নেতাদের কথা
গত চৈত্র সংখ্যার ‘বঙ্গবাণী’তে শ্রীযুক্ত জ্ঞানেন্দ্রনাথ রায়, পিএইচ-ডি ও শ্রীযুক্ত প্রফুল্ল কুমার বসু, এমএসি কর্তৃক অনূদিত ভবানীপুর ব্রাহ্মসমাজে প্রদত্ত স্যার পি, সি, রায়ের বক্তৃতার যে সারাংশ প্রকাশিত হয়েছে, তার সম্বন্ধে কয়েকটা কথা বলবার ইচ্ছা হয়েছে। এই জাতিভেদ ও তাহার প্রায়শ্চিত্ত শীর্ষক প্রবন্ধে স্যার পি, সি, রায় জাতিভেদরূপ মহাপাপ ভারতবর্ষকে অধঃপতনের দিকে কিরূপে চালিত করেছে তার দুই একটি দিক সম্বন্ধে কিছু ব’লতে চেয়েছেন। স্যার পি, সি, রায় সম্প্রতি ভারতবর্ষের নানা স্থান পরিভ্রমণ ক’রে নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত অনেক কার্যে অনেক শ্রেণীর লোকের সঙ্গে মিশে যেটুকু অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন তাতে তিনি বুঝেছেন যে, জাতিভেদ দেশের যে সর্বনাশ করেছে তা বলে শেষ করা যায় না।
এই প্রবন্ধে তিনি যে সর্বনাশের ইঙ্গিত করেছেন তার মধ্যে একটা সর্বনাশ মনে হয় যেন তিনি বলতে চান যে, “বাংলা দেশের শতকরা ৫০ জনেরও অধিক মুসলমান। অথচ এই মুসলমানদিগের মধ্যে শতকরা ৯৯ জন লোকের শরীরে হিন্দুর রক্ত। আজ যে বাংলা দেশে এই শতকরা ৫০ জনেরও অধিক মুসলমান ইহার কারণ হিন্দু সমাজের কঠোরতা। জাতিভেদের কঠোর বন্ধনে হিন্দু সমাজকে আমরা সঙ্ঘবদ্ধ করিতে যাইয়া তাহাকে কেবল পঙ্গুই করিয়াছি। এই শতকরা ৯৯ জন মুসলমান যাহাদের রক্ত হিন্দু ও ভাষা বাংলা–তাহারা আমাদের অত্যাচারে জর্জরিত হইয়া ইস্লামের উদার বক্ষে আশ্রয় লইয়াছে।”
এই আশ্রয় লওয়াটা ভালো হয়েছে কি মন্দ হয়েছে এ সম্বন্ধে স্যার পি, সি, রায় কোনো স্পষ্ট মত দেন নাই বটে, তবে গোটা প্রবন্ধ পড়লে মনে হয় যে, তাঁর মতে এতে হিন্দু সমাজের ক্ষতি হয়েছে এবং তাতে ক’রে গোটা ভারতবর্ষের সর্বনাশ হয়েছে। এদিকে আবার তিনি বলেছেন, “মুসলমান সমাজ মানুষকে চিরদিনই মানুষ বলিয়া স্বীকার করে। যেদিন ইস্লাম ধর্ম গ্রহণ করা গেল সেইদিন বাদশাহ্ ফকীর এক মসজিদে উপাসনা করিতে অধিকারী হইল। হেয় অবজ্ঞাত হইয়া কাহাকেও থাকিতে হয় না। সুশিক্ষা প্রাপ্ত হইলে ফকীর-পুত্রের ওমরাহের দুহিতার পাণিগ্রহণেও কোনো বাধা নাই।” স্যার পি, সি, রায়ের বর্ণিত ইস্লামের ‘উদার বক্ষে’ যদি মানুষ আশ্রয় নেয়, তাতে হিন্দুর অতএব স্যার পি, সি, রায়ের মতে ভারতবর্ষের সর্বনাশ হয়েছে একথা যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয় না। হতে পারে স্যার পি, সি, রায় ইস্লাম সম্বন্ধে এখানে যে-ব্যাখ্যা দিয়েছেন সে-ব্যাখ্যা তাঁর মনের ব্যাখ্যা নয়; এ কেবল ‘হিন্দুকে’ একটু অনুপ্রাণিত করার উদ্দেশ্যে একটা খেয়ালী ব্যাখ্যা। এ ব্যাখ্যায় মুসলমানদের কোনো হানি হবে বা হতে পারে কি না তা ঠিক বলা শক্ত; কিন্তু এটা ঠিক, যে এতে মুসলমানকে পর ক’রে দেখা হয় এবং সাম্প্রদায়িক বিরোধের সূচনার সৃষ্টি হয়।
স্যার পি, সি, রায় আরো বলেছেন, “চৈতন্য যদি আবির্ভূত না হইতেন, তাহা হইলে ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থ এই ২৬ লক্ষ বাদে বোধ হয় সমস্ত দেশই মুসলমান হইয়া যাইত।” তাতে ক্ষতি বৃদ্ধি কি হ’ত সে সম্বন্ধে স্পষ্ট ব্যাখ্যা এ প্রবন্ধে না থাকলেও গোটা প্রবন্ধ পড়লে বেশ মনে হয় যে তাতে স্যার পি, সি, রায়ের মতে ভারতবর্ষের আরো সর্বনাশ হ’ত।
সম্প্রদায় বিশেষের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং গোটা ভারতবর্ষের সর্বনাশ হওয়া এই দুটো জিনিস যে এক এ কথা মনে করা আমাদের দেশের এক মস্ত ভুল। অবশ্য এ কথা ঠিক যে, এক দেশবাসী নানা সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে যদি পরস্পর পরস্পরের সহিত বিরোধে লিপ্ত থাকে, তা হলে দেশের ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী। এই হিসাবে অবশ্য মুসলমান যে বাংলা দেশে শতকরা ৫০ জনেরও অধিক এতে দেশের সর্বনাশ হয়েছে এটা বোঝা যায়। কিন্তু যদি মুসলমানেরা এদেশে নাই আসত এবং এদেশের কোনো লোক মুসলমান সমাজের ‘উদার বক্ষে’ আশ্রয় না নিত, তা হলেই কি এ দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উৎপত্তির সম্ভাবনাই থাকত না? ইতিহাসের সাক্ষ্য অন্যরূপ। বৌদ্ধ ধর্ম্মাবলম্বী ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বীদের সাম্প্রদায়িক মারামারি কাটাকাটি বাদ দিয়েও এ দেশে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে আরো বিরোধের কথা শোনা যায়। তা ছাড়া মুসলমানরা এ দেশে না এলেও জাতিভেদ জিনিসটার ভেতরে ভেতরে যে সাম্প্রদায়িক বিরোধের বহ্নির আয়োজন সর্বদা বর্তমান এ কথা অস্বীকার করা এবং মানুষকে মানুষ বলে স্বীকার না করা একই কথা। ইস্লামের “উদার বক্ষে” আশ্রয় নেবার সুযোগ যদি এ দেশবাসীরা না পেত, তবে যে সব লোকের জাতিভেদের কঠোরতা সইবার মতো শক্তির বা রুচির অভাব তারা অন্য কোনো “উদার বক্ষের” সন্ধান পেত এবং সেখানে আশ্রয় নিত। তাতে ক’রেও ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হ’ত এবং সেই সব সম্প্রদায় যদি পরস্পর পরস্পরের মত সহ্য করার মতো শিক্ষা না পেত, তা হলে হিন্দু-মুসলমানে যেরূপ বিরোধ চলেছে এই বিরোধ সে সময়েও চলত। এমন কি যদি এখনও সমস্ত মুসলমান এ দেশ ছেড়ে চলে যায় অথবা সকলেই “হিন্দু” সমাজভুক্ত হয়ে যায়, তা হলেই যে এ দেশে সাম্প্রদায়িক বিরোধ ক্ষান্ত হবে এরূপ আশা করা যায় না। এখন মুসলমানকে যাঁরা বড্ড বেশী পর এবং দেশের কাঁটা মনে করছেন, হয় তো ভবিষ্যতে এমন এক প্রবল সম্পদ্রায়ের সৃষ্টি হবে যারা এঁদের আবার দেশের কাঁটা মনে করবে। মোটের উপর সাম্প্রদায়িক বিরোধ জিনিসটার জন্য যে কোন্ সম্প্রদায় দায়ী তা বলা খুব সহজ বলে আমার মনে হয় না। ভারতবর্ষের সর্বনাশের জন্য ইসলামের “উদার বক্ষ” দায়ী বা পরস্পর পরস্পরের মত সহ্য করতে না পারার মতো অসহিষ্ণুতাই দায়ী, সেটা বিশেষভাবে ভেবে দেখা দরকার। এই অসহিষ্ণুতা আবার কার মধ্যে বেশী সে সম্বন্ধে সুবিচারের অভাব পরাধীন জাতির চরিত্রগত দোষের মধ্যে অন্যতম। এ বিষয়ে আবার বিচার চাওয়া বা বিচার করতে যাওয়াও পরাধীনতা-প্রিয়তার চিহ্ন। যে সম্প্রদায় বা যে জাতি এই বিষয় বিচার বিতর্কে কাল কাটায়, তারা কোনো বড় কাজ করার যোগ্য নয়। একটা গোটা সমাজ বা সম্প্রদায়ের প্রতি কোনো একটা বিশেষ দোষারোপ করা অলস ও অনুর্বর মস্তিষ্কের পরিচায়ক।
দেশের কৃতী সন্তান স্যার পি, সি, রায়ও গতানুগতিকতার অনুসরণ ক’রে অন্যান্য পাঁচ জন সাধারণের মতো মুসলমানকে অনেকখানি পর ক’রে দেখেছেন। ইস্লামের “উদার বক্ষে” আশ্রয় নিলে দেশের সন্তান যে বিদেশী হয়ে যায় বলে মুসলমানদের মধ্যেকার একটা দলের বদনাম আছে তার মূলে কতকগুলি জিনিস আছে যার একটা এখানে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ভারতবর্ষের মুসলমানের সংখ্যা “হিন্দুর” এক তৃতীয়াংশ। সুতরাং “হিন্দুই এখানে এখন প্রবল। এই প্রবল অংশ যদি দুর্বল অংশকে পর বলে মনে করে এবং এ দেশ “হিন্দু”রই দেশ আর কারো নয় এই কথা সাহিত্যে ও বক্তৃতায় প্রমাণ করতে প্রাণপণ চেষ্টা করে, এক কথায় দুর্বল অংশকে বাড়ী ছাড়া ক’রে দেয়, তবে দুর্বল অংশ তো একটা কোথাও তাদের বাড়ী ঠিক করতে চাইবে। যখন এ দেশে পেরে উঠছে না তখন কি করা–লাচার হয়েই তারা সমরকন্দ ও বোখারার স্বপ্ন দেখে। এ দেখাটা এতই স্বাভাবিক যে ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া ক’রে যদি তাদের আরো বিব্রত ক’রে তোলা হয় তারা আরো পর হয়ে ওঠে এবং অনেক সময় লাচার ও হতাশ হ’য়েই যারা তাদের পর বলতে চায় তাদের পর ভাবতে বাধ্য হয়।
ভারতমাতা এদেশবাসী মুসলমানের যেমন জননী হিন্দুরও তেমন। “হিন্দু” মুসলমানকে পর ক’রে রাখতে চাচ্ছে এবং বলছে এ দেশ শুধু হিন্দুর, তাতে মুসলমানদের একটু অভিমান না করা যে অত্যন্ত অস্বাভাবিক। এতে যে-মুসলমানের বুকে কিছু অভিমান না জাগে সে অস্বাভাবিক মানুষ এবং বুঝতে হবে যে তার অনেকখানি নৈতিক অবনতি হয়েছে। সে মানুষ হিসেবে খুব ছোট এবং যদি সে শুদ্ধ হয়ে হিন্দুর দলে ভিড়ে যায়, তাতে হিন্দু সমাজের অবনতি বই উন্নতি হবে না।
স্যার পি, সি, রায় তাঁর এই প্রবন্ধে হিন্দু সমাজের মঙ্গলকে দেশের মঙ্গল বলতে চান। এ সম্বন্ধে ভারতবাসীকে নতুন ক’রে ভাবতে হবে। দেশের মঙ্গল অর্থে দশের মঙ্গল বুঝতে হবে। দশ মানে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান সব। স্যার পি, সি, রায় বলতে পারেন যে, “হিন্দু” বাদে অন্যে তাঁর কথা মানবে কেন। তাই তিনি তাদের সম্বন্ধে কিছু বলতে সাহস পান না। দেশের মঙ্গলের জন্য যাঁর মন ব্যস্ত, তিনি কে কথা মানবে আর কে মানবে না, সেদিকে তাকিয়ে কাজ করতে পারবেন না। ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থ সকলেই কি স্যার পি সি রায়ের কথা মানছেন? এ জগতে কারও কথা কেউ মানে না। যাকে অন্তরের সহিত ভালবাসা যায়, সে ছাড়া আর কেউ কথা শোনে না। স্যার পি, সি, রায় মুসলমানকে অন্তরের সহিত ভালবাসেন কিনা তার পরিচয় তাঁর বক্তৃতা ইত্যাদিতে পাই নাই। কিন্তু এ কথা ঠিক যে গরীব দুঃখীর উপকার করার দিকে যাঁর মন আছে তিনি গরীব দুঃখীর জাত বিচার ক’রে উপকার করতে চাইলে দেশের উপকার করতে সক্ষম হবেন না।
স্যার পি, সি, রায় সম্বন্ধে এখানে যে কথাটা বলতে চেয়েছি সেটা আমাদের দেশের সব নেতাদেরই সম্বন্ধে খাটে। দেশের সব নেতাই “হিন্দু-মুসলমান” ইত্যাদি কথা এতই ব্যবহার করেন যে, তাঁরা দেশের মঙ্গল চান এ কথা স্বীকার করা যায় না। এঁরা কেউ হিন্দুর মঙ্গল, কেউ মুসলমানের মঙ্গল চান। সাহিত্যে বা বক্তৃতায় হিন্দুর মঙ্গল বা মুসলমানের মঙ্গলের জন্য যখন কোনো নেতা বিশেষ আগ্রহ দেখাতে যান বা তাঁর নেতৃত্বের দাবী সপ্রমাণ করতে চান তখন যে বিদ্বেষের বহ্নি জ্ব’লে ওঠে তাতে পুড়ে মরে উভয়েই। যাঁরা দেশের প্রকৃত সেবক হতে চান তাঁদের হিন্দু-মুসলমান এ সব কথা বাদ দিয়ে কথা বলতে হবে। সম্প্রদায় বিশেষের নেতা হওয়া এক কথা আর দেশের সেবা করা অন্য কথা, এ কথা আমাদের বুঝতে শিখতে হবে। “হিন্দু” “মুসলমান” এসব কথার হয়তো নতুন ব্যাখ্যারও দরকার হতে পারে। দেশসেবার পন্থা সম্বন্ধেও গতানুগতিকতার অনুসরণ করলে চলবে না। এ সম্বন্ধে নতুন ক’রে ভাবতে হবে।
আমরা দেশসেবক অর্থে সম্প্রদায় বিশেষের নেতা বুঝি। যাঁদের নেতা হবার মতো জ্ঞান বুদ্ধি ও ক্ষমতা আছে, তাঁদের উচিত যথাসম্ভব গণ্ডী অতিক্রম করার চেষ্টা করা। স্যার পি, সি, রায়ের বহুমুখী প্রতিভার নতুন ক’রে পরিচয় দেবার কোনো প্রয়োজন নাই। বড়ই দুঃখের বিষয় যে, স্যার পি, সি, রায়ের মতো প্রতিভাবান ব্যক্তি গণ্ডী অতিক্রম করতে সক্ষম নন। এটা শুধু তাঁর একার দোষ নয়। এই দুর্ভাগা দেশের রীতিই এই। কি হিন্দু কি মুসলমান সবারই দৃষ্টি যেন কেমন ক’রে ছাঁচে ঢালা বস্তুর মতো একই রকম। এ ভাবে দেশের সেবা সম্ভবপর হবে না। আমাদের সকলেরই দৃষ্টি প্রসারিত করা দরকার।
সর্ব বিষয়ে এমন কি ধর্মের বেলায়ও ভারতবাসীর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। আধ্যাত্মিক আহার যোগানই ধর্মের প্রধান কাজ। যে যে-ভাবে পারে শুদ্ধ হয়েই হ’ক বা মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেই হ’ক যাতে তার আধ্যাত্মিক ক্ষুধা মিটবে তাই তাকে গ্রহণ করার মতো স্বাধীনতা দিতে হবে। তাতে কারো মনে ব্যথা লাগলে চলবে না। বৈচিত্র্য জগতের নিয়ম। বৈচিত্র্যকে মেনে নিতে হবে।
অবশ্য মানুষ দলবদ্ধ হয়ে থাকতে চায়। ভারতের এখন যে অবস্থা তাতে ভারতবাসী বলেই দলবদ্ধ হতে হবে। অবশ্য কতকগুলি অপেক্ষাকৃত ছোট নেতারা ছোট দলের নেতা হয়ে কাজ করবেন তাতে আপত্তি থাকবে না। কিন্তু তাঁদের ভেতর সহযোগ থাকা দরকার। সব মুসলমানকে হিন্দু করব বা সব হিন্দুকে মুসলমান করব তার পরে সব এক হবো–এক হ’য়ে তার পরে দেশোদ্ধার করবো–এই যদি প্রোগ্রাম হয় তা হলে বলতে হবে এ দুর্ভাগা দেশের কোনো কালে কিছু হবে না। সেই যে কথায় বলে, নয় মণ তেলও জুটবে না রাধাও নাচবে না।