরিমাণ এত বেশি যে সে তা সামলাতে পারছে না। তাই সে আমার সঙ্গে ফিল্ম প্রোডিউস করতে চায়। ন্যাচারালি আমার যা প্রফেশন তাতে তাকে পাত্তা দিতে হয়েছিল। একজন উঠতি নায়িকা, তার নাম চন্দ্রিমা, এর আগে তার একটা ফিল্ম ফ্লপ করেছিল। এর ফলে বুঝতেই পারছেন ফিল্ম মহলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোক অনেক আছে যারা এই ধরনের নায়িকাকে অপয়া ভাবে। এনিওয়ে, তমাল বোসকে পেয়ে আমি তার সঙ্গে চন্দ্রিমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম। পাছে ফিল্ম দুনিয়ায় চন্দ্রিমার অপয়ার গুজব তমাল বোসকে দমিয়ে দেয় সেই ভেবে আমি চন্দ্রিমাকে ওর সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠতার ভান করতে বলেছিলাম।

এই সময় ষষ্ঠীচরণ আরেকটা ট্রেতে কফির পট আর দুটো পেয়ালা রেখে আগের ট্রেটা তুলে নিয়ে গেল।

কর্নেল বললেন, কফি খান মিঃ চৌধুরি। আপনার কথা আমি সৌমেনের মায়ের কাছে শুনেছিলুম। অর্ক, আমি তোমার মাসতুতো দাদাকে তুমি বলি, তোমাকেও তুমি বলছি।

অর্ক স্মার্ট হয়ে বলল, অবশ্যই বলবেন। তাছাড়া আমার দাদু সুভদ্রনারায়ণ রায়চৌধুরি যাঁকে এখনও হাস্যকরভাবে লোকেরা কুমারবাহাদুর বলে থাকে, তার কাছে আমি জেনেছি আপনারা দুজন নাকি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু আমি দাদুকে জিগ্যেস করেছিলুম কর্নেল সাহেব যদি তোমার বন্ধু, তাহলে তাকে একদিনও এই বাড়িতে দেখতে পেলুম না কেন। দাদু ছড়ি তুলে রাজোচিত গাম্ভীর্যে বলেছিলেন, তুই তো একটা বখাটে ছেলে। সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াস, বাড়ি ফিরিস রাত দশটার পর। তুই কী করে দেখতে পাবি কর্নেল সাহেবকে! কিন্তু আমি ছোটবেলায় আপনাকে দেখেছি বলে মনে পড়ছে। আপনি একটুও বদলাননি।

মৃগাঙ্কবাবু বললেন, তোমার দাদু রাজবংশধর। কিন্তু ইনি মিলিটারির রিটায়ার্ড অফিসার। ছড়ির বদলে কর্নেল সাহেব তোমাকে ফায়ার আর্মস দিয়ে বধ করবেন। কাজেই চুপচাপ কফি খাও।

কথাটা বলে তিনি কর্নেলের দিকে তাকালেন-বুঝলেন কর্নেল সাহেব, এই অর্কটা বড্ড বেশি বাঁচাল আর ঝগড়াটে। ওদের ক্লাবে তমাল বোসও একজন মেম্বার। সেখানে চন্দ্রিমা স্বাভাবিকভাবেই অর্কের সঙ্গে একটু বেশি মেলামেশা। করায় তমাল বোস চটে গিয়েছিল। ব্যস। তারপরই অর্কের একদিন মাথা খারাপ হয়ে গেল। সবার সামনে তমাল বোসকে ঘুষি মেরে ফেলে দিয়েছিল। ব্যস! সাপের লেজে পা পড়লে যা হয়। আমি জানতুম না কর্নেল সাহেব পরশু সন্ধ্যায় কে নাকি অর্কের গাড়ি লক্ষ করে গুলি চালিয়েছিল।

বুঝতে পারছিলুম মৃগাঙ্ক চৌধুরি এক সদালাপী এবং ভোলা মনের মানুষ। কিছুক্ষণ ধরে তিনি অর্কের গোঁয়ার্তুমি নিয়ে রসিকতা করে গেলেন। তার পর কফি শেষ হলে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। আমার দিকে তিনি প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিলে আমি ধন্যবাদ বলে ফিরিয়ে দিলুম। এই সময় অর্ক বলল, আমার একখানে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে কাকু, যেজন্য আমরা কর্নেল সাহেবের কাছে এসেছি, এবার সেই কথাটা আপনি বলুন।

মৃগাঙ্ক চোখ বুজে বললেন, আশ্চর্য, তোমার কথা তুমিই বলবে। তারপর দরকার হলে আমি মুখ খুলব।

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে একটু হেসে বললেন, তোমার পেছনে তমাল বোস ভাড়াটে খুনিকে লেলিয়ে দিয়েছে। এটা আমার শোনা কথা। তোমার মা এ ব্যাপারে একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভকে হায়ার করেছেন।

অর্ক বিরক্তির ভাব দেখিয়ে বলল, ওই ভদ্রলোক নাকি পঁয়ত্রিশ বছর পুলিশে চাকরি করেছেন। কিন্তু ওঁর মুখের ভাষা ওঁর ব্যক্তিত্বকে নষ্ট করে ফেলছে তা উনি নিজেও টের পান না।

মৃগাঙ্কবাবু বললেন, শুনেছি তিনি নাকি পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় কথা বলেন। তাতে কী হয়েছে। আমাদের ঘটিদের ভাষার চেয়ে বাঙাল ভাষার জোরটা আমার মতে অনেক বেশি।

অর্ক বলল, আমি ওঁর সব কথা বুঝতে পারি না। আজ সকালে মায়ের কাছে শুনলুম প্রাইভটে ডিটেকটিভ মিঃ হালদার নাকি কর্নেল সাহেবেরও একজন সহযোগী। কর্নেল সাহেব, কথাটা কি ঠিক?

.

০৮.

কর্নেল তার কথা শুনে তার বিখ্যাত অট্টহাসি হাসলেন। তার পর বললেন, হ্যাঁ। তুমি ঠিকই শুনেছ। আমার এই যে মার্কামারা চেহারা দেখছ, এ দিয়ে গোয়েন্দাগিরি করার অসুবিধা আছে। প্রয়োজনে গোয়েন্দাদের ছদ্মবেশ ধরতে হয়, রাত-বিরেতে কোথাও হানা দিতে হয়, এমনকী পাইপ বেয়ে উঠে কোনো ঘরে হানাও দিতে হয়। এ সব কাজে আমাদের হালদারমশাই কিন্তু খুব পাকা। যাই হোক, তুমি কী বলতে এসেছ তাই বলো।

অর্ক চাপাস্বরে বলল, গতকাল আমি বালিগঞ্জ প্লেসে চন্দ্রিমার বাড়িতে গিয়েছিলুম। অবশ্য আগে ফোন করেই গিয়েছিলুম। চন্দ্রিমাকে আমি আগের সন্ধ্যায় আমার উপর হামলার কথা বলতে গিয়েছিলুম। তাছাড়া তমাল বোস সম্পর্কে ওকে সাবধান করতেও চেয়েছিলুম। চন্দ্রিমা আমাকে একটা আশ্চর্য কথা বলল। তমালবাবু নাকি দিল্লির একটা লোকের কাছে শুনেছেন একজন বড়ো বিজনেসম্যানের দিল্লি অফিসের ম্যানেজার তিনি। কী যেন নামটা…হা, সাম সিনহা, সিনহার সঙ্গে তমাল বোসের আলাপ হয়েছে। কী সূত্রে আলাপ হয়েছে তা চন্দ্রিমা জানে না, কিন্তু ওই সিনহার কাছে একটা ফটো ছিল। ফটোটা তমাল বোসকে সে দেখিয়ে বলেছে এই যুবকটি থাকে কলকাতায়। সে একজন জার্নালিস্ট। সে ওই বিজনেসম্যানের স্ত্রীকে খুন করে ক্যাশ সাত লাখ টাকা নিয়ে পালিয়ে এসেছে। ভদ্রমহিলা সেদিনই ওই টাকাটা ব্যাঙ্ক থেকে তুলেছিলেন। ফটোটা দেখে তমাল বোস নাকি চিনতে পেরেছে।

কর্নেল বলে উঠলেন, তমাল বোস বলেছে ফটোটা তোমার। এই তো?

অর্ক বলল, হ্যাঁ। আমার ঘুষি খেয়ে বোসবাবু আমার বিরুদ্ধে ভাড়াটে খুনি লাগিয়েছে। কাজেই ওই ফটো দেখে সে ন্যাচারেলি আমাকে পুলিশে দেওয়ার সুযোগ ছাড়তে চায়নি। মিঃ সিনহাকে সে বলেছে আমাকে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করবে। কথাটা শুনেই আমি বুঝতে পেরেছিলুম ওই ফোটোটা আমার নয়, সৌমেনের। কিন্তু কাল সৌমেনকে ফোন করে পাইনি। সৌমেনের মা আমার কথা কিভাবে নেবেন জানতুম না। অগত্যা এই মৃগাঙ্ককাকুর শরণাপন্ন হয়েছিলুম।

মৃগাঙ্কবাবু বললেন, এবার ব্যাকগ্রাউন্ডটা আমি ক্লিয়ার করে দিই। চন্দ্রিমাই কথাটা আমাকে টেলিফোনে জানিয়েছিল। কারণ অর্কের প্রতি তার দুর্বলতা আছে। আমি তমালকে ফোনে পাইনি। তখন আবার চন্দ্রিমার কাছে গিয়েছিলুম। চন্দ্রিমা আমাকে দেখে বলল এইমাত্র তমাল বোস তার কাছে এসেছিল। সে অর্ককে বধ করবে তার মাসতুতো ভাই সৌমেনের সাহায্যে। আজ সন্ধ্যা সাতটায় নাকি সে মুনলাইট বারে আসতে বলেছে। ওদিকে দিল্লির মিঃ সিনহাও বারে উপস্থিত থাকবেন। এর পরের ব্যাপারটা তো আপনি সবই জানেন।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। মিঃ চৌধুরি সৌমেনকে বিপদ থেকে বাঁচাতে তৎপর হয়েছিলেন। তাই তার মাকে লালবাজারের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়েছিলেন।

মৃগাঙ্কবাবু বললেন, কী করব। অর্কের মতোই সৌমেন মাঝে মাঝে নিপাত্তা হয়ে যায়। আমি তার অফিসে তাকে ফোন করে পাইনি। তখনও জানতুম না সে চন্দ্রিমার কাছে আছে।

অর্ক বলল, চন্দ্রিমার কথা শুনে আমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলুম। আমার মনে। ছিল না যে সৌমেনের সঙ্গে আমার চেহারার কিছুটা মিল আছে। কথাটা শোনার পর আমি সোজা ধর্মতলা স্ট্রিটে তমাল বোসের অফিসে হাজির হয়েছিলুম। তার সঙ্গে একটা চূড়ান্ত বোঝাঁপড়া করাই আমার উদ্দেশ্য ছিল। তাকে মেরে আমি মরব। কিন্তু সেখানে গিয়ে শুনলুম তমাল বোস এগারোটা নাগাদ বেরিয়েছে। কখন ফিরবে কিছু বলে যায়নি। এরপর আমি সৌমেনের খোঁজে ওদের অফিসে গিয়েছিলুম। সৌমেনকে পাইনি। নিউ আলিপুরে ওদের বাড়িতে ফোন করেছিলুম, কেউ ধরল না। খুলে বলা ভালো, আমার মাসিমা আমাকে কিন্তু এড়িয়ে চলেন। পছন্দ করেন না বললেই ঠিক হয়। কারণ আমি ছোটবেলা থেকেই বখাটে ছেলে। সৌমেনের সঙ্গে আমার মেলামেশা এমনিতেই কম, তাও সেই মেলামেশা কখনও ওদের বাড়িতে হয়নি। মাত্র একবার দাদুর সঙ্গে ওদের নিউ আলিপুরের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলুম। সেই শেষ।

মৃগাঙ্কবাবু বললেন, খুব হয়েছে। সম্ভবত কর্নেল সাহেবের অজানা কিছু নেই। কারণ তোমার দাদু কর্নেল সাহেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এবার কী জন্য এসেছ সেই কথাটা খুলে বলল।

অর্ক জোরে শ্বাস ছাড়ল। সে ঠোঁট কামড়ে ধরেছিল। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলুম তার মনের মধ্যে তখন চাপা ক্রোধ আগ্নেয়গিরি মতো বিস্ফোরণের সীমায় এসে যেন দাঁড়িয়েছে।

মিনিট দুই-তিন পরে সে নিজেকে সংযত করতে পেরেছে মনে হল। এবার সে বলল, কর্নেল সাহেব, মিঃ হালদারের দ্বারা কিছু হবে না আপনাকে অনুরোধ, আপনি পুলিশের সাহায্যে দিল্লির ওই লোকটা এবং তমাল বোসকে অ্যাটেমপ্ট টু মার্ডার কেসে ধরিয়ে দিন। আমি বললে চন্দ্রিমা সাক্ষী দিতে পিছপা হবে না। কারণ সে-ও লোকটাকে চিনতে পেরেছে। সেও তা হাত থেকে বাঁচতে চায়।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, তোমাকে একটা সুখবর দিচ্ছি। কাল সন্ধ্যায় মুনলাইট বারে দিল্লির সেই লোকটি অর্থাৎ মিঃ সিনহাকে স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। আমি এখনও পুরোটা জানি না তবে আমার অনুমান, দিল্লির কোনো কেসেই তাকে ধরা হয়েছে। দিল্লি পুলিশের একটা দল অলরেডি এসে গেছে এটুকু জানি। আর তমাল বোসের কথা বলছ, সি আই ডি পুলিশের কবল থেকে সে কাল সন্ধ্যায় মুনলাইট বারের পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে। তবে তাকে এখন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে। এমনও হতে পারে সে কলকাতার বাইরে কোথাও পালিয়ে যেতে পারে। বাই দ্য বাই, তুমি কি আজ চন্দ্রিমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছ?

অর্ক বলল, হ্যাঁ। চন্দ্রিমা আমাকে বলল, তমাল বোস এখন তার কনট্রাক্টরির কাজে কলকাতার বাইরে চলে যাচ্ছে। চন্দ্রিমাকে সে সঙ্গিনী হতে বলেছিল। মৃগাঙ্ককাকুর নাম করে চন্দ্রিমা তার সঙ্গে যেতে চায়নি। কিন্তু চন্দ্রিমা আজ আমাকে একটা ভাইটাল পয়েন্ট দিয়েছে। তমাল বোস তাকে নাকি বলে গেছে তপসিয়া এলাকার বাপী নামে একটি ছেলে চন্দ্রিমার কাছে যাবে। সে চন্দ্রিমাকে একটু ভয়। দেখিয়ে বলেছে আমি যদি চন্দ্রিমার কাছে যাই সে যেন কোনো ছলে গোপনে বাপীকে ফোন করে জানায়। ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন?

কর্নেল এবার একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, বুঝেছি। লোকটা সত্যিই বিপজ্জনক। তো, চন্দ্রিমা কি বাপীর ফোন নাম্বার তোমাকে জানিয়েছে?

অর্ক বল, প্রথমে খুব ভয় পাচ্ছিল। পরে ওকে হুমকি দিয়ে বললুম, নাম্বারটা না দিলে চন্দ্রিমা বিপদে পড়বে। আমি মৃগাঙ্ককাকুকে বলব চন্দ্রিমা বাপী নামে এক গুণ্ডার সঙ্গে প্রেম করে।

অর্ক কথাটা বলে হেসে উঠল। মৃগাঙ্কবাবু এবং আমিও হেসে ফেললুম। কিন্তু কর্নেল গম্ভীর। তিনি টেবিল থেকে একটা ছোট প্যাড আর ডট পেন অর্কের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, তোমাকে আর কিছু লিখতে হবে না, এখানে শুধু বাপীর ফোন নাম্বারটা লিখে দাও।

অর্ক তার বুকপকেট থেকে একটা ভাজ করা কাগজ বের করে বলল, নাম্বারটা আমি তখনই লিখে নিয়েছিলুম। নাম্বারটা আমি আপনাকে লিখে দিচ্ছি। এই নাম্বারটা আমার কাছেও থাকা দরকার।

মৃগাঙ্কবাবু বললেন, অর্ক, ওই নাম্বারে তোমার ফোন করা ঠিক হবে কি না। কর্নেল সাহেবের কাছে জেনে নাও। বাপীর নাম আমিও শুনেছি। হি ইজ এ প্রফেশন্যাল কিলার। পরশু সন্ধ্যায়, আমার ধারণা, সেই ইচ্ছে করলে তোমাকে গুলি করে মারতে পারত। কিন্তু অতটা করেনি। শুধু তমাল বোসের টাকার দায় মেটাতে ইচ্ছে করেই তোমার গাড়ির পেছনের কাছে গুলি করেছে। আরেকটা গুলি জানলার নীচে দিয়ে পিছলে গেছে। আমার ধারণা সে তমাল বোসকে বোঝাতে চায় দুদুবার গুলি করেও সে ব্যর্থ হয়েছে। অতএব তার রেট বাড়াতে হবে। কর্নেল সাহেব কী বলেন?

কর্নেল তেমনি গম্ভীর মুখে বললেন, ইউ আর রাইট মিঃ চৌধুরি। বাপীর নাম আমি পুলিশ সূত্রে শুনেছি। ওর বিরুদ্ধে অনেকগুলো খুনের অভিযোগ আছে। কিন্তু ওর গার্জেন একজন রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতা।

অর্ক ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বরে বলল, শুনেছি আমার দাদুর একটা পুরনো আমলের কোল্ট রিভলবার আছে। আমার কিছু নেই। আমার যদি একটা ফায়ার আর্মস থাকত

তাকে থামিয়ে দিয়ে মৃগাঙ্কবাবু বললেন, অর্ক, আবার তুমি গোঁয়ার্তুমি করছ। আমার ভয় হচ্ছে তুমি চোরা বাজার থেকে ফায়ার আর্মস কিনে কখন না কেলেঙ্কারি করে ফেলল।

এতক্ষণে কর্নেলের মুখে হাসি ফুটল। তিনি বললেন, তোমাকে কিছু করতে হবে না। তুমি যখন আমার কাছে এসেছ তখন নিশ্চিন্ত থাক। অন্তত তমাল বোস কলকাতায় ফিরে না আসা পর্যন্ত বাপী তোমার উপর সেকেন্ড অ্যাটেমপ্ট করবে না। এবার মিঃ চৌধুরিকে একটা পরামর্শ দিতে চাই।

মৃগাঙ্ক বললেন, বলুন।

কর্নেল পুড়ে যাওয়া চুরুটটা ঘষে নিভিয়ে দিলেন। তারপর বললেন আপনার হাতে কি এখন কোনো ছবি আছে?

মৃগাঙ্কবাবু বললেন, একটা ছবি শুরু করব ভেবেছি। কিন্তু ছবিটার বাজেট অনেক বেশি। তাই তমালকে আমি সঙ্গে নিতে চেয়েছিলুম। এখন যা অবস্থা, হয়তো তমালকে আর পাব না।

কর্নেল বললেন, বাই এনি চান্স ছবিটা যদি শুরু করার সুযোগ পান, আপনি চন্দ্রিমাকে যেকোনো একটা রোলে নিন। আউটডোর শুটিং-এর নিশ্চয় দরকার হবে। আজকাল তো বড় পর্দায় বাইরের জগৎকে দর্শক দেখতে চায়। বিহার সীমান্ত এলাকায় অনেক ভালো শুটিং স্পট আমার জানা আছে। আপনি যদি চন্দ্রিমাকে সেখানে অন্তত এক সপ্তাহের জন্য নিয়ে গিয়ে রাখতে পারেন, তাহলে ভালো হয়। কারণ চন্দ্রিমা বাপীর পাল্লায় পড়ে বিপন্ন হতে পারে। আপনি নিশ্চয় এদিকটা চিন্তা করেছেন।

মৃগাঙ্ক চৌধুরি একটু ভেবে নিয়ে বললেন, আমার যা সঙ্গতি তাতে ছবিটার অর্ধেকের বেশি গড়ে তোলা সম্ভব অবশ্য আপনাদের আশীর্বাদে বাজারে আমার সুনাম আছে। আমি ছবিতে হাত দিয়েছি জানতে পারলে বাকি টাকার জন্য কো-প্রোডিউসার হবার চান্স অবশ্যই আছে।

অর্ক বলে উঠল, কোনো মানে হয় না। মৃগাঙ্ক চৌধুরি ছবি করছে জানলে অনেক তমাল বোসই ছুটে আসবে। ছবিতে হাত না দেওয়ার কারণ আমি বলব?

মৃগাঙ্কবাবু সহাস্যে বলে উঠলেন, বলো।

অর্ক বলল, আপনি বলিউডের এক নায়িকার জন্য অপেক্ষা করছেন। তার ডেট পেলেই ছবিতে হাত দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন।

মৃগাঙ্কবাবু তার পিঠে মৃদু থাপ্পড় দিয়ে বললেন, ঠিক আছে, তোমার কথা সত্যি হলেও ছবির কিছু কিছু অংশ বম্বের নায়িকা ছাড়াই তুলে রাখা হয়।

অর্ক বলল, আপনাদের এই কুসংস্কারটা আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। চন্দ্রিমা একবার ফেল করেছে বলে কী বারবার ফেল করবে? বলিউড ছেড়ে। টলিউডের নায়িকাই নিন।

কর্নেল ঘড়ি দেখছিলেন। মৃগাঙ্কবাবু সেটা লক্ষ করে বললেন, চলো অর্ক। দশটা বেজে গেছে। কর্নেল সাহেব, ছবিটা আমি করব। আপনি আমাকে কয়েকটা। লোকেশনের ঠিকানা লিখে দিন।

কর্নেল সেই প্যাড থেকে বাপীর ফোন নাম্বারটা ছিঁড়ে নিয়ে পকেটে রাখলেন। তারপর প্রায় পাঁচমিনিট ধরে তিনি তার পরিচিত কতকগুলো লোকেশনের ঠিকানা ইত্যাদি লেখার পর মৃগাঙ্কবাবুর হাতে দিয়ে বললেন, এই জায়গাগুলোর মধ্যে কোথাও ফরেস্ট বাংলো, কোথাও সেচ বাংলো, কোথাও ট্যুরিস্ট বাংলো এমনকী প্রাইভেট বাংলোও পাওয়া যায়। আপনি আগে লোকেশন ঠিক করে আমাকে রিং। করবেন। আমি যাতে আপনার সুবিধে হয়, আগে ফোন করে ব্যবস্থা করে রাখব।

মৃগাঙ্কবাবু কাগজে চোখ বুলিয়ে একটু হেসে বললেন, এর মধ্যে অন্তত দুটো লোকেশন আমার চেনা, বাকিগুলো অচেনা। ঠিক আছে, এখন উঠি। আপনি অর্ক এবং সৌমেনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারলে খুশি হব।

এই বলে তিনি অর্কের কাঁধে হাত রেখে বেরিয়ে গেলেন।

তারপর আমি বললুম, এই কেসের ব্যাকগ্রাউন্ডটা বড্ড এলোমেলো। কতকগুলো ঘটনা চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। অথচ সেগুলির মধ্যে স্পষ্টই একটা লিংক আছে। তবে আমি বুঝতে পারছি না দিল্লিতে ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে সূরজদাস নেহালিয়ার সম্পর্ক সত্যিই স্বামী-স্ত্রীর, নাকি আজকাল যাকে বলে লিভ টুগেদার, তাই?

কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে চোখ বুজে প্রশস্ত টাকে হাত বুলোচ্ছিলেন। ওই অবস্থায় থেকেই বললেন, এই লিংকটা খুঁজে বের করতে হলে তোমাকেই একটু তৎপর হতে হবে।

বললুম, আপনার কথা শুনে অস্বস্তি হচ্ছে। তবু রিস্ক নিতে আমি দ্বিধা করব না। এবার বলুন আমাকে কী করতে হবে?

কর্নেল চোখ বুজে টাকে হাত বুলাতে বুলোতেই বললেন, সূরজদাস নেহালিয়ার সঙ্গে দিল্লিতে তোমার পরিচয় হয়েছে। কাজেই তোমার প্রথম কাজ কলকাতায় তার অফিস কিংবা বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে বাক্যালাপ। তুমি প্রসঙ্গত সৌমেনের কথাই বেশি করে বলবে। তোমাকে আমি তমাল বোসের লেখা সেই উড়ো চিঠিটার একটা জেরক্স কপি দেব। তুমি মুনলাইট বারের ঘটনাটা বলবে। কিন্তু তার দিল্লি অফিসের ম্যানেজার ভানুপ্রতাপের ব্যাপারটা চেপে যাবে। কিন্তু তার সম্পর্ক খোঁজখবর নিতে পার। তুমি দিল্লিতে গেলে তার সঙ্গে দেখা করবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

বললুম, আপনার ইত্যাদি ইত্যাদি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সূরজদাস, যতখানি মনে হয় অতিশয় ধূর্ত লোক।

কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। তারপর বললেন, আমরা আরেক রাউন্ড কফি খাব। তার পর তুমি মিঃ নেহালিয়ার নেমকার্ড দেখে প্রথমে তার অফিসে ফোন করবে, তারপর দরকার হলে তার বাড়িতে।

আর এর রাউন্ড কফি পানের পর আমার ঘরে গিয়ে মিঃ নেহালিয়ার নেমকার্ডটা নিয়ে এলুম। তিনি কার্ডটা দিয়ে নিজেই বলেছিলেন, কলকাতায় ফিরে যেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আমাদের বিজনেস ওয়ার্ল্ডে চমকপ্রদ সব ঘটনা ঘটে। আপনাকে সেসব খবর দোব। তার কথা শুনে আমার মনে হয়েছিল ব্যবসা-জগতে তার কিছু শত্রু বা প্রতিপক্ষ আছে। খবরের কাগজে তাদের গোপন কথা যাতে আমি ফাস করি, তাই তিনি সৌমেনের মতোই আমার প্রতি আগ্রহী। আমি সৌমেনদের ইংরেজি কাগজটির পাতা কখন উল্টে দেখিনি। এমন হতে পারে সৌমেন তাদের কাগজে মিঃ নেহালিয়ার সূত্রে পাওয়া অনেক খবর প্রকাশ করেছে।

ঠিক এগারোটায় মিঃ নেহালিয়ার ব্রাবোর্ন রোডে তার অফিসে ফোন করলুম। প্রথমে ভেসে এল মহিলা অপারেটরের মিঠে কণ্ঠস্বর। আমি নাম বলার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। তারপর সেই অপারেটর বললেন, মিঃ নেহালিয়া এখন কনফারেন্সে ব্যস্ত। আপনি বারোটার পর রিং করবেন।

আমি তাকে আমার নামটা নোট করে নিতে বললুম। জানিয়ে দিলুম আমি মিঃ নেহালিয়ার সুপরিচিত একজন সাংবাদিক।

আমার একটু অবাক লেগেছিল সৌমেনও একজন সাংবাদিক এবং মিঃ নেহালিয়ার খুব কাছের লোক। সে কি তার অফিসে কখনও রিং করে না? কিংবা মিঃ নেহালিয়াও কি তাকে রিং করেন না? করাটা খুব স্বাভাবিক। আর এভাবেই মহিলা অপারেটরের কাছে সৌমেন বা তার নাম নিশ্চয়ই পরিচিত। অথচ অপারেটর আমাকে জিগ্যেস করলেন না আমি সৌমেন কি না।

কথাটা কর্নেলকে বললুম। কর্নেল বললেন, এই জন্যই তোমাকে বলি তুমি বৌঝ সবই, কিন্তু দেরিতে। তুমি ভুলে গেছ এইসব বড়ো বড়ো মানুষদের ব্যক্তিগত টেলিফোন থাকে, যেটাকে হট লাইন বলতে পার। সৌমেন এবং তাঁর মধ্যে যোগাযোগ সেই হট লাইনেই হওয়া স্বাভাবিক।

কর্নেলের কথায় বিব্রত বোধ করছিলাম। ঠিকই তো, এটা আমার চিন্তা করা উচিত ছিল, কারণ আমার কাছে অনেক ভি আই পি-র হট লাইনের নাম্বার আছে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না মিঃ নেহালিয়া আমাকে তার সেই লাইনের নাম্বারটি কেন দেননি।

আমি আবার রিসিভার তুলে সৌমেনের বাড়িতে ফোন করলুম। আমাকে চমকে দিয়ে সৌমেন বলল, জয়ন্ত, তোকে এখনই ফোন করতে যাচ্ছিলুম। একটা ইনটারেস্টিং ব্যাপার ঘটেছে। তুই কি সল্টলেক থেকে ফোন করেছিস না কি কর্নেলের বাড়ি থেকে?

বললুম, আমি এখন কর্নেলের বন্দী কিন্তু কথাটা কি ফোনে বলা যায় না?

–না। তুই এখনই চলে আয়। কর্নেলকে একটু হিন্টস দিয়ে চলে আয়। জয়ন্ত, দিস ইজ আর্জেন্ট।

.

০৯.

সৌমেনের নিউ আলিপুরের ফ্ল্যাটে আমি বারকয়েক গেছি। তার মা সুনন্দা দেবীকে দেখে প্রথমবারেই আমার মনে হয়েছিল এই ভদ্রমহিলার জীবন খুব সুখের ছিল না। তাই হয়তো সৌমেনের বন্ধুদের সম্পর্ক তার ঈষৎ সংশয় আছে। এক ধরনের মানুষ আছে যারা ভাবেন বিশ্বসুদ্ধ লোক তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। সুনন্দা দেবী কতকটা সেই প্রকৃতির মহিলা। তার ছোট বোন গায়ত্রীর মতো তিনি অত খোলা মনের মানুষ নন।

আমার গাড়ি পার্কিং জোনে রেখে তিনতলায় সৌমেনের অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় ডোরবেলে আঙুল ছোঁয়ালুম।

সৌমেন আমার জন্য প্রতীক্ষা করছিল। সে দরজা খুলেই বলল, আমি জানলা দিয়ে লক্ষ করেছি তোর গাড়ি আসছে। আগে বোস আজকে একটু গরম পড়েছে। মনে হচ্ছে। একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক খা। আমি নিয়ে আসছি।

বসার ঘরটা বেশ বড়ো এবং লম্বা-চওড়া। একটা বুকশেলফে প্রচুর বই। ঘরটার আসবাবপত্র একেবারে একালীন। আমি জানি সৌমেনের বাবা অমিতেশ চন্দ্র বংশের পেশা ছেড়ে শিক্ষকতার লাইনে পা দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপক। সৌমেন এইসব বইগুলো দেখিয়ে বলে, ইতিহাসের ওই। কবরখানা দেখলেই আমার গা ছমছম করে। মানুষ বর্তমান নিয়েই বাঁচে। আমার বাবা অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। হার্ট অ্যাটাকে যখন নিঃশব্দে মারা যান তখন তার বুকের উপর একখানি ইতিহাস বই ছিল। বাবাকে নিয়ে সৌমেন অনেক হাস্য-পরিহাস করে।

একটু পরেই সৌমেন একটা ট্রেতে দুটো কোল্ড ড্রিঙ্ক নিয়ে এসে সেন্টার টেবিলে রাখল। বলল, মায়ের ব্রেনে এখন হাইটাইম চলেছে। কিচেনে কাজের মেয়েটিকে নিয়ে স্টিম ইঞ্জিন চালাচ্ছেন।

বলে সে ওপেনার দিয়ে কোল্ড ড্রিঙ্ক দুটো খুলে ফেলল। তার হাবভাব এবং কথাবার্তায় মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা যেমন গুরুতর ভেবেছিলুম তেমন হয়তো নয়। তাই বললুম, তুই খুব আনন্দে আছিস মনে হচ্ছে? আমি তো ভেবেছিলুম কালকের ঝামেলার জের আজও চলেছে।

সৌমেন দুটো স্ট্র ট্রে থেকে নিয়ে একটা আমার বোতলে গুঁজে দিল। তার পর অন্যটা নিজের বোতলে গুঁজে দিয়ে কয়েকবার টান দেওয়ার পর বলল, তোকে আমি গুরুতর কোনো ঘটনার কথা বলিনি। বলেছিলুম ঘটনাটা ইন্টারেস্টিং।

বললুম, এবার বল কী ঘটেছে?

সৌমেন চাপাস্বরে বলল, এগারোটার সময় হঠাৎ একটা ফোন এসেছিল। ভাগ্যিস তখন মা কিচেনে ঢুকেছিলেন। ফোনটা কার জানিস? আমার মাসতুতো ভাই অর্কের প্রেমিকা সেই ফিল্মস্টার মেয়েটির।

চমকে উঠে বললুম, চন্দ্রিমা সেনের ফোন?

সৌমেন বলল, হ্যাঁ। চন্দ্রিমাকে আমি কখনও দেখিনি। তমাল বোসের কাছে ওর নাম শুনেছিলাম। তমাল বোসই বলেছিল অর্কর সঙ্গে তার ঝামেলার কথা। যাই হোক, চন্দ্রিমা বলল সে নিজেকে বিপন্ন মনে করছে। কারণ তমালবাবু কোথায় গা ঢাকা দিয়েছেন এখনও তার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। এদিকে তপসিয়া এলাকার একজন ভাড়াটে খুনি–

তার কথার উপর বললুম, বাপী।

সৌমেন অবাক হয়ে বলল, তুই চিনিস নাকি তাকে!

বললুম, না। চন্দ্রিমা কী বলল তাই বল।

সৌমেন কিছুক্ষণ কোল্ড ড্রিঙ্ক টানার পর বলল, কিছুক্ষণ আগে বাপী চন্দ্রিমার, বাড়িতে এসেছিল। ভয়ে ভক্তিতে তো বটেই তা ছাড়া ওই তমাল বোসের সঙ্গে বাপী কয়েকবার চন্দ্রিমার ফ্ল্যাটে এসেছে।

বললুম, সংক্ষেপে বল। আমার একটু তাড়া আছে।

সৌমেন বলল, বাপী কার কাছে শুনেছে অর্ক নাকি চন্দ্রিমার ওখানে আছে। তাই সে সেখানে এসেছে। চন্দ্রিমা জানে অর্ককে খুন করবার জন্য তমাল বোস তাকে কিছু টাকা অ্যাডভান্স করেছে। অর্ক সেখানে নেই দেখে বাপী বলে গেছে। অর্ক এলেই যেন তাকে চন্দ্রিমা ফোন করে জানিয়ে দেয়। তা ছাড়া বাপীর লোক চন্দ্রিমার ফ্ল্যাটের দিকে সারাক্ষণ নজর রাখবে। চন্দ্রিমা যদি না ও জানায়, তার লোক তাকে অর্কের কথা জানাবে। অর্থাৎ যাকে বলে চূড়ান্ত থ্রেটনিং।

বললুম, তোর নাম্বার চন্দ্রিমা পেল কোথায়?

সৌমেন বলল, কাল মুনলাইট বারে যাবার আগে তমাল বোস আমার নাম্বারটা চন্দ্রিমাকে দিয়ে গিয়েছিল।

বললুম, তখন তো তুই সেখানে ছিলি। তোর নাম্বার তাকে কেন দিল, তমাল বোসকে জিগ্যেস করিসনি?

সৌমেন বলল, আমাকে জিগ্যেস করতে হয়নি। বজ্জাতটা নিজেই বলেছিল আমার কোনো বিপদ হলে আপনি যেন চন্দ্রিমাকে সাহায্য করেন। ওর বাড়িতে কোনো পুরুষ গার্জেন নেই। আছেন শুধু ওর পিসিমা, কিন্তু তিনি বৃদ্ধা ও রুগণ। অবশ্য সিকিউরিটি গার্ড আছে নীচের তলায়। কিন্তু চিন্তা করে দেখ মোটর সাইকেল হাঁকিয়ে কেউ যদি এসে বলে আমি তপসিয়ার বাপী ব্যানার্জি, তাহলে ভয় পেতেই হবে কারণ তার নামটা মিডিয়ার কল্যাণে অসংখ্য মানুষ জেনে গেছে।

ঘড়ি দেখে বললুম, ঠিক আছে। মেক ইট ব্রিফ। সৌমেন বলল, সে অর্ক এবং তার আসল গার্জেন মৃগাঙ্ক চৌধুরিকে রিং করেছিল, কিন্তু তাদের পায়নি।

বললুম, পাবে কী করে! তারা তখন কর্নেলের ডেরায় ছিলেন। কর্নেল মিঃ চৌধুরিকে পরামর্শ দিয়েছেন, তাঁর ছবির আউটডোর লোকেশনে চন্দ্রিমাকে নিয়ে যেন তিনি শিগগির চলে যান।

সৌমেন বলল, সেটা সময়সাপেক্ষ। চন্দ্রিমা এখনও ফিল্মলাইনে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। তাই সে তত স্মার্ট নয়। সে আমাকে ফোন করে সাহায্য চাইল। অর্থাৎ তার কী করা উচিত? আমি ওকে বললুম পুলিশে জানিয়ে কোনো লাভ হবে না। আপনি এক কাজ করুন। আমি আপনার ওখানে যাচ্ছি। আমি ট্যাক্সিতে যাব। আপনি আমার সঙ্গে আসতে ভয় পাবেন না। আমি আপনাকে সোজা অর্কর দাদুর বাড়িতে পৌঁছে দেব। আমি আরও জানিয়ে দিয়েছি অর্ক আর আমি মাসতুতে ভাই। অর্কের দাদু আমারও দাদু। তিনি রাজা-জমিদার বংশের মানুষ। এখনও তিনি কুমারবাহাদুর নামে পরিচিত।

সৌমেনের কথা শুনে হাসি পাচ্ছিল। হাসতে হাসতে বললুম, তা তুই আমাকে ডাকলি কেন? বেচারা হয়তো তোর প্রতীক্ষায় এখন অস্থির হয়ে আছে আর তুই এভাবে সময় নষ্ট করলি কেন?

সৌমেন একটু হেসে বলল, আসলে আমার একা যেতে ভয় করছে। বাপীর লোক নাকি চন্দ্রিমার ফ্ল্যাটের দিকে নজর রেখেছে। তাই ভাবলুম তোকে আমার সঙ্গী করব।

ততক্ষণে আমাদের কোল্ড ড্রিঙ্ক খাওয়া হয়ে গেছে। ট্রে আর বোতল দুটো টেবিলেই থাকল। সৌমেন আমার কোনও কথা না শুনেই ভিতরে গেল। একটু পরেই সে প্যান্টশার্ট বদলে ফিরে এল। চাপাস্বরে বলল, মাকে তোর কথা বলিনি। কাজের মেয়েটিকে আমি বলে এলুম অফিসের কাজে বেরুচ্ছি; দরজা বন্ধ করো। কাজেই জয়ন্ত তুই এখন আগে বের হ।

আমি নীচে নেমে আমার গাড়ির ভিতর ঢুকতেই সৌমেন এসে গেল। সামনের সিটে আমার বাঁদিকে বসে সে চাপাস্বরে বলে উঠল, হারে জয়ন্ত, তোর কাছে তো একটা ফায়ার আর্মস থাকে। সেটা আছে তো?

বললুম, তুই একটু আভাস দিলে ওটা নিয়ে বেরিয়ে আসতুম। সব সময় পকেটে অস্ত্র নিয়ে ঘোরার বিপদ আছে।

সৌমেন বলল, ঠিক আছে। বাপী ব্যানার্জি নিশ্চয় আবার ওখানে ফিরে আসেনি। শুনেছি সে প্রকাশ্যে চলাফেরা করে কদাচিৎ।

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রাস্তায় পৌঁছে বললুম, আমার একটা জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ভেস্তে দিলি। আমার ঠিক বারোটায় তোর সেই ফ্রেন্ড ফিলজফার অ্যান্ড গাইড মিঃ নেহালিয়ার সঙ্গে তার অফিসে দেখা করার কথা।

সৌমেন অবাক হয়ে বলল, হঠাৎ তার কাছে কেন? বললুম, তুই তো জানিস, কাল সন্ধ্যায় মুনলাইট বারে ওঁর দিল্লি অফিসের ম্যানেজার ভানুপ্রতাপকে পুলিশ অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে। স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ বলেই আমার ধারণা। লোকটার নামে মার্ডার কেস ছাড়াও অন্য কোনো সাংঘাতিক কেস আছে। এই ব্যাপারটা মিঃ নেহালিয়া জানেন কিনা–

আমার কথার উপরে সৌমেন বলল, জানেন। আমি গত রাত্রে বাড়ি ফিরে মিঃ নেহালিয়াকে সব জানিয়েছি। উনি আমাকে মর্নিং-এ ওঁর বাড়িতে ডেকেছিলেন। কিন্তু আমি ঘুম থেকে আজ উঠেছি বেলা নটায়। তারপর বেরুব কি না ভাবছি। সেই সময় চন্দ্রিমার ফোন। এ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেও অনেকটা সময়। গেল। তারপর তোকে রিং করলুম।

কর্নেলের সঙ্গী হয়ে এযাবৎকাল কলকাতার নাড়ীনক্ষত্র আমারও খানিকটা চেনা হয়ে গেছে। কর্নেল কোথাও যেতে হলে সব সময় শর্টকাটের পক্ষপাতী। আমিও শর্টকাটে বালিগঞ্জ প্লেসে পৌঁছে গেলুম তখন বারোটা পাঁচ বাজে।

সৌমেনের নির্দেশমতো একটা ফ্ল্যাটবাড়ির গেটের কাছে গাড়ি দাঁড় করালুম। এই রাস্তাটার দুপাশে ঘন গাছপালা। চন্দ্রিমা কোন ফ্ল্যাটে থাকে সেটা দেখতে পাচ্ছিলুম না। সৌমেন গাড়ি থেকে নেমে বাঁদিকে একটা গলি দিয়ে অদৃশ্য হল। লক্ষ করলুম একটা ঘরে সিকিউরিটির লোক থাকে এবং সে সৌমেনকে চেনে।

আমি গাড়ি থেকে নেমে ছায়াঢাকা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে চারদিকটা দেখে নিলুম। কোথাও সন্দেহজনক কোনো লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলুম না। বাপী হয়তো চন্দ্রিমাকে নিছক ভয় দেখিয়ে গেছে।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। সৌমেনের সঙ্গে শাড়ি পরা এক সুন্দরী যুবতাঁকে দেখতে পেলুম। তার এক হাতে শুধু একটা লেডিস ব্যাগ আর সৌমেনের হাতে একটা কালো রঙের বেশ মোটাসোটা জাবদা ব্যাগ সে এসেই দরজা খুলে পিছনে ব্যাগটা ঢুকিয়ে দিল তারপর বলল, আপনি পিছনে বসুন, তারপর জানলার কাচ তুলে দিন। এবার সে আমার দিকে তাকাল, জয়ন্ত, তেমন কিছু লক্ষ করেছিস? মানে–

তার কথা বুঝতে পেরে বললুম, এই রাস্তার দুধারে কোনো দোকানপাট নেই। আর তেমন লোজনও নেই। আসলে তোদের নিউ আলিপুরের পশ এরিয়ার চেয়ে এটা কলকাতার খুবই অভিজাত এবং বনেদি জায়গা।

অবশ্য কথা বলতে বলতে আমি গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছি এবং সৌমেনও আমার বাঁদিকে উঠে বসেছে। এবার আমাদের যাত্রা ভবানীপুরে। আগের মতোই শর্টকাট করতে করতে ভবানীপুরে পৌঁছলুম তারপর বললুম, কর্নেলের সঙ্গে আমি তোর দাদুর বাড়িতে কাল এসেছিলুম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে জায়গাটা ভুলে গেছি।

সৌমেন বলল, চল, সামনের মোড়ে ডানদিকে ঘুরে যাবি। তার পর আমি দেখিয়ে দেব।

কুমারবাহাদুরের বাড়ির গেটে পৌঁছে হর্ন দিতেই দারোয়ান সৌমেন এবং আমাকে দেখে সেলাম ঠুকে গেট খুলে দিল। সে সৌমেনের উদ্দেশে বলে উঠল, আরে বড়বাবু, আপ কিতনে দিন বাদ এ বাড়িতে আসলেন।

সৌমেন একটু হেসে বলল, তোমার ছোটবাবু বাড়িতে আছেন তো?

চতুর্ভুজ বলল, না। উনহী তো মরনিংয়ে বাহার গেছেন। এখনও আসেননি।

আমি গাড়িতে আস্তে হর্ন বাজিয়েছিলুম। দেখলুম পোর্টিকোর ছাদে কালকের মতো কুমারবাহাদুরকে ছড়ি হাতে। তারপরই তিনি সৌমেনকে দেখে ছড়ি তুলে বললেন, অ্যাই বজ্জাত কোথাকার! আজ তোর পিঠে ছড়ি ভাঙব।

পোর্টিকোর ভিতর গাড়ি ঢুকিয়ে আমি জিগ্যেস করলুম, মিস সেনকে কি সঙ্গে নিয়ে যাবি?

সৌমেন মুখটা করুণ করে বলল, প্লিজ জয়ন্ত, একটু সময় দে। আমি আগে দাদুকে ম্যানেজ করি। তারপর মাসিমাকে তুষ্ট করতে হবে। এখন কিছুক্ষণ আমার রীতিমতো অভিনয়ের পালা।

বলে সে জানলার ফাঁক দিয়ে চন্দ্রিমাকে লক্ষ করল–আপনি কিন্তু অভিনেত্রী, এটা ভুলে যাবেন না। আপনার আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করে যাব। আপনাকেও চোখের জলে নাকের জলে কিছুটা ম্যানেজ করতে হবে। তারপর অর্ক চলে এলেই হবে।

কথাগুলো বলেই সে ঘুরে দাঁড়াল। এক ভদ্রলোক হলঘরের দরজা খুলে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এঁকে কাল দেখেছিলুম। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, আজ সূর্য উল্টো দিকে উঠেছে। চলো, কুমারবাহাদুর ছড়ি হাতে অপেক্ষা করছেন। আশ্চর্য, আমাদের একেবারে ভুলে গেলে তুমি!

কথাটা বলে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর চোখে বিস্ময় লক্ষ করছিলুম। কিন্তু সৌমেন তাকে ঠেলতে ঠেলতে ভিতরে ঢোকাল, বলল, তুমি আমার বডিগার্ড হয়ে চলো। দাদুর ছড়ি তোমার উপর ভাঙবে, আমি বেঁচে যাব।

ভদ্রলোক অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার সঙ্গে চলে গেলেন। পিছন ফিরে দেখলুম চন্দ্রিমা ঠোঁট কামড়ে ধরে বসে আছেন। মুখে আষাঢ়ের ঘনঘটা। একটু হেসে বললুম, মিস সেন, পরিস্থিতির সঙ্গে পুরুষদের চেয়ে মেয়েরা দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তাছাড়া কলকাতায় আপনার আত্মরক্ষার জন্য এত শক্তিশালী দুর্গ আর কোথাও নেই। ইতিমধ্যে বাপী ব্যানার্জিকে আমাদের কর্নেল সাহেব খাঁচায় ঢোকাবেন।

চন্দ্রিমা আস্তে বলল, কিন্তু ওর গার্জেন খুব প্রভাবশালী। শুনেছি যতবার পুলিশ ওকে ধরে নিয়ে যায় ততবারই কীভাবে সে পুলিশের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসে।

বললুম, কর্নেল সাহেব পুলিশ নন, মিলিটারি অফিসার। রিটায়ার্ড হলেও তিনি একজন কিংবদন্তি। শুধু রাজ্য সরকার নন, কেন্দ্রীয় সরকারও কর্নেল সাহেবকে মাঝে মাঝে অনেক সাংঘাতিক দায়িত্ব দেন। কাজেই আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। সৌমেনকে বলে দেব সে এ বাড়ি থেকেই সব কথা কর্নেল সাহেবকে ফোন করে জানিয়ে দেবে।

চন্দ্রিমা বিব্রত কণ্ঠস্বরে বলল, কিন্তু এ বাড়িতে যদি আমাকে অর্কর মা বা দাদু আশ্রয় না দেন?

বললুম, প্রব্লেম। কর্নেল মিঃ মৃগাঙ্ক চৌধুরিকে পরামর্শ দিয়েছেন শিগগির তার ছবির ব্যাপারে কোনও আউটডোর লোকেশনে আপনাকে যেন তিনি নিয়ে যান। অনেক উপযুক্ত লোকেশনের ঠিকানাও কর্নেল তাকে দিয়েছেন। সেখানে অন্তত এক সপ্তাহ আপনাকে থাকতে হবে। ইতিমধ্যে কর্নেল গুন্ডা বাপী এবং আপনার প্রতিপক্ষ যদি কেউ থাকে, তাদের শায়েস্তা করে ফেলবেন।

চন্দ্রিমা ব্যস্তভাবে বলল, একথাটা আপনি আগে বললে আমি এভাবে চলে আসতুম না। মৃগাঙ্ককাকুর জন্য অপেক্ষা করতুম।

বললুম, ঠিক বলেছেন। আমারই ভুল। আসলে সৌমেনের তাড়ায় আমার বুদ্ধিসুদ্ধি গুলিয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু সৌমেন এখনও আসছে না কেন? আমি অস্থির হয়ে পড়েছিলুম। মনে হচ্ছিল, চন্দ্রিমা ঠিকই বলেছে। এ ধরনের সেকেলে বনেদি পরিবারে ফিল্ম করা মেয়ের স্থান হবে না।

ঠিক এই সময় লনে অর্ককে দেখতে পেলুম। সে হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে আসছিল। আজ গ্যারাজে তার গাড়িটা নেই, তা আমার চোখে পড়েছিল। সে তার গাড়িটা নিশ্চয় মেরামত করতে দিয়েছে কোথাও।

অর্ক আমাকে দেখে খুব অবাক হয়েছিল। থমকে দাঁড়িয়ে সে বলল, আপনি? কর্নেল সায়েব এসেছেন নাকি? কী ব্যাপার? আপনারা কি আমাদের ফলো করে এসেছিলেন? মৃগাঙ্ককাকুর গাড়ি আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেল।

তাকে ইশরায় কাছে ডেকে চাপাস্বরে বললুম, আমার গাড়িতে কে আছে আগে দেখে নিন। তারপর গাড়িতে চুপিচুপি উঠে পড়ুন। সব কথা জানতে পারবেন।

অর্ক উঁকি মেরে চন্দ্রিমাকে দেখে তখনই পিছনের দরজা খুলে উঠে গেল। তারপর ওদের চাপাস্বরে কথাবার্তা শুরু হল। প্রায় পনেরো মিনিট কেটে গেছে। তখনও সৌমেনের পাত্তা নেই।

সৌমেন ফিরল আরও প্রায় পাঁচ মিনিট পরে। তার মুখে ক্রোধের ছাপ স্পষ্ট। সে বলল–হোপলেস! আমারই ভুল। দুই বোন একেবারে পরস্পরের প্রতিবিম্ব। দাদু রাজি হলেন। কিন্তু মাসিমা–

তাকে থামিয়ে দিয়ে বললুম, গাড়ির ভিতরে উঁকি মেরে তারপর আমার পাশে উঠে বোস। এবার সোজা কর্নেলের বাড়ি যাব।

অর্ককে দেখেই সৌমেন উল্লাসে ফেটে পড়ল।–ওঃ! তুই এ বেলা বাড়ি ফিরবি জানলে এতক্ষণ মাসিমার পায়ে দেড়-দু লিটার তৈল মর্দন আর হাফলিটার অশ্রু বিসর্জন করতুম না। জয়ন্ত! কুইক!

সে সামনে আমার বাঁদিকে উঠে বসল। আমি গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলে অর্ক বলল, চন্দ্রিমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন জয়ন্তবাবু?

বললুম, কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সুরক্ষিত দুর্গে।

অর্ক বলল, না। ঢাকুরিয়ায় মৃগাঙ্ককাকুর বাড়িতে চলুন। আমি বলছি কীভাবে শর্টকাটে যাবেন। কর্নেল সায়েবের বাড়ি থেকে ফেরার সময়ই আমরা ঠিক করে ফেলেছি, কর্নেলসায়েবের পরিচিত একটা জায়গায় আজ রাতের ট্রেনে মৃগাঙ্ককাকুর একটা ছোট টিম যাবে। চন্দ্রিমাও আমাদের সঙ্গে যাবে। মৃগাঙ্ককাকুর প্রোডাকশান-ম্যানেজার অলকবাবু কলকাতায় থাকবেন। বলিউড হিরোইনের সঙ্গে তিনিই যোগাযোগ রাখবেন।

সৌমেন হাসতে হাসতে বলল, খুব বাঁচা গেল এ দফা। অর্ক! তুই এ সময় এসে না পড়লে আমাকে হয়তো কর্নেল সায়েবের পায়ে দেড় লিটার।

বাধা দিয়ে চাপাস্বরে বললুম, মোটেও না কর্নেল বরং হাতে দাঁও পেতেন। চন্দ্রিমা সেনের পেট থেকে অনেক ক্ল বের করে নিতেন।…

.

১০.

ঢাকুরিয়া এলাকায় ফিল্ম প্রোডিউসার মৃগাঙ্ক চৌধুরির বাড়িতে অর্ক আর চন্দ্রিমাকে পৌঁছে দিয়েই আমরা ফিরে আসছিলুম। গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশনের কাছে এসে ঘড়ি দেখে সৌমেন বলল, সাড়ে বারোটা বাজে। এখন আর বাড়ি ফিরে আবার অফিসে যাওয়া এক ঝক্কি। স্নান করো, পেট পুরে খাও তারপর ভাতঘুমের নেশা কাটিয়ে পোশাক পরে অফিস যাওয়া এক ঝামেলা। কী বলিস জয়ন্ত?

ওর কথা শুনে আমার হাসি পেয়েছিল। বললুম, তোর এই স্বভাবটা আমারও আছে। তবে দৈনিক সত্যসেবক-এ আমার কিছুটা প্রিভিলেজ আছে। আমার তিনটে-নটা ডিউটি হলেও কর্নেলের কোনো কেসে আমি জড়িয়ে পড়লে আমার লম্বা ছুটি। তারপর চায় একটা সাংঘাতিক রহস্যময় কেসের প্রতিবেদন।

সৌমেন জিগ্যেস করল, তুই কি সল্টলেকে যাবি? নাকি কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে?

আমি ওকে মিঃ নেহালিয়ার সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথাটা বললুম। সৌমেন বলল, ওই ভদ্রলোক যদি বারোটায় কাউকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে থাকেন তাহলে তাকে গিয়ে বেলা তিনটে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অবশ্য তোর কথা আলাদা। আমাকে তোর কথা অনেকবার বলেছেন অর্থাৎ তুই একটা রাঘববোয়াল। তোকে পাকড়াও উনি করতে চান।

বললুম, তাহলে গড়িয়াহাটে কোথাও গাড়ি রেখে মিঃ নেহালিয়াকে ফোন করে জানিয়ে দিই যে আমি আর তুই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।

সৌমেন সায় দিল। গড়িয়াহাটে পৌঁছে বাঁদিকে গাড়ি রেখে একটা ওষুধের দোকানে আমি ঢুকে পড়লুম। আমার অভিজ্ঞতা কলকাতার ওষুধের দোকানগুলো বাইরের লোক ফোন করতে দিতে আপত্তি করে না। কিন্তু প্রত্যাশা করে লোকটি নিশ্চয় ওষুধ কিনবে। আমি দুটো অ্যাসপিরিনের ট্যাবলেট কেনার পর ফোন করতে চাইলুম। অনুমতি পাওয়া গেল। তার পর মিঃ নেহালিয়ার অফিসে ফোন করলুম। মহিলা অপারেটর আমার নাম শুনে বলল, উনি আপনার জন্য আধঘণ্টা অপেক্ষা করে বেরিয়ে গেছেন। আমাকে বলে গেছেন জার্নালিস্ট মিঃ চৌধুরি যদি রিং করেন তাকে আমার বাড়িতে সন্ধ্যা ছটায় যেতে বলবে।

ওঁকে ধন্যবাদ দিয়ে টেলিফোন রেখে গাড়িতে ফিরে গেলুম। তারপরই মনে পড়ল সৌমেনের কাছে মিঃ নেহালিয়ার সঙ্গে সরাসরি কথা বলার হট লাইনের নাম্বার আছে। সেটা জেনে নিতে হবে।

সৌমেন আমার কথা শুনে সেই নাম্বারটা দিল। তারপর বলল, তুই বরং একা যাস। আমি আজ অফিসে যাচ্ছি না। কোনো হোটেলে খেয়ে নিয়ে কর্নেলের বাড়িতে যাব। আমি তোকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব।

বললুম, খাওয়া-দাওয়া পরে। এখন সোজা কর্নেলের কাছে গিয়ে পুরো ঘটনাটা বলা দরকার। উনি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

কিছুক্ষণ পরে কর্নেলের বাড়িতে পৌঁছে পার্কিং জোনে গাড়ি রাখলুম তার পর দুজনে তিনতলায় উঠে গেলুম। ডোরবেলে হাত পড়তেই ষষ্ঠীচরণ দরজা খুলে দিল। সে চাপাস্বরে বলল, টিকটিকিবাবু এসে বাবামশায়ের কান দুটোর বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল। তারপর দোতলায় লিন্ডাদের কুকুরের চেঁচামেচি শুনে বাবামশাই আমাকে ডেকে বললেন, আইহোল দিয়ে দেখ, দেখবি নিশ্চয় অচেনা কেউ আসছে।

বলে সে সোজা করিডর দিয়ে সম্ভবত কিচেনে চলে গেল। আমি আর সৌমেন ছোট ওয়েটিং রুমের ভিতর দিয়ে এগিয়ে কর্নেলের জাদুঘর সদৃশ বিশাল ড্রয়িংরুমে ঢুলুম।

হালদারমশাই সহাস্যে বললেন, আয়েন আয়েন জয়ন্তবাবু।

আমি বললুম, আমার সঙ্গে কে, চিনতে পারছেন না?

গোয়েন্দাপ্রবর জিভ কেটে নমস্কার করে বললেন, অঃ, চিনছি। ইনি আমাগো নাটকের বিগ রোলে আছেন। বহেন সৌমেনবাবু।

কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, তোমাদের দুজনকে দেখে বুঝতে পারছি মিঃ নেহালিয়াকে ছেড়ে অন্য কোনও ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলে।

আমরা সোফায় বসে দুজনেই একসঙ্গে বললুম, ঠিক বলেছেন। তারপর আমি বললুম, হালদারমশাইয়ের নিশ্চয় আজ লাঞ্চের নেমন্তন্ন। আমি আবার একজন গেস্টকে জুটিয়ে এনেছি।

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, ওসব ভাবনা তোমার নয়। দুজনে কোথায় রাজা-উজির মারছিলে, ডিটেলস শোনাও।

প্রথমে সৌমেন তারপর আমি ঘটনাটার বিবরণ দিতে থাকলুম। মাঝে মাঝে কখনও আমি কখনও সৌমেন কথা বলছিল।

আমাদের কথা শেষ হলে কর্নেল বললেন, খামোখা কুমারবাহাদুরকে জ্বালাতন না করে তুমি আমাকে টেলিফোন করতে পারতে, সৌমেনও করতে পারতে।

দুজনেই. স্বীকার করলুম, আমাদের ভুল হয়েছে। আমাদের পাশে থেকে গোয়েন্দাপ্রবর একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন, আপনারা বাহির হইছেন আর আমিও আমার ক্লায়েন্টের লগে দেখা করতে গেছি। কারণ সৌমেনবাবুর কথা বলার পরই আমারে টেলিফোন করছিলেন। আমারে দেইখ্যা ম্যাডার সব কথা কইয়্যা ফেললেন। তারপর কাঁদতে কাঁদতে আমারে কইলেন তার দিদির পোলা ওই ফিল্মের মাইয়াটারে অর্কের ঘাড়ে চাপাইয়া ছাড়বে। অর সর্বনাশ করবে। আপনি ওই মাইয়াটারে টেলিফোনে গ্রেটিং করুন। কিংবা যেভাবে পারেন অরে অর্কের সঙ্গছাড়া করেন।

সকৌতুকে বললুম, আপনি ফিল্মের মেয়েটির ফোন নাম্বার জানেন কি?

হালদারমশাই বললেন, হঃ, জোগাড় করছি। তারে ফোন করছিলাম, কিন্তু সে বাড়িতে নাই। তার পিসিমা কইল সে নাকি কোথায় শুটিং করতে গেছে।

কর্নেল আবার চোখ কটমট করে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, তুমি মিঃ নেহালিয়ার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল করেছ। এটাই বেশি জরুরি ছিল।

সৌমেন বলল, মিঃ নেহালিয়া জয়ন্তকে সন্ধ্যা ছটায় তার বাড়িতে যেতে বলেছেন। আমিও ওর সঙ্গে থাকব। কিন্তু আপনি কেমন করে জানলেন–

কর্নেল তার কথার উপর বললেন, আমি মিঃ নেহালিয়ার অফিসে ফোন করেছিলাম। জয়ন্তের কথা উল্লেখ করেছিলুম। অপারেটার বলল, উনি আসেননি।

কথাটা বলে তিনি হেসে উঠলেন, তোমরা দুই বন্ধু একেবারে মানিকজোড়। সুতরাং এবেলা আমরা চারজনে একসঙ্গে লাঞ্চ খাব।

বললুম, ব্যাপারটা একটা স্পেশাল অকেশন মনে হচ্ছে।

কর্নেল সচরাচর বেলা একটায় দুপুরের খাওয়া সেরে নেন। আজ আধঘণ্টা দেরি করেই খাবার টেবিল সাজিয়েছিল ষষ্ঠী। খাওয়ার পর আমি যথারীতি ডিভানে চিত হয়ে শুয়ে পড়লুম। সৌমেন সোফার কোণে হেলান দিয়ে বসল। হালদারমশাই কিছুক্ষণ বসে থাকার পর যথারীতি একটিপ নস্যি নিলেন তার পর বললেন, তা হলে আমি যাই গিয়া। ঠিক সময়ে আপনারে ফোন করব কর্নেল স্যার।

কর্নেল বললেন, আবার বলছি একটু সাবধানে থাকবেন। নেহাৎ প্রাণ বাঁচানোর অবস্থার সৃষ্টি হলে তবেই এক রাউন্ড ফায়ার করতে পারেন। কিন্তু ভুলে যাবেন না। আপনি এখন আর পুলিশ অফিসার নন।

গোয়েন্দাপ্রবর খি খি করে হেসে বললেন, নাঃ। তেমন সিচ্যুয়েশন ঘটবে না। আচ্ছা চলি। সৌমেনবাবু, একটা আর্জেন্ট কামে বার হইতাছি। তা না হলে, আপনাগো লগে গল্প কইর‍্যা খুশি হইতাম।

সৌমেন কিছু না জেনেই বলল, উইশ ইউ গুড লাক মিঃ হালদার।

আমি ভাতঘুমের আশায় চোখ বুজে ছিলুম। কিন্তু কর্নেল ডাকলেন, জয়ন্ত। সোয়া দুটো বাজে। আমাদের হাতে অনেক কাজ আছে। এখানে এসো। একটা আর্জেন্ট মিটিং সেরে নিই।

অগত্যা সোফায় গিয়ে বসতে হল। তিনি কিছুক্ষণ চুপচাপ চুরুট টানার পর বললেন, আচ্ছা সৌমেন, দিল্লিতে যে রাত্রে তোমরা মিসেস শালিনীর কাছ থেকে ফিরে হোটেল পারিজাত-এ উঠেছিলে, সেই রাতে কি মিঃ নেহালিয়া ডিনারের পর একা বেরিয়েছিলেন?

সৌমেন নিষ্পলক চোখে তাকিয়েছিল। একটু পরে বলল, ও হ্যাঁ। মনে পড়েছে, আমরা একটা ডাবল বেড সুইটে ছিলুম। আমি শুয়ে পড়েছিলুম। মিঃ নেহালিয়া তার বিছানার কাছে হোটেলের টেলিফোন তুলে নিয়ে তাঁর মাতৃভাষায় কার সঙ্গে কথা বলছিলেন। এতে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। কিন্তু তার পর উনি রিসিভার রেখে আমাকে জিগ্যেস করেছিলেন আমি ঘুমিয়ে পড়েছি কি না। আমি চোখ বন্ধ করে ছিলুম কিন্তু ঘুমোইনি। আমার সাড়া পেয়ে উনি বলেছিলেন, কাল মর্নিং-এ আমাদের প্লেন। আমি একেবারে ভুলে গেছি এক ভদ্রলোকের সঙ্গে রাত সাড়ে নটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। আমি রিং করে জেনে নিলুম উনি এখনও আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি একবার বেরুচ্ছি। ফিরতে দেরি হলেও চিন্তা কোরো না। আমি বাইরে থেকে দরজা লক করে যাচ্ছি। তোমার নিশ্চয় বাইরে বেরোনার দরকার নেই। যাই হোক, মিঃ নেহালিয়া কখন ফিরেছিলেন তা আমি জানি না। কারণ আমার খুব ঘুম পেয়েছিল।

কর্নেল ড্রয়ার থেকে একটা নোটবই বের করে পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। তার পর। কিছু লিখে নিয়ে বললেন, সকালে যখন তোমার ঘুম ভাঙে তখন কি মিঃ নেহালিয়ার হাবভাবে কোনো রূপান্তর চোখে পড়েছিল?

সৌমেন আবার একটু ভেবে নিয়ে বলল, খুঁটিয়ে কিছু লক্ষ করিনি, তবে আমার মনে হচ্ছিল উনি কেমন যেন অন্যমনস্ক। প্লেন ধরার কথা আমাকেই মনে করিয়ে দিতে হয়েছিল।

কর্নেল জিগ্যেস করলেন, প্লেনে কি তিনি তোমাকে কথাপ্রসঙ্গে এমন কিছু বলেছিলেন যাতে তোমার মনে হতে পারে তিনি তার দিল্লি ব্রাঞ্চ তুলে দেবেন?

সৌমেন বলে উঠল, মাই গুডনেস! প্লেনে আসবার সময় তিনি বারবার ভানুপ্রতাপ সিংহের সম্পর্কে বিরক্তি প্রকাশ করছিলেন। বলছিলেন, তার উপর এই কাজের দায়িত্বটা দিয়ে এলুম, নিশ্চয়ই কোনও গোলমাল পাকিয়ে ফেলবে। ফেললে সে-ই বিপদে পড়বে। ডিডটা রেজিস্ট্রি করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু

সৌমেন হঠাৎ চুপ করল। বলল, এই ধরনের কথাবার্তা বলছিলেন উনি। কিন্তু সব কথা এখন আর মনে নেই। তবে মোটামুটিভাবে আমার একটা ইমপ্রেশন, যে কোনো কারণেই হোক মিসেস শালিনীকে তিনি যেন ঘৃণাই করেন এবং মিঃ সিনহাকে বিশ্বাস করেন না।

কর্নেল নোটবইটা বন্ধ করে রেখে চোখ বুজে কিছু ভেবে নিলেন। তার পর সৌমেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, কলকাতায় ফেরার পর তুমি কি মিস্টার নেহালিয়ার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করেছিলে?

সৌমেন বলল, হ্যাঁ। পরদিন ওঁর অফিসে উনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

কথাটা বলেই সৌমেন নড়ে উঠল। অভ্যাসবশে বলে উঠল, মাই গুডনেস। আমি তো ওঁর চেম্বারে ঢোকার একটু আগে করিডরে–হ্যাঁ, আই অ্যাম রাইট একটা লোককে ওঁর চেম্বার থেকে করিডরে হন্তদন্ত হেঁটে আসতে দেখেছিলুম। তারপর আমি যখন বাঁদিকে মিঃ নেহালিয়ার চেম্বারে ঢুকছি তখন একবার ঘুরে লক্ষ করলুম নোকটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে যেন আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই সে চলে গেল। কর্নেল সাহেব, আমি আসলে তমাল বোসকেই দেখেছিলুম। তখন তার পরনে ছিল টাই-স্যুট, হাতে ব্রিফকেস। সেজন্যই আমি মুনলাইট বারে জিনস আর নীল টি-শার্ট পরা তমাল বোসকে চিনতে পারিনি। কর্নেল তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, আর ইউ সিওর?

সৌমেন জোর দিয়ে বলল, সেন্ট পার্সেন্ট সিওর। আসলে কলকাতা ফিরে ওই উড়ো চিঠি আর টেলিফোনে তমাল বোসের কথাবার্তা শুনে আমি খুবই হকচকিয়ে গিয়েছিলুম। আমার বুদ্ধিশুদ্ধি ঘুলিয়ে গিয়েছিল।

কর্নেল বললেন, এবার আর একটা প্রশ্ন করছি। এটা ভাইটাল প্রশ্ন ব্যাপারটা আমার চোখে পড়েছিল, কিন্তু তুমি কি লক্ষ করেছিলে যে লাল শার্ট পরা ভানুপ্রতাপ সিনহার দিকে তমাল বোস এক হাত তুলে আঙুলের ইশারায় কিছু বলেছিল?

সৌমেন বলল, মনে পড়ছে না। তবে তার আড়ামোড়া করার মতো এক হাত বা দুই হাত ভোলার অভ্যাস আমি লক্ষ করছিলাম।

কর্নেল বললেন, আমি তোমাদের দিকে পিছু ফিরে বসেছিলুম। এই ব্যাপারটা জয়ন্তর লক্ষ করার কথা।

বললুম, আমি সিনহার দিকে পিছন ফিরে বসেছিলুম। তাছাড়া পিছনে আরও দুটো টেবিলে তোক ভর্তি। কেউ কেউ হাত তুলে ওয়েটারকে ডাকছিল।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, সিনহার দিকে আমার চোখ পড়ার কারণ সে আমার পিছনে কোনও লোকের দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারা করছিল। তাই সে কার দিকে ইশারা করছে দেখার জন্য একটু ঘুরতেই চোখে পড়েছিল তমাল বোস হাত তুলে আঙুল নেড়ে কী একটা করছে।

বললুম, এখন এসব কথা কেন?

কর্নেল তাঁর স্বাভাবিক চপলতায় ফিরে এলেন। মিটিমিটি হেসে বললেন, ডার্লিং, আমরা কতকগুলো ঘটনার পিছনে ছুটে যাচ্ছিলুম। সেগুলো আলাদাভাবে রহস্যজনক। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো লিংক ছিল না। আমার মনে হচ্ছে এতক্ষণে আমি লিংক খুঁজে পেয়েছি।

জিগ্যেস করলুম, লিংকটা কীসের?

কর্নেল তেমনি মিটিমিটি হেসে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, লোকে আমাকে অন্তর্যামী বলে। আমার মাথার পিছনেও নাকি অনেক চোখ আছে। আবার বলছি সব বোগাস। ব্যাপারটা একটা অঙ্কের মতো। কতকগুলো সংখ্যা হাতে এলে আমি অঙ্কটা নির্ভুল কষে দিতে পারি।

সৌমেন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল কর্নেলের দিকে। আমি তাকে চিমটি কাটতেই সে ধাতস্থ হল। তারপর বলল, লিংকটা কীসের তা বলতে কি আপত্তি আছে আপনার?

কর্নেল বললেন, শুনে অবাক হয়ো না। লিংকটা একটা পুরনো জড়োয়া নেকলেসের, যার দাম এ বাজারে কোটি টাকার কম নয়।

সৌমেন এবং আমি দুজনেই চমকে উঠে বললুম-জড়োয়া নেকলেস?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু এটার একটা ঐতিহাসিক মূল্যও আছে। হায়দারাবাদের নিজামবাহাদুরের এক আত্মীয় নেকলেসটা চুরি করে কাকে বিক্রি করেছিলেন। ঘটনাচক্রে প্রায় তিরিশ বছর পরে এটা দিল্লির একটা অকশন হাউস থেকে নিলামে বিক্রি হয়েছিল। বেশি দর দিয়ে কিনেছিলেন জনৈক ব্যবসায়ী। তাঁর নাম হিরাচাঁদ জৈন। এই নামটা যে তার আসল নাম নয়, তাতে আমি নিঃসন্দেহ।

জিগ্যেস করলুম, কিন্তু আপনি হঠাৎ আজ কোন সূত্রে এসব তথ্য পেলেন?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, তুমি তো জানো, খবরের কাগজে কোনও ইন্টারেস্টিং খবর বেরুলে আমি তার কাটিং রাখি। আজ তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পর নেহাত খেয়ালবশে কাটিংয়ের ফাইলটা বের করে চোখ বুলোচ্ছিলুম। তারপর ওই খবরের কাটিংটা দেখতে পেলুম। এটার পরবর্তী খবরের কাটিংয়ে জানতে পারলুম দিল্লিতে ঐতিহাসিক জড়োয়া নেকলেস নিলামের কথা। এর সংলগ্ন তৃতীয় কাটিং পড়ে একটু চমক জেগেছিল। নিজামবাহাদুরের উত্তরাধিকারীরা দাবি করেছেন, নেকলেসটির প্রকৃত মালিক তারাই। তারা পুলিশকে জানিয়েছেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারকেও অনুরোধ করেছেন

উত্তেজিত সৌমেন বলে উঠল, হিরাচাঁদ জৈন নামে সূরজদাস নেহালিয়া ইলেকট্রনিক গুডসের কারবার করেন। এই কারবারে জাল আমদানি লাইসেন্সের কেসে প্রায় ফেঁসে গিয়েছিলেন। জনৈক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা তাকে বাঁচিয়ে দেন। মিঃ নেহালিয়া গোপন ওইসব কথা জানিয়ে সেই নেতার সঙ্গে সাংবাদিক হিসেবে আমাকে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন।

কর্নেল বললেন, সেই নেতার নাম কি শৈলেন বসুরায়?

সৌমেন ফাঁসফেঁসে গলায় বলল, শৈলেন বসুরায়। কিন্তু আশ্চর্য! খুবই আশ্চর্য! আপনি–

কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে সহাস্যে বললেন, ধাতস্থ হও। এটা ম্যাজিকের আসর নয়। আমি আজ দুপুরে সি আই ডি অফিসার নরেশবাবুর কাছে টেলিফোনে জানতে পেরেছি, শৈলেনবাবুই মাফিয়াডন বাপীর গার্জেন।

বললুম, সৌমেন! তুই কি শৈলেনবাবুর সঙ্গে দেখা করেছিলি?

সৌমেন ক্লান্তভাবে বলল, নাঃ তবে এখন মনে হচ্ছে, তমাল বোসই মিঃ নেহালিয়াকে শৈলেনবাবুর সঙ্গে বাপীর সাহায্যে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। আমার অঙ্ক থেকে এই রেজাল্টই বেরিয়ে এসেছে। বাই দা বাই, তুমি কি মিঃ নেহালিয়ার কাছে জানতে চাওনি মিসেস শালিনীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কী?

সৌমেন বলল, আমি দিল্লি আসবার সময়ই জানতে পেরেছিলুম, শালিনী দেবী মিঃ নেহালিয়ার প্রথম পক্ষের স্ত্রী। তার সন্তানাদি না হওয়ায় তার অনুমতি নিয়েই তিনি কলকাতায় আবার বিয়ে করেছিলেন।

একটু হেসে বললুম, আচ্ছা কর্নেল, এমন কি হতে পারে না, দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি দেওয়ার মূল্য হিসেবে শালিনী দেবী স্বামীর কাছে সেই ঐতিহাসিক নেকলেস আদায় করেছিলেন?

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, নরেশবাবুর কাছে শুনেছি, দিল্লি-পুলিশ শালিনী দেবীর হত্যাকাণ্ডের মোটিভ হিসেবে তাঁর সোনাদানা গয়নাগাটিকেই দায়ী করছে। দিল্লিপুলিশের একটা সোর্স হায়দারাবাদের নিজামের চুরি যাওয়া নেকলেসের কথা বলেছে। কিন্তু এখনই তারা সরাসরি মিঃ নেহালিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে না। গোপন তদন্ত চলেছে।

সৌমেন বলল, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মিঃ নেহালিয়া শৈলেনবাবুকে ধরেছেন এবং শৈলেনবাবু সম্ভবত পুলিশকর্তাদের বেশি নাক গলাতে দিচ্ছেন না।

কর্নেল বললেন, তোমাকে মিঃ নেহালিয়া আজ সন্ধ্যায় তাঁর বাড়িতে ডেকেছেন। তুমি একাই যাবে। কারণ জয়ন্তর সামনে উনি মুখ খুলতে দ্বিধা করবেন। ওঁর কথা শুনে তুমি ওঁকে ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিয়ে সোজা আমার এখানে চলে আসবে। উইশ ইউ গুড লাক।…

.

১১.

সৌমেন যখন বেরিয়ে গেল তখন সোয়া চারটে হবে। ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি এনে বলল, আর এক দাদাবাবুর জন্য কফি করেছিলুম। কর্নেল বললেন, তোর সেই দাদাবাবুকে কফি খাওয়ার জন্য আরও কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখলে সে ট্রেন ফেল করত। ষষ্ঠীচরণ কর্নেলের কথায় ঝঝ টের পেয়ে তখনই কেটে পড়ল।

আমি বললুম, কিন্তু ষষ্ঠী ঠিকই বলেছে। সৌমেনের নার্ভ চাঙ্গা করে পাঠালে ঠিকই হত। তা ছাড়া তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট তো সন্ধ্যা ছটায়।

কর্নেল বললেন, তোমার বন্ধুটি আমার ব্ৰজাঘাত হানার দরুন ভীষণ নার্ভাস হয়ে গেছে। কফিতে ওর স্নায়ু চাঙ্গা হত না। ওকে বাড়ি ফিরে গিয়ে ধাতস্থ হওয়ার সুযোগ দিলুম। তা ছাড়া তোমাকে আমি বরাবর আমার ইনটিউশনের কথা বলি। সামরিক জীবনে ওই একটা আশ্চর্য গুণ আমি অর্জন করেছিলুম।

কফির পেয়ালা তুলে নিয়ে বললুম, আপনার ইনটিউশন কি সৌমেনকে এক ধাক্কায় বাইরে পাঠিয়ে দিল?

কর্নেল কফিতে লম্বা চুমুক দেওয়ার পর বললেন, কতকটা তাই। আমার কেন যেন মনে হল সৌমেন এখানে বসে না থেকে বাইরে গেলে ভালোমন্দ যা-ই হোক কিছু একটা ঘটতে পারে।

চমকে উঠে বললুম, ভালোর সঙ্গে মন্দও বলছেন কেন?

কর্নেল হাসলেন, ভালো বললেই মন্দটা এসে পড়ে। তবে সেই মন্দটা সৌমেনের না হয়ে অন্য কারও হতে পারে।

এরপর আমরা চুপচাপ কফি পান শেষ করলুম। কর্নেলকে অবশ্য হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। তিনি চুরুট ধরিয়ে নিয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল করতে থাকলেন। তারপর সাড়া এলে বললেন, অরিজিৎ, আবার তোমাকে স্মরণ করছি..হা, গরজটা আমার। তুমি বলেছিলে বিকেলের মধ্যে রিং করে সেই খবরটা জানাবে…হ্যাঁ, আমি শুনছি, তুমি বলে যাও।

এরপর কর্নেল টেবিলে প্যাড এবং ডটপেনটা তুলে নিয়ে কীসব নোট করতে থাকলেন আর মুখে ক্রমাগত হুমহাম শব্দ করতে লাগলেন। প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ ডার্লিং, আমি এই জন্যই বলি সত্য জিনিসটা সব সময়ই ফালতু জিনিসের আড়ালে পড়ে থাকে। আর হ্যাঁ, আমার দ্বিতীয় আর্ষবাক্যটাও স্মরণ করো–আমরা অনেক সময় জানি না যে আমরা কী জানি। আবার এ লট অব থ্যাঙ্কস। রাখলুম।

কর্নেল রিসিভার রেখে প্যাডের উপর ইতস্তত হিজিবিজি লেখায় কয়েকটা টিক দিলেন। তারপর আমার দিকে তাকালেন। জিগ্যেস করলুম, আবার নতুন কিছু আড়াল থেকে বেরিয়ে এল বুঝি?

কর্নেল প্রসন্ন মুখে, কিন্তু চাপাস্বরে বললেন, স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ ভানুপ্রতাপ সিনহাকে কেন অ্যারেস্ট করল তা আমি নিজের অগোচরে জানতুম। হায়দারাবাদের নিজামের উত্তরাধিকারী তাঁদের হারিয়ে যাওয়া জড়োয়া নেকলেসটির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে আবেদন জানিয়েছিলেন। সেই সূত্রেই ভানুপ্রতাপকে ধরার জন্য দিল্লি থেকে নির্দেশ এসেছিল। এক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে নিলামে নেকলেসটি কিনেছিল জনৈক হিরাচাঁদ জৈন।

বললুম, ওটা তো সূরজদাস নেহালিয়ার আরেকটা নাম।

কর্নেল হাসলেন–দুর্নাম। ভানুপ্রতাপ সিনহাকে পুলিশ কাল থেকে দফায় দফায় জেরা করেও জানতে পারেনি হিরাচাঁদ জৈন কে।

বললুম, হিরাচাঁদের সঙ্গে ভানুপ্রতাপকে দিল্লি পুলিশ লিংক আপ করল কোন সূত্রে?

কর্নেল আবার চাপাস্বরে বললেন, ভানুপ্রতাপ সিনহা মিঃ নেহালিয়ার কোম্পানির যে দিল্লি ব্রাঞ্চের ম্যানেজার, খাতা-কলমে তার মালিক জনৈক হিরাচাঁদ জৈন।

জিগ্যেস করলুম, ভানুপ্রতাপ কি মিঃ নেহালিয়ার নাম করেনি?

করেছে। কিন্তু এখনও পুলিশ তার কথা বিশ্বাস করেনি। কারণ কলকাতায় নাকি মিঃ নেহালিয়ার খুব সুনাম আছে। দিল্লিতে তাঁর কারবার থাকার কোনও প্রমাণ পুলিশ খুঁজে পায়নি। হ্যাঁ, অরিজিৎ আমাকে বলল, লালবাজার থেকে মিঃ নেহালিয়ার অফিসে সাদা পোশাকের পুলিশ গিয়েছিল। স্বভাবত তিনি তার দিল্লিতে ব্রাঞ্চ থাকার কথা বেমালুম অস্বীকার করেছেন। তিনি তার অফিস সার্চ করে দেখতেও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। তাই পুলিশ আপাতত ফিরে গেছে।

আমি বলে উঠলুম, বোঝা গেল। এই ব্যাপারেই মিঃ নেহালিয়া সৌমেনকে তার বাড়িতে দেখা করতে বলেছিলেন। আপনার মতো আমারও যেন ইনটিউশন জন্মে গেছে।

কর্নেল সহাস্যে বললেন, তোমার ইনটিউশন বলছে যে, সৌমেন জানে না যে সে কী জানে। তাই না?

বললুম, ঠিক বলেছেন। সৌমেন মিঃ নেহালিয়ার এমন কোনো তথ্য জানে যা সে ভুলে বসে আছে। আমার ধারণা তাকে আপনি জেরা করলে নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে।

কর্নেল তার প্যাডের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভানুপ্রতাপের উপর দিল্লি পুলিশের দ্বিতীয় সন্দেহ সে মিসেস শালিনীকে খুন করেছে।

বললুম, হ্যাঁ আপনি তো বলছিলেন যে গয়নাগাটির লোভে–

আমাকে থামিয়ে কর্নেল বললেন, শুধু গয়নাগাটি নয়, শালিনীদেবী খুন হন রাত্রিবেলায় আর সেদিনই তিনি ব্যাঙ্ক থেকে পাঁচ লাখ টাকা তুলেছিলেন। ভদ্রমহিলার খুব সাহস। তিনি বাড়িতে কোনো কাজের লোককে রাত্রে থাকতে দিতেন না। দিনে যে মেয়েটি কাজকর্ম করত সে বলেছে ম্যাডাম তাকে বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন কিন্তু সব ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। সে বারান্দায় বসে ছিল। সেই সময় ভানুপ্রতাপ গিয়ে তাকে জিগ্যেস করে, তোমার ম্যাডাম কোথায়? মেয়েটি বলে তাকে বসিয়ে রেখে ম্যাডাম ব্যাঙ্কে গেছেন। শুধু এইটুকুই সূত্র থেকে ওখানকার পুলিশের ধারণা ভানুপ্রতাপই সম্ভবত খুনি। ওদিকে শালিনীদেবীর বাড়ি সার্চ করে যে ব্যাঙ্কের হদিস পাওয়া গিয়েছিল সেই ব্যাঙ্ক থেকে পুলিশ জানতে পারে শালিনীদেবী খুন হওয়ার দিনই ক্যাশ পাঁচ লাখ টাকা তুলেছিলেন। কেন অত। টাকা তিনি তুলেছিলেন তা এখনও জানা যায়নি।

একটু চুপ করে থাকার পর বললুম, সৌমেন বলছিল হোটেল পারিজাত থেকে রাত্রিবেলায় মিঃ নেহালিয়া বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি কোথায় গিয়েছিলেন এবং কেন সেকথা সৌমেনকে বলেননি। আমার ধারণা

আমাকে থামিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন, তোমার ধারণা অত রাত্রে মিঃ নেহালিয়া আবার তার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর কাছে গিয়েছিলেন?

বললুম, কিছু অস্বাভাবিক নয়। সম্ভবত ম্যাডামকে যেভাবে যোক বশ মানিয়ে তিনি সেই ঐতিহাসিক নেকলেস হাতিয়ে এনেছিলেন।

কর্নেল চুরুটের একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।

আমরা এইভাবে জল্পনা-কল্পনা চালিয়ে যাচ্ছিলুম। কখন ষষ্ঠী এসে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে লক্ষ করিনি। ওয়ালক্লকের দিকে তাকিয়ে দেখলুম ছটা বাজে। সময় কী দ্রুত ছুটে চলেছে। কর্নেল একবার উঠে বাথরুমে গেলেন। তারপর ফিরে এসে তিনি বসতেই ডোরবেল বাজল। কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী।

একটু পরে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাই সবেগে ঘরে ঢুকে ধপাস করে সোফায় বসে পড়লেন। তারপর শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলেন, বাপী ফিনিশড। এক্কেরে রক্তারক্তি কাণ্ড। ওঃ আমার চক্ষের সামনে তারে অপজিট পার্টির দুই হালায় গুলি কইর‍্যা মারল। তারা আইছিল মোটর সাইকেলে। বাপী ফুটপাতে খাড়াইয়া সিগারেট টানছিল।

কর্নেল তার দিকে তাকিয়েছিলেন নিষ্পলক চোখে। আমি উত্তেজিত হয়ে বললুম, কী সর্বনাশ! বাপী কোথায় খুন হল?

হালদারমশাই ভাঙা গলায় বললেন, সেই ফিল্মস্টারের ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে তারে খাড়াইয়া থাকতে দেখছিলাম। কর্নেল স্যার আমারে কইছিলেন ওই বাড়ির দিকে নজর রাখতে হইব। আমি একটু দূর থাইক্যা ওয়াচ করছিলাম। বাপীরে আমি চিনতাম না। সে ওই বাড়ির কোনো ফ্ল্যাটেই ছিল। তার মোটর সাইকেল ছিল ফুটপাতে। সে সিগারেট টানছিল।

কর্নেল এতক্ষণে বললেন, আগে আপনার স্পেশাল কফি খান হালদারমশাই। তারপর নার্ভ চাঙ্গা হলে আস্তেসুস্থে পুরো ঘটনাটা বলবেন।

অঃ, ঠিক কইছেন কর্নেল স্যার। আমার সামনে একটা মানুষ মার্ডার হইল আর আমি শুধু খাড়াইয়া দেখলাম, আমার বড্ড খারাপ লাগতাছে।

ষষ্ঠী ততক্ষণে হালদারমশায়ের কফি রেখে গেছে। তিনি কফির পেয়ালায় ফুঁ দিয়ে দিয়ে চোখ বুজে কফি পান করতে থাকলেন।

হালদারমশায়ের কফি পান শেষ হলে কর্নেল বললেন, আমি আপনাকে আরও একজনের দিকে লক্ষ্য রাখতে বলেছিলাম। তিনি কিন্তু আপনার প্রথম লক্ষ্যবস্তু ছিলেন।

গোয়েন্দাপ্রবর ঝটপট নস্যি নিলেন। তারপর নোংরা রুমালে নাক মুছে বললেন, সব জট পাকাইয়া গেছে। তিনটার সময় আমি বালিগঞ্জ পৌঁছেছিলাম। তার কিছুক্ষণ পরে মোটর সাইকেলে দুইজন আইয়া ওই বাড়ির গেটের সামনে থামল। তারপর দুইজনেই গেটের ভিতরে ভ্যানিশ হইয়া গেল। ব্যাকসিটে যে বইয়াছিল তার নাম তমাল বোস। আমি ক্যামনে জানুম সাহস কইর‍্যা গেটের কাছে গিছলাম। তারপর সিকিউরিটির লোকই হইব সে আমারে দেইখ্যা জিগাইল, কারে চান? তখন আমি তারে জিগাইলাম, যে দুইজন এখনই ঢুকলেন তাঁদের নাম জানেন? সে আমারে ক্যান জানি না ধমক দিয়া কইল, বোসোহেব জানতে পারলে বাপীরে পাঠাইয়া আপনারে ভালোমতন শিক্ষা দিব। আমি য্যান খুব ভয় পাইছি। এইভাবে দূরে কাইটা পড়লাম। সেখানে গাছের আড়ালে দাঁড়াইয়া নজর রাখছিলাম। তার প্রায় এক ঘণ্টা পরে একা বাপীরে ফুটপাতে দেখলাম। কিন্তু সে বাপী তা কেমন কইর‍্যা জানুম। মোটর সাইকেলের কাছে সে গেল না। ফুটপাতে খাড়াইয়া সিগারেট টানতে লাগল। তারপরই একটা মোটর সাইকেলে আচমকা আইয়া পড়ল তার দুইজন খুনি।

কথাগুলো বলে হালদারমশাই জোরে শ্বাস ছাড়লেন।

কর্নেল বললেন, ওখানে তো অত বেশি লোকজন চলাচল করে না। বাপীকে গুলি করার পর কোনও ভিড় হয়েছিল?

হালদারমশাই মাথা নাড়লেন, বেশ কিছুক্ষণ পরে দুপাশের বাড়ি থেকে লোকেরা বাহির হইছিল কিন্তু বডির কাছে যায় নাই। অনেক প্রাইভেট কার আর ট্যাক্সি পাশ দিয়া গেল কিন্তু অরা কিছু লক্ষ করে নাই।

কর্নেল জিগ্যেস করলেন তারপর তমাল বোসকে দেখতে পাননি?

হালদারমশাই সোজা হয়ে বসে বললেন, হ্যাঁ, তার কথা এক্কেরে মনে নাই। বাপীরে গুলি কইর‍্যা খুনিরা ভ্যানিশ হইছিল। তারপরেই বাপীর সঙ্গে যারে দেখছিলাম সেই লোকটা–তার মানে তমাল বোস আইয়া পড়ল। বডি দেইখ্যাই সে হন্তদন্ত উল্টা দিকে আউগাইয়া গেল। অরে ফলো করুম ভাবছিলাম কিন্তু দেখলাম সে একটা খালি ট্যাক্সি দাঁড় করাইয়া উধাও হইয়া গেল। কেউ পুলিশের ফোন করছিল। পুলিশ আইল আধা ঘণ্টা পরে। পাছে অরা আমারে দেখতে পায় তাই আমি কাইট্যা পড়লাম। তারপর ট্যাক্সি লইয়্যা সোজা আপনার এখানে আইয়্যা পড়লাম।

বললুম, কর্নেল, আপনি দেখছি সত্যিই ভবিষ্যদ্রষ্টা। চন্দ্রিমা ওখানে থাকলে পুলিশ তাকে সহজে রেহাই দিত না। আর বাপীর গার্জেন শৈলেনবাবু দুর্ধর্ষ রাজনৈতিক নেতা।

কর্নেল চুপচাপ টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। তারপর বললেন, আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। লাইনটা দয়া করে ডিটেকটিভ ইনসপেক্টার নরেশ ধরকে দিন…নরেশবাবু, এদিকে সাংঘাতিক খবর…আপনারা অলরেডি জেনে ফেলেছেন…হ্যাঁ, বাপীর গার্জেন একটা হই-হল্লা বাধাতে পারে। আপনাদের অবশ্য সে ব্যাপারে মাথা ঘামানোর কিছু নেই…ভানুপ্রতাপ সিংহের কী খবর… বাঃ! তাহলে আর কী! দিল্লি পুলিশ তাকেনিয়ে গিয়ে যা খুশি করুক, আপনার কোনো দায়িত্ব থাকছে না… আবার কী দায়িত্ব…হ্যাঁ, তমাল বোসকে আপনাদের হাতে পাওয়া দরকার। সে কিন্তু কলকাতা ছেড়ে যায়নি…না নরেশবাবু, আপাতত আমার হাতে কোনো তাস নেই। শুধু এটুকু জানি বাপী ব্যানার্জি যখন চন্দ্রিমার বাড়ি যায় তখন তার সঙ্গে তমাল বোসও ছিল। দুর্ঘটনা ঘটার পরেই সে কেটে পড়েছে। এবার আপনাদের হাতের তাস দেখতে চাই তবে এখন নয়… থ্যাঙ্কস নরেশবাবু, রাখছি।

কর্নেল রিসিভার রেখে নিভে যাওয়া চুরুটটা লাইটার জ্বেলে ধরালেন। তার পর ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন এবং চোখ বুজে চুরুট টানতে থাকলেন।

হালদারমশাই চাপাস্বরে আমার দিকে একটু ঝুঁকে বললেন, বুঝলেন জয়ন্তবাবু, কেউ যত বজ্জাতই হোক কিংবা খুনিই হোক, তারে কেউ আমার চক্ষের সামনে খুন করলে নিজেকে খুব হেল্পলেস মনে হয়। আমার কাছে তো ফায়ার আর্মস ছিল। ইচ্ছা করলে আমি দৌড়াইয়া গিয়া ওই দুই হালারে দুই রাউন্ড ফায়ারে ঠ্যাং ভাইঙ্গা ধরাশায়ী করতে পারতুম। কিন্তু আমারে চুপচাপ সব দেখতে হইল।

বললুম, এতে দুঃখ করার কিছু নেই হালদারমশাই। গীতার সেই শ্লোক পড়েননি–যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানি ভবতি ইত্যাদি ইত্যাদি।

কর্নেল চোখ খুলে তার বিখ্যাত অট্টহাসি হাসলেন, জয়ন্ত, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাচ্ছ। ওসব ছেড়ে দাও। আমি এখন সৌমেনের প্রতীক্ষা করছি। সে আসার পর এই কেসের ভাইটাল অংশটা আমাকে ট্যাকল করতে হবে।

বললুম, মিঃ নেহালিয়ার বাড়ির ফোন নাম্বার আমার কাছে আছে। আমি একবার ফোন করে সৌমেনের কথা জিগ্যেস করব?

কর্নেল বললেন, আর আধঘণ্টা অপেক্ষা করো।

আজ দেখছি সময় খুব হন্তদন্ত ছুটছে সাড়ে ছটা বাজছে। আমি টেবিল থেকে প্রকৃতি বিজ্ঞান সংক্রান্ত একটা রঙিন বিদেশি পত্রিকা তুলে নিলুম। রঙবেরঙের প্রজাপতির ছবি আর তার ফাঁকে কিছুটা করে ছাপানো হরফ। ছবি দেখতে মন দিলুম। তারপর হঠাৎ ডোরবেল বাজল। কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী! তারপর সৌমেন হাসিমুখে আস্তেসুস্থে ঘরে ঢুকে সোফায় বসে বলল, মিঃ নেহালিয়া আজ রাতেই গা ঢাকা দিচ্ছেন। তার দিল্লি অফিস থেকে একটা জরুরি ফোন এসেছে।

কর্নেল তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকে দেখছিলেন। ভুরু কুঁচকে হাসিমুখে তিনি বললেন তোমার ঝুলিতে অনেক জিনিস আছে মনে হচ্ছে। ঝুলি উপুড় করো। যথাসময়ে ষষ্ঠী তোমাকে কফি খাইয়ে চাঙ্গা করবে।

সৌমেন হাসল।–আমি চাঙ্গাই আছি। তবে আপনার ষষ্ঠীচরণের সুস্বাদু প্রকৃত কফি নিশ্চয় খাব। এবার ঝুলি উপুড় করছি। আপনি ইচ্ছে হলে নোট করে নিন। কারণ আমি বড্ড মনভোলা।

কর্নেল প্যাড আর কলম হাতে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ। বলে যাও।

সৌমেন বলল, মিঃ নেহালিয়া দিল্লিতে শালিনীদেবীর কাছে গচ্ছিত একটা দামি জিনিস এনেছিলেন। সেটা নাকি নিলামে কেনা চোরাই মাল। সেটা প্রথমে তিনি আমার কাছে লুকিয়ে রাখার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু ভরসা পাননি। জয়ন্তর সঙ্গে আমার বন্ধুতা লক্ষ করে মত বদলেছিলেন। তমাল বোস তাঁর ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বাসী। তাকে তিনিই বড়-বড় কন্ট্রাকটারি পাইয়ে দেন। কাজেই জিনিসটা তার কাছে রাখেন। তালার নির্দিষ্ট একটা অঙ্ক জানলে ওটা খোলা যায়। স্টিলের তৈরি ন ইঞ্চি বাই ছ ইঞ্চি বাই তিন ইঞ্চি একটা কৌটো। উপরে লাল ভেলভেট সাঁটা। মিঃ নেহালিয়া প্রায়ই হিরাচাঁদ জৈন নামে চোরাই মাল কিনতেন। তমাল বোস তা জানত। আবার তমালের কন্ট্রাকটারি কাজের ফকির প্রমাণও তিনি সংগ্রহ করে রাখতেন। কাজেই পরস্পর ব্ল্যাকমেলিং করার উপায় নেই।

কর্নেল বললেন, তমাল বোস কৌটোটা কি চন্দ্রিমাকে লুকিয়ে রাখতে দিয়েছিলেন?

সৌমেন অবাক হয়ে বলল, আপনি কী করে জানলেন?

ষষ্ঠী কফি রেখে গেল। কর্নেল বললেন, কফি খাও। খেতে খেতেও বলতে পার।

সৌমেন কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, মিঃ নেহালিয়াকে তমাল বোস বলেছিল, জিনিসটা সে ফিল্মস্টার চন্দ্রিমা সেনের কাছে রেখেছে। কারণ বাপী ব্যানার্জি নামে এক মাফিয়াকে হাতে রাখার ফলে বাপীর শত্রু মোনা ধাড়া তার শত্রু হয়ে গেছে। আগে মোনার কাছ থেকে হার্ডওয়ারের জিনিসপত্র বাধ্য হয়ে সে কিনত। এখন তাকে ওসব কিনতে হয় না। তমাল বোস মিঃ নেহালিয়াকে বলেছিল, বাপী চন্দ্রিমাকে গার্ড দেয়। কাজেই জিনিসটা নিরাপদে থাকবে। এদিকে মিঃ নেহালিয়া তাকে ঝোঁকের মুখে বলে ফেলেছিলেন আমার কথা। আমার কাছে জিনিসটা রাখার অসুবিধা নিয়েও আলোচনা করেছিলেন।

আমি বললুম, তাহলে সরাসরি নিজে মিঃ নেহালিয়াকে ব্ল্যাকমেল করতে না পারার জন্যই তমাল বোস তোর শুভাকাঙ্ক্ষী সেজেছিল। অর্থাৎ তোকে দিয়ে ব্ল্যাকমেল করাত। ওদিকে দিল্লিতে শালিনীদেবী খুন হয়েছেন। মিঃ নেহালিয়ার দৃঢ় বিশ্বাস, ভানুপ্রতাপ ওই চোরাই জিনিসটার লোভেই তাকে খুন করেছে। সে জানত, জিনিসটা শালিনীর কাছে আছে। এ কথা সত্যি যে, মিঃ নেহালিয়ার যাকে পছন্দ হয়, তাকেই কোনো কাজে লাগান কিংবা গোপন কথা খুলে বলে পরামর্শ চান।

হালদারমশাই গুলি গুলি চোখে তাকিয়ে কথা শুনছিলেন। এতক্ষণে বলে উঠলেন, হঃ! বুঝছি মুনলাইট বারে পুলিশের তাড়া খাইয়া তমাল বোস বুঝছিল, এবার তার পিছে লাগব অরা। ফলো কইরা ঘুরব। এদিকে মিঃ নেহালিয়ার জিনিসটা পুলিশ যাইয়া চন্দ্রিমারে জেরা করলেই ব্যস! তাই বাপীরে লইয়া সে চন্দ্রিমার কাছে জিনিসটা লইতে আইছিল। তারপর–

তাকে থামিয়ে কর্নেল বললেন, ইউ আর ড্যাম রাইট হালদারমশাই। তবে জিনিসটা চন্দ্রিমা যে তার ফ্ল্যাটে রেখে যায়নি, সে-বিষয়ে সিওর হওয়া দরকার। মৃগাঙ্ক চৌধুরির টিম এখনও বেরোয়নি। তার বাড়িতে ফোন করে দেখা যাক।

বলে কর্নেল হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে তার খুদে নোটবই থেকে নাম্বার দেখে ডায়াল করলেন। তারপর সাড়া পেয়ে বললেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। মৃগাঙ্কবাবুকে..মৃগাঙ্কবাবু। হ্যাঁ। আমিই বলছি। জরুরি দরকারে চন্দ্রিমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই!… সে কী! তার ফ্ল্যাটে রিং করেছেন?… কী আশ্চর্য! অর্ক কোথায়?…হ্যাঁ। তার পক্ষে এটা স্বাভাবিক। ঠিক আছে। কিন্তু বুঝতে পারছি, চন্দ্রিমা কী করে জানতে পেরেছিল বাপী ব্যানার্জি খুন হয়েছে?…তাই বলুন! অর্ক চন্দ্রিমাকে খবরটা দিয়ে ঠিক করেনি মনে হচ্ছে। …ধন্যবাদ।

.

১২.

সে রাতে সৌমেন চলে যাওয়ার পর কর্নেল আবার চন্দ্রিমার ফ্ল্যাটে রিং করেছিলেন। কোনও সাড়া পাননি। রিসিভার রেখে ভেবেছিলেন তমাল ও বাপী চন্দ্রিমার ফ্ল্যাটে গিয়ে তার খোঁজ পায়নি। তাই রাগের বশে তার টেলিফোন লাইন। ছিঁড়ে ফেলেছিল। এই খবরটা আমি নরেশবাবুর কাছে জেনেছি। পুলিশ চন্দ্রিমার ফোনের তার ছেঁড়া অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছিল।

জিগ্যেস করেছিলুম, তাহলে আবার ওখানে রিং করছেন কেন?

–একটা চান্স নিচ্ছি। যদি চন্দ্রিমা সেখানে ফিরে গিয়ে থাকে, তাহলে সে তার জোড়া দিয়ে নেবে। ওদিকে অর্ক তার খোঁজে বেরিয়েছে। কাজেই অর্করও সেখানে থাকার কথা। এখন বোঝা যাচ্ছে ফোনটা ডেড হয়েই আছে।

হালদারমশাই বলেছিলেন, কাল আমি আমার ক্লায়েন্টের লগে দেখা করুম। এখন উঠি।

কর্নেল তাকে হঠাৎ প্রশ্ন করেছিলেন, আচ্ছা হালদারমশাই, বাপী যখন খুন হয় তখন কি আপনি ঘড়ির কাঁটা দেখেছিলেন?

গোয়েন্দাপ্রবর বলেছিলেন, না। তবে সাড়ে চারটে, পৌনে পাঁচটা হবে।

–আর একটা কথা। ভালোভাবে স্মরণ করে বলুন। খুনিদের মধ্যে পেছনে যে মোটর সাইকেলে বসেছিল তাকে লক্ষ করেছিলেন?

–আমার কাছ দিয়া যখন যায় তখন লক্ষ করি নাই। তারা যে খুনী তা ক্যামনে জানুম কন কর্নেল স্যার। হঃ। মনে পড়ছে পিছনে যে জন বহিয়া ছিল তার চোখে সানগ্লাস পরা ছিল। দেখতে অনেকটা আমাগো সৌমেনবাবুর মতন।

–ঠিক আছে। আপনি কাল সকালে আপনার ক্লায়েন্টের বাড়ি গিয়ে অর্কর খোঁজ করুন।

হালদারমশাই চলে যাওয়ার পর কর্নেল কয়েক মিনিট চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে থাকার পর হঠাৎ সোজা হয়ে বসে তারপরই ফোনের রিসিভার তুলে একটা নাম্বার ডায়াল করেছিলেন। সাড়া এলে বলেছিলেন, হোটেল কন্টিনেন্টাল, প্লিজ পুট মি টু ম্যানেজার মিঃ রঙ্গনাথন…হ্যালো মিঃ রঙ্গনাথন… নো নো, নাথিং রং…আমি শুধু জানতে চাইছি আপনাদের হোটেলে কোনো নবদম্পতি চেক ইন করেছে কি না…হ্যাঁ, আপনি খোঁজ নিয়ে বলুন…করেনি? ঠিক আছে। আসলে আমার চেনা মানুষ ওরা। বাইরে থাকে। যদি আজ রাত্রে ওরা এসে পড়ে, ওদের থাকার অসুবিধা যেন না হয়। শুধু একটা কথা মিঃ রঙ্গনাথন, ওদের যেন ঘুণাক্ষরেও জানতে দেবেন না আমি আপনাকে ওদের ব্যাপারে ফোন করেছিলুম…না, না, নাথিং রং-থ্যাঙ্কস মিঃ রঙ্গনাথন।

আমি অবাক হয়ে শুনছিলুম। তারপর বলেছিলুম, হঠাৎ হোটেল কন্টিনেন্টালে কেন? কাউকে যদি ট্র্যাপ করতে চান, আরও হোটেল আছে।

কর্নেল গম্ভীর মুখে বলেছিলেন, এই হোটেলটায় বাঙালিরা ওঠে না। চার্জ বেশি, তা ছাড়া এখানে কোটিপতি লোকেরাই ওঠে।

বলেছিলুম, বাঙালি দম্পতি মানে কি আপনি অর্ক-চন্দ্রিমার কথা ভেবেছেন? চন্দ্রিমার কাছে তমালের লুকিয়ে রাখা সেই ঐতিহাসিক জিনিসটা আছে।

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বলেছিলেন, শাট আপ! আর একটি কথাও নয়। ডিনারের সময় হয়েছে, খেয়েদেয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ো।

রাত দশটায় ডিনারের পর কর্নেল এদিন অভ্যাস মতো ড্রয়িংরুমে চুরুট টানতে যাননি। বেডরুমে ঢুকে পড়েছিলেন। আমার মাথায় কর্নেলের হঠাৎ ওই হোটলে ফোন করার ব্যাপারটা মাছির মতো ভনভন করছিল। দরজা বন্ধ করার আগে আমি ওই ঘরে দাঁড়িয়ে দেখেছিলুম ডানদিকে কিচেনে হাত-পা ছড়িয়ে বসে ষষ্ঠীচরণ খাচ্ছে। কর্নেলের বেডরুমের দরজায় কান পেতে শুনেছিলুম তিনি কাকে যেন ফোন করছেন। আড়িপাতার সাহস হয়নি। ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়েছিলুম।

সকালে ঘুম ভাঙল ষষ্ঠীর ডাকে। তার হাতে বেড টি। তাকে জিগ্যেস করলুম, তোমার বাবামশাই কোথায়?

ষষ্ঠীচরণ চোখ বড় করে বলল, কিছুক্ষণ আগে লালবাজার থেকে টেলিফোন এসেছিল। বাবামশাই তখন ছাদের বাগানে ছিলেন। নেমে এসে ফোন ধরলেন তারপর ঘরে ঢুকে পোশাক বদলে তক্ষুনি বেইরে গেলেন।

তার কথা শোনামাত্র আমার মনে স্বভাবত উত্তেজনা দেখা দিল। আমি দ্রুত চা গিলে বাথরুম সেরে একেবারে সেজেগুজে ড্রয়িংরুমে গেলাম। পকেটে আমার। রিভলবারটাও নিয়েছিলুম। ফোনের রিসিভার তুলে প্রথমেই নরেশবাবুর বাড়ির নাম্বারে ফোন করলুম। কেউ বলল, উনি বেরিয়ে গেছেন। কখন ফিরবেন জানি না।

হতাশ হয়ে একটুখানি বসে থাকার পর ডিসি ডিডি-১ মিঃ অরিজিৎ লাহিড়ীর কোয়ার্টারে ফোন করলুম। তার ডিরেক্ট নম্বর আমার জানা। কেউ সাড়া দিয়ে বলল, সাহেব ভোরবেলা বেরিয়েছেন। আপনি কে বলছেন? রাগ করে রিসিভার রেখে দিলাম।

প্রায় মিনিট দশেক পরে টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলে সাড়া দিতেই কর্নেলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, জয়ন্ত, একটা গুরুতর ব্যাপার ঘটেছে। ল্যান্সডাউন রোডে মিঃ সূরজদাস নেহালিয়াকে কেউ গতরাতে গুলি করে মেরেছে। অগত্যা পুলিশ লালবাজারে ওসি হোমিসাইডকে জানিয়েছিল। কিন্তু তিনি নরেশবাবুদের জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি।

দ্রুত বললুম, আপনি এখন কোথায় আছেন?

আমি আছি হোটেল কন্টিনেন্টালের লাউঞ্জে। তুমি এখনই রেডি হয়ে চলে এস। এখানেও একটা খুনোখুনি ঘটতে পারত কিন্তু গতরাতে আমি অরিজিৎকে ফোন করে এই হোটেলে সাদা পোশাকে কয়েকজন অফিসার এবং আর্মড কনস্টেবল পাঠাতে বলেছিলুম। স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকও কয়েকজন ছিল। তাই খারাপ কিছু ঘটেনি। নরেশবাবুরা তিনশো সাতাশ নম্বর সুইটে জেরা চালাচ্ছেন। আমি তোমাকে নীচে রিসেপশন থেকে টেলিফোন করছি।

জিগ্যেস করলুম, হালদারমশায়ের খবর কী?

–তিনি সম্ভবত তার ক্লায়েন্টের বাড়িতে গেছেন। এখন ওঁর কোনও প্রয়োজন এখানে নেই। পুরোটা পুলিশের হাতে চলে গেছে।

–কথাটা ওভাবে বলবেন না কর্নেল। নিজের কৃতিত্বকে ছোট করতে নেই। আপনি পুরো কেসটা টুকরো টুকরো করে কেটে রান্না করা মাংসের মতো পুলিশের কাছে পরিবেশন করেছেন। আমি যাচ্ছি।

ফোন রেখে বেরিয়ে গেলুম। আমার গাড়িটা বহুবার কর্নেল এসব ক্ষেত্রে নিয়ে যান। চাবি কোথায় থাকে তিনি জানেন। কিন্তু আজ নিয়ে যাননি। তার মানে লাহিড়ী সাহেব তাঁকে নিতে গাড়ি পাঠিয়েছিলেন।

হোটেল কন্টিনেন্টালে পৌঁছে পার্কিং জোনে গাড়ি রাখলাম। তারপর লক্ষ করলুম বাইরে পুলিশের একটা বেতারভ্যান দাঁড়িয়ে রয়েছে। লনে কয়েকজন। কনস্টেবল আড্ডা দিচ্ছে। আমি ভিতরে ঢুকে লাউঞ্জে কর্নেলকে দেখতে পেলুম।

কর্নেল হাসিমুখে বললেন, গুড মর্নিং জয়ন্ত। থ্রি টু সেভেন স্যুইটে গিয়ে যাকে দেখবে তাকে তোমার যেন হার্টফেল না হয়।

আমার হাত ধরে কর্নেল লিফটের দিকে এগিয়ে গেলেন।

লিফটে উঠে তিনি আবার বললেন, হ্যাঁ। এতকাল তুমি আমার সঙ্গে ঘুরছ। এ ধরনের ঘটনা যে কখনও ঘটেনি এমন নয়। আর তোমাকে বরাবর বলে আসছি– একটা মানুষের বাইরের পরিচয়টা তার সত্যকার পরিচয় নয়।

অবাক চোখে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে ছিলুম। বললুম, আজ এত বক্তৃতা দিচ্ছেন কেন? আমি তো স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি অর্ক আর চন্দ্রিমা আপনার পাতা ফাঁদে ধরা পড়েছে। অর্ক বাপীর শত্রু মোনাকে টাকা দিয়ে খুন করিয়েছে। এদিকে চন্দ্রিমার কাছে সে জানতে পেরেছিল তমাল বোস একটা দামি জিনিস তাকে লুকিয়ে রাখতে দিয়েছে। কাজেই কোথাও বনেজঙ্গলে শুটিংয়ে না গিয়ে দুজনে মৃগাঙ্কবাবুর বাড়ি থেকে কেটে পড়েছিল। বাপী যখন বেঁচে নেই তখন চন্দ্রিমার সাহস বেড়ে যাওয়ার কথা। গতরাতে আপনি তো মৃগাঙ্কবাবুকে বলেছিলেন বাপী খুন হওয়ার কথা চন্দ্রিমাকে বলা অর্কের ঠিক হয়নি। তাই না?

আমাদের লিফট থামল যে ফ্লোরে, বেরিয়ে গিয়ে দেখি সাদা পোশাকের পুলিশে ছয়লাপ। দরজা একটু ফাঁক হল। তার একটু পরে নরেশবাবুকে উঁকি মারতে দেখলুম। তিনি সহাস্যে বললেন, আসুন আসুন জয়ন্তবাবু। আপনার বৃদ্ধ বন্ধুর দৌরাত্ম্যে আমাদের সারা রাত এই ফ্লোরে টহল দিতে হয়েছে আর দরজায় কান পাততে হয়েছে। বার দুই চন্দ্রিমাদেবীর সহচরটি বেরিয়েছিল। চারদিক ঘুরে অবস্থা বুঝে পালানোরও তাল করেছিল। কিন্তু পালাবে কী করে। তাই বুদ্ধিমানের মতো চুপচাপ শুয়ে থেকেছে।

দরজা আরও একটু খুলে কর্নেল আমাকে ভিতরে ঠেলে দিলেন। আমি এগিয়ে গিয়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে এবং মুখ নামিয়ে যাকে বসে থাকতে দেখলুম, দেখা মাত্র আমার মাথা যেন বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগল। এ কী দেখছি। নির্ঘাৎ দুঃস্বপ্ন। এ কক্ষনো হতে পারে না। কর্নেল নিশ্চয় ভুল করেছেন। মানুষ মাত্রেই ভুল হয়। কর্নেল তো সত্যিই দেবতা নয়।

আমি তার কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে ডাকলুম, সৌমেন একী দেখছি। তুই চন্দ্রিমার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে–

আমাদের মুখের কথা শেষ না হতেই সৌমেন সাপের মতো ফেস করে উঠল, চন্দ্রিমাকে আমি এক বজ্জাতের হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলুম। অর্কর মতো সাংঘাতিক ছেলের পাল্লায় পড়লে চন্দ্রিমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যেত।

কর্নেল তার পাশে ধপাস করে বসলেন। লক্ষ করলুম চন্দ্রিমা খাটের অন্য প্রান্তে দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে বউমা সেজে বসে আছে।

 কর্নেল বললেন, সৌমেন, এ যাবৎকাল অসংখ্য ধূর্ত এবং দক্ষ অভিনেতার মুখোমুখি আমি হয়েছি। কিন্তু আমাকে তুমি ফাঁকি দিতে পেরেছিল। তুমি কাল বিকেলে কথামতো মোনাকে দিয়ে বাপীকে ফোন করিয়েছিলে। পুলিশ মোনাকে অ্যারেস্ট করেছে। মোনা বলেছে তার ফায়ার আর্মস তুমি ভাড়া নিয়েছিলে। তারপর সোজা ল্যান্সডাউন রোডে মিঃ নেহালিয়ার কাছে গিয়েছিলে। তুমি যেভাবে হোক জানতে যে এদিন নেহালিয়ার ফ্যামিলি লেকটাউনে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যাবেন। সম্ভবত নেহালিয়াই তোমাকে সে কথা বলেছিলেন। কারণ মিঃ নেহালিয়া। তোমাকে যা বলতে চেয়েছিলেন তা গোপনেই বলার কথা। তিনি তোমাকে বলেছিলেন–আমার অঙ্ক বলছে যেভাবে হোক চন্দ্রিমার কাছ থেকে জিনিসটা উদ্ধার করে দিতে। দরকার হলে যদি খুনখারাপিও করতে হয় তিনি তার জন্য টাকা দেবেন। কিন্তু তুমি তার আগেই জিনিসটা হাতাতে চেয়েছিলে। কারণ মিঃ নেহালিয়া তোমাকে এত বিশ্বাস করতেন যে ঐতিহাসিক গয়নার বাক্সটি খোলর পদ্ধতিটাও তোমাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন।

নরেশবাবু বললেন, সব স্বীকার করেছে, বুঝলেন জয়ন্তবাবু। আর এই দেখুন সেই বাক্স খোলার অঙ্ক। এটা ওর প্যান্টের পকেট থেকে উদ্ধার করেছি।

কাগজটা হাত নিয়ে দেখলুম তাতে লেখা আছে : 5-1-3-10-5

নরেশবাবু কাগজটা নিয়ে এবার তার কাঁধের ব্যাগ থেকে খবরের কাগজে মোড়া লাল ভেলভেটের ছোট বাক্স বের করলেন। সামনের দিকে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত সংখ্যা গোলাকারে লেখা।তিনি ৫ থেকে ১, তারপর ৩, তারপর ১০, ঘুরিয়ে আবার ৫-এ ঘোরালেন। অমনি বাক্সটা খুলে গেল। ভিতরে লাল রঙের সিল্কের কাপড় খুলতেই চোখ ঝলসে উঠল। দেখলুম সোনার একটা জড়োয়া হারের উপর নানা রঙের বহুমূল্য রত্ন খচিত আছে।

নরেশবাবু সেটা বুজিয়ে রেখে আবার কাঁধের ঝোলায় ঢোকালেন। তারপর ব্যাগ থেকে রুমালে জড়ানো একটা সিক্স রাউন্ডার রিভলভার বের করে বললেন, এইটা দিয়ে মিঃ নেহালিয়াকে খুন করেছিল সৌমেন। তারপর বাকি তিনটে থ্রি-নট-থ্রি বুলেট ওই নির্বোধ যুবতীর শরীরে বিধিয়ে ঐতিহাসিক গয়নাটি নিয়ে সে কেটে পড়ত। সব কৃতিত্বই কিন্তু কর্নেল সাহেবের। উনি কেন জানি না সৌমেনের আপাত সরলতাকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছিলেন।

কর্নেল বললেন, আমি জয়ন্তর কথা শুনে বুঝতে পেরেছিলুম, মিঃ নেহালিয়া যার কোনো পুত্র-সন্তান নেই তার পক্ষে আপাতদৃষ্টে মিষ্টি এবং বলিষ্ঠ চেহারার যুবকের অনুরাগী হওয়া স্বাভাবিক। তাই তিনি অনেক গোপন কথাও ঝোঁকের বশে ওকে বলে ফেলতেন। মিঃ নেহালিয়ার যে আরেকটা গোপন নাম হিরাচাঁদ জৈন, এমন গুরুতর তথ্যও তিনি সৌমেনকে না জানিয়ে পারেননি। এদিকে সৌমেন বুঝতে পেরেছিল নিজামের উত্তরাধিকারী যখন কেন্দ্রীয় সরকারের শরণাপন্ন হয়েছেন তখন শেষ পর্যন্ত হিরাচাঁদ জৈনরূপী মিঃ নেহালিয়া ধরা পড়বেনই। অতএব তার মুখ চিরতরে বন্ধ করতে পারলে জিনিসটা তার হাতে এসে যাবে। ওদিকে তমাল বোস তো পুলিশের খাতায় ফেরারী আসামী। দিল্লির ভানুপ্রতাপ সিংহ জেরার মুখে কবুল করেছে তমাল বোস মিঃ নেহালিয়ার ডান হাত।

এতক্ষণ চুপচাপ শোনার পর বললুম, সৌমেন, তুই নিশ্চয় লোভের বশে একাজ করিসনি। আমার মন বলছে এর পিছনে কারও প্ররোচনা ছিল। কে সে?

সৌমেন জবাব দিল না।

নরেশবাবু বললেন, সে আমাদের বলেছে চন্দ্রিমাই নাকি তাকে প্ররোচিত করেছিল।

চন্দ্রিমা কেঁদে উঠল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে বলল, না। আমি একজনের হাত থেকে বাঁচতে সৌমেনের পাল্লায় পড়েছিলুম।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, তুমি বারবার একজনের কথা বলছ। সেই একজন যে অর্ক নয় তাও তুমি বলেছ। তাহলে সে কে? তমাল বোস? সে তো এখন পুলিশের চোখে অপরাধী। সৌমেনকে দিয়ে সে নাকি মিঃ নেহালিয়াকে ব্ল্যাকমেল করতে চেয়েছিল। চন্দ্রিমা, এখনও সময় আছে। জিনিসটা তুমি চুরি করে এনে নিজের কাছে রাখোনি। ওটা রাখতে দিয়েছিল তমাল বোস। তাহলে কার প্ররোচনায় তুমি সৌমেনকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলে?

চন্দ্রিমা কান্নাজড়িত স্বরে বলল, আমি অর্ক আর সৌমেনের পাল্লায় পড়ে মৃগাঙ্কবাবুর কাছে আশ্রয় নিয়েছিলুম। আপনারা জানেন না মৃগাঙ্ক চৌধুরি একজন লম্পট।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, ঠিক আছে। মৃগাঙ্কবাবু কি অর্কের অগোচরে তোমার দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন?

চন্দ্রিমা বলল, হ্যাঁ। কিন্তু আমি জানতাম না সৌমেন অর্কর চেয়ে সাংঘাতিক। মৃগাঙ্কবাবুর বাড়ি থেকে গোপনে চলে এসে আমি যখন তার বাড়ির গেটে অপেক্ষা করছি তখন দারোয়ান আমাকে একটা চিঠি দিয়েছিল। সেই চিঠিতে সৌমেন। লিখেছিল, আমাকে বাড়িতে পাবে না। তুমি ল্যান্সডাউন রোডে একটা নাম্বারে–নাম্বারটা চিঠিতে লেখা আছে, ওখানে ফুটপাতে অপেক্ষা করতে হবে। সৌমেন সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় বেরিয়ে ট্যাক্সি করে আমাকে আমাদের ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়েছিল। তখন ওখানে পুলিশ ছিল না। তারপর রাত সাড়ে নটায় সে এসে আমাকে বলে একটা বড়ো হোটেলে আমরা উঠব। সেখান থেকে গয়নাটা বিক্রির চেষ্টা করব। ওই হোটেলে দেশ-বিদেশের কোটিপতি ব্যবসায়ীরা এসে থাকেন।

বলে সে ব্লাউজের ভিতর থেকে একটা দোমড়ানো চিঠি বের করে কর্নেলকে। দিল। কর্নেল সেটা পড়ে নরেশবাবুকে দিলেন। দিয়ে বললেন, আর কী! এবার আমরা কেটে পড়ছি। তবে নরেশবাবু, অরিজিৎকেও বলছি–এই নির্বোধ মেয়েটিকে যেন রাজসাক্ষী করা হয়। হ্যাঁ, তার টাকার লোভ ছিল। কিন্তু এই ছদ্মবেশী নেপথ্যের আততায়ীকে সে চিনতে পারেনি। চলো জয়ন্ত। এমন বন্ধুর জন্য তোমার দুঃখ করার কোনও অর্থ হয় না। আমরা এবার কেটে পড়ি। ফিরে গিয়ে হালদারমশাইকে ফোনে ডাকব।

কিন্তু তাকে ডাকতে হয়নি। কর্নেলের বাড়ি ফিরেই দেখি গোয়েন্দাপ্রবর খবরের কাগজ পড়ছেন।