নেত্ৰপাণির বিভীষিকা

নেত্রপানির বিভীষিকা

সুন্দরবনের নাম শুনলেই তােমরা হয়তাে ভেবে বসাে, না জানি কতই সুন্দর মনােরম বন সেখানা। গাছে গাছে হয়তাে পাখি ডাকচে, নদীতে কলকল্লোল সুর তুলে বয়ে চলেচে জলের ধারা, জঙ্গলের অনেক ভিতর থেকে ভেসে আসচে আদিবাসীদের গান।

কিন্তু…

এই ধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং অলীক।

সেথায় গাছের মাথায় মাথায় মাংসাশী পাখিরা সতর্ক, আতঙ্কমাখা দৃষ্টিতে চেয়ে রয় জঙ্গলের দিকে। নদীর জল দিয়ে ভেসে ভেসে সাগরে এসে পড়ে শহরতলির লক্ষ লক্ষ মড়া এবং সেইগুলিকে বুভুক্ষু লােভে ছিড়ে খাবার জন্য ওৎ পেতে থাকে জঙ্গলের ত্রাস ডােরাকাটারা। বনের ভিতর থেকে। রাতবিরেতে ভেসে আসে এমন কিছু শব্দ, এমন কিছু আর্তনাদ, যার ব্যাখ্যা বিজ্ঞানে হয় না, কিন্তু সেসব শব্দের মানে জঙ্গলের সন্তানেরা ভালােই বােঝে।

মানচিত্রে সুন্দরবনের দ্বীপসমষ্টির একদম নীচের দিকে নেত্রপাণি তালুক। বুড়ােরা বলে পুরাণের মনসামঙ্গলের সেই নেতিবােপানির ঘাটের থেকেই নাকি এই নামের উৎপত্তি, যদিও সেসব ছেলেভুলানাে গপ্পো এখনকার বাসিন্দারা আর বিশ্বাস করে না।

সুন্দরবনের তালুক, আবাদ, জমিদারি শব্দগুলি শুনে তােমরা আবার যেন বিশাল কিছু মনে করে বসাে না, কেমন?

এই মৃত্যুপুরী ভূখণ্ডের মাত্তর তিন শতাংশ কষ্টেসৃষ্টে বাসযােগ্য। গােরা সায়েবরা আকাশে ওড়ার কলগুলিতে চেপে দেখেচে যে বাকি এলাকা ছেয়ে রয়েছে নিবিড় নিখাদ হিংস্র মহাবন।

একসময় কিন্তু এই তালুক যথেষ্ট নামকরা ছিল। নেত্রপাণির জমিদার ত্রিদিবেন্দ্র রায়চৌধুরীর দাপটে বাঘে হরিণে এক বাঁওড়ে জল খেতাে। অসম্ভব প্রজাদরদী কিন্তু ভয়ানক তেজী মানুষ ছিল ত্রিদিবেন্দ্র। তা, একবার হল কি, গাঁ থেকে তিনজন মেয়েমানুষ একদিনে উধাও হয়ে গেল। নায়েবের বৌ শ্রীময়ী, গােয়ালা বৌ হীরামতি, আর প্রধান সহিসের বৌ (নামটা ভুলে গিয়েচি)। অনেক খানাতল্লাস করেও তাদের সন্ধান পাওয়া গেল না।

এমনিতেই এসব ক্ষেত্রে একটা মেয়েমানুষ উধাও হয়ে গেলে অনেক রকম মিছে কলঙ্ক রটে, কিন্তু তিন তিনজন একসাথে হারিয়ে যাওয়ায় সেইটে আর হল না। পরের হপ্তায় আবার একটি বৌ হারালাে। দিকে দিকে চর লাগিয়ে দিন তিনেক পরে খবর এল নেত্রপাণি আর জঙ্গলবাড়ি রেলের ইস্টিশানের মাঝে যে বিরাট পাঁচমারীর বন রয়েছে, তার দক্ষিণে সাগরের পাড়ে দুইজন কাপালিক আর একটি মেয়েমানুষ আস্তানা নিয়েছে ক’দিন হল। জঙ্গলবাড়ির ইস্টিশানটা আদপেই তেমন নামকরা নয়। ত্রিদিবেন্দ্রর বাপ জমিদার গজেন্দ্র রায়চৌধুরী প্রজাদের সুবিধার জন্যে জঙ্গলে কাঠ নিতে আসা মালগাড়িগুলাের সঙ্গে একখানা মানুষ বওয়া কামরাও জুড়ে দেন রেলের কর্তাদের বলে, এবং শালকাঠ দিয়ে একখানা ক্ষুদ্র ইস্টিশান বানিয়ে দেন নামা ওঠার জন্য। সেইখান থেকে নেত্রপাণিতে আসতে হয় পাঁচমারীর দুর্গম বন পেরিয়ে। তাতে সময় লাগে প্রায় দুই প্রহর।

তা, ত্রিদিবেন্দ্র নিজের লােকলস্কর সমেত সেইভেনে হানা দিয়ে দেখলে আট দশটি নরকঙ্কাল পড়ে রয়েচে যজ্ঞবেদীর সুমুখে, আর হারিয়ে যাওয়া দশ এগারােটি গৃহবধূর মৃতদেহ গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে ঝুলচে।

এই ফাঁকে কয়ে রাখি, এই কাপালিক দুইজন কিন্তু বড়াে যেমন তেমন মানুষ ছিল না। যে ভৈরবীটি আগুনে আহুতি দিচ্ছে, তার নাম মাতঙ্গী। যে ভয়ালদর্শন পুরুষটি আগুনের চতুর্পার্শ্বে ঘুরচে, তার নাম ভৈরােনাথ, আর সাগরের জলে এক পা নিমজ্জিত করে অপর পা হাঁটুতে তুলে যে সাধকটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইদিকে ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে, সে হল কালকেতু। বহু বৎসর যাবৎ অতি ভয়ংকর পিশাচতন্ত্রে সাধনা করে পিশাচসিদ্ধ হয়ে একজন ভৈরবীকে সঙ্গে নিয়ে এরা এইবারে অতি ভয়ানক অগ্নিমন্থন যজ্ঞে বসেচে নির্জন পাঁচমারীর বনে। তন্ত্রে যতগুলি নিকৃষ্ট সাধনা রয়েছে, তার মধ্যে নিকৃষ্টতম হল এই অগ্নিমন্থন সাধনা। এর প্রভাবে শাকিনী, হকিনী, ব্রহ্মপিশাচ, ওলা, নােলা, পেঁচো আর যােগীনীদের নিজের বশবর্তী করে কাজে লাগানাে যায়। তখন সাধক কোনও বস্তুর নাম উচ্চারণ করা মাত্র সেই বস্তু তার করতলগত হয়, কারাে নামে মারণেচ্ছা প্রকাশ করা মাত্র তার বধ সাধিত হয়। আরও অনেক কিছু।

**********

এই তিনজন শয়তান কিন্ত এতগুলি মানুষকে দেখেও তিলমাত্র বিচলিত হল না। ত্রিদিবেন্দ্র ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে চাপা কণ্ঠে কইলাে, “শয়তান, নরকের কীট, আমার তালুকে প্রবেশ করে, আমারই প্রজাক্ষয় করে তোরা প্রাণ ধরে পালাতে পারবি নে। আমার এই লেঠেলরা তােদের এইমুহূর্তে প্রাণ বধ করবে।”

ভৈরােনাথ আর মাতঙ্গী এই কথা শােনামাত্র অট্টহাসিতে বাতাস মুখরিত করে তুললাে।

এইবার কালকেতু সর্পবিজড়িত হিমশীতল স্বরে মুখ খুললাে, “বটে! তা বেশ, বেশ।”

-“আমরা যা অন্যায় করেছি, তাতে আমাদের কঠিন শাস্তি হওয়াই তাে উচিৎ। কিন্তু আমাদের ধরবে কে? তাের এই কুকুর বেড়ালের দল? বেশ বেশ। আয়…”

জমিদারের ইঙ্গিতে প্রায় বিশ জন লাঠিয়াল ছুটলাে তাদের পাকড়াও করতে। কালকেতু নীচু হয়ে একতাল বালি তুলে নিয়ে বিড়বিড় করে কি সব মন্তর পড়ল, আর সঙ্গে সঙ্গে সেই বালির পিন্ড আগুনের গোলকে পরিণত হল। সেই গােলা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলা মাত্র তা রূপান্তরিত হল অসংখ্য বিষধর ডাঁশ পতঙ্গে। আকাশ কালাে করে সেই ডাঁশের পাল ঝাঁপিয়ে পড়ল উপস্থিত প্রজাদের উপরে।

বিষের জ্বালায় আর হুলের বেদনায় লােকজন দৌড়াদৌড়ি শুরু করল। তাদের আতঙ্ক মিশ্রিত চিৎকারে কাপালিকেরা আর মাতঙ্গী ভয়ানক হাসতে থাকলাে। এরপর ভৈরােনাথ একখানা গাছের ছােটো ডাল ভেঙে আবার কি মন্ত্র পড়ে ছুঁড়ে দিলাে আকাশে, আর সেই নরম ডাল বিকটদর্শন সর্পের আকার নিয়ে চক্র বিস্তার করে একে ওকে দংশন করতে থাকলাে। একেকবার কামড়ে একেকজন ব্যক্তি নীলবর্ণ হয়ে পুড়ে যেতে শুরু করল। সেই প্রাণঘাতী তীব্র গরলের অভিঘাতে আক্রান্তদের শরীর দগ্ধ হয়ে পচে যেতে থাকলাে। প্রায় জনা দশেক গ্রামবাসীর জীবন হরণ করে সেই কালসর্প বাতাসে মিলিয়ে গেল।

ততক্ষণে প্রজারা প্রায় সকলেই হয় প্রাণভয়ে পালিয়েছে, নয়তাে বীভৎস ভাবে মারা গিয়েছে। ত্রিদিবেন্দ্র ডাঁশের কামড়ে জর্জরিত শরীর নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে বাকী জনা দশেক পাইককে আদেশ করলেন ঐ তিনজনকে বর্শা বিদ্ধ করতে। পাইকেরা ক্লিষ্ট শরীরে হাতে ভল্ল তুলে যেই ছুঁড়তে যাবে, তৎক্ষণাৎ কালকেতু নিজের ডান হাতটি নিজের মাথার মধ্যস্থলে স্থাপন করে একটা অপার্থিব দূর্বোধ্য শব্দ করে উঠলাে, আর পাইকরা সভয়ে লক্ষ্য করল, পিছনের জঙ্গল থেকে ঝােপঝাড় ভেঙে ছুটে আসচে অগুনতি কালাে রঙা বেড়াল। একটি দুইটি নয়, একশত দুইশত নয়, সহস্র সহস্র। তাদের আকার সাধারণ বেড়ালের তুলনায় তিনগুণ বড়াে। হিংস্র শ্বদন্ত বেরিয়ে রয়েছে মুখ ভেদ করে, আর তাদের চক্ষুতে জ্বলচে ধিকিধিকি আগুন।

মুহূর্তের মধ্যে পাইকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল, আর সেই হিংস্র রাক্ষসের পাল ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের উপর। ত্রিদিবেন্দ্র ছুটতে শুরু করল। সবকয়টি পাইকের কণ্ঠনালী ছিঁড়ে ফেলে তারা একযােগে তাড়া করল জমিদারকে। ছুটতে ছুটতেই একেকটি বেড়াল ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকলাে তার পিঠে, আর সেগুলিকে ছুটন্ত অবস্থাতেই কোনওমতে ঝেড়ে ফেলে, আবার ছুটতে থাকলাে সে। অবশেষে মন্ত্রের প্রভাব শেষ হবার কারণেই হােক, আর ত্রিদিবেন্দ্রর পরমায়ু থাকার জন্যেই হােক, সেই বেড়ালরূপী রাক্ষসগুলি একসময়ে বাতাসে মিশে গেল। জমিদার নিজের দেউড়ির সুমুখে পৌঁছে আছাড় খেয়ে পড়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ল। বাতাসের পরতে পরতে ধ্বনিত হতে থাকলাে তিন শয়তানের হাড়কাঁপানাে হাসির অনুরণন।

তিনটি দিন ধুম জ্বরের প্রকোপে ত্রিদিবেন্দ্র আচ্ছন্ন হয়ে রইলাে। তিনদিন পর শরীরে সামান্য বল পেয়ে উঠে বসে কইলাে,

– “আমি বেঁচে থাকতে ঐ তিন শয়তান কখনও নিজের অভিষ্টে সিদ্ধি পাবে না। বলে না হােক, ছলে আমি ত্রিদিবেন্দ্র রায়চৌধুরী ওদের বধ করবাে। তােরা বুলা বৈদ্যকে খবর পাঠা। বল, জমিদারমশায় ডেকেচে, আর এই চিরকুটখানা তার হাতে দিবি।”

এই বলে একখানি ক্ষুদ্র চিঠিকে পিত্তলের চোঙে ভরে, ঢাকনিতে লাক্ষারস দিয়ে মােহর ছাপ দিয়ে, সেরেস্তাদারের হাতে পাঠিয়ে দিলাে।

বৈকালে বুলা বৈদ্য এসে হুজুরে দর্শন দিলাে। হাতে একখানি ছােট্ট পুটুলি। তাকে নিয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে জমিদার এসে লুকিয়ে রইলাে কাপালিকদের ডেরার কাছে জঙ্গলে। শয়তানগুলি অগ্নিমন্থন যজ্ঞে বসেছে, আর মাতঙ্গী কাঠকুটো জ্বেলে বুনাে খরগােশের মাংস রন্ধন করচে। অগ্নিমন্থন যজ্ঞ অতি গােপনীয় এবং গৃঢ় এক প্রক্রিয়া। এর সাধনা যারা করে, তারা বক্ষপিঞ্জরের মতাে সযত্নে এর গােপনীয়তা রক্ষা করে। আচ্ছা আচ্ছা বড়াে নামজাদা সাধকেরাও অনেকে এই প্রক্রিয়ার নামটুকুও শােনেনি।

যজ্ঞ সমাপ্ত হলে পর তিনজনে মিলে যজ্ঞভস্ম নিয়ে সাগরের জলে ভাসাতে গেল, আর সেই সামান্য অবসরে বুলা বৈদ্য ক্ষিপ্রবেগে একবার পুটুলিটি নিয়ে সেইখান থেকে ঘুরে এসে আবার লুকিয়ে পড়ল জমিদারের পাশে।

কাপালিকেরা ফিরে এসে তিনজনে মিলে একটি বধূর মৃতদেহ নামিয়ে এনে সেটি কাটতে বসল। সেই মড়ার তাজা রক্তমাখা খুলিতে সুরা ঢেলে আকণ্ঠ পান করলে তারা, আর তারপরে নেশায় বুদ হয়ে হােগলাপাতার শয্যা প্রস্তুত করে তার উপরে আহার করতে বসল। কালকেতু কইলাে,

– “আজ রাত্তিরে আমরা ঘুমাবাে, আর মাতঙ্গী পাহারা দিবি, বুঝলি?” মাতঙ্গী ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাে।

“তা আর বলতে প্রভু? আমি হাজারখানা নজর মেলে লক্ষ্য রাখবাে খন।”

আহার অর্ধেক সম্পন্ন হতে না হতে নেশার ঘােরে কাপালিক দুইজন শয্যায় ঢলে পড়ল, আর সামান্য সময়ের ব্যাবধানে মাতঙ্গীও শয্যা নিলাে।

জমিদার আর বুলা সন্তর্পণে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাে তাদের পাশে। জমিদার চাপা কণ্ঠে শুধােলাে

-“কি মনে হয় রে বুলা? উঠতে পারে?”

বুলা বৈদ্য আত্মপ্রত্যয়ের সুরে বললে –

-“অসম্ভব হুজুর। আমরা আটপুরুষে বৈদ্য। আমার তৈয়ারী করা এই বিষ যার পেটে একবার গিয়েছে, তার শরীরের ভিতরের সব প্রত্যঙ্গ এতক্ষণে গলে পচে গিয়েছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”

প্রভাতে বহু প্রজা প্রচণ্ড ক্ষোভে লাঠিসোঁটা নিয়ে হাজির হয়ে দেখলাে বুলার কথা সত্য। তিন নরপিশাচ মরে কাঠ হয়ে রয়েছে। তাদের মুখে মাছি বসচে, আর দেহে পিপড়া ধরা শুরু হয়েছে। ক্ষিপ্ত জনগণ মৃতদেহগুলির উপরে লাঠির আঘাত করে তাদের টানতে টানতে নিয়ে গেল জমিদারবাড়ির প্রাঙ্গণে।

ত্রিদিবেন্দ্র তাদের বললে-

-“শােননা বাছারা, নরকের কীট শয়তানগুলাে আমার অসংখ্য প্রজা নষ্ট করেছে। আরও কোনও ভয়ানক অভিসন্ধি হয়তাে ছিল এদের। আমি হিন্দু জমিদার অন্নপালক হয়ে এদেরকে বিষপানে হত্যা করেছি। এই গ্লানি নিয়ে আমি বাঁচতে পারবাে না। তাই নিজের সান্ত্বনার হেতুও বটে, আবার প্রথা রক্ষার জন্যেও বটে, আমি এদের মরার পরেও অন্য আরেকখানি প্রথামাফিক দন্ডের ব্যাবস্থা করতে চাই। আমার ইচ্ছা এই যে, এদেরকে সুদামার হাতে তুলে দেওয়া হােক। সেই এদের পুনর্বার দন্ড দেবে। সুদামাকে ডাকা হােক।”

সুদামা এসে মৃতদেহগুলির পিছনে দাঁড়ালাে।

বুলা যতােই কুলীন চিকিৎসক হােক, এই কাপালিকেরাও বড়াে সাধারণ ছিল না। তাদের রক্তের রঙ ঘাের কৃষ্ণবর্ণ, তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে দৌড়াচ্চে কালাে তন্ত্রের মহাশক্তি আর তাদের উদরে রয়েছে ব্যাঘ্রের ন্যায় পরিপাক শক্তি। তীব্র বিষের অতর্কিত আক্রমণে তাদের দেহে জীবনচেতনার সব লক্ষণ লােপ পেয়েছিলাে, কিন্তু যত সময় কাটচে ততই তাদের আচ্ছন্ন চেতনা ফিরে আসতে থাকলাে, আর একসময়ে কালকেতু চোখ মেলে চাইলাে।

কালকেতু ক্রুর দৃষ্টিতে ত্রিদিবেন্দ্রকে দেখে নিয়ে নিজের দুই সঙ্গীর দিকে। চেয়ে দেখলাে। একটা বাতাসের হালকা ঢেউ খেলে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে বাকী দুজনেরও জ্ঞান ফিরে এল।

সেই ভয়ানক কুচক্রী কাপালিক শায়িত অবস্থাতেই নিজের হাতে একখাবলা মাটি তুলে নিলাে, এবং তাই দেখে বিদুৎবেগে ত্রিদিবেন্দ্র রায়চৌধুরী হাঁক দিলেন, – “সুদামাআআআ”

হঠাৎ যেন দিকদিগন্ত কেঁপে উঠলাে একটা গর্জনে।

কাপালিকেরা চমকে উঠে পিছনে তাকাতেই ভয়ে তাদের রক্ত জল হয়ে এল। শয়তান তিনজনের থেকে মাত্র এক গজ দুরে এক পা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক ভয়ালদর্শন হস্তী। জমিদারের হাতীশালের খাস হাতী সুদামা। মেঘের মতাে কুচকুচে রঙ, বজের মতাে কঠিন গজদন্ত, প্রকাণ্ড শালবৃক্ষের ন্যায় একেকটি পা।

ভালাে করে কিছু বুঝে ওঠার পূৰ্বেই সুদামা নিজের শতমণী রাক্ষুসে পা চাপিয়ে দিলাে কালকেতুর বুকে। মুহূর্তের মধ্যে কাপালিকের দেহ থ্যাঁতলানাে মাংসপিন্ডে পরিণত হল। ভৈরােনাথ আর মাতঙ্গী পালানাের জন্য খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌড়ে বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল।

আমরা দূরত্ব বা দৈর্ঘ্য মাপার সময়ে অনেকগুলি একক ব্যবহার করে থাকি। তার মধ্যে একটি হল ‘গজ।

একটি হাতী একটি পা ফেলতে যতখানি দূরত্ব অতিক্রম করে, আসল হিসেবে সেইটেই হল এক গজ।

তাই, সুদামা মাত্র বিশ বাইশ পা ফেলেই দুই পলাতককে ধরে ফেললাে এবং নিজের পাহাড়প্রমাণ পায়ের আঘাতে দুইজনকে মর্দিত করে ছিন্নভিন্ন করে দিলাে।

গাঁয়ের লােকেরা এই পাপাত্মাদের পাপী শরীরকে দাহ করতে সম্মত হল না। ক্রোধান্বিত প্রজারা দল বেঁধে তিনটি মৃতদেহ তুলে নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলাে জঙ্গলের পরিত্যক্ত একখানা গভীর দারার মধ্যে, আর ক’দিনের মধ্যে ত্রিদিবেন্দ্র সূদন নামের একজন মস্তোবড়াে গুণীনকে ডেকে নিয়ে এল। সেই গুণীন যতই ক্ষমতাসম্পন্ন হােক, কিন্তু যজ্ঞের ধ্বংসাবশেষ দেখে সে কিছুতেই ধরতে পারলে না যে এই কাপালিকেরা আসলে ভয়ংকর অগ্নিমন্থনের সাধনা করছিলাে। আগেই কয়েচি যে এই অতি গুহ্য অগ্নিমন্থন বিদ্যে ধরার ক্ষমতা এক সহস্র তান্ত্রিকের মধ্যে একজনের রয় কিনা সন্দেহ। সূদন গুণীন সেই ইদারার চারদিক মন্ত্র পড়ে বন্ধন করে দেবার পরে জমিদার সেই জায়গাটি পরিত্যক্ত বলে চেঁড়া দিয়ে দিলাে।

***********

সৃষ্টিকর্তা যখন চরাচরের সৃজন শুরু করেন, তখন নিজের সৃষ্টিকে একসময়ে ধ্বংস করারও প্রয়ােজনীয়তা তিনি বুঝেছিলেন। তাই জীব, জড় নির্বিশেষে সকল পদার্থের নাশের হেতু তিনি এক ধরনের অদৃশ্য কণা-স্রোতের সৃষ্টি করেন। সেই স্রোত প্রতিনিয়ত প্রতিটি বস্তুকণাকে বিদ্ধ করে, ফুঁড়ে, বয়ে চলে, এবং ততই সেসব বস্তু নিজের অন্তিম পরিণতির দিকে এগিয়ে চলে। এই অদেখা কণা-স্রোতকেই আমরা ‘সময়’ বলি।

সেই স্রোতের নিয়মেই পৃথিবীর দৃশ্যপট বদলে চলে।

মাঝখানে দুদশটি নয়, পুরাে একটি শতাব্দী কেটে গিয়েচে। গাঁয়ের তেমন পরিবর্তন হয়নি, পাঁচমারীর বনও বদলায়নি, সাগর এখনও নেত্রপাণির চরণে আছড়ে পড়ে, কেবল বদলেচে প্রজারা। এখন তালুকের জমিদার মহেন্দ্র রায়চৌধুরী। বাপদাদার মতাে ইনিও অতি প্রজাবৎসল এবং সুশাসক। গাঁয়ের লােকেরা বেশ শান্তিতেই বাস করচে তার রাজত্বে। মহেন্দ্রর একটি পুত্র। নাম দেবেন্দ্র, বয়স পঁচিশ। আর একটি কন্যা মন্দাকিনী। পুত্রটির এখনও বিবাহ হয়নি। মন্দাকিনীর বিবাহ হয়ে গিয়েচে কিছু বৎসর হল। কন্যাটি মাসখানেকের জন্য পিতৃগৃহে এসেছে। সামনের মাসে জামাইষষ্ঠীতে জামাতা ছােকরা এসে একসাথেই নিয়ে যাবে।

তা, একদিন বিকেলে আচমকাই বােশেখের ঝড় উঠেছিল। সেই সঙ্গে অকাল বর্ষণ। তিনটি দিন কেটে গেল, তবু মুষলধারে বৃষ্টি থামার লক্ষণ দেখা গেল না। সাগরের জল ফুলে ফেঁপে উঠে ক্ষুদ্র দ্বীপগুলি ডুবিয়ে দিলাে। তালুকের লােকেরা উদয়াস্ত খেটে নেত্রপাণির দক্ষিণে বাঁধ নির্মাণ করল, কিন্তু পশ্চিমের তট থেকে জলের তােড় ঢুকে অনেকখানি আবাদী জমি, ঘরবাড়ি, জলা জংলা ভাসিয়ে দিলাে।

চতুর্থ দিন বৃষ্টির প্রকোপ ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এল। জলও নেমে গেল। প্রজারা যখন মােটামুটি স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনযাপন শুরু করে দিয়েছে, ঠিক সেই সময়টাতেই গাঁয়ে হানা দিলাে এক ভয়াবহ উপদ্রব এবং সেই আক্রমণ যতই প্রকটভাবে দেখা দিতে থাকলাে, ততই প্রজাদের জীবনযাত্রা ছারখার হবার উপক্রম হয়ে উঠলাে।

সচ্চিদানন্দ ঘােষ হল গাঁয়ের গােহালা। পড়শীরা তাকে চিত্ত বলে ডাকতাে। তা, এই চিত্ত সেদিন রাত্তিরে ঘরের দাওয়ায় বসে গােরুর জাবনা কুটচিলাে। তার দুই ছেলে বসেচিলাে আর দুই বৌ খাওয়া শেষে একসাথে বাসনপত্তর ধুচ্চিলাে। হঠাৎ তারা শুনতে পায় দক্ষিণের বনের থেকে একটা কিসের যেন হাড় জল করা তীক্ষ্ণ চীৎকার ভেসে এল। সে শব্দ ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। যেন শত শত অশুভ প্রেত একসাথে একযােগে হাহাকার করে কারুকে ডাকছে।

দুই বৌ ঘাটের থেকে উঠে এসে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছে, এমন সময়ে চিত্ত হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে জঙ্গলের পানে হাঁটা শুরু করল। তার বড়াে বৌ ক্ষিপ্রবেগে এসে তার হাত ধরে টান দিয়ে কইলাে, “হা ভগবান, তােমার কি বুদ্ধিশুদ্ধি হারালাে নাকি গা!”

-“বনের ভিতরপানে না জানি কোন ভয় এসে বাসা বেঁধেচে, অমন অলুক্ষুণে ডাক ডাকচে, আর তুমি বাইরে চললে বুঝি?”

চিত্ত এক ঝটকায় বৌয়ের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে ঢুকে পড়ল বনের ভিতরে। বাড়ির লােকজন হায় হায় করে চিৎকার করে উঠলাে।

চিত্তর মাথায় সত্য সত্যই গােল লেগে গিয়েচে। সুরেলা নারীকণ্ঠে কে যেন তাকে ডাকচে,

“আয়য়য়, এদিকে আয়।

আমার পিছনে পিছনে আয়য়য়

আয়য়য়…”

নেশাগ্রস্তের ন্যায় আচ্ছন্নভাবে চিত্ত অনেক দূর চলে আসার পর দেখলাে সে সাগরের পাড়ে বালিমাটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এইবারে চিত্তর সেই নেশার ঘাের কেটে গেল, আর মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুমান করে তার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠলাে। এ কোথায় এসে পড়েছে সে? কেমন করে এসেচে!

প্রচণ্ড আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে ফেরার জন্য পিছনে ঘােরা মাত্রই ভয়ে চিত্তর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এল। জঙ্গলের ভিতরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিনখানা ভয়ংকর কালাে মূর্তি এবং তা যে মানুষের নয়, সেকথা বলে দেবার অপেক্ষা রাখে না।

দুইপার্শ্বে দুইটি করালবদন হিংস্র পুরুষ, আর মধ্যভাগে এক নারীমূর্তি পিশাচিনী। তার ঝুলে পড়া অধর ঠেলে বেরিয়ে এসেচে তীক্ষ কুকুরদাঁত। তিনজনের ছয়খানা চক্ষু আগুনের ন্যায় ধকধক করে জ্বলচে। মাতঙ্গী এক পলকে ঝাঁপিয়ে পড়ল হতভম্ব হয়ে থাকা চিত্তর ঘাড়ের উপর। খট করে একটা মৃদু শব্দ করে ঘাড়টা মটকে গেল। কালকেতু আর ভৈরােনাথ হতভাগ্য চিত্তের শরীরটা নিয়ে পরস্পরের বিপরীত দিকে পাক দিতে থাকলাে। যন্ত্রকলে মর্দিত ইক্ষুর ন্যায় শরীরটা দুমড়ে মুচড়ে থেঁতলে গেল।

**********

ভােরের আলাে ফুটতে না ফুটতেই গােটা ধীবরের দল আবিষ্কার করল চিত্তর মৃতদেহটা আর গােটা গাঁয়ের ছেলেবুড়াে দৌড়ে এসে আঁতকে উঠলাে তাকে দেখে। মৃতদেহটিতে একবিন্দু রক্ত অবশিষ্ট নাই। হাড়গােড় বিচূর্ণ হয়ে থেঁতলানাে, মােচড়ানাে দেহটা কাদার পিন্ডে পরিণত হয়েছে যেন। মেয়েমানুষদের তড়িঘড়ি যে যার গৃহে পাঠিয়ে দেওয়া হল। মহেন্দ্র রায়চৌধুরী মৃতদেহের হাল দেখে হতভম্ব হয়ে গেল কইলাে, “এ কী!”

বাড়ি থেকে এতখানি দূরে এইখেনে বনবাদাড়ে এসে চিত্ত এমন ভয়ানকভাবে মরলাে কিসে? শরীরের এমন অবস্থা হল কেমন করে? কোন জন্তুতে মেরেচে এঁকে?”

গাঁয়ের প্রবীণ প্রজাদের মধ্যে বিষ্ণু বারুই কথা কইলাে,

– “আমাদের কোথাও ভূল হচ্চে কত্তা। এইরকম পৈশাচিকভাবে হত্যা করার মতাে জানােয়ার সোঁদরবনের মাটিতে কেউ নাই। না বাঘ, না কুমীর, ময়াল, কেউই এমন বীভৎস ভাবে বধ করে না। দেখে মনে হচ্চে খাওয়ার মতলবে মারা হয়নি, যেন মারার আনন্দেই হত্যা করা হয়েছে। দেখেচেন কৰ্ত্তা, লাশটার শরীরে…

বলেই বিষ্টু অপ্রতিভ হয়ে বললাে, “মানে, চিত্তর পরণের বসনখানা অবধি কোথাও ছিন্ন হয়নি অবধি। এ জঙ্গলখানা সোঁদরবন না হয়ে পশ্চিমের দিকে হলে বলতুম, চিত্তকে হাতীতে মেরেছে।”

অনেক জল্পনা, অনেক আলােচনা হল, কিন্তু সমাধানে আসা গেল না। খুনীও ধৃত হল না। গাঁয়ের লােকেরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুলাে যে হয়তাে সাগরের থেকে কোনও হিংস্র জানােয়ার উঠে এসে মানুষ মেরেচে আর তারপর জলেই ফিরে গিয়েছে।

গ্রামের লােকজন এই স্থির বিশ্বাস নিয়ে কতক আশ্বাস পেলাে বটে, কিন্তু বিশ্বাস করল না মহেন্দ্র, আর মানতে পারলাে না চিত্ত গােয়ালার পরিবার। তাদের কানে এখনও সেই ভয়ঙ্কর নিশির ডাকের প্রতিধ্বনি লেগে রয়েছে…

আয়… আয়…

এদিকে আয়…।

চিত্তকে তীব্র আক্রোশে ছিন্নভিন্ন করে মেরে বহু দিনের বহু বৎসরের সেই প্রতিশােধস্পৃহা নূতন করে জেগে উঠলাে তিন শয়তানের মধ্যে। এই গাঁয়েই তাদেরকে কুকুরের ন্যায় পদদলিত করে হত্যা করা হয়েছে। পাঁচমারীর নির্জন বনের পরিত্যক্ত ইদারায় তাদের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। বদলা চাই। রক্ত দিয়ে এই অপমানের মূল্য শােধ করতে হবে নেত্রপাণিকে। অতি প্রচণ্ড বিদ্যা, অতি গােপন প্রক্রিয়া অগ্নিমন্থনের শক্তি তাদের শিরায় শিরায়। ঠিক সাতদিনের মাথায় ঘটলাে পরের নৃশংস হত্যাকাণ্ডটা। এইবারে আর রাত্তিরের আঁধারে নয়। দিনে দুপুরে, সক্কলের নজরের সুমুখে।

নেত্রপাণির উত্তুর-পূবে সাগরের বুকে প্রতি বৎসর জষ্টি মাসের শুরুতে প্রকৃতির কোনও অজ্ঞাত নিয়মে একখানা বিশাল বালির চর মাথা তােলে। লােকজন বলে ‘ভুঁইচর’। এই ঘটনাকে কোনও দেবতার নির্দেশ মনে করে নেত্রপাণির মানুষেরা ওই কয়েকটি দিন সেই চরে পূজা আর্চা, মেলার আয়ােজন করে থাকে। এ বৎসরও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। সেদিন দুপুরে গাঁয়ের পাঠশালের পণ্ডিত নীলমণি ঘােষাল মেলার মঞ্চে ভাগবৎ কথকতা করছিলাে। মানুষজন তার সুমিষ্ট কণ্ঠে বিভাের হয়ে কথকতা শুনচে, এমন সময়ে তারা লক্ষ্য করল দক্ষিণের আকাশ কালাে করে আসছে। ইতি-উতি তাকাতে তাকাতে তারা সভয়ে আবিষ্কার করল যে ওইটে মেঘ নয়, হাজার হাজার ডাঁশ পােকার পাল।

মুহূর্তের মধ্যে সেই মাংসভূক পােকার দল আছড়ে পড়ল উপস্থিত লােকজনের উপরে। জনতা বিয়ের জ্বালায় আর আতঙ্কে ছত্রভঙ্গ হয়ে এলােপাতাড়ি পালাতে শুরু করল আর দেখলাে মেলার ধারে ধারে প্রতিটি গাছের শাখায় ঝুলচে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বিষধর সর্পের পাল। পলায়নের মধ্যেই তাদের কানে এল একটা রক্ত জল করা অট্টহাসির শব্দ। তারা অনেকখানি দূরে পালিয়ে গিয়ে পিছন ঘুরে যা দেখলাে, তাতে তাদের শরীর হিম হয়ে গেল।

নীলমণি মাস্টারের দেহটা মঞ্চের উপর শূন্যে ঝুলে রয়েছে। ঠিক শূন্যে নয়। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিনটি আবছায়া কৃষ্ণবর্ণ মূর্তি ধোঁয়ার মতাে ভয়াল আকৃতিবিশিষ্ট একটি মেয়েমানুষ নীলমণির পাশে স্থির রয়েছে, আর বাকী দুইটি কালান্তক পৈশাচিক পুরুষমূর্তি নীলমণির পা আর মাথাটি ধরে উল্টোপানে ঘুরাচ্চে। মরণ যন্ত্রণায় নীলমণি পরিত্রাহি আর্তনাদ করছে, আর তিনটি পিশাচ নিষ্ঠুর আনন্দে হেসে চলেচে।

কিছু সময় পরে নীলমণির দেহ ফেলে দিয়ে তিন পিশাচমূর্তি অদৃশ্য হল, আর সঙ্গে সঙ্গেই ডাঁশ আর সাপের দলও বাতাসে মিলিয়ে গেল। পড়িমরি করে দৌড়ে সকলে পৌঁছুলাে মঞ্চের কাছে আর দেখলাে পণ্ডিতের থেঁতলে যাওয়া পিন্ডাকার দেহখানা রক্তশূন্য নীলচে বর্ণ ধারণ করে আবর্জনার মতাে গুটি পাকিয়ে পড়ে রয়েছে।

**********

এর পরে এই হত্যালীলা আর দুর্ঘটনা হয়ে থাকলাে না, বরং অভ্যাসে পরিণত হল। দুই চারদিন বাদে বাদেই একজন করে মানুষ মরতে লাগল এই তিন কালান্তক পিশাচের হাতে। মধ্যে মধ্যেই আকাশ ভেঙে নেমে আসতাে ডাঁশপােকার দল। ছােট ছােট শিশুদের কামড়ে ছিড়ে খেয়ে যেত কালাে হিংস্র বেড়ালের পাল। গাঁয়ের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ঝড়ে উড়ে যাওয়া খড়কুটার ন্যায় বিধ্বস্ত, এলােমেলাে হয়ে পড়ল। কেবলমাত্র নরহত্যাই নয়, মরতে থাকলাে গৃহপালিত জন্তুরাও। বহু ঘরের প্রজা নিজের নিজের বাস্তুর মায়া পরিত্যাগ করে পালিয়ে গেল। যারা রইলাে, তারা নিষ্ঠুর, নির্মম ভবিতব্যের হাতে নিজেকে সমর্পণ করে দিয়ে প্রহর গুণতে থাকলাে এক ভয়াবহ মৃত্যর।

কালকেতু, ভৈরােনাথ আর মাতঙ্গীর নরক ক্ষুধা কিন্তু এত নররক্তেও নির্বাপিত হল না। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল নিজেদের হত্যাকারী ত্রিদিবেন্দ্র রায়চৌধুরীর বংশের লােকেদের বধ করা। তবেই তাদের শত বৎসরের প্রতিহিংসার অনলে বারিসিঞ্চন হবে, কিন্তু তার কিছু বাধাও রয়েছিলাে।

দু চারজন প্রজার মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেই মহেন্দ্র গাঁয়ে আনিয়েচিলাে দুইজন নামজাদা তান্ত্রিক ভক্তানন্দ আর মুক্তকেশী আচার্যকে। আশপাশের দশ গাঁয়ে এদের প্রচুর নামডাক। তা, তারা একদিন গাঁয়ে থেকে চতুর্দিকে আতিপাতি করে খুঁজেও কোনও হদিস পেলাে না। তারা পরদিবসে মহেন্দ্রকে ডেকে কথা কইলাে, “বাছা, আমরা দুইজনে সম্ভাব্য সকল স্থানেই সন্ধান করেছি, কিন্তু কোনও সূত্রই পেলাম না। এই পিশাচেরা কোন শক্তিতে যে বলসঞ্চার করছে, তাও বােঝা যাচ্চে না। আমাদের সাধ্য নাই এই বিপদের মােকাবেলা করার। আমাদের বিদেয় দিন।”

এই কথাবার্তা হবার সময়ে তিনটি ছায়ামূর্তি বাতাসে গা মিশিয়ে দাঁড়িয়েছিলাে তান্ত্রিকদের ঠিক পিছনে। উদ্যেশ্য ছিল এই জোড়া তান্ত্রিকের হত্যা, কিন্তু যখন তারা দেখলে যে এই ব্যক্তিদ্বয় অগ্নিমন্থনের নামটুকুও কস্মিনকালে শােনেনি তখন এদের বিদ্যেবুদ্ধির দৌড় সম্বন্ধে তাদের ধারণা হয়ে গেল, আর মনে মনে হাসতে হাসতে বাতাসে ভেসে চলে গেল।

এই তান্ত্রিকেরা পিশাচগুলাের তন্ত্রাচার ধরতে পারেনি বটে, কিন্তু তারা নেহাৎ নিম্নমানের সাধকও ছিল না। যাবার পূর্বে তারা গুটিকয়েক রক্ষাকবচ তৈয়ারী করে মহেন্দ্রকে দিয়ে গেল আর বললাে, “শােনাে বাছা, নানান কথা থেকে যা বুঝেছি, তাতে তােমার পরিবারের প্রতিই শয়তানগুলাের আক্রোশ সর্বাধিক। এই রক্ষাকবচ শয়ে শয়ে তৈয়ারী করা অসম্ভব, তাই এই কয়টি তুমি আর তােমার পরিজনেরাই ধারণ করাে। সকল অশুভ শক্তির নাশ করেন যিনি, সেই ঈশ্বর তােমাদের মঙ্গল করুন।”

তান্ত্রিকেরা চলে গেল। তাদের দেওয়া কবচের জন্যেই মহেন্দ্রর পরিবারকে ঠিকঠাক আক্রমণ করতে পারছিলাে না তিনটি ক্রোধে অন্ধ হয়ে ফুসতে থাকা প্রেতাত্মা। তারা সুযােগ খুঁজচিলাে এমন কারুকে নির্দয়ভাবে হত্যা করার জন্য, যে মরলে সবচাইতে বেশি আঘাত দেওয়া যাবে মহেন্দ্রকে। একদিন সেই সুযােগও জুটে গেল বড়াে অপ্রত্যাশিত ভাবে।

সেই কথাই আজ তােমাদের বলতে চলেছি।

সামনেই জামাইষষ্ঠী।

দূরদূরান্ত থেকে গাঁয়ে জামাইরা আসবে শ্বশুরগৃহে। প্রতিবৎসর যে উৎসবটি নিয়ে ছেলেবুড়ােরা যারপরনাই আনন্দে উৎসুক হয়ে থাকে, এই কাল বৎসরে সেই উৎসবই তাদের ত্রাস হয়ে দেখা দিলাে। যে যেমনভাবে পারলাে, কন্যার স্বামীগৃহে সংবাদ পাঠিয়ে দিলাে, যাতে এই বছরে জামাইরা কোনওভাবেই মেয়েকে নিয়ে না এসে পড়ে। মহেন্দ্রও নিজের কন্যার শ্বশুরবাড়ির ঠিকানায় জরুরী পত্র লিখে সেটি ডাকে দেবার জন্য নিজের গােমস্তা রাইচরণকে খবর পাঠালাে।

রাইচরণ সন্ধ্যার মুখে জরুরী তলব পেয়ে বাড়ির থেকে বেরিয়ে পথ ধরলাে জমিদারগৃহের। অশ্বথ তলা পেরিয়ে বাম দিকে যেই সে বাঁক নিয়েছে, তখনই তার মনে হল এই দুর্দিনে একলা বেরিয়ে কাজটা ঠিক হয়নি। বাঁ দিকের ঝােপের কাছটায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য আলাে মিটমিট করে যেন জ্বলছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর রাইচরণ সভয়ে উপলব্ধি করল সেগুলি আসলে অগণিত বুভুক্ষু বেড়ালের ওৎ পেতে থাকা চক্ষু। পিছন ফিরে রাইচরণ উৰ্দ্ধশ্বাসে দৌড়াতে শুরু করতেই তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল কালকেতুর মন্ত্রবলে তৈরি পাতালের অন্ধকার থেকে উৎপন্ন বেড়ালের দল। রাইচরণের চিৎকার গুমরে গুমরে মিলিয়ে গেল।

কালকেতুর হুকুমে সেই রক্তলােলুপ জীবের দল রাইচরণের দেহের একটা হাড়ও অবশিষ্ট রাখলাে না। ক্ষুদ্র তালুকের প্রভুভক্ত গােমস্তা পৃথিবীর থেকে সম্পূর্ণ রূপে বিলুপ্ত হয়ে গেল।

ভৈরােনাথ জমিদারবাড়ির কাছাকাছি এসে মন্ত্রবলে রাইচরণের অবয়ব ধারণ করে মহেন্দ্রের সুমুখে এসে দাঁড়ালাে।

-“এসাে রাইচরণ।”

তােমাকে একখানা জরুরী কাজের জন্য ডাক পাঠিয়েছিলাম। এই পত্রখানা কাল সকালেই তােমাকে ডাকবাক্সে ফেলে দিয়ে আসতে হবে। বাবাজীবন যাতে কোনােক্রমেই এদিকে না এসে পড়ে তার ব্যবস্থা করতে হবে। পারবে তাে?”

ভৈরােনাথ অবিকল গােমস্তার কণ্ঠে উত্তর করল-

-“আজ্ঞা হুজুর।”

আমি কাল একখানা কাজে গ্রামান্তরে এমনিতেই যেতুম। ফিরতে ক’দিন সময় লাগবে। এই কয়দিনের ছুটি মঞ্জুর করে দেন কর্তা। আমি যাবার পথে চিঠিখানা বাক্সে দিয়ে যাবােখন।”

মহেন্দ্র বিষণ্ণভাবে কইলাে, – “পালাচ্চো রাইচরণ।”

– “সব বুঝি। তবে কয়দিন আর বাইরে বাইরে রইবে বলাে তাে? বাপ পিতেমাের ভিটের টান যে বড়াে বালাই। তা এড়িয়ে থাকতে পারবে কী? বেশ, যাও।”

ভৈরােনাথ বিদায় নিয়ে বাইরে এসে পত্রখানার দিকে তাকাতেই তাতে আগুন ধরে গেল। চিঠিখানা ভস্মীভূত করে ভয়ংকরভাবে হেসে উঠে অন্ধকারে মিশে গেল।

**********

কথায় বলে নিয়তিকে খন্ডানাে যায় না। যার ভাগ্যে যা লেখা থাকে, তা হবেই। ষষ্ঠীর আগেরদিন বেশ রাত্তিরে শেষ রেলের গাড়িতে চেপে যথারীতি মহেন্দ্রর জামাতা, ত্রিশ বৎসরের সেই যুবকটি এসে নামলাে জঙ্গলবাড়ি ইস্টিশানে। রেলের এক বাঙ্গালী কর্মচারী রাতের বেলায় রেলঘরেই ঘুমুতাে। সে যখন দেখলাে জোড়া ইলিশ হাতে একজন ছােকরা এসে নামলাে, তখন পরিচয় শুধালাে তার।

যুবা জামাইটির ইচ্ছে হল, ঘণ্টাচারেক পাঁচমারীর বনের পথ দিয়ে হেঁটে গিয়ে ভােরের দিকে শ্বশুরবাড়ির লােকেদের একটু চমকে দেবে, তাই রেলের কর্মচারীটির বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও ‘ও কিছু হবে না বলে সে ঝকঝকে ইলিশজোড়া ঝুলিয়ে, সুটকেসটি বগলদাবা করে ঢুকে পড়লাে ঐ মৃত্যুপুরীর মহাবনে।

স্ত্রীয়ের সঙ্গে আশু দর্শনের আনন্দে মন্দাকিনীর স্বামীটি গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে এগুচ্চে, এমন সময়ে একটা ব্যাপার খেয়াল করে তার গান বন্ধ হয়ে গেল। বনের পাখপাখালীগুলাে এই মাঝরাত্তিরে হঠাৎ করে কিচিরমিচির করে ভয় পেয়ে একযােগে ডেকে উঠলাে, যেমনটা তারা কোনও বড়াে জন্তু বেরুলে করে থাকে।

যুবকটি এইবারে সত্য সত্যই চিন্তায় পড়ে গেল। জঙ্গলে ডােরাকাটা বােরােয়নি তাে? পাখিগুলাে, বানরগুলাে এইভাবে ডাকচে কেন?

এইসব চিন্তা করতে করতে, চলতে চলতে, নেত্রপাণির সীমান্ত যখন আর সামান্যই বাকী, ঠিক সেই সময়ে যুবকটি আচমকা দেখলাে সামনে পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক কালাে কুচকুচে নারী অবয়ব। চক্ষু দুইটি তার রক্তবর্ণ বিদ্যুৎছটার মতাে দপদপ করে জ্বলচে। চুলের গােছা সর্পের চক্রের ন্যায় বাতাসে ফনাবিস্তার করে রয়েছে। মূর্তিটি আস্তে আস্তে এক পা এক পা করে নিকটবর্তী হতে থাকলাে আর যুবকটি সম্মােহিতের ন্যায় সেইদিকে চেয়েই রইলাে। হঠাৎ সেই ভয়ঙ্করী প্রেতিনী বনের নৈঃশব্দকে খানখান করে অমানুষিক খােনা স্বরে হেসে উঠলাে আর বিদ্যুৎবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল যুবকটির উপরে। একটা অস্ফুট মরণ চিৎকারে প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার সেই আদি বন ডুবে গেল নিজের স্বভাবসিদ্ধ নিস্তব্ধতায়।

**********

জামাতা আসুন না আসুন, তার মঙ্গলকামনার্থে মহেন্দ্রের গৃহে পূজার ব্যবস্থা করে রাখা রয়েছে। ভােরের আলাে ফুটতেই মন্দাকিনী, তার মা, আর জমিদারবাড়ির বাকী মেয়েমানুষেরা বসে গেল পূজার আয়ােজনে। বটগাছের শেকড়, বট অশ্বথর জোড়া পাতা, দই, মিষ্টান্ন, তালপাতার হাতপাখা, কিছুই বাদ পড়েনি। জামাইয়ের দীর্ঘজীবন লাভের আশীৰ্ব্বাদ করল জমিদারগৃহিণী। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললাে-“আশীৰ্ব্বাদ করি, তােরা সুখে থাক। জামাই দীর্ঘায়ু হন। তুইও চিরায়ুম্মতি হ। সিঁথির সিন্দুর যেন অক্ষয় হয়।”

আচমকা বাইরে একটা ভয়ার্ত কোলাহলের মতাে শােনা গেল। যেন একগাদা লােক একসাথে কিছু বলতে চাইছে। দোর খুলতেই গাঁয়ের প্রজা পদ্মলােচন এসে আছড়ে পড়ল দেউড়ির উপরে, মহেন্দ্রের পায়ের কাছে।

মহেন্দ্র রায়চৌধুরী শশব্যস্ত হয়ে কইলাে, “আরে রে, এ কী? কী হয়েছে কী পদ্ম ?”

পদ্মলােচন হাহাকার করে বুক চাপড়ে বললাে,

-“কর্তামশায়, আপনি আমার ছেলেডারে বাঁচান কর্তা। তারে সেই পিরেতে টেনে নিয়ে যাচ্চে হুজুর। হা ভগবান! দশটা জোয়ান মর্দ লােক তারে ধরে রাখতি পারতেছে না। তারে বাঁচান কৰ্ত্তামশায়।”

মহেন্দ্র আর তার পরিবারের বাকীরাও ছুটলাে পথ ধরে। সঙ্গে দশ বারােজন পাইক। চলতে চলতেই শােনা গেল, পদ্মলােচন আর তার চৌদ্দ বৎসরের ছেলে নিতাই সকাল হতেই বনের ধারে ধীবরদের পাড়ায় গিয়েছিলাে জ্বালানি কাঠকুটো কুড়ুতে। হঠাৎ একটা ঝড়ের মতাে ওঠে, ছেলেটি ভূতে পাওয়ার মতাে বিড়বিড় করতে থাকে আর সাগর পানে এগুতে থাকে। ভয় পেয়ে পদ্মলােচন চিৎকার করে তােকজন জড়াে করে ফেলে, কিন্তু দশ বারােজন দশাসই পুরুষ মিলেও নিতাইয়ের গতি রােধ করতে পারছে না। সে ঘােলাটে চক্ষে এগিয়ে চলেছে মরণের পানে।

সাগরের কাছাকাছি এসে মহেন্দ্রর চোখে পড়ল এক মহা বিস্ময়কর দৃশ্য। চৌদ্দ বৎসরের এক বালক এগিয়ে চলেছে সাগরের জলের দিকে এলােমেলােভাবে। তার গায়ে মাছ ধরার জাল অবধি ছোঁড়া হয়েছে আটকানাের জন্যে, কিন্তু মরণের হাতছানি শােনা পতঙ্গের মতােই সে এগিয়ে চলেচে অজানার দিকে।

হঠাৎ উপস্থিত লােকজন লক্ষ্য করল সাগরের ঠিক তটভূমির কাছে দুইখানি বিকটদর্শন পুরুষ মূর্তির আবছা চেহারা ভেসে উঠলাে। জাল, দড়ি ফেলে যে যার মতাে পালাতে শুরু করল, কেবল মহেন্দ্রের পরিবার, পদ্মলােচন, আর কিছু সাহসী লােকজন হায় হায় করতে লাগল নিজেদের অসহায়তায়।

নিতাইয়ের দেহটা কিছুটা শূন্যে উঠে পড়ল, আর বিশ্রীভাবে হেসে উঠে কালকেতু আর ভৈরােনাথ বালকটির মাথা আর পা ধরে মারলাে এক মােচড়। নিতাই মরণাহত পশুর মতাে আর্তনাদ করে উঠলাে। সে কষ্টকর আকুতি-মিনতি কানে শুনে সহ্য করা যায় না।

পদ্ম হাউহাউ করে কাঁদছে। পিশাচদুটি আরেকবার মুচড়ালাে শরীরটা, আর নিতাই পূণর্বার মৃত্যু যন্ত্রণায় গােঙাতে থাকলাে। তিনবারের বার মােচড় দিলেই নিতাইয়ের প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাবে। দুইজনে শেষবারের মতাে শরীরটা দুমড়ে-মুচড়ে দেবার উদ্যেশ্যে হাত ওঠালাে এবং ভয়ঙ্কর শব্দে ক্রুদ্ধ গর্জন করে উঠলাে।

অবাক হয়ে সবাই খেয়াল করল, এইবারে তাদের এই গর্জন কিন্তু আর প্রতিহিংসাপরায়ণতার উদগ্র গর্জন নয় বরং তাতে মিশে রয়েছে ক্রোধ আর একরাশ বিরক্তি। কোনও একটা অদৃশ্য শক্তিতে যেন তারা চূড়ান্ত আক্রমণে বাধা পাচ্ছে এবং সেই কারণেই ক্ষেপে উঠেছে।

তাদের ক্রোধ মেশানাে দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েচে বুড়াে অশ্বথতলার বেদীর দিকে। পিশাচদুটির দৃষ্টি অনুসরণ করে সেইদিকে তাকাতেই চোখে পড়ল বড়সড় একজোড়া ইলিশমাছ হাতে করে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসচে মহেন্দ্র রায়চৌধুরীর জামাই, রায়দীঘড়ার ডাকসাইটে জমিদার কালীপদ মুখুজ্জে।

**********

পিশাচদুটি নিতাইকে অজ্ঞান অবস্থায় ঝুপ করে ফেলে রেখে আগেই অদৃশ্য হয়েছিলাে। মহেন্দ্র শশব্যস্তে এগিয়ে গিয়ে বিস্ময় জড়িত ভাবে কইলাে,

-“এ কী, কালীপদ! তুমি এ সময়ে এইখেনে? হা ঈশ্বর। তুমি পত্র পাওনি?”

কালীপদ ইলিশজোড়া শ্মশ্রুঠাকরুণের হাতে দিয়ে মহেন্দ্রকে প্রণাম করে বললাে, “আমি তাে কোনও পত্র পাইনি চৌধুরীমশায়। আপনি কি রায়দীঘড়া বরাবর লিখেছিলেন?”

-“হাঁ বাপু। তােমার দাদার বরাবর চিঠি দিয়েছি। আমার গােমস্তা সেই চিঠি বাক্সতে ফেলেও এসেচে।”

মন্দাকিনী আনন্দের উচ্ছ্বাস গােপন করে স্বামীর দিকে হাঁ করে চেয়েছিলাে। হঠাৎ মায়ের একটা উগ্র রকমের ইশারা চোখে পড়ায়, জিহ্বা দংশন করে দুই হাত ঘােমটা টেনে দিলাে।

সকলে মিলে জমিদারবাড়ির দিকে এগিয়ে চললাে। এক স্থানে এসে কালী নীচু হয়ে একখানা গাছের ডাল তুলে কি যেন দেখলাে। এক খাবলা মাটি তুলে কয়েকবার দীর্ঘ আঘ্রাণ নিলাে। তারপর চিন্তিত মুখে অস্ফুট কণ্ঠে বললে,

-“বড়াে ভয়ানক বিপদ।”

পিছনের দিকে চলতে চলতে কালীপদ, মহেন্দ্র আর গাঁয়ের পুরােহিত চন্দ্ৰধর গাঙ্গুলি নীচু গলায় কথা কইচিলাে। কালীপদ বললাে,“গাঙ্গুলি মশায়, এ কী উপদ্রবের মধ্যে বাস করছেন আপনারা! কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন?”

চন্দ্রধর কাতর কণ্ঠে বললাে,

-“তােমার শ্বশুরমশায় চেষ্টায় ত্রুটি রাখেনি বাছা। দুইজন নামকরা তান্ত্রিককে আনিয়েছিলাে সে। কিন্তু তারা ধরতেই পারলে না যে এই শয়তানগুলাে আদৌ শক্তিটা পাচ্চে কোন সাধনার থেকে।”

কালীপদ একখানা গাছের পাতা কুড়িয়ে শুকতে শুকতে বললাে, “তা ঠিক। আমাদের মতাে সাধারণ গড়পড়তা মানুষের পক্ষে সেই প্রক্রিয়া বােঝা কঠিন বটে। আমিও ছাই ঠিকঠাক ধরতে পারচি নে। তবে ঐ ছায়ামূর্তিদুটো যেমন তেমন প্রেত নয়। তাদের শরীরে কাপালিকের লক্ষণ রয়েচে দেখলুম। আমার মনে হচ্চে ঐ পিশাচগুলি আগুন-ডামর যজ্ঞে সিদ্ধিলাভ করেছে।”

চন্দ্ৰধর অতি বিস্মিত স্বরে শুধােললা,

– “আগুন-ডামর? সেখানা আবার কি জিনিস বাবাজী? কক্ষনাে তাে নামও শুনিনি।”

কালীপদ চিন্তিত এবং উদ্বিগ্নভাবে ধীরে ধীরে বললে, “যারে দেব ভাষায় বলে ‘অগ্নিমন্থন’।”

**********

জমিদারবাড়িতে প্রবেশের মুখে কালীপদ হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মহেন্দ্র একটু অবাক হয়ে শুধালাে, “কি দেখছো বাবাজী?”

কালী একদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে প্রশ্ন করল, “এই জুতাজোড়া কার?”

বাস্তবিকই সেইখানে এক জোড়া রবারের কালােরঙা জুতা পড়েচিলাে। যখন কেউই সেটির মালিককে চিনতে পারলাে না, তখন কালীপদ সেই জুতাজোড়া তুলে নিয়ে দূর থেকে ঘ্রাণ নিতে লাগল, আর সেখানা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললাে, “এঃ!”

-“প্রেতগুলাে দেখচি আপনার ঘরে অবধি ঢুকে পড়েছিলাে। তাও আবার যেমনে তেমনে নয়, একেবারে ছদ্মবেশ ধারণ করে।”

মহেন্দ্র আতঙ্কিত হয়ে কাঁপা কণ্ঠে কইলাে, “দুয়া, দুর্গতিনাশিনী! কি বলছো বাবা! এ যে বড় ভয়ানক কথা। কার রূপ ধরে ঢুকেচিলাে সে?”

– “আজ্ঞে, তা তাে পরিস্কার কইতে পারি নে, তবে কতক কতক অনুমান করতে পারছি। ঐ যে আপনি বললেন না যে আপনার গােমস্তা… কী যেন নাম?”

“রাইচরণ…”

-“হ্যাঁ। এই রাইচরণকে সম্ভবতঃ হত্যা করে, তার রূপ নিয়েই এসেছিলাে সে। উদ্যেশ্য একটাই, যাতে আমি পত্র না পেয়ে এই গ্রামে এসে পড়ি। তবে এই কাজ করে তারা বুদ্ধিমানের কাজ করল, নাকি নিজের পায়ে কুড়ােল বসালাে, তার প্রমাণ ভবিষ্যৎই দেবে।”

সামান্য বেলা হয়েছে।

কালীপদ শ্বশুরগৃহে একটি ঘরে নিভৃতে বসেচিলাে, এমন সময়ে মন্দাকিনী লুকিয়ে লুকিয়ে তার ঘরে প্রবেশ করেই দোরের শিকলি তুলে দিলাে।

লুকিয়ে এইজন্যই আসতে হল, কারণ তখনকার দিনে বাড়িতে গুরুজনদের উপস্থিতিতে স্বামী-স্ত্রী দিনমানে যখন তখন দেখা করতে পারতাে না। কালীপদ মনে মনে খুশী হল।

মন্দাকিনী মৃদু স্বরে শুধােলাে, “তুমি কিছু খাবে এখন?”

– “নাহ, এখন ক্ষুধা নাই। তবে এই জিনিসটে যদি তৈরি করে আনতে পারাে তবে খাই।” এই বলে কালীপদ তােরঙ্গর ভিতর থেকে একখানা মস্ত বড়াে টিন নির্মিত বাক্স বের করল, আর স্ত্রীকে কইলাে,

-“এই জিনিসখানা দুধ আর শর্করা মিশিয়ে ফুটিয়ে খেতে হয়।”

মন্দাকিনী নাক সিঁটকে বললে,

– “ম্যা গাে। এ কী জিনিস? কেমন বিশ্রী দেখতে!”

-“দুর পাগলী। বিশ্রী হবে কেন! এর নাম চায়ের পাতা। পাহাড়দেশে জন্মায়।”

-“হু। যত্তসব ছাইয়ের পাতা না কি এনে জুটিয়েছে। এসব নেশা না করলেই নয়?”

-“ছাইয়ের পাতা নয়, চায়ের পাতা। গােরা সায়েরা খায়। দিব্যি জিনিস।”

-“ওই একই হল। এসব আজে বাজে ছাইয়ের পাতা না খেলেই যেন নয়।”

এইখেনে একটা কথা কয়ে রাখি। সে সময়ে এই চায়ের পাতা কিন্তু কেবলমাত্র কিছু বিত্তবানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ মানুষ এর মূল্যের নাগাল পাওয়া তাে দূর, নামও শােনেনি কস্মিনকালে। চোখেও দেখেনি কক্ষনাে। যারা বা দেখেচে, তারা ভয়ানক ভয় পেতাে একে নেশার বস্তু মনে করে। দমদমা ইস্টিশানে ব্রিটিশ গভর্ণমেন্ট বড়াে বড়াে করে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন সে সময়ে,

‘ইহাতে নাইকো মাদকতা দোষ

কিন্তু পানে করে চিত্ত পরিতােষ’

যাই হােক, যাক সে কথা।

মন্দাকিনী একটু ইতস্ততঃ করে কালীকে বললাে,

-“শােননা একটা কথা কই। তুমি যেন আমার এই বাপের বাড়ির তালুকে। ওসব গুণীনগিরি-টিরি বেশি দেখাতে যেও না বাপু। এদিগের সক্কলে তােমাকে ভদ্রলােক বলে জানে।”

কালী ছদ্মরাগের ভান করে বললে,

-“বটে! গুণীনরা তবে ভদ্রলােক হয় না বলাে?”

মন্দাকিনী ফিক করে হেসে জবাব দিলাে—

“তা নয়, তবে বড্ড বাউন্ডুলে হয় তা ঠিক। দু দন্ড কাছে পাবার জো নাই,” বলেই জিভ কেটে ঘর থেকে পালিয়ে গেল।

**********

কালীপদ সারা দিবস গাঁয়ে ঘুরে ঘুরে সকলের কথা শুনলাে, প্রয়ােজনীয় জিজ্ঞাসাবাদ করল। সমস্ত বৈকালটা সে একা একা বসে অনেক কিছু ভাবতে থাকলাে।

কারা এই শয়তানরা?

কি চায় তারা? কেন এভাবে নরহত্যায় মেতে উঠেছে তারা? কিসের বদলা নিচ্চে? এদেরকে বিনাশ করার পন্থা কী ?

তিন হিংস্র প্রেতাত্মার মধ্যে একটি মেয়েমানুষ গতকাল রাত্তিরে তার উপরে আক্রমণ করেছিলাে। প্রথমে বনের ভিতরের এক স্থান থেকে আয়য়.. আয়য়য়…” করে তাকে ডাকচিলাে। হয়তাে ইচ্ছে ছিল নিজের ডেরায় বসেই নরহত্যা করবে। কিন্তু কালীপদর উপরে সেই অমােঘ আহ্বানের কোনওরকম প্রভাব পড়চে না দেখে বিরক্ত হয়ে সে নিজেই অতর্কিতে উপস্থিত হয়ে কালীর কণ্ঠ লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

কালীপদ মুখুজ্জেকে মানুষে কালীগুণীন নামেই বেশি চেনে। বৎসরখানেক পূর্বেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে বাড়ি ফিরেছে সে। তাকে ইস্টিশানের এক কর্মচারী যখন বহুবার রাত্তিরে বনে ঢুকতে নিষেধ করচিলাে, তখনই সে মনে মনে স্থির বুঝেচিলাে যে বনে ঢুকলে কিছু একটা ভয়ানক জিনিস তার মুখােমুখি পড়তে চলেছে। সে ভিতরে ভিতরে প্রস্তুত হয়েই ছিল। তখনই সেই শয়তানী ঝাঁপ দেয় তার উপরে এবং শরীর স্পর্শ করা মাত্র জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

বাকী থাকলাে দুই কাপালিক। এরা আর কালীর কাছাকাছি হয়তাে ঘেঁষবে  না। কিন্তু গ্রামকে পুরােপুরি মুক্ত করার উপায় বের করতেই সন্ধ্যায় মহেন্দ্রর বৈঠকখানায় জনা বিশেক মুরুব্বি হাজির ছিল। তাদের উদ্যেশ্যে কালীপদ আস্তে আস্তে মুখ খুললাে, “দেখুন, আপনাদের এই গাঁ নেহাৎই হঠাৎ গজিয়ে ওঠা গাঁ নয়। রায়চৌধুরী বংশের বহু পুরুষ শাসন করে গিয়েছেন এই তালুকে। আজ লােকমুখে একখানা ঘটনার কথা শুনলুম। এই বংশের এক পূর্বপুরুষ এককালে তিনজনের জীবনদন্ড দিয়েছিলেন হাতীর পায়ে পিষ্ট করে। তারা নাকি সে সময়ে অনেকগুলি মেয়েমানুষকে হত্যা করেছিলাে। তা, আমার সন্দেহ হচ্চে যে এই শয়তানগুলােই হল তারা, কারণ এরাও কাপালিক। লক্ষণযুক্ত এবং অগ্নিমন্থনে সিদ্ধি পেতে একশােটি সধবার বলি লাগে। হয়তাে তারা সে সময়ে অন্যান্য তল্লাটের থেকে বাকী নরহত্যাগুলি করে শেষ ঠাঁই নিয়েচিলাে এইখেনেই।

শুনলাম, তাদের দেহ ঘৃণায় কেউ দাহ করতে চায়নি। কোনও এক কুয়াতে পুঁতে ফেলা হয়েছিলাে। আসার পরে দেখলাম এই এলাকায় কিছুদিন পূর্বেই সাগরে বান ডেকেছিলাে। সেই জল পাঁচমারীর বন অবধিও পৌঁছায়।

আপনাদের এই গাঁয়ের নাম নেত্রপাণি। শুনেচি বহু বহু যুগ পূর্বে এইরকম কোনও একটা স্থানেই ছিল মনসামঙ্গল খ্যাত সেই নেতিধােপানির ঘাট, যে ঘাটে স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে ঠেকেচিলাে সতী শিরােমণি বেহুলা। সে লক্ষ্য করেছিলাে এই ঘাটের জলের এক অলৌকিক গুণ। এর জল গায়ে লাগলে মৃত প্রাণীও জীবনলাভ করে।

পুরাণের সকল ঘটনা কাল্পনিক হয় না। হয়তাে সত্যই সেই জলে এমন কোনও গুণ ছিল। প্রকৃতির কোটি কোটি রহস্যের মধ্যে আমরা দুই চারিটিই ভেদ করতে পেরেছি। এখনও জানিনে মানবশিশুরা জন্মের পরে শ কাল নির্বিশেষে ‘ম’ শব্দটাই আগে শেখে কেন!

ডাব সূর্যের প্রখর রৌদ্রের মধ্যে থেকেও শীতল হয় কেন!

আমাদের পরিবেশের তাপমাত্রা একদাগ বাড়লেই ছটফট করি, অথচ গনগনে ফুটন্ত আগুনের উপর পাতলা সরের মতাে ভূপৃষ্ঠে দিব্যি চলেফিরে বেড়াই কী করে!

তাই বলচি, প্রকৃতির সব রহস্য আমরা জানিনে। সেই নেতিধােপানির জীয়ন জল বানের তােড়ে এসে পড়েছে সেই ইঁদারায় এবং ঐ শয়তানগুলাের সামান্যতম অস্থি হয়তাে এখনও টিকে রয়েছে সেইভেনে, ফলে জলের ছোঁয়াতে তারা প্রাণ পায়। ওদের শরীরগুলি অবিকৃত থাকলে হয়তাে পূণর্বার বেঁচেই উঠতাে, কিন্তু দেহের অস্তিত্ব না থাকায় তারা বিদেহী হয়ে জেগে ওঠে। আমাদের কাল ভােরে বনের আতিপাতি খুঁজে সেই ইদারাখানা বের করতে হবে। তার ভিতর থেকে সেই দেহের অবশিষ্টাংশ তুলে দাহ করে ফেলতে হবে। ভয় পেও না। আমি গা বন্ধন করে নিয়ে যাবাে তােমাদের। কাল সকালে সবাই এই বাড়িতে উপস্থিত হবে।”

উপস্থিত জনগণ দল বেঁধে ইষ্টনাম জপতে জপতে প্রস্থান করল। কালীপদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস মােচন করে নিজের মনে বলে উঠলাে,

-“কালী, কালী, মহামায়েঃ করালবদনী, পথ দেখা মা। হে অসুর পিশাচ নাশিনী, জগৎ উদ্ধারকারিনী। শক্তি দে।”

**********

ভােরের প্রথম আলাে মাটিতে পড়তেই দল বেঁধে সকলে হাজির হল বনের ভিতরে।

দিনের বেলাতেও প্রায় নিকষ, নিচ্ছিদ্র এই ভয়ানক অরণ্যের মধ্যে দিক ঠিক রাখাই দায়। বহু খুঁজেও কিছু পাওয়া গেল না। সবাই যখন হাল ছেড়েই দিয়েছে, তখন কালীপদ তাদের উদ্যেশে বললাে, “বাবাসকল, আমরা এত খুঁজেও কোনওদিকে কিছু খুঁজে পেলাম না। খোঁজা সম্ভবও নয় এইভাবে। তবে একটা কথা। পরশু রাতে যখন এই পথ দিয়ে গাঁয়ে যাচ্ছি, তখন বনের ভিতরে এক জায়গা থেকে একজন আমাকে ডাকচিলাে। যতটুকু আন্দাজ হয়, সেই স্থানটা এই পশ্চিমের দিকেই হবে। সেই এলাকাটা একবার খুঁজে দেখতে চাই।”

ভৈরােনাথ আর কালকেতু অনেক দূরে অলক্ষ্যে থেকে নজর রাখচিলাে। তারা কালীপদর কাছাকাছি আসতে পারেনি বটে, কিন্তু গাঁয়ের প্রজারা কালীগুণীনের কথামতাে যখন ইদারাটি খুঁজে বের করে তার থেকে অতি ক্ষুদ্র দুইখানি অস্থিখন্ড বের করে আনলাে, তখন দুই শয়তান একটুও ঘাবড়ালাে না। এই অস্থি কোনওভাবেই কেউ দাহ করতে পারবে না। তারা করতেই দেবে না। প্রলয়ঙ্করী অগ্নিমন্থনের শক্তি তাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এক গ্রাম্য সাধারণ গুণীনের সাধ্য নাই তাদের মােকাবেলা করে। একটু হেসে দুই কাপালিক অন্তর্হিত হল।

সূৰ্য্য যখন মাথার উপরে প্রায়, তখন সেই অস্থি হাতে করে কালীপদ সদলে ফিরে এল গ্রামে। জমিদারবাড়ির সুমুখে ডাঁই করে রাখা হয়েচে খড়ের আঁটি। তাতে ঢালা হয়েছে সেজবাতির রেড়ির তেল। তার উপরে স্থাপন করা হয়েছে হাড় দুইখানি। কালীপদ হাড় দু’খানাকে মন্তর পড়ে বেঁধে রেখেচে, যাতে শয়তানের দল তা ছিনিয়ে নিতে না পারে। অদূরে মশাল জ্বলচে। কালীপদ মশাল তুলে নিয়ে খড়ের গাদার কাছাকাছি সবেমাত্র এসেছে, এমন সময়ে উপস্থিত লােকজন আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাে। কালীপদ মুখ তুলে দেখলে, তার থেকে হাত পঞ্চাশেক দূরে আবছায়ার মতাে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুটি প্রেতমূর্তি। দিনের বেলায়। এত মানুষের সামনে।

কালকেতু নীচু হয়ে একতাল মাটি তুলে নিয়ে বিড়বিড় করে মন্তর পড়তেই তা পরিণত হল একখানি জ্বলন্ত পিন্ডে। তাই দেখামাত্র কালীপদও একটুখানি মাটি তুলে নিয়ে পালটা কি সব আউড়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিলাে।

পশ্চিমের আকাশ অন্ধকার করে কাপালিকদের মাথার উপর দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল লক্ষ লক্ষ ডাঁশের দল। মানুষজন যখন ছুটোছুটি করতে শুরু করেছে, এমন সময়ে আরেকখানা কান বধির করা গুঞ্জন শােনা গেল। সকলে পূবদিকের আকাশে চেয়ে দেখলে, সেদিক থেকে উড়ে আসচে হাজারে হাজারে ছাতারে পাখি। দেখতে দেখতে দুটো দলই ঝাঁপিয়ে পড়ল লােকেদের উপরে, কিন্তু ডাঁশের দল সুবিধা করে উঠতেই পারলাে না। এক একটি ছাতারে পাখি রাক্ষসের মতাে একেকবারে আট দশটি ডাঁশকে মুখে পুরতে লাগল। সামান্য সময় পরেই রক্তলােলুপ পােকার দলকে নিশ্চিহ্ন করে ছাতারে পাখির দল বাতাসে মিলিয়ে গেল।

প্রজারা আনন্দে চিৎকার করে উঠলাে। ভৈরােনাথ অন্ধকার চক্ষে তাকিয়ে থেকে একটা গাছের ছােটো ডাল ভেঙে নিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করতে শুরু করল। কালীপদ সেদিকে ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ লক্ষ্য করে, এক টানে নিজের মাথা থেকে তিনচারটি চুল ছিড়ে নিলাে। ভৈরােনাথ মন্ত্র পড়ে ডালটিকে মাটিতে সজোরে নিক্ষেপ করল, আর কালীপদ চুলগুলিকে হাতের তালুতে ঘষে নিয়ে বাতাসে ভাসিয়ে দিলাে।

ভূপৃষ্ঠের উপরে মাটির ফাঁকফোকর থেকে কিলবিল করে বেরিয়ে এসে ফণাবিস্তার করে দাঁড়ালাে অগুনতি বিষধর সাপের দল। নানান বর্ণের, নানান আকৃতির ভয়াবহ সাপগুলি তেজের সঙ্গে ছুটে এল লােকজনের দিকে।

এই দৃশ্য দেখে সকলে ভয়ে কোলাহল করে উঠলাে, এবং শুনতে পেলাে তাদের পিছন দিকের জঙ্গলের থেকে কারা যেন হুড়মুড়িয়ে বনজঙ্গল ভেঙে ছুটে আসচে এদিকে।

মুহূর্তের মধ্যে বনের ভিতর থেকে দলে দলে বেরুতে থাকলাে উদ্-বিড়ালের পাল। ভয়ংকর তাদের আকৃতি, হিংস্র তাদের প্রবৃত্তি। এক লহমায় তারা ধানের ক্ষেত্রে পঙ্গপালের আক্রমণের ন্যায় গিয়ে পড়ল সাপের দলের উপরে, আর কিছু সময়ের মধ্যেই প্রতিটি সাপকে ছিন্নভিন্ন করে অদৃশ্য হয়ে গেল।

পরপর দুইবার পরাভব হওয়ার পরে এবারে ক্রুদ্ধ গর্জন করে এগিয়ে এল কালকেতু। সে নিজের ডানহাতটি মাথার চারদিকে ঘােরাতে শুরু করল। কালীপদ সরু চোখে একটুক্ষণ সেদিকে চেয়ে থেকে নিজের মনে বললাে,- “বটে?”

কালকেতুর পিছনের ঝােপের থেকে বেরিয়ে আসতে থাকলাে বুভুক্ষু, রাক্ষুসে কালাে বেড়ালের সারি। তারা এদিকে মহা জিঘাংসায় ছুটে আসছে, এমন সময়ে কালীগুণীন একটা পাটকেল তুলে কপালে স্পর্শ করে ছুঁড়ে দিলে নিজের মাথার পিছনে, আর সেদিক থেকে লাফিয়ে এসে থাবা পেতে দাঁড়ালাে শত সহস্র বুনাে কুকুরের ঝাঁক।

বেড়াল কুকুরে প্রলয়ঙ্কর যুদ্ধ বেঁধে গেল। প্রবল শক্তিশালী কালাে বেড়ালগুলি পাতালের গহীন থেকে অশুভ শক্তিকে সঙ্গে করে বয়ে এনচে তারা অব্যর্থ, তারা অমােঘ।

কিন্তু শুভশক্তির অপরিমেয় বল দ্বারা জন্ম নেওয়া কুকুরগুলির শক্তি ঐ বেড়ালদের থেকে একটু বেশিই ছিল। ধীরে ধীরে সবকয়টি বেড়ালকেই তারা টুকরাে টুকরাে করে ছিড়ে ফেলে বিদায় নিলাে।

কালকেতুর পিছনে তখনও একখানা প্রকাণ্ড বিড়াল দাঁড়িয়ে ছিল। মনিবের হুকুমে সে এবার ধেয়ে এল কালীপদর দিকে। কালকেতু উগ্র ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে বললাে,

– “তাের জন্য পাতালের অতল থেকে আনা এই উপহার স্বীকার কর।”

বেড়ালটি ভীষণ গতিতে ছুটে এসে কালীর কণ্ঠনালী লক্ষ্য করে দিলাে এক লাফ, আর কালীপদর গা বন্ধের সীমারেখার মধ্যে প্রবেশ মাত্র ‘চিড়িক’ করে একটা শব্দ করে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতাে পুড়ে ছাই হয়ে গেল সেটি।

“দুঃখিত, আমি পাপিষ্ঠের দেওয়া দান গ্রহণ করি নে।”

কালীগুণীন বিরস তিক্ত স্বরে প্রত্যুত্তর করল।

কালকেতু হিসহিসিয়ে কইলাে, “আচ্ছা বেশ। কিন্তু এই অস্থি তুই দাহ করিস কি দিয়ে তা দেখি।”

এই বলে সেই কাপালিক নীচু স্বরে উচ্চারণ করল, “খড়।”

সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল হাড় দুখানা মাটিতে পড়ে রয়েছে, আর খড়ের আঁটিটা পড়ে রয়েছে কালকেতুর পায়ের নিকট। দুইজন হাঃহাঃহাঃহাঃ করে রক্ত জল করা হাসি হেসে উঠলাে।

কালীপদ অপ্রস্তুত হয়ে দড়ি থেকে একখানি শাড়ী তুলে নিয়ে পুঁটুলি পাকিয়ে তার উপরে হাড় রেখে তড়িঘড়ি আগুন দিতে গেল।

কালকেতু আবার নীচু স্বরে বললাে,“শাড়ী।”

আবার যে কে সেই। শাড়ীখানি কালকেতুর পদপ্রান্তে গিয়ে বসল।

এ ভাবে যতবারই নানা রকম বস্তু দিয়ে পােড়ানাের চেষ্টা হতে লাগল, ততবারই তান্ত্রিকেরা সেই বস্তুর নাম ধরে ডাক দেয়, আর সেগুলি গিয়ে পড়ে তাদের সামনে। হাড় কিছুতেই আর জ্বালানাে যায় না। কালীপদ এই অভিনব উপদ্রবে অস্থির হয়ে উঠে যখন কূলকিনারা পাচ্ছে না, তখন হঠাৎ গম্ভীর স্বরে সে কালকেতুকে বলে উঠলাে, “বটে রে শয়তান। তাের এতই যদি বিদ্যার জোর, তবে আমার সঙ্গে কেন, আমার গুরুর সঙ্গে লড়ে দেখা। আমার কাছে আমার গুরুর দেওয়া এক দৈব মন্ত্রপড়া জিনিস রয়েছে। দাঁড়া তবে।”

এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে কালীপদ হাতে করে একখানা বড়াে রক্তবর্ণ পুঁটুলি নিয়ে বেরুলাে। পুঁটুলি খুলে একরাশ কুচকুচে কৃষ্ণবর্ণ কি যেন মন্ত্র পড়ে ঢেলে দিলাে মাটিতে, আর সেই স্তুপের উপর স্থাপন করল হাড় দুখানা।

এইবারে কাপালিক দুজনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠলাে। এই দিব্য বস্তু তাদের পরিচিত নয়। উপস্থিত কেউই প্রায় এমন দ্রব্য চোখেই দেখেনি!

কালকেতু নিজের সম্ভাব্য চেনা জানা সকল বস্তুর নাম ধরেই ডাক দিতে থাকলাে, কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা।

কালীপদ মশাল ছুঁয়ে দিলাে স্তুপে। সাগরের হু হু ঝােড়াে বাতাসে দাউদাউ করে ধরে উঠলাে হাড়গুলাে। কানফাটানাে আর্তনাদ করতে করতে একসময়ে দুই পিশাচ মিলিয়ে গেল গুঁড়াে গুঁড়াে হয়ে।

**********

গাঁয়ের লােক হৈ হৈ কলরব করে ত্রাণকর্তা জামাইটিকে কাঁধে তুলে আনন্দ করতে লাগল। মহেন্দ্রবাবু স্বয়ং কালীপদর কাঁধে হাত রেখে কইলেন, “তুমি আমার চাইতে বয়সেও নবীন, আর সম্পর্কেও তাই। কিন্তু তুমি যা করলে আমাদের জন্য, তা নেত্রপাণি একশাে বছরেও ভুলবে না। তবে কিনা বাবা, একটা জিনিস তাে জানা হল না। তােমার গুরু ওইখানি কি এমন ভয়ানক জিনিস দিয়েছিলেন তােমাকে, যে জিনিস আমরা অবধি চিনলেম না?”

কালীপদ মাথা নীচু করে চুপ করে রইলাে। মন্দাকিনী ঘােমটার আড়াল থেকে ফিক করে হেসে উঠে চাপা গলায় বললাে, “হ। মন্তর না কচু। যত্তোসব ‘ছাইয়ের (চায়ের) পাতা।”

-সমাপ্ত-

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *