নেদারল্যান্ডের চারপেয়েটা

নেদারল্যান্ডের চারপেয়েটা

সুগন্ধ তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যেতে আমি দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিলাম৷ আমার আবার একটু দরজা নিয়ে বাতিক আছে ছোট থেকেই৷ একান্নবর্তী পরিবারে মানুষ, একা থাকার সুযোগ খুব কমই হত, তাও কখনো কখনো একা থাকলেই মনে হত দরজাটা ঠিকমতো বন্ধ করা আছে তো? বারবার গিয়ে চেক করে এসেও যেন শান্তি হত না, মনে হত এক্ষুনি ঘরের পর্দা সরিয়ে ফাঁকা বাড়িতে হয়তো উঁকি মারবে কোনো অনাহূত আগন্তুক!

তার উপর কাল রাতের খচখচানিটা মন থেকে এখনো ভালো করে যায়নি৷ মনে পড়লেই কেমন করে উঠছে বুকের ভেতরটা৷

গায়ের ওভারকোটটা ভালো করে জড়িয়ে আমি কফির মগটা নিয়ে জানলার কাছে এসে দাঁড়ালাম৷ দূরের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে সুগন্ধ সাইকেল চালিয়ে চলে যাচ্ছে আমার দৃষ্টির বাইরে৷ ঝকঝকে নীল আকাশ, দূরের সাদা উইন্ডমিলগুলো আজ ঠান্ডা হাওয়ায় মনের খুশিতে ঘুরে যাচ্ছে৷ কোনো এক নাম না জানা ফুলের গন্ধ যেন ঝিমঝিম করছে বাতাসে৷

এত সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে মুহূর্তের জন্য মাথা থেকে টেনশন উধাও হয়ে গেল৷ ইশ, এমন সুন্দর মিষ্টি রোদ উঠেছে আজ, এই দিনে কেউ অফিস গিয়ে সময় নষ্ট করে?

আমার হঠাৎ ইচ্ছে করল সুগন্ধকে পিছু ডাকতে, তারপর গাড়ি নিয়ে দেড়-দু’ঘণ্টা দূরের সেই লিসে টাউনের টিউলিপ বাগানে ছুটে চলে যেতে, সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফুল ফোটে যেখানে৷ এমনিতেই এই নিঃসঙ্গ দেশে থাকতে থাকতে কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠছি, তার উপর কাল রাতের এই উটকো ভয়৷ হঠাৎ যেন হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করল সেই টিউলিপ, ড্যাফোডিল আর হায়াসিন্থ ফুলের মধ্যে৷

কিন্তু পেট-রুটি-রোজগার বড় বালাই, সবে আগের সপ্তাহে ঘুরে এসেছি, এরপর আবার সেখানে যাওয়ার কথা বললে সুগন্ধ নির্ঘাত আমাকে ভস্ম করে দেবে৷ এই দেশের মানুষ এমনিতেই কর্তব্যপরায়ণ, সুগন্ধ নিজের রেপুটেশন খারাপ করতে চায় না কোনোমতেই৷ তা ছাড়া কাল সারারাত ল্যাবে ছিল, ভোরবেলা ফিরেছে, ঘণ্টা তিন-চার রেস্ট নেওয়ার সময় পেয়েছে বেচারা, এখন এইসব বললে আরো রেগে যাবে৷

এই জানলা থেকে যতদূর চোখ যায়, শুধুই ফাঁকা দিগন্তবিস্তৃত সবুজ হলুদ ঢেউখেলানো মাঠে সারি সারি উইন্ডমিল৷ সেগুলো তিনটে করে সাদা শলাকার মতো ব্লেড নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ অনেকটা আমাদের দেশের গ্রাম গঞ্জের দিকের রেললাইনের পাশে দাঁড়ানো ইলেকট্রিক পোলগুলোর মতো৷

দূরে চরে বেড়াচ্ছে কিছু ঘোড়া, আর আমাদের বাড়ির পাশটাতেই একদল গোরু জাবর কেটে চলেছে৷

সুগন্ধ একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে আমাদের মধ্যে এই কয়েকদিনে গজিয়ে ওঠা অভ্যাসমতো ছোট্ট ছোট্ট কুঁড়ি আসা সবুজ চেস্টনাট গাছটার তলায় সাইকেলটাকে একবার থামিয়ে পিছনে ফিরে আমার দিকে একঝলক হাত নাড়ল, তারপর আবার প্যাডলে চাপ দিয়ে চলে গেল৷

এইবার শুরু হল আমার সারাদিনের একাকিত্ব৷ এমনিতেই এ দেশে লোক কম, ,তার উপর সবাই সাইকেলটাকেই এখানে দৈনন্দিন যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে, ফলে গাড়ির আওয়াজও নেই তেমন৷ শুধু দূরের অ্যামস্টারডাম যাওয়ার হাইওয়ের দিকে তাকালে সোঁ সোঁ করে চলা গাড়ি অস্পষ্ট দেখতে পাই৷

এই নিস্তব্ধতা ভালো লাগলেও কখনো কখনো বেশ অসহ্য হয়ে ওঠে৷

যেমন আজ৷

কাল রাতের ঘটনাটা সুগন্ধকে ইচ্ছে করেই বলিনি৷ কী দরকার, একে এত দূরে বিদেশ বিভুঁইয়ে এসে দুজন পড়ে আছি, তার ওপর সারাটাদিন আমি একলা থাকি, শুধু শুধু চিন্তা করবে৷ তার ওপর কাল রাতে সুগন্ধ নিজেও ছিল না, ওর ল্যাবে এখন কিছুদিন নাইট শিফটিংও চলছে৷ দুবার করে ছুটতে হচ্ছে ওকে৷

কিন্তু না বললেও মনটা কেমন যেন একটা অজানা আশঙ্কায় ভরে আছে৷

অন্যদিন এই সময় মা’কে একটু ফোন করি, আজও মোবাইলটা হাতে নিতেই চোখ পড়ে গেল আজকের তারিখের দিকে৷

তাই তো, আজ তো বিশে অক্টোবর৷ ঠিক একবছর আগে আজকের দিনে আমি আর সুগন্ধ দেখা করেছিলাম৷ সাউথ সিটির একটা রিটেল স্টোরে৷

আগে থেকে স্কাইপ, ফোনাফুনি চললেও সেদিনই প্রথম সামনাসামনি দেখা হয়েছিল৷

সুগন্ধর সাথে বিয়ের সম্বন্ধটা যখন এসেছিল, তখন আমার ইতিহাসে এম. এ-টা সবে কমপ্লিট হয়েছে৷ কেউ বলছে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দেওয়া শুরু কর, কেউ বলছে পিএইচ. ডি-র দিকে চলে যা৷ আমি কী করব তাই নিয়ে খুব কনফিউজড ছিলাম৷ ধরাবাঁধা পড়াশোনার বাইরে বেরিয়ে যেন একটু মুক্ত বাতাস চাইছিলাম৷ ইচ্ছে হচ্ছিল কনভেনশনের বাইরে গিয়ে কিছু করতে৷

ঠিক সেই সময় যখন সুগন্ধর মতো আউট অফ কনভেনশন একটা সম্বন্ধও এল, বাবা মা বা অন্যদের একটু কিন্তু কিন্তু থাকলেও আমি হ্যাঁ বলে দিয়েছিলাম৷ সেই ‘হ্যাঁ’ এর পেছনে শুধুই ইউরোপীয় সভ্যতার প্রতি আমার ভালোবাসা কারণ ছিল না, নিজের কিছু করার তাগিদটাও ছিল৷ মনে হয়েছিল সবার চোখের আড়ালে গিয়ে নিজের মতো করে থাকলে হয়তো কিছু করতে পাবব মনের মতো৷

তা ছাড়া সুগন্ধর সাথে আমার মানসিক মিলও বেশ হয়েছিল৷ ভালো ছাত্র হয়েও সুগন্ধ প্রচলিত পথে না হেঁটে যাদবপুর থেকে পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চলে এসেছিল এই নেদারল্যান্ডে, এখানকার উইন্ড এনার্জি অর্থাৎ বায়ু থেকে শক্তি তৈরি করার হাওয়াকল তো জগৎবিখ্যাত, সুগন্ধ এখানেই উইন্ড টার্বাইন ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করেছিল৷ তারপর এখন এখানকার একটা নামকরা ফার্মের ও উইন্ড টার্বাইন ইঞ্জিনিয়ার৷ ওর প্রধান কাজই হল ওই উইন্ডমিলগুলোর মেকানিজম নিয়ে রিসার্চ করা, এনার্জি ক্যাপাসিটি বাড়ানোর জন্য ডেডিকেটেড টিমের ও একজন গুরুত্বপূর্ণ মেম্বার৷ তো সেই রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের কোনো ধরাবাঁধা টাইম নেই, যখন চাপ আসে, তখন দিনরাত একাকার করে খাটতে হয়, চাপ কমলে একটু রিল্যাক্সড থাকা যায়৷

আমিও যাদবপুরের প্রাক্তনী ছিলাম৷ মনে আছে, প্রথম দিন দেখা হতেই আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘‘আচ্ছা এখানেই কোনো আইআইটি থেকে এম. টেক করলেন না কেন? তা ছাড়া হঠাৎ এইরকম একটা অফবিট স্ট্রিম…!’’

সুগন্ধ হেসে বলেছিল, ‘‘আসলে নেদারল্যান্ড দেশটা আমাকে ছোট থেকেই টানে৷ সেই যে ক্লাস ফাইভে পড়েছিলাম হান্স বলে ছোট্ট ছেলেটা সারারাত নিজের হাত দিয়ে গর্ত চেপে রেখে সারা শহরকে বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া থেকে আটকেছিল, তখন থেকেই মনে হয়েছিল …!’’

‘‘কিন্তু সেটা তো হল্যান্ড যতদূর মনে পড়ছে!’’ আমি বাধা দিয়ে বলেছিলাম৷

‘‘আরিব্বাস! আপনার গল্পটা মনে আছে?’’ সুগন্ধ বেশ প্রশংসার চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিল, ‘‘আসলে নেদারল্যান্ডে মোট বারোটা প্রভিন্স আছে, তার মধ্যে দুটো হল নর্থ হল্যান্ড আর সাউথ হল্যান্ড৷ অ্যামস্টারডামের মতো বেশিরভাগ বড় বড় শহরগুলো এই দুটো প্রভিন্সে বলে অনেকে নেদারল্যান্ডকে হল্যান্ড বলেই ডাকে, যদিও সেটা ভুল৷ অনেকটা বর্ধমান বা কৃষ্ণনগরে থেকেও বাইরে ঘুরতে গিয়ে অনেকে যেমন বলেন ‘কলকাতা থেকে এসেছি’, এটাও সেরকম, বুঝলেন?’’

আমি বুঝেছিলাম৷ বুঝে বাড়িতে এসে বিয়েতে মত দিতে একটুও দেরি করিনি৷ ঝকঝকে স্মার্ট অথচ ভদ্র শান্ত সুগন্ধর সাথে এই নেদারল্যান্ডে চলে এসে রাশি রাশি উইন্ডমিলের মাঝে পাণ্ডববর্জিত একটা অ্যাপার্টমেন্টে সংসার পাতার কেমন যেন ভীষণ ইচ্ছে হয়েছিল৷

দেখতে দেখতে এখানে এসেছি তাও চারমাস মতো হয়ে গেল৷ বিয়ের দশদিনের মধ্যেই আমরা চলে এসেছিলাম৷ যদিও সুগন্ধর উইন্ডমিল এই ফাঁকা জায়গায়, রটরড্যাম বলে সাউথ হল্যান্ড প্রভিন্সে একটা বড় শহর আছে, চাইলে আমরা রটরড্যামেই থাকতে পারতাম, ওখান থেকে হয়তো রোজ আসতে সুগন্ধর ঘণ্টাখানেক লাগত তো কি, ওর বেশিরভাগ কলিগ ওই শহরেই থাকে৷

কিন্তু সুগন্ধের তো বটেই, আমারও ইচ্ছে ছিল এইরকম ফাঁকা একটা ছোট গ্রামে থাকার৷

আমাদের গ্রামটার নাম সেন্টফিল্ড৷ রাইন, মিউজ আর শিল্ড এই তিনটে নদী তিনদিক থেকে এসে এই সাউথ হল্যান্ডে একটা ব-দ্বীপ সৃষ্টি করেছে, তার ফলে জন্ম হয়েছে এইরকম বহু ছোট ছোট গ্রামের৷ সেন্টফিল্ড দশ থেকে বারো বর্গ- মাইলের গ্রাম হলেও লোকজন থাকে দু থেকে আড়াই হাজার৷ বাড়িঘরও খুবই কম, চারদিকে খালি উইন্ডমিল৷

প্রথম প্রথম একদমই ভালো লাগত না, কথা বলার লোক নেই বললেই চলে এই ছোট্ট গ্রামটায়, বইপত্র নিয়েই থাকতাম৷ যেটা আমার ইচ্ছে ছিল, অ্যাকাডেমিক অ্যাপ্রোচে না গিয়ে নিজের মতো প্রাচীন ব্যাবিলনের সম্রাট নেবুকাডনেজারের কিছু তথ্য নিয়ে রিসার্চ, সেগুলোরই প্রস্তুতি নিতে শুরু করছিলাম৷ সুগন্ধর ফিরতে ফিরতে সন্ধে ছ’টা বাজত, তারপর আমরা একটু হাঁটতে বেরোতাম৷ কাছেই একটা ছোট চার্চ আছে স্থানীয়দের জন্য, সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ বসতাম, তারপর নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে ফিরে আসতাম বাড়িতে৷

কিছুদিন যাওয়ার পর আস্তে আস্তে আমি আলাপ করলাম আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে৷ ছোট থেকে আমি মিশনারি স্কুলে পড়েছি, কাজেই লাজুকভাব বা ভাষার সমস্যা আমার মধ্যে কোনোকালেই নেই৷ কিন্তু তাঁদের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আমাদের বাসস্থানটার এখানে একটু বর্ণনা দেওয়া প্রয়োজন৷

এই সেন্টফিল্ড গ্রামে সবই প্রায় কাঠের বাড়ি, সামনে বেশ কিছুটা করে ফাঁকা জায়গা৷ সুগন্ধ আমাকে এসে আগেই সাবধান করে দিয়েছে শীতকালে কিন্তু এখানে জাঁকিয়ে শীত পড়ে৷ এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষেরই জীবিকা এগ্রিকালচার আর পশুপালন৷ প্রায় প্রতি বাড়িতেই তেজি ঘোড়া আছে, যেগুলোকে এরা তৈরি করে রেসের জন্য, শুধু নেদারল্যান্ড নয়, এইসব ঘোড়া রেসিং-এর জন্য পাড়ি দেয় গোটা ইউরোপে৷ রেসিং ঘোড়া সাপ্লাই ছাড়াও সেন্টফিল্ড গ্রামে রয়েছে প্রচুর ক্যাটল, অর্থাৎ গোরু-ছাগলের ফার্ম৷ আমাদের বাঁ-পাশের প্রতিবেশী মিঃ এবং মিসেস মেইজার ওই ফার্মের মালিক, চার-পাঁচজন ভৃত্যস্থানীয় লোক ফার্মে থাকলেও মূল ব্যবসা ওই বয়স্ক দম্পতি নিজেরাই দেখাশোনা করেন৷ প্রায় কুড়িটার উপর গোরু, তার সঙ্গে বেশ কিছু ছাগলও রয়েছে তাঁদের ফার্মে৷ এ ছাড়া রয়েছে অনেক মুরগি৷ প্রধানত রটরড্যামের একটা নামকরা ফুডচেনের সঙ্গে এঁদের টাই-আপ আছে, দুধ-ডিম-মাংস সব সপ্তাহে দু-তিনবার করে ফার্মেরই ম্যাটাডোর জাতীয় গাড়িতে সাপ্লাই করা হয় সেখানে৷ এ ছাড়া ব্রিডও করা হয় ওঁদের ফার্মে৷

আমাদের ডানদিকে অনেকটা ফাঁকা চারণভূমি, তারপর দু-একটা ঢালু টিলার পর ওদিকে রয়েছে আরেকটা বাংলো, সেটা বন্ধই পড়ে থাকে৷ সুগন্ধকে জিজ্ঞেস করাতে ও বলেছিল ওই বাড়ির মালিক থাকেন অ্যামস্টারডামে, মাঝেমধ্যে ছুটি কাটাতে আসেন এখানে৷ এখানকার অনেক বাংলোই অবশ্য তাই, এমনকি আমাদেরটাও৷ আমাদের মালিকও থাকেন নর্থ হল্যান্ডের এক শহরে৷

মেইজার দম্পতি নিঃসন্তান, ডাচ জাতির তুলনায় একটু বেশিই মিশুকে বলা চলে৷ যদিও এখানকার মানুষজন আশ্চর্যরকমের কৌতূহলবিমুখ, দেখা হলে প্রাথমিক কুশল সম্ভাষণ ছাড়া এরা অন্যের কোনো ব্যক্তিগত ব্যাপারে অযাচিত কৌতূহল দেখায় না, তবু আমি আসার পর মিসেস মেইজার নিজে এসে আমার সঙ্গে আলাপ করে গিয়েছিলেন, তারপর একদিন তাঁদের ফার্মটা আমাকে ঘোরাতেও নিয়ে গিয়েছিলেন৷

যাক সে কথা৷

সুগন্ধ চলে যাওয়ার পর আমি জানলা দিয়ে ঝুঁকে কিছুক্ষণ কথা চালালাম ক্যাথারিন বলে মিসেস মেইজারের বাড়ির মেয়েটার সঙ্গে৷ ক্যাথারিন বেশ ভালো মেয়ে, সে মেইজারদের পোলট্রির দেখাশোনা করে৷ এখানকার প্রধান ভাষা ডাচ হলেও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোর মতো এখানেও ইংরেজি প্রায় সবাই বোঝে, বলতেও পারে অধিকাংশই৷ সে-ই হাত নেড়ে বলল, ‘‘হ্যালো বোটি!’’

আমার নাম ব্রততী হলেও এরা কেউই সেটা ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারে না, আমি সেই নিয়ে কাউকে জোরাজুরিও করিনি, সবাই আমাকে এখানে বোটি বলেই ডাকে৷

আমি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম, জিজ্ঞাসা কিছু করতে হলে আমি ক্যাথারিনকেই করব আগে, সুগন্ধকে প্রথমে জানানোর কোনো মানে নেই৷ মেইজারদেরও ব্যাপারটা বলা মানে তাঁরা অনধিকার চর্চা বলে মনে করতে পারেন৷

আমি কিছুক্ষণ এটা সেটা কথা বলে মিষ্টি হেসে বললাম, ‘‘ক্যাথারিন, মিঃ মেইজার কি নতুন কোনো জন্তু এনেছেন ব্রিডিং-এর জন্য?’’

ক্যাথারিন মুরগিগুলোর খাঁচা রোদে নিয়ে এসে পরিষ্কার করছিল, আমার প্রশ্নে বেশ একটু অবাক হয়ে তাকাল উপরের দিকে, ‘‘নতুন জন্তু? না তো? শেষ এসেছে তো দুটো ডাচ বেল্টেড গোরু, তাও দু-মাস হয়ে গেল৷ এরপর তো আসেনি কিছু৷’’ ক্যাথারিন মুখ নামিয়ে আবার কাজে মন দিল, ‘‘আর তুমি তো জানোই, মিসেস মেইজার সেদিন বলছিলেন তোমাকে, নতুন ফসফেট আইনের জন্য এখন খুব প্রোডাকটিভ ব্রিডিং হলেও করা যাবে না, অনেক রেস্ট্রিকশন আছে৷ অনেক রুল মানতে হচ্ছে এখন, না হলে লাইসেন্স ক্যানসেল করে দেবে৷’’

আমি মৃদু মাথা নেড়ে সরে এলাম৷ আমার ফোন বাজছে ঘরে৷ অফিস পৌঁছে সুগন্ধ একটা রুটিন ফোন করে, এটা সেটাই হবে নির্ঘাত৷ আমি ফোন ধরতে যেতে যেতে ভাবলাম, ক্যাথারিন ঠিকই বলেছে৷ নতুন কোনো জন্তু এলে তো আমার চোখে পড়তই৷ মেইজারদের পুরো ক্যাটলটাই আমার বারান্দা থেকে দেখা যায়৷ আর তা ছাড়া এই ডাচ গোরুগুলো দেখতে খুব সুন্দর হয়, ধবধবে সাদা আর মিশমিশে কালো রঙের মিশেলে পুরো শরীরগুলো অনেকটা জেব্রার মতো লাগে৷

আমার বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন একটা অশুভ আশঙ্কায় ছ্যাঁত করে উঠল৷

কাল রাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল৷ তখন দুটো কি আড়াইটে হবে৷ বাথরুম থেকে ঘুমচোখে ঘরে ফেরার সময় আলগা চোখ পড়ে গিয়েছিল কাচের ওপাশে৷ এই বাংলোগুলো কাঠের হলেও শীতকালের অত্যধিক ঠান্ডার জন্য দোতলার সব জানলাগুলোয় পরে হাওয়া আটকাতে কাচ লাগানো হয়েছে৷ একটা বিজাতীয় কিছু দেখে আমি উঁকি মেরেছিলাম জানলায়৷

তখনই দেখেছিলাম দৃশ্যটা৷ মিঃ মেইজারের ফার্মের ঠিক অন্যদিকে অর্থাৎ আমাদের বাংলোর ঠিক ডানপাশে যে ফাঁকা জায়গাটা, সেখানে একটা জন্তু ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ চারপায়ে সে হাঁটছে ঠিকই, কিন্তু চলাটা যেন বড্ড অস্বাভাবিক, কেমন ঘষটে ঘষটে চলছে মনে হচ্ছে৷ যেন অনেক কষ্টে একটু করে এগোচ্ছে, তারপর জিরিয়ে নিচ্ছে কিছুক্ষণ, মাটিতে শুঁকছে কিছু এদিক-ওদিক মাথা নেড়ে, তারপর আবার চলছে৷

কতক্ষণ এভাবে কেটেছিল জানি না, হঠাৎই অন্ধকারে আর জন্তুটাকে দেখতে পেলাম না৷

দৃশ্যটা এই দিনের বেলায় কল্পনা করতেই আমার যেন বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল৷

ওই জন্তুটা আর যাই হোক, গোরু-ছাগল, মোষ কিচ্ছু না৷

স্পষ্ট যে একটা বিটকেল আকৃতির জন্তুকে আধা আলো আধা অন্ধকারে চরে বেড়াতে দেখলাম, সেটা তাহলে কী?

কোথা থেকে এল?

সেটা কি আদৌ তৃণভোজী?

প্রশ্নটা মনে আসামাত্র আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল৷ নির্জন জায়গা, একা থাকি, অতর্কিতে কোনো জন্তু হামলা করলে কেউ টুঁ শব্দটি পাবে না, মেইজাররা যতক্ষণে বুঝতে পারবেন, ততক্ষণে হয়তো আমার ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে!

*******

সুগন্ধ ফিরল বেলা বারোটা নাগাদ৷ কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ সেরেই ও শুয়ে পড়ল৷ ওকে আবার নাইট শিফটে যেতে হবে রাতে, উফ কী যে ঝামেলা!

জানি ওকে বিরক্ত করা এখন ঠিক নয়, এমনিই প্রেশারে আছে, তবু যেন পারলাম না আমি৷

অন্ধকার ঘরে গিয়ে লাইট জ্বাললাম৷ সুগন্ধের মনে হয় তন্দ্রা মতো এসে গিয়েছিল, হঠাৎ আলোর ঝলকে পরিশ্রান্ত চোখ দুটো মেলে আমার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে চাইল৷

আমাদের বিয়ের পর নতুন ভাবটা এখনো পুরোপুরি যায়নি৷ এখনো দুজনেই দুজনের কাছে যতটা সম্ভব মডেস্ট থাকার চেষ্টা করি, মিষ্টি খুনসুটিতে, অভিমানে মিটিয়ে নিতে চেষ্টা করি পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি৷ মানে সুগার কোটিংটা এখনো রয়েছে আমাদের মধ্যে৷

‘‘বলছি, তোমার এই নাইট ডিউটি কতদিন চলবে?’’ আমি উশখুশ করতে করতে বলেই ফেললাম৷

‘‘কেন?’’ ঘুমজড়ানো গলায় উত্তর দিল সুগন্ধ, ‘‘এই তো, এই উইকটা!’’

‘‘তারপর?’’

‘‘এখনো জানি না, হয়তো পরের মাসে আবার থাকবে৷’’ পেল্লাই একটা হাই তুলল সুগন্ধ, ‘‘কেন বলো তো? কী হয়েছে?’’

‘‘না ঠিক আছে৷ ঘুমোও৷’’ আমি আর কিছু বলিনি, লাইট নিভিয়ে দিয়ে চুপ করে গেলাম৷

ঠিক রাত ন’টায় সুগন্ধ যখন বেরিয়ে গেল, দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই বুঝতে পারছিলাম যে মনটা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে৷ নিজেকে কাজে ডুবিয়ে রাখলে হয়তো এই উচাটন ভাবটা কমতে পারে, তাই মায়ের সাথে স্কাইপে কিছুক্ষণ কথা বলে নিজের কাজ নিয়ে বসলাম৷

মনটা একটু শান্ত হলে নাহয় খেয়ে শুয়ে পড়ব৷

আমি আমার রিসার্চ ওয়ার্কে মন দিলাম৷

প্রাচীন বিশ্বের ইতিহাসে সম্রাট নেবুকাডনেজার এক বিস্ময়কর চরিত্র৷ তিনি যে শুধু মেসোপটেমিয়া সভ্যতার ব্যাবিলনিয়া সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন তাই নয়, তখনকার আঙ্গিকে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, আর্কিটেকচার, আর্ট সবকিছুকেই তিনি এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন৷ ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানও তাঁর সময়েই বানানো, যাতে তাঁর অসুস্থ স্ত্রী ঘরে বসেই বাগানের শোভা উপভোগ করতে পারেন৷ কিন্তু ব্যাবিলন শহরের আর্কিটেকচার আপাতত আমার গবেষণার বিষয় নয়৷ তখনকার এক ইহুদি যুবক দানিয়েলের লেখা একটি পুথিতে পাওয়া সম্রাট নেবুকাডনেজার সম্পর্কে কয়েকটা বিতর্কিত তথ্যই আমার গবেষণার বিষয়বস্তু৷ দানিয়েল কোনো কারণে সম্রাটের চক্ষুশূল হয়েছিলেন, কাজেই তাঁর বইটি যে তখনকার অন্যান্য লেখকদের মতো পক্ষপাতদোষে দুষ্ট হবে না সে আশা করাই যায়৷

এখন আমি কোনো ইন্সটিটিউশনের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও যাদবপুরে প্রাচীন বিশ্ব ইতিহাস নিয়ে মাস্টার্স করার সময় আমার যে প্রিয় অধ্যাপক ছিলেন, সেই ডঃ সুকান্ত দাশগুপ্ত আমায় এই বিষয় নিয়ে এগোতে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন৷ স্যার আমাকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন তাবড় তাবড় অধ্যাপকের সঙ্গে ইন্টারনেটে আলাপও করিয়ে দিয়েছেন, যাতে আমার রিসার্চটা আমি তাঁদের কাছে প্রেজেন্ট করতে পারি, তাঁদের ফিডব্যাক নিতে পারি৷ লেখা শেষ হলে কোনোভাবে যদি আমার পেপারটা একটা ভালো জার্নালে পাবলিশড হয়ে যায়, তবে সারা বিশ্বের কাছে ইয়ং ইতিহাসবিদ হিসেবে আমি সামান্য হলেও একটা জায়গা তৈরি করতে পারব৷ তারপর তেমন সাইটেশন বা রেকমেন্ডেশন পেলে অক্সফোর্ডে যদি ডক্টরেট করার একটা সুযোগ পাই তো হয়েই গেল!

উফ ভাবতে ভাবতে কোথায় চলে গেছিলাম৷ চমক ভাঙল মোবাইলের রিংটোনে, ‘‘হ্যাঁ বলো৷’’

‘‘খেয়ে নিয়েছ? আমি এই এলাম৷ আজকে জব্বর ঠান্ডা৷ এরপর আর সাইকেলে আসা যাবে না রাতের দিকে দেখছি৷’’ সুগন্ধের কাঁপুনি দেওয়া গলা পেলাম৷

মাত্র চারমাসের পুরোনো স্বামীর প্রতি একটু এক্সট্রা খেয়াল সব বউয়েরই থাকে৷ আমিও উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠলাম, ‘‘তোমাকে বললাম ভেতরে আরেকটা থার্মাল পরো, শুনলে না কোনো কথা৷ এখন ঠান্ডা লেগে গেলে এই নিয়ে অফিস করবে কী করে? ছুটিও তো নিতে পারবে না এখন যা প্রেশার বলছ৷’’

‘‘ও ঠিক আছে৷ শোনো তুমি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ো, রাত কোরো না বেশি৷’’

সুগন্ধ ফোনটা রেখে দিতেই ঘরটা ঝুপ করে আবার আগের মতো নিস্তব্ধ হয়ে গেল৷ এখানকার নৈঃশব্দ্যটা এমনই বিরক্তিকর, মনে হয় সারাক্ষণ কথা চালিয়ে যাই, কিংবা ইউটিউবে ভিডিও চলুক নিরন্তর, তবে যেন মনে হয় এই বিশ্বচরাচরে আর কেউ আছে!

আমি কাজকর্ম সেরে দরকারি কয়েকটা ফোন করলাম, তার মধ্যে একটা দাশগুপ্ত স্যারকে৷ একটা ব্যাপারে খুব কনফিউশন হচ্ছে, সেটা আমার পেপারে মেনশন করব কি না বুঝতে পারছি না৷ কিন্তু দানিয়েলের লেখা যদি সত্যি হয় তবে এর থেকে বড় কন্ট্রোভার্সিয়াল ইস্যু ইতিহাসে আর খুব বেশি হবে না৷

কিন্তু এইরকম কি আদৌ হতে পারে?

স্যার শুনে-টুনে বললেন, ‘‘দ্যাখো ব্রততী, প্রপার এভিডেন্স ছাড়া কিন্তু কোনো ইনফরমেশনের ভ্যালু নেই৷ আমার মনে হয় তুমি রেফারেন্সগুলো আরো খুঁটিয়ে পড়ো, একটু এদিক ওদিক লিখলে কিন্তু রে রে করে তেড়ে আসার লোকের অভাব নেই৷ তার উপর যদি অক্সফোর্ডের জার্নালটায় বেরোয়, রেকগনিশনের পাশাপাশি ক্রিটিসিজমের সন্মুখিন যেন না হতে হয়, সেটা কিন্তু তোমার কেরিয়ারের প্রথমেই একটা নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট ফেলবে৷’’

ছোট থেকে জয়েন্ট ফ্যামিলিতে মানুষ হয়েছি, একা একা বেশিক্ষণ থাকার সুযোগই পেতাম না, সেখানে একা খেতে বসা কল্পনারও অতীত ছিল৷ মাঝেমধ্যে মনে হয়, সবাইকে নিয়ে থাকার মধ্যে যে আনন্দটা আছে সেটা সেই আনন্দটা জীবন থেকে চলে গেলে তখন অনুভব করা যায়৷ যেমন এখন প্রতি মুহূর্তে এই একাকিত্ব কুরে কুরে খাচ্ছে আমায়৷

খেয়ে নিয়ে শুতে যাওয়ার আগে জানলার দিকে একবার তাকালাম৷ যতদূর চোখ যায় ফাঁকা ঢেউখেলানো সুবিস্তৃত সমভূমি, তার উপর চাঁদের আলো টেরচা ভাবে পড়ে কেমন একটা মায়াময় পরিবেশের সৃষ্টি করেছে৷ গোটা এলাকাটা আট-দশটা বড় বড় চেস্টনাট আর পাইন গাছ ছাড়া সবুজ নরম ঘাসে ঢাকা৷ আমাদের এই সেন্টফিল্ড গ্রামের অন্য ফাঁকা জায়গাগুলোয় গ্রামবাসীদের ঘোড়া, গোরুগুলো চরে বেড়ালেও আমাদের বাংলোর ডানপাশের এই জায়গাটায় আসে না, তার কারণ এই জায়গাটার মালিক বাইরে থাকলেও তার কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এ ব্যাপারে৷ আর একটা জিনিস আমি এই কয়েকদিনেই বুঝেছি, আমাদের দেশের মানুষ যেমন নিয়ম ভাঙা, অবাধ্য হওয়াটাকে চ্যালেঞ্জ মনে করে, এইসব উন্নত মহাদেশে লোকজন নিয়ম মেনে চলতেই ভালোবাসে৷

সাড়ে দশটা নাগাদ শুয়ে পড়লাম৷ বিছানায় শুয়ে একবার ফোন করি রোজ সুগন্ধকে, আজও করলাম, ‘‘শুয়ে পড়ছি৷ তুমি কখন ফিরবে?’’

ওদের ফ্যাক্টরিতে যখন মেশিন চলে আওয়াজে প্রায় কিছুই শোনা যায় না, তবু তার মধ্যেই সুগন্ধর গলা পেলাম, ‘‘আমার ফিরতে সাড়ে তিনটে-চারটে মতো বাজবে৷ তোমাকে উঠতে হবে না, ডুপ্লিকেট কি তো রয়েছে, আমি ঢুকে পড়ব৷ তুমি ঘুমিয়ে পড়ো৷’’

‘‘অত রাতে সাইকেলে করে আসবে, ভালো করে মাথা কান সব ঢেকে এসো কিন্তু! গুড নাইট৷’’

সবে শীত পড়ছে, তার উপর মোটা ব্ল্যাংকেটের তলায় ঘুম, বেশ গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম৷

ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল৷

বাইরে তাকিয়ে দেখলাম ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ এইরকম সময় ঘুম ভাঙল কেন? কোনোদিন তো এমন হয় না৷

অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে মোবাইলটা নিয়ে আলো জ্বাললাম৷ ঘড়িতে তিনটে পাঁচ৷

পাশ ফিরে আবার শুতে যাব, হঠাৎ একটা অস্বাভাবিক জান্তব আর্তনাদে শরীরের একদম ভেতরের স্নায়ুটাও মনে হল যেন ঝনঝন করে উঠল৷

গভীর রাতে কুকুর যেভাবে করুণ সুরে ডাকে, অনেকটা সেইরকম একটা চাপা ডাক যেন ভেসে আসছে৷ কীরকম সেই শব্দ তা ব্যাখ্যা করার শক্তি আমার নেই, শুধু এটুকু বলতে পারি সেই অপার্থিব বীভৎস ডাকে অতি শক্তিশালী মানুষেরও ব্রহ্মতালু কেঁপে উঠবে৷

আওয়াজটা একটানা হচ্ছিল না, ছোট ছোট ডাক একটানা হয়ে চলেছিল৷

আমি আর থাকতে পারলাম না, যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠে চললাম জানলার দিকে৷

আজ চাঁদের আলোয় বেশ স্পষ্ট বাইরেটা দেখা গেলেও জন্তুটা যেহেতু একটা বড় ওক গাছের তলায় পাক খাচ্ছিল, সেটাকে ভালো দেখতে পাচ্ছিলাম না৷ শুধু এইটুকু বুঝতে পারছিলাম , সেটা পা ঘষটে ঘষটে চলছিল, আর মাঝে মাঝেই মুখ দিয়ে বিকট একটা শব্দ করছিল৷ শব্দটা যেন সে অতিসতর্ক ভাবে চাপা স্বরে করছে কাউকে না জানানোর অভিপ্রায়ে৷

আচ্ছা পেছনের পা দুটো একটু বেশিই লম্বা কি?

জন্তুটা মুখ নিচু করে ওটা কী করছে? শুঁকছে?

আশপাশে মানুষ থাকলে সেই গন্ধটা নাকে যাওয়ার মতই কি তীব্র ঘ্রাণশক্তি ওটার?

আমি আর পারলাম না, জানলা থেকে সরে টলতে টলতে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম৷

প্রচণ্ড অবসন্ন লাগছে৷

***

ঘুম ভাঙল যখন, তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে৷ জানলা দিয়ে মিষ্টি রোদের আলো এসে পড়েছে বিছানায়৷ আমি চোখ মেলে দেখলাম, সুগন্ধ পাশের চেয়ারটায় বসে ল্যাপটপে কী করছে৷ কাল অতবার বললাম থার্মাল পরে যেতে, শুনল না৷ এখন নাক টানছে জোরে জোরে৷

আমাকে উঠতে দেখে বলল, ‘‘কী হয়েছে? শরীর খারাপ?’’

আমি কিছু না বলে মাথা নাড়লাম৷ অন্যদিন সুগন্ধ ভোররাতে এসে ঢুকলেও আমার ঘুম ভেঙে যায়, ও অল্প কিছু খেয়ে শুয়ে পড়ে৷ আজ ভোরে ও কখন এসেছে টের তো পাইইনি, উল্টে এত বেলাতেও আমার ঘুম ভাঙেনি৷

আমি ধড়মড় করে উঠতে যেতেই সুগন্ধ কাশতে কাশতে বলল, ‘‘না না, শরীর খারাপ লাগলে রেস্ট নাও৷ আমি বেরিয়ে যাচ্ছি৷’’

‘‘খেয়েছ? কফি আর স্যান্ডউইচ বানিয়ে দিই?’’ আমি উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠলাম৷

‘‘না না, তোমায় কিছু করতে হবে না৷ তুমি রেস্ট নাও৷ আমার পেটটাও এমনিতে ভালো নেই, আমি অফিসে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নেব৷’’

আমি ম্লান হাসলাম৷ সুগন্ধ মনে হয় ঘাবড়ে গেছে, এসে থেকে আমাকে কখনো ও অসুস্থ দেখেনি বলেই বোধ হয়৷ আমি বললাম, ‘‘তুমি ঠান্ডাটা তো ভালোই লাগিয়েছ দেখছি৷ ওষুধ খেয়েছ?’’

মুখে একরকম কথা বলে চললেও মনে অন্য চিন্তা আমার ঘুরপাক খাচ্ছিল৷ আচ্ছা, কাল রাতে যেটা দেখলাম, সেটা কি দুঃস্বপ্ন? পরপর দু-রাতই? পুরোটাই কি আমার একা থাকা মনের কল্পনা? আমাদের বাংলো ছাড়া আর কোথাও থেকে নাহয় এই ফাঁকা জায়গাটা তেমন দেখা যায় না, কিন্তু ওই যে মর্মবিদারী শব্দ, আর কেউ কি সেটা পায়নি?

আমি আজ আর চুপ করে বসে থাকতে পারলাম না, সুগন্ধ বেরিয়ে যেতেই দরজা বন্ধ করে চলে গেলাম মিসেস মেইজারের কাছে৷ কিছু একটা করতেই হবে, না হলে রাত আসতেই আমাকে যেন আতঙ্ক এসে ঘিরে ধরছে৷

মিসেস মেইজার কিন্তু কথাটা একেবারে উড়িয়ে দিলেন না, ‘‘আমিও কাল রাতে একটা স্ট্রেঞ্জ শব্দ পেয়েছি বোটি! বাথরুমে উঠেছিলাম, তখন৷ প্রথমে ভাবলাম কোনো গোরুর কি কোনো কষ্ট হচ্ছে? তারপর বুঝলাম যে, না৷ এটা কোনো গোরুর ডাক নয়৷ কিন্তু বাইরে কিছু দেখতে পেলাম না৷ ইনফ্যাক্ট…’’ উনি চিন্তিত মুখে বললেন, ‘‘আমি আগেও মাঝে মাঝে এই শব্দটা পেতাম৷ কিন্তু খুব একটা গুরুত্ব দিইনি৷ কিন্তু তুমি যা দেখেছ এরপর তো আর বসে থাকলে চলে না বোটি!’’

আমি একটা শ্বাস ছাড়লাম! যাক! অবশেষে একজনকে পাওয়া গেল যে না দেখলেও অনুভব করেছে জন্তুটাকে৷

আমি বললাম, ‘‘তুমি কী করে দেখতে পাবে, জন্তুটা তো আমাদের বাংলোর ডানপাশটায় ঘুরছে? যদি কোনো হিংস্র পশু হয়?’’ শেষ কথাটা বলার সময় আমার গলাটা ঈষৎ যেন কেঁপে গেল৷

আমরা ভারতীয়রা সবসময় আমাদের দেশে পপ্যুলেশন বেশি বলে গালমন্দ করি, কিন্তু অতিরিক্ত কম মানুষজনও যে কত চিন্তার হতে পারে, তা এইসব দেশে না এলে বোঝা যায় না৷ এখানে মোটামুটি সব বাড়িতেই লাইসেন্সড বন্দুক থাকে একটা করে৷ যদিও কড়া পানিশমেন্ট আর ল বলে এখানে ক্রাইম রেট বেশ কম, তবু সাবধানতা অবলম্বন করে সবাই৷

যেহেতু আমাদের প্রায় চার-পাঁচশো মিটারের মধ্যে কোনো বসতবাড়ি নেই, তাই আমাদের আর মেইজারদেরই যা করার করতে হবে৷ এখানকার পুলিশ ফোর্স যেহেতু খুব এফিশিয়েন্ট, এরা কিছু হলেই পুলিশ ডাকে৷ আমাদের দেশের মতো পুলিশে ছুঁলেই আঠেরো ঘা টাইপ ফোবিয়া এদের নেই৷

মিঃ মেইজার, মিসেস মেইজার, আমি আর ক্যাথারিন ছাড়াও মেইজারদের ফার্মের দুটো ইয়ং কর্মচারী মিলে বসে ঠিক করা হল আজ রাতে পুলিশ ডাকা হোক৷ আমরা সবাই সতর্ক থাকব, জন্তুটা এলেই বেরোনো হবে৷ তারপর অবস্থা বুঝে যা প্রপার অ্যাকশন নেওয়ার, পুলিশ নেবে৷

মিঃ মেইজার পুলিশকে ফোন করতে উদ্যত হতেই আমি একটু ভেবে বললাম, ‘‘কিন্তু পুলিশ যদি বলে এখনো তো আপনারা এটা বোঝেননি যে জন্তুটা বিপজ্জনক, তাহলে আমরা কেন যাব?’’

মিঃ মেইজার অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন, ‘‘বাহ, প্রিভেন্টিভ মেজার হিসেবে পুলিশকে ডাকতে হবে না? এখন কারও ক্ষতি করছে না ভালো কথা, দুম করে যদি তোমাদের বাড়ি অ্যাটাক করে বসে? আর তুমি যেরকম ডেসক্রিপশন দিচ্ছ, তাতে কাচের জানলা ভেঙে ঢোকা অতবড় জন্তুর পক্ষে অসম্ভব নয়৷ তার চেয়ে পুলিশ স্টেশনে জানিয়ে রাখি, ওরা লোক পাঠালে আমরা রাতে তোমাদের বাড়ির একতলায় লুকিয়ে থাকব৷ তোমাদের বাড়ির পেছন দিয়ে ওই পাশের মাঠে যাওয়ার একটা জায়গা আছে না?’’

‘‘হ্যাঁ৷ পেছন দিকে নয়, একতলায় ডানদিকে৷ ওটা দিয়ে সোজা ওই গাছটার কাছে চলে যাওয়া যায়, যেটার চারপাশে জন্তুটা ঘুরছিল৷’’ বলতে বলতে আমার বুকের ভেতরটা আবার ভয়ে কেঁপে উঠল৷ নাহ, আজ রাতে সুগন্ধকে বাড়িতে থাকতে বলতেই হবে৷ এরা যতই সঙ্গে থাকুক, ও না থাকলে আমি ঠিক ভরসা পাব না৷

মেইজারদের বাড়ি থেকে ফেরার সময় ভয় হলেও অদম্য কৌতূহলটা চাপতে না পেরে আমি সোজা বাড়ি না এসে একবার আমাদের বাড়ির ডানদিকের ওই জায়গাটায় গেলাম৷ সবুজ নরম ঘাসে ঢাকা সুন্দর একটা জায়গা, ঠিক যেন বিলিয়ার্ড খেলার টেবিল৷ কে বলবে নিশুতি রাতে এখানে এক ভয়ঙ্কর জন্তু এসে ঘোরে?

ইতিউতি ঘুরে যখন চলে আসব ভাবছি, তখন একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ওক গাছটার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম৷ কী যেন একটা অস্বাভাবিকত্ব মনে হল৷

কাছে যেতেই দেখলাম ওক গাছের মোটা গুঁড়িটার চারপাশের যে সবুজ ভেলভেট ঘাসগুলো ছিল সেগুলো উধাও, গোল বলয়ের আকারে পুরো জায়গাটা যেন ন্যাড়া হয়ে গেছে, রক্তমাংসের নীচে থাকা হাড়ের মতো ফ্যাকাশে মাটি বেরিয়ে এসেছে৷ মনে হচ্ছে এক রাতে কোনো এক রাক্ষুসে গোরু এসে সব ঘাস গিলে খেয়েছে৷

আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমস্রোত নেমে গেল৷

কী চায় জন্তুটা?

*******

সুগন্ধ যখন অফিসে থাকে, আমি ইচ্ছে করেই সাংসারিক কোনো ঝামেলার কথা বলে ওকে বিব্রত করিনা৷ এমনিতেই ওদের রিস্ক ফ্যাক্টর অনেক বেশি, তার মধ্যে অফিসটাইমেও বাড়ির সমস্যা শুনতে কারোরই ভালো লাগে না৷ ঠিক করে রাখলাম দুপুরে যখন ফিরবে, তখনই পুরো ব্যাপারটা ওকে বুঝিয়ে বলব, যদি অফিসে একটু ম্যানেজ করে রাতে আজকের দিনটা বাড়িতে থাকতে পারে৷

কিন্তু কথায় বলে মানুষ ভাবে এক, আর হয় আর-এক৷ অন্যদিন বারোটা সাড়ে বারোটার মধ্যে দুপুরে ফিরে আসে সুগন্ধ, কিন্তু আজ তার একটু আগেই ফোন করল৷ ওদের একটা মেশিনে নাকি মেজর ফল্ট দেখা দিয়েছে, আজ ও বাড়ি আসতেই পারবে না, এমনিতেই নাকি অনেক আপার লেভেল থেকে এসক্যালেটেড হয়েছে ম্যাটারটা, আজ রাতের মধ্যেই সেটাকে রিসলভ করতে হবে ওদের গোটা টিমকে৷ ও সব কাজ মিটিয়ে একেবারে ভোররাতে ফিরবে৷

আমি কিছু না বলে ঠোঁট কামড়ে ধরে চুপ করে গেলাম৷ একবার ভাবলাম দু-দিন ধরে চেপে রাখা ব্যাপারটা বলব কি না, তারপরেই মনে হল ল্যাবে এত চাপে রয়েছে, তার মধ্যে আবার এটা বলে দুশ্চিন্তা বাড়ানোটা কি ঠিক হবে? পুলিশ তো আজ রাতে আসবেই! যা করার ওরাই করবে৷ মেইজাররাও রয়েছেন৷ সুগন্ধকে বলা মানে ও কিছুই করতে পারবে না, মাঝখান থেকে কাজের মধ্যে টেনশন করবে৷

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সুগন্ধ মানানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘‘প্লিজ আমার সিচুয়েশনটা একটু বোঝার চেষ্টা করো৷ আজকের ব্যাপারটা মিটিগেট হলে পরের উইকটা একটু হালকা থাকবে, তেমন হলে আমরা কাছেপিঠে কোথাও ঘুরেও আসব, এই ধরো অ্যামস্টারডামের দিকটা৷’’

আমি আর কিছু বলতে পারলাম না, শুধু অস্ফুটে বললাম, ‘‘ঠিক আছে৷ ওখানে খেয়ে নিও তাহলে৷ আর ঠান্ডা লাগিয়ো না৷’’

অন্যদিন সকালবেলা জানলাগুলো খুলে দিই, কিন্তু আজ ডানপাশের জানলাগুলো সব বন্ধ করে দিলাম, দূরের ওই একাকী দাঁড়িয়ে থাকা ওক গাছটার দিকে তাকালেই কেমন একটা কু ডাকছে মনটা৷

লাঞ্চ সেরে আমার পেপারটা নিয়ে আবার বসলাম৷ মনের মধ্যে আসন্ন রাত নিয়ে যতই উচাটন হোক, আমার নিজের কাজটাও ফেলে রাখলে চলবে না৷

দাশগুপ্ত স্যার যতই আমাকে সাবধান করুন, আমি নিজের ব্যাপারে কনফিডেন্ট যে এই পেপারটা পাবলিশড হলে আমি পুরো লাইমলাইটটা পাব৷ কিন্তু এই সমস্ত ভালো ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর যেসব জার্নালের, তারা পেপার অথরদের কনফারেন্সেও ইনভাইট করেন, যেখানে বড় বড় মানুষের ওই পেপারের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়৷ যাকে বলে কোয়েশ্চেনেয়ার রাউন্ড৷ আমাকেও যদি সেইরকম কোনো কনফারেন্সে যেতে হয়, তার জন্য এখন থেকেই প্রিপেয়ারড হওয়া প্রয়োজন৷

কিন্তু সম্রাট নেবুকাডনেজারের যে অদ্ভুত চারিত্রিক ডিজঅর্ডারটা আমি দানিয়েল এবং আরো কিছু দুষ্প্রাপ্য পুঁথি থেকে আবিষ্কার করেছি, সেটা যদি সত্যি হয় তবে তো ওঁরা প্রশ্ন তুলতেই পারেন যে তারপর থেকে এই আড়াই হাজার বছরে এইরকম সিনড্রোম আর কারও দেখা গেল না কেন? তাই সবরকম অকওয়ার্ড প্রশ্নের জন্য আমাকে তৈরি থাকতে হবে৷

আচ্ছা সত্যিই কি এতগুলো বছরে এই সিনড্রোমের কেস একটাও পাওয়া যায়নি? নাকি পাওয়া গেলেও সেগুলোর সংখ্যা এতই কম যে মেডিক্যাল বইতে তার কোনো উল্লেখ নেই!

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আমাকে ইন্টারনেট চষে ফেলতে হবে৷

সাধারণত আমি যখন কোনো কাজে মন দিই, তখন এতটাই তার মধ্যে বুঁদ হয়ে যাই যে নাওয়াখাওয়ার খেয়াল থাকে না৷ এক্ষেত্রেও সেটাই হল৷ দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে কখন যে সন্ধে নেমে এসেছে আমি খেয়ালই করিনি৷

মিঃ মেইজার যখন ক্যাথারিনকে দিয়ে বলে পাঠালেন ওঁরা তৈরি হয়ে আছেন, আমাদের বাড়ি চলে আসবেন কি না, তখন আমার হুঁশ ফিরল৷ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ন’টা বেজে গেছে৷ দূরের টিলাগুলোর পেছনে কখন যেন সূর্য অস্ত গিয়ে গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছে ঝুপ করে, ধু-ধু মাঠের আনাচেকানাচে বাসা বেঁধেছে ঠান্ডা অন্ধকারের ধূসর দানা৷

এই রে! ওঁরা চলে আসবেন বলছেন, আমার তো রাতের খাওয়াও হয়নি৷ এদিকে নতুন এত কিছু জিনিস যে এই কয়েকঘণ্টায় জানতে পারব সেটা আশাতীত ছিল৷ ফলে এখন নিজের এই কাজ ছেড়ে উঠতেও ইচ্ছে করছে না৷

তবু উঠতে হল৷ বিশেষত যখন আবার এক ঝলকের জন্য মনে পড়ল সেই চাপা অথচ গায়ের রক্ত জল করে দেওয়া ডাকটার কথা আর জন্তুটার ঘুরে বেড়ানোর কথা৷

নাহ, মিঃ মেইজারদের থেকেও আমারই এই ব্যাপারে উদ্যোগী বেশি হওয়া উচিত, কারণ ঝুঁকিটা সবচেয়ে বেশি আমার৷

আমি ক্যাথারিনকে বললাম, ‘‘আমি আধঘণ্টার মধ্যেই ডিনার করে নিচ্ছি৷ তুমি ওঁদের চলে আসতে বলো তার মধ্যে৷’’

সবাই রেডি হয়ে থাকলেও পুলিশ এল রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ৷ আমি জন্তুটাকে দু-দিনই দেখেছি তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ, কিন্তু সেই সময় পুলিশের গাড়ি ঢুকলে আলোতে জন্তুটা নাও বেরোতে পারে৷ তাই আগেভাগেই চলে আসাটা যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে সবার৷

আজকে ভেতরের নার্ভাসনেসের কারণেই হোক, কিংবা প্রাকৃতিক কারণে, শীতটা যেন একটু বেশি করছে৷ ইচ্ছে করেই আলো জ্বালাইনি আমরা৷ অন্ধকার ঘরে থাকতে থাকতে প্রথমে কিছু না দেখা গেলেও চোখ সয়ে যায় তারপর৷ এখনো সেটাই হয়েছে, আমাদের শোবার ঘরের বিছানা, চেয়ার, সোফা সবেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আমরা বসে আছি, বাইরের চাঁদের অস্পষ্ট আলোর যেটুকু আভা ঘরের মধ্যে এসে পড়েছে, তাতে সবাই সবার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছি৷

মিঃ মেইজার একটু আমুদে মানুষ, বললেন, ‘‘ধুর, এইভাবে চুপচাপ বসে থাকা যায়? একটা মুভি দেখলে কেমন হয়?’’

অন্ধকারে কেউ আমরা কারও মুখ ভালোভাবে দেখতে না পেলেও সবার মুখেই একচিলতে করে হাসি ফুটে উঠল৷ মিঃ মেইজারের পুরোনো হলিউডি সিনেমার প্রতি প্রচণ্ড শখের কথা সকলেই জানা৷ প্রায় প্রতিদিন সন্ধেবেলা তাঁর বাড়ির দিকের জানলায় গিয়ে দাঁড়ালে গ্রেগরি পেকের গলার আওয়াজ শোনা যায়৷ কিন্তু এখন বাধ সাধলেন মিসেস মেইজার, ‘‘খেপলে নাকি! মুভি দেখলে আলো জ্বলবে, তাতে যদি জন্তুটা বুঝতে পেরে যায়? পুরো প্ল্যানটাই ভেসে যাবে তাহলে৷’’

ন্যায্য কথা৷ অতএব সবাই নীচু কণ্ঠে গল্পগুজব করতে লাগলাম৷ ঘুম আসছিল ভালোই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় টইটম্বুর হওয়ার ফলে কেউ ঘুমোতে চাইছিলাম না৷

পুলিশ স্টেশন থেকে দুজনকে পাঠানো হয়েছিল৷ দুজনেই বেশ হাসিখুশি ধরনের৷ একজন বেশ রোগা লম্বা, অন্যজন একটু মোটাসোটা কিন্তু খুব লম্বা৷ দ্বিতীয়জন আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘‘আচ্ছা জন্তুটাকে তো শুধু আপনিই এখনো অবধি দেখেছেন, তাই তো?’’

আমি অন্ধকারে মাথা নেড়ে বললাম, ‘‘হ্যাঁ৷’’

‘‘কিন্তু আপনাদের বাড়ির ওইপাশটা তো একেবারেই ফাঁকা, জন্তুটা যদি রাতেই আসে, তবে দিনের বেলা থাকে কোথায়? কাছেপিঠে কোনো জঙ্গল তো নেই, যদি দূর থেকেও আসে, তবে আর কেউ তাকে দেখতে পায়নি কেন?’’

আমি চুপ করে রইলাম৷ এর কী উত্তর দেব!

আমার হয়ে মুখ খুললেন মিঃ মেইজার, ‘‘এটা আমারও মনে হয়েছিল যে জন্তুটা থাকে কোথায়৷ সেন্টফিল্ড গ্রামের একদম শেষে যে জঙ্গল আছে, তার মধ্যে কিছু পুরোনো গুহাও আছে, সেদিকটায় কেউ তেমন যায় না৷ ওখানে যদি ঘাঁটি গেড়ে থাকে? তবে শুধু রাতের বেলায় হেঁটে হেঁটে এতটা আসে, এটা কিন্তু ভারী আশ্চর্যের৷ কেনই বা আসে৷’’

নীচু গলায় আমাদের আলোচনা চলছিলো৷ আড়াইটে নাগাদ আমি আর মিসেস মেইজার কিচেনে গিয়ে একটু কফি নিয়ে এলাম, ফ্লাস্কে করাই ছিল আগে থেকে৷ গরম কফি খেয়ে সবাই যখন আবার বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছি, মিঃ মেইজার কী একটা যেন বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ একটা অদ্ভুত গোঙানির মতো চাপা আওয়াজে সবাই চমকে উঠলাম৷

সেই শব্দটা!

জন্তুটা এসেছে৷

এত মানুষ আজ আমার সঙ্গে থাকতেও আমার বুকের মধ্যে যেন আবার হাতুড়ি পেটা শুরু হয়ে গেল৷

আগে থেকেই ঠিক করে রাখা ছিল, কেউ সবাই মিলে গিয়ে জানলার কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়বে না, একজন পুলিশ অফিসার জানলার কাছে গিয়ে অন্ধকারে দেখে নিশ্চিত হলেন, তারপরেই আমাদের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে এক এক করে আমরা সবাই একতলায় নামতে লাগলাম৷ শুধু একজন অফিসারের হাতের ছোট্ট একটা লেজার লাইটের আলো ছাড়া সব অন্ধকার৷

যতটা সম্ভব আওয়াজ এড়িয়ে নীচে নামছিলাম আমরা৷ মিসেস মেইজার বয়স্ক হলেও বেশ শক্তসমর্থ, রোগাটে গড়ন, কাজের মধ্যে থাকেন বলে বেশ চটপটেও, কিন্তু নীচে নেমে উনি বললেন, ‘‘আমার পায়ে ব্যথা আছে, খুব জোরে ছুটতে পারব না৷ তোমরা বরং যাও৷ সবাই কি একসঙ্গেই যাবে?’’

আমাদের বাড়ির একতলায় আমরা কেউ না থাকলেও বাড়তি আসবাবপত্র কিছু রয়েছে৷ আমি এই চারমাস হল এলেও সুগন্ধ বিয়ের আগে থেকে প্রায় বছরখানেক হল এই বাড়িতেই থাকে, কাজেই ওর কোনো বন্ধুবান্ধব এলে আমরা নীচের ঘর দুটো গেস্টরুম হিসেবে ব্যবহার করি৷

একতলায় দুটো ঘর আর একটা মাঝারি মাপের ডাইনিং, তারই ডানপাশে যে বন্ধ কাচের দরজাটা আছে, সেটা খুলে দিলে সোজা চলে যাওয়া যায় ওই ফাঁকা জায়গাটায়৷ দরজাটা খুলে যদি কেউ ছুটতে শুরু করে, ওই ওক গাছটার কাছে যেতে তার বড়জোর পাঁচ সেকেন্ড সময় লাগবে৷

সেইরকমই ঠিক হল৷ আবছা আলোয় দেখলাম ঠিক গতকালের মতোই জন্তুটা পেছনের অস্বাভাবিক লম্বা পা দুটো ঘষতে ঘষতে মাথা নীচু করে শুঁকতে শুঁকতে ধীরে ধীরে চলছে৷ তবে এবার আর ওক গাছটার চারপাশ নয়, তার থেকে একটু দূরের চেস্টনাট গাছটার চারপাশে গোল হয়ে ঘুরছে সেটা, আর মাঝে মাঝেই সেই ডাকটা ছাড়ছে৷

মিঃ মেইজার চাপা গলায় বললেন, ‘‘ডাকটা শুনলে যেন মনে হচ্ছে, জন্তুটার জোরে ডাকতে খুব ইচ্ছে করছে, কিন্তু প্রাণপণে কন্ট্রোল করে সে ভল্যুমটা চাপছে, তাই না?’’

আমিও এই কথাটাই ভাবছিলাম৷ একটা চতুষ্পদ প্রাণীর এত বুদ্ধি দেখে আশ্চর্যও যেমন হচ্ছিলাম, তেমনই অনাগত বিপদের আশঙ্কায় ভয়ে যেন হতবুদ্ধি হয়ে যাচ্ছিলাম৷

যদিও দুজন অফিসারের কাছেই রিভলভার রয়েছে, তবু সত্যিই জন্তুটা একটা হিংস্র নরখাদক হয়? পুলিশের গুলির নিশানায় পড়ার আগেই যদি আমাদের আক্রমণ করে বসে? সুগন্ধ জানতেও পারবে না তার বউটা মরে গেল৷ হাজার হাজার মাইল দূরে বসে থাকা আমার বাবা মা-ও কল্পনা করতে পারবেন না তাঁদের একমাত্র মেয়ের পরিণতি!

আর আমার রিসার্চ? ভাবতেই আমার গলার কাছটা কেমন দলা পাকিয়ে উঠল৷ সম্রাট নেবুকাডনেজারের এত বড় একটা ঐতিহাসিক তথ্য কি আবার ইতিহাসের অতলেই তলিয়ে যাবে?

রোগা লম্বা পুলিশ অফিসারটার চাপা গলায় আমি আবার সংবিৎ ফিরে পেলাম, ‘‘সবাই শুনুন, ওয়ান টু থ্রি গোনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দরজাটা খুলে বাইরে ছোটা শুরু করব, আপনাদের আগেও বলেছি ভেতরে থাকলে ভালো করতেন, কিন্তু আপনাদের যখন এতই আসার ইচ্ছা, তখন আমাদের দুজনের পেছন পেছন আসবেন, বেশি এগোবেন না জন্তুটার কাছে৷ রেয়ার কোনো স্পিসিস হলে আমরা মারতে চাই না, কোনোভাবে ইনজিওরড করে হায়ার অথরিটিকে রিপোর্ট করতে হবে, বুঝেছেন তো?’’

বুঝেছি সবই৷ কিন্তু টেনশনে যে মোটা ডবল ব্রেস্টেড কোটের তলাতেও ঘামতে শুরু করেছি, তা আর এই পুলিশ দুটোকে কে বোঝাবে৷ আধো অন্ধকারে দেখলাম মিঃ মেইজারের ফার্মের ছেলে দুটো বড় বড় দুটো রড উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷

আরো একবার সেই চাপা আওয়াজটা শোনা যেতেই রিভলভার তাক করে পুলিশ অফিসার দুজন দরজাটা খুলে দিয়েই তিরের মতো ছুটে গেলেন বাইরের দিকে৷

মিঃ মেইজার, ক্যাথারিন, ওদের ফার্মের ছেলে দুটো আর আমিও ছুটলাম রুদ্ধশ্বাসে, বাইরে খোলা আকাশের নীচে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে মনে হল ঠান্ডা হাজার হাজার ছুঁচ যেন মোটা কাপড় ভেদ করে কেউ ঢুকিয়ে দিল গায়ে৷ তবু ছোটা থামালাম না৷

পুলিশ দুটো এগিয়ে গিয়ে প্রথমে জন্তুটার পা লক্ষ্য করে একটা গুলি চালাল, সেটা সামান্যর জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে লাগল চেস্টনাট গাছের গুঁড়িটায়, মোটা অফিসার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড পাওয়ারফুল একটা টর্চের আলো জ্বেলে সোজা তাক করলেন জন্তুটার দিকে৷

নেদারল্যান্ডে এখনো ততটা ঠান্ডা পড়েনি৷ পাঁচ-ছয়ের মধ্যেই হবে তাপমাত্রা৷ তবু সেই আলো বরাবর তাকিয়ে আমি যেন বুঝতে পারলাম যে আমার শিরদাঁড়ার মধ্যে দিয়ে আলোর চেয়েও দ্রুত গতিতে একটা ঠান্ডা বরফের কুচি নামছে আর রক্তগুলোকে তার সেই হিমশীতল পরশ দিয়ে জল করে দিচ্ছে ধীরে ধীরে৷

চেস্টনাট গাছটার তলায় চারপায়ে হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে নড়াচড়া করছে একটা পূর্ণদেহী মানুষ, সম্পূর্ণ উলঙ্গ, এই শীতের রাতে তার গায়ে একটা সুতোও নেই, যেন ভীষণ খিদে পেয়েছে, এমনভাবে বাঁ হাত দিয়ে সে প্রবল আক্রোশে সবুজ নরম ঘাসগুলো ছিঁড়ছে, তার হাতের চাপে ঘাসগুলো মাটি ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে, আর সে ঘাসগুলোকে মুখে পুরে কচকচ করে চিবোচ্ছে৷ তার সম্পূর্ণ আবরণহীন পা দুটো হাঁটুর কাছ থেকে মুড়ে এল শেপের আকারে ছড়িয়ে রয়েছে পেছন দিকে, যেটাকে আমি দূর থেকে অস্বাভাবিক বড় পা বলে ভুল করেছিলাম৷ ঘাস খেতে খেতে সে আরো একবার ওই ডাকটা ছাড়তে যাচ্ছিল, এমন সময় এত উজ্জ্বল আলোর ঝলকানিতে সে ঘোলাটে দিশেহারা চোখে তাকাল আমাদের দিকে৷ সেই দৃষ্টি যেন সম্পূর্ণ শূন্য, সে এদিকে তাকিয়েছে ঠিকই, কিন্তু যেন দেখতে পাচ্ছে না কিছুই৷

অনেকটা মৃত মানুষের চোখের মতো৷

আমিও তাকালাম৷ শরীরের সব রক্ত শুষে নেওয়া ফ্যাকাশে চোখে৷

আর এমন শুভদৃষ্টি বোধহয় বিয়ের পর এই দ্বিতীয়বার হল আমাদের৷

জ্ঞান হারানোর আগে অবচেতনে সব চিন্তা, সব ভয়, সব উদ্বেগ যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল৷ সবচেয়ে উপরে ভেসে আসছিল আমার রিসার্চ ওয়ার্ক৷ আমার আবিষ্কার৷ বোয়ানথ্রপি, সম্রাট নেবুকাডনেজারের সেই রেয়ারেস্ট মানসিক ডিজঅর্ডার, যা আমি দানিয়েলের বই থেকে উদ্ধার করেছিলাম৷

বোয়ানথ্রপি৷ এমন একটা সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার, যাতে মানুষ নিজেকে তৃণভোজী গোরু ভাবতে শুরু করে৷ প্রথমে মাঝে মাঝে, তারপর সবসময় পশুর মতো আচরণ করতে থাকে৷ নেবুকাডনেজার অত্যন্ত দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্রাট ছিলেন, কিন্তু তাঁর এই বিকৃতি ছিল৷ দানিয়েল নিজে লিখে গিয়েছেন, সম্রাট রাতের অন্ধকারে উলঙ্গ হয়ে জঙ্গলে ঘুরতেন, ঘাস চিবিয়ে খেতেন আর মুখ দিয়ে জন্তুর মতো আওয়াজ করতেন৷ একটা চরম ডিলিউশনের ফেজ এটা৷ সারা পৃথিবীতে এমন রুগির সংখ্যা বড়জোর পাঁচটা পাওয়া গেছে হয়তো৷

জ্ঞান হারানোর আগে রক্তচাপ চরমে পৌঁছলে মানুষ একটা হ্যালুসিনেশনে পৌঁছে যায়, আমারও মাথায় হাজার হাজার কাটা কাটা ছবি ভেসে আসছিল৷

দাশগুপ্ত স্যার আমাকে প্রপার এভিডেন্স জোগাড় করতে বলেছিলেন৷ বোয়ানথ্রপি এতটাই বিরল মানসিক বিকৃতি, ইতিহাসের পণ্ডিতরা আমার কথা কতটা মেনে নেবেন, তা নিয়ে স্যার শঙ্কায় ছিলেন৷

আজ সারা দুপুর ধরে আমি বোয়ানথ্রপির কেস স্টাডি করেছিলাম না?

কত সাইকোলজির ওয়েবসাইট ঘেঁটে যেন প্রমাণ খুঁজছিলাম?

তখন কি কল্পনাতেও ভাবতে পেরেছিলাম যে বোয়ানথ্রপির জলজ্যান্ত উদাহরণ আমার ঘরেই রয়েছে?

জ্ঞান হারানোর আগে শুধু শেষবারের মতো সুগন্ধের লালচে সবুজ ঘোলাটে চোখটা দেখতে পেলাম৷ আর দেখতে পেলাম ওর ঠোঁটের একপাশ দিয়ে সবুজ কষ গড়িয়ে পড়াটা৷

*********

সেদিনের সেই অভিশপ্ত রাতের পর দু-সপ্তাহ কেটে গেছে৷ এই দু-সপ্তাহে সুগন্ধের রেজিগনেশন লেটার জমা দেওয়া থেকে শুরু করে এই বাড়ি ছাড়া, ভিসা, টিকিট, সবকিছুর ঝড় আমি একাই সামলেছি৷ অবশ্য আমাকে সবদিক থেকে সাহায্য করেছেন মিঃ এবং মিসেস মেইজার৷

দেশ থেকে বাবা মা , শ্বশুর শাশুড়ি প্রবল উদ্বেগে কী হয়েছে জানতে চাইলেও আমি কিছু খুলে বলিনি তেমন৷ শুধু জানিয়েছি, ‘‘চলে আসছি৷’’

বিয়ের পরের জড়োসড়ো নতুন বউটা যেন এই দু-সপ্তাহে পোড় খাওয়া হয়ে ঘাগু লোক হয়ে উঠেছে৷

সেদিন রাতে সুগন্ধর দৃষ্টিই শুধু অস্বাভাবিক ছিল না, ও ছিল সম্পূর্ণ বাহ্যজ্ঞানশূন্য৷ পুলিশ ওকে জাপটে ধরে তুললেও ও সেই আওয়াজটাই করে যাচ্ছিল, মনে করলেই আজও বুকের ভেতরটা কাঁপে আমার৷

ওর জামাকাপড়, সাইকেল দূরের রাস্তার এককোণে পড়েছিল৷

পরের দিন সকালে ও কিন্তু আর কিছু মনেই করতে পারেনি৷ জিজ্ঞেস করতে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল শুধু৷

না, বোয়ানথ্রপির কোনো ওষুধ নেই৷ সম্রাট নেবুকাডনেজার এই বিকৃতিতেই যে শেষ জীবনে ধীরে ধীরে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন সেই ইঙ্গিতও ছিল দানিয়েলের লেখায়৷ মিঃ মেইজারের এক আত্মীয় রটরড্যাম শহরের নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট, তিনিও তাই বললেন ফোনে৷ এখন সুগন্ধ নাইট শিফট করে ফেরার সময় নিজের অজান্তেই এই কাজটা করছে প্রতি রাতে৷ আগেও হয়তো করত, যখনই নাইট শিফট থাকত, তাই মিসেস মেইজার আমাকে বলেছিলেন যে তিনি ওই আওয়াজ আগেও দু-একবার পেয়েছেন৷

ওই সাইকিয়াট্রিস্ট রাখঢাক না রেখেই বললেন, সুগন্ধের এই ফ্রিকোয়েন্সি ধীরে ধীরে বাড়বে, একটা সময় এমন ফেজ আসবে, সারাক্ষণই ও নিজেকে একটা তৃণভোজী চতুষ্পদ জন্তু ভাববে৷

এর নাকি কোনো ট্রিটমেন্ট নেই৷

কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি৷

হাল আমি ছাড়ব না৷ সুগন্ধ শুধু আমার স্বামী নয়, ও এই ক-টা মাসে আমাকে যে নতুন জীবন দিয়েছিল, মুক্ত বাতাস নিতে শিখিয়েছিল, ডানা মেলে উড়তে সাহস দিয়েছিল৷ ওকে আমি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বড় বড় ডাক্তার দেখাব, কাউন্সেলিং করাব, প্রয়োজনে পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তে নিয়ে যাব, তবু ওকে আমি সারিয়ে তুলবই৷

এখান থেকে ডাইরেক্ট ফ্লাইট তেমন নেই, অ্যামস্টারডাম থেকে লন্ডন, সেখান থেকে কলকাতা৷ প্লেনে উঠে উইন্ডো সিট ছেড়ে দিলাম সুগন্ধকে৷ এই কয়েকদিনে ও কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে, আমার কোনো পদক্ষেপেই কোনো প্রশ্ন তোলেনি৷ শুধু একবার মৃদুগলায় জিগ্যেস করেছিল, ‘‘চলে কি যেতেই হবে ব্রততী?’’

আমি শুধু ছোট্ট করে বলেছিলাম, ‘‘হ্যাঁ৷’’

লাগেজ আগেই ক্যারেজে দিয়ে দিয়েছিলাম, আমার হ্যান্ডব্যাগটা উঠে দাঁড়িয়ে প্লেনের উপরের কেসে রাখতে যেতেই বাইরে চোখ পড়ল৷ প্লেন চলতে শুরু করেছে৷ গোধূলিবেলার পড়ন্ত মিষ্টি ওম এসে পড়েছে সুগন্ধর কপালে৷

নেদারল্যান্ডের শেষ সূর্যের আলোয় আমি একটা জোরে নিঃশ্বাস নিলাম, তারপর ওর দিকে তাকালাম৷

গোধূলি আলোয় মাখা সুগন্ধর নিষ্পাপ মুখটার দিকে তাকিয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম, সুস্থ আমি ওকে করে তুলবই!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *