নেতাজি

নেতাজি

আজ– এবং নেতাজি

এ পৃথিবীতে ভারতের মতো অতখানি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র আর নেই। এবং সে জন্য যে আমরা ক্যাপিটালিস্ট-কম্যুনিস্ট উভয়পক্ষেরই বিরাগভাজন হয়েছি তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। সামাজিক জীবন লক্ষ করলেই এ তত্ত্বটা পরিষ্কার হয়ে যায়। যে মানুষ দলাদলির মাঝখানে যেতে চায় না–তা সে স্বভাবে শান্তিপ্রিয় বলেই হোক, আর দুই দলের গোঁড়ামিই তার কাছে আপত্তিকর বলে মনে হয় বলেই তোক সে উভয় দলেরই গালাগালি খায়।

তাই পাঁড় কম্যুনিস্টরা আমাদের টিটকারি দিয়ে বলছে, যাও, কর গে পিরিত ক্যাপিটালিস্টদের সঙ্গে; এখন বোঝ ঠ্যালা। আর পাড় ক্যাপিটালিস্টরা বলছে ঠিক এই একই কথা। আমরা নাকি কম্যুনিস্টদের গলায় পিরিতির মালা পরাতে গিয়ে পেয়েছি লাঞ্ছনা।

পুরোপাক্কা সুস্থমস্তিষ্ক নিরপেক্ষ জন পাই কোথা যে তার মতটা জেনে নিয়ে আপন চিন্তাধারা আপন আচরণের বাছ-বিচার করি, জমা-খরচ নিই।

তবে পৃথিবীর লোক সচরাচর বলে থাকে সুইজারল্যান্ড নাকি বড় নিরপেক্ষ দেশ। আমার মনে হয়, লোকে তাকে যতটা নিরপেক্ষ মনে করে ঠিক ততটা সে নয়। তবু সবাই যখন একথা বলছেন তখন সুইসদের মধ্যে যারা সচরাচর লিবরেল উদারপ্রকৃতি-সম্পন্ন বলে গণ্য (সব সুইসই যে সমান নিরপেক্ষ একথা সত্য হতে পারে না) তাঁদের মতটা শোনা যাক।

এরা প্রথমেই বলেন, চীন যে ভারত আক্রমণ করেছে এটা তার লাওস, ভিয়েতনাম বা কোরিয়াতে লড়াইয়ের মতো নয়। এসব জায়গায় সে লড়ে ক্যুনিজম ধর্মকে কাফের ক্যাপিটালিস্ট-ইপিরিয়ালিস্টদের অযথা আক্রমণ থেকে বাঁচাবার জন্য (ভারতবর্ষ আক্রমণে সে উদ্দেশ্য থাকতে পারে না, কারণ একথা কেউ বলতে পারবে না যে ক্যুনিজম-ধর্মবিশ্বাসী কম্যুনিস্টদের আমরা নির্যাতন করে করে নিঃশেষ করে আনছিলুম, বরঞ্চ বলব ওদের প্রতি আমাদের সহিষ্ণুতা ধৈর্যের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে বলে ঘরে-বাইরে অনেকেই মন্তব্য প্রকাশ করেছেন), এস্থলে চীন ভারত আক্রমণ করেছে নিছক রাজ্যজয়ার্থে।

আমরাও বলি তাই, যদিও অন্য একাধিক কারণ থাকতে পারে।

এর পর সুইস লেখক বলেছেন, এই আক্রমণের প্রতিক্রিয়া হয়েছে কী?

১. ভারতবাসীর স্বদেশপ্রীতি ও জাতীয়-ঐক্য রুদ্র জাগ্রত রূপ ধারণ করেছে এবং

২. যে নিজুমের প্রতি এতদিন সে উদাসীন এবং সহিষ্ণু ছিল তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছে।

৩. বিশ্বজন চীনকেই আক্রমণকারী, পররাজ্য লোভী, ইপিরিয়ালিস্ট বলেই ধরে নিয়েছে, কারণ তারা নিরপেক্ষ জাতিদের মধ্যে ভারতকেই সর্বাগ্রগণ্য বলে শ্রদ্ধা করতেন ও ভারত যে তার দীনদুঃখীর ক্লেশ মোচনের জন্যই সর্বশক্তি নিয়োগ করছে সে সত্যও তারা জানতেন (অর্থাৎ চীন যেমন অস্ত্র নির্মাণে আপন শক্তির অপচয় করছিল তা না করে)।

৪. ভারতীয় কম্যুনিস্টরা পড়েছেন মহাবিপদে (আমরা গাঁইয়া ভাষায় বলি ফাটা বাঁশের মধ্যিখানে); হয় তাদের প্রাণের পুত্তলি চৈনিক অগ্রগতির সঙ্গে যোগ দিয়ে, সর্বভারতীয়ের সম্মুখে নিজেদের দেশদ্রোহী ভ্রাতৃহন্তা রূপে প্রকাশ করে, পরিশেষে রাজনৈতিক আত্মহত্যা বরণ করতে হবে, কিংবা চীনের বিপক্ষে, এমনকি শেষমেশ চীনের কনিষ্ট সম্ভই বিষ্ণুপ্রলেতারিয়ার গুলিস্তান পরীস্তান রুশ– অবশ্য সত্তাই কারণ সে ছোটভাই চীনকে সাহায্য করতে আদৌ উৎসাহ দেখাচ্ছে না– এমনকি রুশেরও বিপক্ষে দাঁড়াতে হবে।

 ৫. শ্ৰীযুক্ত ঋণফকে হয় বিশ্বজনের সম্মুখে স্বধর্মানুরাগী পীতভ্রাতা চীনের বিরুদ্ধ পক্ষের সঙ্গ নিতে হবে, কিংবা চীনের পক্ষ নিয়ে ভারত তথা এশো-আফ্রিকার নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর মৈত্রী থেকে বঞ্চিত হতে হবে।

৬. ভারতকে এখন পাশ্চাত্য রাষ্ট্রসমূহের কাছ থেকে প্রচুর এবং প্রচুরতর অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে হবে। ফলে পশ্চিমের সঙ্গে মৈত্রী বাড়বে, কমুনিস্টদের প্রতি বৈরীভাব বৃদ্ধি পাবে। ধীরে ধীরে তার নিরপেক্ষতা সম্পূর্ণ লোপ পাবে।

 পাঠক ভাববেন না, আমি সুইসের সঙ্গে একমত। আমিও ভাবছি না যে আপনি সুইসের সঙ্গে দ্বিমত। তবে একটা কথা আমরা উভয়েই মেনে নেব, নিরপেক্ষতা সর্বকালীন সর্বজনীন সার্বভৌম ধর্ম নয়। যদি সত্যই একদিন আমাদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস হয়, কোনও বিশেষ নিরীহ দেশ অকারণে বলদৃপ্ত স্বাধিকার-প্রমত্ত রাষ্ট্র কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছে তবে আমরা নিশ্চয়ই নিরপেক্ষতা বর্জন করে আক্রান্ত রাষ্ট্রের পক্ষ নেব। মিশর আক্রান্ত হলে পর কমনওয়েলথের সম্মানিত সদস্য হওয়া সত্ত্বেও আমরা মিশরের পক্ষ নিয়েছিলাম। শুধু তাই নয়, নিরপেক্ষতা রক্ষার জন্য আজ আমরা যে আফ্রিকায় ভারতীয় সৈন্য পাঠাচ্ছি, ঠিক সেইরকম আর্তনকে রক্ষার জন্য নিরপেক্ষতা বর্জন করে ঠিক সেইরকমই সৈন্য পাঠাব। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, যেখানে ধর্ম সেখানেই জয়। কিন্তু হিটলার বিশ্বাস করেন, যেখানে জয় সেখানেই ধর্ম।

কিন্তু উপরের ছয় নম্বর বক্তব্যে ফিরে গিয়ে বলি, আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস আমাদের নিরপেক্ষতা বর্জন অবশ্যম্ভাবী নয়। ক্ষণেকের প্রয়োজনে যদি-বা আমরা তৃতীয় পক্ষের সাহায্য নিতে বাধ্য হই, তার অর্থ এই নয় যে, আমরা চিরকালই তৃতীয় পক্ষের কেনা গোলাম হয়ে থাকব। তার অর্থ এ-ও নয়, আমরা নেমকহারাম। এবং যাতে করে তৃতীয় পক্ষের বা বিশ্বজনের এ অন্যায় সন্দেহ না হয়, তাই সাহায্য নেবার পূর্বেই, আমাদের নীতি ও উদ্দেশ্য সর্বজনকে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে হবে।

এই দুঃখের দিনে নেতাজির কথা মনে পড়ল।

দশ-বারো বৎসর পূর্বে তার সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে বলি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মাঝামাঝি তিনজন নেতা স্বেচ্ছায় নির্বাসন বরণ করে দেশোদ্ধারের জন্য মার্কিন ইংরেজের শত্রুপক্ষকে সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিলেন। এদের মধ্যে প্রথম জেরুজালেমের গ্র্যান্ড মুফতি এবং দ্বিতীয় ইরাকের আবদুর রশিদ। এদের দুজনাই আপন দেশের একচ্ছত্র নেতা ছিলেন। তৃতীয় ব্যক্তি আমাদের নেতাজি। তিনি ভারতের সর্বপ্রধান নেতা ছিলেন না।

তিনজনই কপর্দকহীন, তিনজনই সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন আপন আপন যশ ও চরিত্রবল। প্রথম দুজনার স্বজাতি ছিল উত্তর আফ্রিকায়, অথচ শেষ পর্যন্ত দেখা গেল এদের কেউই কোনও সৈন্যবাহিনী গঠন করে তুনিসিয়া আলজারিয়ায় লড়তে পারলেন না; শুধু তাই নয়, জর্মন রমেল যখন উত্তর আফ্রিকায় বিজয় অভিযানে বেরুলেন তখন এদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাবারও প্রয়োজন অনুভব করলেন না। এদের কেউই জর্মন সরকারকে আপন ব্যক্তিত্ব দিয়ে অভিভূত করতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত তাদের গতি হল আর পাঁচজনের মতো ইতালি থেকে বেতারে আরবিতে বক্তৃতা দিয়ে প্রোপাগান্ডা করার।

অথচ, পশ্য, পশ্য সুভাষচন্দ্র কী অলৌকিক কর্ম সমাধান করলেন। স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মাণ করে, ইংরেজের গর্ব ভারতীয় সৈন্যদের এক করে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে তিনি ভারতবর্ষ আক্রমণ করলেন। বর্মা-মালয়ের হাজার হাজার ভারতীয় সর্বস্ব তার হাতে তুলে দিল, স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণ দেবার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে গেল!

আমরা জানি, জাপান চেয়েছিল, সুভাষচন্দ্র ও তার সৈন্যগণ যেন জাপানি ঝাণ্ডার নিচে দাঁড়িয়ে লড়েন (মুফতি এবং আবদুর রশিদ জর্মনিকে সে সুযোগ দিতে বাধ্য করাতে পারেননি)। ভাষচন্দ্র কবুল জবাব দিয়ে বলেছিলেন, আমি আজাদ হিন্দ ও তার ফৌজের নেতা। আমার রাষ্ট্র নির্বাসনে বটে, কিন্তু সে রাষ্ট্র স্বাধীন এবং সার্বভৌম। যদি চাও তবে সে রাষ্ট্রকে স্বীকার করার গৌরব তোমরা অর্জন করতে পার। যদি ইচ্ছা হয় তবে অস্ত্রশস্ত্র এবং অর্থ দিতে পার– এক স্বাধীন রাষ্ট্র যেরকম অন্য স্বাধীন রাষ্ট্রকে মিত্রভাবে ধার দেয়, কিন্তু আমি কোনও ভিক্ষা চাই না এবং আমার সৈন্যগণ আজাদ হিন্দ ভিন্ন অন্য কোনও রাষ্ট্রের বশ্যতা স্বীকার করে যুদ্ধ করবে না।

আজ আমরা স্বাধীন। পৃথিবীতে আমাদের গৌরব আজ অনেক বেশি। নেতাজি বিনাশর্তে সেদিন যে শক্তি সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন, আজ কি আমরা তা পারব না? না পারলে বুঝতে হবে আমাদের রাজনীতি দেউলিয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *