নেতা যে রাতে নিহত হলেন

নেতা যে রাতে নিহত হলেন

 পুলিশ অফিসারটি বেশ মার্জিত ধরনের। চেয়ারে গা এলিয়ে খুবই আয়েশি ভঙ্গিতে সিগ্রেট টানছিলেন তিনি। টেবিলের সামনে দুজন সাধারণ পুলিশের সঙ্গে অত্যন্ত নিরীহ, গোবেচারা, গ্রাম্য লোকটিকে দেখে চোখ তুলে তাকালেন। কিন্তু বসার ভঙ্গিটি বদলালেন না। সিগ্রেটে টান দিয়ে বললেন, কি, ঘটনা কি?

দুজন পুলিশের একজন বলল, আমার খুব সন্দেহ হচ্ছিল।

অপরজন সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমারও স্যার। লোকটির চাল-চলন আচার-আচরণ খুবই সন্দেহজনক। নেতার বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল সে।

নেতার কথা শুনে পুলিশ অফিসারটি বেশ ধাক্কা খেলেন। গা এলানো ভাবটা মুহূর্তে কেটে গেল তার। চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন তিনি। টেবিলের ওপর, হাতের কাছে ছিলো তাঁর পুলিশি টুপি। টুপিটা নিয়ে যত্ন করে মাথায় পরলেন। যেন এইমাত্র দায়িত্বে বহাল হলেন। এতক্ষণ যেন ছুটি কাটাচ্ছিলেন।

হাতের সিগ্রেট এসট্রেতে গুঁজে দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখ তুলে লোকটির দিকে তাকালেন অফিসার। আকাশি রঙের ঝুল পকেটঅলা শার্ট পরা। ডোরাকাটা লুঙি বেশ খানিকটা উঁচু করে পরেছে। যেন নিচু করে পরলে ধুলোময়লা লেগে যাবে। লোকটির খালি পা এবং মুখের রঙ প্রায় একই রকম। রোদে পোড়া, নিরেট কালো। মাথার ঘন কালো চুল কদমছাট দেয়া। দাড়িগোঁফ দু একদিন আগে কামিয়েছে। থানার ভেতরকার উজ্জ্বল আলোয় অফিসার দেখতে পেলেন, লোকটির গালের শক্ত চামড়া ভেদ করে ধারালো দাড়িগোঁফ মাথাচাড়া দিচ্ছে।

লোকটির ঠোঁট খুব পুরু। নাক থ্যাবরা। পরিশ্রমী, পেশিবহুল শরীর। কিন্তু চোখ দুটি বেশ কৌতূহলী। বুকের কাছে জীর্ণ কাপড়ের একটি পুঁটলি শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছে সে।

অফিসার গম্ভীর গলায় বললেন, নাম কী?

প্রশ্নটি কাকে করা হয়েছে বুঝতে পারল না লোকটি। সঙ্গের পুলিশ দুজনের দিকে তাকাল সে।

একজন বলল, আমাদের নয়, তোমার নাম জানতে চেয়েছে।

অপরজন বলল, আমাদের নাম স্যারে জানেন। তোমার নাম বল।

 লোকটি সামান্য গলা খাকারি দিল। তারপর অমায়িক মুখ করে বলল, আমার নাম সাহেব রতন। রতন মাঝি।

কি কর?

দুজন পুলিশের একজনের স্বভাব হচ্ছে কথা একটু বেশি বলা। আসলে অফিসারকে তোয়াজ করা। সে হাসি হাসি মুখ করে বলল, নামের শেষে যখন মাঝি আছে নিশ্চয় নৌকা বায় স্যার।

সঙ্গে সঙ্গে রতন নামের লোকটি হা হা করে উঠল। না না সাহেব, না, নৌকা বাইনা। নৌকার মাঝি না আমি। আমার বাবা-দাদায় আছিল মাঝি। সেই থেকে আমাদের পদবি হয়েছে মাঝি।

অফিসার আগের মতোই গম্ভীর গলায় বললেন, তাহলে কি কর তুমি?

 রতন বলল, আমি সাহেব ভাগচাষী।

বেশি কথা বলা পুলিশটি বলল, চাষী বুঝি। কিন্তু ভাগচাষী তো বুঝি না। ভাগচাষী জিনিসটা কি!

অফিসার এবার রেগে গেলেন, আঙুল তুলে বললেন, তুমি চুপ কর। আমি যতক্ষণ কথা বলব আমার সামনে একটিও কথা বলবে না। একদম পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে।

জ্বি আচ্ছা স্যার।

আবার কথা। তোমাকে না বললাম একদম চুপ। একদম পাথর।

লোকটি যেন সত্যি সত্যি পাথর হয়ে গেল।

অফিসার আবার রতনের দিকে তাকালেন, বল।

রতন বলল, কি বলব সাহেব?

কি কর তুমি?

ওই যে বললাম, ভাগ চাষী। নিজের জমি নাই। পরের জমি আধাআধি ভাগে চাষ করি।

 বাড়ি কোথায়?

তা অনেক দূর সাহেব। পদ্মার ওপার দিয়ে তিন চার ঘণ্টা একটানা হাঁটতে হয়। গ্রামের নাম উদয়পুর।

এখানে এলে কি করে?

এখানে তো সাহেব আপনার লোকজন ধরে নিয়ে এল।

অফিসার বেশ বিরক্ত হলেন। কিন্তু তার স্বভাব হচ্ছে একটু একটু করে অনেকক্ষণ ধরে রাগেন। তারপর এক সময় ফেটে পড়েন। রাগের প্রাথমিক পর্যায়টা শুরু হয়ে গেছে। গম্ভীর গলায় অফিসার বললেন, এখানে মানে আমি শহরের কথা বলেছি।

রতন সরল ভঙ্গিতে হাসল। শহরে সাহেব লঞ্চে করে এসেছি। পদ্মার পার থেকে সকালবেলা চড়েছি, শেষ বিকালে শহরে এসে নামলাম। বাড়ি থেকে বেরিয়েছি কাল দুপুররাতে। ওই যে বললাম, তিন চার ঘণ্টা হেঁটে নদীতীর, তবে লঞ্চঘাট।

 তুমি কি কথা একটু বেশি বল?

রতন খুবই লজ্জা পেল। জ্বি না সাহেব। আপনে জিজ্ঞেস করলেন তাই বললাম।

শহরে তুমি আগে কখনও এসেছ?

জ্বে না।

এই প্রথম?

জ্বে!

কেন এসেছ?

বললে সাহেব আপনে অন্য কিছু ভাববেন না তো!

 বল, তবে সত্য কথা বলবে। মিথ্যে বললে কঠিন শাস্তি হবে।

 আমি সাহেব নেতাকে দেখতে আসছি।

অফিসার চমকে ওঠলেন। পাথর হয়ে থাকা সেই দুজন পুলিশ এই প্রথম মুখ ঘুরিয়ে দুজন দুজনার চোখের দিকে তাকাল। তারপর আগের ভঙ্গিতে ফিরে আবার পাথর হয়ে গেল।

অফিসার নড়েচড়ে ওঠলেন। নেতাকে দেখতে এসেছ মানে কি? নেতাকে তুমি চেনো? নেতা তোমাকে চেনেন?

রতন অমায়িক মুখ করে বলল, নেতাকে কে না চেনে সাহেব! তারে চিনব না এ হয় নাকি। নেতাও তো দেশের সব মানুষকেই চেনেন। মুখখানা দেখলে আমাকেও চিনবেন। আমিও তো দেশের মানুষ।

তুমি যে নেতার বাড়ির পাশে ঘুরঘুর করছিলে, বাড়ি তুমি চিনলে কি করে?

 লঞ্চ থেকে নেমে লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে চলে গেছি। ম্যালা রাত হয়ে গেছে। এত রাতে তো নেতাকে আর দেখতে পাব না। ভাবছিলাম তার বাড়ির সামনের রাস্তায় বসে থাকব। দিনের বেলা তিনি যখন বেরুবেন দুচোখ ভরে তাঁকে একবার দেখব। পোটলাটা নামিয়ে রাখব তাঁর পায়ের কাছে।

অফিসার হাসলেন। মাথায় ছিট আছে তোমার?

জ্বে না সাহেব।

পোটলায় কি?

চিরে। খুব ভালো চিরে সাহেব। বাড়ির নামায় এক চিলতে জায়গায় কালিজিরে ধান হয়েছিল। খুব অল্প হয়েছিল। পোনে দুসেরের মতো চিরে হয়েছে। চিরেটা সাহেব নেতার জন্যে নিয়ে এসেছি। নেতা একমুঠ মুখে দিলে জীবন ধন্য হয়ে যাবে আমার। আমি সাহেব নেতাকে বড় ভালোবাসি। গরীবের ভালোবাসা। নেতাকে কেমন করে জানাব। ম্যালা দিনের স্বপ্ন ছিল তাঁরে একবার সামনাসামনি দেখব। পায়ের কাছে চিরের পোটলাটা নামিয়ে রেখে পা দুখানা একবার ছুঁয়ে দেখব।

রতন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে আর হল কই! আপনার লোকজন ধরে নিয়ে এল। ঠিকই করেছে। তুমি আসলে বদমাস।

জ্বে!

হা তুমি বদ মতলবে নেতার বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করছিলে। এতক্ষণ ধরে যা বললে সবই মিথ্যে। বানোয়াট। তোমার মতো লোকের এত পয়সা ব্যয় করে, এত পরিশ্রম করে, এতদূর শুধু নেতাকে একপলক দেখতে আসার কথা নয়। অতগুলো চিরে বিক্রি। করলে ভালো পয়সা পেতে তুমি। তুমি এসেছ নিশ্চয় অন্য কোনও মতলবে। ভালোবাসা দেখাতে নয়।

এতক্ষণের হাসিমুখটা মুহূর্তে চূর্ণ হয়ে গেল রতনের। একেবারেই স্তব্ধ হয়ে গেল সে। কাতর গলায় বলল, না সাহেব না। আমি একটাও মিথ্যা কথা বলি নাই। আমরা মিথ্যা কথা বলি না। মানুষ গরিব হতে পারি সাহেব কিন্তু আমাদের ভালোবাসাটা খাঁটি। আমাদের মতো গরিব মানুষরাই নেতাকে বেশি ভালোবাসে সাহেব। আল্লার কসম খেয়ে বলছি আমি নেতাকে দেখতে আসছি। এ আমার ম্যালা দিনের স্বপ্ন। আপনে বিশ্বাস করেন।

একটু একটু করে অনেকক্ষণ ধরে জমে ওঠা রাগটা এবার ফাটল অফিসারের। প্রচণ্ড রেগে একটা ধমক দিলেন তিনি। চোপ। সেই ধমকে রতন তো বটেই পাথর হয়ে থাকা পুলিশ দুজনও কেঁপে ওঠলো। পুলিশ দুজনের দিকে তাকিয়ে অফিসার বললেন, পোটলাটা নাও। খুলে দেখ ভেতরে কী আছে।

সঙ্গে সঙ্গে রতনের বুক থেকে চিড়ের পোটলাটা ছিনিয়ে নিল একজন। থানার মেঝেতে ফেলে পোটলাটা খুলল। চিড়েগুলো ছড়িয়ে গেলো চারদিকে। চিড়ের তাজা, মিষ্টি একটা গন্ধে থানার গুমোট পরিবেশ কী রকম ম ম করে ওঠল।

অফিসারের কথা শুনে রতনের মনে হল, প্রচণ্ড খরায় চষা জমির মাটির ঢেলা যখন পাথরের মতো হয়ে ওঠে, সেই ডেলা ভাঙবার জন্যে চাষী যে ইটামুগুর ব্যবহার করে, সে রকম একটি ইটামুগুর দিয়ে হঠাৎ করেই কেউ তার বুকে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করেছে। ও রকম আঘাতে দম বন্ধ হয়ে যায় মানুষের। চোখ ঠিকরে বেরোয়। মানুষ কোনও শব্দ করতে পারে না।

রতনও কোনও শব্দ করতে পারল না।

অফিসার বললেন, এই চিড়ে কেমিক্যাল টেস্টে পাঠাও আর বদমাসটাকে লকআপে ভরো।

 বেশি কথা বলা পুলিশটি বলল, একটা কথা বলব স্যার।

অফিসার রাগী চোখে তাকালেন। কি?

 চিরের গন্ধটা বড় ভালো।

তাতে কি হয়েছে?

 বলছিলাম কি একটু মুখে দিয়ে দেখব?

অফিসার প্রচণ্ড রাগলেন। যদি তোমার কোনও একসিডেন্ট হয়। যা বললাম তাই কর। টেস্টে পাঠাও।

রতন তারপর আর একটিও কথা বলেনি। একেবারেই পাথর হয়ে গিয়েছিল। থানা হাজতের দেয়ালে হেলান দিয়ে সারারাত বসে থেকেছে। একজন টহলদার পুলিশ পাঁচ মিনিট পর পর গরাদের সামনে দিয়ে টহল দিয়ে গেছে। রতন তার দিকে ফিরেও তাকায়নি।

ভোরবেলা কীরকম একটা গুঞ্জন ওঠল থানায়। কীরকম একটা ছুটোছুটি। চাপা ফিসফাস। খানিকপর সেই দুজন পুলিশ এসে লকআপ খুলল। রতন মাঝি, বেরোও।

কথা বেশি বলা পুলিশটির প্যান্টের দু পকেট বেশ ফোলা।

রতন নিঃশব্দে লকআপ থেকে বেরোল। পুলিশ দুজন ঠেলে তাকে এনে দাঁড় করাল সেই অফিসারের সামনে।

অফিসার কী রকম দুঃখী মুখ করে চেয়ারে বসে আছেন। চোখে উদাসীনতা কিংবা অন্য কিছু।

রতনকে দেখে চোখ তুলে তাকালেন তিনি। গভীর দুঃখের গলায় বললেন, নেতা কাল রাতে নিহত হয়েছেন। আমরা খবর পেয়েছি তার খুব ঘনিষ্ঠ লোকজন, নেতার আদর্শে বিশ্বাসী, একই রাজনীতি দীর্ঘদিন করেছে তারা ষড়যন্ত্র করে নেতাকে হত্যা করেছে। তোমার ওপর আমি অবিচার করেছি ভাই। যাও বাড়ি যাও তুমি।

বেশি কথা বলা পুলিশটি তখন তার প্যান্টের পকেট থেকে চিড়ে বের করে অবিরাম মুখে পুরছে। রতন বুঝে গেল এই সেই চিড়ে। ভালোবেসে বহুদূর থেকে নেতার জন্যে নিয়ে এসেছিল সে। কালিজিরা ধান কত যে যত্নে বুনেছিল বাড়ির নামায়। সেই ধান শুকিয়ে কত যে যত্নে চিড়েটা কুটে দিয়েছিল তার কৃষাণী!

এসব ভেবে চোখ ভরে আসার কথা রতনের। কিন্তু হল তার উল্টো। চোখ দুটো কী রকম জ্বলে উঠল তার। অফিসারের দিকে তাকিয়ে শীতল গম্ভীর গলায় রতন বলল, আমাকে ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না সাহেব। আমাকে হাজতেই রাখুন। ছেড়ে দিলে নেতা হত্যার প্রতিশোধ নেব আমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *